কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্ত
মন্দার মুখোপাধ্যায়
বড় হয়ে ওঠার প্রথম ধাপই ছিল, চেনা বৃত্ত কেটে ছেঁটে বার বার বেরিয়ে যাওয়া। আর ছিল নিজেকে ছাপিয়ে বৃহত্তর সব বৃত্তের খোঁজ। মঞ্জুষদার সঙ্গে পরিচিত হয়ে, কাছে এসে দেখলাম এক অন্য ম্যাজিক। বিরাট মাপের এক কম্পাস, একটি বিন্দুতে ঠেকিয়ে তিনি যে এক মস্ত গোল আঁকছেন, তার নাম ‘অন্তর্বৃত্ত’। পরিধি এবং বৃত্ত নিয়ে এই আয়োজনটাই আমাকে চমকে দিয়েছিল। চাঁদ পাওয়ার মতো মনে হয়েছিল, হাতে পেলাম নিজস্ব এক আড্ডাঘর। ঠিক যেমন বাড়ি, ইশকুল, কলেজ আর পাড়ায় - এ বাড়ি, ও বাড়িতে ঘটত। দূর দূরান্ত থেকেই নয়, গ্রাম গ্রামান্তর থেকেও এসে জড়ো হতেন কবি প্রকাশক, সম্পাদক এবং আবৃত্তিকারেরা। আবার এও ঠিক যে অনেকেই আসতেন না। অনেক মানুষের হয়ে মঞ্জুষদাই যে পৌঁছে যেতেন সর্বত্র, সেটাই যেন বহু মানুষের বিশিষ্টতায় পৌঁছে যাওয়া। এই যে ‘অন্তর্বৃত্ত’ – এর মানেই তো তাই - সম্পূর্ণ এবং সচেতন এক স্বজন বৃত্ত। সকলের জন্য যেমন বরাদ্দ এক কাপ চা, তেমন প্রাণভরা উৎসাহ। সঙ্গে উতরোল আলোচনা, সমালোচনা এবং শাসন। পত্রপত্রিকার হদিশ তো পেতামই পাতিরামের স্টলে এবং আরও কোথাও কোথাও, কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের সেই সব সম্পাদক, প্রকাশক এবং অজস্র উৎসাহী কবি ও গদ্যকারকে সামনা সামনি দেখা, পরিচিত হওয়া – সে এক অন্য আনন্দ। বয়স্ক এবং তরুণ সকলের জন্যেই তাঁর হৃদয় শুধু অবারিতই ছিল না, মনও ছিল উন্মুখ। না হলে কি করে খুঁজে বার করে, টেনে আনলেন আমাকে! সকলের সঙ্গে মিশে যেমন আড্ডায় মিলিয়ে দিতেন সবাইকে, তেমনই একান্তে খোঁজ নিতেন প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ এবং অসুবিধের। এই নৈকট্যের নামই ছিল ‘অন্তর্বৃত্ত’। কেউ যেমন তাঁর চোখ এড়িয়ে যেত না, তেমনই অন্যেরাও এড়িয়ে যেত না তাঁকে। তিনি যে কোনও কিছু পাইয়ে দিতে পারতেন বা পাঠিয়ে দিতে পারতেন দেশ বিদেশে উপার্জন বা অর্জন কুড়োতে, তা তো একেবারেই নয়, কিন্তু কাছে টানতে পারতেন একেবারে আপনার জনটি হয়ে। অহঙ্কার, ঈর্ষা, অযথা আক্রমণ এসব যেন পাশে রাখা ব্যাগের মতো নিচে পড়ে থাকতো। কারণ সবের ওপরে ছিল তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত আন্তরিক ব্যবহার এবং শুভকামনা। আসলে তাঁর আত্মসম্মান বোধটি এতো প্রখর ছিল বলেই বোধহয়, অন্যকেও সম্মানীয় মনে করতে দ্বিধা করতেন না। তিনি জানতেন অন্তর এবং বৃত্ত এই দু’টি শব্দের প্রকৃত অর্থ কি! যুক্তাক্ষরে তাই অনায়াসে মিলিয়ে দিয়েছিলেন এক ভিন্ন চেতনার সংস্কৃতি।
আর মজা হল যে এ সবই ঘটছে কিন্তু পোদ্দার কোর্টে, একটি সরকারি অফিসের অন্দরে। যে কোনও সরকারি অফিসের মতো টেবিল এবং অপরিচ্ছন্ন করিডর পার হতে হতে, দোতলায় উঠে, দরজা ঠেলে ঢুকলেই চমক! অলিগলি পেরিয়ে হঠাৎ সমুদ্র দেখতে পাওয়ার বিহ্বলতা। হতে পারে তিনি বড় আধিকারিক, কিন্তু খান কুড়ি চেয়ার টেনে টেবিলের পাশে তিন চার সারে সাজিয়ে সন্ধ্যে অবধি দল জুটিয়ে আড্ডা! অফিস আওয়ার্স থেকে এতখানি সময় বার করা মানে, আগে এসে কি দ্রুততায় নির্দিষ্ট কাজগুলি সেরে ফেলতে হতো তাঁকে! প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়া সেই মেধার ছাপ থাকতো পাশের ঘরটিতে, যেখানে টেবিল জোড়া ফাইল আর কেজো সময়ের ছাপ। একটা পার্টিশন দিয়ে যে ভাগ - তার এদিকটায় ছবির প্রিন্ট বইয়ের প্রচ্ছদ ও আরও নানা টুকিটাকি সেঁটে সাজানো। কামরাটাও শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত নয়। মস্ত এক পাখা, লম্বা লাঠি সমেত সিলিং থেকে ঝুলছে। একটা বোধহয় আধা খোলা জানলা আর দিনের বেলাতেও জ্বলা একটি ম্লান নিয়ন। তবু কি উজ্জ্বল সেই ঘরটি! আর সব সময় তা যেন প্রাণের বাতাসে ভেসে আছে, আনাচ কানাচ সমেত।
মারক ব্যাধিতে চলে গেলেন মঞ্জুষদা। উঠে গেল ‘অন্তর্বৃত্ত’ নামে সেই আদরের ঠেক। এতে তো মানুষ ঠিক নিরাশ্রয় হয় না, তবে কেমন ফাঁকা ফাঁকা এবং বোকা বোকা লাগে সব কিছু। ভীষণ ভাবে কম পড়ে যেতে থাকে অনেক কিছু। টান পড়তে থাকে মায়া, মমতা আর অনাবিল বন্ধুত্বে। ভাগ্যিস ওই একটা কথাই বলে গিয়েছিলেন ! রোজ তাই অন্তত একবার হলেও সাদা পাতার সামনে ‘ঝুঁকে বসি’ মঞ্জুষদা। ঝুঁকে বসেই তো কবিতার সঙ্গে আমৃত্যু কথা বলে গেলেন আপনি!
‘নিঃশর্ত প্রেমের মতো এতো খোলা প্রান্তর দেখিনি’
পল্লববরন পাল
রাত পৌনে একটা। টেলিফোন। পড়িমরি একতলা থেকে দৌড়োলাম ওপরে – বয়স হয়েছে বাবা-মায়ের, যেন ঘুম না ভাঙে – এতো রাতে! কে? খারাপ চিন্তার ছোটোবড়ো জিজ্ঞাসা চিহ্নের মিছিল বাধ্য ছাত্রের মতো আমার পিছু। সিঁড়ির ধাপ টপকে লাফাতে লাফাতে পৌঁছে গেলাম খাবার টেবিলের পাশে দেরাজের ওপর রাখা রিসিভার প্রান্তে। আমার গলায় আশঙ্কাকম্পিত সুর – হ্যালো...
ও প্রান্ত থেকে এক ঐশ্বরিক সুরবাহারের স্নেহ-সুর গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে আছড়ে পড়লো, যেন সকাল সাতটা চল্লিশের আকাশবাণীতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত, যেন পাহাড়ি ঝর্ণার প্রথম উশুম-উশুম শান্তিজল এইমাত্র নিঃশর্ত লাফ দিলো ওপর থেকে আমার মাথার ওপর, যেন বিশাল এক সামুদ্রিক জলের দেয়াল সৈকতবালির ওপর এইমাত্র আছড়ে পড়ে ছড়িয়ে দিলো একরাশ সম্ভ্রান্ত পবিত্র জুঁই ফুলের মালা –
-পল্লব...?
প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। এখনও ঐ প্রত্যেকটা গুঁড়ো সুর আলাদা আলাদা করে গেয়ে উঠতে পারি – এতটাই চেনা ও প্রিয় আত্মীয়। অত রাতে তাঁর ফোনের উদ্দেশ্য বুঝলাম পরের বাক্যে। আসলে সেদিনই বিকেলে তাঁর পোদ্দার কোর্টের মজলিশ শেষে চুপিচুপি আমারই সম্পাদিত ‘তিন নম্বর চোখ’ পত্রিকার মোটাসোটা উৎসব সংখ্যার এককপি গুঁজে দিয়েছিলাম ওঁর হাতে – মধ্যে আমার লেখা প্রথম গদ্য উপন্যাস – ইতি সিদ্ধার্থ। ‘পড়ে জানাবেন?’ আমার কাঁধে আলতো হাত ছুঁয়ে বলেছিলেন – ‘নিশ্চয়ই’। রাতখাবারের পর বসে এইমাত্র রুদ্ধশ্বাস পড়ে শেষ করেছেন, এবং...
হ্যাঁ, এই হলেন মঞ্জুষ দাশগুপ্ত। বাঙলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। অর্থনীতির কৃতি ছাত্র এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নগরোন্নয়ণ পরিকল্পনা দপ্তরের উচ্চ পদের অফিসার। আমাদের মঞ্জুষদা। অত বড়ো মাপের একজন কবি, বাঙলা সাহিত্যের সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক সম্মান স্বীকৃতি ও নিবিড় যোগাযোগ সত্ত্বেও, সমস্ত বাণিজ্যিক পত্রিকার আবশ্যিক নিয়মিত লেখক হয়েও যিনি আগাপাশতলা লিটল ম্যাগাজিনের কবি – এমন কতজনই তো ওঁকে রোজ স্বরচিত বই উপহার দিয়ে ধন্য হয় – তাই বলে সেটা সেই রাত্রেই পড়ে ফেলা এবং তারপরে এই গভীর রাত্রে ফোন! আমার মতো এক অপাংক্তেয় অর্বাচীনকেও তাঁর বুকে এত গুরুত্ব দিয়ে অযাচিত জায়গা দেবেন... আমার কাছে অভাবিত!
সেই রাতে নিঃশব্দে রিসিভার কানে লাগিয়ে তাঁর পাঠপ্রতিক্রিয়ার তন্ময় উষ্ণ উচ্ছ্বাসে আমার শরীরের হাড়-মাংস-গ্রন্থি-জ্ঞান-বোধ-সংবিৎ একে একে গলতে গলতে মেঝের ওপর অনুভূমিক টলটলে মহাদেশ মানচিত্রে পরিণত হতে সময় নিলো পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। রিসিভার ছেড়ে দেখি, ঘেমে নেয়ে গেছি, আর আমার মাথার পিছনে যেন এক জ্যোতির্বৃত্ত বাঁইবাঁই ঘুরছে – বুঝলাম, তাঁর অন্তর্বৃত্তে আমার নাগরিকত্ব পাকা হলো।
তাঁর কোনো দায় ছিলো না - কোনো গণিত ছিলো না আমাদের সম্পর্কে - কারণ হিমালয়ের সঙ্গে পথপার্শ্বের একটা সামান্য প্রস্তরখণ্ডের পারস্পরিক কোনো সম্পর্ক হওয়ারই কথা নয়, গণিত তো দূর-অস্ত্। তার ওপর সম্পর্ক নির্মাণেও তো নিদেন সময় লাগে – তখন অবধি কতোবারই বা গেছি শুক্রবারের সাপ্তাহিক পোদ্দারকোর্টের তিনতলায় বিকেল তিনটের অন্তর্বৃত্ত-আড্ডায় – ক্লাশের সবচেয়ে পিছনের বেঞ্চের উচ্ছিষ্টে এলেবেলে ছাত্রের মতো ঘাপটি মেরে পিট্পিট্ করে সামনের আলোকিত বৃত্তের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে বসে থেকেছি।
‘উইলো গাছেরা উঁচু হয়ে মাপে পাহাড়ী দীর্ঘতাকে –
তুমি কি তেমনি বড়ো?
আমি এইখানে হাড়গোড় ভাঙা সংকোচে জড়োসড়ো’ ...
আমার বাড়ি ও নিজস্ব স্থপতি-অফিস তখন হাওড়া শিবপুরে। তৎসহ ‘তিন নম্বর চোখ’-নামের ক্ষীণদেহী এক ফর্মা অফসেটে ছাপা সুন্দরী মাসিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে উন্মাদ পরকীয়া প্রেম। সেই সূত্রেই কবিতা ভিক্ষায় একদিন দুরুদুরু স্পর্ধিত বুকে পোদ্দারকোর্টের তিনতলা। ব্যাস, উজ্জল স্নেহহাসি এবং সিঙাড়া-চায়ে গরম আপ্যায়ন – ভীষণ ছোঁয়াচে আন্তরিক খোলামেলা গভীর সাহিত্য আড্ডামগ্নতা – ঝটপট আলাপ ও আত্মীয়তা হয়ে গেলো টগবগে আমার সমবয়সী নামী কবিদের সাথেও – চিত্তরঞ্জন, ধীমান, নাসের, রামকিশোর, অরুণাংশু সহ মঞ্জুষদার কাছ-বয়সি অনেক স্বনামধন্য কবিদের সাথেও। চাঁদের হাট।
সেই থেকে কর্মসূত্রে বা অন্য কোনো কাজে নদী পেরোলেই অমোঘ টান পোদ্দার কোর্টের, আমার কাছে তখন কলকাতার আরেক নাম পোদ্দার কোর্ট। অন্তর্বৃত্তের মধ্যে ঢুকে দেখলাম, রোজ রোজ সে বৃত্তের ব্যাস সোনার দামের মতো বেড়েই চলেছে, কারণ মঞ্জুষদার সম্ভবত কোনো পৃথক বহির্বৃত্ত ছিলো না, তাঁর বুকের মধ্যে ছিলো আস্ত পৃথিবীর মানচিত্র – তার বাইরে মহাশূন্য।
একটা গোটা প্রজন্মের পরমপিতা ছিলেন তিনি। আশ্রয়স্থল। আমি খুব দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, অসংখ্য তরুন কবি কবিতা নির্মাণ ধ্যানে বসতেন চোখ বুঁজে মঞ্জুষদাকে নৈবেদ্য সাজিয়ে – প্রতিটি শব্দ নির্বাচনে তাঁর আশকারা আর স্নেহের স্পর্শের অনুমোদন চাইতো নিঃশব্দে – ঐ সময়ে তো বটেই, এখনও তাঁর তিরোধানের এতোদিন পরেও অনেক কবিকে দেখি – যারা মঞ্জুষদাকে ঈশ্বর জ্ঞানে আজো মগ্ন সন্ন্যাসী। আমি এক শুক্রবার দুপুরবেলায় আমার অফিসে বসে ফোন তুলে তাঁকে সদ্যসদ্য লেখা একটি কবিতা শোনাই। ছোট্ট কবিতা। ‘নদী বললো – যদি ভ্রমণ হও/ তবেই হবো তোমার সহচরী/ আমি বললাম – রমণী যদি হও/ তোমার সঙ্গে কালাতিপাত করি।’ বিকেলে যথারীতি অন্তর্বৃত্ত আড্ডার মধ্যে হঠাৎ পাশে ডেকে নিয়ে ফিসফিসে বললেন – ‘ভ্রমণ’ নয়, ওটা ‘পর্যটন’ করে দাও। বড়ো সুন্দর স্পষ্ট উচ্চারণ করতেন মঞ্জুষদা। আমার ঐ কথার সূত্র খুঁজতে একটু সময় লেগেছিলো। এতোটাই উজাড় উপযাচিত অভিভাবকত্বের অকুন্ঠ উপদেশে আগলে রাখতেন আমার মতো পিছনের বেঞ্চের এলেবেলে ছাত্রকেও। ঘটনাটা সম্ভবত ২০০০ বা ২০০১ সালের কথা। আমারও বয়স তখন কুড়ি বছর কম। সত্যি বলছি, তাঁর এই আদেশ বা অনুরোধ আমি রক্ষা করতে পারিনি – হয়তো খারাপ ছাত্র বলেই। আমি ‘ভ্রমণ’ শব্দটা বদলাইনি। কুড়ি বছর পরে, এখন বুঝি ‘ভ্রমণ’ আর ‘পর্যটন’ শব্দ দুটির চরিত্রগত তফাত। এখন আফশোষ ছাড়া গতি নেই।
নতুন শতক শুরুর আগে আগে একদিন বিকেলে ট্যাক্সির মধ্যে কথায় কথায় শোনালেন কয়েকটা এক পংক্তির কবিতা। ‘পর্যটন যতটাই ঘরে থাকা ততটাই একান্ত জরুরি’ ‘কারো কারো কাছে অপেক্ষা মানে জানালা’ ‘পাথরের বুকের ওপর নারী ও জ্যোৎস্না এসে পড়ে’ ‘পৃথিবীর ভেজা গল্প গ্রীষ্মে মেঘ জমিয়ে রেখেছে’ ইত্যাদি - আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। বললাম – আমি স্কেচ করবো মঞ্জুষদা। আমার দিকে চেয়ে আদেশ করলেন – এই বইটা স্থপতি পল্লব তার ইচ্ছেমতো ডিজাইন করুক – পূর্ণ স্বাধীনতা দিলাম।
যেন সম্রাট শাহজাহান তাজমহলের নকশা বানাতে বলছেন!
বইটির উৎসর্গ পৃষ্ঠায় উনি আমার নাম লিখে পাঠিয়েছিলেন – এ আমার অহঙ্কার! আমার গৌরব!
বাঙলা আকাদেমির উঠোনে কাচ-স্বচ্ছ ঘরে শুয়েছিলেন মঞ্জুষদা – কারুর চোখে রূপকথার মতো, কেউ ভাবছিলো ‘তোমার জন্য জীবন নিলাম/ করেছি বলেই/ শুধু শূন্যতা বিনিময়ে দাও…/ হাত পেতে আছি দাও’ - আমার সেদিন মনে হয়েছিলো পিতামহ ভীষ্ম যেন শরশয্যায় শায়িত –উনি শুয়ে শুয়ে যেন দেখছেন চারপাশে কে কীভাবে অনুবাদ করছে এই শোকশব্দের পদাবলী। তাঁর প্রিয় অনূজদের থিকথিকে ভীড় – বহু চোখে সত্যিকার স্বজনহারানো বিষাদ, কেউ সোচ্চার কেউ বা নিভৃত নির্জন, কেউ কেউ মুখোশ খুলে শোকসাজে এসে দাঁড়িয়েছে, নামী কুমীরেরা তাঁদের নিজস্ব ছোটোছোটো অন্তর্বৃত্তে কান্নাকাটি করছেন - এ যেন তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যু – ফুলের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বন্ধ চোখে দেখছেন কবি মঞ্জুষ - শেষ মাঘের বিকেলে চারপাশের নিবিড় গাছেরা ঝরাচ্ছে পাতা, তারাও তো তাঁর অন্তর্বৃত্তের সদস্য, কবি মঞ্জুষের স্নেহধন্য – ‘গাছের গায়ে কখনো লিখবো না/ আমি তোমার নাম/ শব্দবিহীন রক্তপাতে গাছ/ দিতেও পারে গান্ধারীর শাপ/ সারাজীবন বাটালি ছুরি ছেনি/পাথরে কাটে/ নাম তোমার নাম/ এবং দেবে/ নিষ্প্রাণে যে প্রাণ/ এই তো অহং/ কিংবা অভিমান’
আলো কমে আসছে। শোকে সঙ্কুচিত হচ্ছে দিন। কাচঘর পিঠে শেষযাত্রার গাড়ি বাঙলা আকাদেমির গেট পেরিয়ে নন্দনকে বাঁয়ে রেখে রবীন্দ্র সদনের পাশ দিয়ে খই ছড়াতে ছড়াতে যেতে যেতে সমবেত যুযুৎসবঃ শুনতে পেলো সেই ঐশ্বরিক সুরবাহারের গুঁড়ো গুঁড়ো স্নেহ-সুর মাখা ফিসফিস কন্ঠস্বর তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্র পাঠ করছেন -
প্রথামত
আমাকে দিও না গঙ্গাজল
গঙ্গায় গিয়েছে ভেসে আমার অজস্র ভাইবোন
যদি পারো
পরিশ্রুত জল ঠোঁটে দিও
দূষনে কার্বনে গেছে অপচয়ে সারাটা জীবন
কাঠের চিতায় নয়
বৈদ্যুতিক চুল্লিতে পোড়াও
আরেকটি গাছের মৃত্যু আমার মৃত্যুর সাথে সাথে
চাইতে পারি না।
গাড়ি অদৃশ্য হয়ে যায় আচার্য জগদীশ রোডে। ঝুপ অন্ধকার নামে। একটা হাড়-কাঁপা শীত এক এক করে আলোগুলো জ্বেলে দেয় বাঙলা আকাদেমি নন্দন চত্ত্বরে। সিনেমা শো ভাঙে, ফের শুরু হয়। গাছের তলায়, ঝোপের আড়ালে, ঝিলের পাড়ে যৌবন ঘনিষ্ঠ হয়, উপচে ওঠে – ‘...উত্তরসূরির হাতে অভিজ্ঞতা রেখে যেতে হয়’ - ধূপের গন্ধ ভারি হয়ে আস্তে আস্তে মিশে যায় আমন্ত্রণের কুয়াশাআড্ডায় -
... ‘জীবন বিপুল শব্দে মৃত্যুর নীরব হিম অনুবাদ করে’ ...
------------
সীমাশব্দ থেকে অসীম অন্তরীক্ষে
অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়
শব্দ নেই, নেই নদীও, সমুদ্রও নেই...
পরিত্যক্ত সার সার নিঃসঙ্গ মন্দির
একাকিত্বের দিকে একাকিত্ব
অপলক চেয়ে আছে স্থির...
একাকিত্ব
নির্জন নয় আবার কোলাহলও নয় শুধু এক স্তব্ধতার আবহে রয়েছে এই সময়ের মানুষ, আশঙ্কা নিরুচ্চার উদ্বেগ, বিপদসীমা ছুঁয়ে রক্তের ওঠা নামা। নিসর্গের ঋতু সম্ভার দিয়ে সাজানো ভুবন রয়েছে জীবনের অপেক্ষায়। অন্যদিকে শূন্যতা প্রতি মুহূর্তে অস্তিত্বের গভীরে খেলা করছে মৃত্যুর প্রাত্যহিকতায়। অতিমারী আক্রান্ত অবসাদ ঘিরে রয়েছে মানুষের সত্তা মনন। পৃথিবীর এক গভীর অসুখে অস্তিত্ব সংকটে মানুষ। কিন্তু এক কবি যখন বলেন----
জীবন বিপুল শব্দে মৃত্যুর নীরব হিম অনুবাদ করে
আস্থা রাখি পৃথিবীর কোনো জরা মৃত্যু অসুখই স্পর্শ করতে পারে না কবিকে। গভীর মনোজগতে সুরক্ষার সৃষ্টি বলয় ঘিরে থাকে তাঁর শব্দের নির্মাণ। সময়ের প্রাসঙ্গিকতায় কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্তকে আর একবার ফিরে দেখা যেখানে তিনি শব্দ নির্মাণের মধ্যে দিয়ে অনন্ত হয়ে বাজতে থাকেন----
একটি দারুন শব্দ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণ
দূরতম অন্তরীক্ষ চকিতে দেখাবে
গোপন থাকবে না কিছু- নির্বাস প্রান্তর হবে তোমার হৃদয়।
শব্দ
ষাটের দশকের কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্ত। এই কবির সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন তাঁরা জানেন কী দারুন এক প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর কবিতাতে শব্দের চূড়ান্ত বুননে প্রকাশ পায়- মৃত্যু, জন্ম, প্রেম, প্রতিবাদ, অভিমান, নৈকট্য, মায়া, কৌতুক, অলীক, কল্পজগৎ, বাস্তব এবং পরাবাস্তব। মানুষ তার জটিল সম্পর্ক নিয়ে শব্দ নৈঃশব্দ্য- এ থাকে কবিতায়---
তবু এত সীমাশব্দ নিয়ে দিন যায়। শব্দকে অসীম করে দাও। আমি তা পারিনি।
সীমাশব্দ
এই অতৃপ্তিই সৃষ্টিশীল করে রাখে কবিকে। যে সৃষ্টি সমকালকে অতিক্রম করে চিরকালীন হয়ে থাকে মূর্ত বিমূর্ততায়। তাঁর উচ্চারণে পাই সময়ের এক অবাক চিত্র। পৃথিবীময় এখন একা থাকার তর্জনী নির্দেশ। এই একাকিত্ব আরোপিত। স্পর্শ বাঁচিয়ে সামাজিক দূরত্ব নির্দেশ যে জীবাণুরেণুকে প্রতিহত করতে, সেখানে মানুষ অজান্তেই হয়ে উঠল এক মানসিক একাকিত্বের নিষ্ঠুরতম শিকার।
তুমি কিছু বলতে চাও দেখবে কোনো প্রতিধ্বনি নেই
খামোশ পৃথিবী
সতর্ক মানুষ জানে চুপচাপ জীবনযাপন
স্বার্থপর মগ্নতার শরীরে উঠেছে উইঢিপি।
শেষছবি
এই যে সময় চিহ্ন রেখে গেল মানব সভ্যতার শরীরে --- স্বার্থপর অমানবিক হয়ে উঠল স্পর্শের বিভীষিকা, অণুসমান এক জীবাণুর কাছে পরমাণু বিস্ফোরণ বিজ্ঞান অক্ষম সময়ের সাক্ষি হয়ে দেখছে মৃত্যুর মহাকাতরতা।
সেই বিজ্ঞানচেতনার তরঙ্গ যখন তাঁর কবিতায় - 'এই তরঙ্গ যায়/অণু পরমাণু কিংবা/কোয়ার্কের ভাঙা/ তাও কিন্তু ছুঁয়ে আছে পৃথিবীর ডাঙা...'
বিজ্ঞান অথবা গান মিথ্যে কথা বলতেই পারে না
স্থাপত্য অথবা কবিতাও।
ভুল ব্যাখ্যা মানুষেরা করে।
প্রেম
অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে সময়ের এক এক কালখণ্ডে কবিতার এক এক সত্য কখন যে চিত্রকল্পে অমোঘ হয়ে ওঠে।
আদ্যন্ত এক কবির পেলবতা সূক্ষ্ম রসবোধ তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তি নিয়ে মঞ্জুষ দাশগুপ্ত। অসাধারণ মেধা, স্মৃতিশক্তি, ও বুদ্ধির ঔজ্বল্য- এ তিনি ছুঁয়ে গিয়েছেন অগুনতি নবীন প্রবীণ কবি, গায়ক, শিল্পীর হৃদয় মন, তবুও অচেনা থেকে যান তিনি এক রহস্যময়তায়।
কবি তো চির রহস্যময়। ঈশ্বরেরই মতো ভাব ও শব্দের সৃষ্টি রহস্যে নিমগ্ন থাকেন, কখনো কখনো নত হন ভালোবাসার কাছে, প্রেমের কাছে, প্রকৃতির কাছে এবং লিখে ফেলেন স্বপ্নাদ্য কবিতার লাইন---
তোমাকে ছুঁলেই খররোদে খুব বৃষ্টি হয়
সৃষ্টি হয় কবিতার অসমাপ্ত কয়েকটি চরণ
তখন আগুন নিভে মেঘপাতা ধূসর আকাশ
বিষণ্ন বাতাসে জানে সাদা হাঁস ছড়ায় পালক
ভালোবাসা লিখে যায় বৃষ্টিতে নিবিড় পরিচয়
ভালো আছো ভালোবাসা
প্রথা অনুযায়ী নয় তাঁর কবিতার ভাষা। শব্দের স্বকীয়তা কখনো মেদুর কখনো তুখোড় হয়ে স্বপ্নের দৃশ্যময়তায় কবিতা হয়ে ওঠে। 'ঐতিহ্যের অনুসরণ করতে করতে হয়তো ঐতিহ্যের বিস্তার ঘটে। ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে কোনো আন্দোলনই সার্থক হয় না।' তিনি এভাবেই বলেছিলেন ঐতিহ্যের প্রসঙ্গে। যখন তাঁর কবিতায় বাঁক বদল বা ভাষার নির্মাণ উচ্চকিত নয়, অথচ এক পরমাশ্চর্য ---
সেদিন একটিই ভাষা মানুষের। এক ধ্বনিমূলক থেকে।
এক কথাছবি।
বাবেল মিনারে আমি রেখে আসি আদিমতম ভাষা।
বাকরীতি বদলে দিতে হবে। ভাষামুদ্রা। শেষ প্রথা নাচ।
অভিবাসনের ডৌল পাল্টে নিয়ে জন্ম হল ভেদ ভালোবাসা।
শেষ ছবি
তাঁর কবিতায় পাহাড়ি নদীর গতিময়তা আছে যার গতিপথ স্বচ্ছন্দ অথচ পাথরে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ছোট ছোট ঘূর্ণি তৈরি করে এগিয়ে চলে তীব্র স্রোতে। অর্থাৎ প্রতিবাদী সমুদ্রের ঢেউয়ের প্রাবল্যের চেয়ে ঘূর্ণির সূক্ষ্ম প্রতিবাদ সেখানে থাকে---
ব্রাহ্মণ আসেনি পৃথিবীতে, এসেছে মানুষ
সবুজের রেখা নেই, তির তির কাঁপছে বাতাস
বরফের ভাপ উঠছে অনুভূতি তখনো ঘুমিয়ে
হামাগুড়ি দিতে দিতে ঢুকে পড়ছে ইগলুর ভিতরে...
ইতিহাস
মঞ্জুষ দাশগুপ্তকে রোমান্টিক কবি হিসাবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু তিনি যখন লেখেন --- 'আমি এক অচেনা ভাষালিপির জন্য/ অপেক্ষায় আছি'। সেখানে স্যুররিয়ালিজম, ক্লাসিসিজম, রোমান্টিসিজম যেন এক বিন্দুতে এসে মেশে----
এলিয়টি মাংসখণ্ড প্রিয় পাঠকের মুখে তুলে আমি এই নতুন রূপক
আমার গোপন বিশেষণ
রহস্য সূত্রের মতো রেখে যাচ্ছি সন্ধ্যার বাতাসে
যেমন পুস্পকরথে যেতে যেতে অলংকার খুলে
সীতা রাখে দিকচিহ্নগুলি
বালির উপরে থাকে পদচ্ছাপ সমুদ্র কুলে
কিছুক্ষণ সামান্য আভাসে
দিকচিহ্ন
তাঁর এই কবিতালিপি সরল না জটিল এই দ্বন্দ্বের উত্তরে তিনি বলেছিলেন --- 'সরল কবিতার দিন অস্তমিত বলেই মনে হয়, কেউ কেউ সরল কবিতা লেখেন আমিও লিখি তবুও তার আড়ালে এক রহস্যনদীর কথালিপি লেখা হয়'---
চুপচাপ। ভাঙাচোরা ঘর। অসমাপ্ত নদী। আকাশে সিঁদূর খেলা। কৃষ্ণচূড়া জানে।
একা এসে বসে থাকি। বাতাসের হারমনিয়ামে রাগাশ্রয়ী গান। ইতিহাস দ্বন্দ্ব সমাসের কথা কোনোদিন এখানেই লিখেছিল।
সময় গিয়েছে ছুটে নীল চোখ হরিণের পায়ে।
দম শেষ পুতুলের মতো চারদিক ঠান্ডা হয়ে আছে।
ভাঙাচোরা ঘর। অসমাপ্ত নদী ভিতরে ভিতরে।
ইতিহাস
অসমাপ্ত নদীর ভিতর কবির রহস্যলিপিতে ধরা থাকে যে সময়ের অসুখ, তাই নিরাময়ের ভাষালিপি হয়ে ওঠে এই সময়ের 'এক' মানুষের কাছে---
কারো নিঃসঙ্গতার উট হয়ে মরুভুমি পার করে দিতে পারি না
কে কি পারে।
এস একাকী মানুষ তোমার মুখে জন্ম দাগের মতো বিষণ্ন নৈঃশব্দ্য
দেখি। দেখি না- ঘুম রাতের কোটরে বয়স চোখ আর
বাতাসের মতো অদৃশ্য আকাঙ্ক্ষার বোবা গান...
ভিতর
অসামান্য এক আত্মকথা 'পটুয়ার বিমূর্ত শিল্প' বইটিতে মঞ্জুষ দাশগুপ্ত লিখেছেন ---- 'শব্দ দিয়ে শুধু ছবি আঁকি। সব ভাঙাচোরা অসমাপ্ত ছবি। ভাঙা বলেই কি এরা বিমূর্ত? অসমাপ্ত বলেই কি এরা আবছায়া?'
অন্ধকারে ভাষাশব্দ আলোকথা লিখে লিখে ভোর ডেকে আনে আমাদের সামান্য বাগানে
গুহালিপি
শব্দ- নৈঃশব্দ্যের মাঝে এভাবেই তিনি কবিতা বাগানে রেখে গিয়েছেন আলোছায়ার দিকচিহ্ন, যার হিরন্ময় দ্যুতিতে আগামীর পথচিহ্ন...
---------------------------------
আমার বাবা শ্রী মঞ্জুষ দাশগুপ্ত
মণীষ দাশগুপ্ত
অন্ধকার ঘরের জানালার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে এক ছায়ামূর্তি। সেই ছায়া কোথায় যেন ভেঙ্গে যাচ্ছে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে চোখ। চশমাটা টেনে নামালেন। গেঞ্জিটার হাতা দিয়ে চোখ মুছলেন যেন। এই সব মুহূর্তে কিছু বলা চলে না। আমি এবং মা দুজনই নির্বাক। আমাদের ভিতরে তখন নীরব অশ্রুপাত। কিছু আগে ডাক্তার বাবুর Lake Road এর chamber এ একটি পরিবার বসে। আত্মবিশ্বাসী কিছুটা শঙ্কিত। ডাক্তার বাবুর ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সম্মিলিত আত্মবিশ্বাস ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। Rectal tumor (মলদ্বারের টিউমার) শব্দটি যেন ভয়ঙ্কর কোন আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত লাভা। সেটা 2001 সালের September মাস। রক্ত পরীক্ষা, Biopsyর পথ ধরে Colorectal Adeno Carcinoma সেই আনন্দময় মানুষটাকে বারবার আঘাত করছিল। ঈশ্বরের এই নিষ্করুণ দয়াহীন দান কিছুতেই নিতে পারছিলাম না।
এমন তো হবার কথা ছিল না। সব ওলট পালট হয়ে গেল যেন। খুব ছোটবলায় কোনওদিন যদি সামান্যতম চোট পেতাম, বাবার জন্য অপেক্ষা করতাম সঠিক শুশ্রূষা পাওয়ার জন্য। মা বলেন এমন কি বাঁহাতের আঙুলে চোট পেলে সারাদিনের পরে বাবা এলে ভুলে গিয়ে ডান হাতের আঙুল তুলে দেখাতাম। বাবা একটু হাত বুলিয়ে দিলে শান্তি হত।
বাবা যখন বিদেশ গেলেন, তখন আমার দুই বছর বয়স। শুনেছি Airport-এ বাবা আমাকে একটাকার একটা নোট দিলে তা ছিঁড়ে ফেলে এই ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। চমকে উঠে আরো আদর করেছিলেন বাবা।
একটু বড় হতে school-এ ভর্তি হলাম। সে সব ছিল আমাকে বড় করার সংগ্রামের দিন। বাবা কখনো সখনো school-এ নিয়ে গেলে সারা রাস্তা আমাকে দিয়ে ইংরেজী সাইনবোর্ড পড়াতেন। আর অনর্গল ছড়া বলতেন। আমিও শিক্ষিত হতে না চেয়ে চুপ চাপ বাবাকে চিমটি কেটে দিতাম। এখন বুঝি চলন্ত গাড়ির জানালার বাইরে তাকালে এত শব্দ কেন বুঝতে পারি না। কারণ বুঝিয়ে দেওয়ার মত কেউ তো আর নেই। সব কিছু এখন নিজেকেই বুঝে নিতে হয়।
পরীক্ষার সময় বাবা অভয় দিতেন এটা বলে যে পাশ করলেই চলবে। নিজে কখনো school-এ দ্বিতীয় হননি। আমার অহং বোধে লাগত। চেষ্টার মাত্রা বেড়ে যেত মোটামুটি ভাল ফলাফল করার জন্য। এটা এক ধরনের অনুপ্রেরণা এবং খুবই দরকারি বলে আমার মনে হয়।
কেউ কি ভাবতে পারে B.A. পরীক্ষার হল অবধি বাবা আমাকে পৌছে দিয়েছেন কাঁধে হাত দিয়ে? Presidency College এ সীট পড়েছিল। বাবা সেই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। পুরনো কলেজে ঢুকে তাঁর চোখে মুখে একটা আনন্দের আভা দেখতে পেলাম। আমায় সব কিছু চিনিয়ে দিচ্ছিলেন। ঠাকুরদাদা তখন মেদিনীপুরে posted. বাবা অর্থনীতি নিয়ে Presidency College-এ পড়বার সুযোগ পেয়েছিলেন। ধুতি পাঞ্জাবী পরে কলেজ করতেন। এই জন্য বন্ধুমহলে কম হেনস্থা হতে হয়নি তাঁকে। কিন্তু তাঁর অৰ্থ সংস্থান ছিল না প্যান্ট শার্ট তৈরী করে পরবার। অবশ্য সহৃদয় বন্ধুর সংখ্যাই বেশি ছিল। তারাই তাঁকে আড়াল করে রাখতেন। ভালোবাসা সর্বত্র ডানা মেলে থাকে বিষণ্ণ সময়কে ঢেকে রাখবে বলে।
বাবা কৃতি ছাত্র ছিলেন নিঃসন্দেহে এবং দুবার WBCS পরীক্ষায় সফল হন। কিন্তু ঠাকুরদাদা চাননি বাবা স্টেট এক্সাইজ-এর চাকরিটা করেন। বাবা এমন কি IAS পরীক্ষার interview দিতে গিয়েছিলেন ধুতি পাঞ্জাবী পরে এবং এই একটি কারণে তাঁকে তীব্র ভর্ৎসনার সামনে পড়তে হয়। মানুষকে না বুঝে তার পোষাককে গুরুত্ব দেওয়ার এই ঔপনিবেশিক মানসিকতা আজও বেপরোয়া ভাবে বর্তমান। তবে বাবা নগরায়ণ দপ্তরের প্রচুর পরিকল্পনায় নিজস্ব ছাপ ছেড়ে গেছেন।
ফরাসী ভাষাটা তিনি খুব ভালো করে শিখেছিলেন। কারণ তিনি ফরাসী সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। অনেক কবিতার অনুবাদ তিনি করে গিয়েছিলেন যা পরবর্তীতে সমাদর পায়। TV Monde বলে যে ফরাসী চ্যানেলটা ছিল, তা খুব কাছে বসে শোনবার চেষ্টা করতেন যাতে ভাষাটা আরো ভালো করে রপ্ত হয়।
আমি একবার বাবাকে জন্মদিনে writing pad ও কলম উপহার দিয়েছিলাম। তাতে তিনি এত উল্লসিত হয়েছিলেন যা আগে কখনই দেখিনি। সেই মায়া কলম দিয়ে প্রায় সারারাত কত কিছু লিখেছিলেন। আমি চাকরি পাওয়ার পর শিলিগুড়িতে পোস্টিং পাই। বাবা আমার কাছে প্রায়শই চলে যেতেন। একবার রাত সাড়ে তিনটায় আমার মিলনপল্লীর quarter-এর দরজায় করাঘাত। আমি ধড়মড় করে উঠে দেখি বাবা দাঁড়িয়ে! বললেন, বালুরঘাটে কবিতা পাঠ অনুষ্ঠান শেষ করেই বাস-এ চেপে শিলিগুড়ি। জলপাই মোড়ে নামিয়ে দিয়েছে বাস। তারপর প্রায় দেড় কিলোমটার রাস্তা পায়ে হেঁটে মিলনপল্লী। কপাল ছুঁয়ে দেখলাম জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। নিজেই গরম জল করে স্নান করলেন। চা খেলেন। ওষুধ খেলেন। তারপর alarm set করে ঘুমোতে গেলেন। শোবার আগে বললেন কাল সকালে গাড়ী ভাড়া করবি, দার্জিলিং যাবো। আমি মৃদু স্বরে প্রতিবাদ করতে গিয়ে দেখলাম ততক্ষণে তিনি ঘুমে কাদা। তাঁর শান্ত, প্রসন্ন মুখচ্ছবি দেখে বড় মায়া হল। পরের দিন আমরা সত্যি দার্জিলিং গেলাম। Kurseong Tourist Lodge-এ চা, পকোড়া খেয়ে হঠাৎ দেখি উধাও হয়ে গেলেন। খুঁজে পেলাম পাশের একটি বাড়ীর বাগানে। সেখানে একটা ছোট্ট জমায়েত তখন। আর বাবা তাদের রবীন্দ্রনাথের কবিতা শোনাচ্ছেন। দার্জিলিং পৌঁছে ঘোরতর বিপত্তি! সবাইকে তাঁর অদ্ভুত ভুল হিন্দীতে জিজ্ঞেস করছিলেন "Rhododendron কহা ফুটতা হ্যায়।" উত্তর পাচ্ছিলেন "হুন্দাই নহ", "মালুম নেহি" এমন কি "জানি না"ও। একজন বললেন এটা তো October মাস। এখন Rhododendron ফোটে না। February মাসে এই ফুল পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় ফোটে। বিশেষ করে সিকিমে। পরের বছর বাবাকে এই ফুল দেখাতে পেরেছিলাম।
বাবাকে নিয়ে মুম্বাই উড়ে গেলাম সুচিকিৎসার জন্য। Lower Parel এ Tata Cancer Hospital. আমাদের বাসস্থান কোলাবায় বাবার কলেজ এর বন্ধু আমল সাহার বাসায়। তিনি অকৃতদার এবং ভীষণভাবে বন্ধুবৎসল। আমাদের Airport থেকে বাড়ী নিয়ে এলেন। প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই মানুষটি রোজ অফিসের পরে রূপসী আরব সাগরের পাড় ধরে তিন কিলোমিটার ছুটতেন। হাসপাতালের দীর্ঘ পথ আমরা রোজ taxiতে অতিক্রম করতাম। হাসপাতালে প্রচণ্ড ভীড়। বাবার ডাক্তার শ্রী পারুল শুক্লা বাবার কষ্ট শুনলেন মনোযোগ দিয়ে। নানা টেস্ট করতে বললেন। কারণ, উনি একটি ছোট্ট সার্জারি করবেন। অনেক দিনের চেষ্টার ফলে হাসপাতালে ভর্তি ও সার্জারি। তারপর কলকাতায় chemotherapy ও radiotherapy। এ সব নিয়েও কিন্তু বাবা অফিস বজায় রাখতেন। কারণ, অফিসে চলতো রোজ বিকেলে নির্ভেজাল সাহিত্য আড্ডা। হৃদয়ের আরাম পেতেন। দেখতাম বসতে কষ্ট হত বলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কবিতা লিখতেন। ক্যান্সার ক্রমে হাড়ে ছড়াচ্ছিল। ডান হাতটা প্রায় বিকল হয়ে গিয়েছিল। বাঁ হাত দিয়ে ডান হাত টাকে ধরে লিখে চলতেন। কি অসীম মানসিক শক্তি! হার না মানা এই প্রাণবন্ত মানুষটা একদিন চলে গেলেন। অনেক যন্ত্রনা নিয়ে, অনেক কিছু না বলে। আজও সেই ফুরিয়ে না যাওয়া কথাগুলো শুনতে চাই। জিজ্ঞাসা করতে চাই... "বাবা, তুমি কেমন আছো?" মহাশূন্যে তারাদের মাঝে হারিয়ে যায় আমার প্রশ্ন। সেই সব না শেষ করে যাওয়া কবিতার পংক্তির মত।
"অধুরা কাজের স্তূপ সাঁচির দরজার দিকে বিপন্ন তাকায়।"
------------
ভাবনার ভাঁজ খুলে
রামকিশোর ভট্টাচার্য
এখনো আচ্ছন্ন রাখে পোদ্দার কোর্ট ৷ কলম
ছবি আঁকে মুখস্থ সময়লিপির ৷ কত রঙ যে
পাল্টে যাবে খোলসের ভিতর ৷ অক্ষর খুঁটে
চলে যাওয়া পায়রাদের অনেকেই ফিরবে না
আর ৷ এখন ভাবনার ভাঁজ খুলে উড়ে যায়
পরিচিত দুপুর ছবিরা ৷ মনখারাপের দূরে -
ঝিরঝির হাওয়া, অন্ধকার অন্ধ নয় বলে
পাশ কাটিয়ে যায় কেউ ৷ দিব্যি গড়ায় রাস্তা ৷
কিভাবে পূরবীকথা বাজে ইচ্ছেদের পাশে ,
চোরাগোপ্তা ইঙ্গিতে দুগ্ধপাত্র মসিময় হয়ে ওঠে
এসবই বুঝতে শেখালো দ্য মূরের গেলাস ৷
চারপাশে
ভক্তির লালায় ভরিয়ে দেওয়া ভোররাতের আমেজ
দেখে হাসতে হাসতে উল্টে যায় চেয়ার ৷
ছয় বাই ছয় ঘরের ইতিহাস লিখে টাঙানো হয়
অজুহাতের সামনে ৷ এসময় একঘেয়ে চিত্রকল্প কাটিয়ে
বলে উঠি - মঞ্জুষদা সাদা এত গ্রন্থিময় হয়...
স্বপ্নভূমির মঞ্জুষদা, মঞ্জুষদার স্বপ্নভূমি…
কুমারেশ চক্রবর্তী
স্বপ্নভূমির বিষয়বস্তু কি হতে পারত ?
কি হতে পারেনি---
সেসব নিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য বা যুক্তিগ্রাহ্যহীন ভাবনা
মাথার মধ্যে ভিড় করেনি অযথা !
স্নেহ নিম্নগামী বলেই হয়তো বা
আপনার প্রশ্রয়ে সঞ্চিত সাহসেই লিখিয়ে নিয়েছি---
স্বপ্নভূমি…
শহরে জমে ওঠা হরেক কেচ্ছার রঙ-বেরঙের ধুলো---
ধূলিমলিন ধূসরতায় জীবনের প্রতিটা পর্যায়ে
দুঃস্বপ্ন ঢুকে এসে দাদাগিরি করে !
সেই স্বপ্নে রচিত ভূমি কিন্তু আজও
ভাষা কিংবা দিক বদলের অজুহাতে
অন্য হাতে গিয়ে ওঠেনি,
সেই স্বপ্নে রচিত জীবন ও মৃত্যু
কোনও রাজনৈতিক মধ্যপন্থায়
আমাদের ভেতরেও দূরত্ব তৈরি করেনি---
পোদ্দার কোর্টের তিন নাম্বার গেটের তেতলায়
আপনার ওই ছোট্ট অফিসে কী জীবন্ত এখনও---
স্বপ্ন ও ভূমির সখ্য !
ধীমান, চিত্ত, রামকিশোর, অরুণাংশু, তাপস, আমি
মাঝেমধ্যে কবিতার আড্ডায় ফিরি সেখানেই…
অবিনাশী স্বর
নমিতা চৌধুরী
অক্ষরের চিহ্নরূপ একটু একটু করে
পেরিয়ে যায় আকাশ সীমানা
ফেলে যাওয়া রঙিন পালকগুলি
নিজস্ব নিয়মে তুলে আনে
ছোট ছোট ঢেউকথা
চরাচর জুড়ে মুদ্রা এঁকে দেয় নোনা জল
জেগে উঠেছিল জীবনের যে একমাত্র শ্লোক
তার তন্তুতে, প্রতিটি পাতায় কাঁপে অবিনশী স্বর
খুঁজেছিল শিকড়ের ডানা
নিবিষ্ট খনন মাঝে মাঝে স্তব্ধতা ভেঙে
বড়ো কাছে এসে দাঁড়ায়
ডেকে ওঠে সহজিয়া গানে।
0 comments: