0

সম্পাদকীয়

Posted in















সম্পাদকীয় 


সম্পাদকীয় লিখছি যখন, বাইরে বৃষ্টি অবিশ্রান্ত। লকডাউন পুরোপুরি উঠবে হয়তো কিছুদিনেই। শুনলাম, সরকারী স্বাস্থ্য দপ্তরেও নাকি স্যানেটাইজারে হাত ধুয়েই ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে এখন। থার্মাল গান টেস্টিং, স্যানেটাইজার টানেল দিয়ে ভেতরে ঢোকা, সব বন্ধ। 'কেন' জিজ্ঞেস করলেই আজকাল সবাই সুপ্রীম কোর্ট দেখাচ্ছে, বলছে, 'নির্দেশ'! দুর্গা পুজোও হবে। আদালতের অনুমতি সাপেক্ষেই। হওয়াই উচিৎ হয়তো! ষাট হাজার কোটি টাকার লেনদেনের একটা ব্যবসা হয় নাকি প্রতি বছর এই সময়, বাঙলা ও বৃহত্তর বাঙলা জুড়ে। পুরোটা না হলেও, কিছু তো হবেই! এমনিতেই অর্থনীতির যা অবস্থা! কিন্তু তাহলে অতিমারী, দূরত্ববিধি, দৈনিক সংক্রমণ, দুই শতাংশের কম মৃত্যু হার, কোমরবিডিটি - এসবের কি হবে? অনেক ধোঁয়াশা! সব প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইতে নেই! 

যাক গে, আমরা সাহিত্য চর্চা করি। এ মাসে কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্ত ক্রোড়পত্র রইলো নিবিষ্ট পাঠকের জন্য - বিশেষ বিভাগ। বাকি নিয়মিত বিভাগগুলি তো রইলোই। 

সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন...

শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের ভাগ্য বিপর্যয়ের পরবর্তী ৫০ বছরে বণিক ইংরেজ ছলে-বলে-কৌশলে বাংলা তথা ভারতের শাসক হয়ে উঠলো। শাসক ইংরেজের প্রবলতর শক্তির প্রভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষা , ভাব ও সংস্কৃতি বাঙালির জীবনে ও মননে তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল। তার অনুকূল ও প্রতিকূল উভয় পরিণামই দেশ ও জাতিকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলেছিল। মধ্যযুগীয় চিন্তা-ভাবনা ও সমাজ ব্যবস্থার অচলায়তনে আবদ্ধ বাঙালির শ্লথগতি জীবনযাত্রা সহসা নবচেতনার বেগে বলীয়ান হয়ে উঠল। বাঙালি উদ্যমে ও জীবনবোধে মধ্যযুগ অতিক্রম করে নবযুগের অংশীদার হল। ১৯শতক বাঙালির নবজাগরণের মাহেন্দ্রক্ষণ। এই নবজাগরণের একটি গভীর ও ব্যাপক তাৎপর্য আছে। সেই গভীরতা ও ব্যাপকতার উৎস থেকে তৎকালীন সাহিত্য প্রচেষ্টা উৎসারিত। শুধুমাত্র একটি নবসাহিত্য রচনার উদ্যমই নবজাগরণের পরিপূর্ণ রূপ নয়। রাষ্ট্রজীবন, সমাজজীবন, ধর্ম, সংস্কৃতি, শিল্প, শিক্ষা, সভ্যতা ---এক কথায় সমগ্র জীবন সাধনার সমন্বয ও ঐক্যের মধ্যেই বিধৃত ও স্পন্দিত হয় নবজাগরণের চিৎশক্তি। এই ইতিহাস ধারার সন্ধান না করলে আমরা নবজাগরণের মর্মবাণীকে অনুভব করতে পারবোনা।
এই নবজাগরণের কালেই ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে। (বীরসিংহ তখন সম্ভবত হুগলি জেলার অন্তর্গত ছিল)। ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভগবতী দেবীর জ্যেষ্ঠ সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র অল্প বয়সেই তাঁর বাবার সঙ্গে কলকাতায় চলে এসেছিলেন শিক্ষালাভের জন্য। শাস্ত্র অধ্যয়ন করে সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ ক'রে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান পণ্ডিত হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও, ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন ইশ্বরচন্দ্র। ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ৩০ বছর বয়সে ঐ কলেজের অধ্যক্ষের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। সমাজসংস্কারক ও শিক্ষাবিদ্ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনা এবং শিশু পাঠ্যবই রচনার পাশাপাশি যে সংস্কৃত হিন্দি ও ইংরেজি থেকে বিভিন্ন গ্রন্থের অনুবাদ করেছিলেন, তার মূলে ছিল নব জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ বাঙালির জাগ্রত চিত্তের জিজ্ঞাসা। জীবন ও জগৎ-কে নুতন আলোয় দেখার আগ্রহ থেকেই অনুবাদ সাহিত্যের সূচনা হয় উনিশ শতকে।অনুবাদের মাধ্যমে শুধু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হওয়াই নয়, স্বদেশের প্রাচীন শাস্ত্র ও রসসাহিত্যের অনুধাবন ও আস্বাদনের সুযোগও বাঙালি পাঠক পেল।
উনিশ শতকের অনুবাদ ধারার অচ্ছেদ্য অংশরূপে বিদ্যাসাগরের অনুবাদ গ্রন্থ রাজিকে তালিকাবদ্ধ করলে দেখা যায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও রসশাস্ত্র উভয় বিষয়ে তাঁর দক্ষতা অতুলনীয় ----
প্রকাশ কাল গ্রন্থ নাম মূল ভাষা
১৮৪৭ --বেতাল পঞ্চবিংশতি -- হিন্দি
১৮৪৮ -- বাঙ্গালার ইতিহাস -- ইংরেজি 
১৮৪৯ -- জীবনচরিত --- ঐ
১৮৫১ -- বোধোদয় --- ঐ
১৮৫৪ -শকুন্তলা -- সংস্কৃত (কালিদাস)
১৮৫৬ -- কথামালা -- ইংরেজি
১৮৫৬-- চরিতাবলী --- ঐ
১৮৬০ -- সীতার বনবাস-- সংস্কৃত(ভবভূতি)
১৮৬০-- মহাভারতের উপক্রমণিকা --- সংস্কৃত
১৮৬৯-- ভ্রান্তিবিলাস -- ইংরেজি ( শেক্সপিয়ার ) 

এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় হ'লো - মহাকবি কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ নাটকের বিদ্যাসাগর প্রণীত গদ্যানুবাদ ।
বিদ্যাসাগরের কোন অনুবাদই হুবহু পরানুসরণ নয়,আলোচ্য শকুন্তলা নাটকের গদ্য অনুবাদ এর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সাত অঙ্কে বিন্যস্ত অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ এর গৌড়ীয় সংস্করণ ও উত্তর ভারতীয় সংস্করণ এর পাঠ অনুসরণ করে বিদ্যাসাগর মহাশয় সাতটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত গদ্য উপাখ্যান "শকুন্তলা "রচনা করেছিলেন।
মূল নাটক অনুযায়ী মহারাজ দুষ্মন্তের মৃগয়া প্রসঙ্গের উল্লেখ করেই গদ্য কাহিনী সূচনা হয়েছে । প্রতিটি চরিত্রের সংলাপ অনূদিত হয়েছে বাংলা গদ্যে । অবশ্য সংলাপ উদ্ধৃতি চিহ্নের বন্ধনে আবদ্ধ নয়। উত্তর ভারতীয় তথা দেবনাগরী সংস্করণের তুলনায় গৌড়ীয় সংস্করণে তৃতীয় অঙ্ক দীর্ঘতর। বিদ্যাসাগর মহাশয় এর গদ্যানুবাদে গৌড়ীয় সংস্করণের এই অতিরিক্ত অংশ সংযোজিত হয়েছে। যেমন মাধবীলতা য় ফুল ফুটলেই শকুন্তলা র বর আসবে এই উপাখ্যান গৌড়ীয় সংস্করণ থেকেই বিদ্যাসাগর গ্রহণ করেছেন। গদ্য কাহিনীর শেষাংশে মূল নাটকের সঙ্গে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। মূল নাটকের সপ্তম অংকে বর্ণিত হয়েছে, রাজা দুষ্মন্ত সর্ব দমনের রক্ষাকবচ স্পর্শ করলেও তা সর্পে রূপান্তরিত হল না দেখে আশ্রমের তাপসী রা শকুন্তলাকে সংবাদ দিলেন। শকুন্তলা আপন সৌভাগ্য সম্পর্কে আশান্বিত না হয়েই অকুস্থলে এসে স্বামী দুষ্মন্তের দেখা পেলেন। অথচ বিদ্যাসাগরের অনুবাদের সপ্তম পরিচ্ছেদ এর শেষাংশে মূল নাটকে বর্ণিত মারীচ আশ্রমের অন্যান্য ঘটনা উল্লেখিত হলেও অপরাজিতা কবচের প্রসঙ্গ বর্জিত হয়েছে । বিদ্যাসাগর বর্ণনা করেছেন, বহুক্ষণ অদর্শনের ফলে উৎকণ্ঠিতা শকুন্তলা পুত্রকে অন্বেষণ করতে করতে হঠাৎ দুষ্মন্তের দেখা পেয়েছিলেন।
প্রয়োজন বুঝে মূল বক্তব্য থেকে বিচ্যুত না হয়েও সংলাপের বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন বিদ্যাসাগর। যেমন ,
মূল নাটকের তৃতীয় অংকের শেষাংশে কণ্ব মুনির ভগিনী গৌতমী বিরহ কাতর শকুন্তলাকে অসুস্থ মনে ক'রে তার কুশল কামনা করছেন , এই প্রসঙ্গটি বিদ্যাসাগর অসামান্য দক্ষতায় চিত্রিত করেছেন ।
মূল নাটকের সংলাপ এর বঙ্গার্থ এইরকম :
"( জলে র পাত্র নিয়ে গৌতমীর প্রবেশ, সঙ্গে দুই সখী)
গৌতমী: বৎসে , তোমার শরীরের তাপ কিছু কমেছে কি?
শকুন্তলা : আজ একটু ভালো মনে হচ্ছে।
গৌতমী : এই কুশোদকে তোমার সব অসুখের শান্তি হবে।বৎসে,দিন শেষ হয়ে এসেছে। চল, আমরা কুটীরে ফিরে যাই।"


বিদ্যাসাগর কৃত গদ্য অনুবাদ :

"কিয়ৎক্ষণ পরেই শান্তি জলপূর্ণ কমণ্ডলু হস্তে লইয়া গৌতমী লতা মণ্ডপে প্রবেশ করিলেন এবং শকুন্তলার শরীরে হস্ত প্রদান করিয়া কহিলেন, বাছা! শুনিলাম আজ তোমার বড় অসুখ হয়েছিল, এখন কেমন আছ, কিছু উপশম হয়েছে? শকুন্তলা কহিলেন, হাঁ পিসি! আজ বড় অসুখ হয়েছিল, এখন অনেক ভালো আছি। তখন গৌতমী কমণ্ডলু হইতে শান্তিজল লইয়া, শকুন্তলার সর্ব্ব শরীরে সেচন করিয়া কহিলেন, বাছা! সুস্থ শরীরে চিরজীবিনী হয়ে থাক। অনন্তর, লতা মণ্ডপে, অনসূয়া অথবা প্রিয়ংবদা, কাহাকেও সন্নিহিত না দেখিয়া, কহিলেন, এই অসুখ তুমি একলা আছ, কেউ কাছে নাই। শকুন্তলা কহিলেন, না পিসি! আমি একলা ছিলাম না অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা বরাবর আমার নিকটে ছিল,এইমাত্র, মালিনীতে জল আনিতে গেল। তখন গৌতমী কহিলেন, বাছা! আর রোদ নাই! অপরাহ্ন হয়েছে, এস কুটীরে যাই।"
গার্হস্থ্য জীবন রসসিক্ত এই কথোপকথন যথেষ্ট বাস্তবানুগ মনে হয়েছে বাঙালি পাঠকের কাছে। অনুবাদকের পর্যবেক্ষণশক্তি ও জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতার পরিচয় মেলে অনুবাদ এর বিভিন্ন অংশে, উদ্ধৃতাংশটি তার অন্যতম দৃষ্টান্ত।
আলোচ্য অংশে আর একটি সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটিয়েছেন অনুবাদক। মূল শ্লোকে গৌতমী বলেছেন, দিন শেষ হয়ে এসেছে, সন্ধ্যা আসন্ন, তাই তিনি শকুন্তলাকে একাকিনী না রেখে কুটিরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন। বিদ্যাসাগরের অনুবাদে গৌতমী বলছেন, আর রোদ নেই তাই এখন কুটিরে ফিরে গেলে শকুন্তলার আর কোন কষ্ট হবে না।
নাট্যগুণ বজায় রেখে এমন সুন্দর সরল অনুবাদ সৃষ্টি করা যে সম্ভব তা বিদ্যাসাগর প্রমাণ করে গেছেন। বাংলা ভাষা শৈলীকে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন বিদ্যাসাগর এই অনুবাদের মাধ্যমে। বাংলা গদ্যের যথার্থ পদবিন্যাস রীতির তিনিই নির্মাতা। সংস্কৃত পদান্বয় পদ্ধতির অনুসারী এক বিচিত্র পদবিন্যাস বাংলা গদ্যের বিকাশকে ব্যাহত করছিল, বিদ্যাসাগরের প্রতিভা স্পর্শে বাংলা গদ্য তার নিজস্ব গতিপথের পথের সন্ধান পেল। 
১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে স্যার উইলিয়াম জোন্স অভিজ্ঞান শকুন্তলম এর ইংরেজি অনুবাদ করেন, শিরোনাম, "The Fatal Ring"।‌ এই ইংরেজি গদ্যানুবাদের জার্মান অনুবাদ পড়ে মহাকবি গ্যেটে ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দে মন্তব্য করেছিলেন,
" Willst du den Himmel ,die Erde ,mit einem,Namen begriefen,/ Nenn'ich Sakontala dich , und so ist alles gesagt"
"একটি নামে যদি স্বর্গ আর মর্ত্যকে মেশাতে চান তাহলে , শকুন্তলা আমি তোমারই ,নাম করছি আর তাহলেই সব কথা বলা হয়ে যায়।"
এক ই ভাবনার প্রতিধ্বনি শোনা যায় ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনায়---
১৮৫৩খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে 'সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব ' গ্রন্থে কালিদাসের নাটক আলোচনা প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন," কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তল অপূর্ব্ব পদার্থ।.....মনুষ্যের ক্ষমতায় ইহা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট রচনা সম্ভবিতে পারে না ।...
যদি শতবার পাঠ কর ,শত বার ই অপূর্ব্ব বোধ হইবে।"

সংস্কৃত অনভিজ্ঞ অথচ রসজ্ঞ পাঠকদের সামনে অভিজ্ঞান শকুন্তলম নাটকের অনাস্বাদিতপূর্ব রসের আধারকে উপস্থিত করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।


ড.পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
যোগমায়াদেবী কলেজ

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ধীমান চক্রবর্তী

Posted in


তারপর আমরা হাঁটতে শুরু করেছিলাম। পোদ্দার কোর্ট থেকে কলেজস্ট্রীটের দিকে। মঞ্জুষ দাশগুপ্তর সাথে মাঝে মধ্যেই। কেউ না কেউ তাঁর সাথে থাকতই। কুমারেশ চক্রবর্তী, চিত্তরঞ্জন হীরা, রামকিশোর ভট্টাচার্য, আমি এবং আরও কেউ কেউ। বিশেষত শুক্রবার পোদ্দার কোর্টে মঞ্জুষদার অফিসের সেই বিখ্যাত আড্ডার পর একটু হেঁটে যাওয়া। মঞ্জুষদার মতো অত বড় মাপের মানুষের সঙ্গে হেঁটে যাওয়ার একটা আলাদা আনন্দ ছিল।

‘আরেকটি দিন শেষ হল। কথা তুলে রাখা বারান্দায় সন্ধ্যাচিক নেমে এলো। পর্যটন প্রিয় নক্ষত্রকে স্থির দেখি।’

‘একসাদা ভূতকাপড়ের মতো আবছা চাঁদ। ভাঙাসেতুর উপর উড়তে থাকে।’

বললাম বটে অত বড়মাপের মানুষ – কিন্তু তাঁর আচার আচরণে কোনোদিন তা প্রকাশ হতে দেননি। মাঝে মাঝে তো আমাদের সাথে শিশুর মতো মিশতেন। বড় মাপের মানুষদের যা চরিত্র আর কি! পা থেকে মাথা পর্যন্ত একজন ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায়, তাই ছিলেন মঞ্জুষদা। তাঁর স্নেহ, বন্ধুত্ব ও ইতিবাচক চিন্তাভাবনা আমাদের মধ্যে চারিয়ে যেতো এবং প্রাণবন্ত করে তুলতো। এতো বড় মাপের দিলখোলা হৃদয়বান মানুষের সাথে আমি অন্তত খুব কমই মিশেছি। তাঁর সঙ্গে গভীরভাবে মিশলে যে কোনও মানুষই এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেন।

‘তোমার মুসাফির গন্ধ ঘুরে বেড়ায়। মৃদুচুড়ি বিলম্বিত লয়ে রিণরিণ। কে তোমাকে বেশি খায়। নিঃশব্দ অন্ধকার নাকি আমি!’

‘তুমি একটি না-মানুষপাথর। এখন। সে ঘুমোয়। কাদাপাথর। প্রিয়কে কথা বলার এইতো সময়। ছুঁড়ে দাও নিজেকে। পাথরের গায়ে। পাথরের লাগে না। শব্দ হয়।’

মঞ্জুষদার সঙ্গে এইসব যাতায়াতের পথে খরচ বলতে প্রায় কিছুই হতো না। উনিই প্রায় সব খরচ করতেন, কেউ দিতে গেলে তাকে স্নেহভরে ধমকে দিতেন। কদাচিৎ আমরা খরচ করার সুযোগ পেতাম। কোনো কোনো দিন দামুরস্‌-এ যাওয়া হতো। মঞ্জুষদার প্রিয় জায়গা ছিল। তবে মদ আর সিগারেটের খরচ প্রত্যেকের নিজস্ব। এ তো কলকাতার মধ্যে। কলকাতার বাইরেও অঁর সাথে একাধিকবার বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ গেছি। গেছি পার্বতীনাথ দে-র আহ্বানে চন্দ্রকোণায়। অচিন্ত্য নন্দীর ডাকে গেছি মেদিনীপুর, তো কবিতা পাক্ষিকের অনুষ্ঠানে দুর্গাপুর। সে সব স্মৃতি আজও অমলিন। ওঁর মতো স্নিগ্ধ অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সাথে সময় কাটানো এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা ছিল।

‘মেঘ জানে না। কোথায় যে যেতে হয়! কেন যাওয়া! মানুষও জানে না। তবু যায়। যেতে থাকে। গাছ জানে কোথাও যাবার নেই।’

‘পেরেক ঠোকার শব্দ। মেধাকোষে। বারেবারে ছিটকে আসে। একসময় ঠিক ভোর হয়। বৃষ্টি থামে। পালিশ লাগানো সবুজের মধ্যে। তোমাকে উপুড় করে রাখি।’

‘একটি অণুগল্পের শেষে আরো একটি অন্ধকার দিন আসে। টাইরেসিয়াস জানে। আলো শুধু মিথ্যে কথা বলে।’

শুক্রবার ছাড়াও কোনো কোনো দিন পোদ্দার কোর্টে মঞ্জুষদার অফিসে কেউ কেউ চলে যেতাম। তবে বেলাআ তিনটের আগে নয়। এ ছাড়াও দেখেছি অল্প, জানতে পেরেছি বেশি যে বহু মানুষকেই প্রয়োজনে উনি আর্থিক সাহায্য করতেন। বিপদে পড়ে কেউ কাছে এসে সাহায্য চাইলেই হলো। লক্ষ্য রাখতেন, এই সাহায্যের কথা যেন কেউ জানতে নাআ পারে। অজস্র লিটিল ম্যাগাজিনের সঙ্গে ওঁর ছিল নিবিড় সখ্যতা। সেখানে কত কত কবির অসংখ্য কবিতা উনি ছেপে দিয়েছেন তা আর বলার নয়। তাঁর ওখানে তরুণ আর বয়েসি কবিদের যাতায়াত লেগেই থাকতো। তারা বহু সময়েই কবিতা পড়তো বা মঞ্জুষদাকে তাদের কবিতা পড়াতো। মজার বিষয় হলো, কারোর কবিতাকেই তিনি খারাপ বলতেন না। ভালো হয়েছে, চমৎকার – তিনি এমনই বলতেন। আসলে তিনি মনে করতেন, একজন তরুণ যত খারাপ কবিতাই লিখুন না কেন, প্রশংসা করলে হয়তো একদিন সে ‘কবিতা’ লিখে উঠতে সক্ষম হবে।

‘কখনো কি পূর্ণ উন্মোচিত হয়। প্রতিফলন প্রতিমায়! আরো ভিতরের অচেনা ভাষালিপির জন্যে সে অপেক্ষা করে। আরো একটি ট্রেন শূন্য কাঁপিয়ে চলে গেল।’

‘আকাশ গাছ। তারাপাতা ঝরে যায়। রুপোরঙ। কারো চোখজল ঝরে। মাঝে মাঝে। মানুষ কত কম দেখে। কম মানুষই দেখে। নাকি কেউ না!’

‘একটানা ট্রেন যায়। অস্থির আঙুলে শুধু সিগারেট পোড়ে। একসময় ডানাশব্দ বন্ধ করে পাখি। শিউলির ঝরে পড়া দেখি।’

যখনি পোদ্দার কোর্টে মঞ্জুষদার অফিসে আড্ডায় যেতাম, দেখতাম ওঁর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। পকেটে বা সামনের টেবিলে ফিল্টার উইলসের প্যাকেট পড়ে আছে। প্রায়শই আড্ডার মধ্যে তিনি কাউকে কাউকে কবিতা পড়তে বলতেন। ওই আড্ডায় নিয়মিত কবিতা পাঠ হত। খুবই মনোযোগ দিয়ে তিনি কবিতা শুনতেন এবং তাঁর যা মনে হত, সেই মন্তব্য করতে তিনি যথেষ্ট সপ্রতিভ ছিলেন। অনেক সময়ই বলতেন, বিশেষত সমসাময়িকদের, যে কবিতায় প্রত্যেকের স্বর যেন আলাদা করে চিনতে পারা যায়। মঞ্জুষদার অফিসেই গঠিত হয়েছিল অন্তর্বৃত্ত নামে একটি সংস্থা, যা প্রত্যেক সদস্য কবিদের জন্মদিন পালন করতো। সে একটা লম্বা ব্যাপার। এখানে নয়, এ নিয়ে আলাদা ভাবে লেখা প্রয়োজন।

‘কেবলি যাবার কথা। ভাবি। অনড়পাথর। রাত হয়। অন্ধকার। ঝিঁঝিস্বর। চোখনৌকা কিছুই শোনে না। দেখে। সময় মুচকি হাসে। চলে যেতে থাকে।’

‘বরফের উপর আমার আত্মার লাল লিখে রাখি। আমার রক্ত কখনো কালো ছিল না। বিনীত ছিলাম বলে ভুল ভেবেছিলে। প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করিনি কোনোদিন।’

‘অন্ধকারে ছায়াডাক। বহুদিন শুনিনি তারপর। মৃত সূর্য অনাদৃত রাত। সুশ্রুষা নদীর সাথে দেখা হল। সেইদিন। ডাক ভেঙে পড়ে। শুনি।’

বাঙলা দেশের বহু কবি মঞ্জুষদার অফিস পোদ্দার কোর্টে আসতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা। আমরাও অংশগ্রহণ করতাম। ত্রিপুরা থেকেও অনেক কবিকে আসতে দেখেছি। আসলে উনি খুব ভালো সংগঠক ছিলেন। প্রচুর কবিতা পাঠের আসর, কবিতা-গদ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন একাধিকবার তিনি আয়োজন করেছিলেন।

ভালো মানের চা খেতে খুব ভালোবাসতেন। তবে যেখানে সেখানে চা পেলেই হলো। বহু মঙ্গলবারই তিনি দক্ষিণ কলকাতার দিকে আসতেন। এলে আমার বাড়িতে এসে ঢুঁ মেরে যেতেন এবং এক কাপ চা বরাদ্দ থাকতই তাঁর জন্য। এখনো মাঝে মাঝেই বিশ্বাস করতে মন চায় না যে তিনি নেই। স্বপ্ন দেখি হাত ধরাধরি উনি আর আমি জেব্রাক্রসিং পার হচ্ছি। ওঁর হাতে ‘জন্মহীন সাদা লাঠি।’


[রচনাটিতে উল্লিখিত কাব্যাংশগুলি কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্তের ‘অন্ধকার অন্ধ নয়’ (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৫) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া]

0 comments:

0

প্রবন্ধ - চিত্তরঞ্জন হীরা

Posted in


সাল ১৯৯৫, ২৫ আগষ্ট, কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্তকে নিয়ে একটি সাম্মানিক প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয় হলদিয়া, মেদিনীপুর থেকে শ্রদ্ধেয় নিমাই মাইতির সম্পাদনায়। লক্ষ্য করা যায়, এই সময়টি তাঁর ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে যে, এ সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর "অন্ধকার অন্ধ নয়" কাব্যগ্রন্থখানি। যেখানে তাঁর নিজেকে অতিক্রমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছিল আবহমান বাংলা কবিতার নিবিড় পাঠ, তাঁর "বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক প্রবণতা" শীর্ষক প্রবন্ধ গ্রন্থখানি। যেখানে রয়েছে প্রথাপ্রচল রীতির বাইরে কবিতার ইতিহাসকে নতুনভাবে তুলে ধরার এক সচেতন প্রয়াস। কারণ এর আগে কোনও সাহিত্য গবেষক কবিতার বৈশিষ্ট্য চিহ্নিতকরণে তরুণ থেকে তরুণতম কবিদের সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করার চেষ্টাই করেননি।

আমরা প্রথমে নিমাই মাইতি সম্পাদিত "প্রসঙ্গ মঞ্জুষ দাশগুপ্ত" গ্রন্থটি নিয়ে বসি। সেখানে সামান্য পরিসরে ব্যক্তি মঞ্জুষকে নিয়ে সাতটি নিবন্ধ রয়েছে। অন্যান্য লেখালেখি নিয়ে বারোটি গদ্য এবং কিছু চিঠিপত্র। সব মিলিয়ে ১২৮ পাতার একটি গ্রন্থ। আমরা ব্যক্তি মানুষটিকে নিয়ে এখনও বলতে বসলে দেখা যাবে স্মৃতির পাতা ভরে উঠছে অসংখ্য অক্ষরে। তাঁর ব্যক্তিগত মেলামেশার স্তর, মানুষের প্রতি তাঁর সহৃদয়তা এবং সর্বোপরি তরুণ কবিদের প্রতি স্নেহের যে স্পর্শ লেগে রয়েছে, সে সংখ্যাটিও অগণন। মহানুভব স্পর্শকাতর মানুষটি অবশ্য জীবনে যত ভালোবাসা বিলিয়ে গেছেন, বিনিময়ে সমান প্রতিদান পেয়েছেন, তেমনটা বোধহয় জোর করে বলা যাবে না। কারণ আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতায় ঈর্ষা একটি মহৎ গুণ। তিনি অবশ্য শত্রু জেনেও বুকে টেনে নিতে কখনও দ্বিধা করেননি। নিজের মহত্ব থেকে একচুল সরে আসার আদর্শ তিনি গ্রহণই করেননি।

শুধু ব্যক্তি মঞ্জুষ সম্পর্কে বললে কিন্তু কবি মঞ্জুষ, প্রাবন্ধিক মঞ্জুষ, সম্পাদক মঞ্জুষ, অনুবাদক মঞ্জুষ, তথা ঔপন্যাসিক মঞ্জুষ, ছড়াকার মঞ্জুষ অনেকটাই ঢাকা পড়ে যায়। তাই আমরা এই অদলীয় সৃষ্টিশীল মানুষটিকে বহুভাবে বহুবার ধরার চেষ্টা করেছি। তাঁকে নিয়ে যখনই কোনও লেখার কথা, পত্রিকার কথা ভেবেছি সবার আগে তাঁর লেখকসত্তাকেই প্রাধান্য দিতে চেয়েছি। তাঁকে নিয়ে যখনই কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে তখনই আমরা তাঁর লেখালেখির উপরই আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। তবু সেই ব্যক্তি মানুষটি ঘুরে ফিরে আসে, এসে যায়। বাংলা সাহিত্যে অনেক অনেক কবি-লেখক এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে আড্ডা হয়তো ইতিহাস হয়ে গেছে। এখনও অনেক কবি-লেখকের সাহচর্য পেতে তাঁর বাড়িতে লেখক সমাবেশের অন্ত নেই। যার মধ্যে অনেক স্তাবকতা, অনেকাংশে আত্মপ্রচারের লোভ – যা অস্বীকার্য নয়। কবি মঞ্জুষ চাকরি জীবনে তাঁর অফিসঘরটিকে যখন সাহিত্যের আড্ডা হিসাবে গড়ে তোলেন তখন আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয় যে, একজন মানুষ ভেতরে ও বাইরে কতটা কবিসত্তাকে যাপন করতে ভালোবাসেন। আমরা তাঁর যাপনে তাড়িত হই, নিজেকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হই। কবিতার বাইরে তাঁর যেন কোনও জীবন নেই। প্রত্যেকের ব্যক্তি জীবনের নানা খুঁটিনাটি খোঁজখবর নিতে নিতেই তিনি কবিতায় ফিরে আসেন। আজকের যাঁরা পাঠক, এই মানুষটিকে যাঁরা সামনে থেকে পাননি, তাঁরা এই অনন্য অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আর এখন আমাদেরও পক্ষেও সম্ভব নয় একটা লেখার মধ্যে সেই মানুষটিকে তুলে ধরা। তবু আমাদের স্মৃতিতে তিনি আজও একটি মহীরুহর ছায়া, তিনি একান্ত আশ্রয়।

তাঁর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে অগ্রজ কবি-প্রাবন্ধিক মাননীয় দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, "মঞ্জুষ কারও ঘেরতায় না ঢুকে কেবল আপন চিত্ত আর আপন রচনার চর্চা করেছে বলে তার সঙ্গে একটা সহজ সম্বন্ধ টের পাই বরাবর। দেখতে পাই সবার সঙ্গে মেশার সময়েই সে সাদামাঠা ভাবেই বেশ মিশতে পারে, সে যে লিখিয়ে এবং অমুক বড়ো দলের একজন এই তাচ্ছিল্য বা কৃপামুখটুকু তার নেই।" (প্রসঙ্গ মঞ্জুষ দাশগুপ্ত, পৃ : ১১)

এই ছিলেন ষাট দশকের হাংগ্রি, শ্রুতি, ধ্বংসকালীন, শাস্ত্রবিরোধী দলের বাইরে এক অদলীয় ব্যক্তিত্ব কবি মঞ্জুষ। তবে পরবর্তীতে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, "পৃথিবীর সমস্ত শিল্প আন্দোলনগুলি কখনও না কখনও আমাকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু কবিতা লেখার সময় কোনও একটি শিল্পতত্ত্বকে আশ্রয় করে লেখার কথা ভাবিনি। যখন যেমন এসেছে তেমন লিখেছি।" (ফিনিক্স, সঃ গৌতম সাহা, বইমেলা ২০০১)

দেখতে দেখতে কতগুলো বছর পার, তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ২০০৩-এর ১৯ জানুয়ারি। কিন্তু মনে হয় আজও স্বার্থশূন্য একটা ভালোবাসার টান বুকে এসে লাগছে। তাঁর ওম্ পাই, গন্ধ পাই। ত্রিকাল পাখির গল্প শেষ হবার নয়। সে সব দেখে। শব্দ দিয়ে ছবি আঁকতে আঁকতে ভেসে উঠছে সময়, সময়কে পেরিয়ে একটি সম্ভাবনা। যা আগামীর গল্প, আগামীর গান হয়ে যায়। লিখতে বসলে ছায়া এসে জড়িয়ে ধরে কলমটিকে, ছায়া অক্ষরে বেজে ওঠে আমার ভাঙা ভায়োলিন। তাঁর সুর, তাঁর অব্যক্ত ধ্বনিগুলো। সে কথা শুধু অহল্যা পাথর জানে।

দশক বিচারে কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্তর আবির্ভাব ষাটের শুরুতেই। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "প্রথম দিনের সূর্য" প্রকাশ পায় ২৫ জুন ১৯৬২তে। কবি অমিত ব্রহ্মর সঙ্গে যৌথ প্রকল্পে। এক্ষেত্রে বলার, আমাদের দুর্ভাগ্য কবি অমিত ব্রহ্ম সম্পর্কে আমরা আর বিশেষ কিছু জানতে পারি না। পরবর্তীতে তাঁর কবিতাপাঠের তেমন সুযোগও ঘটেনি। এই কবি সম্পর্কে বিশেষ আলোচনাও নজরে আসেনি। অবশ্য আমরাও কখনও কবি মঞ্জুষের কাছে এ বিষয়ে প্রশ্ন করিনি। এই লেখা লিখতে বসে কথাটা খুব মনে পড়ছে। এটা আমাদেরই ভুল।

যাহোক "প্রথম দিনের সূর্য" থেকেই তাঁর কবিতায় নিজস্ব একটা চলন সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করা গিয়েছিল। প্রেমকে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন তাঁর অব্যক্ত আনন্দলোকের শুভবোধ দিয়ে। সেই অনুভূতিকে আমরা এভাবেই পাই –

রক্তাক্ত করেছে মেয়ে শঙ্খসাদা আমার হৃদয়
কেড়ে নিল তপস্যার গিনিগলা সোনালী সময়
জ্বেলে দিল দীপ্তদীপ– সে আগুনে সব কিছু ছাই,
তবু হায় শক্তি নেই তাকে ছেড়ে সুদূরে পালাই।

(বিজয়িনী/ প্রথম দিনের সূর্য)

তাঁর ভাষায় ভেসে যাওয়া একটা সুদূরের টান থাকলেও পলাতক হয়ে ওঠার কোনও যাযাবরী মনোবৃত্তি ছিল না। একটু সুধীন্দ্রনাথের প্রতি ঝুঁকে পড়া অনুভব নিয়েও ধ্রুপদী চালে তিনি নিজেকে আলাদা করে তুলেছিলেন। যেন নিভৃতে সমসাময়িকদের থেকে একটা আলাদা ভাষার খোঁজে নিজেকে সচল রেখেছিলেন। জীবনানন্দ পরবতী বাংলা কবিতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদে জীবনকে দেখতে চেয়েছিলেন আনন্দময় শান্তির প্রত্যাশা নিয়ে। বলা যায় ভালোবাসায় ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। সে সময়ে তাঁর সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন "দু একটি পংক্তি পড়লেই এই কবির নিজস্ব কন্ঠস্বর চেনা যায়। এ জন্য সে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। বাংলা ভাষায় কিছু লিখতে গেলে বাংলা ভাষার সমগ্র রূপটি সম্পর্কেই একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। গভীর মনোযোগী পড়ুয়া না হলে লেখক হওয়া যায় কিনা তাতে সন্দেহ আছে। মঞ্জুষ পড়েছে অনেক।" (প্র: ম:, পৃ : ৯)

আমরা তাঁর পঠন-পাঠন, মেধা ও প্রজ্ঞার মুখোমুখি হতে পেরেছি এ আমাদের পরম সৌভাগ্য। তিনি যখন "বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক প্রবণতা" লিখছেন, প্রতিটি পর্বের পাঠ-পরিকল্পনা, উদ্ধৃতি উদ্ধারে প্রতিনিয়ত তরুণ কবিদের কাব্যগ্রন্থ নিয়ে, বা তখনও কোনও গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি অথচ তিনি একটি সম্ভাবনাময় কবিতা কোনও পত্রিকায় পড়েছেন, তার পংক্তি স্মরণ করা বা উদ্ধার করা, সে আলোচনায় আমাদেরও সঙ্গী হতে হয়েছে। কাছ থেকে একজন নিমগ্ন পাঠক-আলোচক-কবি-প্রাবন্ধিককে দেখা। আমাদের মনে রাখতে হবে তাঁর পাঠ শুধু বাংলা ভাষার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ফরাসি, স্প্যানিশ সহ একাধিক বিদেশি ভাষা জানতেন। মূল ভাষায় সে দেশের কবিতাকে জানার আগ্রহে তিনি নিত্য সন্ধানে ব্রতী থেকেছেন। এতে তাঁর নিজের কবিতাই সমৃদ্ধ হয়েছে।

তাঁর সঙ্গে আড্ডায় কবিতার বিশ্বকে চেনা। যে ঋণ কোনও মূল্যে হয়তো পরিশোধযোগ্য নয়। আমার একান্ত বন্ধু বিশিষ্ট কবি-প্রাবন্ধিক অরুণাংশু ভট্টাচার্য লিখিত আকারে বলেছেন ১৮ নং রবীন্দ্র সরণির পোদ্দার কোর্টের তিন তালার সেই অফিস ঘরটির কথা। বলেছেন "বাংলা সাহিত্যে এমন কবি কমই আছেন যে যিনি একবারও মঞ্জুষদার ঘরে আসেননি। এই ঘরটিতে কখনও দলাদলি হয় না। অথচ যাঁরা আসেন বাইরে হয়তো তাঁরা অনেকেই অনেক গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু ১৮ নং রবীন্দ্র সরণিতে সকলে মুক্ত খোলামেলা। এর একমাত্র কারণ কিন্তু মঞ্জুষদার পক্ষপাতহীন বাউল মনোবৃত্তি।" (প্র: ম :, পৃ : ২০)

তিনি তাঁর লেখালেখির জীবনে কবিতার সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে বেশি নিবিষ্ট থেকেছেন কবি ও কবিতা বিষয়ক গদ্য রচনায়। সমস্ত গদ্যেই কম বেশি উঠে এসেছে কবিতার ইতিহাস। এ ব্যাপারে তিনি বুদ্ধদেব বসুকে সবসময় মান্যতা দিয়েছেন। তরুণ প্রজন্মের কবিদের কবিতার ভাষা, আঙ্গিক, নতুন নতুন প্রবণতা লক্ষণের দিকে যেমন ছিল তাঁর সতর্ক দৃষ্টি, তেমনি উৎসাহ দানের পদ্ধতিও ছিল নিখাদ। প্রেরণা পেয়ে যাতে একজন সম্ভাবনাময় কবি যথার্থ প্রতিভাদীপ্ত হয়ে ওঠেন। এ কাজ সকলের দ্বারা আসে না। এ কাজ কঠিন। আত্মত্যাগের সমান। আবার একথাও বলেছেন তরুণদের দেখে তিনি নিজেও উদ্দীপ্ত হন। এই কারণেই হয়তো তিনি নিজেকে বারবার ভাঙতে পেরেছেন। অতিক্রমের কথা বলেছেন। একজন কবিকে তাঁর নিজের তৈরি ভাষাভঙ্গী থেকে বেরিয়ে নতুন পথ খোঁজার কথা বলেছেন। তাঁর সমসাময়িক কবিরা যখন একটি পেয়ে যাওয়া ভাষা বা অর্জিত ভাষায় গতানুগতিক কাব্যচর্চা করে চলেছেন তখন তিনি নিজেকে ভেঙে ভেঙে নতুন ভাষার সন্ধানে ডুবে যাচ্ছেন। সারা পৃথিবীর কবিতার ভাঙচুর তিনি লক্ষ্য করতে চেষ্টা করছেন। তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠও ছিল এতটা মরমী যে চিৎকৃত কলোরব ছাড়াই শব্দের কাছে কান পাতলে যেন কান্নাটুকু শোনা যায়। বলছেন "শব্দের ভিতরে ধর্ম পুরে দেয় পুরোহিত অথবা যাজক" আর কবিই একমাত্র পারেন শব্দের মধ্যে ভালোবাসা পুরে দিতে। এটা হয়তো সহজ কথা, কিন্তু কবি মঞ্জুষ তো নিজেকে অতো সহজে প্রকাশ করতে রাজি ছিলেন না, তাই বলছেন সেই ভালোবাসাটা কেমন, "অনেক সবুজ ক্ষেতে জাপটে ধরা শরীরের খুশি / সমুদ্রের শঙ্খ কণ্ঠস্বর" (বজ্রকীট/এত প্রিয় এখন পৃথিবী, প্রকাশ : জানুয়ারি ১৯৯২)। তাঁর প্রেম ও প্রতিবাদ এভাবে মিলে মিশে রয়েছে এসময়ের বহু কবিতায়। এই গ্রন্থের ভূমিকাগদ্য বা প্রাককথনে তার আভাস রয়েছে। সেখানে তিনি বলছেন, –"সাহিত্যের যে শাখাটি সবচেয়ে জটিল, গোলমেলে ও ঘোলাটে তা কবিতা। শব্দে ও পংক্তির ভাঁজে ভাঁজে যে রহস্যময়তা, অলৌকিকতা ও ব্যঞ্জনা তা অনেক সময়ই সহজ ও সুবোধ্য হয় না, অনেকের কাছে। ভাবাত্মক, রূপাত্মক, চিন্তা ও অনুভূতিপ্রসূত শব্দবর্ণমালা কখনও প্রচণ্ড ধাক্কায় মাথা ঝিমঝিম করায়, কখনও বা মাধুর্যের হাওয়ার নৌকোয় ভাসিয়ে নিয়ে যায় চেনা-অচেনার এক মায়াবীলোকে। …", এখানে তিনি সমকালীন সময় সমাজ পরিপার্শ্বর কথাও বলেছেন। চারপাশের ঘটনাপ্রবাহের আলোড়নের কথাও বলেছেন। চেতনে অচেতনে যা একজন কবিকে নিরন্তর বিদ্ধ করে। তাই লেখা হয়ে যায়-

আমার শরীরে কোনো পাপড়ি নেই শুধুমাত্র কাঁটা
এখন ভারতবর্ষে ছিটকে পড়ে কণিষ্ক গোধূলি
চারদিকে হিমঠাণ্ডা বিপুল সন্নাটা :

(ভাগলপুর ১৯৮৯/ ঐ, পৃ : ১৩)

এই গ্রন্থে এরকম আরও অজস্র পংক্তি রয়েছে যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় একজন কবি ফুল পাখি লতা নদী সমুদ্র পাহাড় থেকে যেমন কবিতার রসদ সংগ্রহ করেন, আবার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক পরিবেশ থেকে, তার নানা ঘটনার অভিঘাত থেকেও নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন না।

# # #

আমরা লক্ষ্য করলাম কবিতার পাশাপাশি তাঁর গদ্যের ভাষাতেও এক চৌম্বকশক্তি রয়েছে এবং আশ্চর্য তার বনেদীয়ানা। একজন দীক্ষিত পাঠকের ঔজ্জ্বল্য সর্বত্র দীপ্যমান। এই প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় দেবীপ্রসাদের আরেকটি বক্তব্য তুলে ধরতে খুব ইচ্ছা হয়। সেখানে তিনি বলছেন, "গল্প নাটক কবিতা গদ্যপ্রবন্ধ যত রকম লেখা লিখেছে সে, লিখেছে চূড়ান্ত মন দিয়ে। হয়তো কবিতাই প্রধানা শাসিকা তার। তবু আমার নিজের মনে হয় সুকরতর সিদ্ধি সে দেখতে পাবে তার চিন্তার গদ্য লেখাতে একদিন। কেননা যে সহজ বিবেচনা ও মনস্কতা তার সব লেখার মূল নিয়ামক আর যাতে কবিতা উত্তাপ হারায় হয়তো কখনও কখনও, তাতেই প্রভাবান হয়ে ওঠে শিক্ষাপ্রদ গদ্য লেখা।" (প্র: ম :, পৃ : ১২)

তাঁর এই মনে হওয়াটা যে যথাযথ তা আমরা কাছে থেকে লক্ষ্য করেছি যখন "নবীন আধুনিকতার অস্থিরতার বিন্দুগুলি" নিয়ে তিনি ভাবতে বসেছিলেন। যা ছিল খুব সম্ভবত ১৯৯০ বা ৯১ সালের গোড়ার কথা। যেখানে মূলত তিনি সত্তর আশির দশকের কবিদের রচনার বিষয় ও আঙ্গিক নিয়ে সংক্ষিপ্ত একটি আলোচনা উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছিলেন। তারপরই আরও বিস্তৃতভাবে সন্ধান করতে বসলেন স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা কবিতার প্রবণতা লক্ষণ বা বিবর্তনের চিহ্নগুলি নিয়ে। যে খোঁজ শুরু হয়েছিল মধুসূদনের কাল থেকে। কারণ লক্ষ্য, আধুনিকতার পর্বগুলি তিনি তাঁর মতো করে বলবেন। অতীতের গবেষণার ফাঁকফোকর থেকে পর্বগুলি যাতে আমাদের মনে আরও নতুন ভাবনার রসদ জোগায়।

এই প্রবণতা প্রসঙ্গটি একটু বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। আবারও বলি "নবীন আধুনিকতার অস্থিরতার বিন্দুগুলি" ছিল একটি ছোট প্রবন্ধসংকলন (দেড় ফর্মা)। তার পরপরই তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেছিলেন বাংলা কবিতার পুরোনো আধুনিকতা থেকে নতুন আধুনিকতায় যাত্রাপথের ইতিহাস। এ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের গবেষকরা যাকে পুরোনো আধুনিকতার কাল বলেছেন, কবি মঞ্জুষ তাকে বলতে চাইলেন প্রথম আধুনিকতা। তিনি বলেছেন, –"বাংলা কবিতার ঐতিহাসিকেরা পুরোনো আধুনিকতার কালটিকে কিঞ্চিৎ দীর্ঘ করে দেখিয়েছেন। 'পুরোনো' বিশেষণটি বর্জন করে যদি 'প্রথম' বিশেষণটি জুড়ে এভাবে বলা যায় যে ১৮৬১ থেকে ১৮৯৯ পর্যন্ত প্রথম আধুনিকতার কালপর্ব তাহলে সীমানাটি বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।" (প্রবন্ধসংগ্রহ, পৃ : ৩৬)। প্রসঙ্গত তিনি বলেছেন ১৮৬১ সালে মধুসূদনের 'মেঘনাদবধ কাব্য'-এর মাধ্যমেই প্রথম আধুনিকতার পদসঞ্চার ঘটে। আর ১৮৯৯ মানে রবীন্দ্রনাথ এসে পড়েছেন। মাইকেল থেকে রবীন্দ্রনাথে এসে আধুনিকতার নতুন বাঁক আসে। যাকে তিনি বলছেন দ্বিতীয় আধুনিকতা। আর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থেকে মুক্তির চেষ্টার মধ্যে জন্ম নেয় তৃতীয় আধুনিকতা। যা প্রতিষ্ঠিত হয় জীবনানন্দের হাত ধরে। তারপর পার হয়েছে আরও দীর্ঘ সময়। খেয়াল রাখতে হবে জীবনানন্দের মৃত্যু হয় ১৯৫৪ সালে। বাংলা কবিতা তারপরও চার চারটি দশক পার করেছে। স্বাভাবিক কারণে পরবর্তী আধুনিকতার খোঁজ আমাদের মধ্যে জারি থাকে। এই প্রসঙ্গেই তিনি বলেছিলেন, "স্বাধীনতা পরবর্তী কবিতা থেকে চতুর্থ আধুনিকতার যাত্রা শুরু।" (প্রবন্ধসংগ্রহ, পৃ : ৩৭)

তিনি পঞ্চাশ থেকে নয়ের দশকের মাঝামাঝি (১৯৯৪-৯৫) সময় পর্যন্ত সেই পর্বের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে যখন আলোচনা করতে বসেন তাকে এক একটা যাত্রাপথের মাধ্যমে দেখেছেন। যেমন –

১. প্রথম যাত্রাটি শুরু হয় সমিল থেকে অমিল কবিতার দিকে। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন ধ্রুপদী সংস্কৃত কবিতায় নিরূপিত ছন্দের ব্যবহার থাকলেও আদ্য মধ্য অন্ত্যমিলের ব্যবহার বা সহজস্বরের বিন্যাস প্রথম আসে জয়দেবের কবিতায়। এই কারণে জয়দেবই বাংলার আদি কবি বলে বিবেচিত হয়েছেন। তিনি আমাদের এই সামান্য পরিসরেই দেখিয়েছেন, বাংলা কবিতার শুরুর কাল যদিও ধরা হয় চর্যাপদ বা চর্যাগানকে, কিন্তু হাজার বছরের আগেও অর্থাৎ চর্যাগানের আগেও কোথাও হয়তো সংগৃহীত হয়ে আছে বাংলা কবিতা যা এখনও কোনও সংগ্রাহকের গবেষণার অপেক্ষায়। ফলে আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি না যে, চর্যাপদ থেকেই বাংলা কবিতার স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়েছিল। আপাতত যা সংগৃহীত, তা-ই প্রমাণিত, সেভাবেই আমাদের চলা।

এভাবেই তিনি প্রচলিত ধারণার বাইরে নতুন কিছু ভাববার রসদ দিয়ে গেছেন। নিরূপিত ছন্দে লিখতে লিখতে কবিরা কীভাবে ছন্দের ভাঙচুর নিয়ে খেলতে শুরু করেছেন সেকথা যে এভাবেও বলা যায় তা এই গ্রন্থটি না পড়লে আমাদের জানাই হতো না। প্রতিটি পর্বের শেষে এসে তিনি তরুণতর কবিদের কবিতাই বেশি উদ্ধৃতি দিতে চেয়েছেন। অর্থাৎ প্রথাপ্রচল ইতিহাসবিদদের সংস্কার তিনি ভাঙতে চেয়েছিলেন, সঙ্গে লক্ষ্যণীয় হলো গদ্যভাষা। তাঁর এই মানসিকতার কথাই বোধকরি বলতে চেয়েছিলেন মাননীয় কবি-প্রাবন্ধিক দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়।

২. এভাবেই তিনি এসেছেন বাংলা কবিতার প্রতিষ্ঠিত মিথ ভাঙার খেলায়। ধরা যাক মেঘনাদবধ কাব্যে যার শুরু। যেখানে অমিত্রাক্ষর ছন্দে যেমন মধুসূদন বাংলা কবিতার চেহারায় নতুন পোশাক পরালেন তেমনি বাল্মীকি রামায়ণের ভিলেন চরিত্রকে তিনি করে তুললেন হিরো। এভাবেই একটি মিথ ভেঙে নতুন মিথের জন্ম হয়। নতুন ভাষার জন্ম হয়। শিল্পের বিমূর্ততাও নতুন রূপ পায়। তিনি দেখিয়েছেন মধুসূদন থেকে জীবনানন্দ পর্যন্ত বাংলা কবিতার ছন্দমাধুর্য সঙ্গীতের আলোয়ান গায়ে যেমন সুন্দরের উপাসনা করে গেছে, তেমনি নিসর্গ দিয়ে রচিত অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের কাল কীভাবে বদলে বদলে এসেছে। তারপরই এসেছেন জীবনানন্দ পরবর্তী ভাষায় এবং বিষয়বৈচিত্র্যে‌। বুদ্ধদেব বসুই তো বলেছিলেন, কবিতার নবজন্ম তখনই সম্ভব, যখন কবিরা ভাষাকে দিতে পারেন নতুন প্রাণ ও ধ্বনিস্পন্দন।

৩. কবি মঞ্জুষের পরবর্তী যাত্রা হলো চিত্র থেকে চিত্রকল্পের দিকে। এই বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় তিনি দেখিয়েছেন ইন্দ্রিয়ঘন চিত্রমালা কীভাবে 'আপাত অবিশ্বাস্য ব্যাখ্যাতীতকে নিঃশব্দসুন্দর শব্দচিত্রে'র মাধ্যমে কবিতার অবয়বে নিয়ে আসা যায়। আমাদের লক্ষ্য করার বিষয় হলো শুধু রহস্যময় সুন্দরের ছায়ামুক্তি নয়, অসুন্দরকেও প্রকাশের ক্ষমতা রয়েছে চিত্রকল্পের। এসব ক্ষেত্রে অনুষঙ্গই শব্দকে তার বহুকৌণিক আলো দিয়ে চিত্র থেকে চিত্রকল্পের দিকে নিয়ে যায়।

৪. এরপর তিনি দেখিয়েছেন অলংকারহীন কবিতার সন্ধানে কবিরা কতটা পথ এগিয়ে যথার্থ পথিক হয়ে উঠলেন। বা একেবারে অলংকারমুক্ত কবিতা বা কবিতাবিরোধী কবিতা বা সে অর্থে প্রতিকবিতা বা অ্যান্টি পোয়েট্রি লেখা কতটা সম্ভব সে প্রশ্নের মুখোমুখিও তিনি আমাদের দাঁড় করালেন। তিনি বললেন, –"কোনো ধারার কবিতাই কিন্তু শেষ পর্যন্ত রহস্যরিক্ত ব্যঞ্জনাহীন বা রূপক উপমা উৎপ্রেক্ষাহীন হতে পারে না। এমনকি বিবৃতিমূলক সামাজিক দায়বদ্ধতার শ্লোগানও কবির হাতে পড়ে শ্লোক হয়ে যায়।" (প্রবন্ধসংগ্রহ, পৃ : ৬২)।

৫. স্বভাবত কবিতার পরবর্তী যাত্রা শুরু হয় শ্লোগান থেকে শ্লোকের দিকে। এখানেও তিনি দেখিয়েছেন কবিতা থেকে সৌন্দর্যবোধের ব্যাকুলতা কখনও একেবারে মুক্ত হবার নয়। কবিতা কখনও তা সহ্য করতে পারে না। সে কোনও রক্তাক্ত প্রতিবাদ থেকে স্লোগানের জন্ম হতে পারে, কিন্তু যান্ত্রিক উচ্চারণে স্লোগানও ঐশ্বর্য হারায়। ফলে সমাজ সচেতনতার সঙ্গে যখন চিত্রকল্পে যথার্থ মিশে যায় আর্তহৃদয়ের আতুরতা, তখনই শব্দরা স্লোগান থেকে শ্লোকে পর্যবসিত হতে পারে। তাঁর কথায়, "সামগ্রিক সামাজিক প্রয়োজনে কবি কখনো কখনো কবিতা জলাঞ্জলি দিয়ে স্লোগান লিখলেও শেষ পর্যন্ত কবিতায় কবিতা ফিরিয়ে আনাই কবির কাজ।" (ঐ, পৃ : ৭১)।

৬. এরপর তিনি দেখিয়েছেন বাংলা কবিতা আখ্যানকাব্যের যুগ পেরিয়ে যেভাবে খণ্ডকবিতায় অবতীর্ণ হয়েছিল, আবার একটা সময় ফিরে যেতে চেয়েছে দীর্ঘ বা মহাকবিতার দিকে। বাংলা কবিতায় বোধ করি ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে ঈশ্বর গুপ্তর সময় থেকে একটু একটু করে খণ্ডকবিতার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু গাঁথা বা কাহিনিকাব্যের কাল তখনও সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়নি। তা থেকে মুক্তির জন্যেই দীর্ঘকবিতায় আসা। জীবনানন্দ যাকে বলেছিলেন মহাকবিতা। যেমন রবীন্দ্রনাথের 'শিশুতীর্থ'-এর কথা উল্লেখ করতে হয়। কবি মঞ্জুষ বললেন, "একটি ছিন্ন অনুভূতি বা মুডকে স্বতন্ত্রভাবে রূপায়িত না করে দীর্ঘ পরিসরে মানবমনের চেতন অবচেতন ও অচেতন অনুভব ও কল্পনাজগৎ ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় যখন হয়তো তখনই দীর্ঘ কবিতার জন্মলাভ।" (ঐ, পৃ : ৭২)। এই দীর্ঘ কবিতা লেখার ধারাটি এখনও লক্ষ্য করা যায়। আজও অনেকেই এর মধ্যে তাঁর সৃষ্টির সিদ্ধি খোঁজেন। তবে এই মুহূর্তে সিরিজ কবিতা চর্চা অনেক বেশি সমৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে কবির ওই ছিন্ন ছিন্ন অনুভূতি বা মুডকে ধরছেন ক্রমানুসারে। একে আমরা দীর্ঘ কবিতার পরবর্তী পর্যায় বা বৈশিষ্ট্য হিসাবে ধরতে পারি।

৭. দীর্ঘ কবিতার মধ্যে একটা অমিত বা বাড়তি কথা বলার ঝোঁক কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি। দীর্ঘ কবিতার সঙ্গে ছোট কবিতার মৌল পার্থক্য এখানেই। পরবর্তীতে আমরা দেখলাম আরও কম কথায় কবিতাকে কীভাবে ছোট অথচ স্বয়ংসম্পূর্ণ করা যায়। কবিতার যাত্রা শুরু হলো অমিত থেকে মিতকথনের দিকে। অর্থাৎ তীব্রভাবে আরও সংহত হতে থাকা। পুনরাবৃত্তিকে বর্জন করা, প্রগলভতাকে বর্জন করা। এ বিষয়ে অনেক অনেক উদ্ধৃতির উল্লেখ করা যায়। ষাটের দশকে শ্রুতির কবিরা মিতায়তনের কবিতায় বিশ্বাস রেখেছিলেন। এরপর এলো আরও সংহত কবিতা। এই মুহূর্তে আমরা দেখতে পাই এক পংক্তি, দুই পংক্তি থেকে চার পংক্তির কবিতার জোয়ার। কবিতা এভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনুভূতির রূপভেদে পাল্টে যেতে থাকে।

৮. যেমন আমরা এসেছি প্লেটোনিক থেকে শরীরী প্রেমের পথে। এ যাত্রাও কম দীর্ঘ নয়। প্রেমের কবিতায় অশরীরী রোমান্টিকতার কথা বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথের কথা ভীষণভাবে এসে যায়। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলতে চেয়েছিলেন 'আধুনিকতার ভূত' যার প্রকাশ শুরু হয় তাঁর সময়কালেই ত্রিশের দশক থেকে। তাঁর চেয়ে বয়সে কিঞ্চিৎ বড় কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস (১৮৫৫-১৯১৮) কিন্তু অনেকটাই দ্বিধাহীন ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যখন 'সোনারতরী' বা 'চিত্রা'র কবিতাগুলি লিখছেন অর্থাৎ ১৮৯৪ সাল, সে সসময়েই কবি গোবিন্দচন্দ্র লিখলেন –

আমি তারে ভালবাসি অস্থিমাংসসহ,
অমৃত সকলি তার – মিলন বিরহ।
বুঝি না আধ্যাত্মিকতা
দেহ ছাড়া প্রেমকথা
কামুক লম্পট ভাই যা কহ তা কহ।

(কস্তুরী আমার ভালবাসা)

দেহজ প্রেমের উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথের তখনও আড়ষ্টতা রয়েছে। কিন্তু মোহিতলাল, বুদ্ধদেব বসুরা নারীদেহের বর্ণনায় অকপট হয়ে উঠছেন। তাঁদেরই প্রশ্রয়ে হয়তো পঞ্চাশের কবিরা প্রেম ও যৌনতার জোড়ে কবিতার জোর খুঁজেছিলেন। ষাটের হাংরির কবিরা এ বিষয়ে ছিলেন আরও উদার। ফলে সমালোচকদের আক্রমণে তাঁরা বিদ্ধ হয়েছেন। সমকালে দাঁড়িয়ে এই জৈব-আর্তনাদকে শ্রুতির কবিরা অবশ্য বর্জন করতে চেয়েছিলেন। তারপর তো কালের প্রবাহে নদীর জল বহুভাবে বহুপথে সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে। এখনও অনেকের কলম ক্ষুধার্ত ও অকপট। তবে কবি মঞ্জুষ প্রাবন্ধিক হিসাবে বিষয়টিকে যেভাবে শেষ করেছেন তা অতুলনীয়। বলছেন –"ইন্দ্রিয় নির্ভরতার বিরুদ্ধে উচ্চারিত চিৎকার পেরিয়ে চিরন্তন রোমান্টিকতায় কবি হয়তো লিখে ফেলেন 'আয় খুকু স্বর্গের বাগানে আজ ছোটাছুটি করি' যেখানে নক্ষত্রের রেণু কবির গায়ে এসে লাগে।" (ঐ, পৃ : ৯৬)।

৯. পরবর্তী প্রবণতাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞান ও কবিতার মেলবন্ধন। যাত্রাটি বিজ্ঞান থেকে কবিতার দিকে। এখানে ভাবার বিষয় হলো কবিতায় বৈজ্ঞানিক অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হওয়াটাই প্রধান কথা নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে বিজ্ঞানচেতনার প্রসঙ্গটি। কবিতায় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিরীতির প্রচলন। জীবনানন্দ যাকে বলেছিলেন 'বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিদিব্যতা'। আর কবি মঞ্জুষ বলছেন, –"বিদ্রোহী ইলেকট্রন শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটাতে ঘটাতে চক্রপথে প্রোটনের মুখোমুখি হয়ে ফিরে আবার অন্য প্রোটনের অভিমুখে লাফ দিয়ে ছুটে যায় – এই বিজ্ঞানসত্যকে সামনে রেখে কবিমানসের ভিতরে যেন নানা জ্যোতিমঞ্জরীর মঞ্জীরধ্বনি শোনা যায়। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের আলো কবির গায়ে এসে লাগলেও ব্যাখ্যাতীত অন্ধকারকেই সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে স্পর্শ করার প্রয়াসই শেষ পর্যন্ত কবিতা।" (ঐ, পৃ : ১০১)। এই ব্যাখ্যাতীত অন্ধকারই আমাদের বিশ্বপরিচয় ঘটায়। যে পরিচয় বিজ্ঞানের জ্ঞানচেতনা।

আমরা এরপরও অনেকটা সময় পেরিয়ে এসেছি। কবিতার যথেষ্ট পালাবদল ঘটে গেছে। আরও কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হয়তো তখনই সংযোজন করা যেত, যেমন কবিতায় গল্প বলার প্রবণতা, যা আজও অনেকের মধ্যে রয়ে গেছে। পাশাপাশি চলছে টানা গদ্যে লেখার চল। জন্ম নিয়েছে দুটি বিশেষ্য, দুটি বিশেষণ বা বিশেষ্য বিশেষণ মিলিয়ে শব্দজোট তৈরি বা শব্দসমবায়ের মাধ্যমে নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টির প্রবণতা। এসেছে কবিতাকে বিষয়কেন্দ্রের বাইরে এনে অনির্দিষ্টের দিকে ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা। সিদ্ধান্তহীনতা। বিদ্রূপ, শ্লেষ বা তির্যকতার নতুন রূপসন্ধান ইত্যাদি। এভাবেই প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে আরও আরও নতুন প্রবণতা। কারণ কবিতার ইতিহাস হলো প্রবহমান ভাষাবদলের ইতিহাস, টেকনিকবদলের ইতিহাস।

# # #

আমরা লক্ষ্য করেছি কবি মঞ্জুষ নয়ের দশকের প্রথম পর্বে অর্থাৎ ১৯৯০-৯৫, এই সময়কালে লেখকজীবনের অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। যেমন এই প্রবন্ধগ্রন্থ দুটি – ১. নবীন আধুনিকতার অস্থিরতার বিন্দুগুলি ; ২. বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক প্রবণতা। ১৯৯৩-এ লিখেছেন "স্বপ্নভূমি"র মতো একটি ভিন্ন আঙ্গিকের উপন্যাস। যেখানে চরিত্রগুলি নিজেরাই নিজেদের জীবনের কথা বলছে। বাংলা সাহিত্যে গুটিকয়েক উপন্যাস এই ধারায় লিখিত। লেখক নিজেও একটি চরিত্র হয়ে ভিন্ন মাত্রার সংযোজন ঘটিয়েছেন। যাকে সে অর্থে আত্মজৈবনিক উপন্যাস বলা যাবে না। তবে যেমন হয়, কোনও কোনও চরিত্রের মধ্যে নিজের জীবন ভাবনা আদর্শ স্বপ্ন অবশ্যই ঢুকে পড়ে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো তিনি জীবদ্দশায় মাত্র তিনখানি উপন্যাস লিখেছিলেন। "একদিন একরাত" (এপ্রিল ১৯৮১), "স্বপ্নভূমি" (অক্টোবর ১৯৯৩) এবং "ক্রশরোড" (জানুয়ারি ২০০৩)। বলার কথা হলো একজন কবি হিসাবে তিনি তাঁর কবিতার অনুভব ও সত্তাকে বজায় রেখেই এই উপন্যাসগুলি যে লিখতে বসেছিলেন তা পড়তে পড়তে সহজে বোঝা যায়। সরাসরি এসেছে কবিতার উদ্ধৃতি এবং কবি চরিত্রও। ফলে অন্যান্য কবি-লেখকদের থেকে তিনি এক্ষেত্রেও আলাদা। কারণ কবিতা দিয়ে শুরু করে অনেকেই গদ্যসাহিত্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তাঁরা গদ্যের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও কবিতা সেখানে অবহেলিত হয়েছে।

কিন্তু তিনি আদ্যন্ত কবি। এই সময়কালেই তিনি কবিতার ফর্ম নিয়ে চূড়ান্ত ভাবনা চিন্তা করেছেন। প্রকাশিত হয় তাঁর "অন্ধকার অন্ধ নয়" (জানুয়ারি ১৯৯৫) কাব্যগ্রন্থখানি। তার আগে "আগুনের ডানা" (১৯৯৩) পর্যন্ত প্রকাশ পেয়েছে তাঁর সাতখানি কাব্যগ্রন্থ। যেখানে আমরা দেখেছি অস্তিত্ববাদ ও প্রতীকের নানারকম মেলামেশা ঘটতে। সারা পৃথিবীতে তখনও Surrealism নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। উঠে আসছে Magic-realism-এর প্রসঙ্গগুলি। সেই অবস্থান থেকেও তিনি ভাবতে শুরু করেছিলেন বহুস্তরিক অবচেতনের আরও একটি পরত কীভাবে খোলা যায়, উন্মোচন করা যায়‌। ওই সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গেও তিনি যা বলেছিলেন, – ''অন্ধকার অন্ধ নয়' মূলত আমার অবচেতন স্তরের নানা বিরুদ্ধমূলক উদ্ভাস। কিছুটা বক্রোক্তি, কিছুটা কূটাভাস, কিছুটা নিরীহ শব্দচালের মধ্যে মায়াবিভ্রম লুকিয়ে রাখা। কিছুটা কোলাজ, কিছুটা মন্তাজ, কিছুটা দর্শন। সরল শব্দযূথ পরিত্যাগ করে ব্যঞ্জনাময় শব্দযূথ আবিষ্কারের প্রয়াস করেছি। 'অন্ধকার অন্ধ নয়' শুধুমাত্র পরাবাস্তব কবিতার সংকলন ভাবলে বোধহয় ভুল হবে। পরাবাস্তবতার সঙ্গে এখানে মিশে গেছে Entropy-র দ্বন্দ্ব।" (ফিনিক্স, বইমেলা ২০০১)।

এই entropy বলতে বলা হচ্ছে বিজ্ঞানের কণাতরঙ্গের কথা। এছাড়াও এর মধ্যে রয়েছে ব্যাখ্যাতীত অন্ধকারের আভাস। যা প্রথা-প্রচল আলো-অন্ধকারের বিন্যাসকে ভেঙে ফেলতে চায়। বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডে তারই আলোড়ন চলছে বা বলা যায়, পৃথিবীতে অস্থিরতা যতক্ষণ বর্তমান, ততক্ষণই সৃষ্টির উদ্ভাস। এর রহস্যটা এখানেই। আমরা বরং এই গ্রন্থের একটি কবিতা থেকে বিষয়টা কিছুটা অনুভব করার চেষ্টা করি আমরা –

স্মৃতিঋতু। চোখ দিগন্তে। নীল শ্লেটে। লেখা ও ছবি পড়ে। মুছে
যায়। অদৃশ্য ইরেজারে। আলোয়ানওমে নারী শ্বাস ফেলে। দীর্ঘ
ঈকারের মতো দূর দীর্ঘশ্বাস। বাতাস কাঁপে। পাহাড়ে ঢালে দ্রুতসন্ধে।
রাত্রিও ! ঘুম ও না ঘুমের মাঝখানে অফুরান বর্ষা।

(শীত, পৃ : ২৩)

আমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছি যে, এ কবিতার অভিঘাত কোথায়! কোথায় তিনি অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র ! এধরনের কবিতা থেকে কোনও পংক্তি তুলে উদ্ধৃতি দেওয়া যায় না। টোটাল পোয়েট্রি। সম্পূর্ণ কবিতার মধ্যেই এক আশ্চর্য আলোড়ন, যা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। কিছুটা সেরিব্রালও বটে।

তবে সমকাল ও ইতিহাসই নির্ধারণ করে দেয় একজন কবি কীভাবে কবিতা লিখবেন। তিনি আত্মিক প্রেরণাকে গুরুত্ব দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। এই প্রেরণাকে আমরা যেমন প্রেম বলতে পারি তেমনি লক্ষ্য করবো গদ্যভাবনাও তাঁর কবিতার বিষয়কে ছুঁয়ে আমাদের টেনে নিয়ে চলেছে অন্য এক দিগন্তে। তবে নির্দিষ্ট কোনও তত্ত্ব অনুসরণ করে কবিতা লেখায় তিনি বিশ্বাস করেননি। বিষয়ের অন্তঃপ্রকৃতি অনুযায়ী ভাষাকে নির্মাণ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর Metaprose বা পরাভাষা বহুমাত্রিক। কিন্তু একেবারে অনির্ণেয়তার দিকে তাঁর যাত্রা নয়, শেষ পর্যন্ত একটা সংযোগসেতু গড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন সবসময়। তিনি বিশ্বাস করতেন, "পূর্বাপর বিরহিত, ঐতিহ্যছুট, স্বয়ম্ভূ কবিতা কখনো হতে পারে না। নানা কালপর্বে শিল্পশৈলী বাঁকবদল করে আর এই আঙ্গিকবদলই কবিতার ইতিহাস রচনা করে যায়।" (নির্বাচিত কবিতা /সূচনা-কথা, প্রকাশ: জানুয়ারি ১৯৯৮)।

আমরা এই পর্বের পরেই দেখবো সহজাত কবিত্ব থেকে উৎসারিত শব্দরা কীভাবে নির্মাণের হাত ধরে নতুন এক যাত্রায় সামিল হয়। প্রতি নিয়ত ছিল তাঁর এই শব্দসন্ধান। জাগতিক বিশৃঙ্খলা থেকেই তিনি সুন্দরকে খুঁজে নেন। লিখছেন –

চোখজলে জেগে ওঠে দেশরেখা। লহমায় ভাগ হয়ে যায় পাহাড় পর্বত
নদী-মানুষেরা। চোখ জ্বলে। কাঁটাতার, তুমি এতো শক্তিশালী ! ও দেয়াল,
ও শক্ত নিরেট জল, তোমরাও। দিগন্ত কাঁপিয়ে ট্রেন যায়। ও সবুজ ট্রেন,
তুমি কেন নিয়ে যাচ্ছ আমাদের ! কালো রং দু-একটি পালক ফেলে যাও।

(ত্রিকাল পাখির গল্প/ নির্বাচিত কবিতা, অগ্রন্থিত অংশে)

একটি দীর্ঘ কবিতা। কখনও টানাগদ্যে, কখনও কবিতার ফর্মে ভাঙা ভাঙা পংক্তি বিন্যাসে ত্রিকাল পাখিটি যেন জীবনের গল্প বলছে। সময়, সমাজ, পরিপার্শ্ব, বিজ্ঞানচেতনা এবং জীবনকে ভেতর থেকে দেখার তীব্র বাসনা। যা মেলে ধরে বড় একটা ক্যানভাস। অনন্য ভাষায় আমাদের নিয়ে যায় মহাকবিতার দিকে। তাঁর সময়ের কবিরা এই বয়সে কবিতাকে নিয়ে এভাবে কতটা ভেবেছেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এই ত্রিকাল পাখিটি যে কবি নিজেই।

# # #

কবি মঞ্জুষের আগ্রহের আরেকটি দিক হলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কবিতার অনুবাদ। বিশেষ করে ফরাসী কবিতা। তিনি অনুবাদের মধ্যেও একধরনের স্ফূর্তি খুঁজে পেতেন। অনুবাদ করা ছিল যেন তাঁর মৌলিক কবিতা লেখার আনন্দেরই একটা অংশ, আলাদা কোনও বাধ্যতামূলক অভ্যাস নয়। এই সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন "আসলে যখনই কোনও বিদেশি কবিতা পড়ি তখনই ইচ্ছা হয় সেগুলি অনুবাদ করি। মনে হয় আমার বন্ধুরা যদি এগুলো পড়েন তাঁরাও এই কবিতা থেকে বাংলা কবিতার জন্যে কিছু আহরণ করতে পারবেন।" তাঁর এই ভাবনার কাছে চিরকাল আমাদের নত হয়ে বসতে হয়। তাঁর অনুবাদকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডিরোজিওর কবিতা, ভ্যারনার ল্যামবেরসির কবিতা সহ একগুচ্ছ ফরাসী কবির কবিতা।

তাঁর অসামান্য আত্মজীবনীমূলক গদ্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল 'পারানি' নামে একটি পত্রিকায়। তখন শুধু তাঁর গদ্যটির জন্যেই যে পত্রিকাটি আদৃত হয়েছিল পাঠকমহলে একথা বলার কোনও অপেক্ষা রাখে না। আমরা অধীর আগ্রহে থাকতাম। সেই "পটুয়ার বিমূর্ত শিল্প" গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় খুব সম্ভবত ২০০০-এর এপ্রিলে। শব্দের সঙ্গে সহবাস করতে করতে এই যে পিছন ফিরে দেখা, খুঁড়ে খুঁড়ে দেখা, নিঃসঙ্গ পথিকের গান হয়ে বেজে উঠছে আমাদের বুকের মাঝখানে। প্রবহমান স্রোতে জীবনের এক একটি প্রহর যেন রঙ বদলে বদলে সামনে ধরা দিচ্ছে। তিনি জীবন ও প্রকৃতিকে দেখতে চেয়েছেন খুব নিবিড়ভাবে। তাঁর শিল্পবোধ ও মানসিকতা আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় কবি হওয়ার আগে একজন ভালোমানুষ হয়ে ওঠার কথাটি। এ গ্রন্থের ভাষাও অনবদ্য। তিনি বলেছেন একজন মানুষের ফিরে ফিরে জন্ম হয়। নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে পাল্টাতে থাকে সেই মানুষটি। কারণ পরিবর্তনই জীবনের ধর্ম। তাঁর আত্মজৈবনিক এই রচনা হলো অনেকটাই শব্দ দিয়ে ছবি আঁকা। সব ছবিই হয়তো অসমাপ্ত ভাঙাচোরা, কিন্তু সুন্দরের সোনালি রেখাটি স্পষ্ট। হয়তো আরও অনেক কথা বলার ছিল, কিন্তু তিনি চাননি জীবন এরচেয়ে বেশি উন্মোচিত হোক। তাঁর সংযমবোধ, শালীনতাবোধ থেকেও আমাদের শেখার আছে। তাঁকে আরেকটু জানতে আমরা আর একবার তাঁর অফিস ঘরে ফিরে আসি। কবি-প্রাবন্ধিক বিপ্লব মাজী লিখেছিলেন –

"১. কেউ নতুন পত্রিকা বের করবেন। মঞ্জুষ পরিকল্পনা করে দিচ্ছেন। ২. কেউ নতুন বই করবেন। কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে মঞ্জুষ বলে দিচ্ছেন। ৩. কেউ পত্রিকা বের করছেন। ভালো লেখা পাচ্ছেন না। মঞ্জুষ বলে দিচ্ছেন। ৪. বহরমপুর বা ধানবাদে সাহিত্যসভা হবে। কে কে যাবেন ? মঞ্জুষ ঠিক করে দিচ্ছেন। ৫. সাহিত্যের অসংখ্য যেসব পুরস্কার আছে সেগুলো সম্পর্কে মঞ্জুষের সঙ্গে পুরস্কারদাতারা আলোচনা করছেন।

অর্থাৎ বিকেল তিনটে থেকে চারটে এমনকি সন্ধে ৬টা পর্যন্ত মঞ্জুষের ওখানে সাহিত্যের যে আড্ডা তা বাংলা সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করছে।" (প্রসঙ্গ মঞ্জুষ দাশগুপ্ত, পৃ : ১৬)

এভাবেই আড্ডা আলোচনা থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। প্রথমেই নজরে আসে পূর্ণেন্দু পত্রীর অপূর্ব প্রচ্ছদে একটি নির্বাচিত কাব্য সংকলন "এই মুহূর্তের কবিতা" (প্রকাশ : রথযাত্রা, ১৩৮৮)। অসামান্য এই সংকলনে নির্বাচিত কবিরা ছিলেন সেই মুহূর্তে বিশেষভাবে সক্রিয়। তাঁদের অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে এই সংকলন। নির্বাচিত হয়েছিল প্রায় একশজন কবির একটি করে কবিতা। বাংলা কবিতার অনেক অনেক সংকলন থেকে যা অনেকটাই আলাদা। অন্তত কবিতার মান ও কবির বিচারে। তবে কোনও সংকলনই তো শেষপর্যন্ত সম্পূর্ণ নয়।

যাহোক, পরবর্তী সংকলনটি প্রকাশিত হয় পূর্ণেন্দু পত্রীকে নিয়ে পরের বছরই "পূর্ণেন্দু পত্রী : শিল্পী ও ব্যক্তি"। তারপর ১৯৮৮ সালে তিনি প্রকাশ করেন প্রতিবাদী কবিতার একটি সংকলন "প্রতিবাদ যখন কবিতা" এবং ১৯৯০ সালে কলকাতার তিনশ বছর উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হয় "ছড়ায় না-ছড়ায় কলকাতা"। প্রতিটি সংকলন আলাদা আলাদা করে আলোচনার দাবি রাখে। শুধু ছড়ায় না-ছড়ায় প্রসঙ্গে একটু বলি, তিনি কবিদের কাছে কলকাতার উপর ছড়া দাবি করেছিলেন, কিন্তু নির্বাচনের সময় তিনি লক্ষ্য করলেন এর সব লেখাকে ছড়ায় আখ্যায়িত করা যায় না। আবার কবিদের কাছে নতুন করে ছড়া দাবি করাও জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই তিনি সব লেখা রেখে সংকলনটির নামকরণ করলেন "ছড়ায় না-ছড়ায় কলকাতা"। এছাড়াও আরও কিছু সংকলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষে পরোক্ষে জড়িয়ে ছিলেন তিনি, সঙ্গে আমাদের মধ্যে অনেকেই।

এভাবে আরও অনেক কথাই মাঝে মাঝে মনে পড়ে। সব কথা হয়তো লেখার নয়। তবু যখন দেখি তাঁর অগুনতি স্নেহধন্য কবি-লেখক এখন প্রায় তাঁকে ভুলেই থাকেন, মনে পড়ে যায় তাঁরই এক পংক্তির কবিতাগুলি, যেমন– "কোন বন্ধুত্বই খুব দীর্ঘজীবী নয়"। বা মনে পড়ে যায় – "মানুষের মুখ আর চোখেই পড়ে না এই মুখোশ সমাজে"।

কিন্তু তাঁর সমস্ত প্রয়াস কি ব্যর্থ হতে পারে ! তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা ! তাঁর মতো সাহিত্যপ্রেমী, কবি ব্যক্তিত্ব কি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে পারেন ! এই যে জীবনগ্রন্থখানি, মলাট খুলতেই বারবার ভেসে ওঠে অতীতের সঙ্গে ভবিষ্যৎকে মেলানোর জন্যে এক প্রাণবন্ত বর্তমান। আর ভেসে ওঠে তাঁর অমোঘ কণ্ঠস্বর "মানবিকতার সম্পর্কগুলো বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে এই কবিত্ব, শুধুমাত্র কয়েকটি অক্ষরের মূলধন করে বেঁচে থাকা – তাও ব্যর্থ হয়ে যাবে।" এভাবেই হয়তো অন্ধকারের ভাষাশব্দ নিয়ে, নৈঃশব্দ্য নিয়ে তাঁর আলোকথা লিখে রাখা…!

0 comments:

1

ক্রোড়পত্র - মঞ্জুষ স্মরণে

Posted in




কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্ত

মন্দার মুখোপাধ্যায়



বড় হয়ে ওঠার প্রথম ধাপই ছিল, চেনা বৃত্ত কেটে ছেঁটে বার বার বেরিয়ে যাওয়া। আর ছিল নিজেকে ছাপিয়ে বৃহত্তর সব বৃত্তের খোঁজ। মঞ্জুষদার সঙ্গে পরিচিত হয়ে, কাছে এসে দেখলাম এক অন্য ম্যাজিক। বিরাট মাপের এক কম্পাস, একটি বিন্দুতে ঠেকিয়ে তিনি যে এক মস্ত গোল আঁকছেন, তার নাম ‘অন্তর্বৃত্ত’। পরিধি এবং বৃত্ত নিয়ে এই আয়োজনটাই আমাকে চমকে দিয়েছিল। চাঁদ পাওয়ার মতো মনে হয়েছিল, হাতে পেলাম নিজস্ব এক আড্ডাঘর। ঠিক যেমন বাড়ি, ইশকুল, কলেজ আর পাড়ায় - এ বাড়ি, ও বাড়িতে ঘটত। দূর দূরান্ত থেকেই নয়, গ্রাম গ্রামান্তর থেকেও এসে জড়ো হতেন কবি প্রকাশক, সম্পাদক এবং আবৃত্তিকারেরা। আবার এও ঠিক যে অনেকেই আসতেন না। অনেক মানুষের হয়ে মঞ্জুষদাই যে পৌঁছে যেতেন সর্বত্র, সেটাই যেন বহু মানুষের বিশিষ্টতায় পৌঁছে যাওয়া। এই যে ‘অন্তর্বৃত্ত’ – এর মানেই তো তাই - সম্পূর্ণ এবং সচেতন এক স্বজন বৃত্ত। সকলের জন্য যেমন বরাদ্দ এক কাপ চা, তেমন প্রাণভরা উৎসাহ। সঙ্গে উতরোল আলোচনা, সমালোচনা এবং শাসন। পত্রপত্রিকার হদিশ তো পেতামই পাতিরামের স্টলে এবং আরও কোথাও কোথাও, কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের সেই সব সম্পাদক, প্রকাশক এবং অজস্র উৎসাহী কবি ও গদ্যকারকে সামনা সামনি দেখা, পরিচিত হওয়া – সে এক অন্য আনন্দ। বয়স্ক এবং তরুণ সকলের জন্যেই তাঁর হৃদয় শুধু অবারিতই ছিল না, মনও ছিল উন্মুখ। না হলে কি করে খুঁজে বার করে, টেনে আনলেন আমাকে! সকলের সঙ্গে মিশে যেমন আড্ডায় মিলিয়ে দিতেন সবাইকে, তেমনই একান্তে খোঁজ নিতেন প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ এবং অসুবিধের। এই নৈকট্যের নামই ছিল ‘অন্তর্বৃত্ত’। কেউ যেমন তাঁর চোখ এড়িয়ে যেত না, তেমনই অন্যেরাও এড়িয়ে যেত না তাঁকে। তিনি যে কোনও কিছু পাইয়ে দিতে পারতেন বা পাঠিয়ে দিতে পারতেন দেশ বিদেশে উপার্জন বা অর্জন কুড়োতে, তা তো একেবারেই নয়, কিন্তু কাছে টানতে পারতেন একেবারে আপনার জনটি হয়ে। অহঙ্কার, ঈর্ষা, অযথা আক্রমণ এসব যেন পাশে রাখা ব্যাগের মতো নিচে পড়ে থাকতো। কারণ সবের ওপরে ছিল তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত আন্তরিক ব্যবহার এবং শুভকামনা। আসলে তাঁর আত্মসম্মান বোধটি এতো প্রখর ছিল বলেই বোধহয়, অন্যকেও সম্মানীয় মনে করতে দ্বিধা করতেন না। তিনি জানতেন অন্তর এবং বৃত্ত এই দু’টি শব্দের প্রকৃত অর্থ কি! যুক্তাক্ষরে তাই অনায়াসে মিলিয়ে দিয়েছিলেন এক ভিন্ন চেতনার সংস্কৃতি।

আর মজা হল যে এ সবই ঘটছে কিন্তু পোদ্দার কোর্টে, একটি সরকারি অফিসের অন্দরে। যে কোনও সরকারি অফিসের মতো টেবিল এবং অপরিচ্ছন্ন করিডর পার হতে হতে, দোতলায় উঠে, দরজা ঠেলে ঢুকলেই চমক! অলিগলি পেরিয়ে হঠাৎ সমুদ্র দেখতে পাওয়ার বিহ্বলতা। হতে পারে তিনি বড় আধিকারিক, কিন্তু খান কুড়ি চেয়ার টেনে টেবিলের পাশে তিন চার সারে সাজিয়ে সন্ধ্যে অবধি দল জুটিয়ে আড্ডা! অফিস আওয়ার্স থেকে এতখানি সময় বার করা মানে, আগে এসে কি দ্রুততায় নির্দিষ্ট কাজগুলি সেরে ফেলতে হতো তাঁকে! প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়া সেই মেধার ছাপ থাকতো পাশের ঘরটিতে, যেখানে টেবিল জোড়া ফাইল আর কেজো সময়ের ছাপ। একটা পার্টিশন দিয়ে যে ভাগ - তার এদিকটায় ছবির প্রিন্ট বইয়ের প্রচ্ছদ ও আরও নানা টুকিটাকি সেঁটে সাজানো। কামরাটাও শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত নয়। মস্ত এক পাখা, লম্বা লাঠি সমেত সিলিং থেকে ঝুলছে। একটা বোধহয় আধা খোলা জানলা আর দিনের বেলাতেও জ্বলা একটি ম্লান নিয়ন। তবু কি উজ্জ্বল সেই ঘরটি! আর সব সময় তা যেন প্রাণের বাতাসে ভেসে আছে, আনাচ কানাচ সমেত।

মারক ব্যাধিতে চলে গেলেন মঞ্জুষদা। উঠে গেল ‘অন্তর্বৃত্ত’ নামে সেই আদরের ঠেক। এতে তো মানুষ ঠিক নিরাশ্রয় হয় না, তবে কেমন ফাঁকা ফাঁকা এবং বোকা বোকা লাগে সব কিছু। ভীষণ ভাবে কম পড়ে যেতে থাকে অনেক কিছু। টান পড়তে থাকে মায়া, মমতা আর অনাবিল বন্ধুত্বে। ভাগ্যিস ওই একটা কথাই বলে গিয়েছিলেন ! রোজ তাই অন্তত একবার হলেও সাদা পাতার সামনে ‘ঝুঁকে বসি’ মঞ্জুষদা। ঝুঁকে বসেই তো কবিতার সঙ্গে আমৃত্যু কথা বলে গেলেন আপনি!







‘নিঃশর্ত প্রেমের মতো এতো খোলা প্রান্তর দেখিনি’

পল্লববরন পাল


রাত পৌনে একটা। টেলিফোন। পড়িমরি একতলা থেকে দৌড়োলাম ওপরে – বয়স হয়েছে বাবা-মায়ের, যেন ঘুম না ভাঙে – এতো রাতে! কে? খারাপ চিন্তার ছোটোবড়ো জিজ্ঞাসা চিহ্নের মিছিল বাধ্য ছাত্রের মতো আমার পিছু। সিঁড়ির ধাপ টপকে লাফাতে লাফাতে পৌঁছে গেলাম খাবার টেবিলের পাশে দেরাজের ওপর রাখা রিসিভার প্রান্তে। আমার গলায় আশঙ্কাকম্পিত সুর – হ্যালো...

ও প্রান্ত থেকে এক ঐশ্বরিক সুরবাহারের স্নেহ-সুর গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে আছড়ে পড়লো, যেন সকাল সাতটা চল্লিশের আকাশবাণীতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত, যেন পাহাড়ি ঝর্ণার প্রথম উশুম-উশুম শান্তিজল এইমাত্র নিঃশর্ত লাফ দিলো ওপর থেকে আমার মাথার ওপর, যেন বিশাল এক সামুদ্রিক জলের দেয়াল সৈকতবালির ওপর এইমাত্র আছড়ে পড়ে ছড়িয়ে দিলো একরাশ সম্ভ্রান্ত পবিত্র জুঁই ফুলের মালা –

-পল্লব...?

প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। এখনও ঐ প্রত্যেকটা গুঁড়ো সুর আলাদা আলাদা করে গেয়ে উঠতে পারি – এতটাই চেনা ও প্রিয় আত্মীয়। অত রাতে তাঁর ফোনের উদ্দেশ্য বুঝলাম পরের বাক্যে। আসলে সেদিনই বিকেলে তাঁর পোদ্দার কোর্টের মজলিশ শেষে চুপিচুপি আমারই সম্পাদিত ‘তিন নম্বর চোখ’ পত্রিকার মোটাসোটা উৎসব সংখ্যার এককপি গুঁজে দিয়েছিলাম ওঁর হাতে – মধ্যে আমার লেখা প্রথম গদ্য উপন্যাস – ইতি সিদ্ধার্থ। ‘পড়ে জানাবেন?’ আমার কাঁধে আলতো হাত ছুঁয়ে বলেছিলেন – ‘নিশ্চয়ই’। রাতখাবারের পর বসে এইমাত্র রুদ্ধশ্বাস পড়ে শেষ করেছেন, এবং...

হ্যাঁ, এই হলেন মঞ্জুষ দাশগুপ্ত। বাঙলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। অর্থনীতির কৃতি ছাত্র এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নগরোন্নয়ণ পরিকল্পনা দপ্তরের উচ্চ পদের অফিসার। আমাদের মঞ্জুষদা। অত বড়ো মাপের একজন কবি, বাঙলা সাহিত্যের সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক সম্মান স্বীকৃতি ও নিবিড় যোগাযোগ সত্ত্বেও, সমস্ত বাণিজ্যিক পত্রিকার আবশ্যিক নিয়মিত লেখক হয়েও যিনি আগাপাশতলা লিটল ম্যাগাজিনের কবি – এমন কতজনই তো ওঁকে রোজ স্বরচিত বই উপহার দিয়ে ধন্য হয় – তাই বলে সেটা সেই রাত্রেই পড়ে ফেলা এবং তারপরে এই গভীর রাত্রে ফোন! আমার মতো এক অপাংক্তেয় অর্বাচীনকেও তাঁর বুকে এত গুরুত্ব দিয়ে অযাচিত জায়গা দেবেন... আমার কাছে অভাবিত!

সেই রাতে নিঃশব্দে রিসিভার কানে লাগিয়ে তাঁর পাঠপ্রতিক্রিয়ার তন্ময় উষ্ণ উচ্ছ্বাসে আমার শরীরের হাড়-মাংস-গ্রন্থি-জ্ঞান-বোধ-সংবিৎ একে একে গলতে গলতে মেঝের ওপর অনুভূমিক টলটলে মহাদেশ মানচিত্রে পরিণত হতে সময় নিলো পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। রিসিভার ছেড়ে দেখি, ঘেমে নেয়ে গেছি, আর আমার মাথার পিছনে যেন এক জ্যোতির্বৃত্ত বাঁইবাঁই ঘুরছে – বুঝলাম, তাঁর অন্তর্বৃত্তে আমার নাগরিকত্ব পাকা হলো।

তাঁর কোনো দায় ছিলো না - কোনো গণিত ছিলো না আমাদের সম্পর্কে - কারণ হিমালয়ের সঙ্গে পথপার্শ্বের একটা সামান্য প্রস্তরখণ্ডের পারস্পরিক কোনো সম্পর্ক হওয়ারই কথা নয়, গণিত তো দূর-অস্ত্‌। তার ওপর সম্পর্ক নির্মাণেও তো নিদেন সময় লাগে – তখন অবধি কতোবারই বা গেছি শুক্রবারের সাপ্তাহিক পোদ্দারকোর্টের তিনতলায় বিকেল তিনটের অন্তর্বৃত্ত-আড্ডায় – ক্লাশের সবচেয়ে পিছনের বেঞ্চের উচ্ছিষ্টে এলেবেলে ছাত্রের মতো ঘাপটি মেরে পিট্‌পিট্‌ করে সামনের আলোকিত বৃত্তের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে বসে থেকেছি।

‘উইলো গাছেরা উঁচু হয়ে মাপে পাহাড়ী দীর্ঘতাকে –

তুমি কি তেমনি বড়ো?

আমি এইখানে হাড়গোড় ভাঙা সংকোচে জড়োসড়ো’ ...

আমার বাড়ি ও নিজস্ব স্থপতি-অফিস তখন হাওড়া শিবপুরে। তৎসহ ‘তিন নম্বর চোখ’-নামের ক্ষীণদেহী এক ফর্মা অফসেটে ছাপা সুন্দরী মাসিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে উন্মাদ পরকীয়া প্রেম। সেই সূত্রেই কবিতা ভিক্ষায় একদিন দুরুদুরু স্পর্ধিত বুকে পোদ্দারকোর্টের তিনতলা। ব্যাস, উজ্জল স্নেহহাসি এবং সিঙাড়া-চায়ে গরম আপ্যায়ন – ভীষণ ছোঁয়াচে আন্তরিক খোলামেলা গভীর সাহিত্য আড্ডামগ্নতা – ঝটপট আলাপ ও আত্মীয়তা হয়ে গেলো টগবগে আমার সমবয়সী নামী কবিদের সাথেও – চিত্তরঞ্জন, ধীমান, নাসের, রামকিশোর, অরুণাংশু সহ মঞ্জুষদার কাছ-বয়সি অনেক স্বনামধন্য কবিদের সাথেও। চাঁদের হাট।

সেই থেকে কর্মসূত্রে বা অন্য কোনো কাজে নদী পেরোলেই অমোঘ টান পোদ্দার কোর্টের, আমার কাছে তখন কলকাতার আরেক নাম পোদ্দার কোর্ট। অন্তর্বৃত্তের মধ্যে ঢুকে দেখলাম, রোজ রোজ সে বৃত্তের ব্যাস সোনার দামের মতো বেড়েই চলেছে, কারণ মঞ্জুষদার সম্ভবত কোনো পৃথক বহির্বৃত্ত ছিলো না, তাঁর বুকের মধ্যে ছিলো আস্ত পৃথিবীর মানচিত্র – তার বাইরে মহাশূন্য।

একটা গোটা প্রজন্মের পরমপিতা ছিলেন তিনি। আশ্রয়স্থল। আমি খুব দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, অসংখ্য তরুন কবি কবিতা নির্মাণ ধ্যানে বসতেন চোখ বুঁজে মঞ্জুষদাকে নৈবেদ্য সাজিয়ে – প্রতিটি শব্দ নির্বাচনে তাঁর আশকারা আর স্নেহের স্পর্শের অনুমোদন চাইতো নিঃশব্দে – ঐ সময়ে তো বটেই, এখনও তাঁর তিরোধানের এতোদিন পরেও অনেক কবিকে দেখি – যারা মঞ্জুষদাকে ঈশ্বর জ্ঞানে আজো মগ্ন সন্ন্যাসী। আমি এক শুক্রবার দুপুরবেলায় আমার অফিসে বসে ফোন তুলে তাঁকে সদ্যসদ্য লেখা একটি কবিতা শোনাই। ছোট্ট কবিতা। ‘নদী বললো – যদি ভ্রমণ হও/ তবেই হবো তোমার সহচরী/ আমি বললাম – রমণী যদি হও/ তোমার সঙ্গে কালাতিপাত করি।’ বিকেলে যথারীতি অন্তর্বৃত্ত আড্ডার মধ্যে হঠাৎ পাশে ডেকে নিয়ে ফিসফিসে বললেন – ‘ভ্রমণ’ নয়, ওটা ‘পর্যটন’ করে দাও। বড়ো সুন্দর স্পষ্ট উচ্চারণ করতেন মঞ্জুষদা। আমার ঐ কথার সূত্র খুঁজতে একটু সময় লেগেছিলো। এতোটাই উজাড় উপযাচিত অভিভাবকত্বের অকুন্ঠ উপদেশে আগলে রাখতেন আমার মতো পিছনের বেঞ্চের এলেবেলে ছাত্রকেও। ঘটনাটা সম্ভবত ২০০০ বা ২০০১ সালের কথা। আমারও বয়স তখন কুড়ি বছর কম। সত্যি বলছি, তাঁর এই আদেশ বা অনুরোধ আমি রক্ষা করতে পারিনি – হয়তো খারাপ ছাত্র বলেই। আমি ‘ভ্রমণ’ শব্দটা বদলাইনি। কুড়ি বছর পরে, এখন বুঝি ‘ভ্রমণ’ আর ‘পর্যটন’ শব্দ দুটির চরিত্রগত তফাত। এখন আফশোষ ছাড়া গতি নেই।

নতুন শতক শুরুর আগে আগে একদিন বিকেলে ট্যাক্সির মধ্যে কথায় কথায় শোনালেন কয়েকটা এক পংক্তির কবিতা। ‘পর্যটন যতটাই ঘরে থাকা ততটাই একান্ত জরুরি’ ‘কারো কারো কাছে অপেক্ষা মানে জানালা’ ‘পাথরের বুকের ওপর নারী ও জ্যোৎস্না এসে পড়ে’ ‘পৃথিবীর ভেজা গল্প গ্রীষ্মে মেঘ জমিয়ে রেখেছে’ ইত্যাদি - আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। বললাম – আমি স্কেচ করবো মঞ্জুষদা। আমার দিকে চেয়ে আদেশ করলেন – এই বইটা স্থপতি পল্লব তার ইচ্ছেমতো ডিজাইন করুক – পূর্ণ স্বাধীনতা দিলাম।

যেন সম্রাট শাহজাহান তাজমহলের নকশা বানাতে বলছেন!

বইটির উৎসর্গ পৃষ্ঠায় উনি আমার নাম লিখে পাঠিয়েছিলেন – এ আমার অহঙ্কার! আমার গৌরব!

বাঙলা আকাদেমির উঠোনে কাচ-স্বচ্ছ ঘরে শুয়েছিলেন মঞ্জুষদা – কারুর চোখে রূপকথার মতো, কেউ ভাবছিলো ‘তোমার জন্য জীবন নিলাম/ করেছি বলেই/ শুধু শূন্যতা বিনিময়ে দাও…/ হাত পেতে আছি দাও’ - আমার সেদিন মনে হয়েছিলো পিতামহ ভীষ্ম যেন শরশয্যায় শায়িত –উনি শুয়ে শুয়ে যেন দেখছেন চারপাশে কে কীভাবে অনুবাদ করছে এই শোকশব্দের পদাবলী। তাঁর প্রিয় অনূজদের থিকথিকে ভীড় – বহু চোখে সত্যিকার স্বজনহারানো বিষাদ, কেউ সোচ্চার কেউ বা নিভৃত নির্জন, কেউ কেউ মুখোশ খুলে শোকসাজে এসে দাঁড়িয়েছে, নামী কুমীরেরা তাঁদের নিজস্ব ছোটোছোটো অন্তর্বৃত্তে কান্নাকাটি করছেন - এ যেন তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যু – ফুলের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বন্ধ চোখে দেখছেন কবি মঞ্জুষ - শেষ মাঘের বিকেলে চারপাশের নিবিড় গাছেরা ঝরাচ্ছে পাতা, তারাও তো তাঁর অন্তর্বৃত্তের সদস্য, কবি মঞ্জুষের স্নেহধন্য – ‘গাছের গায়ে কখনো লিখবো না/ আমি তোমার নাম/ শব্দবিহীন রক্তপাতে গাছ/ দিতেও পারে গান্ধারীর শাপ/ সারাজীবন বাটালি ছুরি ছেনি/পাথরে কাটে/ নাম তোমার নাম/ এবং দেবে/ নিষ্প্রাণে যে প্রাণ/ এই তো অহং/ কিংবা অভিমান’

আলো কমে আসছে। শোকে সঙ্কুচিত হচ্ছে দিন। কাচঘর পিঠে শেষযাত্রার গাড়ি বাঙলা আকাদেমির গেট পেরিয়ে নন্দনকে বাঁয়ে রেখে রবীন্দ্র সদনের পাশ দিয়ে খই ছড়াতে ছড়াতে যেতে যেতে সমবেত যুযুৎসবঃ শুনতে পেলো সেই ঐশ্বরিক সুরবাহারের গুঁড়ো গুঁড়ো স্নেহ-সুর মাখা ফিসফিস কন্ঠস্বর তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্র পাঠ করছেন - 


প্রথামত

আমাকে দিও না গঙ্গাজল

গঙ্গায় গিয়েছে ভেসে আমার অজস্র ভাইবোন

যদি পারো

পরিশ্রুত জল ঠোঁটে দিও

দূষনে কার্বনে গেছে অপচয়ে সারাটা জীবন

কাঠের চিতায় নয়

বৈদ্যুতিক চুল্লিতে পোড়াও

আরেকটি গাছের মৃত্যু আমার মৃত্যুর সাথে সাথে

চাইতে পারি না।



গাড়ি অদৃশ্য হয়ে যায় আচার্য জগদীশ রোডে। ঝুপ অন্ধকার নামে। একটা হাড়-কাঁপা শীত এক এক করে আলোগুলো জ্বেলে দেয় বাঙলা আকাদেমি নন্দন চত্ত্বরে। সিনেমা শো ভাঙে, ফের শুরু হয়। গাছের তলায়, ঝোপের আড়ালে, ঝিলের পাড়ে যৌবন ঘনিষ্ঠ হয়, উপচে ওঠে – ‘...উত্তরসূরির হাতে অভিজ্ঞতা রেখে যেতে হয়’ - ধূপের গন্ধ ভারি হয়ে আস্তে আস্তে মিশে যায় আমন্ত্রণের কুয়াশাআড্ডায় -

... ‘জীবন বিপুল শব্দে মৃত্যুর নীরব হিম অনুবাদ করে’ ...



------------






সীমাশব্দ থেকে অসীম অন্তরীক্ষে
অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়


শব্দ নেই, নেই নদীও, সমুদ্রও নেই... 
পরিত্যক্ত সার সার নিঃসঙ্গ মন্দির
একাকিত্বের দিকে একাকিত্ব
অপলক চেয়ে আছে স্থির...

একাকিত্ব

নির্জন নয় আবার কোলাহলও নয় শুধু এক স্তব্ধতার আবহে রয়েছে এই সময়ের মানুষ, আশঙ্কা নিরুচ্চার উদ্বেগ, বিপদসীমা ছুঁয়ে রক্তের ওঠা নামা। নিসর্গের ঋতু সম্ভার দিয়ে সাজানো ভুবন রয়েছে জীবনের অপেক্ষায়। অন্যদিকে শূন্যতা প্রতি মুহূর্তে অস্তিত্বের গভীরে খেলা করছে মৃত্যুর প্রাত্যহিকতায়। অতিমারী আক্রান্ত অবসাদ ঘিরে রয়েছে মানুষের সত্তা মনন। পৃথিবীর এক গভীর অসুখে অস্তিত্ব সংকটে মানুষ। কিন্তু এক কবি যখন বলেন----
জীবন বিপুল শব্দে মৃত্যুর নীরব হিম অনুবাদ করে

আস্থা রাখি পৃথিবীর কোনো জরা মৃত্যু অসুখই স্পর্শ করতে পারে না কবিকে। গভীর মনোজগতে সুরক্ষার সৃষ্টি বলয় ঘিরে থাকে তাঁর শব্দের নির্মাণ। সময়ের প্রাসঙ্গিকতায় কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্তকে আর একবার ফিরে দেখা যেখানে তিনি শব্দ নির্মাণের মধ্যে দিয়ে অনন্ত হয়ে বাজতে থাকেন----

একটি দারুন শব্দ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণ
দূরতম অন্তরীক্ষ চকিতে দেখাবে
গোপন থাকবে না কিছু- নির্বাস প্রান্তর হবে তোমার হৃদয়।
শব্দ

ষাটের দশকের কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্ত। এই কবির সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন তাঁরা জানেন কী দারুন এক প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর কবিতাতে শব্দের চূড়ান্ত বুননে প্রকাশ পায়- মৃত্যু, জন্ম, প্রেম, প্রতিবাদ, অভিমান, নৈকট্য, মায়া, কৌতুক, অলীক, কল্পজগৎ, বাস্তব এবং পরাবাস্তব। মানুষ তার জটিল সম্পর্ক নিয়ে শব্দ নৈঃশব্দ্য- এ থাকে কবিতায়---

তবু এত সীমাশব্দ নিয়ে দিন যায়। শব্দকে অসীম করে দাও। আমি তা পারিনি।
সীমাশব্দ

এই অতৃপ্তিই সৃষ্টিশীল করে রাখে কবিকে। যে সৃষ্টি সমকালকে অতিক্রম করে চিরকালীন হয়ে থাকে মূর্ত বিমূর্ততায়। তাঁর উচ্চারণে পাই সময়ের এক অবাক চিত্র। পৃথিবীময় এখন একা থাকার তর্জনী নির্দেশ। এই একাকিত্ব আরোপিত। স্পর্শ বাঁচিয়ে সামাজিক দূরত্ব নির্দেশ যে জীবাণুরেণুকে প্রতিহত করতে, সেখানে মানুষ অজান্তেই হয়ে উঠল এক মানসিক একাকিত্বের নিষ্ঠুরতম শিকার।

তুমি কিছু বলতে চাও দেখবে কোনো প্রতিধ্বনি নেই
খামোশ পৃথিবী
সতর্ক মানুষ জানে চুপচাপ জীবনযাপন
স্বার্থপর মগ্নতার শরীরে উঠেছে উইঢিপি।
শেষছবি

এই যে সময় চিহ্ন রেখে গেল মানব সভ্যতার শরীরে --- স্বার্থপর অমানবিক হয়ে উঠল স্পর্শের বিভীষিকা, অণুসমান এক জীবাণুর কাছে পরমাণু বিস্ফোরণ বিজ্ঞান অক্ষম সময়ের সাক্ষি হয়ে দেখছে মৃত্যুর মহাকাতরতা। 
সেই বিজ্ঞানচেতনার তরঙ্গ যখন তাঁর কবিতায় - 'এই তরঙ্গ যায়/অণু পরমাণু কিংবা/কোয়ার্কের ভাঙা/ তাও কিন্তু ছুঁয়ে আছে পৃথিবীর ডাঙা...'

বিজ্ঞান অথবা গান মিথ্যে কথা বলতেই পারে না
স্থাপত্য অথবা কবিতাও।
ভুল ব্যাখ্যা মানুষেরা করে।
প্রেম
অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে সময়ের এক এক কালখণ্ডে কবিতার এক এক সত্য কখন যে চিত্রকল্পে অমোঘ হয়ে ওঠে।
আদ্যন্ত এক কবির পেলবতা সূক্ষ্ম রসবোধ তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তি নিয়ে মঞ্জুষ দাশগুপ্ত। অসাধারণ মেধা, স্মৃতিশক্তি, ও বুদ্ধির ঔজ্বল্য- এ তিনি ছুঁয়ে গিয়েছেন অগুনতি নবীন প্রবীণ কবি, গায়ক, শিল্পীর হৃদয় মন, তবুও অচেনা থেকে যান তিনি এক রহস্যময়তায়। 

কবি তো চির রহস্যময়। ঈশ্বরেরই মতো ভাব ও শব্দের সৃষ্টি রহস্যে নিমগ্ন থাকেন, কখনো কখনো নত হন ভালোবাসার কাছে, প্রেমের কাছে, প্রকৃতির কাছে এবং লিখে ফেলেন স্বপ্নাদ্য কবিতার লাইন---

তোমাকে ছুঁলেই খররোদে খুব বৃষ্টি হয়
সৃষ্টি হয় কবিতার অসমাপ্ত কয়েকটি চরণ
তখন আগুন নিভে মেঘপাতা ধূসর আকাশ
বিষণ্ন বাতাসে জানে সাদা হাঁস ছড়ায় পালক
ভালোবাসা লিখে যায় বৃষ্টিতে নিবিড় পরিচয়

ভালো আছো ভালোবাসা

প্রথা অনুযায়ী নয় তাঁর কবিতার ভাষা। শব্দের স্বকীয়তা কখনো মেদুর কখনো তুখোড় হয়ে স্বপ্নের দৃশ্যময়তায় কবিতা হয়ে ওঠে। 'ঐতিহ্যের অনুসরণ করতে করতে হয়তো ঐতিহ্যের বিস্তার ঘটে। ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে কোনো আন্দোলনই সার্থক হয় না।' তিনি এভাবেই বলেছিলেন ঐতিহ্যের প্রসঙ্গে। যখন তাঁর কবিতায় বাঁক বদল বা ভাষার নির্মাণ উচ্চকিত নয়, অথচ এক পরমাশ্চর্য ---

সেদিন একটিই ভাষা মানুষের। এক ধ্বনিমূলক থেকে।
এক কথাছবি।
বাবেল মিনারে আমি রেখে আসি আদিমতম ভাষা।
বাকরীতি বদলে দিতে হবে। ভাষামুদ্রা। শেষ প্রথা নাচ।
অভিবাসনের ডৌল পাল্টে নিয়ে জন্ম হল ভেদ ভালোবাসা।
শেষ ছবি

তাঁর কবিতায় পাহাড়ি নদীর গতিময়তা আছে যার গতিপথ স্বচ্ছন্দ অথচ পাথরে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ছোট ছোট ঘূর্ণি তৈরি করে এগিয়ে চলে তীব্র স্রোতে। অর্থাৎ প্রতিবাদী সমুদ্রের ঢেউয়ের প্রাবল্যের চেয়ে ঘূর্ণির সূক্ষ্ম প্রতিবাদ সেখানে থাকে---

ব্রাহ্মণ আসেনি পৃথিবীতে, এসেছে মানুষ
সবুজের রেখা নেই, তির তির কাঁপছে বাতাস
বরফের ভাপ উঠছে অনুভূতি তখনো ঘুমিয়ে
হামাগুড়ি দিতে দিতে ঢুকে পড়ছে ইগলুর ভিতরে...
ইতিহাস

মঞ্জুষ দাশগুপ্তকে রোমান্টিক কবি হিসাবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু তিনি যখন লেখেন --- 'আমি এক অচেনা ভাষালিপির জন্য/ অপেক্ষায় আছি'। সেখানে স্যুররিয়ালিজম, ক্লাসিসিজম, রোমান্টিসিজম যেন এক বিন্দুতে এসে মেশে----

এলিয়টি মাংসখণ্ড প্রিয় পাঠকের মুখে তুলে আমি এই নতুন রূপক
আমার গোপন বিশেষণ
রহস্য সূত্রের মতো রেখে যাচ্ছি সন্ধ্যার বাতাসে
যেমন পুস্পকরথে যেতে যেতে অলংকার খুলে
সীতা রাখে দিকচিহ্নগুলি
বালির উপরে থাকে পদচ্ছাপ সমুদ্র কুলে
কিছুক্ষণ সামান্য আভাসে
দিকচিহ্ন

তাঁর এই কবিতালিপি সরল না জটিল এই দ্বন্দ্বের উত্তরে তিনি বলেছিলেন --- 'সরল কবিতার দিন অস্তমিত বলেই মনে হয়, কেউ কেউ সরল কবিতা লেখেন আমিও লিখি তবুও তার আড়ালে এক রহস্যনদীর কথালিপি লেখা হয়'---
চুপচাপ। ভাঙাচোরা ঘর। অসমাপ্ত নদী। আকাশে সিঁদূর খেলা। কৃষ্ণচূড়া জানে।
একা এসে বসে থাকি। বাতাসের হারমনিয়ামে রাগাশ্রয়ী গান। ইতিহাস দ্বন্দ্ব সমাসের কথা কোনোদিন এখানেই লিখেছিল।
সময় গিয়েছে ছুটে নীল চোখ হরিণের পায়ে।
দম শেষ পুতুলের মতো চারদিক ঠান্ডা হয়ে আছে।
ভাঙাচোরা ঘর। অসমাপ্ত নদী ভিতরে ভিতরে।
ইতিহাস

অসমাপ্ত নদীর ভিতর কবির রহস্যলিপিতে ধরা থাকে যে সময়ের অসুখ, তাই নিরাময়ের ভাষালিপি হয়ে ওঠে এই সময়ের 'এক' মানুষের কাছে---
কারো নিঃসঙ্গতার উট হয়ে মরুভুমি পার করে দিতে পারি না
কে কি পারে।
এস একাকী মানুষ তোমার মুখে জন্ম দাগের মতো বিষণ্ন নৈঃশব্দ্য
দেখি। দেখি না- ঘুম রাতের কোটরে বয়স চোখ আর
বাতাসের মতো অদৃশ্য আকাঙ্ক্ষার বোবা গান...
ভিতর

অসামান্য এক আত্মকথা 'পটুয়ার বিমূর্ত শিল্প' বইটিতে মঞ্জুষ দাশগুপ্ত লিখেছেন ---- 'শব্দ দিয়ে শুধু ছবি আঁকি। সব ভাঙাচোরা অসমাপ্ত ছবি। ভাঙা বলেই কি এরা বিমূর্ত? অসমাপ্ত বলেই কি এরা আবছায়া?'

অন্ধকারে ভাষাশব্দ আলোকথা লিখে লিখে ভোর ডেকে আনে আমাদের সামান্য বাগানে
গুহালিপি

শব্দ- নৈঃশব্দ্যের মাঝে এভাবেই তিনি কবিতা বাগানে রেখে গিয়েছেন আলোছায়ার দিকচিহ্ন, যার হিরন্ময় দ্যুতিতে আগামীর পথচিহ্ন... 


---------------------------------



আমার বাবা শ্রী মঞ্জুষ দাশগুপ্ত

মণীষ দাশগুপ্ত


অন্ধকার ঘরের জানালার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে এক ছায়ামূর্তি। সেই ছায়া কোথায় যেন ভেঙ্গে যাচ্ছে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে চোখ। চশমাটা টেনে নামালেন। গেঞ্জিটার হাতা দিয়ে চোখ মুছলেন যেন। এই সব মুহূর্তে কিছু বলা চলে না। আমি এবং মা দুজনই নির্বাক। আমাদের ভিতরে তখন নীরব অশ্রুপাত। কিছু আগে ডাক্তার বাবুর Lake Road এর chamber এ একটি পরিবার বসে। আত্মবিশ্বাসী কিছুটা শঙ্কিত। ডাক্তার বাবুর ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সম্মিলিত আত্মবিশ্বাস ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। Rectal tumor (মলদ্বারের টিউমার) শব্দটি যেন ভয়ঙ্কর কোন আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত লাভা। সেটা 2001 সালের September মাস। রক্ত পরীক্ষা, Biopsyর পথ ধরে Colorectal Adeno Carcinoma সেই আনন্দময় মানুষটাকে বারবার আঘাত করছিল। ঈশ্বরের এই নিষ্করুণ দয়াহীন দান কিছুতেই নিতে পারছিলাম না।

এমন তো হবার কথা ছিল না। সব ওলট পালট হয়ে গেল যেন। খুব ছোটবলায় কোনওদিন যদি সামান্যতম চোট পেতাম, বাবার জন্য অপেক্ষা করতাম সঠিক শুশ্রূষা পাওয়ার জন্য। মা বলেন এমন কি বাঁহাতের আঙুলে চোট পেলে সারাদিনের পরে বাবা এলে ভুলে গিয়ে ডান হাতের আঙুল তুলে দেখাতাম। বাবা একটু হাত বুলিয়ে দিলে শান্তি হত।

বাবা যখন বিদেশ গেলেন, তখন আমার দুই বছর বয়স। শুনেছি Airport-এ বাবা আমাকে একটাকার একটা নোট দিলে তা ছিঁড়ে ফেলে এই ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। চমকে উঠে আরো আদর করেছিলেন বাবা।

একটু বড় হতে school-এ ভর্তি হলাম। সে সব ছিল আমাকে বড় করার সংগ্রামের দিন। বাবা কখনো সখনো school-এ নিয়ে গেলে সারা রাস্তা আমাকে দিয়ে ইংরেজী সাইনবোর্ড পড়াতেন। আর অনর্গল ছড়া বলতেন। আমিও শিক্ষিত হতে না চেয়ে চুপ চাপ বাবাকে চিমটি কেটে দিতাম। এখন বুঝি চলন্ত গাড়ির জানালার বাইরে তাকালে এত শব্দ কেন বুঝতে পারি না। কারণ বুঝিয়ে দেওয়ার মত কেউ তো আর নেই। সব কিছু এখন নিজেকেই বুঝে নিতে হয়।

পরীক্ষার সময় বাবা অভয় দিতেন এটা বলে যে পাশ করলেই চলবে। নিজে কখনো school-এ দ্বিতীয় হননি। আমার অহং বোধে লাগত। চেষ্টার মাত্রা বেড়ে যেত মোটামুটি ভাল ফলাফল করার জন্য। এটা এক ধরনের অনুপ্রেরণা এবং খুবই দরকারি বলে আমার মনে হয়।

কেউ কি ভাবতে পারে B.A. পরীক্ষার হল অবধি বাবা আমাকে পৌছে দিয়েছেন কাঁধে হাত দিয়ে? Presidency College এ সীট পড়েছিল। বাবা সেই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। পুরনো কলেজে ঢুকে তাঁর চোখে মুখে একটা আনন্দের আভা দেখতে পেলাম। আমায় সব কিছু চিনিয়ে দিচ্ছিলেন। ঠাকুরদাদা তখন মেদিনীপুরে posted. বাবা অর্থনীতি নিয়ে Presidency College-এ পড়বার সুযোগ পেয়েছিলেন। ধুতি পাঞ্জাবী পরে কলেজ করতেন। এই জন্য বন্ধুমহলে কম হেনস্থা হতে হয়নি তাঁকে। কিন্তু তাঁর অৰ্থ সংস্থান ছিল না প্যান্ট শার্ট তৈরী করে পরবার। অবশ্য সহৃদয় বন্ধুর সংখ্যাই বেশি ছিল। তারাই তাঁকে আড়াল করে রাখতেন। ভালোবাসা সর্বত্র ডানা মেলে থাকে বিষণ্ণ সময়কে ঢেকে রাখবে বলে।

বাবা কৃতি ছাত্র ছিলেন নিঃসন্দেহে এবং দুবার WBCS পরীক্ষায় সফল হন। কিন্তু ঠাকুরদাদা চাননি বাবা স্টেট এক্সাইজ-এর চাকরিটা করেন। বাবা এমন কি IAS পরীক্ষার interview দিতে গিয়েছিলেন ধুতি পাঞ্জাবী পরে এবং এই একটি কারণে তাঁকে তীব্র ভর্ৎসনার সামনে পড়তে হয়। মানুষকে না বুঝে তার পোষাককে গুরুত্ব দেওয়ার এই ঔপনিবেশিক মানসিকতা আজও বেপরোয়া ভাবে বর্তমান। তবে বাবা নগরায়ণ দপ্তরের প্রচুর পরিকল্পনায় নিজস্ব ছাপ ছেড়ে গেছেন।

ফরাসী ভাষাটা তিনি খুব ভালো করে শিখেছিলেন। কারণ তিনি ফরাসী সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। অনেক কবিতার অনুবাদ তিনি করে গিয়েছিলেন যা পরবর্তীতে সমাদর পায়। TV Monde বলে যে ফরাসী চ্যানেলটা ছিল, তা খুব কাছে বসে শোনবার চেষ্টা করতেন যাতে ভাষাটা আরো ভালো করে রপ্ত হয়।

আমি একবার বাবাকে জন্মদিনে writing pad ও কলম উপহার দিয়েছিলাম। তাতে তিনি এত উল্লসিত হয়েছিলেন যা আগে কখনই দেখিনি। সেই মায়া কলম দিয়ে প্রায় সারারাত কত কিছু লিখেছিলেন। আমি চাকরি পাওয়ার পর শিলিগুড়িতে পোস্টিং পাই। বাবা আমার কাছে প্রায়শই চলে যেতেন। একবার রাত সাড়ে তিনটায় আমার মিলনপল্লীর quarter-এর দরজায় করাঘাত। আমি ধড়মড় করে উঠে দেখি বাবা দাঁড়িয়ে! বললেন, বালুরঘাটে কবিতা পাঠ অনুষ্ঠান শেষ করেই বাস-এ চেপে শিলিগুড়ি। জলপাই মোড়ে নামিয়ে দিয়েছে বাস। তারপর প্রায় দেড় কিলোমটার রাস্তা পায়ে হেঁটে মিলনপল্লী। কপাল ছুঁয়ে দেখলাম জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। নিজেই গরম জল করে স্নান করলেন। চা খেলেন। ওষুধ খেলেন। তারপর alarm set করে ঘুমোতে গেলেন। শোবার আগে বললেন কাল সকালে গাড়ী ভাড়া করবি, দার্জিলিং যাবো। আমি মৃদু স্বরে প্রতিবাদ করতে গিয়ে দেখলাম ততক্ষণে তিনি ঘুমে কাদা। তাঁর শান্ত, প্রসন্ন মুখচ্ছবি দেখে বড় মায়া হল। পরের দিন আমরা সত্যি দার্জিলিং গেলাম। Kurseong Tourist Lodge-এ চা, পকোড়া খেয়ে হঠাৎ দেখি উধাও হয়ে গেলেন। খুঁজে পেলাম পাশের একটি বাড়ীর বাগানে। সেখানে একটা ছোট্ট জমায়েত তখন। আর বাবা তাদের রবীন্দ্রনাথের কবিতা শোনাচ্ছেন। দার্জিলিং পৌঁছে ঘোরতর বিপত্তি! সবাইকে তাঁর অদ্ভুত ভুল হিন্দীতে জিজ্ঞেস করছিলেন "Rhododendron কহা ফুটতা হ্যায়।" উত্তর পাচ্ছিলেন "হুন্দাই নহ", "মালুম নেহি" এমন কি "জানি না"ও। একজন বললেন এটা তো October মাস। এখন Rhododendron ফোটে না। February মাসে এই ফুল পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় ফোটে। বিশেষ করে সিকিমে। পরের বছর বাবাকে এই ফুল দেখাতে পেরেছিলাম।

বাবাকে নিয়ে মুম্বাই উড়ে গেলাম সুচিকিৎসার জন্য। Lower Parel এ Tata Cancer Hospital. আমাদের বাসস্থান কোলাবায় বাবার কলেজ এর বন্ধু আমল সাহার বাসায়। তিনি অকৃতদার এবং ভীষণভাবে বন্ধুবৎসল। আমাদের Airport থেকে বাড়ী নিয়ে এলেন। প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই মানুষটি রোজ অফিসের পরে রূপসী আরব সাগরের পাড় ধরে তিন কিলোমিটার ছুটতেন। হাসপাতালের দীর্ঘ পথ আমরা রোজ taxiতে অতিক্রম করতাম। হাসপাতালে প্রচণ্ড ভীড়। বাবার ডাক্তার শ্রী পারুল শুক্লা বাবার কষ্ট শুনলেন মনোযোগ দিয়ে। নানা টেস্ট করতে বললেন। কারণ, উনি একটি ছোট্ট সার্জারি করবেন। অনেক দিনের চেষ্টার ফলে হাসপাতালে ভর্তি ও সার্জারি। তারপর কলকাতায় chemotherapy ও radiotherapy। এ সব নিয়েও কিন্তু বাবা অফিস বজায় রাখতেন। কারণ, অফিসে চলতো রোজ বিকেলে নির্ভেজাল সাহিত্য আড্ডা। হৃদয়ের আরাম পেতেন। দেখতাম বসতে কষ্ট হত বলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কবিতা লিখতেন। ক্যান্সার ক্রমে হাড়ে ছড়াচ্ছিল। ডান হাতটা প্রায় বিকল হয়ে গিয়েছিল। বাঁ হাত দিয়ে ডান হাত টাকে ধরে লিখে চলতেন। কি অসীম মানসিক শক্তি! হার না মানা এই প্রাণবন্ত মানুষটা একদিন চলে গেলেন। অনেক যন্ত্রনা নিয়ে, অনেক কিছু না বলে। আজও সেই ফুরিয়ে না যাওয়া কথাগুলো শুনতে চাই। জিজ্ঞাসা করতে চাই... "বাবা, তুমি কেমন আছো?" মহাশূন্যে তারাদের মাঝে হারিয়ে যায় আমার প্রশ্ন। সেই সব না শেষ করে যাওয়া কবিতার পংক্তির মত।

"অধুরা কাজের স্তূপ সাঁচির দরজার দিকে বিপন্ন তাকায়।"

------------




ভাবনার ভাঁজ খুলে

রামকিশোর ভট্টাচার্য



এখনো আচ্ছন্ন রাখে পোদ্দার কোর্ট ৷ কলম

ছবি আঁকে মুখস্থ সময়লিপির ৷ কত রঙ যে

পাল্টে যাবে খোলসের ভিতর ৷ অক্ষর খুঁটে

চলে যাওয়া পায়রাদের অনেকেই ফিরবে না

আর ৷ এখন ভাবনার ভাঁজ খুলে উড়ে যায়

পরিচিত দুপুর ছবিরা ৷ মনখারাপের দূরে -

ঝিরঝির হাওয়া, অন্ধকার অন্ধ নয় বলে

পাশ কাটিয়ে যায় কেউ ৷ দিব্যি গড়ায় রাস্তা ৷

কিভাবে পূরবীকথা বাজে ইচ্ছেদের পাশে ,

চোরাগোপ্তা ইঙ্গিতে দুগ্ধপাত্র মসিময় হয়ে ওঠে

এসবই বুঝতে শেখালো দ্য মূরের গেলাস ৷

চারপাশে

ভক্তির লালায় ভরিয়ে দেওয়া ভোররাতের আমেজ

দেখে হাসতে হাসতে উল্টে যায় চেয়ার ৷

ছয় বাই ছয় ঘরের ইতিহাস লিখে টাঙানো হয়

অজুহাতের সামনে ৷ এসময় একঘেয়ে চিত্রকল্প কাটিয়ে

বলে উঠি - মঞ্জুষদা সাদা এত গ্রন্থিময় হয়...







স্বপ্নভূমির মঞ্জুষদা, মঞ্জুষদার স্বপ্নভূমি…

কুমারেশ চক্রবর্তী



স্বপ্নভূমির বিষয়বস্তু কি হতে পারত ?

কি হতে পারেনি---

সেসব নিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য বা যুক্তিগ্রাহ্যহীন ভাবনা

মাথার মধ্যে ভিড় করেনি অযথা !

স্নেহ নিম্নগামী বলেই হয়তো বা

আপনার প্রশ্রয়ে সঞ্চিত সাহসেই লিখিয়ে নিয়েছি---

স্বপ্নভূমি…

শহরে জমে ওঠা হরেক কেচ্ছার রঙ-বেরঙের ধুলো---

ধূলিমলিন ধূসরতায় জীবনের প্রতিটা পর্যায়ে

দুঃস্বপ্ন ঢুকে এসে দাদাগিরি করে ! 

সেই স্বপ্নে রচিত ভূমি কিন্তু আজও

ভাষা কিংবা দিক বদলের অজুহাতে

অন্য হাতে গিয়ে ওঠেনি,

সেই স্বপ্নে রচিত জীবন ও মৃত্যু

কোনও রাজনৈতিক মধ্যপন্থায়

আমাদের ভেতরেও দূরত্ব তৈরি করেনি---

পোদ্দার কোর্টের তিন নাম্বার গেটের তেতলায় 

আপনার ওই ছোট্ট অফিসে কী জীবন্ত এখনও--- 

স্বপ্ন ও ভূমির সখ্য !

ধীমান, চিত্ত, রামকিশোর, অরুণাংশু, তাপস, আমি

মাঝেমধ্যে কবিতার আড্ডায় ফিরি সেখানেই…







অবিনাশী স্বর

নমিতা চৌধুরী



অক্ষরের চিহ্নরূপ একটু একটু করে

পেরিয়ে যায় আকাশ সীমানা

ফেলে যাওয়া রঙিন পালকগুলি

নিজস্ব নিয়মে তুলে আনে

ছোট ছোট ঢেউকথা

চরাচর জুড়ে মুদ্রা এঁকে দেয় নোনা জল

জেগে উঠেছিল জীবনের যে একমাত্র শ্লোক

তার তন্তুতে, প্রতিটি পাতায় কাঁপে অবিনশী স্বর

খুঁজেছিল শিকড়ের ডানা

নিবিষ্ট খনন মাঝে মাঝে স্তব্ধতা ভেঙে

বড়ো কাছে এসে দাঁড়ায়

ডেকে ওঠে সহজিয়া গানে।

1 comments:

0

someপ্রতীক - রীতা পাল

Posted in






এবারের someপ্রতীক যেদিন লিখতে বসেছি, সেদিনের যে খবরটি মনকে নাড়া দিয়ে গেলো, সেটি হলো – ধর্ষণ। দুই নাবালিকা বোনকে বাড়ি থেকে কয়েকজন তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে, যার মধ্যে একজন নাবালকও ছিলো। দুই বোন বাড়ি ফিরে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বড়ো বোন মারা যায়। ছোটো বোনের জবানবন্দীতে নাবালক সহ কয়েকজন ধরা পড়েছে।

ধর্ষকদের ব্যবস্থা যা করার, আইন করবে। আমার প্রশ্ন – দুই নাবালিকার আত্মহত্যার চেষ্টা নিয়ে। ধর্ষণ তো অনেক হলো, শাস্তিও বেশ কিছু। বদল ঘটলো কি কিছু?

নারী হিসেবে, মা হিসেবে মনে হচ্ছে, মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু ভুল থেকে যাচ্ছে না তো? প্রাণ ফিরে পেয়েও তারা ‘প্রাণ’কেই সবচেয়ে বড়ো পাওয়া বলে ভাবতে পারছে না কেন? আমরা কেন তাদের শেখাতে পারছি না – তোমার একমাত্র পরিচয় – তুমি নারী। ধর্ষিতা নয়। অপরদিকে যারা ধর্ষক, তারা কখনোই পুরুষ নয়। তারা ধর্ষক। 

‘ধর্ষণ’ একটা দুর্ঘটনা ছাড়া কিছুই নয়। এটা এমন একটা দুর্ঘটনা, যা কেবল মেয়েদের জীবনেই ঘটে। ঘরে থাকলেও ঘটতে পারে। কোনো কোনো মেয়ের জীবনে একাধিকবারও ঘটতে পারে। লজ্জা তার নয়, সমাজের। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবর্তন না আনতে পারলে ফোটার আগেই কিন্তু অনেক কুঁড়ি ঝরে পড়বে।

মেয়েদের আত্মরক্ষা শেখানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে – খুব ভালো কথা। কিন্তু মনোজাগতিক পরিবর্তন না হলে সে শিক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

0 comments:

1

someপ্রতীক - সুমিকমল

Posted in

ঋতুপর্ণ ঘোষ এমন একজন মানুষ যে  তাঁর সম্পর্কে লেখা খুব সহজ কাজ নয়, আমি জানিনা আমি ওনাকে নিয়ে লেখার জন্য যোগ্য মানুষ কিনা, যখন ঋতবাকের তরফ থেকে আমাকে লিখতে বলা হয় মনে মনে একটু দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে ছিলাম কিন্তু এই প্রিয় পরিচালক নিয়ে লিখতে হবে মনে করে বেশ খুশিও হয়েছিলাম। গত 31st আগস্ট তার জন্মদিন ছিল সুতরাং সেই কথা মাথায় রেখেই ঋতবাকের  সবিনয় শ্রদ্ধার্ঘ রইল এই মহান পরিচালকের প্রতি। 1963  31st আগস্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ ঋতুপর্ণ ঘোষ। মাত্র 49 বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। হীরের আংটি নামক চলচ্চিত্র টি তিনি প্রথম পরিচালনা করেন, ছবি করার ক্ষেত্রে তার অনুপ্রেরণা হলেন বিশ্ববরেণ্য পরিচালক স্রী সত্যজিৎ রায়।এই কথা তিনি অকপটে বলেছেন ও লিখে গেছেন অনেক পত্র পত্রিকায়। 

খ্যাতির মধ্যগগনে থাকতে থাকতেই হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন উনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।

এক অদ্ভুত শূন্যতার সৃষ্টি  হলো আজকের সিনেমা জগতে। যাত্রা শুরু হীরের আংটি দিয়ে এবং শেষ হলো তা চিত্রাঙ্গদায়।

টলিউড ও বলিউডের অনেক নামি দামি শিল্পীদের নিয়ে উনি কাজ করেছেন,খুব অনায়াস ভাবে।

ঋতুপর্ণ ঘোষ কে  ঘিরে মানুষের ছিল অনেক কৌতূহল ,কিন্তু তিনি ছিলেন অসম্ভব স্বাধীন ও দৃঢ়চেতার মানুষ, 

যে কোনো সাক্ষাৎকারে তিনি ছিলেন একেবারেঅকপট।যা বলতেন তা তার অন্তরের বিশ্বাস থেকে বলতেন। তিনি বাঙালি সাবেকি রান্না খেতে খুবই পছন্দ করতেন।

একবার সৌভাগ্যবশত আমার ওনার বাড়ি যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল,সে ই বাড়িতে যেমন ছিল অজস্র বই, আর ছিল অজস্র সিনেমার ডিভিডি, 

এম এল এ ফাটা কেষ্ট  থেকে শুরু করে স্টিফেন স্পিলবার্গ এর ছবি কিছুই বাদ নেই।

এমন কাব্যময় গৃহ আমি আগে কখনো দেখিনি।উনি তেমন মানুষের সাথেই আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন  যাদের সঙ্গে তার সুক্ষবোধ মেলে।

কাজের বিষয় ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও শ্রদ্ধাশীল।তার অধিকাংশ ছবি  নয় জাতীয় না হয় আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন।

বড় অসময় চলে গেলেন এই প্রতিভাধর মানুষ টি ,না জানি তার ঝুলিতে আরো কত পুরস্কার জড়ো হতে,আর আমরা বাঙালিরা গর্বে ভয়ে উঠতাম।

তিনি এই সময়ের মধ্যে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন উচ্চমানের এগারটি ছবি। আর তার কোনো ছবির শুভমহরত হবেনা কিন্তু আবহমান ধরে চলবে তার হিরের আংটি থেকে চিত্রাঙ্গদা কে নিয়ে এই সফরের কাহিনী নিয়ে আলোচনা।

আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তোমাকে অকুন্ঠ শ্রদ্ধা জানাই ,আর চাই দীর্ঘায়ু নিয়ে আবার ফিরে এসো এই বাংলায় আমরা সমৃদ্ধ হই তোমার সৃষ্ঠ শিল্প কে চাক্ষুষ দেখে।

1 comments: