প্রবন্ধ - সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
রক্ত ও রক্তদান- কিছু সাধারণ কথা
সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৬১৬ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম হার্ভে বুঝিয়েছিলেন মানবদেহে রক্ত সঞ্চালনের ক্রিয়াপদ্ধতি। তারপর কেটে গিয়েছে তিন শতাব্দী। লোকে যুদ্ধ দেখেছে, হানাহানি দেখেছে, দেখেছে রক্তক্ষয়। বুঝেছে রক্তের উপর মানুষের নির্ভরতা। চেষ্টা চলেছে কুকুর, ভেড়া এমনকি মানুষের শরীর থেকেও রক্ত নিষ্কাশন করে অন্য মানুষকে দেওয়ার। বলাই বাহুল্য, এগুলো অত্যন্ত crude method বলেই বিবেচিত হয়েছিল, সেকালেও--- এর মধ্যে ১৮১৮ সালে ডাক্তার জেমস ব্লান্ডেলের সরাসরি মানুষের শরীর থেকে রক্ত নিয়ে এক রক্তশূন্য প্রসূতিকে বাঁচানোর ঘটনাটি প্রণিধানযোগ্য।
অবশেষে, বিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায়, ১৯০১ সালে অস্ট্রিয়ান প্যাথোলজিস্ট ডাক্তার কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার আবিষ্কার করলেন ব্লাড গ্রুপ--- যাকে আমরা ABO system বলে অভিহিত করি। যদিও নেগেটিভ না পজিটিভ গ্রুপ, তা জানতে কেটে গেল আরো উনচল্লিশটা বছর। ১৯৪০ সালে ল্যান্ডস্টাইনার, ডাক্তার আলেকজান্ডার ওয়াইনারের সঙ্গে যৌথভাবে আবিষ্কার করলেন Rh factor, অর্থাৎ রক্তের গ্রুপ পজিটিভ না নেগেটিভ, তার নির্ণয় করা সম্ভব হলো। Blood transfusion এর ক্ষেত্রে ঘটে গেল নিঃশব্দ বিপ্লব!
এর পরেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ সালে কলকাতায় চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউএর অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথে, ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস সোসাইটির দ্বারা পরিচালিত ভারতবর্ষের প্রথম ব্লাডব্যাঙ্ক স্থাপিত হলো।
রক্ত মূলত দুই কারণে প্রয়োজন হয়। প্রথমত, আপৎকালীন বা ইমার্জেন্সি অবস্থায়, যেমন প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ, অপারেশন টেবিলে অথবা অপারেশনের অব্যবহিত পরেই কোনো শিরা বা ধমনী থেকে রক্তক্ষরণ(ম্যাসিভ হেমারেজ), পথ দুর্ঘটনা, অস্ত্রক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ(স্ট্যাব ইনজুরি বা বুলেট ইনজুরি), শরীরের কুড়ি শতাংশ বা তার বেশি পুড়ে যাওয়া, অকস্মাৎ রক্তবমি বা রক্ত পায়খানা, ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়ার মতো কিছু সংক্রমণ ইত্যাদি।
আর, দ্বিতীয়ত, রক্ত লাগে কিছু নন ইমার্জেন্সি অবস্থায়, যেমন কোনো পরিকল্পিত অপারেশন--- হার্টের বাইপাস অপারেশন, থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের অপারেশন, জরায়ু বাদ দেওয়ার অপারেশন, ভাঙা হাড় জোড়া দেওয়ার অপারেশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে--- এবং বিভিন্ন রক্তঘটিত রোগের ক্ষেত্রে, যেমন, থ্যালাসেমিয়া, লিউকেমিয়া, অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া, হিমোফিলিয়া ইত্যাদি রোগের সঙ্গে যুদ্ধে।
প্রতিটি রোগীর আত্মীয়ের কাছেই তার রোগীর অবস্থা সবচেয়ে জরুরী বা ইমার্জেন্সি--- আমি শুধু চিকিৎসকের দৃষ্টিতে আপৎকালীন এবং আপৎকালীন নয়, এমনভাবে ভাগ করে দিলাম। যদিও অবস্থাগতিকে তারতম্য থাকবেই, ব্যতিক্রমও থাকবে, কিন্তু সেটা অন্য কোনো বিস্তারিত আলোচনার জন্য তোলা থাক।
এবার আসা যাক রক্তদানের কথায়।
কারা রক্তদান করতে পারেন? ১৮ বছর বয়সের উপরে এবং ৬৫ বছর বয়সের নীচে যে কোনো ব্যক্তি--- পুরুষ, মহিলা নির্বিশেষে, রক্তদান করতে পারেন।
রক্তদান করতে গেলে শরীরের ওজন কমপক্ষে ৪৫ কেজি হতে হবে। একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষের শরীর থেকে কেজি প্রতি আট মিলিলিটার পর্যন্ত রক্ত সংগ্রহ করলে তাঁর কোনোপ্রকার ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না।
একবার রক্তদান করলে তিনমাস পর্যন্ত আর রক্ত দেওয়া যায় না। তারপর আবার দেওয়া যায়। একজন সুস্থ মানুষ বছরে চারবার রক্ত দিতে পারেন।
বিগত একবছরের মধ্যে জন্ডিস বা টাইফয়েড আর ছয়মাসের মধ্যে ম্যালেরিয়া হয়ে থাকলে রক্ত দেওয়া যাবে না।
জলাতঙ্ক বা হেপাটাইটিস বি টিকা নেওয়ার একবছরের মধ্যে রক্ত দেওয়া যাবে না।
কোনো বড় অপারেশনের একবছরের মধ্যে এবং ছোটখাটো সার্জারি, যেমন দাঁত তোলা, ফোড়া কাটা ইত্যাদির ছয়মাসের মধ্যে রক্ত দেওয়া যাবে না।
ব্লাডসুগারের রোগী যদি ইনসুলিন নেন, রক্ত দেবেন না। যদি খাওয়ার ওষুধ খান, আর ব্লাডসুগার নিয়ন্ত্রিত থাকে(অবশ্যই সাম্প্রতিক রিপোর্ট সঙ্গে রাখবেন), রক্ত দিতে বাধা নেই।
ব্লাডপ্রেশার নিয়ন্ত্রিত থাকলে রক্ত দেওয়া যায়, তবে ১৪০/৯০ এর ঊর্দ্ধে থাকলে রক্তদান করা অনুচিত।
কিছু কিছু রোগ থাকলে কখনোই রক্তদান করা উচিৎ নয়, যেমন হাঁপানি, মৃগী, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, হার্টের অসুখ, কিডনি বা থাইরয়েডের অসুখ, সিজোফ্রেনিয়া, ক্যানসার ইত্যাদি থাকলে রক্তদান করবেন না।
মহিলারা ঋতুচক্র চলাকালীন রক্ত দিতেই পারেন, যদি হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ঠিক থাকে।
গর্ভপাতের ছয়মাসের মধ্যে, আর প্রসবের একবছরের মধ্যে রক্ত দেওয়া যায় না। সন্তানকে স্তন্যপান যতদিন করানো হয়, ততদিন রক্ত দেওয়া যায় না।
অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে খেতে রক্ত দেওয়া যাবে না। ওষুধ বন্ধ হওয়ার ৭২ঘন্টা পরে দাতা রক্ত দিতে পারেন। সম্ভাব্য দাতা সবসময়ই ওষুধের প্রেসক্রিপশন সঙ্গে রাখবেন।
রক্ত দেওয়ার আগে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। ১২ থেকে ১২.৫ গ্রাম/ডেসিলিটার থাকলে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিক বলে ধরা হয় আর রক্তদাতা নির্বিঘ্নে রক্ত দিতে পারেন।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে, রক্তদান কত রকমের হতে পারে?
পাড়ায় পাড়ায়--''স্বেচ্ছা রক্তদান শিবির''--এর ফেস্টুন বা ব্যানার দেখেননি এমন মানুষ বিরল।
প্রখ্যাত রসসাহিত্যিক তারাপদ রায়, তাঁর রম্যবচনার সংকলন 'কান্ডজ্ঞানে' লিখেছিলেন, রক্তদান কি করে স্বেচ্ছায় ব্যতীত অন্যভাবে হতে পারে? দান, বিশেষত তা যদি রক্ত হয়, সেটা 'স্বেচ্ছা'য় না হয়ে অনিচ্ছায় হলে তো ভয়ানক ব্যাপার!
একটু বিশদে বলি।
Donation কথাটার বাংলা হলো দান। তাই, মানুষের শরীর থেকে,তার অনুমতি নিয়ে রক্ত নিষ্কাশন করা হলেই সেটা 'দান'। এবার, যদি কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই, এই দান করতে কেউ রাজি থাকেন, তাহলে তাঁকে voluntary donor বা স্বেচ্ছা রক্তদাতা বলে অভিহিত করা হয়।
আর যদি কোনো ব্যক্তি তাঁর কোনো আত্মীয় বা স্বজনবন্ধুর জন্য ব্লাডব্যাঙ্ক থেকে রক্ত নিতে এসে, এক ইউনিট রক্ত বা রক্তের কোনো উপাদানের বিনিময়ে রক্তদান করেন, তাঁকে বলা হয় replacement donor বা বিনিময়কারী রক্তদাতা। ব্লাডব্যাঙ্কের বাইরে আয়োজিত বিভিন্ন শিবিরে, কোনো বিনিময় ছাড়াই যাঁরা অচেনা অজানা মানুষের উপকারে লাগবে বলে মনের তাগিদে রক্তদান করেন, সেই স্বেচ্ছা রক্তদাতারাই যে কোনো ব্লাডব্যাঙ্কের মেরুদণ্ড।
এখানে একটা কথা বলা হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না, যে ভারতবর্ষে professional blood donation বা পেশাদার রক্তবিক্রয় কিন্তু ১৯৯৮ সালের ১লা জানুয়ারি থেকেই মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আদেশে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে।
আজকাল শিবিরগুলোয় রক্তদাতাদের আকর্ষণীয় উপহারসামগ্রী দেবার চল হয়েছে। কিন্তু নিয়মমাফিক, একটি ছোট টিফিনের প্যাকেট, সুদৃশ্য ব্যাজ এবং রক্তদানের সার্টিফিকেট ছাড়া, রক্তদাতাদের আর কিছু দেওয়া নীতিবিরুদ্ধ।
পশ্চিমবঙ্গে রক্তদান আন্দোলনের গোড়ার থেকে এই মহীরূহে যাঁরা অক্লান্তভাবে জলসেচন করে আসছেন, সেই অসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি, West Bengal Voluntary Blood donor's forum বা Association of Voluntary Blood donors কিন্তু কোনো উপঢৌকন বা উপহারের বিনিময়ে রক্তদানের তীব্র বিরোধিতা করে থাকেন।
আবার, এটাও লক্ষ্যণীয় যে, বিনা incentiveএ অধিকাংশ শিবিরেই দাতা দুর্লভ হয়ে ওঠেন। এ-ও দেখেছি, পাশাপাশি পাড়ায় দু'টি রক্তদান শিবির অনুষ্ঠিত হলে, যে উদ্যোক্তারা বেশি দামী উপহার দিচ্ছে, তাদের ক্যাম্পেই ভিড় বেশী হয়ে থাকে।
'দিবে আর নিবে' মন্ত্রজপা বর্তমান স্বার্থপর সমাজে, প্রকৃত স্বেচ্ছা রক্তদানের সামাজিক সচেতনতাটুকু এখনো সেভাবে গড়ে তুলতে পারেননি গণআন্দোলনের কর্মীরা--- এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়।
আরো একটা বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে চাই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা রক্তদান আন্দোলনকে ইদানীং রক্তদান উৎসব বলে উল্লেখ করছেন, খুবই ভাল কথা। কিন্তু উৎসব যদি কেবলমাত্র ডিসেম্বর-জানুয়ারী এবং জুলাই আগস্ট মাসেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে না উৎসব, না বিপ্লব--- কোনোটাতেই সেই কর্মকান্ড উত্তীর্ণ হতে পারেনা। এই রক্তদাতারাই যদি অল্প সময়ে বিরাট পরিমাণে রক্ত না দিয়ে, unused blood wastage এর পরিমাণ কমিয়ে, সারা বছর ধরে ছোট ছোট শিবিরে বিভক্ত হয়ে রক্তদান করেন, গ্রীষ্মকালীন এবং শারদোৎসবকালীন রক্তের হাহাকারটা একটু কমে। এখানেই donor motivation factorটা ভীষণ জরুরী কথা হয়ে দাঁড়ায়।
যে কোনো রক্তদান শিবির থেকে রক্ত সংগ্রহের পরে, তা পাঁচ থেকে ছ'ঘন্টার মধ্যে ব্লাডব্যাঙ্কে এনে পৃথকীকরণের কাজ শুরু করে দেওয়া উচিৎ।
পৃথকীকরণ মানে? যখন রক্ত সংগৃহীত হয়, তা সবসময়ই হোল ব্লাড হিসেবে সংগৃহীত হয়। ব্লাডব্যাঙ্কে এনে নানা যন্ত্রের মাধ্যমে সেই হোল ব্লাড থেকে প্যাকড রেড ব্লাড সেল, প্লাজমা এবং প্লেটলেট তৈরি করার পদ্ধতিকেই বলে পৃথকীকরণ।
তাছাড়া, সংগৃহীত রক্তে বিভিন্ন জীবাণুর উপস্থিতিও পরীক্ষা করে দেখা হয়---যেমন, এইচ আই ভি, হেপাটাইটিস বি এবং সি, ম্যালেরিয়া আর ভিডিআরএল( সিফিলিস জাতীয় যৌনরোগ)--- যে জীবাণুগুলি রক্তের মাধ্যমে রোগীর দেহে সংক্রমণ ছড়াতে পারে, সেই জীবাণুকে চিহ্নিতকরণের কাজ হয়। যদি সংগৃহীত রক্তে এ ধরনের কোনো জীবাণুর উপস্থিতির প্রমাণ মেলে, তা সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট করে ফেলা হয়-- কোনো রোগীকে দেওয়া যায় না। সেই রক্তদাতা, যাঁর রক্তে জীবাণু মিলেছে, তাঁকে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে( যে হাসপাতালের সঙ্গে ব্লাডব্যাঙ্কটি যুক্ত), সেখানে ডেকে এনে উপযুক্ত চিকিৎসা এবং কাউন্সেলিং করা হয়।
এই কারণে, প্রতিটি রক্তদান শিবিরে, রক্তদাতার ঠিকানা এবং মোবাইল নম্বর নথিভুক্ত করা আবশ্যক।
দেখা যাক মূলত কি কি রোগ দূষিত রক্তের মাধ্যমে ছড়ায়। ভাইরাল রোগের মধ্যে রয়েছে এইচ আই ভি, হেপাটাইটিস বি এবং সি, হিউম্যান টি লিম্ফোট্রফিক ভাইরাস(সংক্ষেপে এইচটিএলভি), সাইটোমেগ্যালোভাইরাস বা সিএমভি, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস ইত্যাদি। ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমণের মধ্যে রয়েছে সিফিলিস। আর প্যারাসাইটিক সংক্রমণের মধ্যে রয়েছে ম্যালেরিয়া এবং শাগাজ ডিজিজ(Chagas disease).
আমাদের দেশে, রক্তসংগ্রহের পরে এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি ও সি, সিফিলিস এবং ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা করা হয়।
যখনি কোনো জীবাণু মানবদেহে ঢোকে, শরীরের ইমিউন সিস্টেম তাকে প্রতিহত করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এই antibody testই হলো immunoassay বা ELISA, যা এইচআইভি 1ও 2, হেপাটাইটিস বি এবং সি-র জীবাণুর উপস্থিতি প্রায় নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করে।
রোগজীবাণুর শরীরে প্রবেশ এবং তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কালই হলো window period. এইসময়ের মধ্যে যদি কোনো রক্তদাতার রক্ত ELISA test এ পরীক্ষা করা হয়, জীবাণুর উপস্থিতির প্রমাণ না-ও পাওয়া যেতে পারে। ঠিক এই কারণেই, রক্তদাতাদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি, যাকে বলা হয় pre donation history taking. অনেকসময় খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমেই এমন অনেক তথ্য উঠে আসে, অভিজ্ঞ চিকিৎসক বা ব্লাডব্যাঙ্কের কর্মী বুঝতে পারেন, যে রক্তে জীবাণু থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
আর সম্ভাব্য রক্তদাতারও কোনো তথ্য গোপন করা অনুচিত। শুধু বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থে নয়, তার নিজের সুরক্ষার জন্যও।
ব্লাডব্যাঙ্কের সেরোলজি ল্যাবে সম্পন্ন হওয়া এই পরীক্ষা কিন্তু কখনোই confirmatory test নয়। এই ELISA test result positive হলে সেই রক্তের ব্যাগটি সঙ্গে সঙ্গেই autoclave পদ্ধতিতে নষ্ট করে ফেলা হয়। কিন্তু সেই ব্যক্তিটির আরো কতকগুলি পরীক্ষা নিরীক্ষা(অবশ্যই ব্লাডব্যাঙ্কের ল্যাবরেটরিতে নয়) করাবার পরে তবেই নিশ্চিত রূপে বলা যায়, যে উল্লিখিত রক্তদাতা সেই রোগে আক্রান্ত। এই কারণেই প্রত্যেক রক্তদাতার মোবাইল নম্বর এবং যোগাযোগের ঠিকানা রক্ত সংগ্রহকারী ব্লাডব্যাঙ্কের কাছে নথিভুক্ত করে রাখা প্রয়োজন, যাতে screening test positive এলেই পরবর্তী পরীক্ষার জন্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।
ELISA test যেমন ইমিউন সিস্টেমের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় তৈরি হওয়া antibodyর উপস্থিতি দেখে result দেয়, তেমনই কিছু পরীক্ষা আছে, যেগুলি ভাইরাসের জিনগত উপকরণ খুঁজে বার করতে সাহায্য করে। এই পরীক্ষাকে বলে Nucleic acid test, সংক্ষেপে NAT. NAT যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ হওয়ায় সরকারী ব্লাডব্যাঙ্কে এর ব্যবহার সীমিত।
উপরোক্ত পরীক্ষাগুলি ছাড়াও সিফিলিসের জন্য rapid plasma reagin, সংক্ষেপে RPR এবং ম্যালেরিয়ার antibody test ও হয়।
সকলের মনেই এই প্রশ্ন থাকতে পারে, যে রক্ত দেওয়ার আগেই এই পরীক্ষাগুলি কেন করানো হয় না? তাহলে তো কোনোভাবেই রক্তসুরক্ষার সঙ্গে কোনো আপস হয় না। না, সেটা সম্ভব নয়। কারণ, এই serological test অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আর খামোখা একজন সম্ভাব্য রক্তদাতাকে দু'বার সূচ ফোটানোর কষ্ট পেতেই বা হবে কেন?
Pre donation donor screening এবং history takingএর গুরুত্ব কিন্তু অপরিসীম। আর এই ব্যাপারে রক্তদান শিবিরের উদ্যোক্তা ক্লাবগুলিরও কিন্তু যথেষ্ট ভূমিকা আছে।
অধিকাংশ রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেন পাড়ার ক্লাব, স্থানীয় রাজনৈতিক দাদা দিদিরা। বহিরাগত ব্লাডব্যাঙ্ক কর্মীদের চেয়ে স্থানীয় রক্তদাতা মানুষজনকে ক্লাবের ছেলেরা অনেক বেশি চিনবেন। কার তিনমাস আগে জন্ডিস বা ম্যালেরিয়া হয়েছিল, কে মুম্বইতে সোনার কাজ করতে গিয়েছিল একা, কার মাদক নেওয়ার অভ্যাস ছিল, অথবা, কে উপঢৌকনের লোভে একমাস আগে পাশের পাড়ায় রক্তদান করার কথা বেমালুম গোপন করছে, এ কথা ক্লাবের ছেলেরা জানবেই।
তাদের সহযোগিতায় এই donor screening আরো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে, রক্তসুরক্ষার বলয় আরো অটুট হবে, এটা নিশ্চিত বলা যায়।
আরো একটা কথা, রক্তদান শিবির উদ্যোক্তাদের একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, যে blood safety নিশ্ছিদ্র করতে, NACO অর্থাৎ National Aids Control Organisation এর guideline অনুযায়ী কোনো যৌনপল্লীর 2 কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কোনো রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা যায় না।
একটাই কথা বলার--- যে transfusion transmitted infection এর screening test গুলোর কথা লিখলাম, সেগুলি খুবই স্পর্শকাতর এবং উপযোগী হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু 100% fullproof নয়। তাই মুষ্টিমেয় কিছু ক্ষেত্রে হলেও দুর্ভাগ্যজনক ভাবে থ্যালাসেমিয়া বা হিমোফিলিয়া আক্রান্ত রুগ্ন মানুষ শুধু unsafe transfusion এর কারণে HIV বা HEPATITIS B/C আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে-- শুধু এদেশে নয়, বিদেশেও।
রক্তসুরক্ষা নিয়ে অক্লান্ত কর্মকাণ্ড আজও চলছে। ভারতবর্ষের মতো জনবিস্ফোরণে ভারাক্রান্ত দেশে, যেখানে public health awarenessই সর্বত্র সেভাবে গড়ে ওঠেনি, যেখানে সিংহভাগ রক্তের চাহিদার জন্য মাঠেঘাটে স্বেচ্ছারক্তদান শিবিরগুলির উপর ভরসা করতে হয়, সেখানে নিখুঁত রক্তসুরক্ষার জন্য আমাদের অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।
অযথা আলোচনা দীর্ঘায়িত করব না--- বড় ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে। রক্তদান এক বিশাল বিষয়। এই ছোট্ট পরিসরে তাকে ধরা মুশকিল। অনেক প্রশ্ন হয়ত অমীমাংসিত থেকে গেল--- বহু প্রশ্ন উথ্থাপনই করা হলো না। তবু আলতো করে ছোঁয়া হলো হয়ত অচেনা জগৎটাকে। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা কিছু ভ্রান্ত ধারণাকেও ভাঙার চেষ্টা করা গেল একটুখানি।
সাধারণ মানুষের সচেতন সহযোগিতা ব্যতীত আমাদের দেশে রক্তদান এবং রক্তসুরক্ষা নিয়ে বেশিদূর এগোনো যাবে না-- সকলকে এই কথা মনে করিয়ে দেওয়াই এই লেখার উদ্দেশ্য।
খুব সময়োপযোগী লেখা। আমরা তো আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতাও প্রায় ভুলতে বসেছি। সেটা মনে করিয়ে দেওয়াটাও একটা দরকারী কাজ।
ReplyDeleteধন্যবাদ।পড়ে সমৃদ্ধ হলাম।
ReplyDelete