0

ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


এক কিশোরীর রোজনামচা - ২১

সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়



Diary Entry - 19
28, September, 1942, Monday.

প্রিয় কিটী, 

এর আগের চিঠিটা আমি প্রায় বাধ্য হয়ে খুব তাড়াতাড়ি শেষ করছিলাম। তখনও আমার বেশ কিছু কথা বাকী ছিল। আসলে, তোমার সঙ্গে ছাড়া আর কার সাথেই বা’ প্রাণ খুলে কথা বলব! তোমায় গত চিঠিতে আরও একটা ঝগড়ার ঘটনা বলার ছিল। কিন্তু শ্রীমতী ভ্যান ড্যানের লজ্জায় লাল হয়ে ওঠার কথা বলতে বলতেই আমায় চিঠি লেখা শেষ করতে হয়েছিল। এই ঝগড়ার কথাটা যে তোমায় গুছিয়ে বলব, তার সুযোগই সেবার হলো না। 

আমি বুঝি না, বা বলতে পার, আমি ভাবতেই পারি না বড়রা কি করে এত ঝগড়া করতে পারে? তা’ও আবার বোকার মতো কিছু অর্থহীন বিষয় নিয়ে! এতদিন আমি জানতাম, ছোটরা, এমন কি, আমাদের বয়সীরাও একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত নিজেরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে। আবার তারপর তারাই মিটিয়ে নেয়; কোন কোন সময়, হয়ত বড়দের হস্তক্ষেপের দরকার হলেও হতে পারে। এভাবে যত তারা বড় হয়ে ওঠে, ততই আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে ঝগড়া করার প্রবণতাটা কমে যায়। বিশেষ করে তারা ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে আর ঝগড়া করে না।কারণ তাদের আর ব্যক্তিগত কোনও বিষয়ই আর থাকে না, সবটাই পারিবারিক বিষয় হয়ে যায়। এমন’কি বড়রা ঝগড়া করলে, অনেক সময় ঠাট্টা করে তাদের উদ্দেশ্যে বলা হয়, “দ্যাখো, ওরা কেমন ছোটদের মতো ঝগড়া করছে!” তবে, অনেক সময় বা কোনও কোনও  ক্ষেত্রে, বড়দের মধ্যেও ঝগড়া করার মতো অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। আশা করা হয় তখন তারা, নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমে ঝগড়ার বিষয়বস্তু ও পরিধিকে ছোট করে আনবে। এইজন্যেই ত' তারা বড়! 

কিন্তু তোমায় এখন যে ঝগড়ার কথা বলব, সেটা বাস্তবিকই কিছু অপ্রয়োজনীয়, অবাস্তব খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে ঝগড়া। এটা এতটাই অপ্রয়োজনীয় ও অবাস্তব, যে এর কারণ বের করতে তুমি বেশ বেগ পাবে। তবে কারণটা প্রায় অদৃশ্য, বা কল্পিত নয়। কারণটা হলো “আমি”। এই সব অবাস্তব খুঁটিনাটি ঝগড়ার মূল কারণ যখন আমি, তখন ত’ আমার এই ধরণের ঝগড়ার সাথে অভ্যস্ত হয়ে পড়া এবং জড়িয়ে পরাটাই স্বাভাবিক। মজাটা কি জান! বড়ারা এটাকে আবার ”ঝগড়া” বলে না, বলে নিজেদের মধ্যে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে “আলোচনা”। তবে এটা একদম ঠিক নয়। আমি তোমায় জোরের সাথে বলছি, ওরা যেটা বলছে সেটা একদমই ঠিক নয়। তারা চায়, আমি ছোট, আমি যেন তাদের কথাবার্তার মধ্যে একদমই না থাকি। অথচ তারা আমায় নিয়ে, আমার আচার আচরণ নিয়ে, এক কথায় আমার A To Z সব কিছু নিয়ে আলোচনা (!!) করবে, আর আমাকে সামনে বসে পরম যত্নে তা’ চুপ করে শুনতে হবে, হজম করতে হবে; এমনকি ওদের ঝগড়ার (!!) চেঁচামিচিটাকেও চোখ নীচু করে শুনে যেতে হবে। তোমার কি মনেহয়, এটা সম্ভব? অন্ততঃ আর কারুর পক্ষে এটা সম্ভব হলেও, আমার পক্ষে’ সম্ভব নয়। আমি এটা করতে অভ্যস্ত নই। আমার আচার আচরণকে কেউ ক্রমাগত আক্রমণ আর দোষারোপ করে যাবে, আর আমি সেটা অত্যন্ত ছোট করে দেখব, কোনও প্রতিবাদ করব না, চুপচাপ হজম করে নেব, এটা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। আমি ওদের স্পষ্ট করে বলে দিতে আর বুঝিয়ে দিতে চাই যে অ্যানি ফ্রাঙ্ক সেদিনের মেয়ে নয়ে; সে বেশ বড় হয়ে গেছে। আজ যারা ক্রমাগত আমার সমালোচনা করে চলেছে, তারা একদিন না একদিন অবশ্যই বুঝতে পারবে, অ্যানি ফ্রাঙ্ক তাদের যথাযথভাবে শিখিয়ে ও বুঝিয়ে দিতে পারে, যে সে কেমন ধরণের মেয়ে! আর আমি জানি, একমাত্র তখনই তাদের মুখগুলো সব বন্ধ হয়ে যাবে। ওরা আমার ব্যাপারে আজেবাজে কথা বলা বন্ধ করবে। তোমার কি মনে হয়, ওদেরকে সেইরকম মানসিকতা আর মেজাজ দেখানো উচিৎ? আমার সঙ্গে যেটা করছে, সেটাকে সাদা চোখে বলে অসভ্যতা, বর্বরতা! সত্যি বলছি, ওদের এই রকম আচরণ, ব্যবহার দেখে আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই। ওদের বাজে অসভ্যতা, আচার-আচরণ, বিশেষ কারুর বোকার মত কথাবার্তা, (বিশেষ কারুর নাম বলতে বললে, শ্রীমতী ভ্যানের নাম বলতেই হয়) আমায় বিস্মিত করে। কিন্তু যখন এখনকার মতো, অনন্যোপায় আবস্থায়, আমি বাধ্য হই এই অসভ্য আচরণগুলো দেখতে, হজম করতে, এবং এদের মুখোমুখি হতে, তখন, তুমি বিশ্বাস কর, এদের ব্যবহারের উপযুক্ত জবাব মুখের ওপর দিতে আমার একটুও কুণ্ঠা বোধ হয় না। তবে ভাগ্য ভাল খুব বেশীক্ষণ আমায় এদের সহ্য করতে হয় না। আর একবার এদের মুখের ওপর যথাযথ জবাব দিয়ে দিলে, এদের গলার স্বর আপনাআপনি নেমে যায়। 

তোমার কি মনে হয়, আমার স্বভাব, রুচিবোধ কি সত্যিই এত খারাপ? আমি কি এতটাই অহংকারী, স্বার্থপর, একগুঁয়ে, যে আমার মাথা থেকে পা’ পর্যন্ত সবটাই নিন্দা আর সমালোচনার যোগ্য? অথচ, তুমি বললে বিশ্বাস করবে না, ওরা সমানে আমায় স্বার্থপর, একগুঁয়ে আর অহংকারী এই বিশেষণগুলো শুনিয়ে যায়। আমার বিশ্বাস, এর কোনটাই আমার সম্পর্কে সার্বিকভাবে বলা যায় না। হতে পারে, আমার কিছু দোষ আছে। সে’ ত’ সবারই কিছু না কিছু দোষ থাকে। তেমনি আমারও আছে। সে কথা আমি ভালভাবেই জানি, আর তা’ অস্বীকারও করি না। তাই বলে কেউ শুধু আমার দোষগুলোকে শুধু শুধু বাড়িয়ে দেখাবে, আর আমার গুনগুলোকে ইচ্ছা করে চাপা দিয়ে রাখবে; সেটাও ত’ হতে দেওয়া যায় না। তাই সময়ে সময়ে আমায় প্রতিবাদ করতেই হয়। এবং তা’ করতেও হবে। 

কিটী, তুমিই হয়ত জান, ওদের এই ক্রমাগত ঠাট্টা বিদ্রুপের কথা শুনতে শুনতে আমার গা’ জ্বালা করে। জানি না কতদিন আমায় এই সব নিচুমানের ঠাট্টা বিদ্রুপের দুষিত বাতাস, নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে গ্রহণ করতে হবে? মাঝে মাঝে মনে হয় এই দূষিত বাতাস আমার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ করে দেবে! একদিন সত্যি সত্যিই হয়তঃ আমি আমার ভিতরের এই দুর্বার রাগ আর আক্রোশে ফেটে পরব। 

যাই হোক, এখনও সে’রকম কিছু ঘটেনি। এখনও আমি আমার সহ্য শক্তির পরীক্ষা দিয়ে চলেছি। বুঝতে পারি, এইসব অর্থহীন ঝগড়া ঝাঁটির কথা তোমায় যখন বলছি, তখন তোমার বোধহয় ধৈর্যচ্যুতি ঘটাচ্ছি! আমার ত’ ঘটছেই । তা’ হোক, তোমায় আমি আজ, কয়েকদিন আগে খাওয়ার টেবিলে, খাওয়ার সময় কি কি ঘটেছিল, সে’টা সবিস্তারে জানাব। 

আমাকে কেন্দ্র করে সেদিনের আলোচনাটাকে অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা যায়। সেদিন খাওয়ার টেবিলে বসে সবাই আমার বাবার, (পিম্প--- আমার বাবার ডাক নাম। সেদিন এই নাম বলেই আলোচনা চলছিল), শালীনতা বোধ নিয়ে সদর্থক বাক্য ও স্বরেই আলোচনা করছিল। আমার ত’ মনে হয় পৃথিবীর সব থেকে ষ্টুপিড, নিরেট ব্যক্তিও আমার বাবার শালীনতাবোধ মেনে নিতে বাধ্য হবে। হঠাৎ আলোচনার মধ্যেই কোনও নির্ধারিত প্রসঙ্গ ছাড়াই, শ্রীমতী ভ্যান ড্যান বলে উঠলেন, “আমার মধ্যেও কোনওরকম আত্মপ্রচারের মিথ্যা প্রবণতা নেই। এটা আমার স্বামীর মধ্যে অল্পবিস্তর থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু আমার মধ্যে একফোঁটাও নেই।“ 

এই ধরণের নির্বোধের মতো কথা আগে কখনও কোথাও, কাউকে প্রসঙ্গহীনভাবে বলতে শুনেছ, বা দেখছ? এই রকম কথা যে বলছে, তার সম্পর্কে এটাই প্রমাণ হয় যে, এই লোক বা মহিলাটি কতটা ধৃষ্টতার সঙ্গে নিজেকে আদ্যান্ত প্রমাণ ও জাহির করার চেষ্টা করছে! নিজের ঢাক নিজেকে বাজাতে হচ্ছে, আর তাতে কোন লজ্জাও নেই। হঠাৎ শ্রী ভ্যান ড্যানের অন্ততঃ মনে হলো  তাঁর স্ত্রী অকারণেই কিছুটা হলেও আত্মপ্রচারশীল হয়ে উঠেছেন, অথবা তাঁকে হেয় বা ছোট করার চেষ্টা করছেন। তাঁর মনে হলো প্রত্যুতরে তাঁর কিছু বলা দরকার। তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, “আমি অকারণে নিজেকে “শালীন” হিসাবে প্রমাণ করতে চাই না। আমি দেখেছি এ’তে খুব একটা লাভ কিছু হয় না। তারপর কোনও কারণ ছাড়াই, একই টানে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “শোন অ্যানি, তোমায় একটা কথা বলি। তুমিও অকারণে অহংকারী, বা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠো না। আমি আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে বলছি, তাতে তোমার বিশেষ কিছু কোথাও লাভ হবে না।

শ্রী ভ্যান ড্যানের কথা শেষ হওয়া মাত্র আমার মা সম্মতিসূচক ইশারায় ঘাড় নাড়লেন। আমিও চুপ করেই ছিলাম। কিন্তু শ্রীমতী ড্যানের স্বভাব ত’ সেরকম নয়। তিনি কোনওভাবেই অন্য কারুর মন্তব্য বিনা বাক্যে বা বিনা মন্তব্যে মেনে নিতে পারেন না। তাই তাঁকে যে কোন বিষয়ে অন্য কেউ অন্য কিছু বললে, কিছু না কিছু মন্তব্য করতেই হবে। এবার তিনি হয়ত কিছুটা ইচ্ছা করেই তাঁর মন্তব্যটি স্বামীর প্রতি না করে, পরিবর্তে আমার মা বাবার উদ্দেশ্যে করলেন। আশ্চর্যজনক ভাবে, তাঁর মন্তব্য ছিল আলোচ্য বিষয় থেকে বিচ্যুত। আমার মা আর বাবার উদ্দেশ্যে বললেন, “ছেলেমেয়ে সংসার বিষয়ে তোমাদের দৃষ্টিভঙ্গীটা আজব রকমের ব্যতিক্রমী। বিশেষকরে অ্যানির বিষয়ে তোমাদের ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। আমি যখন ওর মতো বা ওর বয়সী ছিলাম তখন আমি কখনই ওর মতো ছিলাম না। আমার মনে হয় এইভাবে মানুষ করে তোমরা হয়ত প্রমাণ করতে চাও, যে তোমরা অনেক বেশী আধুনিক, এবং পরিবারকেও আধুনিক মূল্যবোধ দিয়ে বড় করে তুলতে চাও। কিন্তু এটা আদৌ ঠিক নয়। আমি জানি না (আমি কেন, হয়ত কেউ জানে না) উনি হঠাৎ এইসব কথা বললেন কেন! এটা ত’ আমার মা আর বাবাকে সরাসরি দোষারোপ করা। যেন শ্রীমতী ড্যান এটাই বলতে চেয়েছেন, যে আমার মা আর বাবা আমাকে বা আমাদের যে ভাবে মানুষ করে তুলেছে, সেটা আদৌ ঠিক নয়, একদমই বেঠিক পথ । 

তবে মানুষ তার নিজের মানসিক ভ্রম বুঝতে পারার পর, দ্রুত তা’ নিজেই শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করে। শ্রীমতী ড্যান- ও বুঝতে পেরেছেন, তাঁর হয়ত কথাটা এ’ভাবে বলা ঠিক হয়নি। অন্ততঃ শ্রী ও শ্রীমতী ফ্রাঙ্কের বিষয়ে। আর তাই, কথাটার গূঢ অর্থ বুঝতে পেরে, ইতিমধ্যেই শ্রীমতী ড্যানের মুখটা বেশ লালচে হয়ে উঠেছিল। শ্রীমতী ড্যানকে কিছু বুঝতে না দিয়ে, আমার মা সমস্ত কথাটা অত্যন্ত স্থির ধীর ও অচঞ্চল মুখে শুনলেন। মায়ের মুখ দেখে বোঝার উপায়ই ছিল না, যে, কথাগুলো মাকে আঘাত করেছে। যে সমস্ত লোক ভুলভাল কথা বলে নিজেই নিজের কাছে অপ্রতিভ হয়ে পড়ে, তারা শেষ পর্যন্ত নিজেদের ভুল ঢাকতে, বা, অন্যের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে, হঠাৎই উত্তেজিত বা উতপ্ত হয়ে পড়ে। আর এই ধরণের বিতর্কিত কথার প্রেক্ষিতে, তাদের অহেতুক উত্তেজনাই তাদের দুর্বলতাকে প্রকাশ করে দেয়। অথচ আমার মা ছিলেন, সাধারণ সময়ের মতোই অবিচল ও অচঞ্চল। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল না, যে, শ্রীমতী ড্যানের কোন কথা তার মনের ওপর রেখাপাত করেছে! তবে তাঁর চোখমুখের মধ্যে একটা প্রচেষ্টা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট, প্রবল ও দীপ্ত। তিনি চাইছিলেন, এই ধরণের আলোচনাকে তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে দিতে। পরিবর্তে অন্য কোন বিষয়ের বা প্রসঙ্গের অবতারণা করতে। কারণ আমরা সবাই বুঝতে পারছিলাম, আলোচনার মান ও গতি উভয়ই নিন্মমুখী হয়ে পড়ছিল। তিনি এবার কিছুটা আগ বাড়িয়ে (হয়ত আমাদের আলোচনার মূল বিষয়টাকে পরিকল্পিত উপায়ে অন্য দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য) অন্য একটা পারিবারিক প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন। আমার মা শ্রীমতী ড্যানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “দেখুন, আমার মনে হয় ভালভাবে লোকের সঙ্গে কথা বলার জন্যে বা ভাল পড়শীকে কাছে পাওয়ার জন্যে মাত্রাতিরিক্ত শালীন হওয়ার দরকার নেই; প্রধান দরকার নিজের আচরণ সম্পর্কে পরিমিতি বোধ। এ’রকম হতেই পারে, যে আমার স্বামী, মারগট বা পিটার হয়তঃ সাধারণভাবে বেশী কথা বলতে ভালবাসে না, বা বেশী কথা বলে না। তারা তাদের মতো করে শালীনতার একটা সীমারেখা করে নিয়েছে, আর তার মধ্যেই থাকতে ভালবাসে। কিন্তু এই যে আমি, তুমি বা অ্যানি, আমরা কিন্তু ওদের মতো শালীনতার সীমাকে নির্ধারণ না করে, আমাদের মতো করে ভেবেছি। আমরা ওদের মতো হালকা বা নিম্ন স্বরে কথা বলি না। তার জন্যে কি আমাদের ব্যবহার আচার আচরণকে সম্পূর্ণ অশালীন বলা যায়? নিশ্চয়ই বলা যায় না। আমাদের সম্পর্কে বরং একথা হয়ত বলা যায়, যে, আমরা শালীনতার দুই চূড়ান্ত সীমার মাঝামাঝি অবস্থান করি। 

শ্রীমতী ভ্যান ড্যান মায়ের কথা কিছুক্ষণ চুপচাপ শোনার পর, বেশ সিরিয়াস স্বরে বললেন, “কিন্তু শ্রীমতী ফ্রাঙ্ক আমি আপনার সব কথা ঠিক বুঝলাম না। আমি ত’ আমার আচরণে কোন রকম শালীনতার অভাব দেখিনা। তাছাড়া, আমি সাধারণভাবে অন্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করি না। তা’হলে আপনি আমায় এ’সব কথা কেন বলছেন তা’ আমি বুঝতে পারছি না! 

আমার মা একটু হেসে বললেন, “আমি আপনাকে ঠিক বদমেজাজি বা অশালীন বলতে চাইনি। তবে এটা যে কেউ আপনাকে দেখে স্বীকার করবে বা বুঝতে পারবে, যে, আপনার মানসিকতায় আত্মকেন্দ্রিকতার মেজাজ আছে। 

মায়ের এই কথা বা বিশ্লেষণ শ্রীমতী ভ্যান ড্যানের আদৌ পছন্দ হয় নি। তবুও নিজের ভিতরের রাগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে, উত্তর দিলেন, “এক সাথে যখন থাকি, তখন আমার এই স্বভাবটা ভাল করে আপনাদের বুঝে নিতে হবে। আমি জানি না কেন বা কি কারণে আমায় আত্মকেন্দ্রিক বলা হচ্ছে! তবে একটা কথা আমি চিরকাল আপ্তবাক্য হিসাবে মেনে এসেছি; তা’হলো নিজেকে নিজের পায়ের তলার জমিকে শক্ত করে রাখতে হয়। না রাখতে পারলে নিজেই আমি মারা পড়ব। 

শ্রীমতী ভ্যান ড্যানের এ’রকম অবাস্তব ও অর্থহীন আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা দেখে, মা একেবারে থ’! তারপর কোনও উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে হঠাৎ তিনি বেশ জোরে হেসে উঠলেন। মায়ের ও’রকম উচ্চস্বরে হাসি দেখে, শ্রীমতী ভ্যান ড্যান আরও রেগে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। দেখে মনে হলো, কেউ যেন ওঁর জারমান-ডাচ রক্তে বিদ্রূপের হুল ফুটিয়ে দিয়েছে। এতক্ষণ যিনি, জারমান-ডাচ, ডাচ-ডয়েশ্চ- এর হুল সবার গায়ে ফুটিয়ে দিচ্ছিলেন, তার মুখ হঠাৎ কেউ যেন সরু দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলেছে। এরপর তিনি আর কি করবেন ? চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর কক্ষ ত্যাগ করে চলে যেতে উদ্যত হলেন। 

যেতে যেতে হঠাৎ শ্রীমতী ড্যান একপাশের চেয়ারে বসে থাকা আমার দিকে তাকালেন। অথবা তাঁর নজর পড়ে গেল। এইসময় বোধহয় আমার দেখা উচিত ছিল, যে, তিনি আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকাতে তাকাতে ঘর ছাড়তে উদ্যত হয়েছেন। আরও দুঃখের বা হতাশার কথা কি জান, ঠিক যে সময় তিনি যেতে যেতে হঠাৎ ঘুরে আমার দিকে তাকালেন, ঠিক তখনই আমি ছদ্ম বিষণ্ণে আমার মাথাটা নাড়ছিলাম। বিশ্বাস কর আমি দেখিনি, উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আরও বিশ্বাস করো, আমার বিষণ্ণতার ভঙ্গী, বা অকারণে মাথা নাড়ানো ইত্যাদি কোন কিছুই কাউকে দেখানোর জন্যে বা, কোন বিশেষ উদেশ্য সাধনের জন্যে আমি করিনি। আমার কিছু করার ছিল না, তাই আমি নিজের মনে বসে বসে মাথা নাড়াচ্ছিলাম। অবশ্য এটা ঠিক যে, আমি ওই চেয়ারে বসেই, ঘরের মধ্যেকার সব কথাবার্তা শুনেছি। বলতে পার, আমি সবটা জানি। শুধু জানিই না, অত্যন্ত কাছ থেকে সবটা শোনার ও দেখার জন্যে আমার কাছে কোনও কিছুই অজানা নয়। 

এরপর যেটা ঘটল, সেটা আরও নাটকীয়। শ্রীমতী আমার ওপর থকে চোখ সরিয়ে তড়বড় করে কিছু অশালীন জার্মান শব্দ, যেগুলোকে আমরা সাধারণভাবে অশোভন বা স্ল্যাং শব্দ বলে থাকি, সেগুলোই আমার উদেশ্যে পরোক্ষে উচ্চারণ করে, মুখ লাল করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি তাঁর এই মুখটা যদি আঁকতে পারতাম, তাহলে এই মুহূর্তে তাঁর মুখটাকে তোমার “লাল মুখো মেছুনীর” মতো মনে হতো, যার মুখ দিয়ে অকারণে বোকার মতো কিছু অশিষ্ট স্থুল শব্দ বেরিয়ে আসছে। 

যাই হোক, এর থেকে আজ আমি একটা কথা শিখলাম। তুমি একটা লোককে তখনই খুব ভাল করে চিনতে পারবে, যখন। তার সঙ্গে তুমি কথা বলবে। তার সাথে কথা বলে বা কথা বলার ধরণ দেখেই তুমি তার চরিত্রও, তার স্বভাব ইত্যাদি বুঝতে পারবে। তার আগে নয়। 

ইতি,
অ্যানি 

0 comments: