1

ছোটগল্প - কর্ণ শীল

Posted in


ছোটগল্প


এমিথি
কর্ণ শীল 



(এক)

তারা আর অন্ধকার থাকলে দুর্গপ্রতিম বাড়িটা প্রস্থ বরাবর অশেষ মনে হয়। আটটা মিনারের মাথায় মাথায় লোহার বিদ্যুৎবাহ। ওকগাছের ডাল ঝুঁকে পড়ে কোনও গবাক্ষের সন্নিধানে। চুল্লি থেকে হঠাৎ রাতের নিঝুম প্রহরে উড়ে যায় ডানার শব্দ মেলে নিশাচর খেচর।

জ্যোৎস্নারাতে আবার আরেক রূপ। হলুদ পাথরের দেওয়ালগুলো বেয়ে চাঁদের অনুচর ছায়ারা ওপরে যায়, নীচে নেমে আসে। প্রহর ঘোষণা করে প্রাসাদের মধ্যবর্তী চূড়াশীর্ষের বিশাল ঘড়ি।

আমি সেই একাই রয়ে গিয়েছি। আগের বাড়ি থেকে মা আসেনি আমার সঙ্গে। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলেনা, আরও বিষাদগ্রস্ত ব্যথাতুর হয়ে পড়ে।

লন্ডনের সেই রাত আমার এখনও মনে আছে। তুষারঝরা হিম হিম রাত। টিপটিপে পচা বৃষ্টির মধ্যে থেমস থেকে উঠে আসা হাওয়ার হাড়ে পচন ধরিয়ে দেওয়া সেই রাতের কথা কি আমি ভুলতে পারি?


(দুই)

এমিথি ক্যারল জোনস্ আমার নাম।বাবা ব্রিটিশ সরকারের পুরাতত্ব বিভাগে কাজ করেন। পূর্ব ইওরোপের ক্রুশেড নিয়ে বাবার গবেষণা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আমাদের ক্রিস্যামথেমাম স্ট্রীটের বাড়ির বেসমেন্ট ভর্তি বিভিন্ন আকৃতির তলোয়ারে। সোজা, বাঁকানো, বেঁটে, খড়্গাকৃতি। বিভিন্ন রকমের ঢাল, বর্ম। কাঁটালাগানো মুগুর। ঘোড়ার মুখবর্ম, রেকাব, জিন। অদ্ভুত কিম্ভুতকিমাকার রূপার ছুঁচলো দণ্ড। আর অনেকগুলো মূর্তি। সেগুলো রক্তে ভরা।

ওগুলো দেখলেই আমার দেহটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়তে চায়।

আমার আগের মা খুব সুন্দর দেখতে ছিল। শাঁখের মতো রঙ। নীলকান্তমণির মতো চোখ। একমাথা সোনালি চুল মেলে শেষবিকেলে পশ্চিমের ঝুলবারান্দায় দাঁড়ালে পড়ন্ত রোদে আগুন জ্বলে উঠতো যেন। প্রতিফলিত আলোয় ড্যান্ডিলিয়ন ফুলের রেণু উড়ে উড়ে প্রজাপতি ধরতে চাইত। আমার মা গান গাইত,

I hath witnessed Thee
In the light of my outward eyes,
The very twilight shows Thee
In my most treasured sighs.

কি সুন্দর গলাটা ছিল মায়ের! কোমল, সুরেলা। ঘুঘুপাখির বুকের মতো ওম্ ছিল ওখানে। মুখ গুঁজে দিতাম ওখানে। শুষে নিতে চাইতাম মায়ের আদরের শেষ বিন্দুটুকু। মাও আমাকে বুকে নিয়ে চুপ হয়ে থাকত।

দুএকজন পুলিশ রোঁদে বেরিয়েছেন। হাঁটুঅব্দি ঝোল্লা ওভারকোটের চওড়া কলারে মুখ ঢাকা। ফেল্ট টুপি। কুয়াশাঘেরা পাথুরে রাস্তার বাতিগুলো ছমছম করছে। যেন তারা পশ্চিমের উত্তর আটলান্টিক থেকে বয়ে আসা ছুরির মতো হাওয়ার আঘাতে থরথর করে কেঁপে উঠছে।

অপসৃয়মান ছায়াশরীররা লম্বা হতে হতে টাওয়ার ব্রীজের দিকে চলে গেল।

মা ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে উদাসভাবে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে। আগুনের শিখা থেকে বুড়বুড়ির মতো ফুলকিরা উড়ে আসছে। ফারকাঠ পুড়ছে মৃদু চড়চড় শব্দে। ছোট্ট টেবিলঘড়িটা প্রহর গুনছে।

টিক্ টক্ ...টিক্ এ টক্...

একটা মথ মায়ের খোলা চুলের পাশ দিয়ে উড়ে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেল।

তখনই মা তীব্রস্বরে আর্তনাদ করে উঠলো। ছিটকে পড়লো ডিভান থেকে মেঝেতে। চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে এলো। পাদুটো প্রচণ্ড জোরে জোরে আন্দোলিত হতে লাগলো। লালকালো কার্পেটে রক্ত ছিটকে পড়তে লাগলো। লালে লালে মিশে গেল। আয়নায় মায়ের দেহের প্রতিবিম্ব শুধু। আর কেউ নেই।

মোমদানের বাতিগুলো দপ্ করে নিভে গেল।

আমার মায়ের দেহের ক্ষুদ্রতম অংশটুকুও খুঁজে পাওয়া যায়নি শেষকৃত্যের জন্য। কিছু গানের বই, একটা কাঠের পুতুল, মায়ের একটা গাউন কফিনে রাখা হয়েছিল।

বাবা একটাও কথা বলেননি। ভেজা ওয়ালনাট পাতা বিছিয়ে থাকা পথে নিশ্চুপ মানুষের পায়ের শব্দ উঠছিল।

বাবা চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর গ্রামের বাড়িতে আমাকে নিয়ে চলে এসেছিলেন। লন্ডনের বাড়ির কোনও স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে আসেননি।

শুধু পুরনো রক্তমাখা জঘন্য মূর্তিগুলো আর রূপার তৈরি দামী ছুঁচালো দণ্ডগুলো সঙ্গে এনেছিলেন ওগুলোর পুরাতাত্বিক মূল্য খুব বেশি বলে।

হলুদ পাথরে তৈরি সামন্তযুগের দুর্গের মাথাগুলো লাল। ছুঁচলো। লোহার বিদ্যুৎবাহ।

গ্লাসগো থেকে সোজা উত্তরে বার্চ আর সারি সারি ওয়লনাট গাছের মধ্য দিয়ে উঁচুনিচু পথ। বনভূমির ফাঁকে ফাঁকে নিত্যবহ ক্লাইড নদীর তীরে নলবন দেখা যায় মাঝে মাঝে। স্থির নীলজলের পুকুরে লাল হলুদ সাদা ওয়াটার লিলি।

সড়কপথের একশো দুই কিলোমিটার বন্ধ কাচের ভিতরে আচ্ছন্ন হয়ে শুয়েছিলাম। বাবার দৃষ্টি রাস্তায় আঠার মতো আটকে গেছে যেন।

ড্রাইভারের পাশের সীটে বসা নতুন মা আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে মুচকি হেসেছিলেন একবার। খোলা কালো চুল। কপালে গাঢ় লাল রঙের গোল ছোপ একটা। লম্বাহাতাওয়ালা কোমর পর্যন্ত লাল জামা। অদ্ভুত একটা বস্ত্রখণ্ড কোমরে ভাঁজ করে করে জড়ানো। তারই একটা অংশ বুক আবৃত করে বাঁ কাঁধের উপর ফেলা। গলায় বড় বড় লালচে গোল ফলের তিন চার ফেরতা মালা।

ওঁর নামটাও বড্ড অদ্ভুত। সংযুক্তা চ্যাটার্জি জোনস্!

ওঁর হাসি আর দৃষ্টিতে আমার দেহ যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে চাইল আবার।

(তিন) 

আমার কিছু ভালো লাগেনা। সারাদিন যেন দুটো তীক্ষ্ণ চোখ আর একটা লাল রঙের বিন্দু আমাকে আড়াল থেকে অনুসরণ করে।

আমাদের প্রাসাদের ঠিক পিছন দিয়ে কয়েক মিটার নীচেই ক্লাইড নদীর ধারা বয়ে গেছে। সবুজ টেনিস কোর্টের পাশ দিয়ে প্রায়ান্ধকার ঢাল বেয়ে খালিপায়ে নেমে যেতে আমার বেশ লাগে। ওকগাছের ফল চড়বড় করে শিশিরে ভিজে ঝরে পড়ে। গাছের নীচু ডাল থেকে হাত বাড়িয়ে ধরে নেওয়া যায় ছানা রবিন বা বাদামখোর কাঠবেড়ালি।

আজ বিকেলে নদীর ধারে ভিজে ঘাসে বসে আছি। অন্য পাড়ে ভেড়ার কোমল মাংসল পিঠ বেয়ে গাঢ় লাল সূর্য অস্ত গেছে প্রায়। লকশায়ার গ্রামের ছোট ছোট কটেজের টারেট ছুঁয়ে আসছে টুকরো তারার মৃদু আলো।

অগভীর জলের নলবনের মধ্যে একটা রূপালি স্যামনমাছ ঝিকিয়ে উঠলো। ধবধবে চামড়ার ভেতর রক্তবাহগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। খুব আমোদ হলো। নরম মাছটাকে খপ্ করে ধরলাম। চোখের সামনে এসে দেখতে দেখতে মাছটা নেতিয়ে পড়তে লাগলো। নাঃ, আর দেরি করলে হবেনা। মাছটা মরে গেলে...

"অ্যাই ছাড় মাছটাকে...!" পিছন থেকে কে চেঁচিয়ে উঠলো যেন। আমি চমকে উঠে মাছটা ছেড়ে দিলাম আর সেটা এঁকেবেঁকে গভীরজলে হারিয়ে গেল।

ঘুরে দেখি সেই সংযুক্তা জোনস্। কি ভয়ানক লাগছে। খোলাচুল হাওয়ায় উড়ছে। লাল টকটকে বিশাল চোখদুটো যেন জ্বলন্ত কয়লার টুকরো। ঝকঝকে সাদা দাঁতের পাটি ...

আর ওর হাতে সেই বীভৎস রক্তাক্ত মূর্তি। আমি ভয়ে চীৎকার করে উঠলাম। সেই শব্দে সংযুক্তার হাত থেকে মূর্তিটা পড়ে গেল। তিনি ভিজে ঘাসে আবৃত মাটিতে বসে পড়লেন।

আমি ভয়ে ভয়ে তাঁর কাছে গেলাম। পাশে বসে খুব সাবধানে তাঁর কন্ঠাটা কামড়ে ছিঁড়ে ফেললাম। ওঁর দেহটা কিছুক্ষণ ছটফট করে নেতিয়ে পড়তে লাগলো। 

নাঃ, আর দেরি করলে হবেনা। পুরো মরে গেলে রক্তের স্বাদ থাকেনা তেমন।

উঃ, গরম রক্তের স্বাদ কতদিন পর পেলাম!

দেহটা রক্তশূন্য হয়ে গেলে হাড়, মাংস, অস্থি, মজ্জা সব চুষে চিবিয়ে গিলে ফেললাম।

কোনও চিহ্ন রাখলে হবেনা। আমার বাবার নতুন বউ আসবেনা যে নইলে।

কাঁটার মুকুট পরা মানুষটার বীভৎস মূর্তিটা পচাপাতা দিয়ে ঢেকে দিই।

ওটা বেশিক্ষণ সামনে থাকলে আমার দেহটা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যেতে চায়!

যাই, ম্যান্টলপীসের উপর আবার পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি আর দুর্বোধ্য ফিসফিসানিতে বাবাকে আবার মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করি।

1 comment:

  1. কবিতার আবহ সাথে নিয়ে এগোতে এগোতেই মোড় নিল অন্যখাতে। মারাত্মক! দারুণ স্বাদের এক গল্প পাঠ করলাম।

    ReplyDelete