0

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


প্রাচীন কথা


রাজ আজ্ঞা
অনিন্দিতা মণ্ডল



বড়ই বিপদে পড়েছেন ক্ষত্তা অধিরথ। এমনতরো বিপদ যে আসতে পারে তা তাঁর স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। বেশ সুখেই জীবন কাটছিল। কিন্তু গত রাতে রাজা জানশ্রুতির এক অদ্ভুত দর্শন হয়েছে। ফলে শয্যাত্যাগের পরপরই এই বিপত্তি। ডেকে পাঠিয়েছেন ক্ষত্তা অধিরথকে।

রাজা জানশ্রুতি পৌত্রায়ন। এমন শ্রদ্ধাশীল, দানশীল নৃপতি ভূভারতে নেই। তাঁর রাজত্বে একটি মানুষও অভুক্ত থাকেনা। রাজপথ জুড়ে পান্থশালা, অন্নসত্র। সেখানে তাঁর নির্দেশে এমনভাবে অন্নপাক হয় যে প্রতিটি মানুষ ক্ষুধার অন্ন পায়, অথচ একটি কণাও অপচয় হয়না। একে প্রজারা দৈবকৃপা বলে। জানশ্রুতির এই মহৎ কাজটির কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি অসাধারণ খ্যাতিমান। সারা দিনমান রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি গমন করেন। নিজে অন্বেষণ করেন কেউ অভুক্ত আছে কিনা। তাঁর এই যাত্রায় সঙ্গী থাকেন ক্ষত্তা অধিরথ। এমন একটি মহান কাজে যুক্ত থাকার ফলে সারথির মনেও অপার শান্তি। সারাদিন রাজার সঙ্গে থাকার পরও রাজ প্রাসাদের একটি নিভৃত কক্ষে তিনি নিশিযাপন করেন। কখন না জানি রাজার সারথির প্রয়োজন পড়ে। বিশেষ কারণে ছাড়া অবশ্য রাজা তাঁকে রাত্রিতে ডেকে তোলেন না। আজ কিন্তু বিশেষ কারণেই রাজা তাঁকে নিশি পোহাতেই ডেকে পাঠিয়েছেন। 

রাজার কাছে গিয়ে অভিবাদন করে দাঁড়ালেন তিনি। জানশ্রুতি একটু যেন বিমর্ষ, চিন্তান্বিত। যে পুণ্যকর্মের বিভায় তাঁর মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে থাকে, তা যেন কিছুটা মলিন। ক্ষত্তা অবাক হলেন। এমন কেন? রাজা জানশ্রুতির ন্যায় এমন শ্রদ্ধাশীল দানী জগতে বিরল। তাঁর অর্জিত পুণ্য অক্ষয়। তবে কেন এই চিন্তাক্লিষ্ট বদন? সাধারণত ক্ষত্তার সঙ্গে রাজা একান্তে অনেকটা সময় অতিবাহিত করেন। ফলে রাজা-ভৃত্য সম্পর্ক ছাপিয়ে একধরণের সখ্য গড়ে উঠেছে দুজনের মধ্যে। তাই রাজা কোনও রাজকর্মচারীর সঙ্গে পরামর্শ না করে ডেকেছেন অধিরথকে। শূদ্রাণী গর্ভজাত এক ক্ষত্রিয়সন্তান অধিরথ। তাঁকে রাজা নিজের ছায়ার মতন বিশ্বাস করেন। অধিরথ জিজ্ঞাসু চোখে চাইলেন রাজার পানে। তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় রাজা যা বলবার নিজেই বলবেন। একটু সময় নিচ্ছেন মাত্র। 

জানশ্রুতি বলতে শুরু করলেন। যদিও কথার মাঝে তাঁর অস্থিরতা ও মানসিক ক্লেশ প্রকাশ পাচ্ছিল। অধিরথ ব্যথিত হচ্ছিলেন। কি সেই কথা? গতকাল সারাদিন প্রখর গ্রীষ্মের দাবদাহ উপেক্ষা করে রাজা তাঁর রাজত্বের প্রত্যন্ত প্রদেশে গমন করেছিলেন। নতুন একটি পান্থশালা নির্মিত হয়েছে। স্বহস্তে অন্নপাক করে সেটির উদ্বোধন করে এসেছেন। এই উত্তাপ, যাত্রার ধকল, ও অন্নপাক তাঁকে ক্লান্ত করেছিল। তাই সন্ধ্যার পর জানশ্রুতি প্রাসাদ সংলগ্ন উদ্যানে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। শীতল হাওয়ায় শরীর জুড়োবে। এই সময় আকাশে দুটি হাঁস উড়ে যাচ্ছিল। জানশ্রুতি বুঝতে পারলেন যে হাঁস দুটি দুই ঋষি। আকাশপথে যাত্রা করছেন। দুজনের মধ্যে যিনি পশ্চাদবর্তী তিনি প্রথমজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন – ওহে সাবধান। তুমি এখন রাজা জানশ্রুতির রাজ্যসীমায় পৌঁছেছ। তাঁর এমন দিব্য তেজ যে চেয়ে দ্যাখো, নিশার আকাশও যেন দিনের মতো উজ্জ্বল। সতর্কতা অবলম্বন না করলে ওই তেজে আমরা জ্বলে যেতে পারি। কিন্তু প্রথমজন এই সাবধান বাণী সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলেন। হেসে বললেন – কি এমন তেজ রাজা জানশ্রুতির? তা কি শকটবাহী রৈক্কের চেয়েও বেশি? দ্বিতীয় জন বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন – রৈক্ক কে? প্রথম ঋষি জানালেন পরিচয়, -রৈক্ক পূণ্যবাণ। তাঁর পূণ্যফলে জগতের সমস্ত ব্যক্তির ব্যক্তিগত পূণ্যার্জন যোগ হয়ে যায়। ঠিক যেমন ‘কৃত’ পাশার খেলা। উক্ত ক্রীড়াটিতে যিনি জয়লাভ করেন তাঁর জিতসংখ্যার সঙ্গে অন্যান্য সকলের দানের সংখ্যা যুক্ত হয়ে যায়। বিজিত ব্যক্তির দেওয়া দানের কোনও মূল্য থাকেনা। রাজা জানশ্রুতি সম্পূর্ণ কথোপকথন শুনলেন। অবিলম্বে তাঁর মানসিক স্থৈর্য অন্তর্হিত হলো। তাহলে এতদিন ধরে তাঁর এত কাজ সব বৃথা? তাঁর অর্জিত কর্মের ফল রৈক্কের কর্মফলে যুক্ত হয়েছে? তাঁর সঞ্চয় শূন্য? জীবন যেন এক লহমায় মুল্যহীন হয়ে গেলো। জীবনের লক্ষ্য তাঁর কাছে স্থির ছিল। সেই একমুখী লক্ষ্যে অবিচল থেকে তিনি পরমার্থ লাভে ব্রতী হয়েছিলেন। কিন্তু আজ যেন সেই স্বর্গ থেকে পতন হলো তাঁর। দিবসের দাবদাহ থেকে নিশীথের শীতলতা বেশি অস্বস্তিকর হয়ে উঠল। সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারলেন না। অবশেষে প্রত্যূষে ডেকে পাঠালেন ক্ষত্তাকে। সন্ধান চাই রৈক্কের। কে এই মহামহিম? এতকাল কেন তাঁকে জানা যায়নি? তাঁর রাজ্যসীমার মধ্যে তিনি বাস করেন অথচ রাজা জানেন না? কিন্তু অনুসন্ধান গোপন রাখতে হবে। 

নগরের প্রতিটি স্থান তন্নতন্ন করে খুঁজেও রৈক্ককে পেলেননা অধিরথ। কে এই মহাপুরুষ? বিফলমনোরথ হয়ে ফিরে গেলেন রাজপুরীতে। নতবদনে জানালেন ব্যর্থ হয়েছে অনুসন্ধান। পাওয়া যায়নি তাঁকে। আর ঠিক তখনই রাজার মনে খেলে গেলো চকিত বিদ্যুতের মতো একটি সূত্র। রৈক্ক ব্রহ্মজ্ঞ! রৈক্ক সর্বজ্ঞ! তাই তাঁর পূণ্যার্জন কোনও সীমিত সংখ্যায় নয়! তিনি অমিত পুণ্যের অধিকারী! অনন্তপুণ্য তিনি! নব উন্মেষে উদ্দেপ্ত রাজা আজ্ঞা দিলেন – ক্ষত্তা, কোনও নগরে তাঁর অনুসন্ধান কোরোনা। জনবিরল যে স্থানে কোনও ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ বাস করেন সেরকম স্থানে খুঁজে এসো। নিশ্চয় পাবে। অধিরথ ক্লান্ত। মনে মনে সব আশা ছেড়েছেন। তবু রাজার আদেশ। সখাও বটে। তাঁকে স্বস্তি দিতে না পারলে তিনি নিজেও স্বস্তি পাননা। আরও একবার সন্ধানে গেলেন তিনি। সোজা রথ ছুটিয়ে দিলেন নগরের সীমানা ছাড়িয়ে। প্রবেশ করলেন অরণ্যে। আর সেখানেই দেখতে পেলেন একটি ক্ষুদ্র শকট। সেই শকটের নীচে বসে আছে এক ব্যক্তি। সর্বাঙ্গে তার খোস। সে মুখভঙ্গি করে পরম আরামে চুলকে চলেছে সেই খোস পাঁচরা। ভীষণ ঘৃণায় মুখ কুঞ্চিত করে অধিরথ চলে যেতে চাইলেন। এ রৈক্ক হতে পারেনা। তবু একবার কর্তব্য স্মরণ করে জিজ্ঞাসা করলেন – আপনিই কি মহামতি রৈক্ক? খোস চুলকোনো অব্যাহত রেখে পুরুষ উত্তর দিলেন – হ্যাঁ আমিই রৈক্ক। কালক্ষেপ না করে অধিরথ ফিরে এলেন রাজার কাছে। জানালেন – অত্যন্ত ঘৃণ্য দৈহিক অবস্থায় একটি ক্ষুদ্র শকটের নীচে বিশ্রামরত এক ব্যক্তিকে দেখেছি। তিনি নিজের গায়ের দুষিত ক্ষত ক্রমাগত নখ দিয়ে চুলকে চলেছেন। এত দুষিত এত পূতিগন্ধময় দেহ, এমন একজনকে মহামতি রৈক্ক ভাবতে আমার প্রবল অনীহা জন্মাচ্ছে রাজন। রাজার মুখ কিন্তু উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চোখের তারায় এক অপার্থিব আলো। ক্ষত্তা বোঝেননি যে মহামতি তাঁর স্বরূপ গোপন করেছেন। যোগ্য পাত্রের কাছেই নিজেকে উন্মোচন করবেন। কিন্তু এখন ক্ষত্তাকে সেকথা বোঝাবার অবকাশ নেই। মুহূর্ত চলে যাবে। মহাকাল জানশ্রুতির জন্য আচার্য চিহ্নিত করে দিয়েছেন। সম্বর্গ বিদ্যার আচার্য। যে বিদ্যা অধীত হলে জানশ্রুতির কর্মের পূণ্যফল আর সীমিত থাকবেনা। কারণ অনন্ত অক্ষয় সেই পূণ্য কোনও কর্মার্জিত হবেনা। হবে এক অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের উন্মেষে। 

তখনই অধিরথের রথ ছুটল অরণ্য অভিমুখে।

0 comments: