5

ছোটগল্প - উত্তম বিশ্বাস

Posted in


ছোটগল্প


কাঁকড়া
উত্তম বিশ্বাস



দোনের সুতো একবার দলা হলে আর রক্ষে নেই!---সেদিন থ্রু হাতেই রাত কাবার! আজ নিজের মাথার চুল নিজেই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল বিশেনাথের। মাথাটা ঝিম ধরে আসে। ক্লান্ত চোখদুটি করুণভাবে ঝুঁকে পড়ে ফ্যানাহীন স্বচ্ছ জলের গভীরে। সহসা কয়েক কুচি ক্ষয়াটে চাঁদ হেসে উঠল যেন ঘোর লাগা নিশিথ তরঙ্গের মতো! ক্ষুধার্ত চাঁদের মুখে বালিহাঁসের পাখা উড়ে এলেও অনেকসময় রাত রাক্ষুসী হয়ে ওঠে। বিশেনাথ আজ স্পষ্ট দেখতে পায়,-- আজ তার নোনালাগা মাটির দাওয়ায় মা শিবানীর বহুদিনের চেপে রাখা ভাত আহিংকে হাসি এক্কেবারে শালিধানের খইএর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। হ্যাঁ হ্যাঁ এই তো--- আজ দু’জনকেই একসঙ্গে খেতে বসার ব্যবস্থা করেছে হিংকু। 

ঘুম ঘন হয়ে আসে। কথা হয় কুলুকুলু জলের গভীরে, “আর ঝাই বলো বুড়ির খাই আচে মন্দ না!” বিশের বৌ হিংকু। চোখ টিপে ঠারেঠোরে কর্তার সাথে ইয়ার্কি ফাজলামো মারার চেষ্টা করে। বিশেও বৌয়ের তালে তালে হাসার চেষ্টা করে, কিন্তু সে হাসিতে তুষের আগুন মেশানো। বিশের মন ভালো নেই। বুড়োকে খেতে দেওয়া হয়েছে বাঁশের মাচায়। বুড়ো লবাই বিশের আশি উত্তীর্ণ বাপ। যদিও এতটা বয়স হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। আসলে অনাহারক্লিষ্ট পেট আর নোনা হাওয়ায় এখানকার মানুষের জীবন বুড়িয়ে যায় তাড়াতাড়ি। হিংকু সারা বিকেল ধরে বেটে ঘষে ভাগে ভাগে রান্না করেছে,--কড়াই ডাল, আলুমাখা, রুই মাছের ডিমের বড়া, আর বয়লারের ছাট-ছাল। বুড়ির পাতে ডিম বড়া দু’খানা বেশিই ফ্যালে হিংকু। কেননা এবারের যাত্রা বুড়ি তার স্বামীকে ছাড়তে রাজি হয়েছে। তবুও ওকে দিয়ে বিশ্বাস নেই হিংকুর। তাই সে আরও একহাতা ডাল সেঁচতে সেঁচতে মুখ তোলসো করে বলে, “বোঝোই ত সুমসারখানার কী হাল। তার ওপর ভাড়ার লৈকো। রাক্ষুসীর বুকির ওপরে বসত। আর এক চাং ভাঙলিই গোটা সুমসারডা মাতলায় চেটে লি গে বেরোবে। বুঝো। লৈকোয় উঠলিপারে আজ আবার সিদিনগারের মতোন ঝ্যান চিক্কিছেড়ে কান্তি বোসো না।” 


“শেষ রাতে ভাঁটা ভাঙলে তবেই নৌকো ছাড়বে গগন। বোঝ তো ভাড়ার ভুটভুটি; নিত্যদিন অপ গেলি অন্যকারো হেপাজত হতি পারে!” বিশে তার মা’কে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে। গগন আর লবাই সমবয়সী। কোনও কোনও দিন হাল ধরত গগন আবার কোনও দিন বা লবাই। কিন্তু ইদানীং লবাইএর আর উঠে বসবার চারা নেই। তবু ক্ষুধার সংসার তাকে ছাড়বে কেন? গগনকে দুদিন অবসর দিলেও চলে, কেননা নৌকোটা তো তার,--- আর ওপর গুড়োয় বসলে আর এক ভাগ। কাঁকড়া বেঁচা কুস্তের সব কাঠিই যদি বেরিয়ে গেল তার আবার থাকল কী! এসব চিন্তা একা একা করে বিশে। তার আগে ভরা পেটে খানিক ভাতঘুম মেরে নিতে চায় বিশে। হিংকুর চোখের পাতাজোড়াও আজ আর কিছুতেই এক হতে চায় না। দু’লাখ টাকার স্বপ্নে অস্থির হয়ে ওঠে ওর ময়লা কাঁথা মাদুর জড়ানো শরীর মন। “খালধারে দু’কাঠা বসত জমি হবে। পেটে এট্টা এলে এট্টু ফুড পড়বে। আর বাকী টাকায় নিজের বলতি একখান লৈকো, ক’গাছি জালসুতো--দুচারখান কানা উঁচু থালাবাসন তো হবে।” এসব হাজার চিন্তা উকুনের মতো কিলবিল করে ঘুরতে থাকে হিংকুর মাথার মধ্যে। একসময় বিশের গায়ে গুঁতো দিয়ে কাছে টেনে নিয়ে বলে, “কোই? কিছু এট্টা করো তো! এত অঞ্জালা কেন বুঝি না!” বিশেও একসময় আদরে আদরে অস্থির হয়ে হিংকুর বাহুপাশ থেকে ক্লান্ত শরীরটাকে মুক্ত করে উঠোনে বাঁশের মোড়ায় এসে বসে। দেখে নেয় তার বাবা লবাই ঘুমিয়ে পড়ল কিনা। লবাই খাটিয়ায় নেই। মনের ভেতর খটকা লাগে বিশের। একটু এদিক ওদিক উঁকি মেরে আবার হিংকুর গায়ে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দেয় বিশে, “হেই! শুনচিস? বাবা কনে গেল?” হিংকু ঘুমঘোরে তিতো টিপে বলে, “বুড়ি বয়েসে তোমার মায়ের রেল্লা মন্দ না! দ্যাখো আবার মাশারীর মদ্দি ঢুকেছে কিনা?” বিশে বসে বসে একটা বিড়ি ধরিয়ে সময় অতিবাহিত করার চেষ্টা করে। এত শীতে এটুকু আগুনে শরীর খুব একটা তাতে না। হিংকুর কাঁথার ওম ভেঙে গেল; সেও আর আগ্রহ দ্যাখাবে না। হঠাৎ বুড়ির মাশারীর মধ্যে থেকে লবাই এর খুচখুচে কাশির আওয়াজ আসে। হিংকু এবার দুপদাপ করে পা ফেলে হোগলা পাতার বেড়ায় হাতের চাপড় মেরে ডাকে, “মা! বলি কী কতা ছিল? ক্যান এইভাবে উনার মাথাডা চিবাচ্ছো? লৈকো ছাড়বে। উনাকে ছাড়তি ঝেদি মন না সরে, তুমি নিজেও ত ঝাতি পারো!” এরপর বিশের ওপর ঝাল ঝাড়তে থাকে, “কোই গেলে? তুমারও ছেমোয় পেয়েচে না কি! কুকড়ো দুটো ঝটপট ড্যানা মুচড়ে ন্যাও না কি!”


কিছু কিছু জায়গা আসলে ভুটভুটির মেশিন বন্ধ করে সন্তর্পণে এগোনোই নিয়ম। কেননা কোর এরিয়ায় একবার ধরা পড়লে জেলের ঘানি নিঘঘাৎ! কথা বার্তাও চালাতে হয় সংকেতে। কিন্তু বুড়োকে বোঝায় কে! অনবরত সে কানমাথা জ্বালাতেই থাকে, “অ বাপ! বিশে! এইবার এট্টা বাচ্চাকাচ্চা নিস।” বাপের কথায় বিশে জবাব না দিলেও; মনে মনে ভাবল, “ঠাকুর দক্ষিণারঞ্জন ঝেদি মুখ তুলে চায়, লিচ্চই এবার দান এট্টা বাধবে।” আজ অনেকটা রমনসুখ লাভ করেছে বিশে। চোখে মুখে এখনও তৃপ্তির ছাপ। স্রোতের বেগ সামাল দিতে মুঠো শক্ত হয়ে আসে। সে জোরে জোরে বৈঠা চালায়। উত্তুরে ঝামট আসে খুব। নোনা খাড়ির সব লবণ যেন সূচ হয়ে ছুটে আসে ওদের দিকে। বাবার ওপর করুণা হয় খুব। বিশে জিজ্ঞেস করে, “ অ বা, এট্টা বিড়ি খাবা?” লবাই এত কথা শুনতে পায় না। জল আর হাওয়ার শব্দ ওকে ইহজগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। হঠাৎ বুড়ি মায়ের জন্যে বিশের বুকের ভেতরটা হুহু করে ওঠে। বেচারা বুড়ি শিবানী! পেটে ভাত নেই; কব্জিতে হাড় কখানা ছাড়া কী বা আর অবশিষ্ট আছে।—অথচ সকাল সন্ধ্যা শাঁখা নোয়ার শব্দে শুকনো সানকিগুলোর কানমাথা অস্থির করে তোলে। একটা ছায়-রঙ্গা রুক্ষ চুলের সিঁথি; নোয়া শূন্য রাক্ষুসী চেহারার একজোড়া কংকাল হাত বারবার বিশের পেছন থেকে ওর নৌকোর বৈঠাখানি টেনে ধরে কাকুতি মিনতি করতে লাগল, “অ বাপ! বিশে! ব্যাগ্যাতা করি তোদের!--- এ পাপ তুরা করিসনে!” সহসা সমুখেই একটি ট্রলারে ঠোক্কর খেয়ে সম্বিত ফেরে বিশের, “হেইইইইইইই! বিশে না? এই শীতে জ্যাঠারে? কোন মতলবে?” বিশে কথার ঘোলা ঘুরিয়ে জানতে চায়, “তোর দোন কদ্দুর কেয়ে? চাগালি?--- কিছু টের পাস? কাঁকড়া আজ ব্যাঙও খেতি চায় না রে। মুরগীর ছাল মাস তাও না! ইবার কী নিজের হাতপা কেটে গাঁথতে হবে বঁড়শিতে কী জানি বাবা---!” কেয়ে কথার বহর মেপে আরও দূরে সরে যায়। বিশে নিজ এরিয়া খুঁজে আরও দ্রুত বৈঠা চালায়। নেতাধোপানির ঘাট পেরিয়ে কিলো তিনেক ভেতরে ঢুকলেই কাঁকড়া খাঁড়ি।--- সবাই বলে অভাবী বাঘ-মানুষের এটাই নাকি সত্য কুরুক্ষেত্র! তারজালি ঘেরা নদী। ভাগে ভাগে সুন্দরী, শ্বাসমূল, আর ঝোপ ঝোপ হেতাল ধুঞ্চে আর মুলি বাঁশের ঝাড় পেরিয়ে সন্তর্পণে এগিয়ে যেতে থাকে বিশে। 

বুনো জিনিসের গন্ধ ঠিক চেনে বিশে। গতমাসে ঠিক এইখানেই এসে ভাগ্য ঘুরে গেল ভোলার! ওর এখন দু’দুটো নৌকো; গলুই ভর্তি ফর্সা জাল,---উঠোনে দুটো ছেলেমেয়ে সকাল সন্ধ্যায় গড়া খায়। পেটেও একটা। ভোলার বৌ এখন ট্যাংরামাছের মতো পেট নিয়ে বিশের উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করে আর জরদা মেশানো ভুরভুরে পানের পিক ফেলে যায়। এসব দেখে শুনে লম্বা লম্বা শ্বাস ফ্যালে বিশের বৌ, “আজ গেলিও ঝেতি হবে। কাল গেলিও ঝেতি হবে। সুমায় ত প্রায় ফুরিয়েই এয়েচে, কী বলো দি।--- এট্টু সাহস!-- এই ঝা। এছাড়া ত আর কিছু না। কিন্তু শ্বাশুড়ি!--- ছেলেডার সুমসার খানা ঝে ভেসে ঝেতি বসেছে এটুনিই বা উনার বুঝায় কিডা!” কথার ফাঁকে ফাঁকে ভোলার বৌ ভক্তিভরে দক্ষিণারঞ্জনের মাহাত্ব গুঁজে দিতে থাকে হিংকুর মাথায়। এসব গল্প শোনে আর রাতে শুতে এসে বিশের কানের লতিতে পাতলা কামড় বসিয়ে হিংকু বলে, “আগে তুমার বাবা দ্যাখো রাজি হয় কি না? তারপর আমিও তুমার এট্টা নতুন জিনিস দোবো।” বিশে দেহের সকল সঞ্চয় নিংড়ে দিয়ে পাশ ফিরে শোয়।

“কি গো কিচু বললে না ঝে?”
“হেই! কী বলিস ওসব? তাই কখনও সম্ভব?” 
হিংকু চোখ চার হাত কপালে তুলে বলে ওঠে, “ভোলার বাপ পুণ্যিবান বলতে হয়। ছেলেরে রাজা বানিয়ে দিয়ে গেল! আর তুমার ওই মা রাক্ষুসী, এখোনো চেটেপুটে খাওয়ার বাসনা ত্যাগ করতি পারলে না কো।” নৌকোর তলের ছলাৎ ছল কথার লহরি যেন হিংকুর কথা হয়ে ফিরে ফিরে বাড়ি খেয়ে ওঠে। হাঁটু সমান জলে এসে নৌকোটা একটা হেতাল গাছের সঙ্গে বাঁধল বিশে। এর বেশি ডাঙায় আর উঠবে না। এরপর কাদা টিপে টিপে ডাঙায় উঠে অনেকটা জায়গা জুড়ে কী যেন একটা অনুসন্ধান করতে চাইল। নৌকোয় ফিরে এসে দাঁতের ফাঁকে এককুচি বিড়ির আগুন চেপে নিয়ে হাতের হ্যাচকা টানেই মুরগী দুটোর ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করে ফটাফট ফেড়ে ফেলল। তাজা রক্ত খানিকটা জলে, খানিকটা নৌকোর খোলে--- আর বাকিটা লবাই এর মুখে এসে লাগল। নাড়ি দুটো একত্রে জুড়ে লবাই এর মাথার ওপর দিয়ে ডাঙার দিকে ছুঁড়ে মারল। তারপর পাটাতনের ফাঁক থেকে ছুরি বার করে যখন কুচি কুচি করে কাটতে লাগল, তখন গলুইতে বসা লবাই কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বিশেকে বলল, “অ বাপ! আমি বঁড়শি কডা গাঁথব?”

“না। তুমি নাড়িটার মাথা ধরে টান মারো। যাও ডাঙায় যাও।” বুড়ো কাঁচা নাড়ি টানতে টানতে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। বিশে বঁড়শিতে মাংস গাঁথে আর একের পর এক টোপ ফেলতে ফেলতে নদীর অনেক গভীরে ঘন কুয়াশায় মিশে যেতে থাকে। মাঝে খানিক বুড়ো বনবিবির গল্প বলা শুরু করেছিল, কিন্তু সে আর বিশের শোনার অবকাশ হলো না। “অনেকগুলো বঁড়শি। এমনিতেই শীতের দিনে সব প্রাণীদের খাওয়ার চাহিদা থাকে না। তার ওপর দক্ষিণারঞ্জন যদি দেবী মাহাত্বে সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষা নেন তাহলে সব পরিকল্পনা ঘোলা জলে ঘোল হয়ে যাবে!” বিশে ভাবে।

ক্লিশে একটা আর্তনাদ, কিম্বা ভয়ার্ত বনহুংকারে আকাশবিদারী এমন একটা কিছু সংকেতের জন্যে বিশের কান দুটি উন্মুখ হয়ে ছিল অনেকক্ষণ। আজ কাঁকড়ারাও তাজা মাংসে কামড় বসাচ্ছে খুব! বঁড়শি তো ওরা গেলে না; শুধু নরম মাংসের মণ্ডটা জটের মতো হাতপা দিয়ে জড়িয়ে ধরে থাকে মাত্র। দোন চাগাও আর চ্যাগজালে বাধিয়ে ফটাফট নৌকোর খোলে চেলে ফ্যালো; ব্যাস! আর কামড় কসালে? গলুইতে সজোরে এক আছাড় মারলেই ঘিলু পিণ্ডি ছিটকে সাতসমুদ্র হলুদ হয়ে যাবে! কিন্তু না, এত যন্ত্রণা সত্বেও আছাড় মারতে মন চায় না কারও। কেননা এরাই তো জেলে জাতির অসময়ের আদি পিতা-মাতা। হাতপা ধরে একটাকে বাজার পর্যন্ত আনতে পারলেই নুন-তেলের খরচ উঠে যায়! আছাড় মারবে কোন দুঃখে? বিশে সুতো চাগিয়ে টোপ থেকে একটার পর একটা চেলে ফেলতে থাকে নৌকোর খোলে। কাঁকড়ারা একটাও পালাতে পারে না। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। ওরা কেউ কাউকে ছেড়ে বাঁচতে পারে না যে! কেননা, কানা বেয়ে একটা ওপরে উঠেছে না অমনি আর একটা ঠ্যাং ধরে নীচে নামিয়ে আনবে। বিশে দ্যাখে; আর মনে মনে হাসে, “শালার মাদী কাঁকড়াটা ঠিক আমার মা শিবানীর মতো। কিছুতেই ছাড়বে না! মরবে গুতে মুঁতে পচে!--- তেঁও সুকসারী হয়ে বাঁচার বাসনা কত!”

সুতো গোটাতে গোটাতে পুবদিকের আকাশটা লাল হয়ে আসে। বিশে নৌকো লাগায়, ঠিক যেখান থেকে সুতো ছাড়তে শুরু করেছিল ঠিক সেইখানে। খুঁটিতে বাঁধা মুরগীর নাড়ির সংকেত ধরে ধরে ডাঙায় ওঠে বিশে। সহসা বুকের মাঝে অবশিষ্ট নোনা রক্তটুকু বাড়ি খাওয়া জলের মতো ধক করে ওঠে! সংরক্ষিত এরিয়ার অনেকটা কাছাকাছি এসে পড়েছে সে। না। কোত্থাও নেই তার বাবা। শুকনো খোনা কণ্ঠে দু’একবার “বাবাআআআআআআআআ! বাবাআআআআআআআ!” বলে ডাকবার চেষ্টা করলেও গলা বুজে আসে তার। নৌকোয় উঠে হাউমাউ করে কেঁদে একেবারে হাল ছেড়ে দেয় সে। পিতৃহারানো বিয়োগ ব্যথায় অবুঝ সন্তানের নৌকো একা একাই তুফানের বেগে সাগরের দিকে ভেসে যায়। 

বিধ্যাধরীর সংযোগস্থল পেরিয়ে মূল মাতলায় একবার পড়তে পারলেই ফিরতি পথে জোয়ারের বেগ থাকে দারুণ। ঠিক যেন হিংকুর ইচ্ছের মতো। গা গতর খিচ মারা ব্যাথা। কান্নাকাটি তো অনেকটাই করেছে সে; অতএব আর না। বিশে হাল ছেড়ে দিয়ে ঝিমটি মেরে নেয় কিছুক্ষণ। ফরেস্ট রেঞ্জার বাবুরা বার বার জিজ্ঞাসা করতে থাকেন, “তোমার বাবার বয়স একজ্যাক্ট কত ছিল? চলন শক্তি ছিল কি না? গায়ের রং? পরনের জামাকাপড়? এর আগে সরকারী কোনও অনুদান পেয়েছে কি না? মা কার সাথে থাকেন? তিনি কার কাছে খান?--- সত্যিই কী মাছ ধরবার জন্যে, নাকি মৃত পিতার সৎকারের----?” বিশের চোখ গোল গোল হয়ে আসে, “এমা! অফিসার বলেন কী!” কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে থাকা কেয়েকে এগিয়ে দেয় বিশে। সঙ্গে সঙ্গে কেয়েরও জবান রেকর্ড করা হয়। সেও সাক্ষী কিনা! যতই হোক নিজের বাপের নামে এতবড় একটা দুর্ঘটনার অভিযোগ খাঁড়া করতে হলে সাক্ষী সবুত লাগে তো বটেই। কত আর নেবে কেয়ে?--- বড়ো জোর হাজার বারোশো? সে না হয় অবসরে চুক্তি ফুরিয়ে নেবে অখন বিশে। ভালোয় ভালোয় পুলিশ কয়ারিটাতো হয়ে যাক! কেয়ে এক্কেবারে ভোরের আগের কাঁকড়া খাঁড়ির মুখ থেকে সুতো ছাড়ার ঘটনা থেকে ফরফর করে বলতে শুরু করে! পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হিংকু দাঁতে কাপড় কেটে অস্থির হয়ে ওঠে, “ওফফফ! এক খানা দু’লাখি চেক লিখতে গিয়ে সাত সাগর ঘুলিয়ে ফ্যানা ফ্যানা করে ফ্যালছে দেখছি! দেবে ত সরকারি টাকা। তাতেও এত আঠা!”

নৌকো থেকে সেঁউতি ভরা জল ছুঁড়ে মারে গগন, “হেই! বিশে আর কত বেলা! ওঠ। না হলি পরে লৈকো দনগাজোরা থেকে উলটো সাগর পানে ধা করব্যানি। বাজার যাবি তো? আমি বুড়ো মানুষ শরীলটা কিন্তুক ভালো না! ---- গোসাবা, নাকি বাসন্তী?”

স্বপ্নছেড়া চোখে সেই বুড়ো গগনকেই দ্যাখে বিশে। আর প্রতিদিনই এমনিভাবেই সমূহ সম্ভাবনাগুলি ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। ওর ভেতরটা রী রী করে ওঠে, “এই তো ল্যাওড়ার ক্যাঁকড়া! তার আবার কাশেমবাজার!” বেলা বাড়তে থাকে। গগন নেমে যায় আগের ফেরী ঘাটে। অনেকখানি অশ্রদ্ধা আর আঁশটে জলের ফ্যানা নিয়ে বিশের নৌকো একসময় ঘাটে এসে ভেড়ে। 

খবর পেয়ে হাঁড়ি নিয়ে হুড়মুড়িয়ে নৌকোর খোলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংকু। পেছনে রাক্ষুসী চেহারার ক্ষয়াটে খরবুটে আলুথালু চুলের মা শিবানী। নৌকোর খোল ভর্তি গ্যাজলানো জলে সিঁদুর পরা দুটি মুখের ছবি পাল্লা দিয়ে দুলতে থাকে পাশাপাশি। সূর্যের রোদে ঝলক লাগে বিশের চোখে। কাঁকড়াদের সাঁড়াশি দাঁত আর ডাম্বেলের মত লম্বা লম্বা চোখ উঁচু হয়ে থাকে ওদের দিকে। বিশের বুকের ভেতরটা ব্যথায় টসটস করে ওঠে। এরপর জলের ঝাপটা দিয়ে চোখের পিচুটিটুকু ধুয়ে নেয় সে।–ঘুমটুকুও।

হাতের জল মুছে, বিড়ি ধরিয়ে মা ও বৌয়ের প্রতি রোজকার মতো ব্যাতিব্যস্ত হয়ে বকরবকর করতে শুরু করে বিশে, “হেই! ওসব থ্যাঁতলানো মরা কাঁকড়া হাঁড়িতে তুলতিছো কোন দুক্ষি শুনি? ফ্যাল। হাভাতের পাল ওসব ফ্যাল!” 

বিশের বৌ খানিকটা লজ্জা পায়; কিন্তু পরক্ষণেই নদীঘাটে সর্বজয়ার মতো হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বলে, “বুড়ো মানুষটা কদ্দিন ধরে বিছেনে পড়ে রয়েচে। দু’খোন বেটে বড়া করে দিলেও তো খাতি পারে। কদ্দিন বা আর বাঁচবে বলো!” বুড়ি শিবানীর চোখদুটি সদ্য ফোঁটা পদ্মের মতো টলমল করে ওঠে। বিশে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে সর্বংসহা হিংকুর দিকে। হিংকুর কথাটা ওর মুখের ওপর যেন কাঁচা আতার ছালের মতো এসে বাড়ি খেল! স্বপ্নের মাঝে এই হিংকু কোথায় থাকে? আর যে আসে কুহকিনীর মতো নষ্ট চাঁদের প্রতিবিম্ব হয়ে, সে কে? মুহূর্তের মধ্যে মনের সমস্ত কালি, রাতের দুঃস্বপ্ন মুছে গিয়ে হিংকুর প্রেমে বিশের বুকের ভেতরটা আবারও ভরা নৌকোর মতো ছলকে উঠল। 

কিন্তু একটি বারের জন্যেও মুমূর্ষু বাপের কুশল জিজ্ঞাসা করতে সাহস হয় না ওর।

5 comments:

  1. অসাধারণ লেখা । মন ছুঁয়ে যায় । জীবন এখানে যেন আশা আর কামনার মিশ্রণ । জীবন আছে এক অন্য নদীর বাঁকে । ভেসে ভেসে তীরে থেমে থাকে না । অঙ্কুরিত জায়মান বীজ মনের মধ্যে বাসা গড়ে । অনেক হিসাব মেলে না তবু ভালোবাসা বার বার আসে, ভাসিয়ে দেয় খড়কুটো । জীবনের যন্ত্রণা পাশ ফিরে শোয় । দারুণলেখা

    ReplyDelete
    Replies
    1. কলমের ক্লান্তি দূর হয়ে যায় আপনাদের এমন স্পর্শ পেলে। ঋদ্ধ করলেন দাদাভাই!

      Delete
  2. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  3. (প্রথমাংশ)
    অষ্টাদশ শতাব্দিতে ইউরোপীয় নবজাগরণে মানবতাবাদের প্রাণ-প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত। পেত্রার্ক, দান্তে, ট্যাসো, শেলি, কীটস, বায়রন, শেক্সপিয়র প্রমুখ মনিষীদের সুউচ্চ ভাবাদর্শ এবং উদারনীতিক মানবতাবাদী সমুন্নত চিন্তাভাননার অনুবর্তনে ঊনবিংশ শতাব্দির প্রারম্ভকালে বাংলাসাহিতও তথাকথিত মধ্যযুগীয় ভাবধারার অন্তর্গত ভক্তিবাদের ফেনিল উচ্ছ্বলতা আর অলৌকিকতার খোলস উন্মোচন করে আধুনিকতার আলোকতীর্থে পদার্পণ করে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, মধুসূদন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ মনিষীদের হাত ধরে। যদিও বৈষ্ণবীয় প্রেমগীতিতে বিশেষ করে চণ্ডীদাসের পদাবলীতে, রামপ্রসাদের কড়াপাকের ভক্তিরসে, মুসলিম কবিদের মর্ত্যপ্রীতিতে আর ভারতচন্দ্রের সাংবাদিকসুলভ চটুলতার মধ্যে আধুনিকতার চকিত চমক থাকলেও প্রকৃত যে মানবতাবাদ তা উপেক্ষিতই ছিল।সেই অর্থে বাংলাসাহিত্যে আধুনিকতা প্রণয়নের একমাত্র ভগীরথ হলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অবশ্য সেকেলে কিছু রবীন্দ্র-বিরোধীগোষ্ঠী ছিলেন যারা রবীন্দ্রসাহিত্যে উৎকলিত আধুনিকতা তথা মানবতাবাদকে বাইরে থেকে আরোপিত বলে মনে করতেন। তাই কিছুটা তাচ্ছিল্যজাত অবঞ্জা আর বাকীটা ঐতিহাসিক অনিবার্যতার কারণে বাংলাসাহিত্যে জন্ম নিলেন একদল রবীন্দ্রবিরোধী উত্তরসাধক। কল্লোলগোষ্ঠীর নবযৌবনপ্রাপ্ত এই লেখকবৃন্দের কর্ণবিদারী সুউচ্চ কাকলী-লহরী আর বিদ্রোহ ঘোষনার মধ্য দিয়ে বাংলাসাহিত্যে নবরূপে আবির্ভূত হল তথাকথিত মানবতাবাদ। নজরুল, শরৎচন্দ্র, মানিক,তারা,বিভূতি,ভূদেব, প্রেমেন্দ্র, বুদ্ধদেব, জগদীশ প্রমুখের কলমের আঁচড়ে ধূলিমলিন মর্ত্য-পৃথিবীর নানা সমস্যা ও দুঃখ-দারিদ্রদীর্ণ অসহায় মূক মানুষগুলো ভাষা ফিরে পেল।কখনো একক আত্মগত সংঘাতে, কখনো গোষ্ঠীগত কোন্দলে, কখনো জরাজীর্ণ ভাঙাচোরা সংসার জীবনের কঠিন সংগ্রামে কখনো বা আপন অস্তিত্ব রক্ষার কঠিন লড়াইয়ের বর্ণাঢ্য দৃশ্যে গন্ধে অতি তুচ্ছ অপাঙক্তেয় অসহায় এইসকল মূক মানুষগুলো উঠে এল।অবরুদ্ধ মানুষগুলির প্রাণ সাহিত্যিকদের হৃদয়-দীগন্ত থেকে উত্থিত দখিন বাতাসে মুখরিত হয়ে উঠল। বিশেষ করে মানিক,তারা আর মহাশ্বেতা পরবর্তী উত্তর-আধুনিক বাংলাসাহিত্যের আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে বিদ্ধৃত নিঃস রিক্ত নিরন্ন মানুষের যথার্থ জীবনচিত্রনের সঙ্গমধারায় এসে মিলিত হলেন একালের অখ্যাত কিছু সাহিত্য-জনেরা। এঁনাদের মধ্যে অবিসংবাদিত নাম নিতে হয় বিখ্যাত লেখক উত্তম কুমার বিশ্বাসের।
    গল্পকার উত্তম বিশ্বাসের অধিকাংশ গল্পই যেন প্রান্তিক মানুষের জীবন-ভাষ্য।একএকটি বিশেষ আঞ্চলিক স্বাতন্ত্রতায় তারা উজ্জ্বল। স্বল্প পরিসরে আর আপন ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তিতে তারা প্রত্যন্ত দ্বীপবাসী হয়েও সকল সামাজিকের হৃদয়ে চিরকালের জন্য আসন লাভে সমর্থ হয়ে ওঠে।সুগভীর কোন জীবনবোধ না থাকলেও আত্মগত জীবনদর্শনে এরা চিরসমুজ্জ্বল। আলোচ্য 'কাঁকড়া 'গল্পে অতি সংক্ষিপ্ত পরিসরে বর্ণিত বিশে চরিত্রের মধ্যে সেরকমই জীবনদর্শনের পরিচয় পাওয়া যায়। এ গল্প আসলে বিশে নামক এক অসহায় অখ্যাতজনের নিষ্ঠুর ভবিষ্যতের কাছে আত্মসমর্পণের ইতিহাস।একদিকে মুখরা ও মেকী লাস্যময়ী স্ত্রী হিংকুর যৌন আবেদন অন্যদিকে অকেজ পিতা মাতার সকরুণ মুখচ্ছবি বিশেকে ক্ষত বিক্ষত করে তুলেছ।
    (ক্রমশ)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি অভিভূত হে বিদগ্ধ পাঠক। শ্রী বিশ্বজিৎ বিশ্বাস। আপনার কলমের কাছে বসে রইলাম চুপচাপ।

      Delete