ছোটগল্প - দেবদত্তা ব্যানার্জী
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
চক্রবূহ্য
দেবদত্তা ব্যানার্জী
(১)
খুব ভয় করছে মুনাইয়ের। চাকরিটা ওর ভীষণ দরকার। ছাড়তে পারবে না। বাড়িতে বিধবা মা, দুটো ছোট ভাই বোন। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছে এই চাকরিটা ধীরে ধীরে ওকে অন্ধকারে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। এখন বুঝতে পারছে ইন্টারভিউ-এর সময় ওর এ্যাকাডেমিক রেকর্ড খারাপ হলেও কেন চাকরিটা পেয়েছিল! আসলে সে সময় একটা চাকরির খুব দরকার ছিল। ওরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাড়ির কথা জেনে নিয়েছিল। মুনাইও বলে দিয়েছিল সব।
অফার লেটারে মাইনের অঙ্কটা ওর ভাবনার থেকে বেশিই ছিল। কিন্তু কয়েক মাসেই ও কেমন হাঁফিয়ে উঠেছে।
ইন্টারকমটা মুনাইয়ের চিন্তার জাল ছিন্ন করে বেজে উঠতেই রিসিভার তুলল ও। কুসুমিকা অনাথ আশ্রমের ফাইলটা নিয়ে ওকে তক্ষুনি ডাঃ সরকারের ঘরে যেতে বললেন ডাঃ জানা।
কাঁপা হাতে ফাইলটা নিয়ে গিয়ে ঢুকল ও। ওকে বসতে বলেই দু জন ডাক্তার ফাইলটা ভালো করে দেখে বললেন একটা পেন ড্রাইভে সব রিপোর্ট কপি করে হার্ড ডিস্ক খালি করতে।
আবার টেবিলে এসে বসে কাজ শুরু করল মুনাই কাঁপা হাতে। এই লাইফ কেয়ার নার্সিংহোমটায় ওকে ডেটা অপারেটরের কাজ করতে হয়। আজ ছয় মাস এই কাজটা করছে। ওর ঘরটা আলাদা, ল্যাবের পাশে ছোট একটা ঘর। ও আর রিমা দু জনে এদিকটা সামলায়। অবশ্য এর বাইরে এদের এই এনজিও রিলেটেড অনাথ আশ্রমের কাজ মুনাইকেই সামলাতে হয়। এখানে ‘কথা কম কাজ বেশি’ নীতিতে চলতে হয়। প্রথম প্রথম অনেক কিছুই বুঝত না ও। কিন্তু এই কয়েক মাসে অনেক কিছুই জেনেছে। বেশ কয়েকটা রাজ্যে ওদের এনজিও কাজ করে।
রাতে একা ছাদে এসে দাঁড়িয়ে ছিল মুনাই। বাতাসে বৃষ্টি ভেজা জুঁইএর মিষ্টি গন্ধ। ওর মনটা ভালো নেই। কুসুমিকা অনাথ আশ্রমটা ওদের এনজিও চালায়। প্রায় তিরিশটা অনাথ মেয়ে ছিল। ওরা একটা হেলথ চেক-আপের ক্যাম্প করেছিল। গত মাসেও ডাঃ জানা সেই ফাইলটা নিয়ে কি যেন দেখছিলেন। তারপর তিনটে মেয়েকে আনা হয়েছিল আশ্রম থেকে। বয়স সব আঠারো থেকে পঁচিশ। ওদের নানা রকম টেষ্ট হলো। মুনাই শুনেছিল ওদের একটা ট্রেনিং-এ পাঠানো হচ্ছে বাইরে। ও দেখেছ দু-জনের ব্লাড গ্ৰুপ ও নেগেটিভ। একজন এবি নেগেটিভ। তার দু দিন আগেই দেখেছিল ডাঃ জানা ফাইলে এই তিনটে ব্লাড গ্ৰুপকে মার্ক করেছিলেন। ডাঃ জানার একটা মেলে হঠাৎ চোখ পড়ে গেছিল সেদিন। ব্লাড গ্ৰুপ তিনটে জ্বলজ্বল করছিল। বাকিটা খেয়াল করেনি, তবে কিডনি কথাটাও মনে হয়...
পুরোটাই মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পরদিন এভাবেই ওকে দিয়ে ওরা হার্ড ডিস্ক খালি করিয়েছিল আর লাল ফাইলটাও নষ্ট করে ফেলেছিল।
এ মাসে কুসুমিকার দুটো মেয়েকে আবার এনে চেকআপ হচ্ছিল। মেয়ে দুটো কিছুই জানে না। কিন্তু ও আস্তে আস্তে অনেক কিছুই জেনে ফেলছিল। ওর খাওয়া ঘুম সব চলে গেছে। কিছুই ভালো লাগে না। কাকে বলবে!! কি বলবে !!
চোখের নিচে কালি পড়ছে। কাল আবার ডাঃ সরকার ওকে দেখে বলল -"কি ব্যপার? কিছু প্রবলেম নাকি ? তোমায় কেমন লাগছে !"
তাড়াতাড়ি একটা মিথ্যা অজুহাত দিয়ে পালিয়ে এসেছিল।
রিমা ও ভীষণ চুপচাপ কাজ করে। কিছুটা রোবটের মতো। ঘুমন্ত ভাই বোন দুটোকে দেখে মুনাই, বড্ড ছোট! নিজের বিবেকের সঙ্গে লড়াই করে চলে সে।
একটা ছোট ছয় বছরের বাচ্চা অনাথ মেয়েকে এনেছে আজ। কে নাকি দত্তক নেবে। এত ছোট মেয়ে কুসুমিকায় নেই। একে অন্য কোথাও থেকে এনেছে। মাঝে মাঝে মুনাই ভাবে এই অনাথ বাচ্চাগুলো এরা পায় কোথায়! কে এভাবে বাচ্চা ছেড়ে যায়! মাথাটা কাজ করে না ওর।
আগের সপ্তাহে একটা প্রজেক্ট করেছিল এরা পথশিশু আর রাস্তার ভিখারিদের নিয়ে। ওকে যেতে হয়নি। পরে ফাইলটা দেখেছিল। মোট আটচল্লিশ জনের সমীক্ষা, তার মধ্যে সাতটা ভিখারি আর চারটা পাগল ছিল। এদের পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে জামাকাপড় ওষুধ খাবার এ সব দেওয়ার পাশাপাশি এদের হেলথ চেক হয়েছে। সবাই প্রায় অপুষ্টির শিকার। টুকটাক রোগ ছাড়া তেমন বড় কিছু নেই। চারটে পাগলের মধ্যে দুটো মহিলা। এদের রোজ ওষুধ খাওয়াচ্ছে এই টিম। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে প্রশংসা হচ্ছে। ডাঃ জানার আর ডাঃ সরকারের নাম টিভি, খবর কাগজ সব জায়গায় দেখানো হচ্ছে। কিন্তু মুনাইয়ের মনটা কেমন খচখচ করছে। এর পিছনে যে কত বড় রহস্য রয়েছে ও একটু একটু করে বুঝতে পারছে।
কয়েকদিনের মধ্যেই ওর চোখে পড়েছিল একটা পাগলি আর একটা ভিখারিকে আর দেখা যাচ্ছে না। কেউ নেই এদের খোঁজ করবার। এদের আধার কার্ড, রেশন কার্ড নেই। কোথায় গেল, কি হ’ল কেউ জানতে চাইবে না। এদের জন্ম মৃত্যুর কোনও হিসাব নেই। শুধু ওর ফাইলে নামগুলো রয়ে গেল। কী মনে হতে ও ঐ দুজনের ব্লাড গ্ৰুপ আর বাকি ডিটেলসটা কপি করে রেখে দিল ওর ফোনে।
-"একবার আমার ঘরে এসো, এখনই।"
ডাঃ জানা কখন এসে দাঁড়িয়েছে ওর পেছনে খেয়াল করেনি। হঠাৎ ওঁর গুরুগম্ভীর আওয়াজে চমকে উঠলো মুনাই। আচমকা এভাবে চমকে ওঠায় হাতের ধাক্কায় ফাইলটা ছিটকে পরল নিচে। ভয়ে চোখমুখ কেমন হয়ে গেছিল মুনাইয়ের, কতক্ষণ উনি এসেছেন কে জানে!! ওকে কপি করতে দেখেছি কিনা কে জানে। মাথা নিচু করে সময় নিয়ে কাগজগুলো গুছিয়ে তুলতে তুলতে নিজেকে সামলে নিল মুনাই। এই ডাকটা সব সময় একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে আনে। কিন্তু যেতেই হবে।
ডাঃ জানা দাঁড়িয়ে ওর কাজ দেখছিলেন। মুনাই উঠে দাঁড়াতেই চোখাচোখি, ওঁর বাড়ানো হাতে ফাইলটা দিয়ে মাথা নিচু করে ওঁর পেছন পেছন গেল সে।
কেবিনে ঢুকেই ডাঃ জানা বললেন -"সব সার্ভে রিপোর্ট পেন ড্রাইভে রেখেছ তো?" ও মাথা নাড়তেই উনি বললেন -"তোমায় কাল আমার সঙ্গে দিল্লি যেতে হবে এসব নিয়ে। দু’দিনের কাজ।"
অবাক হয়ে তাকায় মুনাই। ওকে এর আগে বাইরে যাওয়ার কথা কখনও বলেনি এরা। যদিও চাকরি দেওয়ার সময় জানিয়েছিল প্রয়োজনে বাইরে যেতে হবে। ও রাজিও হয়েছিল। কিন্তু এখন এমন একটা পরিস্থিতিতে...
- "সব গুছিয়ে আমায় দিয়ে আজ বাড়ি যাও। কাল সকাল আটটায় তোমায় তুলে নেবে আমার ড্রাইভার। দু দিনের ট্যুর। প্যাকিং করে রেডি থাকবে। ফ্লাইটে যাব। সো... লাগেজ সেভাবেই নেবে। "
মুনাই কিছুই বলতে পারে না। অফিস থেকে বাড়ি অটোতে পনেরো মিনিটের পথ। জীবনে প্রথম ফ্লাইটে করে বসের সঙ্গে দিল্লি যাবে ও, কিন্তু মনে কোনও আনন্দ নেই ওর। কেমন একটা চিন্তা, একটা ভয় ওকে কুরেকুরে খাচ্ছে।
মায়েদের সব বুঝিয়ে ও গোছগাছ শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। কী মনে করে ফোনে গত ছ’মাসে যা যা তথ্য রেখেছিল সব পাঠিয়ে দেয় ওর পিসতুতো দাদাকে। সঙ্গে ছোট করে একটা মেসেজ। বহুদিন কথাও হয় না দাদার সঙ্গে। চাকরি পাওয়ার পর মাত্র একবার দেখা হয়েছিল। ভগবানের হাতে বাকিটা ছেড়ে সে সব ডিলিট করে শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম আসে না। ভয়টা চেপে বসে।
( 2 )
বিশাল একটা আওয়াজ করে ট্রেনটা সরীসৃপের মতো এঁকে বেঁকে প্লাটফর্ম পেরিয়ে এগিয়ে গেলো। আয়ুশ একবার সেদিকে তাকিয়ে দেখল। চারদিকে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের ছোঁওয়া, ধান ক্ষেত, পাট ক্ষেত, বাঁশ ঝাড় আর সবুজ গাছপালায় আঁকা এক শান্ত স্নিগ্ধ জলছবি। ভাঙ্গা সিঁড়ি পেরিয়ে নিচে নামতেই অমলতাস গাছের নিচে দুটো ভাঙ্গা চোরা রিক্সা চোখে পড়ল। গন্তব্য বলতেই লড়ঝড়ে চেহারার রিক্সা নিয়ে মাঝবয়সী চালক এগিয়ে এলো। পুকুর, ধানক্ষেত, বাঁশঝাড় পার করে ছোট্ট বাজারকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল আয়ুশের রথ। চালকের প্রশ্ন -"বাবুকি নতুন ইদিকে? আগে দেখি লাই !!"
-"এই প্রথম এলাম। তুমি কি এখানকার লোক?"
-"উই কুমীরমারি ছাড়ায়ে ধুলার ক্ষেত, তারপর কদমপুরে আমার ঘর । আপনি কুমীরমারিতে কার কাছে যাবেন?" পথ চলতে চলতে সরল গ্ৰাম্য কৌতূহলে প্রশ্ন করে চলে চালক।
-"শ্রী অরূপ বিশ্বাস, আমার স্যার, চেনো নাকি ?"
-"মাষ্টারমশাইএর বাড়ি। ও তো সবাই চেনে। আমার মেয়েটাকে পড়ায়েছিলেন উনি। আজ মেয়ে অঙ্গনওয়ারীতে কাজ করে দুটো টাকা আনে। বিয়ে দিতেও অসুবিধা হয়নি। গ্ৰামের মেয়েরা তো আগে পড়তোই না। শহরে থাকা খাওয়ার কাজ নে চলি যেত। ছেলেরাও একটুকুন বড় হলেই কুনো কাজে লাগে যেত। আজ রিটিয়ার করে এই গ্ৰামে এসে কয়েক বছর ধরি উনি কত ছেলেমেয়েরে পড়ালেন। উনি এখানকার ভগবান।"
-"আচ্ছা ওনার একটা মেয়ে ছিল। বনানী..." আয়ুশের কথা শেষ হওয়ার আগেই রিক্সা চালক বলতে থাকে -"এই তো বছরটাক আগে বিয়া দেছিল মেয়েটার। ডাক্তার বর। কিন্তু কপালে সইল না। গত পূজার আগে মেয়েটা চইলা গেলো। কি সব অসুখ... বাইরে নে গেছিল ডাক্তার বরটা। জলের মতো পয়সা খরচ কইরাও বাঁচাতি পারলো কৈ!! সেই থিকা মাষ্টারটাও বড্ড চুপচাপ। ঐ আসি গিছে।"
একটা পুকুর পার করে একচালা ছোট বাড়িটার সামনে দাঁড়ায় চালক। আয়ুশ ভাড়া মিটিয়ে নেমে আসে। ছোট বেড়ার গায়ে বাঁশের গেট খুলে ঢোকে। বারান্দায় এক বৃদ্ধ বসে। গেটের আওয়াজে চোখ তুলে চায়!!
-"নমস্কার স্যার, আয়ুশ... বনানীর বন্ধু... চিনতে পারছেন?" আয়ুশ এগিয়ে যায়।
-"আয়ুশ... বনানীর সঙ্গে পড়তে... তুমি তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে খড়গপুর চলে গেছিলে!! বনানী তখন প্রেসিডেন্সি তে..."
-"হ্যাঁ স্যার। যোগাযোগ ছিল আমাদের। ফেসবুকে, তারপর হঠাৎ দু’বছর বনানীর সঙ্গে যোগাযোগটা ছিল না। "
বৃদ্ধ উদাস হয়ে যান। আপন মনে বলেন -"কি যে হলো আমার জলজ্যান্ত মেয়েটার ... জামাই নাকি অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সব অদৃষ্ট বুঝলে। না হলে আমার অমন মেয়ে... "
-"আপনি জামাই কে প্রশ্ন করেননি? কী হয়েছিল ?"
-"ওর একটা পেটে ব্যাথার চিকিৎসা করাতে গিয়ে জামাই জানতে পারে ওর প্যানক্রিয়াসের কিছু প্রবলেমের কথা। সাউথে নিয়ে গেছিল। কিন্তু বাঁচাতে পারেনি। মেয়েই যখন নেই তখন আর জামাইকে দোষ দিয়ে কি হবে বলো তো?"
-"কিন্তু কাগজগুলো কি আপনি দেখেছিলেন? মেয়ের ট্রিটমেন্ট কোথায় কী করে হয়েছিল? আপনাকে সঙ্গে নেয়নি! শেষবার মেয়েকে দেখতে পেলেন না..."
-"জামাই তো মাটির মানুষ। পেপার দেখে সম্বন্ধ এসেছিল, এক দেখায় মেয়েকে বিয়ে করলো। পণ নেয়নি। বাড়িতে শাশুড়ি ননদ নেই। এত ভালো ছেলে... বড় ডাক্তার... টিকল না।
প্রথম কয়েক মাস নিয়মিত আমার খোঁজ নিত। আমিই বলেছি... এসব ভুলে আবার নতুন করে শুরু করতে। কী এমন বয়স। কেউ নেই ওর। "
আয়ুশ একটু অবাক হয়। সরল বৃদ্ধ মাষ্টারের প্রতি একটা করুণা জন্মায় মনে। বলে -"জামাই এখন কোথায়? ওর ফোন নম্বর ঠিকানা আছে আপনার কাছে?" বৃদ্ধ ভেতর থেকে একটা ডাইরি নিয়ে আসে। কলকাতার একটা ঠিকানা আর ফোন নম্বর। আয়ুশ জানে এটাতে আর কেউ নেই। বলে -"বনানীর বিয়ের কোনও ফটো বা কিছু আছে আপনার কাছে? "
বৃদ্ধা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বলে -"কেন বাবা? কী হয়েছে একটু খুলে বলবে? জামাইটার কী কিছু..."
আয়ুশ এই সরল বৃদ্ধকে এখনি কিছু বলতে চায় না। বলে -"আসলে ওর বরকে একটু দরকার ছিল। আচ্ছা স্যার, আজ আসি। "
-"এত দূর থেকে এসেছ। কিছু মুখে না দিয়ে এভাবে তোমায় যেতে দেবোনা। বসো একটু।" বৃদ্ধ ভেতরে ঢুকে একটা কাচের গ্লাসে জল আর চারটে বিস্কুট নিয়ে আসে। বলে -"দুপুরে দুটো ভাতে ভাত খেয়ে যাও বাবা।"
জলটা খেতে খেতে আয়ুশ বলে -"আবার আসব স্যার। সে দিন খাব। আজ তাড়া আছে।" এক রাশ চিন্তা মনের মধ্যে নিয়ে বেরিয়ে আসে সে। মনের কোণে লুকিয়ে থাকা ভয়টা উঁকি দেয়।
(৩)
জীবনে প্রথম পাহাড় দেখছে পৌলমী। সব ঐ কুয়াশা ঘেরা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। একমাস আগেও ও ভাবেনি ওর মতো কালো মেয়ের বিয়ে হতে পারে। তাও আবার এত ভালো ছেলের সাথে।
ওকে দেখতে এসে এক প্লেট খাবার খেয়ে নাকচ করে দিয়ে যেত পাত্রপক্ষ। এটা ওর অভ্যাস হয়ে গেছিল। বাবার পকেটের তেমন জোর ছিল না সেটাও ও জানত। পড়াশোনার মাথাটাও ভগবান দেয়নি ওকে।
কি ভাবে যেন বাবা এই বাদলকে খুঁজে পেয়েছিল। ঐ যে বিয়ের প্রজাপতি অফিস ওখানেই নাকি আলাপ। মুম্বাই থেকে একমাসের ছুটিতে এসেছিল মাকে নিয়ে বিয়ে করতে। এদিকে যে মেয়ে ঠিক হয়েছিল সে নাকি পালিয়ে গেছে। ওদের তখন একটা ভালো ঘরোয়া মেয়ে চাই।
বাবা ওকে নিয়েই ফিরেছিল। পৌলমী স্নান করে কাপড় মেলছিল বাড়ির সামনে, ফুল ছাপছাপ হলুদ নাইটি পরা, চুলগুলো গামছায় মোরা। বাদল অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। লজ্জায় লাল পৌলমী ছুটে পালিয়েছিল ঘরে। একটু পরে বাবার ডাকে আরেকবার আসতে হয়েছিল। এবার অবশ্য কুর্তি আর লেগিন্স পরে এসেছিল। বাদল নিজের অফিসের ফোন নম্বর, বাড়ির ঠিকানা এসব দিয়ে বলেছিল খোঁজ নিয়ে নিতে। ওর মেয়ে পছন্দ, শুধু রেজিষ্ট্রি করে বিয়ে দিলেও চলবে। টালিগঞ্জে ওদের একটা ছোট ফ্ল্যাট ছিল। পরদিন বাবা মা আর ছোট মামা গেছিল ওদের বাড়ি। বিনা পণে যে এমন একটা ছেলে পাবে ওরা ভাবেইনি কখনও।
পনেরো দিনের মধ্যে বিয়েটা হয়ে গেছিল। তারপর সোজা মুম্বাই।
এখন ওরা চলেছে মহাবালেশ্বরের পথে। মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে গাড়িটা ওপরে উঠছে। বাদল একটু চুপচাপ শান্ত স্বভাবের ছেলে। পৌলমী একাই বকবক করে চলেছে। একটা কোকের বোতল এগিয়ে দেয় বাদল। এসব ভালোই বাসে পৌলমী। এমন একটা জীবনসঙ্গী পাবে কখনও কল্পনাও করেনি। কোকের বোতলটা শেষ করে বাদলের কাঁধে মাথা দেয় সে। বাদল কাছে টেনে নিল ওকে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। আসলে সারা রাত বাদল যা দুষ্টুমী করে! ঘুমটা পেতেই পারে। চোখ বুঝে এক স্বপ্নের দুনিয়ায় হারিয়ে যায় পৌলমী।
(৪)
বনানীর কথা সাহানা আয়ুশের কাছেই শুনেছিল। হায়দ্রাবাদের একটা ছোট নার্সিং হোমে আয়ুশ ওর এক আত্মীয়কে দেখতে গিয়ে ভুল কেবিনে ঢুকে পরেছিল। সেখানেই বনানীকে দেখেছিল কোমায়। কিন্তু অবাক হয়েছিল পেশেন্টের নাম আলাদা দেখে। ওর বরকে দূর থেকেই লক্ষ্য করেছিল আয়ুশ। পুরো ব্যাপারটাতেই একটা আঁসটে গন্ধ ছিল। এরপর আয়ুশ যখন কলকাতায় আসে বনানীর খোঁজ শুরু করে। কিন্তু কারওর সঙ্গেই মেয়েটার তেমন যোগাযোগ ছিল না। ওর বরের খোঁজ ও পাওয়া যায়নি। সাহানার কাছে ওর বিয়ের একটা ফটো পাওয়া গেলো ফেসবুকের কল্যানে। বাকিটা শুনে সাহানা বেশ উত্তেজিত।
শুরুটা কোথা থেকে করবে ভেবে পায় না দুই বন্ধু। একটা মেয়ে জাষ্ট মারা গেছে আর তার বরকে পাওয়া যাচ্ছে না! পুরানো সব বন্ধুদের সঙ্গে আগেই সোসাল নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিল আয়ুশ। কিন্তু বনানীর বিয়ের পর কারওর সঙ্গে তেমন যোগাযোগ ছিল না। ওর বরের নাম ডাঃ সমরেশ বসু, একজন সার্জেন এটুকু জানা গেছিল।
রাতে আলোক ফিরলো বিধ্বস্ত অবস্থায়, দুদিন ধরেই দৌড়ে বেরাচ্ছে সে। একটা মেয়ে দিল্লি গেছিল অফিসের কাজে, ফিরে আসেনি। মেয়েটির অফিস আলোককে ডেকেছিল ওকে খোঁজার ব্যাপারে। কারণ অফিসের কাজে গিয়েই হারিয়ে গেছে। একটা এনজিওতে কাজ করতো মেয়েটা। দিল্লির কাজ শেষ করে মেয়েটি গেষ্ট হাউস থেকে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলো এরপর আর পাওয়া যায়নি ওকে। ট্রেনে ওঠেনি সে। সাহানা শুনেছে সব। হয়তো দিল্লি যেতে হবে। একটা রুটিং ইনভেষ্টিগেশন আর কী।
সাহানা আর ওকে বিশেষ ঘাঁটায় না। পরদিন আলোক সাহানাকে বলে ওর সঙ্গে একবার মেয়েটার বাড়ি যেতে। ওর মা বোনের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিতে হবে কোনও প্রেম বা ঐ জাতীয় কোনও ঘটনা আছে কিনা এর পেছনে।
ছোট্ট বাড়িটা ফুলের গাছ দিয়ে যত্ন করে সাজানো। বসার ঘরটা ছিমছাম, পরিস্কার। দেওয়ালে হাতের কাজের নমুনা। কাচের গ্লাসে জল এনে দিল বছর সতেরোর একটি মেয়ে। সাদার উপর সবুজ ডুরে শাড়ি পরা মাঝবয়সী মহিলাকে দেখলে বোঝা যায় ভেঙ্গে পরেছেন। চোখ দুটো লাল। সাহানা ওঁকে হাত ধরে এনে বসালেন। বছর তেরো চোদ্দর আরেকটি ছেলে এসে উঁকি দিচ্ছিল। উনি যা বললেন স্বামী মারা গেছিলেন দেড় বছর আগে। বড় মেয়ে মুনাই গ্ৰ্যাজুয়েট, কাছেই লাইফ কেয়ার নার্সিংহোমে কাজ করতো, একটা এনজিও নার্সিং হোমটা চালায়। ভালোই চাকরি করছিল। অফিসের কাজে দিল্লি গেছিলো আট দিন আগে। আর ফেরেনি। প্রথম দু’দিন দু’বার ফোন করেছিল। ফেরার কথা বলেনি কিছু। কয়েকদিন পর ওঁর মেজো মেয়ে সোনাই দিদির অফিসে যায় খোঁজ নিতে। ওঁরা বলেন যে ওর তো ট্রেনে ফিরে এসে অফিস জয়েন করার কথা ছিল। অফিস জয়েন কেন করেনি? ওঁরাও চিন্তিত। এরপর থানায় খবর দেওয়া হয়। অফিসের লোক ভালোই বলতে হবে যে প্রাইভেট ইনভেষ্টিগেটরের সাহায্য নিয়েছে। পুলিশের উপর তো কোনও ভরসাই নেই ! দিল্লিতে মেয়ে পাচার অহরহ ঘটছে! ওর মোবাইলের লাষ্ট লোকেশন দিল্লি স্টেশন।
সাহানা ওর বোন সোনাই আর ভাই পুকাইয়ের সঙ্গে কথা বলল অনেকক্ষণ। দুই ভাই বোনের বক্তব্য দিদি চাকরিটা করতে ভালোবাসত না। টাকাটা দরকার বলে করত। কিন্তু কেমন বদলে যাচ্ছিল। অথচ মাইনে ভালো, মেডিক্যাল ছিল তাই ছাড়তেও পারছিল না। মুখে না বললেও ভাই বোন বুঝেছিল দিদি অখুশি।
সাহানা ভেবেই পায় না বাড়ির এত কাছে ডেটা এন্ট্রির চাকরি করে যে মেয়েটা এত ভাল টাকা রোজগার করতো, সে কেন খুশি ছিল না!
না, প্রেম বা বয়ফ্রেন্ড ছিল না মুনাইয়ের। অন্তত বাড়ির লোক তো তাই বলল। ও এই বয়সেই সংসারের দায়িত্ব নিয়ে নাজেহাল ছিল। বিলাসিতার সময় ছিল না।
মুনাইদের বাড়ি থেকে বার হওয়ার সময় একটা ছেলে এসে ঢুকলো। সোনাই বলল এটা ওদের পিসতুতো দাদা শুভব্রত, দিদির খবর শুনে এসেছে কয়েকদিন হলো। আলোক নিজের কার্ড দিয়ে বলে এসেছিল কোনও ফোন বা খবর আসলে ওকে জানাতে।
শুভব্রত কেমন ভাবে একটু তাকাচ্ছিল ওদের দিকে। ওর সাথে একটু কথা বলে আলোক উঠে পরল। এবার গন্তব্য মুনাইয়ের কাজের জায়গা, লাইফ কেয়ার।
ডাঃ জানা ওদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আলোকের সাথে ফোনে আলাপ ছিল। আজ ডাঃ সরকার ও বাকি কয়েকজন স্টাফের সঙ্গেও কথা হলো। সবাই বলল মুনাই বড্ড চুপচাপ থাকতো। কাজের বাইরে এখানে কেউ মাথা তোলার সময় পায় না। গল্পর সুযোগ কম এমনিতেই। ওর সম্পর্কে তেমন কোনও খবর কেউ দিতেই পারলো না। ওর সঙ্গে যে মেয়েটা কাজ করতো রিমা, সেও কিছু জানে না তেমন।
জাষ্ট একটা ইনভেষ্টিগেশন করাতে হয় তাই ওরা করাচ্ছে। কেমন গা ছাড়া ভাব সবার।
অরগানাইজেশনটা নিয়ে কয়েকটা ধোঁয়াশা আছে। ওরা এত সামাজিক কাজ করে যে লোকাল লোক খুব খুশি। ওদের ওখানে টেষ্টিং এর চার্জ ও কম। আবার কিছু এই ধরনের ক্লিনিকের ওদের ওপর প্রচুর রাগ, কারণ তারা ব্যবসা করতে পারছে না। আলোক বেশ ভালোই খবর জোগাড় করছিল।
(৫)
আলোক এক গাদা খবর কাগজের ফটোকপি নিয়ে বসেছে সেই বিকেল থেকে। কি সব নোট করেই চলেছে। এমন সময় আয়ুশের ফোনটা আসে। ওরা বনানীর বিয়ের ফটোটা সোস্যাল সাইটে দিয়ে ওর বরের খোঁজ করছিল। গুগল ঘেঁটে ডাঃ সমরেশ বসু পাওয়া গেছে আটজন। তার মধ্যে দু জন বয়স্ক। একজন বৃদ্ধ। বাকি পাঁচ জনের মধ্যে দুজন তিরিশের নিচে। বাকি তিনজনের মধ্যে দু জন সার্জেন একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। এই তিনজনের ছবির সঙ্গে বনানীর বরের তেমন মিল নেই। তবুও আয়ুশ একবার আলোকের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল। সাহানা ওকে চলে আসতে বলে।
আলোককে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে ও। আলোক বলে -"এমন একাধিক চক্র সারা ভারত জুড়ে ব্যবসা করছে। কন্যাদায় গ্রস্ত পিতার সংখ্যা প্রচুর। বিনা পণে ছেলে পাওয়া গেলে এঁরা খোঁজ খবর না নিয়েই বিয়ে দিয়ে দেন। সোস্যাল সাইটেও এসব দালালরা জাল বিছায়, প্রেমের নামে ফাঁসিয়ে নেয় মেয়েদের। প্রতি দিন এমন কত মেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। কখনও পণ্য হয়ে পাড়ি দিচ্ছে আরব মুলুকে। কখনও দেহের প্রতিটা অরগ্যান এমনকি শেষ রক্ত বিন্দু পর্যন্ত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এদের। সচেতনতার অভাব এর জন্য দায়ী। নকল আইডেন্টিটি বানানো ভারতে আসল আইডেন্টিটি বানানোর চেয়েও সহজ।"
-"তুমি শুধু এই সমরেশকে খুঁজে দাও।" সাহানা বলে।
-"ওটা ওর আসল নাম নয়। আসল নামে কেউ এ খেলায় আসে না। এরা দুর্বল সরল সাধাসিধা মেয়েদের বাবাকে টার্গেট করে। যাদের লড়াই করার শক্তি থাকে না। প্রতিদিন এমন বনানীরা হারিয়ে যায়। এদের গ্যাং এত বড় ঐ দুএক জনকে ধরে এদের শেষ করা যাবে না। বিয়ের আগে কোনও মেয়ের বাবাই পুলিশে যাবে না জামাইয়ের খোঁজ নিতে। এরাও আনন্দের সঙ্গে ব্যবসা করবে। তবে বনানীর কেসটা হলো কিডনি বা অরগ্যান পাচার। আমি এখন এই ধরনের একটা কেসেই ফেঁসে আছি। দেখছি একটু খোঁজ নিয়ে। এই পেপারগুলো দেখো। এই পৌলমী মেয়েটাও বিয়ের একমাসের ভেতর হারিয়ে গেছে। আরও এমন খবর প্রচুর।"
একটু পরেই আয়ুশ আসে। আলোক বনানীর ব্যাপারে সব জেনে নেয়। হায়দ্রাবাদে যে নার্সিংহোমে আয়ুশ ওকে দেখেছিল সেটার ব্যাপারে খোঁজ নেয়। এক বড় মন্ত্রীর ছেলের নার্সিংহোম ওটা। বেশ কিছু দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বনানীর বরের ফটোটা এক পুলিশ বন্ধুকে পাঠায় আলোক। যদি কোনও খোঁজ পাওয়া যায়!
অনেক্ষণ আলোচনার পর আয়ুশ চলে গেলো। ও পরদিন আবার বাইরে যাচ্ছে ট্যুরে। এসে খোঁজ নেবে বলে গেলো।
রাতে শোওয়ার আগে মেল চেক করতে গিয়ে একটা আননোন মেল দেখে আলোকের ভুরু কুচকে ওঠে। মেলটা যে পাঠিয়েছে নিজের নাম গোপন রাখতে চায় জানিয়েছে। লাইফ কেয়ার নার্সিং হোমের কিছু পেপার, রিপোর্ট, বেশ কয়েকজনের টেষ্টের রিপোর্ট, আর কিছু তথ্য। আলোক এত কিছু একসঙ্গে পেয়ে দিশাহারা। ল্যাপটপে সব মন দিয়ে দেখে একটা পেন ড্রাইভে কপি করে রাখে। ফোন করে নিজের সোর্স মারফত আরও খবর নিতে চেষ্টা করে।
অনেক রাত অবধি নোট প্যাডটা নিয়ে আঁকি বুঁকি করছিল আলোক। মাঝে মাঝেই চিন্তায় ভুরু কুঁচকে উঠছে। সাহানা পেপারের ফটোকপির ফাইলটা নিয়ে দেখে। গত ছমাসে বেশ কিছু মেয়ে এভাবে হারিয়ে গেছে। দুটো ছেলে একটা ভিখারী হারাবার খবর ও আছে। এদের কারওর কোথাও কোনও খোঁজ নেই, সবাই যেন উবে গেছে!!
সাহানা জানে দেশের রাজনৈতিক মহল পুলিশ প্রশাসন সবাই এখানে জড়িত। আলোকের একার পক্ষে এসব কেস সামলানো একটু মুশকিল।
(৬)
আলোক সকালেই বেরিয়ে গেছে। অয়ন ওর বহুদিনকার বন্ধু, জার্নালিষ্ট, প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক দুই জগতেই পরিচিত মুখ অয়ন। ওর একটা টক শো ''সত্যের মুখোমুখি'' খুব জনপ্রিয়। চ্যানেল 'প্রতি মুহুর্তের খবর' একটা জনপ্রিয় নিউজ চ্যানেল। সেখানে এই শো এর টিআরপি দেখার মতো।
আলোকের মন্ত্রী মহলে পরিচিতি থাকলেও মিডিয়ার কেউ সঙ্গে থাকলে এসব ব্যাপারে জোর পাওয়া যায়। মন্ত্রীদের দোষ গুলো তুলে ধরতে হলে শক্ত কাউকে পাশে চাই। অয়ন সব শুনে এগিয়ে এসেছিল নিজে থেকেই। নবান্নে আলোচনার পর ওরা দুজনেই বিকেলের ফ্লাইটে দিল্লী চলে গেলো। অয়নের অফিস দারুন সাপোর্ট দিয়েছিল। ওরাই সব এপয়েন্টমেন্ট করে রেখেছিল। খবরটা ওরাই করতে চায়।
পরের দু’দিন কোথা দিয়ে কেটে গেলো অয়ন আর আলোক টের পেলো না। জাল বিছানো হয়েছিল আলোকের প্ল্যান মতো। লোকাল পুলিশ বা নেতাদের কিছু জানানো হয়নি। কাক পক্ষী টের পাওয়ার আগেই একটানে জাল গুটিয়ে ফেলেছিল ওদের টিম।
বনানীর বরের ফটো ধরে খুঁজে একজন ডাক্তারের খবর পাওয়া যায় যার নামে আগেও এমন অভিযোগ উঠেছে। ডাক্তারী ডিগ্ৰিটাও নামটার মতোই ভূয়ো। পাচার চক্রে সে ভালোভাবেই জড়িত বোঝা গেলো।
তিনদিন পর প্রতিটা চ্যানেলে খবরটা বড় করে কভার করছিল বারবার। দেশ জুড়ে কিডনি ও অরগ্যান চক্রের জাল বিছিয়েছিল এক গোষ্ঠী। একসঙ্গে তাদের কলকাতা, দিল্লী হায়দ্রাবাদ মুম্বাই চেন্নাই বিহার এর ডেরায় হানা দিয়েছিল স্পেশাল ফোর্স। প্রচুর ডাক্তার নার্স ছাড়াও মন্ত্রী আমলা এবং প্রসাশন এর সঙ্গে জড়িত ছিল। খুব গোপনে গোয়েন্দা বাহিনীর সহায়তায় সব কয়টা রাজ্যে স্পেশাল ফোর্স পাঠিয়ে একসঙ্গে পুরো দলটাকে ধরা হয়েছে। তবুও কয়েকজন দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে মনে করা হচ্ছে।
আয়ুশ ফোন করে সাহানাকে বলে -"বনানীর বরকে চিনতে পারছিস? টিভিতে দেখ, গেটআপ চেঞ্জ করলেও ওকে আমি চিনেছি। শালা হাতুড়ে ডাক্তার, নিজেকে সার্জেন বলত। দিল্লিতেই ধরা পরেছে। "
একের পর এক ফোন ঢুকছে আলোকের ফোনে। প্রচুর শুভেচ্ছা বার্তা। প্রয়োজনীয় অর্গ্যান বার করে নিয়ে ওরা বডিগুলো নষ্ট করে ফেলত ওরা। কঙ্কালটাও বিক্রি হয়ে যেত। অরগ্যান যাদের শরীরে বসানো হতো তাদের থেকেও ডোনেশনের নামে মোটা টাকা নেওয়া হতো। মেডিক্যাল এথিক্স অনুসারে ডোনারের নাম জানা যাবে না। অরগ্যান পাওয়া যাচ্ছে এটাই তাদের কাছে বিশাল ব্যাপার। বেশ কিছু জায়গায় এ ব্যবসা চলছিল রমরমিয়ে। নেগেটিভ ব্লাড এবং রেয়ার গ্ৰুপ যাদের তাদের দামও বেশি।
অনাথ, রাস্তার পাগল এদের খোঁজ করার কেউ থাকত না। কিন্তু এভাবে এক জায়গায় বেশি শিকার করলে লোকের চোখে ধরা পরে যাবে। তাই সফট টারগেট ছিল কন্যাদায় গ্ৰস্ত পিতা আর গ্ৰামের গরীব কাজের মেয়ে বৌরা। যারা শহরে থাকা খাওয়ার কাজ করতে রাজি।
মুনাইয়ের খোঁজ আর পাওয়া যায়নি। ও অনেকটা জেনে ফেলেছিল বলেই ওকে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল আলোকের ধারণা। ডাঃ জানা আত্মহত্যা করেছিলেন ধরা পড়ার পর। ওরা প্রচুর ফাইল নষ্ট করে ফেলত তাই অনেকের খবর এভাবেই হারিয়ে গেছিল।
আলোক প্রধান মন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতিকে বলেছিল ওকে এই দলকে ধরতে সাহায্য করেছিল একটি মেইল। যাতে লাইফ কেয়ার নার্সিং হোমের লাষ্ট ছয় মাসের একটিভিটি ছিল। আলোক খোঁজ নিয়ে জেনেছিল মুনাই এই সব ডেটা ওর দাদাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ও ভয় পেয়েছিল খুব। ওর দাদা প্রথমে আলোককে বিশ্বাস করেনি। ও যেহেতু লাইফকেয়ারের তরফ থেকে গেছিল তাই কিছু জানায়নি। পরে বেনামে মেইল করে জানায়। আর মুনাইয়ের এই কাজের জন্য এত বড় দলটা ধরা পড়ল। ওর ফাইলেই বাকি ডেরাগুলোর হদিশ ছিল।
মুনাইদের পরিবারকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে সরকার। ওর ভাই বোনের পড়ার খরচ সরকার দেবে এবং ওর মাকে একটা চাকরী দেওয়া হবে। ভাই বোন ও ভবিষ্যতে চাকরি পাবে সরকার বলেছে। আলোক সাহানা আয়ুশ ওদের বাড়ি গেছিল আলাদা করে। রাজ্য সরকার ওদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সাহসিকতার পুরস্কারের জন্য মুনাইয়ের নাম রাষ্ট্রপতির দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
(৭)
কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খোলেন বৃদ্ধ। কদিন ধরেই শরীরটা ভাল নেই। টিভি আর খবরকাগজ দেখে মাথাটা আর কাজ করছে না। বড় ভাল ছিল মেয়েটা। তার শেষে এই পরিণতি! জামাইটা এমন শয়তান ছিল!
দরজার বাইরে বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়ে, আয়ুশকে চিনতে পারেন অরূপ বাবু। বাকি তিনটে মেয়ে আরও কয়েকটা ছেলে। সবাই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বারান্দাতেই বসে পরে। অনেকেই ওঁর প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রী।
-"আমরা সবাই বনানীর বন্ধু স্যার। আমরা আপনার সঙ্গে আছি। ওর খুনীরা ধরা পরেছে। শাস্তি পাবে..." আয়ুশ বলে।
বৃদ্ধ অরূপ বাবুর হাত পা কাঁপছে, বসে পড়েন বারান্দায়।
-"আপনি একা না, সারা দেশে এমন বাবার সংখ্যা প্রচুর। আপনি ভেঙ্গে পড়বেন না স্যার। " সাহানা বলে।
-"এই বাচ্চা দুটোকে দেখুন, একমাত্র উপার্জন ক্ষম দিদিকে হারিয়েছে ওরা।" পুকাই আর সোনাই এগিয়ে আসে। শুকনো মুখ, চোখের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে এই বয়সেই অনেকটা ঝড় বয়ে গেছে ওদের ওপর।
-"আমরা আসবো স্যার, মাঝে মাঝেই আসবো। আমরা আর এভাবে বনানীদের হারতে দেবো না। গ্রামের লোকেদের আরও সচেতন করতে হবে এসব বিষয়ে।" অরূপ বাবুর হাতটা ধরে এক তরুণ।
চোখটা আরও ঝাপসা হয়ে আসে। তবুও অরূপবাবু আকাশের দিকে তাকান। বহুদিন পর আজ মিষ্টি রোদ উঠেছে। আকাশে সাদা মেঘেরা হাসছে। বনানীর হাতে কয়েক বছর আগে লাগানো শিউলি গাছটায় একটা দুটো করে কুড়ি ধরছে। এবার প্রথম ফুল ফুটবে। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলেন উনি। মেয়েটা যেখানেই থাকুক আজ হয়তো শান্তি পাবে।
বাঃ, বেশ ভালো লাগলো।
ReplyDelete