প্রাচীন কথা - ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীন কথা
মিথ-কথন
ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী
গ্রীস
গ্রিক পুরাণের বিভিন্ন গল্পে নানা জনপ্রিয় এবং তুলনামুলক কম জনপ্রিয় কিছু চরিত্র বারবার উঠে এসেছে। এই গল্পগুলি জানার জন্য এই চরিত্রগুলির সম্পর্কে একটু ধারণা থাকা দরকারী। আগামী কিছু পর্বে আমরা গ্রীক পুরাণ নিয়ে কথা বলব। এখানে মূলতঃ পুরাণের বিভিন্ন চরিত্রের পরিচয় এবং তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে একটু আলোচনা করা হলো।
পর্ব ১- টাইট্যান (Titan)
গ্রীক পুরাণ বা মিথোলজি হলো সবথেকে জটিল মিথোলজির একটা। আমাদের ভারতীয় পুরাণের মতোই অগুনতি গল্পের সম্ভার। পড়ার আগে মনে রাখতে হবে, এইসময় কিন্তু আমাদের আধুনিক বিয়ের ধারণা ছিলো না। নিজের বোনকেই বিয়ে বা সম্ভোগ করেছেন অনেকে।
গ্রীক দেবতারাও তিন পুরুষ ধরে রাজত্ব করেছেন। স্বর্গের দেবতা হিসাবে জিউসকে ধরা হয়। কিন্তু কাহিনী অনুসারে তার আগে ছিল টাইট্যানদের রাজত্ব।
এবার প্রশ্ন হলো টাইট্যান কে বা কাহারা? ইহা খায় না মাথায় দেয়?
টাইট্যানরা কাঁচাখেকো দেবতা বলতে যা বোঝায়, প্রায় তাই। এঁরা অমর, দৈত্যাকার এবং অসীম ক্ষমতার অধিকারী। এঁরা মানুষদের খুব একটা পাত্তা দিতেন না। মানুষ এঁদের শ্রদ্ধার থেকেও ভয় পেতেন বেশি। আর এঁরা ভয়ানক মাংসাশী ছিলেন, নিজের সন্তানকে খেতেও এঁদের মনে কোনওরকম দ্বিধা ছিলো না। এঁরা গ্রীসের মাউন্ট অর্থিসে (Mount Arthis) বাস করতেন। এবং গ্রীসের আদি দেবতা হিসাবে মান্যতা পেতেন।
ভারতীয় পুরাণে কশ্যপের স্ত্রী অদিতির থেকে যেমন দ্বাদশ আদিত্যের জন্ম, সেরকমই, ইউরেনাস (Uranus) আর গায়ার (Gaia) থেকে প্রথম দ্বাদশ টাইট্যানের জন্ম। ইউরেনাস এখন একটি গ্রহের নাম হলেও তখন সম্পূর্ণ আকাশ বলেই ধরা হতো। গায়া হলেন মা ধরিত্রী। এই দ্বাদশ টাইট্যানের মধ্যে মহিলা ছিলেন ছয়জন।
নেমোসিন (Mnemosyne) - ইনি হলেন স্মৃতির আদি দেবী এবং মিউজ বা ইন্সপিরেশনের নয় দেবীর জননী।
থিয়া (Theia) - ইনি টাইট্যানদের মধ্যে সবথেকে বড়। ভাই হাইপেরিওনের সাথে সঙ্গমের ফলে জন্ম দিয়েছেন হেলিওস (Helios), সেলেন (Selene) এবং ইওস (Eos)। এঁরা হলেন সুর্য, চন্দ্র ও সন্ধ্যা।
টেথিস (Theia) - নামটা একটু চেনা চেনা, আমাদের টেথিস সাগরের মতোই। ইনি সকল নদীর মাতা। ভাই ওশেনাসকে বিবাহ করে তিনি অসংখ্য নদী দেবতার জন্ম দিয়েছেন। এঁর কন্যাদের ওশিয়ানিড (Oceanid) বলা হয়। তাঁরা বিভিন্ন জলাশয়, পুকুর, মাঠ ইত্যাদির দেবী ছিলেন।
ফিবি (Phoebe) - ইনি মূলতঃ চাঁদের সাথেই সম্পর্কিত। তবে ইনি ভাই কোয়োসের সঙ্গে সঙ্গমের ফলে জন্ম দিয়েছেন বিখ্যাত কিছু সন্তানের। লেটো (Leto) এবং এস্ট্রিয়া (Asteria) তাঁর দুই কন্যা। তাঁরা আবার বিখ্যাত কিছু সন্তানের মা। ফিবিকে এছাড়াও ভবিষ্যৎবাণীর আদি দেবী বলে মনে করা হয়।
রিয়া (Rhea) - এঁকে গ্রীস পুরাণে প্রধানত সব অলিম্পায়েড দেবতাদের মা বলে স্বীকার করা হয়। ভাই ক্রোনোসকে বিবাহ করে জন্ম দিয়েছিলেন ছয়জন পরবর্তী যুগের দেবতার। হেস্টিয়া, ডিমেটর এবং হেরা কন্যা এবং হেডিস, পোসেইডন এবং জিউস এঁর পুত্র। এছাড়াও তিনি হলেন বেদানার দেবী। বেদনা নয়, বেদানা (Pomegranate)। প্রাচীন গ্রীকরা সম্ভবত বেদানা খেতে খুব ভালোবাসত। তাই একজন দেবী শুধু এই ভালো ফলটির জন্যেই পূজিত হতেন।
থেমিস (Themis) - থেমিস হলেন আইন কানুনের দেবী। আইনের প্রতীক যে ন্যায়ের দাঁড়িপাল্লা, সেটি এঁরই প্রতীক। ন্যায়, আইন, রীতি, পরম্পরা ইত্যাদির দেবী হলেন ইনি। পরে জিউসের সঙ্গে সঙ্গমের ফলে হোরাই নামে এক সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। যিনি ঋতু এবং সময়ের দেবী। হোরাইয়ের নাম থেকেই ইংরেজি আওয়ার (Hour) বা ঘন্টার জন্ম।
বাকি টাইট্যানদের মধ্যে যে ছয়জন পুরুষ ছিলেন, বিভিন্ন দেবদেবীর বাবা হওয়া ছাড়াও এঁদের বাকী যে গুণাবলী ছিলো, তা লিখছি অল্প করে।
ওশেনাস (Oceanus) - নাম থেকেই বোঝা যায় ইনি সমুদ্রের আদি দেবতা। তখন তো সমুদ্র সম্পর্কে কোনও ধারণাই তৈরি হয়নি, মনে করা হতো ওশেনাস একজন বিরাট নদী যে পৃথিবীকে ঘিরে আছে।
হাইপেরিওন (Hyperion) - ছেলেপিলের বাবা হওয়া ছাড়া এঁর একটিমাত্র উল্লেখ হলো, ইনি টাইট্যানোম্যাকি যুদ্ধে ক্রোনোসের পক্ষে লড়াই করেছিলেন।
কোয়োস (Coeus) - এঁর উল্লেখ অত্যন্ত কম আছে গ্রীক পুরাণে। তবে মনে করা হতো, স্বর্গ যে অক্ষবিন্দুর উপরে ঘুরপাক খাচ্ছে তারই রূপ ইনি। আবার একটি ভিন্ন মতে ইনি বুদ্ধিমত্তার আদি দেবতা।
ক্রোনোস (Cronus) - টাইট্যানদের মধ্যে সবথেকে বেশি নাম এঁরই শোনা যায়। ইনি গায়া আর ইউরেনাসের কনিষ্ঠ টাইট্যান সন্তান। সময়ের আদি দেবতা। কথিত আছে ইনি নিজের ইচ্ছেমত সময়কে তাড়াতাড়ি বা ধীরে চলতে বাধ্য করতে পারেন। এঁর থেকেই ক্রোনোলজিক্যালি শব্দটির উৎপত্তি। ইনি মায়ের নির্দেশে বাবার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। পরে এঁকে এঁর নিজের ছেলে জিউস পরাজিত করে এবং টারটারাসে আটকে রাখে। তবে সে অন্য গল্প। ইউরেনাসকে পরাজিত করে ইনি স্বর্গে রাজত্ব করেন বহুদিন। এঁর প্রতীক হলো সাইথ বা লম্বা হাতলওয়ালা কাস্তে।
ক্রিয়োস (Crius) - ইউরেবিয়া নামে নিজেরই এক বিপিতার কন্যাকে বিবাহ করেন। এবং পার্সেস নামের এক পুত্রের জন্ম দেন, পার্সেস গ্রীক দেবী হেকেটির (Hecate) পিতা ছিলেন। এর বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি।
আইপেটোস (Iapetus) - ইনি বিবাহ করেন টেথিস এবং ওশেনাসের কন্যা এশিয়াকে। চার বিখ্যাত টাইট্যান সন্তানের পিতা। অ্যাটলাস (Atlas), প্রমিথিউস (Prometheus), মেনোটিয়াস (Menoetius) এবং এপিমেথুস (Epimetheus)।
গায়া হলেন সবথেকে পুরোনো দেবীদের একজন, ওঁকে সব দেবদেবীর মা বলে মানা হয়। এমনকি ইউরেনাস ওরই ছেলে ছিলো। আর ইউরেনাস আর গায়ার সন্তান টাইট্যানরা ছাড়াও ছিলো জায়েন্ট মানে দৈত্যরা। আর অদ্ভুত ভাবে পন্টোস (Pontus) বা সমুদ্রের মা ও গায়া, তবে পন্টোসের বাবা কে জানা যায়নি, একটি মতে অবশ্য ইথার (Aether) হলেন বাবা। এছাড়াও ইউরেনাস আর গায়ার সন্তানরা হলেন সাইক্লপস (Cyclopes) অর্থাৎ একটিমাত্র চোখওয়ালা অমর দানব, যারা তিনজন ছিলেন। এছাড়াও হেকাটনকেয়ারস (Hecatoncheires) বা একশ' হাতওয়ালা জীব। এঁরাও তিনজন ছিলেন। এঁদের প্রত্যেকের একশ' হাত এবং পঞ্চাশ মাথা ছিলো। এছাড়াও আরও কিছু সন্তান তিনি ইউরেনাসের ঔরসে জন্ম দিয়েছিলেন।
ইউরেনাস সারাক্ষণ গায়ার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইতেন। ইউরেনাস তাঁর সন্তানদের একদম পছন্দ করতেন না, টাইট্যান ছাড়াও সাইক্লপস এবং হেকাটনকেয়ারসদেরও গায়ার শরীরের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে রাখতেন। গায়া ব্যাথা পেতেন, অতিষ্ঠ হয়ে যেতেন তবুও ইউরেনাস তাঁকে ছাড়তেন না। ইউরেনাসের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গায়া ঠিক করলেন, এর হাত থেকে মুক্তি পেতে হবে। গায়া পাথর দিয়ে এক কাস্তে (Sickle of Adament) বানালেন। তারপর সব সন্তানদের একত্র করে জিজ্ঞাসা করলেন কে তাঁর হয়ে ইউরেনাসকে পরাজিত করবে? একমাত্র ক্রোনোস রাজী হলেন তাই তিনিই এই কাস্তে উপহার পেলেন। একদিন ভালো ভালো খাদ্য তৈরি করে গায়া নেমন্তন্ন করলেন কত্তাকে। ভাত দিই মাছ দিই করলেন খুব। তারপর ভরপেট্টা খেয়ে কত্তা যখন দিবানিদ্রা দিচ্ছেন, তখন মায়ের নির্দেশে ক্রোনোস কুচিকুচি করে ফেললেন বাবাকে, ছড়িয়ে দিলেন সারা আকাশে। লিঙ্গচ্ছেদ করে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিলেন। সেই লিঙ্গচ্ছেদের রক্ত থেকে জন্ম নিলো জাইগ্যান্টিস বা জায়েন্ট বা দৈত্যরা। ইউরেনাসের সেই লিঙ্গ থেকে আবার দেবসুন্দরী প্রেমের দেবী এফ্রোদিতির জন্ম হয়। ইউরেনাস অমর, তাই মরলেন না, কিন্তু চতুর্দিকে ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে, বিশেষত লিঙ্গটি আর খুঁজে না পেয়ে আবার এক হয়ে পুরো বাবা হওয়ার ক্ষমতাও হারালেন। মা গায়া সুখী এবং খুশি হয়ে বিয়ে করলেন টারটারাসকে (Tartarus)। আমরা যাকে পাতাল বলি। আমাদের পাতালের মতো হলেও একটু পার্থক্য আছে। যত দৈত্য দানব বা টাইট্যান আছেন, মানে সাধারণ মানুষের থেকে বেশি ক্ষমতাশালী অপদেবতা বা উপদেবতা, এই টারটারাসে মৃত্যুর পর চলে যান। অনেকেই অমর তাই তাঁরা সম্পূর্ণ পরাজিত হলে এখানেই আজীবন বন্দী থাকেন। এই টারটারাস হলেন একই সঙ্গে একজন ব্যক্তি এবং একটি স্থান। গায়া এবং ইউরেনাসের মতোই।
এভাবেই টাইট্যানদের প্রথম প্রজন্ম শেষ হয়ে দ্বিতীয় প্রজন্মের শুরু হয়। ক্রোনোস স্বর্গের রাজা হন। এই সময়কে গোল্ডেন এজ বলে। ভারতীয় যুগ চার ভাগে বিভক্ত যেমন সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এবং কলি। গ্রীক পুরাণ অনুসারেও পাঁচ যুগ আছে। গোল্ড বা স্বর্ণ যুগ, সিলভার বা রৌপ্য যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ, হিরোইক যুগ পেরিয়ে এখন আমরা আয়রন বা লৌহযুগে বাস করছি। ক্রোনোস পুরো স্বর্ণযুগে রাজত্ব করেন। মনে করা হয় এই যুগে নাকি সবথেকে বেশি শান্তি, সমৃদ্ধি আর ঐক্য ছিল। ক্রোনোসের মতো একজন রাজার রাজত্বকালে এত শান্তি সমৃদ্ধি বজায় ছিল! কিভাবে ছিল তা জানার আর কোনও উপায়ই আজ নেই ...
ক্রমশ…
দারুণ হয়েছে লেখাটা... \@_@/
ReplyDeleteBaapre kirom sob deb-debi!
ReplyDeleteবাঃ ! কেয়া বাৎ
ReplyDeleteলেখাটা চমৎকার হয়েছে। পরের খণ্ডের অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDeleteজিও!
ReplyDeleteএটার একটা সংক্ষিপ্ত রূপ তো পেজে পড়েছিলাম, অল্প সময় ছিলো সেটা। আমার একটা সাজেশন আছে। এখন তো তুমি আলাপ-পর্বে আছো, এরপরে যখন বিস্তারে পৌঁছোবে, একটু অন্যান্য দেশের মিথোলজির সঙ্গে কোথায় কি মিল, সেটাও যদি ছুঁয়ে যেতে পারো, পাঠকের কাছে আরো মনোগ্রাহী হবে ব্যাপারটা।
ReplyDelete