0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত



॥১৬॥



হতে পারতো দুশমন নক্ষত্রটি মাঝ দুপুরের মতোই চকচকে একটি শব্দভেদী আলোর বর্শা 



গোরাচাঁদ

গানটার প্রথম লাইন কিছুতেই মনে পড়ছেনা গোরাচাঁদের। মাঝের লাইনটা বারবার চক্কর কাটছে গ্রামোফোন রেকর্ডে পিন ফেঁসে যাওয়ার মতো।...ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা...। এর আগেও না পরেও না। গোরাচাঁদের ভিতরে এখন এমন মানসিক নৈরাজ্য বিস্তার করে আছে যে শিথিল নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসছে না। অত্যন্ত অসহায়তা যে মানুষকে অকেজো করে দেয় সেটা বুঝেও তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না।

চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। তাঁবুর নিচে গালিচা পাতা ওয়েল ইকুইপ্ট একটা রুম। বাথরুম কোমোট সংলগ্ন। সব কিছুই সুবিধা আছে এতে। কেবল শুয়ে বসে আরাম করো। সন্ধে হওয়ার পর একবার তাকে এসকোর্ট করে নিয়ে যাওয়া হয় জেরেকার কাছে। রাশিয়ান আর্মি জবরদস্ত নজরবন্দী করে রেখেছে। অবশ্য গোরাচাঁদের জন্য এটা অতি আবশ্যক ছিল। বাইরে থাকলেই ওকে প্রাণে মেরে ফেলত। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ধ্যানস্থ হওয়ার মতো স্থির হয়ে বসে থাকতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল শিমুলিয়া পাহাড়ের শীর্ষে দুটি জড়াজড়ি করে থাকা গাছ শিমুল ও অর্জুন। পাহাড়ের নিচে যতদূর প্রসারিত করা যায় সবুজের নানান শেডেরগুল্ম ও ছোটো ছোটো গাছ। এক একটা উপত্যকার পাশে বিশাল বিশাল গর্ত। একটা বিশাল এলাকা জুড়ে মহুলবনের মাঝবরাবর দুধঝর্ণা বইছে। 

কল্পনার চোখে বাস্তব ভৌগলিক অঞ্চলটি দেখতে দেখতে নিজেকে হারিয়ে ফেললেন তিনি। কল্পনাতে এমনকি গুল্মলতা ও উদ্ভিদগুলির আলাদা আলাদা গন্ধও তাঁর স্মৃতিপটে এল। এই বিস্তীর্ণ উপত্যকা প্রকৃতির দুস্প্রাপ্য বিশল্যকরণী ভেষজের বাগীচা। এক এক ডুংরীতে এক এক রকমের ঔষধি। মোহমুগ্ধ হয়ে তিনি প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে হারিয়ে ফেলেছিলেন নিজেকে। হঠাত্‍ অস্পষ্ট দীর্ঘ বুউমমম শব্দে চমকে তাকালেন চারদিকে। তাঁবুর ভিতর যেমনকার তেমনিই। কিন্তু বহুদূরে কোথাও কামান দাগা হচ্ছে। গোরাচাঁদ জানেন এই মূহুর্তে ভারতীয় সেনার স্নাইপার ও স্পটার টিম কাজ করছে। ওরা দূরে ছড়িয়ে থাকা জঙ্গলের ভিতরে আদিবাসীদের ছোটো ছোটো বস্তিগুলোকে চিহ্নিত করছে। কামানের শব্দে ওরা যখন ঘরছেড়ে বাইরে বেরবে তখন দূর থেকে লং রেঞ্জড টেলিস্কোপ দিয়ে সেনা স্পট করবে। এতদিন ধরে ভারতীয় সেনা মহড়াতে টারগেট পেতেছিল শিমুলিয়া পাহাড় আর এই গ্রামটি। এবার পুরো অঞ্চলটির উদ্ভিদ প্রাণীর বিধ্বংস চাই এই প্ল্যাটুনের। আবার কি। এই ধ্বংস তাণ্ডব ওরা জাতীয়তার সপক্ষে করে নিয়েছে। এই বিধ্বংসী মূলক কাজ অমানবিক কিন্তু মানবিকতার দোহাই দিয়ে সেটাকে কানুনী করে নিয়েছে ওরা। দেশকে আতঙ্কিদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই মহড়া কিন্তু তার আগে কোনও সার্ভে নেই। সবচেয়ে বেশি বেদনাদায়ক যে পশ্চিমীদেশের বর্ণবৈষম্য আবার নতুন করে এই অঞ্চলে নিয়ে এলো সৌমেন। আদিবাসী জংলি ভারসাস জেনারেল।সেটা নিজেরই স্বার্থে। কিন্তু তার এই অপচিন্তার কথা খোদ সাদা চামড়ার রাশিয়ান মেজর জানান দিয়ে দিল যাকে সৌমেন ঢাল করে নিয়ে এসেছে এখানে। সৌমেনের ধারনা ছিল সাদা চামড়ার লোকেদের স্বতই কালোদের প্রতি ঘৃণা ও তুচ্ছ ভাব থাকে। কিন্তু এই ব্যপারেই ও ভুল করেছে। ও জানেনা এই মেজর সাম্যবাদে বিশ্বাসী। অবশ্য কেবল মেজরকে জানলে হবেনা, পুরো পল্টনের মানসিকতা জানা যায়নি। আর সমু নিশ্চয়ই মেজরের মনোভাব আঁচ করে নিয়েছে। একটা কথা মনে আসতেই গোরাচাঁদ সচকিত হয়ে উঠে বসলেন। ঠিক এমনিভাবে বিচার করলে তো ইন্ডিয়ান ট্রুপের কথাও ভাবতে হয়! নিশ্চয়ই সেনানির মধ্যে এমন অনেকজন আছে যারা সৌমেনের সাথে একমত নয়? বাধ্যহয়ে সায় দিতে হচ্ছে? এমন কী কিছু করা যায়না যাতে সেনাবাহিনীর মধ্যে অসমঞ্জস্যতা সৃষ্টি করা যায়?

এইসব তন্ময় হয়ে ভাবছিলেন হঠাত্‍ দূর থেকে চারপাশ জুড়ে ধামসা ও ঢাকের দ্রিমি দ্রিমি শব্দ শুনতে পেলেন।

এক প্রান্ত থেকে দা ধুমম দা, দা ধু উ মমম দা দা। বিরতি। অন্য প্রান্ত থেকে একটি অন্য তালের বোল। একটু বিরতির পর চতুর্দিক থেকে দামামা। এইভাবেই অনেকক্ষণ ধরে চলতে লাগলো। ধামসার এই বোল তিনি ওদের কাছ থেকেই শিখেছেন। এখানকার আদিবাসীরা আচারআচরণ ভাষা চেহারাতে একটু ভিন্ন একটু সূক্ষ্ম পার্থক্য তো রয়েছে। কিন্তু পরস্পরের মধ্যে মতের অমিল দেখাযায় না। একে অপরকে স্বীকার করে নেওয়ার প্রবণতা বেশি। তাই বিস্তীর্ণ ঘন জঙ্গলে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলির মধ্যে সংবাদ আদানপ্রদানের একই রকম মাধ্যম। এই ধামসার বোল সবার এক। আর আশ্চর্য প্রকৃতির নিয়ম! এখনকার প্রাচীন আদিবাসী সবার, এমনকি এশিয়ার সব আদিবাসীরা আফ্রিকার, সাউথ আমেরিকার প্রাচীন আদিবাসীরা সবাই একই রকম ড্রাম ম্যাসেজ দিয়ে নিজেদের মধ্যে সংবাদ আদানপ্রদান করতো। একরকম ড্রাম একরকম তার বোল। বিদেশের হোক বা আমাদের এখানের ধামসাগুলির সব এক ধরনের গঠন। খুববড় কাঠের গুড়ির মাঝখানটা গর্ত করে বানানো। যত বড় গুড়ি তার তত ভারী আওয়াজ। এই সংকেত ভাষার তোয়াক্কা করে না। কিন্তু সবাই পড়তে পারে বুঝতে পারে। সেনেগালে এগুলোর নাম টামা নাইজেরিয়াতে বলে দুনদুন কালাঙ্গু, ঘানাতে নাম লুন্না।আর এখানে ধামসা। সারা পৃথিবী জুড়ে এই ড্রাম ম্যাসেজের ভাষা ওদেরকে কে শেখালো?

গোরাচাঁদ অভিভূত হয়ে গেলেন এই কথা ভেবে। এই সাঙ্কেতিক ভাষা ওদের কাছ থেকেই শেখা। তাই ধামসা সাঙ্কেতিক ভাষায় কি বলছে পরিষ্কার বুঝতে পারছেন তিনি। সারগেই আর জেরেকার মধ্যে এই ম্যাসেজ পাঠানোর কথা যে হয়েছে সেটা গোরাচাঁদ শুনেছেন জেরেকার কাছ থেকে। কিন্তু কি ম্যাসেজ সবার কাছে যাবে এটা তিনি জানতেন না। যত শুনছেন তত হতভম্ব হয়ে যাচ্ছেন তিনি। নিয়মমতো অঞ্চলের সবাইকে ধামসা বাজিয়ে ডাকা হয় শাল পিয়াল আর আমগাছ ঘেরা একটা বিশাল বড় ময়দানে। কিন্তু ধামসার বোল বলছে দুধ ঝর্ণার জল যেখান থেকে গড়িয়ে পড়ছে অনেক নিচে একটা বিশাল খাদে, সেই বিশাল খাদ শুরু হওয়ার ঠিক আগে পাহাড় প্রমাণ চ্যাটালো পাথরের পিছনে সবাই সূর্য মাথার উপর থাকতে থাকতেই যেন চলে যায়। এই ম্যাসেজের উত্তরে প্রত্যুত্তরে আরও এইকথাই রিপিট করা হচ্ছে। আর সবাই এতে সম্মতি জানাচ্ছে।

গোরাচাঁদ কিছুই বুঝতে পারলেননা। টিলার উপরে ঝর্ণার উৎস মুখে একটা বিশাল চাট্টান আছে বটে। সেটা আবার খাড়া দেওয়ালের মতো। ওখানে কি সুরক্ষার জন্য জেরেকা ওদের পাঠিয়ে দিলো? ওর চেয়ে তো ময়দান ভালো ছিল? গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন তিনি। হঠাত্‍ কি মনে হতে সোজা হয়ে বসলেন। একদম শুরুতে ধামসার বার্তা তাঁর মনে পড়ল। ওতে বলা হয়েছে জাগতে রহো, আমাদের দলনেতার আদেশানুসারে এই বার্তা সবাই সতর্ক হয়ে শোনো। দলনেতা? দলনেতা তো পেরো? তবে? তবে কি?

আবার একটা কথা তার মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল। ওই পাথরের আড়ালে লুকনো একটা গুপ্ত সুড়ঙ্গ আছে। যেটা এখানের কেউই এমনকি জেরেকা ও পেরোও জানেনা। এই প্যাসেজের সন্ধান কেবলমাত্র গোরাচাঁদ জানেন। তাও আবার হঠাত্‍ করে আবিষ্কার বহুদিন আগে এক গভীর রাত্রে। তখন কয়েকদিন অনাহারে অনিদ্রায় ক্ষত বিক্ষত রোগে ভুগে পথ হারিয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সংজ্ঞাহীন হয়ে ঝর্ণার ধারে পড়েছিলেন। কারা যেন কয়েক রাত কোনও বন্ধ পাতার কুটিরে সেবা শুশ্রসা করে সেই গুপ্ত সুড়ঙ্গ অব্দি ছেড়ে এসেছিল। তারপর বহু চেষ্টা করেও আর তিনি সেই সুড়ঙ্গ মুখ খুঁজে পাননি।

কেউ তাঁর তাঁবু ঘরে আসছে। দেখলেন পর্দা তুলে অনুমতি নিয়ে ঢুকলেন রাশিয়ান মেজর জেনারেল সারগেই। হাতে একটা পাতলা ফাইল। পিছনে চারজন সশস্ত্র রক্ষী। গোরাচাঁদের হাতে সেই ফাইলটা ধরিয়ে দিয়ে ইঙ্গিতে উনি খুলে পড়তে বললেন। মুখে বললেন ওটা মেল থেকে ডাউনলোড করা হার্ডকপি। গোরাচাঁদ পড়ে দেখলেন। আজকের সবরকম একশনের স্টে অর্ডার। ভারতীয় সুরক্ষা মন্ত্রালয় থেকে।

0 comments: