0

স্মৃতির সরণী - ঈশানী রায়চৌধুরী

Posted in


স্মৃতির সরণী


অ-রূপকথা

ঈশানী রায়চৌধুরী



পূর্ব প্রকাশিতর পর



(৫)



চার চারটে বছর কেটে গেল লালবাজারে। যাবজ্জীবন কারাবাসের হুকুম হলে একটা সময়ের পরে কয়েদীর আর তেমন হেলদোল হয় না, তা আমিও সে নিয়মের ব্যতিক্রম ছিলাম না। চাপ একটাই ছিল, ওই হায়েস্ট মার্কসের কলামটা আর এটা শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত করা যে রেজাল্ট বেরোলে যেন আমার আগে আর কারো নাম না থাকে। কারণ তাহলে আমার ফাঁসি হবেই, মায়ের হাতে।

ক্লাস নাইনে উঠলাম আমরা। এবার তিনটে থেকে দুটো সেকশন হলো। যারা অ্যাডিশনাল ম্যাথস বা বায়োলজি নিল, তারা 'এ' সেকশন আর লজিক-সাইকোলজি নিলে 'বি'। আমার আদৌ ইচ্ছে ছিল না সায়েন্স সাবজেক্টের চক্করে পড়ি, কিন্তু আমাদের বাড়ি বরাবর হিটলারের ভক্ত। অগত্যা!

কিছু পুরোনো বন্ধু গেল অন্য সেকশনে। কিছু নতুন বন্ধু এল। ক্লাস এইটে আমাদের ইংরিজি পড়াতে এসেছিলেন এক দিদি। নিঘাত বোয়েল ফাজিল (জ-এর উচ্চারণ জেড-এর মতো)। গুজরাটি বোরি মুসলমান মহিলা, অবিবাহিতা। একটি বর্ণ বাংলা বোঝেন না। 

সিস্টাররা তবু বাংলা বলেন। কিন্তু তাতে কী! অসাধারণ শিক্ষিকা। আমরা মুগ্ধ ছিলাম। আমি অন্তত ক্লাস এইটের আগে যতটা বাংলা গল্প উপন্যাস পড়তাম, ততটা ইংরিজি সাহিত্য পড়তাম না। দিদি আমাকে আমূল বদলে দিলেন। আমার সঙ্গে একটা অদ্ভুত লেনদেনের সম্পর্ক তৈরী হলো....ইংরিজি বইয়ের। আমার বাড়িতে ছিল কিছু, দিদির বাড়িতে তো সবই....আমরা বই বদলাবদলি করতাম। সেই যে নেশা তৈরী হলো, সেই যে ইংরিজি -বাংলা দুই-ই আঁকড়ে বাঁচা শুরু হলো ক্লাস নাইনে দিদি ক্লাস নিতেন না বটে, কিন্তু আমার নেশাটি অটুট রইল।

দিদি যখন স্কুলে আসেন, সঙ্গে একটি আছোলা বাঁশ এনেছিলেন। দিদিরই বান্ধবী আর এক ইংরিজির দিদিমণি। ক্লাস নাইনে উঠে আমাদের চোখ কপালে উঠল। তাঁর বান্ধবীটি, জয়শ্রী ঘটক। ওই রক্ষণশীল স্কুলে, যেখানে কানে ঝোলা দুল পরা বা চুলে রঙিন ক্লিপ লাগানো পর্যন্ত নিষিদ্ধ, সেখানে তিনি প্লাক করা ভুরুতে, ঠোঁটে লিপগ্লস লাগিয়ে, স্লিভলেস ব্লাউজে এবং নাভির নীচে শাড়ি পরে মোহময়ী। তবে সে মোহ ঘুচে গেল প্রথম দিনেই, যেদিন ক্লাসে এসে চিবিয়ে চিবিয়ে দাঁত চেপে প্রবল অ্যাকসেন্ট সম্বলিত ইংরিজিতে ঘোষণা করলেন, উনি কোনও ইডিয়সি বরদাস্ত করবেন না। আর কী যে পড়ান, চেপা দাঁতের দুর্গ পেরিয়ে গ্লস-চিকচিক ঠোঁট ডিঙিয়ে সে তো আমাদের কানেই ঢোকে না! ক্লাস টেস্টে তো ডাহা ফেল করব! এবং তাই হলো। ক্যাটরিনা ম্যান্সফিল্ডের 'দ্য ডল'স হাউস' –এর ওপরে প্রথম পরীক্ষাটি হলো এবং তাতে আমি দশে আড়াই পেলাম। না না, হাসার কিছু নেই, ওটাই হায়েস্ট। মাকে দিয়ে খাতা সাইন করাতে হবে তো! আমি প্রচুর সাহস সঞ্চয় করে জয়শ্রীদিকে জিজ্ঞেস করলাম, "ম্যাডাম, একটু যদি গাইড করে দেন...কোথায় ভুল...." তিনি অতি লীলায়িত ভঙ্গিমায় গোলাপি নখপালিশ মাখা হাত উল্টে বললেন, "কোত্থাও ভুল নেই তো! শুধু এই লাস্ট সেন্টেন্সটা তুমি কমপ্লেক্স সেন্টেন্স লিখেছ, ওটা কম্পাউন্ড সেন্টেন্স লিখলে বেটার হতো।"

তবে এ যমযন্ত্রণা বেশিদিন সইতে হয়নি। জয়শ্রীদি দু-তিন মাস পরেই বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন এবং তার মাসখানেক বাদে আমাদের রেহাই দিয়ে হতভাগ্য স্বামীটির স্কন্ধে আরূঢ়া হলেন। আমাদের ইংরিজি পড়াতে এলেন সিস্টার ম্যাক্সিমিলা। ক্লাসে চন্দনগন্ধী বাতাস বইতে শুরু করল।



সিস্টার ম্যাক্সিমিলা দুটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আজ থেকে চার দশক আগে তা মোটেই সহজ ছিল না, বিশেষ করে চুড়ান্ত রক্ষণশীল রোমান ক্যাথলিক স্কুলে।

প্রথমটি হলো 'প্রেয়ার রুম'। এই স্কুলেও চ্যাপেল ছিল, আমরা মাঝে মধ্যে ইচ্ছে সুখে সেখানে গিয়ে বাইরে রাখা মন্ত্রপূত জর্ডন নদীর জল মাথায় ছিটিয়ে ভেতরে হাঁটু গেড়ে বসে বিড়বিড় করে প্রার্থনাও করতাম। তবে সাধারণ রোজের প্রার্থনা তো উঠোনেই হোতো। আবার চ্যাপেলের পাশেই প্রায় একটা 'সিক রুম'-ও ছিল, সেখানে খুব বেকায়দায় পড়লে অসুখের ছুতোয় এক আধবার আমিও গিয়ে প্রাণে বেঁচেছি (আসলে সে ঘরটা এত সুন্দর করে সাজানো আর গ্র্যান্ড পিয়ানোও ছিল যে হোমওয়ার্ক করতে ভুলে গেলে মাথাব্যথার ভান করতেই হতো!)। কিন্তু প্রেয়ার রুমের কনসেপ্ট আলাদা। ঘরটি আধো-অন্ধকার, মেঝেতে জাজিম, মোমদানিতে মোমবাতি, কিছু ফুল সাজানো ফুলদানিতে আর আবছা ধূপের গন্ধ (টাটকা ফুল আর নতুন মোম, রোজ ধূপ জ্বালানো হতো ....ডিউটি ভাগ করে দেওয়া হতো আমাদের )। কোনও ঠাকুর দেবতা ধর্মগুরুর ছবি বা মূর্তির বালাই নেই। শুধু চোখ বুজে প্রার্থনা করাটি আছে। এ এক অদ্ভুত ঈশ্বর -নিরীশ্বরবাদের ধারণা। কোনও জুলুম নেই, কোনও বাধ্যতামূলক নিয়ম নেই, কোনও ধরাবাঁধা সময় নেই। প্রার্থনার তো নির্দিষ্ট সময় থাকে না, তাই না? ওই প্রেয়ার রুম আমাদের নিজেদের চিনতে শেখার প্রথম ধাপটি তৈরী করে দিয়েছিল।

দ্বিতীয় বিষয়টি আবার বৈপ্লবিক। সিস্টার আমাদের "সেক্স এডুকেশন"- এর ক্লাস চালু করলেন। চিন্তা করুন! এক সন্ন্যাসিনী আমাদের জন্মচক্রের পাঠ দিচ্ছেন, রীতিমতো ছবি এঁকে, চার্ট তৈরী করে। বলছেন, মেয়েদের অনেক অসুবিধে, অনেক বিপদ। তাদের এগুলো জানা দরকার। আমরা ক্লাস করছি, নোট নিচ্ছি, বাড়ির লোকজন চমকে যাচ্ছে। তবে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। একদিন সিস্টার আমাকে ক্লাসে ফট করে দাঁড় করিয়ে বললেন, "ঈশানী, মেয়েরা কতটা বুঝছে জানি না, তুমি একটু বাংলায় ওদের এক্সপ্লেন করো।"

সব্বোনাশ! এ গূঢ়তত্ত্ব বাংলায়! আমি হাত নেড়ে বলেছিলাম, "কিচ্ছু ভাববেন না সিস্টার, এরা সব্বাই যথেষ্ট সেয়ানা, ঠিক যা বোঝার বুঝে নিচ্ছে।"

এখন ফিরে তাকাই যখন, সিস্টারের কথা ভাবি.... মনে হয়...কিছু কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা সময়ের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে থাকেন ...চিন্তায়, ভাবনায়, কাজে। সিস্টার ঠিক তেমনটিই ছিলেন। 




(৬)



বেশিদিন সুখ কারওর কপালে সয় না। আমারও তাই হলো। নাইনের অ্যানুয়েল পরীক্ষায় ভেবেছিলাম অঙ্কতে সব ঠিকই করেছি, বিধাতা মুচকি হেসেছিলেন। রেজাল্ট বেরোনোর দিন আমার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে সিস্টার ভেরোনিকা অমোঘ বাক্যটি উচ্চারণ করলেন, "ঈশানী অ্যানুয়েলে কিন্তু থার্ড হয়েছে।" রিপোর্টকার্ডে আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েছিল অঙ্কের নম্বর। আমি একশ'তে ঊনপঞ্চাশ পেয়েছি! খবর নিয়ে জানলাম, জ্যামিতিতে পঞ্চাশে ঊনপঞ্চাশ পেয়েছি বটে, কিন্তু অ্যালজেব্রাতে পঞ্চাশে শূন্য! আমি সব x-y-z দেওয়া অঙ্কগুলো a-b-c দিয়ে আর a-b-c-র অঙ্কগুলো x-y-z দিয়ে কষে এসেছি। এ নিয়ে বিশদ আলোচনায় যেতে চাই না। হাফ-ইয়ার্লি আর অ্যানুয়েলের নম্বর যোগ করে যদিও আমার সামান্য পদোন্নতি হলো, কপালে সেকেন্ড প্রাইজ, কিন্তু সেই থেকে আমার দু-কানের মাপে সামান্য অ্যাসিমেট্রি আছে। সাদা চোখে অবিশ্যি ঠাহর করা যায় না।

ক্লাস টেনে উঠে যে ক্লাসরুম আমাদের কপালে জুটল, সেটি খাসা। চারতলার ওপরে জানলার পাল্লা একটু কায়দা করে খুলে রাখলে যদি ঠিকঠাক ডেস্কটি ম্যানেজ করা যায়, দিদিদের সাধ্যি নেই ওই ডেস্কের ছাত্রীকে দেখতে পাবেন স্পষ্ট করে। আমি জানলার ধরে মৌরসীপাট্টা গাড়লাম। জানলা দিয়ে উদাস চোখে পাশের বাড়িগুলোর ছাদে রংবেরঙের শাড়ি ঝুলতে দেখা যায়, রোদে দেওয়া আচারের বয়াম, দু-চারটে শখের ফুলগাছ। কে জানে কার বাড়িতে মুরগি পুষেছে, তারা নিয়মিত জানান দেয়। তারা ডাকাডাকি শুরু করলেই জীবজন্তুর বিষয়ে সবজান্তা ডেইজি ফিসফিস করে ঘোষণা করে, "ডিম পেড়েছে"। এবং আমি প্রবল তর্কে সামিল হই একটা মুরগি দিনে ম্যাক্সিমাম ক'টা ডিম দেয়। জীববিদ্যার মুখে ছাই দিয়ে নির্ঘাৎ অনেক, কারণ বাজারে মুরগির চেয়ে ডিমের সংখ্যা বেশি। সে তর্ক শুনে সিস্টার ভেরোনিকা দৈববাণী উচ্চারণ করেন, "ঈশানী বায়োলজি খাতার পাতায় একাই ঝুড়ি ঝুড়ি ডিম পাড়বে।"

সংস্কৃত জ্ঞানভাণ্ডার বাড়াতে সাহায্য করে সুতপা। গোয়াবাগানের গোঁড়া পরিবারের মেয়ে, বাড়িশুদ্ধু কোনও মঠে কোনও বাবাজির কৃপাধন্য, যে বাড়িতে নিয়মিত নাম-সংকীর্তন হয় এবং মেয়েরা পনেরো পেরোলেই বাইরে শাড়ি পরে, সে বাড়ির কন্যা সুতপা আমাকে বিপুল পরাক্রমে 'স্তোকনম্রা' থেকে 'বলাৎকার'... যাবতীয় সংস্কৃত শব্দের আভিধানিক অর্থ শেখাতে তৎপর হয়।

এই "বাইরের বই" পড়ে জ্ঞান বাড়ানোর তাগিদে আমার শুরু হয় জানলার আড়াল খুঁজে ক্লাসে কোলের ওপরে গল্প/কবিতার বই রেখে পড়া। সব ক্লাসে সুবিধে হোতোনা। বেছে নিয়েছিলাম দেবিকাদির ইতিহাস ক্লাস। আমি একা নই। এ নেশা পাপিয়া দত্তরও ছিল। একবার শোভাদির ভূগোল ক্লাসে চান্স নিতে গিয়ে ধরা পড়লাম দুজনই। পাপিয়া বেঁচে গেল অক্লান্ত বকুনির হাত থেকে, কারণ ও পড়ছিল শরৎবাবুর 'ক্লাসিক", বোকার মরণ আর কাকে বলে! আমি ধরা পড়লাম সুনীলের "বৃত্তের বাইরে" হাতে নিয়ে। শোভাদি "ম্যায়েরা বড়ই লঘুচরিত্রের" নিদান হেঁকে রাগ করে পাঁচটা ভাব-সম্প্রসারণ হোমটাস্ক দিয়েছিলেন।



ইতিহাস ক্লাসেও ধরা পড়লাম। সেদিন হাতে ছিল "ধূসর পাণ্ডুলিপি"। দেবিকাদি খুব ঠাণ্ডা মাথায় মেজাজ ঠিক রেখে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "ক্লাসে এমন দুর্মতি কেন?"

আমি বলেছিলাম, "ইতিহাস নিজে নিজেই তো পড়া হয়ে যায়। আমার ভালো লাগে না ক্লাসে পড়া শুনতে।"

আমাকে তাজ্জব করে দেবিকাদি বলেছিলেন, "ঠিক আছে, অনুমতি দিলাম। তুমি অন্য বই পড়তে পারো। তবে অন্যদের ডিস্টার্ব না করলেই হলো।"

এক -দুজন সহপাঠিনী এ হেন পক্ষপাতিত্বে বিপুল প্রতিবাদ জানালে দেবিকাদি যুক্তি দিয়েছিলেন, "অনুমতি দিয়েছি, কারণ ক্লাসে পড়া শুনুক বা না শুনুক, ঈশানী আমাকে পরীক্ষার খাতায় ওর কাছ থেকে যা আশা করি, তার চেয়ে অনেক বেশিই দেয়।"

এখন বুঝি, আগে অতটা দিতাম কি না জানি না, এ কথা শোনার পরে অন্তত নিজের কাছে নিজে দায়বদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম।

এই বাড়তি পড়ার নেশা এমনই ছিল যে আমরা ঠোঙা পড়াও বাদ দিতাম না। আর এক পাপিয়া ছিল, পাপিয়া ঘোষ, তার বাড়িতে রোজ ঠাকুর পুজোর নকুলদানা গুজিয়া আসত কাগজের ঠোঙায়। তাকে বলা ছিল, ঠোঙা সাহিত্য কালজয়ী। তাতে বঙ্কিম থেকে পাড়ার দাদাকে লেখা প্রেমপত্র এমনকী বটতলা সাহিত্যও থাকে। ফলে সে রোজ ঠোঙা সাপ্লাই করত। ঠোঙা পড়ে পড়ে আমরা তিন চারজন পৃথিবীর বহু বিষয়ে ওয়াকিবহাল হয়েছিলাম। তবে এ কথা 'চুকলিখোর' ভালো মেয়েরা জানত না। এ সব প্রিভিলেজড গ্ৰুপের জন্যই শুধু বরাদ্দ ছিল।

ছেলেদের স্কুলে কী হয় জানি না, তবে আমাদের, মানে মেয়েদের স্কুলে তো ওই সেলাই আর ড্রয়িং ক্লাস বাধ্যতামূলক । আমার মতো অপদার্থ অপোগণ্ডদের জন্য সে প্রায় হিটলারের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প। প্রতি সপ্তাহে ঠাকুরের মাথায় ফুল চড়িয়ে বিড়বিড় করে বলি, "এ সপ্তাহে ক্লাস বানচাল হোক।" কিন্তু দিদিমণিদের সোনার স্বাস্থ্য! আমারও যে জ্বরজারি হয়, তাও সপ্তাহের অন্যদিনগুলোতে। বিশেষ করে যে দিন লাইব্রেরি ক্লাস থাকে। অবিশ্যি আমাদের সময়ের লাইব্রেরির গল্প যত কম করা যায়, ততই মঙ্গল। মহাপুরুষদের জীবনী, কিছু ভ্রমণ বৃত্তান্ত, কিছু ছেলেমানুষী রূপকথা ... এই সবই বেশি। আর ছিল কিছু বিদেশী বইয়ের অনুবাদ।

কাজেই লাইব্রেরি ক্লাসের জন্য প্রাণ হাঁকুপাকু করে বটে ....কিন্তু তা হট্টগোল করার উৎসাহে। সেলাই আর ড্রয়িং ক্লাসে সে সুখ নেই। কিছুতেই আঁচলসমেত শাড়ির পাড় বা হাড়জিরজিরে খিটখিটে বুড়োর মুখ এঁকে উঠতে পারি না, অথচ আমার আশেপাশে কেমন ফুলেল আঁচল উড়তে থাকে সিলিং ফ্যানের হাওয়ায়, বুড়োর চোখ দুটো পাশের ডেস্কের খাতার সীমানা পেরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ফিচেল হাসি হাসে। আমার খাতায় নম্বর হোঁচট খেয়ে সেই যে মুখ থুবড়ে পড়ে, একেবারে কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার।

সেলাই ক্লাসও তথৈবচ। ক্লাস টেনে উঠেও আমার উন্নতির লক্ষণ নেই। হেম সেলাই ভাবলেশহীনভাবে সটান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কুচকাওয়াজ করে। ডাবল চেন এক একটা দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট চেহারা, আবার এক একটা সেই দুর্ভিক্ষের মূর্তিমান কারণ মার্কা চেহারা। উল বুনতে গিয়ে ঘর পড়ে যায়। আমি অবিশ্রান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাই মঞ্জুলা দিদিমণিকে বোঝাতে যে স্রেফ প্রতি কাঁটায় শুধু সোজা ঘর বুনলেও দিব্যি ডিজাইন হয়। এই সব এঁড়ে তর্কের কারণে আমি দিদিমণির বিষনজরে। পরীক্ষায় বুনতে হয় খুদে মোজা, খুদে জাম্পার, কিংবা খুচ করে আস্ত কাপড় বেবাক কেটে ফেলে ডেকোরেটিভ রিপু। কী আপদ! কোনওরকমে যাচ্ছেতাই জোড়াতালি দিয়ে কাজ সারি। নম্বর আর পাঁচের কোটা পেরোয় না! অথচ অন্যরা কেউ কেউ কেমন ফটাফট কাজ করে, নম্বর পায়। আমার সেলাই বোনা "কার্টসি মা" অব্যাহত থাকে। মানে সারা বছরের কাজ। পরীক্ষায় ক্যাচ কট কট কেস। কী ভাগ্যিস, লাল দাগটুকু পড়ে না।

ক্লাস এইট পর্যন্ত এসব আপদ বালাই ছিল। ক্লাস নাইনে উঠে কিঞ্চিৎ ফুর্তি এসেছিল মনে। ওয়ার্ক এডুকেশন এল। ভাবলাম, সেলাই থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া গেল। ও হরি, কিস্যুই না। এই পুঁতির বটুয়া, এই চুমকির কাজ, এই অ্যাপ্লিক .... আমার জীবন মহানিশা, হাতেও হ্যারিকেন। আবার নাকি ক্লাস টেনে উঠে মোমবাতি, সাবানও বানাতে হবে। মোমবাতিটা খানিক উৎরে গেল, শুধু অর্ধেকের বেশি মোমবাতির সলতেগুলো মাথা উঁচু করে শহীদ হতে রাজি হলো না। কিন্তু সাবান? দেখতে ঠিক চিটচিটে গুড়ের নারকেল নাড়ু। তাতে আবার ওই বেশি ঝুনো নারকেল হলে কেমন একটা তেল তেল বিদিকিচ্ছিরি গন্ধ ছাড়ে, ঠিক তেমন।

ঠিক নাড়ু পাকানোর মতো করে আমরা মহা উত্তেজনায় গোল্লা পাকাচ্ছি, মঞ্জুলা দিদিমণি সরেজমিনে তদন্ত করতে এসে বললেন, "কী করছ?"

আমি দোষের মধ্যে বলে ফেলেছিলাম, "সাবানের পিণ্ডি চটকাচ্ছি".... সে কী রাগ! গার্জেন কল হবার দশা! অথচ আক্ষরিকভাবেই কিন্তু সেটাই করা হচ্ছিল। আমরা খুব চেষ্টা করছিলাম, সাবান যাতে একটা জিওমেট্রিক শেপ পায় , কিন্তু হতভাগা সাবান নিজেই এমন একবগ্গা, কে জানত!

সুতরাং ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান। সেই মঞ্জুলাদি। সেই পাঁচ বা ছয়ের ঘরে নম্বর। সেই ক্লাসে খোরাক। সেই কিছু মেয়ের দিদিমণির সঙ্গে গা ঘেঁষা .... মা –বেড়াল আর ছানা -বেড়ালের মতো আর সেই আমাকে মঞ্জুলাদির শাসানি, "এই একশ' নম্বর আমার হাতে, তোমাকে পঞ্চাশের বেশি দেবই না, দেখব কী কর অবাধ্য মেয়ে!"

(কারণে অকারণে বকুনি আর হেনস্তার কারণে আমার তো পুরোনো খার ছিলই। সেই রাগে মঞ্জুলাদি অ্যালকোহলকে "অ্যালকোলাহল" বলতেন বলে দোষের মধ্যে আমি বলেছিলাম, "বেশি কোলাহল হলে মন দিয়ে ক্লাস করি কী করে!" সেই থেকেই আর কী.... মানে আরও গোল বেধে গেল। সাপে - নেউলে কেস!)

তবে আমিও তো কম পাজী ছিলাম না! অনেকেই তো বাড়িতে মা, ঠাকুমা, দিদির দৌলতে সেলাই ক্লাসে করে কম্মে খাচ্ছে। সবাই কি সবেতে এক্সপার্ট হয় নাকি? শুধু আমি একাই বিষ নজরে? এমন মজা দেখাব না!

স্কুলে হাতের কাজ, সেলাই, বোনার একজিবিশন হতো ঘটা করে। ক্লাস ফোরের, সিক্সের ...কী সব সেলাই, বোনা! বাপ রে! দেখে মনে হবে মায়ের পেট থেকে পড়েছে উল বুনতে বুনতে বা নিজের অন্নপ্রাশনের কার্পেটের আসন নিজেই সেলাই করেছে। কেউ কেউ হয়ত ক্ষণজন্মা মহিয়সী, তারা পারত, কিন্তু বেশিরভাগই "কার্টসি মা মাসি দিদি" কেস।

ওই একজিবিশনে বাইরের লোকও আসতে পারত কেনাকাটা করতে। আমার এক বন্ধুর দিদিকে ফিট করলাম। সে বেচারী সারা স্কুললাইফ আমারই মতো অবমাননার শিকার। ঠিক বেরোবার আগে একটা খাতা থাকত, দর্শকদের প্রতিক্রিয়া লেখার জন্য। সব্বাই তাতে ভালো ভালো কথা লিখত। সেগুলো আবার পরে চেঁচিয়ে পড়ে শোনানো হতো সবাইকে।

তা একজিবিশন শেষ। সবাই দর্শক- প্রতিক্রিয়া জানতে উদগ্রীব। যে পড়ে শোনাচ্ছিল, সে দেখি তোতলাচ্ছে। যা লেখা আছে, পড়লে সত্যনাশ!

কী লেখা আছে এমন?

"বাঃ, দেখে বড় ভালো লাগল যে গার্জেনদের হাতের কাজ, উল বোনা, সেলাই ....সবেতেই ভারী উন্নতি হয়েছে। দিনে দিনে আরও শ্রীবৃদ্ধি হোক। তবে কচিকাঁচারা কেমন শিখল, খুব একটা সত্যিই বোঝা গেল না।"

নেকনজরে ছিলাম না, হাত কচলাতে পারতাম না, ঘাড় বেঁকা তে-এঁটে টাইপ ছিলাম তো, মঞ্জুলাদি সত্যিই আমাকে অন্যায়ভাবে মাধ্যমিকের ইন্টারনাল অ্যাসেসমেন্টে পেনালাইজ করেছিলেন। অবিশ্যি করেও যে তাতে খুব জব্দ করতে পেরেছিলেন, তা নয়...কারণ আগেই থেকে ওঁর শাসানিতে অভ্যস্ত ছিলাম বলে নিজেকে বাকি বিষয়গুলোতে সেভাবেই তৈরী করেছিলাম, যাতে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর পরে মায়ের দৌলতে কানের অ্যাসিমেট্রি আরও না বেড়ে যায়। তবে আজও ....আমার ক্ষোভের জায়গাটা রয়েই গেছে। থেকেও যাবে। আমৃত্যু।




(৭)



ক্লাস টেনে আমরা মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলাম। শিক্ষামূলক ভ্রমণ। ইতিহাসের আনাচে কানাচে ঘোরাঘুরি। সে কী রোমাঞ্চ! যারা চার দশক আগে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে প্যারোলে ছাড়া পেয়ে দু-দিনের জন্য বাড়ি যেত, তারা ছাড়া এ আনন্দ আর কেউ বুঝবে না। বাসে করে যাওয়া, দু-রাত্তির বাইরে থাকা। সঙ্গে সিস্টার জিটা, সিস্টার ভেরোনিকা, দেবিকাদি (সঙ্গে ল্যাংবোট পিয়াসা, দিদির বাচ্চা মেয়ে) আর নিঘাতদি। দেবিকাদি ভয়ে ভয়ে যাচ্ছেন। আমরা যেকোনও মুহূর্তে পিয়াসার শব্দভাণ্ডার বাড়িয়ে দিতে পারি। বাংলা ব্যাকরণ ক্লাসে তখন আমাদের যাবতীয় উৎসাহ বহুব্রীহি সমাসের ব্যাসবাক্যে...উটকপালি, চিরুনদাঁতি ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি আমাদের দেখবেন না মেয়ে আগলাবেন? আমাদের বিরাট কৌতূহল সিস্টারদের চুলের দৈর্ঘ্য নিয়ে। মানে তাঁরা নেড়ুমুণ্ডি, না কদমছাঁট না ববকাট। সে কৌতূহল মিটেছিল, কারণ মুর্শিদাবাদে রাতে শুতে যাওয়ার সময়ে পাকেচক্রে সিস্টার জিটার মাথা থেকে টুপিটি খুলে যায়।

আমি খুব দুষ্টু ছিলাম। বাজি ধরেছিলাম, সবাই ইউনিফর্ম পরলেও আমি রঙিন জামায় ফুরফুরে হয়ে ঘুরব। কিন্তু কী করে? খুব সহজ। বাসে লাঞ্চ ট্রে উল্টে দাও ...নিজের ইউনিফর্মের ওপরে। ভাত, ডাল, বাঁধাকপির তরকারি আর ডিমের ঝোলে সাদা জামা মাখামাখি। তখন বাস থামিয়ে অচেনা বাড়ির কলের জলে জামা ধুয়ে বাসের পেছনের সীটে শুকোতে দাও আর ব্যাগ থেকে রঙিন জামাটি পরে নাও। বাড়তি স্কুল ড্রেসটা পরের দিন পরতে হবে তো! এতে যা হলুদের দাগ, বাড়ি গিয়ে সাবান সোডা দিয়ে ফোটাতে হবে।

মনে আছে, ফেরার পথে জয়ন্তীর কেনা ছানাবড়ার হাঁড়ি ওর ঘুমে কাতর অবস্থার সুযোগ নিয়ে আমরা শেষ করেছিলাম। শুধু রস পড়েছিল। জয়ন্তীর সে কী হাঁউমাউ করে চিল্লানো! ফেরার পথে আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করেছিলাম, যাতে বাস খারাপ হয়। আমরা আরও খানিক বাড়ির বাইরে থাকতে পারি। তেত্রিশ কোটি দেবদেবী আর যীশু আমাদের সহায় ছিলেন। বাস খারাপ হয়েছিল। আমরা স্কুলে ফিরেছিলাম মাঝরাত পার করে।

ওই অত সাদা সবকিছু (যদিও সাদা আমার সবচেয়ে প্রিয় রং)... নিয়ম ভাঙার খুব ঝোঁক ছিল আমার। মুর্শিদাবাদে কেলেঙ্কারি করে আশ মিটল না, স্কুলে এবার একদিন বন্ধুদের বললাম, আমার খুব ইচ্ছে, একদিন স্কুলে রঙিন জামা পরব। জানি আপাতভাবে সে গুড়ে বালি। কিন্তু আমি পরবই পরব। একদিন। সারাদিন ধরে। চ্যালেঞ্জ! কিন্তু কী করে?

সেদিন আকাশে খুব মেঘ । আমার মন পেখম তুলেছে। আজই! স্কুলে এসেছি খুব সকাল সকাল। তেমন কেউ তখন আসেনি। ঝমঝম করে এই নামল! আমি মাঝের শানবাঁধানো চাতালে। মনের আনন্দে খুব ভিজছি। বেশি না, দশ মিনিটে কাজ শেষ। আর না। এবারে একে একে করে আসছে অন্যরা, ছাতা নিয়ে। লক্ষ্মী খুকুর দল! আমিই দুষ্টু! সেদিন উঠোনে প্রার্থনার পাট নেই।

"ইস, তুই এত ভিজলি কী করে?"

"আর বলিস না, ছাতা নিয়ে বেরোইনি। ও কিছু না, গায়ে শুকিয়ে যাবে।"

প্রথম ক্লাস ইংরিজি। আমার হিসেব করাই আছে। সিস্টার ম্যাক্সিমিলা।

" ইস, ঈশানী, তোমার তো জ্বর এসে যাবে!"

আমি বোকা ভীতু চোখে, মাথা নীচু। বাড়ি পাঠাবার প্রশ্ন নেই। শুকনো জামা নেই। এভাবে থাকলে বিকেল পর্যন্ত নির্ঘাত ডবল নিউমোনিয়া!

সিস্টার ডাকলেন, "ডেইজি, তুমি খুব কাছেই থাক। আমি জানি। যাও, ঈশানীকে নিয়ে। তোমার বাড়ি। তোমার একটা ফ্রক পরে আসুক। স্কুল ড্রেস না হলেও ঠিক আছে। এসে এই জামাটা বরং শুকিয়ে নিয়ে পরে বাড়ি ফিরবে।"

আমার চোখে ঝিলিক। ডেইজির ঠোঁটে চাপা হাসি। সুদীপ্তা, পাপিয়া ....মুখে হাত চাপা । আর "ভালো "মেয়েদের চোখে ভর্ৎসনা! ছিঃ! কী দুষ্টু!

আমার মনে আছে, সেদিন ইস্কুলে আমি কমলা-কালো-বাদামী ফ্রকে। সারাদিন!

এখন একটা মন আর তাতে বসত করা গুবরে পোকাটা বলে, "কাজটা কি ভালো হয়েছিল?"

আমি তাকে চোখ পাকিয়ে দাবড়ানি দিই, "উফ, ছাড় তো! খালি খোঁচা মারা! বেশ করেছিলাম। আমার সেদিন অন্যরকম হতে ইচ্ছে হয়েছিল খুব!"

ক্লাস টেনের প্রি-টেস্টে আমাকে বংশদণ্ড দিলেন শোভাদি। ভূগোলে ফেল করলাম। একশ'তে আটত্রিশ। চল্লিশ পাসমার্ক। ফেল করেও অবিশ্যি সেকেন্ড হয়েছি। কিন্তু ফার্স্ট হইনি এবং লাল কালি। অথচ আমি সত্যি ফেল করার মতো পরীক্ষা দিইনি। তাজবি ব্যাপার, একঝাঁক মেয়ে ফেল করেছে। এবং ওই ভূগোলেই। বাড়ি গেলে নিগ্রহের আর বাকি থাকবে না। বাড়িতে পটাসিয়াম সায়ানাইড নেই, পারম্যাঙ্গানেট আছে ...কিন্তু একথাবা খেলেও মরার চান্স কতটা জানি না। খাতা সই তো করাতেই হবে। খাতা দেখে মা আমার যা হাল করেছিল, ভাবলে এখনও শিউরে উঠি। যত বলি, ফেল করার মতো লিখিনি...কে শোনে কার কথা! শেষে মা বলল, শোভাদির সঙ্গে দেখা করবে। আমি তাতেই রাজি।

শোভাদি গম্ভীর গলায় মাকে বললেন, "আসলে ফেল করেনি, বুঝলেন! আমিই শাস্তি দিয়েছি। ও এমন একটা কেয়ারলেস মিস্টেক করেছিল যে রাগে অস্থির হয়ে ওর সব ক'টা উত্তর থেকে আমি দু-নম্বর করে মাইনাস করেছি।”

অর্থাৎ কুড়িটা উত্তরে মাইনাস হয়েছে চল্লিশ নম্বর! আমি পেয়েছিলাম আটাত্তর।

সব জেনে যখন সেটা জোর গলায় মাকে বলতে গেলাম, মা এক দাবড়ানি দিয়ে বলল, "লজ্জা করে না! লেটার মার্ক্স্ হয়নি!"

অথচ মৈত্রেয়ীও ওই আটত্রিশই পেয়েছিল। হতচ্ছাড়ি বাড়িতে বকুনির হাত থেকে বাঁচতে বলেছিল, "আমাকে বকছ কেন? ঈশানীও লাল কালি।" আমার সে রাতে বাড়িতে খাবার জোটেনি, ওর কাকা বলেছিলেন, "তাই না কি? তাহলে তো ঠিকই আছে! লাগাও পোলাও-মুরগি।"

এই মৈত্রেয়ী পরে ভূগোলের অধ্যাপিকা হয়! কী আয়রনি!

নবনীতা দেবসেনের "স্বজন সকাশে" পড়তে গিয়ে দেখি একটি অধ্যায় দু-জন পাদ্রীকে নিয়ে লেখা। দু-জনের মধ্যে একজনের সঙ্গে আমাদের স্কুলজীবনে প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল। ফাদার ফালোঁ। অমনি এই দুপুরে চোখ বুজে দেখি পৌঁছে গেছি মানিকতলা -বীডন স্ট্রিট ক্রসিঙে। 

একজন লম্বা রোগাসোগা পাদ্রী, পাক্কা সাহেবী চেহারা, হালকা দাড়ি। বাইসাইকেলটাকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে চলেছেন আমাদের স্কুলের দিকে। পথে যত এটা ওটা কিনছেন। দুটো আপেল, চারটে কলা, এক থাবা আঙুর, এক মুঠো খেজুর, এমনকি চাট্টি আলু-পেঁয়াজও। প্রত্যেক ফেরিওয়ালার কাঁধে হাত দিয়ে কথাও বলছেন বাংলায়। কিন্তু কেনার পর সওদা যে কোথায় রাখছেন ...দেখা যাচ্ছে না। পরে বুঝেছিলাম, সাদা আলখাল্লার পকেটে। আমার বিশ্বাস, আলখাল্লার এধার ওধার জুড়ে চারদিকেই ঘুরিয়ে পকেটের মতো ব্যবস্থা। সারা মহল্লার বাজার ঢুকে যাবে। পকেট নির্ঘাত কোমর থেকে গোড়ালি পর্যন্ত। সব সময়েই মুখে দেবশিশুর মতো হাসি। 

আমাদের স্কুলে ফাদার যেতেন আমাদের সঙ্গে ধর্মালোচনা করতে। আমাদের তখন ক্লাস নাইন টেন। ফাদার মানেই "ধম্ম আলোচনা"। ওঁর বিদেশী উচ্চারণে "ধর্ম" যদিও "ধম্মে" পর্যবসিত হতো, তাতে ধর্মচর্চার (আসলে দর্শনচর্চার) গুরুত্ব কিছুমাত্র কমত না। তখন উশখুশ করতাম সাইকোলজি রুমে বসে (দু সেকশনের কম্বাইনড ক্লাস, হরি ঘোষের গোয়াল ...তবে বেশিটাই মিটমিটে দুষ্টুমি, মিশনারী স্কুলে অনুশাসনের প্রাবল্য খুব বেশি), কী যে বড় বড় তত্ত্বকথা...ভালো লাগে না ছাই, ঘুম পায়। তার ওপর ফাদার মাঝেমাঝেই ধর্ম, দর্শন ...এসবের ওপর রচনা লেখার হোমওয়ার্ক দেন। ছাইপাঁশ যা মনে আসে, লিখি, এদিক সেদিক থেকে কোটেশন তুলে অল্পবিদ্যা জাহির করি। কী হয় এ সব ধর্ম আর নীতিশিক্ষার ক্লাস করে?

তখন বুঝিনি। এখন ভাবি, ফিরে দেখি যখন ...এই মানুষটি কোনও দিন বাইবেল চর্চা করেননি ক্লাসে, ধর্মালোচনা যা করতেন...পুরোটাই দর্শনভিত্তিক এবং তা সর্বধর্মসমন্বয়ের দর্শন। তাতে ঝড়ের মতো আসত গীতা-বাইবেল-কোরান-উপনিষদ সব। আর বলতেন ...ধর্মকর্ম কর। কর্মের মধ্যে দিয়ে ধর্মপালন, মনুষ্যত্বের ধর্মপালন। বিবেকানন্দর কথা উঠে আসত। আসত হরিজনদের কথা। সকলের জন্য শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের প্রয়োজনের কথা। বলতেন, "ধর্ম'' কেমনের "চক্ষু" দিয়ে "দর্শন" করতে শেখো। 

এ সব তো ভুলেই গিয়েছিলাম বইটা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, আচ্ছা, ফাদার ফালোঁর সঙ্গে কার চেহারার যেন ভারী মিল? মনে পড়ছে, আবার পড়ছে না...

তারপর দেখি আমার আলমারিতে সেই কবে পুনে থেকে দাদুর এনে দেওয়া চিনেমাটির যীশুর মূর্তি। সেই হালকা দাড়ি, একজোড়া মায়াবী চোখ, পা পর্যন্ত লুটোনো আলখাল্লা...

মনে পড়ে গেল!



(উপসংহার)



প্রি-টেস্ট মিটল। দু-মাস আমাদের আপাদমস্তক ঝাড়াইবাছাই করে তৈরী করা হলো টেস্ট পরীক্ষার জন্য। ক্লাসের সময় কমে এল, বাড়িতে পড়ার সময় বাড়ল। টেস্টের রেজাল্ট বেরোল। এবার প্রথম বড় পরীক্ষা। নিজেকে প্রমাণ করার পালা। আমার ওপরে কার কতটা আশা, কে যে কতটা হতাশায় ভোগেন আমাকে নিয়ে... বুঝি না...এটুকু বুঝি... মেয়েরাও অর্জুন হয়। আমাকেও ওই পাখির চোখে লক্ষ্যভেদ করতে হবে। মায়ের ভয়েই শুধু নয়, নিজের দায়েও।

খুব জেদ ছিল আমার। পাখির চোখে চোখ রেখে তীর ছুঁড়তে পেরেছিলাম তাই।

এই এত বছর পরে ধুলোবালি ঝেড়ে পুরোনো বইয়ের পাতা খুলে বসা, তাকে পড়া ...মোটেই সহজ কাজ নয়। এই যত সালতামামি। সম্পর্ক এবং সখ্যের।

কিছু কিছু সখ্য এমনই, যা সময়ের বিস্তীর্ণ উঠোন পেরিয়ে রয়ে যায় নিজস্ব নির্ভার দাবিতে। দেখা হয় না, কথা হয় না। কিন্তু যখন হয় বা হবে, আমি নিশ্চিত জানি, যে তখন মনে হবে মাঝের ওই বয়ে যাওয়া সময়টা থমকে ছিল। কিংবা আদৌ ছিলই না! এই সব সম্পর্ক তো আমার আছে, হয়তো বা আজ এত বছর পরে অজস্র নয়, আঙুলে গোনা সামান্য দুটো চারটে ... তবু তারা ঝুরো ফুলের পাপড়ি হয়ে বিছিয়ে আছে নির্জন চলার পথে। ঝিমঝিম মাতাল সুরভি ছড়িয়ে।

যত দিন মাস বছর গেছে, জটিল হয়েছি আমি। গুরুভার হয়েছে মনস্তত্ত্ব। ঘরের বাইরে চৌকাঠ, চৌকাঠ ছাড়িয়ে উঠোনে পা। খুব সন্তর্পণে। কাঁটা না বেঁধে,পচা শামুকে পা না কাটে! নিরাপদ রাস্তায় হাঁটি এখন। এ পথে ফুল বিছিয়ে নেই আগের মতো। দু পাশে অনেক ফুলগাছ যদিও। রং বেরঙের আধচেনা অচেনা ফুল। যারা সুরভি ছড়াতে নিতান্ত অপারগ।

দাঁড়াব কেন? এগিয়ে যাই।

মাঝেমাঝে ছেঁড়া ফুটিফাটা আঁচলের খুঁট খুলে ওই বড় মায়ায় কুড়িয়ে জড়ো করা ঝুরো ফুলের পাপড়িতে নাক মুখ ডুবিয়ে দিই। খুঁজি। সখ্য। আশ্রয়। সেই তো ঢের!

সবাই বলে, একটা বয়সের পর বেশি মানুষজনের সঙ্গে নাকি আর বন্ধুত্ব হয় না। ভাগ্যিস! আমার শতছিন্ন আঁচলে আর জায়গা কই, ফুল কুড়োবার? ফুল জমাবার?

সে এক অন্যরকম ফিকে কমলা-রঙা সকাল, বাসন্তী দুপুর, গোলাপি গোধূলি আর ঘন নীল জমিতে জরির ফুল তোলা রাত্রি ছিল আমাদের বালিকাবেলা আর কিশোরীকালের। এবং প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ ভালোবাসার । রঙিন ধুলোর ঝড় আবির ছিল মুঠিভরা। ছিল ভীরু আঙুল, সাহসী চোখ, বেহিসেবি সাধ, সীমিতসাধ্য। ঠোঁটে ভেসে থাকত অব্যক্ত অভিব্যক্তির মধুরিমা। আকাশ নির্মেঘ তবু কত বৃষ্টি ... হৃদয়ের আনাচেকানাচে।

ভালো থেকো ....ভুলে থাকা হৃদয়ের সাতরং।

0 comments: