undefined
undefined
undefined
বইঘর - চয়ন
Posted in বইঘর
বইঘর
সূর্যনগরীর কান্না
চয়ন
‘দুর্গম গহন অরণ্য, তার মধ্যে আছে হিংস্র জন্তু, নির্জন মরুর চেয়েও শুষ্ক বিশাল পর্বত-রাজ্য- তারই আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকবে লাল-মানুষের সতর্ক চক্ষু। সে সব নিষ্ঠুর চোখ যখনই আমাদের আবিষ্কার করবে তখনই ছুটে আসবে উত্তপ্ত বুলেটের ঝটিকা।’ (সূর্যনগরীর গুপ্তধন : হেমেন্দ্রকুমার রায়;১৯৪৪)
‘বন্দর-নগর টম্বেজ যে অত্যন্ত উন্নত ও সমৃদ্ধ এক অজানা রাজ্যের একটি সীমান্ত ঘাঁটি মাত্র তা বুঝতে তাঁর দেরী হয়নি। সর্বত্র রাস্তায় ঘাটে দেবস্থানে সোনা-রুপোর ছড়াছড়ি দেখেছেন,দেখেছেন সেই আশ্চর্য প্রাণী যার কোমল মসৃন লোম ইউরোপের শ্রেষ্ঠ পশমকেও হার মানায়- অজানা সভ্যতায় ব্যবহৃত নতুন কয়েকটি শব্দ শিখেছেন যেমন কুরাকা, যেমন মিনি মারেস্, যেমন ইঙ্কা।’ (সূর্য কাঁদলে সোনা :প্রেমেন্দ্র মিত্র, ১৯৬৯)
দুই কিশোরপাঠ্য অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস। এক পটভূমি – পেরু। দু’জন লেখক। জগৎ চিন্তার দুটি মেরু। সূর্যনগরীর গুপ্তধন এবং সূর্য কাঁদলে সোনা। হেমেন্দ্রকুমার রায় আর প্রেমেন্দ্র মিত্র। ১৫৩২ সালে স্পেনের ফ্রান্সিস্কো পিজারো, চরম নীচতা আর বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়ে পেরুর সম্রাট ইংকা নরেশ আতাহুয়াল্পাকে হারিয়ে পেরু জিতে নেন। পেরুবাসীর ওপর চলে অকথ্য অত্যাচার। শেষে সম্রাটকে খুনও করেন পিজারো। সম্রাটের মুক্তিপণ হিসেবে রাশি রাশি সোনা নিয়ে আসছিল প্রজারা। রাজহত্যার খবর পেয়ে সেই সোনা তারা কোনও গোপন স্থানে লুকিয়ে ফেলে। সূর্যনগরীর গুপ্তধন বিংশ শতকে এই লুকোন সম্পদ দেখতে যাওয়ার কাহিনী বলে। সূর্য কাঁদলে সোনা বলে পিজারোর পেরু বিজয়ের গল্প।
প্রথমটির নায়ক বিমল-কুমার। বা আরও স্পষ্ট করে বললে বিমল। ছ’ফুটের ওপর লম্বা, অসীম দৈহিক বল, রাইফেলে ক্র্যাক্শট, বাঙালির ঘরকুনো বদনাম ঘোচাতে মরিয়া। তার ঘোষণা- ‘ঘরকুনো বাঙালির ঘরে জন্মেও আমরা হতে চাই বিশ্বমানবের আত্মীয়, আমরা ধন-মান-খ্যাতি কিছু প্রার্থনা করি না, আমরা চাই শুধু ঘটনার আবর্তে ঝাঁপ দিতে, উত্তেজনার পর উত্তেজনা ভোগ করতে, নব নব দৃশ্য আর সৌন্দর্যের মধ্যে তলিয়ে যেতে’ (সোনার পাহাড়ের যাত্রী, নজরটান আমার)। দ্বিতীয়টির নায়ক ঘনরাম দাস। ১৫০৩ সালে ভারতের ‘পশ্চিম উপকূলের সমুদ্রে পর্তুগীজ বোম্বেটেদের লুট- করা, জ্বালিয়ে- দেওয়া তাম্রলিপ্তির সদাগরী জাহাজ থেকে রক্ষা পেয়েও ধরা পড়ে প্রায় অর্ধেক যৌবন পর্যন্ত পোর্টুগ্যাল, স্পেনে এবং এখন যাকে আমরা কিউবা আর মেক্সিকো বলে জানি, সেই দুই দেশে ক্রীতদাস হয়ে কাটিয়ে... [পরে] দাসত্ব থেকে মুক্তি পেলেও নিজের বংশের ধারার ওই চরম গ্লানি ও পরম গৌরবের অধ্যায় চিরস্মরণীয় করে রাখবার জন্য দাস পদবীই গ্রহণ করেছিলেন’ (সূর্য কাঁদলে সোনা)। শ্যামলকান্তি, সুপুরুষ ঘনরাম তলোয়ার চালান কিংবদন্তীর এল্ সিড্ কম্পিয়াডরের মতো; ফার্নানদেজ দে ওভিয়েদো ঈ ভালদেজের মতো পণ্ডিত তাঁর শিক্ষাগুরু। তাঁর আত্মঘোষণা, ‘স্পেনের শত্রু আমি নই, অবিচার অন্যায় নীচতা দম্ভ পাশবিকতা লোভ পৃথিবীর সব সাধারণ মানুষের মতো আমি শত্রু এই সব কিছুর।’ এই স্বর আমরা আবার শুনি তাঁর অধঃস্তন দ্বাবিংশতিতম উওরপুরুষ একমেবাদ্বিতীয়ম্ ঘনশ্যাম দাসের গলায়। অমানুষ ধলা-আদমি ফিংককে তিনি বলেন, ‘আমার দেশের নাম মানুষের দুনিয়া। আপনার দক্ষিণ আফ্রিকা তার মধ্যে নেই’ (‘জল’:প্রেমেন্দ্র মিত্র, ১৯৬৪। নজরটান আমার)।
আপনি জানতে চাইছেন, এই নজরটান গুলো ঊদ্ধৃতির মধ্যে আমি দিচ্ছি কেন? আসলে, একই পটভূমিতে লেখা দু’টো কিশোরপাঠ্য অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসকে সামনে রেখে বইঘর বুঝে নিতে চাইছে বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের এক বিশেষ ধরণকে। একটু পিছিয়ে যাই। উনিশ শতক, ঔপনিবেশিক শিক্ষার দৌলতে গড়ে উঠল এক নতুন শ্রেণী। বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক সম্প্রদায়। ইংরিজি সে শিখল বটে, কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই বোঝা গেল যে সে এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রোডাক্ট, যার উদ্দেশ্য হলো সুশীল, রাজভক্ত প্রজা বানানো। এই শ্রেণীর একটা বিশেষত্ব ছিল। একদিকে, এরা বৃটিশরাজকে ভয়,ভক্তি করতো, আর একটা প্রবল হীনমন্যতায় ভুগত ইংরেজের ক্ষমতার আস্ফালনের সামনে। মনে মনে চাইত প্রভুর সমান হতে। অন্যদিকে, ‘ছোটলোক’ সম্প্রদায়কে ঘেন্নার ব্যাপারে এরা ছিল একেবারে এককাট্টা। ঔপনিবেশিক শিক্ষার সবচেয়ে খারাপ দিক ছিল নিরন্ন, অপুষ্ট, অশিক্ষিত প্রকৃত ভারতথেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। এই দু’রকম দিকেরই প্রতিফলন ঘটে বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে। আমরা তার একটা দিককে দেখতে চাইছি। বিশের শতকের দ্বিতীয়ভাগ থেকেই বাংলা ছোটদের লেখায় এক ধরণের চরিত্রের দেখা পাওয়া যেতে থাকে। এরা গতে বাঁধা জীবন নিয়ে প্রচণ্ড অসন্তুষ্ট; অজানার আহ্বানে চঞ্চল পাখা মেলতে তাদের মন-বলাকা হামেশা তৈয়ার। তারা জগৎ দেখতে চায়, অ্যাডভেঞ্চার চায়,সাহেব প্রভুদের মতো শক্ত সমর্থ হতে চায়। কিংসটন-ব্যালেন্টাইন-হেন্টি-হ্যাগার্ড-কিপলিং-ওয়ালেস পড়া বাঙালি লেখককুল গড়ে তুললেন ইচ্ছেপূরণের দুনিয়া, যেখানে বাঙালির ছেলে বদ্ধঘর ছেড়ে বেরোতে চায়। গোলটাও বাধল ঠিক এখানেই। নিজের অজান্তেই ঔপনিবেশিক বয়ানের ফাঁদে পড়লেন তাঁরা। যেসব সাহেব সুবোর নাম করলাম তাঁদের লেখার উদ্দেশ্যই ছিল সাহেবখোকাদের (খুকুদের নয়) গ্লোরিয়াস এম্পায়ার রক্ষার তালিম দেওয়া। সাদা মানুষের অসভ্য কালা-আদমিদের সভ্য করে তোলার বোঝা বওয়ার মতো মজবুত কাঁধ বানাতে মদত করা। ঠিক এই ছাঁচেই পড়ে গেল ছোটদের জন্য লেখা বাংলা অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসগুলো। সঙ্গে মিশল মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণীচরিত্র। দু’ইয়ে মিলে ফল দাঁড়ালো এই যে, ঘরের বাইরে বেরোতে চেয়েও ঘরেই রয়ে গেল ডানপিটে অভিযানকারীর দল। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কালজয়ী গোপাল রাখাল দ্বন্দ্ব সমাস – উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য বইয়ে লিখেছেন,
উত্তেজনার খোঁজে বেরিয়ে পড়া বাঙালিরা-আফ্রিকা, লাতিন- আমেরিকা, চীন, ব্রহ্মদেশ, ভারত যেখানেই যাক, যত বিচিত্র মানুষের সংস্পর্শে আসুক, যত আলাদা রীতি-নীতি ধ্যানচিন্তার আবহে প্রবেশ করুক, অচেনা ভুবনগুলি তারা নেহাতই স্পর্শকের মতো ছুঁয়ে যায়, অপরিসীম অবজ্ঞা ও নাকউঁচু মনোভাব নিয়ে এড়িয়ে যায়। ফলে তাদের মনে চেনা অচেনার কোনো দ্বন্দ্ব তৈরি হয় না, যে চেনা জগৎ ছেড়ে তারা বেরিয়েছে সেই জগৎটাই ছাপিয়ে উঠে গ্রাস করে নেয় অচেনা জগৎকে। (গোপাল রাখাল দ্বন্দ্ব সমাস – উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য; পৃ:২৮৬)
তাই বিভূতিভূষণের শঙ্কর রোডেশিয়া গেলেও চাঁদের পাহাড় – এর কোথাও সাদাদের অমানবিকতা নিয়ে ঘনশ্যাম দাসের মতো স্পর্ধিত উচ্চারণ নেই। আসলে এক উপনিবেশের প্রজা অন্য উপনিবেশের প্রজার মধ্যে নিজেকে দেখতে চায় না। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘একদিকে যারা সাড়ম্বরে বিজ্ঞাপিত করে তারা স্বভাব বাউণ্ডুলে, সৃষ্টিছাড়া, তারাই আবার নিজেদের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। অন্যের মাপকাঠিতে নিজেকে যাচাই করার দায় থেকে রেহাই পেতে চায় বলেই বিকল্প জীবনযাত্রাকে তারা আমল দেয় না।’(গোপাল রাখাল দ্বন্দ্ব সমাস – উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য; পৃ:২৮৬)
এই কারণেই, বিমলের বিশ্বমানবের আত্মীয় হওয়ার ইচ্ছে আর ঘনরাম- ঘনশ্যামের মানুষের দুনিয়া-র মধ্যে আড়াআড়ি বেধে যায়। সূর্যনগরীর গুপ্তধন যদি ভালো করে পড়েন তবে দেখবেন বইটার মধ্যে রামায়ণের আদল আছে। নিষিদ্ধ সূর্যনগরীতে সবান্ধব বিমল, কুমার আর ফিলিপ সাহেব ঢুকতে পারেন বিভীষণ ইক্নিটাইক্-এর সাহায্যে। এখানে একটা কথা মনে রাখলে ভালো। ইংকা সাম্রাজ্যের বর্ণনা দেওয়ার সময় ফিলিপ সাহেব পিজারোকে নিষ্ঠুর, বিশ্বাসঘাতক, দস্যু প্রভৃতি বাছা বাছা বিশেষণে বিশেষিত করেন। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় ভিন্ন সভ্যতা সম্বন্ধে তাঁর মনে একটা খোলা ভাব আছে? না। একেবারেই না। গুলি খাওয়া ইক্নিটাইক্ যখন জল চাইছে তখন,
ফিলিপের ওষ্ঠাধরে ফুটল কঠিন হাসি। তিনি বললেন, “ইক্নিটাইক্, তুমি যে আমাদের পরম শত্রু, সে কথা আমরা জানি। আমাদেরই অনিষ্ট করবার জন্যে কাল তোমরা এখানে এসেছিলে, তাই ভগবান তোমাকে শাস্তি দিয়েছেন। আমাদের কাছে জল চাইতে তোমার লজ্জা হচ্ছে না?”
একেবারে পেশিবহুল কেরেস্তানি গলার স্বর। তাহলে, এই বই কি পুরোপুরি সাহেব ভজনায় ভর্তি? তাও নয়। আসলে ব্যাপারটা এত সোজা সাপটা হলে কোনও সমস্যাই থাকত না। এই বই পড়লে দেখবেন ন্যারেটিভ স্তরে একটা বিপুল টানাটানি আছে। ইংকা সভ্যাতার উন্নত দিকটা অস্বীকার করা যাচ্ছে না আবার তাদের নিষ্ঠুর প্রথার কথা ভেবে সভ্য ভাবতে বাধছে! ১৯৪৪এ দাঁড়িয়ে স্বাধীনতাকামী বাঙালি লেখক রোমান ক্যাথলিকদের ইন্কুইজিশন্-কে সমালোচনা করছেন, একইসঙ্গে ইংরেজ জমানায় সিডিশনের দায়েও পড়তে চাইছেন না। তার ওপর আবার,ভিন্নতাকে কদর দেওয়ার প্রশিক্ষণও তাঁর নেই। ফলে বইটা টেনশনে ভরা। এই টেনশনটাই ঔপনিবেশিক কালে আমাদের মধ্যবিত্ত মনের গহীনে চারিয়ে গিয়েছিল। আজও বোধহয় আমরা সেটা কাটিয়ে উঠিনি। কিন্তু, সেটা আলোচনার জায়গা বইঘর নয়। যাই হোক, এই টেনশনের দায়ে এই বই ভুলে যায় যে ইংকা বা ইন্কা একটা জাতির নাম! কয়েক পাতা আগে যাদের সভ্যতার কথা বলা হচ্ছিল, শেষের দিকে দেখা যায় সেই ইন্কা বলতে রাজা বোঝানো হচ্ছে! রাজা বলব, না ‘অসভ্য জাত’-এর সর্দার বলব? মৃণুর গানের অবজ্ঞার ধরণে তাই মনে হয় যে!
ইন্কা যদি করত আমায় ইন্কী রে!
চক্ষে তবে জ্বলত আমার
অগ্নিরাগের ফিন্কি রে!
এক চড়ে তার ঘুরত মাথা,
কুঁচকে যেত বুকের ছাতা,
ভাবত বোকা- ‘এমনি ভাবেই
কাট্বে আমার দিন কি রে,-
এ যে বিষম ইন্কী রে!’
শেষ পর্যন্ত অটুটই থাকে ঔপনিবেশিক বয়ান। আর,ঠিক এখানটাতেই সূর্য কাঁদলে সোনা আলাদা হয়ে যায়। পঁচিশ বছরের মধ্যে বদলে গেছে বাঙালি কিশোর সাহিত্যিকের চিন্তাবিশ্ব। হীরোর মডেল একই আছে। শস্ত্র-শাস্ত্র নিপুণ, রূপে-গুণে অদ্বিতীয়। কিন্তু, পালটে গেছে দেখার ধরণ। একটা উদাহরণই যথেষ্ট হবে। যে ইন্কা নিয়ে মৃণুর গান, তাঁর সম্ব্বন্ধেই বলছে কথককন্ঠ-
এই নতুন মহাদেশে এ পর্যন্ত এস্পানিওলরা অনেক কিছু দেখেছে, বড় ছোট অনেক মানুষের সংশ্রবে এসেছে। তুষার ঢাকা অভ্রভেদী পাহাড়ের বুকে ‘সূর্য কাঁদলে সোনা’র দেশ যত রহস্যময়ই হোক সত্য-মিথ্যা নানা বর্ণনা শুনে তার রাজ্যেশ্বর ইংকা আতাহুয়াল্পা সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা তাই পিজারো আর তাঁর দলবলের মনে গড়ে উঠেছিল।
আতাহুয়াল্পার চাক্ষুষ যে রূপ দেখা গেছে তার সঙ্গে সে ধারণার একেবারে মিল নেই।
আতাহুয়াল্পার মতো এরকম সত্যিকারের সম্রাটোচিত চেহারাই এর আগে এদেশে কোথাও পিজারো বা তার সঙ্গীদের কারুর চোখে পড়ে নি।
দে সাটো আর হার্নাণ্ডো পিজারোর এই ইংকা নরেশের সামনে আপনা থেকেই নিজেদের কেমন ছোট মনে হয়েছে।
দু’টো আলাদা জীবন ধারার সংঘাতের কাহিনী লিখছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর সব শর্ত মেনেই। তাঁর গল্প বরং হেমেন্দ্রকুমারের থেকে বেশ একটু জটিল। মারপ্যাঁচ অনেক বেশি। থ্রিল আছে, সাসপেন্স আছে, নায়ক-নায়িকা আছে, খলনায়ক-খলনায়িকাও আছে। কিন্তু, সব চেয়ে বেশি করে আছে ভিন্ন সংস্কৃতিকে সম্মান দেওয়া। নিরপেক্ষ মূল্যায়নের চেষ্টা। এর জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন লেখক, বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে তা অন্তত আমার চোখে আগে পড়েনি। নায়ক ঘনরাম স্পেন আর পেরু দু’জায়গাতেই বহিরাগত। যতই বিদেশে বড় হোন না কেন, তাঁর মনে পড়ে আছে জন্মভূমিতে। তাই, তাঁর পক্ষেই সম্ভব কোনও পক্ষই না নেওয়া। তিনি কতগুলো আদর্শের পক্ষে। অজানাকে জানা, জ্ঞানের বিস্তার ঘটানো, মানুষে মানুষে মিতালি। মানে, যেটা আগের নায়করা চেষ্টা করেও পারেননি, ঘনরাম অবলীলায় সেটা পেরেছেন। তার ওপর ক্রীতদাসের জীবন কাটানোর ফলে নিপীড়িতের যন্ত্রনা তিনি একেবারে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানেন। তাই তিনি এক সুপার-কমন্-ম্যান্। তাঁর বাসভূমি সত্যিই মানুষের দুনিয়া । এরকম নায়ক সৃষ্টি দেশ স্বাধীন না হলে হতো কি না, সে তর্কে ঢুকছি না। শুধু ভাবছি, প্রেমেন্দ্রও তো পরাধীন ভারতে জন্মেছিলেন, ঔপনিবেশিক শিক্ষাতেই শিক্ষিত হয়েছিলেন, ভদ্রলোক সম্প্রদায়ভুক্তও ছিলেন, তাহলে এই খোল নলচে বদলানোর কাজটা তিনি করলেন কীভাবে? জবাব বোধহয় আছে। প্রেমেন্দ্রের সামনেও একটা মডেল ছিল। খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ভোম্বল সর্দার । বাংলা ছোটদের লেখার জগতে প্রথম আউটসাইডার। ‘অতিথি’র তারাপদর কথা তুলবেন না। প্রথমত, ওটা ছোটদের কথা ভেবে লেখা নয়; দ্বিতীয়ত, তারাপদ একটা মেটাফর। ভোম্বল তারাপদর মতো মূর্তিমান সারল্য নয়। সে জেদি, গোঁয়ার,অবাধ্য। তার চোখে ধরা পড়ে গ্রামের দারিদ্র্য, পীড়ন, অপুষ্টি। তার চলা আর দেখে চলা প্রসঙ্গে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘ভোম্বলের ওই নিষ্পলক দৃষ্টি যেন বলছে, জন্মলগ্ন থেকে বাঙালি ভদ্রলোক সম্প্রদায় কর্মসূচির যে খসড়া লিখে চলেছে তা এবার আগাপাশতলা পালটানো দরকার’ (গোপাল রাখাল দ্বন্দ্ব সমাস – উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য; পৃ:২৯৬)।
আমি একবারও বলছি না যে প্রেমেন্দ্র খগেন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত। সেটা সম্ভবও নয়। কারণ, ভোম্বল সর্দার –এর প্রথম খণ্ড ১৯৩৬এ বেরোলেও, দ্বিতীয় আর তৃতীয় খণ্ড বেরোয় যথাক্রমে ১৯৫৫ ও ১৯৭৫ এ। সূর্য কাঁদলে সোনা-র প্রথম প্রকাশ ২৫শে বৈশাখ, ১৩৭৬। আমি বলতে চাইছি, চালু বয়ানের প্রতি-বয়ান থাকবেই। একই সামাজিক পরিবেশ থেকে বিরোধী স্বর জন্ম নিতে বাধ্য। তাই, হেমেন্দ্র যে স্বরের প্রতিনিধি তার উলটো স্বরের প্রতিনিধিত্ব করেন খগেন্দ্র-প্রেমেন্দ্র।
সূর্যনগরীর গুপ্তধন আর সূর্য কাঁদলে সোনা বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের দু’টো ভিন্ন ধারার প্রতিভূ। নামেই তার প্রমাণ। হেমেন্দ্র জোর দিয়েছেন অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্যের চিরাচরিত গুপ্তধন মোটিফের ওপর। এর সঙ্গে মিশে থাকে একটা জিতে নেওয়ার গন্ধ। ভিন্ন সংস্কৃতি ইত্যাদি এখানে গৌণ। প্রেমেন্দ্র ভাবছেন পেরুর লোককথা নিয়ে। সোনাকে যে বলে সূর্যের চোখের জল। নামই বলছে ‘অপর’-এর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার কথা। বলছে এস্পানিওলদের ইস্পাতের তলোয়ারের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত পেরুবাসীর চোখের জলের প্রতি তাঁর মমত্বের কথা।
এক পটভূমি। দু’টো বই। বিশ্বপ্রেক্ষার দুই ভিন্ন মেরু।
মুগ্ধ হলাম। বই দুটো পড়ার ইচ্ছে রইলো।
ReplyDeleteএমন টানটান লেখা তোমার পক্ষেই সম্ভব.... অনিমেষ উৎসাহে পড়ে যেতে হয় পুরোটা... অসাধারণ !!
ReplyDeleteবেশ ভাল
ReplyDelete