0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


জলরেখা
নন্দিনী সেনগুপ্ত


২৪ 

‘ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই, মা। সবাই ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক। তুমিও যাও না, একটু বিশ্রাম করে নাও। আমি আরও দুদিন আছি। শুক্রবার ভোরে বেরিয়ে যাবো। যাওয়ার আগে একবার অফিস যেতে হবে, তাই কলকাতা যাওয়া। নইলে সোজা এখান থেকেই...’ নিরূপ বসার ঘরে ইজিচেয়ারে শরীর এলিয়ে বসে। চোখ বোজে। ক্লান্তি। 

এষা কেমন যেন কোনও কথা খুঁজে পান না। নিরুর বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর হয়েছিল। তাই স্কুলে যেতে দেননি এষা আজ। ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। ও স্কুলে থাকলেই কি একটু ভালো হতো এই মুহূর্তে? নিরূপের সাথে মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তে যদি এখুনি নিরু ঘুম ভেঙে উঠে আসে? যদি দরকারি কথাগুলি আর বলা না হয়? নিরূপকে কদ্দিন পরে দেখছেন তিনি? নয় মাস? একবছর? ঠিকঠাক হিসেব করতে পারেন না এষা। নিজের সন্তানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এত অস্বস্তিকর হতে পারে এটা আগে কখনও ভাবেননি এষা। সুনন্দও নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছেন। তিনিও সুস্থ নন। তার রুটিন মাফিক জীবন। নিরূপকে কি বলবেন তিনি? আর পাঁচটা স্নেহময়ী মা যেভাবে বহুদিন পরে নিজের একমাত্র সন্তানকে চোখের দেখা দেখে চোখের জল ফেলে, সেভাবে কিছু কি করতে পারবেন? একমাত্র? হ্যাঁ, একমাত্র। অরূপ চলে গেছে কবেই। এখন তো নিরূপ একাই। থেকেও অনেক দূরে। এষা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন নিরূপের দিকে। কত রোগা হয়ে গেছে। গায়ের রঙ জ্বলে তামাটে হয়ে গেছে। অথচ বাড়ির মধ্যে ও সবচেয়ে ফর্সা। মাথায় সিংহের কেশরের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ কালো কোঁকড়ানো চুল হাল্কা হয়ে লেগেছে নুন-গোলমরিচ ছোঁয়া। মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি। অথচ আগে কত শৌখিন ছিল নিরূপ। রূহ্‌। হ্যাঁ, এই নামেই তো এষা আগে ডাকতেন ছোটছেলেকে। ‘রূহ্‌, যাও দুষ্টুমি কোর না, পড়তে বস। যাও রূহ্‌, আর খেলা নয়। আবার কুকুরছানা এনে ঘরে তুললে, রূহ্‌? আবার কোথায় যেন গেলো রূহ্‌, টিকির দেখা নেই!’ উফফ, খুব জ্বালাতো রূহ্‌ ছোটবেলা থেকেই। বরং অরূপ অনেক দায়িত্বশীল ছিল বরাবর। ‘এখন এত দূরে সরে গেছিস রূহ!’ মনে মনে বলেন এষা, ‘রূহ্‌, আমার আত্মার টুকরো। কেন এড়িয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস?’ 

এষা লক্ষ্য করেন নিরূপ হঠাৎ চোখ খুলল। ও কি শুনতে পেয়েছে মনের কথা? চোখ। হ্যাঁ, চোখদুটো এখনও আগের মতই জ্বলজ্বলে, ... ‘কিছু বলছো মা?’ 

-‘তুই আমাকে জানাসনি কেন যে তুই নিজেই অসুস্থ ছিলি? কেন রূহ্‌, কেন?’ কাতরে ওঠেন এষা।

-‘ক্কে... কে বলল তোমাকে?’ নিরূপের গলা কাঁপে সত্যিটা প্রকাশিত হয়ে যাওয়ায় নাকি অনেকদিন পরে মায়ের মুখে নিজের ডাকনাম শুনে, সেটা সে নিজেই ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা। 

-‘কে বলবে? আমি তোর মা! তোর মুখে এই পক্সের দাগ কোনওদিন ছিল? দাড়ি রেখে কটা দাগ ঢেকে লুকোবি তুই?’ অনুচ্চ অথচ তীব্রকণ্ঠে বলে ওঠেন এষা।

নিরূপ মাথা নিচু করে চোখ ঢাকে দুই হাতে। পালিয়ে বেড়াচ্ছে সে। সব দায়িত্ব, কর্তব্য থেকে দূরে সরে থাকছে। কিন্তু মায়ের চোখকে সে কীভাবে ফাঁকি দেবে? সহ্য করতে পারেনা সে ঐ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি।

‘কি করবো বলো? তুমি বলে দাও। জানো তো আমি খালি ভুল করি। ছোটবেলা থেকেই করি। অরূপ আগে সব সামলে নিতো। ও চলে যাবার পরে আমি একের পর এক ভুল করে গেছি। সেগুলো এখন শোধরানো অসম্ভব। কি করবো বলে দাও।’ ডুকরে ওঠে নিরূপ। 

এষার বুকের ভেতরে মুচড়ে ওঠে। না, তিনি তো ভাবেননি যে নিরূপ এসে এভাবে তার সামনে ভেঙে পড়বে একদিন। তিনি শুধু চেয়েছিলেন যে নিরূপ নিজে এসে নীরদার সামনে দাঁড়িয়ে বলুক সত্যিটা। বলুক যে ওর মা বেঁচে আছে। কিন্তু বেঁচে আছে তো? অপেক্ষায় থাকতে থাকতে শেষ হয়ে যায়নি তো? সত্যি সত্যিই মেঘের মধ্যে মিলিয়ে যায়নি তো? কেঁপে ওঠেন এষা। নিরূপের পাশে মোড়াটা টেনে নিয়ে বসেন এষা। বহুদিন পরে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। উফফ, কি রুক্ষ মাথার চুলগুলো। কদ্দিন তেল দেয়না কে জানে! কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, ‘হ্যাঁ, রে, তুই কি কোনও খবরই জানিস না বউটার? কোনও খবরই কি রাখিসনি এদ্দিন? সেই এত বছর আগে কেড়ে নিয়ে এসেছিলি দুধের বাচ্চাটাকে, সেই হতভাগিনী মায়ের কি কোনও খোঁজ রাখিসনি তুই?’ 

নিরূপ সোজা হয়ে বসে, ‘পাই। ভাসা ভাসা খবর পাই। একদম গণ্ডগ্রামে পাহাড়ের উপরে একটা চার্চের স্কুলে পড়ায়। একা থাকে। একটা ফোন নম্বরও পেয়েছি। চেষ্টা করেছি যোগাযোগ করার। ধরে। বুঝতে পারি ঐপাশ থেকে ওরই নিঃশ্বাসের শব্দ। কিন্তু কোনও কথা বলেনা। চুপ। অভিমানী। ভীষণ অভিমান ওর। স্বাভাবিক। বড় অবিচার করেছি আমি। বুঝতে পারছি আমার যাওয়া দরকার।’ 

-‘কেন যাসনি এখনও?’ তিরস্কারে ফেটে পড়েন এষা। ‘খবর যখন পেয়েছিস, কেন এখনও যাসনি? কিসের অপেক্ষায় আছিস তুই?’

‘যেতাম। আমার অসুস্থতা, কাজের চাপ, সব মিলিয়ে খুব খারাপ অবস্থায় ছিলাম। এখানেই আসতে পারছিলামনা। তোমাদের, নিরুকে কতদিন দেখিনি বলো তো?’ যুক্তি সাজায় নিরূপ... ‘তাছাড়া, আমি ভেবেছিলাম...’

-‘কী? কী ভেবেছিলি তুই? শহুরে আদবকায়দায় মেয়েকে মানুষ করবি বলে মায়ের বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এলি, আর দ্যাখ, আমরাই এখন শহর ছেড়ে এসে এই শহরতলিতে পড়ে আছি। ভেবেছিলি তুই?’ এষা ফুঁসে ওঠেন।

-‘না, সেটা নিয়ে আমি কোনও কথা বলবনা, মা। যদিও আমাকে কাকিমা বারে বারে বলেছে তোমাকে বোঝানোর জন্য, যাতে তুমি ফিরে যাও ও বাড়িতে। কিন্তু আমি জানি, তুমি দুম করে ঝোঁকের মাথায় কিছু কোনওদিন করনি, আজো করবেনা। জানি আমি।’ 

-‘হ্যাঁ, প্রথম প্রথম অসুবিধে হলেও এখন মানিয়ে নিয়েছি আমরা সবাই। তবে এই বাড়িটা সারাতে হবে। সেটা...’ এষা চুপ করেন।

‘তুমি কি আমার থেকে একটা পয়সাও নেবে না মা?’ নিরূপ মায়ের হাত চেপে ধরে। 

‘কী মুস্কিল! আমি বুঝি তাই বলেছি? তুই এসে এখানে থাকলে, নিজের মেয়েকে নিজে মানুষ করলে, সব খরচ তুইই চালাবি। আমি পায়ের উপর পা তুলে বসে খাবো। তুই কাজের লোক, রাঁধুনি সব রেখে দিবি। ব্যস, আমার ছুটি!’ পরিবেশ হাল্কা করার চেষ্টা করেন এষা। 

-‘না, তোমার ছুটি নেই। আমি কীভাবে এসব পারবো বলো?’ নিরূপের কণ্ঠস্বরে শিশুর সারল্য ঝরে পড়ে।

-‘পারবি, সব পারবি। তার আগে তুই বউটাকে খুঁজে নিয়ে আয় এখানে। মা-মেয়ের দেখা হওয়া খুব দরকার। এভাবে আর পালিয়ে বেড়াস না। মেয়েটা বড় হচ্ছে। ও তোকে কোনওদিন ক্ষমা করবেনা রূহ্‌!’ 

-‘আমরা যাবো! আমরা দুজনে মিলে যাবো খুঁজতে।’ মিষ্টি রিনরিনে আওয়াজে চমকে ওঠেন এষা। নীরদা। মেয়েটা ঘুম ভেঙে এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের দরজায়।

‘নিরু, তুই?’ এষা বিস্ময়ে আর্তনাদ করে ওঠেন। এই ভয়টাই তিনি এতক্ষণ পাচ্ছিলেন। কে জানে তাদের কথা মেয়েটা সব শুনলেও কী কতটা বুঝেছে! 

-‘আয়, আয় মা!’ নিরূপ হাত বাড়ায়। নীরদা দৌড়ে এসে বাবার কোলে মুখ গোঁজে...‘আমি নিরুকে সব জানিয়ে রেখেছি, মা!’ মুচকি হাসে নিরূপ। 

-‘জানিয়েছিস? কী বলেছিস তুই?’ এষার বিস্ময় বাঁধ মানে না, ‘কবে? কীভাবে?’

-‘বাবা কয়েকমাস ধরে প্রতি শনিবার দুপুরে তোমরা ঘুমিয়ে পড়লে ফোন করে আমার সাথে কথা বলে, জানো ঠাম্মা?’ নীরদার ঠোঁটে দুষ্টু হাসিটা কি ছোট্ট রূহ্‌-এর মতো? এষার কাছে কিরকম অবিশ্বাস্য লাগে, ‘বাবা, তোমাকে কিছু জানাতে মানা করেছিল। বলেছিল, তুমি শুধু শুধু ভাবনা করবে, তাই...’ নীরদা ও নিরূপ দুজনেই মুচকি হাসে। 

-‘ওহহ, তাই বুঝি? এটা বাপ-বেটির ষড়যন্ত্র, তাই না?’ এষা হাসবেন না অভিমান করবেন ভেবে পান না। 

-‘বাবা বলেছে আমাকে সব। আমরা মেঘের দেশে আমার মাকে খুঁজতে যাবো। কিন্তু তার আগে বাবাকে জলের দেশ থেকে আমাকে নিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া বাবা যেখানে এখন রয়েছে, সেটা আগুনের দেশ। জল নেই একদম। যেটুকু আছে, বিষে ভরা। এবার ঐ বিষটুকু বের করতে না পারলে বাবার খুব কষ্ট হবে। ঐ কাজটা সেরে বাবা আগুনের দেশ থেকে একেবারে জলের দেশে চলে আসবে। তখন আমরা যাবো। তদ্দিনে আমার পরীক্ষাও হয়ে যাবে।’ কলকল করে ওঠে নীরদা। 

এষা আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেন না এই রূপকথা গল্পের। তবে মেয়ে-বাবার এই সখ্য দেখে খুব আনন্দ পান।

ভুলগুলো এভাবে জলের সাথে উঁচু থেকে নিচুতে বয়ে ধুয়ে গেলে, আর কিচ্ছু তিনি চান না। ভুলের চিহ্ন থাকেনা আর। জলের রেখাটা নদীর মতই শান্তিপ্রবাহিণী। 



(সমাপ্ত)

0 comments: