নাচনী---একটি ব্যক্তিগত অনুসন্ধান
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
( বলে রাখা ভালো, এটি উপসংহার নয়, ভূমিকা মাত্র। এই ধরণের একটি বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান সহজসাধ্য নয়, অতি অল্প সময়ে তাঁকে জানা এবং উপলব্ধি করা এবং তাই নিয়ে লেখালেখি বড় সহজ কাজ নয়। ব্যক্তিগত আগ্রহ এবং ভালবাসা থেকে বিষয়টি নিয়ে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি মাত্র। অনুসন্ধান চলছে, চলা উচিত।)
‘জয়মদনান্তক দক্ষ মখান্তক
জয় ত্রিপুরান্তক জয় শশীধারী।।
জয় বিষাণবাদক পিশাচ পালক
নীলকন্ঠ সুরহিতকারী।।‘
ঝুমুর সম্রাট ভবপ্রীতানন্দ ওঝার একটি পদের উল্লেখ করে এবং প্রথিতযশা ঝুমুর নৃত্যশিল্পী সিন্ধুবালা দেবীকে শ্রদ্ধা জানিয়েই এই রচনা শুরু করি। ঝুমুর গানের আসরও তো শুরু হয় দেব-দেবী বন্দনা দিয়েই, যেমন এই পদের মাধ্যমে ভবপ্রীতানন্দ মহেশ্বর বন্দনা করেছেন। আর ভবপ্রীতানন্দ বা সিন্ধুবালা দেবী যে ঝুমুর গানের দেব-দেবী ...একথা কেই বা না জানেন!
আদ্যোপান্ত পুরুলিয়া প্রেমী। পুরুলিয়ার আকাশ-বাতাস, রুক্ষ পাহাড়, কাঠফাটা রোদ, ফুটিফাটা মাঠ, ভাদু-টুসু-ঝুমুর সব ভাল লাগে। ভাল লাগে সহজ, সরল মানুষগুলিকে। আর ভাল লাগে তীক্ষ্ণ-মধুর ভাষাটিও। এ যেন একযোগে তীব্র টক, ঝাল আর মিষ্টির সমাহার। ‘পুরুল্যার বিটি ’---এই ভাললাগা থেকেই জানার আগ্রহ নাচনীদের সম্বন্ধেও।
একটু বড় হয়ে ওঠার সময় বাড়িতে রেডিও, রেকর্ডে গান শুনেছি অংশুমান রায়ের গলায়- ‘ সাঁঝে ফুটে ঝিঙ্গাফুল, সকালে মলিন গো’, কিংবা ‘ দাদা তোর পায়ে পড়ি রে’ ইত্যাদি গানগুলি। জেনেছি এই গানগুলিকে বলে ঝুমুর গান। গানের সুরের তালে ঝামরী ওঠে যে নৃত্য, তাই কি ঝুমুর নৃত্য, নাকি নাচের তালে তালে ঝামরী ওঠে যে সুর তাই ঝুমুর গান? অঙ্গাঙ্গীভাবে তারা এক অপরের সঙ্গে জড়িত।
মানভূমের বাসিন্দা হবার সুবাদে ঝুমুর গানের সঙ্গে পরিচয়টুকু ছিল, কিন্তু সেভাবে গান শোনা হয়ে ওঠেনি কখনও। কারণ অবশ্যই রক্ষণশীলতা। ওসব নিম্নলোকের পাড়ায়, নিম্নমানের গান আবার শুনতে যাওয়া কি! সুতরাং কাছে থেকে বসে সে গান শোনার সৌভাগ্য হয়নি কোনদিন। তবে, বাড়িতে কাজের সাহায্যকারিণী যে মহিলা আসতেন, আমরা যাকে বলতাম ‘সত্য দিদি’, তিনি আমাদের শুনিয়ে ছিলেন অনেক ঝুমুর গান। বাড়ির পিছনে রেললাইন আর তার ওপারে মাঠ পেরিয়ে সামান্য দূরের এক গ্রাম থেকে তিনি আসতেন আমাদের বাড়িতে কাজ করতে। তখন বুঝিনি, কিন্তু এখন মনে হয় তালিম পেলে সত্যদিদিও একজন ভাল ঝুমুর নর্তকী হতে পারতেন, হয়ত বা গায়িকাও। ভাদু-টুসু এসব গানও গাইতেন, তার কাছেই প্রথম শুনেছি। মানভূমের কেই বা না জানেন সে গান! সত্যদিদির কাছে শোনা একটি ঝুমুর গানের কয়েকটি কলি আমার এখনো মনে আছে----
‘আষাঢ় মাসে আষাঢ়ি
চৈত মাসে খেসারি
এত বড় পরব গেল বিফলে
আরে, তুরা খালি বাটি বাটি
হামকো না দিলি দুটি
হামি শুধু খালি মহুল সিঝা
তু দ্যাখ ধনী, হামি কেমন সিধা
আরে, আসছ্যে আষাঢ় শেরাবণ মাস
কিনব্য গরু, করব্য চাস
তখন খাবি প্যাট ভরে
তু, যাস না বাপের ঘরে......’
সত্যদিদি কোন কোনদিন কাজের শেষে হাতে সময় থাকলে জলের খালি ঘটি, ছোট ঘড়া কিংবা অন্য কিছু মাথায় চাপিয়ে নাচ দেখাতেন। আমরা সত্যদিদির ব্যালান্সের নাচ দেখতাম। কোনদিন পরনের কাপড়খানা গাছকোমর করে বেঁধে নিয়ে গামছাটি ওড়নার মত করে মাথার ওপর দিয়ে পিঠে ফেলে নিতেন। আমরা অবাক হয়ে তাঁর নাচ দেখতাম। এ সবই চলত তার কাজের পরে আমাদের মায়ের আড়ালে। সত্যদিদি বলতেন লাচনী লাচ, মানে নাচনী নাচ। আসলে, সত্যদিদি ঝুমুর গানের সমঝদার ছিলেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, যেভাবে ঝুমুর গান ও গানের শিল্পীরা বায়না নিয়ে ঘুরে ঘুরে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নাচা-গানা করতে যান, এই ছবিটি প্রথম পাই তারাশঙ্করের ‘আংটি চাটূয্যের ভাই’ ছোট গল্পে, যা পরে ‘পলাতক’ নামে ছায়াছবি হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ঝুমুর গানের নাচনীদের দুঃখময় যাপনের দিকটি ফুটে ওঠে ছোট গল্প ও ছায়াছবি উভয়ের মাধ্যমেই। তারাশঙ্কর ছাড়া জীবনরসে সম্পৃক্ত এই গ্রাম্য মানুষগুলির কথা আর কেই বা বলবেন... বসন, নসুবালাকেও তো তিনিই চিনিয়েছেন!
তারপরেও লেখা হয়েছে কিছু গল্প, দু/একটা উপন্যাস। কিছু গবেষণাও হয়েছে। সেটা কতটা নাচনীদের জীবনের দুঃখের বারমাস্যা জানার জন্য, আর কতটা তাদের বৈধ-অবৈধ প্রেমজ জীবনের আকর্ষণে, তা বলতে পারব না। সম্প্রতি একটি বই পড়েছি--রসিক, লেখক সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বলতে কি, এই বইটি পড়েই আবার নাচনী সম্বন্ধে জানার আগ্রহ দ্বিগুণ হল। এটিও একটী উপন্যাস অবশ্যই, কিন্তু বইটির মূল আকর্ষণ আমার কাছে তার ভাষা। আগাগোড়া পুরুলিয়ার কথ্য ভাষায় লেখা বইটি। আর আছে আশ্চর্য্য সেই সমাজের প্রতিচ্ছবি। অল্প একটু হলেও আছে নিশারাণী নামের আড়ালে মানভূমের বুলবুল ঝুমুর গানের প্রথিতযশা শিল্পী সিন্ধুবালা দেবীর কথা। বইটির সমালোচনা করা আমার কাজ নয়, কিন্তু ভাললাগা টুকু জানাতে দোষ কোথায়!
রচনার শুরুতেই ভবপ্রীতানন্দের পদটি ‘রসিক’ বইটি থেকেই নেওয়া।
কাকে বলে নাচনী, তারা কারা ?
সাধারণভাবে ঝাড়খন্ড যা ছিল একসময় মানভূম, সিংভূম এবং উড়িষ্যার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এক শ্রেণীর মহিলা গায়িকা ও নৃত্যশিল্পীদের দেখা যায় যারা পুরুষ ঢোলকবাদক বা নাগরের (প্রেমিক) সঙ্গে নৃত্য ও সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকেন। এই মহিলা শিল্পীকে বলা হয় নাচনী। পুরুষ সঙ্গীটি তার প্রেমিক বা নাগর এবং অবশ্যই নাচনীর নৃত্য-গীতের শিক্ষক, যিনি ‘রসিক’ নামে পরিচিত। সম্পর্কটি গুরু-শিষ্যার, সম্পর্কটি দুই প্রেমিক-প্রেমিকার, সম্পর্কটি মনিব-রক্ষিতারও। শুধু সম্পর্কটি নয় বিবাহিত দুই নরনারীর, যদিও প্রেমজ এবং দেহজ উভয় সম্পর্কই সেখানে বর্তমান। এ এক অদ্ভুত জীবনযাপন। একদিকে চরম নারীত্বের অপমান, আর একদিকে চরম আনন্দের উপাখ্যান।
ঝুমুর গানের উৎস নিয়ে আছে নানান কিংবদন্তী। কারো কারো মতে, ঝুমুর গানের সৃষ্টি মানভূমের বিখ্যাত পঞ্চকোট রাজবাড়িতে। কোন এক পঞ্চকোট রাজের মহিষী ছিলেন রানী বসুমতী। রানী বসুমতীর নৃত্য-গীতের শিক্ষক ছিলেন সুবল নামে এক যুবক। সুবল ছিলেন রানী বসুমতীর গোপন প্রেমিক। নৃত্য-গীত শিক্ষার আড়ালে তাদের প্রেমজীবনের আকাঙ্খা, ভালবাসাই প্রকাশিত হয় এই গানগুলির মাধ্যমে। এই কিংবদন্তীর আড়ালে কতটা সত্য লুকিয়ে আছে, আজ আর জানা সম্ভব নয়। তবে, যা রটে তা কিছু তো বটে ! মানভূমের ঝুমুর গানের পৃষ্ঠপোষকতা যে মানুভূমের পঞ্চকোট রাজপরিবার করেছেন, এও সত্য। মানভূমের রাজসভার সভা-গায়িকা ছিলেন বিখ্যাত ঝুমুর শিল্পী সিন্ধুবালা দেবী। এই সম্মান তো সকলের ভাগ্যে জোটে না!
ঝুমুর গান মূলতঃ প্রেমের গান। নর-নারীর প্রেমলীলা, রাধা-কৃষ্ণের প্রেম মূল উপজীব্য বিষয়। গানের সুর, তাল মনে আনন্দের জোয়ার আনে, দেহে হিল্লোল আসে, অজান্তেই চরণ চঞ্চল হয়ে নৃত্য ভঙ্গিমার শুরু। তাই ঝুমুর গানে গান ও নাচ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
নানান গবেষণা থেকে উঠে আসছে যে তথ্য, তাতে পাচ্ছি যে, গৌড়ীয় নৃত্যের একটি অঙ্গ বলা যায় এই ঝুমুর নৃত্যকে। দেবদাসী নৃত্যের একটি রূপও। বাংলায় যখন বৈষ্ণব যুগের সূচনা হল এবং বৈষ্ণবীয় ভাবের প্লাবন বয়ে গেল, তখন বাংলাতেও তার প্রকাশ ঘটল। মানভূম, সিংভূম, বর্ধমান, বীরভূম ইত্যাদি অঞ্চলে দেবদাসী নৃত্যের এই রূপ পরিবর্তিত হয়ে অন্য মাত্রা পেল। কোথাও কোথাও পৃষ্ঠপোষকতা করতে লাগলেন রাজপুরুষেরা, যেমন মানভূমের পঞ্চকোট রাজপরিবারের রাজা অযোধ্যাপ্রসাদ সিংহদেব একজন। পুরুলিয়া অঞ্চলে এই ঝুমুর নৃত্য-গীত বিশেষ সমাদর লাভ করল তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায়।
কারা হন নাচনী ?
বাস্তবে, গরীব-গুর্বো যারা অতি নিম্নসম্প্রদায়ের হাঁড়ি, ডোম, বাগদী পরিবারের অরক্ষণীয়া কন্যা, কিংবা হাত-ফিরতি মেয়ে অর্থাৎ যে মেয়ের স্বামী ঘরে নেয় না, যাদের পেটে ভাত নেই, মাথার উপরে ছাদ নেই কিংবা মা-বাপ মরা মেয়ে, তাদের কিনে আনা হয় সেইসব পরিবার থেকে। অন্ততঃ আগে তাই হত। এখন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং ঝুমুর গান শিল্পের দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখার ফলে অনেকেই আসছেন এই পেশায়। গরীব বাবা-মায়ের একটি মেয়ের বদলে পরিবারের লোকেরা পান হয়ত কিছুদিনের ভাত, কিংবা মাথার উপরে ছাদটুকু করে নিতে পারেন। আবার অনেক সময় চুরি করেও আনা হয় তাদের। তারপর চলে নৃত্যগীতের শিক্ষা। একসময় সে কিছুটা শিখলে তাকে নিয়ে বসে নাচ-গানের আসর। নাচ-গানের আকর্ষণ, দুবেলা দুমুঠো ভাত আর প্রেমের বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে মেয়েটিও। হাতে খড়ি হয় তার নাচনী হিসাবে। পাশাপাশি চলে রসিকের সঙ্গে দৈহিক ও মানসিক প্রেমের সম্পর্ক। অনেকে এই জীবনে মাতৃত্বের স্বাদও লাভ করেন। আবার করেনও না। কিন্তু রসিকের সংসারটি হয়ে ওঠে তার নিজের সংসার, রসিকের সন্তানদের কাছে সে নাচনী-মা। আবার এই জীবনে এভাবেই কেউ কেউ হয়ে ওঠেন একজন সত্যিকারের গায়িকা, নৃত্যশিল্পী, যা তাকে দেয় সম্মান, কিছুটা অর্থও। অনেক সময় ওস্তাদ রেখে তাঁরা নৃত্য-গীত শিক্ষাও করেন। এদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসেন সিন্ধুবালা দেবীর মত গায়িকা, যাঁকে রাজদরবারে নিয়ে যান খাতির করে, সভাশিল্পী করে। সকলেই হয়ত তা হতে পারেন না, কিন্তু কেউ কেউ আছেন, যারা যে মানুষটি তাকে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন যত্ন করে নৃত্য-গীত, তার প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তিতে আজীবন থেকে যান সেই এক রসিকের কাছে। অনেক নাচনী আবার চলে যান অন্য কারো সন্ধানে। এক আশ্চর্য্য নিরন্তর টানাপোড়েন চলে মানুষগুলির জীবনে।
কিন্তু নাচনীর সঙ্গে এত রকম সম্পর্ক থাকলেও রসিকের পরিবারের চোখে তার সমাদর নাচনী হিসাবেই। একজন রসিকের নাচনী থাকা যেন তার পক্ষে সম্মানের বিষয়। রসিক গৃহে তার সমাদর নাচনী হিসাবে থাকলেও সে রসিকের প্রেমিকাই, স্ত্রী নয়। রসিকের গৃহে সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটলেও, এমন কি চাষের কাজ করলেও পরিবারের হেঁশেলে তার কোন অধিকার থাকে না, নেই। হেঁশেলের অন্দরে তার যাতায়াত থাকে না, সেখানে সে ছোটজাতের মেয়ে। সেই অধিকার একমাত্র রসিকের কুলের বৌ বা ভাতের বৌ, যে কিনা তার বিবাহিতা স্ত্রী। নাচনীর নৃত্য-গীতের পরিবর্তে পাওয়া অর্থও সংসারে খরচ হয়, সেখানে কোন বাধা থাকে না, বাধা থাকে না কুলের বৌ বা ভাত কাপড়ের বৌটির স্বামীটিকে অধিকারের, কিন্তু বাধা আছে হেঁশেলে। এ বড় সম্মানের জায়গা, ছোটজাতের মেয়ে নাচনীর সেখানে কোন স্থান নেই।
কোন কোন সময় স্ত্রী এবং নাচনীর সম্পর্কটি হয় দু-বোনের মত। আবার সাপে-নেউলে যে হয় না এমন কথা তো বলাই যায় না, বিশেষতঃ স্বামীর সেই মহিলার প্রতি অনুরাগের কারণে। কিন্তু সম্পর্ক যেমনই হোক, বিবাহিতা স্ত্রীটি জানেন যে রসিকের সঙ্গে নাচনীর সম্পর্কটি হল কৃষ্ণের সঙ্গে রাধিকার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক না থাকলে একজন রসিকের সঙ্গীতজীবন বৃথা। স্বামী তার একজন বড় রসিক--এই ভাবনা স্ত্রীটিকেও ভাবিত করে বৈকি! নইলে নাচনীকে প্রথম দিন নিয়ে আসার পর স্বামীর ঘরে তুলে দেবার দায় বা নিয়মটুকু যে রসিকের স্ত্রীরই, সেখানে কোন জারিজুরি খাটে না। বড় অদ্ভুত নিয়ম এই সংসারের! একদিকে বুক ভাঙ্গে তো অন্যদিকে গড়ে।
আবার এক একজন রসিক নাচনী রাখার নামে মেয়েদের প্রতি বিশেষ আকর্ষণে এক পরিবারের সাতজন ভগিনীকে পরপর নাচনী রেখেছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে। প্রখ্যাত ঝুমুর শিল্পী হিসাবেও তিনি বিশেষভাবে নন্দিত ছিলেন। তাঁর নামটি উহ্যই থাক।
রসিকের সংসারে নাচনীর যত সম্মানই পান না কেন, মৃত্যুতে তার সিকিটুকুও পান না। অন্ততঃ আগে পেতেন না। একে তো নাচনীরা আসতেন বা এখনও আসেন প্রায় নিম্নসম্প্রদায় থেকে, অতিনিম্নবিত্ত পরিবার থেকে যেখানে মেয়েটিকে রসিকের হাতে তুলে দিতে পারলে কিছু অর্থের সংস্থান হত সেই পরিবারের। এমত অবস্থায় রসিকের পরিবারে পরম্পরা অনুযায়ী নাচনীর আগমন স্বাভাবিক হলেও রসিকের স্ত্রীর চোখে , বিশেষত তার সন্তানদের চোখে নাচনী বিশেষ সমাদর, ভালবাসা পান না। মায়ের সামনে অন্য এক মহিলার প্রতি পিতার অনুরাগ বা আকর্ষণ যাই হোক না কেন, সন্তানকে পীড়িত করে। তাই মৃত্যুতে নাচনীর প্রতি সম্মান দেখাতে পারেন না কিংবা সেই রাগ বশতঃই দেখান না। সবার উপরে আছে দারিদ্র্য। রসিকের জীবিতকালে নাচনীর মৃত্যু হলে রসিকের কিছুটা দায় থাকে, কিন্তু অবর্তমানে তা থাকে না। নাচনীর পরিবারগুলি অর্থনৈতিক ভাবে দুর্দশাগ্রস্ত, তার উপরে আছে সমাজের শুচি-অশুচির বিধান। একেবারে সমাজের নিম্নতম জাতির পরিবার থেকে আগত মহিলাদের শবানুগমন বা শবকে শ্মশানে নিয়ে যেতে রাজী হন না কেউই। গ্রামের সেই নিম্নতম পরিবারের কোন মানুষ এসে সেভাবেই ফেলে দিয়ে আসেন মৃত শব। কিন্তু এখন অবস্থার কিছুটা উন্নতি এবং সামান্য কিছু হলেও অর্থনৈতিক অবস্থানের বদল হওয়ার জন্য মৃত্যুর পর দাহ নিয়ে ততটা আগের মত প্রতিক্রিয়া দেখান না। যদিও, পারলৈকিক ক্রিয়া হিসাবে এই ফেলে দিয়ে আসার কোন বিধান কোনকালেই ছিল না। সামাজিক ও অর্থনৈতিক এবং ঘৃণা, বিদ্বেষ থেকেই নাচনীদের প্রতি এই অবিচার করা হয় বা হত।
এসবই জেনেছি এক ঝুমুর শিল্পীর কাছে, যিনি নিজে ঝুমুর গান করেন, ঝুমুর গানের উপরে একটি তথ্যচিত্রে ঝুমুর শিল্পী হিসেবে অভিনয়ও করেছেন। তাঁর প্রতি এবং পুরুলিয়ার এক বন্ধু যিনি সেই সুযোগ করে দিয়েছেন, উভয়ের প্রতি রইল কৃতজ্ঞতা।
অনেকসময় ঝুমুর গানে শোনা যায় তাদের জীবনে দুঃখের বারমাস্যা। ঝুমুর গান মূলতঃ প্রেমের গান হলেও সারাজীবন সুখ-দুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলি তাদের দৈনন্দিন দুঃখের কথা ব্যক্ত করেন গানের মাধ্যমে। আবারো ‘রসিক’ বইটি থেকে এমনই একটি গানের পদ দিয়ে জীবনরসে সম্পৃক্ত মানুষগুলির সুখ-দুঃখ, বেদনা, মান-অপমানকে বুঝে নিতে চেষ্টা করি। রচনাটি কোন রসিকের জানা নেই, প্রচলিত হতে পারে।
বৈশাখ মাসেতে নবীন বৎসর প্রচন্ড ঝড়ে উড়াইল ঘর
যায় যেন সব দলিয়া
জ্যৈষ্ঠ মাসেতে ঐ ভাঙ্গা ঘরেতে থাকি যেন আঁখি মুদিয়া।
আষাঢ় মাসে মেঘ ডাকে ঘন ঘন ভয়ে সদা হয় প্রাণ উচাটন
শ্রাবণেতে জল ঝরে অবিরল, ঘর পড়ি যায় ভাঙ্গিয়া।।
ভাদ্র আশ্বিন শরৎকাল গরিবের ঘরে নাই থাকে চাল
ক্ষুধানল উঠে জ্বলিয়া
পূজি অন্নপূর্ণা দেশ অন্ন শূন্যা, হাহাকার আছে ঘেরিয়া।
কার্তিক মাসেতে ক্ষেত্রে থাকে ধান মনে বুঝি দুখ হল অবসান
বাঁচিব এবার খাইয়া
অগ্রহায়ণ মাসেতে ঋণ ফাঁস এসে ধরে গলা যেন চাপিয়া ।।
পৌষ মাসে বহে উত্তরি বায় শীতে থর থর কাঁপে কায়
ক্ষণে ক্ষণে যায় টলিয়া
খাদ্যহীন হয়ে বস্ত্রহীন হয়ে জীয়ন্তে থাকি যে মরিয়া......
এ যেন ফুল্লরার বারমাস্যা। নিজ জীবনে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা সাধারণ মানুষগুলির দুঃখ প্রতিফলিত হয় গানের ভাষায়। আশ্চর্য্য যাপনের অন্তরালে থাকা মানুষগুলির কষ্টকর জীবনযাপন ও প্রেমময় জীবনের সঙ্গে সঙ্গীত ও নৃত্যের প্রতি এই ভালবাসা দেখে বিস্ময়বোধ ও শ্রদ্ধা একই সঙ্গে না জানিয়ে তো পারি না!
তাঁরা ভাল থাকুন, সঙ্গীতময় হোক তাঁদের জীবন।
1 comments: