3

প্রচ্ছদ নিবন্ধ : ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ 




শম্ভু মিত্র : 
আধুনিক বাংলা থিয়েটারের ‘একলা রাজা’ 
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় 



থিয়েটার দলগত শিল্প আমরা, জানি । তবুও ব্যক্তি তার অনন্য প্রতিভার গুনে থিয়েটারে যুগচিহ্ন হয়ে যান কখনো কখনো, তাও আমরা জানি । বাংলা থিয়েটারের আড়াইশ’ বছরের পরম্পরায় একটা দীর্ঘ সময়কে ‘গিরিশ যুগ’ এবং তার পরের সময়কালটিকে ‘শিশির যুগ’ বলে চিহ্নিত করি । শিশির যুগের শেষ লগ্নে এলেন আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের অনন্য প্রতিভা শম্ভু মিত্র । তবুও অসামান্য নাট্য ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র বাংলা থিয়েটারে যুগচিহ্ন হয়ে ওঠেন নি , হওয়ার কথাও ছিল না । বরং বলা যায় এবং সঠিক ভাবেই আমরা বলি গত শতকের চল্লিশের দশকটিকে গণনাট্যের যুগ । ব্যক্তি-অভিনেতা কেন্দ্রিক পেশাদারি  থিয়েটারের তখন ক্ষয়-কাল । ১৯৫০এ বহুরূপী প্রতিষ্ঠা উত্তর সময়কে নবনাট্যের যুগ বলেও অনেকেই চালাতে চেয়েছিলেন । তা ছিল নিতান্তই সাময়িক, তেমনই গণনাট্যের মোর্চাও ভেঙে যায় বটে পঞ্চাশের শুরুতেই । কিন্তু শিশির ভাদুড়ী  পরবর্তী সময়কালটি বাংলা থিয়েটারে ‘শম্ভুমিত্র যুগ’ হয়ে ওঠেনি । বরং শম্ভুমিত্রই তাঁর বহুরূপী প্রতিষ্ঠা এবং বহুরূপীর পথ ধরেই অনেক নাট্যগোষ্ঠীর আবির্ভাবের মধ্যদিয়ে যে নাট্য প্রবাহের সূচনা হয়েছিল, তাকে ‘নবনাট্য আন্দোলন’ অভিধা দিয়েছিলেন । 

ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা প্রথম বিভাগে পাশ করার পর ভর্তি হয়েছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে । ছেড়ে দিলেন । মনে করেছিলেন কলেজে পড়া সময়ের অপচয়, মনে হয়েছিল এর চেয়ে কম সময়ে অনেক বেশি পড়া যায় । অর্থাৎ ডিগ্রি অর্জন নয় জ্ঞানার্জন হয়ে উঠলো তাঁর অভীষ্ট । পিতা শরতকুমারকে একথা বলেছিলেন । বলেছিলেন ‘পড়াশোনা করে কিছু হয় না’ ।পিতা শরতকুমার তাঁর দুই পুত্রকেই বলেছিলেন ‘তোমাদের জীবন তোমাদের নিজেদের, পড়াশোনা করবে কি করবে না, কেমন করে বাঁচবে, সে তোমরা নিজেরা ঠিক কোর’ । 

শিশির কুমার ভাদুড়ীর নাট্যজীবন নিয়ে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাসের নামকরণ করেছিলেন ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ । বাংলা থিয়েটারের অসামান্য ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্রও তো তাইই, আর এক ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ । পেশাদারি থিয়েটারের অবক্ষয়ের শেষ পর্যায়ে শম্ভু মিত্র থিয়েটারে এসেছিলেন ১৯৩৯এ, শির কুমারের দলে যোগ দিলেন । শিশির কুমার ভাদুড়ীর থিয়েটার তাকে ছুঁতে পারলো না, চলে এলেন। চল্লিশের দশকে এলো শিল্প-সাহিত্য সৃজনের এক ক্রান্তিকাল, গণনাট্য সঙ্ঘের নেতৃত্বে রচিত হল থিয়েটারের উর্বর সৃজনভুমি, আকর্ষণ করলো শম্ভু মিত্রকে । পাঁচ বছর পরে, তিনি মনে করলেন শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টিতে কোন মতাদর্শের নিয়ন্ত্রণ শিল্পীর স্বাধীনতার পরিপন্থী । অতএব সরে গেলেন গণনাট্য আন্দোলনের প্রবল বিরোধিতা করে । চলচ্চিত্র পরিচালনা ও অভিনয় করেছিলেন কিন্তু সেখানেও থাকেননি । নিজের সন্তানতুল্য ‘বহুরূপী’ যা আগের আশি বছরের প্রবহমান পেশাদারী থিয়েয়েটারের ধ্যান ধারণাকে দুমড়ে মুচড়ে নবতর থিয়েটার ভাবনার দিকদর্শন ঘটিয়েছিল সেই বহুরূপীতেও থাকতে পারেন নি, সরে এসেছিলেন । এমনকি বহুরূপীতে ‘অনভিপ্রেত’ বলে চিহ্নিত হয়ে ছিলেন ।সহধর্মিনী তৃপ্তির সঙ্গেও দূরত্ব তৈরী হয়েছিল, একে অপরের কাছ থেকে সরে গিয়েছিলেন । জাতীয় নাট্যশালা চেয়েছিলেন, পান নি ।কিছু প্রতিষ্ঠিত নাট্য দলকে একত্রিত করে নিজেদের নাট্যশালার নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন – তাও পারেন নি । যে থিয়েটারের কল্পনা শম্ভু মিত্র করেছিলেন তা অধরাই থেকে গিয়েছিল । সেই অধরা স্বপ্ন বুকে নিয়ে, একরাশ অভিমান নিয়ে তিনমাস আগে লেখা আপন ইচ্ছাপত্র অনুযায়ী, অগণিত অনুরাগীদের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ না দিয়ে নীরবে চলে গিয়েছিলেন আধুনিক বাংলা থিয়েটারের ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ । 

কি চেয়েছিলেন শম্ভু মিত্র ? চেয়েছিলেন জাতীর জন্য একটা নাট্যশালা , অন্যধারার থিয়েটারের কাজের জন্য একটা নিজস্ব স্থান । শিশির কুমার ভাদুড়ীও চেয়েছিলেন জাতীয় নাট্যশালা – রাষ্ট্রের কাছে । শম্ভু মিত্র চাননি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে জাতীয় নাট্যশালা হোক । ‘সন্মার্গ সপার্যা’ গ্রন্থে তাঁর স্বপ্নের কথা লিখে রেখেছেন এইভাবে “বাংলার নাট্যকর্মীদের এখন অনেক কিছু করার বাকি আছে । তুচ্ছ দলাদলির উর্ধে উঠে তাকে বাংলা নাট্যের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে । এমন একটা নাট্যভঙ্গি আয়তেও করতে হবে যা একেবারে ভারতের, একেবারে বাঙালীর” । বিশ্বাস করেছিলেন “জাতি তার নিজের নৈতিক জোরে জাতীয় রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে নেবে”। বাঙালি শম্ভু মিত্রকে বিশ্বাস 
করে নি । কেন করেনি – সে অন্য প্রসঙ্গ । শুধু একটা নাট্যমঞ্চের নির্মাণই তো তাঁর অভিপ্রায় ছিলনা, সমস্ত রকম শিল্পের চর্চা হতে পারে এমন একটা সংস্কৃতি
 কেন্দ্র নির্মাণই ছিল তাঁর স্বপ্ন । আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৮, দশটা বছর অক্লান্ত প্রয়াস চালিয়েছিলেন, এই প্রয়াস ‘বহুরূপী’র সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আলগা হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে ওঠা সত্বেও । ১৯৬৮তে শম্ভু মিত্র প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাংলা নাটমঞ্চ প্রতিষ্ঠা সমিতি’ ।
বহুরূপী ছাড়াও সেই সময়ের অনেক প্রতিষ্ঠিত নাট্যদল – 
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নান্দীকার’, সবিতাব্রত দত্তর ‘রূপকার’, ‘গান্ধার’, বিভাষ চক্রবর্তী অশোক মুখোপাধ্যায়ের ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’ প্রদা, শ্যামানন্দ জালান’এর ‘অনামিকা’ । সম্মিলিত অভিনয়, নাট্যোৎসব ও চাঁদা তুলে প্রায় তিনলক্ষ টাকাও সংগৃহীত হয়েছিল । শম্ভু মিত্রর ‘জাতীয় নাট্যশালা’ নির্মাণের স্বপ্ন সার্থক হয় নি । সরকারের কাছ থেকে এক খন্ড জমি না পাওয়াই একমাত্র কারণ ছিল না । থিয়েটার ছাড়া আর কিছুই চাননি । রাষ্ট্রীয় সম্মান, বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ ‘পদ্মভূষণ’ কিংবা ‘ম্যাগসেসাই পুরস্কার’ তাঁর কাছে গুরুত্বহীন ছিল । তিনি চেয়েছিলেন ‘থিয়েটার’ । পাননি । পেয়েছেন একদা কাছের মানুষদের আছ থেকে অসন্মান, অবিশ্বাস । তাঁর ’থিয়েটারের স্বপ্ন’ চুরমার হয়ে যেতে দেখেছেন । যানা যাবেনা কোন অভিমানে মৃত্যুর তিনমাস আগে অন্তিম ইচ্ছাপত্রে লিখে গিয়েছিলেন তাঁর শবদেহ যেন সাধারণের জন্য প্রদর্শিত না হয় , কারো কাঁধে চেপে নয়, শবদেহ যেন মৃত্যুর অব্যবহিত পরে কোন আড়ম্বর বা প্রথা না মেনে সোজা শ্মশান  ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় । তাঁর অগনিত অনুরাগী বাংলা থিয়েটারের ‘একলা রাজা’র মৃত্যু সংবাদ জেনেছিল একদিন পরে সংবাদ পত্র পাঠ করে । 

কিন্তু অভিনেতা, নাট্যপরিচালক শম্ভু মিত্রকে অস্বীকার করবে কে ? কেই বা স্পর্শ করতে পারবে নাট্যসংলাপ প্রক্ষেপণ  কিংবা বাংলা কবিতা পাঠের উচ্চারণে শম্ভু মিত্রর উচ্চতা ? আমাদের কৈশোরের ১৯৫০এর দশক – বাঙালি মননের সে এক আশ্চর্য সৃজনকাল । ১৯৫১তে ‘চার অধ্যায়’এর পর ১৯৫৩তে শম্ভু মিত্র করলেন ‘রক্তকরবী’, ১৯৫৪তে মুক্তি পেল ‘পথের পাঁচালী’, ১৯৫৯এ মিনার্ভায় উৎপল দত্তর ‘অঙ্গার’, ১৯৬০এ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত নান্দীকারের ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র’ । শিল্প-সাহিত্যের সেই ঊর্বর মননভুমিতে রক্তকরবীর ‘রাজা’র অভিনয় দেখা কিংবা সামনে বসে ‘মধুবংশীর গলি’ আবৃত্তি শোনার সেদিনের উত্তেজনা ষাট বছর পরে কিভাবেই বা ভাগ করে নেবো ? শম্ভু মিত্রই আমাদের চেনালেন নাটকের রবীন্দ্রনাথকে । বাংলা মঞ্চে ব্রাত্য হয়ে থাকা রবীন্দ্র-নাট্য প্রযোজনার পথ উন্মোচন করলেন শম্ভু মিত্র । তারপর একে একে ‘চার অধ্যায়’, ‘ডাকঘর’, ‘মুক্তধারা’ । নিয়ে এলেন ইবসেনের ‘পুতুল খেলা’, সোফোক্লেশের ‘রাজা ওয়াদিপাঊস’, বিজয় তেন্ডুলকারের ‘চুপ আদালত চলছে’ ইত্যাদি । 

শম্ভু মিত্রর কথা বলতে গেলে তাঁর ‘বহুরূপী’আর বহুরূপীর প্রথম নাট্য প্রযোজনা ‘রক্ত করবী’র কথা আসবেই অবধারিত ভাবে । রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় রক্তকরবীর কোন মঞ্চায়ন হয়নি । তাঁর মৃত্যুর ১৩ বছর পরে শম্ভু মিত্র রক্তকরবী নিয়ে বাংলা মঞ্চে অভিনয়, দৃশ্য রচনা নাট্য আবহ রচনা ও প্রয়োগ ভাবনায় নবতর দিগন্তের উন্মোচন ঘটালেন আর উত্তরসুরিদের বলে গেলেন মঞ্চে রবীন্দ্রনাট্যও করা যায় । আজও কোন নাট্যজন ‘রক্তকরবীর’ কথা ভাবলে শম্ভু মিত্রর কথা তাঁর মনে আসবেই, এমনই কিংবদন্তী হয়ে আছে শম্ভু মিত্র আর ‘রক্তকরবী’ । ‘রক্তকরবী’ পড়ার সুবাদে আমরা জানি এতে সাধারণ মঞ্চ নাটকের মত কোন ঘণবদ্ধ নাট্য-কাহিনীক্রম নেই, নেই কোন নাট্য ও মঞ্চ নির্দেট, মঞ্চ নাটকে যেমন থাকে । সমস্ত নাটকটাত, যেন এক অমোঘ কবিত্বের আকর্ষণে বাঁধা । সেই রক্তকরবী শম্ভু মিত্রর অসামান্য নাট্যপ্রয়োগ গুনে বাংলা থিয়েটারের মাইল ফলক হয়ে গেল । তারই সমকালীন নাট্য ব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত বলেছেন “আসলে শম্ভুবাবুর সূক্ষ্ম রসবোধ ও প্রয়োগ কৌশলের অভিনবত্ব এমন এক নাটক সৃষ্টি করেছে যা বাংলা রঙ্গমঞ্চের প্রকৃত ঐতিহ্যকে ধরে, তাকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে । বিগত পঁচিশ বছরে বাংলা দেশে কোন নাটক এ করতে পেরেছে বলে আমার জানা নেই” । উৎপল দত্ত এ মন্তব্য করেছিলেন ১৯৫৬তে । 

তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ থিয়েটারের মানুষ ।জীবনের উপান্তে পৌছে এক সাক্ষাৎকারে, শম্ভু মিত্র বলেছিলেন ‘আমি যা কিছু করেছি, যা কিছু ভেবেছি, 
যা কিছু পড়েছি, সবই থিয়েটারের জন্যে’ । চলচ্চিত্রের অভিনয় তাঁকে টানেনি
মোটেই । যদিও ‘বিয়াল্লিশ’,’পথিক’ ‘শুভ বিবাহ’, ‘মাণিক’, ‘বঊ ঠাকুরানীর হাট’, ‘কাঞ্চন রঙ্গ’ এই ছটি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন । রাজ কাপুর তাকে বলে ছিলেন’আমি পরিচালনা করবো, আমার ছবিতে আপনি অভিনয় করুন’ শম্ভু মিত্র বলেছিলেন ‘না আপনি অভিনয় করুন, আমি পরিচালনা করবো । তাই হয়েছিল, নির্মিত হয়েছিল দারুণ সফল সিনেমা ‘জাগতে রহো’ । 

অথচ, সেই শম্ভু মিত্র থিয়েটার থেকেই সরে এলেন । ১৯৬৭র পর থেকেই তাঁর সঙ্গে বহুরূপীর সম্পর্ক আলগা হয়ে পড়ে । ১৯৬৭তে বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’এর পর বহু্রূপীতে তাঁর পরিচালনায় কোন সাড়া জাগান প্রযোজনাই হয় নি । বিশিষ্ট নাট্য গবেষক ও প্রাবন্ধিক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি একটি নিবন্ধে মন্তব্য করেছেন “শম্ভুবাবু প্রবল অভিমানে নিজেকে ‘আক্রান্ত’ বিবেচনা করে নিজেকে থিয়েটার থেকে ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকলেন । ক্রমে তাঁর নাট্যদলও পালটে গেল, ... শম্ভুবাবুর থিয়েটার পনেরো বছরের মধ্যেই শেষ কার্যত শেষ” । বহুরুপীর পরিচালক হিসাবেও নিজেকে সরিয়ে নিলেন এই সময় 
থেকে, যদিও ১৯৭১ পর্যন্ত কাগজে-কলমে তিনিই ছিলেন বহুরূপীর নাট্য পরিচালক । ১৯৭১এ তাঁর নির্দেশনায় অভিনীত হয়য় ‘চুপ আদালত চলছে’ ! ১৯৬৮র পরের প্রায় দশ বছর শম্ভু মিত্র প্রাণপাত করেছিলেন ‘জাতীয় রঙ্গমঞ্চ’ স্থাপনের লক্ষ্যে । নাটমঞ্চ প্রতিষ্ঠা সমিতির ব্যানারে অভিনয় করেছেন ‘রাজা ওয়াদিপাউস’ ‘দশ চক্র’, ‘গ্যালিলিওর জীবন’ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘মুদ্রা রাক্ষস’ ।কিন্তু বহুরূপীর সঙ্গে তাঁর প্রতিষ্ঠাতার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি । ১৯৭৮এর জুন মাসে বহুরূপীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয় । বলা ভালো, ‘বহুরূপী’ই তাঁর প্রতিষ্ঠাতাকে বিসর্জন দিয়েছিল । দলটির কার্যকরী সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শম্ভু মিত্র বহুরূপীতে ‘অনভিপ্রেত’, তাঁকে আর ফিরিয়ে আনার প্রয়াস করা হবে না (তথ্য সূত্র- শম্ভু মিত্রঃবিচিত্র জীবন পরিক্রমা / শাঁওলী মিত্র) ১৯৭৯র সেপ্টেম্বরে বহুরূপী ‘মৃচ্ছকটিক’ প্রযোজনা করে । শম্ভু মিত্র তখন বহুরূপীর নতুন প্রজন্মের কাছে ‘অনভিপ্রেত’ । তাঁর পরম প্রিয় শিষ্য কুমার রায় গোপনে একটা টিকিট কেটে তখন প্রায় দৃষ্টি শক্তিহীন শম্ভু মিত্রকে প্রেক্ষাগৃহে বসিয়ে দিয়েছিলেন । সংগঠন তাঁকে আমন্ত্রণ জানায় নি (তথ্যসূত্রঃঐ) । তথ্যটি উল্লেখ করা এই জন্য যে, আমরা জানতে পারি কি অনাদর, অসম্মান অপেক্ষা করছিল এই প্রবল আত্মমর্যাদা সম্পন্ন নাট্যপুরুষটির প্রতি নিজ উত্তরসুরীদের কাছ থেকে ! 

নিজেকে আক্রান্ত মনে করা অতয়েব অমূলক ছিল না । হয়তো, সঙ্গত অভিমানেই মৃত্যুর তিনমাস আগে ‘অন্তিম ইচ্ছাপত্রে’ লিখে গিয়েছিলেন “......মৃত্যুর পর যত দ্রুত সম্ভব যেন আমাকে সোজা পোড়ানোর যায়গায় নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয় । দেহটা যেন রবীন্দ্রসদন ইত্যাদির মত কোন সাধারণ স্থানে প্রদর্শিত না হয়, পথে ঘোরানোও যেন নয়া না হয় .... কারোর কাঁধে চ’ড়ে যেতে চাই না । কোন গাড়ীতে নিয়ে যাওয়াই ভালো । ... আমি সামান্য মানুষ, জীবনে অনেক জিনিস এড়িয়ে চলেছি । তাই মরবার পরেও আমার দেহটা যেন তেমনি নীরবে, একটু ভদ্রতার সঙ্গে, সামান্য বেশে, বেশ একটু নির্লিপ্তিতে  পুড়ে যেতে পারে ......” । 

১৮ই মে রাত্রি ২টা ১৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন আর সেই রাত্রেই কন্যা শাঁওলী আর গুটিকয় নিকট জনের উপস্থিতিতে নীরবে অগণিত অনুরাগী ও গুনমুগ্ধদের শেষ শ্রদ্ধার সুযোগ না দিয়ে স্মশানের বৈদ্যুতিক চুল্লিতে ঢুকে গেলেন শম্ভু মিত্র – আধুনিক বাংলা থিয়েটারের ‘একলা রাজা’ ।

3 comments:

  1. অনন্য সম্পদ। শেয়ার করলাম।

    ReplyDelete
  2. Ei tottho ek oishorjo.bhalo laglo.

    ReplyDelete
  3. অনেক কিছু জানলাম ।

    ReplyDelete