প্রবন্ধ : সৌম্য ব্যানার্জী
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
মাতৃপুরাণ
সৌম্য ব্যানার্জী
পুরাণ কি সম্পূর্ণই কবিকল্পনা? নাকি তার গভীরে প্রাগৈতিহাসিক সত্যের ইঙ্গিত থাকে? প্রশ্নটা পুরাতত্ববিদদের মনে বার বার চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। নির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যায় নি। পাওয়া বোধহয় সম্ভবও নয়। কারণ, ওই ‘প্রাগৈতিহাসিক’ শব্দটা... শুনতে অতি প্রাচীন মনে হলেও, মাত্র আড়াই হাজার বছরের কিছু আগের সময় পর্যন্ত সবকিছুকেই প্রাক-ইতিহাস, অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ইতিহাস গ্রন্থন আরম্ভের পূর্বেকার ঘটনা বলে মানতে হবে। অন্তত ভারতীয় ভূখণ্ডে তাই-ই। কারণ এখানে নির্দিষ্টরূপে বাস্তবধর্মী ইতিহাস রচনা শুরু হয় গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক, বা তার কিছু পরবর্তী কাল থেকে। তার পূর্ববর্তী সব সংকলন পুরাণপর্যায়ভুক্ত। আর পুরাণ মানেই কবিকল্পনায় ভাস্বর দৈবমহিমামণ্ডিত অলৌকিক কাহিনীসমূহ। তার মধ্যে কিছু প্রাচীন সত্যের ইঙ্গিত থাকলেও, অধিকাংশটাই মনে হয় যেন প্রজন্মক্রমে গড়ে ওঠা লোকপ্রবাদ। সমস্যাটা সেখানেই।
সমস্যা, অর্থাৎ আপাতকাল্পনিক এই সব কাহিনীর অভ্যন্তরে সুপ্ত সত্য সন্ধান করার চেষ্টা। অতি প্রাচীন, অকথিত ইতিহাস নির্ণয় করার জন্য সাধারণত অন্যান্য যে সব বিদ্যাগুলির সাহায্য নেওয়া হয়, অর্থাৎ ভূতত্ব, নৃতত্ব, প্রত্নতত্ব, সমাজবিজ্ঞান বা জ্যোতিষশাস্ত্রের মতন বিষয়গুলি সবই প্রমাণসাপেক্ষ, যুক্তিনির্ভর। শুধু পুরাণের বেলায় তার ব্যতিক্রম হবে কেন? তাতে ইতিহাসে বেনোজল ঢুকে পড়ার সম্ভবনা বেড়ে যায় না কি? কিন্তু মুশকিল হলো, কয়েকটা ইঙ্গিত এতই স্পষ্ট, যে তার ভিতর প্রচ্ছ্বন্ন সম্ভাব্য সত্যের সন্ধান করার লোভ পুরাণপ্রমিকের পক্ষে সামলানো দুষ্কর। আর, না-ই বা হলো সে সর্বৈব সত্য ইতিহাস! তেমনটা দাবি না করলেই আর সমস্যা থাকে না। ইতিহাস কল্পনাশ্রিত হতে পারে না; হওয়া কাম্যও নয়। কিন্তু কল্পনার তো ইতিহাসভিত্তিক হতে কোনও বাধা নেই! ভূতত্ব, নৃতত্ব, প্রত্নতত্ব, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদির সংমিশ্রণ ও সংশ্লেষে যে শুধুমাত্র পণ্ডিতগ্রাহ্য বিশুদ্ধ, বিশুষ্ক ইতিহাসের প্রতিষ্ঠা, পৌরাণিক কাহিনীর উপাদান মিশিয়ে তাকে সজীব, সরস করে তুলতে বাধা কোথায়?
সমাজবিজ্ঞান বলে, প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার অধিষ্ঠাতারা ছিলেন মাতৃতান্ত্রিক। কেন ছিলেন, তারও একটা নির্দিষ্ট কারণ সমাজবিজ্ঞান দেয়। মধ্য এশিয়ার রুক্ষ, শুষ্ক পার্বত্য অঞ্চলে ভ্রাম্যমান যাযাবর সেই আদিম জনগোষ্ঠী একসময় হিমালয়-হিন্দুকুশের দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর অতিক্রম করে এসে উপস্থিত হয় সিন্ধুনদের শ্যামল অববাহিকায়। উর্বর তৃণভূমির অপর্যাপ্ত পরিসর পেয়ে মূলত পশুপালক সেই জাতি এবং তাদের প্রাণীসম্পদ সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে ছোট ছোট ‘কওম’ বা গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে, এবং অচিরেই শুরু করে কৃষিকর্ম। এই সামাজিক বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সমাজচেতনাতেও সংযোজিত হয় একটি নতুন মাত্রা। সে মাত্রা ভূসম্পত্তির অধিকারবোধের, যে বোধ উপযুক্ত উত্তরাধিকারীর হাতে সম্পত্তি সমর্পণ না করা পর্যন্ত তৃপ্ত হয় না। উত্তরাধিকারী, অর্থাৎ আপন সন্ততি। সেই আদিম, মুক্ত মানবসমাজে পিতৃত্ব নির্ধারণ ছিলো দুরূহ কাজ। তাই, খুব স্বাভাবিক ভাবেই, তাদের দ্বিতীয় বিকল্পটি বেছে নিতে হয়েছিলো। অর্থাৎ, মাতৃতন্ত্র। একজন প্রধানা রমনীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতো এক একটি গোষ্ঠী, যার অধিকাংশ সদস্যই সেই নারীর সন্তান সন্ততি।
ভূসম্পত্তি বলতে কৃষি ও পশুচারণের ভূমি এবং পালিত পশুগুলি। সেই পশুগুলির মধ্যে ছিলো গরু, ভেড়া, ছাগল, ইত্যাদি গবাদি প্রাণী এবং চারণকালে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বৃহদাকার নেকড়ে-জাতীয় কুকুর। এই শ্বাপদটি যে কোন বিস্মৃত কালে মানুষের সঙ্গী হয়ে উঠেছিলো, তা আজ অনির্ণেয়। সম্ভবত সেই প্রাচীন সভ্যতারও বহু, বহু বছর পূর্বে বন্য, অসভ্য মানুষের সঙ্গে শিকারের
প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পড়তে কোনও এক জান্তব প্রবৃত্তিতে তারা বুঝেছিলো যে সংঘাতের পরিবর্তে এই বুদ্ধিমান দ্বিপদ প্রাণীটির সংসর্গই তাদের অস্তিত্বের পক্ষে নিরাপদতর। মানুষও বুঝেছিলো শিকারসন্ধান এবং তাড়নার জন্য এই প্রাণীটিকে প্রতিপক্ষের বদলে সহায় হিসেবে পেলেই তার সুবিধা। সম্ভবত সেই থেকেই দুই প্রাণীর সহাবস্থান শুরু।
প্রত্নতাত্বিক ইতিহাস বলে, ভারতীয় ভূখণ্ডে অশ্ব নামক প্রাণীটির প্রবেশ ছয় থেকে সাত হাজার বছর আগে। ধরে নেওয়া যেতে পারে যে আমাদের সেই মাতৃতান্ত্রিক আদিম জাতির সভ্যতা পত্তনের আদি যুগে তাদের সঙ্গে ঘোড়ার সংস্রব ছিলো না। বড় ধরনের যুদ্ধ-বিগ্রহ না থাকার কারণে তার অভাবও বিশেষ অনুভূত হতো না। সমস্যাটা আরম্ভ হলো যখন তাদের উৎপন্ন শস্য আর পশুসম্পদের লোভে হানা দিতে শুরু করলো এক বর্বর জাতি। পুরাণ এদের অসুর নামে চিহ্নিত করেছে। পূর্বভারতের অরণ্যসঙ্কুল অঞ্চলগুলিতে অসুর নামক যে প্রাচীন জনজাতিটির সন্ধান আজও পাওয়া যায়, এরা সম্ভবত তাদেরই পূর্বজ।
নৃতত্ব বলে, কৃষিবিদ্যা এরা তখনও শেখেনি। শিখেছিলো শুধু পশুপালন। অধুনা
ঝাড়খণ্ড এবং ছত্তিসগড়ে ছড়িয়ে থাকা স্বল্পসংখ্যক অসুর নামক আদিবাসী গোষ্ঠী এখনও পেশায় প্রধাণত মহিষপালক। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে যে সভ্যতার সেই উষাকালে সেই আদিম জাতি ভারতবর্ষের আর এক আদি বাসিন্দা বন্য মহিষের সঙ্গে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক স্থাপন করেছিলো। দুধ, মাংসের সহজলভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে পশুগুলিকে বাহন রূপেও ব্যবহার করতো অসুররা। সেই বাহনে সওয়ার হয়ে হানা দিত শস্য, গবাদিপশু এবং নারী লুন্ঠনের অভিপ্রায়ে। ফলত সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠতো। সেই সংঘর্ষে দলে ভারি, দুর্দান্ত সেই অসুর যোদ্ধাদের সঙ্গে পেরে ওঠা ছোট ছোট মাতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠীগুলির পক্ষে হয়ে উঠতো কার্যত অসম্ভব। এবং ক্রমবর্ধমান সেই সংঘাতের ফলে একসময়ে সেই প্রাচীন কৃষিজীবী পশুপালক জাতির অস্তিত্বসংকট দেখা দিয়েছিলো।
এই পর্যন্ত মেনে নিতে ইতিহাসের আপত্তি হওয়ার কথা নয়। এর পর থেকে পুরাণের আশ্রয় নিতে হবে। তাতে কিছু দেব-দেবীর মহিমা খণ্ডিত হতে পারে, কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাসে আঘাত লাগতে পারে। কিন্তু এ রচনার উদ্দেশ্যই পুরাণের অতিলৌকিক কাহিনীর অভ্যন্তরে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের লৌকিক ইতিহাসের ইঙ্গিত সন্ধান করা। তাই ধরে নেওয়া যাক যে সেই দুর্ধর্ষ মহিষবাহন অসুরবাহিনীর এক প্রবল পরাক্রমশালী নেতা ছিলেন। পুরাণ তাঁকেই মহিষাসুর নামে অভিহিত করেছে। তাঁর আগ্রাসন ও রণনৈপূণ্যের সঙ্গে যুঝে উঠতে পারছিলো না ছোট গোষ্ঠীগুলি। সৈন্যসংখ্যায়, বাহনের কার্যকারিতায় এবং আগ্রাসনে অসুররা বারবার তাদের প্রতিপক্ষকে ছাপিয়ে যাচ্ছিলো। মহিষাসুরের ব্যক্তিগত রণদক্ষতা এবং নেতৃত্বগুণ তাদের প্রায় অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিলো। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর বিশালকায়, ভীষণদর্শন মহিষটিকে দেখেই বিপক্ষ আতঙ্কে কম্পমান হতো।
সিন্ধুতীরবর্তী সেই প্রাচীন সভ্যতার অধিষ্ঠাতারা প্রমাদ গুনলেন। প্রতিদিন তাঁদের অস্তিত্ব বিপন্নতর হয়ে উঠছে। একক গোষ্ঠীর পক্ষে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা অসম্ভব। তাই তাঁরা, অর্থাৎ যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে মহিষাসুর তাঁর দলবল নিয়ে দৌরাত্ম চালাচ্ছিলেন, সেই অঞ্চলে বসবাসকারী গোষ্ঠীগুলির নেত্রীরা এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার সম্ভাব্য উপায়ের সন্ধানে একত্রিত হলেন। এঁরা একেকজন ছিলেন মহীয়সী বীরাঙ্গনা। প্রতিপালন ও প্রতিরক্ষায় সমান দক্ষা, মাতৃস্বরূপিনী, শক্তিস্বরূপিনী। এঁরা সকলে মিলে গঠন করলেন এক যৌথবাহিনী। নারী, পুরুষ উভয় সম্বলিত এক বিশাল বাহিনী। সঙ্গে তাঁদের সেই আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু সারমেয়দল। আকারে বা শক্তিতে মহিষগুলির সমতুল্য না হলেও তাদের দাঁত, নখ, ক্ষিপ্রতা, এবং সর্বোপরি তাদের প্রকৃতিগত শ্বাপদ হিংস্রতাও যুদ্ধক্ষেত্রে তুচ্ছ নয়।
বাহিনী গঠনের পর এলো নেত্রী নির্বাচনের পালা। যোত্যতমা নেত্রী নির্বাচিতা হলেন। প্রভূতা শক্তিশালিনী, সর্বাধিক বুদ্ধিমতী ও রণনিপুণা সেই নারীশ্রেষ্ঠার নাম দুর্গা। তাঁর গোষ্ঠীটির জনসংখ্যাও সর্বাধিক এবং তারা অন্যান্য গোষ্ঠীগুলির তুলনায় বেশি সংগঠিত। মহিষাসুরের দল এঁদের অধিকৃত অঞ্চলেও হানা দিয়েছিলো, কিন্তু বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারে নি। বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি সত্বেও দুর্গার বাহিনী তাদের মোটামুটি প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছিলো। তাঁর সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী কুকুরটিও অন্যান্য কুকুরগুলির তুলনায় আকারে বৃহত্তর, ক্ষিপ্রতর ও বেশি বুদ্ধিমান। যুদ্ধক্ষেত্রে তার বিক্রম বিপক্ষের মহিষগুলিকে রীতিমতন ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো। তাই দুর্গার নেতৃত্বাধিকার এমনিতেই সবার চেয়ে বেশি ছিলো। প্রতিটি গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব অস্ত্রসম্ভার তাঁর সম্মুখে উজাড় করে দিলো। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক জন যোদ্ধা তাঁর সামনে শপথ নিলেন মরণপণ লড়াইয়ের। তিনিই তাদের শেষ ভরসা, তাদের অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রামে অগ্রবর্তিনী নেত্রী, দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা।
পুরাণের অবশিষ্ট আখ্যায়িকা সবার জানা। দুর্গা তাঁর সিংহবিক্রম সারমেয়টির
সাহায্যে সম্মুখসমরে সবাহন মহিষাসুরকে পরাজিত ও হত্যা করেন। তাঁর বাহিনী মহিষাসুরের দলকে পর্যুদস্ত করে। তাঁর সেই অতুল কীর্তি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে, জনমানসে তাঁকে উন্নীত করে দেবীর পর্যায়ে। পুরাতত্ববিদরা এই জাতীয় ঘটনাকে মানুষের দিব্যারোহন আখ্যা দিয়ে থাকেন। মানুষের মহান কীর্তি তাকে জনমানসে অমর করে তোলে, তার উপর দেবত্ব আরোপ করে তাকে সমাজস্মৃতিতে যুগ যুগ ধরে ভাস্বর করে রাখে। ইন্দ্র, রামচন্দ্র, কৃষ্ণ, এঁরা সকলে সম্ভবত বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত হওয়া এই রকম একেকজন অমিতকীর্তি পুরুষ, যাঁরা কালক্রমে লোকচর্চায় দেবত্বলাভ করে আমাদের সংস্কৃতিতে অমর হয়ে গেছেন। দুর্গা এঁদেরও বহু পূর্বের, বিস্মৃতপ্রায় এক ধুলিধূসর সময়ের মানবী, যাঁর বুদ্ধিবল ও বাহুবলে রক্ষা পেয়েছিলো সেই অতি প্রাচীন কৃষিজীবী সংস্কৃতি। সময়ের একটা স্থূল হিসেব করলে, এ ঘটনা আজ থেকে কমপক্ষেও সাড়ে সাত-আট হাজার বছর পূর্বের। সে মহাসংগ্রাম জয় সেই প্রাচীন জাতিকে যে প্রতিষ্ঠা, যে সুরক্ষা দিয়েছিলো, তার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সিন্ধুসভ্যতা, এবং কালক্রমে আর্যসভ্যতা। সেই মহান সভ্যতার উত্তরাধিকারী আমরা আজও সেই মহীয়সী রমণীকে স্মরণ করি, সশ্রদ্ধচিত্তে তাঁর আরাধনা করি।
এ কাহিনীর একটা উপসংহার আছে। কারণ, সব কিছুর শেষে একটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়বদ্ধতা থেকে যায়। প্রশ্নটা এই, যে সুদূর সিন্ধুপারের প্রাগৈতিহাসিক সেই ঘটনা বাঙালির স্মৃতিতে এত উজ্জ্বল কেন? কেন বাঙালি যুগ যুগ ধরে দুর্গাপূজার রীতি এত নিষ্ঠাভরে পালন করে আসছে? ঘটনার পটভূমি যেখানে, সেই উত্তর-পশ্চিম ভারতে তো এ আচার এত যত্নসহকারে পালিত হয় না! এর উত্তর দেওয়ার জন্য আবার ইতিহাসের শরণাপন্ন হতে হবে। সে ইতিহাস এ ঘটনার বহু পরবর্তী কালের, ভারতীয় ভূখণ্ডে আর্য অনুপ্রবেশের পরের ইতিহাস। সে ইতিহাস বলে, আর্যসভ্যতার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সিন্ধুসভ্যতার ধারকরা ছড়িয়ে পড়েছিলেন ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্বাংশে। যাঁরা উত্তরভারতে থেকে গিয়েছিলেন, তাঁদের সংস্কৃতি মিশে গিয়েছিলো আর্যসংস্কৃতির সঙ্গে। বিবাহাদি সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো পিতৃতন্ত্র। ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলি একত্রিত হয়ে স্থাপিত হয়েছিলো বড় বড় রাজ্য। আর্যদের পৌরুষ ও বীরত্বের কাহিনীগুলি ধীরে ধীরে পাল্টে দিচ্ছিলো মানুষের সমাজচেতনা। একই পরিস্থিতি হচ্ছিলো দক্ষিণ ভারতে। যাঁরা বিন্ধ্যপর্বত অতিক্রম করে দাক্ষিণাত্যে উপনীত হচ্ছিলেন, সেখানকার অধিবাসীদের সুপ্রাচীন সংস্কৃতি ও লোকাচারের সংস্পর্শে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিলো তাঁদের সমাজচেতনা, যে সংশ্লেষের ফল দ্রাবিড় সভ্যতা। কিন্তু সে আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। মোট কথা, সেই প্রাচীণ মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার স্মৃতি আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে আসছিলো ভারতীয় ভূখণ্ডের মানুষের মন থেকে...
বিলুপ্ত হয়নি শুধু তাঁদের চেতনা থেকে, যাঁরা গঙ্গা অতিক্রম করে এদিকে, অর্থাৎ পূর্বভারতে চলে এসেছিলেন। ভৌগোলিক দূরত্ব এবং দূরধিগম্যতার কারণে তাঁদের উপর আর্য সংস্কৃতি সেভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। পূর্বভারতের সমাজতাত্বিক ইতিহাস বলে, আর্য ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও রাজন্যপ্রথা এখানে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বহু পরবর্তী কালে। বঙ্গদেশ বহুকাল অবধি থেকে গিয়েছিলো কৌমতন্ত্রের পীঠস্থান, অর্থাৎ ছোট ছোট কওম বা গোষ্ঠীতে বিভক্ত এক প্রদেশ। এর প্রমাণ বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত থেকে শুরু করে কালিদাসের রঘুবংশ কাব্যে অবধি আছে।
বাঙালির নৃতাত্বিক বিশ্লেষণ বলে, সেই প্রাচীন আর্যপূর্ব মাতৃতান্ত্রিক জাতির রক্ত বইছে আমাদের অধিকাংশের ধমনীতে। সম্ভবত সেই কারণেই বঙ্গদেশে আজও দেব, অর্থাৎ পুরুষ দেবতাদের চাইতে দেবীদের পূজার প্রচলন ব্যাপকতর। শীতলা, মনসা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, জগদ্ধাত্রী, কালী, ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে তাই দেবী দনুজদলনী দুর্গা আজও আমাদের ভগবদচেতনায় ভাস্বর, বঙ্গসংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িতা এবং সেই সংস্কৃতির হাত ধরে আজ প্রায় সারা বিশ্বে পূজিতা।
bhalo laglo
ReplyDelete