0

ছোটগল্প : সুমন্ত চ্যাটার্জী

Posted in


ছোটগল্প 



মহিষাসুর কমপ্লেক্স 
সুমন্ত চ্যাটার্জী 



মহালয়া থেকে ভাসান অবধি বাড়ির বাইরে বেরোতে পারেনা অশোক। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে সেগুলোকে চাদর-গামছা-কাঁথা দিয়ে মুড়ে রাখে, যাতে মানুষের কোলাহল বা বাজি-পটকার আওয়াজ ঘরে না আসে। এই অস্থির সময়টাতে ও লেখালেখি করে, ছবি আঁকে, চুপচাপ অন্ধকার ঘরে শুয়ে একমনে চিন্তা করে। 


সদর আদালতের মুহুরী অশোক বিশ্বাসের জীবনটা এরকম ছিলনা। ২০০২ সালে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে স্ত্রী জয়া ওর সাথে ঝগড়া করে বাপের বাড়ি যাওয়ার পথে বাস দুর্ঘটনায় মারা যায়, একমাত্র ছেলে অবীনকেও বাঁচানো যায়নি। তখন থেকেই একাকীত্ব গ্রাস করে ওকে। পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে অশোক। আদালতে অনিয়মিত হয়ে যাওয়ার কারণে ওর উকিল অন্য মুহুরী নিয়োগ করে। সব গোলমাল হয়ে যায়, তছনছ হয়ে যায় অশোকের জীবন। 


একাকীত্ব আর একঘেঁয়েমি থেকে মুক্তি বলতে গেলে বিকেলে একবার গঙ্গার ধার দিয়ে ঘুরে আসা। দুর্গাপুজোর সময় সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। জয়া আর অবীন মারা যাওয়ার বছরেই শেষবার পুজোয় বেরিয়েছিল অশোক। হাজারো মানুষের ভিড়ে একলা ঘুরে বেড়ানো, যেদিকে দু’চোখ গেছিল, সপ্তমীর আলো-রাতে, পাগলের মত। অষ্টমীর রাতে ও সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেটাতেও সাহস লাগে - প্রচন্ড দুঃসাহস, কিংবা চূড়ান্ত কাপুরুষতা। কাজেই ... নবমীর বিকেলে মন্ডপের ভেতর এসে দাঁড়ানো চুপচাপ, প্রতিমার সামনে। 


সেদিনই প্রথম মাথায় নানা চিন্তা ঘুরপাক খেতে খেতে কিছু পাগলাটে, শিশুসুলভ ভাবনা এসে জড়ো হয়। যেমন, “মা দুর্গার দশটা হাত কেন? একজন দশহাতওয়ালা মহিলার সাথে একজন দু’হাতওয়ালা পুরুষ যুদ্ধে তো হেরে যাবেই, এ তো অসম যুদ্ধ! সিংহ তো মোষকে মেরে ফেলবেই! এতে বীরত্বের কি আছে! তবুও মানুষ দুর্গাকে পুজো করে কেন”? এরকম নানা আলগা চিন্তা এসে ছেঁকে ধরে অশোককে, বাড়ি ফিরে আসে ও, কিন্তু চিন্তার হাত থেকে রেহাই মেলেনা। মাথার গভীরে বেশ কিছু সূক্ষ্ম শিরা যেন ছিঁড়ে যেতে থাকে। সেদিন রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেও পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ও বুঝতে পারলো যে ভাবনার রেশ রয়ে গেছে, অনেকটা নেশার মত। 


এর একসপ্তাহ পর থেকেই কৌতূহলবশত মহিষাসুর নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলো অশোক। দোকান থেকে নানা পৌরাণিক-পুরাতাত্ত্বিক বই কিনে আনলো, চললো রাতভর পড়াশোনা। প্রায় সব বই শেষ করার পর ওর মনে হল, সব গাঁজাখুরি! আসল সত্যিটাকে সকলেই এড়িয়ে গেছে। একটা ছোট্টো নোটবুকে ও ওর সমস্ত যুক্তি-পুরাণের পাল্টা যুক্তি লিখে রাখলো। আরো গভীরে গিয়ে বেশকিছু গবেষকের লেখাও পড়লো। সেগুলোও মন ভরাতে পারলো না ওর, তবে সেখান থেকেই জানতে পারলো যে ঝাড়খন্ডে এক সম্প্রদায়ের মানুষ আছে যারা মহিষাসুরের উপাসক। তারা পূজোর দিনগুলোতে শোক পালন করে। অশোকের বারবার মনে হতে লাগলো সেই সম্প্রদায়ের সাথে নিশ্চয় কোনো যোগাযোগ রয়েছে ওর। পাগলামি আর কৌতূহলের বশে পরের বছর পূজোটা ও ঝাড়খন্ডে সেই সম্প্রদায়ের সাথে কাটালো। নাহ, ওর মনে হল এরা অন্ধ উপাসক, ওর মত যুক্তিপ্রবণ নয়। 


এরপর থেকেই দিনের পর দিন আরো কুঁকড়ে যেতে লাগলো অশোক। সমাজের ওপর বিতৃষ্ণ হয়ে পড়লো। যে মানুষেরা নারী নির্যাতন করে, নাবালিকা ধর্ষণ করে, কন্যাভ্রূণ মেরে ফেলে তারাই আবার পূজোর সময় প্রতিমার সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ায়। আসলে পূজোটাও কোনো সিনেমা বা ক্রিকেট লীগের মত মেকি বিনোদন মাত্র! মানুষজন বড্ড আমুদে আর ভন্ড। তবে ও ভন্ড নয়, ও জানে ওর স্ত্রী-ছেলের মৃত্যুর জন্য ও-ই দায়ী। যতই নতুন জামা-প্যান্ট পরে দুর্গার সামনে হাতজোড় করে নতমস্তকে দাঁড়াক, সত্যিটা বদলাবে না। তাইতো এসব মেকি হুল্লোড়-ঢাকের আওয়াজ-ধুনোর গন্ধ-শব্দবাজির দৌরাত্ম্য থেকে ও দূরে থাকতে চায়। 


কিন্তু আগের বছর সবকিছু সীমা ছাড়ালো। কিছু ছোটোছেলের অত্যাচারে অশোক প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে উঠলো। অষ্টমীর রাতে পূজো চলাকালীন একটা বিশাল হাতুড়ি নিয়ে ও ঘর থেকে বেরিয়ে এলো রাগে ফুটতে ফুটতে। মন্ডপের ভিড় ঠেলে উন্মাদ অশোক এগিয়ে গেল পুরোহিতের দিকে। পুরোহিত কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর হাতের হাতুড়িটা সজোরে আছড়ে পড়লো দেবী দুর্গার শরীরে! সবাই এই আচমকা ঘটনায় ধাতস্থ হওয়ার আগে আরো একটা আঘাত! বেশকিছু মানুষ গিয়ে জাপটে ধরে ফেললো ওকে, চললো ধস্তাধস্তি। তারপর শুরু হল গণপিটুনি। মাটিতে দুমড়ে- মুচড়ে পড়ে রয়েছে অশোক, জামা ছিঁড়ে গেছে এখানে-সেখানে, কপাল ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে, চারপাশের মানুষগুলো হাঁপিয়ে উঠেছে, তবুও অশোকের মুখে হাসি, কোথাও যেন সামান্য চিড় ধরেছে, চোখে ভাসছে নীলাভ-সবুজ রঙের একটা পেশীবহুল মানুষ, তার বুকে রক্তের দাগ, এভাবেই তো ... এভাবেই তো! না, বদলাতে হবে, সবকিছু, ডানহাতে এখনো কিছুটা শক্তি বাকি আছে, ওঠার চেষ্টা করতেই ধাতব কিছু একটা ... খুব জোরে, খুব জোরে, খুব কালো, খুব ... !

0 comments: