ধারাবাহিক : নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক
ছুটি কথা ১
নন্দিনী সেনগুপ্ত
আমি যখন প্রাইমারী ইস্কুলে পড়তাম, পড়াশুনার চাপ, ইত্যাদি নিয়ে বাবা-মা তখন সাংঘাতিক রকমের মাথা ঘামাতেন না। ইস্কুলেও বেশীর ভাগ নাচ-গান, ছবি আঁকা, খেলাধুলা এইসবের উপর পড়াশুনার থেকেও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত। অর্থাৎ পড়াশুনা বলতে যা বোঝায়, তাতে বেশ ফাঁকি দিয়েও দিব্যি পার পেয়ে যেতাম, কারণ পরীক্ষার রেজাল্ট মন্দ হত না কখনও। গরমের ছুটি পড়লেই নাকি কান্না কেঁদে, ‘মামাবাড়ি যাব’ বললেই ছুটির কাজের অঙ্ক আর হাতের লেখার খাতাসমেত আমাকে আমার বাবা গিয়ে মামাবাড়ি রেখে আসত। আমার বহু গরমের ছুটি কেটেছে সোদপুরে আমার মামাবাড়িতে, যেখানে থাকতেন দাদুভাই, দিদা, ন’মামা এবং ন’মামী। মামার ছেলে শুভ আমার থেকে বেশ ছোট। শুভকে নিয়ে অবশ্যই পরে কোন একসময় লিখবো।
যাই হোক, আমার অঙ্কখাতা প্রায় সাদা পড়ে থাকত। হাতের লেখার খাতার পিছনদিকে ছবি এঁকে ভরিয়ে ফেলতাম। দুপুরগুলো কাটতো শুধু মামাবাড়ির সামনের পুকুরের জলছবি দেখে। পুকুরের উত্তরদিকে ছোট একটা খেলার মাঠ, মাঠ পেরোলে বড় রাস্তা, পুকুরের বাকি তিনপাশে বার্মাশেল-পল্লীর বাড়িঘর। পুকুর ঘিরে সারিসারি নারকেলগাছ, ঐ বুঝি একদম হেলে পড়া একটা গাছ থেকে ঝুনো নারকেল খসে পড়লো পুকুরের জলে! প্রচুর দক্ষ সাঁতারু ঐ পাড়ায়, নারকেল পড়লো- তো ছেলেপিলের দলও ঝপাং করে লাফ দিয়ে জলে পড়লো ফলের দখল নিতে। কে আগে যাবে সাঁতরে, সে এক রুদ্ধশ্বাস প্রতিযোগিতা। পরে যখনই কোনও সাঁতার প্রতিযোগিতা দেখেছি টিভিতে, শিশুকালের সেই অনুভূতি ফিরে আসতো। কারণটা হয়তো এই, যে আমি নিজে মোটেই ভালো সাঁতরাতে পারি না, তাই। জলে থাকতে ভারি ভালোবাসি, কিন্তু ঐ যে আমার অলস স্বভাব, এই জন্যই ঠিকঠাক সাঁতার শেখা হলো না। আমি জলে নেমে কিছুক্ষণ হাত-পা নেড়ে তারপর ভেসে থেকে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতাম, বাঃ, অন্য সবাই কি সুন্দর সাঁতার কাটছে। দেখে দেখেই আমার বেলা যেতো, আঙ্গুলের চামড়া সাদা হয়ে কুঁচকে যেত, কিন্তু জল থেকে মোটেই উঠতাম না, যতক্ষণ না পাড় থেকে কেউ ডাক দিত, ‘অনেক হয়েছে, এবার উঠে এস’ বলে।
যাক গে, যা বলছিলাম সেই পুকুরপাড়ের জলছবির কথা। দুপুরের রোদ্দুর গড়িয়ে গিয়ে গাছের ছায়াগুলো আরও লম্বা হয়ে পুকুরের ঐপারে চলে যেত, আমি হাঁ করে জলের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মনে হত, এখুনি পুকুরের ঠিক মাঝখান থেকে হেলতে দুলতে উঠে আসবে সহস্রফণা এক নাগ, তার মাথায় এক মণি এমন উজ্জ্বল যে বারোটা সূর্য হেরে যাবে! তারপর সেই মণি সে নামিয়ে রাখবে পুকুরের ঠিক অগ্নি-কোণে পারুলদিদার গোয়াল-ঘরের সামনে। তখুনি পারুলদিদার পোষা গরু সৌরভি ‘হাম্বা’ বলে একতাল গোবর দিয়ে ঐ মণি চাপা দিয়ে দেবে। আমি এত সব ভাবতাম আর দাদুভাই, “দিদিমণি, রোদ্দুরে থাইকো না, ঘরে আইসা বিশ্রাম করো” বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়তো; তারপর ‘স্বাগতম’ মিষ্টির দোকান থেকে বিকেল হলে রসগোল্লা এনে খাওয়াবে, এইসব লোভ দেখিয়ে আমাকে ঘরে নিয়ে যেতো। আমার স্থির বিশ্বাস ছিল, যে দুপুরে আমি দাদুভাই বা দিদার জোরাজুরিতে কিভাবে যেন ঘুমিয়ে গেছি, ঠিক সেই দুপুরেই ঐ নাগরাজ এসে মাথার মণি পারুলদিদার গোয়ালঘরে লুকিয়ে রেখেছিলো। নইলে গোয়ালঘরের উপরের মাচায় পুঁইশাক এত অল্প সময়ে লকলকিয়ে বাড়লো কিভাবে?
একদিন সন্ধ্যায় দিদা বলে উঠল, “পারুলদির বাড়ি যামু, তুই লগে যাবি?” আমি তো একপায়ে খাড়া, যদি কোনোভাবে গোয়ালঘরটা দেখা যায়। ওনাদের বাড়ি গেলাম আর লোডশেডিং! পারুলদিদা নতুন বিয়ে করেই ছেলে কিভাবে বউয়ের বশ হয়ে গেছে, এইসব দিদার কাছে খুব কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলেন; আমার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হল যে, এইসব সেই সাপের মাথার মনির জন্যই হয়েছে। তারপর আমি পারুলদিদার ড্রেসিং টেবিলে কেরোসিনের ল্যাম্পের আলোয় কুরুসের আয়না-ঢাকায় জলের ঢেউ আর কালীয়নাগের ফণার মত একটা ডিজাইন দেখতে দেখতে দিদার কানে কানে ফিসফিস করে বললাম, “একবার গোয়ালঘরে যাব”। পারুলদিদা শুনতে পাননি, প্রশ্ন করলেন, “কি কও, দিদিভাই, বাথরুমে যাইবা?’’--- আরে দূর, দূর, বাথরুমে যাবে কোন মূর্খে! আমি তো একবার একটা চান্স নেবোই গোয়ালঘরটা সরেজমিন তদন্ত করে দেখার। যাই হোক, দিদা হয়তো ভেবেছিলেন আমি শহুরে মেয়ে, গোয়ালঘর, পোষা গরু এসব বিশেষ দেখিনি, তাই এত কৌতূহলী! অতএব বেগ পেতে হলনা গোয়ালঘর পরিদর্শণে যেতে। পারুলদিদা লণ্ঠন হাতে সঙ্গে চললেন, শুধু যেতে যেতে বললেন, “অহন তো সৌরভি গুমায়, অরে য্যান ডাইকো না”। আমি তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলাম; ওমা, গিয়ে দেখি সৌরভি মোটেই ঘুমাচ্ছে না। সে মশারির ভেতর জেগে বসে আছে। পাশে ধুপধুনা জ্বলছে। আমার দৃঢ় ধারণা হল যে, সে মণি পাহারা দিচ্ছে। নইলে যখন আমি এরকম ভাবছি, সে ঠিক তখুনি কেন মাথা নেড়ে আর “হাম্বা-আ-আ” করে উঠল। যাকগে, বিশেষ লাভ হলনা, মাঝখান থেকে বেরোবার সময় কিভাবে যেন অন্ধকারে আছাড় খেয়ে সবে গতবারের পুজায় বানানো গোলাপি রঙের নেটের ফ্রকের বেল্টটা ছিঁড়ে গেল। ভাগ্যিস, মামাবাড়িতে জামা-জুতো ছিঁড়লেও কেউ বকে না, নিজের বাড়িতে থাকলেই হয়েছিল আরকি। মা, ঠাম্মা, কাকা, পিসি কেউ বাদ যেতোনা শাসন করতে। এই তো, বাড়ি ফিরলেই ঠাম্মা বলবে, ‘ইসস্, গায়ের রংখান হইসে দ্যাখো, এক্কেরে য্যান কর্তার ছাতির কাপড়!’... হোকগে কর্তা, মানে আমার দাদুর ছাতির কাপড়, বাবার বাজার করার ব্যাগের ঐ মার্কিন থান-কাপড়ের মত গায়ের রং বানাতে আমার বয়ে গেছে। আমি তো আর গরমের ছুটিতে লন্ডন যেতে চাইনা, আমি মামাবাড়ি যেতে চাই।
Bhison sundor.jiboner ei obhiggotagula jeno ekekti muktor phul kuriye paoa.lekhati bhalo laglo.
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ লেখা পড়বার জন্য ।
Delete