0

বিশেষ রচনা : মৌসুমী দাস

Posted in


বিশেষ রচনা 



আমার হারিয়ে গেছে চিঠি 
মৌসুমী দাস 



"পোস্ট অফিস হইতে কেষ্ট সিং চিঠি হাতেই ফিরিল। ব্যগ্র হইয়া শিবনাথ চিঠিখানা তাহার হাত হইতে লইয়া মুহূর্তে খুলিয়া ফেলিল। একি! এ কাহার হাতের লেখা! কাশী, নিচে পত্র লেখকের নাম- গৌরী দেবী ! গৌরী! 

গৌরী পত্র লিখিয়াছে! তাহার মুখ চোখ লাল হইয়া উঠিল!বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ড ধকধক করিয়া বিপুল বেগে চলিতেছে! হাত পা ঘামিয়া উঠিয়াছে। উঃ, দীর্ঘদিন পরে গৌরী পত্র লিখিয়াছে! চিঠিখানা সে তাড়াতাড়ি পড়িয়া গেল।" 
- ধাত্রীদেবতা, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় । 

ঘরে ঘরে টেলিফোন প্রচলনের আগে মানুষ এই শিবনাথের মতই অধীর আগ্রহে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম চিঠি/ পত্রের জন্য অপেক্ষা করে থাকত । সে চিঠি মা-বাবার বা ছেলেমেয়ের হোক অথবা কোনও নিকট আত্মীয় বা পরম প্রিয় মানুষটিরই হোক, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর চিঠি এলে আনন্দে বিহ্বল হয়ে যেত, ঠিক যেমন দীর্ঘ দাবদাহের পর এক পশলা বৃষ্টি। অথবা যেন দিন কয়েক ধরে একটানা বৃষ্টির পর প্রথম সূর্যের আলো। চিঠির মধ্য দিয়েই যেন সেই মানুষটির স্নেহ, ভালবাসা, আবেগের ছোঁয়া পাওয়া যেত। এখনকার মত সে যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থা তত উন্নত ছিল না। ধরা যাক বহু দূর দেশে ছেলে কাজ করতে গেছে। গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা, স্ত্রী সবাই রয়েছেন । অধীর আগ্রহে ছেলের কুশল সংবাদ জানবার জন্য সবাই প্রতীক্ষা করে আছেন।এবার দীর্ঘ দিন পর ছেলের একটি চিঠি এল। পরিবারের অবস্থা তখন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত হত।মা-বাবা সেই চিঠি বুকে জড়িয়ে ধরে যেন তাঁর স্পর্শ অনুভব করতেন।হাতের লেখা প্রতিটি অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতেন। প্রিয়তমা পত্নীটি বার বার করে সে চিঠি পড়তেন, আবার লুকিয়ে রাখতেন। আবার পড়তেন। সে এক অন্য রকম অনুভুতি ছিল। 

আসলে চিঠি হল আত্ম প্রকাশের একটি মাধ্যম। এবং অন্য মনের সঙ্গে নিজ মনের মিলনের এক সৃজনশীল পথ। একমাত্র চিঠি - পত্রের মাধ্যমেই আমরা নির্ভয়ে, অসঙ্কোচে, অকপটে, নিজের মনের সব কথা উজার করে বলতে পারি।বহু কাল আগে, মহাকবি কালিদাস তাঁর রচিত মেঘদূতম কাব্যে প্রিয়তমা পত্নীর কাছ থেকে দূরে নির্বাসিত এক যক্ষ “আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ নবীন মেঘকে তাঁর কুশল সংবাদ নিয়ে দূত রূপে বিরহিণী প্রিয়ার কাছে পাঠিয়েছিলেন। সে যুগেও যে বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থা ছিল, তার আভাস দিয়েছিলেন কবি । 

পত্র রচনা যে এক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য, তা অনেক কাল আগেই প্রাচীন গ্রিসে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।এবং তার পর থেকেই দেশে বিদেশে বহু বড় বড় মনীষীদের পত্রাবলী সংগ্রহ, সংরক্ষণ করে রাখা হত। সেই সংরক্ষিত চিঠি থেকে তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি বর্ণনা, চিন্তাধারা সম্পর্কে পরবর্তীকালে আমরা জেনেছি।আর এভাবেই একদিন রবিঠাকুর কর্তৃক ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লেখা মুল্যবান চিঠিগুলো পরবর্তীতে চিঠির পারিবারিক অংশ বাদ দিয়ে “ছিন্নপত্র” নামে গ্রন্থাকারে আমাদের ঘরে এসে পৌছায়।শুধু রবিঠাকুরই নন, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্র নাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, প্রমথ চৌধুরী, জগদীশচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, থেকে শুরু করে কাজী নজরুল ইসলাম, বা সুকান্ত ভট্টাচার্যের সংরক্ষিত চিঠি থেকে তাঁদের সাহিত্য সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিত, রচনাকালীন অনুভূতি, ব্যক্তিগত জীবন, যন্ত্রণার কাহিনী জানতে পারি। 

বিখ্যাত ছাড়া সাধারন মানুষেরাও তাদের প্রিয় জনের বহু মুল্যবান চিঠি সযত্নে বহুদিন পর্যন্ত রেখে দিতেন।সেই চিঠি অনেকদিন পর বের করে পড়তেন।তা নিয়ে বেশ মজার বা বেদনার ঘটনাও ঘটেছে। বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস, সিনেমায় আমরা দেখেছি হয়ত কারো লুকানো চিঠি অন্য কারো হাতে চলে গেল্, বিশেষ করে যার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে, অসাবধানে তার হাতেই পরে গেল, তখন এক অনাসৃষ্টি কাণ্ড হত। ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হত। 

টেলিফোন চালু হবার পর থেকে, চিঠি লেখা বা পড়ার, সময় বা ইচ্ছে প্রায় সকলেরই আর নেই বলা যায়। এখন তো আবার সকলের হাতে হাতে মুঠোফোন এসে গেছে। প্রয়োজনীয় খবরাখবর আদানপ্রদান এর মাধ্যমেই খুব অল্প সময়ে সেরে নেওয়া যায়। তাছাড়া দিন দিন মানুষের ব্যস্ততা যেন বেড়েই চলেছে। এই চরম ব্যস্ততার জীবনে চিঠি লেখা বা পড়ার সময় নেই কারো । তবে অল্পবয়সীদের মধ্যে প্রেমের চিঠি যে লেখা হয় না তা নয়। কিন্তু তা ডাকযোগে পাঠানো হয় কি না, আমার জানা নেই। ডাকযোগে চিঠি আদান প্রদানের মাধ্যমে যে আনন্দানুভূতির সৃষ্টি হয়, তা ওই সংক্ষিপ্ত এস,এম,এস এর মাধ্যমে হয় কি না কে জানে! কারণ, মেসেজে তো আর বিস্তারিত ভাবে মনের কথা বলা যায় না। তাছাড়া মেসেজ তো এক সময় delete করতেই হয়, চিঠি কিন্তু ইচ্ছে করলেই রেখে দেওয়া যেত। 

বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা “টেলিগ্রাম” শব্দটির সাথেও বিশেষ পরিচিত নয়। আগে কারো বাড়ী “টেলিগ্রাম” এলে, সে বাড়ির সাথে সাথে সারা পাড়ার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ত।কাঁপা কাঁপা হাতে প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে পিওনের কাছ থেকে সেই দূরবার্তা বা তারবার্তা গ্রহণ করা হত। কারণ  সে সময় “টেলিগ্রাম” ছিল কিছু মাত্র সুসংবাদের চেয়ে, বেশি মাত্রায় দুঃসংবাদ বহনকারী একটি দ্রুত মাধ্যম।এখন সুসংবাদ, দুঃসংবাদ সবই মুঠোফোনের মাধ্যমে নিমেষে প্রচারিত। 

পোস্টকার্ড বা ইনল্যান্ড এর ব্যবহার তো এখন আর চোখেই পরে না।সে সময় ঘরে ঘরে এর ব্যবহার হত প্রায় সারা বছর। ছোটবেলা বাবাকে দেখেছি নববর্ষ বা বিজয়ার পর “অবশ্য- কর্তব্য” পালনের জন্য একগুচ্ছ ইনল্যান্ড, খাম নিয়ে বসতেন, দেশে বিদেশে যত আত্মীয় স্বজন আছেন তাদের সাথে শুভেচ্ছা, ও কুশল বিনিময় করতেন। একটু বড় হলে, বাবার সময়ের অভাবের জন্য আমাকে দিয়েও চিঠি লেখাতেন। শিখেছিলাম বড়দের প্রণাম ও ছোটদের স্নেহ ভালবাসা জানিয়ে লেখা শুরু করতে হয়। তাছাড়া দূরদেশে থাকা মামাতো পিসতুত ভাইবোনদের সাথেও চিঠি লেখালেখি শুরু হয়েছিল। মনে পরে লেখার মাধ্যমে ইংরেজি চর্চা করব বলে আমরা ইংরেজিতে চিঠি লিখতাম। সে ছিল এক উন্মাদনা! চিঠি যেন দীর্ঘ হয় সে শর্তও থাকত।আবার পরস্পর পরস্পরের লেখার ভুল সংশোধন করে দিতাম। পিওন কাকুর কাছ থেকে চিঠি নিয়ে পড়তে কি আনন্দ যে হত, বলে বোঝানো যাবে না ! 

কলেজের পড়া শেষ হলে বন্ধু বান্ধবীরা যখন যে যার বাড়ি চলে গেল, তখন অনেক দিন পর্যন্ত ওদের সাথে চিঠি পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল। আমার কলেজের এক বান্ধবী রুনু, একই শহরে বাস ছিল আমাদের। এ পাড়া ও পাড়া আর কি। প্রায়ই দেখা সাক্ষাৎ হত। একবার হল কি, এক সুন্দর রঙ্গিন খামে ওর চিঠি এল। দেখি ওর পোষা কালো বেড়ালের চারটে ছানা হতে গিয়ে বেড়াল টা কষ্ট পেয়ে মারা যায়, সে খবর নিদারুণ  ভাবে বর্ণনা করে জানিয়েছে।এত নিখুঁত সে বর্ণনা ছিল, যে চিঠি পড়তে পড়তে চোখের সামনে সে ঘটনা দেখতে পাচ্ছিলাম। সেই বর্ণনাকে পত্র সাহিত্যই বলা যায়। দেখা হলেই খবরটা দিতে পারত, কিন্তু সেটা হৃদয়কে এতটা স্পর্শ করত কি না কে জানে। কারণ, মুখোমুখি কথায় যা কিছু মনের ভাব এড়িয়ে যায়, চিঠিতে তা সুন্দর করে ধরা দেয়। খবর জানানোর এই অভিনব পদ্ধতিতে চমকিত ও হয়েছিলাম ।খুব মিস করি সেসব দিনগুলি।মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রিয় বন্ধু বান্ধবীদের সাথে আবার যদি চিঠি লেখা লেখি শুরু করা যেত! তবে সবাই আমরা এখন এত ব্যস্ত, যে সে ভাবনা বাস্তবায়িত করা হয়ে ওঠে না। 

আসলে প্রিয়জনের কাছে লিখিত আকারে মনের ভাব প্রকাশই তো চিঠি, তা কি আর এস,এম,এস এর মাধ্যমে পূরণ হয়? আর সামনা সামনি আমরা কতটুকুই বা মনের কথা গুছিয়ে বলতে পারি। সময় যত এগোছে এই “চিঠি” নামক শিল্পকর্মটি ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।এখন শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক বা প্রশাসনিক কাজেই চিঠিপত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো এটুকুও আর থাকবে না, উন্নত আরও নতুন কোনো পদ্ধতির  উদ্ভব হবে। আর “চিঠিপত্র” শব্দটি অভিধানেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে।

0 comments: