0

মুক্ত গদ্য : অব্যয় অনিন্দ্য

Posted in


মুক্ত গদ্য 




কবিতা আসলে এক ধরনের কূটনীতি 
অব্যয় অনিন্দ্য 


কবিতা আমার কীর্তিনাশার খেয়া। খেয়াটা আমাকে নেয় না তার কোলে। তবে আমার গন্ধটাকে নেয় আঁচলে গিট দিয়ে। নিয়ে তুলে দেয় বিশ্ব-মননের ট্রেনে। গন্ধটা অবশ্য খেয়ায় ওঠার আগে অনেকগুলি লোকাল স্টেশান ছুঁয়ে এসেছে। জীয়ন পুকুর পাড়ে দাদুর হাতে শৈশবকে দিয়ে ঠাকুরমার ঝুলি ছুঁয়েছে। পদাবলীর লেজ ধরে রবীন্দ্রনাথকে ছুঁয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ফেলে আন্তর্জাতিকতার মশাল নিতে চেয়েছে করতলে। ঘুরেছে সাত মহাদেশের প্রভাতকে স্বাগত জানিয়ে। গন্ধটাকে কোলে নিয়ে এখন আধুনিকতার উত্তরেই দৌড়াচ্ছে কবিতার খেয়া। কবিতার সাথে আমার ইটিশ-পিটিশ সেই রাবার ঢিলা হাফ-প্যান্টের সময় থেকেই। একদিন বকফুল ভাঁজার মত প্রজাপতিকে ভাঁজতে চাইলে দাদু হাতে তুলে দিয়েছিল আলো আর আঁধারের দীক্ষা। সেই দীক্ষা থেকে উঠে আসা সৌন্দর্যকে বসতে দেবার জায়গা পাচ্ছিলাম না। নিরুপায় হয়ে ওই সৌন্দর্যকে দিলাম কবিতার পিঁড়ি। সুন্দরকে বুকে করে চলতে শুরু করল আমার কবিতা। আনত সন্ধ্যা-সূর্য্যকে টাটা দিয়ে ঘরে ফিরতে থাকা তৈ তৈ হাঁসের ডানায় ছিল ও। ছিল কিশোরীর সদ্য ফোটা বুকে। লটকন গাছে গুচ্ছ গুচ্ছ ঝুলে ছিল সুন্দর কবিতাগুলি। সুন্দরের সাথে কবিতার লটর-পটর অবশ্য বেশিদিন চলতে পারেনি – আসলে চলতে দেয়নি। দেয়নি সুন্দরের উল্টা পিঠে ঝুলে থাকা সামাজিক হিংসার কালো বিড়াল। বিড়ালটার স্বার্থমাখা চাহনি আর চাহনিতে ভাসতে থাকা থাবা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল পৈচাশিকতার স্টেশনে। সেই স্টেশনে কিন্তু আমি একা যাইনি – কবিতাকেও নিয়েছিলাম সাথে। সাম্প্রদায়িক জিহ্বা, স্বর্গ-ফাঁদ, ধর্ষকামী-মর্ষকামী রন্ধনশালা সব ঘুরে এসেছে আমার কবিতা। ঠোঁটে নিয়েছে অগ্নিগিরি। এখানে এসে কবিতা প্রায়ই আর আমার কথা শোনেনি। শুরু হয়েছে কবিতার সাথে আমার কূটনীতি। কবিতাও আসলে এক ধরনের কূটনীতি – একটা নেগোসিয়েশান। কালের প্রবাহের কোন একটা অংশকে কবিতা ঠোঁটে ধারণ করে তাঁর নিজেরই প্রয়োজনে। এখানে ঠোঁট কতটুকু ধরবে তার নেগোসিয়েশান চলে কবির সাথে সময়ের। ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে’ – কূটনীতির এমন ব্লাংকচেক নির্দিধায় কবিদের দিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই সত্যের কূটনীতি কবিতার সারা সত্ত্বায়। অন্যদিকে আবার কবিতার দেহ ও মনের সাথে পাঠকের নেগোসিয়েশান চলে নিরন্তর। নিজের জীবনের ক্যানভাসে কবিতাকে নিয়ে যেতে পাঠকও খোঁজে সময়ের ডাকবাক্স। এভাবেই সময়ের হাসি কান্না ছুঁয়ে কবিতা হয়ে ওঠে একটা কূটনীতি।

0 comments: