6

রম্যরচনা : সৌমিত্র চক্রবর্তী

Posted in


রম্যরচনা 




শপিং মল জ্যাম জমাট 
সৌমিত্র চক্রবর্তী 



সকাল থেকেই মেজাজ খারাপ। টেনশনটা বাড়ছেই। একেই প্রেসার হাই তারপরে এরকম টেনশন হলে শেষপর্যন্ত যাওয়া হলে হয়। 

সেই সাতসকালে খবরের কাগজ দেখে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়েছিল। এক্কেবারে ওপরেই প্রথম পাতাজুড়ে কোয়েস্টা মলের অ্যাড। এরা নাকি এশিয়ার সবচেয়ে বড় শপিংমল। আজই ওপেনিং আর সেই উপলক্ষে কত্তো কি যে অফার! উফফ…ভাবলেও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কদিন পরেই বাপের বাড়ী যাবার তাড়া। অথচ এখনো পর্যন্ত প্রায় কিছুই কেনাকাটা হলো না। 

-‘কি রে তোর গান শোনা কি এ জম্মে আর শেষ হবে না? লেখাপড়া তো উচ্ছন্নে গেল। এক ক্লাসে ঘষে ঘষে…’ 

-‘উফ মা! সবসময় এরকম কোরোনাতো!’ সরস্বতী বিরক্ত মুখ করে খেঁকিয়ে উঠলো। 

-‘যাবে তো সেই মলে। এখন সবে সাড়ে চারটে বাজে। এখন কোনো ভদ্রলোক ওখানে যায় না’। 

-‘ওই আশাতেই থাক। সাড়ে চারটে কবে বেজে গেছে। আর কি এত শুনিস সারাদিন ওই তারগুলো কানে লাগিয়ে? সেই তো ওয়ান ডিরেকশন। পচে গেল শুনতে শুনতে’।  মুখঝামটা দিল দুর্গা। 

-‘পচুক, তাতে তোমার কি? তোমাকে তো আর শুনতে হচ্ছে না। এরকম করলে আমি…’ 

বলতে গিয়েও থমকে গেল সরস্বতী। বলতে যাচ্ছিল, এরকম করলে আমি যাবনা। কিন্তু সেটা যে বেশ সুখের হবে না, সেটা মনে পড়ে গেল। 

দুর্গা তখন বড় আয়নার সামনে। মুখে ল্যাকমে ক্যালামাইন ঘষতে ঘষতে ঝরঝর করে ভেবে নিচ্ছে কত কাজ বাকী। 

পার্লারে যেতে হবে। লাস্ট কবে ফেসিয়াল করেছিল, মনে নেই। কিন্তু বছরে এই একবার বাপের বাড়ী গেলেই যত রাজ্যের লোক এসে হামলে পড়বে মা মা করে। তাদের সামনে এই নানারকম দাগ ভর্তি মুখ নিয়ে… মাগো… ওখানে আশেপাশের প্রতিবেশীরা মেয়ে বাপের বাড়ী এলেই খুব খুঁটিয়ে দেখে। চোখের কোলে কালি পড়েছে কিনা! গায়ে গয়না আছে কি নেই। মুখে বেশ সুখী সুখী ভাব আছে কি না! 

এতটুকু খুঁত পেলেই আড়ালে ফিসফিস গুজগুজ। -‘ঐ দেখেছ বলেছিলাম না গেঁজেল হাসবেন্ড। মেয়েটা যে খুব দুঃখে আছে তাতে কোনো সন্দেহই নেই’। বলেই হেউ করে একখানা তৃপ্তির ঢেকুর। 

-‘শালা!’ বলেই একবার এদিক ওদিক দেখে নিল দুর্গা। আশেপাশে কেউ নেইতো! এই ট্যাবলয়েড গুলোর পাপারাৎজি গুলোকে একেবারেই বিশ্বাস নেই। কোত্থেকে লুকিয়ে শুনবে আর কাল সকালেই হয়তো হেডলাইন, “গাল দিচ্ছেন দুর্গাও”। ও মাই গড! পপুলারিটির টিআরপি হুশ করে একবার নেমে গেলে তাকে ফের ওঠানো যে কি কষ্টকর, তা ভুক্তভোগীই জানে। 

-‘ কি রে হলো তোর? লক্ষ্মী টা গেল কোথায়?’ 

-‘হি হি… দিদি তো সকাল থেকেই বয়ফ্রেন্ডের সাথে হাওয়া’। 

-‘বয়ফ্রেন্ড! মানে? বিয়ে হওয়া ধিঙ্গি মেয়ে, এসব কি?’ 

-‘আমি তার কি জানি। তুমি দেখ। সবসময় তো আমারই দোষ দেখ’। ঠোঁট ফুলিয়ে বলে ওঠে সরস্বতী। 

-‘আসুক বাড়ীতে, তারপর দেখছি। হ্যাঁ রে, তোর কি কি লাগবে?’ 

-‘আমার!’ প্রবল উৎসাহে বিছানার ওপরে উঠে বসে সরস্বতী। ‘ওরিফ্লেম, অ্যামওয়ে, ফেসেস, ম্যাক, চেম্বুর, অ্যাভন, প্রোডা, লোটাস, গুচচি…’ 

-ব্যাস ব্যাস!’ হাত তুলে থামিয়ে দেয় দুর্গা। ‘বাপ কে কি কোটিপতি পেয়েছিস নাকি? যত রাজ্যের শুধু মেকআপের লিস্ট’। 

-‘তুমিই তো জিজ্ঞেস করলে’। মুখ গোমড়া করে বলে ওঠে ছোটমেয়ে। 


ঢোকার পাল্লা দেওয়া দরজাটা পেরোতেই লেগে গেল পনের মিনিট। ইয়া লম্বা লাইন। আশ্চর্য! শহরশুদ্দু সব্বাই কে কি আজকেই আসতে হয়! মনে মনে গজগজ করে উঠলো দুর্গা। 

একে বাসে ওই বেজায় ভীড়ের মধ্যে সরস্বতীকে নিয়ে সামলে সুমলে আসতে হয়েছে। এতবড় মেয়ে কিন্তু কোনো হ্যাঁৎক্যাৎ নেই। বুকের সামনে যে হাত দিয়ে আড়াল করতে হয় সে জ্ঞানটা আর কবে হবে! একটা মাঝবয়সী পরিস্কার নিজের হাতটা দুলিয়ে দুলিয়ে ঠেকিয়ে দিচ্ছিল ওর বুকে। দেখে রাগে গা রি রি করে উঠেছিল দুর্গার। ওই ভীড়ের মধ্যেই টেনে সরস্বতীকে নিজের বাঁদিকে সরিয়ে এনেছিল। এখানে এসেও সেই ভীড়। 

কিন্তু ঢুকেই শরীর জুড়িয়ে গেল দুজনের। আর যাই হোক কিছুক্ষণ তো এয়ার কন্ডিশনড জায়গাটায় থাকা যাবে। 

এমনিতেই যে কোনো মলে এলেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আর এ তো…! 

কি নেই! বাপরে! পৃথিবীর সব কোম্পানী এসে হাজির হয়েছে এখানে। হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হল। সরস্বতী কনুই ধরে টান দিয়েছে। ওর চোখের ইশারায় তাকিয়ে প্রথমে কিছুই বুঝলো না। একটা বড় শোরুম। ভেতরে কয়েকজন আলট্রা মডার্ন বসে। 

-‘কি ব্যাপার?’ 

-‘দেখ ভেরো মোডা, এখানে’। গদগদ স্বরে মেয়ে বলে উঠল। 

-‘তাতে কি। ধুত চল তো। এইসব মোটা ফোটা দেখতে হবেনা। লোকে এখন টাকা খরচ করে স্লিম হতে চাইছে, আর তুই...’ 

-‘মা তুমি না এক্কেবারে গাইয়াই রয়ে গেলে। আরেবাবা ভেরো মোডা হল ভিক্টোরিয়া বেকহ্যামের জামাকাপড়ের ফ্যাশনরুম। ডেভিড বেকহ্যামের বউ। এখানে শোরুম করেছে। ইইইই...কি মজা!’ 

-‘অ, ভালো। তা একটা জামার দাম কত?’ 

-‘ধ্যাত, ওখানে কেউ দাম দেখে নাকি? গায়ে ভেরো মোডা থাকলে স্টেটাস কোথায় দৌড়বে বলতো?’ মেয়ে অকপট। 

-‘আচ্ছা ঠিক আছে চল চল, ওদিকটা দেখি’। দুর্গা পালাতে পারলে বাঁচে। তাকে এখন আয়ত্বের মধ্যের জামাকাপড় টানছে। 

-‘মা দেখ দেখ, ক্যাট ওয়াক এসেছে। ওদের ওয়েজ টাও দারুন’। 


কোনোরকমে মেয়েকে টেনে ফোরথ ফ্লোরে জামাকাপড়ের জায়গায় এসে বোকার মত তাকিয়ে থাকলো দুর্গা। কে নেই! সত্যা পল, ঋতু কুমার, রোহিত বেহাল, দিলীপ, সব্যসাচী মুখার্জ্জী, অগ্নিমিত্রা পল। যত ফ্যাশান ডিজাইনাররা গুঁতোগুঁতি করছে এক জায়গায়। 

অবশ্য দুর্গা এত জানতো না। এইমাত্র মেয়ের কাছে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে তার এই বোধোদয় হয়েছে। 

-‘মা, আমি কিন্তু একটা জেগিন্স, একটা লেগিন্স আর একটা প্যাগেটি স্ট্রাইপড টপ নেব। আর দিদির জন্যে আনারকলি আর একটা মাইক্রো মিনি আর একটা হট প্যান্ট। তোমার জন্যে কিন্তু আমি এবারে পছন্দ করব হ্যাঁ! সুপারনেট শাড়ি। হেব্বি চলছে এবছর। না করতে পারবে না। কি যে প্রত্যেক বছর ওই একঘেয়ে শাড়িগুলো পর’। পোষা বেড়ালের আদুরে গলায় বলে উঠলো সরস্বতী। 

দুর্গার কানে আদ্ধেক ঢুকলো, বাকী আদ্ধেক শনশন করে কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। সে তখন ব্যস্ত কোথায় কত অফার লেখা আছে, লেবেলের দাম কত, এসবে। 

হাবি হতচ্ছাড়া তো একপয়সাও দেয়না। নিজের ওই কোচিং সেন্টারের জমানো কটা টাকাই সম্বল। উল্টে নেশাভাং করতে প্রত্যেক মাসে হাবি নামে যন্ত্রটিকে বেশ কিছু টাকা গুনাগার দিতে হয়। কি আর করা! তখন ওই শিল্পী শিল্পী চোখ দেখে বাড়ী থেকে বাবা মা র অমতে পালিয়ে গিয়ে বিয়ের হাতে গরম রেজাল্ট এটা। 

এখন ওর মধ্যে থেকেই যা কিছু কেনাকাটা করতে হবে। নিজের আর মেয়েদের চুলের ফ্যাশন ও আছে। জুতো, চটি কত কিছু বাকী। 

বড়ছেলে গনেশ সারাদিন ওই ব্যাসদেবের মুদীখানায় খাতা লিখে মাসগেলে কয়েকটা টাকা ঘরে আনে। বিয়েও করেছে কোত্থেকে একটা গ্রামের মেয়েকে। সারাক্ষণ শুধু ঘোমটা দিয়েই থাকে, আর পারতপক্ষে বাড়ির কারো সঙ্গে কথা না বললেই বেঁচে যায়। 

ছোট কার্ত্তিক টা মহা লফঙ্গা হয়েছে। এত দামড়া হল, কিন্তু এখনো পর্যন্ত না রোজগার, না সংসার। কোনোদিকেই মন নেই। বাড়িতেও থাকেনা এখন। দুর্গা শুনেছে কোন একটা তামিল না তেলেগু মেয়ের সঙ্গে লিভ টুগেদার করছে। দুহাতে আর পিঠে ট্যাটু করে মেয়েটার নাম লিখে ঘুরে বেড়ায়। খুব ভারী একটা নিঃশ্বাস ফেললো সে। 

এসব কথা এমনকি বাপের বাড়িতেও কাউকে বলা যায় না। বললে নিজের ছোঁড়া থুতু নিজের গায়েই পড়বে। মিডিয়ার কাছেও চেপেচুপে বলতে হয়। কিন্তু বাপের বাড়ী গেলে তো সবকটাকে তো সাজিয়ে গুছিয়েই নিয়ে যেতে হবে। 


দুজনের সবকটা হাতে বড় বড় প্যাকেট গুলো নিয়ে যখন বাইরে পা দিল ওরা, তখন পা-কোমর টনটন করছে। জিনিসপত্র তো দেখেশুনে মনের সুখেই কিনতে পেরেছে। ফাঁকতালে চুলের বুফো ডিজাইনও করিয়ে নিয়েছে হাবিব থেকে। সরস্বতী করিয়েছে ফ্রিঞ্জ। 

অনেক বায়না করে নাভির ওপরে ফুটো করে একটা দুলও পরেছে ও। এটা নাকি এখন লেটেস্ট ফ্যাশন পিয়ারসিং। আগে শুধু নাকে আর কানে পরা হত, এখন বডির সব জায়গাই নাকি ফুটোযোগ্য। লেহ্ ফ্যাশান! 

কিন্তু সবচেয়ে ঝামেলা হল পেমেন্টের সময়। বিসশাল লাইন সবকটা কাউন্টারের সামনে। ওফ্! টাকা দেবার জন্যে যে এত ঝামেলা কে তা জানতো! 

বাস স্টপেজে এসে আকাশের দিকে তাকাল দুর্গা। লাল হয়ে আছে এই রাত দশটার আকাশ। তার মানে বৃষ্টি নামবে এক্ষুনি। 

তাহলেও বেশ খুশি খুশি মনে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়াল দুজনে। 

মহালয়াটা আর কদ্দিন দেরী যেন!

6 comments:

  1. মা দুগগা পেমেন্ট কিসে করলেন??

    ReplyDelete
  2. কল্পতরু ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডে অরিন্দম দা। :)

    ReplyDelete
  3. দারুন মজা পেলাম পড়ে, অনেকক্ষণ হাসলাম :D

    ReplyDelete
  4. যাক রিয়া লাফিং ক্লাবের আরো একজন সদস্য বাড়লো :)

    ReplyDelete
  5. হাসির মাঝে টুকরো টুকরো শ্লেষগুলো জীবন্ত ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. শারদ শুভেচ্ছা শেখ সাদ্দাম হোসেন।

      Delete