0

ছোটগল্প : অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

Posted in


ছোটগল্প 



মাছি 
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী 



নিশুত রাতে ডাকাত পড়ল মহন্ত’র বাড়ি। বিহারী ডাকাতের দল, ইয়া তাগড়াই চেহারা, পাকানো পুরুষ্টু গোঁফ। দুই লাথিতে সদর দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল বাখুলে। 

মহন্ত’র কাঁচা-পাকা দোতলা বাড়ি। বাড়ির চারপাশে বাখুলভরা হামার আর মরাই। বারোমাস সেসব ধানে টইটম্বুর। মা লক্ষ্মীর পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে মহন্ত। তবে কী – খানদানি ডাকাত ধান লুটতে আসে না; তাতে মান যায়। তাদের লক্ষ্য কাঁচা টাকাপয়সা – গয়নাগাটি, আকবরি মোহর, নিদেন পক্ষে ষষ্ঠ জর্জের মাথাওলা চাঁদির টাকা। ইংরেজের রাজত্বে ডাকাতের দল চালানো চাট্টিখানি কথা না! 

দু’জন সড়কি আর মশাল হাতে বাড়ির সামনে পিছনে পাহারায় থাকল। বাকিরা কুড়ুল হাতে দরজা ভাঙায় লেগে পড়ল। 

কিছুদিন হল নাতিবৃদ্ধ মহন্ত মারা গেছেন। তাঁর বড় ব্যাটা টাটকা জোয়ান – ধানখেতের আলে দাঁড়িয়ে মুনিষ-কামিনের ধান রোয়ার তদারক করছিল। দু’ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে না পড়তেই বজ্রাঘাত! মুহূর্তেই দাঁড়িয়ে থাকা জ্যান্ত মানুষ পড়ে থাকা লাশ। সেই শোকে বছর খানেক শয্যাশায়ী থেকে মহন্ত গেলেন ওপারে। রীতি অনুযায়ী বড় ব্যাটার একমাত্র পুঁয়ে-পাওয়া জীবিত পুত্র পচাই এখন মহন্ত। কিন্তু সে মাত্র সতের বছরের ছোকরা। কাজেই শিষ্যবর্গকে দীক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব অস্থায়ী ভাবে মেজ ব্যাটাতেই বর্তেছে। তবে মেজকত্তা ও ছোটকত্তা মহন্ত’র মৃত্যুতে সম্বচ্ছর পালন করছেন। দীক্ষাহীন বৃদ্ধ শিষ্যেরা নরকবাসের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন, সম্বচ্ছর না ফুরুলে গুরুদর্শন অসম্ভব। 

ভাঙাভাঙি সাঙ্গ করে ভেতরে ঢোকার আগে ডাকাতরা একটু সতর্ক হয়ে গেল। মহন্ত’র বাড়িতে বন্দুক আছে, দোনলা জার্মান বন্দুক। তবে ডাকাতদের কাছে খবর আছে মেজকত্তা পালনের কালে অশুদ্ধ বিধায়ে টোটা-বন্দুক ছোঁবেন না। আর ছোটকত্তা তো বই মুখে নিয়ে গরু-বাগালি করেন, তিনি ধর্তব্যের মধ্যেই আসেন না। বন্দুকবাজ একজনই, তারই হেফাজতে থাকে বন্দুক – মেজকত্তার বড় ব্যাটা সেই চাঁদুই এ রাতে অনুপস্থিত বাড়িতে। তবু সাবধানের মার নেই, ডাকাতরা ভাগ ভাগ হয়ে সন্তর্পণে ভেতরে ঢুকল। 

সর্দার নিজে উঠল দোতলায়। বাইরে থেকে পাকা সিঁড়ি গিয়ে দোতলার দরজায় শেষ। ভেতরে মেজ আর ছোট কত্তা শয়ান থেকে জেগে উঠে কম্বলে আসীন। ছোট’র হাত-পা কম্পমান। মেজ কত্তার নির্দেশে পচাই বন্দুক হাতে দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে, হাতের কাঁপুনি থামাতে পারছে না। মেজকত্তা ফিসফিস করে বলছেন, -- বন্দুক চালাই দিয় না, তুল্যে ভয় দেখাবে শুধু। 

পচাই ঘাড় নাড়ে, সেফটি ক্যাচ তোলার কথা মনেই নাই তার। 

দরজা ভেঙে সর্দার আর তার পেছনে এক চ্যালা ঘরে ঢুকেই টর্চের আলো ফেলে পচাই-এর চোখে, এক ঝাপটায় তার হাতের বন্দুক কেড়ে নেয়। সামনেই মেজ কত্তা কম্বলে বসে, তার পেছনে ছোট। খবর আছে সব লুকোনো চাঁদিমোহর রাণীগোঁসাই-এর হেফাজতে। জেনানালোগের গায়ে হাত দেওয়া ওস্তাদের বারণ। আরও খবর রাণীগোঁসাই-এর আদরের ছোট ছেলেই একমাত্র সেই গুপ্ত জায়গার হদিশ জানে। অতএব সর্দার নিজেই ছোটকত্তার দায়িত্ব নিল। তার চুলের মুঠি এক হাতে পাকড়ে অন্য হাতে বিশাল এক রদ্দা তার ঘাড়ে ঠুসে দিয়েই চাপা গর্জন, -- বোল কাঁহা হ্যায় সোনা-চাঁদি? 

ছোটকত্তার তার মা’র মতো টুকটুকে গায়ের রঙ, আতঙ্কে এখন তা নীলচে। এমনিতেই একটা শব্দ উচ্চারণ করতে তার পাক্কা এক মিনিট সময় লাগে, রদ্দার দাপটে ঘাবড়ে গিয়ে ব্‌ - ব্ব্‌ - ব্ব্‌ করতে করতে সেখানেই আটকে গেলেন। সর্দার অধৈর্য হয়ে আবার হাত তুলেছিল, মেজকত্তা থাকতে না পেরে সেটা ধরে ফেললেন। বললেন, -- মাত মারো ওকে, ও তোতলা হ্যায়। 

সঙ্গে সঙ্গে সর্দারের চ্যালা বন্দুকের বাঁট মেজকত্তার মাথায় বসায়। তাঁর টাকের চামড়া ফেটে রক্ত গড়াতে থাকে, তিনি জ্ঞান হারিয়ে কম্বলের ওপর গড়িয়ে পড়েন। চ্যালা একটু বাংলা জানে। সে সর্দারকে বলে, -- উও হাকলা হ্যায়। 

গুপ্তধনের হদিশ পাওয়ার আশা তাতে ক্ষীণতর হতে সর্দারের নির্দেশে চ্যালা ছোটকত্তার ঠ্যাঙ ধরে হিড়হিড় করে টেনে সিঁড়িতে ঘষটাতে ঘষটাতে বাখুলের কুলতলায় যখন নিয়ে ফেলল তখন তিনি একেবারেই ন্যাংটো, পরনের ধুতি ছিঁড়েখুড়ে চৌকাঠে ঝুলছে। 

সর্দারের ছেলে নবীন জওয়ান। ছাতি তো নয়, বাঁধের চাতাল; বাবরি চুল, ডাগর চোখ – ঠিক যেন কেষ্টঠাকুরটি। তার চোখে পড়ল তীর্থবালা, মেজকত্তার বড় মেয়ে – দড়ির খাটিয়ার নীচে গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে রয়েছে। এক ঝটকায় খাটিয়া বাঁ হাতে তুলে ছুঁড়ে ফেলে কেষ্টঠাকুর। তীর্থবালার বিয়ে হয়েছে বছরও গড়ায়নি। এখনও দ্বিরাগমন বাকি। তার গা-ভর্তি গয়না। ওস্তাদের বারণের মর্যাদা দিয়ে কেষ্টঠাকুর পটাপট তার গলার হার, কানের দুল ছিঁড়ে নিতে থাকে। তীর্থবালার কানের লতি ছিঁড়ে ঝরঝর করে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে করতে সে হাতের চুড়ি, কঙ্কণ, বালা খুলে ডাকাতটির পায়ের ওপর ফেলে দেয়। 

মহন্ত বাড়ির বাইরেও তখন প্রায় নিঃশব্দে কিছু ঘটনা ঘটছে। দরজা ভাঙার শব্দের সঙ্গে আন্দরমহিলাদের আর্তকণ্ঠ যুক্ত হলে গাঁয়ের দু-পাঁচজন লোক জাগতে শুরু করে। প্রথম  যে মানুষটি ডাকাত পড়ার ব্যাপারটি আন্দাজ করে প্রচণ্ড হতাশ ও কুপিত হল, সে গোরাচাঁদ, মহন্ত বাড়ির সম্বচ্ছরের মাইন্দার। কোন রকম শব্দে-টব্দে তার নিদ্রাভঙ্গের প্রশ্ন নেই, কেননা সে জেগেই ছিল। অতি সন্তর্পণে নিঃশব্দ পদক্ষেপে সে যখন মহন্ত’র বাখুলের পিছনদিকের এক গোপন ঘুলঘুলি দিয়ে গোয়ালে ঢোকার উপক্রম করছিল তখনই সে ডাকাতদের কুড়ুলের আঘাতে সদর দরজা ভেঙে পড়ার আওয়াজ পায়। ব্যাপারটা বুঝে ফেলে এক লহমাও দেরি করেনি সে। আড়রা বলদের মতো শরীরস্বাস্থ্য হলেও ডাকাতদের মহড়া নেওয়ার মত বুকের পাটা তার নেই। আবার এতদঞ্চলের বিহারী ডাকাতদের বামামোহন ক্ষমতা বিষয়েও সে বিলকুল ওয়াকিবহাল। কাজেই সে আকুল হয়ে প্যাকাল মাছের পিচ্ছিল ভঙ্গিতে ডাকাতদের চোখ এড়িয়ে সটান চলে আসে গাঁয়ের মাঝখানে নীলমণি গোঁসাই-এর উঠোনে। 

মহন্তেরই এক ভায়াদ সাড়ে চার ফুট উচ্চতার নীলমণি গোঁসাই-এর প্রতাপ দৌর্দন্ড। তার কাড়বাঁশের নিশানা অভ্রান্ত। জমি দখলের প্রয়োজনে দাঙ্গাহাঙ্গামায় নায়েব-গোমস্তারা তাকে সুপারি-হলুদ পাঠিয়ে থাকেন। বেশ কয়েকজন লায়েক অনুচরও আছে তার। বছর দুয়েক আগে একখণ্ড জমি নিয়ে মহন্ত’র সঙ্গে তার বিবাদ হয়। মহন্ত’র ভাড়া করা পশ্চিমা লগদিদের মজবুত চামড়ার ঢালে নীলমণি ও তার লায়েক চ্যালাদের কাঁড় মুখ থুবড়ে পড়ে। নীলমণিকে জমির দখল ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়। সেই মহন্তের বাড়িতে ডাকাত পড়লে তাতে নীলমণির কোন দায় থাকার কথা নয়। তবুও জেগে উঠে তার রক্ত গরম হয়ে গেল। গোরাচাঁদ আবার তাতে তাত দ্যায়, -- বিহারী ডাকাতের এতই আস্পর্দা যে নীলমণি গোঁসাই-এর ভায়াদের বাড়ি আগাম পত্র না পাঠিয়েই ডাকাতি করতে আসে! পত্র যে পাঠায়নি সেটা মহন্ত’র খাস মাইন্দার গোরাচাঁদ জানবে না? 

সারা গাঁ জেগে গিয়ে তখন নীলমণির দুয়ারে। তার লায়েক চ্যালারাও কাঁড় কাঁড়বাঁশ পিঠে হাজির। এখন শুধু গুরুর আদেশের অপেক্ষা। গোরাচাঁদ নীলমণির পায়ের ধুলো নিয়ে তাড়া লাগায়। মহন্ত বাড়িতে ডাকাতদের অধিকক্ষণ অবস্থানে তার কপাল পোড়ার সমূহ সম্ভাবনা। 

অবশেষে কুলকুলি দিতে দিতে নীলমণি আর তার চ্যালারা কাঁড় কাঁড়বাঁশ বাগিয়ে মহন্ত বাড়ি ঘিরে ফেলল। 

মহন্ত বাড়িতে ডাকাত আসার আগে থেকেই আর একজন জেগে বসেছিল সেই রাতে। মহন্তবাড়ির বালবিধবা, পবিত্রতার অনুশাসনে বদ্ধ জীবন, অনাত্মীয় পুরুষদর্শন ও আমিষআহার যার নিষিদ্ধ, সাদা থানের শুচিশুভ্র আবরণ ঠেলে যার যৌবন তবুও ছলকাতে চায়। ডাকাতেরা যখন দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে, এঁদো পুকুরের ক্লেদ ঝেড়ে ফেলে নদীপ্লাবনের গন্ধ পেতে সে উল্লসিত উন্মুখ। বিহারী ডাকাতদের বলিষ্ঠ দেহসৌষ্ঠব মানভুমে কিংবদন্তী। কেষ্টঠাকুর যখন তীর্থবালার গয়না ছিঁড়ছে সে তখন চৌকাঠে পা দিয়ে লণ্ঠনের আলোয় নয়ন সার্থক করছে। গয়না হস্তগত করে কেষ্টঠাকুর তার দিকে তাকিয়েই থ বনে গেল। চকচকে চোখে বুনো টান, মহন্ত বাড়িতে এমন রত্ন! কেষ্টঠাকুর নিমেষে সম্মোহিত। 

নীলমণির ছোঁড়া প্রথম কাঁড়টিই মহন্ত বাড়ির ভাঙা কপাটে বিঁধে থিরথির করে কাঁপতে লাগল। তারপরেই এদিক ওদিক থেকে সাঁ সাঁ করে কাঁড় ভেসে আসতে লাগল। সচকিত সর্দার ‘মাছি মাছি’ চিৎকারে জানান দিল দলকে। অন্ধকার রাতে কাঁড় অতি ভয়ানক অস্ত্র। সর্দারের পেছনে জড়ো হয়ে মহন্ত’র বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়ে একটা দিক খালি করে সবাই বেরিয়ে গেল মহন্ত বাড়ি থেকে। আতঙ্কিত সর্দার খেয়ালই করল না একটি মাছি গুড়ে লেটকে পড়ে রইল।

0 comments: