রম্যরচনা : অদিতি ভট্টাচার্য্য
Posted in রম্যরচনা
রম্যরচনা
চক্রব্যূহ
অদিতি ভট্টাচার্য্য
ঠং ঠং ঠং ... আওয়াজে কান ঝালাপালা হয়ে যাবার জোগাড়। তার মধ্যেই ঘরে বসে খাতাগুলোর দিকে তাকিয়েছিল দিশা। স্কুলে হঠাৎ করে ছুটি পড়ে গেছে অস্বাভাবিক গরমের জন্যে। এক সপ্তাহের ছুটি। তার আগে তিনটে ক্লাসের ক্লাস টেস্ট হয়েছে। তারই খাতা জমা হয়েছে। এখন দেখে ফেলতে পারলে ভালো হত, সে চেষ্টাই করছিল, কিন্তু পারল না। না পারার যথেষ্ট কারণ আছে। বাড়িভর্তি মিস্ত্রি। নানান কাজের নানান ধরণের মিস্ত্রি। আর এই মুহূর্তে দিশা বাড়িতে একা। তুহিনের আজ অফিস কামাই করা সম্ভব নয়, কী যেন জরুরি কাজ আছে। শাশুড়ি সম্প্রতি খুব ভুগে উঠেছেন। তার মধ্যে এই আওয়াজ, ধুলোবালি – এসবে অসুবিধে হবে বলে তাঁকে তাঁর বোনের বাড়ি পাঠানো হয়েছে। ক’দিনের জন্যে। আর ছোট্ট ঝিমলিকে তার দিদা দাদু নিয়ে গেছেন, এই হট্টগোলে তার না থাকাই ভালো বলে।
বাড়িটা পুরোনো হচ্ছে, ঠিকঠাক করা দরকার, তাই মিস্ত্রির দরকার পড়েছে। রান্নাঘরটার অবস্থা তো খুবই খারাপ হয়েছিল। সেখানে রাজমিস্ত্রিরা পুরোনো স্ল্যাব ভেঙে ফেলেছে, মেঝে খুঁড়ে ফেলেছে। সেখানে অবস্থা আরো সাংঘাতিক। বাথরুমের কল খারাপ হয়েছে, সেখানে কলের মিস্ত্রি পুরো বাথরুম জুড়ে যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঠকঠক করেই যাচ্ছে। এদিকে যা গরম পড়েছে, ঘরে এ.সি. না লাগালেই নয়। এ সি র মেকানিক এসে দেখে সব বলেটলে গেছে। এখন ইলেকট্রিশিয়ান এসে এ.সি. র লাইন করছে প্লাস ধাঁই ধপাধপ করে দেওয়ালে ফুটো করছে! এ.সি. র পাইপ বেরোবে না। এ কাজটা এ.সি. র লোকেদেরই করার কথা কিন্তু তারা সাফ বলে দিয়েছে, “গর্ত, লাইনটাইন করে একদম রেডি রাখুন। আমরা মেশিন নিয়ে এসে ফিট করে দিয়ে চলে যাব। হেভি চাপ এখন। নাহলে ওয়েট করুন, গরমটা যাক, তখন দেখা যাবে।”
শুনেই দিশা হাঁ হাঁ করে উঠেছিল, “গরমটা যাক আবার কী কথা! এ.সি. তো গরমেই দরকার!” তাই পরিচিত ইলেকট্রিশিয়ানকেও ডাকা হল। দিশা ভেবেছিল এক সপ্তাহের ছুটি পাচ্ছে, মেয়ে শাশুড়িও কেউ নেই – এই সুযোগেই সব মিটিয়ে নেওয়া ভালো।
তুহিন কিন্তু বলেছিল, “পারবে তো এতগুলো সামলাতে? আমি কিন্তু ওই উইকটা পুরো ছুটি নিতে পারব না।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ম্যানেজ করে নেব আমি,” বলে তো ছিল দিশা তখন, কিন্তু এখন এই মিস্ত্রি পরিবৃত অবস্থায় বুঝছে কত ভুল বলেছিল।
ওদিকে আবার ঘরে রঙও শুরু হয়েছে, সব মিলিয়ে একেবারে নাজেহাল অবস্থা দিশার।
ইলেকট্রিকের মিস্ত্রি লাইন করছিল, দিশাও ঘরে খাতা খুলে বসেছিল। কিন্তু যেই ড্রিলিং মেশিনের আওয়াজ আর ছেনি হাতুড়ির ঠং ঠং শুরু হল, এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারের ফর্মুলাও দিশার কাছে যেন হিব্রু ভাষা মনে হতে লাগল।
ছেনির আওয়াজ একবার থামতে শুনল, “বৌদি বৌদি” করে আর্তরবের মতো ভেসে আসছে ।
দিশা দৌড়ল, “কী হল?” বাথরুম জলে ভেসে যাচ্ছে! “সর্বনাশ! কী করে হল?”
কলটা পালটাতে গিয়ে কী করেছে তা তারাই জানে, কল তো পালটাতে পারেই নি, উলটে কল আর বন্ধই হচ্ছে না, জল পড়েই যাচ্ছে।
“ট্যাঙ্কের জল তো সব শেষ হয়ে যাবে,” দিশা প্রায় ডুকরে উঠল।
“পেরায় ঠিক করে এনেছি, ওয়াশারটা গেছে। ঠিক হয়ে যাবে, তাও আপনারে জানায়ে দিলাম,” প্লামবার এক গাল হেসে বলল।
ওর সহকারী ছেলেটার মুখে যদিও একটুও হাসি নেই। বোধহয় নতুন কাজে ঢুকেছে, এসব দেখা বিশেষ অভ্যেস নেই। বৌদি বৌদি করে আর্তনাদও বোধহয় ওই করছিল।
“যা করার তাড়াতাড়ি করো, জল পড়া বন্ধ করো। নইলে মুশকিল হয়ে যাবে,” বলল দিশা।
ছোটো ঘরটা, যেটা অদূর ভবিষ্যতে ঝিমলির ঘর হবে, সেখানে খুব গুলতানি হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে।
“এরা কি শুধু গল্পই করে যাচ্ছে? কাজের নাম নেই? ভেবেছে আমি বোধহয় দেখছি না। উফ্, আর পারা যায় না! যাই, দেখি গিয়ে কী করছেন মহাশয়রা!” দিশা ছোটো ঘরের দিকে রওনা দেয়।
গিয়ে যা দেখল তাতে চক্ষুস্থির হয়ে গেল। দেওয়ালে লাইট ক্রিম রঙ লাগানো হচ্ছে বর্তমান বাজার দরের আলোচনা করতে করতে!
“এ কী করছ! ক্রিম রঙ এ ঘরে দিচ্ছ কেন?”
“কেন বৌদিমণি, কিরিমই তো এ ঘরে হবে,” হেড মিস্ত্রি বেশ কনফিডেন্ট।
“কে বলল ক্রিম হবে?” ধৈর্য হারিয়ে দিশা চেঁচিয়ে ওঠে, এত দামী রঙ, নষ্ট হলে রাগ হবারই কথা, “সকালে যে পাখি পড়া করে বোঝালাম যে এ ঘরে পিঙ্ক হবে আর খাটের মাথার কাছটা, হ্যাঁ ওই দেওয়ালটার ওখানটা ছেড়ে রাখবে, কোম্পানির লোক এসে রঙ করবে, তখন কি কিছুই শোনো নি?”
“এখানে পিঙ্ক? তাহলে কিরিম কোথায় হবে? এক কাজ করি, হয়ে যখন গেছে, তখন এই দেওয়ালটা কিরিমই থাক, অন্যগুলো নাহয় পিঙ্ক.........”
“না না তা হবে না। এক কোট হয়েছে সবে, ওঠাও তোমার কিরিম, পিঙ্ক করো।”
“ঠিক আছে, এ ঘরটা এখন ছাড়ি। এটা শুকোক, আবার ঘষে তুলতে হবে। ডাইনিংটা ধরি,” হেড মিস্ত্রি বলে।
“তাই ধরো। ওখানের রঙটা মনে আছে তো? লাইট স্কাই ব্লুটা হবে,” বলল দিশা।
“হ্যাঁ হ্যাঁ। আর গোলমাল হবে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।”
মিস্ত্রিরা ছোটো ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, দিশাও চলে আসে গজগজ করতে করতে, “ভাগ্যিস আমি দেখতে গেলাম, নাহলে যে কী হত। এখন আবার রঙ কিনতে না হয়। ক্রিমটা যদি কম পড়ে যায়!”
“বৌদি, এদিকে আসুন, প্লাগ পয়েন্টটা কোথায় করব দেখুন,” দিশার ঘর থেকে ইলেকট্রিশিয়ানের হাঁক।
ঘরে ঢুকে অবস্থা দেখে দিশার কান্না পেল। টুকরো ইঁট, বালি ঘরময় পড়ে। দেওয়ালে গর্ত হয়ে গেছে, দিব্বি এক টুকরো আকাশ সেখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে।
“কত তাড়াতাড়ি গর্তটা করে দিলাম দেখলেন?” ইলেকট্রিশিয়ান ছেনি, হাতুড়ি গোছাতে গোছাতে বিজয়গর্বে বলে।
সবে প্লাগ পয়েন্টের জায়গাটা দেখিয়েছে দিশা এমন সময় রঙের মিস্ত্রির ডাক, “এদিকে একবার আসেন বৌদিমণি, আপনার জলের মেশিনটা কোথায় রাখব?”
জলের মেশিন? মানে অ্যাকোয়াগার্ড? ওটা ওরাই খুলে ফেলল! সর্বনাশ! ঠিকঠাক খুলেছে তো? খাবার জল ভরা আছে? দ্রুত পায়ে সেদিকে যেতে যেতে এক ঝলকে দিশা দেখল ঘরে যে জলের বোতলটা এনে রেখেছিল, তার জল প্রায় শেষ, এক চুমুক মতো হবে। যা ভেবেছে ঠিক তাই! একটা বোতলও ভরা নেই! এখন এদেরই কাউকে পাঠাতে হবে পাশের বাড়ি থেকে জল ভরে আনতে।
“অ্যাকোয়াগার্ডটা খুলে ফেলেছ! রাখো, ওই পাশে রাখো। ঠিকঠাক রঙ কোরো। স্কাই ব্লু হবে, মনে আছে তো?” দিশার গলাই শুকিয়ে গেল।
একবার রান্নাঘরটা ঘুরে এলে হয় না? ওখানটায় খুব ধুলো বলে যাচ্ছিল না, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না।
রান্নাঘরের দরজার কাছে গিয়েই দিশা আঁতকে উঠল! “এ কী! ওই স্ল্যাবটা কী করে ভাঙল? তোমাদের তো শুধু এ দুটো ভাঙতে বলা হয়েছে।”
“পাশেই তো, এটা ভাঙতে গিয়ে ওটা একটু ড্যামেজ হয়েছে। একদিকে ভালোই হয়েছে। ওটাও না পালটালে ঠিক ম্যাচ করত না। এটা তো ছোটো স্ল্যাব, এই মাপের একটা পিস এনে দেবেন, কাল লাগিয়ে দেব। অন্য রকমও আনতে পারেন, ডিজাইন হবে,” ম্যাচিং, ডিজাইন – এসব সম্পর্কে রাজ মিস্ত্রির জ্ঞান বেশ উচ্চ পর্যায়ের বোঝা গেল।
দিশা কথা বলার ক্ষমতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। স্ল্যাবের দিক থেকে নজর ঘুরিয়ে দেখল মিস্ত্রিরা ব্যাগ গুছিয়ে যাবার জন্যে রেডি।
“তোমরা এখন চলে যাচ্ছ কেন? সবে তো আড়াইটে বাজে!” দিশার গলা দিয়ে যেন স্বর বেরোচ্ছে না।
“আজ তাড়া আছে দিদি। ওইজন্যে কত তাড়াতাড়ি টিপিন করে নিলাম দেখলেন না? কাল সকাল সকাল চলে আসব,” দিশার সামনে দিয়েই বেরিয়ে যায় দুজনে।
এই সময়েই প্রবল একটা ঠং আওয়াজ শুনে দিশা পড়ি কী মরি করে দৌড়ল। বাথরুমে আবার কী হল কে জানে!
কলের মিস্ত্রির মুখে চওড়া হাসি, হাতে পুরোনো কলটা ধরা, “দেখছেন বৌদি, এক্কেরে জ্যাম হয়ে গেছিল। কয় বচ্ছরের কল বৌদি? দেখেন তাও খুলে ফেলছি! এবার আপনার এই নতুন ঝকঝকে কল লাগিয়ে দেব। কিচ্ছু ভাববেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
দিশা কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই, “বৌদি।” এবার ইলেকট্রিশিয়ানরা। তারাও চলে যাচ্ছে।
“তোমরাও চললে? কাজ সব শেষ হয়েছে?” দিশা জিজ্ঞেস করে।
“হ্যাঁ সব কমপ্লিট।”
ঘরে এসে দিশা দেখল এ.সি.র লাইনটা হয়ে গেছে।
“গর্তটা কিছু দিয়ে বন্ধ করো নি কেন! বললাম যে ওই প্লাস্টিকগুলো ঢুকিয়ে আপাতত বন্ধ করো।”
“গর্ত বন্ধ করার কী দরকার?” ইলেকট্রিশিয়ানদের দুজনেরই মুখ ব্যাজার, “ওইটুকু গর্ত, থাক না আছে। গরমকাল, অসুবিধে তো নেই, একটু নাহয় বাতাস ঢুকলই। তাছাড়া কাল পরশুই তো এ.সি. বসবে।”
“না না তোমাকে আর ওই গর্ত খোলা রেখে বাতাস ঢোকাতে হবে না!” দিশা বলে উঠল।
প্যাঁচার মতো মুখ করে ওদের একজন আবার মই-এ চড়ে গর্তে গুঁজে গুঁজে প্লাস্টিক ঢোকাল। তখনই দিশার মনে পড়ল, আরে ড্রয়িং রুমের টিউবলাইটটা তো খারাপ হয়েছে, ওটা তো ঠিক করল না, ওটাও তো ঠিক করার কথা ছিল। এখন মনে পড়তেই বলল।
“ওটা এখন হবে না। অন্য কাজ আছে। একটা ফ্ল্যাটের ওয়্যারিং হচ্ছে। দুবার ফোন করেছে তারা এর মধ্যে। নেহাত দাদা কালকে অনেক করে বলে গেছিল তাই এটা করে দিলাম। দেখি যদি পারি তো পরশু আসব,” তাদের সাফ জবাব।
ওরা চলে যেতেই দিশা ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। যে যেমন পারছে কাজ করছে, যখন খুশী চলে যাচ্ছে – কোনোটাতেই দিশার কোনো হাত নেই। এক সপ্তাহ ছুটি পেয়ে খুব ভেবেছিল কাজগুলো শেষ করে ফেলবে, শুধু রঙের কাজটা বাকি থাকবে। কিন্তু এখন দেখছে তা নয়। এদের কাজে লাগানো দিশার ইচ্ছেয় হয়েছে, কিন্তু এদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়াটা ওর ইচ্ছেয় হবে না, একেবারেই নয়। সেটা পুরোপুরি নির্ভর করছে এদের মর্জির ওপর, বেশ বুঝতে পারছে দিশা। মনে হচ্ছে যেন একটা চক্রব্যূহে আটকে পড়েছে, ঢুকতে তো পেরেছে, কিন্তু বেরতে পারছে না! ঠিক যেন অভিমন্যুর মতোই!
0 comments: