প্রবন্ধ : রিয়া চক্রবর্তী
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
পটশিল্পের ইতিহাস
রিয়া চক্রবর্তী
পট কথাটির অর্থ কাপড়, এটি সংস্কৃত পট্ট শব্দ থেকে এসেছে। পট চিত্র কাপড়ের টুকরোর ওপরে আঁকা হয়। পট চিত্রের প্রাচীনত্ব জানতে গেলে পৌঁছতে হবে সেই বুদ্ধ দেবের সময়ে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শতকে। যে সময়ে বুদ্ধদেব স্বয়ং 'চরণচিত্রের' প্রশংসা করেছিলেন যা ছিল পট চিত্রের উত্তরসূরি। এই চরণচিত্রে একটি ছবির নীচে আর একটি ছবি আঁকা হয়।বুদ্ধদেবের সমসাময়িক আজীবক ধর্মমতের প্রবর্তক গোসাল ছিলেন এক চিত্রকরের ছেলে। তিনি নিজে সন্ন্যাস গ্রহণের আগে তাঁর বাবার মতোই ছবি দেখিয়ে বেড়াতেন। বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে যেমন, পাণিনি, পতঞ্জলির গ্রন্থেও তেমন এক শ্রেনীর চিত্রকরের উল্লেখ আছে যারা গান গাইতে গাইতে ছবি দেখিয়ে পথিকদের মনোরঞ্জন করতেন। বাণ তাঁর 'হর্ষচরিত'এ বর্ণনা করেছেন যে হর্ষবর্ধন থানেশ্বর নগরীতে ঢোকার মুখে এমন এক পট্টিকার কে দেখেন যিনি এক হাতে ঝোলানো পট খুলে খুলে গান গেয়ে ' যমপট' দেখাচ্ছিলেন। ঠিক এইভাবে পরবর্তীতে বাংলার পট চিত্রেও দেখা যায় ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত একই ভাবে কাহিনীর ঘটনা গুলো পরস্পর আঁকা হয়েছে। বাংলার পটুয়ারা ঠিক এই ভাবেই যুগ যুগ ধরে বাংলার গ্রামে গঞ্জে 'যমপট' ও আরও নানান পট দেখিয়ে বেড়াতেন।
আগে পট চিত্র আঁকা হোত কাপড়ের ওপরে খড়িমাটির জমি তৈরি করে। পরে জমির বদলে কাগজ আটকে । পট দু'রকম ১/ আয়তকার অর্থাৎ ‘ চৌকস পট’ এবং ২/ দুহাত চওড়া ও বারো থেকে পঁচিশ হাত লম্বা ‘ জড়ানো পট’ । প্রাচীন কালে এই ‘জড়ানো পট’ অর্থাৎ কাঠের দণ্ডে গোটানো পট চিত্রই ‘যমপট’ নামে পরিচিত হয়ে আসছে। পটুয়া অর্থাৎ যারা পট চিত্র তৈরি করেন, তারা এই রকম পট দেখিয়েই গান গেয়ে লোক শিক্ষা ও মনোরঞ্জন করতেন। সেই দিক থেকে দেখলে পটুয়ারা যে শুধু চিত্রকর ছিলেন তা নয়, একাধারে তারা ছিলেন কবি- গীতিকার এবং সুরকার ও বটে। ধর্মমত ও নীতিজ্ঞানে তারা যে কতখানি সমৃদ্ধ ছিলেন তার পরিচয় তাদের গানেও পাওয়া যায়। সমাজের নিম্ন বর্গের মানুষের শিক্ষা দানের দায়িত্ব তারা সফলতার সাথেই পালন করে গেছেন। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, মঙ্গলকাব্য, ও চৈতন্য জীবন অবলম্বনে পট এঁকে মানুষের জ্ঞানের দিক আরও প্রসারিত করেছেন।
পট চিত্রকররা নানা জায়গায় নানান নামে পরিচিত। উত্তর পশ্চিম বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় ‘পটিদার’, বীরভুমে ও মেদিনীপুরের কোন কোন অঞ্চলে ‘চিত্রকর’। এবং দক্ষিণপশ্চিম বাংলায় ‘পটুয়া’ নামেই পরিচিত। পটুয়ারা সাধারণত দরিদ্র শ্রেনীর অন্তর্ভুক্ত। তবে এর মধ্যে বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার পটুয়ারা মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলী, ও চব্বিশ পরগণার পটুয়াদের থেকে অনেক বেশী পিছিয়ে। আর এই দুই পর্যায়ের পটুয়াদের মাঝখানে বীরভুমের পটশিল্পীদের স্থান। বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার পটুয়াদের বাস উপজাতি সমাজে। তাঁদের মধ্যে তাই পরিশীলিত আচার - আচরণের বদলে বরং চোখে পড়ে আদিবাসী সারল্য। আর মেদিনীপুর, দক্ষিণ - পশ্চিম বঙ্গ ও আংশিক বীরভূমের পটুয়াদের বাস হিন্দু সমাজের কাছাকাছি। ফলে তারা অনেকটা পরিশীলিত হয়ে উঠেছেন, এবং তাঁদের পেশাগত অমর্যাদা সম্পর্কে ক্ষোভ অনেক বেশী। এই সামাজিক অবিচারের কারণেই সমতল বাংলার অনেক পটুয়া হিন্দু সমাজের প্রান্তরবাসী হয়ে থাকার চেয়ে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করাই উচিৎ বলে মনে করেছেন।
এর কারণে তারা যে শুধু মুসলমান সমাজে মর্যাদা পেয়েছেন তা নয় তবে হিন্দু সমাজের অপশাসন থেকে অনেক খানি রেহাই পেয়েছেন। সাধারণ ভাবে নিজেদের মুসলিম বললেও এই পটুয়ারা কিন্তু পীর, গাজির পটের সাথে হিন্দু দেবদেবী , পুরাণ, মহাকাব্য, মঙ্গল কাব্য ইত্যাদির পটও দেখিয়ে বেড়ান ঘরে ঘরে। এঁদের জীবন ধারণ নির্ভর করে হিন্দু- মুসলিম উভয় সম্প্রদায় মানুষের আনুকুল্যের ওপর। এরা তাই সব সময়েই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে। এমন কি তাঁরা চান হিন্দু ধর্মের সম্প্রদায় গুলির মধ্যেও পারস্পরিক মিলন। তাই দেখা যায় বীরভুমের পটুয়ারা আঁকেন পঞ্চ কল্যানী পট।এই পটের বিভিন্ন অংশে যথাক্রমে – মনসা, কালী, কাত্যায়নী, রামপ্রসাদ, নিমাই সন্ন্যাস, মহিষাসুরমর্দিনী, এবং রামের সভা দেখানো হয়েছে সকলের মনঃতুষ্টির জন্য, মিলনের জন্য। অবস্থান ও পরিবেশ অনুযায়ী বিভিন্ন শৈলীতার বিচারে বাংলার পটচিত্রকে মোটামুটি চার ভাগে ভাগ করা যায়। ১/ সাঁওতাল উপজাতির জন্মকথা ও তাদের মধ্যে প্রচলিত ‘ চক্ষুদান পট’ ২/ ‘যমপট’ ৩/ ‘গাজিপট’ ৪/ হিন্দু পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, কৃষ্ণলীলা, ও চৈতন্য লীলা পট।
১/ ‘চক্ষুদান পট’- এই পটের প্রচলন সাধারণত পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার উত্তর- পশ্চিম অঞ্চলে। এই অঞ্চলের অধিবাসীরা প্রধানত সাঁওতাল।তাই এখানকার পটচিত্র শিল্পীরা সাঁওতাল উপকথা অনুযায়ী তাদের জন্মকথা চিত্রিত করতেন। এই উপকথাকে ‘কো রিয়াক কথা’ বলা হয়ে থাকে। এর কাহিনী ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত মোট পাঁচটি ভাগে ভাগ করে আঁকা হতো।
প্রথম ভাগে; জন্মলগ্ন পৃথিবীতে আকাশে উড়ছে হংস ও হংসী, কোথাও তাদের বসার মতো একটুকুও জমি নেই।
দ্বিতীয় ভাগে; একটা কেঁচো সেই থৈ থৈ জলের মধ্যে মাটির একটা সামান্য ভিত গড়ে তুলেছে।
তৃতীয় ভাগে; হংস ও হংসী সেই কেঁচোর তৈরি করা ভিতে বসে দুটো ডিম পেড়েছে।
চতুর্থ ভাগে; সেই দুটি ডিম থেকে জন্ম নিল একজন পুরুষ ও একজন নারী।
পঞ্চম ভাগে; এই প্রথম নারী পুরুষের মিলনে জন্ম নিল প্রথম সাঁওতাল।
এই ভাবে সাঁওতাল সমাজ ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এবং সংখ্যায় বাড়তে থাকে। যদি এই সমাজে কোন পুরুষ, শিশু অথবা নারী মারা যেতেন, তখন এই শিল্পীরা মৃতের একটি কল্পিত ছবি এঁকে হাজির হতেন সেই বাড়িতে যেখানে কোন সদস্য মারা গেছেন। এবং লিঙ্গ ভেদে ও বয়স ভেদে সেই মৃতের সাথে কল্পিত ছবির তুলনা করে রং ও রেখায় ছবিটি সম্পূর্ণ করলেও চোখের তারার জায়গা কিন্তু খালিই রাখতেন। এবং সেই মৃতের শোকগ্রস্ত পরিজনদের চোখের তারা বিহীন ছবি দেখিয়ে বলতেন চক্ষুহীন অবস্থায় মৃতজন পরলোকে ঘুরে ঘুরে কষ্ট পাচ্ছেন । এবং সেই পরিবারের কাছ থেকে ভুজ্জি পেয়ে চোখের তারা এঁকে দিলে তবেই মৃত জন পরিত্রাণ পাবেন, এইভাবে মৃতজনের পরিবারের কাছ থেকে টাকা, কড়ি ও অন্যান্য জিনিষ পত্র নিয়ে ছবিটিতে চক্ষুদান করেন পটুয়ারা। এটাই হল ‘চক্ষুদান পট’ আর যেসব পটুয়ারা এই চক্ষুদান পট আঁকতেন তাদের বলা হতো ‘জাদু পটুয়া’ । এই ম্যাজিক চরিত্র আঁকার জন্যই এই পটুয়াদের নাম জাদু পটুয়া। সাঁওতাল ছাড়াও এই পটের প্রচলন দেখা গেছে পূর্ব বঙ্গের ভেদিয়া উপজাতির মধ্যে। এই উপজাতি পটুয়ারা চক্ষুদান পট ছাড়াও বাঘ, সিংহ প্রভৃতি পশু দেবতাদের ছবিও এঁকেছেন।
২/ ‘যমপট’- যমপট ও চক্ষুদান পটের মানসিকতাতেই পারলৌকিক বিষয় নিয়ে আঁকা। তবে এই পট সমতল বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচারিত হয়ে এসেছে। এতে যম অর্থাৎ ধর্মরাজের বিচারে দণ্ডিত মৃত ব্যাক্তির নরক যন্ত্রণা আর পুরস্কৃত ব্যাক্তির স্বর্গসুখের কাহিনীই এঁকে বর্ণনা করা হয়েছে। দণ্ডিত মৃত পাপীর নরক যন্ত্রণার দৃশ্যগুলি ভয়ানক ও বীভৎস। অন্যদিকে স্বর্গে প্রেরিত ব্যাক্তির স্বর্গ রমনীদের সাথে কামকেলীতে রত দৃশ্যগুলি আকর্ষণীয়। কিন্তু এই দুই ক্ষেত্রের চিত্রাঙ্কনই অমার্জিত। তবে এই যমপটের গুরুত্ব অবশ্যই শিল্পকর্ম হিসেবে নয়, এর গুরুত্ব নীতি শিক্ষার বাহক হিসেবে।
৩/ ‘গাজিপট’- এই পটগুলি হল মুসলমানি পট। পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার মুসলিম যোদ্ধা ও গাজি - পীরদের বীরত্ব ও অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ বর্ণনা করা হয়েছে এই শ্রেনীর পটে। তাই এগুলো ‘গাজিপট’ নামেই খ্যাত। এই ‘গাজিপটের’ মধ্যে লৌকিক ব্যাঘ্র দেবী বনবিবির ছবিও দেখতে পাওয়া যায়। অঙ্কনরীতিতে এই পট অন্যান্য পটের তুলনায় পিছিয়েই ছিল। তবে কালু গাজির পট বাংলাদেশের কুমিল্লা, ফরিদপুর ও বরিশাল জেলায় বিশেষ জনপ্রিয়। মৈমনসিংহ জেলাতেও পটচিত্রের যথেষ্ট প্রচলন ছিল।
৪/ ‘হিন্দু পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, কৃষ্ণলীলা, ও চৈতন্য লীলা পট’- সমতল বাংলার কৃষিজীবী মানুষের মধ্যে এই পটচিত্রগুলির গুরুত্ব অনেক বেশী ছিল। হিন্দুদের এই প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ধর্মগ্রন্থগুলির কাহিনী নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সব জেলাতেই পট আঁকা হয়েছে। এর মধ্যে মেদিনীপুরের কৃষ্ণলীলা ও মঙ্গলকাব্যের, বর্ধমান ও নদীয়ার চৈতন্যলীলার এবং বীরভুম ও বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার শাক্ত ও বৈষ্ণব বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে মনসা মঙ্গলের জনপ্রিয়তা ছিল অনেক বেশী। রচনাশৈলীর বিচারেও এই পটের শিল্পীর দক্ষতা ছিল অনেক বেশী স্পষ্ট।
এই সব চিত্রে আদিম মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। কালো, গাঢ় খয়েরি, হলুদ ও কিছু কিছু গাঢ় লালের ব্যবহার দেখা যায়। অবশ্যই সাদা কাপড়ের ওপরে। এর তুলনায় গাজি পটের রঙের ব্যবহার ও রেখা কিছুটা উন্নত। তবে এই সব পটে আদিম চিত্ররীতিরধারাই বেশী। হিন্দু পুরান, মহাকাব্য, মঙ্গলকাব্য নির্ভর পটচিত্রগুলো অনেক বেশী উন্নত রঙের ও রেখার ব্যবহার চোখে পড়ে। যেমন প্রাথমিক লাল, হলুদ, নীল রঙে সীমাবদ্ধ না থেকে একাধিক বর্ণের ব্যাবহার মুগ্ধ করে।
গ্রাম বাংলার পটচিত্রের পরম্পরা এসে পড়ে কালীঘাটে। এখন বাঙালির নিজস্ব এক শিল্প- অভিব্যক্তি হিসেবে দেশে ও বিদেশে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে কালীঘাটের পট। তবে গ্রামের পটচিত্রের পাশাপাশি কালীঘাটের পটে নাগরিক চরিত্র খুব সহজেই চোখে পড়ে। কালীঘাটের পট যতই পৃথিবী বিখ্যাত হোক না কেন তার সৃজনশীলতার কালে এই পটশৈলীর আবেদন শিক্ষিত বাঙালির সমাজে ছিল নিকৃষ্ট চিত্রকর্মের উদাহরণ। তখনকার ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি সমাজে দুই শ্রেণীর চিত্রকলার প্রচলন ছিল ১/ উন্নতমানের ২/ নিম্নমানের। উন্নতমানের চিত্রকলার ধারা বলতে বোঝানো হতো জয়পুরের চিত্রকলা, আর নিম্ন মানের চিত্রকলা বলতে বোঝানো হত পটুয়াদের আঁকা ছবি। যেগুলো কালীঘাট ও তারকেশ্বরের হাটে এক পয়সা থেকে এক আনা মুল্যে হাজার হাজার বিক্রি হতো। আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে, তখনও কালীঘাটের পটের গৌরব উজ্জ্বল সেই সময়ে গ্রামবাংলার হাটে, বাজারে ছবির চাহিদা ছিল আকাশছোঁয়া। কালীঘাটের পটের সূচনা ঠিক কোন সময়ে তা স্পষ্টকরে বলা যায় না, তবুও মনে করা হয় উনিশ শতকের প্রথমের দিকে এই পটচিত্রের সূচনা হয়। আর বিশ শতকের প্রথম দিকেও এই চিত্রের ব্যবহার ছিল। এবং এই চিত্রের অবলুপ্তি ঘটে ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে।
সাধারণত রুজি রোজগারের জন্যই গ্রামবাংলার পরম্পরাগত শিল্পীরা এসে হাজির হয়েছিলেন ব্যবসা- বানিজ্যে সরগরম এই কলকাতায়। বিশেষ করে কালীঘাটের আশেপাশে। পটুয়া ও চিত্রকর এই দুই পদবি থেকেই অনুমান করা যায় কালীঘাটের পটুয়াদের আদি নিবাস ছিল প্রধানত দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ও মেদিনীপুরে। উনিশ শতকে কলকাতার জীবন বইতো দুই ধারায়। একদিকে ছিল সাহেব পাড়া আর অন্যদিকে ছিল দেশী পাড়া। এই দুই অধিবাসীদের বিলাস-ব্যসনের দেখা মিলত কালীঘাটের পটে। সাহেব-বিবি প্রতিকৃতি, হাতিতে চেপে সাহেবের বাঘ শিকার, ঘোড়দৌড় ইত্যাদি ছবিতে রয়েছে সাহেব পাড়ার চিত্র। অন্যদিকে উচ্চবিত্ত বাঙালি বাবু কালচারের যে চিত্র টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল’, কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ বইদুটোতে যা পাই তারই চাক্ষুষ নিদর্শণ রেখে গেছেন কালীঘাটের পটুয়ারা তাঁদের পটচিত্রে।
কালীঘাটের শৈলীর বিশেষত্ব তার আঙ্গিকে নয় তার রূপাদর্শে। তাই দেখা যায় দেবদেবী, কিংবা সাধারণ মানুষ সকলেরই রূপ নির্মাণ করা হয়েছে বিশেষ এক আদর্শ নিয়ে তার সৌন্দর্যবোধে। যেমন পটলচেরা চোখ, ধনুকের মতো ভ্রু বাবরি চুল, নধর বপু। এই গুলো ছিল কালীঘাটের পটচিত্রের বিশেষ ধারা। বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে কালীঘাটের পটুয়াদের প্রধান বিষয় ছিল দেবদেবীর চিত্র। এঁরা শুধুমাত্র যে কালীঘাট এর পটুয়া বলে কালীর পট আঁকবেন তা কিন্তু নয়। এঁরা দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, শিব, গনেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী, যশোদা, কৃষ্ণ, রাধা, রাম, সীতা, হনুমান, চৈতন্য, ইত্যাদি দেবদেবীর ছবিও এঁকে মনোরঞ্জন করতেন। দুর্গার নানান রূপ আঁকতেন, যেমন- গনেশ জননী, শিব- পার্বতী, অসুর দলনী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কৃষ্ণের নানান ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল যশোদা- কৃষ্ণ, রাধাকৃষ্ণ, ইত্যাদি।
গ্রাম বাংলার পটুয়াদের মতো কালীঘাটের পটুয়াদের আঁকা হয়েছে সেই জ্ঞান, শিক্ষা, আনন্দ, আর পুণ্যকে উদ্দেশ্য করে। রূপ নির্মাণের আদর্শে, পটরচনার উদ্দেশ্যের বিচারেও কালীঘাটের পটুয়ারা তাদের ধর্ম থেকে সরে যাননি। বরং আনন্দদানের ক্ষেত্রে কালীঘাটের পটুয়ারা স্বত্রন্ত্র হয়ে পড়েছেন গ্রামবাংলার পটুয়াদের থেকে। তাঁদের আঁকায় যেমন দেবদেবী ছিলেন তেমনই ছিল কলকাতার বাবু কালচার। যখন কোন শিল্পী আঁকেন জোড়া পায়রা, মাছ মুখে বেড়াল, সাপের মাছ গেলা তখন তার মধ্যে পুণ্যবোধের থেকে নীতি শিক্ষাই কাজ করে বেশী। সেখানে তিনি দর্শককে দিতে চান নির্মল এক আনন্দ। এই আনন্দ যে কেবল মাত্র গ্রাম বাংলার লতাপাতা ছেড়ে শহরের ‘চৌকস’ পট চিত্র আঁকার জন্য তা কিন্তু নয়। আনন্দদান ছিল নতুনের খোঁজে। নতুন নাগরিক পরিবেশে, ব্রিটিশ চিত্রকলার কাছাকাছি এসে, নতুন রসবোধের রঙে নিজেদের রাঙিয়ে কালীঘাটের পটুয়ারা গুনগতভাবেই অনেকটা আধুনিক হয়ে ওঠেন। আর তার ছাপ পড়ে তাঁদের পটচিত্রে। কেউ কেউ হয়ে ওঠেন প্রকৃত অর্থে আধুনিক শিল্পী। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – নীলমণি দাস, বলরাম দাস, এবং গোপাল দাস এবং একেবারে শেষের দিকে বিখ্যাত পটশিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নিবারণ চন্দ্র ঘোষ, কালিচরণ ঘোষ।
তবে বাংলার পটচিত্র নাগরিক মন জয় করে কেবল মাত্র কিছুদিনের জন্য। এই পটচিত্রগুলি ক্রমশঃ তাদের প্রাণশক্তি হারাতে থাকে জার্মান থেকে ছেপে আসা ‘ওলিওগ্রাফ’ এর চাপে। যেখানে একটি সুন্দরী মেয়ে অভিমান করে এক দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে, আর তার প্রেমিক যুবক সেই প্রেমিকার মানভঞ্জন না করে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে অভিমান করে। বিদেশী এই গুনগতমান দেশী পটচিত্রের থেকে অনেক বেশী। তাদের রঙের ব্যবহার, রেখার ব্যবহার অনেক উন্নত। এই অসম প্রতিযোগিতায় কালীঘাটের পটুয়ারা দুর্বল হতে থাকে এবং এক সময় সম্পূর্ণ পরাজিত হয়ে যায়। টান পড়ে তাঁদের রুজি রোজগারে। ক্ষিদের তাড়নায় তারা তখন পটচিত্র ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দিতে শুরু করেন। ক্রমে ক্রমে এই ভাবেই বিলুপ্ত হয়ে যায় পটশিল্পের এই সৃজনশীল ধারা।
এত বিপুল তথ্যসমৃদ্ধ অথচ শৈল্পিক প্রবন্ধ খুবই কম পড়েছি।
ReplyDeletesundor
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ বন্ধু এতো বড় লেখাটা দেওয়ার জন্য।বন্ধু Soumitra Chakraborty।
ReplyDeleteধন্যবাদ আপনাকে :) Deepak Roy
ReplyDeleteবেশ পরিশ্রমী লেখা । লেখার বাধুনিটাও বেশ ভালো । তথ্য সংগ্রহেও রিয়া আন্তরিক ছিলেন, বোঝা যায় । রিয়া লিখেছে "এই চিত্রের অবলুপ্তি ঘটে ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে "। কালিঘাটের পটুরা অবলুপ্তি শুরু হয়েছিল আরো অনেক অনেক আগেই । উনিশ শতকের কলকাতা 'বাবু কালচার' ইন্রাজ ও ফরাসী শিল্প প্রীতি, কলকাতার লিথোগ্রাফি প্রেসের উদ্ভব কালিঘাটের পটুয়াদের নির্মূল করেছিল ।
ReplyDelete