ছোটগল্প : অপর্ণা গাঙ্গুলী
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
জানলার যিশু
অপর্ণা গাঙ্গুলী
জানলার কাঁচে টোকা পড়ল আর ঠিক তখনই এদিকে মুখ ফেরালো বৃষ্টি l আজ একটু তাড়াতাড়ি অফিস যাবার আছেl তাই ট্যাক্সি নিতেই হয়েছে l এমনিতেই মনটা খচ্ খচ্ করছিল ওর l আজকাল ট্যাক্সি চড়লেই হাত পা বেচে দেবার মত অবস্থা l It does cost you an arm and a leg, really… কাঁচের ওপারে একটা রংচঙে মুখ এই সক্কাল সক্কাল l বছর ষোলো l লম্বা বেনী, এক হাতে ফ্যান এর মত ঘোরাতে ঘোরাতে বলল –‘দিদি কিছু দিয়ে দে, তোর ভালো হবে l'
‘আজ presentation টা পাস হবে তো ?’ মনে মনে বিড় বিড় করে বৃষ্টি l
দে বে দে, ছাড় তাড়াতাড়ি... হাতে তালি পড়ল l এরা আবার খুব ফাস্ট রেসপন্স চায়, কখন সিগনাল খুলে যায় l দশ টাকা দিল বৃষ্টি l লাস্যময়ী চলে গেল আবার বেনী নাচাতে নাচাতে l পরের কাঁচ খোলা গাড়িতে l ঠিক এই কারণেই, বৃষ্টি গাড়ির কাঁচ তুলে রাখে l অন্তত ও যেদিকটায় বসে, সে দিকে l ট্যাক্সি চালক আয়না দিয়ে বৃষ্টির মুখটা দেখে নেয় একবার l তারপর বলে ওঠে – ‘এই হয়েছে এদের আজকাল, এদের কারণে লোকে ট্যাক্সি চাপাও ছেড়ে দেবে দেখছি l খেটে খেতে পারে না l’
বৃষ্টি সংবেদনশীল মনের মেয়ে - ধীরে বলে, ‘কে ওদের কাজ দেবে বলুন .. আপনি আমি দেব?’ ধীরে কিন্তু দৃঢ়ভাবেই বলে, ট্যাক্সি ড্রাইভার চুপ l আসলে ড্রাইভার কে চুপ করানো ওর উদেস্শ্য l এখন আর কথা ভালো লাগছে না l আজ চাইল্ড ফান্ড এর প্রজেক্ট এর জন্য কয়েকজন বিদেশী আসছেন ওদের এন জি ওতে l এটা ওদের পেতেই হবে l শহরের শিশুদের নিয়ে একটা বিরাট কর্মযজ্ঞ করতে চলেছে ওরা l এখন অন্তত কিছুক্ষণ concentrate করা দরকার l
ট্যাক্সিটা থেমে আছে সাদার্ন এভিনিউ থেকে আসা রাস্তাটা ধরে গোলপার্কের ঠিক মুখটাতে l বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি l একদল ফুটপাথের ছেলেমেয়ে খেলছিল একটা গাড়িবারান্দার তলায় l ট্যাক্সি দেখেই ছুটে এলো – ‘এই সিগনাল সিগনাল গাড়ি দায়রেছে l হেই সুমা এদিকপানে আয় দিনি l’ বৃষ্টির ট্যাক্সি জানলায় দুটি কচি মুখl ‘দেবে দিদি দশটা টাকা, কিছু খাইনি সক্কাল থেকে l’
‘খাসনি তো এত খেলছিস কি করে’ - পাল্টা প্রশ্ন করে ওঠে বৃষ্টি l
‘ হেই দেখো গো খেলা আর খাওয়া বুঝি এক,’ চোখ ঘোরায় ছেলেটি l বোঝা যাছে মেয়েটির দাদা ও l সপাটে দশ টাকাই চেয়ে বসে এরা l দশ টাকাতে কি বা হয় আজকাল l তবু ওদের বাজাতে চায় বৃষ্টি – ‘মা বাবা নেই তোদের?’
‘হেই দেখো, থাকবে না কেন, কাগজ গুড়াতে গেছে সব l তাছাড়া খাওয়া দাওয়া নিজেদের যোগাড় করে নিতে হয় দিদি l’
বৃষ্টি থমকে যায় l পেট থেকে পড়েই এরা জেনে যায়, অন্ন সংস্থান নিজেদের করতে হয় l হায় রে দেশ l অথচ লক্ষ লক্ষ বাচ্চা জন্মায় রোজ রোজ কলকাতার ফুটপাথে, ঝোপড়পট্টিতে l এদের কেউ কেউ আবার মা-বাপের সদিচ্ছায় মাধ্যমিক-এ স্টার ও পায় l এ সব নিয়ে তাদের ছোট এন জি ও সমীক্ষা চালিয়েছে, এসব জানে বৃষ্টিরা l যাই হোক, দুজনকে দুটি দশ টাকার নোট্ দিল বৃষ্টি আর বলল – ‘এভাবে চাইবি না আর বুঝলি? ভিক্ষে চাওয়া মোটেই ভালো না, পড়াশোনা করিসনা? l’ বলেই বৃষ্টি বোঝে প্রশ্নটা কতটা অবান্তর হয়ে গেছে l এদের পড়াশোনার জন্য একটা ব্যবস্থা, না পাল্টাতেই হবে presentationটা l খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে নেতিবাচক ঘাড় নাড়ল ভাই বোন, জানালো, তারা সন্ধ্যেবেলা ঠোঙ্গা বানায়, তবে সে রোজগার মা নেয়, বাবা নেয় l তাই নিজেদের জন্য এই পথ l বলেই নিমেষের মধ্যে পরের taxi র জানলায় l যতটা রোজগার করা যায় l ‘Window slam’ খায় এরা বারংবার, তবু সেলসম্যান দের মতই পরের জানলায় তো সবসময় আছে এদের কাছে l
বালিগঞ্জ ফাঁড়ির সিগনাল l জানলার কাঁচে এক অসহায় মুখ l একটি মা, কোলে বছর দু'এক-এর শিশুটি l কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে l নাক দিয়ে সিকনি ঝরছে, মায়ের কাতর দৃষ্টি, ‘দিদি কিছু দেন, বাচ্চাটা কাল থেকে খায়নি l’ ‘কেন,’ প্রশ্ন বৃষ্টির l সরাসরি l ‘কাল বৃষ্টিতে বেরোতে পারিনি দিদি বাচ্চা নিয়ে, জ্বর তো’ l বৃষ্টি শুনেছে অনেকের নাকি নিজের বাচ্চা নয়, ভাড়া করা বাচ্চা, ভাড়া এরকম পাওয়া যায়, এসব একধরণের ব্যবসা l কিন্তু, এই মুহূর্তে কি করবে বৃষ্টি l বাচ্চাটার খাওয়া দরকার সেও বোঝে l টাকা দিলে বাচ্চার খাবার কিনবে, না এই মেয়ে অন্য কিছুতে উড়াবে কে জানে l দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে দিয়েই ফেলল দশ টাকা l আর তক্ষনি বৃষ্টি এল ঝেঁপে l ওমা, মা টি নিজের মাথায় শাড়ির আঁচলটা টেনে নিয়ে, নেড়া মুন্ডি বাচ্চাকে ভেজাতে ভেজাতে রাস্তা পার হলো l সিগনাল খুলে দিয়েছে ততক্ষণে l আর বাচ্চার কান্না বন্ধ জানলা ভেদ করে বৃষ্টির কানে লেগে রইলো সারাটা দিন l
রিপন স্ট্রিট ক্রসিং l আবার জানলা, আবার টোকা l এবারে বেশ দেবশিশু মুখের দুই বালক, স্পষ্ট ইংরিজিতে জানালো, তাদের মা মারা গিয়েছেন, বেরিয়ালের পয়সা তুলতে বেরিয়েছে তারা l বাবা নেই, কোনদিন ছিল কিনা জানে না, প্রশ্নের উত্তর পেল l স্পর্শকাতর মন বৃষ্টির, শুনেই হৃদয় চলে গেল, বাচ্চা দুটির কাছে, আর দিয়ে ফেলল টাকা l ট্যাক্সি ওয়ালা অবশ্য বলল, সব বুজরুকি l ওমা সত্যি হয়ত, একটু পরেই তারা হাসতে হাসতে ছুটতে ছুটতে রাস্তা পেরোলো l মা মরে শুয়ে থাকলে আর বাচ্চারা ডেভিল না হলে কি অমন করে হাসাহাসি করে... কে জানে l
ভারাক্রান্ত মন, presentation টা খানিক বদলাবে বৃষ্টি l station-এর backyard এ নাকি ৯ - ১৫ বছরের বাচ্চারা dendrite শুঁকে নেশা করছে l ভিক্ষে করে তার জন্য, খবর পেয়ে সত্য যাচাই করেছে ওরা l আজ অফিস এ এসেই জানা গেল খবরটা সত্যি l
বাচ্চার লিউকিমিয়া, হিমোফিলিয়া, বাচ্চার মৃত্যু, এক্সিডেন্ট আর কত কত অজুহাত এই শহরের সহিদদের ঘিরে কে জানে, ভাবে বৃষ্টি l টাকায় এ সমস্যার সমাধান হয় না l প্রয়োজন মূল্যবোধের আমূল পরিবর্তনের l আজ যে কাগজ কুড়ুনে ছেলেটা গাড়িতে পিষ্ট হয়ে মরে গেল, কতটুকু দাম তার প্রাণের? একটা খাবার পেট কমল, আর একজন নেবে পড়বে সেই কাজে l কাল আবার ফোঁটা ফোঁটা জল থেকে তৈরী হবে হাজার হাজার জানলার যিশু l ট্যাক্সির জানলা বন্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু টোকা দেওয়া বন্ধ হবে না l কেবল অসহায় মুখগুলো তাড়া করে ফিরবে বৃষ্টিদের l
মাস খানেক পরে আবার এক ট্যাক্সি l আবার সেই সাদার্ন এভিনিউ গোলপার্ক এর কাছে জানলার কাঁচে টোকা l দুটি মুখ, ওদের ভোলেনি বৃষ্টি l একটা একটু ছেঁড়া সহজ পাঠের প্রথম ভাগ দেখালো ছেলেটি l 'দিদি এই বই মা গুড়িয়ে এনেছিল l’ সহজ পাঠও ডাস্টবিন এ ! লজ্জিত, বৃষ্টি l ওদিকে ছেলেটি বলেই চলে, ‘আমরা হই দুকানের দিদির কাছে পড়তে শিখছি l পড়তে পারলে তোমাকে শোনাব l তুমি যে টাকা দিয়েছিলে তাই দিয়ে পেন আর কাগজ কিনেছি দিদি, বোন আর আমি পড়ি রোজ সন্ধ্যে করে l’ বৃষ্টি আপ্লুত, কি বলবে, ওদিকে সিগনাল, অফিসের তাড়া, বললে ‘আমি একদিন এখানে আসব তোদের কাছে, কেমন? এই কুড়ি টাকা রাখ আজ l’ হাত গুটিয়ে নিল দুই ভাই বোনেই l কিছুতেই নিল না l ভাই বোন লাফাতে লাফাতে বলতে লাগলো - 'কালো রাতি গেল ঘুচে, আলো তারে দিল মুছে l' আর ঠিক তখনই, বৃষ্টির এক ফাঁকেও সকালের সুয্যিটা উঠে পড়ল এক লাফে l
0 comments: