0
undefined undefined undefined

সম্পাদকীয়

Posted in


ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গেলে দেখি চারিদিক অন্ধকার করে অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি পড়ে চলেছে। কখন থেকে, কে জানে! হালদারদের দেড়শো বছরের পুরনো জোড়া শিব মন্দিরের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা মহানিম গাছখানা তার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একেবারে কাকভেজা ভিজছে চুপটি করে। চেতনালোকে ঝোড়ো হাওয়ার বেগে ঝাপটা দিয়ে গেলো পদাবলি – 

‘এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা 
কেমনে আইলো বাটে। 
আঙ্গিনার মাঝে বঁধূয়া ভিজিছে 
দেখিয়া পরাণ ফাটে’ 

আহা! আহা! আমার বিরহবিলাসী মন মুহূর্তে আন্দোলিত হয়ে ওঠে… 

‘এ সখি হামারি দুখের নাহিকো ওর। 
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর 
শূন্য মন্দির মোর’ 

সেই মুহূর্তেই বুঝেছি, আজ আর কাজ হবে না কোনও… 'রইল পড়ে পসরা মোর পথের পাশে'।  আজ ‘এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর/ তোর তরে কবিতা আমার…’ 

তারপরে সারাদিন ধরেই শুধু বর্ষাযাপন… ‘তোমার বাঁশীটি বাজাও’ – ওগো আমার পরাণ বঁধুয়া, আমার গোপন প্রেমিক…আমার সুদূরের মিতা... 

যাবার বেলায় শুধু জানিয়ে যাই, প্রকাশিত হলো ঋতবাক অষ্টম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা। 

ভালো থাকুন সকলে 

শুভেচ্ছা নিরন্তর…

0 comments:

1
undefined undefined undefined

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অবন্তিকা পাল

Posted in



প্রত্যাখ্যানের নিরিখে যে যাপিত জীবনের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করা যায়, প্রায়-দীর্ঘ ৭১ বছর ব্যাপী তা কখনোই সরলরৈখিক স্রোতে বহমান হয়নি। শ্রুত আছে ঈশ্বরচন্দ্র বাল্যবেলায় সংখ্যা শিখেছিলেন বাবার হাত ধরে দীর্ঘ পথ হাঁটতে হাঁটতে। চলতি ব্যবস্থার সুখপ্রদ অবস্থাগুলিকে এই ব্যক্তিই প্রাপ্তবয়সে যেভাবে প্রত্যাখ্যান করতে করতে এগিয়েছেন, সেগুলিকে তাঁর ব্যক্তিজীবনের মাইলস্টোন বলে ভাবা যেতে পারে।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি, ১৮৪১-এ, ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভের সমসময়ে মাত্র ২৪ বছর বয়সে প্রথমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান হলেন। সেই কলেজ ছেড়ে দিলেন ১৮৪৬-এ। ওই বছরেই যোগ দিলেন সংস্কৃত কলেজে, সহ-আধিকারিক হিসাবে। ঠিক তিন বছর পর রসময় গুপ্তের সঙ্গে বিরোধবশত সংস্কৃত কলেজ পরিত্যাগ করলেন ১৮৪৯ সালে। এরপরে আবার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রধান-করণিক হিসাবে কাজে যোগ দিলেন। ততদিনে কিন্তু লেখক হিসাবে ঈশ্বরচন্দ্রের অস্তিত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এতদসত্ত্বেও সংসার প্রতিপালন, এবং মূলত সামাজিক ক্রিয়াগুলি অব্যহত রাখার জন্য তাঁকে চাকরি করে যেতে হচ্ছে। দেড় বছর পর, অর্থাত্‍ ১৮৫০-এর ডিসেম্বরে ফের ফোর্ট উইলিয়াম ছেড়ে তিনি ফিরে এলেন সংস্কৃত কলেজে। নিলেন সাহিত্যের অধ্যাপক ও সেক্রেটারি পদের গুরুদায়িত্ব। এর ঠিক এক মাস পর তিনি ওই কলেজের অধ্যক্ষ পদে আসীন হলেন। চলতে থাকল বর্ণপরিচয়, কথামালা, বোধোদয় রচনার কাজ। একইসঙ্গে শ্রেণি নির্বিশেষে সবার জন্য শিক্ষার প্রচার, নারীশিক্ষার উন্মেষ ও সর্বোপরি বাল্যবিবাহ রদ এবং বিধবাবিবাহ প্রচলনের ঐকান্তিক প্রয়াস। আট বছর যাবত্‍ সাফল্যের সঙ্গে অধ্যক্ষ পদ বহন করার পর, ১৮৫৮ সালের নভেম্বরে, ৩৯ বছর বয়সে তিনি সংস্কৃত কলেজ ত্যাগ করলেন। এমনকি সরকারের সঙ্গেও তাঁর যাবতীয় সংযোগ ছিন্ন করলেন।

এরপর জন্মভিটে বীরসিংহ ত্যাগের পালা। ১৮৬৯-এ স্কুলের হেডপণ্ডিত মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় জনৈকা বিধবাকে বিবাহের ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন। এই মুচিরামের ভিক্ষা-সম্পর্কে হালদার পরিবারের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। হালদার পরিবার চাননি এ বিবাহ সম্পন্ন হোক। তাঁর বিবাহ রোধে ঈশ্বরচন্দ্রের শরণাপন্ন হন। ঈশ্বরচন্দ্র কথা দেন এই বিবাহ থেকে মুচিরামকে তিনি নিরস্ত করবেন। অথচ ঈশ্বরের অজ্ঞাতসারে তাঁর ভাই দীনবন্ধু ও কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে মুচিরামের সঙ্গে ওই রমণীর বিবাহ সম্পাদন করেন। নিজের অজান্তে বিদ্যাসাগর প্রতিজ্ঞাচ্যুত হন। এই ঘটনার বশবর্তী হয়ে তিনি ঘোষিতভাবে বীরসিংহ পরিত্যাগ করলেন এবং প্রকৃতই আর কখনও সেখানে পা রাখলেন না। এরপর একে একে পুত্রের সঙ্গে মতবিরোধ, পুত্রের প্রতি আশানুরূপ কর্তব্য পালন করতে না পারায় অথবা না চাওয়ায় স্ত্রীর সঙ্গেও দূরত্ব রচিত হওয়া – এসব বিদ্যাসাগরের একক সত্তাকেই প্রতিবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে লাগল।

বীরসিংহ ত্যাগের প্রাক্কালে বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন পশ্চিমে স্থানান্তরিত হতে। মেট্রোপলিটান স্কুল ও কলেজকে কেন্দ্র করে ১৮৭০-৭২ নাগাদ যখন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতানৈক্য চরমে ওঠে, ঈশ্বরচন্দ্র চেষ্টা করেন বন্ধুর সহায়তায় দেওঘরে স্থানান্তরিত হওয়ার। সে সময় দেওঘরে বাংলোর দাম অত্যন্ত বেশি ছিল। তাছাড়াও একে একে বালিকা বিদ্যালয়গুলির কাজে অর্থব্যয় করে তাঁর সঞ্চিত সম্পত্তি বেশ কিছুটা কমে এসেছিল। অবশেষে সন্ধান করে ছোটোনাগপুর মালভূমি সন্নিকটে অধুনা-ঝাড়খণ্ডের কার্মাটাড় অঞ্চলে তিনি দুশো কাঠা জমি ও বসবাসের জন্য একটি বাড়ি কেনেন। ১৮৭৩-৭৪ সাল থেকে পাকাপাকিভাবে সেখানেই বসবাস শুরু করেন। আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে জীবনের শেষ আঠেরোটি বছর সমর্পণ আদতে কলকাতার শহুরে সভ্যতাকেই প্রত্যাখ্যান, যে আপাত-পরিপাটি বঙ্গসমাজ তাঁর প্রায় প্রতিটি নীতিকে প্রতিহত করতে চেয়েছে বারবার, সামাজিক ও আর্থিকভাবে। ১৮৭৪-এ মেট্রোপলিটান-এর ছেলেরা যখন প্রথমবারের এফএ (ফার্স্ট আর্টস) পরীক্ষায় আশাতীত সুফল পেল, ঈশ্বরচন্দ্র ছুটে এলেন কলকাতায়। দ্বিতীয় স্থানে থাকা পরম স্নেহের ছাত্র যোগেশচন্দ্রের বাড়িতে গিয়ে তাকে উপহার দিয়ে এলেন স্কট-এর ওয়েভারলি নভেলস-এর একটি খণ্ড। তারপর কর্মক্ষেত্রের অনিবার্য টান উপেক্ষা করে ফিরে গেলেন কার্মাটাড়ের বাড়ি নন্দনকাননে। কেন গেলেন?

আত্মকথনে ঈশ্বরচন্দ্র লিখছেন, “সাংসারিক বিষয়ে আমার মতো হতভাগ্য আর দেখিতে পাওয়া যায় না। সকলকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন করিয়াছি, কিন্তু অবশেষে বুঝিতে পারিয়াছি, সে বিষয়ে কোন অংশে কৃতকার্য হইতে পারি নাই। ...সংসারী লোকে যে সকল ব্যক্তির কাছে দয়া ও স্নেহের আকাঙ্ক্ষা করে, তাহাদের একজনেরও অন্তঃকরণে যে আমার ওপর দয়া ও স্নেহের লেশমাত্র নাই সে বিষয়ে আমার অণুমাত্র সংশয় নাই। এরূপ অবস্থায় সাংসারিক বিষয়ে লিপ্ত থাকিয়া ক্লেশ ভোগ করা নিরবচ্ছিন্ন মূর্খতার কর্ম...।” কার্মাটাড় যাওয়ার কয়েক বছর আগে চিঠিতে ভগবতী দেবী ও ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও প্রায় একই মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন তিনি। কিন্তু কার্মাটাড়-ই তো প্রত্যাখ্যানের শেষ সত্য নয়। ১৮৬৬-তে পানিহাটির বালিকা বিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে পথ দুর্ঘটনা ও লিভারে মারাত্মক আঘাত – পরিপাক যন্ত্র দুর্বল হয়ে আসছিল তখন থেকেই। কার্মাটাড়-জীবনের শেষদিকে, ১৮৯০-এ বীরসিংহে এসে যখন মায়ের স্মৃতিতে বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করে যাচ্ছেন, তখন তিনি একবেলার খাবার হজম করতে পারেন কোনোক্রমে। সামাজিক কাজ বিরামহীন, অথচ হোমিওপ্যাথি থেকে হাকিমি, কবিরাজি থেকে পাশ্চাত্যের চিকিত্‍সা, সমস্তকিছুকেই গ্রহণ করতে অপারগ হচ্ছেন। এই শরীরী প্রত্যাখ্যান আত্মিক প্রত্যাখ্যানও বটে।

যে ঋজু মেরুদণ্ডের ব্যক্তিটি কখনও কারও প্রতিনিধিত্ব করেননি (উনিশ শতকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে লালিত হয়ে রামমোহন বা ডিরোজিও যেমনটা করেছিলেন), এককভাবে বিধবাবিবাহের প্রচলন করতে চেয়েছিলেন নারীসুরক্ষা ও পরিবার পরিকাঠামোকে অব্যহত রাখার জন্য, সেই মানুষটি অন্তিমলগ্নেও সহবাস-সম্মতি আইন বিষয়ে তাঁর অসম্মতি ব্যক্ত করে যাচ্ছেন। প্রাচ্যের যে আদি-অকৃত্রিম সংস্কৃতি পরিবার থেকে বিকেন্দ্রীভূত হয়ে সামাজিকতায় বিস্তার লাভ করে, সংসারত্যাগী ঈশ্বরচন্দ্র তাতেই আস্থাশীল থেকেছেন আজীবন। যতবার পরিপার্শ্ব তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তারও অধিকবার তিনি সসম্মানে ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যকে সসম্মানে উপেক্ষা করে গেছেন। তাঁর যাবতীয় লড়াই তাই একের লড়াই, সমস্ত ইতিহাস তাই ব্যক্তির ইতিহাস।

1 comments:

9
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - পল্লববরন পাল

Posted in




আরে! মুখুজ্যে মশাই যে! নমস্কারকী খবর?
আর এই লেখা-টেখা সংসার-টংসার এই নিয়েই ব্যস্ত।
তা বেশ। কিন্তু দেখো মুখুজ্যে...

একটা একদম আটপৌরে আলাপচারিতা – আড্ডার ঢঙে – জনৈক মুখুজ্যের সঙ্গেযিনি লেখেন-টেখেন আর সংসার-টংসার করেন – আচ্ছাবাঙলা কবিতায় এর আগে এই ‘টেখা’ ‘টংসার’ জাতীয় শব্দের ব্যবহার হয়েছে কিএই মুখার্জী নয়নৈমিত্তিক কথ্য ‘মুখুজ্যে’ শব্দটিও এর আগে বা পরে বাঙলা কবিতা সাহিত্যের কোথাও উল্লেখ হয়েছে কিএ সব প্রশ্নের উত্তর গবেষকরা দিতে পারবেন। আমি সামান্য কবিতাপ্রেমী। আমার সীমানা এই প্রশ্ন উত্থাপন অবধি! প্রসঙ্গত বলিএ কবিতা আমি প্রথম পড়েছি আমার স্কুলজীবনে – গত শতাব্দীর সাতের দশকের গোড়ার দিকে – তখনও আমি রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ পড়িনি, ‘গান্ধারীর আবেদন’ বা ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ও নয় – ইংরেজি সাহিত্যে অনেক আগেই ‘কন্‌ভার্সেশন পোয়েম’ লিখেছেন কোলরিজকিন্তু আমি সে সব জেনেছি অনেক পরে – কাজেই, ‘মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপ’এর এই আড্ডাভাবনা আমার কাছে তখন অভিনব। নতুন। আবিষ্কার।

অনেক বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতের মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বাঙলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘যত দূরেই যাই’। ১৯৬২তে প্রকাশিত। ত্রিবেণী প্রকাশন। প্রচ্ছদ পূর্ণেন্দু পত্রী। দাম তিন টাকা। ১৯৬৪ সালে এই বইয়ের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার দেওয়া হয় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। এই বইয়ের ২৮ নম্বর অর্থাৎ শেষ কবিতা ‘মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপ’। এ বইয়ের দীর্ঘতম কবিতা।

আচ্ছাআলাপের একদিকে তো ওই জনৈক মুখুজ্যেযিনি ব্যস্ত তাঁর ‘লেখা-টেখা সংসার-টংসার’ নিয়ে – কবিতার শুরুতেই মনে হচ্ছে ইনি কবি সুভাষ মুখুজ্যেই হবেন – বেশবোঝা গেলো – কিন্তুঅন্যজন কেকথার মেজাজে বুঝতে পারিইনি সমবয়সী একজন অতিপরিচিত প্রতিবেশী – একেবারে তুইতোকারি জিগরি দোস্ত নয়হলে নাম ধরে বা শুধু মুখুজ্যে বলে সম্বোধন করতেন, ‘মুখুজ্যে মশাই’ বলতেন না। আবার আপনি-আজ্ঞের দূরত্বেরও সম্পর্ক নয় – কথার ঢঙেও বেশ শুভানুধ্যায়ী পারস্পরিক সমীহপূর্ণ আত্মীয়তা -
আমার এই ডানদিকটাকে বাঁদিক
আর বাঁদিকটাকে ডানদিক ক’রে
আয়নায় এভাবে ঘুরিয়ে দেওয়া –
আমি ঠিক পছন্দ করি না।
তার চেয়ে এসোচেয়ারটা টেনে নিয়ে
জানলায় পা তুলে বসি।
এককাপ চায়ে আর কতটা সময়ই বা যাবে?

দু’জনে আড্ডা মারতে বসছেন পাড়ার চায়ের দোকানে নয়একেবারে যে ঘরে আয়না থাকে অর্থাৎ শোবার ঘরেই – তার মানে এই দ্বিতীয় ব্যক্তিটি মুখুজ্যে মশাইয়ের নিকটতম প্রতিবেশীতাঁর ডানদিকের বাঁ আর বাঁয়ের ডানদিক – তৃতীয় পংক্তির ‘এভাবে’ শব্দটিতেই পরিস্কার – আয়নার অন্যপারের মুখুজ্যে। অর্থাৎএটা ‘মুখুজ্যের সঙ্গে মুখুজ্যেরই আলাপ’।

পুরো আড্ডায় প্রথম মুখুজ্যের সংলাপ ঐ একটা পংক্তিতেই সীমাবদ্ধ। কবিতার দ্বিতীয় পংক্তিটুকু – ‘আর এই লেখা-টেখা সংসার-টংসার এই নিয়েই ব্যস্ত’ – ব্যাস! ঐটুকুতেই তাঁর নড়বড়ে এলোমেলো কিংকর্তব্যবিমূঢ় যাপনচরিত্রের বিভ্রান্তি বিধৃত – ওই ‘লেখা-টেখা’ আর সংসার-টংসার’এ। লেখা নাকি টেখাসংসার নাকি টংসারআমরা সাধারণত একটা অর্থযুক্ত শব্দের সঙ্গে প্রায় সমোচ্চারিত অর্থহীন অন্য একটি শব্দ জুড়ে দিই – খুব অগভীর হাল্কাচ্ছলে – অর্থযুক্ত শব্দটির গুরুত্ব কমাতে – শব্দটাকে গুলিয়ে দিতে – উচ্চারণে তুচ্ছতাবোধের তাগিদে। এই দুর্বোধ্য প্রহেলিকাতেই তো চিরকালীন ‘আমি’-র বসবাস। আমাদের সকলের ‘আমি’। এবং সেই সূত্রেই প্রত্যেক ঘরের দেয়ালে নয়তো সাজটেবিলে ঐ ‘ডানদিকটাকে বাঁদিক আর বাঁদিকটাকে ডানদিক’ করা আয়নার অস্তিত্ব ঘোষণার তাগিদ।

দেশলাইআছে।
ফুঃএখনও সেই চারমিনারেই রয়ে গেলে।
তোমার কপালে আর ক’রে খাওয়া হল না দেখছি।
বুঝলে মুখুজ্যেজীবনে কিছুই কিছু নয়
যদি কৃতকার্য না হলে।

আলাপের প্রথম অংশের শেষে আরো কিছু তথ্য জানা গেলো – যা বিস্তার লাভ করবে পরবর্তী অধ্যায়ে। যেমনপাঁচের দশকের বামপন্থী বুদ্ধিজীবিদের কয়েকটি সাধার বাহ্যিক ধর্ম ছিলোযা থেকে খুব সহজে তাদের চেনা যেতো – পাঞ্জাবি-পায়জামাকাঁধে ব্যাগআর ঠোঁটে চারমিনার। পাঞ্জাবি-পায়জামা বা ব্যাগের ক্ষেত্রে তবু উচ্চ মধ্য নিম্ন বিত্তের তারতম্য তর্কাতীত নয়কিন্তু চারমিনার একমেবাদ্বিতীয়ম সর্বহারা সংস্কৃতির সঙ্গে খাপে খাপে মানানসই ও সম্পৃক্ত।

অর্থাৎ জানলায় পা তুলে চায়ের কাপ হাতে পাশাপাশি চেয়ারে আধশোয়া আলগা বসে পড়লেন দুই মুখুজ্যে – সুভাষ মুখুজ্যে ও আয়না মুখুজ্যে। আড্ডার আবহাওয়া ও মেজাজ তৈরি।

এবং ফস্‌ করে দেশলাই ঠুকলেন আয়নার মুখুজ্যে।



আকাশে গুড়গুড় করছে মেঘ –
ঢালবে।

অনায়াস ঔদ্ধত্যে ওভার বাউন্ডারি দিয়ে ইনিংস শুরু করলেন আয়না মুখুজ্যে। এমন দুটি পংক্তি উচ্চারণ করে একমাস নির্জলা উপোসেও তৃপ্তির ঢেকুর ওঠে। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় আমার জীবনে পড়া বোধহয় সবচেয়ে প্রিয় দুটি পংক্তি। বিশেষত দ্বিতীয় পংক্তিটি। একটি মাত্র শব্দের। মিতভাষণ কবি সুভাষের স্বভাবধর্ম। এই ‘এক শব্দের পংক্তি’ র মধ্যে যেন মাইল মাইল ধু ধু মাঠযেন তিন খণ্ডের ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’র বিশাল বিস্তৃতি। এমন উদাহরণ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই ‘যত দূরেই যাই’ গ্রন্থেরই পাতায় পাতায় – প্রথম কবিতা ‘যেতে যেতে’র মধ্যে ‘ ...আমার কাঁধের ওপর হাত রাখল/ সময়।/ তারপর কানের কাছে...’; ‘পাথরের ফুল’ কবিতায় ‘ফুলগুলো সরিয়ে নাও,/ আমার লাগছে।/ মালা/ জমে জমে পাহাড় হয়/ ফুল জমতে জমতে পাথর। ...’এছাড়া ‘যেন না দেখি’, ‘ফিরে ফিরে’, ‘আরও গভীরে’, ‘ঘোড়ার চাল’, ‘গণনা’ – অজস্র কবিতায় অসংখ্যবার বিভিন্নভাবে বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এই এক শব্দের পংক্তি ব্যবহার করেছেন কবি সুভাষ। পরবর্তী সময়েও এর অনেক সার্থক প্রয়োগ দেখেছি সুভাষের কবিতায় – যেমন ‘কাল মধুমাস’ বইয়ের ‘খোলা দরজার ফ্রেমে’ কবিতায় ‘...মাথার ওপর লম্বা একটা লাঠি উঁচিয়ে/ কোলে-পো কাঁখে-পো হয়ে/ একটা ট্রাম/ তার পেছন পেছন/ তেড়ে গেলে/ তারের গায়ে অনেকক্ষণ ধ’রে ঝুলে থাকল/ একটা একটানা/ ছি/ ছি/ শব্দ...’। কিন্তু এই সব অসাধারণ শব্দ-পংক্তির মধ্যেও একটিমাত্র ক্রিয়াপদে ‘ঢালবে’ অদ্বিতীয়। এতো সংক্ষিপ্ত অথচ দীর্ঘতম উপন্যাসোপম বিস্তৃতি – ভাবা যায় না। মেঘ গুড়গুড় করলে আকাশ কী কী ঢালতে পারেসেটার জন্য কবি কি পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তির ওপর ভরসা করেই মৌন রইলেন?

‘...কিন্তু খুব ভয়ের কিছু নেই;
যুদ্ধ না হওয়ার দিকে।
আমাদের মুঠোয় আকাশ;
চাঁদ হাতে এসে যাবে।...’

‘ঢালবে’ পংক্তিটা আরো গমগম করে উঠলো – শব্দ ও বাক্যটির অভিঘাতে পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তি প্রত্যেক পংক্তির শেষে আরো কয়েক গুণ বেড়ে বেড়ে গেলো। কী সহজ কথায় অনায়াসে ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধের কথা রূপকথার নরম ঐশ্বর্যে মুড়ে পেশ করলেন সুভাষ। এই রূপকথা প্রসঙ্গে বলি, ‘যত দূরেই যাই’ বইয়ের প্রথম কবিতা সহ বেশ কয়েকটির মধ্যে এই রূপকথার মেজাজ লক্ষ্যণীয়। এর সঙ্গে ‘সন্দেশ’ শিশু পত্রিকার সম্পাদনার কোনো যোগসূত্র আছে কিনাসুভাষ গবেষকরা বলতে পারবেন।

এতক্ষণে ইনিংস গুছিয়ে নিয়েছেন আয়নার মুখুজ্যে। উইকেটের চারদিকেই স্বচ্ছন্দে বাউণ্ডারি মারছেন। খুচরো রান নিচ্ছেন। মাঠ বড়ো করছেন এবং আন্তর্জাতিক হয়ে উঠছেন।

‘...ঘৃণার হাত মুচড়ে দিচ্ছে ভালবাসা।
 পৃথিবীর ঘর আলো ক’রে –
দেখোআফ্রিকার কোলে
সাত রাজার ধন এক মানিক
স্বাধীনতা।
...শুধু ভাঙা শেকলগুলো এক জায়গায় জুটে
এই দিনকে রাত করবার কড়ারে
ডলারে ফলার পাকাবার
ষড়যন্ত্র আঁটছে। ...’

ভালোবাসার পাঞ্জায় কী অসম্ভব জোর – ঘৃণার পেশিবহুল হিংস্র হাত মুচড়ে দেওয়ার সাহস ও শক্তি! মানুষের যে কোনো সৎ সুস্থ প্রবৃত্তির মধ্যেই যে এই জোর থাকেন্যায়ের এই প্রস্তরবৎ শিরদাঁড়ার কথা প্রচার করা একজন কবির অত্যন্ত জরুরি একটা সামাজিক দায়িত্ব। এখানে আর একটা জিনিস লক্ষ্য করুন পাঠকপরের লাইনে ‘পৃথিবীর ঘর আলো ক’রে’-র শেষে ‘ড্যাশ’ চিহ্নটির প্রয়োগ। মোটেই বাহুল্য নয়। আরও একাধিক শব্দের অযথা ব্যবহারকে নস্যাৎ করে মিতভাষী এই কবি একটা ছোট্ট চিহ্নের ব্যাপ্তিনির্দেশে অন্ধকারের দেশের মুক্তির আলো সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দিলেন। তারপর আবার এক শব্দের পংক্তি - ‘স্বাধীনতা’। সদ্যোজাত শিশুর মতো পবিত্র ও মহার্ঘ্য। পরক্ষণেই তিনটি মোক্ষম শব্দের অনুপ্রাসে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের গোপন উপস্থিতির সতর্কবার্তা। আলো অন্ধকারের কী নাটকীয় উত্থান-পতন!

এই অবধি ছিলো পটভূমি নির্মাণ। সামগ্রিক পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা। কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে বা সেমিনারে এটাই দস্তুর। শুরুতে পটভূমিকায় আঞ্চলিক থেকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণতার পর ‘কী করিতে হইবে’। আয়না মুখুজ্যেও তাঁর পরবর্তী রাজনৈতিক কথাবার্তার আয়োজনের প্রস্তুতি সেরে নিলেন।

এবার নিজস্ব মতামত ও নির্দেশ দিতে শুরু করলেন – সেই আড্ডার নৈমিত্তিক ঢঙেই – যেন পার্টি ক্লাশ নিচ্ছেন – এই সুভাষিত ভাষা ও ভঙ্গিতে যদি সত্যিই তখন বা পরবর্তী সময়ে পার্টি-ক্লাশ হতোতাহলে হয়তো বামপন্থার আরো সঠিক বিস্তার হতো – মার্ক্স এঙ্গেলস লেনিনকে মুখস্থ করে মাথায় না রেখে বুকের ওমে টাটকা রাখা যেতো – আরো সঠিক প্রয়োগ হলে পরবর্তীতে বামদূর্গের হুড়মুড় ভেঙে পড়া বোধহয় রোধ করা যেতো – এই রাজনৈতিক অতিমারীতে হয়তো এই বামপন্থাই ফের মানুষের আশ্বাস ভরসা হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হতো।

‘...ধনতন্ত্রের বাঁচবার একটাই পথ
আত্মহত্যা।
দড়ি আর কলসি মজুত
এখন শুধু জলে ঝাঁপ দিলেই হয়।
পৃথিবীকে নতুন ক’রে সাজাতে সাজাতে
ভবিষ্যৎ কথা বলছেশোনো,
ক্রুশ্চভের গলায়।

নির্বিবাদে নয়বিনা গৃহযুদ্ধে
এ মাটিতে
সমাজতন্ত্র দখল নেবে।
হয়তো একটু বাড়াবাড়ি শোনাচ্ছে
কিন্তু যখন হবে
তখন খাতা খুলে দেখে নিও
অক্ষরে অক্ষরে সব মিলে যাচ্ছে।...’

ব্রিগেডের লাল জনসভার ভাষণকেউ দুঃস্বপ্নেও এর আগে ভেবেছিলো যেএই ভাষায় কবিতা লেখা যায়আমার আলোচনা সুভাষের রাজনীতি নিয়ে নয়কবিতা নিয়ে। তাই ক্রুশ্চভ ঠিক না ভুলসমাজতন্ত্র সত্যিই উন্নততর পদ্ধতি কিনা – সে সব নিয়ে রাজনৈতিক তাত্ত্বিকেরা অন্যত্র আলোচনা করবেন।

আমি শুধু এটুকু বলতে পারিএই কবিতা পড়েই কমিউনিজমে দীক্ষা নিয়েছিলো আমার প্রজন্ম সেই যুগে – গত শতাব্দীর সেই ষাট-সত্তর দশকে। বাঙলায় বামযুগের সূত্রপাতে এই কবির একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিলোযতোই তাঁকে পরবর্তী সময়ে অস্বীকার করুক বাম দলেরা।



তৃতীয় অধ্যায়ে খুচরো রানে ব্যস্ত হলেন আয়না মুখুজ্যে। আন্তর্জাতিক স্তর থেকে বৃত্ত ছোটো করে এলেন আঞ্চলিক চেনা চৌহদ্দিতে। বিন্দু থেকে সিন্ধু হয়ে ফের বিন্দুতে ফিরে এলেন। একদম পার্টি-ক্লাশের শিক্ষকের মতো। কথা বললেন মস্তিষ্ক থেকে নয়বুক থেকে উঠে এলো তাঁর আন্তরিক অনুশাসন – সামগ্রিকভাবে এটাই তো হওয়ার কথা ছিলো।

‘...দেখো মুখুজ্যেমাঝে মাঝে আমার ভয় করে
যখন অমন সুন্দর বাইরেটা
আমার এই আগোছালো ঘরে হারিয়ে যায়।...’

কী সহজ বিবরণ! ঘর আর বাহির – বাস্তব আর স্বপ্ন – মাঝখানে কি বার্লিনের কংক্রিট পাঁচিলকী অদ্ভুত ব্যবহার ‘আগোছালো’ শব্দটার! নাহ্‌অভিধানে ‘অগোছালো’ আছে, ‘আ’ তো নেই! তাতে কী? ‘অ’ সরিয়ে ‘আ’ আরো একটু বেশি এলোমেলো অবিন্যস্ত করলো না কি আমার ঘরটাকেএ স্বাধীনতা তো কবিরই প্রাপ্য। তাএই ‘আগোছালো’ ঘরটা কী রকম?

‘... পাঞ্চেতের এক সাঁওতাল কুলি দেখতে দেখতে
ওস্তাদ ঝালাইমিস্ত্রি হয়েছিল –
এখন আবার তাকে গাঁয়ে ফিরে গিয়ে পেটভাতায়
পরের জমিতে আদ্যিকালের লাঙল ঠেলতে হচ্ছে।
এক জায়গায় রুগী ডাক্তার অভাবে মরছে,
অন্য জায়গায় ডাক্তার রুগী অভাবে মরছে। ...

আমি দেখে এসেছি নদীর ঘাড় ধরে
আদায় করা হচ্ছে বিদ্যুৎ -
ভালো কথা।
কলে তৈরি হচ্ছে বড় বড় রেলের ইঞ্জিন –
খুব ভালো।
মশা মাছি সাপ বাঘ তাড়িয়ে
ইস্পাতের শহর বসেছে –
আমরা সত্যিই খুশি হচ্ছি।...’

এ সবই ধনতন্ত্রের অমোঘ ফলাফল। পুঁজির বিকাশচিত্র। আমাদের সামনে উন্নয়ণের নীল-সাদা রঙ বা তিনহাজার কোটির প্যাটেলমুর্তির চোখ ধাঁধানো তালিকা। কিন্তু কবি তো দূরদ্রষ্টা। সত্যবাদিতা কবি হয়ে ওঠার প্রাথমিক স্বার্থ। অনেকটা এগিয়ে থাকে তাঁর দৃষ্টিসীমানা। তাই –

‘... কিন্তু মোটেই খুশি হচ্ছি না যখন দেখছি –
যার হাত আছে তার কাজ নেই,
যার কাজ আছে তার ভাত নেই,
আর যার ভাত আছে তার হাত নেই।...’

পরপর তিনটি ছক্কা! পুঁজিবাদের এর চেয়ে মোক্ষম সংজ্ঞা হয়আমি দ্বিধাহীন সোচ্চারে বলিএতো সহজে কোনো রাজনৈতিক তত্ত্বগুরুও আমাকে পুঁজিবাদ বোঝাতে পারেননি। ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’। এই ‘আছে’ আর ‘নেই’এর ধাঁধায় সংশয়ে দ্বিধায় আমরা ‘কলে পড়া জন্তুর মতো মূর্ছায় অসাড়’। ‘আছে’ আর ‘নেই’এর সংঘাতেই তো সমাজের আসল দ্বন্দ্বএই দ্বন্দ্ব থেকেই তো বস্তুবাদযা কবি সুভাষের জীবনে বহুদিনের বিশ্বাস। পরবর্তীকালে আশির দশকের দ্বিতীয় ভাগে সোভিয়েতের পতনে তার চিন্তার গতিপথ পরিবর্তন হয়েছিলো। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ, এবং আরো বছর পঁচিশেক পরের ঘটনা। কারণআমরা এখন আছি ‘যত দূরেই যাই’ প্রকাশকাল, অর্থাৎ উনিশশো বাষট্টি পরবর্তী কালে। শুনেছি ‘ভবিষ্যৎ কথা বলছে শোনো ক্রুশ্চভের গলায়’ প্রসঙ্গে নব্বই দশকে সুভাষ অকপটে বলেছেন – এখন হয়তো নয়কিন্তু ব্যাপারটা ঐ সময়ে আমার কাছে সত্যই ছিলোআমি আমার বিশ্বাস থেকেই লিখেছিসেটাই সত্য সেই সময়ের জন্য। ভণ্ডামিহীন এই প্রজাতির সৎ কবি এ যুগে কেউ আছেন কি?

এই তৃতীয় অধ্যায়ের শেষে আয়না মুখুজ্যের হাতের ব্যাট ফের গর্জন করে উঠলোগলার আওয়াজ আরো স্পষ্ট ও ধারালো হলো –

‘... গদিতে ওঠবস করাচ্ছে
টাকার থলি।
বন্ধ মুখগুলো খুলে দিতে হবে
হাতে হাতে ঝনঝন ক’রে ফিরুক।
বুঝলে মুখুজ্যেসোজা আঙুলে ঘি ঊঠবে না
আড় হয়ে লাগতে হবে।...’  

সরাসরি নির্দেশ। একদম রাজনৈতিক নেতার মতোন। কবি সুভাষ তখন আগাপাশতলা রাজনৈতিক মানুষ। পার্টিসদস্য।



‘... যারা হটাবে
তারা এখনও তৈরি নয়।
মাথায় একরাশ বইয়ের পোকা
কিলবিল করছে –
চোখ খুলে তাকাবার
মন খুলে বলবার
হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখবার –
মুখুজ্যেতোমার সাহস নেই।...’

কমিউনিস্ট পার্টির অনুশাসনের মধ্যে থেকেও এই সপাট আত্মসমালোচনা বা স্বগতোক্তির সাহস একমাত্র সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো গুটিকয় মানুষই দেখাবার হিম্মত রাখতেন। এই মেরুদণ্ড এখন বিরল প্রজাতি। উপরের এই আট পংক্তির সত্যতা আজও সমানভাবে প্রযোজ্য। তাই শেষ পংক্তির থাপ্পড়ের পরেও উচ্চস্বরে বলেন –

‘... আগুনের আঁচ নিভে আসছে
তাকে খুঁচিয়ে গনগনে ক’রে তোলো।
উঁচু থেকে যদি না হয়
নীচে থেকে করো।...’

এখনও নিশ্চয়ই আর সেই জানলায় পা তুলে চেয়ারে হেলান দেওয়া অলস ভঙ্গি নয়! এক কাপ চা অনেকক্ষণ শেষ। কাপের গায়ে শুকনো স্মৃতি হয়ে লেগে আছে উনিশশো বাষট্টি। আয়না মুখুজ্যে হাহাকার করে উঠলেন –

‘... সহযোদ্ধার প্রতি যে ভালোবাসা একদিন ছিল
আবার তাকে ফিরিয়ে আনো;
যে চক্রান্ত
ভেতর থেকে আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে
তাকে নখের ডগায় রেখে
পট্‌ ক’রে একটা শব্দ তোলো।।...’

আপাদমস্তক রাজনৈতিক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ভালো লাগার জন্য তাঁর রাজনীতির প্রতি সমর্থন কোনো শর্তই নয়। আমি বহু বিরুদ্ধ মতবাদে বিশ্বাসী মানুষকেও সুভাষের কবিতা অনর্গল মুখস্থ বলতে শুনেছি। আসলে কবি সুভাষ আমাদের মতো কয়েকটা প্রজন্মকে বামপন্থী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাঁর নির্দেশেই আমরা বিশ্বাস করেছি যুক্তি বিজ্ঞানকেআমরা অনুশীলন করেছি ভাবনাগুলোকে চামচে ক’রে নাড়ার মতো মুক্তচিন্তার। তাঁর কবিতা পাঠেই ভরসা পাই – ‘হেরেছিতাতে কী?/ কখনও যায় না শীত/ এক মাঘে।/ আছে/ লড়াইতে হারজিত।’

‘মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপ’ এই বইয়ের এমনই একটা দীর্ঘ কবিতাযার সাথে আমাদের প্রজন্মের আত্মীয়তা। এই একটি কবিতা নিয়ে আলোচনায়আমার অনুভূতিগুলোকে লিপিবদ্ধ করার প্রয়াসে বা কবিতাটির পাঠ প্রতিক্রিয়া নিয়ে আমি টানা দশ বছর বকবক করতে পারি। ইতিমধ্যেই অন্তত তিন লক্ষ বার আমার নিজস্ব আয়নার সামনে এ কবিতা পাঠ করেছি। এখনও করি। আজীবন করবো। আমার সত্তায় স্বভাবে শরীরের প্রতিটি রোমকূপে মৌলবাদের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার দৈনিক সংগ্রামে এই কবিতা আমাকে আজও আশাবাদী করে রাখেযে মুক্ত চিন্তারযে আশাবাদের প্রচার আজ এই সামাজিক রাজনৈতিক অতিমারী সময়েও ভীষণরকম প্রাসঙ্গিক।      

‘... দরজা খুলে দাও,
লোকে ভেতরে আসুক।

মুখুজ্যেতুমি লেখো।।’   

9 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - শুক্লা পঞ্চমী

Posted in



"অচিন পাখি"- আধ্যাত্মবাদে এক সুপরিচিত নাম। যাকে শিল্পে সাহিত্যে গানে কবিতায় নানাভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। আধ্যাত্মবাদ নিয়ে আমার সারা জীবনের আগ্রহ। বিশেষ করে জন্ম এবং মৃত্যু। একটা প্রক্রিয়ায় মানুষের জন্ম হয়। ধীরে ধীরে কাঠামো গড়ে উঠে। অজস্র সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অণু পরমাণু নিয়ে কাঠামোটি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। এই যে দেহ পরিচালনাকারী শক্তি – কেউ কেউ তাকে অচিন পাখি বলে আখ্যায়িত করেছেন। জন্মমৃত্যুর রহস্যের কোনও কূলকিনারা নেই। যুগ যুগ ধরে বহু দার্শনিক আধ্যাত্মবাদকে নানাভাবে নানারকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিজ্ঞানীরাও বাদ যাননি। খুঁজেছেন, এখনো খুঁজে চলেছেন এর স্বরূপ। আপাতদৃষ্টিতে জন্মের রহস্যে বিজ্ঞানীরা বেশ খানিকটা এগিয়েছেন। কিন্তু মৃত্যুর ব্যাপারে একেবারেই ধোঁয়াশায়। মৃত্যুকে ভয় নেই এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম। মানুষ জীবনকে বড্ড ভালবাসে, তাই হয়তো মরণকে ভয় পায়। মরণভীতি শুধু মানুষের বেলায় নয়। অন্যান্য প্রাণীরাও এর থেকে আলাদা নয়। একটা বাঘকে যখন আটকে ফেলা হয়, প্রথমেই যে ভীতিটা কাজ করে তা হচ্ছে মৃত্যুভয়। সাপের ক্ষেত্রেও তাই। একটা সাপ তখনই আঘাত করে যখন বোঝে সে বিপদগ্রস্ত। হয়তো ভাবে, সে মৃত্যুর সম্মুখীন। জন্ম এবং মৃত্যুকে ঘিরে কিছু অদ্ভুত জিনিসও ঘটে। যেটাকে বলে মিরাক্ল। যেখানে বিজ্ঞান বা ধর্ম দুটোই যুক্তিহীন হয়ে পড়ে। লালনের গানটিই তখন যথার্থ বলে মনে হয়...

চিরদিন পোষলাম এক অচিন পাখি
ভেদ পরিচয় দেয় না আমায়
সেই ভেবে ঝরে আঁখি—

কী অদ্ভুত দর্শন! নিজের দেহের ভিতর বাস করে যে পাখিটা, তাকে আমরা চিনতে পারি না। কী বলে বিজ্ঞান? বৈজ্ঞানিক যুক্তি আদৌ কি ফলপ্রসূ?

এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরাও দ্বিমত পোষণ করছেন। বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকগণ মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের প্রশ্নে সংশয়বাদের আশ্রয় নেন। বিজ্ঞানীরা কেউ কেউ বিশ্বাস করেন ব্রেনের বাইরেও আত্মা বলে একটা জিনিস আছে। যেটা চলে গিয়েও কখনো কখনো মৃত ব্যক্তির শরীরে ফিরে এসেছে। আমরা জানি আত্মার দুটো কাল আছে – ইহকাল এবং পরকাল। লোকায়ত মতবাদ থেকে এ ধারণা এসেছে। অনেক মানুষ মনে করে মৃত্যুর পর আত্মা বেঁচে থাকে। কোনও কোনও ধর্ম মনে করে আত্মার পুনর্জন্ম হয়। আবার কোনও ধর্ম মনে করে, ইহকালের কর্মফলের কারণে আত্মা শাস্তি পায়। মূলত পরকালের আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার্য। অধিবিদ্যিয় (মেটাফিজিক্স) মডেলগুলো বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর আত্মা বেঁচে থাকে। অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিক্স কী, সেটা স্বল্প পরিসরে জেনে নেওয়া যাক। মেটাফিজিক্স হল দর্শনের একটি শাখা, যা বিশ্বের অস্তিত্ব, আমাদের অস্তিত্ব, সত্যের ধারণা, বস্তুর গুণাবলী, সময়, স্থান, সম্ভাবনার দার্শনিক আলোচনা করে। এই ধারার জনক দার্শনিক অ্যারিস্টটল।

Metaphysics is the branch of philosophy that examines the fundamental nature of reality, including the relationship between mind and matter, between substance and attribute, and between potentiality and actuality.

অধিবিদ্যায় দুটো মূল প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়-

১-সর্বশেষ পরিণতি কী?
২- কিসের মত?

এই দুটো ধারাই বস্তু বা সত্তার অন্তর্নিহিত রূপকে জানার চেষ্টা করে। বাস্তবিক অর্থে আত্মা বা স্পিরিট নিয়ে সর্বশেষ কোনও সমাধান কেউ দাঁড় করাতে পারেননি। মানুষ নিজের মত করেই ভেবে নেয়। মৃত্যুভীতি নিয়েই জীবনকে চালিয়ে নেয়।

সবার মত আমারো মৃত্যুভয় ভয়ঙ্কর। ছোটবেলায় কেউ মারা গেছে শুনলে ঘর থেকে বেরোতাম না। মায়ের আঁচল ধরে বসে থাকতাম। বাথরুম পেলে খুব চেপে যেতাম। মায়ের সামনে সহজে আওয়াজ বের করতাম না। এতো ভয় পেতাম দেখে মা শিখিয়ে দিয়েছিলেন, কৃষ্ণনাম জপ করলে ভয় চলে যায়। এই বিশ্বাস নিয়ে মনে মনে এগোলেও বাস্তবে খুব একটা কাজে লাগাতে পারিনি। বিশেষ করে রাতের বেলায় কিছুই কাজে আসতো না। গ্রামের বাড়ি ইলেক্ট্রিসিটি নেই, আমগাছ জামগাছ বাঁশঝাড়ের মটমট শব্দ সবই যেন মৃত্যুভীতির পরিপূরক। এর মধ্যে পুড়িয়ে ফেলা মনে হলে শিরশির করে উঠত গা। আর কবরের ব্যাপারটা আরো ভয়ঙ্কর। সাদা কাপড়টা নিয়ে নাকি লাশ উঠে আসে। এরকম দুই একবার আমাদের বাড়ির গোরক্ষক হরিকাকার মুখে শুনেছি। হরিকাকার স্টকে কত গল্প যে ছিল! তা এই ভীতু অতি আগ্রহী মানুষটিকে না বললেই যেন নয়।

মৃত্যু জিনিসটা শুধু ভয়েরই নয়, বেশ আগ্রহেরও। যত ভয় পেতাম তত আগ্রহ জন্মাত। মৃত্যু নিয়ে ভাবেননি এমন কেউ নেই। তবে কেউ কেউ মৃত্যুকে একেবারে উড়িয়ে দিয়েছেন। মৃত্যু ভাবনা নিয়ে আমার আজকের লেখা অচিন পাখির টানে। মৃত্যুকে কে কিভাবে দেখেন। এই যে দেহের ভিতর অচিন পাখি, তাকে তো সবাই অনুধাবন করেন। লালন দর্শনে বারেবারে তুলে ধরেছেন খাঁচা আর পাখি। যে কিনা দেহ নামক খাঁচাতে আটকে থাকে। সময় হলেই খাঁচা ফেলে চলে যায়।

মৃত্যুকে ভাবেন না এমন কেউ নেই। রবীন্দ্রনাথও মৃত্যু নিয়ে দোদুল্যমান ছিলেন। চলে যাওয়ার বেদনা যেমন তাঁকে তাড়িত করেছে, তেমনি মৃত্যুকে আহবান জানিয়ে শ্যামের সাথে তুলনা করেছেন। কখনো মৃত্যুকে চিরশান্তি বলে আখ্যায়িত করেছেন। 'মৃত্যুতে চিরশান্তি'। আদৌ কী তাই? কেন? ভয়ঙ্কর ভীতু মানুষটি স্বয়ং তিন তিনটে মৃত্যু খুব কাছ থেকে দেখেছি। এবং তিনটি মৃত্যুতেই পাখি নামক জিনিসটাকে চলে যেতে অনুভব করেছি। অসম্ভব দ্বিপার্শ্বিক টানাটান গমনরত মানুষটিকে ক্লান্ত করে তোলে। একদিকে বেঁচে থাকার মায়া ,অন্যদিকে চলে যাওয়ার বেদনা প্রতিটা শিরায় শিরায় যেন সঞ্চালিত হয়ে ওঠে। তার মুখ, নিঃশ্বাসপতন ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে।

খুব কাছে থেকে দেখা সম্প্রতি আমার বাবার মৃত্যু। ঠিক দুপুর বারোটা পাঁচ। আমি বাবার হাত ধরে বসে আছি। ঘাম হচ্ছে ত্বকে, অনুভূত হচ্ছে কিন্তু বাইরে বোঝা যাচ্ছে না। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি মুখের দিকে। মনে হচ্ছে কার সাথে যেন লড়াই করে যাচ্ছে। ছোট্ট পাখিটা গলার কাছে ঘরঘর শব্দে কিচির মিচির করে যাচ্ছে। জিভটা শুকিয়ে আসছে বারবার। একফোঁটা একফোঁটা করে জল দিয়ে যাচ্ছি। এটাও যেন পরপারে যাওয়া এক যোদ্ধার সাথে সামিল হওয়া। হঠাৎ দেখলাম খুব বড় করে হাঁ করছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা যেন বেরোবে। তাকে চলে যাওয়ার জন্য যেন পথ খুলে দিচ্ছে। সেই হাঁ ক্রমশ বড় হতে থাকল। উপুড় হয়ে তাকিয়ে থাকলাম মুখের দিকে। দেখলাম ক্যাচ করে শব্দ করে কী যেন বেরিয়ে গেল। যা ধরার জন্য আমার বাবা দুইবার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। কিন্তু না, পাখিটা সত্যি খাঁচা ফেলে চলে গেল। পালস বিট দেখলাম আস্তে আস্তে চলছে। হার্টও সচল। খুব ধীর লয়ে থামাচ্ছে তার গাড়ি। এবারো টের পেলাম মানুষের শরীরে আত্মা বা স্পিরিট নামে একটা অচিন পাখি থাকে। যার শরীরের অন্যান্য অর্গ্যানগুলোর সাথে কোনও সম্পর্ক নেই। সে থাকলে তারা সচল না থাকলে অচল। আমার মত মৃত্যু নিয়ে অনেকেই ভেবে থাকেন। বিখ্যাত ব্যক্তিরাও এর থেকে আলাদা নন, যেমিনটি আমি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বলেছি।

মৃত্যু নিয়ে কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের উক্তি থেকেও জানা তাদের মৃত্যু ভাবনা।

"জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে? চিরস্থির কবে নীর হায়রে জীবন নদে?" মাইকেল মধুসূদন দত্ত

"মৃত্যু কি সহজ, কি নিঃশব্দে আসে অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়" -- সমরেশ মজুমদার

"আমি মনে করি মৃত্যু হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে অসাধারণ উদ্ভাবন। এটি জীবন থেকে পুরনো ও সেকেলে জীবন থেকে মুক্ত করে" -- স্টিভ জবস

"এই যে বেঁচেছিলাম দীর্ঘশ্বাস নিয়ে, যেতে হয় সবাইকে অজানা গন্তব্যে। হঠাৎ ডেকে উঠে নাম না জানা পাখি অজান্তেই চমকে উঠে জীবন, ফুরলো নাকি! এমনি করেই সবাই যাবে যেতে হবে" রুদ্র মহম্মদ শহীদুল্লাহ

জীবনানন্দ তাঁর "মানুষের মৃত্যু হলে" কবিতায় বলেছেন-
মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব
থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে
প্রথমত চেতনায় পরিমাপ নিতে আসে

বলতে গেলে জীবন ও জীবনবোধ এবং মৃত্যু নিয়ে বলে গেছেন সব গুণীজন। ভাবি এই যে, জন্মরহস্য হাজার হাজার শুক্রাণুকে ঠেলে নিজের জায়গা করে নেওয়া পরবর্তীতে শুধু ঠাঁই ঠাঁই নাই করে তরী ভারী করা... এসবই বেঁচে থাকার চরম স্বার্থপরতা কিনা।

আজকাল মানুষের দৌরাত্ম্য ভাবিয়ে তুলছে। কী না করতে পারছে মানুষ। বলতে গেলে জন্মমৃত্যু নিয়েও খেলছে। জন্মমৃত্যু নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। যদিও ধর্ম এবং বিজ্ঞান এ নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে আগেই আলোচনা করেছি। সেদিকে আর আলোকপাত করতে চাচ্ছি না। আমার আলোচ্য বিষয় জন্ম এবং মৃত্যুর অচিন পাখি। মানুষের আগমন থেকে প্রস্থান। এই দুইয়ের মধ্যিখানের সময়টা শুধুই লড়াই। বাস্তব পরাবাস্তবতার অন্তক্ষরণের সমীকরণ। হিন্দু শাস্ত্রে মানুষের জীবন কর্মকে চারটা ভাগে ভাগ করেছেন।

ব্রহ্মচর্য
গার্হস্থ্য
বাণপ্রস্থ
সন্ন্যাস

জীবনের প্রথম ভাগেই রয়েছে শিক্ষা। গুরুসমেত বিদ্যাপিঠে পরবর্তী জীবন যাপনের জন্য সুশৃঙ্খল জ্ঞান অর্জন করা। গুরুকুলকেই শিক্ষার প্রথম পাঠ ধরা হয়। যার পাঠক্রিয়া রামায়ণ ও মহাভারত এবং বেদে পরিস্কার ভাবে পাওয়া যায়। সর্বশেষ ধর্মগ্রন্থ "কোরানুল করিমে" আছে জন্ম থেকে কবর অবধি শিক্ষা। অর্থাৎ সুশৃঙ্খলতা। শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষের বেঁচে থাকা। তার কৃতকর্মই তার পথ নির্দেশনা দেবে। মৃত্যুর পরে আদৌ কোন কিছু আছে কিনা তা কোনদিনই মানুষ জানতে পারবে না। শরীর থেকে অচিনপাখি বেরিয়ে গেলেও মানুষের চোখেমুখে ভেসে উঠে শান্তির ছাপ। মনে হয় দীর্ঘপথচলার ক্লান্তিময় ঘুম। যা রবীন্দ্রনাথের গানের মতই বলতে হয় "এইখানে শান্তির পারাবার"।

এই লেখাটা যখন শুরু করেছিলাম তখন টিনের চালে টুপটুপ বৃষ্টি পড়ছে। ফিকে হয়ে গিয়েছে দিনের আলো। বলা চলে সন্ধে, তবুও খানিকটা বিকেলের আমেজ একপাটি খোলা জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সন্ধিক্ষণের দ্বৈরথ। অর্থাৎ বিকেল বলছে যাবো না, সন্ধে বলছে আমি এসে গেছি। কী অদ্ভুত নিয়ম প্রকৃতির মাঝে! চলে গিয়েও আবার ফিরে আসে নতুন রূপে। প্রাণীদের বেলায় তা হবার নয়। এখন শ্রাবণ মাস। আকাশের মনের কোনও স্থিরতা নেই। যখন ইচ্ছে ঢলে পড়ছে। একটু আগেও বোঝার উপায় ছিল না এমন হুড়মুড় করে বৃষ্টি ঝরবে। দুদিন হল বেড়াতে এসেছি। গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সমতল ভূমি সুসং দুর্গাপুরে। উদ্দেশ্য, শতবর্ষী শাশুড়িমাতাকে দেখা। প্রহর গুনছেন অমোঘ নিয়মের। শ্রাবণ মেঘের ধারাপাত শুনে হঠাৎ বলে উঠলেন "এটা কী শ্রাবণ মাস?" জানিনা শ্রাবণের বৃষ্টিপতন তাঁর মনের উপর কী রেখাপাত করেছে। আমিও ভাবছি, এই যে ঠাণ্ডা অক্সিজেন বুক ভরা নিশ্বাস অচিন পাখির অস্তিত্বকেই ধারণ করে। আমি রোজকার মত দেহের খাঁচা ধুই, পরিষ্কার করি মুছে রাখি সযতনে। পাখি শূন্য হলে সবই বৃথা। সাধ আর সাধ্যের খুনসুটিতে পড়ে মনটা মাঝেমাঝে বিগড়ে যায়। তখন মৃত্যুর মত সরল সত্যকে অনেকটা শ্যামের মতই লাগে। দূরে বাজে অষ্ট আঙুল বাঁশের বাঁশি আর আমি নির্জনে খুঁজি আত্মহারা কবিতা। যে কবিতা ছুঁয়ে যায় শূন্য খাঁচায়। আমার স্মৃতি বিস্মৃতির মধ্য সীমানায়। সক্রেটিসের মৃত্যু ভাবনা দিয়ে আমার সামান্য ভাবনার পরিসমাপ্তি টানছি "I to die, you to live, which is better only God knows."

0 comments: