0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়



ঋতবাক ৫ম বর্ষ, ১২তম সংখ্যা। সময়টা স্মৃতিমেদুর। পাঁচ বছর পূর্ণ করে ছয়ে পা দিতে চলেছে ঋতবাক। একটা পথ চলা। সব সময় সমান যায়নি। অনেক উত্থান পতন, তবু দিশা পরিবর্তন হয়নি। যাঁরা ছিলেন, যাঁরা আছেন, সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা। 

বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আমাদের আনন্দ ঘোষণা, এই সংখ্যা থেকে পত্রিকার কার্যনির্বাহী সম্পাদকের পদ অলংকৃত করবেন বন্ধুবর শিশির রায়, সাহিত্য জগতে যাঁর পরিচয় দিতেই লাগে না। আমরা সম্মানিত বোধ করছি।

এদিকে আশেপাশে চলছে অনেক কিছুই। ডাক্তার পেটানো, বিশ্বকাপে ভারতের পারফরমেন্স, রাজনৈতিক গুলতানি, ইত্যাদি প্রভৃতি। কিন্তু জরুরী একটা বিষয় বহুল ঘটনা স্রোতের মধ্যেই ভুস করে কেমন ভেসে উঠেই তলিয়ে গেল। খানিকটা চাপান উতোর হলো অবশ্য, তবুও কিছু প্রশ্ন রয়েই গেল। 

বলি খোলসা করেই! হ্যাঁ, বিষয়টা - জল। পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীর পুরো পেয় জলের মাত্র কমবেশি ৫% গার্হ্যস্থ কাজে ব্যবহার করা যায়। অনেক অপচয় করলেও, যদিও সেটা একেবারেই কাম্য নয়, তবুও ১০%এর বেশি খরচ হয় না। বাকি ৯০% জল খরচ হয় কৃষি এবং শিল্পে। 

প্রথমে ধরা যাক, কৃষির কথা। যে কোনও দেশের কৃষি ব্যবস্থা বেড়ে ওঠে সে দেশের জলবায়ু বা আবহাওয়ার আনুকূল্যে। কিন্তু এখন যে সব উচ্চ ফলনশীল শস্য সারা বছর ধরে চাষ করা হচ্ছে, তাতে যে বিপুল পরিমাণ জলের প্রয়োজন, তার যোগান আসছে কোথা থেকে? 

এর পরে যদি শিল্পের কথায় আসি, সেখানেও তো অবস্থা তথৈবচ। ওই যে, ১ লিটার সফট ড্রিঙ্ক বানাতে ৭ লিটার জল অপচয় হয়, একথা এখন সবাই জানে। সবচেয়ে ভয়ানক কথা হলো মাটির নীচ থেকে যথেচ্ছ জল তোলায় কোনও বাধা নেই। মাটি যার মাটির নিচের জলও তার। আশ্চর্য নিয়ম!

আরও আশ্চর্যের বিষয়, এখনও পুকুর বোজানো, পুকুরের পাড় বাঁধিয়ে ফেলা, যথেষ্ট পরিমাণে গাছ না লাগানো হয়েই চলেছে। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে, পুরসভার অনুমতিপ্রাপ্ত বহুতলগুলিতে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং মাস্ট নয়। যথেচ্ছভাবে মাটির উপরিতল কংক্রিটে মুড়ে ফেলাও বারণ নয়...

কি হচ্ছে এসব!

আকাটেও নিজের বাড়ির যত্ন নেয়! বাড়ি না থাকলে থাকবো কোথায়? কি জানি, বাবা

সচেতনতার উদয় হোক, একে আত্মসচেতনতাই বলা ভালো...

শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ



বাজার ভগবান
রঞ্জন রায়


এই ভ্যাপ্সা গরমে বুকে কফ জমে গিয়ে চিত্তির! শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। পুরনো ব্রংকাইটিসের ধাত। শেষে দুগ্গা বলে প্রেডনিসোলোন নামের স্টেরয়েড দুই গুলি আর একটা বাজারচলতি ব্রংকোডায়ালেটর কফ সিরাপ দুই চুমুক খেয়ে গোঁফ মুছে টিভি চালিয়ে পিঠে বালিশ আর হাতে বই নিয়ে একটু আরামে শুয়েছি কি কখন চোখ লেগে গেছে!

স্বপ্ন দেখলাম যে আমি একটা মহান আর্ট ফিলিম বানিয়েছি। মাত্র পাঁচ মিনিটের। তাতে নাচা-গানা নেই। নায়ক-নায়িকা নেই। ঢিসুম-ঢিসুম নেই। কোন আইটেম সং নেই। কিন্তু সাউন্ড ট্র্যাক আছে। আর সেই জিনিসটা টালিগঞ্জের ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে একটা ছোট প্রোজেকশন রুমে দেখানো হচ্ছে। ফিলিম শুরু হতেই দেখি সার্টিফিকেটে লেখা আছে যে ওটা ডিপ্লোমা ফিলিম, কোন আর্ট ফিলিম নয়। বিষম খেলাম। তারপর দেখি ফিলিমের ল্যাংগোয়েজ হিন্দি। মাইরি! আমি ফিলিমের লাইনে এয়েচি, তাও হিন্দি ফিলিমের ন্যাজ ধরে? "এ যে শালা জ্যাকপট!'' কিন্তু, নামটা "বাজার মেঁ বাজা'', আবার ইংরেজি সাব টাইটেলে "ড্রামস্ অ্যাট বাজার''। পাশ থেকে কেউ ফিস ফিস করলো--- বুঝলেন, বাজার নামে সাগর সরহদীর একটা সিনিমা আগেই হয়ে গেছে। মন্ডী নামে শ্যাম বেনেগাল বানিয়েছেন। কাজেই "ড্রামস্ অ্যাট বাজার'', পাবলিক খুব খাবে।

--- ধেত্তেরি! শুরু করুন তো!

শুরু হল। সে কি সিনেমা ? অ্যাকেবারে সারিডন।

প্রথমে পর্দা জুড়ে একটা স্যাকরার নিক্তি, যেটা আস্তে আস্তে বাঘাযতীন বাজারের আলুওয়ালার দাঁড়িপাল্লা হয়ে গেল। সেই পাল্লা আস্তে আস্তে উঠছে আর নামছে, খানিকটে আদনান সামির "মুঝকো ভি জরা লিফ্ট করা দে'' স্টাইলে। সাউন্ড ট্র্যাকে শোনা যাচ্ছে কিছু শব্দ, দাঁড়িপাল্লা ওঠানামার তালে তালে।

----বা--জা--র। সাপ্লাই, ডিমান্ড, নাফা-নুকসান, বা--জা---র! মোল-ভাও, গ্রাহক-খাতক, খরিদ-বিক্রি, বা--জা-র! নগদ- উধার, ডিস্কাউন্ট-প্রিমিয়াম, লেওয়ালিয়া-দিওয়ালিয়া,বাজার।
একটা শট, রতনপুরের শনিবারের পশুবাজার। সারি সারি মোষ জাবর কাটছে আর পাগড়ি মাথায় ছাতিবগলে খরিদ্দাররা মোষের ল্যাজ তুলে দেখছে। পশুমালিক মোষের মুখ খুলিয়ে কটা দাঁত উঠেছে, দেখাচ্ছে। কাট।

মেয়ে দেখতে আসা পাত্রপক্ষ মেয়ের চুল খুলে দেখছে, হাঁটিয়ে দেখছে। কাট।

রায়পুরের বাবুলালগলির নগরবধূরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। বুড়ো এবং অল্পবয়েসি খদ্দের তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। একটি মেয়ে কায়দা করে বুকের আঁচল ফেলে দিল। কাট।

ক্যামেরা বিলাসপুরের শনিচরি বাজারের মাঝখানে ঘুরছে। বাসনপত্রের দোকান, মুদি দোকান, মুড়িতেলেভাজার দোকান ছাড়িয়ে রাস্তায় কোদাল-ঝুড়ি-গাঁইতি নিয়ে বসে থাকা একদল মেয়েপুরুষের মুখের ওপর ক্লোজ-আপ। ওরা রোজিতে যেকোন কাজের জন্যে মজুর খাটতে যাবে। সাউন্ড ট্র্যাকে বাঁশিতে রবীন্দ্রসংগীতের সুর --- আমারে কে নিবি ভাই,বিকাতে চাই আপনারে। ফেড আউট। গব্বযন্তণা শেষ। ঘুম ভেঙে গেল।

দেখি, বুকের ওপর আদ্দেক পড়া বইটি নিয়ে ঘুমুচ্ছিলাম। বইটি Total Capitalism: Market Politics, Market State। লন্ডন নিবাসী লেখক কলিন লেজ নিজের পাড়ার লোক্যাল অথরিটির একটি চিঠি পেয়েছেন। আর পেয়ে ব্যোমকে গেছেন। কারণ ঐ চিঠিতে তাঁকে সম্বোধন করা হয়েছে "কাস্টমার'' বলে। কি জ্বালা! উনি তো লোক্যাল কাউন্সিল থেকে কিছু কেনেন না। উল্টে লোক্যাল কাউন্সিলের প্রতিনিধিদের উনি ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন। শুধু তাই নয়, এনাদের দেয়া ট্যাক্সো থেকেই কাউন্সিলের খরচাপাতি চলে। তবে উনি নির্বাচক নাগরিক থেকে "খদ্দের'' অভিধায় ভূষিত হওয়ার মত এমন কি মহা কাজ করেছেন? ভাবতে গিয়ে বুঝলেন যে সার্কুলার পাঠানো আমলার চোখে লোক্যাল কাউন্সিলও একরকম কর্পোরেশনই বটে যে কিছু বিক্কিরি করে, হয়তো "স্যাটিস্ফ্যাকশন'' বেচে। অবাক হওয়ার কিছু নেই। সমসাময়িক পুঁজিবাদের দর্শনে সবকিছুই মুনাফা-কামানো সংগঠন হওয়া উচিৎ। সবকিছু। এমনকি আগে যা সরকারের কাজকম্মো বলা হত, এমন অনেককিছু। বলা হয় যে ভূমণ্ডলীকৃত দুনিয়ায় বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা দক্ষতা বাড়াবে। পাব্লিক সার্ভিস নিয়েও মার্কেট প্লেয়ারদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা সার্ভিসের কোয়ালিটি বাড়াবে। কাজেই যে আমলাটি সার্বভৌম নাগরিকদের কাস্টমার বলে ভাবতে শিখেছেন,তিনি আসলে ঐ দর্শনের ভাবনার শরিক হয়েছেন।

এইবার লেখকের মাথায় টিউবলাইট জ্বলে ওঠে। গোটা সমাজের নাগরিকদের গ্রাহক হিসেবে ভাবা-- আজকের সর্বাঙ্গীন পুঁজিবাদের দর্শন-- কোথায় যেন প্রথম বিশ্বমহাযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে! কেন দিচ্ছে? হ্যাঁ, কারণ সেই প্রথম শোনা গেল -- সর্বাঙ্গীন যুদ্ধ। লড়ছে দুটি সৈন্যবাহিনী নয়, লড়ছে দুটি সমাজ; যুযুধান দুই দেশের সমস্ত নাগরিক।

তবে দুই পরিস্থিতির মধ্যে তফাৎও বেশ মজাদার।

সর্বাঙ্গীণ যুদ্ধের পরিস্থিতিতে সব দেশেই সিটিজেনদের আর্থিক ও নাগরিক স্বাধীনতা, অবাধ মুক্ত বাজার, এমনকি জাতীয় সার্বভৌমত্ব, সবকিছুই কমবেশি একধরণের মিলিটারি সোস্যালিজমের আওতায় চলে আসতে থাকে। ওদিকে সর্বাঙ্গীণ পুঁজিবাদ বা "টোটাল ক্যাপিটালিসম'' এ হয় ঠিক উল্টোটা। বাজার হয়ে ওঠে "প্রভু"। তার আওতায় শুধু জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও নাগরিক অধিকারই নয়, সমগ্র ব্যক্তিগত ও সামজিক জীবনই বাজারের গোলাম হয়ে পড়ে। পাবলিক ও প্রাইভেট কাজকম্মের সীমারেখা ক্রমশই ধূসর হয়ে পড়ে। আর ধীরে ধীরে সরকারের নাগরিক পরিষেবাগুলি, যেমন ধরুন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, গবেষণা, দূরসঞ্চার, প্রকাশনা, বিদেশি ঋণ, জমি, জল, শিল্পকলা এবং নাগরিকদের জন্যে নীতিনির্ধারণ, এসবই ক্রমশ বেশি বেশি করে সরকারী ক্যাবিনেটে নেমন্তন্ন করে নিয়ে আসা প্রাইভেট এক্সপার্টদের হাতে ছেড়ে দেয়া হতে থাকে। এইভাবেই সমস্ত বিষয়গুলো দ্রুত "এফিসিয়েন্সি''র নামে "মার্কেট-ড্রিভেন-পলিসি''র অধীনে আনা হয়। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের উন্নত সমাজ গড়ার চেষ্টায় নিবেদিত এই জনসেবামূলক কাজগুলো তাদের আদি চরিত্র হারিয়ে ফেলে বেশি মুনাফার সম্ভাবনাময় কিছু প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট-এর চেহারা নেয়। অধ্যাপক কলিন লেজ অক্সফোর্ড, সাসেক্স ও আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিশাস্ত্র পড়িয়েছেন। বর্তমানে কানাডার কুইনস্ ইউনিভার্সিটিতে এমেরিটাস প্রফেসর। উনি "দ্য সোশ্যালিস্ট রেজিস্টার" নামের প্রখ্যাত বার্ষিক প্রকাশনের যুগ্ম সম্পাদকও বটেন। আর বর্তমানে বৃটেনের ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিসের প্রাইভেটাইজেশনের বিরুদ্ধে আপ্রাণ লড়ে যাচ্ছেন। কেন? ক্রমশ প্রকাশ্য।

সে নাহয় হল। কিন্তু এই "নয়া দৌড়''-এর জমানার রাজনীতির চেহারাটি কেমন হবে? ওঁর কথা হল, এই নিও লিবারালিজমের জমানায় পুঁজির ওপর আর লাগাম থাকবে না। ফলে একসময়ের অত্যন্ত শক্তিশালী সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাজনীতিও ক্রমশ বাজারের স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল হবে। আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো আগের চেয়ে আরও বেশি করে সুপার পাওয়ারের রাজনীতির অধীন হবে। আর সেটা নাকি গণতন্ত্রের পক্ষে খুব খারাপ হবে!
(দূর! দূর! সেই বাঁধাবুলি। এ আমি কোলকেতায় অনেক শুনিচি। বোরিং! বই বন্ধ করে টিভি খুললাম। নিউজিল্যান্ডের ছানাপোনাদের বিরুদ্ধে সৌরভ ১৪ রান করে আউট। চ্যানেল ঘোরাতেই দেখি কন্ডোলিজা রাইস দিল্লিতে প্লেন থেকে নামছেন। আমি ভাবতে লাগলাম, কন্ডোলিজাকে কোথায় কোথায় কস্মেটিক সার্জারি করে নাওমি ক্যাম্পবেল বানানো যায়! ইস্, এইবয়সে এসব কি বিকৃতি! আবার বই খুল্লাম।)

আচ্ছা, উনি যদি অন্যদের মত খালি আম্রিকাকে গালি দিয়ে সস্তায় বাজিমাৎ করতে চান তাহলে আর পড়বো না। চ্যারিটি বিগিনস্ অ্যাট্ হোম। নিজেদের কতা বলুন দেখি, কত বুকের পাটা? আর কতটা ভণ্ডামি? উনি কি আমার মনের কথা জানতে পেরে গেলেন! পরের পাতা ওল্টাতেই দেখি--- আমি নিজের দেশ বৃটেনকেই আমার অধ্যয়নের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছি। এর কারণ, ম্যাগি থ্যাচার বাজারের মহারাণী বটেন। ওঁর নেতৃত্বেই বিশ্বজুড়ে সোশ্যাল ডেমোক্রাসি ছেড়ে টোটাল ক্যাপিটালিজমের গলায় বরমালা পরিয়ে দেয়ার শাঁখে ফুঁ পড়েছিলো। আর আমার এম্পিরিক্যাল এভিডেন্সের জন্যে বেছে নিলাম দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক সার্ভিস্--- পাবলিক সার্ভিস টেলিভিশন আর পাবলিক হেল্থ সার্ভিস। কি ভাবে এই দুটো ফিল্ডে পলিসির বিবর্তন ক্রমশ জনস্বার্থের সমগ্র ধারণা থেকে সরে এসে বিশ্ববাজারের চাপের কাছে নতিস্বীকারের ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা আমি সবাইকে খুঁটিয়ে দেখাতে চাই।

--- কেন চান, মশাই?

--- কেন চাই? আমি চাই পুঁজিবাদকে যেখানে তার কোনও কল্যাণকামী ভূমিকা নেই, সেখান থেকে তাড়িয়ে দিতে। আমি চাই ভবিষ্যতের সামাজিক সংগঠনের জন্যে একটি অ-পুঁজিবাদী রাস্তা খুঁজে বের করতে।

এঃ! হাতি-ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল?

উনি মুচকি হাসলেন। বুড়ো শুনতে পেল নাকি? খেয়েছে!

-- আরে শোন, কল্যাণকামী রাষ্ট্রের সামাজিক সেবাগুলোকে ক্রমশ পেরাইভেট করা এই টোটাল ক্যাপিটালিজম-এর একদম খাস ফিচার, আর তোমার মত তথাকথিত প্রগতিশীল সবজান্তা-বোকচন্দররা প্রথমে কিন্তু-কিন্তু করে, তারপর মেনে নেয়। খেয়ালও করেনা যে জনসেবার পেরাইভেট করা শুরু হতেই একটি মারাত্মক ক্ষতিকর চক্র ঘুরতে শুরু করে।

---কি আটভাট বকছেন! মারাত্মক? কার জন্যে মারাত্মক? ঝেড়ে কাসুন তো।

--- সে তুমি দিচ্ছ কোথায়? আমি মুখ খুল্লে দুটো পয়সা পাই। তুমি পাওনা, তবু তোমার মুখ বর্ষাকালের নর্দমার মত কলকল করেই চলেছে। বলা ছেড়ে এবার একটু শোনার অভ্যেস কর। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। গণতন্ত্রের সফল হওয়ার দুটো ইম্পর্টান্ট শর্ত হল সামাজিক ঐক্যবোধ ও নাগরিকদের বেসিক সাম্য। সোশ্যাল সার্ভিসের প্রাইভেটাইজেশন বা তোমাদের রাষ্ট্রভাষায় ''নিজীকরণ'' হলেই এই দুটো কন্সেপ্টের বাঁশ হয়ে যায়। তোমরা ব্যপারটা খেয়ালও কর না, খালি বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বল- ইট ডাজন্ট্ ম্যাটার হু প্রোভাইডস্ দ্য সার্ভিস, সো লং অ্যাজ্ ইট ইজ পেইড্ ফর আউট অফ ট্যাক্সেস্, বা ঐ জাতীয়কিছু প্রোফাউন্ড নন্সেন্স্।

---আচ্ছা, এই সার্ভিস গুলোর নিজিকরণের মাধ্যমে বাজারিকরণ বা বাজারে রুপান্তরের ব্যাপারটা, মানে প্রক্রিয়াটা একটু বুঝিয়ে বলবেন?

--কেন, তুমি জেনে কি করবে?

---আগেভাগে সতর্ক হবো। মানে এগুলো তো আমাদের দেশে বেশিদিন শুরু হয় নি।

--বটে! রেলে করে যাতায়াত কর? বেড়াতে যাও? খেয়াল করেছ যে ক্যাটারিং ব্যাপারটা অনেকদিন পেরাইভেট হয়ে গেছে?

--বাজারের নিয়মে দাম বেড়েছে, বেশ! কিন্তু সার্ভিসের কোয়ালিটি?

--- আমি কি বলব? ছোটবেলায় বাবার সংগে বেড়াতে গেলে বম্বে মেলে সক্কালবেলা ডাইনিংকার থেকে আসা টি-পট, মিল্ক পট, সুগার কিউব আর টোস্ট। দুপুরে সরুচালের ভাত আর চিকেনকারি--- মনে ছবি হয়ে আছে। এখন ডেলি প্যাসেঞ্জারি করি কি বেড়াতে যাই--- ঘরের থেকে টিফিন ডাব্বা ভরে নিই।

বুড়ো গজগজ করতে থাকে --- তোমার মত আতাক্যালানে সতর্ক হবে, লোককে সতর্ক করবে? আরে আগে নিজের প্যান্টের জিপ বন্ধ কর।

আমি অপ্রস্তুত। বুড়ো একটু নরম হয় --- শোন, কোন পাবলিক সার্ভিসের বাজারু হতে গেলে আগে গোটা তিনেক শর্তপুরণ আবশ্যক।
(শালা! সে তো কোনও মেয়ে বাজারু হতে গেলেও লাগে, যেমন ''নথ উতারনা'' উৎসব। এতা আবাল কি নতুন কতা!)

এক, এই পাবলিক সার্ভিসের অখণ্ড রূপটিকে খণ্ড খণ্ড করে আলাদা আলাদা ডিস্ক্রিট সার্ভিস বানাও। আর তাতে আলাদা প্রাইস ট্যাগ্ লাগাও। তারপর ফেলো কড়ি মাখো তেল। দাঁড়াও, রেলের হেল্থ সার্ভিস এখনো পেরাইভেট হয়নি। ধর, রেলের কর্মচারির অসুখ হল। সে তার কার্ড নিয়ে একটি ন্যূনতম ফি দিয়ে রেল হাসপাতালে নাম রেজিস্ট্রি করালো। তখন রেল হাসপাতালের দায়িত্ব তাকে ভাল করে সুস্থ করে ডিউটিতে ফিরিয়ে দেয়া। তার জন্যে যতকিছু চেক আপ হোক, ওষুধ লাগুক, এক্স -রে করতে হোক, সিটি স্ক্যান, অপারেশন করতে হোক – সব মিলে একটাই সার্ভিস, হেল্থ কেয়ার। তাকে আলাদা করে আর কোনও পে করতে হবে না। এই ব্যপারটাই পেরাইভেট হলে এটাকে অখণ্ড হেল্থ কেয়ার প্যাকেজ না করে সব রকম টেস্ট, সব রকম স্পেশালিস্ট চেক আপ, সার্জারি, সব কিছুর আলাদা প্রাইস লিস্ট। যে যেমন মালকড়ি দেবে, সে তেমন সেবা পাবে। রাষ্ট্রের সোস্যাল সার্ভিসের দিনে রোগীর কোন স্পেশালিস্টকে দেখাতে হবে, সার্জারি আদৌ দরকার কি না-- এসব সিদ্ধান্ত ডাক্তার নিত; পেরাইভেট হলে নেবে রোগির পরিবারের লোকজন। আলাদা আলাদা চেক আপের বা আলাদা আলাদা ডাক্তারের প্রাইস লিস্টের দিকে টুকুর টুকুর তাকাবে আর পকেটে হাত দিয়ে মাল্লু গুনবে।

দুই, এমন করতে হবে যাতে লোকে কোনও সার্ভিস নিজের গাঁটের কড়ি ফেলে কিনতে চাইবে। সেটা করতে গেলে প্রথমে রাষ্ট্র তার ''পরামর্শদাতা''(আসলে বাজারের দালাল)দের কথা শুনে নন-মার্কেট সেক্টরের জন্যে বাজেট প্রভিসন কম করে ফান্ড টাইট করবে, যাতে সরকারি সার্ভিসটির (আরে তোমাদের সরকারি হাসপাতাল, ইডিয়ট!) কোয়ালিটি সত্যি সত্যি মার খায়। ফলে বাধ্য হয়ে তোমার মত পাতি পাব্লিক কোনও বাজার-নির্ধারিত পেরাইভেট ক্লিনিক, পলিক্লিনিক, ড্রাগ স্টোরে লাইন লাগাবে।

তিন, বিশেষ জনসেবাটিকে সফল বাজারু সার্ভিস করতে হলে তার কর্মচারিদের মনোভঙ্গী, ওয়ার্ক এথিকস্ সব পাল্টাতে হবে। আগে লোককে সুস্থ করার যে সংযুক্ত লক্ষ্য এবং নীতি নিয়ে এরা কাজ করত, এখন সেসব ভুলে শুধু এমপ্লয়ারের প্রফিট বাড়ানোর জন্যে কাজ করবে। তাতে কোনও কম হলে পেছনে কিক্ খেয়ে বাড়ি যাবে। তাই কর্মচারিদের নীতি-ফীতি ভুলে প্রফিট-মাইন্ডেড করার জন্যে ঐ জব্ ইন্সিকিউরিটি বা পশচাদ্দেশে লাথির ভয়টা খুব জরুরি। বুঝলে না? তোমাদের বিলাসপুরের অ্যাপোলো হাসপাতালের বাওয়ালিটাই দেখ। অনেকদিন ধরেই লোকে কানাঘুসো করছিল যে এখানে মরলেও ডাক্তারদের রোগির আত্মীয়স্বজনদের তক্ষুণি জানাতে দেওয়া হয় না। ওপরের নির্দেশে আই সি ইউ তে আরো একদিন রেখে ডেডবডিতে ইন্জেকশন দেওয়া, অক্সিজেন দেওয়া, এসব করে মোটা বিল তুলে পরের দিন পুরো বিলটা আদায় করে তবে বডি হ্যান্ড ওভার কর হয়। কিন্তু অ্যাপোলোর সঙ্গে তকরার করবে? বেড়ালের গলায় কে ঘন্টা বাঁধবে? বেশ চলছিল।

কাল হল বিলাসপুরের মেয়র অশোক পিঙ্গলের চিকিৎসায় ঐ ফর্মূলা অ্যাপ্লাই করায়। গোপনকথাটি আর গোপন রইলো না। বিজেপি'র সরকার। ভাঙ্গচুর হল। কোর্ট কেস হল। হাইকোর্টের নির্দেশে হার্ট স্পেশালিস্ট ডঃ জয়রাম আইয়ারকে গ্রেফতার করা হল। অ্যাপোলো বিপদ বুঝে ওদের সেরা ডাক্তারকে গলাধাক্কা দিল। হাইকোর্ট হার্ট-স্পেশালিস্ট জয়রাম আইয়ারকে জামিন দিল না। তখন জয়রাম আইয়ার স্টেটমেন্ট দিলেন, অ্যাপোলো ম্যানেজমেন্ট মেয়র অশোক পিঙ্গলে মারা যাওয়ার একদিন পরে ডেথ সার্টিফিকেট দিতে ওঁকে একটি রুমে ফিজিক্যালি আটকে রেখে বাধ্য করে। বেরুতে দেয়নি। কারো সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি। কোথায় লাগে টিভি সিরিয়াল!

চার, এতে প্রাইভেট সেক্টরের প্লেয়ারের যে রিস্ক ইনভলভড্, তা সরকারকে ট্যাক্স পেয়ারের টাকায় আন্ডাররাইট করতে হবে। অমন হাঁ করে ভ্যাবাগঙ্গারামের মত তাকিয়ে আছ কেন?আরে বুশসায়েবের ৭০০ বিলিয়ন ডলার বিলটি সেনেটে পাস করানোর পরও যদি এই কন্ডিশন না বুঝতে পারো, তাহলে তোমার মাথায় সত্যি সত্যি গোবরপোরা। মন দিয়ে শোন। একবার যখন এই সেবা ক্রমশ কমোডিটি বা বাজারে বিক্কিরির জন্যে তৈরি মালের রূপ ধারণ কচ্চে, তখন "এ ফার্দার ডাইনামিকস্ কামস্ ইন্টু অপারেশন"। কম্পিটিশনের চাপে আসে ''টেলরিজম''--- অর্থাৎ, সস্তা শ্রমকে সরিয়ে দিয়ে মাহাঙ্গা মেশিন বা গ্যাজেট। ব্যাপারটা একটা সীমার বাইরে চলে গেলে সমস্ত পার্সোনাল সার্ভিস, বা সার্ভিসের মানবিক অংশগুলো (যেমন ধর কাউন্টারের সেল্সগার্ল মেয়েটি বিক্রির সময় ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে তোমাকে যে পার্সোনাল স্যাটিসফ্যাকশন দিচ্ছে, তা আর অর্গানাইজেশনের জন্যে ততটা প্রফিট দিতে পারে না, যতটা ''ক্যাপিটাল ক্যান আর্ন ফ্রম মাস-প্রোডিউসিং গুডস্''। আবার পুঁজির ধর্ম এমন যে সে গড়পড়তা লাভের চেয়ে কম কামাইওলা ক্ষেত্রে আটক থাকতে চায় না। এর ফলটা কি হয়?

-- কি হয়?

--আরে বুদ্ধু! সর্বত্র পার্সোনাল-সেবা-বিক্কিরির জায়গায় আসে মাস-স্কেলে প্রোডিউসড্ মেটিরিয়াল গুডস্ এর বিক্কিরি। পার্সোনাল টাচ্ অদৃশ্য হয়ে যায়। যতটুকু পার্সোনাল টাচ আগে ক্লায়েন্টকে দেয়া হত, সেটা ক্রমশ ক্লায়েন্টকে নিজে নিজে করতে বাধ্য করা হয়। ফের অতবড় হাঁ? কিস্যু হবে না। মুখ বন্ধ করে চোখটি খোল। চারদিকে তাকাও। দ্যাখ, ব্যাংক টেলারের জায়গায় এসেছে এটিএম মেশিন। পোস্টম্যানের জায়গায় কম্পুটার আর ই-মেল। নার্সের বদলে ড্রাগ এবং হার্ট মনিটর। সুপারমার্কেটে চেক-আউট স্টাফের জায়গায় চেক-আউট মেশিন। এয়ারপোর্টে চেক-ইন স্টাফের জায়গায় চেক-ইন মেশিন। এখন হোটেল খুলছে হোটেল স্টাফ ছাড়া, পড়ানো হচ্ছে টীচার ছাড়া, সিডি দিয়ে।পাবলিশিং হাউস খুলছে এডিটর না নিয়েই।

এই প্রক্রিয়ায় সেবা ব্যাপারটা ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এখন আর রোগী ফ্যামিলি ডাক্তারের সঙ্গে কনসাল্ট করবে না। প্রথমে রোজ আলাদা আলাদা নতুন ডাক্তারের দল দেখবে। তারপর ফলো আপ করতে নার্স বা তার সহকারীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। শেষে মেডিক্যাল সেন্টারে ফোন করে এক কম্পুটরাইজড্ প্রোটোকলের মাধ্যমে কল সেন্টার স্টাফ তোমার মেডিক্যাল প্রবলেমের সমাধান বাতলাবে। বোঝো ঠ্যালা! এরপরও তুমি ''ফুল সার্ভিস'' পেতে পার, কিন্তু ''অ্যাট্ ডিফারেন্শিয়েটেড হায়ার প্রাইস্''। তোমার খাবারটা আলাদা হবে,তোমার কেবিনে টিভি থাকবে, ইত্যাদি।

তাহলে দাঁড়াল কি? যাদের টাকা নেই, তারা বিভিন্ন গ্রেডের নিম্নমানের সার্ভিস্ পাবে অথবা একেবারেই পাবেনা। ওয়েলফেয়ার স্টেটে যা একসময় শুরু হয়েছিল এক ''কলেকটিভলি ডিটার্মাইন্ড্'' সামাজিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য পূর্ণ করতে, তা আজ পর্যবসিত হয়েছে মাস-প্রোডিউসড্ গূডস্ উঁচুদরে বিক্কিরির ধান্দাবাজিতে। আগে ছিল ''পাবলিক'', এক নাম-অবয়বহীন সমূহ। এখন ছোট-বড় আলাদা আলাদা ব্যক্তি। নাম-অবয়বহীন পাবলিককে বাজার অদৃশ্য করে দিয়েছে। সমাজকেও দেবে। কারণ, ""Total capitalism seeks a totally individualised population, without collective needs or universal values; for total capitalism there is, as Mrs. Thatcher put it, ''no such thing as society, only individuals and their families, spending their money in markets.''

কিন্তু, ভেবে দেখ, গণতন্ত্র কি সমাজ ছাড়া বাঁচতে পারে?

-- ধেত্তেরি, সমাজ আবার কোথায় যাবে? আর টেলিভিশনের গল্পটা বল্লেন না?

-- টেলিভিশনের গপ্পো? তোমাদের নিউজ চ্যানেলগুলো দেখ। চব্বিশ ঘন্টা ধরে যা দেখায় তার মধ্যে কতটুকু নিউজ, কতটুকু অ্যাড্ আর কতটুকু সিনেমা স্টার, টিভি স্টার আর ক্রিকেট স্টার নিয়ে নাচানাচি? এরপর ও আছে লাফটার চ্যানেল, লাফটার সার্কাস। সবই বাজার ভগবানের আশীর্বাদ! না,না, আমি যেটা বলছি মন দিয়ে শোনো। সার্বজনিক পাবলিক হেল্থ সার্ভিস্ না থাকলে একটা আইনের চোখে সবাই সমান বা সমান সুযোগ পাচ্ছে এই অনুভূতি নাগরিকদের কেমন করে হবে?

---যেমন করে অ্যাদ্দিন হয়েছে।

--- আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কি করে টিঁকবে যদি তার পলিসি নির্ধারণ বিশাল বিশাল কর্পোরেশনের মাথায় বসা কিছু মুষ্টিমেয় এলিট গ্রুপের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়? যাদের প্রায়রিটি হল কেবল শেয়ারহোল্ডারদের ভ্যালু বাড়ানোর জন্যে দাঁও-প্যাঁচ কষা!

আমি এতসব জানিনে। মাপ চেয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছি কি দেখি আমার বন্ধু বিজন আসছে সঙ্গে ছোট বোন বেবিকে নিয়ে। বেবি গেল রান্নাঘরে, ওর বৌদির সঙ্গে গল্প করতে। আমি বল্লাম - আরো একটু আগে আসলে পারতি। কলিন লেজ্ বলে এক ইংরেজ অধ্যাপক বাজার-বাজার করে আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছিল। বলে কি না বাজারবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।

--- দ্দুদ্দুর! ওসব বুদ্ধি করিসনি। ভগবানের সঙ্গে কি লড়াই করা যায়?

--- কি বাজে বকছিস-?

--- হ্যাঁরে, দেখনা, আজকে বোনকে দেখতে এসেছিল। রিজেক্ট করে গেছে, উল্টে জ্ঞান দিয়ে গেছে। ভাল করে খাওয়াদাওয়া করে শরীর ভাল কর, নইলে বিয়ে হবে না।

--- মানে?

--- মানে আর কি, বিয়ের বাজারে মেয়েরা মাংসের দরে বিক্কিরি হয়। তা, আমার বোনটি রোগা, তাই পছন্দ হল না। তাই বলছিলাম ভগবানের সঙ্গে কি লড়াই হয়? বাজার হল ভগবান।

[১০ বছর আগে অক্টোবর ২০০৮ এ লেখা। অবস্থা খুব পাল্টেছে কি?]

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সুরঞ্জন রায়

Posted in

প্রবন্ধ


পাসোলিনির সিনেমা যেন ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য’
সুরঞ্জন রায়


ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি জ্যোতিষ্কই যেমন পরস্পরের সঙ্গে বাঁধা আছে এক উপবৃত্তাকার গাঁটছড়ায়, সে অন্তহীন যাপনের ছাপ মানুষের শিল্প-সাহিত্যকেও কখনও কখনও উতরোল করে তোলে। জানা বা অজানায় মোড়া সেই যাপনকে আমরা শিল্প-সাহিত্যে আস্বাদন করি এক স্বর্গীয় আনন্দে।

১৯২২ সালে উত্তর-পূর্ব ইতালির বোলোগনা শহরের কাছাকাছি ফ্রিউলি নামের এক গণ্ডগ্রামে জন্মেছিলেন পিয়ের পাওলো পাসোলিনি (১৯২২-১৯৭৫)। কিশোর বয়সেই শিক্ষাদীক্ষায় সমৃদ্ধ বোলোগনা-তে চলে আসেন লেখাপড়া করতে। পড়াশোনার পাশাপাশি চলতে থাকে কবিতা ও গল্প লেখার চর্চা। আংশিক সময়ের শিক্ষকতার কাজ করতে করতেই তিনি জড়িয়ে পড়লেন সমকামী এক কেচ্ছায়, খোয়ালেন চাকরিটি, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ থেকেও বরখাস্ত হলেন— ঝামেলা গড়াল আদালত পর্যন্ত। ফলে ১৯৫১ সালে তিনি রোমের পথে পা বাড়ালেন, রোজগারের আশায় চিত্রনাট্য লেখায় মনোযোগী হয়ে উঠলেন। প্রথম উপন্যাস ‘চিলড্রেন অব লাইফ’ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হলেন। এই উপন্যাসের সুবাদেই তিনি সমর্থ হলেন ইতালির সুপ্রতিষ্ঠিত পরিচালক মাউরো বোলগনিনির সান্নিধ্য লাভেও। ১৯৫৭ সালে পরিচালক ‘দ্য ইয়াং কাপল’ ছবিটির চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব দিলেন পাসোলিনিকে। এই সময়েই পাসোলিনি তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘গ্রামশিস অ্যাশেজ’-এর জন্য জনপ্রিয় এক পুরস্কারে ভূষিত হলেন। এ বার ইতালির লব্ধপ্রতিষ্ঠ পরিচালক ফেদেরিকো ফেলিনির কাছ থেকে ডাক এল পাসোলিনির কাছে— ‘নাইটস অব ক্যাবিরিয়া’র চিত্রনাট্য লেখার কাজে মনোনিবেশ করলেন। অবসর সময়ে পাসোলিনি ঘুরে বেড়াতেন রোমের দারিদ্রলাঞ্ছিত বস্তি-জীবনের আনাচে-কানাচে। যার ছাপ স্পষ্ট আঁকা আছে তাঁর সৃষ্টিকর্মে। ১৯৫৯ সালে ‘চিলড্রেন অব লাইফ’ অবলম্বনে লিখলেন ‘আ নাইট অব অডাসিটি’র চিত্রনাট্য, পরিচালক সেই বোলগনিনি। ১৯৬০ সালে বোলগনিনির নির্দেশে মোরাভিয়ার ‘রোমান টেলস’ অবলম্বনে পাসোলিনি লিখলেন ‘আ ফুলিশ ডে’র চিত্রনাট্য। ছবিটি এক দিকে যেমন দর্শকদের সাধুবাদ পেল, অন্য দিকে তেমনই পেল বিদগ্ধজনের বাহবাও। ক্রমে পাসোলিনি হয়ে উঠলেন ইতালীয় সিনেমার এক গুরুত্বপূর্ণ মুখ। এই বছরেই ভিতালিয়ানো ব্র্যানকাতির উপন্যাসকে ভিত্তি করে গড়ে উঠল ‘আন্তোনিয়নি, দ্য গ্রেট লাভার’-এর চিত্রনাট্য। ব্র্যানকাতির উপন্যাসে ফ্যাসিবাদের মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, কিন্তু পাসোলিনি তাঁর চিত্রনাট্যে সমসময়ের সমাজজীবনে এই ফ্যাসিবাদেরই ফল্গুধারা ব্যক্তিজীবনে কী ভাবে মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে আনছে, তারই ট্র্যাজিক চেহারাটা আমাদের সামনে ফুটিয়ে তুলেছেন। বোলগনিনি ও পাসোলিনি একসঙ্গে কাজ করতে করতেই এক সময় অনুভব করলেন তাঁদের মানসজগতের ভিন্নতা, তাই দুজনেই দুজনের থেকে সরে আসাকেই শ্রেয় বলে অনুভব করলেন।

সর্বহারাদের বিপর্যয় পাসোলিনিকে বিচলিত করেছে বরাবর। মার্ক্সবাদকে তিনি আবেগ দিয়ে গ্রহণ করেননি, করেছিলেন মেধা দিয়ে। এই মেধার শিকড় চারিয়ে গিয়েছিল তাঁর সত্তার গভীরে। বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন পাসোলিনি। ১৯৭৫ সালে নৃশংস ভাবে খুন হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত টলেনি মার্ক্সবাদে তাঁর আস্থা। ১৯৬১ সালে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে এগিয়ে আসেন তিনি। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিপন্ন রোমের নিচুতলার মানুষদের নিয়ে গড়ে তোলা তাঁর চলচ্চিত্র ‘আকাটোনে’ ও ‘মাম্মা রোমা’ থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠল তাঁর আলাদা পথে চলার ধরন। এর পরে দুটো শর্ট ফিল্ম বানানোর পর ১৯৬৪ সালে তিনি বানালেন তাঁর বিতর্কিত ছবি ‘গসপেল অ্যাকর্ডিং টু সেন্ট ম্যাথু’ (ইন দি আই অব আ কমিউনিস্ট)। বহু সমালোচকই ভুল ভাবে ছবিটিকে ক্যাথলিক-মার্ক্সিস্ট আখ্যায় ভূষিত করলেন। আসলে সাধারণ নিপীড়িত মানুষের কাছে যিশু যে সর্বরোগহর পয়গম্বর হিসেবেই বিবেচিত হয়েছিলেন, সেটাকেই তিনি ছবিতে তুলে ধরেছেন।

তরুণ বয়সে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ খারিজ হয়ে গেলেও থিসিস-অ্যান্টিথিসিস-সিন্থেসিস’এর স্বপ্নে বিভোর পাসোলিনির কবিতা-উপন্যাস-চিত্রনাট্যে যেমন তার ছায়া দেখা দিল প্রগাঢ় ভাবে, তেমনি তাঁর সিনেমাতেও ঘনিয়ে উঠল এর সুর। আমাদের ছাত্রাবস্থায় সাউথ ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির ব্যবস্থাপনায় পাসোলিনির প্রথম দিকের ছবি ‘গসপেল অ্যাকর্ডিং টু সেন্ট ম্যাথু’ দেখানোর আয়োজন করা হয়। সরলা রায় মেমোরিয়াল হলে সে দিন তিলধারণের জায়গা ছিল না। উপস্থিত বহু বিশিষ্টজনের মধ্যে উত্তমকুমার ও সুপ্রিয়া দেবীও এসেছিলেন ছবি দেখতে। এ ছবির লোকেশন বাছা হয়েছিল ধূলিমলিন মরক্কোর গ্রামেগঞ্জে। নিষ্করুণ দারিদ্রের চেহারাটা ফুটে উঠেছিল সিনেমার পর্দায়। মির‌্যাক্‌লের ঘনঘটায় দর্শকদের কিন্তু ধৈর্যচ্যুতি ঘটছিল। বিশেষত যখন এক খঞ্জ মানুষ লাঠিতে ভর দিয়ে যিশুর করুণা লাভের আশায় পয়গম্বরের সন্নিকটে জায়গা করে বসে পড়ল, এবং‌ কিছু সময়ের মধ্যেই সেই করুণাঘন মানুষটির নির্দেশে লাঠি ছাড়াই সেই ব্যক্তি স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে হাঁটতেই নিজ কর্মবৃত্তে ফিরে গেল। বেশির ভাগ অপরিণতবুদ্ধি দর্শকও আসন ছেড়ে হল থেকে বেরিয়ে পড়ল। শুধু আমাদের মতো দু-চার জন দর্শক বাঙালির সম্মান বাঁচানোর দায়ে ছবিটা শেষ পর্যন্ত দেখতে বসে রইলাম। আজ জীবন-সায়াহ্নে পৌঁছে অনুভব করি, পরিচালক সেই লো-অ্যাঙ্গল শটগুলোর মধ্য দিয়ে যিশুর প্রবল ব্যক্তিত্বের যে ছবি এঁকেছিলেন, আজও তা ভুলতে পারিনি।

প্রাচীন গসপেলগুলোর মধ্যে উচ্চারিত হয়েছে ধনীর প্রতি তীব্র ঘৃণা। সেন্ট ম্যাথুর ভাষায়, যিশু বলেছেন, ‘আমি পৃথিবীতে এসেছি আগুন দিতে... তোমরা কি ভাবছ আমি পৃথিবীতে শান্তি বিলাতে এসেছি? আমি বলছি, না! আমি এসেছি বিরোধ সৃষ্টি করতে। এর পর থেকে এক ধনী পরিবারের পাঁচ ব্যক্তিও দ্বিধাবিভক্ত হবে— হয় তিনের বিরুদ্ধে দুই, নাহয় দুইয়ের বিরুদ্ধে তিন।’ (ম্যাথু, ২৪:২৬) লুক-এর সমাচারে একে সংক্ষিপ্ত করা হলেও তীব্রতা বেড়েছে: ‘ভেবো না আমি পৃথিবীতে প্রেম বিলাইতে আসিয়াছি। প্রেম বিলাইতে আসি নাই আমি, আসিয়াছি তরবারি দিতে।’ (লুক, ১২:৪৯) আর এই জন্যই পাসোলিনি তাঁর ছবির দৃশ্য গ্রহণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন দারিদ্রলাঞ্ছিত মরক্কোকেই। আর শিল্পীর মনে হয়েছিল, যিশু সর্বহারাদের শামিল করতে চেয়েছিলেন লোভী কুচক্রী ধনীদের বিরুদ্ধে।

‘গসপেল অ্যাকর্ডিং টু সেন্ট ম্যাথু’-র পর ১৯৬৭ সালে তিনি তাঁর শুটিং ইউনিট নিয়ে আবার চলে এলেন মরক্কোয়। সোফোক্লিসের ‘অয়দিপাউস’ নাটকটি কেন্দ্রে থাকলেও পাসোলিনি তাঁর ছবি ‘অয়দিপাউস রেক্স’-এ কোনও কোনও জায়গায় নিজ আদর্শ অনুযায়ী রূপান্তর ঘটিয়েছেন। যেমন গ্রিসের রাজপ্রাসাদের জায়গায় এসেছে মরক্কোর ধূলিমলিন গ্রাম্য জনজাতির আবাসস্থল। আর অয়দিপাউসের বাবা পলিবাস এখানে রাজা নয়, এক সামান্য সৈনিক। ছবিতে অয়দিপাউস অ্যাপোলোর মন্দিরে এসে দৈববাণী শুনতে পায়নি,শুনেছে পথচলতি এক দরিদ্র গণকের কাছ থেকে। গ্রিক নাটকের ভাগ্যবিড়ম্বিত নায়ক পাসোলিনির সিনেমায় হয়ে উঠেছে ক্রোধতাড়িত, জীবনের বিশ্লেষণে অক্ষম এক দুর্বল মানুষ। আর সেই জন্যই সে মেনে নিয়েছে তার অন্ধত্ব। ছবির শেষে এই অন্ধ মানুষটি এক তরুণ সঙ্গীর কাঁধে ভর দিয়ে চলে এসেছে উত্তর ইতালির এক শিল্পাঞ্চলে। আর শেষ দৃশ্যে সে এসে পড়ে শ্যামশষ্পে ঘেরা তার জন্মস্থানেই— সম্পূর্ণ হয় তার জীবনবৃত্ত।

পাসোলিনির ‘অয়দিপাউস রেক্স’ ছবিটি দেখতে দেখতে মনে ভেসে আসে জীবনানন্দ দাশের ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য’ কবিতাটি।

দরদালানের ভিড়— পৃথিবীর শেষে
যেইখানে প’ড়ে আছে— শব্দহীন— ভাঙা
সেইখানে উঁচু উঁচু হরিতকী গাছের পিছনে
হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোল— রাঙা—

চুপে চুপে ডুবে যায়— জ্যোৎস্নায়।
পিপুলের গাছে ব’সে পেঁচা শুধু একা
চেয়ে দ্যাখে; সোনার বলের মতো সূর্য আর
রূপার ডিবের মতো চাঁদের বিখ্যাত মুখ দেখা।

হরিতকী শাখাদের নীচে যেন হীরের স্ফুলিঙ্গ
আর স্ফটিকের মতো শাদা জলের উল্লাস;
নৃমুণ্ডের আবছায়া— নিস্তব্ধতা—
বাদামী পাতার ঘ্রাণ— মধুকূপী ঘাস।

কয়েকটি নারী যেন ঈশ্বরীর মতো:
পুরুষ তাদের: কৃতকর্ম নবীন;
খোঁপার ভিতরে চুলে: নরকের নবজাত মেঘ,
পায়ের ভঙ্গির নিচে হঙকঙের তৃণ।

সেখানে গোপন জল ম্লান হয়ে হীরে হয় ফের,
পাতাদের উৎসরণে কোনো শব্দ নাই;
তবু তারা টের পায় কামানের স্থবির গর্জনে
বিনষ্ট হতেছে সাংহাই।

সেইখানে যূথচারী কয়েকটি নারী
ঘনিষ্ঠ চাঁদের নিচে চোখ আর চুলের সংকেতে
মেধাবিনী; দেশ আর বিদেশের পুরুষেরা
যুদ্ধ আর বাণিজ্যের রক্তে আর উঠিবে না মেতে।

প্রগাঢ় চুম্বন ক্রমে টানিতেছে তাহাদের
তুলোর বালিশে মাথা রেখে আর মানবীয় ঘুমে
স্বাদ নেই; এই নিচু পৃথিবীর মাঠের তরঙ্গ দিয়ে
ওই চূর্ণ ভূখণ্ডের বাতাসে— বরুণে

ক্রূর পথ নিয়ে যায় হরিতকী বনে— জ্যোৎস্নায়।
যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বেলোয়ারি রৌদ্রের দিন
শেষ হ’য়ে গেছে সব; বিনুনিতে নরকের নির্বচন মেঘ,
পায়ের ভঙ্গির নিচে বৃশ্চিক-কর্কট-তুলা-মীন।

‘পৃথিবীর শেষে’ পড়ে আছে শব্দহীন ভাঙা দরদালানের ভিড়, আর সেখানে হরিতকী গাছের পেছনে ডুবে যাচ্ছে রাঙা গোল সূর্য, চুপে চুপে জ্যোৎস্নার মধ্যে। প্রায় পিথাগোরাসের ঢঙে গড়ে তোলা এই ছবিটি মোটেই অস্পষ্ট বা ঝাপসা নয়। একদিন পাসোলিনি মাতৃতান্ত্রিক সমাজকে নিয়ে গড়ে ওঠা গ্রিক উপকথা থেকে নেওয়া ‘অয়দিপাউস’ নাটককে বিষয়বস্তু করেই গড়ে তুললেন তাঁর সিনেমা, তবে লোকেশন হিসেবে বেছে নিলেন মরুভূমির প্রান্ত-প্রত্যন্তকেই। তাই সিনেমাটি চলে আসে কবিতার আরও কাছাকাছি। কবিতায় হেমন্তের বিকেলের সূর্যাস্ত বলে দিচ্ছে, জ্যোৎস্না এখনও গাঢ় হয়নি। এই সরল ছবিটি যে কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ে উঠবে সভ্যতার অবক্ষয়, ধ্বংস ও জীর্ণতার প্রতীক, তা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়— হয়তো একটু অস্বস্তি অনুভব করি কেবল। কবিতাটি ভালো করে পড়লে দেখতে পাই, এখানে সূর্য হয়ে উঠেছে মানবসভ্যতার প্রতীক, আর চাঁদ যেন ডেকে এনেছে সেই সভ্যতার অবক্ষয়কে। এখানে পেঁচা মহাকালের মতোই গ্রাসমান সভ্যতাকে অবলোকন করছে। কবিতাটির প্রেক্ষাপটে ফুটে উঠেছে এই সন্ধিকাল। ‘সুপক্ক যবের ঘ্রাণ অসহ্য বোধ’ হয়েছিল বলেই কি ছবিতে দেখি ঊষর মরুভূমিতে ক্যামেরা ট্রলি করে এগোতে থাকে— যেন আমাদের সতর্ক করতে থাকে বন্ধ্যাত্বের অভিশাপ বিষয়ে। অথচ এক দিন যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বেলোয়ারি রৌদ্রে ঝলমল করে উঠেছিল মিশরের সাম্রাজ্যের দিন— যার একটা ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ‘ক্লিয়োপাট্রা’ সিনেমায়— আজ কিন্তু ‘শেষ হয়ে গেছে সব’,থেমে গেছে তুরি-ভেরির নিনাদ। হিরের স্ফুলিঙ্গ আর স্ফটিকের মতো সাদা জলের উল্লাস, নৃমুণ্ডের আবছায়া জনহীন প্রান্তরে অন্ধকারকে আরও ঘনীভূত করে তোলে। এর পরেই স্টেজে নেমে আসে ঈশ্বরী নয়, ভাগ্য-প্রেরিত ঈশ্বরীর মতো কয়েকটি নারী (ইয়োকাস্তে কি?) হংকঙের মতো কোনও একটা উপনিবেশের মাটিতে শুরু হয়েছে তাদের যন্ত্রণার দিন গোনা। এই নারীদের সঙ্গী নবীন পুরুষেরা সফলতাকে আস্বাদন করতে পেরেছে (অয়দিপাউস)। কিন্তু তারা জানে না, সর্বনাশ চুপিচুপি তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কেননা আমরা কবিতায় দেখতে পাচ্ছি, এই নারীদের খোঁপার ভিতরে চুলে নরকের নবজাত মেঘ। সর্বনাশের এই হাতছানি অয়দিপাউস তো এড়াতে পারেনি। তাই হয়তো কবিতার শেষে দেখি,প্রগাঢ় চুম্বন ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে, তুলোর বালিশে মাথা রেখে আর মানবীয় ঘুমে স্বাদ নেই তাই ভাগ্যচক্র তাকে টানছে এক অবশ্যম্ভাবী নিয়তির দিকে। এই ইয়োকাস্তের বাহুলগ্ন হয়েই অয়দিপাউস বধির হয়ে রইল— শুনতে পেল না তার শহরের জনগণের যন্ত্রণার খবর।

এ প্রসঙ্গে মনে আসছে গোদারের কথা। প্রথম থেকেই পরিচালক গোদার তাঁর সিনেমার গল্পগুলোর ভিত্তি খুঁজে পাচ্ছিলেন চকিতে ছুঁয়ে যাওয়া কোনও গল্প বা নাটক থেকে। কখনও বা কারও মুখে শোনা গল্পই তাঁকে উত্তেজিত করে তুলছিল— যেন কোনও গল্পের বইয়ের পাতা ওল্টাতে তিনি পেয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর পরবর্তী সিনেমার অবলম্বন। ‘আলফাভিল’ছবিটি দেখতে দেখতে আমাদের মনে পড়ে যায় ‘রক্তকরবী’র কথা। ধনবাদী সজ্জায় সজ্জিত এ এক চোখ-ধাঁধানো সাম্রাজ্য। ‘রক্তকরবী’র রাজার মতোই এখানকার শাসকও শোষণ করে অলক্ষ্য থেকেই। শোনা যায়, গোদার ‘রক্তকরবী’র আখ্যান শুনেছিলেন এক বন্ধুর কাছ থেকেই। কবি পাসোলিনি কি জীবনানন্দের কবিতাটি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন? ক্লিন্টন সিলির অনুবাদ কি তাঁর নজরে এসেছিল? এ সব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই, তবে পাসোলিনির সিনেমার সঙ্গে জীবনানন্দের কবিতার আত্মীয়তা আর আশ্চর্য মিল আমাদের অনুভূতিকে গভীর ভাবে নাড়া দেয়... দেয় না কি?

0 comments:

0

প্রবন্ধ - তীর্থার্থ চট্টোপাধ্যায়

Posted in

প্রবন্ধ


প্রকৃতি ও আমরা
তীর্থার্থ চট্টোপাধ্যায়


প্রকৃতি চলে নিজের খেয়ালে। সৃষ্টির আদিকাল থেকে প্রকৃতির খেয়াল মেনে নিয়েই তৈরী হয়েছে জীববৈচিত্র – বিভিন্ন উদ্ভিদ, হরেকরকম প্রাণী। বিবর্তনের কালচক্রে পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ঘটার পরে এক বিশেষ অধ্যায়ের সূচনা হল। বুদ্ধিবৃত্তিতে শ্রেষ্ঠ মানুষ (যদিও এ বিষয়ে বিতর্কের যে একেবারেই অবকাশ নেই, তা নয়!) প্রকৃতির খামখেয়ালিপনাকে সহজে মেনে নিতে অস্বীকার করল। বৃষ্টি পড়লেই যে ভিজতে হবে, তা মেনে নিল না; বাসস্থানের জন্য জোর গলায় সওয়াল করল। শীত এলেই যে ঠাণ্ডায় কাঁপতে হবে, বিনা তর্কে তা মেনে না নিয়ে পোশাক তৈরী করল। শুরু হল আমাদের তথাকথিত সভ্যতার ইতিহাস, যেখানে প্রকৃতির লড়াই-এর বিজয়গাথা মানুষ সগর্বে রচনা করল। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত সাফল্যের অহংকারের আড়াল দিয়ে চুপিসারে ঢুকে পড়ল লোভ! খামখেয়ালি প্রকৃতিকে গোহারা হারিয়ে মানুষ তাকে এতটাই চটিয়ে তুলল যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃতি মুখ ফিরিয়ে নিল মানুষের থেকে – প্রকৃতিতে মানুষের অস্তিত্ব সঙ্কটময় হয়ে উঠল। তাই দেখে ভবিষ্যতের মানুষ আক্ষেপ করতে বাধ্য হল, তার সাথে ইতিহাসের মানুষদের দোষ দিতেও ছাড়ল না। এখানে একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা সহজবোধ্য করে তোলা প্রয়োজন।

আমরা জানি, আদিম মানুষ খাদ্য সংগ্রহের জন্য শিকার আর বনের ফলমূল সংগ্রহের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ক্রমশ তারা শিকারের ঝুঁকি আর সারা বছর ধরে ফলমূলের সহজলভ্যতার অভাব – এই দুই বিষয়েই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। অভিজ্ঞতা খরচ করে মানুষ শিখল যে ফল খেয়ে তার বীজ মাটিতে পুঁতে দিলে যে গাছ জন্মায়, তাতে ওই একই রকম ফল ধরে। তাই এবার সে গাছ থেকে ফল পেড়ে খেয়ে তার বীজ ফেলে দিল না – সাথে করে নিয়ে এসে পুঁতে দিল নিজের বাসস্থানের আশেপাশে। সংগ্রাহক মানুষ ধীরে ধীরে উৎপাদক মানুষে পরিণত হল। সময়ের সাথে সাথে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে মানুষ এও শিখল যে একই গাছের একশো ফল থেকে সংগ্রহ করা একশো বীজ থেকে যে নতুন একশো গাছ জন্মায়, তাদের সকলের ফলের স্বাদ হুবহু একরকম নয় – সামান্য তারতম্য রয়েছে। মানুষ বেছে বেছে সেই গাছের ফলই সংগ্রহ করতে শুরু করল, যার বীজ থেকে ভালো স্বাদের ফলের গাছ জন্মায়। উৎপাদক মানুষ পরিণত হল নির্বাচক মানুষে। তার নির্বাচন তার প্রয়োজন অনুযায়ী হল – প্রকৃতি নির্বাচনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করল। হয়তো কোনো জায়গার মাটির চরিত্র অনুযায়ী টক আমের গাছ ভালো জন্মায় – প্রাকৃতিক নির্বাচন তাই সেখানে টক আমের বীজকেই প্রাধান্য দিত। কিন্তু মানুষের প্রয়োজন তো মিষ্টি আম! অতএব টক আমের বীজ অঙ্কুরিত হবার সুযোগ পেল না – নির্বাচক মানুষের আনা মিষ্টি আমের বীজ প্রকৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেখানে প্রাধান্য পেল। জংলী উদ্ভিদ ও প্রাণীসম্পদকে এভাবে আমরা পোষ মানাতে শুরু করলাম। জংলী মানুষ চাষবাস শুরু করল। মানুষের চাহিদা মেটাতে পারে এমন সব গাছ, শস্য, ফল, ফুলকে মানুষ পোষ মানিয়ে গৃহপালিত করে তুলতে লাগল – আর অধিকাংশ উদ্ভিদ ও প্রাণীসম্পদ অবশ্যম্ভাবী বিলুপ্তির পথে পা বাড়াল। ইতিহাসের মানুষ জেনে বা না জেনে তার তোয়াক্কাই করল না! তথাকথিত অসভ্য, অবাধ্য এই উদ্ভিদ ও প্রাণীসম্পদের মধ্যে কিন্তু এমন কিছু গুণ ছিল, যা ভবিষ্যতের মানুষের বিশেষ কাজে লাগতে পারত। যেমন, মোটা চালের ধানগাছ শৌখিন ও ভোজনরসিক মানুষের কাছে প্রাধান্য না পেলেও তার খরা সহ্য করার ক্ষমতা কিন্তু মানুষের কাছে উপযোগী। কিন্তু ইতিহাসের মানুষ হয়তো ভবিষ্যতের এই পরিবর্তিত জলবায়ু সম্পর্কে উদাসীন ছিল। তাই মোটা চালের ধানের প্রজাতির সাথে সাথে তার এই খরা সহ্য করার গুণটিকেও আমরা বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে পারলাম না। মানুষের নিজস্ব চাহিদা পূরণের লোভের কাছে লাঞ্ছিত হয়ে অভিমানী প্রকৃতি নিঃশব্দে তার বৈচিত্রের পসরা গুটিয়ে নিল। আজ বহুদিন পরে আমাদের বোধোদয় হয়েছে। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে দেরীতে হলেও আমরা জীববৈচিত্র সংরক্ষণে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছি। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, মানুষের কাছে লাঞ্ছিত প্রকৃতি সবসময়ই যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, তেমনটা নয়। বেশ কিছু ক্ষেত্রে সে নিঃশব্দে প্রতিবাদ করেছে। পরবর্তীকালে সেই নৈঃশব্দের অনুনাদে মানুষের অস্তিত্ব কেঁপে উঠেছে। এমনই একটা উদাহরণ এখানে তুলে ধরা যাক।

আগাছা বলতে আমরা অবাঞ্ছিত গাছ বুঝি। ফসলের ক্ষেতে এই আগাছা মূল ফসলের জন্য প্রাপ্য সূর্যালোক ও মাটির উর্বরতায় ভাগ বসায়। স্বভাবতঃই, সঠিক সময়ে আগাছা নিয়ন্ত্রণকরতে না পারলে ফসলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রকৃতির খেয়ালে এই আগাছাদের আবার ‘কই মাছে’র প্রাণ’ – প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও টিঁকে থাকার প্রশ্নে আমাদের পোষ মানানো সভ্য ফসলের তুলনায় আগাছা বেশ কয়েক মাইল এগিয়ে! তাই আগাছা নিয়ন্ত্রণ শুধু জটিলই নয়, বেশ শ্রমসাপেক্ষ ও ব্যয়সাপেক্ষ। হাত দিয়ে বেছে উপড়ে সমূলে বিনাশ করাই এর সবচেয়ে ভালো দাওয়াই। তবে দক্ষ কৃষিশ্রমিকের অভাব এবং দর, এই দুই কারণেই আগাছা নিয়ন্ত্রণ চাষির বিশেষ মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। উর্বর মানবমস্তিস্ক অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই এর একটা সহজ উপায় বের করে ফেললো। এমন কিছু রাসায়নিক আবিষ্কৃত হল যা আগাছা মেরে ফেলতে সক্ষম। সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় এইসব রাসায়নিক আগাছানাশী ছড়িয়ে দিলে তারা নির্বিচারে সমস্ত আগাছা মেরে ফেলতে ওস্তাদ। তবে সমস্যা অন্য জায়গায়। ঠিক যে নীতিতে ভর করে আগাছানাশী রাসায়নিক আগাছা মেরে ফেলে, সেই একই নীতিতে সে আমাদের পোষ-মানানো ফসলকেও মেরে ফেলতে পারে। অতএব উপায়? খোদার ওপর খোদকারী করে, জীবপ্রযুক্তিবিদ্যার নিখুঁত প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা এমন কিছু ফসল বানালাম যাদের ওপরে এই আগাছানাশী রাসায়নিকের কোনো প্রভাব পড়ে না। আবার মানুষের কাছে প্রকৃতি পরাজিত হল। তবে প্রকৃতি এবার চুপ করে বসে থাকলো না। আগেই বলেছি যে পরিবর্তিত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিঁকে থাকার ক্ষমতায় আগাছার জুড়ি মেলা ভার। প্রকৃতির খেয়ালে আগাছার মধ্যেও স্বতঃস্ফূর্ত জিনগত পরিবর্তন হামেশাই ঘটে। এমন কিছু পরিবর্তনও ঘটে, যার ফলে একটি বিশিষ্ট রাসায়নিক আগাছানাশীর কবল থেকে ওই পরিবর্তিত আগাছাটি রেহাই পেতে পারে। যতদিন রাসায়নিক আগাছানাশী আমরা ব্যবহার করিনি, ততদিন সেইসব জিন-পরিবর্তিত আগাছারা চুপিসারে আর পাঁচটা আগাছার মধ্যে মিশে ছিল। আর পাঁচটা সাধারণ আগাছার বীজের মতই তাদের বীজও অঙ্কুরিত হবার সুযোগ পাচ্ছিল। মোদ্দাকথা, আগাছার সংসারে এইসব পরিবর্তিত আগাছারা বিশেষ কেউকেটা হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু যে মুহূর্তে আমরা রাসায়নিক আগাছানাশী ব্যবহার করলাম, সাধারণ আগাছারা নির্মূল হয়ে গেল - টিঁকে রইল শুধু পরিবর্তিত আগাছা। প্রাকৃতিক নির্বাচনে যে ছিল সাধারন, আগাছানাশীর মাধ্যমে আরোপ করা আমাদের কৃত্রিম নির্বাচন তাকে ‘অসাধারণ’ করে তুলল। শুধুমাত্র সেইসব ‘কেউকেটা’ আগাছারাই বেঁচে থাকার, ফুল ফোটানোর এবং বীজপ্রস্তুত করার সুযোগ পেল। ফলে পরের বারে পরিস্থিতি হয়ে উঠল ভয়ানক! দোর্দণ্ডপ্রতাপ যে আগাছার বংশ জন্মাল, রাসায়নিক আগাছানাশী তাকে মোটেই মারতে পারল না। ছিল আগাছা – হয়ে গেল রক্তবীজের বংশ! ইদানীং সমস্যা আরো গম্ভীর আকার ধারণ করেছে, কারণ বেশ কিছু আগাছা একাধিক রাসায়নিক আগাছানাশীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। ফসলের ক্ষেত যদি এইসব অপ্রতিরোধ্য আগাছায়ই ভরে ওঠে তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ‘দুধে-ভাতে’ থাকতে পারবে তো?

আজ সচেতনতা গড়ে তোলার সময় এসেছে। প্রকৃতিকে আমাদের প্রতিপক্ষ না ভেবে পরিপূরক বলে ভাবতে পারি না কি? পৃথিবী যে শুধু মানুষের জন্য নয় – এই সহজ সত্যটাকে অস্বীকার করলে মানুষেরই অস্তিত্ব যে সঙ্কটময় হয়ে ওঠে, প্রকৃতি তা বারে বারে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে। লোভের বাটখারা নামিয়ে দিয়ে, আসুন, আমরা প্রকৃতি ও ব্রহ্মাণ্ডের দাঁড়িপাল্লায় এক চিরন্তন সুস্থির সাম্য প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হই।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী

Posted in

প্রবন্ধ


জন্মশতবার্ষিকিতে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়: একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি
ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী


(১)

সাগরময় ঘোষের “হিরের নাকছাবি” বইটিতে একটি সুন্দর অ্যানেকডোট আছে।

প্রতিভাবান এবং রূপোলী পর্দায় প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্মীর বরপুত্র এক নামী-দামী লেখক বিভূতিভূষণকে বলেছিলেন যে বনজঙ্গল আর গ্রামগঞ্জের মাঠঘাটের গল্প না লিখে বরং সামাজিক জীবনে নারী-পুরুষের বিচিত্র সম্পর্কের টানাপোড়েনের গল্প লিখতে। লক্ষ্মীর বরপুত্র সাহিত্যিকের কথায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বনজঙ্গল, গ্রামগঞ্জের লেখক বিভূতিভূষণকে ওইসব লেখার জন্য মনে রাখবে না বরং ওঁর লেখাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।

খুব দুঃখ হয়েছিলো বিভূতিভূষণের। অতঃপর তিনি সেই প্রখ্যাত লেখকের টালার বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে টালিগঞ্জে কালিদাস রায়ের কাছে ছুটে এসেছিলেন। কালিদাস রায় তখন একজন বিখ্যাত বাংলা সাহিত্য সমালোচক। সব শুনে হেসে তিনি বিভূতিভূষণকে বলেছিলেন যে অমুক সাহিত্যিক বঙ্গসাহিত্যের দেবী সরস্বতীকে যতই স্বর্ণালঙ্কারে সাজানোর চেষ্টা করুন না কেন, দেবী সরস্বতীর নাকের হিরের নাকছাবিটা কিন্তু বিভূতিভূষণেরই থাকবে।

কি যে অসাধারণ দূরদৃষ্টি ছিলো কালিদাস রায়ের, আজ তা বাংলা সাহিত্যের পাঠক মাত্রেই উপলদ্ধি করতে পারছেন।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মের শতবার্ষিকি তর্পণকালে এই লেখাটি লিখতে বসে আমার সাগরময় ঘোষ কথিত ওপরের অ্যানেকডোটির কথাই সর্বপ্রথমে মনে এলো।

এই প্রসঙ্গে আমার অত্যন্ত ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, হিরের নাকছাবিটা না হয় বিভূতিভূষণেরই থাকলো, তবে হংসেশ্বরী দেবী সারদার অঞ্জলিদান প্রকল্পে বঙ্গসাহিত্যের উৎকৃষ্ট কিছু পুষ্পচয়ন কালে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের নামটা যে অন্যতম হিসেবে অবশ্যই বিবেচিত হবে, এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই।

কিশোর বয়সে অনেকের মতো আমারও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার সাথে প্রথম পরিচয় অতি অবশ্যই ওঁর অমর সৃষ্টি টেনিদার মাধ্যমে। টেনিদা ঘনাদা নন; নন তিনি ফেলুদা অথবা ঋজুদা। বঙ্গসাহিত্যে আমরা যে ক’টি দাদা চরিত্রের সন্ধান পাই, তার মধ্যে থেকে বয়স ভোলানো, প্রজন্ম পেরোনো এক অবাক করা চরিত্র এই টেনিদা। পটলডাঙ্গার চারমূর্তির মহানায়ক টেনিদা ওরফে ভজহরি মুখুজ্জে এক কিংবদন্তী চরিত্র। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদাকে নিয়ে লেখা পাঁচটি উপন্যাস, বত্রিশটি গল্প আর একটা নাটিকা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। পাঠক-পাঠিকা মহলে টেনিদার এতই প্রভাব ছিলো যে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত টেনিদা সমগ্রের সংকলক জানাচ্ছেন,সংকলনটির কাজে হাত দিয়ে তাঁর টেনিদা নামে এমন গল্প-উপন্যাসও দু-একটা বাজার-চালু গ্রন্থে চোখে পড়েছে, যা কিনা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর প্রকাশিত এবং সেগুলো তাঁর লেখা নয়। সেইসব সৃষ্টি তিনি সেই সংকলনে স্থান দেওয়া সঙ্গত মনে করেননি। সেই সঙ্গে তিনি অতি বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছেন যে এই পাঁচটি উপন্যাস, বত্রিশটি গল্প আর একটা নাটিকা ব্যতীত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের আর কোনও লেখা যদি কোন সহৃদয় পাঠক-পাঠিকা’র সন্ধানে আসে, তবে তাঁরা যেন অনুগ্রহ করে প্রকাশকের গোচরে আনেন।

উপন্যাস হিসেবে “চারমূর্তি”-ই টেনিদা সিরিজের প্রথম উপন্যাস। ১৯৫৭ সালে অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির থেকে চারমূর্তি যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, ভূমিকায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “ছোটদের একটুখানি খুশি করবার আশা নিয়ে চারমূর্তি ধারাবাহিক ভাবে শিশুসাথী’তে লিখেছিলাম। ছোটরা আশাতীতভাবে সাড়া দিয়েছে। সেই ভরসাতেই বইয়ের আকারে প্রকাশ করা গেল।”

(২)

এখন কথা হচ্ছে, এই অদ্বিতীয় টেনিদা কি পুরোপুরি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কল্পনা? আর চাটুজ্জেদের রোয়াক কি সত্যিই কোথাও ছিলো? এতদিন ধরে যাঁরা এসব জানতে চেয়ে এসেছেন, তাঁদের কৌতূহল নিরসন করার জন্য টেনিদাভক্ত এক সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তী পটলডাঙ্গায় গিয়ে সেই সত্যি টেনিদার সাথে দেখা করে তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত করেছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকায়।

সাক্ষাৎকারের পর তিনি যে কথাটা বলেছেন সেটা আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি - “টেনিদা আর লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় একই বাড়িতে থাকতেন, টেনিদা বাড়িওয়ালা, লেখক ভাড়াটে।”

২০ নম্বর পটলডাঙ্গা স্ট্রিটের বাসিন্দা প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ওরফে আদি ও অকৃত্রিম টেনিদা বললেন, “ওটা আসলে মুখুজ্জেদের রোয়াক। নামটা একটু পালটে দিয়েছিলেন নারায়ণদা। আর ‘ডি-লা-গ্র্যান্ডি’ও আদতে ওঁরই মুখের কথা, গল্পের খাতিরে আমার মুখে বসিয়ে দিয়েছিলেন।”

এবার একটু নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনপঞ্জির দিকে নজর দেওয়া যাক।

ইং ১৯১৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি তৎকালীন অবিভক্ত বাংলাদেশের দিনাজপুরের বালিয়াডিঙ্গীতে জন্মগ্রহণ করেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। বাবার নাম ছিলো প্রমথনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। গঙ্গোপাধ্যায় পরিবারের আদিবাড়ি ছিলো বরিশাল জেলার বাসুদেবপুরের নলচিরা গ্রামে।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের পারিবারিক নাম ছিলো তারকনাথ। সাহিত্য জগতে তিনি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ছদ্মনামেই প্রকাশিত হন। বলা যেতে পারে এটাই তাঁর প্রথম ছদ্মনাম। এরপরে অবশ্য তিনি সুনন্দ ছদ্মনামেও প্রকাশিত হয়েছিলেন।

বাবার বদলির চাকরির সুবাদে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে দিনাজপুর, ফরিদপুর আর বরিশাল ঘুরে ঘুরে স্কুল আর স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করতে হয়েছিলো।

এই সময়ে তাঁর জীবনের দুটি ঘটনা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য।

১৯৩৫ সালে ফরিদপুরে রাজেন্দ্র কলেজে পড়াকালীন বিপ্লবী কার্যকলাপের জন্য তাঁকে কলেজ ছাড়তে হয়। ভাবতে বসলে আশ্চর্য হতে হয় যে, ইংরেজ সরকারের অধীনে পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত পিতার সন্তান হয়েও দেশমাতৃকাকে সেবা করার ডাকে সাড়া দিতে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় পিছপা হন নি।

অবশেষে ১৯৩৬ সালে নন-কলেজিয়েট ছাত্র হিসেবে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন বরিশালের বি.এম কলেজ থেকে।

দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি হলো, স্নাতক স্তরে পঠন-পাঠন কালে তিনি জীবনানন্দ দাশকে পেয়েছিলেন তাঁর শিক্ষক হিসেবে। নিয়তির লিখনে এই সাক্ষাৎকারই হয়ত ভবিষ্যতে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে সাহিত্য জগতে প্রবেশের প্রেরণা দিয়ে থাকবে।

অবশেষে ১৯৩৮ সালে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পঠনপাঠনের জন্য নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কলকাতায় আগমন। তারপর থেকে আমরা দেখতে পাই পূর্ণবিকশিত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে।

১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম.এ পাশ করেন তিনি আর সেই সঙ্গে প্রাপ্ত হন ভুবনেশ্বরী স্বর্ণপদক। এরপর শুরু হয় তাঁর অধ্যাপনা আর বাংলা সাহিত্যসেবা। জলপাইগুড়ি কলেজ, কলকাতার সিটি কলেজ ঘুরে তিনি ১৯৫৬ সাল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অধ্যাপনা জীবন শুরু করেন। ইতিমধ্যে ‘বিচিত্রা’পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। তারপর থেকে লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখনী বঙ্গসাহিত্যকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। যে বঙ্গসাহিত্যের সেবা তিনি শুরু করেছিলেন কবিতা সৃষ্টির মাধ্যমে, অতঃপর তাঁর সেই প্রচেষ্টা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটিকা আর পত্রিকায় কলাম লেখার মধ্যে দিয়ে। “সম্রাট ও শ্রেষ্টী”, “শিলালিপি”,“উপনিবেশ” সহ তাঁর অনেক উপন্যাস বাঙালী পাঠক মহলে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে। 

সেই সময়ের প্রখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা সজনীকান্ত দাশ সম্পাদিত “শনিবারের চিঠি”-র নিয়মিত লেখক ছিলেন তিনি। এছাড়া সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় সুনন্দ ছদ্মনামে লেখা ‘সুনন্দ’র জার্নাল’ বাঙালী পাঠক-পাঠিকা মহলে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলে দিয়েছিলো। এই দেশ পত্রিকার মাধ্যমেই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য জগতে প্রথম প্রকাশ কবি হিসেবে। 

পুরস্কার-প্রাপ্তির ঝুলিও তাঁর খালি থাকে নি। ১৯৪৬ সালে আনন্দ পুরস্কারে সন্মানিত হন তিনি। অধ্যাপনা আর সাহিত্য সেবার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ছোট গল্পের ওপর তাঁর অনুসন্ধানমূলক কাজও চলতে থাকে। অবশেষে এই কাজের জন্য ১৯৬০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.ফিল উপাধিতে ভূষিত করে। এছাড়া ১৯৬৮ সালে বসুমতি পত্রিকার সাহিত্য পুরস্কারটিরও প্রাপক হিসেবে তিনি মনোনীত হন।

(৩)

যদিও কিশোর বয়সে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে পরিচিত হই টেনিদা সিরিজের মাধ্যমে, তবুও স্কুলছাত্র জীবনের প্রথম পর্যায়ে মাঝে-মধ্যে দেশ-এ নিয়মিত প্রকাশিত হওয়া সুনন্দ’র জার্নাল-এর সাথে পরিচয় হয়েছিলো। সত্যি কথাটা স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে সেই সময়ে বয়সের অপরিণতির জন্য তার সঠিক স্বাদ তখন পাইনি। তবে পরে কলেজ জীবনে পুনরায় এর স্বাদ গ্রহণ করে প্রভূত তৃপ্তি পেয়েছি। 

অবাক হয়েছি এই ভেবে যে কি অসাধারণ কুশলতায় তিনি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের অনিয়মগুলোকে কখনও তীব্র জাতীয়তাবোধের কশাঘাতে, কখনও বা ব্যাঙ্গাত্মক তির্যক বক্রোক্তির দ্বারা দিনের পর দিন অক্লান্তভাবে জনসমক্ষে হাজির করে গিয়েছেন। চোখে আঙুল দিয়ে সমাজের আইনরক্ষক, বুদ্ধিজীবি, নীতি নির্ধারকদের দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন সামাজিক কৃষ্ণগহ্বরগুলোকে। 

কলকাতার এক বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা দু-মলাটের মাঝখানে সুনন্দ’র সমস্ত জার্নালগুলোকে একত্রে প্রকাশ করে বাংলা সাহিত্য পাঠককুলের জন্য একটি মহৎ কাজ করেছেন। আজ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মশতবার্ষিকিতে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন কালে “সুনন্দর জার্নাল” নিয়ে দুকথা লেখার লোভ সামলাতে পারছি না।

মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্সের প্রকাশিত “সুনন্দর জার্নাল”-এর অখণ্ড সংস্করণটি (২০১৬ সালে প্রকাশিত অষ্টম মুদ্রণ) হাতে পেয়ে মনটা খুশিতে ভরে উঠে উঠলো। ঝকঝকে হার্ড বাউন্ড জ্যাকেট লাগানো বইটা যে কোন পুস্তকপ্রেমীর বইয়ের আলমারির শোভা যে বাড়িয়ে তুলবে সে বিষয়ে আমি একেবারে নিঃসন্দেহ। বইটার বাড়তি আকর্ষণ হচ্ছে চণ্ডী লাহিড়ী অঙ্কিত অসামান্য সব কার্টুন। সংগ্রহে রাখার মত একটি প্রকাশনা।

আরও যেটা ভাল লাগলো সেটা হচ্ছে যে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সুনন্দর জার্নালগুলি ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত নিয়মিত ভাবে সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় লিখেছিলেন “সুনন্দ”ছদ্মনামে। মিত্র ও ঘোষ একটি ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থা হলেও আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠী তাঁদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এই অসাধারন সঙ্কলনটির জন্মলগ্নে। প্রকাশকের ভাষায়, “সুনন্দর জার্নালের এই অখণ্ড সংস্করণে এমন অনেক লেখা আছে যা ইতিপূর্বে প্রকাশিত গ্রন্থে ছিলো না। এইসব ইতিপূর্বে অগ্রন্থিত রচনাগুলির উদ্ধার আনন্দবাজার পত্রিকা এবং তাঁদের লাইব্রেরির সহযোগিতা ভিন্ন সম্ভব ছিলো না। এজন্য আমরা তাঁদের ধন্যবাদ জানাই। সুনন্দর জার্নালে মুদ্রিত শ্রীচণ্ডী লাহিড়ীর কিছু অনবদ্য চিত্র এই গ্রন্থে মুদ্রিত হয়েছে। সেজন্যেও আমরা চণ্ডীবাবু ও আনন্দবাজার পত্রিকার কাছে কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ।”

বঙ্গসাহিত্যের আপামর সনাতন পাঠক সম্প্রদায়ের তরফ থেকে আমি হাজার কুর্ণিশ জানাই আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠী এবং চণ্ডীবাবুকে। ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দিতার উর্ধ্বে উঠে ওঁরা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, তা এককথায় অতুলনীয় এবং অতি অবশ্যই অনুকরণীয়।

নান্দীমুখ সেরে নিয়ে এবার “সুনন্দর জার্নাল” বইটির পাতা ওল্টানো যাক।

মোট একশো আশিটি ফিচারধর্মী লেখা নিয়ে মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনাগোষ্ঠী তাঁদের অনবদ্য অখন্ড “সুনন্দর জার্নাল” বইটি পাঠকদের দরবারে হাজির করেছেন। সঙ্কলনটিতে ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত প্রায় অবিচ্ছিন্নভাবে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের “সুনন্দ” ছদ্মনামে লেখা জার্নালগুলি সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় স্থান পেয়েছে। আমার কাছে লেখকের এই প্রয়াসটি বেশ অনবদ্য লেগেছে। ছদ্মনামধারী লেখক লিখছেন নতুন একটি ছদ্মনামে! জানিনা এই রকম প্রয়াস পৃথিবীর আর কোনও লেখকের ঝুলিতে আছে কিনা! একই লেখকের এক বা একাধিক ছদ্মনাম থাকতেই পারে তবে প্রথম থেকেই ছদ্মনামেই পরিচিত লেখক আবার ছদ্মনামে লিখছেন এরকম ঘটনা আমার নজরে আসেনি।

এই একশো আশিটি নাতিদীর্ঘ সাপ্তাহিক লেখার দ্বারা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সমকালীন সময়ের একটি রেখাচিত্র অঙ্কন করে গেছেন অত্যন্ত অধ্যাবসায়ের সঙ্গে, যা বাংলা পাঠক সমাজে সেই সময়ে একটা গভীর অভিঘাতের সৃষ্টি করেছিলো। প্রতি সপ্তাহে পাঠককুল অধীর আগ্রহে উন্মুখ হয়ে থাকতো দেশ পত্রিকা প্রকাশ মুহূর্তের জন্য। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এবং অনিবার্য কারণবশতঃ দু-একবার জার্নাল প্রকাশ বন্ধ হয়েছিলো বলে পাঠকসমাজ যারপরনাই উতলা হয়ে উঠেছিলো বললে ভুল বলা হবে না।

বাঙালির সুখ-দুঃখ-আশা-হতাশা-আনন্দ-উৎসব, তার আগমার্কা অলসতা, সংস্কৃতিপ্রিয়তা এবং বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া ছাড়াও সমসাময়িক রাজনৈতিক উত্থান-পতন, শিক্ষাব্যবস্থা, নামী-দামী লেখক আর মনীষীদের কথা, আন্তর্জাতিক ঘটনাপঞ্জীসহ প্রায় সমস্ত বিষয়ের ওপরেই সুনন্দ’র লেখনী সতত চলমান থেকেছে। সত্যি অসাধারণ জঙ্গম এই জার্নাল।

(৪)

এই প্রসঙ্গে দেখছি প্রকাশকের এপিটাফের শেষ লাইনটিতে লেখা আছে, “এই গ্রন্থ একাধারে এই সময়ের বাঙালির জীবন ইতিহাস এবং সমাজের দর্পণ।” এব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই বললে মোটেই অত্যুক্তি করা হবে না। 

সুনন্দর জার্নালের বিষয়গুলি আজ প্রায় অর্ধশতাব্দী পথ অতিক্রম করে এলেও আজকের ডিজিটাল-এজের সামাজিক পরিস্থিতিতেও তারা কত প্রাসঙ্গিক তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। এইখানেই লেখকের আসল সার্থকতা।

মহাকালের অবশ্যম্ভাবী সময়ের পলিমাটির প্রলেপ আমাদের জীবনের পুরোনো বহু প্রাসঙ্গিক ধ্যানধারণাকে প্রতিনিয়ত অপ্রাসঙ্গিক করে তুলছে। সময়ের বালুকণারাশির পর্বত ডিঙিয়ে যা কিছু মাথা তুলে নিজস্ব মর্যাদা বজায় রাখতে পারে, তাই চিরকালীন বলে বিবেচিত হয়। সুনন্দর জার্নাল টেস্ট অফ টাইম-এর পরীক্ষায় জলপানি নিয়ে পাশ করে গেছে বলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা।

কয়েকটি উদাহরণ দেবার লোভ সামলাতে পারছি না।

“ভ্রম-সংশোধন” লেখাটিতে সুনন্দ লিখছে, “আমরা সেই পর্যন্ত সত্যনিষ্ঠ, যে পর্যন্ত আমাদের গায়ের চামড়া নিরাপদ। আজ সারা বাংলা দেশে, সারা ভারতবর্ষে এই সুবিধাবাদী সত্যেরই সাধনা চলছে, আদর্শের জামাটাকে মাপসই করে ছেঁটে নেওয়া হচ্ছে সুবিধের প্রয়োজনে।”

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হই এই ভেবে যে আজকের যুগেও কতখানি প্রাসঙ্গিক এই বক্তব্যটি!

সুনন্দর লেখাগুলো পড়তে গিয়ে পাঠকের একটা ধারণা হতে পারে যে সামাজিক জীবনের মূল সমস্যাগুলোর বোধহয় চরিত্রগত কাঠামোর কোনও বদল হয়নি, যে বদলটা হয়েছে সেটা হচ্ছে প্যাকেজিং-এর। 

তাই “উপহার-টুপহার” নামক ফিচারটি লিখতে বসে সুনন্দ যখন লেখে, “আজকাল অযাচিতভাবে এই সব উপহার প্রাপ্তি – বাস্তবিক, এ এক রোমহর্ষক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত্রতত্র পেয়ে যাচ্ছি চায়ের পেয়ালা, প্লাস্টিকের বাটি, স্টীলের চামচে, ডট পেন, ছোট তোয়ালে, দাড়ি-কামানোর ব্লেড। পেতে পেতে এমন অভ্যেস হয়ে গেছে যে এক দিস্তে কাগজ কিনে একটা ফ্রী ফাউন্টেন পেন কেন পেলাম না – এই ভেবে মন খুঁত খুঁত করতে থাকে।”

এককথায় অসাধারণ উপলব্ধিমূলক স্বীকারোক্তি!

সঙ্গে গাদা খানেক টুথপেস্টের মাঝখানে বসে থাকা বিরক্ত এক প্রৌঢ়ের ছবিযুক্ত চণ্ডী লাহিড়ীর কার্টুনটিও এক কথায় যাকে বলে অনবদ্য। কার্টুনের ক্যাচ লাইনটি হলো “লাকি কুপনের লোভে বাজার উজাড় করে টুথপেস্ট কিনতে শুরু করুন।”

ঠিক সাড়ে-সাতচল্লিশ বছর আগেকার লেখার বিষয়বস্তুর সাথে আজকের দিনের পরিস্থিতির কি আশ্চর্য মিল!

সুনন্দ তার একটি লেখাতে “দেয়ারস নাথিং নিউ আন্ডার দা সান” এই ইংরেজি প্রবচনটি স্মরণ করে বলেছে, “পরদিন স্বাভাবিক নিয়মেই ট্রেন বন্ধ। কোনও ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগেই যাত্রীদের অবধারিত বিক্ষোভ – তারপর নিদারুণ ক্রোধ হলেই সামনে যাকে পাওয়া যাবে, তাকেই ঠ্যাঙানো আমাদের একটা আত্মিক কর্ত্যব্য। তাই পত্রপাঠ স্টেশন তছনছ,কাগজপত্র ছাই, টেলিফোন বিচূর্ণ, স্টেশন মাস্টার এবং সহযোগীবৃন্দ প্রহৃত, আহত, পলাতক (অবশ্য পালাবার মতো শরীরের অবস্থা থাকলে)।”

সত্যি, আজকের পরিস্থিতির বিচারেও সুনন্দ বর্ণিত উপরিউক্ত ঘটনাপ্রবাহ কতখানি জীবন্ত! তাই সুনন্দর সাথে গলা মিলিয়ে বলতে চাই, “দেয়ারস নাথিং নিউ আন্ডার দা সান!”

একের পর এক লেখাতে সাবলীলভাবে সুনন্দ চমক সৃষ্টি করে গিয়েছে তার জীবন্ত ভাষা, চিন্তাধারা আর তৎকালীন উপযুক্ত বিষয় নির্বাচনের অভিনবত্বের মাধ্যমে। সনাতন বাঙালী পাঠক এই সব বিচিত্র বিষয়ের ব্যাপ্তির মাধ্যমে উপলব্ধি করতে পারে সুনন্দর মর্মবেদনা। ব্যঙ্গাত্মক রচনাগুলোর মধ্যে দিয়ে সুনন্দ যেন বাঙালির জড়রূপী চেতনার গোড়া ধরে টান দিয়ে তাকে প্ররোচিত করতে চায় এক সুস্থ্য সবল নির্ভিক জাতির হৃত গৌরব উদ্ধার প্রকল্পে। এ যেন স্বামী বিবেকানন্দ কথিত উপনিষদের সেই বিখ্যাত বাণী, “অ্যারাইজ, আওয়েকঅ্যান্ড স্টপ নট টিল ইউ রীচ ইওর গোল।” আর ঠাকুর রামকৃষ্ণের ভাষায়, “চৈতন্য হোক।”

এই স্বল্প পরিসরে সুনন্দর সব লেখার গুণগত মূল্যায়ন করা সম্ভব নয় আর সে বিষয়ে আমি একজন অবার্চীন মাত্র। তাই সে প্রচেষ্টা না করাই ভাল। তবে যে বিষয়টি আমার চেতনাকে সবচেয়ে বেশী করে নাড়া দিয়েছে, সেই বিষয়টা হলো আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নিজে যেহেতু শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিলেন, তাই রাজ্য আর কেন্দ্রীয় এই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সুনন্দর লেখাগুলি রীতিমতো ওজনদার। এই বিষয়ে বেশ কয়েকটি জার্নাল সুনন্দ লিখেছে এবং তার সেইসব লেখা আজকের দিনেও সবাইকে যথেষ্ট ভাবাবে বলেই আমার মনে হয়।

(৫)

এই প্রসঙ্গে সুনন্দর লেখনী শিক্ষাক্ষেত্রে আত্মহননকারী ধ্বংসাত্মক রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে ক্ষুরধার আলোচনা করেছে।

সুনন্দর লেখা নিয়ে অনেক কথা লেখা হয়ে গেলেও আরও বহু কথা বাকি থেকে গেল। তাই বঙ্গ পাঠক-পাঠিকা মহলের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ যে এই অপ্রাসঙ্গিক লেখাটার ওপরে ভরসা না করে তাঁরা যেন সুনন্দর জার্নাল বইটা আদ্যোপান্ত পড়েন, একবার নয় বারবার পড়েন।

পরিশেষে একটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ।

বইটা পড়তে পড়তে আমার একটা কথা বারবার মনে হয়েছিলো যে “নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়” ছদ্মনামধারি তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর নবতম ছদ্মনাম “সুনন্দ”র জন্য কোনও উপাধি নির্ধারণ করেছিলেন কিনা।

ছোটবেলাকার স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে খুব আবছা ভাবে মনে পড়ছিলো আমার পিতামহের কথা। উনি কোন এক ঘরোয়া আলোচনায় যেন সুনন্দর উপাধিটা উল্লেখ করেছিলেন বলে মনে হয়। তবে তা আমার স্মরণে থাকার কথা নয়, কারণ দেশ পত্রিকাটি তখন আমার কাছে সচিত্র অরণ্যদেবের আকর্ষণের জন্যই পরিচিত ছিলো। সেই কারণে সাহিত্য অনুরাগীদের মহলে পিতামহের সুনন্দ’র উপাধি নিয়ে আলোচনাটা তখন আমার মনে বিশেষ দাগ কাটেনি, তবে অবচেতন মনে হয়তো তার ছাপ থেকে গিয়ে থাকবে। তাই দু’মলাটের মধ্যে সুনন্দকে পেয়ে তার সাথে আবার পরিচিত হবার সময়ে শ্যেণদৃষ্টিতে নজর রেখেছিলাম প্রতিটি পাতায়।

অবশেষে ফল মিলেছে। ১৪৪তম লেখা “সুরভি সমাচার”-এ দেখছি সুনন্দ লিখছে, “সুনন্দ রায়ের মতো কমন ম্যানদের অনুভূতিগুলোও মোটামুটি কমন......।”

অতএব “সুনন্দর জার্নাল” আসলে হলো গিয়ে “সুনন্দ (রায়-এ)’র জার্নাল।”

সুনন্দর একজন দুর্মুখ ভক্ত ছিলো। সুনন্দ তাঁকে প্রোফেসর বা অধ্যাপক হিসেবে পাঠকদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। ভগ্নদূতের মতো যখন তখন উদয় হয়ে সে সুনন্দর সাথে কূট তর্কে অবতীর্ণ হয়। বিষয়ের বিচিত্রতায় এই দুজনের তর্কের ফলস্বরূপ পাঠককুল আরও ঋদ্ধই হয়েছে বলা যেতে পারে।

অবশেষে রচনাটিতে দাঁড়ি টানবার সময় এসে গেছে।

শেষ কথাটা লিখবার আগে একটা ছোট্ট কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। সম্প্রতি লালমাটি প্রকাশনা সংস্থার “রোমান্স” নামে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি হাসির গল্পের সংস্করণ হাতে এসেছে। নিবেদনে দেখছি অরিজিত গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন রোমান্স বইটি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম হাসির গল্পের সংকলন এবং সেই সময়ে তাঁর বয়স ছিলো মাত্র চব্বিশ বছর। প্রথমদিকের লেখা হলেও গল্পগুলি বাংলা সাহিত্য জগতের রম্যরচনা অধ্যায়ে পাকাপাকি ভাবে জায়গা করে নিয়েছে। এখানেই লেখক হিসেবে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সার্থকতা। 

গল্পগুলি খুব সম্ভবত “শনিবারের চিঠি” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো চল্লিশ দশকের প্রথমদিকে।

খুব যত্ন নিয়ে লালমাটি এই সংকলনটি প্রকাশ করেছে। উপরি হিসেবে পাঠক পেয়েছে শিল্পী নরেন্দ্র মল্লিকের আঁকা প্রতিটি গল্পের সঙ্গে অসাধারণ কৌতুকচিত্রগুলি।

লালমাটি আরেকটি যে জিনিস পাঠকদের উপহার দিয়েছে, সেটা হচ্ছে বন্ধু সাহিত্যিক নবেন্দু ঘোষের উদ্দেশ্যে লেখা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের অনবদ্য “নবেন্দু ঘোষ” কবিতাটি যা লেখকের কবি প্রতিভারও পরিচয় দেয়।

সেই কবিতার একটি ছত্র এখানে তুলে আনতে চাই সনাতন পাঠকদের জন্য।

(৬)

নবেন্দু ঘোষ
বন্ধুবরেষু
স্বাধীনতা এল, আকাশে জেগেছে নবজাতকের দিন,
ধন্য হল কি রক্তের অভিসার?
তোমার আমার জীবনের ’পরে গুরুভার দুঃসহ
কাঁটাবন আর শঙ্খচূড়ের ফণা
কিউ, কন্ট্রোল, কালোবাজারের অযুত অক্টোপাস,
এপারে গঙ্গা ওপারে গঙ্গা – ভারত – পাকিস্থান,
মাঝখানে বালুচর।
আমাদের বালুচর,
যুথীবন নেই, বিকচ কেতকী কোথা,
ভাগাড়ের হাড়ে হাতছানি দেয় প্রেত পঞ্চাশ সাল
এল কি বন্ধু, নবজাতকের দিন?

শেষকথা লিখবার এবার সময় এসে গেছে।

“সুনন্দর জার্নাল”-এর প্রকাশকের নিবেদন-এ সবিতেন্দ্রনাথ রায় লিখেছেন, “দেশ পত্রিকার একেবারে গোড়ায় ১৯৩৪ সালে ৩’রা নভেম্বর তারিখে নারায়ণবাবুর প্রথম কবিতা‘অবরুদ্ধ’ প্রকাশিত হয়। সেইটেই যতদূর জানি, তাঁর প্রথম মুদ্রিত কবিতা। আর ছত্রিশ বছর পরে ১৯৭০ সালে সেই নভেম্বর মাসেরই একটি দিনে তাঁর শেষ রচনা প্রকাশের বেদনা আমাদের অনুভব করতে হল। ১৯৬৩ সাল থেকে দেশ পত্রিকার পাঠক যে-সুনন্দ’র সঙ্গে নিত্য সম্বন্ধ স্থাপন করেছিলেন, আগামী সংখ্যা থেকে তাঁকে আর খুঁজে পাবেন না – এ দুঃখ সকলেরই। পরলোকগত শ্রীনারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতি আমরা আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি।”

শেষকথা এখানেই শেষ হলো বটে, তবে বাংলা সাহিত্য জগতে সুনন্দ রায় ওরফে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের অবদান টেনিদার ভাষায় যাকে বলে, “ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিষ্টোফিলিস, ইয়াক-ইয়াক-ইয়াক!”

0 comments:

0

প্রবন্ধ - চিত্তরঞ্জন হীরা

Posted in

প্রবন্ধ


নাকথার ভাষা : কিছু প্রেম, কিছু স্বাধীনতা
চিত্তরঞ্জন হীরা



দিনে দিনে দেখছি শরিকি ঝামেলাটা লেগেই থাকছে আবেগ এবং যুক্তির মধ্যে। কে কতটা অংশ নেবে, কার সীমা কোন্ পর্যন্ত – এ নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ, চলতেই থাকে। একটা দেশ স্বাধীন হতে পারে, একটা বয়স (নির্দিষ্ট কাল পেরিয়ে যাওয়ার পর) স্বাধীন হতে পারে, কিন্তু একটা ভাষা পারে না? এমন প্রশ্ন কারও কারও মনে জাগতেই পারে। আর যদি নাও জাগে, আজ মনে হলো আমরা এটা নিয়েই কিছু কথা বলবো। নাকথার ভাষায় যতটুকু সাধ, কিছু প্রেম, কিছু স্বাধীনতা।

মাতৃভাষাকে ভালোবাসার জন্যে প্রথমত চাই একটা জাতীয়তাবোধ, তারপর ঔপনিবেশিক দাদাগিরি এড়িয়ে নিজের মত তার চলাবলাকে প্রসারিত করা। এখানে থাকবে না অন্য কোনও ভাষার অনুশাসন। থাকবে না কোনও বাধ্যতা। এমনটা একটা রাষ্ট্রই এনে দিতে পারে। কিন্তু এটা দিয়ে ঠিক ভাষার স্বাধীনতা বোঝানো যাবে না। পাশাপাশি, ভাষার ঔপনিবেশিকতা নিয়ে লম্বা চওড়া গল্পটাও না হয় বাদ রেখে আমরা একটু সোজাসাপটায় যাই।

ভাষার স্বাধীনতা হলো নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে কিছুটা উদার হয়ে ওঠা, কিছুটা আপন সত্তায় স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠা। যদিও আমরা শুদ্ধ বাংলা বলতে শব্দ ব‍্যবহারের ছুঁৎমার্গতা বর্জন করেছি বহু আগেই। চেয়ার, টেবিল, কাপ, প্লেট, পেন-পেনসিল দিয়ে কেউ আর হয়তো কোনও ব‍্যাক‍রণে তাকে বাঁধতে চাইছে না। কারণ এই শব্দগুলো অভিধানে বাংলা না পরভাষা, আমরা খুঁজতে যাই না আর। এমনই বাঁধাহীন একটা ভাষা এখন চলেছে নতুন পথের সন্ধানে‌। আরও আরও দুঃসাহস নিয়ে যতটা পেরোলে ঠিক পথিক বলা যায়!

আরেকটু এগোলেই সূর্যাস্তের পাড় ধরে যেখানে গোধূলিরঙ সন্ধ্যা আসবে। আরবসাগরের জল নীল থেকে আরও নীল, নীলাব্জ। সহকলায় আশ্চর্য আসমানিয়া। রাত্রি এসে ধুয়ে দেবে সমস্ত দিনের ক্লেদ। আমরা আমাদের পতাকার রঙে রোদের বেড়ে ওঠা দেখতে দেখতে বলবো, এই তো ভূভারত সুধাময়, নতুন সকাল। ভোর এসে রেশমিডানা মেলে বলবে,হারমোনিতে হিম লেগেছে। কাফেটরিয়ায় ধোঁয়া উড়ছে, বলো সম্ভাবনা। উড়ছে কুয়াশাফের মেঘান্তরার পাখি। পাখি পাখি মেঘের আকাশ, বলো সম্ভাবনা। খুব ভোর ভোর হয়তো কবিও লিখে ফেলবেন এভাবেই দুকলম–

'আমার অন্তরের চিৎকার, ব‍্যাকুলতা
আর অসম্ভব অপেক্ষাগুলো কুড়িয়ে এনে
এই উঠোন, সিঁড়ি, জানালা…'
(তারককুমার পোদ্দার)

আর একটু এগোলেই নির্বিকল্প সরণির বাঁকে আমাদের দেখা হলে দুজনেই বলে উঠবো, স্বাধীনতা। জড়িয়ে ধরবো একে অন্যকে।

#

তো দাঁড়ালো এই, কবি একটু স্বেচ্ছাচারী হলেই ভাষার স্বাধীনতা আসে। একটা পুরোনো পথের উপর নতুনের প্রলেপ পড়ে। এক্ষেত্রে আবেগকে একটু নড়েচড়ে বসতেই হয়। শুধু আবেগ দিয়ে কোনও নতুন পথ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আবেগ হলো বিশ্বাসের, আর যুক্তি থাকবে একান্তপন বিশ্লেষের জায়গায়। এই দুয়ের মাঝখানে তার মনবাড়িটা সব দেখছে। থেকে থেকে মননের দিকে একটা ঝুলন্ত সিঁড়ি রেখে ইন্দ্রিয়াতীত বোধে জুড়ছে অভিজ্ঞতা। প্রশ্ন তখন সত্তার আহার হয়ে ঝুলন্ত সিঁড়ির মুখে বনভোজনে মেতে আমাদের দেখাতে চাইছে প্রস্থানবিন্দুটি কোথায়! অর্থাৎ কোথা থেকে আমাদের শুরু হয়েছিল, আর আমরা যেতে চাই কোথায়!

তর্কটা বহুদিনের। কিন্তু আমরা আর পেছন ফিরে তাকাতে চাইছি না। প্রয়োজনে আরও একটু ভেঙে বাড়িটাকে না হয় নতুন করে গড়বো, একেবারে ভিত থেকে তুলবো। আমাদের একটা নতুন বাড়ি চাই, স্বাধীন সত্তার বাড়ি। কবি থাকবেন প্রবহমান শব্দের নিত্যসঙ্গী হয়ে। শব্দকে ভাঙবেন, খুঁড়বেন, মাটি তুলে তুলে সেই খননগুহার পাড়ে রাখবেন কিছুটা প্রত্নরূপ করে। তারপর সেই নতুন বাড়িটির ভিতে দাঁড়িয়ে হয়তো দেখে ফেলবেন– 

'এই ঘর মৃত্যুর চোয়াল।
দরজার খুব কাছে ঝোপঝাড় হয়ে আছে
অজস্র বাক্যের ক্ষুরধার।
নির্জনতা যেন এক স‍্যানেটোরিয়াম।'
(শ‍্যামশ্রী রায় কর্মকার)

এই হলো একটা বাড়ি তৈরির ভিত, ভাষার স্বাধীনতা, ভাষা ব্যবহারের স্বাধীনতা। অবিশ্রাম উল্লাস থেকে পাওয়া নয়, একনিষ্ঠ নীরবতা। যাঁর ভেতরে এই ধ্বনিগুলো বাজছে, তিনিই নিয়ত বাস্তবকে অন্যরূপে দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যেমন ঘরকে কী ভাবে মৃত্যুর চোয়াল হিসাবে দেখা যায়, বা ঝোপঝাড়গুলো কীভাবে অজস্র বাক্যের ক্ষুরধার হয়ে উঠতে পারে– এই দেখা এবং পাওয়াটাই একজন কবিকে স্বাধীন করে তোলে। যেমন সামান্য হয়েও অসামান্য –

'দুঃখ- রেশমগুটির নীচে শুয়ে থাকা ব‍্যাঙের আর্তস্বর
সুখ- কোনো এক সম্রাটের শুঁড়হীন হাতি'
(রেজাউদ্দিন স্টালিন)

এখানেই অনুভূতির বৈচিত্র্য। যা একটি শব্দকে নানা ব‍্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে। কিন্তু ভেতরের অভিঘাত ছাড়া এই বোধ বা অনুভুতির জন্ম হতে পারে না।

অভিঘাত হলো অতৃপ্তিজাত। একজন কবি তখনই অস্থির হবেন, যখন তিনি যা দেখতে চাইছেন তার স্বরূপটি ফুটিয়ে তুলতে পারছেন না। তিনি জানেন বাইরের দেখাটাই সব দেখা নয়। বাইরের দেখার মধ্যে যে ঘটমান বর্তমান, তার একটা পুরাঘটিত অতীত রয়েছে, একটা সম্ভাবনার আগত কাল রয়েছে। এভাবে একটি স‍্যানেটোরিয়াম থেকে ব‍্যাঙের আর্তনাদ ধরে সেই শুঁড়হীন হাতিটির কাছেই আমাদের তো পৌঁছাতে হবে। এইসব নাকথাগুলো ভাষা পেয়ে যায় এমনি এমনি, তখনই স্বাধীনতা …।

#

আমরা অপরিচয়ের অন্ধকার হাতড়ে আরেক আলোর গভীরে প্রবিষ্ট হতে চলেছি। অতলের প্রকোষ্ঠ ভেঙে বের করে আনতে চলেছি আরও একটি নতুন রূপ, নতুন প্রাণ, যাকে দেখলে মনে হবে, ঠিকই তো, এর কোনও বিকল্প হয় না, অথচ অদৃষ্টপূর্ব। আগে তো ভাবিনি। এভাবেই দুপুর খোলা নৈঃশব্দ্যের একখানা সাদাপাতা আমাদের দেখিয়ে দিতে পারে–

'লোকটার ব্লাডগ্রুপ জেড প্লাস
দরজা না খুলেই বলে দিল
ভিতরে আনমনা আছে
তার লীলায়িত বেগম বাহার।'
(কমল চক্রবর্তী)

এ হলো ভাষা দিয়ে ভাবনার মূর্তিকে বিমূর্ত রেখে একটা অবয়বে গড়ে তোলার স্বাধীনতা। যাতে রয়েছে অনির্বচনীয় স্ফূর্তির টান। মায়া তার নির্মোহকে দেখছে। খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে ভিতরে ঢুকছে, অতলে ঢুকছে, খননের পথ দীর্ঘ করছে। তার লীলা বোঝা ভার। কিন্তু বোঝাটা যখন সহজ হয়ে উঠবে, তখনই সে বেগম বাহার – আহা!

ঘটনা এভাবেই ঘটে। তলে তলে আরও অনেক কিছু ঘটে যায়। স্বাধীন সত্তার প্রকাশ শুরু হয়, যে শব্দের আধারে থাকে, কিছুটা শক্ত খোলসে। প্রকাশের পথটা কবির কাছে একবার উন্মুক্ত হয়ে গেলেই তাঁর আর মুক্তি নেই। অতল জলের ডাক, স্রোত ভেঙে, ঘুম ভেঙে, এবার তাঁকে ধরা দিতে চায়।

#

আসলে কোনও শব্দই স্বপ্ন থেকে আসে না। কবি নিরন্তর শব্দের গর্ভ নিয়ে খেলছেন। পথ চলতে চলতে, চারপাশের আলোড়ন থেকে, ঘটনার অভিব‍্যক্তি থেকে তাঁর ভেতরে অনর্গল খেলা চলতেই থাকে। কিছু ফেলছেন, কিছু রাখছেন, কিছু ভাঙছেন, তারপর গড়তে বসা। সাদাপাতায় বা আজকের যান্ত্রিক পর্দায় যে রূপটি প্রথম ফুটলো, তার আগে ভেতরে ভেতরে অনেক অনেক মূর্তির গঠন-বিগঠন হয়ে গেছে। এরপরও রয়েছে ছিঁড়ে ফেলা, মুছে ফেলা, আরও কত খেলা। এই খেলাই তাঁর নিয়তি। এতসবের পরও তিনি তৃপ্ত হতে পারেন না। যে কবি তাঁর কাঙ্খিত অবয়বটি পেয়ে গেছেন ভেবে আনন্দে বিভোর হয়ে পড়েন, তা হয়তো মুহূর্তের আনন্দ। আবার ফিরে পড়তে বসলেই মনে হবে, কিছুই হলো না‌। এই মনে হওয়াটা তাঁকে আরও একটি নতুনের জন্যে অতৃপ্ত করলো। যা নির্মোহ, তাই-ই সত্য–

'ঘরে ঘরে কাশ ফোলানো আকাশ। চারদিক
জড়িয়ে একটা গোটা, একটা সমস্ত উঠছে ভোর
জাগার আগে। টেবিলের সমতলে তোমার
বিশ্ব ভাসানো পেনসিলে শব্দ উঠছে কবিতার।'
(প্রণব পাল)

বীজ যখন গর্ভে পড়ে, সে বর্তমান স্থিতি ছেড়ে, নস্যাৎ করে নিষেকে নামে। গর্ভ পূর্ণ হয়ে যা প্রকাশিত হলো, পাঠক যে প্রসূত শিশুটির মুখ দেখতে পেলেন, তা ঐ বীজগর্ভের আলো,কিন্তু আপাত ধ্বনির সন্তান। বহুধ্বনির সমষ্টি নিয়ে কবি যাকে শব্দের মোড়ক দিলেন, তা আসলে ধ্বনি থেকে শব্দে, শব্দের সঙ্গে শব্দ মিলিয়ে এক একটি বাক্য বা পংক্তির ধারণা। এই ধারণা ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে পাঠক সম্পৃক্ত হলে তবে তাঁরও মধ্যে নানারকম ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটবে। এবার পাঠক নিজের মত করে একটি কবিতার বয়ান অথবা শব্দাধার তৈরি করে নিতে পারবেন।

এই পর্যন্ত এসে হয়তো পাঠক বললেন, বুঝেছি। কিন্তু কী বুঝলেন! কবিতা তো যতটা বোঝার নয়, অনুভবের, তারচেয়ে বেশি হলো বাজার, বেজে ওঠার। কবি পরোক্ষে পাঠকের ভেতরে ঢুকবার দরজাটা শুধু একটু ফাঁক করে রাখেন। বাকি কাজটা তখন ঐ পাঠকের। পাঠক ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে যতটা বাজবেন, তাঁর ভেতরেও একটা ভাষাদেশ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে। তাঁর কথার ভোল বদলে যাবে নতুন শব্দে, শব্দসম্ভারে। নিজেকে পেতে থাকবেন আপন সত্তায়, উন্মোচনের মাধ্যমে।

#

মানুষ মূলত নিজের মত করে বাঁচে। এখানে আমরা আত্মশক্তির কথা বলতে চাইছি। বেড়ে ওঠা, বড় হওয়ার পর হয়ে ওঠা। হয়ে ওঠার জন্যেই বেরিয়ে পড়া। পথ যে ডাকছে। জল,আলো, বাতাস ডাকছে, আকাশ ডাকছে। কখনও ডুব, কখনও সাঁতার। ভাষায় ভেসে। ভেসে ডুবে কবি দেখছেন তাঁর সারা গায়ে এত এত মৃতশব্দের শ‍্যাওলা জমে আছে! শ‍্যাওলা মুছতে জল, জল মুছতে জলজঞ্জাল। সব কি সাফ হয়ে এলো! কে যেন ডাক দিলো ‌– সুন্দর এখানে একা নয়। আলোর বুদবুদ গায়ে মেখে একটি হরিণী তাকিয়ে আছে জলভরন্ত চাঁদের কিনারে। কানায় জ‍্যোৎস্না লেগে আছে। বেলা কি পড়ে এলো! আমরা দিন এবং রাত্রির মাঝে পড়ে হাবুডুবু, তখনই দেখি –

'ক্ষতচিহ্ন থেকে উঠে আসা জিজ্ঞাসাশহর, তার পাপড়িগুলো
তৃতীয় বন্ধনী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দূরে'
(শান্তিময় মুখোপাধ্যায়)

হারাতে হারাতে আমারই আত্মার খোঁজ দেয়। আমার গভীরতম আত্মায় যে 'আমি', তাকে জাগিয়ে তোলার কথা বলে। বন্ধনী খুলে দিয়ে দূরকে দেখায়‌। অনির্দিষ্ট যাত্রার কথা বলে। কারণ, তারও কিছু প্রত‍্যাশা থেকে যায়, কিছু কিছু প্রণোদনা।

মন বলছে, জীবন নানা তালবাদ‍্যের সমাহারে গড়া। তার যে কী ছন্দ, কী লয়, আমরা বুঝে উঠতে পারিনা‌। শুধু জীবন কাটাই। কিন্তু ভাষা বোঝে সময়ের ক্লান্তিকে। বোঝে বিকারগ্রস্ততা। প্রাণের উৎসে আরেক প্রাণ, আরেক বীজের জীবন, সেখানেই কবিতা।

একজন তরুণতম কবি আত্মপ্রকাশের নিছক তাড়না নিয়ে হয়তো কোনও এক আশ্চর্য সকাল বা নিঃশব্দ রাতে লিখে ফেললেন একটি কবিতা। তাঁর যে কী আনন্দ! ক্রমশ তাঁকে পেয়েও বসে আত্ম-আবিষ্কারের খেলায়, তখনই হয়তো একটু একটু করে টের পান না হয়ে ওঠার বেদনা। এই অনুভবই তাঁকে আলাদা হওয়ার রাস্তা দেখাবে। শুরু হবে অন্তর্ব‍্যাপী বেদনার স্ফূরণ। তাঁকে টেনে নিয়ে যাবে আত্মহননের দিকে। প্রতিটি ঘটনার স্পন্দন, প্রতি মুহূর্তের গ্লানি, ব‍্যর্থতা, কিছুই যাবে না ফেলা। শিরায় শিরায় গোপন সংঘাতের তাড়না। তিনি ছুটে চলেছেন অনিশ্চয়ের দিকে। যা কিছু অনির্নেয়, যা অনিশ্চয়, সেখানেই এক নতুনের সম্ভাবনা।

কোনও বস্তু বা বিষয়ের নির্দিষ্ট কোনও অর্থ নেই, সে প্রকাশিত হয় এক একটি চিহ্নের মধ্যে প্রতীকি ব‍্যঞ্জনায়। অর্থাৎ বহু প্রতিশব্দের মধ্যেই তার অবস্থান। যে যত বেশি প্রতিশব্দের সন্ধান দিতে পারে ততই তার ব‍্যাপ্তি, তার প্রসারতা।

#

অসংযোগ, অসন্তোষ নিয়ে মুহূর্তের 'আমি' চিরন্তনের খোঁজে যখন নেমেছে, তার আর পিছুটান কীসে, কীসের মায়া! গৃহে আছো পাঁকাল মাছের মত, গৃহী হয়েও সন্ন্যাসীর মত,বলোতো সংসারের কোন্ কাজে তোমার মন আছে! জীবনে দুঃখ ছাড়া আর কোনও সঞ্চয়ও তোমার নেই। কারও নিঃসঙ্গতার উট হয়ে মরুভূমি পার করে দিতে পার না। শুধু নিজেকেই, নিজেকে নিয়েই শববাহকের সঙ্গে পাড়ি দিচ্ছ। তারপর দেখতে দেখতে–

'গোটানো ছাতার কাছে শেষ আর্জি পেশের সময়
আমার ভেতরের দোলনাটা যে ভাঙ্গতে দোলে
তাকে তোমরা সংশয় বা স্ববিরোধ বলতেই পারো'
(উমাপদ ক‍র)


কিন্তু ঐ যে শেষ বলে কিছু নেই, আর আলাদা হতে হলে নিঃসঙ্গ হতে হয়। শববাহকের সঙ্গে তুমি যে চলেছো, সেটা হলো মৃতশব্দের শব নিয়ে। তাহলে তোমার সংযোগ কোথায়! তুমি দুঃখকে বুকে টেনে নাও, ভাষাকে জড়াও। দাহ করো, দহনে পোড়ো। পুড়ে পুড়ে খাক হয়ে এবার দেখো একটা নতুন শব্দশিশু উঁকি দিচ্ছে তোমার জন্যে। তাকে তোলো, লালন করতে হবে যে।

#

তো বিষয় রয়েছে অবিষয়ের মধ্যেই, কথারা মেলছে নাকথার ডানা। বাকিটা ভাসা ভাসা কথার কথা মাত্র। ভাষাই জানান দেয় কবিতার অস্তিত্বকে। আর ভাষার স্বতন্ত্রতায় কবির অস্তিত্ব। এই দুই সত্তার মধ্যে মিলে মিশে প্রবাহিত কাল, সময়, সমাজ, মায় সভ‍্যতা। আমাদের খুঁজে নিতে হবে কবি কি সভ‍্যতার পিঠে চড়ে সময়ে পাড়ি দিচ্ছেন, না কালান্তরে গড়ে তুলতে চাইছেন নিজেই এক সভ‍্যতা!

এ প্রসঙ্গে দুটি ধারার হাত ধরে আমরা কিছুটা পথ এগোতে পারি। একই সময়ে দাঁড়িয়ে দুজন কবি জীবনকে দুভাবে দেখছেন, তাঁদের ভাষাও আলাদা হয়ে সেভাবে কবিতায় অবস্থান করছে। একজন হয়তো অপসৃয়মান এক অলীক মায়ায় গড়ে ফেললেন আত্মপ্রতিমাখানি, আমরা মুগ্ধ হলাম। আবার আরেকজন সব বাঁধন কেটে প্রবাহিত মূর্তিমিথ ভেঙে সংগ্রহ করলেন রহস্যের কিছু অভূতপূর্ব ব‍্যঞ্জনা। আমরা মুগ্ধ হলাম না, কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ হলাম, অস্থিরও হলাম, কারণ স্বাভাবিক পাঠ-অভ‍্যাসে সে আঘাত করছে। কিন্তু কবিতা রয়েছে এ দুয়ের মধ্যেই। মুগ্ধতা এবং অস্থিরতা, দুই-ই শিল্পের বিশেষ লক্ষণ, বিশেষ প্রবণতা। ভাঙতে ভাঙতে গড়ে তোলা যেমন শিল্পীর ধর্ম, তেমনি নতুনের সন্ধানে নেমে চেতনার প্রসার ঘটানোও তাঁর দায়বদ্ধতা।

আমরা দুটি উদাহরণ পাশাপাশি রেখে দেখি। যেমন–

'যে মুহূর্তে হেমলক জিভে ছোঁয়ালেন
সেই সময় থেকেই তাঁর অমরত্বের যাত্রা শুরু।'
(শুভঙ্কর দাশ)

এই ঘটনার অভিঘাত থেকে যে সত্যটুকু নির্গত হয়, তা সত্যই। এ হলো প্রথম বিস্ময়, যেখানে রয়েছে মুগ্ধতা। কিন্তু কোনও ভাবনার বাঁক এখানে তৈরি হলো না।

আবার আর একজন কবি একই সময়ে দাঁড়িয়ে লিখছেন–

'বৃষ্টিব‍্যাগ থেকে ভোকাট্টা নামে।
অনেকটা বেড়াল নিয়ে
চুপি চুপি
বিকেলের গোলাপির গায়ে ঝিলিক হয়ে বাজে।'
(কৌশিক চক্রবর্তী)

এখানে আর আমরা অতীত বা বর্তমানের কোনও ঘটনা থেকে উত্থিত সত্যের অভিঘাত পেলাম না। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কারও কারও কাছে এটা অর্থহীন, নাহলে দুরূহ মনে হতে পারে। আসলে সরল সংযোগের অভাবে মনে একটা অস্থিরতাই সৃষ্টি করলো। কিন্তু যিনি এই রহস্যঘরের চাবিটি কোথায় তা জনেন, তাঁর কাছে নানারকম দৃশ্যের দোলা সৃষ্টি হতে বাধ্য। যেমন বৃষ্টিব‍্যাগ বলতে কী কী বুঝে নেওয়া যেতে পারে! ধরা যাক আমরা মেঘ বুঝলাম। আর ভোকাট্টার সঙ্গে ঘুড়ির একটা যোগ যেমন রয়েছে, আবার হারিয়ে যাওয়া বা মিলিয়ে যাওয়াও ধরা যেতে পারে। মেঘ দেখলে কারও কারও মন উদাস হয়, মেঘের সঙ্গী হয়ে হারিয়ে যেতে যেতে কাটা ঘুড়ির মত ভোকাট্টা হয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। একটা বিকেল, একদিকে গোধূলির রঙ আর বিজলি ঝিলিক তাকে আরও উদাসী করলো। ঘর ছাড়া করলো। বেড়ালও এখানে মেঘের সঙ্গে যায়, যেমন কেউ কেউ বুনো মোষের সঙ্গে মেঘের তুলনা দেখেছেন। এভাবে খুঁজে পেতে বের করা যায় আরও আরও অনেক অসম্ভবের সম্ভবতা। আসলে আজ যা সহজগ্রাহ‍্য নয়, কালের নিয়মে ভবিষ‍্যৎ তার জন্যে আসন পেতে বসে আছে। এক্ষেত্রে মাইকেল, জীবনানন্দ প্রমুখরা খুবই প্রাসঙ্গিক উদাহরণ। এখানে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে বা যে দৃশ্যকল্প তৈরি করলো তা অবশ্যই নৈসর্গিক এবং বহুমাত্রিক। দৃশ্যতই আমাদের অনেকগুলো বাঁকে এনে ফেললো। আমরা আগে বেজে ওঠার কথা বলেছিলাম, এখানে দেখার তাড়না, ভিন্ন চোখে দেখা, অস্থির হতে হতেও যাকে নস‍্যাৎ করতে পারলাম না। এখানেই এর মজাটা। শুধু আমাদের নিজেদের মত করে এর মধ্যে জড়িয়ে পড়তে হবে।

#

এটাই নতুন বিস্ময়। নতুনের সম্ভাবনায় এভাবে কল্পনাকে বাস্তব করে তোলা। কবি কল্পনায় দেখেছেন বলে প্রথমে কবির বাস্তব, পাঠক যদি রিলেট করতে পারেন তাহলে সম্ভাবনা উজ্জ্বল। অর্থাৎ পাঠকের বাস্তব। এই পর্যন্ত পৌঁছাতে শুধু সময়ের অপেক্ষা। চাঁদের কাস্তেটা শাণ দিতে দিতে যিনি এগোলেন তাঁর কাছে বাস্তবের আর কোনও বিকল্প ছিল না। কল্পনার সঙ্গে ভাষার বাস্তবিক কোনও সংঘাত হতে পারে না, তা শুধু ধারণার অস্পষ্টতা মাত্র। আমরা একটু এগিয়েই বলছি, স্বাধীনতা।

কথা প্রতিনিয়ত বিষয়হীন হয়ে উঠছে। এটা প্রমাণ করে বাইরের অস্থিরতা বা কেওস্। এই বিশৃঙ্খলা কবিকেও আলোড়িত করে। তিনি খুঁজবেন এর মধ্যে সৃষ্টির বীজগুলো কোথায়! এছাড়াও বলার কথা হলো, আমরা যাকে আপাত বিশৃঙ্খল দেখছি, আসলে তা হলো শব্দের অবিভাজিত কণার মধ্যে যে তরঙ্গ, তার উল্লাস, তার অবাধ্য ছোটাছুটি। যা এই বাস্তবের সমস্ত বিচ্ছিন্নতাকে প্রকট করতে চায়, ভেঙে পড়ার অপেক্ষা নিয়ে। আমাদের শব্দবিশ্ব ধ্বনি সম্পর্কে ধারণাকে এভাবে স্পষ্ট করতে চায় কণাতরঙ্গের অস্থিরতা দিয়ে। অস্থির ভাষাকে স্বাধীনসত্তায় ব্যবহারের মাধ্যমে। একটি গঠন ভেঙে কখনও বিগঠনের দিকে হেঁটে যাওয়া, কখনও পুনর্নির্মাণের দিকে।

#

–তাহলে ভেবে দেখা যাক, কবিতা আসলে কি!

আমরা কেউ জানি না। শুধু জানি শব্দ‌। আদি ও অন্তহীন। তাহলে কি শাশ্বত বলবো! হয়তো বা কিছুটা। বাকি যা পড়ে থাকে তা কালের হাতে। তাকে রাখবে না ফেলে দেবে, সময়ই বলবে। আমরা দেখেছি, হয়তো আরও দেখবো, অনেক মহৎ কবিতাই কালের ধুলোর নিচে চাপা পড়ে যায়। অনেক মহৎ কবি শুধু তাঁর সৃষ্টির উল্লাসেই মেতে থাকেন সারাটা জীবন। প্রচারের আলো তাঁকে ছুয়েও দেখলো না। প্রচারসর্বস্ব বিশ্বে অতি নগণ্যও হয়ে উঠতে পারে অনন্য। এই কারণে ইতিহাস সর্বদা আংশিক সত্য, আর কবিতা অংশত শাশ্বত।

তবে সময় তো বদলায়। পরিবেশ বদলায়, সঙ্গে ভাষাও বদলায়। প্রতিটি বদলের সঙ্গে জাগতিক বিস্ফোরণের সংযোগ ঘটতে পারে, আবার নাও ঘটতে পারে। একজন কবির মধ্যেও এভাবে অংশত যুগের হাওয়া, জাতির সংবেদনা মিলে মিশে সংশ্লেষিত হতে হতে সমকালীন এবং সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতা জারিত হয়। তারপর একটা নতুন ভাষাদেশ গড়ে তোলার দিকে যাত্রা করে। কবি যখন তাকে তাঁর সত্তা দিয়ে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হবেন, তখনই উজ্জীবন। উপনিষদ বলছে – অপাবৃণু, অপাবৃণু। অর্থাৎ, নিজেকে উন্মোচন করও,উন্মোচন করও, ঢাকনা খোলো বন্ধু...।

0 comments: