শক্তিপীঠ ও আমার ধর্মজিজ্ঞাসা
আইভি চট্টোপাধ্যায়
চৈতন্যদেব থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ। স্বামী বিবেকানন্দ থেকে রবীন্দ্রনাথ। মিল এক জায়গায়। প্রত্যেকেই তথাকথিত ধর্মসম্পর্কিত ভাবনা এবং ধারণাকে ভেঙেচুরে নতুন আলো দেখাতে চেয়েছেন। স্বাধীনতার এত বছর পরেও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের নাগরিক হিসেবে আমাদের বহুবিধ জটিল ও জরুরী প্রশ্নের একটি আমাদের ধর্মভাব নিয়ে। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ এই যে, ধর্ম মানুষকে যতখানি সম্পন্ন করে ততখানিই বিপন্নও করে।
হিন্দুত্বের উপর প্রত্যক্ষে জোর দেওয়া রাজনীতি নিয়ে মানুষ প্রায়শই বিভ্রান্ত। অবাক হই যখন ‘শিক্ষিত’ মানুষকে প্রশ্ন করতে শুনি,‘ভারত কি হিন্দু রাষ্ট্র হবে না?’‘উচ্চশিক্ষিত’ মানুষ জোরগলায় তর্ক তোলেন,‘ধর্মেই মানুষের শেষ মুক্তি।’
অথচ ভারত এক স্বাধীন সার্বভৌম গণতন্ত্র। ভারত এমন এক রাষ্ট্র, যেখানে হিন্দু মুসলমান শিখ খ্রিস্টান পার্সী বৌদ্ধ জৈন সবাই সমান। হিন্দুরা চাইছেন বেশি করে হিন্দু হতে, মুসলমান চাইছেন বেশি করে মুসলমান হতে। খ্রিস্টান চাইছেন আরো অনেক মানুষকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে। এই চাওয়ার মধ্যে একটা শব্দ বারবার বাদ পড়ে যাচ্ছে। সেই শব্দটি হল ‘ভালো’। একজন ‘ভালো’ হিন্দু,‘ভালো’ মুসলমান বা ‘ভালো’ খ্রিস্টান হতে চাইলে অনেক সমস্যার আশু সমাধান।
পৃথিবীর প্রতি ধর্মের উদ্দেশ্য সর্বজনীন কল্যাণ: ভ্রাতৃত্ব, বিশ্বমৈত্রী, শান্তি। ভালো করে নিজের ধর্মশিক্ষাটুকু অনুসরণ করলে এ সংঘাতের সমস্যা মিটে যায়।
পুজো, অর্চনা, প্রার্থনা। নিয়ম করে দিনে পাঁচবার পাঠ, উপাসনা। পোষাক থেকে শুরু করে বহুবিধ আয়োজন। নানা আচার অনুষ্ঠান। সমর্পণের ভাবনাকে ছাপিয়ে ওঠে বাহ্যিক আড়ম্বর।
মানুষের জীবনদেবতাকে নিয়ে যে ধর্ম, যে ধর্ম সেই সত্যকে নিয়ে, যা সমাজ এবং ব্যক্তিমানুষকে ‘ধারণ’ করে, সে ধর্ম কোথায়?
ঠিক এইখান থেকে আমার ধর্মজিজ্ঞাসার শুরু। বুদ্ধ এবং গান্ধী, চৈতন্যদেব এবং রবীন্দ্রনাথ, যীশু এবং বিবেকানন্দ... সবার ভাষ্যে মিল এক জায়গায়। মানুষের এক নতুন চৈতন্যলোক চাই। আবহমান কাল ধরে পৃথিবীর দাবি একটাই। মানবতাবোধে বিশ্বাসী নতুন ‘বিশুদ্ধ’ মানুষ।
অন্বেষণের এই যাত্রায় আমার প্রথম উপলব্ধি, ভক্ত যে ভগবানকে চায়, সে তার নিজের পূর্ণতার জন্যেই।‘সোহহম’। আমি আর আমার ঈশ্বর একই। ঈশ্বরের যে প্রীতি ও কল্যাণভাবনা সকল মানুষের প্রতি সমান প্রসারিত, সেই ভাবনার আলোয় নিজের অহংবোধের সীমা অতিক্রম করে পরমশক্তির সঙ্গে একাত্ম হতে চাওয়া।
এই প্রসঙ্গেই শক্তি-আরাধনা নিয়ে নানা ভাবনা। দুর্গা, কালী, দশমহাবিদ্যা। একান্নটি শক্তিপীঠ। এই শক্তিপীঠ নিয়ে আমার ধর্মজিজ্ঞাসার শুরু।
‘পীঠ’ কথাটির অভিধানগত অর্থ ‘দেব দেবীর আসন’, দেবতা যেখানে বিশেষভাবে বিরাজিত। পীঠনির্ণয়-তন্ত্র অনুসারে একান্নটি শক্তিপীঠ।
১) জলন্ধর ২) জ্বালামুখী ৩) কাশ্মীর: শারদাপীঠ, অমরনাথ, ক্ষীরভবানী
৪) মানস ৫) প্রয়াগ ৬) কুরুক্ষেত্র ৭) বৃন্দাবন
৮) হিংলাজ ৯) প্রভাস ১০) পুষ্কর(মণিবেদক) ১১) অবন্তী
১২) উজ্জয়িনী ১৩) বারাণসী ১৪) নর্মদা ১৫) জনস্থান
১৬) পঞ্চসাগর ১৭) শুচিদেশ ১৮) করবীর ১৯) রামগিরি
২০) কামাখ্যা ২১) কালীঘাট(কলকাতা) ২২) কালীঘাট(বর্ধমান)২৩) ত্রিপুরেশ্বরী
২৪) চন্দ্রনাথ(চট্টগ্রাম) ২৫) বৈদ্যনাথ ২৬) জয়ন্তীয়া ২৭) ক্ষীরগ্রাম
২৮) বক্রেশ্বর ২৯) কেতুগ্রাম ৩০) অট্টহাস ৩১) তমলুক(বিভাসক)
৩২) কিরিটেশ্বরী ৩৩) ত্রিস্রোতা ৩৪) নলহাটী ৩৫) রত্নাবলী
৩৬) নন্দিপুর ৩৭) যশোর ৩৮) শ্রীহট্ট ৩৯) বিরাট
৪০) সুগন্ধা ৪১) ভবানীপুর ৪২) বিরজাক্ষেত্র (উত্কল) ৪৩) কালমাধব
৪৪) কন্যাশ্রম ৪৫) গণ্ডকী ৪৬) নেপাল ৪৭) শ্রীপর্বত
৪৮) গোদাবরী তীর ৪৯) মিথিলা ৫০) কাঞ্চী ৫১) শ্রীলঙ্কা
সাধারণভাবে এই একান্নটি শক্তিপীঠের নাম থাকলেও বিভিন্ন আধ্যাত্মিক রচনায় সংখ্যাটা অন্য। জ্ঞানার্ণবতন্ত্রে পীঠের সংখ্যা পঞ্চাশ, কুব্জিকাতন্ত্রে বিয়াল্লিশ। শিবচরিতে একান্নটি পীঠের সঙ্গে সঙ্গে ছাব্বিশটি উপপীঠের বর্ণনা।
তন্ত্রসার গ্রন্থ অনুসারে মূল পীঠ চারটি: জলন্ধর, উড্ডীয়ান, পূর্ণগিরি, কামরূপ।
কালিকাপুরাণে মূল চারটি পীঠ: ওড্রা, জালশৈল, পূর্ণশৈল, কামরূপ। যদিও কালিকাপুরাণের অষ্টাদশ অধ্যায়ে পীঠসংখ্যা বাড়িয়ে সাত করা হয়েছে।দেবীকূট, উড্ডীয়ান, কামগিরি, কামরূপ, জলন্ধর, পূর্ণগিরি, কামরূপ সীমান্ত।
কুব্জিকাতন্ত্রে পীঠ: কর্ণসুবর্ণ, ক্ষীরগ্রাম, বৈদ্যনাথ, বিল্বক, কিরীট, অশ্বতীর্থ, মঙ্গলকোট, অট্টহাস
তন্ত্রচূড়ামণি মতে পীঠ: বহুলা, উজালী, ক্ষীরখন্ড, কিরীট, নলহাটি, বক্রেশ্বর, অট্টহাস, নন্দীপুর।
প্রতি পীঠে দেবী আলাদা নামে পূজিতা।
আর প্রতি পীঠে দেবীর সঙ্গে একজন ভৈরবের পুজো হয়। আর্যরা আসার পর শিব ও শক্তির সমন্বয়ে যে এক অর্ধনারীশ্বর পুজো রীতি শুরু হয়েছিল, এই দেবী-ভৈরব আরাধনায় সে সত্য প্রতিষ্ঠিত।
“শিব: শক্ত্যা যুক্তো যদি
ভবতু শক্ত: প্রভবিতুং
নচেদেবং দেবো
ন খলু কুশল: স্পন্দিতুমপি’’ (আনন্দলহরী–শঙ্করাচার্য)
অর্থাৎ, পরমদেব শিব শক্তির সঙ্গে যুক্ত হলেই সমর্থ হন। নতুবা শক্তিহীন শিবও শব মাত্র। সত্যিই তো! শক্তি এবং তাঁর ভৈরব। নইলে কি সৃষ্টি হয়!
শক্তিপীঠ গড়ে ওঠার পিছনে যে পৌরাণিক কথা... দক্ষরাজার সভায় সতীর দেহত্যাগ, মহাদেবের প্রলয়নৃত্য থামাতে বিষ্ণুর সুদর্শনচক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে ফেলা, আর সে দেহাংশ যে যে স্থানে পড়লো সেখানেই শক্তিপীঠ গড়ে ওঠা... অনুরূপ একটি গল্প মিশরের পুরাণে আছে।
মিশরের প্রিয় দেবতা ওসিরিজ। মাথায় সাপ, পরনে বাঘছাল, বাহন এপিস নামের ষাঁড়। ঠিক যেন আমাদের মহাদেব। ওসিরিজের স্ত্রী দেবী আইসিস। ওসিরিজের ভাই সেট ওসিরিজের প্রতি ঈর্ষায় মত্ত হয়ে একদিন তাঁকে হত্যা করে নীলনদের জলে সে দেহ ভাসিয়ে দিলেন। আইসিস পাগলের মতো স্বামীকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। নীলনদের ধারে অবশেষে খুঁজেও পেলেন। কিন্তু সেট সে দেহ ছিনিয়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিলেন। যে যে স্থানে ওসিরিজের দেহাংশ পড়ল, সেখানে একটি করে তীর্থস্থান গড়ে উঠল।
আমরা ইতিহাস থেকে জেনেছি, সেকালে ভারত এবং মিশরে বাণিজ্য ব্যবস্থা ছিল।
প্রশ্ন জাগে, কোন পুরাণ-কথাটি বেশি প্রাচীন! এই গল্পকথা কি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই প্রচারিত হয়েছিল? ওসিরিজের শরীরের টুকরোগুলো মিশরেই পড়লো? সতীর দেহাংশ কেবল ভারতবর্ষে?
সবচেয়ে মজার কথা, শক্তিপীঠ যে দেবীর দেহাংশ পড়েই গড়ে উঠেছে, সে তথ্য প্রথম জানা গেছে ষোড়শ শতাব্দীর আইন-ই-আকবরী থেকে।
পরে বিভিন্ন আধ্যাত্মিক সাহিত্য এ তথ্য স্বীকার করে। তাই অনেক গবেষকই মনে করেন, পুরাণ-কথা হিসেবে সতীর দেহাংশ থেকে পীঠস্থান গড়ে ওঠার গল্পটি পীঠস্থান উত্পত্তির অনেক পরে বিশেষ উদ্দেশ্যে রচিত।
ভারত নামে দেশটার ভৌগোলিক সম্পূর্ণতার যে ধারণা আজকের মানুষের বোধে আনা সহজ হয়েছে, অতি প্রাচীনকালে তা কিন্তু ছিল না। হিন্দুধর্ম পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াসে শঙ্করাচার্য ভারতের অখণ্ডতার প্রথম ছবি আঁকেন। অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বরূপ হৃদয়ে ধারণ করার কাজে ব্রতী হয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ, গান্ধীজী। সে অনেক পরের কথা।
প্রাচীনকালে সমগ্র ভারতকে উপলব্ধি করার প্রয়াস ছিল ধর্মানুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। মহাভারতের মাঝখানে প্রক্ষিপ্ত গীতা সেই সর্বব্যাপী সমন্বয়তত্ত্বের আলোচনা করে।
শক্তিপীঠ ভাবনার সঙ্গে শক্তিপূজা-ভাবনা যতখানি, তার চেয়েও বড় সত্যি ভারতের ঐক্য এবং জাতীয়তাবোধকে ধরে রাখার চেষ্টা। ধার্মিক হিন্দুর কাছে ভারতের চারপ্রান্তে স্থিত চারধাম-যাত্রা পুণ্যের কাজ। শক্তিপীঠ ভ্রমণেও সেই পুণ্য-অর্জনের ইচ্ছে।
লাভ এই যে, তীর্থ করতে গিয়েও দেশটাকে দেখা হয়, জানা চেনা হয়।
যদিও প্রতিটি স্থানমাহাত্ম্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে খানিক ইতিহাস, কিছু বিজ্ঞান, এবং অনেকখানি কুসংস্কার, অলৌকিকতা প্রচারের নেতিবাচক দিক। ধর্মান্ধ মানুষ ইতিহাস ও বিজ্ঞানের অংশটুকু বাদ দিয়ে দেন, আর মেতে থাকেন অলৌকিকতার কুসংস্কার নিয়ে। তাই দৃষ্টি পরিষ্কার হয় না।
অথচ পীঠস্থানগুলোর বিশ্লেষণ করলে সুপ্রাচীনকাল থেকে ভারতের ধর্মীয় বিবর্তনের এক স্পষ্ট ইতিহাস জানা সম্ভব।
এই বিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে শক্তিপীঠ সংক্রান্ত বহু গবেষণাগ্রন্থের মধ্যে অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সরকারের ‘দ্য শক্তি পীঠস’ উল্লেখযোগ্য। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত বহু গবেষণা এই গ্রন্থকে প্রামাণ্য ধরে আলোচনায় এগিয়েছে।
অন্তত চোদ্দটি পীঠ – তমলুক, কিরীটেশ্বরী, মানস, কুরুক্ষেত্র, বৃন্দাবন, হিংলাজ, প্রভাস, অবন্তী, উজ্জয়িনী, বারাণসী, পুষ্কর(মণিবেদক), কন্যাশ্রম, গণ্ডকী, নেপাল – কেবল হিন্দুদের তীর্থ নয়। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন – এই তিন সম্প্রদায়ের তীর্থ এই চোদ্দটি শক্তিপীঠ। আবার হিন্দুদের মধ্যেও কেবল শক্তি-উপাসক শাক্ত নয়, শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ও এই চোদ্দটি পীঠকে সাধনক্ষেত্র হিসেবে মানে।
এই প্রসঙ্গেই আমার আরেকটি পর্যবেক্ষণ এইরকম যে, হিন্দুধর্মের তিন মূল ধারা: শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব... এই তিন ধারার মিলিত একটি রূপও ভারতে আবহমান কাল ধরে চলছে। বিষ্ণু ও শিবকে মিলিয়ে দিয়ে হরি-হর, শিব ও শক্তিকে মিলিয়ে অর্ধনারীশ্বর। বাংলার বাউল ও মহারাষ্ট্রের মহানুভব সম্প্রদায়ের ধর্ম-ভাবনায় একইভাবে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের মিলিত ধারা।
বৃন্দাবন এবং মথুরায় দেবী উমা কঙ্কালমালিনী নামে পূজিতা। তাঁর ভৈরবের নাম ভূতেশ। একসময় কঙ্কালমালিনীর মন্দিরে বৌদ্ধ ও জৈন বিহার ছিল।
তমলুক বা তাম্রলিপ্ত বৌদ্ধদের অন্যতম প্রধান তীর্থ। খৃষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন এবং তার দুশো বছর পর হিউয়েন-সাঙ তমলুককে বৌদ্ধধর্মের তীর্থ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। ইতিহাসের কোন রাজনীতি ও ধর্মীয় বিবর্তনের পথ ধরে তমলুক হিন্দু তীর্থস্থান হিসেবে শক্তিপীঠের মর্যাদা পেলো, তা আগ্রহ জাগায়।
একই ইতিহাস মুর্শিদাবাদের লালবাগের কাছে কিরিটেশ্বরী শক্তিপীঠেও। বৌদ্ধধর্মের প্রাধান্য, আবার ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনর্বিজয়।
বিরজাক্ষেত্র (উত্কল), প্রাচীন নাম উড্ডীয়ান। তন্ত্রমতে, এই স্থানে দেবীর নাভি পতিত হয়। দেবীর নাম বিমলা, ভৈরবের নাম জগন্নাথ। পুরাণ মতে, কলিঙ্গরাজ এই নাভি তিনটি বিগ্রহের মধ্যে স্থাপন করেন। কালো ভৈরব, হলুদ ভদ্রা (দুর্গা), সাদা শিব। বিবর্তনের অনেকখানি পথ পেরিয়ে এসে এই তিন বিগ্রহ আজ জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা।
বিরজাক্ষেত্রের ধর্মীয় বিবর্তন খুব আকর্ষণীয় বিষয়। দশম শতাব্দী পর্যন্ত এখানে বৌদ্ধধর্ম প্রবল ছিল। বৌদ্ধগ্রন্থ হেবজ্রতন্ত্রে উড্ডীয়ানের উল্লেখ আছে। ইন্দ্রভূতি নামে এক বৌদ্ধ সাধক এই উড্ডীয়ানে নির্বাণলাভ করেছিলেন। অনেক গবেষকের মতে, বর্তমানের হিন্দু দেবতামূর্তি আসলে বুদ্ধ, বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধসঙ্ঘের প্রতীক।
বৌদ্ধ ধর্মসাহিত্যে উত্কলবন্দনা অনেকখানি। ইতিহাসও আমাদের জানায়, বৌদ্ধধর্মের প্রভাবেই জগন্নাথধামে জাতিভেদপ্রথা নেই, যে জাতি-বর্ণ ভেদাভেদ অন্য সমস্ত হিন্দুতীর্থের বৈশিষ্ট্য।
বারাণসীতে প্রথমদিকে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রাবল্য ছিল, কিন্তু বৌদ্ধযুগে হিন্দুধর্ম প্রায় অবলুপ্ত হয়। মুসলমান শাসনকালে বারাণসীর সমস্ত হিন্দু দেবমূর্তি বিধ্বস্ত হয়। ইতিহাসের কোন প্রবাহে বারাণসী অন্যতম হিন্দু ধর্মস্থান শক্তির পীঠ হয়ে উঠলো, তা সত্যিই কৌতূহল জাগায়।
শক্তিপীঠ হিংলাজ-এদেবীর নাম কোট্টরী, তাঁর ভৈরবের নাম ভীমলোচন। মুসলমান সম্প্রদায় কোট্টরী দেবীকে ‘নানী’ নামে শ্রদ্ধা জানায়। মুসলমানের কাছে হিংলাজ-তীর্থের নাম ‘নানী কি হজ’।
শক্তিপীঠের পরিক্রমায় এইভাবেই হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন-ইসলাম নানা ধর্মের পরিক্রমা। আমার ধর্ম-জিজ্ঞাসা নতুন আলোয় ঝলমল। তাহলে ধর্ম নিয়ে কেন এত হানাহানি? কেন এত বিভ্রান্তি? কিছু ষড়যন্ত্রী মানুষ বুঝি ধর্মের নামে আপামর সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বিপথগামী করে রাখতে চাইছে? যেসব তীর্থ নিয়ে সব ধর্মের মানুষের আবেগ জড়িয়ে থাকে, তাদের কোনো একটি ধর্মের নামের গণ্ডীতে বেঁধে রাখা উচিত? এই শক্তিপীঠগুলোকে কেন্দ্র করেই আবার মানুষে মানুষে ভালোবাসার মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারি না আমরা সবাই?
অনেক গবেষকের মতে, খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর আলাউদ্দিন খিলজির রাজত্বকালে ইসলাম শাসনের অত্যাধিক পীড়নের ফলে হিন্দু মানসিকতায় ধর্মবাদের আলোড়ন। হিন্দুদের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস যাকে বলে। সেই ক্রাইসিস, এক অভূতপূর্ব বিপন্নতা থেকেই একান্ন পীঠের জন্ম।
সেই অসহায় সময়ে সমস্ত আঞ্চলিক দেবীকে এক মাতৃশক্তির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে মাতৃপূজার আবহ তৈরী করা হয়েছিল। লক্ষ্য করার মতন বিষয় এই যে, পূর্বভারতে শক্তিপীঠের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কেন? পূর্বভারতে অত্যাচার ও নিপীড়ন বেশি হয়েছিল?
অন্য একটি কারণও আছে। তন্ত্রসাধনার বিস্তার। তন্ত্রসাধনার সূত্রপাত চীনে। চীন, তিব্বত, আসাম হয়ে পূর্বভারতে তন্ত্র ভাবধারার প্রসার। তাই পূর্বভারতে সতীপীঠের সংখ্যা বেশি। তান্ত্রিক সাধনায় বাংলা ও আসামের খ্যাতি ছিল। সাধক বামাক্ষ্যাপা দেবীকে মাতৃভাবে তন্ত্র সাধনা করতেন। বাংলার দুই সাধক, রামপ্রসাদ ও শ্রীরামকৃষ্ণ তন্ত্রসাধনা করেছেন। বারাণসীর বিখ্যাত সাধক ত্রৈলঙ্গস্বামী তান্ত্রিক সাধক ছিলেন। মহারাষ্ট্রের কঢ়ারী ব্রাহ্মণরা তান্ত্রিক সাধক ছিলেন। বৌদ্ধদের মহাযান ধর্মমত তান্ত্রিক সাধনার মত।
তান্ত্রিক প্রক্রিয়া সাধারণ মানুষের কাছে রহস্যপূর্ণ ব্যাপার। ভারতীয় ধর্মচেতনায় সাধন-পদ্ধতির দুই মার্গ। এক, নিবৃত্তিমার্গ। দুই, প্রবৃত্তিমার্গ। নিবৃত্তিমার্গ-অনুসারীর চোখে জগৎ সংসার মায়া,মোহ, মিথ্যা। প্রবৃত্তিমার্গে সাধক পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাধনায় বিশ্বাস করেন। তন্ত্রসাধনা প্রবৃত্তিমার্গের সাধনা।
বৈদিক সভ্যতার শেষে বৌদ্ধযুগ। যে বৌদ্ধধর্ম বৈদিক পূজা-পদ্ধতিকে অস্বীকার করে গড়ে উঠলো, বৌদ্ধযুগের শেষদিকে তাঁরাই গুপ্তভাবে বৈদিক যাগযজ্ঞ কর্মকাণ্ড অনুসরণ করতে শুরু করেছিলেন। এই গুপ্ত প্রক্রিয়া থেকেই তন্ত্র সাধনার শুরু।
তন্ত্রসাহিত্যে পীঠস্থানের উল্লেখ আছে। মূল চারটি শক্তিপীঠ,জলন্ধর, উড্ডীয়ান, পূর্ণগিরি, কামরূপ, বৌদ্ধদের সাধনপীঠ হিসেবে স্বীকৃত। বৌদ্ধগ্রন্থ হেবজ্রতন্ত্রে এই চার সাধনপীঠের উল্লেখ আছে। বৌদ্ধগ্রন্থ সাধনমালা-য় জলন্ধরের বদলে শ্রীহট্ট নাম উল্লিখিত।
এ থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে, শক্তিপীঠ আসলে তন্ত্রসাধনার পীঠ। কিভাবে এই পীঠগুলো হিন্দু তীর্থ হয়ে উঠল, সেটাই ইতিহাস। শক্তিপীঠের স্থানগত কারণগুলো আসলে সবটাই ইতিহাস। সবটাই ধর্মীয় ও রাজনীতিক বিবর্তনের ফল।
এইসব যুক্তি দিয়েই মনে হয় আমার, ধর্মভাব প্রবল হয়ে ওঠার যে অধুনা ইতিহাস, তাতে অদূর ভবিষ্যতে পীঠসংখ্যা বেড়ে একশ’ হয়ে গেলেও অলৌকিকত্বের দোহাই দেবার প্রযোজন পড়বে না।
আসলে মানবহৃদয়ের চিরাচরিত পৌত্তলিকতা ভাবনা থেকে কোনো সময়, কোনো সমাজ, কোনো ধর্মই রক্ষা পায় নি। আদিম মানুষ সুরক্ষাজনিত ভয় থেকে, অশিক্ষার অন্ধকারে থেকে যে পদার্থ-উপাসনা শুরু করেছিল, সেই ধারা প্রবহমান।
তাই যে যীশু কোনো ধর্ম-প্রতিষ্ঠান গঠন করতে চান নি, তাঁর দেহাবসানের পর রোমান সাম্রাজ্যে তাঁর নামকে ঘিরেই গড়ে উঠল নতুন একটি ধর্ম: খ্রিস্টধর্ম। যীশু প্রতিভাত হলেন স্বয়ং ঈশ্বর হিসেবে। দিকে দিকে চার্চ ও প্রতিষ্ঠানের যুগোচিত আবহাওয়ায় যীশু হয়ে উঠলেন একজন স্বর্গীয় সম্রাট। যীশু বলেছিলেন পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্যের কথা, ঈশ্বরের রাজ্যের কথা। যীশুর স্বপ্ন, ঈশ্বরে বিশ্বাস অর্পণ করে পৃথিবীতে প্রেম ও অহিংসার স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলা। চার্চ জানালো, যীশুই ঈশ্বর, মুক্তিদাতা। স্বর্গীয় আচরণের স্থান পরলোকে। দিকে দিকে খৃষ্টধর্ম প্রচার করা ও সেই ধর্মের ছায়ায় অগণিত মানুষকে দীক্ষিত করাই স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলার উপায়।
এই আপোষধর্মী মনোভাবের জন্যেই গৌতম বুদ্ধ, যিনি পুজো-অর্চনার বিরোধিতা করে গেলেন আজীবন, তিনিও ভগবান হয়ে পুজো পেতে লাগলেন দেহরক্ষার পর থেকেই। তাঁর নামকে ঘিরে বৌদ্ধধর্ম প্রচার।
কিংবা রাজা রামমোহন রায়। মুক্তমনা একটি সমাজ তৈরী করতে চেয়েছিলেন। পৌত্তলিকতা ভাবনা নয়, সর্ব ধর্ম সমন্বয়ে এক মুক্ত সমাজ। ব্রাহ্মসমাজ। যেখানে সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে শুদ্ধচিত্তে প্রার্থনা করবেন, একাত্ম হবেন। রামমোহনের দেহরক্ষার পর তৈরী হল একটি নতুন ধর্ম: ব্রাহ্মধর্ম।
বিবর্তনের স্রোতে নতুন পরিস্থিতি, নতুন ভাবনা, নতুন চিন্তা আসবেই। সে নিয়ে আপত্তির কারণ নেই। কিন্তু পূর্বসূরীদের অন্তর্দৃষ্টি আমাদের কাছে অর্থবহ হওয়া উচিত। নইলে একান্ন শক্তিপীঠের জায়গায় একশ’ একান্নটি শক্তিপূজাতেও লাভ নেই।
হিন্দুধর্ম, কিংবা যে কোনো ধর্মকেই বুঝতে গেলে ভারত নামের এই দেশটাকে বুঝতে হবে। হিন্দুধর্ম এক বিশাল দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনের প্রবহমান ধারার নাম। আর ভারতের সংস্কৃতি, সভ্যতা, ধর্ম, কোনটাই মানুষকে ছাপিয়ে উঠতে পারে না। মানুষের খাদ্যাভ্যাস, পোষাক আশাক, রীতিনীতি নিয়ন্ত্রণ করে ধর্মশিক্ষা হয় না।
হিন্দুধর্ম হল আত্মদর্শন। শান্তংশিবমদ্বৈতম্। শান্ত, শিব। এবং এই দুই মিলে আত্মার মধ্যে সামঞ্জস্যসাধনে অদ্বৈত হয়ে ওঠার অন্য নাম হিন্দু হয়ে ওঠা। শক্তিপীঠ পরিক্রমায় এই সত্যটুকুই আমার অনুভবে এসেছে। অদ্বৈত হয়ে উঠতে না পারলে সব তীর্থই অসার।
তথ্যঋণ: বিভিন্ন তন্ত্র, কালিকাপুরাণ, শিবপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, উদ্বোধন পত্রিকা
যাঁদের লেখালেখি থেকে এই অন্বেষণের তাগিদ এবং সমৃদ্ধি:
শ্রী ক্ষিতিমোহন সেন, ড: দীনেশচন্দ্র সরকার, শ্রী হোসেনুর রহমান,
শ্রীমতি পূর্বা সেনগুপ্ত, শ্রীমতি কেতকী কুশারি ডাইসন,
স্বামী সারদানন্দ, স্বামী নিগুঢ়ানন্দ
2 comments: