Next
Previous
Showing posts with label অণুগল্প. Show all posts
0

অণুগল্প - স্বাতী ব্যানার্জ্জী

Posted in


অণুগল্প


ভয়
স্বাতী ব্যানার্জ্জী 



পাপাইকে নিয়ে আর পেরে উঠছে না অনুজা। প্রতিটি ইউনিট টেস্টে ধারাবাহিক খারাপ রেজাল্ট করছে। শুধু তাই নয়, মিথ্যে বলছে। হয়তো পাঁচ পেয়েছে,বলছে পনেরো। খাতা লুকিয়ে রাখছে। সেদিন তো একপ্রস্হ ঝগড়াই হয়ে গেল সুবিমলের মায়ের সাথে। সে নাকি পাপাইয়ের খাতা ছিঁড়ে দিয়েছে। আচ্ছা করে শুনিয়ে দিয়েছে অনুজা মিতালীকে। ওর ছেলে পাপাইয়ের খাতা ছেঁড়ে কোন সাহসে? কিন্তু মুশকিল অন্য জায়গায়। পাপাই কিছুই মনে রাখতে পারছে না। পড়তেও চাইছে না। যত দিন যাচ্ছে উত্তরোত্তর খারাপ নম্বর পাচ্ছে। একটা চাপা দুশ্চিন্তা নিয়েই স্কুল করছে অনুজা। নিজের ক্লাসে আশিজন ছাত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে অনুজা। পাপাইয়ের কিছু একটা অসুবিধে হচ্ছে। এগুলি তারই ফলশ্রুতি। কিন্তু অসুবিধাটি কি তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না সে।

আজ ফাইভের ক্লাসে গিয়ে চুপ করে বসেছিল সে। ইউনিট টেস্ট চলছে। দীপা মেয়েটি চুপ করে বসে আছে। মেয়েটি পড়াশোনায় ভালো। সে অঙ্ক না কষে চুপ করে বসে আছে কেন? মিসকে তাকাতে দেখেই মাথা নিচু করে লেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে দীপা। অনুজাও অন্যদের দেখতে থাকে। পরীক্ষা চলাকালীন গুঞ্জন বাড়লে মাঝেমধ্যে হালকা ধমক দিচ্ছে। এরমধ্যেই দীপা এসে আরেকটি প্রশ্নপত্র চায়। তার প্রশ্নটি নাকি ফ্যানের হাওয়ায় উড়ে গেছে। বিনাবাক্যব্যয়ে অনুজা অতিরিক্ত প্রশ্নগুলির থেকে একটি দিয়ে দেয়।

পরদিন বড়দি অনুজাকে ডেকে পাঠালেন। প্রধান শিক্ষিকার ঘরে দীপা এবং তার মা বসে আছে। বসে আছে কুসুমমঞ্জরী এবং তার মাও। কুসুমমঞ্জরী কাঁদছে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বড়দির দিকে তাকাতেই তিনি বলেন দীপার মায়ের অভিযোগের কথা। কাল অঙ্ক পরীক্ষায় মায়ের নির্দেশে প্রশ্নপত্রে উত্তরগুলি লিখে রেখেছিল দীপা। কুসুমমঞ্জরী সেই প্রশ্নটি ছিঁড়ে দিয়েছে। তখন মিস দীপাকে একটি নতুন প্রশ্ন দেন কিন্তু দীপার মা উত্তরগুলি না দেখলে কি করে বুঝবেন মেয়ে পরীক্ষা কেমন দিয়েছে? মিস ক্লাসে থাকতেও দুষ্টু মেয়েটির এত সাহস হয় কি করে? দীপার দৃষ্টিতে স্পষ্ট অনুনয়। কুসুমমঞ্জরী কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে এসব সে করেনি।

মুহূর্তে পাপাইয়ের সমস্যা স্পষ্ট হয়ে যায় অনুজার কাছে। একটি চেয়ারে বসে সে। দীপা আর কুসুমকে ক্লাসে যেতে বলে কুসুমের মাকে আশ্বস্ত করে এই বলে যে তার কোনও দোষ নেই। কুসুম দীপার সাথে একবেঞ্চে তো বসেইনি, অনেক দূরে বসেছিল। প্রশ্ন সে ছেঁড়েনি। কুসুমের মা একটু আশ্চর্য হলেও কিছু না বলে চলে গেলেন। এবার দীপার মায়ের সাথে কথা শুরু করে সে। বড়দির সামনেই। ভদ্রমহিলা ভীষণ অসন্তুষ্ট। "অপরাধীকে পেয়েও কেন ছেড়ে দিলেন মিস?"

"ছাড়িনি তো! আপনিই আসল অপরাধী।" বাকস্তব্ধ হয়ে যায় দীপার মা। দীপার কালকের খাতাটি নিয়ে আসে অনুজা। কিচ্ছু লেখেনি সে। "আপনি এত চাপ দিয়েছেন মেয়েকে যে সে যে অঙ্ক বুঝতে পারছে না,করতে পারছে না তা আপনাকে সাহস করে বলতে পারেনি। তার উপর সব অঙ্ক কষে তার উত্তর লেখার চাপ। যে অঙ্ক সে করেইনি তার উত্তর কোথায় পাবে। আপনার রোষের হাত থেকে বাঁচতে একটি মিথ্যে বলে সে আমার কাছে প্রশ্ন নেয়। মরিয়া হয়ে বন্ধুর ঘাড়ে মিথ্যে দোষ চাপায়। শুধু আপনার ভয়ে। এই ভয়ের জন্যে আজ কুসুমমঞ্জরীর ক্ষতি হতে চলেছিল। ভবিষ্যতে আরও অনেকের হবে যদিনা আপনি দীপার ভয় ঘুচিয়ে ওর বন্ধু হয়ে ওঠেন।"

অনেকক্ষণ কথা বলেন দীপার মা। নিজের ভুল মেনে কথা দেন দীপাকে নতুন করে ভালোবাসার। পাপাইয়ের ভয় ঘুচিয়ে বন্ধু হবার অঙ্গীকার করে হালকা মনে স্টাফরুমে ফিরে মিতালীকে ফোন করে সে। ক্ষমা চাইতে। এটুকু শাস্তি অনুজারও প্রাপ্য।


1

অণুগল্প - দৃপ্ত বর্মন রায়

Posted in


অণুগল্প


আহ্বান
দৃপ্ত বর্মন রায় 

সবে ঠিক করলাম এবার একটু গড়িয়ে নেব, এমন সময় শুনতে পেলাম কে যেন ডাকছে। কি মুশকিল, এদের জ্বালায় একটু শান্তিতে বিশ্রাম নেবার জো নেই। কথা নেই বার্তা নেই, যখন ইচ্ছে ডাকতে শুরু করে। কি দরকার রে বাবা, তোদের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, খামখা কেন বুড়ো মানুষটাকে জ্বালানো। এতটা গিয়ে আবার ফিরে আসতে পরিশ্রমও তো হয়, নাকি? কিন্তু কি আর করা যাবে, ইচ্ছা না থাকলেও উঠতে হলো। 

মাঝে মাঝেই এরকম ডাক আসে। বেশীরভাগ সময়ই পাত্তা দিই না। কিছুক্ষণ ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে একসময় থেমে যায়। কিন্তু আজকের ডাকটা একটু অন্যরকম। বেশ ব্যক্তিত্বপূর্ণ ডাক। উপেক্ষা করা যাবে না। অতএব পা বাড়ালাম।

আওয়াজ শুনে আন্দাজ করে নিলাম কোথা থেকে ডাকটা আসছে। তারপর ঢুকে পড়লাম ঘরটাতে। দেখি একটা গোল টেবিলকে মাঝে রেখে তিনদিকে চেয়ারে বসে আছে তিনটে ছেলে। এদের মধ্যে দুজনকে আমি চিনি, আমার নাতি আর তার এক বন্ধু। তৃতীয় ছেলেটিকে আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ল না। তিনজনই চোখ বন্ধ করে বসে আছে। টেবিলের ওপর একটা মোমবাতি জ্বলছে। এছাড়া ঘরের বাকী সব আলো নেভানো। আধো অন্ধকারেই চোখে পড়ল টেবিলের ওপর আমার একটা ফটো।

আমি ঘরে ঢুকতেই মোমবাতির শিখাটা হঠাৎ করে একবার নিভে যেতে যেতেও কোনও মতে জ্বলে রইল। তিনটি ছেলেই যেন ভীষণ ঠাণ্ডায় একবার কেঁপে উঠল। অপরিচিত ছেলেটা চোখ বন্ধ অবস্থাতেই মাথাটা উঁচু করে টানটান সোজা হয়ে বসল। 

আমার নাতি একবার চোখটা পিটপিট করে বলল, “দ্ দাদু... সরি, স্বর্গীয় দেবেন্দ্র বিজয় চৌধুরী। আপনি কি এসেছেন?”

উত্তরটা আমিই দিলাম। কিন্তু একটা অপার্থিব কন্ঠস্বরে আওয়াজটা বেরোল মাঝখানে টানটান হয়ে বসা ছেলেটার মুখ থেকে।

– “হ্যাঁ, আমি এসেছি।”
0

অণুগল্প - সঞ্চয়িতা বিশ্বাস

Posted in


অণুগল্প


সত্য
সঞ্চয়িতা বিশ্বাস



পশ্চিম আকাশে এখন রঙের খেলা… লালচে-কমলা আকাশে দিনশেষের ক্লান্তি মিশেছে। সব পাখিরা ঘরে ফিরছে। শুধু শান্তনব দেবব্রতের কোথাও ফেরবার নেই। পরিখা-মধ্যে শরশয্যায় শায়িত তিনি। ক্ষণকাল পূর্বে সমস্ত কুরু-পাণ্ডব জ্ঞাতি ফিরে গেছেন তাকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপণ করে। এখন তিনি একা। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি।

-"কুরুশ্রেষ্ঠ…"
পরিচিত বলিষ্ঠ পুরুষকন্ঠের আকুতিভরা ডাকে তাকান ভীষ্ম। এই কন্ঠে নম্রতা থাকতে পারে, এ কথা তিনি জানতেন না। বিষ্ময় গোপন করে তিনি তাঁর পদতলে আসীন দেবকান্তি পুরুষকে আহ্বান করেন, "এসো রাধেয় কর্ণ।" 

ঈষৎ নতমুখে সূতপুত্র এগিয়ে আসেন ভীষ্মের নিকটে। ভীষ্ম তাকান কর্ণের বিব্রত মুখের দিকে, "তোমার মতো পরাক্রমী যোদ্ধার দৃষ্টিতে আজ কিসের ছায়া?" 

কর্ণ মৃদুস্বরে বলেন, "কুরুশ্রেষ্ঠ, আমি সামান্য সূতপুত্র। দুর্যোধনের বন্ধুতায় আজ সিংহাসনলাভ করেছি। আমি জানি না এতে আমার অপরাধ কি! তবে আমি আপনার বিরাগভাজন, এ কথা আমি জানি। আমি করজোড়ে আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। "ভীষ্ম স্নেহভরে স্পর্শ করেন কর্ণকে, "তুমি এসেছো, আমার ভালো লাগছে, কৌন্তেয়।" 

কর্ণ চমকে ওঠেন। বৃদ্ধের প্রাচীন ক্লান্ত চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। কর্ণ ফিসফিস করেন, "আপনি…" মুখের কথা কেড়ে নেন ভীষ্ম, "আমি দেবর্ষি নারদের কাছে শুনেছি তোমার জন্মকথা। আমি জানি তুমি সূতপুত্র নও। তোমার পিতা সূর্য।" 

কর্ণ তিক্তকন্ঠে বলেন, "তাহলে আপনি নিশ্চয়ই জানেন, গাঙ্গীন, আমি জন্মমাত্র পরিত্যক্ত। আমি আমার মায়ের কাছে অযাচিত লজ্জাবিশেষ।" 

ভীষ্ম মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বলেন, "তিনি তোমার জন্মদাত্রী। তাঁর প্রতি এ বিদ্বেষ তোমার অশোভন।" কর্ণ থমকে যান। ভীষ্মের হাতখানি নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে কাতরকন্ঠে বলেন, "বীরশ্রেষ্ঠ, আপনি কি আমায় ক্ষমা করেছেন?" 

ভীষ্মের স্বরে কোমলভাব ফিরে আসে। তিনি এক হাতে আলিঙ্গন করেন কৌন্তেয়কে, "আমি তোমার স্পর্ধায় ক্রুদ্ধ হইনি কখনও। কিন্তু দুর্যোধনের সান্নিধ্যে তুমি পরশ্রীকাতর হয়েছ। বারংবার খর্ব করতে চেয়েছো পাণ্ডবদের। আমি তোমার তেজোহানি করবার নিমিত্ত তোমায় মুহুর্মুহুঃ কটুবাক্য বলেছি। রাজন, তুমি অস্ত্রচালনায় অতুলনীয়। তোমার দান ও জ্ঞানের খ্যাতি সর্বজনবিদিত। তুমি কেন দুর্যোধনের পাপের ভাগী হচ্ছো? তুমি অস্ত্রত্যাগ করো। ফিরে যাও সত্যের পথে।" 

কর্ণ দীর্ঘ সময় নতশিরে বসে থাকেন ভীষ্ম-সান্নিধ্যে। ছায়া নামছে। দূরে, অনেক দূরে বিলাপধ্বনি শোনা যাচ্ছে মৃত সৈনিকের স্ত্রীর। কর্ণ উঠে দাঁড়ান একসময়, "পুরুষোত্তম, আমি যোগ্যতা সত্ত্বেও সারা জীবন অপমানিত হয়েছি। একমাত্র দুর্যোধন আমার প্রতিভাকে মর্যাদা দিয়েছেন। আমি তার কল্যাণার্থে উৎসর্গ করেছি আমার সমস্ত কিছুকে। এটাই আমার সত্য। এর বিরোধিতা করতে আমি অপারগ। আপনি ক্ষমা করুন আমায়।" 



নমস্কারান্তে ফিরে যাচ্ছেন এক বঞ্চিত নায়ক, যিনি শীঘ্রই সত্যরক্ষার্থে ত্যাগ করবেন তাঁর কবচ-কুণ্ডল। ভীষ্মের দৃষ্টি তার গমনপথের দিকে। ছায়া গাঢ় হতে হতে অষ্পষ্ট করে দেয় দৃষ্টিসীমানা। তারপর সব অন্ধকার।


0

অণুগল্প - রাখি পুরকায়স্থ

Posted in


অণুগল্প


কুয়াশার আয়না
রাখি পুরকায়স্থ



শীতের সকালে জুবিলি পার্কের নুড়ি বিছানো পথ ধরে হাঁটা আমার কাছে এক অমোঘ আকর্ষণ। আজ জীবন প্রান্তে পৌঁছে, কুয়াশাচ্ছন্ন স্মৃতিপটে দীর্ঘ জীবনছবি যেন ক্রমশঃ আবছা হয়ে আসছে। তবুও রোজ সেসময় কুয়াশা ভেদ করে সামনে এসে দাঁড়ায় ছেঁড়া জামা পরা সাত-আট বছরের এক শ্যামলা বালক! আমার চোখের সামনে তখন ভেসে ওঠে সাদা কালো একগোছা জীবনছবি। শিয়ালদহ রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে খালি পায়ে ইতস্ততঃ হেঁটে বেড়ানো সেই ছেলে। জনৈক রেলযাত্রীর ফেলে দেওয়া এক টুকরো পাউরুটি কুঁড়িয়ে পেয়ে তার মলিন মুখে হঠাৎ আলোর ঝলক। আমি দেখি, খাবারের দোকানের সামনে এক পেট ক্ষুধা বয়ে বেড়ানো ছেলেটির হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকা, ক্ষুধার জ্বালায় ধূলার উপর তার কেঁদে ঘুমিয়ে পড়া, আর দেখি তার চোখের পাশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া শুকনো জলের দাগ। পুরানো গন্ধ মাখা ছবিগুলি আমার চোখের সামনে পর পর এসে ধরা দেয়। যেন বহুযুগ ধরে হৃদয়ের নিভৃত কোণে যত্নে রাখা একটি ছবির বইয়ের ধূলি ধুসর পাতাগুলি আমি রোজ উল্টেপাল্টে দেখি। ছেলেটি আমাকে স্মৃতির ওপার থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সে আর আমি পরস্পরকে দেখি। মাঝে বয়ে যায় সত্তোরটি বছর।

সঞ্জিবনী আবাসনের দ্বিতলে সারাজীবনের সঞ্চয়ে কেনা দু’কামরার ফ্ল্যাট থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে আমার বড় কষ্ট। তবুও রোজ প্রাতঃভ্রমণে আসি। যুগান্তপারের স্মৃতি ভেসে ওঠে মানসচিত্রপটে। সেই তীব্র টানে শীতের কুয়াশার চাদরে মুড়ে বিজনে ‘নিজের’ সঙ্গে দেখা করি।

0

অণুগল্প - ঝুমা সমাদ্দার

Posted in





অণুগল্প


অন্তরমহল
ঝুমা সমাদ্দার





"শ্ শ্ শ্, চুপ চুপ" – মা বলেছিল। "ও কথা বলতে নেই। কারুক্কে বলবি না কোনওদিন। আমরা তোকে ভালোবাসি না?” - মা আমাকে ভালোবাসে। বাবাও। জন্মদিনে বাবা আমাকে এত্তবড় টেডিবেয়ারটা এনে দিয়েছিল।

“কিন্তু, মা, বাবা আমাকে… আমার খারাপ লাগে মা, ব্যাথা লাগে, রক্ত... আমি মুছে নিয়েছি টেপফ্রক'টা দিয়ে, দেখ তুমি।"

“আমি মানা করে দেব, মা। বাবা আর অমনি করবে না। বাবা তোমাকে ভালোবাসে, মা। ও কথা বলতে নেই। বোলো না কাউকে, কেমন?”

“কাউকে না? লালি'কে-ও না? তুমি তো আগের বারেও বলেছিলে বাবা'কে মানা করবে, কই বাবা শোনে নি তো তোমার কথা?”

“না, কাউকে না। বলে না, মা। এ সব কথা বলতে নেই।"

এ সব কথা বলতে নেই। মা ঘরে না থাকলে বাবার কাছে যেতে নেই। বাবা'কে দেখলেই যে আমার বমি পায়, বলতে নেই। মুখটা তেতো জলে ভরে যায়, গিলে নিতে হয়। বলতে নেই।

দাদু'র যেদিন খুব শরীর খারাপ করলো, মা মামার বাড়ি গেলো। আমার পরদিন পরীক্ষা বলে আমাকে নিয়ে গেল না, সেই রাতে সারারাত নিজেকে বাথরুমে বন্ধ করে রেখে দিয়েছি। হি হি! কেমন জব্দ!

"মামনি, অমনি করে না, মা, ভারী অবাধ্য হয়েছ তুমি, ঠাণ্ডা লাগবে, এস, বেরিয়ে এস।" বাবা ডেকেছে কতবার। দরজার ফাঁক দিয়ে জল ছুঁড়ে দিয়েছি বাবার গা'য়ে।

সকালে মা ফিরে এসে দেখে আমি বাথরুমের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমোচ্ছি। মা এসে ডাকতেই দরজা খুলে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। ধূম জ্বর আমার। ডাক্তার আঙ্কেল এসে কতবার জিজ্ঞেস করল, কেন এমন করেছি আমি। বলিনি আামি। শ্ শ্ শ্, বলতে নেই।



না, এখনও বলিনি আমি। শ্ শ্ শ্, বলতে নেই।

“হাঃ হাঃ, তুমি কি গো! এ সব কথা কি বলতে আছে, নাকি? ঘরের কথা... দাদা সেই কবে থেকে একলা, বলো দেখি? বৌদি মারা গেছে আজ পঁচিশ বছর হয়ে গেল। সেই থেকেই তো একলা। কম কষ্ট পেয়েছে? এখন তোমাকে ঘরের মধ্যে দেখে একটু এদিক ওদিক… হতেই তো পারে…। পারে না? বলো? আর তা ছাড়া, আমি তো তোমাকে ভালোবাসি গো! দাদাও ভালই বাসেন তোমাকে। ও সব কথা বলতে নেই, ছিঃ! এক্কেবারে পাগলী বউ'টা আমার।" - নাকটা টিপে দিয়ে অফিসে চলে গেলেন। ফেরার সময় হাতে দামী লেডিস পারফিউম। কি সুন্দর গন্ধ! আমার বমি পায়।

সব্বাই আমাকে ভালোবাসে। এত ভালোবাসে কেন সবাই আমাকে?

ছিঃ, সবেতেই সন্দেহ আমার। সব ঘরের কথা, বলতে নেই, বাইরে বলতে নেই।

“বউমা …একবার শুনে যাও তো এদিকে, পা'টা বড় যন্তন্না হচ্ছে, একটু টিপে দাও তো মা। আর একটু উপরে, না, উঁহু, আরও একটু উপরে।"

পার্কে ঘুরতে গিয়ে ফেরার সময় বৌমা'র জন্য চিকেন কাটলেট। বমি পায় আমার।

“সত্যি, কপাল করে শ্বশুরবাড়ি পেয়েছিস। না শ্বশুর-শাশুড়ি, না ননদ-জা। ভাসুর এত ভালবাসেন তোকে, একেবারে নিজের মেয়ের মত।"

সত্যি, মেয়ের মতো। কেন যে? শরীর'টা যদি আমার না থাকত!

শ্ শ্ শ্, বলতে নেই।
3

অণুগল্প - অনুষ্টুপ শেঠ

Posted in


অণুগল্প


নেশা
অনুষ্টুপ শেঠ

কাপে চুমুক দিয়ে ‘উফ্‌ফ্‌’ করে উঠল সানাই। বাণীমাসি আবার চিনি দিতে ভুলেছে। অর্দ্ধেক দিনই ভুলে যায়, বয়েস হচ্ছে বটে! সামনে রাখা বইপত্তরের ডাঁই ঠেলে আবার খাট থেকে নামতেও ইচ্ছে করছে না। ধুৎ! ভারি তো চা! না খেলেই বা কি!

জ্বলজ্বলে চোখে ব্যাপারটা বিভু লক্ষ্য করল। লক্ষ্য করল তার অভ্যস্ত প্রিয় জায়গা, বইয়ের আলমারির পাশের খাঁজে গুটিসুটি বসে থেকে। সানাইয়ের বন্ধু মিতালি এটা দেখলেই বলে ‘ধ্যানস্থ বিভু’। ভুল বলে না। ল্যাজের ডগাটুকুও নড়ে না বিভুর। এমনকি ঘাড়ও ঘোরায় না, খালি সবুজ চোখ দুটো ঘুরিয়ে ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত মেপে যায়।

সানাইয়ের কলেজ ছুটি আজ। কিন্তু বাড়িতে বলেনি সেটা, বন্ধুরা মিলে সিনেমা যাবার প্ল্যান আছে। আজ মার কি যেন তুতো দিদির নতুন ফ্ল্যাটে গৃহপ্রবেশের নেমন্তন্ন আছে দুপুরে। কলেজ ছুটি জানতে পারলেই মা ধরে বেঁধে নিয়ে যাবে। সুতরাং ঠিক পৌনে দশটায় রোজকার মতো হালকা সেজে সানাই বেরিয়ে পড়ে - ইশ্ আজ টুটুল আসতে পারে, অথচ বেশি মাঞ্জাও দেওয়া যাবে না। কলেজে বেশি সাজ দেখলেই ভদ্রমহিলা উকিলে জেরা শুরু করবেন। যাকগে, জিনস টি শার্টে ওকে ভালই মানায়।

সানাইয়ের মা দুপুরে পরার শাড়ি বাছতে বাছতে একটা ছোট্ট শান্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মেয়ে যে আবার এমন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে ভাবতেই পারতেন না তখন - ঐ গত বছরের কাণ্ডটার পর। এযুগের ছেলেমেয়ে হয়েও যে এরা এত অবিবেচক ইমোশনাল - কে জানত! না হয় তাঁরা নিম্নবিত্ত ফ্যামিলির অপুষ্টিতে ভোগা কৌশিক নামের ছেলেটিকে নিয়ে আপত্তিই করেছিলেন, না হয় খুবই রাগারাগি করেছিলেন, তা বলে দুজনে মিলে ট্রেনলাইনে ঝাঁপ দিতে যাবে? কি ভাগ্যিস মেয়ের শেষ মুহূর্তে নার্ভ ফেল করেছিল! ছেলেটা গোঁয়ার ছিল, ফিরেও দেখেনি, থামেওনি।

তারপর কি যে আতঙ্কে কাটিয়েছেন, স্তব্ধ পাথর মেয়েকে বুকে জড়িয়ে। কি ভাগ্যিস ঐ বন্ধুদের দলটা ছিল। আর কি ভাগ্যিস মিতালি কোত্থেকে বিভুকে নিয়ে এল এক সপ্তাহের মাথায়। বিভু প্রথমদিন থেকেই সানাইয়ের ন্যাওটা হয়ে গেছিল। গাবলুগুবলু বাদামি বেড়ালটাকে মিতালি সানাইয়ের কোলে ফেলে দিতেই সে যা মুগ্ধ চোখে সানাইয়ের দিকে চেয়ে ছিল, ভাবলে এখনও হাসি পায় আরতিদেবীর। বহুদিন পর সানাইও হেসে ফেলেছিল। না, সত্যি, বন্ধুগুলো আর বেড়ালটা মিলে ভোল পালটে দিয়েছে মেয়ের। 
আগের মত সহজ, চঞ্চল, হাসিখুশি হয়ে উঠেছে আবার।

আগের চেয়েও বেশি, আজকাল মনে হয়! তবে সে হয়তো ঐ নতুন ছেলেটি, টুটুল না কি নাম, আসার পর থেকে। মুচকি হাসেন আরতিদেবী, মার চোখ বলে কথা, নিজের মেয়েকে চিনবেন না!

সুর তুলে দশটা বাজল বসার ঘরের ঘড়িতে। আরতিদেবী স্নান করতে ঢুকলেন।

বিভু উঠে দাঁড়াল। পড়ে থাকা চায়ের কাপের দিকে গুটিগুটি পায় এগোল। 

মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিল, প্রায় পুরোটাই পড়ে আছে আজ। কাপের ওপর বিভুর সবুজ চোখ দুটো স্থির হলো। কাপের মধ্যে সে চোখের ছায়ার মধ্যে আঁকিবুকি কেটে ভেসে ওঠে সানাইয়ের চোখজোড়া, আর্ত, আতঙ্কিত, সানাইয়ের গলায় সেই ছায়া বলে ওঠে, “ছেড়ে দে কৌশিক... ছেড়ে দে... খুব কষ্ট... আমায় রেহাই দে এবার প্লিজ”।

সিনেমাহলের অন্ধকারে, সানাইয়ের বন্ধুরা টেরও পায় না হঠাৎ কয়েক সেকেন্ডের জন্য সানাইয়ের শরীরটা কেমন স্থির পাথর হয়ে যায়, দেখতে পায় না বন্ধ চোখের আড়ালে মণির অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটাও।

“বেড়ালটার কি যে নেশা হইচে, রোজ খুকির চায়ের তলানিটা চেটেপুটে খাবে! আমি রোজ এই বেড়ালের এঁটো মাজব নাকি!” গজগজ করে বাণীমাসি কাপটা নিয়ে যেতে যেতে।

বিভু নিজের প্রিয় জায়গায় ফিরে গেছে ততক্ষণে।


0

অণুগল্প - সঞ্চয়িতা বিশ্বাস

Posted in


অণুগল্প


গুটিপোকা
সঞ্চয়িতা বিশ্বাস


টিউশন থেকে ফিরছিল পলক। পিছন থেকে অনির্বাণের ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালো। অনির্বাণ তার সাথে রাজা স্যারের কাছে সায়েন্স গ্রুপ পড়ে। মুখচোরা মেধাবী ছাত্র। পলকের হাতে একটা চিরকুট গুঁজে দিয়েই "এটা একটু দেখিস" বলে সাইকেলের বেগ বাড়িয়ে দেয় সে। পলক একটু অবাক হয়। তার সাথে প্রয়োজন ছাড়া টিউশনির কেউই খুব একটা কথা বলে না। ঘরের কোণে প্রায় ছায়ার মতোই বসে থাকে সে। স্যার সরাসরি তাকে প্রশ্ন করলেই শুধু তার উপস্থিতি বোঝা যায়। পলক চিরকুটটা খোলে। সাদা কাগজে গোটা গোটা হরফে অনির্বাণের হস্তাক্ষর, "আমার বন্ধু হবি…সারাজীবনের জন্যে?" পলক হেসে ফেললো।

অনিরুদ্ধের সাথে ডিভোর্সের পর পলককে নিয়ে সোদপুরের ফ্ল্যাট ছেড়ে মায়ের কাছে চলে আসে অহনা। মায়ের কাছে মেয়েকে রেখে ডেলি প্যাসেঞ্জারী করে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে। পলককে ভর্তি করিয়ে দেয় স্থানীয় মেয়েদের স্কুলে। দুই বেণী ঝুলিয়ে চতুর্দশী পলক স্কুলে যায়। পড়াশুনোয় সে বেশ ভালো…আচার ব্যবহারও মার্জিত। কিন্তু তবু তার বন্ধু জোটে না স্কুলে বা পাড়ায়। কারণ তার মা ডিভোর্সী।

তার সহপাঠীদের অনেকেই, এমনকি তাদের কারও কারও মা-ও, খুব সমবেদনা জানাতে এসেছিল পলককে। তাদের আসল আগ্রহ ছিল তার বাবা আর মায়ের সম্পর্কে। পলক বয়সে ছোট হলেও এই অযাচিত কৌতুহলের নির্লজ্জতা বুঝতে বেশী সময় তার লাগেনি। যথাসম্ভব ভদ্রভাবেই সে গুটিয়ে নেয় নিজেকে সকলের থেকে। তার দুনিয়াটা মা আর দিদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে নেয়।

পলক আগে কখনও অনির্বাণকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করেনি…পরেও করবে কি না জানে না। চিরকুটটা ব্যাগে পুরে সে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। আহা রে, ছেলেটা জানে না পলকের মনটা সেইদিন থেকে মরে গেছে, যেদিন স্কুল থেকে ফিরে নিজের ভাগের চাবিটা দিয়ে দরজা খুলে বাবাকে দেখেছিল…বাবা-মায়ের বিছানায়…উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের ইস্টিদিদির সাথে। বছর কুড়ির সুন্দরী ইস্টিদিদির শরীরী ভাষা তার কাছে সাপের মতো লেগেছিল…বাবাকে রাক্ষসের মতো…। 

ওরা তার উপস্থিতি টের পায়নি। পলকও কাউকে বলেনি, সে রাতে কেন তার ধুম জ্বর এসেছিল। …মা এই সম্পর্কের কথা অনেক পরে জেনেছিল। চিৎকার চেঁচামেচি না করে মা স্বেচ্ছায় তার দাবী ছেড়ে দিয়েছিল, যেদিন ইস্টিদিদির প্রেগন্যান্সীর কথা তার কানে আসে। পলক কাউকে কিছু কোনওদিন জিগ্যেস করেনি। মাকে সে আহত করতে চায়নি। আর সেদিনের পর থেকে বাবার সাথে সে দূরত্ব তৈরী করেছে নিজে নিজেই।…

…শুধু চলে আসার আগের দিন মাঝরাতে সাদা তেলের বোতলটা ইস্টিদিদিদের দরজার সামনে খালি করে এসেছিল। …সকালের কাগজটা ইস্টিদিদিই তোলে কি না। 

…জিনিসপত্র, মা আর পলককে নিয়ে ম্যাটাডোর যখন রাস্তার বাঁক অবধি চলে এসেছে, তখন সে অ্যাম্বুলেন্সটাকে তাদের ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে থামতে দেখেছিল...


0

অণুগল্প - মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর

Posted in










ছবি - ত্বিষাম


অণুগল্প


স্ত্রৈণ 
মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর 



হারমোনিয়ামটা পেল্লায় সাইজ। সাবেকী আমলের। জার্মান রিডের। কালের প্রহারে শরীরে ছোপ ছোপ দাগ পড়ে গেলেও এর বনেদী চেহারায় এখনও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। 

বংশলতিকা বেয়ে বেয়ে হারমোনিয়ামটার জিম্মাদার এখন আমি। এর মূল মালকিন ছিলেন আমার প্রপিতামহী অন্তরা চৌধুরী। তিনি ছিলেন বেথুনের গ্র্যাজুয়েট এবং সংস্কৃতিমনা। তখন ব্রিটিশ আমল। ঢাকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার বেশ নাম। শুনেছি আমার জমিদার প্রপিতামহ খান বাহাদুর ঈসমাইল হোসেন তার রূপে-গুণে ফিদা হয়ে যান। এবং সামাজিক প্রতিপত্তির প্রভাব খাটিয়েই হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া মেয়েটিকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তোলেন। বিয়েতে শাড়ি, গহনা এবং অন্যান্য সওগাতের সাথে বিলেতে স্পেশাল অর্ডারে তৈরী এই হারমোনিয়ামটাও ছিলো। 

আমার পিতামহের কাছে শোনা টুকরো টুকরো গল্প বিশ্লেষণ করে আমি অনুমান করি, খান বাহাদুর ঈসমাইল হোসেন চৌধুরী অসম্ভব ভালবাসতেন স্ত্রী অন্তরা খানকে। বিয়ের পর তিনি ঘরকুণো হয়ে পড়েন এবং অন্তরা চৌধুরীর গানে বুঁদ হয়ে থাকতেন সারাটা দিন। নিশ্চয়ই অন্তরা চৌধুরী তার একমাত্র শ্রোতাকে প্রগাঢ় ভালোবেসেই গান শোনাতেন এবং সেই সাথে চলতো এই হারমোনিয়ামের রিডগুলোতে তার ললিত আঙ্গুলের পরশ। অবশ্য বিষয়টিকে নেতিবাচক বিশ্লেষণও দেওয়া যায়। বিয়ের পরপরই খান বাহাদুর সম্পূর্ণ স্ত্রৈণ হয়ে পড়েন এবং সেই সাথে শুরু হয় জমিদারীকর্মে তার চরম অবহেলা। ঠাকুর্দার মুখেই শুনেছি বিয়ের পর থেকেই খান বাহাদুররে জীবিকা হয়ে পড়ে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে জমি বিক্রি করা। আমার ঠাকুর্দা হাশেম চৌধুরী যথেষ্ঠ বৈষয়িক হলেও তার পক্ষে জমিদারী উদ্ধার করা আর সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া ইতোমধ্যে ভারত ভাগ হয়ে গেছে এবং পূর্বপাকিস্তানে জমিদারী প্রথা বিলোপও হয়ে গেছে। 

সঙ্গীতে আমার অনুরাগ দেখেই একদিন ঠাকুর্দা বললেন, 'কবীর, মায়ের হারমোনিয়ামটা তো অনেকদিন আগলে রাখলাম। আমি তো গানের গ-ও বুঝি না। আমাদের বংশে শুধু তুই-ই মায়ের গুণটি পেয়েছিস। নিয়ে নে তুই, আর কেউ তো এর মর্যাদা বুঝবে না।' খুশীতে ডগোমগো হয়ে সাথে সাথেই নকশীকাটা বাক্স থেকে বের করে বাজাতে শুরু করি। স্কেলিং পুরোপুরি নষ্ট। নিয়ে গেলাম ঢাকার সেরা হারমোনিয়ামের কারিগর ‘যাদব এন্ড যাদব’ কম্পানির অতুলবাবুর কাছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করলেন তিনি। শেষটায় হতাশ হয়ে বললেন, ‘এটা আর ঠিক হওয়ার নয়। এর আয়ু শেষ হয়ে গেছে। অ্যান্টিক হিসেবে ইচ্ছে করলে রেখে দিতে পারেন’। সেই থেকেই হারমোনিয়ামটি ড্রয়িং রুমে শোভা পাচ্ছিলো। 

ঠাকুর্দা গত হয়েছেন অনেক বছর। বাবা-মাও গত। এক সপ্তাহ হলো বিয়ে করেছি। মৌসুমীও গান গায়। ফুলশয্যার পরের রাতে ড্রয়িং রুমে রাখা হারমোনিয়ামের বাক্সটি ওর চোখে পড়ে। ডালা খুলে বের করে হারমোনিয়ামটি নিয়ে এল বেডরুমে। আমি বললাম, ‘মিছেমিছি টেনে নিয়ে এলে, এটার স্কেলিং তো ঠিক নেই। এর আয়ু শেষ। ঠিক আছে তোমাকে কালকে একটা হারমোনিয়াম কিনে দেবো’। ওর মুখে রহস্য হাসি। কিছুক্ষণ আঙ্গুল চালালো রিডগুলোতে। তারপর গাইতে শুরু করলো – 

তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ 
ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া 
বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক .. 

ওমা ওর সুরেলা কন্ঠের সাথে তাল রেখে হারমোনিয়াম তো ঠিকই বাজছে। কোথাও এতটুকু ছন্দপতন নেই! নিজেকে মনে হচ্ছে জমিদার খান বাহাদুর ঈসমাইল হোসেন চৌধুরী আর ও আমার প্রেয়সী স্ত্রী অন্তরা চৌধুরী। মুগ্ধ হয়ে শুনছি গান। আমারও স্ত্রৈণ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।


0

অণুগল্প - সুবর্ণা রায়

Posted in








অণুগল্প



এক অন্য সিন্ডারেলা 
সুবর্ণা রায়



চাপা গুনগুন, হাসি, মেটালিক আওয়াজ বাইরে থেকেই শুনতে পাচ্ছে দিশা। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই রাতের সশব্দ মৌতাত হুড়মুড়িয়ে গায়ে এসে পড়ল, সাথে জোরালো ফ্লোর লাইট, ডিজের ননস্টপ হিটস।

সাবিয়া হাত ধরে চাপা টান দিল, "চল!"

রোমি হাত নাড়ল পাঁচ জনের ছোটখাটো ভীড় থেকে। দিশার কপালে হাল্কা ঘাম। সাবিয়া এগিয়ে যাচ্ছে। দিশা পিছিয়ে পড়ছে।

প্রায় সবাই নতুন মুখ। তিন বছর থাকার পরেও কলেজের দেওয়াল, ঘর, করিডোর যত আপন হয়েছে, ছেলেমেয়েগুলো নয়। দিশা হোস্টেলেও ঘর সাজিয়েছে একাকীত্ব দিয়ে। মনের কোথাও একটা পাহাড় জমে উঠেছিল কোন ছোটবেলা থেকে, সেটা ডিঙিয়ে যাবার কথা ভাবেও নি কখনও। 

পাতলা কাঁচের গ্লাসটার গোল বৃত্ততে আঙ্গুল চালাচ্ছে ঋষি। ওয়াইনের মখমলী রঙটা আবেশ ধরাচ্ছে চোখে। একটা ঘোর সারা শরীরে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বুদবুদের মতো। একটা ভালোলাগার পালতোলা নৌকা নীলজলে ভেসে যাচ্ছে একভাবে, যাকে বলে স্মুদ সেইলিং। ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে গেল ঋষির। দিশা, সাবিয়া, রোমি এগিয়ে আসছে এদিকেই।

লম্বা ফ্লোয়িং ড্রেসটা সাবিয়ার, দিশা কিছুতেই পড়তে চাইছিল না, জোর করে পড়িয়ে ছেড়েছে। এসব পড়ার অভ্যাস নেই। অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে দিশা। আবার ঋষির চোখের চাহনি পড়ে লজ্জাও লাগছে খুব। কোনও ছেলের চোখে নিজেকে মোহময়ী দেখার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। এই প্রথম দিশার ভিতরে একটা ভালোলাগা তোলপাড় হচ্ছে। সাবিয়ার কাঁধটা ধরে নিজেকে আড়াল করল একটু দিশা। 

চুরি করে একটু দেখতে গিয়ে ঋষির সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল দিশার। কান গরম হয়ে গেল সাথে সাথে। সাবিয়া আর রোমি বকেই যাচ্ছে এর ওর সাথে। দিশার কানে যাচ্ছে না কিছুই।

গত সপ্তাহে আবিষ্কার করেছে যেন ঋষি, দিশাকে। এতদিন কলেজে থেকে চোখে পড়ে নি। একদিন শেষ বিকেলের নরম আলোয় লেকের ধারে কাঠের বেঞ্চে একা দেখেছিল উদাস দিশাকে। কোলে একটা বই নিয়ে গালে হাত দিয়ে দূরে তাকিয়েছিল। কি যেন একটা হয়ে গিয়েছিল মনের মধ্যে ঋষির সেদিন। মনে হয়েছিল, এইই সেই মেয়ে। তারপর থেকে কথা বলার চেষ্টা করেছে কয়েকবার। পারে নি। শুধু চোখাচোখি হয়েছে অনেকবার। মেয়েরা বুঝে যায় চট করে। দিশাও পড়তে পেরেছে নিশ্চয়ই তার চোখের কথা।

ফ্লোরের লাইটস ডিম হয়ে গেছে, ডিজে এখন স্লো রোম্যান্টিক নাম্বারস শুরু করেছে। একে একে হাত ধরাধরি করে জোড়ায় জোড়ায় নাচের জায়গায় তাল মেলাতে শুরু করেছে ছেলেমেয়েরা। দিশা হটাৎই টের পেল, সে একা। সাবিয়া আর রোমি নেই আশেপাশে কোথাও। আর যে ভয়টা পাচ্ছিল, তাইই হল। ঋষি এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বলল, মে আই?

না, নাচতে পারবে না দিশা, কিছুতেই না। কিন্তু ঋষিকে না বলার ক্ষমতা তার নেই। ভীষণভাবে চাইছে তার সারা শরীর ঋষির সাথে তালে তাল মিলিয়ে ভাসিয়ে দিতে নিজেকে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাঁহাতটা বাড়িয়ে দিল দিশা। 

নিস্পলক চাহনিতে চোখে চোখ রেখে কত কথা, আকুতি বিনিময় হচ্ছে ঝরণার মতো। যেন কোনও বিরাম নেই এর। এভাবেই ঘন হয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় এক শতাব্দী। ভয়টা কোন ফাঁকে পালিয়ে গেছে দিশার খেয়াল নেই।

খুব ধীরে দিশার বাঁহাতে নিজের আঙ্গুল জড়ালো ঋষি। তারপর কোমর জড়িয়ে টেনে নিল আরও কাছে। এত কাছে যাতে নিঃশ্বাসের শব্দ, হৃদয়ের শব্দ - সব শোনা যায় পরিষ্কার। সময় থেমেছিল অনেকক্ষণ। আসলে মুচকি হেসে আঘাতের জন্য ঠিক সময়ের অপেক্ষা করছিল মহাকাল। 

দিশার ডান হাতটা একসময় ধরল ঋষি। বাঁহাতটা ছিল নরম পেলব, অথচ ডান হাতটা এরকম শক্ত কেন? ঋষি অল্প আলোতে হাতটা সামনে তুলে দেখতে যাচ্ছিল, দিশা যেন হুঁশ ফিরে পেল, ফিরে পেল নিজেকে। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে গেল দরজার দিকে। 

হতভম্ব ঋষির হাতে ধরা রয়ে গেল কিছু একটা। দরজা থেকে চোখ ফিরিয়ে হাতের দিকে দেখতেই শিউরে উঠল ঋষি। একটা প্রস্থেটিক হাত, কবজি অবধি। আতঙ্কে একটা চিৎকার বেরোল ঋষির মুখ দিয়ে, গোঙানির মতো শব্দে।

বাইরে অন্ধকারে নিজের হাতে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল তখন দিশা, আর ফিরে ফিরে দেখছিল শূন্য দরজার দিকে।



3

অণুগল্প - সুবর্ণা রায়

Posted in


অণুগল্প


একলাবেলা
সুবর্ণা রায়



- বড় হয়ে কি হবি রে টিপু?

- চশমা।

গেমটিচার অত হাসছিল কেন টিপু বুঝতে পারল না! ঠাম্মা মাঝেমাঝেই চশমা খুলে চোখ মোছে। তার মানে তো ভালো দেখতে পাচ্ছে না। চশমা হলে সবার কত সুবিধা হবে। ঠাম্মার। বাবার। এসব আর কাকে বোঝাবে টিপু! মাঝেমাঝে তো মা'র শাড়ির আঁচল হতে ইচ্ছে করে, যে আঁচলটা বারবার চোখ মুছলেও শুকনো থাকবে। লুকিয়ে লুকিয়ে মা যতই কাঁদুক, টিপু ঠিক বুঝতে পারে, কাউকে বুঝতে দেয় না।

স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলেই একছুটে বাগানে। এক বিকেল আলো নিয়ে ঝাঁকড়া পেয়ারা গাছটা তখন গর্বভরে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল। সবাই লোভীচোখে তাকাত কি না! 

একটা ঢিল নিয়ে উপরের একটা জোড়া পেয়ারায় সবে তাক করেছিল টিপু, সড়সড় করে গাছ বেয়ে নেমে এলো বাদামী কাঠবিড়ালিটা। গোড়ার কাছে এসে একটু থমকে টিপুকে দেখল, তারপর ফোলা লেজটা দুবার নাড়িয়ে একটা ডিগবাজি খেয়ে লালঅশোকের ঝোপে ঢুকে গেল। 

ঢিলটা হাতে নিয়ে স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছিল টিপু কয়েক মুহূর্তের জন্য। দুদিন আগে স্কুল থেকে ফেরার সময়, মিত্রজেঠুদের বাড়ির সামনে এই কাঠবিড়ালিটাই ঝিম মেরে আধশোয়া হয়ে পড়েছিল। রাস্তায় লোক ছিল না বিশেষ। গরমে জেরবার হয়ে সবাই ছায়ায় ছিল হয়ত। টিপু এদিক ওদিক দেখে ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বার করল। একটু জল দিলে হয়ত চাঙ্গা হয়ে যাবে। কিন্তু বোতল তো খালি! কি করে এখন? দু'পা গেলেই মোড়ের মাথায় মিষ্টির দোকান। টিপু দৌড়ল সেইদিকে। 

বোতলে অল্প জল, ঢাকনাটা বাঁহাতে, টিপু কাছে এগোতেই, কাঠবিড়ালিটা তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে লেজ ফুলিয়ে দে দৌড়! মিত্রজেঠুদের কাঁঠালগাছে উঠে টিপুর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ঘন পাতার ভিতরে হারিয়ে গেল।

ঠিক চিনেছে টিপু, মাথার পিছনে সেই আড়াআড়ি লম্বা দাগ! যেন গভীর ক্ষত সেলাই করা। 

গুনগুন করে একটা মৌমাছি চলে গেল কানের পাশ দিয়ে। হালকা হাওয়ায় একটা পাঁচমিশালি গন্ধ। ঘাসফুল দু-চারটে উঁকি মারছিল এপাশ ওপাশ থেকে। মৌমাছিটা সাদা-হলুদ লক্ষ্য করে উড়ে গেল ওইদিকেই। পেয়ারাগাছের একটা শুকনো ডাল পড়েছিল লেবুগাছের পাশটায়। কুড়িয়ে নিয়ে ডাল ভেঙে লম্বা লাঠির মতো বানাল টিপু। মা এখনও বই পড়ছে নির্ঘাৎ! উঠলে ডাকাডাকি শুরু করে দিত।

লাল অশোকের ঝোপটার সামনে সন্তর্পণে বসল টিপু। একটুও আওয়াজ করা চলবে না। ঝোপটার ভিতর অন্ধকার। ঘন সবুজ পাতা আর মাকড়সার জালে কিচ্ছুটি দেখা যায় না। হাতের লাঠিমতন ডালটা শক্ত করে ধরে গুটি গুটি দু'পা বসে বসেই এগোল টিপু। 

মা'র সাধের ক্রিসেনথেমামের টবগুলোর মাটি, এক সকালে, লণ্ডভণ্ড হয়েছিল ছাদে। মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল মা অনেকক্ষণ। তারপর, বাবার অফিসের ব্যাগটা! সামনের পকেটটা কেটে কুটিকুটি করে ফেলেছিল। সবাই ভাবল ইঁদুরের কাজ। কিন্তু টিপু এখন বুঝতে পারছে, এটা কার কাজ। অত পছন্দের ডোরেমনের বিছানার চাদরটা মেলতে গিয়ে দেখা গেল অনেক জায়গায় ছেঁড়া। মা বলেছিল, পুরনো হয়ে গেছে। কিন্তু টিপু এখন জানে ওটা কার কাজ ছিল। বাবার কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে। দুবছর আগে যেদিন খুব বৃষ্টি পড়ছিল, ঠাণ্ডায় গায়ে চাদর দিতে হয়েছিল, বাবা অনেক রাতে বাড়ি এসে জুতো রাখার জায়গাতেই বসে পড়েছিল। মাথা চাপড়ে বলেছিল, শেষ অবধি জ্বালিয়ে গেল! বাবার চোখে বৃষ্টির জল ছিল। কিন্তু মা আর ঠাম্মা অনেক কেঁদেছিল। পরের দিন সবাই হাসপাতালে গিয়েছিল, টিপুকে বাড়িতে রেখে। মা বলেছিল পরে, হারিয়ে গেছে! সব্বাইকে জ্বালিয়ে হারিয়ে যাওয়া! টিপু লাঠিটা দিয়ে খুঁচিয়ে আজ মজা দেখাবে। দরকার হলে মারবেও।

কাঠবিড়ালিটাই যে দীপু, টিপুর তাতে কোনও সন্দেহ নেই।


0

অণুগল্প - সঞ্চয়িতা বিশ্বাস

Posted in


অণুগল্প


আংটি
সঞ্চয়িতা বিশ্বাস



"ফুলশয্যার রাতে সায়ন আংটিটা পরিয়ে দিয়েছিল মিতুলকে। পাশাপাশি সাতটা ছোট্ট ছোট্ট হীরে বসানো আংটিটায়। প্রতিটা পাথর তাদের প্রতি জন্মের দ্বৈতজীবনের প্রতীক…এভাবেই মনে মনে ব্যাখ্যা করেছিল মিতুল। গা ভরা ভারী ভারী গয়নার থেকে ঐ আংটিটাই সবচেয়ে ভালো লেগেছিল তার। আংটিটা সায়নের মতো…সহজ, কিন্তু সুন্দর। চাঁপাফুলের সুবাস মৌতাত ছড়িয়েছে প্রদীপের আলো-আঁধারিমাখা ঘরে। জানালায় নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে যুবতী চাঁদ। বৈশাখী পূর্ণিমা আজ। মিতুল হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে আংটিটা। সায়নের কেমন নেশা লেগে যায় অপার্থিব এই পরিবেশে। মিতুলের চোখে চোখ রেখে অষ্পষ্ট হাসে সে...

সংসারের কাজের ফাঁকে, ভীড় বাসে ঝুলে ঝুলে অফিস যাবার সময়, স্নানের ঘরে, খুন্তি নাড়তে নাড়তেও আংটিটা দেখে মিতুল। আংটিটার প্রতি মুগ্ধতা কাটেনি তার। মাঝে মাঝে সায়নের কাছে ধরাও পড়ে যায় সে। সায়ন মজা পায় মিতুলের এই গোপন ছেলেমানুষী খেলায়।…"

---এই অবধি লিখে কলমটা নামালো দিঠি। নাঃ, হচ্ছে না। লেখাটা হচ্ছেই না। অস্থির অস্থির লাগে তার। এই গল্পটা লিখতেই হবে তাকে। চশমা খুলে চোখ কচলায়... হাই তোলে…আড়মোড়া ভাঙে। কাগজের দিকে তাকিয়ে আঙুল মটকাতে শুরু করে। ডানহাতের তর্জনী বামহাতের অনামিকায় এসে থমকে দাঁড়ায়। ছোট ছোট সাতটা হীরে পাশাপাশি বসে আছে সোনার পাতের উপর। বিয়ের রাতে অর্চি পরিয়ে দিয়েছিল।…হাসি পায় দিঠির। তার আর অর্চির প্রেমপর্বটা যত সুন্দর ছিল, বিয়েটা অত সুন্দর হলো না। কেমন যেন অহেতুক পাশাপাশি বাস করা। বর হিসেবে অর্চির যতটা দায়িত্ববান হওয়া উচিত ছিল, তার সিকিভাগও সে নয়। সেজন্যই বোধহয় বৌ হিসেবে যতটা তার নির্ভরশীল হওয়া উচিত অর্চির উপর, তাও দিঠি হতে পারলো না। একটা সূক্ষ্ম শীতল তিক্ততা জমে আছে তাদের সম্পর্কে…মাছের বাজারের চিরন্তন আঁশটে গন্ধের মতো।"…

---পৃষ্ঠার কোণটা মুড়ে বইটা বালিশের পাশে রাখলো পাপড়ি। কৃশানু বড় আলোটা নিভিয়ে মশারীর ভেতর এসেছে। পাপড়ির আঙুলে আঙুল জড়াতে জড়াতে চাপা গলায় বললো, "বিয়ের আংটিটা অনেকদিন দেখি না। পরো না বুঝি?" পাপড়ি অন্ধকারে হেসে ফেলে নিঃশব্দে। কৃশানুর এখন উত্তর চাই না। কোনওদিনই পাপড়ির কোনও উত্তর তার দরকার নেই…যেমন দরকার নেই পাপড়ির ভালমন্দ-সুবিধা-অসুবিধা জানবার। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বোজে পাপড়ি। যেদিন সে কৃশানুর উদাসীনতা প্রথমবার টের পেয়েছে, বিয়ের আংটিটা সেদিনই খুলে রেখেছে… ঠিক যেমনি কৃশানু এখন তার পোষাকটা খুলছে নির্মমভাবে। …ঘুমের জন্যে অপেক্ষা করে পাপড়ি। ঘুমোতে পারলেই সেই ছেলেটা স্বপ্নে আসবে…। লম্বা লম্বা আঙুল ছেলেটার… একমাথা কোঁকড়া চুল। কেমন আলতো করে পাপড়ির হাতটা ধরে পরম মমতায় তাকায় তার দিকে… যেন পাপড়ির সমস্ত দায়িত্বভার তার। সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে পাপড়ির বাম অনামিকায় রোজ বিয়ের আংটিটা ধীরে ধীরে পরিয়ে দেয় সে। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে গাঢ়স্বরে ফিসফিস করে কি যেন বলে। সমুদ্রের গর্জনে কোনওদিন কথাটা শুনতে পায় না পাপড়ি।…



0

অণুগল্প - উৎসব দত্ত

Posted in


অণুগল্প


রিভুর ঘুড়ি 
উৎসব দত্ত



বিকেল হলেই লাটাই আর ঘুড়ি নিয়ে মাঠে ছুট।
শরতের নীল আকাশ। লাটাইটা দুহাতের আঙ্গুলের ফাঁকে রাখা।

আকাশের দিকে তাকালে সাদা তুলোর মতন মেঘের মাঝে হলুদ ঘুড়িটাকে ছোট থেকে আরও ছোট দেখাচ্ছে।

অন্যদিনের মতন আজ একটুও গোঁত্তা খাচ্ছেনা। ঠিক যেন মনে হচ্ছে, ওই নীল আকাশের দিকে জোর, আরও জোরে ছুটে চলেছে ঘুড়িটা।

সন্ধে হতে যায়। এবার বাড়ি ফেরার পালা। ঘুড়ি গোটাতে হবে।

রিভু ঘুড়ির সুতোটা কেটে দিয়ে বলল,
‘যা আমার মায়ের কাছে যা। মা ক্যামন আছে জেনে আয়’
0

অণুগল্প - অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়

Posted in


অণুগল্প


স্বপ্নের আবির্ভাব
অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়


"ডাউনে হাওড়া যাবার গাড়ী ৫ নম্বর প্লাটফর্মে আসছে।"
অ্যানাউন্স শুনে একটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে আবির্ভাব। এমনিও দেরী হয়ে গেছে, তার ওপর ট্রেনটাও লেট...

অপেক্ষমাণ যাত্রীরা নড়াচড়া শুরু করেছে, হকাররা যে যার পজিশান নিচ্ছে এমন সময় হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল লোকাল ট্রেন। ভীড় তেমন নেই যাই হোক...উঠে পড়ল আবির্ভাব। সিটও পেয়ে গেল। বসেই কানে হেডফোন...দুপুর দেড়টায় বাজছে..."এখন অনেক রাত"...হঠাৎ চোখ পড়ল দুটো রো পেরিয়ে তিননম্বর রো'র জানলার ধারে, ট্রেনের হাওয়ায় বেসামাল চুল সামলাচ্ছে মেয়েটা, থুতনীর ওপরে একটা তিল। অনন্যতমা...আবির্ভাব নাম দিয়ে ফেলল মেয়েটার। এই স্বভাবটা ছোটো থেকেই আছে ওর, পাড়ার এক কাকুকে নাম দিয়েছিল দুধের ক্যান, মোটা গলার সহপাঠিনীর নাম দিয়েছিল গরু, এমন কত কি!!

"আমার বৃদ্ধবুকে তোমার মাথা, চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায়", নেশাই বটে এত দূর থেকে অনন্যতমার চোখ দেখার চেষ্টা করছিল আবির্ভাব। দেখতে পেল কি না জানা নেই, তবে মেয়েটা বোধহয় বুঝল দূর থেকে কেউ মাপছে ওকে, মুখ তুলল সোজা আবির্ভাবের দিকে আবির্ভাবের ঠোঁটের কোণায় তখন হাসির আবির্ভাব।

এবার যা হল সেটা হল "এ বাদাম-চাল-ছোলা বাদাম!", "সবেই...দা সব...দা", "ভালো ভালো পেন গুলো লাগ্লে বলবেন", ইত্যাদি হকারের ভীড় এড়িয়ে ওরা দুজনেই একে ওপরকে দেখতে থাকল।

একের পর স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে...হাওড়া আর খুব দূরে নেই... আবির্ভাব ভুলে গেল ওর তাড়া আছে। মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল ট্রেনটা যেন লেট হয়, কিন্তু ঈশ্বর তো আর ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর নন যে, মানুষের জন্য প্রাণ কাঁদবে! অতএব যথাসময়ে আবির্ভাব, অনন্যতমা, আরও বাকি যাত্রীদের নিয়ে ট্রেন আবির্ভূত হল হাওড়া স্টেশনে।

একে একে সবাই নেমে যাচ্ছে, মেয়েটা কিন্তু এখনও দাঁড়িয়ে, আবির্ভাবের প্রত্যাশায় কী? জানা নেই... অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা নিজেদের যায়গায়... মেয়েটা এবার দরজার দিকে এগিয়ে গেল, ঘাড় ঘুরিয়ে একবার আবির্ভাবের দিকে দেখেই নেমে গেল, আস্তে আস্তে মিশে গেল জনতার স্রোতে...

শুধু মাত্র লেট করে বলেই আবির্ভাবদের জীবনে আবহমানকাল থেকেই অনন্যতমারা এসেও চলে যায়... আবির্ভাব হেঁটে যাচ্ছে জনতার ভীড়ের শেষ সারিতে... অনন্যতমা এগিয়ে গেছে... অনন্যতমারা এগিয়ে যায়, এভাবেই।


11

অণুগল্প - মিতিল চক্রবর্তী

Posted in


অণুগল্প



ফটিক
মিতিল চক্রবর্তী


-- ফটিক, অ্যাই ফটিক ...
-- হ্যাঁ, যাই বড়মা।

মাত্র সাত দিন হলো ফটিক চক্রবর্তী বাড়ির নতুন সদস্য। বাড়ির কর্তা সুরঞ্জনবাবু একটি স্কুলের শিক্ষক। এই স্কুলেই ফটিক ভর্তি হয়েছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। ওর বাবার এখন নতুন বৌ। আর ওর মা স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে একরত্তি ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে ঘরছাড়া। অভিমানে সুদূর আন্দামান থেকে পালিয়ে এসেছে ও। প্রথমে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়র বাড়িতে উঠলো । একটা নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলেই তিনি বলতেন – ফটিক আর পড়তে হবে না, ইলেকট্রিক বিল বাড়বে। ফটিক ওর কাছের মানুষ সুরঞ্জন স্যারকে একদিন বলে - স্যার সারা দিন অনেক কাজ করি। বাসন মাজা, বাজার করা, ঘর ঝাঁটপোছ। রাতটুকুই তো আমার পড়ার সময়।

সুরঞ্জন স্যারের বড় মায়া হয়। তিনি বলেন -তুই কাল থেকে আমাদের বাড়িতেই থাকবি। কোনও কাজ করতে হবে না। শুধু পড়াশোনা করবি। ফটিক অনেক কায়দা করে ঐ আত্মীয়র হাত থেকে ছাড়া পায়। মালপত্র গুছিয়ে চলে আসে সুরঞ্জন স্যারের বাড়ি। স্যারের দুই কন্যা দোলা আর পালকি। দুজনের সঙ্গেই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ফটিকের ভাব জমে যায়। দোলাকে দিদি আর পাল্কিকে বোন সম্বোধন করে। পালকি ওকে জিজ্ঞেস করে – কী করে আন্দামান থেকে পালিয়ে এলে? 

ফটিক শুরু করে তার গল্প। বলে- জাহাজে চড়ে পৌঁছলাম ভাইজ্যাগ। সেখান থেকে হাওড়ার ট্রেন ধরলাম বিনা টিকিটে। যখন টিকেট চেকার আমার দিকেই আসছে আমি ভ্যানিস। দেখি ট্রেনের টয়লেটের সামনে কেউ আমের বস্তা রেখে দিয়েছে। সেখান থেকে আম নিয়ে বাথরুমে গিয়ে মনের সুখে খেলাম। এখানে টিকেট চেকার বা আমের মালিক কারো হাতেই ধরা পড়ার ভয় নেই। এরপর হাওড়া স্টেশনে নেমে অজানা শহরে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের খোঁজ।

সুরঞ্জন স্যারের বাড়িতে একটা ছোটদের স্কুল আছে। স্যারের স্ত্রী ঐ স্কুলটি চালান। স্কুলবাড়ির দোতলার ঘরেই ফটিকের রাতের আস্তানা। বড়মা (সুরঞ্জন স্যারের স্ত্রী) ওকে খুবই স্নেহ করেন। ঐ ঘর থেকেই ফটিকের পড়া মুখস্থ করার স্বর ভেসে আসে। পিঠে স্কুলের ব্যাগ নিয়ে গ্রাম্য মেঠো গান গাইতে গাইতে ও রোজ স্কুলে যায়। 

একদিন ভোরের আলো ফুটতেই ফটিক বনগাঁয় এক আত্মীয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। একটা মস্ত বড় কাঁঠাল নিয়ে ফিরলো আর তার বীজ পুঁতে দিলো বাড়ির পেছন দিকে। বড়মা জিজ্ঞেস করলো – ট্রেনের টিকেট কেটেছিলি? ফটিকের সরল উত্তর – বড়মার মত সৎ হলে চার পাঁচ দিনের বেশি বাঁচা যাবে না। ফটিক হাতের কাজে খুব দড়। হঠাতই একদিন কয়েকটা তার দিয়ে হ্যাঙ্গার বানিয়ে ফেললো। নারকেল গাছের পাতা থেকে শলা তুলতে বসলো। বড়মা ভাবলো হয়তো ঝাঁটা বানাবে। কিন্তু ওগুলো দিয়ে বানালো বাহারি নক্সার কয়েকটি ঘুড়ি। একটা ঘুড়ির নাম দিল বৌ ঘুড়ি। সুরঞ্জন স্যার বললো – ফটিক তোর কোনদিন অভাব হবে না। বুদ্ধির জোরেই পেট চালাবি।

ফটিক সপ্তম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলো দ্বিতীয় স্থান লাভ করে। বাড়ির সবাই খুব খুশি। ফটিকের মুখ ভার। হয়তো মায়ের লাবণ্য মাখা মুখটা মনে পড়ছে। পরের দিন সকালে বড়মা ডাকলেন –ফটিক, অ্যাই ফটিক ... দোতলা থেকে কোন সাড়া এল না। বড়মা ওপরে গিয়ে দেখেন খাঁ খাঁ করছে ঘর। ফটিক নেই। ওর বিছানা, বাক্স কিচ্ছু নেই। কাউকে কিছু না জানিয়ে মায়ের কাছে হয়তো ফিরে গেছে। 

সেই সময় পোস্ট আপিস থেকে চিঠি আনতো ডাকপিয়ন আর ঘরে ঘরে ছিলো ল্যান্ডলাইন। মোবাইল জমানা শুরু হয় নি তখনো। বেশ কয়েক বছর বিরতির পর ফোন – 

- আমি ফটিক।
- ফটিক! কেমন আছিস বাবা?
- ভালো। সেদিন আমার ওভাবে চলে আসা উচিত হয় নি।
- যাবিই যখন বলে গেলি না কেন?
- তোমাদের বড্ড মায়া। বললে তোমরা আমাকে ফিরতে দিতে না।
- এখন কী করছিস?
- জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলো। সংসার সামলাচ্ছি। একটা মেয়েও হয়েছে। তোমাদের ভুলি নি বলেই ওর নাম রেখেছি পালকি। 
-আর কাজকর্ম কী করছিস?
-তোমাদের আশীর্বাদে বীজের ব্যবসা করে আমি আজ যথেষ্ট সচ্ছল। প্লেনের টিকেট কেটে রাখবো তোমাদের জন্য। তোমরা আন্দামানে এলে আমাদের মন প্রাণ ভরে যাবে।

ফোনের ওপারে বড়মার কপোল বেয়ে তখন ঝরছে ছেলেকে ফিরে পাওয়ার নির্বাক আনন্দ ও ফটিকের প্লেনের টিকেট কেটে মাতৃঋণ শোধ করার প্রচেষ্টায় নীরব অভিমান। বড়মা অপলকে চেয়ে রইলো কাঁঠাল গাছটার দিকে। ভালোবাসার বীজ থেকে চারা আর সেই চারা আজ মহীরুহ হয়ে ফলভারে আনত। কাঁঠালের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ালো বড়মা। প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে।
4

অণুগল্প - সুজয় চক্রবর্তী

Posted in


অণুগল্প


আসা যাওয়া
সুজয় চক্রবর্তী



---- বুঝলেন, কালই চলে যাচ্ছি।

---- তাই! কখন?

---- সকালে। সকাল ৭টাতে বেরোবো।

---- বেশ।....আমাদের কবে যাওয়া হবে জানি না। সোমবার ডাক্তার দেখানো আছে।

---- ভালো থাকবেন।

---- হ্যাঁ, আপনিও।



# প্রথমজন চলে গেছেন আজ সকালে। দ্বিতীয়জন বিকেলের পড়ন্ত আলোয় গেস্ট হাউসের বাইরের বারান্দায় বসে আছেন। একা। মাথায় হাতে গোনা ক'টা সাদাকালো চুল। তাই-ই কোনও রকমে খোপা করতে যাবেন; অমনি চোখ পড়লো দেওয়ালের কোণে একটা আধ-খাওয়া পোড়া বিড়ির দিকে।

---- কাশছেন, বিড়ি কি খেতেই হবে!


খানিকটা ইতস্তত ক'রে বিড়িটা ফেলে পায়ের নিচে চাপা দিয়েছিলেন প্রথমজন।



# দু'জনেই ছেলেদের সাথে ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন ভেলোর। একজন শিলিগুড়ি, অন্যজন কৃষ্ণনগর। দূরত্বটা অনেক।


তবু এই কটা দিন দুজনেই ছিলেন "এক জায়গার" লোক!


2

অণুগল্প - আইভি চট্টোপাধ্যায়

Posted in


অণুগল্প


ঠাঁই
আইভি চট্টোপাধ্যায়



‘‘আবার ওকে নিয়ে এসেছিস কেন?’’

‘‘কি করব বৌদি? আমাকে দেখলেই পেছন পেছন চলে আসে। এই, ঘরে ঢুকবি না। সিঁড়িতে বসে থাক।’’

‘‘সিঁড়িতে বসবে না, একদম না। ওপরের ফ্ল্যাটের সবাই রাগ করে। ওকে ঢোকাতে বারণ করেছে।’’

‘‘ও কিছু করবে না বৌদি। চুপ করে বসে থাকবে।’’

‘‘না না। শুধু শুধু লোকে কথা শোনাবে... রোজ সকাল সকাল এই ঝামেলা... ভাল্লাগে না।’’

‘‘আচ্ছা, আমি ওকে রেখে আসছি’’, বাইরে বেরিয়ে চটিতে পা রেখেছে কেবল, বৌদি ছুটে এলেন। ‘‘তুই আবার কোথায় যাচ্ছিস? এই তো আধঘণ্টা দেরি করে এলি।’’

‘‘ওকে রেখে আসি। একা একা বেরোলে... এত গাড়ি... ব্যস্ত রাস্তা...’’

‘‘ব্যস, হয়ে গেল। আচ্ছা উমা, গরজ কি শুধু আমার? তোর কাজের দরকার নেই? মাইনে নিয়েই তো কাজ করিস, নাকি?’’

‘‘কাজই করি বৌদি, তা বলে তো সব বিকিয়ে দিই নি। ওইটুকু ছেলে, এক কোনায় একটু বসে থাকবে... তা যখন হবে না, ওকে রেখে আসছি। কাজ করব না তো বলি নি।’’

নিত্যি ঝামেলা। নিজের তিন ছেলেমেয়ে, মাথার ওপর ছাদ বলতে রেললাইনের ধারে একখানা ঘর। বরটা রাজমিস্ত্রীর কাজ করত, ভারা থেকে পড়ে পা ভেঙেছিল, ঠিকমতো চিকিত্‍সা হয় নি, এখনো পা টেনে টেনে হাঁটে। রোজ কাজেও যায় না। উমারানীই ভরসা। তবু... কথায় বলে না “আপনি খেতে পায় না, শঙ্করাকে ডাকে!” উমারানীর সেই দশা। রাস্তার একটা ঘেয়ো কুকুর,পা-ভাঙা একটা শালিক, একটা বুড়ো কাক। কাজের বাড়ির বাসি রুটি, পাঊঁরুটি, বিস্কুট। চলে যাচ্ছিল। এবার আস্ত একটা ছেলে। কোথা থেকে এসে ফুটপাতে শুয়েছিল, উমারানীকে দেখেই নাকি সঙ্গে সঙ্গে চলা শুরু করেছে। রোজ কাজে আসার সময় সঙ্গ ধরে। 

‘‘কি করব? একটা ছানা মানুষ তো! কিন্তু অত্তটুক মাথায় কত বুদ্ধি, জানো? কিছুতেই আমার সঙ্গে বাড়ি যায় না।’’

বলতে বলতে চোখে জল এলো উমারাণীর। ওইটুকু আস্তানা, বাড়ি কোথায়? রেললাইনের ধারে একখানা ঝুপড়ি ঘর। পাকা ইঁট সিমেণ্টের ঘর নয়, কোনরকমে ঠেকা-জোড়া দেওয়া ঘর। প্রথমদিন পিছু পিছু এসেছিল তো ছেলেটা। লক্ষ্মীর বাপ দেখতে পেয়ে তাড়া দিয়েছিল, ‘‘এই যা ভাগ!’’ ব্যস, সেই যে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর এগোয় না। 

সারাদিন কোথায় কোথায় ঘোরে কে জানে। রাত হলে ফুটপাথে এসে ঘুম। সেখানেও জায়গা ভাগ করা। যে যার নিজের পরিবারের জায়গা সামলাতে ব্যস্ত। ছেলেটা বারবার ঠাঁইনাড়া। ওই ছেলের জন্যেই রোজ ঘরে ফিরতে দেরি। সন্ধেবেলা মিত্তিরবাড়ি রুটি করে দেয় উমারাণী। চারটে করে রুটি পাওনা। ফুটপাথে ছেলেকে দিয়ে তবে ঘরে ফেরা। 

একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে। রুটি নেবার জন্যেই ছেলে ফিরে আসে। নইলে প্রথম প্রথম ঘরে ফিরেও কি অশান্তি! ছেলেটাকে দেখে আসতে না পারলেই অশান্তি। কে জানে কোথায় চলে গেল, নাকি গাড়ি চাপা পড়ল।

আহারে, একটা মানুষের বাচ্চা তো বটে। কেমন নিঠুর বাপ-মা, বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে নাকি জন্মের পরই ফেলে দিয়েছে কে জানে। ‘‘তাতে তোর কি? এমন কত বাচ্চা ঘুরছে ফুটপাতে রাস্তায়। স্টেশনে গেলে তো দাঁড়ানো যায় না ওদের জন্যে।’’ 

এত বড় বড় বাড়ি, কেউ যদি একটু ঠাঁই দিত ছেলেটাকে! মিত্তিরদের ফ্ল্যাটের লাগোয়া কাজের লোকের ঘর। খালিই পড়ে আছে। মল্লিকবাড়িতে অতবড় গাড়ি রাখার গ্যারেজ, পিকলুদের বাড়িতে বাগানের পাশের ঘরটা, পূরবীবৌদির বাড়িতে তো একাই থাকে বৌদি... সবাইকে বলে দেখেছে উমারাণী। 

আজ ষষ্ঠীপুজো। উমারাণী কাজে আসে নি। তবে বুঝদার আছে, নিজে না এলেও মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছে। ‘‘মা বলল, পুজোর দিন সব বাড়িতে অনেক কাজ। তুই যা লক্ষ্মী।’’

‘‘কেন? তোর মা কি রাজকার্যে ব্যস্ত?’’ 

‘‘আর বোলো না। ওই ভুলুকে ঘরে এনে তুলেছে না? সেই নিয়ে বাপের সাথে ঝামেলা। আর একটুক ঘর বানাতে হবে যে।’’

‘‘ভুলু? ভুলু আবার কে?’’

‘‘ওই যে গো, মায়ের পুষ্যি। ফুটপাতে থাকত, কাল পুলিশের গাড়ি এসে ফুটপাত থেকে সব তুলে দিয়েছে না? মা বলল, আর উপায় নেই, এমনি এমনি তো ছেড়ে দেওয়া যায় না। এত্তবড় দুনিয়ায় একটু জায়গা পাবে না ছেলেটা? একটুখানি ঠাঁই? তাই ভুলুকে আমাদের ঘরেই নিয়ে এসেছে।’’
4

অণুগল্প : শাহেদ সেলিম

Posted in


অণুগল্প


তালেব-এ-এলেম
শাহেদ সেলিম


-খিচ্চা থাক।
-কতক্ষণ থাকুম ওস্তাদজি?
-থাক, নড়বি না ।
-মুশায় কামড়াইতাছে। হাত পাও জারা জারা হইয়া যাইতেছ, ওস্তাদজি।
-চুপ, চুপ, একদম চুপ। সব ঠাণ্ডা হোক তারপর আমরা বাইরামু।
-হুজুর আমার পুটকি ছিঁড়া ধোঁয়া বাইরাইতাছে।
-কান্দিস না, কালকাই তরে বেল্লাপারের লাটুম কিন্যা দিমু।

বড় মসজিদে ফজরের নামাজ শেষ করে প্রতিদিনের মত নদীর ধারে হাঁটেন করিম ফকির।ভোরের হাওয়া গায়ে লাগে। তাঁর মনে হয় আল্লাহ নিজ হাতে গায়ে হাত বুলিয়েদিচ্ছেন। নদীর শান্ত ঢেউগুলোয় সূর্যের প্রথম আলোর স্নিগ্ধতায়, তাঁর মুখদিয়ে অস্ফুটে উচ্চারিত হয় - সুবহানাল্লাহ। হাঁটতে হাঁটতে আজও দেখেন।

দেখতে দেখতে দেখেন দূরে, নদীর বাঁকটাতে, কয়েকটি কুকুর ঘেয়োঘুয়ি করছে।

ধীরে ধীরে নদীর বাঁকটি তাঁর আরো কাছে চলে আসে। কুকুরগুলোর জটলাটার কিছুদূরে করিম ফকির পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। মুখে অস্ফুট উচ্চারণ, ইয়া মাবুদ, ইয়া মাবুদ, আপনি আমারে কী দেখাইলেন! কী দেখাইলেন!

সকালের নদীটাকে কেটে কেটে বালিভর্তি ট্রলার চলে যাচ্ছে শহরের দিকে। নদীর তীরের কুকুরগুলোর কামড়াকামড়ি তখনও শেষ হয় নাই।



0

অণুগল্প : লিপিকা ঘোষ

Posted in


অণুগল্প


ক্ষেত
লিপিকা ঘোষ 



‘‘তুমার বিবি পলাইলছে রহিম মিঞা, সোহরাব চাচার মাইজ্যা পোলা মাহাতাবের সহিত।’’ হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলে আজিজ,পড়শী।

ক্ষেতে নিড়ান দিতে দিতে আগাছা তুলে সাফ করছিল রহিম। মুখ না তুলে আকাশ পানে চায় – ‘‘মাহাতাব! ইবলিশ।’’

‘‘থানা পুলিশ করবা না?’’ জিগায় আজিজ।

‘‘নাহ।’’

‘‘কেমুন কথা বুইলছো ? বিবিডারে নিইয়ে পলাইছে।’’

‘‘আমি বেঁইধে আনার কে?’’

‘‘তুমি যেন কেমনতর মিঞা!’’ আজিজ বিরক্ত হয়ে বলে।

‘‘এই যি বেগুন ক্ষেত দেইখছ, ইয়াতে আমরা বিষ দেই কি না?’’

‘‘দিতে তো হইলবেকই মিঞা,তয় কি ?’’

‘‘বিষ দিইলে পুকা ধইরবে না ডাগর বেগুন গুলান খদ্দের ধুম কইর‌্যে কিইনবে।’’

‘‘তয়?’’

‘‘তবু কিছু বেগুনে পুকা লাগে। ফোঁপরা হয়। ঐ গুলানে বিষ ঢুকে নাই।’’ হা হা করে হাসে রহিম মিঞা।

‘‘বোঝলাম। বিবিরে বড় ভালোবাসো মিঞা। যা বোঝো তা কর।’’ আজিজ চলে যায়।

খুরপি হাতে নিড়েন দেয় রহিম। ভরন্ত শরীর জরিনার। ওর বিবি। টলটলে মুখ। বড় বড় চোখের ফাঁদ। হাসলে গতর উপচে পদ্মার পানির ঢেউ ওঠে। অমন বিবি কি এই বেগুন ক্ষেতের মালিকের ঘরে টিকে থাকে ? ‘‘উ যি পলাইবে,জানতুক।’’ মনে মনে বলে রহিম।‘‘মাহাতাবডা ধোধ লিল।’’

মাহাতাব ঐ গ্রামের রইসের পোলা।মুর্শিদাবাদের আখেরিগঞ্জের ছাড়-পদ্মার ধারে ছোট গ্রাম মানিকচরা। ইদানীং মার্বেল পাথরের কাজে বিদেশ খাটতে যায় মাহাতাব। গ্রামের অনেকেই যায়। কিন্তু সবার থেকে বেশি টাকা কামিয়ে ফেলেছে ক’দিনেই। মাহাতাবের বহিনের সঙ্গে রহিমের আশনাই হয়েছিল। মাহাতাব সহ্য করতে পারেনি। শহরে রইস ঘরে জোর করে বিয়ে দেয় বহিনের। রাতারাতি খবরটুক পায়নি রহিম। বহিন আশনাই করল রহিমের মতো চাষার ব্যাটা চাষার সাথে? রইসের ঘরে বহিনের বিয়ে দিয়েও জ্বালা ভোলেনি মাহাতাব। নিজের বিবি পোলা ফেলে জরিনাকে নিয়ে পালিয়েছে।‘‘উ তো পলাতুকই’’ – আবার বিড়বিড় করে রহিম।

বেলা পড়ে আসছে। নিড়েন শেষ করে ঘরে ফেরে রহিম। গাঁয়ের মানুষের ভিড়,জমায়েত রহিমের বাড়ির সম্মুখে। রহিমকে আসতে দেখে মাহাতাবের বাপ সোহরাব চাচা এগিয়ে আসে।‘‘বৃদ্ধ হইলছে বুড়াডা। কি তেজ ছিল,বাপরে।’’ মনে ভাবে রহিম।

‘‘রহিম,বাপ আমার, থানা পুলিশ কইরিস না পোলা। তু আবার বিহা কর। আমি ভাল মেইয়্যে দেইখ্যে দিব।’’ কাতরে বলে সোহরাব।

‘‘তুমি ছাড়ান দিবা সোহরাব মিঞা? যদি তুমার ডাগর ছোট বিটিকে নিইয়ে পলাই? তুমার বিটি এখুনো ভুলে নাই আমাকে।’’

‘‘মুখে সামাল দে রহিম’’, গর্জে ওঠে বৃদ্ধ সোহরাব।‘‘আমার বিটি তর মাগের মতো ছিনাল না।’’

হা হা করে হাসে রহিম।‘‘ঘর যাও সব। আমি হাত মুখ ধুই। থানা পুলিশ কইর‌্যে কি হইলবে? পুকায় কাটা বেগুন,বিষ ঢুকে নাই।’’

লোকজনের জমায়েত ধীরে ধীরে ভেঙে যায়। সকলে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটে।

‘‘মাথা ডা এক্কেবারে গেইলছে তুমার। হালার মাহাতাবইয়া কে এইবার জেলে ঢুকাইতা।’’ গজগজ করতে করতে চলে যায় আজিজ।


সন্ধে নেমে আসে গাঁ জুড়ে,রহিমের দাওয়া জুড়ে। শূন্য ঘর। এক চিলতে বেগুন ক্ষেতের চাষা ও।‘‘জরিনার মতুন বিবি টিইকব্যে কিসের জইন্যে?’’ভাবে বসে।‘‘কাল সকালে উঠ্যে ক্ষেতে বিষ দিইতে হইলবে। হালার পুকা গুলোন যেন ক্ষেত উজাড় না কইর‌্যে। নধর বেগুন গুলোন কিইনবে সব খদ্দের হুমড়ি খেইয়্যে। পুকায় কাটা বেগুন কেনে কয়জনা? কেনে দু-এক জনা। উয়ারা জানে পোকায় কাটা বেগুনে বিষ ঢুকে নাই...’’