শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘কিন্নর কিন্নরী’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে, ঘটনাগুলো ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সালের, চাইবাসায় টানা যতদিন ছিলেন, সেসময়ের। তাঁর ‘কুয়োতলা’ উপন্যাস, যা তাঁর শৈশবের কাহিনি, সে উপন্যাসে তিনি নিজের নাম দিয়েছিলেন নিরুপম; পরে নিজের জীবনের ঘটনাবলী নিয়ে যে আখ্যানগুলো লিখলেন, প্রতিটি উপন্যাসে তিনি নিরুপম। ‘কিন্নর কিন্নরী’, যা তাঁর প্রথম প্রেম, কবি হয়ে ওঠা এবং কবিবন্ধুদের নিয়ে, এই আখ্যানে তিনি নিরুপম নামটা বাদ দিয়ে নিজেকে বললেন পার্থ।
উপন্যাসটিতে সুনীল, সন্দীপন, দীপক, উৎপল আছেন, এবং আছেন সমীর রায়চৌধুরী আর আছে চাইবাসা, লুপুংগুটু ঝর্ণা, রোরো নদী, হেসাডির অরণ্য, মধুটোলা, সেনটোলা। উপন্যাসটিতে সমীর রায়চৌধুরীর অদ্ভুত প্রেম নিয়ে একটি সাবপ্লট আছে। কাকে কি নাম শক্তি দিয়েছেন তা যাঁরা চাইবাসার ঘটনাবলী জানেন তাঁরাই বলতে পারতেন। বইটি শক্তি উৎসর্গ করেছিলেন শান্তি লাহিড়ি আর তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী খুকুকে; শক্তির প্রেমিকার সবচেয়ে ছোটো বোন খুকু, যাঁকে শক্তি নাম দিয়েছেন বিন্তি। প্রেমিকা শীলা চট্টোপাধ্যায়ের নাম দিয়েছেন নয়ন, সবচেয়ে বড়ো বোন মন্টি, যার বিয়ে হয়ে গেছে, তার নাম দিয়েছেন চয়ন, অবিবাহিত বোনেদের নাম দিয়েছেন ময়ন, ইন্তি, বিন্তি, ভাই সন্তুর নাম শানু। সমীরের নাম শম্ভু, সুনীলের নাম হিরণ্ময়, সন্দীপনের নাম সনাতন, দীপকের নাম শর্বরী। পার্থ নামের মতোই, প্রতিটি নামই গোপন বার্তাবহ।
ষোলো পর্বের ‘কিন্নর কিন্নরী’র অষ্টম পর্বে চাইবাসায় মধুটোলার ছোটোঘরে শক্তি তাঁর প্রেমিকা নয়নকে নিজের লেখা কবিতা শোনাচ্ছেন, সেই সূত্রে লিখেছেন :
চোখ খুললো নয়ন। গভীর কালো চোখে তার খুশি উপচে পড়ছে। এত সামান্যে খুশি হয় নয়ন? ওর বিপদ অনেক।
বাষ্পাকুল চোখ দুটি তুলে বলে, ‘আর একটা বলবে? এই শেষ। আর বলতে বলবো না।’
‘কেন? আর বলবে না কেন?’ সপ্রশ্ন পার্থ।
‘তোমারও তো কষ্ট হয়, যেমন হচ্ছে আমার! হয় না?’
‘হয় নয়ন, হয় -- কষ্ট মেশানো সুখও হয় আবার। কিন্তু থাক, এতো কথা এখনই, তোমায় না বললেও হবে।’
‘কবিতাটির কোনো নাম দিইনি এখনও, নামটা তুমি দিয়ে নিও নয়ন। পারবে না?’
পার্থ আর উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে আবৃত্তি শুরু করে :
যাবার সময় বোলো কেমন করে
এমন হলো, পালিয়ে যেতে চাও?
পেতেও পারো পথের পাশের নুড়ি
আমার কাছে ছিল না মুখপুড়ি
ভালোবাসার কম্পমান ফুল।
তোমায় দেবো? বাগান দ্যাখো ফাঁকা
তোমায় নিয়ে যাবো রোরোর ধার
তোমায় দেখে সবার অন্ধকার
মুছতে গেল সময়, আমার সময়।
ফিরে আবার আসবো না ককখনো
তোমার কাছে ভুলতে পরাজয়।
সবাই বলতো, ইচ্ছেমতন এসো
অমুক মাসে, বছরে দশবার।
তুমি আমায় বললে, এসো নাকো
জীবনভর কাজের ক্ষতি করে।
‘মিথ্যুক, মিথ্যুক। আমি এমন কথা কবে তোমায় বলেছি? ছাই তোমার কবিতা -- বিচ্ছিরি --- ককখনো সত্যি নয়। ছিঃ’ --- নয়ন রাগে অভিমানে আকুল হয়ে পার্থর বুকের মধ্যে আত্মসমর্পণ করে। ‘তুমি আমায় ভাবো কী?’
‘আমার কেবলি ভয় করে, নয়ন, যদি এমন হয়! তুমি আমায় ভুল বুঝো না, এমন হতেও তো পারে?’
তৃতীয় পর্বে শম্ভুর চাইবাসার বাসায় পৌঁছোনো আর থেকে-যাওয়া নিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখছেন :
পাকা বিহারী গেরস্হালির ছোঁয়াচ শম্ভুরা আবাল্য পেতে অভ্যস্ত। ওরা প্রবাসী বাঙালি। খাস বাড়ি কলকাতায় হলেও বাপ-পিতেমো ব্যবসাসূত্রে পাটনায় দীর্ঘদিন ছিলেন। সেখানে ওদের নিজেদের বাড়ি, নিজেদের ব্যবসা।
শম্ভু চিরকালই লেখাপড়া সাহিত্যশিল্পের অনুরক্ত। ট্রেনিং নিতে চলে গেলো সুদূর জাপানে একদিন। বাড়িতে আগে থেকে কিছুই জানায়নি। যখন জেনেছে তখন বাড়ি থেকে বাধা দিলেও শম্ভুকে ফেরানো শক্ত। তাই অকারণ বাধা দিতে এগিয়ে আসেনি কেউ। বিদেশে ট্রেনিং নিয়ে ঐ অল্প বয়সেই সে বিহার সরকারের বেশ উচ্চ কর্মচারী একজন। অবিবাহিত, রুচিবান, ভালো মনের বন্ধুবৎসল ছেলে। তাই ওর ওপর অত্যাচার অনেক সময়ে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
পার্থ অল্প পরিচয় সত্বেও, শম্ভুর হৃদয়ের কাছাকাছি মানুষজনদের অন্যতম। যখনই কলকাতায় ছোটে কাজে-কর্মে ছুটিছাটায় -- খুঁজে পেতে পার্থর সঙ্গে দেখা করেছে। তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে। পার্থ যথারীতি গেছে এড়িয়ে। বলেছে অনেক কাজ। অমুক মাসে নিশ্চয় যাবো। তারপর সেই পার্থ হঠাৎ এলো শম্ভুর কাছে। এলো আর কিছুতে তাকে ছেড়ে যেতে পারল না। দীর্ঘ দিন পার্থ তার কাছে ছিলো, একেবারে আপনার মতো হয়ে হয়ে ছিলো, তারপর হঠাৎ আবার একদিন পালালো। শুধু শম্ভুর থেকেই পালালো নয়। শম্ভুর যাবতীয় সংস্রব থেকে ছুটি নোলো। মিলিয়ে গেল -- কলকাতার জনসমুদ্রে। কিন্তু তা একেবারেই গল্প শেষের গল্প। আজকের কথা নয়।
নবম পর্বে নয়ন সম্পর্কে শম্ভুর উক্তি নিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখছেন :
শম্ভুর যেখানে বাসা সে-অঞ্চলটির নাম নিমডি। চাইবাসা শহরের একেবারে শেষপ্রান্তে, পূর্বাঞ্চলে। বাড়িটার নামও অদ্ভুত। পুরানা ভাট্টি। আগে এখানে ছিল এক ভাটিখানা। ভাটিখানা উঠে যাবার পর সরকার থেকে এটা নিয়ে নিয়েছে।
বাড়িটা একটা উঁচু টিলার মাথায়। খাপড়ার চাল। গা-গতর পাথরের। দরজা-জানলা সবগুলো দশাসই, তাদের গা-ভর্তি মুঠোর মতন বলটু মারা। খিল যেন ছোটোখাটো শালবল্লী।
জায়গাটা নির্জন। শহর বন্দরের শেষে এমন নির্জন একঘরে জায়গায় ভাটিখানাই সম্ভব। মানুষের পক্ষে বাস করা একটু শক্ত।
কিন্তু শম্ভু ওই বাড়িরই একটা অংশ বসবাসের জন্যে পেয়েছিল। বাকি অংশে থাকতেন আবগারি ইন্সপেক্টর। তাঁর অফিসও এখানে।
এক চাকর, শম্ভু এ আবগারি দুজনেরই খাবার তৈরি করে দিতো। ফাইফরমাস খাটতো। কোন অসুবিধে ছিল না। আজকাল শম্ভু অধিকাংশ দিনই চয়নদের বাড়িতে রাতে খায়। খেতে হয়, না খেলে ওঁরা ছাড়েন না। রাগ করেন। পার্থ যখন এলো তখন শম্ভু বাড়িতে খাওয়াই স্হির করে ফেলল। কেননা দুজনে মিলে কারুর বাড়ি খাওয়া খুবই দৃষ্টিকটু। সকালের দিকে হাতে হাতে উভয়ে তৈরি করে নিতো খাবার। সেই খাবারই থাকতো রাতের জন্যে। অসুবিধে হবার কথা নয়।
তাতেও ওঁরা রাগ করেন। একেকদিন রাতে শম্ভু-পার্থর নিজের হাতে তৈরি খাদ্য পড়ে-পড়ে পচতে থাকে। ওদের ওখানে চর্বাচূষ্য খেয়ে শম্ভু উদগার তোলে। আর শুধোয়, ‘কী রে কেমন বুঝছিস?’
‘কীসের আবার বোঝাবুঝি?’ পার্থ শম্ভুর প্রশ্নের বাঁকা ভাব সিধে করে দ্যায়।
তবু ছাড়ে না শম্ভু, ‘না, তাই বলছিলুম আর কি।’
নিশ্চিন্তে গা ছেড়ে দ্যায় বিছানায় শম্ভু। ‘তা কি পড়াচ্ছিস নয়নকে? এরকম বিনি পয়সার মাস্টারি আগে করেছিস নাকি কখনো?’
‘না’, পার্থ রাগ করে। শম্ভুর এভাবে কথা বলা তার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না।
চলে আসার সময়কার নয়নের স্পষ্ট ও ফিসফাস কানে বাজে, ‘কালকে আসবেন তো? ঠিক?’
পার্থ মাথা নাড়ে।
শম্ভু বলে, ‘কী রে পাগল-ফাগল হয়ে গেলি নাকি শেষ পর্যন্ত? ওভাবে একা-একা মাথা নাড়ছিস কেন? এ্যাঁ?’
পার্থ এবার বাস্তবিক ফেটে পড়ে। আর সহ্য হয় না। শম্ভুর চিপটেনের একটা সীমা থাকা উচিত নিঃসন্দেহে।
‘তাই বলে একা-একা ছাড়া দুজনে কীভাবে মাথা নাড়ে -- আমার জানা নেই শম্ভু। তুই হয়তো জানতে পারিস। তা দেখিয়ে দে কেমন করে নাড়তে। দেখে শিখি।’
‘বাব্বাঃ তুই দেখি রেগেই টং। একটু রহস্য করছিলুম -- তাতে তুই যেমন চ্যাটাং চ্যাটাং বোল ছাড়ছিস, আজ উড়েই যাবো বোধ হচ্ছে। হয়েছে কি? নয়নের বুঝি লক্ষ্মীপুজো ছিল আজ? বেশিক্ষণ পড়াশুনো হয়নি, তাই...’
‘রাখ শম্ভু।’ পার্থ কী বলবে বুঝতে না পেরে হেসেই ফেললো।
‘এই তো, উঃ, কীরকম রামগরুড় হয়ে উঠেছিলি না? যদি আরশি থাকতো মুখের কাছে -- তা বল দিকি কতোদূর এগুলি, একটু শুনি।
‘তুই মহা ইয়ে...’ বলতে পারে না পার্থ। লজ্জায় অধোবদন হয়।
‘আচ্ছা। তাহলে অনেকখানিই পচ ধরেছে।’ শম্ভু উঠে বসে আর তখনি মন্ত্রোচ্চারণের মতো পার্থ বলে, ‘হ্যাঁরে, ও আমার কাছে অনেককিছু আশা করে।’
প্রথম পর্বে নয়ন কখন কলেজ থেকে ফিরবে তার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষারত পার্থ সম্পর্কে হিরণ্ময়ের (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) উক্তি বর্ণনা করেছেন শক্তি:
‘তুই ছোঁড়া কী রে? ঐভাবে ক্যাংলার মতো একটা মেয়েছেলের জন্যে বসে থাকিস হাপিত্যেশ করে। দিন নেই রাত নেই --- একি তোর বাপের পোঁতা ইস্টিশান পেলি নাকি?’
দশম পর্বের শুরু এইভাবে, এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও শীলা চট্টোপাধ্যায়ের প্রগাঢ় প্রণয়ের এবং অজস্র কবিতা রচনার সূত্রপাত; তাছাড়া শম্ভু সম্পর্কে চয়নের দুর্বলতার কথা:
শম্ভুকে ট্যুরে যেতেই হলো। বহুভাবে ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলো। পারল না।
যাবার আগে পার্থকে নয়নদের বাড়ি রেখে গেলো। বলল, ‘ভালোভাবে থাকিস। গাছের ডালে চড়িয়ে রেখে গেলাম। দেখিস অন্তত যে গাছের ডালে বসলি সেই ডালটাই মহান কবির মতো কেটে ফেলিস না।’
‘মানে?’ পার্থ শম্ভুর রহস্যালাপ বুঝেও না বোঝার ভান করে।
মানে যে কী -- শম্ভু বলার সময় পায় না। ইন্তিবিন্তিরা হৈ হৈ করে এসে পড়ে ওদের কাছাকাছি। ইন্তিবিন্তিরা নয়নের ছোটোখাটো বোনের দল। ছোটো মানে নিতান্ত ছোটো নয়, ক্লাসের উঁচুর দিকে পড়ে। ইন্তি সবচেয়ে ওপরের ক্লাসে, বিন্তি আর এক ক্লাস নিচুতে।
‘সর্বনাশ, দুই বন্ধু আবার কী যুক্তি করছে রে?’ ইন্তি বলে বিন্তিকে।
‘কী যুক্তি, কী যুক্তি’ -- বলে বিন্তি যেন নাচে-ভাসা, ওদের গায়ের কাছে সরে আসে। কান পেতে শোনার ভান করে। শম্ভুদা তো স্পিকটি নট। পার্থদা, বলুন না, কী গোপন আলোচনা হচ্ছিলো? নিশ্চই আমাদের নিয়ে, তাই না রে ইন্তি?’
আমাদের নিয়ে তো বটেই। তারপর পার্থদা! এখন তো আপনি আমাদের, শম্ভুদা টোটালি ফালতু। ধরুন আমরা ওঁকে চিনি না, কী বলুন?’
পার্থ মাথা নাড়ে, ‘বেশতো বেশতো। তা ধরা যায়।’
চয়ন এসে বলে, ‘শানু এলে পার্থবাবু তুমি ওর সঙ্গে গিয়ে তোমার টুকিটাকি জিনিসপত্র এনে নেবে শম্ভুর ওখান থেকে।’
তারপর অত্যন্ত সহজ করে জিজ্ঞেস করে, ‘ট্যুরে কোনদিকে যাবে শম্ভু এবার?’
‘জৈতগড়, আর সেখান থেকে ময়ূরভঞ্জের দুচারটে ব্লক।’
‘ফিরবে?’
‘দেখি। সাতদিনের প্রোগ্রাম -- আগে শেষ করতে পারলে, আগেই ফিরবো।’
‘গরম জামা-কাপড় সঙ্গে নিও।’
‘বাঃ, তা নেবো না কেন? আমি কি আর নতুন ট্যুরে বেরুচ্ছি?’
‘নতুন আমি বলছি না তো, তবে তুমি যেরকম উসোভুলো।’
‘আমি? তাহলে পার্থকে যে কী বলবে?’
‘উনি কবি মানুষ, ওঁর ভুল তো স্বাভাবিক।’
‘বাঃ, এরই মধ্যে পক্ষপাত শুরু হয়ে গেলো? দ্যাখ পার্থ, কেমন ভাগ্যবান ব্যাটা তুই -- দুদিনের জন্যে এসে আমার জায়গাটা দখল করে নিলি?’
পার্থ কিছু বলে না। ইন্তিবিন্তির সঙ্গে ঘরের ভেতর দিকে চলে যায়। এখন ওদের একটু সময় দেওয়া উচিত।
ময়ন নামটা হয় না। ময়না থেকে ভেঙে গায়ের জোরে ওরা ওদের নামধারার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে। চয়ন ময়ন নয়ন! তারপর আর মিলরাখা পায়নি বলেই ইন্তি বিন্তি শানু।
চয়ন নয়ন ওদের নামের সঙ্গে ময়নকে মিলিয়েছে বটে, কিন্তু ময়ন মেলেনি। সে ওদের স্বভাবের ঠিক বিপরীত ধাতুতে গড়া। অন্তরালবাসিনী। ওদের মায়ের হাতে ধরা। বড়ো একটা মজলিসে আসে না। সময় পায় না? তাও হতে পারে। আর সময় করে নিতেও চায় না। ও ভেতরে থাকে, ভেতর থেকেই ওদের ওপর মানসিক নজর রাখে। কার কখন কী দরকার ময়নের নখদর্পণে। গোটা সংসারের হাল ধরে আছে সে। মা তো রুগ্নাই। উনি ময়নের কাছে বসে থাকেন। ময়ন বলেছে, তোমায় কিছু করতে হবে না। তুমি শুধু কাছ থেকে বলে দিও।
তবুও মা এটা-ওটা টেনে নিয়ে করতে চান। ময়ন রাগ করে।
মা বলেন, ‘যা না তুই ওদের সঙ্গে একটু গল্প-টল্প করে আয়। দেখা করে আয় শম্ভুর সঙ্গে। ও তো আবার ট্যুরে যাচ্ছে আজ।’
‘দিদিরা তো আছেই, আমার অনেক কাজ।’
এগারোতম পর্বে নয়নের সঙ্গে পার্থর প্রেমের কথা এইভাবে বলেছেন শক্তি :
কলেজে যাবার আগে নয়ন একবার পিছন ফিরে তাকায়। তারপর চোখের ইশারায় বলে, ভালো হয়ে থেকো।
তাই পার্থ ভালো হয়ে থাকে। একেকদিন নিজের সর্বনাশ করতে ইচ্ছা হয়। একেকদিন তাই বাইরে বেরিয়ে রোদে পুড়ে শরীর জখম করে নিয়ে আসে। চলে যায় নয়নের বাস যে পথ ধরে গেছে সেই পথে -- কোর্ট কাছারি বেড় দিয়ে গোশালার সেই পিচ-মসৃণ রাস্তায়। ওইদিকেই অপার চাইবাসা। নয়নের হলুদ কলেজ এতোদূর থেকেই দেখা যায়।
কেন যে এই বোকামিটুকু করে? সর্বক্ষণ নয়নের কাছাকাছি থেকেও এই যে অল্প সময়ের আড়াল --- এতেই পার্থ পাগলের মতন হয়ে যায়। নাকি এ-সমস্তই তার লোকদেখানো বাড়াবাড়ি আদিখ্যেতা। যেতে-যেতে প্রায়ই মনে হয়, আশপাশের পথচারীদের ডেকে বলবে, শোনো, নয়ন, যাকে আমি ভালোবাসি -- সে এই পথ ধরে গেছে বলেই আমি তার পিছু-পিছু পথ স্পর্শ করতে বেরিয়ে পড়েছি। আমার এ-পাগলামির নাম প্রেম। তোমরা একে প্রেমের উদাহরণও বলতে পারো।
নয়নেরই ছোট্ট পড়ার ঘরটায় পার্থর বিছানা। এক কোণে বসে পড়তো নয়ন আর পার্থ চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকতো। চীনালন্ঠনের আলোয় গরবিনীর মুখ লাল।
‘কী দ্যাখো অমন করে?’
‘তোমায় -- তোমাকে দেখি।’
‘আমি আবার দেখার জিনিস নাকি কিছু?’
‘তেমন নয়, তবে--’
‘সর্বদাই তো দ্যাখো, দেখে-দেখে এতদিনে মুখস্হ হয়ে যাবার কথা।’
প্রথম পর্বে শক্তি চট্টোপাধ্যায় শম্ভু আর চয়ন-এর জটিল সম্পর্কের কথা লিখছেন:
‘হ্যাঁরে নয়ন, তোর হয়েছে কি? সর্বাদাই কী যেন ভাবিস। চুপচাপ, গম্ভীর। কই এমন তো ছিলি না তুই।’
‘কী আবার নতুন পেলে আমার মধ্যে’, পালটা প্রশ্ন করে নয়ন।
চয়ন হাসে। ‘তোর তো সবটাই নতুন রে আজকাল।’
‘তাই বুঝি’, হেসে পাশ কাটায়।
না, এভাবে চলবে না, চলতে পারে না। সে ধরা পড়ে যাচ্ছে। বিশেষ ভাবে দিদির চোখকে ফাঁকি দেওয়া যাচ্ছে না। দিদি নয়নের আদ্যোপান্ত জানে। আচ্ছা, জানেই যদি তবে অকারণ এটা-ওটা শুধোয় কেন? আসলে বোধহয় ও কথাবার্তায় সহজ হাওয়া চায়। নয়নকে ভালোবাসে বলেই নয়নের মনের ভাব ভাগ করে নিতে চায়। আশ্চর্য, দিদি ওকে মুখ ফুটে কিছু বলছে না কেন? দিদিকেও কেমন অদ্ভুত মনে হয়। মনে হয় দিদিও ধীর ও ক্রমাগত বদলে বদলে যাচ্ছে। সে-ও নয়নকে কিছু জানাতে চায় আপন অন্তর্বেদনার কথা। নয়ন বুঝতে পারে, দিদি এক অন্যায় আর অপ্রতিরোধ্য আবর্তে জড়িয়ে যাচ্ছে। ভুল, অত্যন্ত ভুল। নয়ন কী করবে কিছুই বুঝতে পারে না । সাবধান করবে দিদিকে? তাতে কি বাস্তবিক কোনো লাভ হবে? দিদি কি নিজেই যথেষ্ট সাবধান নয়? তবে? তবে ছেলেপুলে নিয়ে এখুনি রাউরকেলায় জ্যোতিদার কাছে যাওয়া উচিত। নয়নই চিঠি লিখবে জ্যোতিদাকে। তাড়াতাড়ি করুন, স্ত্রীপুত্রকে এভাবে ফেলে রাখবেন না আর। ভালোমানুষ জ্যোতিদার মুখটা মনে পড়ে নয়নের। দিদি কেমন করে ওঁকে ঠকাচ্ছে ভেবে শিউরে ওঠে সে। বাবাও টের পাচ্ছেন। অস্হির হয়ে ওঠেন তিনিও। এখনই বৈঠকখানা ঘরের দিকে তাকালে দেখা যাবে টেবিল আলোয় তাঁর মুখ অভিমানে জ্বলছে। ঠিক বিস্ফোরণের আগের অবস্হা। দিদি অন্ধ তাই টের পাচ্ছে না। নয়ন কিন্তু বুঝতে পারে যে সর্বনাশের আর বেশি দেরি নেই।
নয়ন চোখ মুদে স্তব্ধ। অকস্মাৎ বিচিত্র কোলাহলে চোখ মেলে দ্যাখে, ‘তুমি? সত্যি তুমি? এত দেরি করলে যে!’
দ্বিত্বীয় পর্বে চয়ন-শম্ভু সম্পর্কের জট এই ভাবে খুলেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়:
প্রথম দিন ওর দিদি চয়নের সঙ্গে দেখা। তিরিশের সামান্য ওপরে বয়স, স্বাস্হ্যোজ্বল চেহারা, হাস্যময় চোখ, তাছাড়া গলার স্বর মায়ায় ভরা। দেখা মাত্রই ভালো লেগে গেল পার্থর। তাছাড়া উনি বললেন যে পার্থর কবিতা পড়েছেন। ভালো লাগে। সব আধুনিক কবিদের মতন দুর্বোধ্য নয়। সুতরাং, পার্থরও ভালো লাগে।
পার্থ অবশ্য মুখে বলে, ‘আমার কবিতা? ওঃ শম্ভু দিয়েছে বুঝি আপনাকে? ছিঃ ছিঃ সে তো ছোটোবেলায় লেখা --- লেখা না বলে বরং তামাশা বলাই ভালো।’
চয়ন মৃদু হাসেন। বলেন, আপনারা দেখছি সবাই এক। নামেই তুলকালাম আধুনিক -- আসলে সেই ম্যাদামারা ভিতু বাঙালি -- কবিতা লেখেন তাতে এত কিন্তু-কিন্তু করেন কেন পার্থবাবু?’
শম্ভু অন্যমনস্ক। একটা চাপা অস্বস্তি তার মুখচোখ ছেয়ে ফেলেছে। তখন বে-আব্রু অবস্হার হাল ধরতে তড়োঘড়ি বলে ওঠে, ‘আচ্ছা মুশকিল, বন্ধুকে আনলাম কোথায় চা-টা খাওয়ানো হবে, না। একি কাণ্ড, হ্যাঁ? ভেবেছিল বেচারা কটা দিন এখানে থাকবে, তা এমন করলে...’
চয়ন অপ্রস্তুত হন। ‘সত্যিই তো, কী অন্যায়, কিছু মনে করবেন না পার্থবাবু, থাকবেন বৈকি, নিশ্চয় থাকবেন...তখন বুঝবেন আমি কিন্তু মানুষ খারাপ নই। আপনার বন্ধুকে...’
পার্থ তাঁর মুখের কথা লুফে নিয়ে বলে, ‘শম্ভুর কথা বলছেন? ও তো আপনার নামগান করছে বলতে পারেন।’
মহিলা আরক্ত হন। পার্থর নজর এড়ায় না। সে কিন্তু তার কথার ওজন সম্পর্কে একেবারেই অবহিত না। দোষক্ষালনের জন্যে সত্বর বলে, ‘মাপ করবেন, যদি ভুল করে আপনাকে আঘাত করে থাকি তো; আমি কিন্তু কিছু ভেবে বলিনি। এমনি হঠাৎ। ও আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে’, বলেই চমকে ওঠে। এ কী কাণ্ড করছে সে পর পর? তার কি মাথা খারাপ? না হেসাডির অরণ্য, পরিবেশের বিধিবহির্ভূত অকপট, তাকে এহেন মুক্ত আর অসামাজিক কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ছিঃ ছিঃ!
তাই শুধরে নেবার জন্য শেষমেশ বলে বসে, ‘আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না কিন্তু, আমি সামাজিক কথাবার্তার বিশেষ একটা ধার ধারি নে। মুখে-মনে এক বলি। আমি বলতে চাই শম্ভু আপনাকে...’
‘অশেষ শ্রদ্ধা করে -- এই --তো? সে তো জানিই! আপনাকে আর ওর হয়ে সাউখুড়ি গাইতে হবে না। আপনি একটু বসুন ভাই, আমি এক্ষুনি আসছি। শোনো শম্ভু।’
পার্থ একাকী বসে নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকলো। শম্ভু গেলো বাইরে, সম্ভবত দোকানেই গিয়ে থাকবে।
চয়ন এসে বসলেন, ‘তারপর কী ভাবছিলে পার্থবাবু? তোমাকে তুমিই বলি। তুমি আমার চেয়ে অনেক ছোটো। তর্ক কোরো না, যা বলছি মেনে নাও।’
‘নিলাম, মেনে নিলাম। শুধু বলুন, আপনি কিছু মনে করেননি তো? আমি এখনো পর্যন্ত ঠিক গুছিয়ে কথা বলতে শিখলুম না। আপনি যদি কিছু মনে করে থাকেন তো---’
‘যদি করেই থাকি। তবে তোমার কি ক্ষতিবৃদ্ধি পার্থবাবু? তুমিই বলো, মনে করা আমার উচিত কিনা।’
‘করতে পারেন। আমার সত্যিই কিছু বলার নেই। আমার মাথাটা---’
‘তোমার মাথাটা খারাপ নয় তেমন, তবে কি জানো ভাই, এক বিবাহিতা মহিলার নামগান যদি তাঁর অতিবড়ো ভক্তেও করে, ব্যাপারটা সত্যি হলে, নিছক ইয়ার্কির খাতিরেও বলা যায় না। আমি শম্ভুকে ভালোবাসি।’
এমন স্পষ্ট আর সদম্ভ উক্তি পার্থ জীবনে শোনেনি। বই-এ পড়েছে ক্বচিৎ-কখনো। রক্তমাংসের সাধারণ এক গৃহস্হবধু স্বল্পশিক্ষিত মনের মধ্যে, স্বামী ছাড়াও আরেকজনের জন্যে সযত্নে সিংহাসন পেতে রেখেছেন। পার্থর মহিলাকে প্রণাম করতে ইচ্ছা হয়েছিলো। ভাগ্যিস, এমন খেলো একটা কাজ সে তড়িঘড়ি করে বসেনি। সন্মান প্রদর্শনের বদলে ব্যাপারটা এমন কুৎসিত হয়ে দাঁড়াতো।
চয়ন বললেন, ‘পার্থবাবু আমার নাটক করার ইচ্ছে নেই, নতুবা গল্পে যেমন হয় আমি ছেলেমেয়ে স্বামী বিসর্জন দিয়ে শম্ভুর হাত ধরে বলতাম, চলো শম্ভু এবার নতুন রকমের জীবনে ঢুকি। এমন ঘটনা কি আর হয় না? আখছার হচ্ছে আজকাল। তবে আমি বলবো, এ সবই হচ্ছে মোহ থেকে -- ভালোবাসা থেকে নয়। আমি আমার স্বামী জ্যোতিকে অসম্ভব ভালোবাসি। তাঁর ছেলেমেয়েকেও। তিনিও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন না, আমি জানি।’
‘শম্ভুর কথা --’
‘হ্যাঁ, এও তিনি জানেন। তাঁকে আমিই বলেছি। তিনিও শম্ভুকে ভালোবাসেন খুব। তিনি কারিগরি কাজের মোটা মানুষ, ভেবেছেন হয়তো স্ত্রীর মধ্যে যে সূক্ষ্ম আবেগ-অনুভূতিগুলো রয়েছে সেগুলোর সাহচর্য দিতে যদি কেউ এগিয়ে আসে, কেউ যদি স্ত্রীর মানসিক সহায় হয়, তাতে আপত্তির কী আছে? এর ফলেই না উভয়ত স্বাস্হ্য বজায় থাকবে। তাঁর কোনো আপত্তি নেই আমাদের এই আলাপচারিতায়, সহযোগে। তিনিও, এখানে এলে আমাদের মধ্যে বসে থাকেন।’
‘ভারি অদ্ভুত তো? আশ্চর্য!’
‘অদ্ভুত কিছুই নয় পার্থবাবু, এ হলো সাদামাটা বাঁচার বিলিব্যবস্থা। নয়ন কিন্তু আমার এ-ব্যাখ্যা মানে না...’
পঞ্চম পর্বে সনাতন (সন্দীপন) সম্পর্কে হেসাডির জঙ্গলের ঘটনা লিখছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়:
সনাতন যে কাণ্ড করেছিলো তা সত্যিই অলৌকিক। অলৌকিক মানে, মানুষের অসাধ্য। এক কথায় বলতে হয়, সনাতন লেমসার মাকে তার অস্তমান যৌবন-স্মৃতির একটি টুকরো উপহার দেয়।
বারান্দায় বসে পার্থ লক্ষ্য করছিল সবই। শুধু এক শ্বাসরোধী আতঙ্কে কোনো কথা বলেনি। বাধাও দেয়নি। কথা বললে কী হতো বলা যায় না। হয়তো কিছুই হতো না। কারণ সনাতন জানতো পার্থ টের পাচ্ছে…
নানা প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত পার্থ, সনাতন কখন এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। হঠাৎ চমকে ওঠে, ‘এত কী ভাবছিস পার্থ?’
পার্থ কিছু উত্তর করে না। মুখ নিচু করে বসে থাকে।
সনাতন বলে, জানি তুই কী ভাবছিস। কিন্তু ঘেন্নার কাজ আমি কখনো করিনি তুই জানিস। তাছাড়া, এক্ষেত্রে অহল্যার মতো এক পাষাণ প্রতিমাকে স্পর্শ করলুম। আমার পূণ্যই হলো। ঐ অশিক্ষিতা স্ত্রীলোক কি কথা বললো জানিস। তুমি তোমার বন্ধুর কাছে ছোটো হয়ে গেলে না তো ? আমার বড়ো উপকার করলে তুমি ---জেনানা লোকের এ যে কতো বড়ো উপকার --- সে তুমি বুঝবে না।
সনাতনই একটানা স্বপ্নে, ফিসফিসিয়ে বলে গেলো লেমসার মায়ের অতীত।
ওর স্বামীও ছিলো এমন চৌকিদার। সেসময়ে ওরা বুঝি থাকতো চাইবাসার সদর শহরে। বাংলোয় লোকজনের ভিড় লেগে থাকতো সদাসর্বদাই। ওর স্বামী, স্ত্রীর যৌবনের উপাসক একেবারেই ছিলো না। অহোরাত্র নেশায় চুর হয়ে থাকতো। সেই নেশার ঘোরে স্ত্রীকে তুলে দিয়ে আসতো বাংলোর ঘরে। প্রথম প্রথম অভিমান হতো ওর। হোক না আদিবাসী … তাই বলে কি রেণ্ডির মতন এর তার সঙ্গে শুতে হবে।
সুতরাং ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত দুই পৃথক নেশাতে গিয়েই দাঁড়ালো। স্ত্রীর এক, স্বামীর অন্য। …
ম্লান হাসে পার্থ। সেই হাসি দেখে সনাতন আরো উত্তপ্ত হয়ে পড়ে।
‘নিজেকে আর কত ভুল বোঝাবি সনাতন? তোর শরীর তোর ওপর প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। যতই ব্যাপারটা অন্যভাবে নিস, আমি বলবো--’
কথাটা পার্থ শেষ করতে পারলো না, সনাতন মুষ্টি একত্র করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর।
( চতুর্থ পর্বে সনাতনের চাকরি সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছেন শক্তি : “ও মাসের প্রথম দিকটায় দু-এক দিনের জন্য অপিস যায়। তখন মাইনে পাবার সময় কিনা । কাজ করে কর্পোরেশানে। ঘুষের সুযোগ আছে বলে ওর সহকর্মীরাই হামলে পড়ে সনাতনের কাজটুকু করে। সনাতনের ঘুষ নিতে নীতিতে বাধে না, ও নিশ্চিত জানে ঘুষঘাস নিতে গেলেই কাজের দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। তার বদলে ঘুষের খাতা সহকর্মীদের হাতে তুলে ও মাসমাইনে নিয়েই বিষম তৃপ্ত।)
তেরো আর চোদ্দো পর্বে শম্ভু ময়নকে বিয়ে করল; চয়ন সে বিয়েতে উপস্হিত থাকতে চায়নি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন :
নয়ন বলছে পার্থকে, ‘তারপর আবার কী? হ্যাঁ-হ্যাঁ একটা সুখবর আছে। তোমাকে শম্ভুদা নিশ্চয় জানাবে। ময়ন, মানে মেজদি আর শম্ভুদার বিয়ে যে গো!’
‘অ্যাঁ? সত্যি বলছো?’
‘সত্যি সত্যি সত্যি তিন সত্যি। কার্ড পাঠাচ্ছি তোমার নামে। এই আসছে হপ্তায় পাবে। আর দিদিটা জানো কি কেলেঙ্কারি করেছে? ও তো একদম রাউরকেল্লা চলে গেছে, আবার লিখেছে ঐ সময়ে আসতে পারবে না। কী যেন একটা ঝঞ্ঝাটের কথাও লিখেছে বাপু। তা তুমি আসছ তো? এই? আমার অনেক বন্ধুকে বলেছি...তারা তোমাকে দেখতে চায়। কি অসভ্য দ্যাখো।’
…..
শম্ভুর বিয়ের চিঠি এসেছে। খুব আশ্চর্য, সে ময়নকে উদ্ধার করতে চলেছে। এই বাড়িতে সে নিজেকে পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ভালো কথা। পার্থর কাছে এ-চিঠির একদিন প্রচণ্ড মূল্য ছিল। আজ এর দাম কানাকড়িও না। সে নিজেকে সব কিছু থেকে সরিয়ে নিয়েছে।
শম্ভু লিখেছে, ময়নের প্রতি পার্থর যে মনোভাব সে কারুর অজানা নয়। না এলে ময়ন ভীষণ দুঃখ পাবে।
ইনিয়ে বিনিয়ে শম্ভু লেখে বেশ। মাছের খবরদারি না করে যদি উপন্যাস-টুপন্যাস লিখতো তাহলে বাজারে কাটতো ভালো। কিন্তু বাপু, পার্থর কাছে আজ আর কিছু কাটবে না। পার্থ অনেক সাবধান হয়ে গেছে আজ। কোনো কিছুই তাকে টলাতে পারবে না।
শেষ পর্যন্ত কেন তাহলে বিচ্ছেদ? শক্তি ইঙ্গিত দিয়েছেন, শম্ভু আর ময়নের ভূমিকার:
শম্ভু আর ময়ন দুজনেই মুকুট নামে একজনের কথা পার্থকে বলেছেন। তার মাধ্যমে চিড় ধরিয়েছেন পার্থ আর নয়নের সম্পর্কের মাঝে। পার্থর সেসময়ে চালচুলো ছিল না, চাকরি করতেন না, মদ খেতেন, এই সব কারণেই হয়ত শেষ পর্যন্ত নয়নের বাবা-মা সম্পর্কের অনুমোদন দেননি। প্রকৃত কী ঘটেছিল তা স্পষ্ট করে জানায়নি পার্থ, নয়নকেই হয়তো তাহলে দায়ি করতে হতো।
ঘটনা হল যে স্নাতকোত্তর পড়াবার অজুহাতে নয়নকে পার্থর সংস্পর্শ থেকে দূরে পাটনায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল শম্ভুদের বাড়িতে।
পার্থ আর কোনোদিন চাইবাসা ফেরেনি।
1 comments: