0

সম্পাদকীয়

Posted in



সম্পাদকীয়


ক্যালেন্ডার যেই সবেমাত্র বর্ষার বিদায় ঘোষণা করতে আরম্ভ করেছে, ওমনি, এ কি রে বাবা... আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এবং কয়েক ঘন্টায় পুরো শহর টইটম্বুর! বেচারা ক্যালেন্ডারেরই বা কি দোষ? সে না দ্যাখে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল, না পায় আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের খবর। এমনকি সম্প্রতি রাষ্ট্রসঙ্ঘের যে সমীক্ষা বলছে পৃথিবীর পরিমণ্ডলে স্বাভাবিকভাবে শ্বাসগ্রহণযোগ্য বাতাসের মেয়াদ বড়ো জোর আর তিন দশক, সেই সমীক্ষার খবরও বেচারা ক্যালেন্ডার রাখে না।

অবশ্য তাতে আমাদের ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ভারতবর্ষ এগোচ্ছে। ইসরোর চন্দ্রযান চাঁদের মাটিতে নামলো বলে। ভারতবর্ষ ছাড়া আর যে সাতটি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা চন্দ্রাভিযান করেছে, সেই অ্যামেরিকা, রাশিয়া, ইওরোপীয় জাতিসঙ্ঘ, চীন, জাপান এবং ইসরায়েল উন্নত অর্থনীতি হিসেবে পরিগণিত। সুতরাং আমাদের চন্দ্রযানের চন্দ্রাবতরণের সঙ্গে সঙ্গেই যে দেশের অর্থনীতির ‘দানবিক উল্লম্ফন’ ঘটবে, তাই নিয়ে নিশ্চয়ই আপনাদের কারও কোনও সন্দেহ নেই! থাকলে এই মুহূর্তে সে সব দূর করুন। নিশ্চিন্তে থাকুন এবং মন দিয়ে আদার ব্যাপার করুন।

আরও আনন্দসংবাদ হলো, এবার কাশ্মীরিরাও নিশ্চিন্তে আদার ব্যাপার করতে পারবে। যে অগণতান্ত্রিক ৩৭০ ধারা এতদিন তাদের সেটা করতে দিচ্ছিলো না, তা এবার সমূলে উৎপাটিত। আর কোনও চিন্তা নেই। পাকিস্তানকে কদলী প্রদর্শন করে কাশ্মীর এবার ভারতকে আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে বসাবার জন্য সবেগে ধাবিত হবে। খালি সেদিন যে কার্টূনটা দেখলাম – একটা বাড়িতে আগুন লেগেছে... দাউ দাউ করে বাড়িটা জ্বলছে... তার ভিতরে আটকে পড়া লোকজনের আর্তনাদ ভেসে আসছে... আর বাইরে কারা যেন অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে দেওয়ালের একটা ফাটল সারাচ্ছে – এইরকম কার্টূন-আঁকিয়েদের অবিলম্বে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিলেই আমাদের আশু অগ্রগতির পথ নিষ্কন্টক!

যাই হোক...ঋতবাকের পঞ্চম বর্ষ পূর্ণ হয়ে ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হলো। এখন এসব জাহাজের খবরে আমাদের কাঁচকলা! আমরা মন দিয়ে সাহিত্যচিন্তা-রূপী আদার ব্যাপার এবং বিনিময় করতে থাকবো। সঙ্গে থাকবেন। ভালো থাকবেন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সৌম্য ব্যানার্জী

Posted in

প্রচ্ছদ নিবন্ধ


স্বর্ণযুগ
সৌম্য ব্যানার্জী


সেদিন সংবাদে দেখলাম, ভারতবর্ষ নাকি ২০১৮ থেকে demographic dividend-এর এক সোনালী সময়কালে প্রবেশ করেছে, যার মেয়াদ আগামী সাঁইত্রিশ বছর! ব্যাপারটা খায় না মাথায় মাখে বোঝার জন্য সংবাদটা খুঁটিয়ে পড়লাম। বিষয়টা ভারতবর্ষের বর্তমান জনসংখ্যার বয়সবিন্যাস সংক্রান্ত। গত বছর থেকে ভারতবর্ষের জনসংখ্যার সিংহভাগ নাকি কর্মক্ষম বয়সে উপনীত হয়েছে। ১৪ বছরের নীচে আর ৬৪ বছরের উপরে যাদের বয়স, অর্থাৎ যারা জীবনধারণের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল, তারা এখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। যার অর্থ, ভারতবর্ষের কর্মক্ষম জনসংখ্যার অনুপাত এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ!

এই সোনালী সংবাদ কিন্তু কোনও সরকারি প্রতিবেদন বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘোষণা নয়। রীতিমতন রাষ্ট্রসঙ্ঘের জনসংখ্যা তহবিলের (UNFPA – United Nations Population Fund) নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী নির্ণিত পরিসংখ্যান, যার মূল উপপাদ্য হলো একটি দেশের জনসংখ্যার বয়সবিন্যাসে পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে সেদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা। এই পরিবর্তন আসে দেশের মানুষের গড়পড়তা আয়ু সুস্থির (stabilisation of life expectancy) হওয়ার পর যখন সামগ্রিক উর্বরতা (TFR – Total Fertility Rate) কমতে থাকে, অর্থাৎ নারী পিছু শিশুর সংখ্যা হ্রাস পায়। সাম্প্রতিক অতীতে এই জাতীয় উন্নয়নের সাক্ষী জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া বা থাইল্যান্ডের-এর মতন তাবড় তাবড় দেশ। এদের মধ্যে জাপানে প্রথম এই স্বর্ণযুগের সূচনা হয় ১৯৬৪ সালে। পরিসংখ্যান বলছে, তৎপরবর্তী দশ বছরের মধ্যে পাঁচ বছর জাপানি অর্থনীতির বাৎসরিক বৃদ্ধির হার ছিলো দুই অঙ্কের, যে কোনও উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য যা বিরাট কৃতিত্বের বিষয়। এই কিছুদিন আগে, ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাপান এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড-এর সুবিধা ভোগ করেছে। তারপর সামাজিক ও প্রাকৃতিক নিয়মে আবার তাদের জনবিন্যাস পাল্টে গেছে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড বা ব্রাজিলের মতন দেশগুলি বর্তমানে এই স্বর্ণযুগের মধ্যে দিয়ে চলেছে। এমন কি বাংলাদেশের জনবিন্যাসেও ভারতবর্ষের সঙ্গে সঙ্গেই ২০১৮য় এই বিবর্তন ঘটে গেছে। ইউ.এন.এফ.পি.এ-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী তৈরি নীচের তালিকাটা থেকে বিভিন্ন দেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড-এর মেয়াদকাল বোঝা যাবে:-
সুতরাং, যতই আপনি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্দিহান হন বা নাক সিঁটকান, মানতে আপনি বাধ্য যে অদূর ভবিষ্যতে ভারতীয় অর্থনীতির হুড়মুড়িয়ে উন্নয়ন অবশ্যম্ভাবী।

কিন্তু এখানে একটা ‘কিন্তু’ আছে। কিন্তু সেই ‘কিন্তু’তে প্রবেশ করার আগে বর্তমান সময়টার একটা পর্যালোচনা করা দরকার। ১৯৬৪র কথা ছেড়েই দিলাম, ১৯৯৪তেও পৃথিবীটা যেরকম ছিলো, আজ তার থেকে অনেকটাই অন্যরকম। প্রযুক্তিগত মহাবিপ্লব ঘটে গেছে গত তিন দশকে। অনেকখানি পরিবর্তন ঘটেছে মানুষের সমাজচেতনাতেও। আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সমাজচেতনাও উন্নীত হবে। হয়েছে কিনা, সেটা সমাজতাত্ত্বিক এবং অবধারিতভাবে রাজনৈতিক তর্কসাপেক্ষ। তবে সেই তর্কে না গিয়েও এটা বোধহয় বলাই যায় যে, সম্প্রতি সারা বিশ্বেই মানুষের অস্থিরতা বাড়ার এবং সহনশীলতা কমার যে ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সেটা কোনও শান্তিপ্রিয়, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্যই খুব স্বস্তিদায়ক হতে পারে না। এর জন্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ জাতীয় সাম্প্রদায়িক বিভাজকগুলোকে দায়ী করা যেতেই পারে। ইতিহাসের আদিকাল থেকেই এরা সাম্যের চাইতে বেশি বিভেদ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু সে তো চিরকালীন সমস্যা, এবং সে সমস্যা যেন ধীরে ধীরে কিছুটা কমেও আসছিলো। অন্তত নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকেও সেরকমটাই মনে হতো। তারপর হঠাৎ হলো কি?

আপনি হয়তো বলবেন, আরে ওই সময়টাই তো ধর্মীয় মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো! ঠিক কথা। উঠলো যে, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঠিক ওই সময়েই কেন উঠলো? একটা কিছু trigger factor তো কাজ করেছে তার পিছনে! সেটা কি?

আবার ভেবে দেখুন... প্রযুক্তি-বিপ্লব জিনিসটা পূর্ণগতি লাভ করেছিলো ওই নব্বইয়ের গোড়াতেই। প্রচারমাধ্যম, সংযোগমাধ্যমের রমরমা শুরু হয়েছিলো ওই সময়েই। প্রথমে কেবল টিভি, তারপর একে একে কম্পিউটার আর মোবাইল ফোন ছেয়ে ফেললো বাজার। পৃথিবী মোটামুটি হাতের মুঠোয় এসে গেলো সাধারণ মানুষের, এবং সেই সঙ্গে শুরু হলো কর্মক্ষেত্রে কম্পিউটার-চালিত স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার, যাকে বলে large scale automation।

হয়তো আপনাদের কারও কারও মনে পড়বে যে এই প্রযুক্তিগত উল্লম্ফনের পর পরই চাকরির বাজারে একটা ঘটনা ঘটতে শুরু করে। সেটা যে তার আগে হয়নি, তা নয়। কিন্তু এই সময়ে তার ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। ঘটনাটা হলো VRS: Voluntary Retirement Scheme, স্বেচ্ছাবসর প্রকল্প। এটা সেই সময়ে ঘটে মূলত উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোতে, যেখানে কারখানাকর্মীদের বিকল্প হিসেবে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ব্যবহার দ্রুতগতিতে বাড়ে। প্রচুর মানুষ সেই প্রকল্পের আওতায় এককালীন থোক টাকা নিয়ে স্বেচ্ছাবসর নেন। অনেকে বাধ্য হন নিতে। মোটের উপর, সেই শুরু হয় মানুষের বিকল্প হিসেবে যন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার।

ব্যাপারটাতে এখন আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগের যে কোনও ব্যাঙ্কের শাখার কথা ভাবুন... কম পক্ষেও কুড়ি-পঁচিশজন লোক কাজ করতো একেকটা শাখায়। এখন সেটা এসে দাঁড়িয়েছে আট-দশে। কোথাও কোথাও আরও কম। যাঁরা internet banking-এ অভ্যস্ত, তাঁদের আজকাল আর এটিএম-এই যেতে হয় না, শাখা তো দূরস্থান। ব্যাঙ্কগুলোও আজকাল তাদের গ্রাহকদের শাখায় যেতে খুব একটা উৎসাহ দেয় না। সুতরাং, এটা বোঝা যাচ্ছে যে কর্মীসংখ্যা সংকোচন শুধু উৎপাদনের ক্ষেত্রে আর সীমিত নেই। পরিষেবা ক্ষেত্রেও বেশ ভালোরকমভাবেই শুরু হয়ে গেছে। নির্দিষ্ট কোনও সংস্থায় একসঙ্গে কয়েক হাজার কর্মীর বরখাস্ত হওয়া আজকের দিনে আর খুব বিস্ময়কর ঘটনা নয়।

এই ব্যাপারটার আঁচ সেরকম মারাত্মকভাবে যে আমাদের অর্থনীতির উপর এতদিন পড়েনি, তার কারণ সমান্তরালভাবে কিছু নতুন নিয়োগের সৃষ্টি হওয়া, যা প্রধানত হয়েছে তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে। রাতারাতি গজিয়ে ওঠা সফ্টওয়্যার আর মোবাইল পরিষেবা সংস্থাগুলো একসঙ্গে বহু লোকের কর্মসংস্থান করেছিলো একসময়ে। কিন্তু আজকের পরিস্থিতিটা অন্যরকম। ছোট এবং মাঝারি মাপের সফ্টওয়্যার কম্পানিগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেছে, এখনও যাচ্ছে। প্রতিযোগিতার চাপে মোবাইল সংস্থাগুলোরও নাভিশ্বাস উঠছে। অদূর ভবিষ্যতের চাকরির বাজার সম্বন্ধেও একমাত্র ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলি ছাড়া আর কারও ভবিষ্যদ্বাণীই বিশেষ আশাব্যঞ্জক শোনাচ্ছে না... এবং সেটাই স্বাভাবিক, কারণ অদূর ভবিষ্যতে অতি দ্রুত এবং অতি ব্যাপক হারে কর্মক্ষেত্রে মানবমস্তিষ্কের জায়গা দখল করতে চলেছে যে বস্তুটি, তার নাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।

AI বা Artificial Intelligence কিন্তু আজ আর রকেট বিজ্ঞান নয়। গুগল, ফেসবুক, ইন্স্টাগ্র্যাম, স্মার্ট ফোন, স্মার্ট টিভি, কন্ঠ-নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিগত সহায়ক(অ্যামাজন একো-র মতন) জাতীয় নানা ধরণের নিত্যব্যবহার্যের সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন আমরা তার উপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠছি এবং যত দিন যাবে, তত বেশি উঠবো। বস্তুত, যে গবেষণার পিছনে এই মুহূর্তে পৃথিবীতে সব থেকে বেশি অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে, সে গবেষণা এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত। তাই AI দিনে দিনে আরও বেশি বুদ্ধিমান হয়ে উঠছে। চিকিৎসাক্ষেত্রে তার ব্যাপক ব্যবহার আজ সর্বজনবিদিত। সমাজমাধ্যমগুলি এ.আই-এর সাহায্যে যেভাবে কোটি কোটি মানুষের চরিত্র আর চাহিদা প্রায় নির্ভুলভাবে প্রতিনিয়ত বিশ্লেষণ করছে ও সেই তথ্য তাদের বিজ্ঞাপনদাতাদের জুগিয়ে চলেছে, তাও আজ আর খুব বেশি বিস্ময়ের উদ্রেক করে না। সফ্টওয়্যারের তৈরি ধ্রুপদী সঙ্গীতের কথাও হয়তো আপনারা অনেকে শুনেছেন, যে সঙ্গীত প্রথমটা অনেক বড় বড় বোদ্ধাকে রীতিমতন চমকে দিয়েছিলো। কিন্তু সম্ভবত আপনারা অনেকে অবাক হবেন শুনে যে সফ্টওয়্যারের লেখা যে সব কবিতা গত এক দশক ধরে ইওরোপ-অ্যামেরিকার সাহিত্যজগতে ঝড় তুলছে, সেগুলি বেশ কিছু বিশিষ্ট ‘মানবতাবাদী’ কবির রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে! এ প্রসঙ্গে botpoet.com জাতীয় ওয়েবসাইটগুলি দ্রষ্টব্য। বিশেষ করে এই ওয়েবসাইটটিতে একটি চিত্তাগ্রহী guessing game আছে – কোন কবিতাটি মানুষ কবির লেখা আর কোনটি যন্ত্রকবির, তাই নিয়ে। হলপ করে বলতে পারি, অবাক হবেন।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে শুধুমাত্র যান্ত্রিক উৎপাদন, তথ্য বিশ্লেষণ বা তার সফল প্রয়োগে নয়, যে বিষয়ে এতদিন মানুষের মৌরসীপাট্টা ছিলো, সেই বৌদ্ধিক সৃজনশিল্পেও এবার তার প্রতিযোগী এসে গেছে... এবং এও স্বতঃসিদ্ধ যে এই প্রতিযোগিতা দিনে দিনে যত বাড়বে, মানুষের নিরাপত্তাবোধ ততই বিপন্ন হবে।

এই সমাজচিত্র তিন দশক আগে সেই নব্বইয়ের গোড়াতে অবশ্যই ছিলো না, কিন্তু উৎপাদনক্ষেত্রে ব্যাপক হারে স্বয়ংক্রিয়-করণের পরিপ্রেক্ষিতে এর আভাস একটা পাওয়া যাচ্ছিলো বটেই... এবং বিপদের একটা আঁচ পাওয়া যাচ্ছে অথচ সে বিপদটা ঠিক কিরকম হতে পারে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না – এইরকম পরিস্থিতিই সম্ভবত সব চাইতে অস্বস্তিকর। সেইরকমটাই হয়েছিলো সে সময়ে। বহু সরকারি-আধাসরকারি-বেসরকারি সংস্থায় কম্পিউটারাইজেশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ধর্মঘট, ইত্যাদিও হচ্ছিলো। তাতে ঘটনাটাকে একটু বিলম্বিত করা গেলেও আটকানো যায়নি। যায়ও না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতির অবধারিত ফলস্বরূপ সামাজিক বিবর্তনকে আটকানোর প্রচেষ্টা যে বাতুলতা মাত্র, সে বিষয়ে আজ আর কারও কোনও সন্দেহ থাকা উচিত নয়।

তবে সমস্যা হলো, একটা সমাজ এবং তার সংশ্লিষ্ট অর্থনীতি যখন অতি দ্রুত বিবর্তিত হয়, যেমনটা এখন ভারতবর্ষের মতন উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলি হচ্ছে, তখন তার গতির সঙ্গে তাল রাখা সে সমাজের অল্পশিক্ষিত আমজনতার পক্ষে মানসিকভাবে বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তারা না জানে অর্থনীতির অং-বং-চং, না বোঝে বিজ্ঞানের হিং-টিং-ছট! শুধু অবাক বিস্ময়ে দেখে, চিরাচরিত ধ্যানধারণাগুলো রাতারাতি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়ে চোখের সামনে নাকের ডগায় এমন সব তাজ্জব ব্যাপার-স্যাপার ঘটতে লেগেছে, যা কোনওদিন কল্পনাই করা যায়নি... এবং সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে তাদের নিরাপত্তাবোধের অভাব এবং অনিশ্চয়তা, যে পরিস্থিতি পেশাদার রাজনৈতিক নেতাদের জন্য একেবারে সুবর্ণ সুযোগ। তাঁদের ব্যবসার মূলধনই তো ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে মানুষের অনিশ্চয়তা!

এখানে সে প্রসঙ্গের অবতারণা নিরর্থক। আমাদের বর্তমান আলোচনা ভারতের জনতাত্ত্বিক স্বর্ণযুগের আগমনপথের মাঝখানে যে ‘কিন্তু’টা হিমশীতল দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে নিয়ে। তার নাম ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার উল্লিখিত হয়েছে। সে নাম – কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আর্টিফশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। দিনে দিনে তার বুদ্ধি বিকশিত হচ্ছে। ঈশ্বরের সৃষ্টিই বলুন বা প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফল, মস্তিষ্ক নামক প্রাণীদেহের যে অত্যাশ্চর্য অঙ্গটির পরমতম বিকাশের আধার হিসেবে মানুষের এতদিনের অহঙ্কার, তা আজ বিপন্ন। অদূর ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে মানুষের কর্মযোগের কতখানি অংশের কাণ্ডারী হয়ে বসবে, একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই তার একটা মোটামুটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া আজ আর খুব কঠিন নয়… এবং সেই ধারণাটা আমাদের ক্রমবর্ধমান চাকরিনির্ভর জনসংখ্যার জন্য বেশ খানিকটা দুশ্চিন্তার কারণ তো বটেই। 

তাই বলছিলাম যে, আগামী সাঁইত্রিশ বছর ব্যাপী ‘জনবিন্যাস মুনাফা’র যে স্বর্ণযুগে আমরা প্রবেশ করতে চলেছি, তার বিষয়ে আশাবাদী হতে কোনও দোষ নেই। পর্যাপ্ত সংখ্যায় সক্ষম কর্মী যে কোনও অর্থনীতির জন্যই সবিশেষ আনন্দের কথা। কিন্তু যদি সেই কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমানে কাজই না থাকে, তাহলে? কারখানা বা দপ্তরের নিয়মিত কাজের কথা ছেড়েই দিলাম... চিকিৎসা, ওকালতি (সম্প্রতি ওয়াশিংটনের নামজাদা আইন সংস্থা বেকার হোস্টেটলার ‘রস’ নামক একটি এ.আই. সফ্টওয়্যারের নামে ওকালতির লাইসেন্স নিয়েছে। আপাতত সে আইনজীবীদের সাহায্য করবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতে নামলে তাকে মামলায় হারানো কোনও মানুষ আইনজীবীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব হবে) বা শিল্পসৃষ্টির মতন একান্তই মনুষ্যোচিত কাজগুলিও যেরকম উৎকর্ষের সঙ্গে বুদ্ধিমান সফ্টওয়্যার করছে, তাতে কোনও সংস্থার পক্ষে এই সব কাজের জন্য মানবকর্মীর চাইতে রোবটকর্মী নিয়োগ করাই শ্রেয় মনে হওয়া স্বাভাবিক... বিশেষ করে যেখানে রোবটকে নিয়মিত মাইনে দিতে হয় না এবং তার কোনও integrity issue বা সততা বিষয়ক সমস্যাও থাকে না।

আমি বলছি না যে কালই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা চাকরির বাজার খেয়ে নেবে। তার জন্য সময় লাগবে। তবে সে সময় অফুরন্ত নয়। ভেবে দেখুন, আমরা মনে করেছিলাম পরিবেশ দূষণে পৃথিবীর কন্ঠরোধ হতে এখনও অনেক দেরি আছে। ততদিনে মানুষ উপায়ান্তর বার করে ফেলবে। কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর নাভিশ্বাস অস্পষ্টভাবে হলেও শোনা যাচ্ছে এবং নিকট ভবিষ্যতে তাকে সুস্থ করে তোলার কোনও উপায়ও দেখা যাচ্ছে না। আসলে শুধুমাত্র বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নয়, মানুষের বিপুল সংখ্যাস্ফীতির কারণেও সামাজিক বিবর্তনের গতিটি অতিমাত্রায় ত্বরান্বিত হয়ে পড়েছে। সে গতির সঙ্গে তাল রাখা আমাদের পক্ষে প্রতিদিন আরও কঠিন হয়ে উঠছে। দুরূহ হয়ে উঠছে অদূর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও সম্যক ধারণা করা। তাই, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড-এর স্বর্ণযুগের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও আমাদের কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে... ভবিষ্যতের অত্যুন্নত পৃথিবীতে আমাদের মতন সাধারণ ছা-পোষা মানুষদের কতখানি প্রয়োজনীয়তা থাকবে? আদৌ থাকবে কি? নাকি অর্থনৈতিক শোষণের যুগ পার হয়ে এসে মানুষ এবার এক সম্পূর্ণ নতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে চলেছে, যার নাম অর্থনৈতিক অপ্রাসঙ্গিতা...?

2 comments:

2

প্রবন্ধ - সুশীল সাহা

Posted in

প্রবন্ধ


‘ক্ষুধার্ত’ লেখক, একাকী মানুষ
সুশীল সাহা


[ষাটের দশকের ‘ক্ষুধার্ত’ (হাংরি) আন্দোলনের কথা হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন। এ রকম সাহিত্য আন্দোলন বাংলায় তেমন একটা হয়নি। ওই আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন বাসুদেব দাশগুপ্ত। ৩১আগস্ট তাঁর প্রয়াণ দিবস। সে কথা মনে রেখেই এই একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতিকথন।]

মার্চ, ১৯৭০। আমি তখন সবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে থিতু হয়েছি। মনের ভিতরে তখন অনন্ত ক্ষুধা। কত কী জানার ইচ্ছে মনের ভিতর। তখন ও-দেশে বসেই উল্টোরথ, জলসা, ঘরোয়া, সিনে আডভান্স জাতীয় পত্রিকা পড়ে এখানকার লেখালিখি, সাংস্কৃতিক জগৎ সম্পর্কে যা একটু সামান্য ধারণা আমার। আর আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত নানা রকম অনুষ্ঠান শুনে শুনে অর্জন করেছিলাম কিছু কিছু। এখানে এসে দেখলাম, আমার সঞ্চয় খুবই অল্প। আমার জানার বাইরেও রয়ে গেছে একটা বড় অজানা জগৎ। হয়তো এখনও সেই অজানা জগতের অনেক কিছুই অধরা রয়ে গেছে। তবু তখনকার অজ্ঞতা ছিল অপরিসীম।

একটু একটু করে সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক বাড়ছিল। লেখালিখিও শুরু করেছিলাম। সেটা বেশ বাড়ল, ছোট মামার সৌজন্যে উল্টোডাঙা অঞ্চলের এক সাহিত্যপত্রিকার সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়ে।সেটা ঘটেছিল আমার এই দেশে আসার মাস তিনেকের মধ্যেই। পত্রিকার নাম ‘নবাহ’। ছ’জনের সম্পাদকমণ্ডলীতে অনতিবিলম্বে আমার নাম যুক্ত হয়ে সাতজন হল। আমিই কনিষ্ঠ, এবং বেকার। অবিলম্বে ঘাড়ে চাপল অনেক কাজের বোঝা। লেখকদের বাড়ি থেকে লেখা সংগ্রহ করে আনা, প্রেসে যাওয়া, প্রুফ দেখা, বিভিন্ন জায়গায় পত্রিকা পৌঁছে দেওয়া, সাহিত্যসভার আয়োজন করা, সর্বোপরি নানা জায়গা থেকে আসা চিঠিপত্রের জবাব দেওয়া। তখনই টের পেলাম, গায়ে একটা পত্রিকা সম্পাদকের তকমা থাকলে লেখক হওয়ার একটা বিরল সুযোগ জোটে। নানা জায়গা থেকে লেখা আসত, অধিকাংশই কবিতা, সঙ্গে চিঠি এবং লেখা চেয়ে আবেদন, ‘আপনার একটি লেখা পাঠান’, অর্থাৎ ‘লেখক হতে সাহায্য করুন, সাহায্য নিন’। ‘হেল্প আস টু হেল্প ইউ’। সেই আমার লেখকজীবনের শুরু। অনেক জায়গায় অনেক লেখা পাঠানোরও শুরু ওই সময় থেকেই। পাশাপাশি শুরু নানা রকম লেখার পঠনপাঠন। এর সূত্রেই অন্য রকম এক লেখকের সন্ধান পেলাম, তাঁর নাম বাসুদেব দাশগুপ্ত। ‘হাংরি জেনারেশন’ দলের অন্যতম পুরোধা।

বাসুদেব দাশগুপ্ত সম্পর্কে আমাকে প্রথম আগ্রহী করে তোলেন কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত। তাঁর একটি লেখায় তিনি তখনকার তরুণ লেখকদের একটা মূল্যায়ন করেছিলেন। অনেকের সঙ্গে তিনি বাসুদেববাবুর লেখা সম্পর্কেও কয়েকটি কথা লিখেছিলেন। এক জায়গায় লিখেছিলেন, ‘সবচাইতে টাওয়ারিং হাইটে আছেন বাসুদেব দাশগুপ্ত’। এই একটি বাক্যই আমাকে প্রবল ভাবে ওঁর সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। এত দিন পরেও ওই বাক্যটি আমি হুবহু মনে রেখে দিয়েছি। পঞ্চাশ বছর তো হতে চলল প্রায়।

তখন আমার একটা অভ্যেস ছিল জোড়া পোস্টকার্ডে নানান জনকে চিঠি লেখা। এই অভ্যেসটা আমি আমার জন্মভূমি থেকে নিয়ে এসেছিলাম। এক দিন ঠিকানা জোগাড় করে বাসুদেব দাশগুপ্তকে চিঠি লিখলাম।তখনও আমি জানতাম না অশোকনগর জায়গাটা একেবারে হাবড়ার গায়ে। হাবড়ায় তখন আমার এই বঙ্গের স্থায়ী ঠাঁই। অবশ্য আমি তখন থাকি উল্টোডাঙায় ছোট মামার আশ্রয়ে। যা হোক, এক দিন বাসুদেববাবুর উত্তর এল। এই চিঠির সূত্র ধরেই এক দিন তাঁর কাছে গেলাম। এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করলেন আমার আর এক সুহৃদ, অধ্যাপক গৌরীশংকর দে। তিনিই আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন বাসুদেববাবুর অশোকনগরের বাড়িতে। প্রথম আলাপেই ভাল লেগে গেল মানুষটাকে। যদিও নানা ব্যাপারে তাঁর প্রবল উন্নাসিকতা ছিল, কিন্তু লেখক হিসেবে তাঁর একটা গ্রহণযোগ্যতা প্রথম থেকেই আমার মধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। খুব অল্প লিখেছেন। কিন্তু যা লিখেছেন, তা-ই অন্য রকম,অনন্যসাধারণ। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘রন্ধনশালা’র প্রথম মুদ্রণ তখন প্রায় নিঃশেষিত। সেটা ছিল ১৯৭২ সাল। ‘রন্ধনশালা’পড়লাম। এক বার নয়, কয়েক বার। তখন আমার প্রিয় লেখক ছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। চকিতে বাসুদেববাবু যেন সন্দীপনের জায়গাটা নিয়ে নিলেন। তবে এত কম লেখা কেন ? জিজ্ঞেস করলে সদুত্তর মিলত না। নানান গল্প হত লেখা নিয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। কিন্তু লিখতে বললে তাঁর মুখ বেজার হত। তবে অল্প লিখেও যে টিকে থাকা যায়, তার একটা বড় উদাহরণ বাসুদেব স্বয়ং।আসলে হাংরি আন্দোলন তখন স্তিমিত, নকশাল আন্দোলনের ঘোরও সবার কাটতে শুরু করেছে। বাহাত্তর সালের নির্বাচনোত্তর একটা অন্য রকম টালমাটাল অবস্থা চলছে তখন।

১৯৭৩-এর শেষ দিকে চাকরি পাওয়ার পরে আমি হাবড়ায় থিতু হই। তখন থেকে নতুন করে বাসুদেববাবুর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ শুরু হয়। তিনি তখন কল্যাণগড় বিদ্যালয়ের শিক্ষক। খুব সুনাম। একমাত্র পুত্র আনন্দ তখন খুব ছোট। বৌদি রাজীবপুরের এক স্কুলে পড়ান। বাড়িতে কয়েকটি বেড়াল ওঁদের পরম প্রশ্রয়ে লালিত হচ্ছে। বাসুদেববাবু কলকাতায় যেতেন খুব কম, বরং ওঁর কাছেই কলকাতার লোকজন আসত।তবে সিনেমা দেখার জন্যে তিনি মাঝে মাঝেই বাড়ির গণ্ডি ছেড়ে বেরোতেন। ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের নির্বাচিত ছবি দেখা ছিল ওঁর প্যাশন। কলকাতায় গোদার-এর রেট্রোস্পেক্টিভে ওঁর নিত্য যাওয়া দেখে আমি হতবাক হয়ে গেছি। রাত জেগে লাইন দিয়ে টিকিট কেটেছিলেন সে বার। ভাল লাগত ছবি দেখার পর তা নিয়ে ওঁর মননঋদ্ধ আলোচনা।

আমি তখন কলকাতার সাহিত্যজগতের সঙ্গে একটু একটু করে জড়িয়ে পড়ছি। ‘বিজ্ঞাপন পর্ব’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তখন। আশির দশকের গোড়ার দিককার কথা। এরই মধ্যে ওই পত্রিকায় তিনি একটি গদ্যও লিখেছেন। সে বার আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক হাসান আজিজুল হককে নিয়ে একটি সংখ্যা করার। ওই সংখ্যায় লেখার জন্যে যথারীতি বাসুদেববাবুর শরণাপন্ন হলাম। তিনি লিখতে রাজি হলেন ঠিকই, কিন্তু দিনের পর দিন চলে গেল, ওঁর লেখা শুরু হল না। তখন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ওঁর বাড়ি যেতাম। সেই সময় তিনি বড় বিষণ্ণ জীবনযাপন করছিলেন। এক বছর ক্লান্তিহীন হাঁটাহাঁটির পর ওঁর একটি চমৎকার গদ্য পেয়েছিলাম, ‘মৃতুগুহা থেকে শেষ কিস্তি’। তত দিনে বাসুদেববাবুর সঙ্গে আমি এক অন্য সূত্রেও জড়িয়ে গিয়েছি। সেটা একেবারেই অন্য এক অধ্যায়।

আশির দশকের গোড়ার দিকে বাসুদেববাবুর কথায় আমি হাবরার এক গণ সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হই। নাম ‘কয়াডাঙ্গা সাংস্কৃতিক সংস্থা’। মূলত গণসংগীতের দল, আমি যুক্ত হলাম নাচের শিক্ষক ও শিল্পী হিসেবে। শুরু হল আমার জীবনের এক স্মরণীয় অধ্যায়। ওই দলে আরও অনেকের সঙ্গে গান গাইতেন বাসুদেববাবু নিজেও। তাঁর গানের গলাটি ছিল বেশ আকর্ষণীয়। তখন তিনি ওই দলের প্রধান শিল্পী। নানা অনুষ্ঠানে তিনি আমাদের সঙ্গে যেতেন। ওই অঞ্চলে তখন আমাদের খুব সুনাম। অচিরেই দলের নাম বদলে রাখা হল ‘তমোঘ্ন’। এই দলের হয়ে বাসুদেববাবু আমাদের সঙ্গে অনেক জায়গায় গেছেন গান গাইতে।তাঁর সংগীতবোধ ছিল প্রখর। গলা ছিল বেশ ভারী, যাকে বলে ‘ব্যারিটোন ভয়েস’। ওঁর সংগ্রহে ছিল প্রচুর পুরনো দিনের ৭৮ স্পিডের রেকর্ড। আর ছিল একটা বেশ ভাল কলের গান। খুব যত্ন করে রাখতেন যন্ত্রটাকে। মাঝে মাঝে বার করতেন। ওঁর বাড়িতে অনেক পুরনো রেকর্ডের গান শুনেছি।

আড্ডাবাজ মানুষ হিসেবে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। কত যে গল্প করতেন! নানা বিষয়ে তাঁর ছিল অবাধ অধিকার। একবার বলতে শুরু করলে সহজে থামতেন না। মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনতাম। সাহিত্য সিনেমা খেলাধুলো হয়ে গান। কত না বিষয়! একক প্রচেষ্টায় তিনি নিজে একটি পত্রিকা বার করেন এক সময়। নিজে লিখতেন, অন্যদের দিয়েও লেখাতেন। অশোকনগর থেকে অমন একটা পত্রিকা বার করা যে কতখানি দুঃসাহসিক ছিল, সেটা আজ বুঝি। পত্রিকার নাম, ‘সময়ের কাছে’। নামেই বিষয়ের আভাস স্পষ্ট। রাজনীতি, সমাজনীতি থেকে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে ও রকম একটি পত্রিকার কথা কেবল তিনিই ভাবতে পারতেন। একবার এক পুজো কমিটির হয়ে একটি অসাধারণ সংকলন করেছিলেন— ‘আনন্দময়ী’। 

বাসুদেববাবুর হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতো। সব লেখাই তিনি নিজের হাতে লিখতেন। এক লেখা কত বার যে কাটাকুটি করতেন! অনেক কসরত করে তিনি শেষ পর্যন্ত যে পাণ্ডুলিপি তৈরি করতেন, তা ছিল সত্যিই দেখার মতো। অমন লেখা সব বর্ণসংস্থাপকের কাছে পরম আদরণীয় হয়ে উঠত। ভুলও তেমন হত না। ছাত্রদের তিনি নিজের হাতে নোট লিখে দিতেন। সেই লেখা জানি না সেই ছাত্ররা তাদের সংগ্রহে রেখে দিয়েছেন কি না! এক সময় তিনি খুব কম পয়সায় ছাত্র পড়াতেন। ছাত্রদের পড়ানোর জন্যে বাড়ির কাছে আলাদা ঘর ভাড়াও নিয়েছিলেন। পড়িয়ে যা অর্জন করতেন তাকে তিনি বলতেন, ‘ব্ল্যাক মানি’। ওই টাকার অধিকাংশটাই ব্যয় করতেন বই কেনায়। বইপত্র খুব ভালবাসতেন। কলকাতায় এলেই ব্যাগ ভর্তি করে বই নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাত আর ধর্মতলার ফরেন বুক এজেন্সিতে বারবার ঢুঁ মারতেন।

১৯৯৪ সালে আমি হাবড়া ছেড়ে হৃদয়পুরে চলে আসি। বাসুদেববাবুর সঙ্গে যোগাযোগও আস্তে আস্তে কমে আসে। বুঝতাম তিনি খুব একাকিত্বে ভুগছেন। অশোকনগরে তাঁর সমান উচ্চতার মানুষ প্রায় ছিলই না।বাধ্য হয়ে তিনি অল্প বয়সের ছেলেদের সঙ্গে মিশতেন। রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে তাঁর বেশ সখ্য হয়েছিল তখন। হয়তো একাকিত্ব ভোলার জন্যেই মদ্যপানে ডুবে থাকতেন। এক সময় প্রচুর সিগারেটও খেতেন।শুনেছি শেষ দিকে নিজের শরীর সম্পর্কেও বড্ড উদাসীন হয়ে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে স্কুল থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি খুব একা হয়ে যান।

এক সময় যে মানুষটা আমার জীবন জুড়ে ছিলেন, তাঁকে ছেড়ে এসে আমিও খুব সুখে ছিলাম না। মাঝে মাঝেই তাঁর অভাববোধ আমাকে খুব পীড়িত করত। তাই কখনও-সখনও তাঁর ল্যান্ডলাইনে ফোন করতাম। অবশ্য ওঁর গলায় তখন সেই আগের উত্তাপটুকু তেমন ভাবে পেতাম না।

এক দিন সব শেষ হয়ে গেল। বাতাসে ভাসতে ভাসতে এল ওঁর মৃত্যুসংবাদ। অতি প্রিয়জনের বিয়োগব্যথার মতো সেই শোক। আজও তাকে বহন করে চলেছি। বাসুদেববাবুর কোনও বিকল্প হয় না। তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন— আমার মনের মণিকোঠায়।

----------------------------------



মহানগরে পথচর বোদল্যার

মলয় রায়চৌধুরী



কী এক ইশারা যেন মনে রেখে একা-একা শহরের পথ থেকে পথে

অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম বাস সব ঠিক চলে

তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হয়ে চলে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে



সারারাত গ্যাসলাইট আপনার কাজ বুঝে ভালো করে জ্বলে।

কেউ ভুল করেনাকো --- ইঁট বাড়ি সাইনবোর্ড জানালা কপাট ছাদ সব

চুপ হয়ে ঘুমাবার প্রয়োজন বোধ করে আকাশের তলে।



একা একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব;

তখন অনেক রাত --- তখন অনেক তারা মনুমেন্ট মিনারের মাথা

নির্জনে ঘিরেছে এসে; মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব



আর দেখেছি কি : একরাশ তারা আর মনুমেন্ট ভরা কলকাতা?

চোখ নিচে নেমে যায় --- চুরুট নীরবে জ্বলে --- বাতাসে অনেক ধুলো খড়;

চোখ বুজে একপাশে সরে যাই --- গাছ থেকে অনেক বাদামি জীর্ণ পাতা

উড়ে গেছে; বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর

কেন যেন; আজো আমি জানিনাকো হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর।



(“পথ হাঁটা” --- জীবনানন্দ দাশ)





আমি একজন রেকলুজ, একা থাকতে ভালোবাসি, একা-একা শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসি। ভারতের এবং পৃথিবীর অন্যান্য যে শহরেই কিছুকাল থেকেছি, কুড়ি বছর হোক বা কুড়ি দিন, রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি, একা-একা টহল দিয়ে চারিদিকে চোখ বোলাতে-বোলাতে, কান পেতে, গন্ধ নিতে-নিতে, হেঁটেছি, স্রেফ হেঁটেছি, কোথাও বা ফাঁকা ফুটপাত বেয়ে শোকেস দেখতে-দেখতে আর কোথাও বা ভিড়ে গাদাগাদি মানুষ-মানুষীর মাংসময়তার ভেতরে-ভেতরে। শহরবাসীর ভাষায় দখল থাকলে যে অভিজ্ঞতা হয়, তার থেকে ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে অজানা ভাষাভাষিদের চলমান জমায়েতে। অফিসের কাজে পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলে সমীক্ষা করতে গিয়ে টের পেতুম যে রাজনৈতিক ভয়ে অনেকে সঠিক উত্তর দিচ্ছেন না; তখন আমার হিন্দি-উর্দু প্রয়োগ করতাম। যেহেতু দাড়ি-গোঁফ ছিল, আর সহকারীরা আমার পরিচয় এম আর চৌধরী বলে দিত, অবাঙালি রূপে ভেতরের কথা টেনে বের করা সহজ হয়ে যেত। আমার ‘অপ্রকাশিত ছোটগল্প’ বইতে ব্যাপারটা নিয়ে ‘মিহিকার জন্মদিন’ শিরোনামে একটা গল্প লিখেছিলুম।ইনকগনিটো থাকার অভিজ্ঞতা। যেমন অভিজ্ঞতাই হোক না কেন, তা বেশ আহ্লাদময়।



উনিশ শতকের প্যারিস মহানগরের পথে-পথে টহলক্রিয়াকে চিহ্ণিত করে শার্ল বোদল্যার একটি ভাবকল্প তৈরি করে দিয়ে গেছেন। ক্রিয়াটিকে তিনি বলেছেন ‘ফ্ল্যানেরি’ এবং ওই পথচর দর্শককে বলেছেন‘ফ্লনিয়র’।



উনিশ শতকের ইউরোপে শহরগুলো দ্রুত অভূতপূর্ব বিশাল আকারে এমন ভাবে বেড়ে উঠছিল যে শহরবাসীর অভিজ্ঞতায় সুদূরপ্রসারী প্রভাবের নকশা গড়ে দিচ্ছিল তারা। বোদল্যারের ফ্লনিয়র জন্মেছিল এই নকশাটি থেকে, আধুনিকতাবাদের প্রথম চারিত্র্যবৈশিষ্ট্যের অন্যতম। গ্রামাঞ্চল থেকে এসে বিশাল মহানগরের ভুলভুলাইয়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেলছিল ব্যক্তিমানুষ। গ্রামাঞ্চলে সে ছিল কৌমের অংশ, সবুজ ভূখণ্ডের অংশ। মহানগরের জটিল ও সর্পিল পথসমষ্টির বিভ্রান্তিকর রাস্তা, পথ, গলি, তস্যগলির ভুলভুলাইয়ায় তার কৌমপ্রতিস্ব ক্রমশ আবছা হয়ে জন্মাচ্ছিল ব্যক্তিএককের আধুনিক প্রতিস্ব। ভুলভুলাইয়াগুলোতে গড়ে উঠছিল গোপন ও নিষিদ্ধ পরিসর, যা একযোগে ভয়ের এবং আনন্দলাভের এলাকা; সেই পরিসরে বক্তিমানুষ, অবশ্যই পুরুষ-ব্যক্তি, এলাকাটির অংশ হয়েও আক্রান্ত হচ্ছিল পারস্পরিক দূরত্বে, অসম্বদ্ধতায়,অপসৃতির বোধে। আধুনিকতা দেশে-দেশে গড়ে তুলছিল মহানগর, এবং সেই মহানগরগুলোয় আধুনিকতার অবদানরূপে দেখা দিচ্ছিল আলোকময়তার পরিসর ও অন্ধকারাচ্ছন্নতার পরিসর; বৈভবশালীর এলাকা ও ভিখারি জুয়াড়ি নেশাখোর যৌনকর্মী অপরাধী ও শ্রমিকদের এলাকা। যুগ্মবৈপরীত্যের বিভাজন।



গ্রিক পুরাণে আছে যে ক্রিট দ্বীপে ছিল এক সর্পিল জটিল বিভ্রান্তিকর ভুলভুলাইয়া, আর সেই ভুলভুলাইয়ায় থাকত মিনোটর নামের বৃষাসুর, যার দেহ মানুষের মতন কিন্তু মাথাটা ষাঁড়ের। জার্মান ভাবুক ওয়াল্টার বেনিয়ামিন ভুলভুলাইয়ার এই গ্রিক রূপকটির তুলনা করেছেন নতুন গড়ে ওঠা উনিশ শতকের ইউরোপীয় মহানগরের সঙ্গে। পথ, গলি, তস্যগলি, ইত্যাদির গোলকধাঁধায় তৈরি ভয়ের ও আনন্দের চিত্তাকর্ষক পরিসরকে তুলনা করেছেন মিনোটর দানবটির সঙ্গে। মহানগরের ভেতরে একটি এলাকা মানব দেহের আরেকটি ষাঁড়ের মাথার। বেনিয়ামিন ও বোদল্যারসহ ইউরোপীয় ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রকরদের অনেকেই ভয়ের ও বাসনার যে মনোহর মেট্রপলিটান এলাকাটিতে আকর্ষিত হতেন, তা যৌনকর্মী, লুম্পেন, ভবঘুরে, ছন্নছাড়া, মাতাল, নেশাড়ু, জুয়াড়ি, অপরাধী অধ্যুষিত।



১৮৬৩ সালে, যে-সময়ে প্যারিস শহরকে পুঁজিবাদের চিত্তাকর্ষক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলছেন তৃতীয় নেপোলিয়ান ও ব্যারন হাউসমান, সে-সময়ে, চারিদিকের ঝিকমিকে ঝিলমিলে দোকান-পশার ও তা উপভোগের জন্য উপচে-পড়া জনসমুদায়কে বিশ্লেষণ করে, নিজেকেও সেই আয়নায় প্রতিফলিত দেখে, ‘লে ফিগারো’ পত্রিকায় শার্ল বোদল্যার একটি প্রবন্ধ লেখেন, যার শিরোনাম ছিল ‘আধুনিক জীবনের চিত্রকর’। রচনাটিতে তিনি ‘ফ্লনিয়র’ (Flaneur) শব্দটি প্রয়োগ করেন। বোদল্যারের আলোচকরা বলেছেন ফ্লনিয়র শব্দটির প্রতিশব্দ অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় নেই। অনেকে অবশ্য ইংরেজি Stroller ওSaunterer শব্দগুলো ব্যবহার করেছন। যে লোকটি পথে-পথে গন্তব্যহীন অলস পায়ে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে বেড়িয়ে বেড়ায়, তাকে তিনি বলেছেন ফ্লনিয়র। লোকটাকে ভবঘুরে (Vagabond, Badaud, Gawker ) বলা যাবে না। সে কোনো-কিছুর ক্রেতা নয়, কেননা সে শপিং করতে বেরোয়নি। বোদল্যার নিজেই রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন, একা-একা, অনেক সময়ে ভোর রাত পর্যন্ত, অপাড়া-বেপাড়া সর্বত্র। পৃথিবীর সব ভাষাতেই শব্দটি যেভাবে ব্যবহৃত ও উচ্চারিত হচ্ছে, আমি সেভাবেই তাকে বাংলায় ব্যবহার করছি। আরও অনেকে, যেমন জীবনানন্দ দাশ, ফালগুনী রায়, অসকার ওয়াইল্ড, জ্যাক কেরুয়াক পথে-পথে হেঁটে বেড়াতেন। তবে, নিষিদ্ধ পরিসরগুলো জীবনানন্দের ক্ষেত্রে কিয়দংশে নিষিদ্ধ ছিল বলেই অনুমান করি।



ফ্ল্যানেরি, তাকিয়ে-তাকিয়ে বেড়িয়ে বেড়াবার ক্রিয়াটি, মডার্নিটির আলোচনায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফ্লনিয়র লোকটি একা ঘুরে বেড়ায়; বন্ধুবান্ধদের সঙ্গে পথচারণা করে না, নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে গুলতানি করে না, বন্ধু বা বন্ধুনির পাশাপাশি হাঁটছেনা, কাউকে দেখে মন্তব্য করে না। বস্তুত ফ্লনিয়র লোকটি নিজে একজন অজ্ঞাত সত্তা। আধুনিকতাবাদের গর্ভ থেকে পয়দা হওয়া পুরুষালি প্যাশনের মহানাগরিক নমুনা। নগ্নিকার ছবি আঁকেন চিত্রকর, কিন্তু নগ্নিকার দিকে তাকিয়ে-থাকা একজন সাধারণ পুরুষ যে আ্হ্লাদ লাভ করে, তা স্কোপোফিলিয়া নামের চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য। আমি আমার ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ উপন্যাসে এই বৈশিষ্ট্যযুক্ত একটি চরিত্রকে উপস্থাপন করেছি, তার পুরুষালি চাউনির মাধ্যমে দখল করে নেবার প্রক্রিয়াটি কী ভাবে কাজ করে, তা বিশ্লেষণের জন্যে। ফ্ল্যানেরি ও স্কোপোফিলিয়া দুটি ভিন্ন প্যাশন। স্কোপোফিলিয়া নারীর ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে বটে, ( তরুনীরা যেমন নগ্ন উর্ধ্বাঙ্গের হৃতিক রোশন বা সালমান খান দেখতে ভালোবাসেন ) তবে নারীর পক্ষে ফ্লনিয়র হওয়া কঠিন বলে স্বীকার করে নেয়া যায়। মহানগরের গোপন পরিসরগুলো নারীর কাছে প্রায় অগম্য। ভিড়ের গাদাগাদির ভেতরে সেঁদিয়ে মাংসের মহাসমুদ্রের অংশ হয়ে হাঁটা সম্ভব নয় নারীর পক্ষে। উনিশ শতকের লেখিকাদের কেউ-কেউ অবশ্য তাঁদের পাঠবস্তুতে ফ্লনিয়র-নারী চরিত্র উপস্থাপন করে গেছেন, যেমন চার্লট ব্রন্টে, ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড, জীন রাইস, ভার্জিনিয়া উলফ প্রমুখ। বিপজ্জনক এলাকায় প্রবেশ ও সেই পরিসরের জীবনযাত্রার দিকে তাকিয়ে গড়ে ওঠে তাঁদের উপস্থাপিত নারী-চরিত্রগুলো। নিজেদের ও শহরের মাঝের দূরত্বকে তারা কল্পনা প্রয়োগ করে মিটিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়।



আধুনিক কবি ও চিত্রকরকে চিহ্ণিত করার জন্য বোদল্যারের তৈরি ফ্লনিয়র ভাবকল্পটি এখন ব্যবহার করা হচ্ছে ‘পোস্টমডার্ন গেজ’ বা উত্তরাধুনিক চাহনি বিনির্মাণ করার কাজে। পুরুষের চাহনির চাপে সংস্কৃতিতে পরিবর্তন ঘটতে থাকে; বহু মহিলা নিজেদের ওই চাহনির উপযুক্ত করে তোলার জন্য আকর্ষক পোশাক পরেন, সাজগোজ করেন। পুরুষের চাহনির কথা মাথায় রেখে পণ্যবস্তু বিজ্ঞাপিত হয়, এবং সেখানেও নারীকে উপস্থাপন করা হয় টোপ হিসেবে। মিশেল ফুকো বলেছেন, এমন নয় যে চাহনি ব্যাপারটা কারোর থাকে বা সে প্রয়োগ করে; এটি একটি সম্পর্কক্ষেত্র যেখানে কেউ প্রবেশ করে। দর্শক যখন কোনো বস্তুর দিকে তাকায়, তখন সে ওই বস্তুটিই কেবল দেখছে না। দর্শক আসলে দেখছে সেই বস্তুটি ও নিজের সম্পর্কের দিকে। কোনো-কোনো বস্তু কেবল তাকাবার খাতিরেই তৈরি হয়, যেমন চিত্রকরদের পেইন্টিং। এখন সাইবার জগতে একা-একা বা কয়েকজন মিলে ভারচুয়াল জগতের দিকে তাকিয়ে কোনো বস্তু বা জীবের সঙ্গে পোস্টমডার্ন সম্পর্ক গড়ে তোলে। ইনটারনেট পর্নোগ্রাফিক চলচ্চিত্র বা নগ্ন নারী-পুরুষ দেখে যে দর্শক, সে একজন স্কোপোফিলিক চরিত্রবৈশিষ্ট্য মানুষ। সে ফ্লনিয়র নয়।



ফ্লনিয়রকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বোদল্যার বলেছিলেন, ভিড় হল এই মানুষটির অপরিহার্য অংশ বা নিদান, পাখির যেমন আকাশ এবং মাছের যেমন জল। তার প্যাশান ও তার বৃত্তি হল জনসমুদায় নামক বিশাল মাংসল সমুদ্রের মাংসাংশ হয়ে ওঠা। একজন নিখুঁত ফ্লনিয়রের, একজন আবেগোচ্ছাসিত দর্শকের, মহানন্দ ঘটে জনসমুদায়ের হৃদয়ে নিবাসস্থান গড়ে নেবার দরুন, জনস্রোতের ঢেউগুলোর গতির ওঠা-নামার লয়ের সাথে-সাথে মিশ খাবার কারণে। সে ওই অনন্তময় ও আশ্রয়প্রার্থী গায়ে-গা ভিড়ের ভেতরে নিজের জন্য এমনই এক বোধে আহ্লাদিত হয়, যেন সে বাড়ি থেকে বহুদূরে চলে গেছে অথচ চারিদিকেই তার বাড়ি, সমাজ-সংসার থেকে লুকিয়ে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করছে, ওই পৃথিবীটিরই অংশ হিসেবে। ওই দর্শক-কবি হল রূপকথার সেই রাজপুত্র, যে সাধারণ মানুষের পোশাকে নিজেকে লুকিয়ে জনগণের কাজ-কারবার দেখার আনন্দে মজে আছে। সে হল জীবনের এমনই এক প্রেমিক, যে সমগ্র জগত-সংসারকে নিজের পরিবারের অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছে; কিংবা সুন্দরীদের প্রতি আকর্ষিত সেই যুবকের মতো যে ওই না-পাওয়া সুন্দরীদের নিয়ে নিজের পরিবার গড়ে তুলেছে; কিংবা পেইন্টিং-এর সেই আঁকিয়ের মতন, যার নিবাস স্বপ্ন দিয়ে বোনা এক ম্যাজিক নগরীতে, যা সে ক্যানভাসে মেলে ধরে। অর্থাৎ সার্বজনীন জীবনের প্রেমিক মানুষটি ভিড়ের ভেতরে এমনভাবে সেঁদিয়ে যায় যেন তা বৈদ্যুতিক তেজোময়তার অপরিমেয় আধার। অথবা আমরা তাকে জনসমুদায়ের মাপের সমান একটা আয়নার সঙ্গে তুলনা করতে পারি, কিংবা তুলনা করতে পারি এমনই এক ক্যালাইডোস্কোপের সঙ্গে, যা নিজের চেতনার সাহায্যে প্রতিটি বিচলনে সাড়া দেয় আর জীবনের বহুত্বময়তাকে তার উপাদানগুলোর ঝিলমিলে মাধুর্যসহ পুনোরুৎপাদন করে চলে।



তাঁর ‘প্যারিস সপ্লিন’ গ্রন্হে ফ্ল্যানেরি ক্রিয়াটিকে বোদল্যার গ্রহণ করেছেন পাঠবস্তু গঠনের কৌশল রূপে, বিশেষ করে ‘ভিড়’ শিরোনামের গদ্যকবিতায়। একজন ফ্লনিয়র ঠিক কী-কী করে, তাকে উপলব্ধি করার বনেদ হয়ে উঠেছে পাঠবস্তুটি। ফ্লনিয়র চরিত্র-বিশিষ্ট কবির ব্যক্তিসত্তাটি একজন পুরুষের, যে কিনা চেয়ে-দেখা প্রাণী বা বস্তুটির দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে তাতে নান্দনিক মর্মার্থ সঞ্চার করে দিতে পারে, এবং নিজেকে ঘিরে গড়ে ফেলতে পারে, ভিড়ের সাহায্যে, আস্তিত্বিক নিরাপত্তার বলয়। তাঁর ফ্লনিয়র একজন পুরুষ কবি, যে তার ব্যক্তিগত একাকীত্ব থেকে আত্মবিতাড়িত অবস্থায় নিজের জীবনের অর্থ খুঁজে চলেছে,জনসমুদায়ের সমুদ্রে, পণ্যবাজারের মনোহারি শোভায়, নিষিদ্ধ পরিসরের গোপন খাঁজখোঁদরে। তার দিনের বেলাকার মেট্রপলিটান পরিবেশ হল ভিড় এবং দোকানপাট। সে ভিড়ের মানুষ; ভিড়ের মধ্যেকার একজন মানুষ নয়। জনসমুদায়ের সাহায্যে যে শৃঙ্খলা সে নির্মাণ করছে, সে অবিস্থিত তার কেন্দ্রস্থলে, যদিও ভিড়ের অন্যান্য মানুষের কাছে সে, অর্থাৎ ফ্লনিয়র-কবি, মেট্রপলিসের নিরন্তর প্রবহমান জনসমুদায়েরই অংশ। তার আস্তিত্বিক বোধ তাকে ফ্লনিয়র করে তুলছে, পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে অন্যান্যদের থেকে।



‘ভিড়’ গদ্যকবিতায় বোদল্যার বলেছেন, জনতার ভেতরে নিজেকে চুবিয়ে জনতা দিয়ে স্নান করার ক্ষমতা সকলের থাকে না; জনতা ও একাকীত্ব, এ-দুটি হল অভিন্নরূপ যমজ অভিধা। তাদের পরস্পরকে পালটাপালটি করার ক্ষমতা রাখে ফ্লনিয়র কবি। যে মানুষ তার একাকীত্বকে জনতাপূর্ণ করতে অক্ষম, সে গাদাগাদি ভিড়েও একা থাকতে অক্ষম। আসলে ফ্লনিয়র তো সেই রাজপুত্র, যে পোশাক পালটে প্রজাদের কেন্দ্রস্থলে গোপনে প্রবেশ করেছে; এই রাজসিক নামহীনতা, বোদল্যারের মতে, ফ্লনিয়র-কবির কাছে স্পষ্ট করে মেলে ধরছে মহানাগরিক পরিসরের মর্মার্থ। সতত অপসৃয়মান ওই প্রবাহের অন্তঃস্থলে যে অনন্তকাল তাকে টের পান কেবল একজন ফ্লনিয়র-কবি।



জীবদ্দশায় বোদল্যার স্বীকৃতি পাননি, তাঁর কবিতা প্রকাশ করার আগ্রহ দেখাতেন না পত্রিকা-সম্পাদকরা, তাঁর বন্ধুবান্ধব বিশেষ ছিল না, বন্ধুনিরা তাঁকে এড়িয়ে যেতেন, চাকরি-বাকরি ছিল না, অন্যের দানের ওপর নির্ভর করতে হত তাঁকে, উদ্যমের পরিবর্তে যন্ত্রণা ভুগতে ছিলেন আগ্রহী, সংসার বলতে যা বোঝায় তা তাঁর ছিল না, থাকতেন একটি ভাড়ার বাসায়, ছিলেন মহানগরের পথচর, তাঁর কবিতায় চলে আসে জঞ্জালকুড়ুনিয়া আর ভিখারি। একাকীত্বের সেই জীবনযাত্রায় বোদল্যার একা-একা পথে-পথে হাঁটতেন, নিরাময়ের উপায় হিসেবে। প্রায় মিলে যায় জীবনানন্দ দাশ ও ফালগুনী রায়ের জীবনের সঙ্গে।জীবনানন্দের থেকে পার্থক্য এই যে বোদল্যার ও ফালগুনী রায় দুজনেই ছিলেন হ্যাশিশের ভক্ত।



ওয়াল্টার বেনিয়ামিন সর্বপ্রথম বোদল্যারের ফ্লনিয়র ভাবকল্পটি পুঁজিবাদের উন্মেষের প্রেক্ষিতে একটি সর্বৈব ‘মহানাগরিক অভিজ্ঞতা’ হিসেবে বিশ্লেষণ করার পূর্বে আরও অনেকে চর্চা করেছিলেন বিষয়টি। স্যঁৎ ব্যোভ বলেছিলেন, ভাবকল্পটিকে ‘কোনও কিছু না করার’ সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ভুল হবে। বালজাক বলেছিলেন, ফ্লনিয়র লোকটির কাজ হল ‘চোখের মাধ্যমে ভুরিভোজ’। অ্যানাইস বাজিন বলেছিলেন, ‘প্যারিসের সার্বভৌম কর্তা হল ফ্লনিয়র’। ভিকটর ফুরনেল বলেছিলেন, ‘ফ্লনিয়র লোকটির কাজের সঙ্গে আলস্যের কোনো সম্পর্ক নেই; তার কাজটি হল বিশেষ এক ধরনের আর্ট বা শিল্প কেননা সে মহানগরের ঐশ্বর্যময় ভূদৃশ্যের বৈভিন্ন্যকে বোঝার ক্ষমতা রাখে।’ যাঁরা তাঁদের জীবন মহানগরের বাইরে গ্রামঞ্চলে বা উপনগরে কাটিয়েছেন, তাঁদের পক্ষে ভিড়ে গাদাগাদি রাজপথে হাঁটার এই মেট্রপলিটান অভিজ্ঞতার বিষয়টি ঠাহর করতে অসুবিধা হবে।



ওয়াল্টার বেনিয়ামিনের বোদল্যার বিশ্লেষণ বোদল্যারকে উপস্থাপন করেছে আধুনিকতা ও আধুনিকতাবাদ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ও উপলব্ধির সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পরিপ্রেক্ষিতে। বেনিয়ামিন মানতে চাননি যে বোদল্যার ছিলেন রোমান্টিক স্বপ্নময় জগতের লিরিক কবি। তিনি বলেছেন যে, বোদল্যার এমনই একজন আধুনিক কবি যিনি ১৮৫০ এর দশকের পর উদ্ভূত মহানাগরিক পণ্য পুঁজিবাদের হাঙরদাঁতের মাঝে ফেঁসে গিয়ে জীবন-মৃত্যুর লড়াই লড়ছেন; তাঁর কবিতা ও গদ্য থেকে যে বোদল্যার আমাদের সামনে আসেন তিনি একজন ফ্লনিয়র, যিনি বাণিজ্যে ভাসমান প্যারিস মহানগরের রাস্তায়-রাস্তায় পদচারণা করতে-করতে তুলে নিচ্ছেন একের পর এক চলমান ছবি; তিনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জঞ্জাল-কুড়ুনিয়া, যিনি কবিতায় পালটে ফেলার জন্য জড়ো করে চলেছেন শহুরে সংঘর্ষে উৎপন্ন সামাজিক জঞ্জালের নুড়িপাথর;বোদল্যার একজন আধুনিক নায়ক, যিনি আধুনিক মহানাগরিক জীবনের পরস্পরবিরোধিতা ও অসম্ভাব্যতার জাঁতাকলে আত্মসমর্পণ করে সেই দুর্ভোগকে দিয়েছেন কাব্যিক অনুভববেদ্যতা। তিনিই প্রথম আধুনিক কবি-শিল্পী যিনি নিজের সৃজনকর্মকে একটি ব্র্যাণ্ড দিতে চেয়েছেন, যাতে তা সাহিত্যিক পণ্যতোরণ শোভিত পথের দুধারের রঙিন শোকেসের উপযুক্ত হয়ে ওঠে।



বোদল্যার বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন মহানাগরিক আধুনিকতার মসনদে তাঁর সাহিত্যকর্মকে কী ভাবে অধিষ্ঠিত করলে তা কালক্রমে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। একজন ফ্লনিয়র হিসাবে তিনি বাজারে ঘুরলেন, বাজারে যে মালগুলো নামছে সেগুলো দেখলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি অপেক্ষা করলেন সেই ক্রেতাদের জন্যে যারা আধুনিকতার হাতে মার খেয়ে তাঁর কবিতা ও গদ্য তুলে নিতে আসবে। সে-অর্থে বোদল্যার ছিলেন একজন সামাজিক কবি, বলেছেন বেনিয়ামিন।



১৮৫০ এবং ১৮৬০-র দশকে লেখা তাঁর কবিতা ও গদ্যে বোদল্যার বর্ণনা করেছেন মহানগরের পথে-পথে হেঁটে বেড়ানোর উত্তেজক অ্যাডভেঞ্চারগুলো, যা যে-কোনও নাটকের চেয়ে বেশি নাটুকে, যে-কোনও গ্রন্থে আলোচিত আইডিয়ার চেয়ে গভীর ও চিন্তা-উদ্রেককারী। ফ্লনিয়রের সঙ্গে অন্যান্য পথচারীর পার্থক্য হল যে অন্যেরা, তারা অলস পায়ে হাঁটলেও, কোনো একটা কাজে বেরিয়েছে, তাদের হাঁটার উদ্দেশ্য আছে, তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্য আছে, যে পথে তারা হাঁটবে তা পূর্ব-নির্ধারিত, যে পথে ফিরবে হয়তো তাও পূর্ব-নির্ধারিত। ফ্লনিয়র কোথাও যাবার জন্য হাঁটছে না, তার কোনো গন্তব্য নেই, উদ্দেশ্য নেই, কেনাকাটা করার নেই। পুঁজিবাদী সমাজের দুটি প্রধান অনুজ্ঞাকে সে অবহেলা ও অস্বীকার করছে : প্রথমত তার তাড়া নেই, এবং দ্বিতীয়ত তার কিছু কেনার নেই, এমনকী সে দরদস্তুরেরও প্রয়োজন বোধ করে না।বোদল্যারের ফ্লনিয়র ভাবকল্পটিকে আদর্শে রুপান্তরিত করে কোনো-কোনো অনুজ কবি কাছিমের গলায় বাহারি ফিতে বেঁধে প্যারিসের বাজারে হাঁটতে বেরোতেন, যখন কিনা ব্যস্ত লোকেরা কুকুরের বেল্ট ধরে কুকুরের পেছন-পেছন দৌড়োতেন।



ভিড়ের দরুন ফ্লনিয়র বিরক্ত হয় না; জনসমুদায়কে চলার পথে বাধা মনে করে না সে। জনসমুদায়ের মাঝে সে নিজেকে চুপচাপ খুলে ধরতে পারে যাতে সে আশপাশের সবকিছু সেই খোলা হাঁ-মুখে ফেলে-ফেলে কবিতার জন্য সঞ্চয় করতে পারে। ছবি আঁকার জন্য সঞ্চয় করতে পারে। জনসমুদায়ই তার ন্যারেটিভের উৎস। বোদল্যারের সমসাময়িক সাহিত্যিকরা আগ্রহান্বিত ছিলেন ধ্রুপদি শিল্পবস্তুর সৌন্দর্যে। বোদল্যার আগ্রহান্বিত হলেন পথে-পথে পাওয়া জীবনযাত্রার আধুনিকতায়। মহানগর যেমন নিজের প্রতি আকর্ষণ করে অজস্র মানুষকে, কিন্তু এমনই তার আত্মবিরোধিতা যে একজন ব্যক্তিএককের সঙ্গে আরেকজনের অমিল ঘটাতে ওস্তাদ। ‘অমিল’ হল আধুনিকতাবাদের মহানাগরিক বীজ। অসম্ভব হলেও ফ্লনিয়র ফিরে পেতে চায় মিলগুলোকে, ফিরে পেতে চায় গোষ্ঠীসমাজের সংবেদনকে, যাকে বোদল্যার বলেছিলেন,“বাড়ির বাইরে গিয়েও নিজের চারিধারে বাড়ি গড়ে নেওয়া”। স্বাধীন ও নামহীন ফ্লনিয়র, এর দরুন, ঘটনার সঙ্গে আত্মতা গড়ে নিয়ে আহত, বিষণ্ণ, দুঃখিত, ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে পড়তে পারে, এমনকী দর্শকরূপে একতরফা প্রেমেও পড়তে পারে। যে বস্তু বা যাদের বোদল্যার দেখছেন-শুনছেন তা তাঁর কাছে টেক্সটরূপে দেখা দিচ্ছে। নিজের চতুর্দিক থেকে সূক্ষ্ম অনুসন্ধান-সূত্র এবং ইশারা সংগ্রহ করেছেন বোদল্যার, যা সাধারণ পথচারীদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। ভিড়ের অংশ হয়ে, যে ভিড় ছেয়ে ফেলেছে রাস্তার দুধার, ফ্লনিয়র তার টেক্সটে দৈহিকভাবে উপস্থিত। শীতল ও কৌতূহলী চাহনি মেলে, ক্ষণকালীন ও একান্ত দূরত্ব বজায় রেখে, পরিবর্তনরত প্রদর্শনীর মিছিলকে অবিরাম অধ্যয়ন করতে থাকে ফ্লনিয়র। তার অস্তিত্বে রয়েছে সক্রিয় বুদ্ধিপ্রক্রিয়া। এই নবতর সাহিত্যিক পরিকল্পনার জনক হিসাবে, সে, চাহনি ফেলে ফেলে নির্মিত সংস্কৃতির সন্দর্ভ-নির্মাতা; ফলে সে একযোগে হয়ে ওঠে প্রট্যাগনিস্ট ও দর্শক। ভিড়ের কোনো ব্যক্তির সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক নেই, অথচ যা বা যাকে সে দেখছে, তার সঙ্গে সে গড়ে তোলে,সাময়িক হলেও, তার সত্তায় লীন হবার মতন গভীর ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক।



ওয়াল্টার বেনিয়ামিন বলেছেন, ফ্লনিয়র নিজেকে খেলানোর জন্যে ছেড়ে দেয়, অন্যের সত্তায় লীন হবার মাদক প্রক্রিয়ায়। সে একযোগে উপভোগ করে স্বকীয় আত্মতা এবং ‘আরেকজন’ হয়ে ওঠার মজা, যেন সে দেহের খোঁজে চরে বেড়ানো একটি আত্মা। সে যথেচ্ছ অন্যের দেহে প্রবেশ করে যায়। তার বুদ্ধিবৃত্তির খাবারের খোঁজে সে যেন ভিড়ের দেহে একটি পরভুক প্রাণী। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সে নিজেরই তৈরি করা আশ্চর্যনগরীতে, কখনও এই বিপণি-জানালায়, কখনও সেই বিজ্ঞাপনের দিকে, কখনও ওই ভবঘুরের দিকে, কখনও সেই নারীটির দিকে, তাকিয়ে-তাকিয়ে, তাদের শরীরে পরজীবি হয়ে জীবনরস সংগ্রহের আনন্দ উপভোগ করে। সে নিজেই নিজের চিন্তার আদল নিয়ে চারিদিকের বস্তুজগতে চষে বেড়ায়, হাঁটতে থাকে সাধনা-তাড়িতের একাগ্রতায়, পর্যবেক্ষণের সতর্কতায়। প্রকৃতপক্ষে তার রয়েছে পর্যবেক্ষণের বৌদ্ধিক কর্মতাড়না। অথচ তার আছে সত্তাস্বাতন্ত্র্য। ফ্লনিয়র নিজেই নিজের চেতনাশক্তি। বোদল্যার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন মহানগরের আধুনিক দর্শকের, মহানগরগুলোয় সে অপরিহার্য চরিত্র, একজন অ্যামেচার ডিটেকটিভ বা শহরের তদন্তকারী।



বোদল্যারের ফ্ল্যানেরি ক্রিয়া ও ফ্লনিয়র কবিসত্তা ভাবকল্পটির বিশ্লেষণ, তাঁর আলোচকদের মতে, অসম্পূর্ণ থেকে যায় তাঁর ‘ক্লেদজ কুসুম’ গ্রন্হের ‘ট্যাবলো প্যারিসিয়েন’ এর অন্তর্গত ‘পাশ দিয়ে যাওয়া পথচারিণী’ কবিতাটির উল্লেখ ব্যতিরেকে (A une passante)। ফ্লনিয়রের প্যাশনকে উপস্থাপনের একটি নিখুঁত দৃষ্টান্ত এই কবিতাটি। ফ্লনিয়রের ভূমিকায় অবতীর্ণ বোদল্যার যাঁকে উদ্দেশ করে কবিতাটি লিখছেন, তাঁর পোশাক দেখে তিনি অনুমান করছেন যে যুবতীটি বিধবা; যুবতীটি এক মুহূর্তের জন্য তাঁর চোখের সামনে আসেন আর অপসৃয়মান ভিড়ে মিশে যান। ওই মুহূর্তটি গড়ে তোলে অনন্তকাল। প্যারিসের মতন বিশাল শহরে একজনকে দেখার সুযোগ বারবার ঘটার সম্ভাবনা কম। যুবতীটির চকিত চাহনির সঙ্গে কবির চাহনির আদানপ্রদানে লুকিয়ে থাকে ক্ষণস্থায়িত্বের অনন্তকালীন উপাদান। সেই উপাদান দর্শককে মৃত্যুর হুঁশিয়ারি দেয় এবং জীবন সম্পর্কে মুগ্ধতার ইশারাও দিয়ে যায়। যুবতীটিকে দেখে কবির অস্তিত্বে প্রেমের আভাস সৃষ্টি হয়, সে প্রেম ‘প্রথম দর্শনে প্রেম’ নয়, সে প্রেম ‘শেষ দর্শনে প্রেম’।



কবিতাটিতে ওই বিধবা যুবতীটি পথচারী ব্যক্তি-এককদের দ্বারা নির্মিত জনসমুদায়ের কথা ঝলকের জন্য কবিকে জানিয়ে উধাও হয়ে যায়। যুবতীটি পূর্বাভাসদায়ক সম্ভাবনা ও কার্যকরিতার প্রতিমূর্তি হয়ে দেখা দেয় কবির জীবনে --- আশ্চর্য নয় যে সেগুলো ভবিষ্যমুখী বৈশিষ্ট্য; অর্থাৎ কবির জন্যে ওই অচেনা মহিলা তাঁর সৃজনকর্মের সাধিত্র। অন্য যে কোনও প্রেরণাসুত্রের প্রতি তাঁর যে আকর্ষণ, সেই একই প্রেরণাসূত্র কবি পেয়ে যান যুবতীটির ক্ষণিক ঝলকে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই সনেটটি ফ্লনিয়রের বহুবিধ বিচার্য বিষয়কে মেলে ধরছে। প্রথমত, শহরের পশ্চাতপটে কান ঝালাপালা-করা আওয়াজ, যা ভিড়ের ভেতরে অকস্মাত চয়নিত বিষয়বস্তুর সঙ্গে কবির সম্পর্ককে ক্ষণিক ও আচমকা করেই শেষ হয় না; দ্বিতীয়ত, ফ্লনিয়রের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া যুবতীটির সঙ্গে প্রায় ভ্যামপায়ারের আদলে জীবনরস ছেঁচে তোলার সম্পর্ক গড়ে ফেলেন কবি; যুবতীটির চোখ তাঁর কাছে পানপাত্র। ফ্লনিয়র উন্মাদের মতন কাঁপে, রোমাঞ্চিত হয়। তৃতীয়ত, তাঁদের দুজনের সম্পর্ক, যা হয়তো গড়ে উঠতে পারতো, সেই সম্ভাবনা যাচাই করার সুযোগ ঘটে না। পারস্পরিক চাহনি-বদল দুজন মানুষের অস্তিত্বে নৈকট্যের আনুভূমিক মুহূর্ত তৈরি করে দেয়; চাহনি হয়ে ওঠে, ফ্লনিয়রের কাছে, এমনই এক কাল্পনিক সাধিত্র, যার সাহায্যে কবি ওই মেয়েটির শোক দুঃখ কষ্ট ও অন্যান্য ঝড়ঝাপটের অভিজ্ঞতা নিজে অনুভব করতে পারেন, একদা বাংলায় যাকে বলা হতো “হৃদয় দিয়ে হৃদয় অনুভব” করার শক্তি। চতুর্থত, সতত অপসৃয়মান নৈর্বক্তিক রাস্তা ফ্লনিয়রকে দিচ্ছে ব্যক্তিক হাল-হকিকত অনুমানের দক্ষতা। কবিতাটি অনেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। আমি এখানে ১৯৫২ সালে রয় ক্যাম্পবেল কৃত অনুবাদটি তুলে দিচ্ছি :



The deafening street roared on. Full, slim, and grand

In mourning and majestic grief, passed down

A woman, lifting with a stately hand

And swaying the black borders of her gown;



Noble and swift, her leg with statue’s matching,

I drank, convulsed, out of her pensive eye

A livid sky where hurricanes were hatching,

Sweetness that charms, and joy that makes one die.



A lightning flash --- then darkness! Fleeting chance

Whose look was my rebirth --- a single glance!

Through endless time shall I not meet with you?



Far off! Too late! Or never! --- I not knowing

Who you may be, nor you where I am going ---

You, whom I might have loved, who know it too.

2 comments:

0

প্রবন্ধ - ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী

Posted in

প্রবন্ধ


সপ্তম রিপু
ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী


(১)

পুজো আসছে।

মাতৃ আগমনের সংবাদটা অনেকে অনেকরকম ভাবে পান। আমি পাই কোলাজে লেখা দেবার তাগাদা আসতে শুরু করলে।

হায়দ্রাবাদে আমার মতন যে কজন প্রবাসী বঙ্গ সন্তান নিজেদের সাহিত্যিক ভেবে আনন্দ পান, তাঁদের কাছে কোলাজ যাকে বলে মরূদ্যানে কল্পতরু। সবার কথা বলা মুশকিল, তবে আমার লেখা কোলাজে প্রকাশিত হলে আমি নিজেকে অত্যন্ত সন্মানিত মনে করি।



ধন্যবাদ জানাই সেই সকল অক্লান্ত পরিশ্রমী ব্যক্তিদের, যাঁরা আজকের আলোর গতিতে চলমান জীবনযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়েও আমার মতো বটতলার লেখকদের মন আনন্দে ভরিয়ে দেন নিজেদের সৃষ্টি ছাপার অক্ষরে জ্বাজল্যমান অবস্থায় দেখার সুযোগ দিয়ে। ভাবতে ভাল লাগে, আজকের হাল্লা রাজাদের রাজত্বেও বনের মোষ তাড়াইবার লোক কম পড়ে নাই।

যাইহোক, কি লিখব ভাবতে ভাবতেই সময় চলে যাচ্ছে।

উৎপটাং কিছু একটা লেখার ইচ্ছে অনেক দিনের, কিন্তু ইঁট পাটকেল চকলেট বোম খাবার ভয়ে অনেকদিন চুপচাপ ছিলাম। এবার সাহস করে লিখেই ফেলব ভাবলাম।

প্রথমে ভেবেছিলাম ছদ্মনামে লিখব, কিন্তু ভেবে দেখলাম, কোন লাভ নেই। এবার পুজোয় শ্বশুরকন্যার উড়িষ্যার “ধমকাই” শাড়ীর বায়না রাখতে না পারার জন্য এমনিতেই সকালে চায়ের বদলে “ছ্যাঃ” পাচ্ছি, তারপর যদি ভদ্রমহিলা জানতে পারেন নাম ভাঁড়িয়ে ভুলভাল কিছু লিখছি, তবে যাকে বলে আমার সব্বোনাশের মাথায় বাড়ি পড়তে বেশি দেরি হবে না। মাইক নিয়ে বলা ছাড়াও জাস্ট ডায়ালে ফোন কোরে ঘটনাটাকে একটা অন্য মাত্রা দেবার ক্ষমতা যে ওনার আছে, তার পরিচয় আমি অনেকবার পেয়েছি।

তাই “ভয় কি মরণে…………”।

যাইহোক, “সপ্তম রিপু” কথাটার সাথে আমি নিজেও এখনও পর্যন্ত পরিচিত নই। আদৌ কথাটা আছে কিনা জানিনা। তবে আমাকে যাঁরা মোটামুটি ভাবে জানেন, তাঁরা এটা অতি অবশ্যই মানেন যে আমি যে ব্যাপারে যত কম জানি, সেই বিষয়ে আমি ততো বেশী লেখা বা বলার ক্ষমতা ধরি। আমার নিজেরও তাই মত।

পরম করুণাময় ঈশ্বর, আমার ওপর জন্মকাল থেকেই অযাচিত ভাবে এই পক্ষপাতিত্ব করে আসছেন। তিন সত্যি করে বলছি, এখানে আমার কোনও কালো হাত নেই। নাম না জানা, নাম না শোনা যে কোনও বিষয়ের ওপর আমি একটা পুরো অখণ্ড রবীন্দ্র রচনাবলী লিখে ফেলতে পারি। 



(২)

অনেক ভণিতা হোল, আমার ভুল ভাল লেখার জমি তৈরি করার জন্য। এবার আসল প্রসঙ্গে আসা যাক। পাঠকবর্গের সহনশীলতার পরীক্ষায় আমি সবাইকে ফুল মার্ক্স দিলাম, অবশ্য যাঁরা এখনও পর্যন্ত আমার সঙ্গে আছেন, ব্যাপারটার শেষ না দেখে ছাড়বেন না বলে।

আর যাঁরা ইতিমধ্যে রণে ভঙ্গ দিয়েছেন, তাঁদের জানাই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা।

শাস্ত্রে আছে মানুষ ষড় রিপুর বশ-কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ এবং মাৎসর্য। এই ছটি শত্রুকে জয় করতে পারলেই মানুষের মানব জন্ম সার্থক বলা যেতে পারে। একজন আদর্শ মানুষ গুণগত ভাবে এই ছটি ঋণাত্মক ধর্মাবলম্বী উপাদান বশে রাখবে, বশবর্তী হবে না।

এই নিয়ে অবশ্য যথেষ্ট তর্কের অবকাশ আছে।

তার্কিকদের কথায় কান না দিলেও, সাধারণ মানুষের মনে একটা সাধারণ প্রশ্ন অতি অবশ্যই জাগতে পারে যে, যদি সকল মানুষ এই ষড় রিপুর দ্বারা সত্যি সত্যি চালিত না হয় তবে আমাদের এই বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা চলমান থাকতে পারবে কিনা?

প্রশ্নটার মূল্য দশ লক্ষ টাকা ধরা যেতেই পারে।

বিষয়ের লেবুটাকে বেশী কচলিয়ে তেতো করবার আগে, ষড়রিপুর ছটা উপাদানকে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করা যাক।

প্রথমেই ধরা যাক “কাম” রিপুটাকে। আপাত অর্থে কাম কথাটার মানে সেক্স সম্বন্ধীয় হলেও, অন্য অর্থে অ্যাকাডেমি বাংলা অভিধান বলছে “কামনা, ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা, ভোগবাসনা, লিপ্সা, যাচঞা”। 

এখন কথা হচ্ছে, অন্য সব অর্থ ছেড়ে দিয়ে যদি প্রথম রিপুর আপাত অর্থটাকেই জাপটে ধরি তবে এই রিপুকে ত্যাগ করলে সংসারের বৃদ্ধি, মানে সাদা কথায় যাকে বলে বংশ বৃদ্ধি তথা বিকাশ, স্তব্ধ হয়ে যাবে।

আবার ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা না থাকলে জীবনের কর্ম পদ্ধতি নতুন সংজ্ঞা পাবে। যদিও গীতা বলেছে, কর্মন্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। কিন্তু সর্বসাধারণকে কর্মে নিয়োজিত করতে হলে জনগণের পছন্দমতো খুড়োর কলে McD বা KFC’র আইটেম নাম্বার ঝোলাতেই হবে। রোম অলিম্পিকে গোল্ড মেডেলটা গলায় পরবার ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নটা না দেখাতে পারলে মিলখা সিং এর কোচ “ভাগ মিলখা, ভাগ” বলতে পারতেন না। 

দ্বিতীয় রিপু “ক্রোধ” জীবকে চরম সর্বনাশের পথে চালিত করে। আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত দ্বিতীয় রিপুই সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকর। তবে তার্কিকেরা বলে থাকেন দ্বিতীয় রিপু মানুষকে আত্মরক্ষায় উজ্জীবিত করে। ক্রোধের বশেই রাজা তাঁর প্রজাদের শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করেন। দুষ্টের দমন করেন। কাজেই মানুষের জীবনে ক্রোধের প্রয়োজন আছে।



(৩)

তৃতীয় রিপু “লোভ” এক অদ্ভুত রিপু। মানুষ মনে হয় ২৪x৭x365 শয়নে, স্বপনে, জাগরণে লোভ রিপুর বশবর্তী।

এই নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতেই পারে।

সকালে জম্পেশ করে হিঙের কচুরি-আলুর দম-জিলিপি খেয়ে নিয়েই আবার দুপুরে কচি পাঁঠার ঝোল আছে শুনে জিভে জল আসেনি এমন ত্যাগী মহাপুরুষ বিরল। এরপর যখন গিন্নির কাছ থেকে জানতে পারি সত্যনারায়ণের কাছ থেকে আনা ইলিশের ভাপাটা রাত্রে পাতে নামবে, তখন জিভের বারিধারা ধরার জন্য মুখের সামনে বাটি ধরতে পারলে ভালো হয়, নয়তো পরিধেয় বস্ত্র নষ্ট হতে পারে।

শুধু এই নয়।

মাসমাইনে পাবার দিনও শেয়ার বাজারে নিজের ধরে রাখা শেয়ারগুলোর স্বাস্থ্যের দিকে দৃষ্টিপাত না করে থাকা খুব মুশকিল।

গভীর ঘুমের মধ্যে সুখ স্বপ্নে কোটি টাকার লটারি পাওয়াটাকে যে অবদমিত হঠাৎ বড়লোক হবার লোভ বলা যাবে না, এটা বলা খুব মুশকিল।

আবার এই লোভের অনুপস্থিতিতে মানুষ যে তার বর্তমান জীবন যাত্রার উন্নতি সাধনে ব্যর্থ হতো, এ বিষয়ে খুব কম লোকই আপত্তি করবেন মনে হয়।

কিন্তু There is a BUT!

শাস্ত্রে আছে, “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু”।

এই জায়গাটাতে একটু দাঁড়ানো যাক।

২৪x৭x৩৬৫ নিজের অজান্তে লোভের বশবর্তী হয়ে পাপ-পুণ্যের হিসেবটা গুলিয়ে যেতেই পারে। কিন্তু কথাটা হলো, লোভ ত্যাগ করতে পারলে কি মৃত্যুকে এড়ানো সম্ভব? এর উত্তরে কিন্তু পণ্ডিতেরা নীরব।

কাজেই শয়নে, স্বপনে, জাগরণে লোভ রিপুর তাড়নায় অসাড় সংসার চক্র ঘোরে নিরবধি।

সাধারণভাবে চিন্তা করলে প্রথম এবং তৃতীয় রিপু দুজনকে বৈমাত্রেয় ভাই বলা যায়। বৈমাত্রেয় বলার কারণ এই যে এই দুই ভায়ের মধ্যে চরিত্রগত কিছু পার্থক্য আছে। অদম্য, অনিয়ন্ত্রিত, অসংযত কামনাই লোভে পরিণত হয়।

তার্কিকদের মতে সমস্ত সাধারণ মানুষের জাগতিক কর্মকাণ্ডের পিছনে এই তৃতীয় রিপুর অবদান সর্বাধিক। প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাহিদা আর অতিরিক্ত প্রয়োজনের দুনিয়া সৃষ্টি করার পিছনে এই তৃতীয় রিপুই যে অগ্রগামী, সে বিষয়ে সন্দেহ না থাকাটাই স্বাভাবিক।



(৪)

চতুর্থ রিপু “মদ” এর দিকে এবার দৃষ্টি দেওয়া যাক।

মদ শব্দের তাৎক্ষণিক অর্থ সুরা মনে হলেও আভিধানিক অর্থে দেখছি “দম্ভ”, “গর্ব”, “অহংকার”, “দর্প” ইত্যাদি শব্দগুলি উপস্থিত।

আক্ষরিক অর্থে এই সকল গুণ কিন্তু রজোগুণী ব্যক্তিদের আধার। সাধারণত রজোগুণী ব্যক্তিরাই সমাজে নেতৃস্থানীয় পদাধিকার অর্জনে অত্যধিক ব্যাকুলতা প্রদর্শন করে থাকেন। আবালবৃদ্ধবনিতা তাদের নেতা,রাজাদের মধ্যে এই গুণগুলোই দেখতে চান নিজেদের আলুনি জীবনের মসলা হিসেবে। বনেদী রাজপরিবারের এই গুণগুলোই Blue Blood হিসেবে সমাজে পরিচিত।

মদমত্ত রাজপরিবার আমজনতার কাছে সর্বদাই ভগবানরূপে পূজিত হন। এক্ষেত্রে ভারতবর্ষের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হলেও রাজা-রাণীর দেশ England-ও খুব একটা পিছিয়ে থাকবে না।

পঞ্চম রিপু “মোহ” খুবই Deceptive. কথাটার অর্থ “মায়া”। এই যে “কোলাজ”, তার জন্য যে লেখা, এসবই মায়া। যাঁরা লিখেছেন, যাঁরা পড়ছেন – সবই মায়া। ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব সীতাদেবীকেও মায়া আখ্যা দিয়েছেন। রাম-সীতা-লক্ষ্মণের বনে যাবার দৃশ্যটা কল্পনা করুন। লক্ষণের দৃষ্টিপথে সীতা মায়া রূপে রামকে অদৃশ্য করে রেখেছেন।

রজনীকান্তর একটা গান আছে, “তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে……মোহ কালিমা ঘুচায়ে।”

হিন্দু দর্শন শাস্ত্রের মতে এই পুরো জগতটাই মায়া। যা দেখছি, যা কিছু বন্ধনে নিজেদের জড়াচ্ছি সব, সবই মায়া।

এখন কথা হচ্ছে, এই রিপুকে যদি অস্বীকার করি তবে দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রাথমিক কারণটাই পেছনের সারিতে চলে যাবে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে পঞ্চম রিপু “মোহ”কে ত্যাগ করে এই জগতে জীবনধারণ এক কথায় অসম্ভব। 

ষষ্ঠ রিপু “মাৎসর্য” মানে “অন্যের ভালো দেখতে না পারা”। এক কথায় “পরশ্রীকাতরতা"। পণ্ডিতেরা বলেন “Schadenfreude” জার্মান শব্দটার ইংরেজিতে সঠিক কোন একাক্ষর শব্দ নেই। তবে তর্জমা করলে যেটা দাঁড়ায় সেটা হচ্ছে – Whenever a friend succeeds, a little something in me dies.

অনেকে বলেন Envy বা Jealousy শব্দ দুটো কাছাকাছি হলেও সঠিক নয়। তবে বাঙলায় সমকক্ষ একটা ভাল তৎসম শব্দ আছে – অসূয়া।

মহাভারতে দুর্যোধন পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থে ঐশ্বর্যময় জীবনযাত্রা দেখে Schadenfreude Syndrome-এ ভুগতেন। এটাকে সরলীকরণে “মাৎসর্য” রিপুর প্রভাব বলা যেতেই পারে।

সত্যি কথা বলতে গেলে, পুরাকালে যাঁরা রাজসিংহাসনে বসে রাজ্য চালাতেন, তাঁদের ওপর যদি মাৎসর্য রিপুর প্রভাব না থাকত, তবে তাঁদের পক্ষে কোনওমতেই অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে পৃথিবীর সমস্ত রাজাদের বশ্যতা স্বীকার করানো সম্ভব হত না।



(৫)

বর্তমানকালে এইপ্রকার উদ্দেশ্য সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে কিন্তু প্রাচীনকালে অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান একটি অবিস্মরণীয় কীর্তি হিসেবে পরিগণিত হত। 

অতএব ধরে নিতে কোনও বাধা নেই যে “সদা সত্য কথা বলিবে” খ্যাত মহারাজ যুধিষ্ঠির মাৎসর্য রিপুর দাস ছিলেন। বেচারা দুর্যোধনই শুধু পরশ্রীকাতর হিসেবে কুখ্যাত হয়ে রইলেন।

আপাতত ষড় রিপুর গুণাগুণ বিচার বিবেচনা করে দেখা যাচ্ছে যে এদের সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করলে মনুষ্যসৃষ্ট এই বর্তমান সমাজ অচল হয়ে পড়তে পারে। রন্ধনশিল্পে যেমন সকল উপাদানের সঠিক মাত্রার উপস্থিতি স্বাদিষ্ট ব্যঞ্জনের সৃষ্টি করে থাকে, ঠিক সেইরকম সঠিক অনুপাতে ষড় রিপুর উপস্থিতি মনুষ্য জীবনে অতি অবশ্যই প্রয়োজনীয়। গীতায় স্বত্ব, রজো ও তম তিনটি গুণের কথা বলা হয়েছে। একটি আদর্শ চরিত্র গঠনে এই তিন গুণের যেরূপ সঠিক পরিমাণের উপস্থিতি প্রয়োজন, সেরূপ ষড় রিপুরও যে সঠিক মাত্রার উপস্থিতি প্রয়োজন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকা উচিত নয়।

মহাভারতের অনুশাসন পর্বে পিতামহ ভীষ্ম স্বজন হত্যায় অনুতপ্ত যুধিষ্ঠিরকে রাজধর্ম সম্পর্কে যে জ্ঞান দান করেছিলেন, সেটি যে “রাজধর্ম্যানুশাসন” নামক একটি সুগার কোটেড ষড় রিপুর সুসম মিশ্রণ মাত্র,সেটি অতি অবশ্যস্বীকার্য।

বলি ভণিতার পর ভণিতা তো হলো, এবার আসল কথাটায় আসা যাক – সপ্তম রিপু। সত্যি কথাটা বলেই ফেলি তাহলে।

পাঠক জনগণ যদি এই অপাঠ্য লেখাটি শেষ পর্যন্ত পড়ে আমার সাথে একমত হন তবে এই সপ্তম রিপু নামক ঋণাত্মক গুণটির জন্য আমি পেটেন্টের দরখাস্ত করতে পারি। এই রিপুটির উপস্থিতি সর্বপ্রথমে যদিও মহাভারতের কুরুক্ষেত্র পর্বে পরিলক্ষিত হয়, তবু কোন এক অজানা কারণে এই ঋণাত্মক গুণটিকে কখনই রিপুর তালিকাভুক্ত করা হয় নি।

এই সপ্তম রিপুটি হোল বিষাদ।

মহাভারতের যুগে অর্জুন প্রথম এই রিপুর বশবর্তী হয়েছিলেন। তারপর থেকে সভ্যতা যত এগিয়েছে এই রিপুর প্রভাব ক্রমে ক্রমে অল্পে অল্পে বাড়তে বাড়তে এই একবিংশ শতাব্দীতে একবারে মহামারীর রূপ ধারণ করেছে বলা যেতে পারে।

বিষাদ, ইংরেজিতে বলতে গেলে বলতে হয় Depression.

হতাশা, ভাল না লাগা, Mood নেই, মন খারাপ লাগা, Negative feelings ইত্যাদি সর্বপ্রকার মানসিক অবস্থানকেই সপ্তম রিপুর অন্তর্গত বলা যেতে পারে। বর্তমান সমাজে মানুষের জীবনযাত্রার চরিত্র যে গতিতে বদলে যাচ্ছে এবং তার সাথে জীবনের নিরাপত্তাহীনতা যে চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে চলেছে, তারই ফলস্বরূপ বিষাদ রিপু আজ মনুষ্য সমাজকে পূর্ণগ্রাসগ্রস্ত অবস্থায় নিয়ে যেতে চলেছে।



(৬)

এই রিপুর একটি বিশেষ ক্ষমতা হলো সরাসরি মানুষের মনকে গ্রাস করে ফেলা। আর তার প্রভাবে মহাভারতের যুগে অর্জুনের যা অবস্থা হয়েছিল, বিজ্ঞানের এই বিপুল অগ্রগতির যুগেও সকল বিষাদগ্রস্ত মানুষেরও একই রকম উপসর্গ দেখা দেয়।

কুরুপাণ্ডব উভয় সেনার মধ্যে অর্জুনের অনুরোধে সারথি কৃষ্ণ রথ স্থাপন করলে, ভীষ্ম-দ্রোণসহ আর সকল আত্মীয়স্বজনকে দেখে বিষাদগ্রস্ত অর্জুন বলে উঠেছিলেন,

“সীদন্তি মম গাত্রানি মুখঞ্চ পরিশুষ্যতি।

বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে।।”

অর্থাৎ, আমার গাত্র সকল অবসন্ন হচ্ছে এবং মুখ পরিশুষ্ক হচ্ছে। আমার শরীরে কম্প ও রোমহর্ষ হচ্ছে।

পরে অর্জুন আরও বলেছেন যে তাঁর হাত থেকে গাণ্ডীব খসে পড়ছে এবং ত্বক পরিদগ্ধ হচ্ছে। বসেও থাকতে পারছি না, আমার মনও যেন ঘুরছে – ইত্যাদি আরও অনেক Depressing কথাবার্তা, এমন কি যুদ্ধ করতেও অস্বীকার করেছিলেন।

লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বর্তমান কালেও বিষাদগ্রস্ত মানুষের Depressing symptomগুলোও একই প্রকার।

এই সপ্তম রিপুর আঘাত বড়ই দুর্বিষহ। মানসিক অবস্থা ক্রমশই নিম্নগামী হয়। ঠিকমত পরিচর্যা না হলে বিষাদগ্রস্ত মানুষ আত্মঘাতীও হতে পারে। বহু বিখ্যাত মানুষ এই রিপুর আঘাতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন বা নিতে চেয়েছিলেন। বর্তমান যুগে সারা পৃথিবী জুড়ে শত সহস্র মানুষ আজ বিষাদগ্রস্ত অবস্থায় দিন যাপন করে চলেছেন।

সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, প্রতিমুহূর্তে মানুষের সপ্তম রিপুর আঘাতের কারণ হিসেবে তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতম বিষয়গুলির প্রভাব ক্রমশই বিস্তার লাভ করে চলেছে। চাকুরিস্থলে Increment, Promotion,চারচক্রযানের দৈর্ঘ্য, আবাসনের বর্গ ফুট, সন্তানের পছন্দমাফিক বিদ্যালয়, Branded পরিচ্ছদ ইত্যাদি আরও অনেক প্রকার হিসাবপত্তর মানুষকে প্রতিনিয়ত বিষাদগ্রস্ততার কুম্ভীপাকে নিষ্পেষিত করে চলেছে। 

ভাগ্যবান অর্জুনের Friend, Philosopher, Guide & Mentor হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন। গীতার প্রথম অধ্যায়ে সপ্তম রিপুর আঘাতে জর্জরিত অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধার করেছিলেন বাকি সতের অধ্যায় জুড়ে ৫৭৬টা শ্লোকের ভোকাল টনিক দিয়ে। মাঝে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়ে এমন ভয় দেখিয়েছিলেন যে অর্জুন জোড়হাত করে বলেছিলেন,

“নমঃ পুরস্তাদথ পৃষ্ঠতস্তে।

নমোস্তুতে সর্বত এব সর্ব।।’’

তোমাকে সম্মুখে নমস্কার, পশ্চাতে(?) নমস্কার, হে সর্ব, তোমাকে সর্বদিকে নমস্কার। শেষে অর্জুন বলেছিলেন, “আমি তোমার এই রূপ দেখে ভীত হয়েছি। তুমি আবার সেই চতুর্ভুজ রূপেই আবির্ভূত হও।”



(৭)

আমরা যারা সাধারণ মানুষ, যাদের কৃষ্ণের মতো Mentor নেই বা থাকলেও ভরসা রাখতে পারি না বৈজ্ঞানিক যুগের যুক্তিবাদের হাতে গরম প্রামাণ্য তথ্যের অভাবে, তাদের পক্ষে সপ্তম রিপুর হাত থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পথ –

“Positive thinking and daily dose of exercise

Makes a person most healthy, wealthy and wise.”

আর যাঁদের শ্রীকৃষ্ণে বিশ্বাস আছে, তাঁরা পথ খুঁজে পান,

“সর্বধর্মানাং পরিত্যাজ্যং মামেকং শরণংব্রজ।

অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্য মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।”

(গীতা-মোক্ষ যোগ/৬৬তম শ্লোক)



কিন্তু মুশকিলটা হলো, আমার মতো “যে জন আছে মাঝখানে” পাবলিকদের। আমরা না পারি “আস্তিক” হয়ে “ভগবান ভরসা”-য় জীবন কাটাতে, আবার ভগবানেরই ভয়ে “নাস্তিক” হতেও পারি না।

আমাদের জন্য বোধহয় বাঙালীর সেই সদাজাগ্রত ৩৩,০০,০০,০০১ নম্বর ঠাকুরই ভরসা – গুরুদেব শ্রীশ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ভদ্রলোকের অসীম ক্ষমতা। একের পর এক পরম নিকট আত্মীয়, এমন কি স্ত্রী, পুত্র এবং কন্যা, সবাইকে হারাবার পরও ভেঙে পড়েননি। তারপরেও তাঁর চিন্তাধারা আর লেখনী স্তব্ধ না হয়ে জন্ম দিয়ে গেছে অসামান্য সব সৃষ্টির।

একমাত্র তিনিই বোধহয় বলতে পেরেছেন,

“আমি তোমার কাছে শান্তি চাব না

থাক না আমার দুঃখ বেদনা।”

গুরুদেবের অমর সাহিত্য সৃষ্টির অবদানকে মাথায় রেখেও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে ওঁর জীবন দর্শনই এই শতাব্দীর মহামারি সপ্তম রিপু রোগটির একমাত্র বিশল্যকরণী – Always stay positive and be productive.

সর্বশেষে, এটাও বলা প্রয়োজন যে সপ্তম রিপুরও একটি Positive side আছে। অর্জুনের এই রিপুর দ্বারা আঘাত প্রাপ্তির ফল হিসেবে আমাদের “শ্রীমদভগবদগীতা” নামক ৭০০ শ্লোক সমৃদ্ধ মহাগ্রন্থটির প্রাপ্তি। 

“।।কৃষ্ণ বলো, সঙ্গে চলো।।”

--------------------------------

(পুঃ- এই প্রবন্ধটি গুরু-চণ্ডাল রোগে পিড়ীত। ইহার আরোগ্যের বিধান দান করিয়া কেহ যেন সময়ের অপব্যবহার না করেন। পাঠ সম্পূর্ণ করিয়াছেন- এমন সকল পাঠকবর্গের কাছে ইহাই লেখকের বিনীত মিনতি। Victorian অথবা Queen’s English ভাষার বর্তমান SMS রূপ লেখককে সাহসী হইতে সাহায্য করিয়াছে।)

0 comments:

2

প্রবন্ধ - শুভাশিস চক্রবর্তী

Posted in

প্রবন্ধ


বিশ্বপথিক অমিয় চক্রবর্তী

শুভাশিস চক্রবর্তী



আইনস্টাইন আমেরিকায় বেড়াতে এলেন। রবীন্দ্রনাথও তখন আমেরিকায়। নিউ ইয়র্কের পার্ক এভিনিউতে বন্ধু এলমহর্স্টের ফ্ল্যাটে বিশ্রাম নিচ্ছেন। সাংবাদিক আর ভক্তদের চোখ এড়িয়ে একরকম গোপনে নিউইয়র্কে পৌঁছোলেন আইনস্টাইন। দু-দিন পর জানতে পারলেন রবীন্দ্রনাথ এখানেই আছেন। মাস কয়েক আগে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বার্লিনে সাক্ষাৎ হয়েছিল, এক সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। আইনস্টাইন ফোন করলেন রবীন্দ্রনাথকে— তিনি কবির সঙ্গে একটা দিন কাটাতে চান। তবে মিডিয়া যেন কোনওভাবেই জানতে না পারে। ১৯৩০-এর ঘটনা এটি।


রবীন্দ্রনাথের তৎকালীন সাহিত্য সচিব অমিয় চক্রবর্তী কি করবেন মনে মনে ভেবে ফেললেন। ফটোগ্রাফার মার্টিন ভস তখন অল্পবয়সী, কিন্তু ছবি তুলিয়ে হিসেবে মার্কিন দেশে তাঁর বেশ সুনাম। অমিয় চক্রবর্তী তাঁকে নিয়ে এলেন, বারান্দায় বহু ঘণ্টা লুকিয়ে রাখলেন। ফ্ল্যাটে প্রবেশের মুখেই ফটোগ্রাফার দেখলে বিজ্ঞানী খুশি হবেন না, জানতেন অমিয়। সারাদিন রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের সাক্ষাৎ চলল, আর ফটোগ্রাফার বারান্দায় লুকিয়ে থাকলেন। চলে যাবার সময় অমিয় চক্রবর্তী আইনস্টাইনকে ভয়ে ভয়ে ছবি তোলার প্রস্তাব দিলে বিজ্ঞানী তাতে এতটুকু খুশি হলেন না। শেষপর্যন্ত অবশ্য ছবি তোলা হয়েছিল।


নেপথ্যে থেকে এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ অমিয় চক্রবর্তী আরও অনেকবারই করেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতিনিধি হিসেবে গান্ধীজির সবরমতি আশ্রমে একাধিকবার গেছেন, সেখানেই আলাপ এবং বন্ধুত্ব গভীর হয়ে ওঠে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে। ১৯৩৫-এ স্ত্রী কমলা নেহরু যখন অসুস্থ, তাঁর শুশ্রুষা করবার ফাঁকে ফাঁকে জওহরলাল অমিয় চক্রবর্তীকে অনেক চিঠি লিখেছেন, সেসময়ের অন্তত পঁচিশটি চিঠি রক্ষিত আছে দিল্লির নেহরু মিউজিয়ামে। স্ত্রীর গুরুতর অসুস্থতার এই সময়ে জওহরলালকে হঠাৎই কারারুদ্ধ করা হয়। কমলা নেহরুকে নিয়ে যাওয়া হয় জার্মানিতে বেডেনওয়েইলারের স্যানেটোরিয়ামে। অমিয় চক্রবর্তী বন্ধুপত্নীকে দেখতে গেছেন। চিকিৎসকেরা তাঁকে জানালেন, দু-মাসের বেশি কমলা বাঁচবেন না। যদি জওহরলালকে এই শেষ সময়ে আনা যায়, তাহলে ভালো হয়। কিন্তু এই প্রস্তাবে কমলা রাজি হচ্ছেন না। ব্রিটিশ পুলিশের দয়াভিক্ষা তিনি চান না। তিনি মনে করেন, কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামীর এই রকম বিশেষ সুযোগ পাওয়া উচিত নয়। অমিয় চক্রবর্তী এবারেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে নিজের কর্তব্য ভেবে ফেললেন। সব দিক ঠিক রাখতে হবে। কারও বিশ্বাসে আঘাত করা যাবে না অথচ কাজটিও ফলপ্রসূ হতে হবে। চিকিৎসাকেন্দ্রের এক জার্মান চিকিৎসককে দিয়ে কমলার শারীরিক অবস্থা বিষয়ে জার্মান ভাষায় একটি রিপোর্ট লিখিয়ে নিলেন তিনি। নিজে কোনও মন্তব্য না করে সেই সময়ের ভারতসচিব লর্ড জেটল্যান্ডকে রিপোর্টটি পাঠিয়ে দিলেন। হঠাৎই বিনা শর্তে, বিনা আলোচনায় জহরলালকে মুক্তি দিয়ে জার্মানি চলে যেতে বলা হয়। সেখানে পৌঁছালেন যখন, কমলা তখনও বেঁচে। স্ত্রীর মত্যুর সময় জহরলাল পাশেই ছিলেন। তিনি কোনওদিন জানতে পারেননি, এই ঘটনার নেপথ্য নায়ক কে। সুভাষচন্দ্র বসু আন্দাজ করেছিলেন, তাঁর একটি চিঠিতে অমিয় চক্রবর্তীকে এই কাজের জন্য নিজের সমর্থন জানিয়েছিলেন। ব্রিটিশ কোনও অফিসারের আকস্মিক বলে ফেলার সূত্রে মহাত্মা গান্ধীও জানতে পেরেছিলেন ঘটনাটির কথা।


অমিয় চক্রবর্তীর জন্ম ১৯০১-এর ১০ এপ্রিল। শ্রীরামপুরে। মামাবাড়িতে। বাবা ছিলেন অসমের গৌরীপুর এস্টেটের দেওয়ান। কৈশোর কাল কেটেছে সেই নদীবেষ্টিত শ্যামকান্তি পরিবেশেই। কবিতা লেখার হাতটি তখন থেকেই বেশ সুন্দর। প্রমথ চৌধুরী আর ইন্দিরা দেবী বড় ভালবেসে ফেলেছিলেন কিশোর অমিয়কে— সেই অল্প বয়সেই দেশি-বিদেশি কবি-সাহিত্যিককে দীর্ঘ চিঠি লেখেন তাঁদের লেখার ভালোমন্দ জানিয়ে। জেরম কে. জেরম, এইচ. জি. ওয়েলস, এমনকি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বুঝতেই পারেননি পত্র লেখকের বয়স মাত্রই পনেরো! চৌধুরীদম্পতি কিশোর অমিয়কে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন শান্তিনিকেতনে। কয়েকদিন থাকবেন তাঁরা। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, অমিয়র জ্বর চলে এল। লজ্জিত কুন্ঠিত সদ্য গোঁফ ওঠা কিশোর কি করবেন বুঝতে পারছেন না। লজ্জার হাত থেকে বাঁচালেন রবীন্দ্রনাথই। ছেলেটির অবস্থা বুঝে দরদ দিয়ে বললেন, ‘কিছু চিন্তা কোরো না, কেউই কিছু মনে করবে না, এই ঘরোয়া বৈঠকে তুমি শুয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দাও।’ তারপরে কত আশ্চর্য আলোচনা। শুয়ে শুয়ে শুনে যাচ্ছেন সেই অপার্থিব মানুষটির বক্তব্য। বারান্দার ওদিক থেকে দেখা যায় খোয়াইয়ের দিগন্ত— চোখ চলে যায় সেদিকেও। সন্ধ্যা বেলায় গানের বাসর— তারও মুগ্ধতা লেগে থাকে কিশোরটির চোখে মুখে।


অঘটনটি ঘটল এর কিছুদিন পর। একটা মত্যু এসে জোর ধাক্কা দিয়ে গেল অমিয়কে। তাঁর থেকে বছর দেড়েকের বড় দাদা, অরুণচন্দ্র, বিনা কারণে, শুধুমাত্র পরলোকের ইঙ্গিত পাবার ব্যাকুল বাসনায় আত্মহত্যা করলেন। ভরা পূর্ণিমায় পদ্মা নদী নীচে বয়ে চলেছে, ঈশ্বরদি স্টেশনের কাছে ব্রিজের উপর রেল লাইনে শুয়ে জ্যোৎস্নায় নিমগ্ন ছিলেন— দার্জিলিং মেল তাঁর উপর দিয়ে চলে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল অমিয়কে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ এবং প্রমথ চৌধুরী। কিছু করে না বসে ছেলেটি। নতুন বউঠানের আত্মহত্যার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন অমিয়কে, ‘…সেই প্রচণ্ড বেদনা থেকেই আমার জীবন মুক্তির ক্ষেত্রে প্রথম প্রবেশ লাভ করলে। আমি ক্রমে বুঝতে পারলুম জীবনকে মৃত্যুর জানলার ভিতর থেকে না দেখলে তাকে সত্যরূপে দেখা যায় না।’ প্রমথ চৌধুরীও তাঁকে নানা ভাবে বোঝাচ্ছেন। উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ পরস্পরকে চিঠিও লিখছেন অমিয় বিষয়ে কী করা উচিত, তা আলোচনা করে। শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে আসাই শ্রেয় মনে করলেন, লিখলেন, ‘তুমি শান্তিনিকেতনে এসে আমার কাছে কিছুদিন থাক’।


সেযাত্রায় শান্তিনিকেতনে না এলেও পাকাপাকিভাবে সেখানে চলে এলেন অমিয় ঠিক চার বছর পরে। বি.এ. পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছেলে এম.এ.তে ভর্তি না হয়ে শান্তিনিকেতনে যাচ্ছে— স্বাভাবিকভাবেই বাবা এটা মানতে পারেননি। তাছাড়া এটা কোনও চাকরি নয়, মাস মাইনে বলে যে একটা বস্তু থাকে তার কোনও ব্যাপার নেই, শুধুমাত্র ‘রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য আর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শের’ আশায় নিজের ভবিষৎকে এভাবে শেষ করা— বাবা ক্ষুন্ন হলেন মনে মনে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আশ্রমের কলেজ স্তরের মেয়েদের ইংরেজি সাহিত্যের শেলি‌-কীটস বিষয়ে ক্লাস নেবার দায়িত্ব দিলেন। কিন্তু তাদের থেকে মাত্রই কয়েক বছরের বড় এই শিক্ষকের ক্লাস মেয়েরা করবে কেন? রোগাটে চেহারা, অনাকর্ষণীয় অমিয়র ভক্ত নয় তারা। ফলে, শিক্ষক অপেক্ষা করেন, মেয়েরা আসে না তাঁর ক্লাসে। এই উপেক্ষা কষ্ট দেয় অমিয়কে। রবীন্দ্রনাথকে চিঠিতে নিজের অক্ষমতার দায় নিয়েই চিঠি লেখেন। রবীন্দ্রনাথ হস্তক্ষেপ করলেন। সমস্যার সমাধানও করলেন। কিন্তু অমিয় চক্রবর্তীকে যে চিঠিটি লিখলেন তাতে বিশ্বভারতী নিয়ে তাঁর স্বপ্নভঙ্গের একটা রেশ কোথাও যেন লুকিয়ে থাকল, ‘তোমার ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসে ছেলেমেয়ে কেউ যায়নি সেটাতে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের চিত্তশূন্য অহঙ্কার প্রকাশ পায়। এদেরই জন্যে আমি আমার রক্ত জল করে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়াচ্চি, নিজের আসল কাজ মাটি করচি এই কথা মনে করে পরিতাপ হয়।’


মাঝে মাঝে এই ক্লাস নেওয়া ছাড়াও অমিয় চক্রবর্তীকে তখন আর একটি দায়িত্ব পালন করতে হত। বিশ্বভারতীতে আগত দেশি–বিদেশি অতিথিদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব। দূরদেশ থেকে আগত প্রবাসীদের বন্ধু হতে তাঁর খুব বেশি সময় লাগত না। আর এসবেরই সুবাদে, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের তৈরি বড় বাড়িতে, আমলকি–বীথির কাছেই, সবুজ দরজা-অলা ছোট্ট একটা ঘরে থাকার ব্যবস্থা হল তাঁর। অমিয় চক্রবর্তী লিখছেন, ‘ঐ ঘরে বসে কত পড়তাম, কবিতা লিখতাম…। শান্তিনিকেতনে তখন যেন হাওয়ার স্রোতে ভেসে বেড়াতাম। এত উৎসাহ, এত বিচিত্র আনন্দ, কবির সান্নিধ্যই সব আনন্দের সঙ্গে যুক্ত। পরে আমার‘সবুজ ঘর’ ছেড়ে তাঁরই বাড়ি ‘কোণার্ক’-এ তিনি নিয়ে গেলেন, তাঁর সাহিত্য সহকারীর পদ গ্রহণ করলাম।’


রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিবের কাজ কি ছিল?


বিদেশি চিঠিপত্রের উত্তর দেয়া, কবিতা কপি করা, বাংলা ও ইংরেজি পাণ্ডুলিপি প্রকাশের জন্য সাজিয়ে রাখা, বইয়ের প্রুফ দেখা, অতিথি-অভ্যাগতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা— এমনকি সাংবাদিকদের ইন্টারভিউ দেওয়া। এর আগে রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্যদেশ ভ্রমণের সময় অমিয়কে সঙ্গীরূপে চেয়েছিলেন, কিন্তু অনেকের বাধা নেপথ্যে জেগে উঠেছিল। শান্তিনিকেতনে একটা গোষ্ঠী বারবার অমিয়র বিরুদ্ধাচরণ করে গেছেন। পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের কারণেই কবির সঙ্গে পেরু যেতে পারেননি তিনি। জাপান থেকে রবীন্দ্রনাথ তারযোগে অমিয়কে ডেকে পাঠালেন, তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে বললেন, কিন্তু নানা মতের দ্বন্দ্বে সেবারেও যেতে পারলেন না। অমিয় চক্রবর্তী জানতেন কারা বাধা দিচ্ছেন, শত্রুতা করছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে ঘুণাক্ষরেও তাঁদের নাম প্রকাশ করেননি। মনে মনে ভেবেছেন, ‘শান্তিনিকেতন মৈত্রীর স্থান, প্রীতির স্থান, সে কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। …সংসারের কিছুই বাঁধা নিয়মে চলে না, তাই দোষ দেব কাকে?’


কিন্তু ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন ইওরোপে গেলেন, তখন লন্ডন থেকে বার্লিনে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন অমিয় চক্রবর্তী। ভাগ্যিস ছিলেন। তাই সেই সফরে রবীন্দ্রনাথ আর আইনস্টাইনের সাক্ষাতের মনোজ্ঞ বিবরণ লিখে গেছেন, এমনকি গোপনে তাঁদের কথোপকথনের নোটও নিয়েছেন। মহাবৈজ্ঞানিক যেখানে থাকতেন, সেই পাড়ার নাম কাপুথ। ছোট্ট দোতলা বাড়ি, দেয়াল দিয়ে লতা উঠেছে, উপরের ঘরে হাসিগল্পে, চা-খাওয়ায় সময় কাটল। তখন আইনস্টাইনের স্ত্রী-কন্যাও ছিলেন। বাড়িতে বিরাজ করছে স্নিগ্ধ আনন্দ। বার্লিনে রবীন্দ্রনাথের হোটেলের ঘরেও সাক্ষাত করতে এসেছিলেন আইনস্টাইন। রবীন্দ্রনাথের ঘরের জানালার বাইরে ওয়ানসে হ্রদের সায়াহ্নের জল তখন রঙিন, পাল তুলে ছুটিবিলাসীদের ছোট ছোট পানসি নৌকো ভেসে চলেছে, তীরে শিশু আর বয়স্করা একসঙ্গে খেলছে, চড়ুইভাতি করছে। রবীন্দ্রনাথ আর আইনস্টাইন পাশাপাশি বসলেন, তাঁদের কথোপকথন শুরু হল। সে এক মহার্ঘ অতুলনীয় সন্ধ্যা। কিন্তু এই দুই মহাবন্ধুর কথাবার্তায় সব আনন্দ অতিক্রম করে মানুষের ভাগ্য সম্বন্ধে বেদনার প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। অমিয় চক্রবর্তীর লুকিয়ে লুকিয়ে নেওয়া নোটটাই পরে রবীন্দ্রনাথের ‘রিলিজন অফ ম্যান’ বইতে প্রকাশ পেল। এরপর তাঁদের আবার সাক্ষাৎ হল আমেরিকায়। দুজনের ছবি তোলার সেই কাহিনি আগেই জেনে গেছি আমরা।


রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিবের পদ ছেড়ে দিলেন অমিয় ১৯৩৩–এ। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি লাভের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন ইংল্যান্ডে। স্ত্রী-কন্যা শান্তিনিকেতনে রয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথকে বলে গেলেন,কবির বাণী বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার কাজেই তিনি ইওরোপ যাচ্ছেন। সত্যিই সেখানে পৌঁছে অমিয় নানা ধরণের উদ্যোগ নিয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। একটি ক্ষেত্রে অমিয় চক্রবর্তীর সাফল্য স্মরণীয়। পথিবীর যে মহাদেশটি তখনও পর্যন্ত আমাদের, এমনকি রবীন্দ্রনাথেরও চেতনায় ছায়াচ্ছন্ন ছিলো— সেই পরাভূত আফ্রিকার আদি সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে তিনি রবীন্দ্রনাথের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। নতুন প্রজন্মের কল্যাণব্রতী কিছু ইউরোপীয়র চোখে দেখা আলাদা এক আফ্রিকা তখন জেগে উঠছিল। মুসোলিনির অত্যাচারে তখন পিষ্ট হচ্ছে আবিসিনিয়া। সম্রাট হাইলে সেলাসি স্বেচ্ছা নির্বাসনে আছেন। নির্বাসিত উগান্ডার রাজপুত্র নিয়াবঙ্গো। এই পরিস্থিতিতে ১৯৩৬-এর ১৭ নভেম্বর অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথকে দীর্ঘ একটি চিঠিতে আফ্রিকা সম্বন্ধে অবহিত করে শেষে লেখেন, ‘আমার কেবলি মনে হচ্ছিল আফ্রিকার এই Tribe Eternal নিয়ে আপনি যদি একটি কবিতা লেখেন। আফ্রিকার সম্পর্কে আপনার কোনো কবিতা নেই— এইরকম কবিতা পেলে কীরকম আনন্দ হবে বলতে পারি না।’সাময়িক বিষাদে-অবসাদে আচ্ছন্ন রবীন্দ্রনাথের প্রথমে উৎসাহ হয়নি। তবুও অমিয়র বারংবার তাগাদায় আফ্রিকার লাঞ্ছিত অপমানিত ইতিহাস বিষয়ে উদাসীন থাকতে পারলেন না। এরপরেই লিখলেন বিখ্যাত‘আফ্রিকা’ কবিতা, ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭–এ। অমিয়কে কবিতাটি পাঠিয়ে সঙ্গে লিখলেন, ‘বাংলা ভাষার কুলুপমারা এই কবিতা নিয়ে ওদের কী কাজে লাগাবে?’ প্রিন্স নিয়াবঙ্গো পরে রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে এই কবিতার একটি অনুবাদও করিয়ে নিয়েছিলেন। হাইলে সেলাসি সোয়াহিলি ভাষায় সেই অনুবাদের অনুবাদ করিয়ে ছড়িয়ে দিলেন সারা আফ্রিকা জুড়ে। প্রিন্স নিয়াবঙ্গো এবং ফ্রেজার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখলেন। এই ভাবে বাংলা কবিতায় প্রবেশ করে আফ্রিকা আমাদের বিবেক-চেতনার অন্তর্গত হয়ে গেল চিরকালের জন্য।


সুভাষচন্দ্র বসু তখন নিজের চিকিৎসার জন্য ইওরোপে। অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা তাঁর চিঠি থেকে বোঝা যাচ্ছে ভিয়েনাতে অমিয়বাবুর বক্তৃতার আয়োজন করতে সুভাষচন্দ্র অত্যন্ত ব্যগ্র, ‘…আপনি অবিলম্বে জানাইবেন ভিয়েনায় কোন তারিখে পৌঁছিবেন এবং আন্দাজ কয়দিন থাকিবেন। আপনার জন্য বক্তৃতার আয়োজন করিতে অনেকে ব্যস্ত…।’ এরই সঙ্গে লিখলেন, ‘প্যারিস-এ গিয়া যদি কোনও কাজে লাগিতে পারি তাহা হইলে আমি সানন্দে যাইব।’


পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসের মধ্যে গান্ধী-সুভাষের দ্বন্দ্বে অমিয় চক্রবর্তী স্বস্তি বোধ করেননি। তবে তাঁর মনে হয়েছে ‘সুভাষবাবু একটু বাড়াবাড়ি করচেন’— এইভাবে রবীন্দ্রনাথকে তিনি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছেন স্বমত। কেননা এই দ্বন্দ্বে রবীন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্রেরই সমর্থক ছিলেন। রোমা রোলাঁর ভারত সম্পর্কিত দিনলিপিতে একটি কৌতূহল উদ্রেককারী তথ্য পাওয়া যায়। ১৯৩৫-এর ১২ জানুয়ারি রোলাঁ লিখেছেন, অমিয় চক্রবর্তী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। রোলাঁকে তিনি খুব জোর দিয়ে বলেছেন, ভারতের তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা জওহরলাল নেহরুরই একমাত্র আছে।


১৯৪৮-এ অমিয় চক্রবর্তী আমেরিকার নাগরিকত্ব নেন। আইনস্টাইন তাঁকে নিউ জার্সির প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য আমন্ত্রণ জানান। ফলে অমিয়র জীবনে এক নব অধ্যায় শুরু হয়। ১৯৪৯-এ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে জওহরলাল মার্কিন সফরে গেলেন। রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যানকে আইনস্টাইনের সঙ্গে নিভৃতে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছে জানালেন। ক্ষমতাবান রাষ্ট্রপতি আইনস্টাইনকে হোয়াইট হাউসে আনানোর বন্দোবস্ত করতে উদ্যত হলে জওহরলাল তাঁকে নিরস্ত করলেন। তিনি চাইলেন না অত বড় একজন মনীষী নিজে এসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করুন। অমিয় চক্রবর্তীর উদ্যোগে ব্যবস্থা হয়ে গেল। জওহরলাল, ইন্দিরা গান্ধী, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত এবং অমিয় চক্রবর্তী প্রথমে গেলেন বিজ্ঞানী ওপেনহাইমারের বাড়ি। দুপুরের আহার সেখানে সেরে বিকেলে পৌঁছলেন আইনস্টাইনের সেই জগতবিখ্যাত ১১২ মার্সার স্ট্রিটের বাড়িতে। ঘন্টা দুয়েকের নিবিড় হাস্যময় সেই সাক্ষাৎ এক বিরল ঘটনা।




২.


লাহোরের ফরমান ক্রিশ্চান কলেজে অনারারি প্রফেসর হিসেবে অমিয় পড়িয়েছেন তিন বছর। চুক্তির মেয়াদ ফুরোবে। নতুন চুক্তি করতে চাইছেন না। লাহোরে থাকতে চাইছেন না আর। শান্তিনিকেতনে না হোক,কলকাতায় অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে আসতে চাইছেন, রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি থাকতে চাইছেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে কিংবা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শূন্য অধ্যাপক পদে যোগ দেবার ইচ্ছের কথা রবীন্দ্রনাথকে চিঠিতে জানালেন। রবীন্দ্রনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে অমিয় চক্রবর্তী সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি জানিয়ে, প্রশংসা করে এই বিষয়ে অনুরোধ জানালেন। অমিয়বাবু নিজেও হাত গুটিয়ে বসে নেই। অক্সফোর্ডে ইংলিশ বোর্ডের চেয়ারম্যান নিকল স্মিথ, সি.এস. লিউসদের শংসাপত্র পেশ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমনকি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরোধে আধুনিক ইংরেজি কবিতার বিষয়ে কয়েকটি বক্তৃতাও দিয়েছেন। অথচ আশার আলো খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।


এদিকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে রবীন্দ্রনাথকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করতে শিগগিরই ভারতের প্রধান বিচারপতি স্যর মরিস গয়্যরের শান্তিনিকেতনে উপস্থিত হওয়ার কথা। মধ্যস্থ হিসেবে অমিয় চক্রবর্তী স্যর মরিসের সঙ্গে চিঠিপত্র লিখে অনুষ্ঠানের বিধিব্যবস্থা ঠিক করছেন। শান্তিনিকেতনের সিংহসদনে অনুষ্ঠান হবে। আসনের টানাটানি খুব, তাই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে আমন্ত্রিত বিশিষ্ট প্রতিনিধিদের সংখ্যা। অনুষ্ঠানের দিন ধার্য হয়েছে ৭ আগস্ট ১৯৪০। হঠাৎ এর মধ্যে কলকাতা থেকে রবীন্দ্রনাথ চিঠি পেলেন, অমিয় চক্রবর্তী আসছেন না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিয়োগ কমিটির মিটিং ইতিমধ্যে হয়ে গেছে এবং উপযুক্ত আবেদনকারীর অভাবে কাউকেই তাঁরা নাকি নিয়োগ করতে পারেননি। চিঠিতে লিখেছেন অমিয়: ‘বাংলাদেশ ছেড়ে চললাম— এখানে যেভাবে দিন কেটেছে— যে–রকম ব্যবহার পেয়েছি তাতে আর থাকা সম্ভব নয়।’ নিয়োগ–কমিটির কোনও–কোনও সদস্য আশ্রমের অনুষ্ঠানেও যাবেন, অমিয় সেই অনুষ্ঠানে তাই আর থাকতে চাইলেন না। রবীন্দ্রনাথ অমিয়কে লিখলেন: ‘আমার বিশেষ ইচ্ছা তুমি ৭ আগস্টের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকো। আর কোনো কারণ নয়— তোমাকে আমি যে অন্যদের চেয়ে শ্রদ্ধা করি সেইটে দেখাবার সুযোগ পেতুম।’ অনুষ্ঠানের দিন দেখা গেল রবীন্দ্রনাথ ছাড়া মঞ্চে বসে আরও চারজন: স্যর মরিস, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান, বিচারপতি হেন্ডারসন এবং অমিয় চক্রবর্তী। সবাই অক্সফোর্ডের আনুষ্ঠানিক হুড গাউন পরিহিত। ওই অনুষ্ঠানের মঞ্চে বসে অমিয় চক্রবর্তীর কী করণীয় ছিল জানা যায় না। মঞ্চের নীচে সামনের সারিতে বসেছিলেন অক্সফোর্ডের বিশিষ্ট ভারতীয় স্নাতকেরা। অন্য অতিথিদের স্থান হয়েছিল পিছনের সারিতে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন এমন কেউ-কেউ যারা মাত্র কয়দিন আগেই কলকাতার অধ্যাপক নিয়োগ কমিটির বৈঠকে অমিয় চক্রবর্তীর যোগ্যতা বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁদের চোখের সামনে অমিয় চক্রবর্তীকে মঞ্চে আসন দেবার অসাধারণ ইঙ্গিত-নাটকটির রচয়িতা অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ, যা মূল অনুষ্ঠানের সমান্তরালে সেদিন অভিনীত হয়ে গেল। তারপরেই কোনও এক অজ্ঞাত কারণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত পালটে গেল দ্রুত। কয়েক মাসের মধ্যেই অপ্রত্যাশিত নিয়োগপত্র পেয়ে কলকাতায় ফিরে এলেন অমিয় চক্রবর্তী। অধ্যাপকের স্থায়ী চাকরি পেলেন ইংরেজি বিভাগে।


বাবার অমতে, নিজের উজ্জ্বল কেরিয়ার রাতারাতি জলাঞ্জলি দিয়ে যে যুবক শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে আসার লোভে শান্তিনিকেতনে চলে এসেছিলেন, ১৯৩৩–এ তিনি সচিবের পদ ত্যাগ করে, শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে বিলেত পাড়ি দিলেন শুধুই ডিগ্রি লাভের বাসনায়? বোধহয় এটা আংশিক সত্য। আসলে অমিয় বুঝতে পারছিলেন ‘মহাপুরুষের ছত্রতলে বিরাজ করার মধ্যে একটা অলীকতা আছে— ঐ রকম আশ্রয় মানুষের সত্তার পক্ষে ক্ষতিকর।’ অমিয় চক্রবর্তী যে মূলত একজন কবি, মোট পনেরোটি কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা, তার প্রকাশ কিন্তু ১৯৩৩-এর মধ্যে, যখন তাঁর বয়স বত্রিশ ছুঁয়ে ফেলেছে, তখনও আমরা সেভাবে দেখতে পাচ্ছি না। ‘খসড়া’, ‘একমুঠো’, ‘দূরযানী’, ‘পারাপার’, ‘পালা-বদল’, ‘অনিঃশেষ’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থগুলি প্রকাশ পাচ্ছে ১৯৩৮ থেকে। শুধু তাই নয়, ১৯৮৬–র ১২ জুন, তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে দুই খণ্ড ‘কবিতাসংগ্রহ’, দুটি গদ্যের বই, দশটি ইংরেজি বই। প্রায় সারা পৃথিবী ভ্রমণ করেছেন, স্বদেশ–বিদেশ মিলিয়ে অন্তত দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। অ্যালবার্ট শোয়াইজার পদক,ইউনেস্কো প্রদত্ত বিশেষ পুরস্কার, ওয়াটুমুল ফাউন্ডেশন পুরস্কার, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম, ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পেয়েছেন। সারা পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য বিখ্যাত মানুষের সঙ্গ করেছেন— ইয়েটস, এলিয়ট,রবার্ট ফ্রস্ট, পাবলো ক্যাসালস, বার্নাড শ, সিলনপা, পাস্তেরনাক, চেস্টারটন, শোয়াইটজার, কে নেই সেই তালিকায়? তাঁর ‘সংগতি’ কবিতার ‘মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর/পোড়ো বাড়িটার/ঐ ভাঙ্গা দরজাটা/মেলাবেন’— পংক্তিগুলো এখন ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’ প্রবাদের জন্ম দিয়ে ফেলেছে। ‘তোমারও নেই ঘর/আছে ঘরের দিকে যাওয়া’, ‘আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে’, ‘কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে’— এসব পংক্তি তাঁর লেখা জীবনের শেষ সাড়ে চার দশকে, সেই ১৯৩৩–র পরেই।


সৃষ্টির এই অসম্ভব ক্ষুধা যাঁর মধ্যে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মত রয়ে গেছে, তাঁর পক্ষে এটাই ভাবা স্বাভাবিক যে রবীন্দ্র–বলয় থেকে নিজেকে সরিয়ে না নিয়ে যেতে পারলে, তাঁর আত্মসত্তার মুক্তি নেই। শিষ্য-প্রতিম নরেশ গুহকে লিখেছেন, ‘যে-সংসর্গমহিমা বিরাট রবীন্দ্রনাথের কাছে অজস্র ধারায় পেয়েছি তা বাড়তির অংক— তিনি একদিন স’রে গেলে আমি কি সূর্যচন্দ্রহীন হ’য়ে যাবো? মন বলত, চলো, চ’লে যাই।’ তাই তিনি শান্তিনিকেতন ছাড়লেন।


অমিয় চক্রবর্তীর এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছেন সুভাষচন্দ্র বসু। একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘আপনি যে ‘শান্তিনিকেতন’ থেকে চলে এসেছেন তাতে একটু আশ্চর্য হয়েছি। তবে আমার মনে হয় যে বড় গাছের ছায়ায় বেশি দিন থাকলে অন্য গাছও সহজে বড় হতে পারে না। অন্ততঃপক্ষে মহাত্মা গান্ধীর শিষ্যবর্গকে দেখে আমার একথা মনে হয়। স্বামী বিবেকানন্দ তাই তাঁর শিষ্যদের নিজের সঙ্গে বেশি দিন রাখতেন না।’


রবীন্দ্রনাথ এই বিচ্ছেদ মানতে পারেননি। অমিয়র উপর তাঁর আশ্চর্য নির্ভরতা, আস্থা, বিশ্বাস ছিল। যেদিন আশ্রম থেকে বিদায় নিচ্ছেন অমিয়, তাঁর বোলপুর স্টেশনমুখী মোটর গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথ। বললেন, ‘যদি কখনও কিছুমাত্র দরকার হয়, অমিয়, আমাকে জানিয়ো।’ অমিয় কবিকে নমস্কার করলেন, মুখে তাঁর একটিও কথা এলো না। গাড়ি চলে গেল। বিমর্ষ রবীন্দ্রনাথের মনে গত পনেরো বছরের স্মৃতি বারবার ফিরে আসছে। রাত জেগে তাঁর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করা, কোণার্ক বাড়ির বারান্দায় বসে মেঘাবত আসন্ন সন্ধ্যাকে দেখা, হ্যাভেলক এলিসের প্রশ্নের উত্তরে অমিয়কে ‘বিজ্ঞান’ সম্পর্কে মনের সব কথা অনর্গল বলে যাওয়া— এইসব ভাবতে ভাবতে চিঠি লেখার কাগজে উজাড় করে দিলেন মনখারাপের অতল শব্দমালা, ‘এতদিন পরে আজ তুমি চলে গেলে কীরকম খারাপ লাগচে বলতে পারি নে। এ যেন মৃত্যুর বিচ্ছেদের মতোই কেবলি মনকে বৃথা আঘাত করচে। যখন মানুষ বেঁচে থাকে তখন কোনোমতেই মনে হয় না কোনোদিন মত্যু আসতে পারে। কিন্তু শেষকালে আসে। তারপরে মনকে সেই শূন্যতার সঙ্গে বোঝাপড়া করিয়ে নিতে হয়। …তুমি আমার অনেক করেচ, অনেক ক্লান্তি থেকে বাঁচিয়েচ— তোমার সহযোগিতা আমার পক্ষে বহুমূল্য হয়েছিল সে কথা কোনো দিন ভুলতে পারবো না— কোনো দিন তোমার অভাব পূর্ণ হবে না।’






------------------------------


(কৃতজ্ঞতা: শঙ্খ ঘোষ, অর্চনা গুহ, সুমিতা চক্রবর্তী, সুমিতা ভট্টাচার্য, সুচরিতা গুহ, অভিষেক চক্রবর্তী)

2 comments: