0
undefined undefined undefined

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়


যং কাময়ে তং তম্‌ উগ্রং কৃণোমি
তং ব্রহ্মাণং তম্‌ ঋষিং তং সুমেধাম্‌

আমি যাকে চাই, সে হয় ওজস্বী, ব্রহ্মা, মেধাবী ও ঋষি।

তিনি যাঁকে চান, আমাদের আরাধ্য তাঁরাও। তিনি মেধা। তিনি ধী। তিনি মনস্বিতা। সেই তিনি চেয়েছিলেন বিবেকানন্দকেও। ১৮৯৩ এর ১১ই সেপ্টেম্বর,নিজের মনন-মেধা অনু্যায়ী ভারতকে বাণীরূপ দিয়ে বিদেশের সামনে তুলে ধরেন স্বামীজি। দেশে ফেরার পর ১৮৯৮ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি, রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেবের উদ্যোগে শোভাবাজার রাজবাড়িতে আয়োজিত এক জনসভায় বিবেকানন্দকে প্রথম নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া হয় তাঁর নিজের শহরে। সভায় সভাপতিত্ব করেন রাজা বিনয়কৃষ্ণ নিজেই। শিকাগো বক্তৃতার একশ’পঁচিশ বছর পূর্তি এবং বিবেকানন্দের প্রথম নাগরিক সম্বর্ধনার স্মৃতিকে হৃদয়ে ধরে, শোভাবাজার রাজবাড়ির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আমরা তাঁর ১৫৫ তম জন্মজয়ন্তী পালন করলাম শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে। কোনও নরদেহধারী দেবতাকে স্মরণ করিনি আমরা। স্মরণ করেছিলাম সেই মনস্বীকে যিনি নিজেকে বলতেন a voice without a form। এই মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এবারের ঋতবাকের নাম বিবেকানন্দ সংখ্যা।

আরও কয়েকজন ধীমানকে আমরা বরণ করেছি গত বারোই জানুয়ারি। শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামী, নৃসিংপ্রসাদ ভাদুড়ী। এবারের ঋতবাক মুদ্রণ সংখ্যায় এঁদের সবার সৃজন থাকছে। লেখা দিচ্ছেন একালের কবি শ্রীজাতও। দার্শনিক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ছাড়াও কল্প-প্রকল্প –অণুকল্প-কে বর্ণে-গন্ধে সাজিয়েছেন বহু গুণীজন। তাঁরা সবাই ঋতব্রতী।

মুদ্রণ সংখ্যা পাওয়া যাবে বইমেলায়। ৩৩৪ নম্বর স্টলে। সবাই আসবেন। আরও বই থাকবে। আগের বছরে মুদ্রিত বইগুলো তো থাকবেই; তাছাড়াও থাকবে এ’ বছরের নির্মাণগুলিও। এই বছর মোট সাতাশটা বই নিয়ে আসছি। মন্দ নয়। কী বলেন?

ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। 

শুভ কামনা নিরন্তর।

0 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - চয়ন সমাদ্দার

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


বিবেকানন্দ – ফুল প্যাকেজ 
চয়ন সমাদ্দার



‘I could not find the exact orange colour of my coat here, so I have been obliged to satisfy myself with the next best – a cardinal red with more of yellow.’

ওপরের ইংরিজি লাইন দু’টো, একটা চিঠি থেকে নেওয়া। ১লা মে, ১৮৯৪তে নিউ ইয়র্ক থেকে লেখা হয়েছিল চিঠিটা। একত্রিশ বছরের এক ফ্যাশনেবল্‌ বাঙালি যুবক, আমেরিকার ফ্যাশন স্টোরে নিজের পছন্দের রঙের কোট পাচ্ছেন না। কমলা রঙ না পেয়ে লাল রঙের কোট কিনছেন। চিঠিটায় আরও লেখা আছে যে, মীরশ্যাম পাইপ কিনে তিনি ছেলেমানুষের মতো খুশি। মানুষটির নাম স্বামী বিবেকানন্দ। 



নরেন্দ্রনাথ দত্ত যে সময়ের মানুষ, সে সময় বাঙালি মোগলাই পোশাক ছেড়ে ধুতি-ফতুয়া-কামিজ ধরেছে। হালফ্যাশনের বাবুরা পরছেন কোট পাতলুন। অল্প বয়সী ছেলেছোকরাদের চুলের বাহার ছিল খুব। সেই সময়, ব্রাহ্ম সমাজে, অন্যান্য সভাতে, সিমলে পাড়ার একটা ছেলে সবার চোখে পড়ত। পাঁচ ফুট ন’ইঞ্চি মতো লম্বা, চওড়া বুক, ব্যায়ামকরা মজবুত দেহ, কপাল চওড়া, কঠিন চোয়াল। চোখ দুটো দেখলে তাকিয়ে থাকতে হয় কিছুক্ষণ। বড় বড় চোখের পাতা, ঘনকালো, টানা-টানা দুটো চোখ। কোঁকড়া চুলের মাঝখান দিয়ে টানা সিঁথি। তবে, এ ছোকরা কেমন যেন! শুধু ধুতির খুঁট গায়ে জড়িয়ে ঘুরছে। কলেজ থেকে ফিরছে, কোটের বোতাম গুলো খোলা। বড় অন্যমনস্ক। তবে, যা পরে, যা করে সবেতেই মানিয়ে যায় নরেনকে। দক্ষিণেশ্বরের তোতলা বামুন বলে, ‘তোরা সব এক থাকের, নরেন অন্য থাকের।’



রামকৃষ্ণ পরমহংসের এই মন্তব্যই সন্ন্যাসী জীবনে পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। যে দিন নিজের উদ্দেশ্য তাঁর কাছে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হয়ে ওঠে, সেদিন থেকেই একটা সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বরাবরই তিনি নজর কাড়েন, সেটাই এবার থেকে সচেতন ভাবে করতে হবে। বেদান্তজ্ঞান মনের মধ্যে ধরে তিনি জানেন যে, বাইরের চেহারাটার মধ্যে আসল তিনি নেই। তাঁর ভেতরের অমলজ্যোতিকে ছোঁওয়ার সাধ্য নেই কোনও কিছুরই। তাই, হিন্দুধর্মকে সবার সেরা প্রমাণ করতে, বাইরের দুনিয়ার সামনে তাকে তুলে ধরতে নিজের দেহটাকেই তার বিজ্ঞাপন করে তুলবেন তিনি। পশ্চিমি বাজারে ডাঁটসে নিয়ে যাবেন নিজের পসরা। ভারতের আধ্যাত্মিকতা। বলবেন, এর বিনিময়ে আমি নেব তোমাদের জড়বিজ্ঞান। আমার দেশের এই সময়ে, ওটা বড় দরকার। এই উদ্দেশ্যের সামনে আর সব কিছু তুচ্ছ। বিদেশীরা সন্ন্যাসী বলতে কী বোঝে, জানা আছে তাঁর। আধল্যাংটো, গায়ে ছাইমাখা, জটাধারী, একদল মানুষ। যাঁদের ওরা শ্রদ্ধা করতে শেখেনি। সেই শ্রদ্ধা তিনি আদায় করে ছাড়বেন । ঠাকুর তো বলেইছেন, ‘নরেন শিক্ষে দিবে।’ সত্যিকারের বিবেকানন্দ হলো, আ ভয়েস উইদাউট আ ফর্ম। ভারতের আত্মার কন্ঠস্বর তিনি। যে বিবেকানন্দকে লোকে দেখছে, এখন থেকে সে একটা প্রতীক। ভারতের ত্যাগ, বীর্য, সৌন্দর্যচেতনা- সব কিছুকে সদর্পে বিদেশের সামনে হাজির করতে, বাইরেটাকে এমন করে সাজাবেন তিনি, যেন ওরা চেয়ে থাকতে বাধ্য হয়। তাঁর ব্যারিটোন কন্ঠে, ওদেরই ভাষায় তাঁর স্বদেশ সম্বন্ধে যা যা বলবেন তা ওদের শুনতে হবে। জন্ম হলো বীর সন্ন্যাসী প্যাকেজের। সন্ন্যাসী ধারণাটারই খোল নলচে বদলে গেল। বিদেশ হাঁ করে চেয়ে দেখল এক দিব্যকান্তি মানুষকে। গেরুয়া আলখাল্লা পরা, মাথায় রাজস্থানী পাগড়ি। এই পাগড়িই বিবেকানন্দের ইউ এস পি। বাংলার মানুষ আগে বা পরে কখনও এমন পাগড়ি পরেনি। রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজরা এখনও পরেন না। তাঁরা পরেন সেই কানঢাকা টুপি, যেটা বিবেকানন্দ হিমাচল থেকে এনেছিলেন। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ নিয়েছেন এই পাগড়ির লিগ্যাসি। স্বামীজির ফ্যাশন স্টেটমেন্ট আজও বেঁচে আছে কিন্তু!

এই পর্যন্ত বলে একটু থামতে হবে আমাদের। আবার, একবার পেছনে তাকাতে হবে। কেননা, আমরা এতক্ষণ আবেগে ভেসেছি। এবার একটু তথ্য ভিত্তিক হই। বিবেকানন্দ আমেরিকা গিয়েছিলেন কেন? বেদান্তবাদী হিন্দুধর্মের মহিমা বিদেশিদের কাছে প্রচার করতে। কোথায়? শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে। সেটা কী ছিল? ১৮৯৩ এ কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের চারশ’ বছর পূর্তি উপলক্ষে শিকাগোতে অনুষ্ঠিত হয় একটা বিরাট মেলা আর প্রদর্শনী। World’s Columbian Exposition। ১লা মে, এই মেলা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। মেলা চলে ১৮৯৩-এর ৩০শে অক্টোবর পর্যন্ত। এই মেলার একটা অংশ ছিল ধর্মমহাসভা। মেলা শুরু হওয়ার দু’বছর আগে থেকেই সারা পৃথিবীতে তিন হাজারের বেশি নেমন্তন্নর চিঠি পাঠানো হয়। সেই চিঠিতে বোলা হয় যে, এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্যগুলোর একটা হলো, বিভিন্ন ধর্মের মধ্যেকার সত্যগুলো জনসাধারণের সামনে চিত্তাকর্ষক ভাবে তুলে ধরা। (নজরটান আমার)। কী মনে হচ্ছে? একেবারে ছাপমারা আমেরিকান শো-বিজ্‌, তাই না? না, বিবেকানন্দ এসব জেনে শো দিতে আমেরিকা যাননি। কারণ, তাঁর কাছে কোনও চিঠি যায়নি। তিনি বুঝেছিলেন, তাঁকে বিদেশ গিয়ে নিজের ধর্মের জয়গান গাইতে হবে। কারণ, সেটা করলে দেশে শিক্ষা দেওয়ার সুবিধে। বিদেশী প্রিজমে দেশ দেখা বৃটিশ কলোনীর প্রজাদের তাঁর খুব ভালোভাবে চেনা হয়ে গিয়েছিল। এখান থেকে টাকা রোজগার করে দেশে ফিরে একটা মিশন গড়ার উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। দেশবাসীর দেহ আর মনের স্বাস্থ্য ফেরানোর আদর্শ সামনে ছিল। এসব ভেবে ১৮৯৩ সালের ৩০শে জুলাই তিনি আমেরিকা যান। শিকাগোতে এসে তিনি জানতে পারেন, ১) তাঁর নাম নথিভুক্ত নেই, করার দিনও পেরিয়ে গেছে; ২) ধর্ম মহাসভায় অংশগ্রহণের জন্য আবশ্যিক পরিচয়পত্র নেই তাঁর কাছে; ৩) শিকাগো থাকা-খাওয়ার খরচ অসম্ভব বেশি। খরচ টানতে না পেরে, বিবেকানন্দ যান বোস্টন। সেখানে থাকা-খাওয়া শিকাগোর চেয়ে অনেক সস্তা। যাওয়ার পথে রেলে আলাপ হয় কেট স্যানবার্নের সঙ্গে। তাঁর সাহায্যে যোগাযোগ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন রাইটের সঙ্গে। তিনি বিবেকানন্দকে নানা ভাবে সাহায্য করেন। পরিচয়পত্র লিখে দেন, ধর্মমহাসভার প্রতিনিধি নির্বাচক কমিটির সেক্রেটারিকে দেওয়ার জন্য একটা চিঠি লেখেন, General Committee of the World’s Congress Auxiliary on Religious Congress এর চেয়ারম্যান রেভারেন্ড জন হেনরি ব্যারোজ-এর ঠিকানা দেন এবং শিকাগো যাবার রেলের টিকিট দেন। বোস্টনে বিবেকানন্দ ছিলেন তিন সপ্তাহের কাছাকাছি। ২৭শে অগাস্ট থেকে ৫ই ও ৬ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি মোট এগারটা বক্তৃতা দেন। সবই ভারত আর হিন্দুধর্ম বিষয়ক। এবং সেগুলো নিয়ে কাগজে লেখাও হতে থাকে। তার মানে, ধর্মমহাসভার আগেই কিছুটা প্রচার পেয়ে যান এই হিন্দু সন্ন্যাসী। আর এগোনোর আগে একটা কথা বলে নিই। শিকাগো ধর্মমহাসভায় ভারত থেকে মোট তের জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিবেকানন্দ ছাড়া হিন্দু ছিলেন আরও চারজন : লাহোরের লক্ষ্মীনারায়ণ, মাদ্রাজের নরসিংহাচার্য, মজফ্‌ফরগড়ের জিন্দারাম এবং মুলতানের সিধ্‌ধুরাম। সুতরাং, বিবেকানন্দকে যে হিন্দুধর্মের কথা বলতে হয়েছিল তা অবশ্যই বাকীদের থেকে আলাদা। এই আলাদা হিন্দুত্ব নিয়ে তর্কের শেষ নেই। কেউ এর মধ্যে দেখেন প্র্যাকটিকাল বেদান্তবাদ; কেউ আবার ১৮৯৭ সালে The Hindu পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকার ঊদ্ধৃত করে বলেন যে, তিনি জাতিভেদ প্রথার সমর্থক ছিলেন। বিবেকানন্দের স্ববিরোধিতা আজকাল খুব ইন্‌ থিং! তবে, এ কথাও সত্যি, স্বদেশকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে বিবেকানন্দ কিছু অদ্ভুত কথা বলেন এই সময়। যদি, ১৮৯৩ এর ২৮শে অগাস্ট সালেমের ওয়েস্‌লি চ্যাপেলে দেওয়া তাঁর বক্তৃতার খবর তার পরের দিনের ইভনিং নিউজে যে ভাবে বেরিয়েছিল তা সত্যি হয়, তাহলে আমাদের মেনে নিতে হবে, স্কটিশ চার্চ কলেজের উজ্জ্বল ছাত্রটি বিশ্বাস করেন, ভারতের মেয়েরা স্বামীকে এতই ভালবাসেন যে, স্বেচ্ছায় মৃত স্বামীর চিতায় প্রাণ বিসর্জন দেন তাঁরা। যদিও সে প্রথা ভারতে তখন কানুনি –অপরাধ, তবু বিবেকানন্দ ‘explained the old custom of woman being burned on the death of their husbands, on the ground that they loved them so that they could not live without the husband. They were in marriage and must be one in death’। ১৮৯৩ এর ২৯শে অগাস্টের ডেইলি গেজেট এর রিপোর্ট বলছে, স্বামী বিবেকানন্দ ওয়েসলি চার্চের বক্তৃতায় বলেছেন, ‘ভারতের স্বামীরা কখনওই মিথ্যে বলে না এবং তাদের স্ত্রীদের ওপর অত্যাচার করে না।’ অতি উদ্ভট কথা। সন্দেহ নেই। এসব নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে বিস্তর। আমাদের কিন্তু অন্যরকম মনে হয়। আমরা মনে করি, এই কথাগুলো জেনে শুনে বলা। ‘ভিক্ষের’ ঝুলি হাতে যে ‘অবুঝ’ জনতার মধ্যে গিয়ে হাজির হয়েছেন, তাদের চমকে দেওয়ার জন্যে বলা। সচেতন ভাবে বিবেকানন্দ আলাদা হতে চাইছেন। নির্মাণ করছেন প্যাকেজ-বিবেকানন্দ। আমরা মনে করি, ধর্ম-বাণিজ্য সভা থেকে যে কোনও মূল্যে অর্থ সংগ্রহ করে দেশে ফিরে তাঁর নিজস্ব ঐশীচেতনার চর্চা ও প্রচারের ক্ষেত্র তৈরী করতে প্রবলভাবে ঔপনিবেশিক, ম্যাসক্যুলিন ক্রিশ্চান যাজকদের সঙ্গে এক দ্বৈরথে নেমেছিলেন তিনি। My God is in no way lesser than your God। ২রা নভেম্বর, ১৮৯৩-তে আলাসিঙ্গাকে লেখা চিঠিটার কথাও মনে করতে পারি আমরা। বিবেকানন্দ সভায় গিয়ে দেখতে পান, সেখানে ধনী ঘরের মহিলার সংখ্যাই বেশি। কেননা, হাতে প্রচুর সময় ও তা নিয়ে যা খুশি করার মতো আর্থিক নিরাপত্তা সবচেয়ে বেশি ছিল তাঁদেরই। তাঁদের করধ্বনি আর উচ্ছ্বাস কতটা বিবেকানন্দের বেদান্তবাদী বক্তৃতা আর কতটা তাঁর রূপ আর পোশাকের জন্য,তা নিয়ে স্বামিজি নিজেই যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তাই তিনি লেখেন, ‘আমার গৈরিক বসনে শ্রোতৃবৃন্দের চিত্ত কিছু আকৃষ্ট হইয়াছিল,…’। সংবাদপত্র থেকে ঊদ্ধৃতি দেন, “এই সুন্দর মুখ বৈদ্যুতিক শক্তিশালী অদ্ভুত বক্তাই মহাসভায় শ্রেষ্ঠ আসন অধিকার করিয়াছেন।”: যদিও ব্যারোজের রিপোর্ট বলছে যে সবচেয়ে বেশি হাততালি ও অভিনন্দন পেয়েছিলেন কনফুসীয় মতের প্রতিনিধি পাং কয়াং যু। বিবেকানন্দ নিশ্চয়ই দেখেছিলেন যে, শিকাগোর এক কাগজ স্বামীজির দেহসৌষ্ঠব আর পোশাকের প্রভাব মহিলাদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তার কারণ বলে লিখেছে। এই সব কিছু মিলিয়েই দ্রুত জনপ্রিয়তা চেয়েছিলেন বিবেকানন্দ। তিনি জানেন, তাঁর অন্তর্জ্যোতি ভাল-মন্দ কিছুর তোয়াক্কা করেন না – না দত্তে কস্যচিৎ পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভু। তাঁর দেশের মহাকাব্যই বারবার বলেছে সিচ্যুয়েশনাল এথিক্সের কথা। তাঁর আসল উদ্দেশ্য এতটাই বড় যে তার জন্য নিজেকে নিলামে তুলতে বাধেনি তাঁর। 





বিবেকানন্দের এই আলাদা হয়ে ওঠাটা আরেক শ্রেণীকে মোহিত করেছিল। ইংরিজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। কোট পাতলুন পরা দিশি সাহেবদের দল। এদের ইমপ্রেস করাটাও খুব জরুরী ছিল। শিক্ষার পুঁজিটা এদের হাতে। এদেরই ক্যাম্পেইনে দ্রুত প্রচার পাবে সন্ন্যাসের এই নতুন রূপের কথা। সারা ভারত ঘোরার সময়, এই ইংরিজি বলা সন্ন্যাসী যে এই কাজটা খুব ভালোভাবে পেরেছিলেন, তার বিস্তর রেকর্ড আছে। উদাহরণ হিসেবে, বম্বের বেলগাঁওএর ফরেস্ট অফিসার হরিপদ মিত্রের কথা মনে করা যেতে পারে। বিবেকানন্দের চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাস পিকউইক পেইপার্স মুখস্ত বলা দেখে, জুল ভের্নের সায়েন্স ফিকশন পড়া দেখে তিনি অবাক হয়েছিলেন। প্রচণ্ড বিস্মিত হয়েছিলেন জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় স্বামীজির অবাধ চলা ফেরা দেখে। তবে, ১৮৯২ এর ১৮ অক্টোবর বিবেকানন্দকে প্রথম দেখে তাঁর যে অনুভূতি হয়েছিল সেটা তিনি কোনওদিন কাটিয়ে উঠতে পারেননি।



‘ফিরিয়া দেখিলাম প্রশান্তমূর্তি, দুই চক্ষু হইতে যেন বিদ্যুতের আলো বাহির হইতেছে। গোঁফদাড়ি কামানো, অঙ্গে গেরুয়া আলখাল্লা, পায়ে মহারাষ্ট্রীয় দেশের বাহানা চটিজুতা, মাথায় গেরুয়া কাপড়েরই পাগড়ি।’ 



পহেলে দর্শনধারী! এই কথাটাই খুব স্পষ্ট করে বুঝেছিলেন বিবেকানন্দ। বুঝেছিলেন, আরও একটা কথা। রামকৃষ্ণেরই কথা। খালি পেটে ধর্ম হয় না। প্রচারের জন্য তিনি যে একধরণের শোবিজ্‌ করেন সেটাও তিনি জানতেন। আর তা নিয়ে কোনও মেকি লজ্জা ছিল না তাঁর –

‘বাবা, তোমরা যেরূপ Utilitarian (উপযোগবাদী), যদি আমি চুপ করিয়া বসিয়া থাকি, তাহা হইলে তোমরা কি আমাকে একমুঠা খাইতে দাও? আমি এইরূপ গল্‌ গল্‌ করিয়া বকি, লোকের শুনিয়া আমোদ হয়, তাই দলে দলে আসে। কিন্তু জেনো, যে সকল লোক সভায় তর্ক বিতর্ক করে, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে, তাহারা বাস্তবিক সত্য জানিবার ইচ্ছায় ওরূপ করে না। আমিও বুঝিতে পারি, কে কি ভাবে কি কথা বলে এবং তাহাকে সেইরূপ উত্তর দিই।’

উদ্দেশ্য পরিষ্কার। পরিষ্কার প্রেজেন্টেশন। পোশাক, কথা বলা – সব মিলিয়ে গড়ে তোলা ফ্যাশনের নিপুণ প্রয়োগ। 



এ ব্যাপারে বিবেকানন্দ কতটা সচেতন ছিলেন, তা ছোটবেলার বন্ধু, পাড়ার ছেলে, প্রিয়নাথ সিংহের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা শুনলেই বোঝা যায়। 

স্বামীজি। আমার ইচ্ছে করে, আমার চোখ দিয়ে তোদের সব দেখাই…এই এত বড় বড় সব বাড়ি government এর রয়েছে, বাইরে থেকে দেখলে তার কোন মানে বুঝিস, বলতে পারিস? তারপর তাদের খাড়া প্যান্ট, চোস্ত কোট, আমাদের হিসেবে একপ্রকার ন্যাংটো। না? …আমাদের জন্মভূমিটা ঘুরে দেখ্‌। কোন buildingটার মানে না বুঝতে পারিস, আর তাতে কিবা শিল্প! ওদের জলখাবার গেলাস, আমাদের ঘটি- কোনটায় আর্ট আছে?...পাড়াগাঁয়ে চাষাদের বাড়ি দেখেছিস? 

আমি। হাঁ।

স্বামীজি। কি দেখেছিস? 

আমি। বেশ নিকন-চিকন পরিষ্কার।

স্বামীজি। তাদের ধানের মরাই দেখেছিস? তাতে কত আর্ট! মেটে ঘরগুলোয় কত চিত্তির বিচিত্তির!...কি জানিস? সাহেবদের utility আর আমাদের art- ওদের সমস্ত দ্রব্যেই utility, আমাদের সর্বত্র আর্ট। ঐ সাহেবী শিক্ষায় আমাদের অমন সুন্দর চুমকি ঘটি ফেলে এনামেলের গেলাস এনেছেন ঘরে। ওই রকমে utility এমনভাবে আমাদের ভেতর ঢুকিয়েছে যে বদহজম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন চাই art এবং utilityর combination;…

প্রশ্ন। কোন্‌ দেশের কাপড় পরা ভাল?

স্বামীজি। আর্যদের ভাল।…কেমন পাটে পাটে সাজানো পোশাক। যত দেশের রাজ-পরিচ্ছদ এক রকম আর্য জাতির নকল, পাটে পাটে রাখবার চেষ্টা, আর তা জাতীয় পোশাকের ধারেও যায় না। দেখ সিঙ্গি ঐ হতভাগা শার্টগুলো পরা ছাড়।

প্রশ্ন। কেন? 

স্বামীজি। আরে ওগুলো সাহেবদের underwear। সাহেবরা ঐগুলো পরা বড় ঘৃণা করে। কি হতভাগা দশা বাঙালীর! যা হোক একটা পরলেই হল? কাপড় পরার যেন মা-বাপ নেই। কারুর ছোঁয়া খেলে জাত যায়, বেচালের কাপড়-চোপড় পরলেও যদি জাত যেত তো বেশ হত। কেন, আমাদের নিজেদের মত কিছু করে নিতে পারিস না? কোট শার্ট গায়ে দিতেই হবে, এর মানে কি? 



বিবেকানন্দের পুরো ভাবনা এর মধ্যে ধরা আছে। কম্বিনেশন। ফিউশন। এথনিসিটি। একটা টোটাল প্যাকেজ। একজন মানুষই হোক বা একটা গোটা জাত, অন্তরে সে অম্লান, অমৃতজ্যোতি। বাইরে তাকে সে ভাবেই সাজতে হবে, যাতে করে পৃথিবীকে ডেকে সে বলতে পারে – দেখ, এই আমি। স্বতন্ত্র। এস। আদানপ্রদান হোক। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলি। 



কিন্তু, এই সব কিছুর মধ্যে, নিজেকে কিছু একটা ‘বানিয়ে তোলা’র ভেতর, ‘বাধ্যতামূলক বক্তব্য’ বলে যাওয়ার নেপথ্যে একটা বিশাল ‘স্ট্রেস ফ্যাকটর’ কাজ করে। তাঁর ‘আরেকটা বিবেকানন্দ থাকলে…’ প্রবন্ধে শিবাংশু দে লিখেছেন,

হয়তো বিবেকের বিরূদ্ধে ক্রমাগত যাত্রা করতে করতেই তিনি অতো কম বয়সে হতোদ্যম ও ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন। গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়কের মতো মৃত্যু ছাড়া তাঁকে শুশ্রূষা দেওয়ার আর কেউ ছিল না। 



আমাদেরও তাই মনে হয়। ব্র্যান্ড বিবেকানন্দ ভেতরে ভেতরে ক্ষইয়ে দেয় মানুষ বিবেকানন্দকে। পুঁজি ও উপনিবেশবাদের সঙ্গে নিজের নিয়মে লড়তে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পরানের সাথে মরণখেলা খেলতে হয় তাঁকে। 





তথ্যসুত্র : 

Swami Vivekananda On Himself – Advaita Ashrama, 2006

স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (৯) – উদ্বোধন কার্যালয়,২২ তম পুনর্মুদ্রণ, জৈষ্ঠ ১৪১৯

প্রসঙ্গ :রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ – কণিষ্ক চৌধুরী।

আরেকটা বিবেকানন্দ থাকলে… - শিবাংশু দে। 















0 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী

Posted in


প্রবন্ধ


বিবেকানন্দ ও তাঁর অনুগামীদের বেদান্তপ্রচারঃ ব্রাহ্মসমাজ ও রবীন্দ্রনাথের চোখে 

অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী 



শিকাগোর ধর্মমহাসভায় ভারতের নানা ধর্মমতের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তৃতা করে ১৮৯৩ সালে সনাতন হিন্দুধর্মের প্রচারক স্বামী বিবেকানন্দ ছাড়া অন্য যাঁরা শ্রোতাদের আগ্রহ ও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন বৌদ্ধধর্মের অনাগারিক ধর্মপাল, জৈনধর্মের বীরচাঁদ গান্ধী, নববিধান বা ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের প্রতাপচন্দ্র মজুমদার। ভারতীয় বক্তাদের সাফল্যের এই সংবাদ ভারতবর্ষের জনমানসে স্বভাবতই প্রভূত উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল। ভারতে, বিশেষত বাংলাদেশে এই গণ-উদ্দীপনার নায়ক ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। বিদেশপ্রত্যাগত এই সন্ন্যাসী যখন ১৮৯৭ সালে তাঁর জন্মভূমির তটে এসে অবতরণ করলেন তখন যেন আসমুদ্রবঙ্গভূমি ভারতবর্ষ তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বলল, “তরুণ বীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়, একি গো বিস্ময়!” বিবেকানন্দের গণ-অভ্যর্থনার প্রথম ঢেউ যেন আছড়ে পড়ল সিংহলের সমুদ্রতটে, সেখানে এই যুবক সন্ন্যাসীর সম্বর্ধনার বিবরণ পড়ে আজ মনে হয়, তিনি যেন সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন আর এক ‘বাঙালির ছেলে বিজয়সিংহ রূপেই! ’ তারপর সেই ঢেউ কলোম্বো-রামনাদ- মাদ্রাজ- মহীশূর হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ভাগীরথীর ধারায় ধোয়া বাংলাদেশকেও ! কবির ভাষায় “জনমিল যেথা বিবেকানন্দ দেশ-আত্মার কুন্ঠা হরি’’ , স্বামীজির নিজের ভাষায় যে শহরের পথের ধূলোয় তিনি খেলা করেছেন, তাঁর সেই ‘শৈশবের শিশুশয্যা’ কলকাতা নগরীর পক্ষে তাঁকে প্রথম নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হল শোভাবাজারের রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে। সে ইতিহাস আজ সুবিদিত।




কিন্তু বিবেকানন্দের ঐ “বিশ্ববিজয়ে’’র পরবর্তী উৎসাহপ্লাবন সত্যিই কি বাঙলাদেশের সকলকেই ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল? বা অভিভূত করেছিল সমভাবে? সাধারণ জনমনে বা শিক্ষিতমানসে এ-ঘটনা যে একধরনের আলোড়ন এনেছিল এ-নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই, কিন্তু এই ঘটনার গুরুত্ব সম্পর্কে সবাই কি একমত ছিলেন, বিশেষ করে সেই ব্রাহ্মসমাজের মানুষজন, যাঁরা বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের প্রচারিত ধর্ম ও সাধনপদ্ধতির অনেক কিছুই অনুমোদন করতেননা? আমাদের মনে রাখতে হবে যে, তখনকার বাংলাদেশে ব্রাহ্মসমাজের তিনটি শাখা সক্রিয় ছিল - আদি, ভারতবর্ষীয় ও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ। নববিধান [বা ভারতবর্ষীয়] সমাজের নেতা কেশবচন্দ্র সেন কিন্তু ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের একজন অনুরাগী, বস্তুত তিনিই প্রথম এই গ্রাম্য সাধকের কথা সুধীসমাজে প্রচার করেন। আবার প্রাক্‌-সন্ন্যাস জীবনে বিবেকানন্দ নিজে একদা যুক্ত ছিলেন ব্রাহ্মদের সর্বাধুনিক শাখাটির অর্থাৎ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে। আবার তারও আগে ঈশ্বরজিজ্ঞাসু তরুণ বিবেকানন্দ উপস্থিত হয়েছেন আদি ব্রাহ্মসমাজের নেতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে।




বিবেকানন্দের বিশ্বখ্যাতি ও সমকালের ব্রাহ্ম প্রতিক্রিয়া




এই পটভূমিটুকু মনে রেখে অগ্রসর হলে আমরা দেখতে পাই যে, আদিসমাজের প্রধান পুরুষ দেবেন্দ্রনাথ শিকাগোতে তাঁর পুর্বপরিচিত যুবকের সাফল্যসংবাদ শুনেই বিবেকানন্দের কলকাতার বাড়িতে এক অভিনন্দন বার্তা পাঠান, স্বামীজি তখনও দেশে ফেরেন নি। দেশে ফিরে আসার পর তিনি অবশ্য মহর্ষির সঙ্গে সৌজন্য-সাক্ষাৎ করে এসেছিলেন, কিন্তু তাতে যে ব্রাহ্মসমাজ ও রামকৃষ্ণ-অনুগামীদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব লোপ পায়নি, সে-কথা বলাই বাহুল্য। শ্রীরামকৃষ্ণ আদি ব্রাহ্মসমাজের দৃষ্টিতে ছিলেন একজন মূর্তি-উপাসক, যে-উপাসনাকে স্বীকার করা ঠাকুর-পরিবারের মানুষদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। এ-জন্যই হয়তো দেবেন্দ্রনাথের ঐ চিঠি পাঠানোর সমকালেই ১৮৯৪ সালে আদি ব্রাহ্মসমাজের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত [জ্যৈষ্ঠ, ১৮১৬] এই সমাজের উপাচার্য চিন্তামণি চট্টোপাধ্যায়ের ‘শিকাগো ধর্মমেলা’ নামে এক প্রবন্ধে এই ধর্মসভার গুরুত্বের কথা বলা হলেও বিবেকানন্দের [এমন কি প্রতাপ মজুমদারেরও] নামোল্লেখ পর্যন্ত করা হয়নি! আবার আর একটি ব্রাহ্ম পত্রিকা ‘বামাবোধিনী’-তে ‘আমেরিকায় বঙ্গের গৌরব’ শিরোনামে যে-মন্তব্য করা হয়েছিল, তাতে বিবেকানন্দের কথা অনুল্লিখিত থাকলেও এই পত্রিকাটির মতে ঐ সভায় প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের বক্তৃতাই নাকি ছিল ‘সর্বোৎকৃষ্ট’! 


এ-সব সত্ত্বেও ‘বিশ্বখ্যাতি’ অর্জন করে এই রামকৃষ্ণ-শিষ্য যখন দেশে ফেরেন, তখন সাধারণ মানুষের বিবেকানন্দের প্রতি সপ্রশংস উন্মাদনা লক্ষ করেই হয়তো তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সাফল্যে সংযত ভাষায় আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। “খ্যাতনামা হিন্দুধর্ম প্রচারক বিবেকানন্দ স্বামী”র “সুদূর বিদেশে ব্রহ্মজ্ঞান প্রচারে”র গুরুত্ব অস্বীকার না করেও তিনি লিখেছিলেন, “তাঁহার সহিত কোনো কোনো বিষয়ে আমাদের অনৈক্য থাকিলেও মূলে তাঁহার মতের সহিত আমাদের সম্পূর্ণ ঐক্য আছে।“ [চৈত্র, ১৮১৮ শকাব্দ সংখ্যা] এই সময়েই ঠাকুর পরিবারের আরেক সদস্যা সরলা দেবীও তাঁর সম্পাদিত ‘ভারতী’ পত্রিকায় [চৈত্র ১৩০৩] একই ধরনের মতপ্রকাশ করেছিলেন অপেক্ষাকৃত আবেগপূর্ণ ভাষায়ঃ- “আমাদের একান্ত আশা, বঙ্গের সামাজিক জীবনে নবযুগ বুঝি সমাসন্ন। এই সম্ভাবিত যুগপ্রবর্তনকারীর সহিত আমাদের সবসময়ে সকল বিষয়ে মতে না মিলিতে পারে, তথাপি তিনি আমাদের শ্রদ্ধেয়। প্রতীচ্য সভ্যজগতে তিনি দীনা মাতৃভূমির যে-গৌরব প্রতিষ্ঠা করিয়া আসিয়াছেন, তাহার জন্য দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেরই কৃতজ্ঞতার পাত্র।…”




এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, ব্রাহ্মদের পূর্বপরিচিত এক ভিন্নমতানুসারী যুবক যখন সহসা বিবেকানন্দরূপে পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হলেন, তখন আর পাঁচজন ভারতবাসীর সমমাত্রায় আহ্লাদিত হওয়ায় ব্রাহ্মদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা বলেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বা সরলা তাঁর সঙ্গে “কোনো কোনো বিষয়ে” মতানৈক্যের কথা উল্লেখ না করে পারেন নি। এই সব সংবাদ থেকে অবশ্য বোঝা যায় না, সাগরপারে বিবেকানন্দের বেদান্তপ্রচারের সাফল্যসংবাদে রবীন্দ্রনাথের নিজের প্রতিক্রিয়া ঠিক কীরকম ছিল। সমকালের এক সজাগ বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি যে বিবেকানন্দের সম্প্রদায়গত পটভূমিটি সম্বন্ধে সচেতন থাকবেন আর আদি ব্রাহ্মসমাজের একজন সদস্য হিসেবে বিবেকানন্দের সেই অবস্থানটিকে পুরোপুরি সমর্থন করবেন না, এ-কথা অনুমান করা কঠিন নয়।




এ-সব সত্ত্বেও অবশ্য পরবর্তীকালে তিনি আদি ব্রাহ্মদের সঙ্গে নব্য ব্রাহ্ম ও বিবেকানন্দের মতো নব্য হিন্দুদের মতানৈক্যকে কিছুটা উদার দৃষ্টিতেই দেখেছিলেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ১৯১১ সালে সঙ্কলিত “রোমীয় বহুদেববাদের পরিণতি” নামে অন্যের এক রচনার পাদটীকায় রোমের পুরানো পৌত্তলিকতা ও আধুনিক খ্রিস্টধর্মের মধ্যে বিরোধ সত্ত্বেও নানা সাদৃশ্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, “বর্তমান ভারতে ব্রাহ্মধর্মের সহিত নবজাগ্রত হিন্দুধর্মেরও প্রায় এইরূপ সম্বন্ধ দেখা যায়। সেই জন্যই কেশবচন্দ্রের সহিত রামকৃষ্ণ পরমহংসের যোগ অথবা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর শেষ বয়সের মতের সহিত হিন্দুসমাজের মতের মিলন এইরূপ সম্ভব হইয়াছে। বিবেকানন্দ যে একসময় উৎসাহী ব্রাহ্ম ছিলেন তাহাতে তাঁহার পরবর্তী মতপরিবর্তনে কোনো গুরুতর বিঘ্ন ঘটায় নাই।“ [অগ্রহায়ণ, শক ১৮৩৩ সংখ্যা] লক্ষণীয় যে, এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ কেশবচন্দ্র বা বিবেকানন্দের পরবর্তী মতবাদ সমর্থন না করলেও তাঁদের মতপরিবর্তন বা রামকৃষ্ণ-অনুরক্তিকে কিন্তু সমালোচনা করেন নি, বরং ভারতের ধর্মক্ষেত্রে প্রাচীন ও নবীন মতের মধ্যে এই ‘আনাগোনা’-র ফলে এই সব ধর্মমতের “বিরুদ্ধতা ক্ষয় হইয়া ইহাদের ভেদচিহ্ন” ক্রমশ লুপ্ত হয়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন। 




ভারতের নানা ধর্মমতের মধ্যে এই আদানপ্রদানকে ১৯১১ সালে অনুমোদন করলেও ১৮৯৩ সালে আমেরিকায়এইসব ধর্মের প্রতিনিধিরা [যাঁদের মধ্যে আদি ব্রাহ্মসমাজের কেউ ছিলেন না] ধর্মপ্রচার করে প্রশংসিত হয়েছিলেন, তাঁদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠিক কেমন ধারণা পোষণ করেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের খোঁজ নিতে হবে বিবেকানন্দ ও তাঁর সহপ্রচারকদের আমেরিকা ও ইয়োরোপ অভিযানের সমসময়ে প্রকাশিত কোনো রচনায় বা চিঠিপত্রে রবীন্দ্রনাথ এই বেদান্তপ্রচার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেছেন কিনা। বিবেকানন্দ যেহেতু একটি সংঘস্থাপনা করে পরবর্তীকালে তাঁর নববেদান্ত আন্দোলনকে একটি সংগঠিত চেহারা দিয়েছিলেন এবং তাঁর দেহাবসানের পরেও দীর্ঘদিন ঐ আন্দোলনের প্রভাবকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন, তাই আমাদের এই অনুসন্ধানের আর একটি জরুরি অংশ হবে – বিবেকানন্দের অবর্তমানেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবর্তিত বেদান্তপ্রচার নিয়ে কোনো মতপ্রকাশ করেছিলেন কিনা।




বিবেকানন্দের বেদান্তপ্রচার সম্বন্ধে ঠাকুর-পরিবারের এই দু’জন সদস্যের [যাঁদের একজন রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ আর একজন তাঁর বয়ঃকনিষ্ঠা ভাগনি] যে মতামত আমরা দেখেছি, তার প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ তখন কোথায় দাঁড়িয়েছিলেন? ১৮৯৫ সালে [তখনও কিন্তু বিবেকানন্দ ও অন্যান্য ভারতীয় প্রচারকেরা মার্কিন দেশে ধর্মপ্রচার করছেন] রবীন্দ্রনাথের সম্পাদিত ‘সাধনা’ পত্রিকায় [ফাল্গুণ, ১৩০১ বঙ্গাব্দ] ‘ধর্মপ্রচার’ শীর্ষক এক বেনামী রচনা প্রকাশিত হয়, ‘রবিজীবনী’ র [ষষ্ঠ খন্ড] লেখক প্রশান্তকুমার পালের মতে এটি রবীন্দ্রনাথেরই রচনা । এই নিবন্ধটির অংশবিশেষ এ রকমঃ-“ ...সম্প্রতি আটলান্টিক পার হইয়া হিন্দু আপন ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করিয়া আসিয়াছে এবং সেই নবধরাতলবাসীগণ আমাদের প্রাচীন ধরাতলের পুরাতন কথা শুনিয়া পরিতৃপ্তি প্রকাশ করিয়াছে, ইহাতে উভয় জাতিরই গৌরবের কথা...।“ ধর্মের সত্যপ্রচারের জন্য হিন্দুদের এ ভাবে পল্লী ছেড়ে বের হওয়াকে এই লেখক ‘নবজীবনের লক্ষণ’ বলে সন্তোষপ্রকাশ করেও এর পরে হিন্দুধর্মের উদারতার দাবিকে কিছুটা কটাক্ষও করেছিলেনঃ-“ যখন নিজের ধর্মকে সকলের ধর্ম করিয়া তুলিতে পারিব, তখনই প্রকৃত উদারতা লাভ করিব, এখন আমরা যাহাকে উদারতা বলিয়া থাকি, তাহা ঔদাসীন্য, তাহা সকল অনুদারতার অধম।“ ইত্যাদি। এখানে উল্লেখ্য, সাগরপারে ও ভারতে নানা বক্তৃতায় বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মের ও হিন্দুদের উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতার কথা বহুবার বলেছেন। তাই এখানে বিবেকানন্দের নামোল্লেখ না করে তাঁর ঐ হিন্দুর উদারতার দাবিকেই কটাক্ষ করা হয়েছে, এমনটা হতেও পারে। আবার এমন দাবিও করা যেতে পারে যে, এখানে ‘হিন্দু’ বলতে ব্রাহ্ম সহ বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি সব ভারতীয় ধর্মের প্রতিনিধিদেরই বোঝানো হয়েছে। মোটের ওপর আমেরিকায় হিন্দু বক্তাদের সমাদর শুধু তাঁদের নয়, উভয় জাতিরই গৌরব, এবং এতে দেশের গণ্ডী অতিক্রম ছাড়া আর বিশেষ কোন গুরুত্ব নেই এই লেখকের এমন অনুচ্ছ্বসিত বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথ [যদি তিনিই লেখক হয়ে থাকেন] এ সময় তাঁর পরিবারের অপর দুই সদস্যের থেকে মানসিকভাবে কিছুটা দূরেই অবস্থান করছিলেন। অন্তত বিবেকানন্দের বেদান্তপ্রচারের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও সরলার যে অনেক বেশি সতর্ক ও সংযত, এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয়না। 




রবীন্দ্রনাথের ঐ মন্তব্যের দু’বছর পরে বিবেকানন্দ যখন স্বদেশে ফিরে এলেন ও ১৮৯৭ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি শোভাবাজার রাজবাটী-প্রাঙ্গনে তাঁকে সংবর্ধিত করা হল, তখন রবীন্দ্রনাথ সেই ঘটনাকে কোন্‌ দৃষ্টিতে দেখেছিলেন? প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর রবীন্দ্রজীবনীতে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ স্বামীজির ঐ সম্বর্ধনাসভায় উপস্থিত ছিলেন, অমল হোমকে নাকি রবীন্দ্রনাথ নিজে সে-কথা জানিয়েছিলেন। এই দাবি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তা’হলে এ-কথা মনে করার একটা কারণ পাওয়া যেত, যে তিনি বিবেকানন্দের ঐ বেদান্তপ্রচার অভিযানকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।প্রভাতকুমার এই দাবির সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা না করলেও এ নিয়ে অল্পবিস্তর অনুসন্ধান করেছেন পরবর্তীকালের দুই গবেষক। শঙ্করীপ্রসাদ বসু তাঁর ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’ গ্রন্থে [চতুর্থ খণ্ড] জানিয়েছেন, ১৮৯৭ সালের ৩রা মার্চ ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকায় স্বামীজির ঐ সংবর্ধনাসভায় উপস্থিত ব্যক্তিদের তালিকায় ঠাকুরপরিবারের যে ক’জনের নাম পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন ক্ষিতীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ ও সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ঐ পরিবারের জামাতা জানকীনাথ ঘোষাল। রবীন্দ্রনাথ সে-সময় কলকাতায় যথেষ্ট পরিচিতি ও খ্যাতির অধিকারী, তাই এই তালিকায় তাঁর নাম না থাকায় তিনি ঐ সভায় সত্যিই উপস্থিত ছিলেন কিনা, এ সন্দেহ থেকেই যায়। এই সংশয়ের নিরশন করে প্রশান্তকুমার পাল জানিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিতভাবেই ঐ সভায় যান নি, কারণ তিনি সেদিন কলকাতায় ছিলেন না। [রবিজীবনী,চতুর্থ খন্ড] কাজেই রবীন্দ্রনাথ যে এই পর্বে [১৮৯৩-৯৭] বেদান্তপ্রচারক বিবেকানন্দকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, এর কোনও প্রমাণ পাওয়া গেল না। অবশ্য এ-কথাও স্বীকার্য যে, রবীন্দ্রনাথ সেদিন কলকাতার বাইরে থাকায় নিঃসংশয়ে এমন কথাও নিশ্চিতভাবে বলা যায়না যে, তাঁর ঐ সভায় অনুপস্থিতি বিবেকানন্দ সম্পর্কে অনাগ্রহেরই প্রমাণ।




এর পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ যে-মন্তব্যটিতে সর্বপ্রথম বিবেকানন্দের উল্লেখ সহ তাঁর ধর্মপ্রচার সম্পর্কে মত প্রকাশ করেছেন, সেটি অবশ্য তাঁর স্বনামেই প্রকাশিত ও তাঁর গ্রন্থাবলির অন্তর্ভুক্ত। ‘সমাজভেদ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “......বিবেকানন্দ বিলাতে যদি বেদান্তপ্রচার করেন ও ধর্মপাল যদি সেখানে ইংরেজ বৌদ্ধসম্প্রদায় স্থাপন করেন, তাহাতে য়ুরোপের গায়ে বাজেনা, কারণ য়ুরোপের গা’ রাষ্ট্রতন্ত্র।“ [১৯০১] এই মন্তব্য সংক্ষিপ্ত হলেও এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রথমত এটি বিবেকানন্দের জীবনকালে রবীন্দ্ররচনায় তাঁর একমাত্র উল্লেখ এবং দ্বিতীয়ত বিবেকানন্দের একটি প্রধান কাজ বেদান্তপ্রচারের প্রভাব সম্পর্কে এখানে স্পষ্টভাষায় মতপ্রকাশ করা হয়েছে। বিদেশে হিন্দুদের ধর্মপ্রচার সংক্রান্ত যে দু’টি মন্তব্য আমরা দেখলাম, সেগুলিকে সম্মিলিত করলে যা দাঁড়ায় তা হল, আমেরিকায় বিবেকানন্দ প্রমুখের ধর্মপ্রচার অভিযানকে রবীন্দ্রনাথ তথা আদি ব্রাহ্মসমাজ একেবারে প্রথম দিকে কিছুটা উদার দৃষ্টিতে দেখলেও শিকাগো বক্তৃতার আট বছর পরে দেখা যাচ্ছে যে, রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের ঐ কাজকে ততটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না বা পাশ্চাত্যসমাজে যে তার কোন উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়তে পারে,এমন কথা স্বীকার করছেন না। এ থেকে মনে হতে পারে, আমেরিকার প্রথম সাফল্যলাভের পর ইয়োরোপ-আমেরিকায় সাত-আট বছর বিবেকানন্দের প্রচার-অভিযানের প্রতিক্রিয়াতেই রবীন্দ্রনাথের মত পরিবর্তন হয়েছিল। কিংবা এমনও হতে পারে, আমেরিকায় বিবেকানন্দের সাফল্যকে তিনি লঘু করে দেখতে চাননি, শুধু ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রেই এ-জাতীয় কাজের গুরুত্ব বা প্রভাব তিনি স্বীকার করেন নি। এখানে উল্লেখ্য যে, এই মতের বিপরীতে বিবেকানন্দের নিজের অভিমত ছিল, আমেরিকার চেয়ে ইংল্যান্ডেই তাঁর কাজ বেশি সফল হবে। 



ভারতে নববেদান্ত আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ




বিদেশে বিবেকানন্দের বেদান্তপ্রচার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যা-ই বলতে চেয়ে থাকুন না কেন, আমরা লক্ষ করি যে, বিবেকানন্দের জীবনকালে বা জীবনাবসানের পর যে দীর্ঘ চার দশক ধরে তাঁর প্রবর্তিত আন্দোলনের নানা প্রতিক্রিয়া দেশে ও বিদেশে লক্ষ করার সুযোগ রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন, তার কোনো সময়েই কিন্তু স্বয়ং বিবেকানন্দের এই বেদান্তপ্রচার সম্বন্ধে তাঁর অভিমত স্পষ্ট ভাষায় আর কখনও প্রকাশ করেন নি। যদিও ভারতে ও বিদেশে বিবেকানন্দের অনুগামীদের বেদান্তপ্রচার সম্পর্কে তিনি কখনও কখনও মন্তব্য করেছেন। এই পর্বে অবশ্য বিবেকানন্দের অবদানের অন্যান্য দিকগুলি সম্পর্কে [যেমন যুবসমাজের ওপর তাঁর বাণীর শক্তি ও প্রেরণার প্রভাব, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভাবসমন্বয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা বা তাঁর বাংলা গদ্যের গুণমান ইত্যাদি] রবীন্দ্রনাথ ইতিবাচক মতপ্রকাশে কুন্ঠিত হন নি। ১৯০৯-১০ সালে বোলপুর ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রকাশিত ভক্তবাণী সংকলনে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের বাণীও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু সেই সব দিকগুলি আমাদের বর্তমান আলোচনার পরিসরের বাইরে বলে আমরা শুধু এটুকু বলেই ক্ষান্ত হব যে, বেদান্তপ্রচারের অতিরিক্ত বিবেকানন্দের অন্যান্য অবদানের মূল্যায়নযখন রবীন্দ্রনাথ করেছেন, তখন তিনি ব্রাহ্মসমাজের গন্ডিতে আবদ্ধ থাকেননি।




বিবেকানন্দের অবর্তমানে ভারতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ সংঘের প্রচারকদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কেমন ধারণা ছিল? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে আমাদের চোখে পড়েছে ১৯০২ সালে ‘সমালোচনী’ পত্রিকায় প্রকাশিত অপ্রকটচন্দ্র ভাস্কর ছদ্মনামে রবীন্দ্রনাথের একটি লঘুরচনা, যেখানে “হিন্দুধর্ম মহান্‌, জাগ্রত, শাশ্বত “ বলে যারা চারদিকে ছুটোছুটি করছেন, তাঁদের “কেশবচন্দ্র-বিবেকানন্দের অনুস্বর বিসর্গ” বলে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। কিছুটা লঘু ঢংয়ে লেখা হলেও এখানে কেশবচন্দ্রের নববিধান ব্রাহ্মসমাজের ও বিবেকানন্দের প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের প্রচারকদের ধর্মপ্রচার সম্বন্ধে এক ধরনের তাচ্ছিল্যই প্রকাশিত হয়েছে বলে মনে হয়। এখানে মনে রাখতে হবে এই পর্বে বিদেশে উপনিষদ ও বেদান্তভিত্তিক হিন্দুধর্ম বিষয়ে প্রধানত ঐ দুই সম্প্রদায়ের প্রচারকেরাই বক্তৃতা বিতর্ক, শিক্ষাদান ইত্যাদি চালিয়ে যাচ্ছিলেন।




বিদেশে বিবেকানন্দপন্থীদের বেদান্তপ্রচারের সার্থকতা বা প্রভাব বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু সংশয় যদি থেকেও থাকে, স্বদেশে তাঁদের জনপ্রিয়তাকে তিনি যে একরকম স্বীকার করেই নিয়েছিলেন, তা বোঝা যায় জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা তাঁর এক চিঠি থেকে। দেশে আদি ব্রাহ্মসমাজকে জনপ্রিয় করে তোলার প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে তিনি ঐ চিঠিতে লেখেন,” এখন সময় এসেছে ব্রাহ্মসমাজের যথার্থ পরিচয় প্রকাশ করবার। ......আমরা অবজ্ঞাপূর্বক আমাদের সেই স্থান ছেড়ে দিয়ে খৃস্টানের পোষ্যপুত্র হতে গিয়েছিলাম বলেই আজ বিবেকানন্দের দল ব্রাহ্মসমাজকে একপাশে সরিয়ে ফেলে দিয়ে দেশের হৃদয়ে সমস্ত জায়গা সম্পূর্ণ জুড়ে বসবার উপক্রম করচে...।“ [১৬-২-১৯১৩] এই মন্তব্য থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের ধর্মপ্রচার অভিযানকে রবীন্দ্রনাথ বস্তুত ব্রাহ্মসমাজের প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৃষ্টিতেই দেখেছিলেন।




আমেরিকায় বেদান্ত প্রচার –ভারতের অবমাননা ?




১৯১২-১৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় দর্শন নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ভাষণ দিতে গিয়ে লক্ষ করেন, কিছু ভারতীয় ‘ স্বামী উপাধিধারী অযোগ্য লোক’ ভারত সম্পর্কে ‘’যা তা” বক্তৃতা করে সে দেশের চিন্তাশীল মানুষের কাছে “ভারতের স্থান অত্যন্ত নামিয়ে দিয়েছে”। এদের কখনও তিনি “বিবেকানন্দের পরবর্তীরা” বা কখনও “বিবেকানন্দের চেলা” বলে উল্লেখ করেছেন। এই চিঠিগুলি তিনি লেখেন তাঁর তিন ঘনিষ্ঠ মানুষকে যাঁরা হয় ব্রাহ্মসমাজের না হয় ভারতীয় দর্শনচর্চার সঙ্গে জড়িত। ৮ই ডিসেম্বর [১৯১২] তিনি তরুণ ব্রাহ্ম কর্মী অজিতকুমার চক্রবর্তীকে লেখেন, “এখানকার পশ্চিম আমেরিকা আমাদের অনেক ছেলেকে মাটি করে দিচ্চে। কত শিক্ষিত ছেলে স্বামী উপাধি ধারণ করে যা তা কথা বলে আসর গরম করে বেড়াচ্ছে…। দেখে দুঃখ হয়, লজ্জাও বোধ হয়।“ বস্টনে এসে তিনি তাঁকেই হার্ভার্ডে তাঁর ভারতীয় দর্শন বিষয়ে বক্তৃতার ও সেখানকার অধ্যাপক উডসের উল্লেখ করে লেখেন, “… তিনি বলছিলেন আজকাল বিস্তর স্বামী উপাধিধারী অযোগ্য লোক এসে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে যা তা বক্তৃতা করাতে ভারতবর্ষের প্রতি এ অঞ্চলের শ্রদ্ধা একেবারে চলে গেছে।“ তিনি আরও অভিযোগ করেন, “তারা আমাদের শাস্ত্র ও দর্শন কিছুই পড়েনি, কেবলমাত্র বিবেকানন্দের বুলি উল্টোপাল্টা করে আবৃত্তি করে কোনোমতে কাজ চালিয়ে দিচ্ছে।আমি এখানকার অনেক চিন্তাশীল লোকেদের মুখে এদের সম্বন্ধে আলোচনা শুনে বড়ই ধিক্কার অনুভব করেছি।“ [১৫-২-১৯১৩]




এই চিঠিটি লেখার কিছুদিন আগেই রবীন্দ্রনাথ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কেও লিখেছিলেন, “ ……দেখছি এখানে নিতান্ত শস্তা জিনিষও উচ্চমূল্যে বিকিয়ে যায়। আমাদের দেশের কত অযোগ্য লোক এখানে বক্তৃতা করে জীবিকা নির্বাহ করছে। তাদের দ্বারা দেশের গুরুতর অনিষ্ট হচ্ছে। বিবেকানন্দ এখানে যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন তা তাঁর চেলার দল এসে একেবারে ধুয়ে মুছে নিঃশেষ করে দিলে।“ [১-২-১৯১৩] এই মাসেই একই ব্যক্তিকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি আবার লেখেন, “…… এখানকার ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক Dr. Woods আমাকে বলিতেছিলেন যে, ভারতবর্ষ হইতে অনেক অযোগ্য লোক আসিয়া ভারতবর্ষ সম্বন্ধে এখানে বক্তৃতা করিয়া থাকে – ইহাতে এমন অবস্থা হইয়াছে যে ভারতবর্ষের কেহ বক্তৃতা করিবে শুনিলে শ্রোতা দুর্লভ হইয়া ওঠে…।“




১৯১৩ সালে তিনি শান্তিনিকেতনের শিক্ষক পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রীকে এক তারিখহীন চিঠিতে লেখেন, “……আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোনো উপলক্ষে একবার পশ্চিম সাগরকুল ঘুরিয়ে নিয়ে যাবার ইচ্ছে আমার আছে।……কিন্তু এ পর্যন্ত যাকেই বলেছি কেউ কর্ণপাত করেননি। তার প্রধান কারণ এই বুঝচি যে বিবেকানন্দের চেলারা এদেশে বেদান্ত প্রভৃতি সম্বন্ধে বক্তৃতা করে বেদান্ত এবং ভারতবর্ষের বিদ্যাবুদ্ধির উপর এদের শ্রদ্ধা একেবারে ঘুচিয়ে দিয়েছে।“




এই চিঠিগুলিতে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যগুলি থেকে পরপর কিছু প্রশ্ন আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। রবীন্দ্রনাথ স্বামী উপাধিধারী যে সব অযোগ্য লোকদের ‘বিবেকানন্দের চেলা’ বলে উল্লেখ করেছেন, যাদের বক্তৃতা মার্কিন দেশে ভারতের অবমাননার কারণ হয়েছিল , তাঁরা আদতে কারা? তাঁরা কি বিবেকানন্দের প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী , না অন্য কোনও স্বামী উপাধিধারী? রবীন্দ্রনাথ কেনই বা তাঁদের নামোল্লেখ করলেন না? আর কেনই বা এইসব ন্যক্কারজনক কাজ যারা করছিলেন তাদের সঙ্গে বিবেকানন্দের নাম জুড়ে দিলেন? ভারতীয় বেদান্ত-প্রচারকদের সম্পর্কে আমেরিকার শিক্ষিতমহলে যে অশ্রদ্ধা ও অভিযোগের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তার কি সত্যিই কোনো ভিত্তি ছিল? 

এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যেতে পারে দু’ভাবে - চিঠিগুলির ভেতরের আর বাইরের সাক্ষ্য থেকে। চিঠিগুলি রবীন্দ্রনাথ যাঁদের লিখেছিলেন, তাঁরা খুব সম্ভব তাঁর উদ্দিষ্ট এই অযোগ্য লোকেরা কারা, তা ভালোভাবেই জানতেন। এর প্রমাণ রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃত প্রথম চিঠিটির উত্তরে অজিত চক্রবর্তীর চিঠির [৭ই জানুয়ারি] এই মন্তব্যঃ- “...... বিবেকানন্দ movement এমেরিকাকে যেমন ছেয়ে ফেলেছে তার ধাক্কাটাকে একটু নরম করা দরকার। …… right viewটা আমেরিকানরা পেলে নিশ্চয় ঐ ঢেউয়ে নাচবেনা। অন্তত এটা বুঝবে যে সমস্ত ভারতবর্ষই বিবেকানন্দের চেলা নয়।“ ইত্যাদি। এটা একরকম নিশ্চিতভাবেই ইঙ্গিত দেয়, রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজের প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৃষ্টি থেকেই খুব সম্ভব আমেরিকায় বিবেকানন্দের সংঘভুক্ত বেদান্তপ্রচারকদেরই ইঙ্গিত করেছেন। আমরা এর আগেও রবীন্দ্রনাথের এই মনোভাব লক্ষ করেছি।




এই চিঠিগুলির বাইরের সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। সংক্ষেপে শুধু এ-টুকু বলা যায়, ঐ সময়ে আমেরিকায় নানাশ্রেণীর ভারতীয় ধর্মপ্রচারকদের সম্বন্ধে ধর্মসংশ্লিষ্ট এবং অন্যান্য বিষয়ে নানাধরনের অভিযোগ ও বিরূপ ধারণা সত্যিই জমে উঠেছিল এবং তাঁদের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের স্বামী উপাধিধারী কয়েকজন সাক্ষাৎ শিষ্য়, এমন কি, সেই শিষ্যদের দীক্ষিত কিছু প্রচারকও ছিলেন। সাধারণভাবে ভারতীয় ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার প্রচারকদের এই বদনামের ফলে তখন আমেরিকায় রামকৃষ্ণ সংঘ পরিচালিত কয়েকটি বেদান্তকেন্দ্রের জনপ্রিয়তা ও সদস্যসংখ্যা যে সত্যিই হ্রাস পেয়েছিল, তা ঐ সঙ্ঘের বেদান্তপ্রচারের নানা বিবরণেও স্বীকৃত হয়েছে। তাই এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের উত্থাপিত অভিযোগগুলো একেবারে মনগড়া বা রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রতি ঈর্ষ্যাপ্রসূত নয় বলেই মনে হয়। এ ব্যাপারে আরও অনুসন্ধানের সুযোগ থাকলেও আপাতত প্রাথমিক ভাবে মনে করা যেতেই পারে যে, উদ্ধৃত চিঠিগুলিতে রবীন্দ্রনাথের উদ্দিষ্ট প্রচারকদের মধ্যে যেমন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের কোনো কোনো সন্ন্যাসী বা তাঁদের শিষ্যভক্তদের থাকার যেমন সম্ভাবনা রয়েছে, সেই সঙ্গে এ-কথাও স্বীকার্য যে,ঢালাওভাবে ওই সঙ্ঘের বিবেকানন্দ-পরবর্তী সব বেদান্তপ্রচারকই রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্য ছিলেন না। তাঁদের মধ্যে যে শাস্ত্রজ্ঞ, সুযোগ্য বেদান্তপ্রচারকেরাও ছিলেন, [ যাঁদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথেরও স্বীকৃতি পেয়েছিলেন], এমন সাক্ষ্যও পাওয়া যায়।




এই তথ্যগুলি মনে রেখে রবীন্দ্রনাথের এই ব্যক্তিগত মন্তব্যগুলিকে দেখলে বোঝা যায়, আমেরিকায় বিবেকানন্দের পরবর্তীদের বেদান্তপ্রচার ও তার প্রভাব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু অভিযোগ থাকলেও বিবেকানন্দের নিজের যোগ্যতা বা শাস্ত্রজ্ঞানকে তিনি একবারও চ্যালেঞ্জ করেননি আর সেদেশে তাঁর প্রতিষ্ঠাকেও কখনও অস্বীকার করেননি। কাজেই এ-কথা বললে হয়তো খুব ভুল হবেনা যে, বিবেকানন্দের নববেদান্ত আন্দোলনের পতাকাবাহকদের বেদান্তপ্রচারকে অপছন্দ করে যিনি ভারতের সত্য পরিচয় সেখানে তুলে ধরার নিজস্ব পরিকল্পনা করেছিলেন,তিনি প্রধানত ব্রাহ্মসমাজের রবীন্দ্রনাথ, আর স্বয়ং বিবেকানন্দের মূল্যায়নের সময় তিনি সাম্প্রদায়িক গন্ডিমুক্ত ইতিহাসদ্রষ্টা ভাবুক রবীন্দ্রনাথ।

~ ~ ~




আকর-পঞ্জীঃ-




১। ‘সঞ্চয়’ / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

২। অনুস্বর ও বিসর্গ/ অপ্রকটচন্দ্র ভাস্কর – শারদীয় ‘দেশ’, ১৩৯৭

৩। অজিতকুমার চক্রবর্তীকে লেখা চিঠি- ‘দেশ’, সাহিত্যসংখ্যা ১৩৮৮

৪। অজিতকুমার চক্রবর্তী- রবীন্দ্রনাথ পত্রালাপ- ‘ভক্ত ও কবি’ [ পশ্চিমবঙ্গ বাংলা

আকাদেমি]

৫। নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠি – ঐ, ১৩৯৮

৬। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা চিঠি- চিঠিপত্র, দ্বাদশ খণ্ড

৭। ক্ষিতিমোহন সেনকে লেখা চিঠি- ‘দেশ’, ২০-১২-১৯৮৬

0 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - সবর্না চ্যাটার্জ্জী

Posted in



প্রবন্ধ


বিষয় যখন কেক 
সবর্না চ্যাটার্জ্জী 


কদিন হলো শীতটা একটু জাঁকিয়েই পড়েছে। জম্পুই শীতে কম্পুই দিতে দিতে আমরাও বেশ হাত পা সেঁকে নিচ্ছি নরম রোদের আলতো আরামে। মনটাও এখন তরতাজা ফুরফুরে। চারদিকে শুধু চড়ুইভাতি, হুটহাট বেড়িয়ে পরার চিন্তা আর পিঠেপুলি খাইখাই, কেকের গন্ধে শীতের মরসুম একদম রমরমিয়ে চলছে। সামনে আবার আসছে বড়দিনের ছুটি। বড়দিন মানে ক্রিসমাসের এই সময়টা কেক ছাড়া খাদ্যরসিক আমরা আর কিছু ভাবতেই পারিনা। 

তবে যিশুর জন্মদিনের কোন নির্দিষ্ট ডেট বাইবেলে নেই| তাই কবে সেলিব্রেশন হবে তাই নিয়ে প্রথম দিকে বেশ মতভেদই ছিল| কেউ বলেন ২৫শে মার্চ প্রথম মা মেরি জেনেছিলেন যে তাঁর কোলে আসছে একজন বিশেষ সন্তান| তার ঠিক ৯ মাস বাদে ২৫শে ডিসেম্বর তাই যিশুর জন্মদিন পালিত হয়| আবার অনেকের মতে য্যুইশ ফেস্টিভ্যাল হানুক্কার সময়ের সাথে মিলিয়ে যিশুর জন্মদিন পালন হয় ২৫শে ডিসেম্বর| 

প্রথম ক্রিসমাস পালিত হয় রোমান সম্রাট কনস্টানটাইনের আমলে ৩৩৬ খ্রীস্টাব্দে| ক্রিসমাসে কেক খাওয়ার প্রচলন অবশ্য আরো পরে| ক্রিসমাসের আগের দিন উপবাস করার নিয়ম ছিল| উপবাস ভাঙ্গা হতো প্লাম পরিজ খেয়ে| 

এরপর পরিজ বানানো শুরু হয় ড্রাই ফ্রুটস দিয়ে| ক্রমশ মশলা‚ মধু সহযোগে পরিজ হয়ে ওঠে ক্রিসমাস পুডিং| ১৬ শতকে ওটমিলের বদলে ময়দা‚ চিনি আর ডিম দিয়ে তৈরী করা হয় সেদ্ধ প্লাম কেক| অপেক্ষাকৃত ধনী ব্যক্তিদের কাছে আভেন থাকতো| তাঁরা ইস্টারের কেকের স্টাইলে ড্রাই ফ্রুটস আর প্রাচ্যের মশলা ব্যবহার করে বানাতে শুরু করেন আজকের দিনের প্রচলিত ক্লাসিক ক্রিসমাস কেক| 

কালের নিয়মে ক্লাসিক ক্রিসমাস কেকের অনেক ভ্যারিয়েশন এসেছে| লাইট‚ ডার্ক‚ ময়েস্ট‚ ড্রাই‚ হেভি‚ স্পঞ্জি| কয়েকটা পপুলার ভ্যারিয়েশন হলো--হ্যুইস্কি ডান্ডি, অ্যাপল ক্রিম কেক, মিন্সমিট কেক ইত্যাদি। 

তবে ক্রিসমাসে কেকের আসল মজা অন্যত্র| সব ক্রিসমাস কেক ই বানানো হয় অনেক আগে| অনেকে এক মাসের ও বেশি আগে কেক বানিয়ে এয়ার টাইট ক্যন্টেনারে উল্টো করে রেখে দেন| এর পর প্রতি সপ্তাহে কেকের মধ্যে ঢালা হয় অল্প পরিমাণে ব্র্যান্ডি‚ শেরি বা হ্যুইস্কি| এই ভাবে 'ফিড্' করা কেক স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় হয়ে ওঠে ক্রিসমাস আসতে আসতে| 

এ তো গেল শুধু ক্রিসমাস কেকের গল্প। আজকে বরং একটু উঁকি দেওয়া যাক, কেকের আবিষ্কারের ইতিহাসের পাতায়। 

কেকের ইতিহাস খুঁজতে হলে উল্টেপাল্টে দেখতে হবে প্রাচীন পুঁথিপত্র। বর্তমানে আমরা যে খাদ্যবস্তুটিকে কেক বলে চিনি, শুরুতে তার রূপ ছিল সম্পূর্ণ আলাদারকম। সেগুলি দেখতে অনেকটা রুটির মত হলেও কেকগুলি মিষ্টি স্বাদের করার জন্য মধু মেশানো হতো। বাদাম ও ড্রাইফ্রুট মাঝেমধ্যে মেশানো হতো। খাদ্য ঐতিহাসিকদের মতানুসারে, প্রাক্তন ইজিপ্টিয়ানরা সেসময় অ্যাডভান্সড বেকিং পদ্ধতি রপ্ত করেছিলেন। ইংরাজি অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী, ১৩দশ শতাব্দীতে কেক শব্দটি প্রকাশ্যে আসে। পুরানো নর্স শব্দ কাকা থেকে কেক শব্দের উৎপত্তি। 

Medieval European bakers যে ফ্রুটকেক ও জিনজারব্রেড বানাতেন তা বহুমাস রাখা যেত। 

খাদ্য গবেষকদের মতানুসারে, আজকের এই অত্যাধুনিক গোলাকার আইসিং কেকের প্রথম জন্ম হয় ইউরোপে। সময়টা ছিল ১৭ শতকের মাঝামাঝি। সাধারণত কেক তৈরীর উপযুক্ত ওভেন, মোল্ড ও উপকরণ হিসাবে বিশুদ্ধ চিনির উপলব্ধতা এই আবিষ্কারকে অগ্রসর হতে সাহায্য করে অনেকটাই। 

সেইসময় সাধারণত গোলাকার কেক মোল্ডটিকে একটি ফ্ল্যাট বেকিংট্রেতে বসিয়ে ওভেনে বেক করা হতো। এগুলি তৈরী হতো প্রধানত কাঠ, কোন বিশেষ প্রকার ধাতু বা কাগজ দিয়ে। 

কেকের ওপর প্রথম আইসিং হিসাবে ব্যবহৃত হয় চিনি ও ডিমের সাদা অংশটির সাথে বিশেষ সুগন্ধি মিশিয়ে ফোটানো একটি মিশ্রণ। এটি এরপর কেকের ওপর ডেলে দিয়ে অল্পকিছু সময়ের জন্য পুণরায় ওভেনে রাখা হতো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠান্ডা হওয়ার পর, কেকের আইসিং কভারটি বরফের মত চকচকে ও কঠিন হয়ে যেত। সেসময়ও অনেক কেক তৈরী হতো যেগুলিতে বেশকিছু ড্রাইফ্রুট দেওয়া হতো। 

মনে করা হয়, ১৯শতকের মাঝামাঝি সময়েই কেক নিজের বর্তমান রূপ পায়। অর্থাৎ উপকরণ হিসাবে এক্সট্রা রিফাইন ময়দা, বেকিং পাওডারের ব্যাবহার শুরু হয়। বিংশ শতক থেকেই পুরানো আইসিং পদ্ধতির বদলে বাটার, ক্রিম, পাওডার্ড চিনি বা আইসিং সুগার এবং বিভিন্ন ফ্লেভার ব্যবহার করে বাটারক্রিম তৈরী করে তার দ্বারা কেক কভার করা শুরু হয়। 

ফ্রান্সের Antonin Careme [1784-1833] কে 

কেক বা পেস্ট্রি ওয়ার্ল্ডের প্রধান ঐতিহাসিক সেফ বলে মনে করা হয়। French culinary ইতিহাস বইতেও তার সম্বন্ধে জানা যায় অনেক কথা। 

কেক, ব্রেড কিংবা বিস্কুট তৈরীতে খুব বেশি পার্থক্য না থাকায় সাধারণত ব্রেড বা রুটিকেই এদের জন্মদাতা বলা যেতে পারে। যদিও বেকিং ও ফার্মেন্টেশনের পদ্ধতি, খাওয়ার পরিবর্তিত প্যাটার্নের ওপর ভিত্তি করে কিছু ব্রেডের নামকরণ করা হয়। 

কিছু রোমান ব্রেড আছে কেকের মতই, যাতে ডিম, বাটার ব্যবহৃত হয়। 

ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার কিছু স্থানে যেখানে ইউরোপীয় প্রভাব খুব বেশি ছিল সেটিই কেকের প্রধান কেন্দ্রস্থল বলা চলে। 

যদিও কন্টিনেন্টাল ইউরোপিয়ান gateau(ফরাসি শব্দ) এবং torte(জার্মান শব্দ) এও বেশি পরিমাণে বাটার, ডিম, চকোলেট দেওয়া থাকত তবুও ওগুলোকে কেকের চেয়ে পেস্ট্রি বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত। 

মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের দুটি ভিন্ন আইটেম যেমন বাবা এবং ইস্টার কুলিচও কেকের চেয়ে সামান্য আলাদা। 

বহমান সভ্যতায় সবকিছুর মতই কেকও ক্রমশ জায়গা দখল করল পাশ্চাত্য থেকে এশিয়ার মাটিতে। জাপানে ছোট স্পঞ্জকেকগুলো kasutera নামে পরিচিত ছিল। আবার ফিলিপাইন এর মুনকেক ও রাইসকেকও বেশ খ্যাতি অর্জন করে সেসময়। 

সুইস হ্রদের গ্রামগুলিতে কেক তৈরীর উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হতো অসমানভাবে ভাঙা দানাশস্য। সেগুলিকে জমিয়ে গরম পাথরের ওপর রেখে বেক করা হতো। 

১৯ শতকে কেক তৈরীর পদ্ধতিতে নতুন দিগন্ত খুলে গেল। ১৮৪০সালে বেকিং পাওডারের আবিষ্কার কেক তৈরী আরও সহজ করে দিল। সোডা বাইকার্বোনেট একটি মৃদু অ্যাসিডের কম্পোজিশনে বেকিংপাওডার নামক এই যৌগটির আবিষ্কারে কেকের মিশ্রণকে সহজেই ফারমেন্ট করা সম্ভব হলো। ফলে ইস্টের ব্যবহার বেশ খানিকটা কমে গেল। তাপমাত্রা পরিবর্তশীল ওভেনের আবিষ্কারও কেক তৈরীর পথ আরও মসৃণ করে দিল। 

উত্তরপশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় একসময় বাড়িতেই নিত্যনতুন কেক প্রস্তুতির প্রণালী আবিষ্কার হতে থাকে। প্রধানত বাড়িতেই গৃহকর্ত্রীদের দ্বারাই এসব বিস্ময়জাগানো কেকের আবিষ্কার হয়। এই কেক তৈরীতে তারা বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। বিশেষ করে কোন অনুষ্ঠানে বা অতিথি আপ্যায়নে এই কেকের বিকল্প তেমন আর কিছু ছিল না বিংশ শতকের দিকে। এখনও বিবাহ বা জন্মদিনের মত শুভ অনুষ্ঠানে কেক বানানোর প্রচলন আছে। 

কেক আবিষ্কার নিয়ে এইসব পড়াশোনা করতে করতে নানান কেকের ছবি ও রেসিপি নজরে এসেছে। আমিও নিছক নিরলস নই বলেই মনে মনে বেশ ছকে নিয়েছি এই শীতে কোনদিন কোন কেকটা বাড়িতে বানানো যায়। আর যাই হোক আবিষ্কারটি নেহাত বিফলে যায় কেন?এই বড়দিনে ক্রিসমাস কেক না হোক মার্বেল কেক, চকোলাভা কেক, ফ্রুট কেক, অরেঞ্জ কেক, পাইন্যাপেল কেক, ব্লাক ফরেস্ট নানান কেক বাড়িতে সহজেই বানানো যেতেই পারে। আর তা না হলে কেক সপ তো রইল নিজেদের ঠিকানায়, কি বলেন? 

তথ্যসূত্র: 
http://www.foodtimeline.org/foodcakes.html 
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Cake 
https://www.puckles.com.au/pages/a-history-of-christmas-cakes 

0 comments:

1
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - উত্তম বিশ্বাস

Posted in


প্রবন্ধ


ঠাণ্ডা রসের ঠিলে 
উত্তম বিশ্বাস



অঘ্রাণ আসলেই খেজুর গাছগুলির ঝুটি ধরে ধরে কোপাতে থাকে গাঁয়ের শিউলিরা। খেজুরে হত্যা ভাবছেন? না, এ কোপ সে কোপ নয়। সারাবছর ধরে সন্যাসীর জটার মতো পুষে রাখা গাছগুলির মাথার ওপর জমাটবদ্ধ শুকনো চোমর, কম্বলের সুতোর মতো ভাঁজে ভাঁজে সাজানো সপরা, আর কাঁটা ওয়ালা বেগো, পাতা---সব কাটতে কাটতে গাছগুলির মাথাটা যখন অনেকটা ফর্সা হয়ে আসে; ওটুকু আরও একটু চেঁছে ছুলে মসৃণ করা হয়, ওটাকে তখন বলা হয় কপাল। আর ওই কপাল ঘেমেই পৌষ থেকে ফাগুন অবধি গড়িয়ে আসে গাছেদের সকল আনন্দ নিসৃত, দুঃখ নিসৃ্‌ত--- চিন্তা নিসৃত শীত শীতল রস। গাছগুলিকে তখন দারুণ ফুরফুরে দ্যাখায়;---ঠিক যেন বৎসরান্তে একবার করে নাপিত ডেকে, অশৌচ পুত্র কন্যাগুলিকে ধরে ধরে মস্তক মুণ্ডন করে ছেড়ে দেওয়া আর কী! তবে সব গাছে ইচ্ছে হলেই এমন ইস্পাতের ধার দেওয়া দা’এর কোপ দেওয়া যায় না। কম করে পাঁচ থেকে সাত বছর না হলে কোনও চারা গাছকেই দা’ কাঠারির ভয় ভীত দেখিয়ে রস আদায় করা একদম নিষেধ। এতে তাদের প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে যে! সামান্য রসের জন্যে চারা গাছের প্রতি এতটা বলাৎকার, জেনে বুঝে কেউ কী করতে চায় নাকী! 

শীতের দিনে সর্ষে ফুল ছোলা-মটর, আর গমক্ষেতের আল ছুঁয়ে কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে ঠিলে গুলি দুলতে থাকে ঠিক যেন যুবতীর বক্ষভারের মতো!--- এটাই আসলে রসময়ী বাংলার শীত প্রকৃত সৌন্দর্য। কিন্তু এরা অসম্ভব রহস্যময়ী!-- এদের মন পাওয়া অতটা সহজ ভাবছেন, ততটা নয়! এদের কাছ থেকে এক ফোঁটা আদায় করতে চাইলে তার হ্যাপা অনেক। আসুন আজ সেই রসের সন্ধানেই আমরা একটু গাঁয়ের পথে যাত্রা করি।

পাহাড়িরা চা পাতা তোলে যে ঝুড়িতে, তার চাইতেও সরু বাঁশের সলা দিয়ে বোনা খাঁচা বানিয়ে নেয় শিউলিরা। স্থানীয় মুচিদের কাছে আগে থেকে বায়না দিতে হয়। শিউলিদের ভাষায় যার আর এক নাম ঠোঙা। এই ঠোঙার ভেতর শিউলিরা গুছিয়ে নেয়, তিন পদের দা’। এগুলি হাসুয়ার চেয়ে সামান্য বেটে, অথচ অত্যন্ত ধারালো। এক নং থাকে কোপের দা’; যেটা দিয়ে ঝোপালো পাতা, শুকনো খোমা, শক্ত গুড়ি কুপিয়ে, কেটে ছেঁটে পাদানি ইত্যাদি প্রস্তুত করতে হয়। অনেকগুলি পাতা কেটে উপরের দিকে উঠতে থাকলে তবেই গাছের সাদা ও নরম অংশ বেরিয়ে আসে। এবার সেটিকে খুব সাবধানে চেঁছে ছুলে গাছ কপাল তৈরি করে শিউলিরা। গাছ তো ঝোড়া হয়ে গেল। এবার পাতা গুলি নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে,--- খুব দাগী, শুকনো পাতা এগুলি জ্বালানীর জন্যে আলাদা গাদা মারা থাকবে। মাঝের পাতা চলে যাবে চাটাই মাদুর শিল্পের কাজে। শপরা আর চোমর যাবে বিয়েবাড়ি, অথবা অন্নপ্রাশনের প্যাণ্ডেল সাজানোর কাজে। শুকনো ফুল আর কাঁটা যাবে হস্তশিল্পে,কিম্বা শহর ও গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন কুটীরশিল্পমেলায়। 

দুই নং দা প্রয়োজন হয় ঠি দিন পনেরো পরে। ঝোড়া গাছগুলি যখন একটু শুকিয়ে আসে, তখন চাচের দা দিয়ে এক পরল ছাল ফেলে দিয়ে চাঁচ দিতে হয়। এর জন্যে লাগে চাচের দা। চাঁচ দেওয়া হয়ে গেলে প্রতিটি শিউলিই মনে মনে ওপরওয়ালাকে ডাকতে থাকে! কেননা এই সময় হুট করে যদি বৃষ্টি অথবা নিম্নচাপের মতো অকাল বর্ষণের অভিশাপ নেমে আসে, তাহলে গাছগুলিতে ফাংগাস অথবা মাজরাপোকার আক্রমণের আশঙ্কা থাকে অনেকটাই। তখন রস যা নামবে,-- হয় তিতো, না হলে মারাত্মক রকম ঘোলাটে আর গ্যাজলানো।

গাছগুলি আপাতত সর্ষে ক্ষেতের আলে মটর ক্ষেতের মাঝে,-- ঝাঁঝালো মুলোর গন্ধ মেখে শীতের ঝলমলে রোদে দাঁত ছাড়িয়ে মনের সুখে আরও দিন দশেক হাসতে থাকুক। শুধু কি হাসি? কতো রকম ভঙ্গিমা এদের এক এক জনের! না দেখলে বিশ্বাসিই করতে পারবেন না। কেউ বা চোদ্দপাটী বার করে, কেউ বা নস্যিটেপা ঠোঁটে কুঞ্চিত মুখে, কেউ বা কিশোরী শ্যামার মতো আধো আধো চাহনীতে চেয়ে থাকে বাংলার মাঠ-ঘাট জুড়ে। অপরদিকে ওদের শরীরের ঠাঁটও এক এক জনের এক এক রকম। কেউ রণরঙ্গিণী বেশে, কেউ বা কুঁজো, কেঊ আবার দশাসই পেট নিয়ে! এদেরই মধ্যে কেউ কেউ আবার এক্কেবারে লাজবতী লতা! অপরপক্ষে কারও চাউনিতে হিংসুটে ভাব, কেউ বা চতুর,-- কেউ আবার মাথামোটা হ্যাদাভোদা আত্মভোলা! এদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন বডিল্যাংগুয়েজ নিখুঁতভাবে লক্ষ্য করে শিউলিরা। কেউ কেউ এমন গাছুড়েও আছে, যারা ওদের গতরের গড়ন দেখে আগেভাগে একটা আন্দাজ করে নিতেই পারে,--- কার কাছ থেকে গোটা শীত সিজেনে আদৌ ক’ফোটা গলানো, বা আদায় করা যাবে! অতএব আরও দিন দশেক গাঁয়ের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা ল্যাংটো পাছায় সারামাঠ ঘুরে ঘুরে গাছের মাথা গুণে গুণে হিসাব রাখুক, আর মনে মনে প্লান কষে নিক,-- কার ঠিলেটি ঢিলিয়ে ভাঙবে, আর কার ঠিলেয় পেঁয়াজকলি, কিম্বা গমের কাঠি চুবিয়ে চোঁ চোঁ করে সাবাড় করবে ঠাণ্ডা নৈশ রাতের রস! 
আর গাঁয়ের শিউলিদের মা ঝিয়েরা কুপি জ্বালিয়ে, দাঁতের আগায় শুকনো খেজুর পাতা চিকিয়ে চিকিয়ে চাটাই বুনতে থাকে, আর একখান পাটির বিনুনি প্রস্তুত হলেই, আতার ছালে সেলাই করে হাঁটে বিক্রি করে তুলে দেয় শিউলির হাতে। কেননা মাটির ঠিলেগুলি কিনতেও ত অনেক টাকা লাগে! অভাবের সংসার গাছেদের আতাবাতা বেয়ে যেটুকু উপার্জন করা যায়, সেটুকুই লাভ! 

শনশনিয়ে শীত এসে পড়ে। শিউলিরা মাথায় ফেট্টি বেঁধে ঢুঁ মারে জাওয়া বাঁশের ঝাড়ে। বুড়ো আঙ্গুলের মতো মোটা সাইজের কঞ্চি কেটে এনে সেগুলি তিন চার ইঞ্চি পরিমানে কেটে নিয়ে,-- চিরে নলি বানায়। আর এক দফায় বাঁশের গোড়া কেটে প্রস্তুত করে নেয় কাঠের গোঁজা বা খিল,-- যাতে ঠিলে ঝোলাতে হয়। এদের একত্রে বলা হয় “খিল-নলী।”---এই খিল নলী প্রতিস্থাপনের দিনগুলিতেই আসলে খেজুর প্রতিমাশিল্পের প্রকৃত চক্ষুদান পর্ব শুরু হয়ে যায়। তখন প্রতিটি গাছের রূপ যায় পাল্টে,-- চোখ, নাক, কপাল চাঁছা নাকে নোলক পরা গাছগুলোকে দেখলে, এবার সত্যি সত্যি মানুষ মানুষ মনে হয় তাদের। খিল নলী প্রতিস্থাপনের দিন গাছে ঠিলে পাতে না কেউ। এদিন কোনও কোনও গাছে দু’এক ফোঁটা ঝরলেও, শিউলি তার দা’এর আগায় মাখিয়ে মন ভরে আস্বাদ নেয় একা একা। বুকের ওপর মুখের ওপর যখন টুপটুপ করে ঝরে পড়তে থাকে আঠালো রস,---তখন এর ভাগ পৃথিবীর আর কাউকেই দিতে চায় না সে! 

গাছগুলির শীরের টান শুরু হবার সাথে সাথেই পালপাড়ার পাঁজায় বাঁশ পাতার আগুন আর ছাই ওড়ে খুব! সস্তা ধাতুর আংটি পরা হাতে ঠুং ঠাং ঠোকা দিয়ে, উল্টেপাল্টে বেছে বেছে পোড় খাওয়া ঠিলে গুলো কিনে আনে শিউলিরা। এরপর বাড়িতে এনে, টানা তিনদিন পুকুরে চুবিয়ে রাখাই দস্তুর। কেননা, আগুনমুখো ঠিলেরা ওদের তপ্ত বুকে রসের ফোঁটা পড়তেই চোঁ চোঁ করে শুষে নেবে প্রথম কাটের রস! এ কারণে আগে থেকেই খুব ভালোভাবে ঠাণ্ডা জলে শীতল আর রসালো করে নেওয়া হয় ওদের বুক। তারপর ঘরের বধুদের হাতে, “ঘটিগুলি মাজে! বাটিগুলি মাজে”র মহিমায় নিত্য দিনের রোজনামচা আর ঠোকাঠুকিতে নথিভুক্ত হয়ে যায় মাটির পাত্রগুলি।

রোদের দিকে পিঠ দিয়ে শিউলিরা বালিধরা পেতে, (সরু মসৃণ কাঠের বাটাম) তাতে ভাজা বালি দিয়ে কাগজের মত পাতলা দাগুলি ঘষে ঘষে ধার দিতে থাকে। আর বাড়ির বৌ ঝিরা দাওয়ায় ঠ্যাং ছড়িয়ে বস্‌ নগ্ন উরুর ওপর কাঠের চাকতি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কোস্টার বেটে কাটতে থাকে। এগুলি পাকিয়ে হবে ঠিলের কানাচ। অর্থাৎ ঠিলে ঝোলানো ফাঁস, বা দড়ি। ওদিকে উঠোনের এক কোণে মুখ সরু পঁচিশ গণ্ডা ঠিলে মুখোমুখি উপুড় হয়ে অল্প আঁচে, অথবা নাড়া(ধানের গোড়া) শুকনো শিরিশপাতা, ভিজে পলবিচালি অথবা ছোট লতাপাতা জ্বালিয়ে তিরী করা হয় সুগন্ধি ধোঁয়া! এই আগুনে ধিমে ধিমে পোড় খেতে থাকে ঠিলেগুলি। এসময় একটু সতর্ক থাকতে হয়, কেননা আগুন দপ করে জ্বলে উঠলে সমস্ত ঠিলেগুলি একসাথে চটপ্ট ফটফট আওয়াজ নিয়ে ফেটেফুটে সারাপাড়ার ঘুম ছুটিয়ে দেবে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, যে ঠিলেগুলি ধোঁয়া খেয়ে খেয়ে সবচেয়ে কালো হয়ে উঠবে, ওদের রসই হবে সবচেয়ে লাল এবং সুগন্ধযুক্ত, স্বাদেও তেমনই!--- এক্কেবারে নেশাধরানো!----যার আদি নাম জিরেন রস। সন্ধ্যায় এই রস নামালে দ্যাখা যায়, খড়ধোয়া জলের মতো ঈষৎ লাল, স্বচ্ছ সুগন্ধে ভরপুর! বাংলার শ্যামল প্রকৃতির এমন আদি রসের উপাখ্যান পৃথিবীর আর কোনও দেশে পাওয়া যায় কিনা আমার সন্দেহ!

রসিক শিউলি এবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজের কোমর আর খেজুরগাছ বেড় দিয়ে বেঁধে নেবে মোটা পাটের দড়া(দড়ি)। সাপোর্ট হিসাবে বিচালির তৈরি বোলেন থাকবে পায়ে। যদিও উলম্ব খেজুর গাছে অনেকগুলির বুকে বছরমাপা এক একটি খাঁজ কাঁটা ভাজ থাকে, সেখানেও পা রেখে ওঠে কেউ কেউ। এবার একগাছি মোটা দড়ির সাথে শিউলির কোমরে বাঁধা বাঁশের ঠোঙায় থাকে খিল নলী, তিন পদের দা, বালি, আর আঁকশিতে বাঁধানো একটি ঠিলে।

এসময় হুড়মুড়িয়ে গায়ের পরে এসে পড়ে ইতুপুজো। দারুণ শৈত্যপ্রবাহের ঠ্যালা খেয়ে সর্ষে ফুলের মঞ্জরিগুলি তিরতির করে কাঁপতে থাকে। আর তিনমাথার ব্যানাঝোপের আলে বসে হলুদ শাড়ি পরা গাঁয়ের মেয়েরা বৃদ্ধা হরিদাসীর মুখে ইতু ঠাকুরের উপকথা শুনতে শুনতে হারিয়ে যায় রূপকাথার দেশে! যেখানে দৈন্য নেই, দুঃখ নেই, আছে শুধু কিশোরী মনের কাঙ্ক্ষিত রাজপুত্তুর! উঠোনের এককোণে ঝুড়ি চাঁপা দেওয়া ইতুঠাকুরের ঘট। চালের আলপনা আর আধখাওয়া পেট নিয়ে উঠতি বয়সের মেয়েরা মাঠে বসে শুনতে থাকে পুরোনো দিনের পাঁচালী! আর এসব দেখবার নেশায় দুষ্টু বালকের মতো হাঁ করে চেয়ে থাকে রাখাল শূন্য খাঁ খাঁ মাঠ! আর একইভাবে ধু ধু প্রান্তরের দিকে একা একা ভিজে চোখে চেয়ে থাকা অশ্রুদানী খেজুর গাছেরাও! পুরোনো ব্রতকথা শুনে ওরাও হয়ত কাঁদে; কিন্তু কার জন্যে কাঁদে সেটা কেউ জানে না! জানে কেবল আবহমানের আলোহাওয়া আর ইটভাটার অসভ্য আগ্রাসী আগুন! পাশাপাশি আত্মীয়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলি এক এক করে বিক্রি হয়ে যায় জলের দরে! হাত মাপা দামে! কিনে নেন ফায়ারব্রিকসের মালিক। ফাড়াই করে পুরে দেন পাঁজায়! এর কোনও প্রতিকার নেই! অভাবের আগুন গিলে খায় গোটা শিউলিসমাজকে! এসব কথা একা একা ভাবে, আর ওদের চোখে মুখে ধারালো দা’এর পোচ দিতে গিয়েও মাঝে মাঝে আনমোনা হয়ে পড়ে অভাবী শিউলিরা। এর ফলে কখনও কাঁটার খোঁচা, কখনও বা সাপের ছোবলেও প্রাণ যায় অনেকের!
গাছ গুলিরও যে একেবারে দয়াধর্ম নেই, তা এমন নয়!—ওদের মধ্যে কেউ কৃপণ, কেউ আবার অতি উদার। তবে বোকার মতো যে গাছটি হাউহাউ করে কেঁদে ভাসাতে পারবে,--- তারই হবে জয়জয়াকার! কিন্তু সবাই ত আর সমান না, কেউ ঝরে ঝর ঝর করে, কেউ ফ্যালে ফোঁটায় ফোঁটায়, কেউ আবার মিনিটে একটিমাত্র ফোঁটা ফ্যালে। কিন্তু একটি বারের জন্যেও শিউলির অশ্রদ্ধা আর আক্রোশের এলোমেলো কোপ এসে পড়ে না ওদের কপালে!

সকাল হলে রসিক মালকোঁচা মেরে আবার উঠে পড়ে গাছে। শিউলির শীতার্ত বুক, নগ্ন উরু, রক্তশূন্য ধমনী ছলকে ওঠে কাঙ্ক্ষিত নবীন রসের আনন্দে। খুব সন্তর্পণে পেড়ে আনে রস ভর্তি ঠিলে। এরপর বাঁশের বাকে বাঁধিয়ে দুলকি চালে ছুটে চলে গাঁয়ের পথে। 

মেয়েরা জিরেন রসের জন্যে আগেভাগে আলাদা আখা বানিয়ে রাখে। পাল পাড়া থেকে বানিয়ে আনে বড় মাপের মাটির কড়াই,--- নাম জেলো। তবে ইদানীং টিনের চাতালেও গুড় জ্বাল দিচ্ছে কেউ কেউ। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, টিনের পাত্রে গুড় পুড়ে যাওয়ার যে সম্ভাবনা থাকে, অথবা স্বাদ নষ্ট হবার যে ভয় থাকে,--- মাটির জেলোতে তার সিকিভাগও ঝুঁকি নেই। এবার রসটুকু ঠিলের মুখে সপরা চেপে ধরে ছেকে নেওয়াই নিয়ম, কেননা ওর সাথে মিশে থাকে সাঁজালের ছাই, পাখির বিষ্ঠা, বাদুড়ের বমি, কচুর ডেগো, ধুতরার বিচি, আরও অনেক পদের উপসর্গ! --- অবশ্য ধুতরা, কচুর মতো এসব বাড়তি বালাই হয়ত যোগ করা হয় রসিক চোরের লোলুপ দৃষ্টি থেকে রাতের রসটুকু বাঁচানোর জন্যে! এ ছাড়াও আরও নানারকম টুকুটাকি গ্রাম্য দাওয়াই ব্যবহার করে থাকে শিউলিরা। এসব খেয়ে মৃত্যুর খবর না পাওয়া গেলেও, পাগল হবার উপকথা কিন্তু বহু প্রচলিত আছে! অর্থাৎ সাধু সাবধান! 

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, শুধুমাত্র রসের কারবারি যারা, তারা রসটুকু সংগ্রহ করেই সকাল সকাল বাজারে পৌঁছে যায়। আর বাকিরা আনে উনোনের ধারে। বাজারে রস পাঠাতে হলে কুয়াশা ভাঙার আগেই পাঠাতে হবে, কেননা বেলা বেড়ে গেলেই ওতে গ্যাজা উঠতে শুরু করবে। জিরেন রসের স্বাদ পেতে যারা বাজারে আসেন, তারা গ্লাস ভর্তি রস চোঁ চোঁ করে মেরে দেন শুধুমাত্র গন্ধ আর মিষ্টির টানে। যেদিন শুনবেন শীতের সকালে খুব হৈ চৈ চেঁচামেচি হচ্ছে, বুঝবেন এ ঝগড়া নিতান্তই রসকেন্দ্রিক। রস খেতে এসে নিশ্চয়ই ভেজাল ধরে ফেলেছেন কেউ!-- খাবার পর গোঁফের কাছে ঠোঁটের কোনায় যদি একটু চিটচিটে টান না অনুভব করা গেল, তাকে আবার জিরেন রস বলে নাকি কেউ!

একবার গাছের চোখে পোচ পড়লে মোটামুটি দিন তিনেক রস ঝরতেই থাকবে। প্রথম দিনের দিন যেটুকু সংগ্রহ করা হয়,-- জিরেন রস। আর দ্বিতীয় দিনে ঝরে সামান্য ঘোলাটে আর মৃদু ঝাঁঝালো,-- ওলা বা দোকাট। আর তৃতীয় দিনের এক্কেবারে তীব্র ঝাঁঝালো ঈষৎ জলপাই কালারের---তে’ঝরা! তার পরেও যদি অভাগা গাছগুলির কান্না না থামে, তখন কাঠবেড়ালি, ভাম, দাঁড়াশ সাপ, পিঁপড়ে, প্রজাপতি, মথ মৌমাছি,---নানা প্রজাতির পাখিরা এসে ওদের নাকচোখ চেটেচুটে শুকোনোর দায়িত্ব নিয়ে নেয়! তবে বড় গাছের নীচে থাকা অথবা ছায়ার গাছগুলি রোগাটে বা সিকিভাব বেশি, অসুস্থ্যও হয় ঘনঘন! এদের নিয়ে খুব দুর্ভোগ পোহাতে হয় শিউলিদের! তখন রস তো দূরের কথা, নিউমোনিয়া রোগীর মতো নাক মুখে শ্লেষ্মার স্রোত দেখলে, আপনারও গাছের ব্যথায় বুকের ভেতরটা খচখচ করে উঠবে!

রসের কড়াই গরম হলেই প্রথম একপরল মোটা ফ্যানা উৎলে উঠবে। কড়াই ছাপিয়ে পড়ে যাওয়ার আগেই উড়কি(নারকেলের মালা দিয়ে তিরী হাতা) দিয়ে ওটুকু ফাটিয়ে দেয় শিউলিরা, অথবা ওপর থেকে আলতো করে অন্য একটি পাত্রে তুলে রাখে,-- যাকে বলা হয় মোলো। এছারাও হাতের কাছে রাখে কাঁচা খেজুর পাতা। রসের কড়াই উৎলে উঠলেই কাঁচা খেজুর পাতা ছুপে ধরলেই তক্ষুনি রস রণে ভঙ্গ দেয়। এরপর জেলো ভর্তি রস নাচতে শুরু করলেই পাড়াময় ভুরভুরে গন্ধ শীতের কুয়াশা ফুঁড়ে হুহু করে ছুটতে থাকে। শিউলিপাড়া, সর্ষে ক্ষেত, ফেরিঘাট, বুড়ো বটতলা দুর্গা দালান মসজিদ মাজার সব একাকার করে নিয়ে মিষ্টি নলেন নলেন গন্ধে তখন ম ম----! ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তখন বাটি হাতে কাঙালের মতো দাঁড়িয়ে পড়বে উনোনপাড়ে! অসীম ধৈর্য নিয়ে শুনতে থাকবে গরম গুড়ের ঘাইমারা শব্দ! ওদেরকে ঢাল করে বয়স্ক কেউ কেউ হাঁকডাক দিতে থাকবেন ঘনঘন। কেউ বা লোভ সম্বরণ করতে না পেরে, মুখফুটে বলেই ফেলবেন,-- “এক চিমটি গুড় দিস মা!” 

মাঝে মাঝে ময়লা ফ্যানা ঘুরতে ঘুরতে জেলোর গায়ে জড়িয়ে উঠবে।--ওটুকু লেগে যাওয়ার আগেই ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে তুলে নেওয়াই নিয়ম, তা না হলে গুড়ের কালার ও গন্ধ দুটোই নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এবার রস আরও ঘন হয়ে এলে মুসুর দানার মতো বুটবুটি নিয়ে ফুটতে থাকবে। ওটাকে বলা হয় মুসুরফুট। এসময় আগুনেই সবচেয়ে সাবধানী হতে হয়। অল্প জ্বালে নাচতে থাকে উড়কি। ফুট বাতাসার আকার ধারণ করলেই, শুরু হয়ে যায় কাউনডাউন। বুটবুটিগুলি একটি দুটি করে ফাটতে শুরু করলেই জেলো নামিয়ে উড়কি দিয়ে ঘোলা মারতে হয়। এবার শুরু হয় শীতল করার পালা। কাঁচা খেজুরের ছড় কেটে তৈরি হয় বীজমারা কাঠি। ওর চওড়া মুখ দিয়ে জেলোর গায়ে ঘষে ঘষে ঘন করতে গরম গুড়। বীজ মরে ধুলো হয়ে এলে, সেটুকু সমগ্র গুড়ের সাথে ঘুলিয়ে নিয়ে চটপট প্রসারিত থালার ওপর ভিজে ন্যাকড়া বিছিয়ে, প্রস্তুত হয়ে যায় প্রমানসাইজের পাটালি। সবাই যে পাটালি করে, এমন নয়। কেউ ঠিলে ভরে, কেউ বানায় ভেড়োঁ। কেউ পাঠায় মোয়ার দোকানে, কেউ পাঠায় ভিয়েনে। ঢেঁকিতে আতপ চাল ধুলো হয়; পাড় পড়ে দুম দুম, কথা কয় ক্যাঁচ ক্যাঁচ!--- পৌষে পিঠে পিঠে পাবে নবান্নের মাঠ। খেয়াঘাট ভরা থাকে ঠিলে ভরা গুড়ে। ফুটপাথে হাঁক দেয় ফেরিওয়ালা, “মোয়া আছে মোয়া!” আর কড়াইয়ের গায়ে যেটুকু অবশিষ্ট থাকে,--- ওটুকু ঝিনুক বাটির কারবারিদের জন্যে বরাদ্দ করা থাকে। গ্রামের কচিকাচারা তখনও শুকনো মুখে ঝিনুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকে উনোনের পাশে! মালিক কড়াই থেকে সরে গেলেই সে কী আনদ! সে কী উল্লাস! এদের মধ্যে হয়ত কেউ পাবে, কেউ পাবে না। কেউ বা কালিঝুলি মেখেই ভূত হবে!--- তবু নলেনের যে স্বাদ , যে নেশা ধরানো গন্ধ--- তা পৃথিবীর আর কোনও খাবারে আছে কিনা আমার জানা নেই!

1 comments:

0
undefined undefined undefined

বইঘর - ঋতবাক

Posted in


বইঘর

চারটি প্রবন্ধের বই
ঋতবাক


'আখির ইয়ে ওয়ক্ত্ কেয়া হ্যায়? কঁহা সে আয়া, কিধার গয়া হ্যায়? ইয়ে কবসে, কবতককা সিলসিলা হ্যায়? ইয়ে ওয়ক্ত্ কেয়া হ্যায় আখির?' জাভেদ আখতারের অমর কবিতা 'ওয়ক্ত্।' যে প্রবন্ধে এটি ঊদ্ধৃত হচ্ছে তার নাম 'সময়'। প্রবন্ধকারের নাম নৃসিংপ্রসাদ ভাদুড়ী। আজ্ঞে হ্যাঁ। ঠিকই পড়েছেন নামটা। মহাভারতের টীকাকার অনায়াসেই, দিন, মাস, বছরে গড়া কালতুরঙ্গের বর্ণনা তুলে আনতে পারতেন মহাকাব্য থেকে। তা না করে, তিনি বলছেন -

ইয়ে ওয়ক্ত্ সাকিত হো অওর হম্ ভি গুজর রহে হোঁ
সফরমে হম্ হ্যাঁয়, গুজরতে হম্ হ্যাঁয়,
জিসে সমঝতে হ্যাঁয় গুজরতা হুয়া, উয়ো থমা হুয়া হ্যাঁয়, 
আখির ইয়ে ওয়ক্ত কেয়া হ্যাঁয়? কেয়া হ্যাঁয় আখির?

বইঘরে স্বাগত বন্ধু। ঋতবাক নির্মিত 'মন্দকথা' বইয়ের নৃসিংপ্রসাদকে আমরা দেখিনি কখনও। এই নৃসিংহ জাভেদ আখতার শুনিয়ে সাফ বলেন তিনি বুড়ো হবেন না। স্মার্ট ভঙ্গীতে লেখেন, কর্পোরেট যুগের গীতাভাষ্য 'Smart গীতা।' যেখানে টিম লীডার বাসুদেব কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, 'Stop neuter gendering yourself'! ভুল করবেন না। ভঙ্গী সর্বস্ব নয় এই বই। কনটেন্ট স্তরে কোথাও আপোস করেননি লেখক। ক্ষমতা নামের সর্বগ্রাসী শয়তান কেমনভাবে রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্রকে এক করে তোলে তার কথা বলেছেন। বলেছেন সিচুয়েশনাল এথিক্সের কথা : যার বিচারে মিথ্যে একটা সিচুয়েশনাল নেসেসিটি। আমি জানি, আপনি কী বলবেন। আপনি বলবেন, 'মহাভারত: নীতি অনীতি দুর্নীতি' বইতে এসব আপনি পড়েছেন। আপনি জানেন, লেখক বলেছেন, অবস্থা ভেদে ধর্মকে অধর্মের মতো আর অধর্মকে ধর্মের মতো দেখতে লাগে : মানুষকে তার বুদ্ধি, শীলন, মেধা দিয়ে ধর্ম আর ন্যায়কে বুঝে নিতে হয় - বিদ্বাদসস্তং সম্প্রশ্যন্তি বুদ্ধ্যা। বলবেন, এসব আপনার আগেই পড়া। না, পড়া নয়। আপনি সেই নৃসিংপ্রসাদকে পড়েননি যিনি এলিয়ট, বোদলেয়র আর মহাভারত মিলিয়ে কথা বলেন; 'শেয়ালদা স্টেশনের ঝগড়া অ্যাবসর্ব করার ক্ষমতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক বেশি'-র মতো সপাট বাক্য লিখতে পারেন; সংযম প্রসঙ্গে চুলকুনি আর তার দার্শনিক তাৎপর্য টেনে আনেন; মুচকি হেসে বলেন, 'চাওয়াটাকে কমাতে হবে বাছা'! সবচেয়ে বড় কথা, এই বইয়ের লাইনে লাইনে নিজের জীবনকে অকপটে মেলে ধরেছেন নৃসিংপ্রসাদ ভাদুড়ী। বলেছেন ছোটবেলার অনটনের কথা, লোকের কাছে চাওয়ার স্বভাবের জন্য মায়ের লজ্জা পাওয়ার কথা। বলেছেন বাঁশবেড়িয়া স্টেশনে নির্মম ভাবে মার খাওয়ার কথা। তারপর, সেই অভিজ্ঞতা থেকে দার্শনিক উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন। এর আগে নৃসিংপ্রসাদ এরকম বই লেখেননি? এর আগে কোথাও নিজেকে উপজীব্য করে, বিশ্লিষ্ট করে বোধিতে এসে পৌঁছনোর রচনা প্রকরণ ব্যবহার করেননি তিনি। প্রথম করছেন এই বইয়ে। কারও তোয়াক্কা না করে বলছেন, 'একান্তে বসলেই আমাদের মনের মধ্যে হিজিবিজি ভাবাবেগ জাগে। ...আর তখনই মানুষ সত্য কথা বলে - নিজের সম্বন্ধেও, পরের সম্বন্ধেও। তখন, মুখোশ থাকে না, থাকে না ভদ্রতার আবরণ। যা দেখে খারাপ লাগে, সেটা সরাসরি বলতে লজ্জা পাই না এই সময়।' এই সব কথা সবসময় শ্রবণসুখকর হয় না। তাই, লেখক তাঁর বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘মন্দকথা’।

*****************************

‘কখনও কোনো নতুন তথ্য আবিষ্কার করে ইচ্ছে হয়েছে সকলকে জানানোর; কখনও আবার নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মতো সুপণ্ডিতের কাঁচা ভুল ধরিয়ে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারি নি। কোনো কোনো বিষয়ে ভুল ধারণা কাটানোর জন্যও কলম ধরতে হয়েছে। তার বিষয় সাহিত্যও হতে পারে, দর্শনও হতে পারে।’

বস্তুবাদী দার্শনিক হিসেবে বিশ্বখ্যাত হলেও রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য আজীবন সাহিত্যেরই অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর ‘খোলা চোখে, খোলা মনে’ বইয়ের উনিশটি প্রবন্ধের বিষয়বস্তু তাই যুক্তিবাদ, বাঙালি সমাজ, ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সাহিত্য, অনুবাদ কবিতা এবং অবশ্যই চার্বাক/ লোকায়ত দর্শন।

অপরাজিত উপন্যাসে বিভূতিভূষণ অপর্ণাকে প্রথম দেখার পর অপুর মনোভাব বোঝাতে তার মনে এক বিদেশি উপন্যাসের লাইনের গুনগুন করার কথা লিখেছেন। ‘অপরাজিত-য় ধ্বনিময় এক ঊদ্ধৃতি’ প্রবন্ধে লেখক জানিয়েছেন সেই উপন্যাসের নাম-ঠিকানা। দেখিয়েছেন কেমনকরে অন্য ভাষার ধ্বনিময়তার সাহায্যে বিভূতিভূষণ তাঁর নায়কের মনের ভাব অপূর্ব দক্ষতায় প্রকাশ করেছেন। নীরদচন্দ্রের মতো পণ্ডিত কেমন করে যে লিখে বসলেন অপু ইংরিজি কবিতার লাইন বিড়বিড় করছিল, বিয়ের আগেই অপর্ণাকে অপুর বউই বা বানিয়ে দিলেন কেন, তা সত্যিই বোঝা দায়! একটা ফুটনোট কতটা সরস আর কৌতুকোজ্জ্বল হতে পারে, তা লেখকের নীরদচন্দ্রের ‘কাঁচা ভুল’ ধরানোর পদ্ধতি না পড়লে বোঝা যাবে না। অধ্যাপক ভট্টাচার্য জানিয়েছেন কীভাবে শেক্সপীয়ার পড়তে নেই। বিষ্ণু দে-র অনুবাদে ইয়েটস্‌- নিয়ে আলোচনা করেছেন। টেরি ইগল্‌টনের ‘আফটার থিওরি’ বইয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে উত্তর-আধুনিকতাবাদকে তুলোধোনা করেছেন। পাণ্ডিত্য কতটা নির্ভার হতে পারে, কতটা সরলভাবে গভীর চিন্তাকে বাঙ্ময় করা যায়, তা জানতে গেলে এই বই পড়তেই হবে। ঋতবাকের নির্মাণ এই বইটির মতো বই বাঙলায় খুব বেশি নেই।

*****************************

চারদিকে যখন এক অদ্ভুত আঁধার ঘিরেছে বর্তমানকে, তখন অধ্যাপক সুদিন চট্টোপাধ্যায় স্মরণ করছেন তাঁর প্রধানশিক্ষককে। বইপাগল মানুষটি কেমনভাবে ইংরিজি সাহিত্যের প্রাণস্পন্দন পৌঁছে দিতেন তাঁর ছাত্রদের কাছে; কেমন করে তাঁর বিশাল বইয়ের সংগ্রহ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দেশবিদেশের লাইব্রেরিতে বলছেন সে কথা। মনে করছেন সেই অদ্ভুত শর্ত। কোথাও দেওয়া থাকবে না দাতার নাম। বইয়ের ভিড়ে মিশে গিয়েই সার্থকতা পাবে তাঁর বইগুলো। পাগল লোক! আর, এমন পাগলেরই আজ বড় অভাব। ‘আঁধার রাতে একলা পাগল’ এমন এক প্রবন্ধের বই, যেখানে বারবার, আজকের দিনে নিষ্ঠা, আদর্শ এবং নিরপেক্ষ বিচারের কথা বলা হয়েছে। বিখ্যাত পণ্ডিত ও মননশীল প্রাবন্ধিকের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়ানো লেখা একত্র করে ঋতবাকের তৈরি এই প্রবন্ধসংকলনে আছে নানা বিষয় নিয়ে লেখা। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে লেখা আছে, আছে সাঁওতাল গণ-অভ্যুত্থান হুল নিয়েও। রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন, গান্ধীজি ছাড়াও দিলীপ কুমার রায়, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কে নিয়ে লেখা যেমন আছে; তেমনই আছে হর্ষবর্দ্ধন ঘোষের ‘ছদ্মনামের অভিধান’ বইটি নিয়ে আলোচনা; আছে শিক্ষাচিন্তা বিষয়ক প্রবন্ধও। অতি মনোগ্রাহী ভাষা। অতি সরল উপস্থাপনা। 

*****************************

‘এত বড়ো ভারতবর্ষে একটা যার মন্দির নেই, সেই সরস্বতী আবার দেবী, আর তার আবার পুজো!’

১৯৪৮ সালে ছোটদের জন্য লেখা ‘কমলাদেবী’ গল্পে লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। কথাটা ভেবে দেখার মতো। তাহলে কে এই দেবী সরস্বতী ? দেবী দুর্গার স্বরূপই বা কী? সত্যিই কি এক সাঁওতালি রমণী দেবী কালিকার আদিরূপ? শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ ধামে কেন জাতের বিচার নেই? বঙ্গীয় স্মৃতি নিবন্ধ অনুসারে দুর্গোৎসব একমাত্র ম্লেচ্ছ অধিকার স্বীকৃত পূজা, শবরোৎসব যার এক অপরিহার্য অঙ্গ। কেন?

জানার ইচ্ছে আছে, কিন্তু জানানোর মতো মানুষ বিরল। উত্তর আসছে হয় দলে টানার উদ্দেশ্য নিয়ে, নাহয় এত জটিল পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষায় যে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ছি আমরা। কবির ভাষা একটু বদলে নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, নিতে চাই, দিতে কেহ নাই! ঠিক এরকম সময়ই প্রয়োজন ছিল শিবাংশু দের ‘দেবতার সন্ধানে-একটি অনার্য অডিসি’ –এর মতো এক বইয়ের। 

এ বইতে লেখক অতি সরল ভাষায় কথা বলে গেছেন । একটি বাড়তি কথা নেই তাঁর শব্দে আঁকা ছবিতে। আপনি তাঁর সঙ্গে দেশ বেড়াবেন। পুরীতে ঘুরতে ঘুরতে তিনি আপনাকে জানাবেন কেমন করে আর্যদের সেরিব্রাল আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে, এক অনার্য ঐশীধারণা নীলমাধব, দারুব্রহ্ম রূপ নেন আর্য প্যান্থিয়নে। সরস্বতী নদী কীভাবে দেবী হলেন, আর এই অতি স্বাধীন দেবীটিকে নিয়ে কী বিপাকেই পড়েছিলেন পুরষতন্ত্রের ধারক-বাহকরা তাও জেনে নেবেন আপনি। জানবেন দেবীটিকে শ্বেতবর্ণা করার গূঢ় কারণ। ক্রীট, ব্যাক্ট্রিয়া বা বালখ্‌ অঞ্চলের এক সিংহবাহিনী দেবী কেমন করে শবর, পুলিন্দ প্রভৃতি আদিম ভারতবাসীদের দ্বারা বিন্ধ্যপর্বতে কাত্যায়নী ও কৌশিকী নামে পূজিতা হতে হতে ক্রমে দুর্গতিনাশিনী দুর্গা হয়ে উঠলেন; কোন উপায়ে পারিবারিক এককের রক্ষণশীল নির্মাণ হয়ে উঠল বাঙালির ঘরের মেয়ে উমা, তাও জানবেন আপনি। অনার্য পূজিতা মাতৃকাশক্তি, বাংলা আর আসামের কৌমজনতার আরাধ্যা এক ঘোরশ্যামা দেবীকে, সম্ভবত পঞ্চদশ শতকে, তাঁর তন্ত্রসার গ্রন্থে দেবী মহাকালী রূপে অবয়বদান করেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তারপর এক অতি জটিল আত্মীকরণ প্রক্রিয়া। স্ববিরোধ ও সমন্বয়ের পথপরিক্রমা। মাতৃতান্ত্রিক আত্মসন্ধান অনার্যমননের অন্দরমহলে। এই সন্ধানে সামিল হবেন আপনিও।

কালীতত্ত্ব, প্রকৃতপক্ষে ইতরবর্গীয় সংখ্যাগুরু দেশবাসীর আত্মপ্রতিষ্ঠার একটি স্বীকার্য খতিয়ান। গোষ্ঠীগত অধ্যাত্মবৃত্তের বাইরের মানুষ হয়তো নিজস্ব বোধে বিনির্মাণের এই তত্ত্বকে অন্যভাবে বুঝতে পারবে। আনুগত্যের বিচারে সনাতনধর্মীয়রা সামগ্রিকভাবে এই দেবীর প্রতি সতত নিবেদিত থাকলেও তাঁর স্বরূপসন্ধান একান্তভাবে একটি অনার্য অডিসি।

কালী সম্বন্ধে এ কথা বললেও এই বইয়ের মূল কথা এটাই। আজ যখন সনাতনের মৌলিক রূপ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, চলেছে ভারতবর্ষের কৃষ্টি-সংস্কৃতির উৎস-সন্ধান; তখন আপনাকে সঙ্গে নিয়ে দেবত্ব আর মানবতার স্বরূপের খোঁজে বেরিয়েছেন লেখক।


********************

চারটি প্রবন্ধের বই। চার রকম ভাবে বিচার। কিন্তু, মিল আছে। কোথায়? চার প্রাবন্ধিকই কোথাও, একটিবারের জন্যও পণ্ডিতি ফলাননি। ভাষাকে অকারণ জটিল করেননি। আর, সবচেয়ে বড় কথা, পাঠকের মেধাকে তুচ্ছ করেননি। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় পড়ানোর সময় ছাত্রদের বলতেন, ‘তোমরা তো সবই জানো।’ এই ‘সবই’-র মধ্যে নন্দনতত্ত্ব থেকে সাম্প্রতিকতম সাহিত্যতত্ত্ব, সবকিছুই পড়ত। ছাত্ররা বুঝতো, কথাটা পুরোপুরি ঠিক হতে পারে না। তবু, এই গুরুত্ব দেওয়াটায় তারা একেবারে গলে যেত। প্রাণপণ চেষ্টা করত কথাটার মর্যাদা রাখতে। এই চারটে বইও আমাদের ওপর একই আস্থা রেখেছে। একই সম্মান দিয়েছে আমাদের বোধশক্তিকে। এবার আমাদের দায় তাদের মান রাখা। আর সেটা আমরা পারবই।

0 comments: