1

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়



ওরে মন, পৃথিবীর গভীর - গভীরতর
                         অসুখ এখন। 

-বিমল ঘোষ 


আমাদের ফাল্গুনীদা মানে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় – এই প্রবাদপ্রতিম প্রবীণ ব্লগার, সাহিত্যব্রতী, বৃদ্ধ-যুবক মানুষটিই কেমন যেন ঋতবাক ২য় বর্ষ, ২৩তম সংখ্যার সম্পাদকীয়র সুরটি বেঁধে দিলেন তাঁর প্রচ্ছদ নিবন্ধে। সত্যিই ‘পৃথিবীর গভীর – গভীরতর অসুখ এখন’। বিবেকহীন দুর্বিনীত অশালীন ঔদ্ধত্যে উন্মত্ত পৃথ্বী... শিক্ষাও মানুষকে নম্র হতে, ভদ্র হতে শেখায়না আজ। আসলে শিক্ষা মানে তো শুধু অনেকখানি পড়ে নেওয়া নয়! শিক্ষা মানে সেই লব্ধ জ্ঞানকে হৃদয়ঙ্গম করা, আত্মস্থ করা। তেমনটা আর হচ্ছে কই! মুখে বলা আর কাজে করা – দুয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। যৌক্তিকতার বালাই নেই। সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই। বিবেকদংশন নেই। আত্ম অহংকার আছে, আত্ম সম্মান নেই। ক’টা টিশার্ট আছে, ক’জোড়া জুতো আছে, ক’টা GF/BF আছে, ব্যাঙ্কে কত টাকা আছে, – সেই হিসেব নিয়েই ব্যস্ত। বেশ আছে কিন্তু! খাই-দাই কাঁসি বাজাই-গোছের স্ট্যাটাস। এরাই আমাদের তরুণ প্রজন্ম – দেশের আগামী ইতিহাস নাকি এরাই রচনা করবে!! 

এত নৈরাশ্য, তবু আশার কথা তো শোনাতেই হবে, আশা নিয়েই তো বেঁচে থাকা। সেই ভরসার কথাটি হলো, এখনও বেশ কিছু সমপরিমান মান ও হুঁশ সমন্বিত সামাজিক প্রাণী রয়েছেন ভারসাম্য রক্ষার জন্য। আর তাই আজও সৌভ্রাতৃত্ববোধ আছে। শ্রদ্ধা আছে। প্রেম আছে। আছে কদম কেশর আর বকুল বিছানো পথ। আছে সপ্তপর্ণীর মাতাল করা সৌরভ। ভোরের স্নিগ্ধ আকাশ আছে, দীর্ঘ দগ্ধ অপরাহ্ণের বিষণ্ণতা আছে, বৃষ্টির শব্দ মুখরিত বিনিদ্র রাত্রি আছে। অহংকারী বলে, আমার কিছু পাওয়ার নেই, আমি শুধু দিতে চাই। আমি বলি, বিপুলা এই পৃথিবীকে কি-ই বা দেওয়ার আছে আমার! বরঞ্চ পাওয়ার আছে অনেক কিছু – রূপ রস গন্ধ বর্ণ – প্রেম প্রীতি – শ্রদ্ধা ভালোবাসা – কাব্য গীতি ... আরও আরও কত কিছু – অজস্র অফুরান...! নিত্য নৈমিত্তিক দিনযাপনের রুক্ষ রণক্ষেত্রকে এরাই তো মসৃণ করে রাখে। এ তত্ত্ব হয়ত ‘অ-সাধারণ’-এর বোধের অতীত। আমি বড় ছাপোষা, বড় সাধারণ। আমি জীবনকে এই ভাবেই দেখি। আর তাই তো আমার পৃথিবীটা আজও বড় সুন্দর, বড় প্রতিশ্রুতিময়! একজন্মে যেন সবটুকু পাওয়া হয় না – বার বার ফিরে ফিরে আসতে ইচ্ছে হয়! 

আচ্ছা, হয়েছে! অনেক দার্শনিক তত্ত্ব কথা হলো। এবার কিছু জাগতিক ইনফো দেওয়া যাক। উৎকর্ষের ধারাকে অব্যাহত রাখতে ঋতবাকে অফিশিয়ালি সংযোজিত হলেন আরও কিছু বিশাল মাপের রত্নখচিত ব্যক্তিত্ব। ঋতবাক ঋদ্ধ হলো। ওদিকে ঋতবাক পাবলিকেশন বন্ধুদের বই ছাপার জন্য পুরোমাত্রায় প্রস্তুত। এদিকে আবার ঋতবাক বার্ষিক সংকলনে লেখা মনোনয়ন পর্বও শুরু হয়ে গিয়েছে। আপনারা তো জানেনই, লেখা নির্বাচনের বিচার্য মাপকাঠি লেখার গুণগত মান, বানান বিধির বিশুদ্ধতা, রচনাশৈলী, বিষয়গত সারবত্তা এবং অবশ্যই বক্তব্যের যুক্তিগ্রাহ্য স্বচ্ছতা। তাই ভালো লেখা পাঠান অনেক অনেক।

আরে, লেখা পাঠানোর কথায় মনে পড়লো, ঋতবাকে ঘোষিত হয়েছে গল্প প্রতিযোগিতা – ‘এসো গল্প লিখি’। সেখানেও তো পাঠাতে হবে গল্প! সাবজেক্টে ‘বিষয় – এসো গল্প লিখি’ - লিখে RRITOBAK@gmail.com – এই ঠিকানায় পাঠিয়ে দিন ন্যুনতম ৭০০ শব্দের গল্প, শেষ তারিখ ১৫ই জুলাই, ২০১৬। একজন গল্পকার সর্বাধিক ২টি গল্প পাঠাতে পারবেন। তবে আর অপেক্ষা কিসের! 

আপনাদের স্বতঃস্ফূর্ত সাহচর্যই ঋতবাকের একমাত্র পাথেয়। 

শুভেচ্ছা নিরন্তর

সুস্মিতা বসু সিং

1 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in

প্রচ্ছদ নিবন্ধ



ফিরে এসো দামাল ছেলেরা
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়


‘ঐ ক্ষেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই
অসুরপুরে সোর উঠেছে জোরসে সামাল সামাল তাই
কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই’ !

‘দামাল ছেলে’র একটা চেহারা বোধহয় নজরুলের ‘কামাল পাশা’ কবিতায় রয়েছে। এ তো অনেক পুরনো কথা। সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সময়কালের। এ যুগের দামাল ছেলেদের ‘কামাল’ করার পন্থা-প্রকরণ বদলেছে। কয়েক মাস আগে কোন এক রাজনৈতিক দলের বাহুবলী কর্মী কলেজের ভিতরে এক শিক্ষিকার মুখে জলের জগ ছুড়ে ছিলেন। শোনা যায় তার দলের নেতারা নাকি তাঁর পিঠ চাপড়ে ছিলেন দলের ‘দামাল ছেলে’ বলে। কে যেন সেদিন জিজ্ঞাসা করছিল, ‘দামাল ছেলেরা সব গেল কোথায়’? আমি বলি, যাবে কোথায়, আছে তো! তবে অন্য চেহারায়। আগে রকে বসে সিগারেট ফুঁকত। ছোট ছেলেদের দুষ্টুমি দেখে এড়িয়ে যেতাম আর এখন কলেজের অধ্যক্ষকে মেরে চশমা ভেঙ্গে দিলেও ‘ছোট ছেলেদের দুষ্টুমি’ আখ্যা পায়। দুষ্টুমির ধার ও ভার বেড়েছে। ফারাক এ’টুকুই।

বাংলার দামাল ছেলেদের নিয়ে আমাদের সমাজ জীবনের কত গৌরব গাথা, কত গল্প আমাদের সাহিত্য নাটক, কবিতা, চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতে। কবি সুকান্ত দামাল ছেলেদের একটা ছবি এঁকেছিলেন তাঁর ‘আঠেরো বছর বয়স’ কবিতায় –

‘আঠেরো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠেরো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।

সুকান্ত ডাক দিয়েছিলেন ‘এ দেশের বুকে আঠেরো আসুক নেমে’। স্বাধীনতার সংগ্রামে বাংলার দামাল ছেলেদের গৌরব গাথা রচনা করেছিলেন ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, সূর্য সেনরা। স্বাধীনতার পরে সুকান্তর ‘এদেশের বুকে আঠেরো’ নেমে এসেছিল অন্তত তিনটি দশক জুড়ে। তারপর আশির দশক পর্যন্তও দামালপনা আর আঠেরোর আবেগের কিছু অবশেষ ছিল।

এলোমেলো হওয়া শুরু সত্তরের দশক থেকেই। ‘এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে’, সুকান্তর সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে এক ঝাঁক তরুণ দামাল শোনালেন ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে। বলা ভালো, দামালরা ব্যবহৃত হলেন। সত্তরের দশকটাই যেন হয়ে গেল বাংলার আদর্শবাদী দামাল ছেলেদের মৃত্যুর দশক। কবি বিমল ঘোষ কবিতায় সেই ছবি এঁকেছিলেন’

‘কিনু গোয়ালার গলি
সোনার টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি
বারুদগন্ধ বুকে নিয়ে আকাশে ফোটে জ্যোৎস্না
ময়লা হাতে ওকে তোরা ছুঁস না
ওরে মন, পৃথিবীর গভীর - গভীরতর
অসুখ এখন।

সত্তর দশকেই অসুখের শুরু। আর আশির দশকে মধ্যভাগ থেকে এতদিনের চেনা দামাল ছেলেরা কেমন বেবাক বেপাত্তা হয়ে গেল। তারা গেল কোথায়? এমন তো নয় যে তারা সব চাকরী-বাকরী পেয়ে প্রভূত উন্নতি করে হারিয়ে গেল। আসলে তাদের দামালপনা অন্য খাতে বইয়ে দেওয়া হলো। দিলেন তাঁরা, যাঁরা এইসব দামালদের ব্যবহার করা শুরু করলেন। দামাল ছেলেরা সব কেমন যেন পুতুল হয়ে গেল। ‘যেমন নাচান তেমন নাচি’। তাদের সামনে কোন আদর্শবাদ নেই, নেই তার নিজের সমাজ ও পারিপার্শ্বিকের প্রতি কোন ভালোবাসা, ভালোবাসার আবেগ। তারা হয়ে গেল নেইরাজ্যের বাসিন্দা। 

প্রয়াত অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর ‘ছন্নছাড়া’ কবিতাটির কথা নিশ্চয়ই মনে পড়বে। ওদের কথা লিখেছেন পরম সংবেদনায় –

‘ওরা বিরাট এক নৈরাজ্যের – এক নেইরাজ্যের বাসিন্দা
ওদের জন্য কলেজে সিট নেই
অফিসে চাকরি নেই
কারখানায় কাজ নেই
ট্রামে বাসে জায়গা নেই
খেলায়মেলায় টিকিট নেই
হাসপাতালে বেড নেই
বাড়িতে ঘর নেই
খেলবার মাঠ নেই
অনুসরণ করবার নেতা নেই
প্রেরণা জাগানো প্রেম নেই
ওদের প্রতি সম্ভাষণে কারুর দরদ নেই ......’

এত নেই-এর মধ্যেও তবু ওরা ছিল। মৃতদেহ সৎকার করতে, পাড়ায় রাত-পাহারা দিতে, হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগীর পাশে রাত জাগতে এরা একডাকে ঝাঁপিয়ে পড়তো। বিয়ে বাড়িতে গেঞ্জি গায়ে কোমরে গামছা বেঁধে পরিবেশনের বালতি নিয়ে ছুটোছুটি করতো এই সেদিনও। এখন অবশ্য ফোন করলেই মৃতদেহ সৎকারের সু-সজ্জিত গাড়ি চলে আসে, ক্যাটারিংএর কর্মীরা স্যুট-টাই পরে পরিবেশন করে। পাড়ার ছন্নছাড়ারা অতএব অন্য আশ্রয়ে। তাই এখন আবার অচিন্ত্যকুমারের দেখা সেইসব ছন্নছাড়াদেরও বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। রাস্তায় কোন বৃদ্ধের রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকলেও ‘প্রাণ আছে, প্রাণ আছে’ উচ্ছ্বাসে ট্যাক্সি থামায় না তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে। এখন চোর অপবাদে দাগিয়ে আর এক মেধাবী তরুণকে পিটিয়ে মেরে ফেলেও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কোনও ভাবান্তর দেখতে পায় না !

‘আমাদেরই ছেলে বিজয় সিংহ হেলায় লঙ্কা করিল জয়’ বলে দামাল ছেলেদের কোনও প্রাচীন গৌরবগাথার আবেগে যাবো না। কিন্তু এও তো জানি যে ঐসব ছেলেদের দামালপনা আমাদের সামাজিক ইতিহাসেরও উপাদান হয়ে যায়। বাঙালির দামালপনার চির শ্রেষ্ঠ প্রতীক হয়ে আছেন সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস। সেই কবে দেড়শো বছর আগে ‘থাকবো নাকো ঘরের কোণে, দেখবো এবার জগৎটাকে’ -এই মন্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা বিশ্ব। কৈশোরে জাহাজের স্টুয়ার্ট থেকে সার্কাস কোম্পানীতে বাঘ-সিংহ’র খেলা দেখিয়ে বেড়ানোর পর থিতু হয়েছিলেন সুদূর ব্রাজিলে। অসীম সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিয়ে ব্রাজিলের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে হয়েছিলেন কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস। আড়াইশো বছর আগেকার এক ঘটনা ছুঁয়ে যাই। তখন দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন জমিদাররা, যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার থাকতো না। হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ায় এই রকম এক দুর্গাপূজায় কিছু তরুণকে ঢুকতে দিল না জমিদারের লোকজন। অপমানিত, উৎসবে প্রত্যাখ্যাত সেই বারো জন তরুণ ঠিক করলো, কুছ পরোয়া নেই, আমরাই করবো দুর্গাপূজা। পরের বছর ঐ বারোজন তরুণ উদ্যোগী হয়ে চাঁদা তুলে শুরু করলো দুর্গাপূজা। সেই দিন থেকে শুরু হয়ে গেল বারোয়ারি দুর্গাপূজা। সেটা ১৭৬১ সালের কথা। এইসব দামালরা চিরকালই আমাদের সস্নেহ প্রশ্রয় পেয়েছে, প্রকাশ্যে না হলেও আড়ালে। এদের জন্য আমাদের বুকে কোথাও যেন একটা ভালোবাসার জায়গা ছিল। আর ছিল বলেই আজও খুঁজে বেড়াই, জানতে চাই দামালরা সব গেল কোথায় ? 

ওদের আশ্রয় বদল হয়েছে, ওদের আবেগ এখন অন্য আশ্রয়ে। আমাদের সাহিত্য, কবিতা, চলচ্চিত্র, গানেও আর তারা নেই। এখন কোনও পাগলা দাশুর দুরন্তপনা নেই, হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন কিংবা টেনিদার বিচিত্র কাণ্ডকারখানা নেই, এখন কোন ঘনাদার আড্ডাঘরে দেশ-বিদেশের রাজা-উজির মারা নেই। এখনকার দামালরা স্বপনকুমার, নীহারগুপ্ত পড়ে সময় নষ্ট করে না। 

হাহাকার নয়। সময়ের চলমান স্রোতে তারুণ্য ও যৌবনের এলোমেলো করে দেওয়া সময়ে তারা আর ফিরবে না জেনেও বলতে ইচ্ছা করে- ফিরে এসো, ফিরে এসো, দামাল ছেলেরা।


0 comments:

0

প্রবন্ধ - রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ



চার্বাকপূর্ব বস্তুবাদ : একটি সমীক্ষা
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য 



প্রাচীন ভারতে ভাববাদের পাশাপাশি বস্তুবাদেরও উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিল – এ নিয়ে কেউ তর্ক তোলেন না। তবে দুঃখ করে কেউ কেউ বলেন – ভাববাদের এমন শক্তিশালী একটি প্রতিপক্ষ ছিল কিন্তু তার কোনো মৌলিক রচনা আমাদের হাতে এল না, সমস্ত বেমালুম হারিয়ে গেল! কেউ কেউ আবার বলেন, যদিও কোনো প্রমাণ ছাড়াই – চার্বাকদের সব বই পুড়িয়ে বা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে; তার জন্যেই ভারতের বস্তুবাদী ধারার সঙ্গে এখনকার লোকের পরিচয় আক্ষরিক অর্থেই নামমাত্র।

এখানে কয়েকটি ব্যাপার ঠিক মতো বোঝার আছে। 

(এক) ভারতে বস্তুবাদের একটিই মাত্র ধারা – ছয়/পাঁচ শতক থেকে +বারো শতক অবধি বহাল ছিল না। বরং যুগে যুগে একাধিক বস্তুবাদী সম্প্রদায় দেখা দিয়েছিল। সংস্কৃত ভাষায় লেখা বইপত্রে তার খবর না-থাকলেও পালি ও প্রাকৃত রচনায় পাওয়া যায়। অজিত কেশকম্বলীকে আদি-বস্তুবাদী (প্রোটো-মেটিরিয়ালিস্ট) বলা হয়েছে। পরলোক নেই, পুনর্জন্ম হয় না, যজ্ঞ করে ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা দেওয়া বৃথা – এমন অনেক কটি ‘না’ নিয়ে তিনি নিজের মত প্রচার করতেন। ইনি ছিলেন বুদ্ধর সমসাময়িক। বৌদ্ধ সাহিত্যে তাঁর মতকে উচ্ছেদবাদ বলা হয়। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ দার্শনিক রচনাতে তাঁর বক্তব্যকেই বস্তুবাদ বলে সনাক্ত করে হয়েছে।

একা অজিত কেশকম্বলীই নন, পরলোক ও পুনর্জন্মে অবিশ্বাসী আরও একজনের কথা বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে পাওয়া যায়। তাঁর নাম পায়াসি বা পএসি। ইনি কোনো ছোটো রাজা বা কোনো অঞ্চলের শাসক ছিলেন। তিনিও অজিত-এর কথাই বিশ্বাস করতেন (তবে তিনি অজিত-এর নাম করেন নি)। নাগার্জুন, চন্দ্রকীর্তি প্রমুখ বৌদ্ধ দার্শনিক পরবর্তীকালে তাঁর কথাই উদ্ধৃত করেছেন – এমন হওয়াও সম্ভব।

জৈনদের প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থ সূত্র-কৃতাঙ্গ-সূত্র ও আচারাঙ্গসূত্র-য় অনেক ধরণের গোষ্ঠি বা সম্প্রদায়ের কথা আছে যারা পঞ্চভূতের বাইরে আর কোনো সত্তায় বিশ্বাস করত না।

(দুই) কিন্তু তারপরেই একটা বিরাট ফাঁক পড়ে যায়। বস্তুবাদীদর্শনের প্রবক্তাদের মধ্যে সবচেয়ে চেনা নাম হলো চার্বাক। শব্দটি কিন্তু সাধারণত বহুবচনেই ব্যবহার করা হয়। যেমন, ‘চার্বাকরা বলেছেন,’ ‘চার্বাকরা প্রতিপন্ন করেন,’ ইত্যাদি। নামটি এতই পরিচিত যে বস্তুবাদী বোঝাতে – যে সময়েরই হোক – চার্বাক নামটিই সচরাচর ব্যবহার করা হয়। মুশকিল হচ্ছে, চার্বাক একজন ব্যক্তির নাম, লোকায়ত বা বার্হস্পত্য বা নাস্তিক-এর প্রতিশব্দ হিসেবে নামটি পাওয়া যায়, কিন্তু চার্বাক-এর পরে মত বা দর্শন শব্দটি না দিলে এটি কোনো দার্শনিক সম্প্রদায়ের মূল নীতি বোঝায় না। ফলে বুদ্ধর সময়েও চার্বাকরা ছিলেন – কথাটি অর্থহীন। +আট শতকের আগে ভারতের কোনো ভাষায় চার্বাক বলতে কোনো দার্শনিক বা দর্শন সম্প্রদায়ের অনুগামী বোঝাত না। তার পর থেকেই +বারো শতক পর্যন্ত নানা নামে (দেহাত্মবাদী, ভূতচৈতন্যবাদী, ইত্যাদি) বস্তুবাদের উল্লেখ করা হয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার : চার্বাকরা ভারতে এখনও পর্যন্ত আমাদের জানা শেষ বস্তুবাদী দার্শনিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। তার পর থেকেই তাঁদের বইপত্র কোনো অজানা কারণে কোথায় হারিয়ে গেছে।

প্রশ্ন হলো : তাহলে কি –ছয়/পাঁচ শতক আর +আট শতকের মধ্যে বস্তুবাদ বলে ভারতে আর কিছু ছিল না? সুখের বিষয় এর উত্তর প্রাচীন তামিল সাহিত্যে বহুকাল ধরেই মজুত ছিল। কিন্তু যে কারণেই হোক, তার দিকে নজর দেওয়া হয়নি। তামিল মহাকাব্য মণিমেকলাই (+চার শতক থেকে +সাত শতকের মধ্যে কোনো সময়ে লেখা)-তে শুধু বস্তুবাদীদর্শনই নয়, ভারতের অনেক ক'টি দর্শনেরই পরিচয় পাওয়া যায়। এই মহাকাব্যর নায়িকার নাম মণিমেকলাই। দাক্ষিণাত্যের নানা অঞ্চলে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন; বেশ কটি দার্শনিক সম্প্রদায়ের প্রবক্তাদের সঙ্গে তাঁর দেখা হচ্ছে। তাঁদের কাছ থেকে প্রত্যেকের দার্শনিক মতের বিবরণ তিনি শুনছেন। সর্গ ২৭-এ এই কটি দার্শনিক সম্প্রদায়ের নাম আছে : লোকায়ত, বৌদ্ধ, সাংখ্য, ন্যায়, বৈশেষিক আর মীমাংসা। এই ক'টি সম্প্রদায়ের আচার্য হলেন যথাক্রমে বৃহস্পতি, জিন (বুদ্ধ), কপিল, অক্ষপাদ (গৌতম), কণাদ আর জৈমিনি। তামিলে অবশ্য নামগুলি একটু অন্যরকম। আচার্যদের নামের ক্ষেত্রেও তামিল রূপই দেওয়া হয়েছে (২৭।৭৮-৮২) এগুলি ছাড়াও অবশ্য শৈব, বৈষ্ণব, ইত্যাদি মতের কথাও আছে।

লক্ষ্য করার বিষয় হলো : সংস্কৃত নামের পাশাপাশি কোনো কোনো পারিভাষিক শব্দর নামও পাওয়া যায়। যেমন প্রমাণ, অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞানের উপায়, বলে যে কটির নাম করা হয়েছে সেগুলির কয়েকটি সংস্কৃত, কয়েকটি তামিল। সে যা-ই হোক, প্রমাণগুলি হলো : প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ (আগম), উপমান, অর্থাপত্তি ও অভাব (২৭।৮৩-৮৫)।

এর থেকে বোঝা যায় : বস্তুবাদী চিন্তার ক্ষেত্রে লোকায়ত ও বৃহস্পতির নাম +আট শতকের আগেই জানা ছিল, যদিও ‘চার্বাক’ নামটি এখানে পাওয়া যাচ্ছে না। তার বদলে লোকায়ত ছাড়াও পূতবাদ (সংস্কৃত : ভূতবাদ) নামে অন্য একটি বস্তুবাদী মতের নাম জানা যাচ্ছে। এমন একজন ভূতবাদীর কাছে মণিমেকলাই তাঁর দার্শনিক মত জানতে চান। সেই ভূতবাদী শুধু নিজ মতের কথাই বলেন না, লোকায়তদের সঙ্গে কোথায় তাঁদের মেলে না, সেকথাও জানান (২৭।২৬৪-৭৩)। তিনি বলেন :

 ফুল, গুড়, ইত্যাদি মেলালে যেমন মাদকশক্তি উৎপন্ন হয়, তেমনি  ভূতগুলি মিলিত হলে উৎপন্ন হয় চেতনার। প্রমাণের মধ্যে একমাত্র  প্রত্যক্ষই স্বীকার করার যোগ্য, এমন কি অনুমানও বর্জনীয়।  বর্তমানে যা আছে আর বর্তমান জীবনে আমরা যা ভোগ করি,  সেগুলোরই অস্তিত্ব আছে। অন্য এক জীবন আছে, আমাদের  কর্মফল সেখানে ভোগ করা যায় – এমন দুটি ধারণাই ভুল (২৭।২৬৪-৭৬ । সংক্ষেপিত)

মণিমেকলাই প্রাচীন তামিলে লেখা একমাত্র বৌদ্ধ রচনা; শুধু তামিলে নয়, গোটা ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে এই মহাকাব্যটি বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। সেতলাই সাতনার ও ইলাঙ্গ দুজনে এই মহাকাব্যটি রচনা করেছিলেন। বইটির একাধিক সংস্করণ ও অন্তত একটি টীকাগ্রন্থ পাওয়া যায়; ইংরেজীতে তিনটি অনুবাদ দেখার সুযোগ হয়েছে। তামিল সাহিত্যের ইতিহাস তথা তামিলনাড়ুতে ধর্ম ও দর্শনের অতীত কথা জানতে হলে মণিমেকলাই পড়তেই হয়। কিন্তু যে কারণেই হোক ভারতে বস্তুবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে যাঁরা অনুসন্ধান করেছেন, তাঁদের প্রায় কেউই বোধহয় এই মূল্যবান রচয়নাটির কথা জানতেন না। অথচ বস্তুবাদের ইতিহাসে চার্বাকপূর্ব ধারার দুটি সম্প্রদায়ের কথা এখানে পাওয়া যাচ্ছে : লোকায়ত ও ভূতবাদ। ভূতবাদ নামটি জৈন ঐতিহ্যে পাওয়া গেলেও (+নয় শতকে শীলাঙ্ক-র সূত্রকৃতাঙ্গসূত্রবৃত্তি, ১।১।৭-৮, পৃ.১০-১১) সেটি যে আদতে চার্বাক বা লোকায়তর প্রতিশব্দ নয়, বরং অন্য একটি বস্তুবাদী মতের নাম - মণিমেকলাই না-থাকলে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি জানা যেত না। আরও দেখবার এই যে, ইংরিজি মেটেরিয়ালিজম্‌ শব্দটি ভূতবাদ-এর একেবারে আক্ষরিক তর্জমা। 

মণিমেকলাই আগাগোড়াই উদ্দেশ্যমূলক রচনা। অন্য সব ধর্মদর্শনের তুলনায় বৌদ্ধমতের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপন্ন করাই ছিল তার রচয়িতাদের একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু তারই ফাঁকে ফাঁকে দক্ষিণ ভারতে ধর্ম ও দর্শন সম্প্রদায়গুলির বিষয়ে অনেক খবর এতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে বস্তুবাদের ইতিহাস পুনর্গঠন করতে এই তামিল মহাকাব্যটি হারিয়ে–যাওয়া খেই ধরিয়ে দেয়। একদিকে, আদি-বস্তুবাদ আর পুরোপুরি দর্শনপ্রস্থান হিসেবে লোকায়ত আর ভূতবাদ-এদের মধ্যে মণিমেকলাই–এর বিবরণ এক যোগসূত্র। অন্যদিকে, চার্বাকপূর্ববস্তুবাদ আর চার্বাক মত-এই দু-এর মধ্যেও ঐ বিবরণটি যোগসূত্রর কাজ করে। পালি সাহিত্যে অজিত কেসকম্বল ও পায়াসি (জৈন সাহিত্যে যাঁর নাম পএসি) এঁরা দুজন আদি নাস্তিক। পরলোক ও জন্মান্তরকে তাঁরা বাতিল বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এ হলো শুধুই পরমতত্ত্ব (অন্‌টোলজি)। পুরোপুরি দর্শনপ্রস্থান হতে গেলে এর সঙ্গে জ্ঞানতত্ত্ব (এপিসটোমোলজি), অধিবিদ্যা (মেটাফিজিক্‌স), নীতিবিদ্যা (এথিক্‌স্‌) ইত্যাদিও থাকা চাই। মণিমেকলাই-তে দেখা যাচ্ছে : এমন অন্তত ছটি দর্শনপ্রস্থান (ভূতবাদকে ধরলে, সাতটি) আর সেগুলির পাশাপাশি কয়েকটি বৈদিক ও অবৈদিক ধর্মসম্প্রদায় +সাত শতকের মধ্যেই দাক্ষিণাত্যে রীতিমত জায়গা করে নিয়েছিল।

দ্বিতীয় কথা, পালি ও সংস্কৃত বৌদ্ধ সাহিত্যে ‘লোকায়ত’ শব্দটি অতীতে, এমনকি +প্রথম/দ্বিতীয় শতকেও, ব্যবহার হতো বিতণ্ডাসত্থ বা বিতণ্ডাশাস্ত্র বোঝাতে। কিন্তু মণিমেকলাই -তে দেখা যাচ্ছে : +চার ও +সাত শতকের মধ্যেই লোকায়ত বলতে একটি বস্তুবাদী দর্শন প্রস্থান বোঝায়। ওদিকে, +আট শতকেই দেখা যায় : চার্বাক, নাস্তিক, বার্হস্পত্য আর লোকায়ত-এই চারটি নাম একে অপরের সমার্থক; লোকায়ত শব্দটির যে অর্থ আগে ছিল সেটি আর চালু নেই। কোন্‌ সময় থেকে ‘লোকায়ত’র দ্বিতীয় অর্থটি (=বস্তুবাদীদর্শন) প্রধান হতে শুরু করেছে - তার নিশানাও ঐ তামিল মহাকাব্যে পাওয়া যায়।

কোথায় কোথায় চার্বাকপূর্ব মতগুলির সঙ্গে চার্বাকমত আলাদা? তফাৎ হয় মূলত চারটি জায়গায় : 

ক) চার্বাকপূর্ববস্তুবাদীরা ছিলেন ভূতপঞ্চকবাদী; চার্বাকরা ছিলেন ভূতচতুষ্টয়বাদী। মাটি, জল, বাতাস আর তেজ (আগুন) ছাড়া আকাশ (বা ব্যোম বা শূন্য) বলে পঞ্চম কোনো ভূত চার্বাকরা মানতেন না।

খ) চার্বাকপূর্ববস্তুবাদীরা (অন্তত ভূতবাদীরা) দু-ধরণের পদার্থে বিশ্বাস করতেন : নির্জীব আর সজীব। সজীব থেকে জীবন আসে, শরীর আসে নির্জীব থেকে। চার্বাকরা অমন দুটি সত্তায় বিশ্বাস করতেন : সজীব-নিরজীব সব বস্তুই চতুর্ভূত থেকে উৎপন্ন / অভিব্যক্ত হয়েছে। শরীর থাকলে তবেই চেতনার উদ্ভব হতে পারে।

গ) চার্বাকপূর্ববস্তুবাদীরা (অন্তত তাঁদের কেউ কেউ) ছিলেন যদৃচ্ছাবাদী, কার্যকরণ সম্পর্কে আস্থাহীন; চার্বাকরা কার্যকারণভাব অর্থে স্বভাব-কে মানতেন

ঘ) চার্বাকপূর্ববস্তুবাদীরা প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলতে; চার্বাকরা কিন্তু প্রত্যক্ষ ছাড়াও লোকপ্রসিদ্ধ অনুমান বা উৎপন্ন-প্রতীতিকে প্রমাণ বলে স্বীকার করতেন। তার মানে, ঈশ্বর, পরলোক, সর্বজ্ঞপুরুষ, ইত্যাদি বাদে যেসব ব্যাপার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায় (যেমন, ধোঁয়া থেকে আগুনের অনুমান) – সে জাতীয় অনুমানে তাঁদের আপত্তি ছিল না।

মণিমেকলাই–এর সঙ্গে তত্ত্বসংগ্রহ, ন্যায়মঞ্জরী, স্যাদ্‌বাদরত্নাকর, ইত্যাদি মিলিয়ে পড়লে এটা সত্যিই বেরিয়ে আসে।



- - - - - - - - - 



এই প্রবন্ধে যেসব প্রাথমিক ও হাত ফেরতা উৎস থেকে সাহায্য নেওয়া হয়েছে সেগুলির পুরো তালিকা দিতে অনেক জায়গা লাগবে। ছাপার ঝক্কিও কম নয়। উৎসাহী পাঠকরা আমার এই দুটি প্রবন্ধ দেখে নেবেন।


Development of Materialism in India : the Pre-Carvakas and the Carvakas. – Esercizi Filosofici8. 2013

Svabhavavada and the Carvaka/Lokayata : A Historical Overview. Journal of Indian Philosophy. 40 : 5, October 2012.

দুটি লেখাই অনলাইনে-এ দেখতে পাওয়া যায়। <carvaka4india> ও <Academia.edu> blog/website থেকে ডাউনলোডও করা যায়।



কৃতজ্ঞতা স্বীকার : প্রদ্যুতকুমার দত্ত, সিদ্ধার্থ দত্ত।






















0 comments:

2

প্রবন্ধ - অমিত ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ



যমের ছেলেবেলা, যমের বড়বেলা
অমিত ভট্টাচার্য *



বাজশ্রবস স্বর্গকামনায় যজ্ঞ করছেন। ঘর ভর্তি আমন্ত্রিত অভ্যাগতরা এসেছেন। যজ্ঞের নাম সর্বস্বদক্ষিণ বিশ্বজিৎ যজ্ঞ। সব দেবার আয়োজন চলছে। কিন্তু নামে তালপুকুর ঘটি ডোবে না। যজ্ঞানুষ্ঠানে দানধ্যানের বহর মোটেই আশাপ্রদ নয়। যারা প্রায় শেষবারের মতো খেয়েছে, পান করেছে এবং যাদের ইন্দ্রিয়গুলো শিথিল হয়েছে, যাদের আর বাছুর হবে না – এমন সব গরুগুলোকে অকাতরে বিলোনো হচ্ছে। যজ্ঞের ফল জন্মান্তরে নথিভুক্ত করে দেওয়া হবে – এই বিজ্ঞাপনে মুগ্ধ বাজশ্রবস। কেবল মানুষের আনাগোনা, ধন্যি ধন্যি রব। কথকঠাকুর ঋষির বলার ভঙ্গিমায় পাঠক উৎকর্ণ। কেউ কেউ বলেন বাজশ্রবস পূর্বেই সব দান করে রিক্ত হওয়ায় কতিপয় নিরিন্দ্রিয় গরুই অবশিষ্ঠ ছিল এবং হাতের কাছে সেই পড়ে থাকা গরুই বিতরণ করা হচ্ছিল। সুতরাং বাজশ্রবসের মর্যাদা খাটো করার প্রশ্নটি মোটেই সঙ্গত নয়। 

এই পর্যন্ত ভালোই চলছিল। বাদ সাধলেন বাজশ্রবসের পুত্র নচিকেতা। বয়সে কুমার নচিকেতার অন্তরে বিবিদিষা চাড়া মেরে উঠল। দাতার দানসামগ্রী যদি গ্রহীতার ভোগে না লাগে, ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয় তবে দাতা এবং গ্রহীতা উভয়েরই অকল্যাণ। বস্তুত প্রজননসামর্থ্যহীন শীর্ণদেহ গরু কেনই বা স্বর্গকামী পিতা দান করছেন তা ভেবে ভেবে নচিকেতা নিজের অন্তরের থেকে কোন সদুত্তর পেল না। স্বর্গবাসনা-পূরণ যজ্ঞের আনন্দানুষ্ঠানের মধ্যেও নচিকেতার মন বিষণ্ণ, ভারাক্রান্ত। স্বর্গকামী মানুষ কিনা শেষমেশ নিরানন্দময় লোকে গমন করে দুঃখ পাবেন। বয়সটা নিতান্তই কম হলেও নিজের উপলব্ধ সত্যকে পিতার সামনে খোলামনে প্রকাশ করতে নচিকেতা কৃতসঙ্কল্প হল। যজমান বাজশ্রবসের অধোগতি অবধারিত অনুভব করে নচিকেতার নিষ্পাপ কিশোরচিত্ত উদ্বেলিত হল—‘এবম্ভুতাঃ গাঃ ঋত্বিগ্‌ভ্যো দক্ষিণাবুদ্ধ্যা দদৎ প্রযচ্ছন্‌, অনন্দা অনানন্দাঃ অসুখা নাম ইত্যেতদ্‌ যে তে লোকাঃ, তান্‌ স যজমানো গচ্ছতি’ (শা.ভা.ক.উ. ১।১।৩) 

নচিকেতা একবগ্গা । আড়াল থেকে পিতার অনুষ্ঠান-কর্ম সে সবই খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছে। পিতার মুখোমুখি হয়ে নিজের অন্তরের জিজ্ঞাসা নিয়ে সে হাজির। ‘কস্মৈ মাং দাস্যতীতি’ আমাকে কাকে দিচ্ছেন? আমি তো আপনার মূল্যবান সম্পত্তি। আমি সবুজ, বয়সে নবীন। আমাকে কোন্‌ ঋত্বিকের উদ্দেশ্যে দক্ষিণারূপে প্রত্যর্পণ করছেন। বিবিদিষু নচিকেতার প্রশ্নে যজ্ঞশালা জুড়ে শোরগোল পড়ে গেল। অনেকের মনে হল, একরত্তি ছেলে কি ডেঁপোরে বাবা ! পংক্তিভোজনের সময় ভরা পেট খেয়ে ফাঁকের দিকে বন্ধুরা মিলে কোথায় ছুটোছুটি করবে, তা না—একঘর আমন্ত্রিতদের মধ্যে পিতাকে পাকা প্রশ্ন—আমাকে কাকে দিচ্ছেন ?

সব বাড়িতে যেমন হয় এখানেও তার ব্যতিক্রম হল না। নিজের স্বর্গকামনা অভিলাষী বাজশ্রবস মুখ তুলেও চাইবার প্রয়োজন অনুভব করলেন না। নচিকেতা নাছোড়বান্দা। যেমন বুনো ওল তেমন বাঘা তেঁতুল। প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি হল। আজ্ঞে, শুনছেন, আমাকে কাকে দিচ্ছেন? পিতা নিরুত্তর। দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার এই একই কথা ‘দ্বিতীয়ং তৃতীয়ম’। বাজশ্রবস শুনলেন। আহতহৃদয় পিতার ক্রোধাগ্নির সামনেও নচিকেতা অবিচল। বাজশ্রবসের উন্নত কপালে স্বেদবিন্দু। আরক্তনয়ন পিতার মুখমণ্ডলের সামনেও পলায়নহীন পুত্র শান্ত, সরল ও সত্যবদ্ধ।

বাজশ্রবস পুত্রের কানে হাত দিলেন না, গালে সপাটে চড় কষালেন না, পুত্রকে সকলের মধ্যে হাঁটু মুড়ে বসতে বললেন না, বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করার জন্য ধমক দিলেন না, জুলপি ধরেও টানলেন না। এই সবই লঘু অপরাধের শাস্তি বলে তিনি মনে করলেন। বাজশ্রবসের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে। তিনি স্ত্রীকে ডাকতে পারতেন, রাগারাগি করতে পারতেন, বখাটে ছেলেটাকে গর্ভে ধারণের জন্য স্ত্রীর নিন্দামন্দ করতে পারতেন। আরও কিছু করতে পারতেন। যেমন ছেলেটাকে পাঁচশ বার ওঠাবসা করাতে পারতেন, উত্তম-মধ্যম দিয়ে ধুলোয় লুটিয়ে দিতে পারতেন। প্রতিবেশীদের সামনে নিজের কপালে বারংবার চপেটাঘাত করে পরিবারের মানমর্যাদা মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারতেন। গৃহস্বামী হিসেবে বাজশ্রবসের পক্ষে এসব মোটেই বেমানান হত না।

কিন্তু সকলে শুনলেন ক্রুদ্ধ বাজশ্রবস অবাধ্য পুত্রকে যমের বাড়ি পাঠালেন। ‘মৃত্যবে ত্বা দদামি’। বাজশ্রবসের মনে হল পুত্রের অপরাধ অমার্জনীয়। কিশোর বয়সেই পিতার স্বর্গস্বপ্ন চুরমার করে দিতে উদ্যত। নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠান সমাপ্তপ্রায় যজ্ঞে দক্ষিণার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন। অসহ্য। যমের বাড়িই এই উদ্ধত কিশোরের একমাত্র উপযুক্ত স্থান। এরকম পুত্রের মুখদর্শনও পাপ। বয়সে ছোট হলেও এর মধ্যে ছেলেমির বিন্দুবিসর্গ নেই। ‘নায়ং কুমারস্বভাবঃ’ (শা. ভা. ক. উ. ১। ১। ৪)

‘নচিকেতা পরিদেবয়াঞ্চকার’ ভাবতে থাকে। কোন্‌ পরিস্থিতিতে স্বয়ং পিতা পুত্রকে অন্তর থেকে যমালয়ে পাঠাতে চান। নচিকেতা নিজের পারফরম্যান্সের চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করে। সে তো নিম্নমানের মোটেই নয়। অধম, নীচ পুত্রের মৃত্যুকামনা অমূলক নয়। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল। কিন্তু বহুজনের মধ্যে উত্তম অথবা মধ্যম হবার দাবিদার যে, তাকে এই ধরনের ভর্ৎসনা! নচিকেতার সিদ্ধান্ত হল, প্রথম জিজ্ঞাসাতেই পিতা নেহাৎ অবহেলার ছলেই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বারংবার একই প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে তিনি ধৈর্যচ্যুত হন এবং শেষে নিতান্ত বিরক্তিবশতই এই কঠোর বাক্য প্রয়োগ করেন ‘নূনং ক্রোধবশাদুক্তবান্‌ পিতা’ (শা. ভা. ক. উ. ১। ১। ৫)

মুখ থমথমে। মুখ ফসকে যা বলে ফেললেন তা বাস্তবে ঘটলে নিজের পায়ে লোকে কুড়ুল মারার অভিযোগে লোকে বাজশ্রবসের দিকে আঙুল তুলবে বৈ কি ! যে আত্মজ পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করবে বলে মনে করা হয়, সেই আত্মজকে ইহজগৎ থেকে বিদায়ের আদেশ দিয়ে একরাশ আতঙ্ক নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেন বাজশ্রবস। সত্যনিষ্ঠ নচিকেতা পিতার কথা পালনে যত্নবান হল। কথা দিয়ে যায় চেনা। ‘ন চলতি খলু বাক্যং সজ্জনানাং কদাচিৎ’ সুতরাং যেভাবেই হোক উচ্চারিত বাক্যের মর্যাদা রক্ষায় বাজশ্রবস যেন বিন্দুমাত্র বিচলিত না হন। ‘পালয়াত্মনঃ সত্যম্‌’। উচ্চারিত সত্য পালন করাই বিধেয়। কথামতো এবার আমায় যমের বাড়ি চলে যাবার অনুমতি দিন—‘প্রেষয় মাং যমায়’। বিষাদবিধুর বাজশ্রবস পুত্রের কাছে হারলেন। কালের অনুসরণ করে চলেছেন নিজের অজ্ঞাতসারে।

ইহলোক বাসের মেয়াদ উত্তীর্ণ হল। নচিকেতা চললেন যমালয়ে। ঋষি পথের কোন বর্ণনা দেননি। বর্ণিত পথের বিবরণ শুনে আরও অনেকে যে সেই পথে ভীড় করবেন না, তা তো সহজেই অনুমেয়। আপামর জনতা জানেন, যমের সদন মানেই অপারেশন সাইলেন্স। নামোচ্চারণেই পাবলিক শিহরিত হয়, চোখ বন্ধ করে। নচিকেতা ব্যতিক্রমী। বন্ধনমুক্তির অনুমতি নিয়ে কম বয়সেই নতুন ভুবনে যাবার আনন্দে মশগুল। পিতার কাছে অপ্রিয় সত্য বলবার দায়ে নচিকেতা অভিযুক্ত। এই অভিযোগেই যমদর্শনের সুযোগ।

যমের জন্ম ইতিহাসটা ভারি মজার। বিশ্বকর্মার কন্যা সংজ্ঞার সাথে সূর্যের বিবাহ হয়। মার্তণ্ড সূর্যের দোর্দণ্ড তাপ তো বলবার অপেক্ষা রাখে না। বস্তুত সূর্যের দিকে তাকানোই দুষ্কর। সূর্য সংজ্ঞার দিকে তাকালেই সংজ্ঞা নেত্রযুগল বন্ধ করতেন। এদিকে সূর্য গেলেন বেজায় চটে। মুদ্রিতচক্ষু নায়িকার সঙ্গে তো প্রেম চলে না। সূর্যের মনের কন্দরে নায়কোচিত ভাবটি জেগে ওঠে। ‘লোচনৈঃ পীয়মানঃ’ না হলে তো দাম্পত্য প্রেমের কবর খনন হয়। স্বামীকে দেখলেই সংজ্ঞার দু-চোখ জুড়ে আসত। ‘সংজ্ঞা চ রবিনা দৃষ্টা নিমীলয়তি লোচনে’ (মা. পু. ৭৭। ৩)। সূর্য যে কার সঙ্গে জমিয়ে গল্প করবেন ভেবে পান না। অসন্তুষ্ট সূর্য সংজ্ঞাকে দিলেন অভিশাপ। সূর্য বললেন, যেমন আমায় দেখে নিমীলিত নেত্রে রয়েছো তেমন তোমার গর্ভস্থ সন্তানের নাম শ্রবণেও মর্ত্যের মানুষ মুদ্রিতচক্ষু হবে—

ময়ি দৃষ্টে সদা যস্মাৎ কুরুষে নেত্রসংযমম্‌
তস্মাজ্জনিয্যসে মূঢ়ে প্রজাসংযমনং যমম্‌।। (মা. পু. ৭৭। ৪)

পরিণামে সমগ্র প্রাণিকুলের সংযমনকারী যমের জন্ম হয়েছিল। সূর্যের অভিলাষ ছিল আর পাঁচটা স্ত্রীর মতোই তার স্ত্রীও যেন ‘আঁখো মে আঁখি’ ডালতে জানেন। কিন্তু যমের মা নয়নকোণে পুষ্পধনু বাঁকানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। সূর্যের অভিশাপে অভিমান স্পষ্ট। এদিকে সংজ্ঞাও যে দৃষ্টিদানের চেষ্টা করতেন না, তা নয়। তবে তার দীর্ঘশ্বাস ফেলা দেখে অভিযোগের কিছু চলতে পারে না।

দুই পুত্র ও এক কন্যা নিয়ে সূর্য-সংজ্ঞার সংসার। জ্যেষ্ঠ পুত্র মনু শাস্ত্রানুশীলনে বেশি সময় ব্যয় করে। মনুর অনুজ যম এবং কন্যা যমুনা। যমুনার জন্মকাহিনীও অভিশাপ জর্জরিত। সংজ্ঞা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেন সূর্যকে দু’চোখ ভরে দেখবেন। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। স্বামীর উজ্জ্বল তেজে নিজেকে সইয়ে নিতে নিতেও শঙ্কিত সংজ্ঞার চোখ পিটপিট করে ওঠে। সারাদিন ধরে জগৎকে তাপ বিকিরণ করে দিনান্তে একটুকু বিশ্রামের বেলায় যদি পিটপিটমুখী স্ত্রী হাজির হন তবে কারই বা ধৈর্য থাকে। স্ত্রীর চঞ্চল দৃষ্টিতে পুনরায় সূর্য ধৈর্যচ্যুত হন এবং বলেন—তোমার এই চঞ্চল দৃষ্টির জন্যই গর্ভস্থ সন্তান বিলোলা নদীরূপিনী হবে—

যস্মাদ্বিলোলিতা দৃষ্টির্ময়ি দৃষ্টে ত্বয়াধুনা
তস্মাদ্বিলোলাং তনয়াং নদীং ত্বং প্রসবিষ্যসি।। (মা.পু. ৭৭। ৬)

স্বামী, পুত্র, কন্যার ভরা সংসারেও সংজ্ঞা কিন্তু মোটেই ভালো নেই। নিজের ভালো না থাকার জন্য তার সন্তানেরা দায়ী নয়। এর জন্য দায়ী সংজ্ঞা নিজে, না তার স্বামী স্বয়ং সূর্য—তা সংজ্ঞা বুঝে উঠতে পারেননি। তবে সংজ্ঞা এটুকু বুঝেছেন যে, দাম্পত্যসুখের মূল যে অদ্বৈতবোধ, তা সে যতই ক্ষণিকের হোক্‌, সেটিই বড় অভাব তার জীবনে। অত্যন্ত সহজভাবে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করেও সংজ্ঞা সূর্যের দিকে স্বাভাবিকভাবে দৃষ্টি দিতে পারেন নি। দৃষ্টিদানের টেনশনেই সংজ্ঞা মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। পুত্রকন্যার কথা ভেবে সংজ্ঞা এতকাল অসহ্য হলেও গৃহত্যাগ করেন নি। বিবাহের পর থেকেই সংজ্ঞার একটিই সমস্যা। সূর্যের সঙ্গে সহাবস্থানই তার অসহ্য লাগে—

সাপি সংজ্ঞা রবেস্তেজঃ সেহে দুঃখেন ভাবিনী।
অসহস্তী চ সা তেজশ্চিন্তয়ামাস বৈ তদা।। (মা.পু. ৭৭। ৮)

অভিশাপ মাথায় নিয়ে সন্তানধারণ কারই বা ভাল লাগে! সংজ্ঞা ভাবতে বসেন, সন্তানদের ছেড়ে তিনি কোথায় যাবেন, ওদের কে দেখভাল করবে, খিদে পেলে ওরা কার কাছেই বা খাবার চাইবে। সংজ্ঞার মন নানা দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত। সকাল থেকেই সূর্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাকেও সন্তানদের দেখভালের জন্য সময় দিতে বলা ব্যর্থ। মনু, যম, যমুনা—কেউ বুঝবে না সংজ্ঞার অন্তরের বেদনাকে। আর তাদের সে বোঝার বয়সও হয়নি। সংজ্ঞার প্রায়ই মনে হয় সূর্যের কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে। সংজ্ঞা মনমরা।

সংজ্ঞা স্বামীকে চটাতেও চান না। উজ্জ্বল পিতৃপরিচয়ের অধিকারিণী সংজ্ঞা অপযশের ভাগী হতে মোটেই ইচ্ছুক নন। এতেই সমস্যা জটিল আকার নিয়েছে। সূর্যকে চটাবোও না অথচ তার থেকে দূরে কোথাও নিজেকে রাখব - তা কিভাবেইবা সম্ভব ! কি করি, কোথায় যাই, কোথায় গেলে সমস্যা দূর হবে, অথচ উনিও রাগবেন না—এই সব কিছুই সংজ্ঞার অন্তরটাকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে—

কিং করোমি ক্ক গচ্ছামি ক্ক গতায়াশ্চ নির্বৃতিঃ।
ভবেন্মম কথং ভর্তা কোপমর্কশ্চ নেষ্যতি।। (মা.পু. ৭৭। ৯)

চিন্তায় চিন্তায় সংজ্ঞার দুচোখের পাতা যখন আর এক হয় না, তখন তিনি স্থির করেই ফেললেন পিত্রালয়ে যাবেন। পিতাকে গিয়ে নিজের অসুবিধার কথা বলার চেষ্টা করবেন।

এদিকে যাবো বললেই তো যাওয়া যায় না। সংসারের একটা দায়িত্ব আছে বৈ কি? ছেলেমেয়েদের দেখাশোনার দায়িত্ব, সূর্যের চাহিদা পূরণের দায়িত্ব। বুদ্ধিমতী সংজ্ঞার মাথায় চটজলদি একটা প্ল্যান এসে গেল এবং সেটিকে তিনি অত্যন্ত ক্ষিপ্রতায় বাস্তবায়িতও করলেন। প্রবল আবেগ-তাড়িত সংজ্ঞা নিজেরই দেহ থেকে অবিকল একই রকম সূর্যের প্রিয়তমা ছায়াময় তনু নির্মাণ করলেন। বিশ্বকর্মার কন্যা হওয়ার সুবাদে সংজ্ঞাও নির্মাণকার্যে কম যান না। সৃষ্টি হল ছায়াসংজ্ঞা। একরকম নাক, একরকম চোখ, হাঁটাচলা, ওঠাবসা সবই এক (নকল সংজ্ঞা, Dummy !) ছায়াসংজ্ঞার সাথে কথা হল।

সংজ্ঞা ছায়াকে জানালেন তার অন্তরের অভিপ্রায়। ছায়াকে সংসারের ভার দিয়ে তিনি চলে যেতে চান পিত্রালয়ে। ছায়াকে সংজ্ঞা দীর্ঘক্ষণ ধরে দায়দায়িত্ব বোঝাতে থাকলেন। মনু, যম, যমুনাকে মায়ের মতনই যত্ন করতে হবে, বাড়ির সব প্রয়োজনের দিকে অতন্দ্র দৃষ্টি রাখতে হবে এবং সর্বোপরি সূর্য যেন ঘুণাক্ষরেও তার এই প্ল্যানের বিষয়ে কিচ্ছুটি জানতে না পারেন। সূর্য বাড়িতে ফিরে যখন যেটি বলতে চাইবেন তখন সেটি তৎক্ষণাৎ নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে ছায়া যেন সম্পন্ন করেন। কেবল সূর্যই নয়, ছেলেমেয়েরাও যেন সংজ্ঞার বিষয়ে কিছুই না জানতে পারে। ছায়াসংজ্ঞা উপলব্ধি করেন তার ওপরে অর্পিত দায়িত্ব মোটেই সোজা নয়। বেশ কঠিন।

দায়িত্বের বোঝা নিয়ে ছায়ার মনে যে শঙ্কা আছে তা আগাম অনুমান করলেন সংজ্ঞা। তিনি ছায়াকে প্রলুব্ধ করলেন। সংজ্ঞা বললেন, আজ থেকে সম্পূর্ণ বাড়িটাই তোমার। আমি যেমন এই বাড়িতে থেকেছি, মর্যাদা পেয়েছি, তুমিও তেমনভাবেই থাকবে, মর্যাদা পাবে। শুধুমাত্র একটাই জিনিস মনে রেখো, আমার সঙ্গে আচরণে তারতম্য আনবে না। সূর্য যেন আমার অভাব না বুঝতে পারেন—

তাঞ্চোবাচ ত্বয়া বেশ্মন্যত্র ভানোর্যথা ময়া।
তথা সম্যগপত্যেষু বর্তিতব্যং তথা রবৌ।।
পৃষ্টয়াপি ন বাচ্যং তে তথৈতদ্‌গমনং মম।
সৈবাস্মি নাম সংজ্ঞেতি বাচ্যমেতৎ সদা বচঃ।। (মা.পু. ৭৭। ১২-১৩)

ছায়া অনুভব করলেন তার কাজটা হুবহু সম্পন্ন করতে বেশ বেগ পেতে হবে। প্রতিমুহূর্তেই সূর্যের কাছে ধরা যাবার ভয় তো আছেই। প্লাস শিশু-পুত্রকন্যার নজরদারি।

ছায়াসংজ্ঞা অবস্থা পর্যালোচনা করে শর্তাধীনে রাজি হলেন। আসলে প্রকৃত ঘটনা জানাজানি হলে যে চড়থাপ্পড় খেতে হতে পারে বা অভিশম্পাত বর্ষিত হতে পারে, ছায়ার সেটি বোঝার মত বুদ্ধি ছিল। এজন্য ছায়া সংজ্ঞাকে জানান যে—শাপ ও কেশাকর্ষণ যতদিন না হয় ততদিন সে প্রদত্ত আদেশ যথাযথভাবে পালন করবে। ঐ দুটিকে ছায়ার বড্ড ভয়—

আ কেশগ্রহণাদ্দেবি আ শাপাচ্চ বচস্তব।
করিষ্যে কথয়িষ্যাম বৃত্তন্তু শাপকর্ষণাৎ।। (মা.পু. ৭৭। ১৪)

ছায়া জালালেন পুরুষ কর্তৃক মেয়েদের প্রহারের কুদৃশ্য এবং শাপ-শাপান্ত মোটেই সহ্য করা যায় না। এই দুটির কোনওটি ঘটলে ছায়া যে সব প্রকৃত ঘটনা ফাঁস করে দেবেন, তা জানিয়ে দিলেন। সংজ্ঞা জানতে চাইলেন, ছায়ার আর কোন শর্ত রয়েছে কি-না। থাকলে সে যে তা প্রাণ খুলে নির্ভয়ে বলতে পারে, তাও জানিয়ে দেওয়া হল। সংজ্ঞার আন্তরিকতায় ছায়া সূর্যের সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন।

সংজ্ঞার আনন্দ আর ধরে না। সূর্যের অসহ্য তেজের মুখোমুখি হতে হবে না ভেবেই তিনি আনন্দে অধীর হয়ে উঠলেন। এতো চটপট ছায়াকে রাজি করানো যাবে তিনি ভাবতেই পারেন নি। সংজ্ঞার মনে হয়েছিল ছায়া কৌতুহলী হবেন, নানান প্রশ্নাবলীতে তাকে জর্জরিত করবেন বা উপদেশের ছলে বলে বসবেন—এই ধরণের চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে তিনি যেন পুনর্বিবেচনা করেন ইত্যাদি, ইত্যাদি। অথবা নিজে না হলেও লোক মারফৎ প্রকৃত ঘটনা সংজ্ঞা বিশ্বকর্মাকে জানিয়েছেন কি-না, প্রভৃতি। কিন্তু ছায়া পরিপ্রশ্ন না করায় সংজ্ঞা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সংজ্ঞার অন্তরাত্মা খুশিতে ডগমগ। নিজের বৈবাহিক জীবনে চোখে চোখে যে এতো যন্ত্রণা পেতে হবে তা কে জানত। জানা থাকলে সংজ্ঞা কখনও বিবাহে সম্মতিই দিতেন না।

দীর্ঘকাল বাদে কন্যাকে পিত্রালয়ে পেয়ে বিশ্বকর্মা আহ্লাদে আটখানা। সংজ্ঞা চাপা-প্রকৃতির। পিতাকে কিছুই জানালেন না, জানাতে পারলেন না। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কুশল বিনিময় করে সানন্দে বেশ কিছুদিন পিত্রালয়ে কাটিয়ে দিলেন। দিন যায়। একদিন সাগ্রহে কন্যাকে ডেকে বিশ্বকর্মা বললেন—সংজ্ঞা যতদিন তার নিবাসে থাকবে তিনি খুশী হবেন। কন্যার দীর্ঘকাল অবস্থানও পিতার কাছে ক্ষণিকের মনে হয়। সব পিতাই কন্যার আগমনে উদ্বেলিত হয়ে থাকেন। কিন্তু বিবাহের পর স্বামী, সন্তানকে ছেড়ে পিত্রালয়ে কন্যার দীর্ঘকাল অবস্থান মোটেই সুখকর নয়। বিশ্বকর্মা কথায় কথায় জামাতার কুশল সংবাদ নিয়েছেন। আদরের মনু, যম, যমুনার নিষ্পাপ কচি মুখগুলোর কথা মনে করেছেন। কোন্‌ পিতা না চায়, মেয়ের সঙ্গে নাতি, নাতনিরাও আসবে, হৈ-হল্লা করবে। ছোট ছোট পায়ে দৌড়ে দৌড়ে এসে আবদার করবে, একের বিরুদ্ধে অপরে নালিশ জানাবে। অভিজ্ঞ বিশ্বকর্মা সংজ্ঞার মনে কোন আঘাত না দিয়ে শাস্ত্র, সাহিত্য থেকে পর্যাপ্ত উদাহরণ দিলেন। অবশেষে প্রতিবেশীদের কানাকানির প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন। বিশ্বকর্মার মতে বেশির ভাগ প্রতিবেশীদের পরচর্চা হল প্রমোদ উপকরণ। সংজ্ঞার এতোদিন পিত্রালয়ে উপস্থিতিতে তারা নিশ্চয়ই খারাপ গন্ধ পাচ্ছেন। তাদের মুখ তো বন্ধ করবার কোন রাস্তা নেই। সুতরাং কন্যার আগমনে তিনি খুশী হলেও বর্তমানে সংজ্ঞা যেন স্বামী, সন্তানের কাছে প্রত্যাবর্তন করে। সংজ্ঞার পুনরাগমনের আশা নিয়ে তিনি বসে থাকবেন।

পিতৃগেহে চিরং কালং বস্তুং নার্হসি পুত্রিকে।
সা ত্বং ভর্তৃগৃহং গচ্ছ তুষ্টোহহং পূজিতাসি মে।
পুনারাগমনং কার্যং দর্শনায় শুভে মম।। (মা.পু. ৭৭। ২০-২১)

সংজ্ঞা পিত্রালয় থেকে বাইরে এলেন। নিজের সংসারে প্রত্যাবর্তনের কথা ভাবতেই পারছে না। পুনরায় ‘কিং করোমি ক্ক গচ্ছামি’ অবস্থা। স্থির করলেন সংসার থেকে, পিত্রালয় থেকে দূরে ভিন্ন প্রদেশে তপস্যায় বসবেন। লক্ষ্য হল, পতির উগ্র তেজ নিবারণ।

এদিকে ছায়াসংজ্ঞা সূর্যের সংসার ভালোই সামলাচ্ছেন। সংজ্ঞাকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। সূর্য ডামিসংজ্ঞাকে নিয়েই ঘর করেন, মানুষটিকে বোঝারই উপায় নেই। এই ছায়াসংজ্ঞার গর্ভেও দুই পুত্র ও এক কন্যার জন্ম হল—‘জনয়ামাস তনয়ৌ কন্যাঞ্চৈকাং মনোরমাম্‌ (মা.পু. ৭৭। ২৪)। এই পর্যন্ত ভালোই চলছিল। কিন্তু অনিষ্ট এল আত্ম-পর বোধ থেকে নিজের সন্তানদের বড় হওয়ার সাথে সাথেই সংজ্ঞার গর্ভজাত মনু, যম, যমুনা উপেক্ষিত হতে লাগল।

টিফিনের সময় টিফিন নেই, একসাথে খেতে বসা নেই। সামান্য ছোটখাট জিনিসের বেলায়ও তারতম্য। শেষ অবধি ব্যাপারটা চোখে পড়ার মতন হয়। সংজ্ঞার তিন সন্তানের মধ্যে মনু সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। বাড়ির কোনও ব্যাপারেই তার মাথাব্যথা কোনকালেই নেই। কেবল নিজের অধ্যায়ন নিয়েই সে থাকে। কি খাওয়া হল, কোথায় বেড়াতে যাওয়া হবে, একই পঙ্‌ক্তিতে কেন সবাই বসে খাবার খায় না, একই বাড়িতে কেউ কেউ বেশি পাচ্ছে কেন, ভালো খাবার বন্টনে বৈষম্য কেন-এসব প্রশ্ন তার চিন্তাতেই আসে না। যমুনাও যেন সর্বংসহা পৃথিবী। কোনও প্রতিবাদ নেই। দধির ওপরটা, ঘোলের শেষটা না পেয়েও অসন্তোষ প্রকাশ তার প্রকৃতিবিরুদ্ধ। ফলে মনু এবং যমুনাকে নিয়ে ছায়াসংজ্ঞার কোনও রকম অসুবিধে হচ্ছিল না। একদল বুকের, একদল পিঠের করে ছায়াসংজ্ঞা দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

ছায়াসংজ্ঞা ত্বপত্যেষু যথা স্বেষ্বতিবৎসলা।
তথা ন সংজ্ঞাকন্যায়াং পুত্রয়োশ্চন্ববর্তত।। (মা.পু. ৭৭। ২৫)

বাদ সাধে যম। ছেলেবেলা থেকেই যম পক্ষপাত-বিরোধী। বৈষম্য তার চক্ষুশূল। বহু বই পড়া বড় ভাইকে সে একেক জনের একেক রকম বিশেষ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজের মতামত সুযোগ পেলেই জানিয়ে দেয়। যমের দীর্ঘদিনের আকাঙ্খা পিতার মত বড় হলে সে অবশ্য সকলের জন্য সমান ব্যবস্থার প্রবর্তন করবে। পিতা সূর্যের পক্ষপাতহীন আচরণটি তার সবচেয়ে ভালো লাগে। মায়ের আচরণের পরিবর্তন যম কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করে চলেছে। বাড়িতে পিতার দীর্ঘক্ষণ অনুপস্থিতির সুযোগে ভাই-বোনেদের মধ্যে স্বতন্ত্র ব্যবস্থার মাত্রা একেক সময় বড্ড বেশি প্রকট হচ্ছে। পিতার কাছে এখনও পর্যন্ত নালিশ না জানালেও বড় ভাই মনুকে নিজের অভযোগ বহুবার যম জানিয়েছে। ধীরে ধীরে কিশোর যম নিজের স্বভাবকে অনুসরণ করতে থাকে। অবহেলিত যম নিজের স্বাধীন মতপ্রকাশে ইতস্তত করে না । বরং বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিজের কর্তব্য নিয়ে অগ্রসর হবার জন্য দৃঢ় সঙ্কল্প গ্রহণ করে। শৈশব থেকেই বঞ্চনার শিকার যম প্রতিবাদী হয়ে উঠতে থাকে।

অবশেষে প্রতিবাদ একদিন চরম আকার নেয়। অভিমানী যম নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। লেখাপড়া জানা মানুষ কেন যে অন্যায়কে, বঞ্চনাকে চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেও চুপ করে থাকে, যম তার উত্তর খুঁজে পায় না। বড় ভাইয়ের ওপর একারণে তার ক্ষোভও কম নয়। মায়ের বৈষম্যমূলক আচরণের নমুনা মনুর সামনে সে অনেকবার রেখেছে। মনু শুনেছে, অথচ কোন সদর্থক ব্যবস্থা নিজে নেয়নি এবং নেবার পরামর্শও দেয়নি। ‘মনুস্তৎক্ষান্তবানস্যা যমস্তস্যা না চক্ষমে’ (মা.পু. ৭৭। ২-৬)।

ধৈর্যচ্যুত যম মাকে পদাঘাতে উদ্যত হল। ‘তাড়নায় চ বৈ কোপাৎ পাদস্তেন সমুদ্যতঃ(মা.পু. ৭৭। ২৭)। আর যায় কোথা! গর্জনে হুঙ্কারে ছায়াসংজ্ঞা সারা বাড়ি কাঁপিয়ে তুললেন। উত্তেজিত ছায়াসংজ্ঞা আঙুল তুলে তারস্বরে যমকে ধমক দিতে লাগলেন। ক্রোধে আরক্ত নয়না ছায়াসংজ্ঞা বললেন, পিতার পত্নীকে অমর্যাদা! যে পদ আমার ওপর ব্যবহার করতে তৎপর হয়েছিলে আজই তোমার সেই পদটি পৃথিবীতে পতিত হোক। পাণিপল্লবের আন্দোলন, শাপপ্রদান, তিরস্কার সবই অলাতচক্রন্যায়ে এতো দ্রুত ঘটে যাবে যম কল্পনাও করতে পারে নি। ভয়াতুর যমের ‘সীদন্তি গাত্রাণি, মুখঞ্চ পরিশুষ্যতি’।

ত্রস্ত যম পিতা সূর্যের পাশে গিয়ে করজোড়ে দাঁড়িয়ে রইল। সমস্ত ঘটনার অনুপুঙ্ক্ষ বিবরণ দেবার জন্য যম যেন দীর্ঘকাল প্রস্তুতি নিয়েছিল। পিতার সামনে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে যম আজ হাল্কা হতে চায়। যমের বক্তব্যের সার কথা হল, বড় ভায়ের কাছে, মায়েদের সম্বন্ধে সে অনেক মহৎ কথা শুনেছে। যেমন কুপুত্র যদি বা হয়, কুমাতা কখনও নয়, ইত্যাদি। কিন্তু মনু-কথিত বাণীর সঙ্গে তার মায়ের সে কোন মিল খুঁজে পায় না—

যথা মনুর্মামাচষ্টে নেয়ং মাতা তথা মম।
বিগুনেষ্বপি পুত্রেষু ন মাথা বিগুণা ভবেৎ।। (মা.পু. ৭৭। ৩২)

যম বলে চলে—কোন মা তার স্বভাবসুন্দর বাৎসল্যকে বিসর্জন দিয়ে পুত্রকে শাপ দেন—এমন আশ্চর্য কথা কখনও শোনা যায়নি। পুত্র, কন্যার হাজারো অপরাধ মা মার্জনা করে দেন। তিনি কখনও সন্তানের প্রতি বিরূপা হন না। সত্য উন্মোচনে বদ্ধপরিকর যম কেবল যথাযথ বিবিরণটুকুই দেয়নি, সে পিতার সহানুভূতি আদায়ে নিজের বক্তব্যটিও সুন্দরভাবে গুছিয়ে উপস্থাপন করেছে।

তাতৈতন্মহদাশ্চর্যং ন দৃষ্টমতি কেনচিৎ।
মাতা বাৎসল্যমুৎসৃজ্য শাপং পুত্রে প্রযচ্ছতি। (মা.পু. ৭৭। ৩১)

সূর্য রুচিহীন একটি শব্দও প্রয়োগ করলেন না। ছায়াসংজ্ঞার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে কেবল জানতে চাইলেন—সংজ্ঞা কোথায় ‘ক্কগতেতি সা’। সংজ্ঞাকে দেওয়া পূর্ব প্রতিশ্রুতি স্মরণ করে ছায়াসংজ্ঞা আত্মগোপন করেই রইবেন স্থির করলেন। বারংবার জিজ্ঞাসিত হয়েও তিনি বললেন, সূর্যের আজ কি মতিভ্রম হল। নিজের পত্নীকে তিনি চিনতে পারছেন না। সেই চোখ, সেই মুখ, সেই হাসি। একি বিপদ! সূর্যকে ছায়াসংজ্ঞা বোঝাতে চাইলেন, তিনিই বিশ্বকর্মার কন্যা। সূর্যের সন্তান তিনিই গর্ভে ধারণ করেছেন। 

সা চাহ তনয়া ত্বষ্টুরহং সংজ্ঞা বিভাবসো।
পত্নী তব ত্বয়াপত্যানেতানি জনিতানি মে।। (মা.পু. ৭৭। ৩৪)

কিন্তু না, ছায়াসংজ্ঞা শেষরক্ষা করতে পারলেন না। ক্রোধী সূর্য সত্যসন্ধানী হতে চাইলেন। যেভাবে সুর সপ্তমে চড়িয়ে যমকে অভিশাপ দিতে চেয়েছেন ছায়াসংজ্ঞা, সেটি সূর্যের মোটেই ভাল লাগেনি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা যে কিছু একটা গোপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সূর্য সেটি উপলব্ধি করলেন এবং তৎক্ষণাৎ কালবিলম্ব না করে শাপদানে উদ্যত হলেন। সূর্যের সংসার আগলে রাখার প্রতিশ্রুতি ততকালই ছিল যতকাল ছায়াসংজ্ঞার ওপর শাপ বর্ষিত না হয় ‘কথ্যয়িষ্যামি বৃত্তন্তু শাপকর্ষণাৎ’। সত্য অনাবৃত হল। সূর্য ছায়াসংজ্ঞার মুখে প্রকৃত ঘটনা জেনে স্তম্ভিত। তার অমিততেজের জন্য নিজের ওপর ধিক্কার এল। যমকে সূর্য জড়িয়ে ধরলেন।

সূর্য শ্বশুরালয়ে সংজ্ঞাকে ফিরিয়ে আনবার জন্য ছুটলেন। সংজ্ঞা তার অসহনীয় তেজে কতই না কষ্ট পেয়েছেন। সংজ্ঞার কষ্টের প্রকৃত কারণ আগে থেকে জানা থাকলে স্বামী হিসেবে সূর্য নিশ্চয়ই কোন ব্যবস্থা নিতেন। কোনও অভিমানিনী তার আদরের সন্তানদেরও ছেড়ে যখন পিত্রালয়ে চলে যান তখন কষ্টের পরিমাণ যে মাত্রাতীত—তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সূর্য ব্যথিত। স্ত্রীর এই কষ্টভোগের জন্য সম্পূর্ণ তিনি নিজেই দায়ী। দেখামাত্রই সূর্য সংজ্ঞার কাছে এজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, স্থির করলেন। শ্বশুরের ওপরেও সূর্যের কিঞ্চিৎ অভিমান হল। স্বয়ং বিশ্বকর্মা তো নিজের কন্যার সুবিধার্থে জামাতার তেজ কিছুটা কমিয়ে দিতে পারতেন। তবেই তো বিশ্বকর্মা নামটিও সার্থক হত এবং সূর্যের দাম্পত্যজীবনের এই মর্মান্তিক পরিণতি হত না। এইভাবে একরাশ ভাবনা নিয়ে সূর্য হাজির হলেন শ্বশুরালয়ে।

শিষ্টাচারসম্মত প্রণামাদির কাজ সেরে সূর্য জানতে চাইলেন, সংজ্ঞা কোথায়? সংজ্ঞা কি সত্যই এতদিন এখানেই আছে? বিশ্বকর্মা বুঝলেন, কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। তিনি সূর্যকে জানালেন যে, সংজ্ঞা তার কাছে এসেছিল বটে। কিন্তু কিছুকাল থাকবার পর তিনিই তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে সংজ্ঞা কোথায় তিনি সেই সংবাদ জানেন না। পিতা বিশ্বকর্মা কন্যার ব্যাপারে বিচলিত হলেন। সূর্যের অবস্থাও তথৈবচ।

সংজ্ঞার গৃহত্যাগের কঠোর সিদ্ধান্তে সূর্য আঘাত পেয়েছেন। ধ্যাননেত্রে সূর্য দেখলেন সংজ্ঞা সূর্যেরই তেজ মন্দিকরণের জন্য তপস্যায় রত আছেন। সংজ্ঞার ভালোবাসার গভীরতা আন্দাজ করে সূর্য মর্মাহত। কাছে আসার বেদনায়, অপলক নেত্রে না তাকাতে পারার বেদনায় একজন সংসার ত্যাগ করে কষ্ট স্বীকার করছেন, সূর্যের ভাবতেও খারাপ লাগল। খারাপ লাগবে নাই বা কেন ? সূর্য-সংজ্ঞার তো সাংসারিক কোন বিষয়কে নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, মনোমালিন্য ছিল না। সন্তানদের নিয়েও আক্ষেপ কোনকালে ছিল না। একারণে সমস্ত দায় নিজের কাঁধে নিয়ে সূর্য নিজেকেই দোষী সাব্যস্ত করলেন। তপোভূমিতে সূর্য-সংজ্ঞার মিলন হল। বিশ্বকর্মা জামাতা সূর্যের অনুরোধে তার তেজ নিয়ন্ত্রিত করলেন। দিনান্তে সূর্যের তেজ হল মন্দীভূত। সংবৎসরেও একই রকম তেজ আর রইল না।

সূর্য-সংজ্ঞার প্রত্যাগমনে সমগ্র বাড়িতে আনন্দের পরিমণ্ডল লক্ষ্য করা গেল। মনু, যম ও যমুনা তিনজনেই আনন্দে অধীর হলেও পিতামাতার মিলনের মূল কৃতিত্ব ছিল যমের। যম যথাকালে প্রতিবাদ করাতেই সত্য প্রকাশ পেল। যম যদি প্রতিবাদ না করত, বঞ্চনার বিরুদ্ধে একা রুখে না দাঁড়াত, তবে তো প্রকৃত ঘটনা কোনদিন কেউ জানতে পারত না। এমনকি তার পিতৃদেবও না। যমও তো পারত কেবল দাদা মনুর মতন গ্রন্থকীট হয়ে থাকতে। কিন্তু যমের তা স্বভাববিরুদ্ধ ‘প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি’। যম জানত, যার হয় না নয়তে, তার হয় না নব্বইতে। প্রতিবাদী যমকে পিতা-মাতা দুজনেই স্নিগ্ধ চুম্বনে ভরিয়ে দিলেন। এহো বাহ্য। পিতা সূর্যের আশীর্বাদে সমদর্শী যম যমত্বে উন্নীত হলেন—‘ততো নিয়োগং তং যাম্যে চকার তিমিরাপহঃ’।

পিতা সূর্যের আশীর্বাদধন্য যম পদাভিষিক্ত হয়েই তার নিজের বহুদিনের লালিত স্বপ্নপূরণে যত্নবান হলেন। কোনও বৈষম্য নয়। শপথ নিলেন সকলের কাছে পৌঁছতে হবে। কোটিপতি, বস্তিবাসী একাকার। যমের ভুবনে জমিদার-জমাদার পার্থক্য নেই। দৃঢ়চিত্ত যম জানতেন, বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গৃহীত হলে সব প্রচারের আলো তার ওপর আসবেই আসবে। হয়েছেও তাই। যমের প্রতিষ্ঠা অবিসংবাদিত। ‘সমো মিত্রে তথাহিতে’।

একদিন এই প্রতিষ্ঠিত যমের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন মর্ত্যের অপর এক প্রতিবাদী নচিকেতা। বয়সে কিশোর। সাক্ষাৎ জ্যোতির্বলয় যেন যমসদনে হাজির। জ্বলন্ত দুটি চোখ। সেই চোখ দুটিতে অনন্ত কৌতূহল। এবং জিজ্ঞাসা। এদিকে যম তখন বাড়িতে নেই। বিনা বিজ্ঞপ্তিতে ব্যস্ততম একজনের সঙ্গে কি দেখা মেলে ! সমগ্র জগতের নিয়ন্ত্রণে যিনি, তাকে আগাম না জানিয়ে আসা চরম বোকামি। যমালয়ে নিযুক্ত রক্ষীকুল শশব্যস্ত হয়ে মনিবের অনুপস্থিতির কথা নচিকেতাকে জানাল এবং যথোচিত মর্যাদায় আতিথেয়তা গ্রহণের প্রস্তাব দিল। নচিকেতা আতিথেয়তা গ্রহণে সম্মত হল না। এতো কষ্ট স্বীকার করে যার কাছে পৌঁছেছেন তারই সঙ্গে দেখা না করে কিভাবে আতিথেয়তা গ্রহণ করা যায়। যত কষ্টই জোক যম-দর্শনের আগে কোনমতেই বিশ্রাম নয়।



।। শব্দসঙ্কেত ।।

ক. উ. কঠোপনিষদ 
মা.পু. মার্কণ্ডেয়পুরাণ
শা.ভা. শাঙ্করভাষ্য


* অধ্যাপক, তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। 







2 comments:

0

প্রবন্ধ - অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

Posted in


প্রবন্ধ



বিধিকূটের বন্ধনে যৌনতা 
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী 


এই প্রবন্ধের কেন্দ্রীয় বিষয়টিকে সম্প্রসারণ করতে গিয়ে যে দুটি শব্দবন্ধ ফিরে ফিরে আসবে সেই শব্দবন্ধ দুটি এই প্রবন্ধে যে অর্থে ব্যবহার হবে সেই অর্থে আর কেউ কখনও ব্যবহার করেছেন কিনা তা বর্তমান নিবন্ধকারের জানা নেই। তাই শুরুতেই শব্দবন্ধ দুটির আরোপিত অর্থটি পাঠকদের কাছে প্রাঞ্জল হওয়া দরকার। যৌনতা ও যৌন-মনস্তত্ত্ব নিয়ে ফ্রয়েড, ইউল, কেইন্‌স, পাভলভ, ইত্যাদি মনীষীরাই শেষ কথা বলেছেন। সে-বিষয়ে বিন্দুমাত্র আলোচনা করার যোগ্যতা এই নিবন্ধকারের নেই। সম্পূর্ণ এক মৌলিক ধারণা নিয়ে এই প্রবন্ধ লেখার প্রয়াসটি কেবলই এক মূর্খের দুঃসাহস, যেমনটি সেই কবেই বলে গেছেন আলেকজান্ডার পোপ, ‘fools rush in where angels fear to tread.’ সুতরাং এই দুঃসাহসিক প্রবন্ধে মূর্খতার যথাযথ পরিমাপ করতে এই শব্দবন্ধ দুটির তাৎপর্য পাঠকদের জানা প্রয়োজন। ভনিতা ছেড়ে এবার উল্লেখ করা যাক যে যৌনতাকে আমি দুটি শ্রেণিতে ভাগ করেছি। যে যৌনতার মূলে বংশবৃদ্ধির তাড়না তাকে বলব প্রাকৃতিক যৌনতা আর যে যৌনতার মূলে অন্যতর তাড়না তাকে বলব অপ্রাকৃতিক যৌনতা। এই ‘অপ্রাকৃতিক যৌনতা’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য আছে যা পাঠকদের কাছে পরিষ্কার হবে এই প্রবন্ধের শেষ অংশে। 

সরলকোষী প্রাণী ব্যতিরেকে তাবৎ প্রাণীকুলে অপরিহার্য এক সত্য হলো যৌনতা। বেঁচে থাকাই যেহেতু জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য, খাদ্যগ্রহণ এবং বংশবৃদ্ধি ছাড়া গত্যন্তর নেই। প্রত্যক্ষভাবে বেঁচে থাকার জন্যে খাদ্যগ্রহণ এবং পরোক্ষভাবে বেঁচে থাকার জন্যে বংশবৃদ্ধি করা। আর যৌনতাই সেই অপরিশুদ্ধ আদিম আবেগ যা তাদের প্ররোচিত করে বংশবৃদ্ধি-প্রক্রিয়ায়। এমনই প্রতিস্পর্ধী এই আবেগ যে তার পরিপৃক্তে প্রত্যক্ষ জীবন-ত্যাগের ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করে না সে। বন্যপ্রাণীদের মিলন-ঋতুতে যৌনসঙ্গী বা সঙ্গিনীলাভের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঠিক কত সংখ্যক প্রাণী আহত বা নিহত হয় তার কোন পরিসংখ্যান আমি খুঁজে পাইনি। তবে সেটা যে উল্লেখ করার মতন একটা সংখ্যা হবে সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা দ্বিমত পোষণ করবেন না, তা বলাই বাহুল্য। মনুষ্যসমাজেও, প্রাচীন ও মধ্যযুগে তো বটেই, আধুনিক কালেও প্রেম-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মৃত্যুবরণের সংখ্যা নগণ্য নয়; আর মানুষ বলেই তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ঘটে আত্মহনন। তবে এই প্রতিদ্বন্দিতার মূলে যে আবেগ, তার চরিত্র কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে ভিন্ন রকম। পরোক্ষ জীবনে বয়ে চলার আদিম প্রবনতা থেকে উৎসারিত হলেও মানুষের যৌন-আবেগ বিবর্তনের ধারায় অন্য এক চরিত্র ধারণ করেছে যা মনুষ্যেতর প্রাণীর যৌনতার থেকে সুস্পষ্টভাবে পৃথক। অসামান্য স্মৃতিধর এই প্রাণীটি কালক্রমে বংশবৃদ্ধির তাড়নাকে সুখস্মৃতির আবেগে রূপান্তরিত করেছে। ফলে ঋতুবন্ধ রমণীও যৌন-আবেগে আলোড়িত হতে পারে। শুধুমাত্র যৌনচরিত্রই নয়, মানুষের যৌনরুচিরও একটি বিশিষ্ট বদল ঘটেছে বিবর্তনের ধারায়। মানুষের সমকামিতা এই বিবর্তিত অপ্রাকৃতিক যৌনতারই ফসল। এই প্রসঙ্গে বিশদে যাওয়ার আগে আমার এই বক্তব্যটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে দেখা দরকার সমকামিতা কেবলমাত্র মানবসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ কিনা। 

এটা ঠিকই যে বহু প্রাণীবিদ মনুষ্যেতর প্রাণীর মধ্যেও সমকামিতার আচরণ লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু পর্যবেক্ষণ আর প্রকৃত সত্যের মাঝখানে একটা ফাঁক থেকে যায় –- ‘Seeing is not believing’। সমকামিতার আচরণ মানেই প্রকৃত সমকামিতা নয়। মানুষের সমাজেও দেখা যায় বয়ঃসন্ধিকালে যৌনতার উন্মেষে অনেক কিশোরকিশোরী বিপরীতলিঙ্গের সংস্পর্শে আসার সুযোগের অভাবে সমলিঙ্গের সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে সমকামিতার আচরণে জড়িয়ে পড়ে। এই আচরণ নেহাতই সাময়িক। পরিণত যৌবনে তারা সাধারণভাবে বিষমলিঙ্গের যৌনতাতেই স্থিত হয়। বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গীর অভাব ছাড়াও মনুষ্যেতর প্রাণীদের সমকামিতার আচরণের পিছনে আর একটি কারণও বিদ্যমান। যেমনভাবে শিকারি তাঁর বাচ্চাদের শিকার ধরার শিক্ষা দেয় বা বাচ্চারা যেমন নিজেদের মধ্যে নকলযুদ্ধ (mock fight) করে যা আসলে ভবিষ্যতের প্রকৃত যুদ্ধের মহড়া, তেমনিভাবেই তারা লিঙ্গ-নির্বিশেষে সঙ্গীদের সঙ্গে যৌনসংগমের রিহার্সালে রত হয় প্রকৃত যৌনসংগমের কৌশল আয়ত্ব করতে। দুটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষপ্রাণীকেও কখনও কখনও যৌনসংগমের ভঙ্গিতে লক্ষ্য করা যায়। প্রাণীবিদদের মতে তা সমকামিতা নয়, একে অন্যের উপর আধিপত্য (dominance) প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস। বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে যারা মনুষ্যেতর প্রাণীদের সমকামিতার কথা বলেন, তাঁরা কেউই প্রাণীদের পায়ুসঙ্গম (anal penetration) প্রত্যক্ষ করেননি কখনও। 

সুতরাং এ পর্যন্ত আমার এই বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা দেওয়া গেল যে প্রকৃতির শৃঙ্খলায় আবদ্ধ মনুষ্যেতর প্রাণীদের যৌনতা বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক হলেও বিবর্তনের ধারায় বিশেষ এক চেতনাপ্রাপ্ত মানুষের যৌনরুচি ও যৌনচরিত্র সম্পূর্ণতই অপ্রাকৃতিক। কেবল যৌনতার ক্ষেত্রেই নয়, সামগ্রিকভাবেই মানুষের শারীরিক প্রক্রিয়া প্রকৃতির ধরাবাঁধা রাসায়নিক বিক্রিয়ার ঊর্ধে বিরাজ করে। একটি বিশেষ চেতনা --যাকে আমরা ‘মন’ বা ‘চৈতন্য’ বলেও অভিহিত করতে পারি, মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রক। তবে মানব নামক প্রজাতিটি এই চেতনা নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়নি। বীজটি অবশ্যই ছিল। বিবর্তনের ধারায় ক্রমশ তা বিকশিত হতে হতে আজকের যে চৈতন্যময় মানুষকে আমরা দেখি তাঁকে মাপার মতন কোনও মানদণ্ড তাঁর নিজের হাতেই নেই। মুশকিল হলো, চৈতন্যের এই অস্তিত্ব মানবসমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বীকৃত হলেও দীর্ঘদিন যাবৎ যৌনতার ক্ষেত্রে অস্বীকৃত ছিল। আজও যে সঠিক স্বীকৃতি পেয়েছে তা নয়, তবে একটা চেষ্টা চলছে সংখ্যালঘুর যৌনতা তথা লিঙ্গ-পরিচয়কে স্বীকৃতি দেওয়ার। এই প্রসঙ্গে আমি প্রবন্ধের শেষের দিকে ফিরব। তার আগে যে দুটি বিষয় সম্প্রসারণ করা দরকার সে দুটি হলো, মানুষের অপ্রাকৃতিক যৌনতা, বিশেষ করে সমকামিতা তথা লিঙ্গপরিচয় এবং সংখ্যালঘু যৌনচরিত্রের মানুষের প্রতি প্রাচীন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। এর মধ্যে আর একটি বিষয় আমার অযোগ্যতা হেতু আমি এড়িয়ে যাচ্ছি। সেটি হলো ঠিক কোন যুগ থেকে মানুষের অপ্রাকৃতিক যৌনতা পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হলো। বিষয়টি নৃতাত্ত্বিকেরা আদৌ ভাবার যোগ্য বলে বিবেচনা করেন কিনা তাও আমার জানা নেই। আমার সরল প্রতিপাদ্য এই যে যেদিন থেকে মানুষ তার বিশেষ অঙ্গকে গোপনাঙ্গে পরিণত করল সেদিন থেকেই তাদের অপ্রাকৃতিক যৌনতা পরিস্ফুট হলো। সেটা প্রস্তরযুগে হলেও হতে পারে। কেননা সে যুগেই মানবসভ্যতার উন্মেষ এবং এই উর্বরমস্তিস্ক নিবন্ধকারের কেন জানি মনে হয় গোপন-করতে-শেখা-ই মানবসভ্যতার প্রথম ধাপ। 

প্রাকৃতিক যৌনতাসম্পন্ন প্রাণীদের মধ্যে তো বটেই, অপ্রাকৃতিক যৌনচরিত্রের মানুষের মধ্যেও সাধারণভাবে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন-আকর্ষণ ধাবিত হয়। শতকরা নব্বই ভাগের বেশি মানুষ বিষমকামী (Heterosexual) হলেও বাকি প্রায় দশ ভাগ মানুষের আকর্ষণ দেখা যায় সমলিঙ্গের প্রতি। এই সমকামী মানুষের মধ্যে দুজনেই স্ত্রীযৌনাঙ্গযুক্ত হলে তারা লেসবিয়ান (Lesbian) এবং উভয়েই পুংযৌনাঙ্গযুক্ত হলে তারা গে (Gay) বলে অভিহিত হয়। এর মূলেও সেই চেতনা। অর্থাৎ এই শ্রেণির মানুষের দেহ ও মন একসুরে বাজে না। কারুর পুরুষশরীরে নারীর যৌনচেতনা বা কারুর নারীশরীরে পুরুষের যৌনচেতনা। এরা নিজের শরীরকে অগ্রাহ্য করে বিপরীত লিঙ্গের যৌনতায় স্বচ্ছন্দ বোধ করে। এরা তাই রূপান্তরকামী (Transgender) বলেও পরিচিত। অর্থাৎ মানুষের লিঙ্গ-পরিচয় সব ক্ষেত্রে তাঁর যৌনাঙ্গের উপর নির্ভর করে না। কোনও কোনও পুরুষ আবার একই সঙ্গে নারীর প্রতি এবং পুংযৌনাঙ্গযুক্ত নারীচেতন মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তেমনই কোনও কোনও নারী একই সঙ্গে পুরুষের প্রতি এবং স্ত্রীযৌনাঙ্গযুক্ত পুরুষচেতন মানুষের প্রতি আকর্ষিত হয়। এদেরকে বলা হয় উভকামী (Bi-sexual)। এছাড়াও আছে লৈঙ্গিক ত্রুটিসম্পন্ন আর এক ধরনের মানুষ। নিষিক্তকালে ক্রোমোজোম-সজ্জার অস্বাভাবিক বিন্যাস ঘটলে, মুলারিয়ান বা উলফিয়ান ডাক্টে রাসায়নিক নিঃসরণের গণ্ডগোল হলে অথবা জিনের ত্রুটির কারণেও এই ধরনের শিশুর জন্ম হতে পারে। এরা অপরিণত শুক্রাশয় বা ডিম্বাশয় এবং অপুষ্ট জননাঙ্গ নিয়ে জন্মায়। কারুর ক্ষেত্রে আবার অপরিণত শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয় দুটিই থাকে। এদের ছদ্ম-উভলিঙ্গ বলা যেতে পারে।(এই প্রসঙ্গে আমি বিশদে যাচ্ছি না। যাদের কৌতূহল আছে তাঁরা স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘হলদে গোলাপ’ উপন্যাসটি পড়ে নিতে পারেন। সাধারণ পাঠকের বোধগম্য করে প্রাঞ্জল ভাষায় মানুষের ত্রুটিপূর্ণ জননতন্ত্রের সর্ববিধ বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ দিয়েছেন তিনি)। এইসব লৈঙ্গিক ত্রুটিপূর্ণ মানুষের লিঙ্গ-পরিচয় অনির্দিষ্ট হলেও তাদের মানসিকতা ও যৌনতাবোধ আর পাঁচজন স্বাভাবিক মানুষের থেকে আলাদা কিছু নয়। তাদের কেউবা পুরুষের প্রতি, কেউবা নারীর প্রতি যৌন-আকর্ষণ বোধ করে। এদের মধ্যে যাদের ডিম্বাশয় থাকে কিন্তু পরিপূর্ণ স্ত্রীযৌনাঙ্গ থাকে না, আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে এস আর এস-এর (Sex Re-assignment Surgery) মাধ্যমে তাদের যোনি গঠন (Vaginoplasti) ও স্তন নির্মাণ (Breast augmentation) করা তুলনামূলকভাবে সহজ হলেও শুক্রাশয়-বিশিষ্ট মানুষের পেনিস গঠন খুবই দুরূহ এবং হলেও তা কখনও স্বাভাবিক পেনিসের মতন কার্যকরী হয় না। 

এই সমস্ত ভিন্ন যৌনতার মানুষজনের সকলকেই এক সময় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করার চল ছিল, যদিও জীববিজ্ঞানী ও লিঙ্গতাত্ত্বিকরা শরীর ও চেতনার ভিন্নতা অনুসারে মানুষের লিঙ্গপরিচয়কে কখনও চার বা কখনও পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। তবে যেহেতু বিষমকামী যৌনতার বাইরের মানুষেরা তাদের লিঙ্গ-পরিচয়ের স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলনের স্বার্থে এলজিবিটি (lesbian-gay-bisexual-transgender) নামে একত্রিত হয়েছেন, আমি এই চার ধরনের লিঙ্গ-পরিচয়ের মধ্যেই বর্তমান প্রবন্ধটিকে সীমাবদ্ধ রাখলাম। (কৌতুকের ব্যাপার এই যে এলজিবিটি’র প্রতিপক্ষ হিসেবে বিষমকামী মানুষদের জন্যে একটি নামও উদ্ভাবিত হয়েছে-- Hetero+norm+ative= Heteronormative; অতি সাম্প্রতিক সংস্করণের অভিধান ছাড়া অন্য কোনও অভিধানে এই শব্দটি আপনি খুঁজে পাবেন না)। এবার দেখা যাক প্রাচীন সভ্যতায় সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখে এইসব ভিন্ন যৌনতার মানুষজনের স্থান কী ছিল। 

ভিন্ন যৌনতার স্বীকৃতির প্রমাণ ছড়িয়ে আছে বিশ্বের সব কটি প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসে। আমাদের দেশে ঋকবেদের সংকলনের কাল ধরা হয় ১২০০ খ্রি পূর্বাব্দ, মহাভারতের রচনাকাল ১০০০ থেকে ৩০০ খ্রি পূর্বাব্দ। যদিও পাশ্চাত্যের পণ্ডিতেরা মহাভারত-রামায়ণের কাহিনীর কোনও ঐতিহাসিক সত্যতা স্বীকার করেন না, প্রাচ্য পণ্ডিতেরা মহাভারতের সময়কাল নিয়ে গত এক শতাব্দী ধরে তর্কযুদ্ধে ব্যস্ত আছেন। সম্প্রতি পি ভি ভারতক তাঁর ‘স্বয়ম্ভূ’ গ্রন্থে জ্যোতির্বিদ্যা ও পুরাতত্ত্বের গণনায় প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছেন যে মহাভারতের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৬ অক্টোবর, ৫৫৬১ খ্রি পূর্বাব্দে। তাঁর গণনা সত্য বলে ধরে নিলে মানতেই হয় যে মহাভারতীয় সভ্যতাই পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা। সেই মহাভারতের কাহিনীতে ভিন্ন যৌনতার প্রচুর উদাহরণ আছে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে যে আমরা ‘বৃহন্নলা’ বলে থাকি, সকলেই জানেন যে সেই নামটি মহাভারত থেকেই আহরিত। এছাড়া গ্রিক পুরাণের ‘হার্মাফ্রোদিতাস’ (দেবতা হার্মেস ও দেবী আফ্রোদিতির মিশ্রণ)-এর কাহিনী থেকে ‘হার্মাফ্রোডাইট’ (Hermafrodite) বলে যে শব্দটির উৎপত্তি সেই উভলিঙ্গ মানুষের উদাহরণও পাওয়া যায় মহাভারতে(দুই লিঙ্গই সক্রিয় এমন প্রাণীও বিরল নয় জীবজগতে। এরা সঙ্গীর সঙ্গে মিলনে একই সঙ্গে সঙ্গীর ডিম্বাণু নিজের শুক্রাণু দিয়ে এবং নিজের ডিম্বাণু সঙ্গীর শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত করে। সময়বিশেষে সঙ্গীর অভাবে নিজের ডিম্বাণু নিজের শুক্রেই নিষিক্ত করে), যদিও বাস্তবে উন্নত প্রাণীদের মধ্যে পরিণত উভলিঙ্গ দেখা যায় না। রাজকুমারী অম্বার চেতনা দিয়ে শিখণ্ডীকে গড়েছিলেন বেদব্যাস। তাঁকে সম্ভবত ভীষ্ম ছাড়া আর কেউই অবজ্ঞা করেননি। অর্জুনেরও বৃহন্নলার পরিচয়ে বিরাট-রাজকন্যার নর্তক-শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হতে আটকায়নি। রামায়ণে রাম তো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের এই বলে আশীর্বাদ করেছিলেন যে তারাও একদিন পৃথিবী শাসন করার অধিকার পাবে। মেসোপটোমিয়া, মিশরীয়, সুমেরীয় ও গ্রীক-রোমান সভ্যতায় সমাজে পুং ও স্ত্রী লিঙ্গ-পরিচয়ের বাইরে বিভিন্ন লিঙ্গ-পরিচয়ের স্বীকৃতি আছে। অধিকাংশ সমাজে এরা হেয় বলে গণ্য হলেও কোনও কোনও সমাজে এরা খানিকটা মর্যাদাও পেয়েছে। ব্যাবিলন, সুমের ও অ্যাসিরিয়ায় এদেরকে ‘এরোডিউল’ (Hierodules) বা ‘পবিত্র গণিকা’ বলা হতো, যাদের কাজ ছিল দেবতার সেবা, নাচ-গান ও নাটকে অভিনয় করা। ভারতীয় পুরাণে তৃতীয় লিঙ্গের ‘কিন্নর’গণ ছিলেন সম্মানিত গায়ক ও নর্তক। 

উপরের আলোচনা থেকে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে সভ্যতার ঊষাকাল থেকেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের লিঙ্গ-পরিচয় স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের যৌনতাকে কোনওদিনই স্বীকৃতি দেয়নি। বিষমকামী সংখ্যাগুরু সমাজ যদিও বহুকাল থেকেই জৈবতাড়নার প্রাকৃতিক যৌনতাকে পরিহার করে কেবলমাত্র সুখসর্বস্ব অপ্রাকৃতিক যৌনতায় বিবর্তিত হয়ে সমকামী যৌনচরিত্রের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে গেছে, তবুও সমকামী যৌনতাকে এই সেদিন পর্যন্ত বিশ্বের কোনও সমাজ বা রাষ্ট্রই স্বীকৃতি দিতে চায়নি। যুক্তিবাদীরা নিশ্চয়ই মানবেন যে এই অস্বীকার মানবসমাজের এক চূড়ান্ত ভণ্ডামি। ভান করা হচ্ছে যেন একমাত্র সন্তান উৎপাদনের উদ্দেশ্য নিয়ে এই বিশ্বের প্রতিটি পুরুষ ও নারী পরস্পরের সঙ্গে যৌনক্রীড়ায় সামিল হচ্ছে। কাজেই তাদের যৌনতা প্রাকৃতিক ও পবিত্র। কিন্তু সমকামী যৌনকাণ্ডে সন্তান-উৎপাদন অসম্ভব বিধায়ে তা অপ্রাকৃতিক ও অপবিত্র। 

এখানে সমলিঙ্গ ও বিষমলিঙ্গ যৌনমিলনের চরিত্র-সাদৃশ্য অনুধাবন করতে একটু বিস্তারের প্রয়োজন আছে। একটি সার্থক যৌনমিলনে দুটি ক্ষেত্রেই লিঙ্গপ্রবেশের ভূমিকা নেহাতই গৌণ। চতুরঙ্গে বিস্তৃত এই মিলনে শৃঙ্গারের বিশদ ভূমিকায় আমি ঢুকছি না, তাতে অশ্লীলতা-দোষ ঘটতে পারে। অতদূরে যাওয়ার প্রয়োজনও নেই। রসিকজনেরা জানেন, যুগল যদি পরস্পরে আকুল হয়, পূর্বরাগের দৃষ্টিপাতে বা স্বরক্ষেপণেই রাগমোচন (বিস্তৃত অর্থে উভয়েরই) হতে পারে। আবার তান্ত্রিক মতে ভৈরব-ভৈরবী ‘স্খলনহীন নিরন্তর শারীরিক মিলনের ফলে জ্ঞানের আলোকে উদ্দীপ্ত হয়ে নিজ অভ্যন্তরে অনুভব করেন পরমের দৃপ্ত উপস্থিতি’। তাহলে দেখা যাচ্ছে ‘যোনিগর্ভে বীর্যপাত’ ব্যাপারটিই যৌনতাকাণ্ডে একমাত্র প্রাকৃতিক এবং সেটি সমলিঙ্গের যৌনক্রিয়ায় যেমন ঘটে না, তেমনই বিষমলিঙ্গের মিলনেও প্রায়শই উপেক্ষিত থাকে। অর্থাৎ মানুষের সব ধরনের যৌনতাই চৈতন্যের লীলা। অথচ চেতনাসঞ্জাত অন্যান্য যাবতীয় মানবিক সত্তাকে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দিলেও যৌনতার ক্ষেত্রে স্বীকৃতি দিতে সেই প্রাচীন কাল থেকেই সমাজ ও রাষ্ট্রের তীব্র অনীহা। মধ্যযুগ পর্যন্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর ধর্মের প্রভাব ছিল প্রচণ্ড। স্বাভাবিকভাবেই যৌনতার ক্ষেত্রে ধর্মের অনুশাসন রাষ্ট্র ও সমাজ বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে কোনও দ্বিধা করত না। এবার দেখা যেতে পারে, যৌনতার প্রশ্নে বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলির অবস্থান কী ছিল। 

বাইবেলে বলা হয়েছে, “ God created man in his own image...... male and female he created them....... and God said ‘Be fruitful and multiply’” (Genesis1:25-28)। 

এর সঙ্গে আশ্চর্য মিল বৃহদারণ্যকোপনিষৎ- এ বর্ণিত প্রজাপতি ব্রহ্মার সৃজন-প্রক্রিয়ার। এই উপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায় – চতুর্থ ব্রাহ্মণ শুরু হয়েছে এইভাবেঃ “এই ভূতবর্গের সার পৃথিবী; পৃথিবীর সার জল; জলের সার ওষধি; ওষধির সার ফুল; ফুলের সার ফল; ফলের সার পুরুষ; পুরুষের সার শুক্র (পুরুষঃ পুরুষস্য রেতঃ)”। এই শুক্রের আধার হিসাবে প্রজাপতি প্রথমে স্ত্রীকে সৃজন করলেন। তারপর সর্বগুণান্বিত পুত্র ও জ্ঞানী কন্যা উৎপাদনের জন্যে বিবিধ আচার সহযোগে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হলেন। ইসলামেও বলা হয়েছে যে সন্তান উৎপাদনের নিমিত্ত সর্বশক্তিমান আল্লা পুরুষ ও নারীর মধ্যে যৌন-আকাঙ্ক্ষার আবেগ সৃষ্টি করলেন। 

তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রাথমিকভাবে সব ধর্মেই বংশরক্ষার তাগিদসঞ্জাত অর্থাৎ প্রাকৃতিক যৌনতাকেই মান্যতা দেওয়া হয়েছে; একই সঙ্গে বিবাহের মাধ্যমে সন্তান-উৎপাদনের লক্ষ্যে সেই যৌনতাকে পরিচালিত করার বিধান। বিবাহ-বহির্ভূত যৌনতা সব ধর্মেই নিন্দনীয়। তবে ইসলামে এর শাস্তি ভয়ংকর। কোরানের ২৩ (৫-৬) সুরায় বলা আছে, বিশ্বাসী তাঁরাই “who protect their sexual organs except from their spouses”। বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তিদের জন্ম-নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি গ্রহণ করা বা গর্ভপাত করার ব্যাপারেও তীব্র আপত্তি রয়েছে ক্যাথলিক ধর্মে। কারণ, জন্ম-নিয়ন্ত্রণ করার অর্থ সুখসর্বস্ব অপ্রাকৃতিক যৌনতাকে স্বীকার করা। রোমান-ক্যাথলিক চার্চের মতে, “sexual pleasure is morally disordered when sought for itself, isolated from procreative and unitive purpose”(Catechism of Catholic Church 2351)। এ ব্যাপারে বরং ইসলাম খানিকটা নরম। কোরানে গর্ভপাত নিষিদ্ধ বলে ব্যক্ত হয়েছে কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে প্রকাশ্য নিষেধ কিছু নেই। সেখানে বহির্বস্তুর প্রয়োগে নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আপত্তি থাকলেও ‘প্রত্যাহরণ পদ্ধতি’(coitus interruptus)কে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র বা পুরাণে জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে কোনও উল্লেখ আছে বলে মনে হয় না। মহাভারতে তো সন্তান উৎপাদনে সবাই উন্মুখ, সে রাজা বা ঋষি যে-ই হন না কেন। সন্তানের জন্য বিবাহ-বহির্ভূত যৌনমিলনও সেখানে শাস্ত্র-অনুমোদিত। এই সব মিলনের ফলে জাত ‘কানীন’, ‘ক্ষেত্রজ’ ইত্যাদি নামে অভিহিত সন্তানেরা ঔরসজাত সন্তানের মতনই তাদের মায়ের স্বামীর যাবতীয় উত্তরাধিকার লাভ করত। (বস্তুত পক্ষে, সেকালে যেহেতু জন-বিস্ফোরণ ঘটেনি, জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনও প্রয়োজনই সমাজে উদ্ভূত হয়নি। কালক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক কারণে এবং শিল্পসমৃদ্ধির কারণে উন্নত মানের জীবনযাত্রাকে নিশ্চিত করতে জন্মনিয়ন্ত্রণ করা যে কোনও সমাজের কাছেই আবশ্যিক হয়ে দাঁড়ায়। স্বভাবতই এ ব্যাপারে ধর্মীয় অনুশাসন শিথিল হয়ে পড়ে। আমাদের দেশে একটা চালু ধারণা আছে যে ধর্মীয় কারণে মুসলিম জনগণ জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরোধী। আসলে যে দেশে মুসলিমরা সংখ্যালঘু, সেখানেই মোল্লারা এই ধরনের ফতোয়া দেন যাতে মুসলিম জনসংখ্যা কোনওমতে কমে না যায়। এটি ধর্ম-সংশ্রবহীন বিশুদ্ধ সংখ্যালঘু মানসিকতা।) মোটের উপর, বৈদিক আমলে তো বটেই, পরবর্তী কালে হিন্দু সংহিতাকারগণও প্রাকৃতিক যৌনতাকেই মান্যতা দিয়েছেন। মনুর ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ বা চাণক্যের ‘পুত্রপ্রয়োজনা দারাঃ’, ‘হতা রূপবতী বন্ধ্যা’, ইত্যাদি শ্লোক তারই সাক্ষ্য দেয়। কেবলমাত্র বৃহদারণ্যকোপনিষদে যৌনতার আনন্দময়তার কিছুটা ব্যতিক্রমী স্বীকৃতি পাওয়া যায় যাজ্ঞবল্ক্যের মুখে,- “সর্বেষাম আনন্দানাম উপস্থঃ(জননেন্দ্রিয় সমস্ত আনন্দের একমাত্র গতি)”। 

ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র বিষমকামিতার অপ্রাকৃতিক চরিত্রটিকেই যে-কালে শাক দিয়ে ঢেকে রাখতে ব্যস্ত, সে-কালে চরম অপ্রাকৃতিক সমকামিতার উপর যে তারা খড়গহস্ত হবে, সে তো স্বতঃসিদ্ধ। পাশ্চাত্যের সব ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলিই একযোগে সমকামিতাকে এক জঘন্য পাপ বলে চিহ্নিত করেছিল। ভারতবর্ষে হিন্দুধর্মের তো কোনও প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা ছিল না। ফলে সমকামিতা নিয়ে তার কোন নির্দিষ্ট বিধানও ছিল না। (অধুনা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মুসলিম-বিদ্বেষের উপর ভর করে এলোপাতাড়ি একটা চেষ্টা চালাচ্ছে সেটিকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে তাঁর মাথা হয়ে বসতে। সমকামিতা নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম ধর্মের সুরে সুর মিলিয়েছে।) প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক, মিশেল ফুকো তাঁর The History of Sexuality-Part II গ্রন্থের The Perverse Implantation অধ্যায়ে বলেছেন যে অষ্টাদশ শতকের পূর্বে পশ্চিমী দেশগুলিতে যৌনতার বিনির্মাণে বিবাহিত দম্পতিদের প্রজনন-ভূমিকার উপরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকত। ধর্মীয় এবং দেওয়ানি বিধিরও নজর থাকত সেদিকেই। কিন্তু অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতক থেকে সমাজের আগ্রহ দম্পতিদের যৌনতা থেকে সরে গিয়ে ভিন্ন যৌনতার দিকে ধাবিত হলো। এই ভিন্ন যৌনতাকে ‘বিকৃতকাম’ অভিধায় চিহ্নিত করা হলো। এই বিকৃতকামের শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হলো সমকামীরাও। পূর্বে সমকামিতাকে ব্যক্তিবিশেষের বিকৃতি-জনিত পাপ (sodomy) বলে গণ্য করা হতো; এখন থেকে তাদেরকে এক নতুন ‘প্রজাতি’ হিসেবে গণ্য করা শুরু হলো। ফুকোর মতে এই চিহ্নিতকরণ আসলে একই সঙ্গে যৌনতার গবেষক এবং বিকৃতকাম বলে চিহ্নিত মানুষদের প্রতি ক্ষমতার সোল্লাস আস্ফালন (power and pleasure)। বুর্জোয়া সমাজ একদিকে নিজেরাই বিচ্ছিন্নভাবে এই ‘বিকৃতকামে’ খোলাখুলি নিমগ্ন হলো, অন্যদিকে যেখানে সম্ভব হলো সেখানে তাঁরা এই ভিন্ন যৌনতার উপর ছড়ি ঘোরাতে শুরু করল। (একটু ভাবলেই পাঠকেরা হয়ত অনুধাবন করতে পারবেন যে আমার যেটা মূল প্রতিপাদ্য -- অর্থাৎ ভিন্ন যৌনতাকে অপ্রাকৃতিক বলে দাগিয়ে দেওয়ার সময় ভণ্ডামির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে সমাজপতিরা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল যে মানুষের চেতনাই অপ্রাকৃতিক, বিষমকামী যৌনতা বা heterosexuality-ও সভ্যতার ঊষালগ্নে হারিয়েছে তার প্রাকৃতিকতা, -- তারই সমর্থন আছে ফুকোর এই অসাধারণ প্রজ্ঞাময় পর্যবেক্ষণে। তিনি মানুষের সর্ববিধ যৌনতাকেই বলেছেন, --‘the proliferation of specific pleasure and the multiplication of disparate sexualities’) দেখা গেল, এই সময়ের পর থেকেই সমকামীদের বিকৃতকাম ছাড়াও মনোরোগী বলে দাগিয়ে দেওয়া শুরু হলো। চেতনার বোধটিকে শিকেয় তুলে রেখে অপরাধের বিধিকূটে সমকামিতাকে বাঁধতে নতুন নতুন আইন তৈরিতে হাত লাগালেন রাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা। পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির নিজেদের দেশে তো বটেই, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তাদের অধিকৃত সব ভূখণ্ডেও সমকামিতাকে অপরাধের আওতায় এনে দণ্ডবিধি চালু হয়ে গেল। 

এই পরিপ্রেক্ষিতেই ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা অপ্রাকৃতিক অপরাধ হিসাবে কয়েক ধরনের যৌনক্রিয়াকে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে অন্তর্ভুক্ত করল। সেই অন্তর্ভুক্তিই আজকের বহুচর্চিত ৩৭৭ ধারা। এই ধারাটিকে আগে উদ্ধৃত করা যাকঃ Unnatural Offences: Whoever voluntarily has carnal intercourse against the ORDER OF NATURE with any man, woman or animal, shall be punished with imprisonment for life, or with imprisonment of either description for term which may extend to ten years, and shall also be liable to fine. 

Explanation: Penetration is sufficient to constitute the carnal intercourse necessary to the offence described in this section. 

উদ্ধৃতির ক্যাপিট্যাল লেটার আমার। এই নিবন্ধের শুরুতেই যৌনতার বিশেষণ হিসেবে ‘প্রাকৃতিক’ ও ‘অপ্রাকৃতিক’ শব্দ দুটি বেছে নেওয়ার পেছনে আমার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য আছে বলে ভনিতা করেছিলাম। অবশেষে সেই against the order of nature নামক phrase -টিতে পৌঁছনো গেল। এই পঞ্চশব্দের বাক্‌বিন্যাসটি নিয়ে হাজার হাজার শব্দবিনিময় করেছেন আইনজ্ঞরা ভারতের বিভিন্ন আদালতে। আমার প্রবন্ধের উপসংহার টানতে সেই গল্পের মধ্যে একবার উঁকি দেওয়া দরকার। তা করতে অতীত থেকে সাম্প্রতিক কালে আসতে হয়। নাচতে নাচতে সেখানেই আসা যাক। 

সময়েরও একটি চরিত্র আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের সময় শেষ হয়ে গেল। পরাধীন রাষ্ট্রগুলি স্বাধীন হওয়ার পর ছোট ছোট কয়েকটি দেশ বাদ দিলে সারা বিশ্বেই উদারনৈতিক বা সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেল। সামান্য কয়েকটি মুসলিম-প্রধান দেশ ছাড়া সর্বত্রই রাষ্ট্রের উপর ধর্মপ্রতিষ্ঠানের প্রভাব লুপ্ত হলো। বিগত শতাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে সোভিয়েত রাষ্ট্রের পতনের পর থেকেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে উঠতে লাগল কম-বেশি বিশ্বের সর্বত্রই। এর বহুদিন আগে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণায় গ্রন্থিত টমাস জেফারসনের ‘Right to Life, Liberty and the pursuit of Happiness’ শব্দগুলি এতদিনে যেন প্রাণিত হয়ে উঠল সারা বিশ্বেই। কিন্তু রাষ্ট্রের চরিত্র যতই বদলাক, ক্ষমতার চরিত্র তো বদলাবার নয়। ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে খুব বেশি জায়গা ছাড়তে গণতন্ত্রের গায়েও ফোসকা পড়ে। যৌনতার স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিদার বিশেষত এতই সংখ্যালঘু যে নির্বাচনে তার কোনও প্রভাব পড়ার সম্ভাবনাই নেই। সুতরাং ভারতীয় গণতন্ত্রের দলতন্ত্রপ্রেমী ক্ষমতার মুৎসুদ্দিগণ মেকলের তৈরি ধারাটির প্রতি নতুন করে দৃকপাত করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করলেন না। ইতিমধ্যে পশ্চিমের দ্বার খুলে এলজিবিটি-নামক বিদঘুটে এক গোষ্ঠী এদেশেও তাদের কিছু আত্মীয়স্বজন খুঁজে নিয়ে তাদেরকে সঙ্গে করে সুড়সুড়ি দেওয়ার মতন করে একটা আন্দোলন গড়ে তুলল। কিছু ক্ষ্যাপাটে কলমচি আবার তাদের সমর্থনে লেখালেখিও শুরু করে দিল। ইতিমধ্যে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক সোসাইটি তো বটেই, এমনকি ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রিক সোসাইটিও সমকামিতা মনের রোগ নয় বলে শংসাপত্র দিয়ে বসে আছে। এদিকে ভারতের ১৭২তম ল কমিশনও সমকামিতাকে অপরাধের আওতা থেকে বাদ দিয়ে ৩৭৭ ধারায় সংশোধন আনার জন্যে সুপারিশ করেছে। ‘ঝুটমুট ঝামেলা’ বলে তেতোমুখে মুৎসুদ্দিগণ ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টায় সর্বঘটে-কাঁঠালি-কলা আমলাদের তৈরি ফাইল নিয়ে বসলেন। দেখা গেল, যে-ব্রিটেন এদেশে ধারাটি আমদানি করেছিল, সেই ব্রিটেনই কবে সেই ১৯৬৭ সালে সমকামিতাকে অপরাধের আওতা থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। তা করতে গিয়ে চার্চ অব ইংল্যান্ডের আপত্তিকে গ্রাহ্যই করেনি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। তবে সারা পৃথিবীর ছবিটা দেখে তাঁরা আশ্বস্ত হলেন। শ’খানেক দেশ সমকামিতাকে স্বীকৃতি দিলেও এখনও ৭৯ টা দেশে এটা অপরাধ হিসেবে গণ্য। মহাদেশের হিসেবে আফ্রিকায় ৩৪, এশিয়া ও মধ্য প্রাচ্যে ২৫, আমেরিকায় ১১ এবং ওশেনিয়ায় ৯। খোদ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৩ সালে সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট সমকামিতা-বিরোধী আইনকে অসংবিধানিক ঘোষণা করা সত্ত্বেও সে দেশের ১৩ টি রাজ্যে সেই আইন রদ করা যায়নি। সুতরাং এই নিয়ে এখনই আমাদের উতলা হওয়ার কিছু নেই। যত নষ্টের গোড়া ইউরোপ, সেখানে সব দেশগুলোই আগমার্কা প্রগতিশীল। আয়ারল্যান্ডের মতন রক্ষণশীল দেশও কিনা সমলিঙ্গের বিয়েকে স্বীকৃতি দিয়ে বসল! হবে না? প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চগুলো তো গোল্লায় গেছে। শতকরা ৬২ ভাগ প্রোটেস্ট্যান্ট সমলিঙ্গ-বিয়ের পক্ষে। পোপ ফ্রান্সিস তো আবার সমকামিতা, সমলিঙ্গ-বিবাহ, জন্মনিয়ন্ত্রণ, গর্ভপাত, ইত্যাদি নিয়ে চার্চের মাথা ঘামানো যে তাঁর নাপছন্দ, সে কথা খোলাখুলি বলে বসে আছেন। খ্রিস্টানরা যা পারে করুক, কিন্তু কয়েকটা টপ-বটম এম-এস-এম-কে নিয়ে আঁতেলগুলো যেভাবে গোপন বিকৃতিগুলো নিয়ে রাস্তাঘাটে আলোচনা জুড়েছে, তাতে পবিত্র ভারতীয় সংস্কৃতির আর বাকি থাকল কি! আরে বাবা, পেনাল কোডে থাকলেই বা, সত্যি সত্যি কি হোমোগুলোকে ধরে ধরে যাবজ্জীবন দেওয়া হচ্ছে? বড়োজোর, পুলিশ খুব অভাবে পড়লে গন্ধ শুঁকে শুঁকে দু-একটাকে ধরে বিশ-পঞ্চাশ টাকা পকেটে ভরছে। সে তো আমাদের মতন মানী লোকদেরও কখনও কখনও বিপাকে পড়ে দালাল মারফৎ অনেক বড় অঙ্কের টাকা পুলিশের পকেটে গুঁজে দিতে হয়। এদিকে আদালতের মতলবও প্রথম দিকে ভালো ঠেকছিল না। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে তৃতীয় লিঙ্গকে স্বীকৃতি দিয়ে বসল সুপ্রিম কোর্ট। ওই বছরেই জুলাই মাসে দিল্লি হাইকোর্ট কিনা ৩৭৭ ধারা থেকে সমকামিতাকে বাদই দিয়ে বসল! তা সত্ত্বেও আমরা কিন্তু আপিলে যাইনি -–কেউ বলতে পারবে না আমরা প্রগতিশীল নই। কিন্তু জনগণ ছাড়বে কেন? তারা ঠিকই আপিল ঠুসে দিল সুপ্রিম কোর্টে। হাতে হাতে ফল। সর্বোচ্চ আদালত দিল্লি হাইকোর্টের রায়কে খারিজ করে ৩৭৭ ধারাকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনল তো! তবে সুপ্রিম কোর্ট আবার বলটা আমাদের কোর্টে ঠেলে দিয়েছে। সে দিক্‌গে! আমরা খেললে তবে না...! কত সব গুরুত্বপূর্ণ আইনের বিল পাশ করতে হয় আমাদের। হাতে গোনা কয়েকটা কোতি-পারিকের ধুরপিট্টি করার সুবিধে করতে বিল তৈরির সময় কোথায় আমাদের! সুপ্রিম কোর্টের বল এখন পড়ে পড়ে ঘুমোক। 

ফাজলামি বন্ধ করে এবার দিল্লি হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের রায় দুটি নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা করার চেষ্টা করি। কেননা এই প্রবন্ধে আমার বক্তব্যের নির্যাস নিহিত আছে এই দুটি রায়ের বিতর্কের মধ্যে। 

বিক্রম শেঠ আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকের কাছে একটি অতি পরিচিত নাম। তিনি যে সমকামী – এই তথ্যটিও অনেকের জানা, কারণ তিনি নিজেই তা নিঃসঙ্কোচে ব্যক্ত করে থাকেন। কিন্তু তাঁর মা লেলা(Leila)শেঠের নাম খুব কম লোকই শুনে থাকবেন। অসাধারণ এই মহিলার জীবনকাহিনী রূপকথার গল্পকেও হার মানাবে। সুযোগ পেলে সে গল্প অন্য কোথাও করা যাবে। এখানে যেটা প্রাসঙ্গিক তা হলো হিমাচল প্রদেশের প্রাক্তন চিফ জাস্টিস অশীতিপর এই মহিলা, যিনি আইন, সমাজতত্ত্ব ও দর্শন নিয়ে বেশ কিছু অসামান্য গ্রন্থও রচনা করেছেন, দিল্লি হাইকোর্টের রায়ের প্রভুত প্রশংসা করার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে আহত-আবেগে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শুধু তিনি নন, বহু আইনজ্ঞই সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের ন্যায্যতা ও সম্পূর্ণতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এই প্রবন্ধে লেলা শেঠকে টেনে আনার পেছনে আমার উদ্দেশ্য, সেই সব আইনজ্ঞদের প্রতিভূ হিসেবে তাঁকে বেছে নেওয়া। কারণ, আমার মনে হয়েছে এই সমালোচকেরা সম্পূর্ণ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টিকে দেখতে গিয়ে বিজ্ঞান-মনস্কতার প্রতি অবিচার করেছেন। লেলার বক্তব্য মূলত দুটি। এক, সমকামিতা জীববিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান অনুসারে কেবলমাত্র মানুষের যৌনতার পরিধির মধ্যেই নয়, প্রায় সমস্ত প্রজাতির জীবকুলের যৌনতার পরিধির মধ্যে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এক অবস্থা(natural condition)। সুতরাং এটি not ‘against order of nature’। সুপ্রিম কোর্ট against order of nature-এর ব্যাখ্যা কী দিয়েছে সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে সমস্ত প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে সমকামিতা স্বাভাবিক বলে তাঁর মন্তব্যে আমার আপত্তিটা জানিয়ে রাখি। এই আপত্তির কারণ আমি এই প্রবন্ধের প্রথম দিকে বিশদ ব্যাখ্যা করেছি, এখানে আর পুনরুক্তি করছি না। মানবিক প্রজ্ঞায় উদ্ভাসিত লেলা শেঠ এই প্রসঙ্গে যে প্রশ্নটি উচ্চারণ করেছেন তা এই রায়-প্রসঙ্গে আইনি নীতিশাস্ত্রের বিরোধী এক অতিব্যক্তিক ব্যঞ্জনা হলেও যে কোন সংবেদনশীল মানুষই তাতে সহমত হবেন। তিনি বলেছেন, তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান, যার চেতনা শিক্ষিত হয়েছে একজন সৎ, অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষ হিসেবে – সে যদি তার যৌনতার স্ফূর্তিতে উপগত হয় অন্য এক সাগ্রহী পুরুষে, তাহলে সে যাবজ্জীবন দণ্ডযোগ্য এক অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হবে। অন্যথায় তাকে আজীবন বাধ্যতামূলক সংযম পালন করতে হবে। এটা কী ধরনের ন্যায়বিচার? ‘To criminalize right to love is profoundly cruel and inhumane’— সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের এই তাঁর শেষ মূল্যায়ন। 

এমন নয় যে আমি লেলা শেঠ বা অন্যান্য আইনজ্ঞ যারা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কঠোর সমালোচনা করেছেন, কেউ কেউ এমনকি সকৌতুকে ব্যঙ্গ করতেও ছাড়েননি, তাদের সঙ্গে সহমত নই। তাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত হয়েও আমার খেদ যে দিল্লি হাইকোর্টে যাঁরা নাজ ফাউন্ডেশনের হয়ে সওয়াল করেছেন, তাদের কেউ কেউ মানুষের সব ধরনের যৌনতাই যে অপ্রাকৃতিক (against order of nature)-- আমার প্রবন্ধের এই মূল প্রতিপাদ্যের আশেপাশে ঘোরাফেরা করলেও বিচারপতি এই মামলার যে ১০৫ পৃষ্ঠার রায় দিয়েছেন, তাতে তিনিও সমকামিতাকে against order of nature বলে গ্রহণ করেননি, অর্থাৎ তিনিও সুপ্রিম কোর্টের মতনই প্রচলিত আইনি সূত্রের বাইরে যেতে পারেননি। আমার এই প্রবন্ধের পরিসর থেকে অপ্রাসঙ্গিক বিধায়ে দিল্লি হাইকোর্টের সর্বাধিক পোক্ত যে আইনি যুক্তি যাতে সংবিধানের ১৪, ১৫ ও ২১ ধারা লঙ্ঘনের দায়ে ৩৭৭ ধারাকে অসংবিধানিক আখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং সুপ্রিম কোর্ট যার সমর্থনে যথেষ্ট সাক্ষ্য নেই বলে যেটিকে খারিজ করেছে, সেটিকে আলোচনার বাইরে রাখছি। আমি কেবলমাত্র against the order of nature –-এই পঞ্চশব্দের বাক্‌বিন্যাস নিয়ে দুই আদালতের যুক্তিধারা বিশ্লেষণের মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি। 

এই বাক্‌বিন্যাসটি নিয়ে দুই আদালতের ব্যাখ্যায় কোনও চরিত্রগত ভিন্নতা নেই, দুই ব্যাখ্যাই আইনি শাস্ত্রের ঐতিহ্য-অনুসারী রক্ষণশীল। দুই আদালতই এই পঞ্চশব্দের বাক্‌বিন্যাসটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রথমে এই ধারাটির ইতিহাস উল্লেখ করে। ১২৯০ সালে ইংল্যান্ড প্রথম সমকামিতাকে অপরাধের আওতায় এনেছিল অ্যান্টি-সোডোমি অ্যাক্ট হিসাবে। পরবর্তীকালে এটি ‘বাগারি অ্যাক্ট’ (Buggery Act) হিসাবে সে দেশের দণ্ডবিধিতে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৫৩৩ সালে। তখন এই অপরাধের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। এই আইনটিই সংশোধিত হয়ে ১৮৬১ সালে ব্রিটেনে ও ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের দণ্ডবিধিতে ৩৭৭ ধারা রূপে অন্তর্ভূক্ত হয়। এই ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লি হাইকোর্টের ব্যাখ্যা হলো যে প্রাচীন জুদানীয় ও ক্যাথলিক নীতিবোধ থেকে অনুৎপাদক (non-procreative) যৌনমিলনকে বলা হয়েছে against the order of nature। সময়ের সঙ্গে নীতিবোধের পরিবর্তন হয়েছে। কাজেই অনুৎপাদক যৌনমিলনকে প্রকৃতিবিরোধী বলা বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অযৌক্তিক। সেখানে সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত রক্ষণশীলভাবে এই বাক্‌বিন্যাসের বিস্তৃততর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ব্ল্যাক-এর ‘ল ডিকশনারি’ থেকে ‘বাগারি’(Buggery),‘পেনিট্রেসন’(Penetration), ‘নেচার’(Nature) শব্দের সংজ্ঞা উল্লেখ করেছে। এইসব উল্লেখের পর সুপ্রিম কোর্টের প্রথম সিদ্ধান্ত হলো যে যোনিতে লিঙ্গপ্রবেশ (penile-vaginal penetration) হলো ‘natural’ এবং অন্য সব যৌনকর্মই(penile-non-vaginal) হলো ‘against the order of nature’। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত এই যে জনগণের নীতিবোধ আর সাংবিধানিক নীতিবোধ সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু; প্রথমটি পালটে যেতে পারে, দ্বিতীয়টি অটল। 

কাজেই যৌনবিজ্ঞানকে নস্যাৎ করে মান্ধাতার আমলের বিধিকূটকে মান্যতা দেওয়ার এই সিদ্ধান্তকে নিয়ে যে কোনও মন্তব্যই বাহুল্য। তবে এই প্রসঙ্গে কিছু কৌতুককর তথ্য উল্লেখের লোভ সম্বরণ করতে পারছি না। আমাদের দেশের বাৎস্যায়ন-প্রণীত ‘কামশাস্ত্র’ অনেকেই পড়েছেন। ইসলাম ধর্মেও এমনকি বলা হয়েছে – ‘Sex without foreplay is cruelty’ সেখানে ক্যাথলিক নীতিশাস্ত্র-অনুসারী ভিক্টোরিয়ান যুগের দম্পতিরা বদ্ধ শয়নঘরেও পোশাকের শালীনতা অক্ষুণ্ণ রেখে যোনিদ্বারে লিঙ্গপ্রবেশের প্রয়োজনে ন্যূনতম দেহপরিসর উন্মুক্ত করতেন। বার্ট্রান্ড রাসেল লিখেছেন যে এই মিলনের যন্ত্রণা সহ্য করার কৌশল হিসাবে বিবাহিত মেয়ের মা তাঁর কন্যাকে উপদেশ দিতেন, -- কী আর করবে বাছা, ওই সময় চুপচাপ শুয়ে ইংল্যান্ডের কথা ভাববে ..... lie still and think of England। 

সেদিনের বিলিতি প্রভুরা আজ তাঁদের নীতিবোধ বিসর্জন দিতে পারেন, তা বলে আমরা ভারতীয়রা প্রাক্তন প্রভুর নীতিবোধ ত্যাগ করি কোন লজ্জায়! 

প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণের মধ্য দিয়েই যে মানবিক চৈতন্যের বিকাশ, কেবল তার যৌনতাই নয়, তার মহত্ত্ব, তার প্রজ্ঞা, তার ক্রূরতা-খলতাও যে অতিপ্রাকৃতিক – - এই সহজ কথাটি আইনজ্ঞরা নিদানকালে বিস্মৃত হলেন, সেটাই ভারী আশ্চর্যের। আমার খেদ কেবল একটাই যে দিল্লি হাইকোর্ট মানবিকতাকে আইনি সূত্রের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েও এই কথাটি উচ্চারণ করতে পারলেন না যে ৩৭৭ ধারা অনুসারে সমকামীরা যেমন, বিষমকামীরাও তেমনই অপরাধে অপরাধী। 

[ প্রবন্ধের বিষয়বস্তুর সঙ্গে না গেলেও কৌতূহলী পাঠকের জ্ঞাতার্থে আইনি লড়াইয়ের সর্বশেষ অবস্থাটা জানিয়ে রাখি। সুপ্রিম কোর্ট সমকামিতাকে ৩৭৭ ধারার আওতা থেকে বাদ দিয়ে দিল্লি হাইকোর্টের সিদ্ধান্তকে খারিজ করে দেওয়ার পর নাজ ফাউন্ডেশন সুপ্রিম কোর্টে একটি কিউরেটিভ পিটিশন দাখিল করে। গত ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ তারিখে তার চূড়ান্ত শুনানিতে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, এই বিষয়ে সর্বমোট যে ৮টি কিউরেটিভ পিটিশন দাখিল হয়েছে, সবগুলিই একই সঙ্গে নতুন করে পুনর্বিবেচনা করবে ৫ সদস্যের এক সাংবিধানিক বেঞ্চ। তবে বিগত কিউরেটিভ পিটিশনগুলির পরিসংখ্যান বিবেচনা করলে সুপ্রিম কোর্টের রায় উলটে যাওয়ার সম্ভাবনা নগণ্য — শতকরা মাত্র ৫ ভাগ। আর সুপ্রিম কোর্ট যে এই ধারা সংশোধনের দায় আইনসভার কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে, সেখানেও অদূর ভবিষ্যতে কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম। আগ্রহী পাঠকদের নিশ্চয় মনে আছে কিছুদিন আগেই শশী থারুর-আনীত ৩৭৭ ধারা সংশোধনের একটি প্রাইভেট বিল সংসদ বিনা আলোচনায় মাঠের বাইরে উড়িয়ে দিয়েছে।] 




তথ্যসূত্র ও ঋণস্বীকারঃ 

১) Gender Shock: Exploding the myths of male and female by Phyllis Burke(Anchor Books, New York)

২) A Female soul in a Male body: Sexual Inversion as Gender Inversion in nineteenth century Sexology by G. Hekme

৩) Marriage and Morals, Islam by Sayyid Muhammad Rizvi(Chapter 2&4) 


৫) Instruction on Respect for Human Life in its origin and the Dignity of Procreation & Catechism of Catholoc Church (Wikipedia.org) 

৬) The Mating Game by Robert Burton 

৭) Newsmax.com 



১০) http://hdl.handle.net/11245/1.124794 

১১) স্বামী গম্ভীরানন্দ সম্পাদিত উপনিষৎ গ্রন্থাবলী – তৃতীয় ভাগ(উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা)

১২) পৃথ্বীরাজ সেন সম্পাদিত চাণক্য শ্লোক সমগ্র 

১৩) হলদে গোলাপ – স্বপ্নময় চক্রবর্তী 

১৪) প্রসঙ্গ যৌনতাঃ অপপ্রচার ও প্রকৃত শিক্ষা – ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়(অনুষ্টুপ, সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, ২০১৬) 

এছাড়াও নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং টাইমস অব ইন্ডিয়ার দুটি প্রতিবেদন। 







0 comments: