0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়




দারুণ দহনবেলা... নাই রস নাই... প্রখর তপনতাপে আকাশ তৃষায় কাঁপে, বায়ু করে হাহাকার। এমনই এক ক্লান্ত দীর্ঘ দগ্ধ দিনের অবসানে এক ডালি সুবাসিত সাহিত্য নিয়ে পাঠকের দরবারে হাজির ঋতবাক ২য় বর্ষ, ২১তম সংখ্যা। 

আগেও অনেকবার বলেছি, ভারতবর্ষের আবহমান অপৌরুষেয় সংস্কৃতির উৎস সন্ধানই ঋতবাক-এর সুদূরপ্রসারী অভিক্ষেপের মূল উপজীব্য বিষয়াভিলাস। কিন্তু এ কোন ভারতবর্ষ? কোন অপৌরুষেয় সংস্কৃতি? সমগ্র মানবসভ্যতার অগ্রগতির বৈশ্বিক ইতিহাসে ভারতীয় জনজাতি যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে গরিমান্বিত হয়ে এসেছে এতদিন, আজ তো সেখানেই একটা বড়ো প্রশ্নবোধক চিহ্ন স্থান করে নিয়েছে সব কিছু সরিয়ে। যে দিকে তাকাই, অসহিষ্ণুতা। ধৈর্যহীনতা। আত্মগর্বের উন্মত্ত উল্লাস। আত্মদম্ভের নির্লজ্জ, অশালীন, উৎকট প্রচার। কিন্তু কেন এই অসহিষ্ণুতা, ধৈর্যহীনতা? কিসের এত দম্ভ? একই মানুষের একাধিক মুখাবয়ব। আজ যিনি প্রাতঃস্মরনীয়, কালই তাঁর সংশ্রব ভদ্রসমাজে লজ্জার কারণ। আধুনিকতা ও ঋজুতার নামে চরম আত্মকেন্দ্রিকতা। সেন্স অফ কারেক্টনেস – নৈতিক মূল্যবোধের নামে আত্মপক্ষ সমর্থনের “ছাগলেরও দাড়ি আছে, রবীন্দ্রনাথেরও দাড়ি আছে...” জাতীয় অকাট্য কুযুক্তি নির্মান। ভারতবর্ষের আবহমান অপৌরুষেয় সংস্কৃতির উৎস কি শুধুই যুক্তিনির্ভর? সেখানে কি কোথাও হৃদয়বেত্তার উচ্ছ্বসিত উষ্ণতা, প্রাণের কোমল পরশ, আবেগের দিশাহারা আকুল আহ্বান, কিছুই ছিলো না? তবে কোন পার্থিব প্রবৃত্তিতে শক, হূণদল, পাঠান, মোঘল একদেহে হয়েছিল লীন? কোথায় গেল ভারত আত্মার সেই ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’র মহান উপলব্ধি? প্রকৃত জ্ঞান তো মানুষকে বিনয়ী করে, বিনম্র করে। তবে কি জ্ঞানের অসম্পূর্ণতার দৈন্যের কারণেই এমন সামগ্রিক অবনমন? আর তাই বুঝি সর্বংসহা ধরিত্রীও আজ তাঁর গর্ভজাত শ্রেষ্ঠতম সন্তানটির এমন সার্বিক অধঃপতনে লজ্জায়, ঘৃণায়, শোকে, দুঃখে বারংবার শিউরে উঠছেন। 

এখানেই স্তব্ধ হোক আজ লেখনী। শুধু প্রার্থনা মন্ত্র উচ্চারিত হোক – উপলব্ধি করো নিজেকে, স্মরণ করো তোমার জন্মের কারণ, আত্ম-অক্ষে স্থিত হও, শুধু যুক্তি নয় – মানবিক বৃত্তির চর্চায় পূর্ণতা লাভ করো। 

নিরন্তর শুভকামনা...

সুস্মিতা বসু সিং

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - পলাশ কুমার পাল

Posted in













প্রচ্ছদ নিবন্ধ


ভোট চিত্র
পলাশ কুমার পাল


এখন বসন্ত ও গ্রীষ্মের সন্ধিক্ষণ বলা যায়। ক'দিন আগের বসন্তের প্রকৃতির রঙ ক্রমশ ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। রঙের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির কাঠামোও পাল্টে যাচ্ছে। বসন্তোত্সবের মঞ্চকে নগ্নকরে বাঁশ, কাপড় খোলা হচ্ছে আর এক উৎসবের তাগিদে। এটাও এক রঙের উৎসব। তবে মঞ্চ দুটো আলাদা; অনুষ্ঠানের ধরণ বা সূচীও আলাদা।

বসন্তোৎসবের মতো নিত্যবছর না এলেও, যখন আসে তখন বসন্তোৎসবের চেয়েও বেশি আবীর নিয়ে আসে। রাজার মতো আভিজাত্য নিয়ে আসে তো, তাই তার আসার পথে দেয়ালে দেয়ালে রঙে ভরে যায়, ভরে যায় রঙীন প্রতীকে... আসলে উৎসবটা রাজার লড়াইয়ের। প্রত্যেক রাজ্যেই এই রাজার লড়াই চলে মূল সিংহাসনের অধিকারের দাবীতে। আর সেখানেপ্রজাদের অধিকারটা কেবল হাততালির। হাততালি হলেও অন্তরঙ্গে ক্ষুদ্র মৌলিকতা দর্শকসম। প্রতীক ও রঙের মাঝে শুয়ে থাকা লাশের মতো; এক দিগন্ত আশা নীল আকাশে উড়িয়ে দিয়ে মাটিতে পিঠ ঠেকিয়ে থাকা নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাসে- যাদের উপর দিয়ে রাজা হেঁটে যায়...

আদিম, প্রাচীন, মধ্যম যুগ থেকে বড়াই করা সভ্য ভারতের মূল ভিতে এই প্রতীকগুলির অবস্থান। বৈচিত্র্যময় সংবিধানের এও এক বৈচিত্র্য। এই প্রতীকগুলিই যে সংবিধান শুধরে দেয়।আর প্রতীকের ভিতগুলির পাশে জনগণ ইঁটরূপে দেয়াল হয়। তৈরি হয় বাড়ি। প্রশাসন প্লাস্টার হয়ে যায় সিমেণ্ট ও বালিতে। তারপরে রঙ। কোন রঙ উঠবে দেয়ালে?

এই প্রশ্নের উত্তরের জন্যই উৎসবের ঘোষণা। প্রত্যেক রাজা সেই মঞ্চে উঠে নিজেদের performance দেখায়- প্রতিশ্রুতি, কথন, জনগণের প্রতি হৃদয়গলা ব্যবহারের প্লাবনে। যে performance-এ বেশি হাততালি জোটে সেই প্রতীক ও রঙের রাজা জয়ী হয়। তারপরে নির্দিষ্ট চুক্তিতে সে রঙ ওঠে বাড়ির দেয়ালে।

উৎসব শেষে নির্বাচিত রাজা সিংহাসনে বসতে রাজপ্রাসাদের দিকে ছোটে। বাকি রাজারা ব্যর্থ মনরথে চড়ে আগামী উৎসবে সফল হওয়ার পরিকল্পনা করতে করতে ফেরে। চক্রান্তও বলাযেতে পারে। কারণ এই উৎসব যে প্রতিযোগিতা- রাজপথে দৌড়ের। যেখানে প্রতি পদক্ষেপে সাধারণত আলোকবাতি পার হতে হয়। তাই চক্রান্ত ছাড়া এদিকে এড়িয়ে জয়ী হওয়া অসম্ভবপ্রায়। শেষ সিদ্ধান্তে এইটুকুই বলা যায় যে এই চক্রান্তই হল রাজার নীতির রঙ।

হাততালি দেওয়া শেষ হলে কিছু এলোপাথাড়ি দেহ বা রক্তের ঢেলা অবশেষরূপে পরে থাকে উৎসবের অঙ্কে ভাগ প্রক্রিয়ার সমাপ্তে। প্রজারা ঘরে ফেরে। দেয়ালে দেয়ালে তখনও উৎসবেররঙ জ্বলজ্বল করে। নির্বাচিত রাজার অ-সমর্থকরা আতঙ্কিত হয় রাজার ভবিষ্যৎ নীতির রহস্যে। আর জয়ীরা জয়োল্লাসে বারবার ডোবে স্বপ্নের দরিয়ায়। বসন্তের কিশলয় চিকচিক করেগ্রীষ্মের রোদে। কিশলয় কি বোঝে এটা খুশি না দহন?

রাজা রথ নিয়ে ছোটে। উৎসবের দিন প্রায় ফুরিয়ে যায় পশ্চিমাকাশে। প্রজারা দূর থেকে দেখে রাজার ঘোড়া ছুটছে আর ছুটছে বসতি পশ্চাতে ফেলে সূর্যের পানে... যত এগোয় রাজার পোষাকের রঙ অস্পষ্ট হতে হতে কালো হয়... স্বপ্ন রক্তিম হয় আকাশে।

তারপর কালো রাত নামে। সংস্কারে তুলসী মণ্ডপে জ্বালা প্রদীপ তেলের অভাবে ক্ষণেকেই নেভে। হাতড়ে হাতড়ে রাত কেটে যায় আরও এক সূর্যের প্রতীক্ষায়। এবারে তারা ঠিকঠাক হাততালি দেবে বলে নতুন উৎসবকে আহ্বান জানাই। দিন আসে, আবারও ফুরায় অস্তে, রাজা আসে, রাজাও ঢুবে যায় সূর্যের এপিঠে কালো রঙ হয়ে।

স্বপ্নকে ধর্ষিত হতে দেখতে দেখতে বয়স বেড়ে যায়। ওই ভিতগুলিকে নড়াতে পিঠকে সোজা করে ভিত হয় না কেউ! শুধু ইঁট, ভিত, প্লাস্টারের স্বপ্ন ও অপেক্ষার রঙ বদলে যায়।কোলাহলে শত আহ্নিক ফুরায়, ফুরায় বার্ষিক। রঙ বদলের এরূপ কত উৎসব আসে, চলে যায়... লাশের মতো শুয়ে থাকা এবং হাততালি দেওয়ার রীতি পাল্টায় না। শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবে যেমন 'রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও...' গানের শেষে আবীর মাখার রীতি কখনো পাল্টায় না। উৎসব শেষে কেবল রাঙা হওয়াই রীতি... হয় রঙ না হয় রক্ত। অথবা নির্বাকভাবে কুঁজো হয়ে সরে যাওয়া 'কিছুই হয়নি, কিছুই দেখিনি' এই অজুহাতে।


0 comments:

0

বিশেষ প্রবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


বিশেষ প্রবন্ধ


একটি অনালোচিত দ্বিশতবার্ষিকী:-
বাংলা পুস্তক প্রকাশনার দুশো বছর
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্মবার্ষিকী, শতবার্ষিকী বা দ্বিশতবার্ষিকী পালনের রেওয়াজ বিশ্বের সর্বত্রই আছে। কোনও কোনও বস্তুর ক্ষেত্রেও এমন উদযাপন হয়। ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এমন উদযাপন হয় তাদের অবদানের কারণে। আমাদের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার মধ্যেই তাদের বেঁচে থাকা। বস্তুর স্মরণের ক্ষেত্রে ঠিক এমনটা নয়। নয়, কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সেই বস্তুটির নিয়ত পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, যার ফলে তার আদি চেহারাটাই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ধরা যাক ধ্বনিবদ্ধ কন্ঠস্বর বা গান শোনার যন্ত্র কলের গান, যা আবিষ্কার করেছিলেন টমাস আলভা এডিসন ১৮৭৭ সালে। এখনকি কলের গান বা গ্রামোফোনের জন্মদিন পালন করা যায়? যায় না, কারণ দেড়শো বছরেরও কম সময়ে ধ্বনিবদ্ধ কন্ঠস্বর শোনার বন্দোবস্তটাতেই আমূল বদল ঘটে গেছে। কিন্তু বিজ্ঞানী এডিসনকে বিস্মৃতির অতলে রাখা যাবে না, কারণ ধ্বনিবদ্ধ কন্ঠস্বর শোনার প্রযুক্তির মূল আবিষ্কার ছিল তাঁরই।

কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়, আমি এখানে একটি বস্তুর জন্মের দ্বিশতবার্ষিকীর কথা বলবো। বলার আগে এই ছোট্ট ভূমিকাটুকু করলাম। মুদ্রিত ছাপা বাংলা বই ও বাংলা পুস্তক প্রকাশনার দুশো বছর। হ্যাঁ, এই ২০১৬তে বাংলা অক্ষরে ছাপা বাংলা বই এবং তার বিপণনের দুশো বছর পূর্ণ হল। অথচ কলকাতার আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা বা বাংলার জেলাশহরের কয়েকশো বইমেলার আয়োজনে কোথাও এ সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারিত হয়েছে এমন জানা নেই।

যে কোনও বস্তুর বা প্রতিষ্ঠানের জন্মের একটা পৃষ্ঠভূমি থাকে। আর বইয়ের জন্ম ও বিবর্তনের ইতিহাস তো মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে। সেই বৃত্তান্ত এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। আমি বলছি বাংলাভাষায় ছাপা বই। দুই মলাটের ভেতর ধাতব অক্ষরে ছাপা বই, যে বই আমরা কিনে পড়ি বা পড়ার জন্য উপহার পাই। তার বয়স কিন্তু মাত্র দুশো বছর। হঠাৎ করে একদিন বই ছাপা হয়ে যায়নি। কেউ বলেনি সেই মানুষটিকে, যে ছাপাখানায় ধাতব অক্ষর সাজিয়ে ছাপাখানার যন্ত্র চালাতো। সেই মানুষটি একদিন কলকাতার এক ছাপাখানা থেকে মধ্যযুগের এক স্বনামধন্য কবির একটি সচিত্র বই ছাপিয়ে ফেললেন আজ থেকে দুশো বছর আগে। তাঁর কথা বলার আগে এদেশে ছাপাখানার প্রবর্তন, ধাতব অক্ষর আবিষ্কার, অক্ষর সাজানো বা কম্পোজ করা – এই বিষয়গুলি ছুঁয়ে যাবো।

ছাপা বইয়ের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল আজ থেকে ছ’শো বছর আগে। ১৪৫০ সনে জার্মানীতে জোহানেস গুটেনবার্গ উদ্ভাবন করলেন মুদ্রণ যন্ত্র আর ১৪৫৫ নাগাদ গুটেনবার্গের যন্ত্রে ছাপা হল বাইবেল। সেই শুরু ছাপা বইয়ের জয়যাত্রা। অন্ধকারাচ্ছন্ন সুলতানী আমলের ভারতে তখন কারো দূর কল্পনাতেও ছাপাখানা বা ছাপা বই ছিল না, থাকার কথাও নয়। এদেশে ছাপাখানা এল আরো সোয়া তিনশো বছর পরে ওপনিবেশিক ইংরেজদের হাত ধরে।

১৮শতকের দ্বিতীয়ার্ধ দেওয়ানি লাভের পর ইংরেজরা তখন বাংলায় জাঁকিয়ে বসেছে। কলকাতায় ওয়ারেন হেস্টিংস কোম্পানীর কর্মচারীদের দেশীয় ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে শ্রীরামপুরের মিশনারিরা ধর্ম প্রচারের নানান ফন্দি-ফিকির খুঁজছেন। দুটি কাজেই ছাপাখানাই যে সবচেয়ে বড় সহায়, সেকথা বুঝেছিল তারা। মিশনারিরা প্রথম ছাপাখানা বসালো ১৭৭৮এ হুগলীতে। দু’বছর পরে শ্রীরামপুরে এল ছাপাখানা ‘ব্যাপটিস্ট মিশনারি প্রেস’। ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রামমোহন রায় তখন হুগলী জেলার খানাকুলের পল্লীতে ছয় বছরের শিশু। মিশনারিদের এই ছাপাখানা থেকেই ১৭৮৪তে ছাপা হল ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড সাহেবের ‘এ গ্রামার অফ দি বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’, যাতে প্রথম বাংলা অক্ষর ব্যবহৃত হয়েছিল। ছাপাখানা এল।তারপর বাংলা অক্ষর সাজিয়ে বই ছাপা ও বিপণনের বন্দোবস্তে লেগে গেল আরো তিনটি দশক।

এদিকে হেসটিংস তাঁর রাজ্যপাট ঠিকমত চালাতে ইংরেজ কর্মচারীদের দেশীয় ভাষা শিক্ষার জন্য বাংলায় ছাপার কাজ শুরু করার জন্য হন্যে হয়েছেন। হুগলীতে কর্মরত কোম্পানীর এক কর্মচারী চার্স উইলকিন্স কিছুটা দেশীয় ভাষা শিখেছিলেন। হেস্টিংস তাঁকে বাংলা হরফ বানানোর দায়িত্ব দিলেন। উইলকিন্স ইংল্যান্ডের কারিগরদের দিয়ে বাংলা হরফ বানানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু ব্যর্থ হলেন। অবশেষে সন্ধান পেলেন ত্রিবেণীর এক লৌহজীবী পঞ্চানন কর্মকারের। জনৈক হস্তলিপিবিদ খুশমৎ মুন্সীর সুচারু হস্তলিপি থেকে ধাতব অক্ষর কেটে দিলেন পঞ্চানন কর্মকার। বাংলা ভাষা ও মুদ্রনের ইতিহাসের সে এক সন্ধিক্ষণ। পঞ্চানন ধাতব অক্ষর বানিয়ে দিলেন, শ্রীরামপুরের মিশনারি প্রেস থেকে বাংলায় ছাপা হতে শুরু করল, পাদরি উইলিয়াম কেরির ওল্ড টেস্টামেন্ট ইত্যাদি ধর্ম প্রচারের বই ছাপা হল। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য বাংলা বই ও তার বিপনন শুরু হতে লেগে গেল আরো বেশ কয়েক বছর। ইতিমধ্যে কলকাতায় ছাপাখানা এলো। কলকাতা গ্রন্থনগরী হয়ে ওঠার দিকে পা বাড়াল।

কলকাতা তখন সবেমাত্র তার শৈশব দশা অতিক্রম করেছে। তখনও বেলাগাম দুর্নীতি আর কদর্য বাবু কালচারের কলকাতায় বাদা, জঙ্গলে ঘেরা মেঠো পথ। সবে একটা মাত্র চওড়া রাস্তা হয়েছে। পালকি ভিন্ন যানবাহন নেই।ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রামমোহন রায় তখন সবেমাত্র কলকাতায় এসেছেন স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য, জন্মগ্রহণ করেননি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।তখনও কারখানার চিমনির ধোঁয়া নেই, বিদ্যুতের আলো নেই, কিন্তু বাংলা বই এসেছিল। কলকাতায় বাংলা বই নিয়ে আসা, কলকাতাকে গ্রন্থনগরী করে তোলার ভগীরথ গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। ১৮১৬ সনে কলকাতা থেকে ছাপা ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ই সাধারণের কাছে বিক্রয়ের জন্য প্রথম সচিত্র বাংলা বই – প্রকাশ করেছিলেন এই গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য।

অথচ বাংলার সামাজিক ইতিহাসের এই যুগান্তকারী ঘটনা যিনি ঘটালেন সেই গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য সম্পর্কে তেমন কিছু লেখাজোখা ইতিহাস রেখে যায়নি। জানা যায়না তাঁর জন্ম ও মৃত্যু তারিখ বা কোনও পারিবারিক বৃত্তান্ত। শুধু ১৮৩০-এর ৩০শে জানুয়ারি সংখ্যার ‘সমাচার দর্পণ’-এ প্রকাশিত সংবাদটি ছাড়া। ‘সমাচার দর্পণ’ থেকে জানা যায় - "এতদ্দেশীয় লোকের মধ্যে বিক্রয়ার্থে বাঙ্গালা পুস্তক মুদ্রিতকরণের প্রথমোদ্যোগ কেবল ১৬ বৎসরাবধি হইতেছে ইহা দেখিয়া আমাদের আশ্চর্য্য বোধ হয় যে এত অল্প কালের মধ্যে এতদ্দেশীয় লোকেরদের ছাপার কর্ম্মের এমন উন্নতি হইয়াছে। প্রথম যে পুস্তক মুদ্রিত হয় তাহার নাম অন্নদামঙ্গল শ্রীরামপুর ছাপাখানার এক জন কর্ম্মকারক শ্রীযুত গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য্য তাহা বিক্রয়ার্থে প্রকাশ করেন।" আসলে গঙ্গাকিশোররা ইতিহাসের নির্মাণ করেন কিন্তু ইতিহাস তাঁদের মনে রাখে না।

নবজাগরণকালের সেই ঊষালগ্নে বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের এই ইতিহাস নির্মাণ বিস্ময়কর বৈকি! বাংলার বুদ্ধির জাগরণের অগ্রপথিক রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুরদের সঙ্গে সমান শ্রদ্ধায় উচ্চারিত হওয়ার যোগ্য গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের নাম। কোন প্রেরণায় শ্রীরামপুর মিশনারি প্রেসের এক কম্পোজিটর বাংলার সামাজিক ইতিহাসে পুস্তক প্রকাশনায় অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করলেন সে এক বিস্ময়।

১৭৭৮-এ মিশনারি এন্ড্রুজ সাহেব হুগলীতে প্রথম ছাপাখানা খোলেন। দুবছর পরে শ্রীরামপুরে মিশনারীরা ছাপাখানা বসালেন – ‘ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস’, সে কথা বলেছি।বহড়া গ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণসন্তান গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য পেটের দায়ে সেই প্রেসে কম্পোজিটারের কাজ পেলেন। ১৮০১ থেকেই বাংলা ভাষার বই ছাপা শুরু হয়েছে। সেগুলি সবই পাদরি উইলিয়াম কেরির উদ্যোগে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের পণ্ডিতদের দ্বারা লিখিত পাঠ্যপুস্তক। ছাপা বইয়ের বিস্ময় বুকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন গঙ্গাকিশোর। কলকাতায় তখন কয়েকটি ছাপাখানা বসেছে। পুস্তক প্রকাশনার স্বপ্ন নিয়ে গঙ্গাকিশোর কলকাতা চলে এলেন, আর কলকাতার ‘ফেরিস কোম্পানী প্রেস’ থেকে নিজ উদ্যোগে ছাপলেন রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যটি ১৮১৬ সনে। শুধু বই ছেপেই থেমে থাকলেন না, তার বিপণনের ব্যবস্থাও করলেন। তাঁর বইয়ের বিক্রয়ের জন্য কলকাতায় একটি বইয়ের দোকান খুললেন। গঙ্গাকিশোরই প্রথম কলকাতা শহরে বইয়ের দোকান খোলার পথ দেখান। বই বিক্রির সাফল্যে উৎসাহিত গঙ্গাকিশোর বাংলার নানা শহরে বিক্রয় প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছিলেন। বাংলা বইয়ের আদিপর্বে এ ছিল এক অভাবিত ব্যাপার। এখানেই থামলেন না গঙ্গাকিশোর। দু’বছর পরে ১৭১৮-তে গঙ্গাকিশোর নিজেই একটা ছাপাখানা বসালেন – ‘বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস’ নামে। কলকাতায় ছাপাখানা আসার সেই আদি পর্বে বাংলা বই ছাপাতে হত শ্রীরামপুরের ‘মিশনারি প্রেস’ অথবা কলকাতায় ‘ফেরিস কোম্পানী’র প্রেস থেকে। গঙ্গাকিশোরের আগে কোন বাঙালি ছাপাখানা স্থাপনে এগিয়ে আসেননি। সুতরাং এ ব্যাপারেও গঙ্গাকিশোরই পথপ্রদর্শক। নিজের প্রেস থেকে অতঃপর গঙ্গাকিশোর ‘বাঙাল গেজেটি’ নামে বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। বাঙ্গাল গেজেটি এক বছর চলেছিল। বাঙ্গাল গেজেটির কোনও সংখ্যা পাওয়া যায় না। গঙ্গাকিশোরের এই ‘বাঙাল গেজেটি’ই বাঙালি প্রবর্তিত প্রথম বাংলা সংবাদপত্র। অতএব গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যই একাধারে বাংলা ভাষার প্রথম ছাপাখানার স্থাপক, মুদ্রাকর, পুস্তক প্রকাশক,গ্রন্থ ব্যবসায়ী ও বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশক।

মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের‘অন্নদামঙ্গল’ সম্পর্কে কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন, এ নিবন্ধে সেই সুযোগও নেই। ‘অন্নদামঙ্গল’ অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ রূপে স্বীকৃত, রবীন্দ্রনাথ যে গ্রন্থটিকে বলেছেন “রাজসভাকবি রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল-গান রাজকণ্ঠের মণিমালার মতো, যেমন তাহার উজ্জ্বলতা তেমনি তাহার কারুকার্য।” প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য গ্রন্থটি প্রকাশ করেন, যেটি বাংলাভাষায় প্রথম প্রকাশিত সচিত্র গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে।

ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলীর ভূমিকায় সজনীকান্ত দাস লিখেছেন -‘‘ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য মুদ্রণ করিয়াই বাংলা দেশে বাঙালীর পুস্তক-প্রকাশ ব্যবসায় আরম্ভ হয়; ১৮১৬ খ্রীষ্টাব্দে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ইহার একটি চমৎকার সচিত্র সংস্করণ বাহির করিয়া ‘পাবলিশিং বিজনেস’ আরম্ভ করেন; ...গোটা ঊনবিংশ শতাব্দী ধরিয়া বাংলা দেশে অন্য কোনও বাংলা পুস্তক এত অধিক প্রচারিত এবং পঠিত হয় নাই।” ‘অন্নদামঙ্গল’ ছাড়াও গঙ্গাকিশোর প্রকাশ করেন ‘গঙ্গা ভক্তি তরঙ্গিনী’, ‘লক্ষ্মী চরিত্র’ ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ ও ‘চাণক্যশ্লোক’।

এরপর গঙ্গাকিশোর কি করেন, কতদিন জীবিত ছিলেন, কিছুই জানা যায় না। জানা যায়, ১৮১৯ সনে তাঁর সহযোগী হরচন্দ্র রায়ের সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে গঙ্গাকিশোর তাঁর ছাপাখানাটি নিজ গ্রামে নিয়ে যান এবং এর কয়েক বৎসর পরে মৃত্যু হয় বাংলা মুদ্রণ শিল্পের ও বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশনার পথিকৃত গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যর।

   


তথ্যসূত্র-(১) ‘কলিকাতা শহরের ইতিবৃ০ত্ত’/ বিনয় ঘোষ,(২) ‘সাহিত্য-সাধক ‘চরিতমালা’/ব্রজেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘ভারতকোষ’/বঙ্গীয় সাহিত্য পরিসৎ /৩য় খণ্ড)।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - হিমাদ্রি মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


অগ্নিশিখা এসো এসো
হিমাদ্রি মুখোপাধ্যায়



একটাই তো সত্যিকারের প্রেম। একটাই বই। গীতবিতান। এক জীবনের পক্ষে যথেষ্ট। ভুল বললাম বুঝি! অনেক অনেক জীবনের পক্ষেও কি যথেষ্টের চেয়ে বেশি নয়? কোন প্রহরশেষের রাঙা আলোয় তার চোখে যে আমার সর্বনাশ দেখেছিলুম আজ মনে পড়ে না আর, তারপর কত কত পৌষ ফাগুনের পালা পার হয়ে এই দিনান্তবেলায় পৌঁছেছি। এরই মধ্যে কতবার রং বদলালো তার গান প্রেমে-অপ্রেমে, আনন্দে-বেদনায়। কতবার পালটে গেল গানের মানে, শব্দের দ্যোতনা—

বর্ষায়, বসন্তে, আলিঙ্গনে, প্রত্যাখানে, মিলন আর বিরহের অবিরাম, অবিশ্রাম ধারাস্রোতে। আরও যদি বেঁচে থাকি কিছুদিন, ধরা যাক আরো এক কুড়ি, সেদিনেও, এই কুড়ি-কুড়ি বছর পার হয়ে যাওয়া রিক্ত হেমন্তের শষ্যক্ষেত্রে দাঁড়িয়েও মনে কি হবে না, অন্ত পাওয়া গেল না তোমার কিছুতেই, তোমারই গানের কলি তোমাকেই কি ফিরিয়ে দিয়ে বলে যেতে হবে না - "মধুর তোমার শেষ যে না পাই"? "হার মানা হার"? বেশ তো। এটুকুই না হয় এবারে দিয়ে গেলুম। আমার প্রেম, আমার পূজা, আমার সমর্পণ তোমার যূথীমালিকার মৃদু গন্ধে নাহয় আরো কিছুকাল ধরা থাক।কতবার যে শুনেছি গানটা। "অগ্নিশিখাএসো এসো"...বড়ো প্রিয় গান আমার। আলো ভালোবাসি আশৈশব। তাই আলোর গানে আমার মুগ্ধতা অশেষ। উপনিষদের "তমসো মা জ্যোতির্গময়" মন্ত্রে আলোকের জন্য যে প্রার্থনা উচ্চারিত হয়েছিলো একদিন, রবিঠাকুরের গানে তা যেন পরিণত হয়েছে এক কার্নিভালে। গানে গানে অফুরাণ আলোকবন্দনা। রুদ্ধদ্বার অচলায়তনের প্রাচীর যেদিন ভেঙে পড়ে,আর আলোয় ধুয়ে যায় অন্ধ সংস্কারের অর্থহীন জঞ্জাল,তখন কী উল্লাসেই না বালকেরা গেয়ে উঠেছিলো-- "আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা..."। শুধু কী তাই, "আলো যে আজ গান করে মোর প্রাণে গো...", "আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও...", "আলোর অমল কমলখানি..."। সত্যিই "আলোয় আলোকময়" হয়ে আছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাজপথ। আর আলোর অনুষঙ্গে যদি ভাবি আগুন আর প্রদীপের কথা, তাহলে "আগুনের পরশমণি" থেকে "হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে"... কত যে আলোর গান লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ "ও তার অন্ত নাই গো নাই"। তেমনি আজ বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শুনে যাচ্ছিলাম ইউটিউবে... অগ্নিশিখা এসো এসো... বার দশেক তো বটেই...বার কুড়িও হতে পারে... এভাবেই গান শুনি আমি -- কতদিন কলেজ কামাই হ'য়ে যায় -- স্নান খাওয়া পড়ে থাকে, আজও যেমন পড়ে রইলো মৌসুমীর বসন্ত সংখ্যার কাগজের জন্য ফরমায়েসি লেখা (মেয়েটা বোধহয় এরপর আমাকে মেরেই ফেলবে)। পেরিয়ে গেলো ইলেকট্রিক বিল জমা দেওয়ার শেষ দিন,আর আমি অবিরাম শুনেই চলেছি আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের ১৭ সংখ্যক গান- ১৯২৩ সালে লেখা ইমনকল্যাণাশ্রয়ী অগ্নিবন্দনা -- কখনো অচেনা কোনো কন্ঠে,কখনো বা রাধারাণী দেবীর অপরূপ ধ্রুপদী গায়ন ভঙ্গিমায় ----

               অগ্নিশিখা, এসো এসো, আনো আনো আলো।
               দুঃখে সুখে ঘরে ঘরে গৃহদীপ জ্বালো॥ 
       আনো শক্তি, আনো দীপ্তি,         আনো শান্তি, আনো তৃপ্তি,
               আনো স্নিগ্ধ ভালোবাসা, আনো নিত্য ভালো॥
               এসো পুণ্যপথ বেয়ে এসো হে কল্যাণী
               শুভ সুপ্তি, শুভ জাগরণ দেহো আনি। 
         দুঃখরাতে মাতৃবেশে               জেগে থাকো নির্নিমেষে
               আনন্দ-উৎসবে তব শুভ্র হাসি ঢালো॥

আর এই প্রথম খটকা লাগলো আমার। এ গান কি আদৌ কোনো আলোকবন্দনার গান? আক্ষরিক অর্থও যদি বিবেচনা করি, এই গান, কি সত্যিই অগ্নিশিখার কোনো আবাহন? যদি তাই হয়, "দুঃখে সুখে ঘরে ঘরে" কেবল গৃহদীপখানি জ্বালিয়ে দিয়ে যাওয়া তো আগুনের কাজ নয়। খাণ্ডবদাহন হলে বোঝা যেতো না হয়, কিন্তু কেবলই তৃপ্তিকর কোনো প্রদীপশিখা জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য, একটা দেশলাইকাঠি হলেই যেখানে চলে যায়, সেখানে স্তোত্রোচিত এরকম একটা গান লিখে ফেলা বড়োই বাড়াবাড়ি হয়ে যায়না কী? তরোয়াল দিয়ে শেভিং করার মতো কোনো বদভ্যাসের কথা রবীন্দ্রজীবনীকারেরা তো তাঁর সম্পর্কে লিখে যান নি কখনো। অগ্নিশিখা শক্তি আনে, দীপ্তিও, এটুকু আমরা জানি সকলেই, কিন্তু শান্তি, তৃপ্তি আর স্নিগ্ধ ভালোবাসা কি হতে পারে কখনো আগুনের চরিত্রলক্ষণ, আর "কল্যাণী" কি আদৌ হওয়া সম্ভব দূরকল্পনাতেও অগ্নির কোনো সম্বোধন, তা সে দাবানল বা হোমানল যাই হোক না কেন? আর তখনই অতর্কিত বিস্ময়ে আমরা আবিস্কার করি, এই অগ্নিশিখার গান আসলে আগুন নয়, নারীকে নিয়ে লেখা। অগ্নিশিখা এসো এসো- আসলে নারীরই বন্দনাগীতি -- সেই নারী যিনি একই সঙ্গে কল্যাণী এবং দনুজদলনী, একই সঙ্গে যিনি হতে পারেন জোন অফ আর্ক এবং ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গল -- সংহিতা যাঁকে বলেছেন, পূজনীয়া এবং গৃহের দীপ্তি স্বরূপা, "পূজার্হা গৃহদীপ্তয়ঃ"। ভেবে দেখুন, তিনিই কি শুভ্রহাস্যে নন্দিত করে তোলেন না আমাদের সব উৎসবের দিন, আবার দুর্যোগে দুর্দিনে, আমরা তাঁকেই কি দেখি না "দুঃখরাতে মাতৃবেশে জেগে থাকো নির্নিমেষে"? এ গান তাই কখনো হতে পারে না কেবলই অগ্নিশিখার কোনো আবাহন, যদি না সেই অগ্নিশিখা হয়ে ওঠেন যুগপৎ জায়া এবং জননী, ভগিনী এবং দুহিতা, রক্তকরবীর নন্দিনী এবং মার্কণ্ডেয় চন্ডীর "ত্বমেব সন্ধ্যা সাবিত্রী, ত্বং দেবী জননী পরা"। কত আলতো ভাবেই যে সারা জীবন শুনে আসছি রবীন্দ্রনাথের গান! কত ভুল ব্যাখ্যাই না করে চলেছি আপাত সরল কিন্তু বিপজ্জনকভাবে রহস্যময় তাঁর অক্ষরমালার। বয়েস বাড়ছে। ভয় বাড়ছে আরো। চল্লিশ বছর তাঁকে নিয়েই তো আছি, কিন্তু "মায়ার খেলা"র সখীদের মতো আজও যে কেন বারেবারেই বলতে হয় -- "ওরে বোঝা গেল না -- চলে আয়, চলে আয়"?


0 comments:

0

প্রবন্ধ - অমৃত অধিকারী

Posted in


প্রবন্ধ


যদিদং হৃদয়ং...
অমৃত অধিকারী



পুরাণ বলে, মহর্ষি উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতুই নাকি বিবাহ নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবক। তার পূর্বে নাকি নারীরা ‘গাভীর ন্যায় স্বাধীন’ ছিলেন, অর্থাৎ নিজেদের পছন্দমতন পুরুষের সঙ্গে ইচ্ছামতন উপগতা হতে পারতেন। পুরাণের বক্তব্য অনুযায়ী, শ্বেতকেতু আপন জননীর এই জাতীয় কোনও স্বেচ্ছাচারে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বিবাহস্বরূপ সমাজবন্ধনটি রূপায়িত এবং বেদে সংযুক্ত করেন, যেটি অনতিবিলম্বে সমাজব্যবস্থায় বলবৎ হয়।

কারণ যাই ঘটে থাক না কেন, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভারতীয় সমাজ শ্বেতকেতুর এই উদ্যোগের কাছে গভীরভাবে ঋণী। বিবাহ আধুনিক সমাজবিন্যাসের দৃঢ়তম বন্ধন; পরিবার, আত্মীয়তা ও গোষ্ঠীস্বরূপ তিনটি উত্তরাধিকার সূত্রের মূল প্রতিষ্ঠান, এবং নিঃসন্দেহে ভালোবাসা নামক স্বর্গীয় অনুভূতিটির অন্যতম প্রধান এবং পরিপূর্ণ অভিব্যক্তি।

কিন্তু বিবাহ যে সভ্যতার থেকে প্রাচীন নয়, সে কথা স্বতঃসিদ্ধ। তাই স্বভাবতই এ প্রশ্ন মনে জাগে যে, প্রাকবৈবাহিক যুগের সামাজিক গঠন ঠিক কিরকম ছিলো? কিসের ভিত্তিতে প্রাচীন গোষ্ঠীগুলি গড়ে উঠতো এবং পৃথকভাবে চিহ্নিত হতো? কিরকম ছিলো সভ্যতার প্রাক্কালের সমাজজীবন?

ইতিহাস বলে, আজ থেকে কমপক্ষে ছয়-সাত হাজার বছর আগে এক ভ্রাম্যমান জনজাতি হিমালয়-হিন্দুকুশের পর্বতপ্রাচীর লঙ্ঘন করে এসে সিন্ধুনদের অববাহিকায় বসতিস্থাপন করেছিলো।পশুপালন এবং শিকার ছিলো সেই ঐক্যবদ্ধ জাতির প্রধান জীবিকা। সিন্ধুনদ-ধৌত সুবিস্তৃত উর্বর ভূমি সেই জনজাতিকে ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ার স্বাধীনতা দিয়েছিলো। কালক্রমে তারা কৃষিকর্ম শেখে এবং জমির মালিকানা সম্বন্ধে সচেতন হয়। সেই সঙ্গে উদ্ভূত হয় সে মালিকানার উত্তরাধিকার নির্ণয় করার প্রয়োজন। কিন্তু সেই প্রাচীন সমাজে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্দিষ্ট করার জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান ছিলো না। তাদের আদিম, উন্মুক্ত জীবনযাত্রায় সন্তানের পিতৃত্ব নির্ধারণ করা ছিলো কার্যত অসম্ভব।

তাই তাদের সামনে ছিলো আর একটি মাত্র বিকল্প –উত্তরাধিকার নির্ধারণের মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা। সেটিই ছিলো সহজ প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। প্রতিটি গোষ্ঠীর প্রধান হতেন একজন করে নারী। গোষ্ঠীর বাকি সদস্যরা তাঁর সন্তান-সন্ততি।তাঁরাই সে গোষ্ঠীর জমি ও পশুসম্পদের উত্তরাধিকারী হতেন এবং সচল রাখতেন গোষ্ঠীর বংশক্রম।

কিন্তু এই সমাজব্যবস্থা ক্রমে বিবর্তিত হলো। সে বিবর্তনের প্রধান কারণ পর্বতপ্রাচীর পেরিয়ে আসা নতুন জাতির আক্রমণ। সে আক্রমণের তীব্রতায় এবং তীক্ষ্ণতায় সেই প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক জাতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং বাধ্য হয় সিন্ধুর অববাহিকা ছেড়ে ভারতীয় ভূখণ্ডের নানান অংশে ছড়িয়ে পড়তে। উত্তর ভারতে স্থাপিত হয় সেই আগন্তুক জাতির উপনিবেশ, যা কালক্রমে রূপ নেয় আর্যসভ্যতার।

ইতিহাস বলে, এই আগন্তুকরা প্রাথমিক পর্যায়ে ছিলো বর্বর, সমরস্পৃহ, পুরুষপ্রধান জাতি।কিন্তু তাদের সমাজও ছিলো আদিম, শৃঙ্খলাহীন, এবং তাদের পুরুষরা প্রাকৃতিক নিয়মেই প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতো নারীর অধিকারের জন্য। তাদের নারীরাও সেই একই নিয়মে মনোনীত করতে পারতো নিজেদের পছন্দের পুরুষকে, যখন যেমন খুশী। ঋষি শ্বেতকেতু সম্ভবত এইরকমই এক আদিম সমাজের প্রতিভূছিলেন। যে উদ্দেশ্যেই হোক, তিনি সেই সমাজকে নারী-পুরুষের নির্দিষ্ট সম্পর্কের একটি বন্ধনে বাঁধতে চেয়েছিলেন, এবং সফলও হয়েছিলেন। না হলে পুরাণ তাঁর নাম বিবাহপ্রথার প্রবর্তক হিসেবে স্মরণে রাখতো না।

বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির কিন্তু আজকের সংস্থিতিতেএসে পৌঁছতে বহু বছর লেগেছে। বহুবিবাহের নানান পর্যায় পার হয়ে বিবর্তিত হতে হতে এই অসাধারণ প্রথাটি এসে আজকের সুসভ্য সমাজের মানবিক সম্পর্কের প্রধান যোগতন্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের পুরাণ, আরণ্যক, ব্রাহ্মণ, মহাকাব্য জাতীয় প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে তার প্রচুর সাক্ষ্য জাজ্বল্যমান। পুরুষের বহুবিবাহের ঘটনাই সেই সব সাক্ষ্যে অধিকাংশ হলেও নারীর একাধিক পতির নিদর্শনও কিন্তু দুষ্প্রাপ্য নয়। তবে একথা অনস্বীকার্য যে পুরুষের বহুদারগমন প্রথা ভারতীয় সমাজে বহুকাল অবধি বিদ্যমান ছিলো।

চিত্তাকর্ষক বিষয় হলো এই যে, বীর্যশুল্কে নারীকে জয় করার প্রথাটি কিন্তু অনেকদিন অবধি সমাজসিদ্ধ ছিলো। বিশেষত ক্ষত্রিয়দের মতন যোদ্ধৃজাতির সমাজে। স্বয়ম্বরা রাজকন্যাকে বাহুবলে জিতে নিয়ে যাওয়ার ভূরি ভূরি নিদর্শন রামায়ণ-মহাভারত জুড়ে। এইসব ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজা বা রাজপুত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষ ছিলো অবধারিত, যদিও সেই সংঘাতগুলি প্রাণনাশক হতো বলে মনে হয় না। বিবাহ করতে গিয়ে রাজা বা রাজপুত্রের প্রাণ হারানোর ঘটনা পুরাণ সাহিত্যে বিরল। 

সাধারণত স্বয়ম্বরগুলিতে রাজকন্যা উপস্থিত রাজন্যবর্গের মধ্যে থেকে ইপ্সিত পতিটিকে বরণ করে নিতেন। কিন্তু এ ছাড়াও কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্বয়ম্বর সভায় আয়োজন থাকতো বীরত্বের প্রতিযোগিতার, যেটি আপন বাহুবলে জয় করলে তবেই পাওয়া যেতো রাজকন্যার বরমাল্য। আমাদের দুই মহাকাব্যের দুই নায়ক রামচন্দ্র ও অর্জুন এইভাবেই যথাক্রমে মিথিলা ও পাঞ্চাল দেশের স্বয়ম্বর সভা থেকে লাভ করেছিলেন সীতা ও দ্রৌপদীকে।

প্রসঙ্গত, রাজকীয় বৈবাহিক সম্পর্কগুলি সেযুগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সম্বন্ধস্থাপকের কাজ করতো। বিবাহের মাধ্যমে সূচিত আত্মীয়তা দু’টি রাজ্যকে মৈত্রীবদ্ধ করে তুলতো, যাতে বৃদ্ধি পেতো উভয়ের রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি। এই বিবাহগুলি অনক ক্ষেত্রেই হতো সম্ভাব্য শত্রুকে মিত্রে পরিবর্তিত করার মোক্ষম কূটনৈতিক চাল। এরও বহু উদাহরণ ভারতবর্ষের প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে বিদ্যমান। স্বয়ং কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে এই জাতীয় কূটনীতিকে সপ্রশংস অনুমোদন দিয়েছেন।

সাধারণ বিবাহের ক্ষেত্রে স্বীকৃতি ছিলো অসবর্ণ এবং অসাজাত্য বিবাহেরও। বহুলচর্চিত গ্রন্থ মনুসংহিতা, প্রচুর সমালোচনা সত্ত্বেও যা অনস্বীকার্যভাবে প্রাচীন ভারতীয় সমাজনীতির একটি প্রামাণ্য দলিল, বিবাহকে আটটি প্রকারে ভাগ করেছে - ব্রহ্ম, দৈব, আর্শ, প্রজাপত্য, গান্ধর্ব, আসুর, রাক্ষস এবং পৈশাচ। এর মধ্যে শেষের চারটি, অর্থাৎ গান্ধর্ব, আসুর, রাক্ষস, এবং পৈশাচ স্পষ্টতই অনার্য বিবাহের প্রকার। প্রাগার্য, আর্যেতর এবং ভারতীয় ভূখণ্ডের যে প্রাচীন অধিবাসীদের আজ আমরা আদিবাসী নামে অভিহিত করি, তাদের সামাজিক প্রথাগুলির এই স্বীকৃতি অবশ্যই প্রভূত সংখ্যায় অসবর্ণ ও অসাজাত্য বিবাহের প্রমাণ। অতি প্রাচীন কাল থেকে আবহমান এই জাতি-বর্ণ-সাংকর্যই জন্ম দিয়েছে আজকের ভারতীয় জনসংখ্যার, নৃতাত্ত্বিক বিচারে যা নিঃসন্দেহে সমগ্র বিশ্বে জটিলতম।

আজকের পরিস্থিতি আলাদা। বিবাহের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে বহু সময় লেগেছে আমাদের। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এসে বিধবাবিবাহ আইন প্রণীত হয়েছে ভারতবর্ষে, এবং তাও বিদেশী শাসকের আনুকূল্যে। বিবাহবিচ্ছেদ আইনত অনুমোদিত হয়েছে আরও অনেক পরে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য এবং কাঠামো আজও একই আছে। সমাজবদ্ধ মানুষেরজীবন ও মননে ভারসাম্য নিয়ে আসাই সেই উদ্দেশ্য, যার ফলস্বরূপ জন্ম নেয় সুস্থ, আনন্দময় পরবর্তী প্রজন্ম। সন্তানের বিবাহ সমাজজীবনের একটি প্রতিষ্ঠা, একটি সাফল্য, যা গর্বিত করে প্রত্যেক জনক-জননীকে। বৈবাহিকী অনুষ্ঠানগুলি পারিবারিক আনন্দ সম্মেলনের একেকটি অত্যুৎকৃষ্ট অবকাশ। বিবাহবার্ষিকীগুলিও তাই। এই সব অনুষ্ঠান অর্থনৈতিক ভাবেও আধুনিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। অসংখ্য ব্যবসায়িক সংস্থা আজ এই অনুষ্ঠানগুলিকে সুচারুরূপে নির্বাহ করার কাজে ব্যাপৃত, এবং সামগ্রিকভাবে এই ব্যবসা ক্রমশ একটি সংগঠিত শিল্পে রূপান্তরিত হচ্ছে।

কিন্তু এই সবকিছুর বাইরেও বিবাহ মানবজীবনের এমন একটি অপরিহার্য অঙ্গ, যা স্মরণাতীত কাল ধরে সমাজকে নিয়ত দিয়ে চলেছে তার ভিত্তির দৃঢ়তম প্রতিষ্ঠা, মানবিক সম্পর্কের অখণ্ড পরিকাঠামো, এবং সবকিছুর উপরে যা জীবনের প্রধান পরিপূরক, সেই অবিমিশ্র আনন্দ ও ভালোবাসার পরিপূর্ণ অবকাশ।





0 comments:

1

ধারাবাহিক - অমিতাভ প্রামাণিক

Posted in


ধারাবাহিক


সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে 
অমিতাভ প্রামাণিক



দুই


দর্শন, মূল্যবোধ, বিচারব্যবস্থা – এসবের সাথে লবঙ্গ-দারুচিনি-গোলমরিচের কোনও সম্বন্ধ আছে?

না থাকলে আর প্রশ্নটা খামোকা করা কেন? আর শুধু দর্শন ইত্যাদিই নয়, সমগ্র পৃথিবীর আজ যে রূপ, তার প্রায় সব কিছুর পিছনেই আপাত-নিরীহ ঐ মশলাপাতির তীব্র ভূমিকা। অবাক লাগছে?

যে কোনও জায়গায় কয়েক দানা চিনি ফেলে রাখলে যেমন অনিবার্যভাবে সারি দিয়ে পিঁপড়ের দল এসে হাজির হয় অচিনপুর থেকে, নেমন্তন্ন করে ডেকে আনতে হয় না, ঠিক তেমনি কেমন করে বিদেশীরা জেনে গেছিলো আমাদের এই ভারতবর্ষ মহার্ঘ মশলার আধার। যীশু জন্মানোর হাজারেরও বেশি বছর আগের কথা এসব। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি হতে শুরু হলো ব্যবসাবাণিজ্যে। আরবেরা সমুদ্রপথে এসে মশলা নিয়ে গিয়ে বেচতো ইওরোপে, চড়া মুনাফায়। ইওরোপীয়ানরা চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? গন্ধে গন্ধে তারাও বেরিয়ে পড়লো ইন্ডিয়ার সন্ধানে। কলম্বাস পথ ভুলে চলে গেলো আমেরিকায়, ভাবলো সেটাই ইন্ডিয়া। সে ভুল ভেঙে গেলে অন্যান্যরাও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সমুদ্রে পাড়ি জমাতে লাগলো। ভাস্কো-ডা-গামা রুট বের করে ফেলতেই দলে দলে হাজির হতে লাগলো পর্তুগীজ, ইংরেজ, ফরাসী, ওলন্দাজ, দিনেমাররাও। 

যে সময়ের কথা বলছি, তখন দেশে মোগল আমল চলছে। সপ্তদশ শতাব্দী। তাজমহল বানানো চলছে আগ্রায়, তার জন্যে এক হাজার হাতির পিঠে ধবধবে সাদা মার্বেল আসছে রাজস্থানের মাকরানা থেকে। দেওয়ালে কারুকার্যের জন্য আঠাশ রকমের মণিমুক্তোর কিছু আসছে পশ্চিমে পঞ্জাব বা সুদূর আফগানিস্তান থেকে, কিছু আসছে উত্তরে তিব্বত-চীন থেকে, কিছু বা দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা থেকে। উস্তাদ আব্দুল আহমদ লাহোরির তত্ত্বাবধানে উদয়াস্ত কাজ করছে বিশ হাজার শিল্পী। এর মধ্যে একে একে দিল্লীর মসনদে বসেছেন আগে জাহাঙ্গীর, এখন তাঁর ছেলে শাহজাহান, তৈরী হচ্ছেন তাঁর ছেলে আওরঙ্গজেব। দাপটের সঙ্গে দেশ চালান এঁরা। দেশের প্রজারা সম্রাটকে ভয় করে, মান্য করে। তবে তারা তো আর সম্রাটের দর্শন পায় না, এলাকার জমিদারদেরই ভাবে তাদের ভাগ্যনিয়ন্তা।

জমিদার মানে কিন্তু জমির মালিক না। দিল্লীর বাদশা হচ্ছেন জমির মালিক। বাদশার কাছ থেকে চাষী বা রায়তরা জমির সাময়িক মালিকানা বা জমাবন্দি নিয়ে চাষবাস করে। এতগুলো প্রজা বা রায়তদের কাছ থেকে জমির খাজনা আলাদা আলাদা করে আদায় করা তো সহজ কাজ না, এর জন্য মিড্‌ল্‌ম্যান হিসাবে নিয়োজিত হতো যারা, তারাই জমিদার। জমিদারের কাজ ছিলো স্রেফ রায়তদের কাছ থেকে সরকারি খাজনা আদায় করে সরকারের রাজস্বের ভাণ্ডারে মজুত করা। এ কাজ ভালোমতো করতে পারলে বাদশার তরফ থেকে খিলাত বা উপাধি জুটতো। এই খিলাত দিয়ে খুদে জমিদারি থেকে বড় জমিদারি পেতে সুবিধা হতো। সরকার নির্দিষ্ট করে দিতো, কত তার কর চাই, জমিদার প্রজাদের কাছ থেকে সেই কর তুলে জমা দিতো সরকারি কোষাগারে। ধার্যের অতিরিক্ত যা থাকতো তা যেতো তার পকেটে, সহজ সরল হিসেব। কীভাবে সেই খাজনা আদায় হবে, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কী দরকার দিল্লীর বাদশার? 

খাজনা মোট তিন ধরণের। আবাদি অনাবাদি সমস্ত জমি যেখানে গাছপালা, বনজঙ্গল, জলাভূমি বা পুকুর আছে, তা থেকে যে খাজনা আদায় করা হতো, তার নাম মাল। তা থেকেই মালকড়ি কথাটার শুরু। নদীপথে যেসব নৌকা-বজরা চলাচল করতো আর গ্রামে গঞ্জে যেসব হাট-বাজার বসতো তা থেকে সেইর নামে আর এক ধরণের খাজনা আদায় করা হতো। যারা বিভিন্ন ধরণের কাজকারবার করতো সেইসব পেশাজীবী বা কর্মজীবীদের কাছ থেকে আদায় করা হতো ইনকাম ট্যাক্সের মত বেশ মোটা অঙ্কের খাজনা, তার নামও ছিলো সেইর। এছাড়া অকাজ-কুকাজের জরিমানা, প্রতারণা, এমনকি বিয়ে-শাদি থেকেও বাজে জমা খাজনা আদায় করা হতো। মাল খাজনা আদায়ের জন্য জমি-জিরেত মাপামাপির হাঙ্গামা ছিলো না, জরিপ করবে কে? আন্দাজে একটা মোটামুটি হিসাব করে খাজনা ধার্য করা হতো। কাজের সুবিধের জন্যে মোট ধার্য খাজনার টাকা ভাগ ভাগ করে জমিদাররা প্রজাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতো। মোগল আমলে জমিদাররা প্রজাদের বেশি শোষণ করতে পারতো না, বেশী ঝামেলা সৃষ্টি হলে দরবারে খবর চলে যেতো, বাদশা জমিদার পাল্টে দিতেন। জমিদারি বাঁচিয়ে রাখার তাগিদেই প্রজাদের তাই হাতে রাখতে হতো। তাদের খুশি রাখতে কিছু দাবিদাওয়াও মানতে হতো।

আভ্যন্তরীণ শান্তি বজায় রাখতে জমিদারদের পুলিশ রাখতে হতো। পাশের রাজ্যের হামলা রুখতে সৈন্যসামন্ত সাপ্লাইয়ের দায়িত্বও তাদের। খাজনা আদায়ের জন্য পাইক বরকন্দাজ থাকতো। তারাই স্থানীয় চুরি-ডাকাতি, দস্যুদের উৎপাত থামানোর কাজ করতো। বড় জমিদারদের আওতায় পুলিশ মোতায়েন করা থানা থাকতো, তার অধীনে একাধিক চৌকি, যার কর্মীদের বলা হতো চৌকিদার। থানার প্রধান ছিলো ফৌজদার। ফৌজদাররা আদতে বাদশার লোক, তবে তারা জমিদারদের অধীনেই কাজ করতো। সবই ছিলো খাজনা আদায়ের নানা বাহিনী।

এসব অঞ্চলে মোগলদের যুদ্ধবিগ্রহের সেনাবাহিনীও ছিলো না। যুদ্ধের বা বিদ্রোহ দমনের জন্যে বা পাশের রাজ্য দখলের কাজে বাদশাহীতে সৈন্য-সামন্ত, হাতি-ঘোড়া যা দরকার হতো, তার যোগান দিতে হতো জমিদারদের। এজন্যেও প্রজাদের ঘাড়ে কিছু অতিরিক্ত খাজনা চাপিয়ে দেওয়া হতো। জমিদাররা নিজেরাই ছোটোখাটো বিচার-টিচার করতেন জমিদারি আদালতে। যেসব বিচার সম্ভব হতো না সেখানে, তা পাঠিয়ে দেওয়া হতো থানাদার বা কাজির কাছে। প্রজাদের সপক্ষে রায় যাওয়ার আশা ছিলো বাতুলতা। বাদশার আর জমিদারের স্বার্থরক্ষা করে যেটুকু করা সম্ভব, তার নামই ছিলো বিচার।

প্রজারঞ্জক বলে খ্যাত সম্রাট আকবরের সেনাপতি তোডরমল বাংলা সুবাহ্‌য় এই জমিদারি ব্যবস্থা চালু করেন। ভারত বিশাল দেশ, তাকে ভাগ করা হয়েছে অনেকগুলো অঞ্চল বা সুবাহ্‌য়, এক একটার প্রশাসনের দায়িত্বে এক একজন সুবাহ্‌দার বা সুবেদার। বাংলা সে রকম একটা সুবাহ্‌, তার খাজনা আদায় হতো চৌঁত্রিশটা জমিদারি সরকার দিয়ে। অনেক পরে, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে মুর্শিদকুলি খাঁ যখন বাংলার সুবেদার, চালু হলো মালজমিনি ব্যবস্থা। সরকারি কোষাগারে যাতে নিয়মিত বেশি বেশি রাজস্ব আদায় হয়, তা নিশ্চিত করতে মুর্শিদকুলি বাংলাকে তেরোটা প্রশাসনিক বিভাগ বা চাকলায় ভাগ করলেন। বড় বড় জমিদারদেরই মনোনীত করা হলো এই চাকলাগুলোর চাকলাদার হিসেবে, তাদের কাজ হলো দক্ষতার সঙ্গে রাজস্ব আদায় করা। তবে এরা যত বেশি খালসা বা বাদশার কোষাগারের পুঁজির জোগান দিতে লাগলো, তত এদের ক্ষমতা আর মর্যাদা বাড়তে লাগলো। প্রতিভাবান জমিদারদের বিভিন্ন সরকারি পদে নিয়োগের প্রস্তাব এলে তাদের প্রেস্টিজ আরো বেড়ে গেলো। সেইসঙ্গে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির পথও প্রশস্ত হলো। মূলতঃ রাজস্ব আদায়কারীর ভূমিকা থেকে ক্রমশ জমির মালিকে রূপান্তরিত হতে লাগলো তারা।

মুর্শিদকুলি খাঁ নিয়ম করে দিয়েছিলেন চাষের জমির রাজস্বের জন্যে বাদশার পাওনা কী। এক এক শস্যের জন্যে এক এক রকম কর, যেমন গমের চাষ করলে বিঘা পিছু চার মণ গম হবে বাদশার প্রাপ্য। সে রকম যবের চাষ করলে চার মণ যব, সর্ষের বেলায় আড়াই মণ সর্ষে। অথবা সাড়ে তিন মণ ছোলা বা মটর অথবা ছ’ মণ কলাই। কিন্তু জমিতে যদি রাঙা আলু, শাঁকালু, পেঁয়াজ, লেবু, তেঁতুল, লাউ, কুমড়ো, শাকসবজি ফলে, অথবা চাষ হয় নীল বা পানের, তাহলে সেসব তো আর বাদশার নিত্য কাজে লাগবে না, তার খাজনা দিতে হবে নগদ তংখায়। এসব হিসেব করে রাজস্ব ধার্য করার জন্য গ্রামে গ্রামে যেতো কানুনগোরা। খাজনা দিতে হতো গরু মোষ পালতে, ফলের চাষ করতেও। আর এত রকম খাজনার পাশাপাশি ছিলো গাঁজা, কম্বল, তেল, কাঁচা চামড়ার উপরেও আলাদা ট্যাক্স।

তবে মুর্শিদকুলি তো অনেক পরের ব্যাপার। তার একশো বছর আগেই ইংরেজরা এসে গেছে ভারতে, ঐ লবঙ্গ-দারুচিনি-গোলমরিচের মত মশলাপাতির সন্ধানে, জাহাজ নিয়ে বাণিজ্য করতে।

বিদেশে এসে হুট করে জাহাজে মাল তুলে নেওয়া তো চাড্ডিখানি কথা না, ওভাবে কি বিজনেস হয়? বিজনেস করতে গেলে অফিস কাছারি খুলতে হয়, থিতু হয়ে বসতে হয় সেখানে। ইংরেজের ফড়েরা ওদের রিপোর্ট দিলো– কাছারি খুলতে হলে খোলো বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায়। ব্যবসা ওখানেই জমবে ভালো। সেটা ইংরাজী ১৬১৭ সাল। দিল্লীর গদিতে বাদশাহ জাহাঙ্গীর, আর বাংলার সুবেদার ইব্রাহিম খাঁ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তৈরী হয়েছে মূলত ভারতের সঙ্গে ব্যবসার জন্যেই, মাত্র ষোল বছর আগে, শতাব্দীর গোড়ায়। ইংরেজদের অনুরোধে জাহাঙ্গীর বছর তিনেক পরে তাদের সুরাটে একটা কুঠি নির্মাণ মঞ্জুর করলেন। কুঠি মানে আধুনিক ডিপো বা ওয়্যারহাউস, কাছেপিঠের অঞ্চল থেকে জিনিসপত্র যোগাড়যন্ত্র করে যেখানে মজুত রাখা যাবে কিছুদিন, আর খাতাপত্তর সমেত অফিস। ওরা অবশ্য সেটাকেই বলত ফ্যাক্টরি।

সুরাটের পর আগ্রায় আর মাদ্রাজের দক্ষিণে মছলিপত্তনমে ফ্যাক্টরি বানালো ইংরেজরা। কিন্তু চোখ তো বাংলার দিকে, বাদশার কাছে চলতে লাগলো নিরন্তর আবেদন। আরো চোদ্দ বছর পরে জাহাঙ্গীরের ছেলে শাহজাহান এক ফরমান জারি করলেন যে এরা বাংলায় কুঠি বানাতে পারবে, তবে ওদের থাকার জায়গা হবে উড়িষ্যার পিপলিতে। কুঠি এক জায়গায়, থাকার জায়গা অন্যত্র, এ ঠিক পছন্দ হলো না কোম্পানীর। তারা বলল, তাহলে পিপলিতেই কুঠি বানাই? বাদশা বললেন, না। 

বাদশার আদেশ নড়চড় করা মুশকিল। নতুন ফরমান চাই। কিন্তু চাইলেই কি আর পাওয়া যায়?

কপালে থাকলে সবই সম্ভব। বছর দুই পরে শাহজাহানের এক কন্যা হঠাৎ আগুনে ভয়ঙ্করভাবে পুড়ে গেলো। দিল্লীর তাবড় ডাক্তার-বদ্যি-হাকিম তাকে চিকিৎসা করে বাঁচাতে পারে না প্রায়। সারা গায়ে ঘা, দিন দিন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। সে খবর গেলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কানেও। সুরাট থেকে ইংরেজ ডাক্তার বাউটন এলেন তার চিকিৎসা করতে। কন্যা সুস্থ হয়ে গেলো। বাদশা তো মহাখুশি। লিখে দিলেন, যাও পিপলিতে কুঠি বানাও গে। সেটা ১৬৩৩ সাল।

ইংরেজ বাণিজ্যতরী সেই প্রথম নোঙর ফেলল ভারতের পূর্ব উপকূলে।

১৬৩৮ সালে শাহজাহান তাঁর মেজ ছেলে শাহ সুজাকে পাঠালেন বাংলার সুবেদার করে। তাঁর গৃহেও এক মহিলার অসুখ কিছুতে সারে না। আবার ডাক পড়ল সেই বাউটনের, তিনি হাজির হলেন সুজার রাজধানী রাজমহলে। এবারও অসুখ সারিয়ে দিলেন ডাক্তার বাউটন। ফলে পিপলির সঙ্গে বুড়িগঙ্গার তীরে বালেশ্বর আর কয়েক বছর পরে ১৬৫১ সালে গঙ্গাতীরে হুগলিতেও কুঠি খোলার অনুমতি পেয়ে গেলো কোম্পানী। এরপরে কাশিমবাজারে, তারপরে পাটনায়, সিঙ্গিরায় আর ১৬৬৮ সালে ঢাকায় ইংরেজরা একে একে কুঠি বানিয়ে ফেললো।

এর মধ্যে ১৬৬৪ সালে দিল্লীর মসনদে শাহজাহানের পুত্র আওরঙ্গজেব বাংলার সুবেদার করে পাঠালেন মামা শায়েস্তা খাঁকে। শায়েস্তা খাঁ অতিশয় তালেবর শাসক, কিন্তু হঠাৎ গজিয়ে ওঠা মারাঠা দস্যু শিবাজীকে দমন করতে গিয়ে নাকানিচুবানি খেয়ে গেছেন। তিনি বাংলা শাসন করতে লাগলেন ঢাকা থেকে। ইংরেজরা শায়েস্তা খাঁকে ধরে পড়লো– বাংলায় তারা যেন আজীবন ব্যবসা করতে পারে দিল্লী থেকে এই মর্মে যদি এক ফরমান জারী করিয়ে নেওয়া যায়। বছর বছর রিনিউয়াল এক বিরাট ঝক্কি, বিশেষ করে গদি পাল্টে গেলে নতুন সম্রাটের কী মর্জি হয়, কে জানে! তার চেয়ে পাকাপাকি একটা বন্দোবস্ত হয়ে থাকলে বেশ হয়। ইংরেজদের এতাবৎকালের কার্যকলাপ লক্ষ করে বাদশা তা মঞ্জুর করলেন। 

হুগলির কুঠিতে তিনশো তোপধ্বনির মাধ্যমে সেই আদেশের আনন্দ উদ্‌যাপিত হলো।

রাতারাতি বাংলায় বাণিজ্য বেড়ে গেলো। এর আগে মাদ্রাজে ঘাঁটি গেড়ে নিয়েছিলো ইংরেজরা, পূব ভারতের সব কুঠিগুলো ছিলো তাদেরই অধীন। নতুন ফরমান পেয়ে বাংলাকে মাদ্রাজের থেকে আলাদা করে দেওয়া হলো, মিস্টার হেজেস এলেন বাংলায় বাণিজ্যের অধিকর্তা হিসাবে। হুগলিতে নির্মাণ করা হলো হেজেসের জন্যে এক প্রাসাদ। মাদ্রাজ থেকে সৈন্য এনে মোতায়েন করা হলো তার দেউড়িতে। সেই প্রথম কোনও ইংরেজ সেনা পা রাখলো বাংলার মাটিতে। বাংলা বিহার উড়িষ্যার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রমরমা ব্যবসা চালু হলো ইংরেজদের।

এই যে ফরমান জারি হয়েছিলো দিল্লী থেকে, তার অনেক ব্যাপারই ছিলো গোলমেলে। মাঝেমাঝেই এ নিয়ে ইংরেজ আর সুবেদারের বিবাদ বাধতে লাগলো। সেই সময় বিহারে এক ছোটখাট ঝামেলায় বিহারের এক জমিদার সেখানকার সুবেদারকে আক্রমণ করায় পাটনা কুঠির অধ্যক্ষ মিস্টার পীকককে জেলে ভরে দেওয়া হলো এই অভিযোগে যে, সেও এর পেছনে কলকাঠি নেড়েছে। কামানের গোলায় ব্যবহার হয় সল্টপিটার বলে এক রাসায়নিক বস্তু, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার একচেটিয়া বাণিজ্য করে। ব্যবসার রমরমা দেখে আর এক বিদেশী কোম্পানীও ঐ বস্তুটি বিক্রী শুরু করলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর এই ব্যবসা পড়তে থাকে। সেই সময় অন্য ঝুটঝামেলা বাংলায় না হয়, তা নিশ্চিত করতে এরা হুগলী নদীর মুখে এক দুর্গ বানানোর অনুমতি চাইলো। শায়েস্তা খাঁ এসব বেয়াদপি বরদাস্ত করবেন কেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেই অনুরোধ নাকচ তো করলেনই, উপরন্তু এই বেয়াড়া অনুরোধের জবাব হিসাবে বাংলায় ব্যবসা করার জন্য বার্ষিক প্রদেয় যে তিন হাজার টাকা কর, তার ওপর আরো শতকরা সাড়ে তিন টাকা সারচার্জ হেঁকে বসলেন। 

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাংলার ব্যবসা দেখার দায়িত্বে তখন জব চার্ণক নামে এক ইংরেজ। তাঁর জন্ম ১৬৩০ সাল নাগাদ ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ার অঞ্চলে। ছাব্বিশ বছর বয়সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজ নিয়ে ভারতে আসার বছর দেড়েক পরে তিনি এই কাশিমবাজার কুঠিতে বার্ষিক কুড়ি পাউন্ড বেতনে সাধারণ কর্মী হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। কাশিমবাজার থেকে পদোন্নতি হয়ে তিনি গেলেন পাটনায়। এখানে তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হলো। পাটনার গঙ্গাতীর ধরে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরছিলেন চার্ণক তাঁর সঙ্গী জো-এর সঙ্গে। হঠাৎ এক শোরগোল শুনে তাঁর দৃষ্টি গেলো দূরের এক প্রান্তে, সেখানে গঙ্গাতীরে চিতা জ্বলছে, তাতে শায়িত এক বৃদ্ধের মরদেহ। জনতা শোক করছে না, তারা ঐ একই চিতায় তুলে দিতে চায় আরও দুজন মহিলাকে, তার মধ্যে একজন তো নেহাৎই বালিকা। মুহূর্তের মধ্যে চার্ণক বুঝে গেলেন কী হচ্ছে। তিনি শুনেছেন এদেশের এই প্রথার কথা। জনতার মধ্যে তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘স্ক্যাটার দ্য ফ্যাকটর্স। দ্য পেল্‌ উইডো ইজ মাইন। জো, দ্য লিটল ব্রাউন গার্ল ইজ ফর ইউ।’’

নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া সেই পেল্‌ উইডো – বামুনের ঘরের মেয়ে আর সদ্য স্বামীহারা বৌ – চার্ণকের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে গেলো, চার্ণক তার নাম দিলেন মারিয়া। 

পনেরো বছর চাকরি করে চার্ণকের মাইনে শুরুর সময়ের দ্বিগুণ হয়ে বছরে হলো চল্লিশ পাউন্ড, আর তার চার বছর পরে আরো কুড়ি পাউন্ড গ্রাচুইটি দিয়ে বছরে ষাট পাউন্ড। আরো চার বছর পরে, ১৬৮০ সালে ফের তাঁর প্রত্যাবর্তন কাশিমবাজারে কুঠির প্রধান হয়ে, তখন তিনি এই অঞ্চলের সেকেন্ড অফিসার। প্রায় তিন দশক কাজ করে নিজের প্রতিভাবলে চাকরিতে উন্নতি করে করে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাংলার এজেন্ট হলেন, হুগলিতে হলো তাঁর অফিস। ততদিনে একের পর এক চারখানা কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়ে কুড়ি বছর সংগ্রামী সংসার করে মারা গেছে মারিয়া। কলকাতার নরম জলা জায়গার প্রাচীনতম ইঁটের বাড়ি সেন্ট জন চার্চ প্রাঙ্গনে তাকে কবরস্থ করা হয়েছে। প্রতি বছরে স্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকীতে চার্ণক সেখানে গিয়ে একটা করে মুরগি জবাই করেন পঞ্চপীরের ভক্ত স্ত্রীর বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধায়।

এদিককার কাউন্সিলের চার্ণকই তখন প্রধান, রিপোর্ট করেন মাদ্রাজের ওপরওলাদের কাছে সরাসরি, তারা জানে জব চার্ণক হচ্ছে এক উদ্ধত গোঁয়ার, সে নিয়ে তাদের মধ্যে হাসাহাসিও কম নয়। শায়েস্তা খাঁ বাংলায় অতিরিক্ত কর বসাতে চার্ণক রেগে গিয়ে মোগলদের এক আড়তে গোলাগুলি চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেন। সেই প্রথম মোগলদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের যুদ্ধ। শায়েস্তা খাঁ ভীষণ চটে গিয়ে হুগলীর মোহনা থেকে ইংরেজদের জাহাজ ফিরিয়ে দিলেন মালপত্র ওঠানামা না করতে দিয়েই। সেটা ১৬৮৫ সাল। মোগলদের ভয়ে জব চার্ণক বাধ্য হয়ে কুঠি ছেড়ে পালালেন, প্রথমে চট্টগ্রামে, পরে সেখান থেকে মাদ্রাজে নিজেদের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ কুঠিতে।

ক্রুদ্ধ ইংরেজ কোম্পানী তাদের রাজা দ্বিতীয় জেমসকে অনুরোধ করলো তাদের যেন সেনা নিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়, তারা প্রয়োজনে যুদ্ধ করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখবে। মোগলদের শত্রু আরাকানের রাজার সঙ্গে তলে তলে আঁতাত করে ঠিক হলো নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল নিকলসন রণতরী নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর আক্রমণ করে দখল করে নেবেন, সেখানে হবে ইংরেজ ঘাঁটি। তারা সেখানে টাঁকশাল প্রতিষ্ঠা করবে, রাজস্ব আদায় করবে। তারপর সেখান থেকে তারা এগিয়ে আসবে ঢাকায় আর সেটাও দখল করে নেবে। ইংরেজরা ধরেই নিলো এর ফলে বাংলার সুবেদার বাধ্য হবেন ঢাকা চট্টগ্রাম ছেড়ে পালাতে, আর সন্ধিপ্রস্তাব নিয়ে তাদের বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অনুমতি দেবেন। জব চার্ণক তখন মাদ্রাজে। তাঁকে বলা হলো ৪০০ সৈন্য নিয়ে নিকলসনের সঙ্গে চট্টগ্রামে যোগ দিতে। 

কাজের সময় ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ অন্যরকম হলো। বঙ্গোপসাগরে এক ভয়ঙ্কর নিম্নচাপে উঠলো তীব্র ঝড়, উল্টোপাল্টা হাওয়ায় নৌবহর দিক ঠিক রাখতে পারলো না। চট্টগ্রামের বদলে পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে দু পক্ষই হাজির হলো হুগলির মোহানায়। তাতে অবশ্য তাদের খারাপ কিছু হলো না, বাংলা উপকূলে এতগুলো বিদেশী যুদ্ধজাহাজ দেখে শায়েস্তা খাঁ একটু ভড়কে গেলেন। তিনি ইংরেজদের কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠালেন। 

শান্তি অবশ্য বেশিদিন বজায় রইলো না। কিছু ইংরেজ সেনা শায়েস্তা খাঁর সেনাদের সঙ্গে অভব্যতা করায় বেধড়ক পিটুনি খেলো। বদলা নিতে অ্যাডমিরাল নিকলসন গোলাবর্ষণ করে জ্বালিয়ে দিলেন পাঁচশোর বেশি ঘরবাড়ি, তিরিশ লক্ষ টাকার ওপর ক্ষয়ক্ষতি হলো সেই গোলাগুলিতে। শায়েস্তা খাঁ প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ইংরেজদের সোজা বলে দিলেন বাংলা থেকে পাততাড়ি গোটাতে। আদেশ দিলেন সমস্ত কুঠি ভেঙে দিতে, সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে। সেনা পাঠালেন হুগলি ছেড়ে ইংরেজদের ভাগিয়ে দিতে। 

চার্ণক প্রমাদ গণলেন। হুগলীতে থাকা বিপদ, শায়েস্তা খাঁর সেনাবাহিনীর সাথে তাঁদের পেরে ওঠার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ১৬৮৬ সালের শেষদিক সেটা। সপরিবার চার্ণক হুগলী ছেড়ে নেমে এলেন দক্ষিণে এক গ্রামে। এই গ্রামের তিনদিক ঘেরা জলাভূমিতে, পশ্চিমে বইছে গঙ্গা। তাঁর সৈন্যদের জ্বর, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া জাহাজগুলোর ভালোরকম মেরামত দরকার। এই সময় কোনোভাবেই যুদ্ধ-টুদ্ধ করার উপায় নেই। চট্টগ্রাম আক্রমণের প্ল্যান বাতিল, এই গ্রামেই যে করে হোক কিছুদিন কাটাতে হবে। দিল্লীর সম্রাটের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে চিঠি লিখলেন তিনি, অনুরোধ করলেন আগের ফরমান যেন পুনর্বহাল করা হয়। সম্রাটের আদেশে শায়েস্তা খাঁ এদের সাথে শান্তির চুক্তি করে নিলেন। 

তবে শায়েস্তা খাঁ ব্রিটিশদের একদম পছন্দ করতেন না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ব্যাটাদের মতিগতি ভালো না। তাই পরের বছর ফেব্রুয়ারীতে আবার বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে হুগলী এলেন ইংরেজদের উৎখাত করে দিতে। চার্ণক দেখলেন এই গ্রামেও থাকা যাবে না, পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন হিজলি দ্বীপে। হিজলি বঙ্গোপসাগরে এক নগণ্য দ্বীপ, মূলতঃ জলাভূমি। মশার চাষ হয় সেখানে, সাপ আর বাঘের উপদ্রবও কম না। বসবাসের উপযোগী নয় মোটেই। শায়েস্তা খাঁর সৈন্য অতদূরে তাদের খেদাতে এলো না বটে, কিন্তু তিন মাস সেখানে থেকে জব চার্ণকের অর্ধেক সৈন্য কেউ অসুখে ভুগে, কেউ সাপে কেটে, কেউ বাঘের পেটে চলে গেলো। যারা বাকি রইলো, তাদের অবস্থাও কহতব্য নয়।

দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। শায়েস্তা খাঁর কাছে ভিক্ষা চাওয়া ছাড়া আর গতি নেই। হঠাৎ ভাগ্যের চাকা কিছুটা ঘুরে গেলো চার্ণকের। রাজা দ্বিতীয় জেমস যখন নিকলসনকে চট্টগ্রামে পাঠিয়েছিলেন, একই সময়ে জন চাইল্ড নামে একজনের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয় বোম্বেতে কোম্পানীর যা সম্পত্তি ছিলো তা গুটিয়ে নিয়ে পশ্চিম উপকূলে মোগলদের সঙ্গে সমুদ্রে লড়াই করার। বোম্বেতে ইংরেজদের অনেক আগে এসেছিলো পর্তুগীজরা, ঘাঁটি ছিলো তাদেরই। ১৬৬১ সালে তাদের রাজকন্যা ক্যাথেরিন অফ ব্র্যাগাঞ্জার বিয়ে হয় ইংল্যান্ডের রাজপুত্রের সাথে, বিয়েতে যৌতুক হিসাবে তারা বোম্বে দিয়ে দেয় ইংরেজ রাজাকে। রাজা আর বোম্বে নিয়ে কী করবে, তার স্বত্ব পেয়ে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী, ব্যবসার কারণে। এদিকে পশ্চিম উপকূল থেকে মুসলমান রাজত্বে প্রতি বছর হজ করতে পুণ্যার্থীদের মক্কা পাঠানো হতো সমুদ্রপথে। জন চাইল্ড তাদের ওপর অতর্কিত হামলা শুরু করতেই দিল্লীশ্বর আওরঙ্গজেব প্রমাদ গুণলেন। তিনি চান না পুণ্যকামী মুসলমানেরা ইংরেজদের হাতে আরব সাগরে বিপদে পড়ুক। শায়েস্তা খাঁকে ডেকে বললেন ইংরেজদের সঙ্গে সমঝোতা করে নিতে। ফলে ১৬৮৭ সালের মাঝামাঝি শায়েস্তা খাঁ জব চার্ণককে ডেকে সন্ধির প্রস্তাব দিলেন। চার্ণকের কাছে এ তো মেঘ না চাইতেই জল! 

শায়েস্তা খাঁ অবশ্য ইংরেজদের বাড়াবাড়ি করতে দিতে রাজি নন, তিনি এদের চরিত্র ভালোই জানেন। পরিষ্কার বলে দিলেন, দ্যাখো বাপু, বাংলায় বিজনেস করতে চাও, করো, কিন্তু থাকতে হবে উলুবেড়িয়ায়, তার উত্তরে কোনো স্থাবর সম্পত্তি বানানোর চেষ্টা করোনা। করলেই আমি ভেঙে দেবো। এর আগে চার্ণক যে গ্রামে আশ্রয় গেড়েছিলেন কিছুদিন, উলুবেড়িয়া তারও দক্ষিণে, নদীর পাড়ে ছোট্ট গ্রাম। সেখানে ইংরেজরা ঘাঁটি গাড়তে পারে, তবে তাদের রণতরী যেন হুগলী নদীতে বিলকুল না ঢোকে, শায়েস্তা খাঁ পইপই করে বলে দিলেন তাদের। চার্ণক এসে হাজির হলেন উলুবেড়িয়ায়, সেখানে একটা জাহাজঘাটা বানানোর কাজ শুরু করলেন। কিন্তু জায়গাটা তাঁর মনঃপূত হলো না একেবারেই। এর চেয়ে সেই গ্রামটা অনেক ভালো। মনে মনে চার্ণক তাকে পছন্দ করে ফেলেছেন। সেখানে ফেরার আবেদন জানাতেই শায়েস্তা খানের হুমকি ভেসে এলো – খবরদার! ওখানে ঘাঁটি হারগিজ বানাবে না।

এই যে গ্রামটা চার্ণকের এত পছন্দ হয়ে গেছিলো, তার কারণ আর কিছুই না, এর তিনদিক ঘেরা জলাভূমি। অনেককাল আগে এখনকার ব্যান্ডেল আর ত্রিবেণীর মাঝামাঝি হুগলি নদীর পশ্চিমতীরে সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁ ছিলো এক বিরাট বন্দর। নদীর ভাটিতে একই পাড়ে ছিলো বেতড় নামে এক গ্রাম – এখন যাকে ব্যাঁটরা বলা হয় - সে ছিলো এক উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যকেন্দ্র। এখানে পথিকেরা কেনাকাটা করতো, মা চন্ডীর পূজা দিতো। ১৫৩০ সাল নাগাদ বাংলায় পর্তুগীজদের যাতায়াত শুরু হয়, তখন মোগল আমল সবে শুরু হয়েছে, দিল্লীর গদিতে বাবর। বাংলা প্রদেশে তখন দুটো প্রধান বাণিজ্যিক বন্দর – চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রাম। পর্তুগীজরা চট্টগ্রামকে বলত Porto Grande বা Great Haven আর সপ্তগ্রামকে বলত Porto Piqueno বা Little Haven। টালির নালা বা আদিগঙ্গা ছিলো সমুদ্রে যাতায়াতের পথ। সমুদ্রগামী বড়োবড়ো জাহাজগুলো এখনকার গার্ডেনরীচ অঞ্চলে নোঙর ফেলতো। কেবলমাত্র দেশি ছোটো নৌকাগুলোই হুগলি নদীর আরো উজানের দিকে চলাচল করতে পারতো। 

১৫৮০ সালে, মানে চার্ণকের এই সময়ের একশো বছর আগে, চুঁচুড়াতে পর্তুগীজরা একটা নতুন বন্দর স্থাপন করে। তার কিছু সময় পরে সাতগাঁয়ের দেশী বণিকরা নতুন আর একটা বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপনের দরকার মনে করলেন। তাঁদের অধিকাংশই হুগলিতে বসবাস শুরু করলেন, কিন্তু চারটে বসাক পরিবার আর একটা শেঠ পরিবার বেতড়ের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে নদীর পূবদিকে এক গ্রামের পত্তন করেন, সেখানে অধিবাসীরা বৈষ্ণবমতে গোবিন্দের পুজো শুরু করলো ঘরে ঘরে। সে গ্রামের নাম হয়ে গেলো গোবিন্দপুর। তার ঠিক উত্তরের গ্রামে চলে শক্তির উপাসনা। এখানে এক বহুকালের পুরনো কালীমন্দির আছে। তার জন্যেই হয়ত এর নাম কালীক্ষেত্র। লোকমুখে বদলাতে বদলাতে সে তখন হয়ে গেছে ডিহি কলকাতা। এই গ্রাম একেবারে গণ্ডগ্রাম নয় ঠিক, দুশো বছর আগে স্থানীয় কবি বিপ্রদাস পিপলাই মনসামঙ্গল নামে কাব্য লিখেছেন, সেখানে এই গ্রামের উল্লেখ আছে। তাতে লেখা ছিলো, চাঁদ সদাগর সপ্তগ্রাম বন্দরে যাওয়ার পথে সেখানকার কালীঘাটের মন্দিরে গিয়ে মা কালীর পুজো দিয়েছিলেন। গঙ্গার ধারে ডিহি কলকাতার উত্তরেই চার্ণকের পছন্দের গ্রাম। সেখানকার মানুষজন অধিকাংশই তাঁতী, তাঁতে সুতো কেটে কাপড়চোপড় বানায় তারা, গ্রামের নাম সুতানুটি। তাদের সুতোর হাট বসে কাছেই এক বাজারে, এরা তাকে বলে বড়োবাজার। তাঁতী ছাড়াও বেশ কয়েক ঘর জেলে, মালো, কৈবর্ত জাতির লোক আছে এখানে আর ব্যবসায়ী কিছু নিচু জাতের বণিক। তারা স্বর্ণবণিক বা গন্ধবণিক নয়, তাদের পদবী পোদ। 

এক জায়গায় এতগুলো ঘর, কিন্তু তাদের পুজো আচ্চার জন্যে ব্রাহ্মণ পেতে যেতে হতো সেই ডিহি কলকাতার কালীমন্দিরে। কয়েক মাস আগে মহেশ্বর কুশারী নামে এক প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ ভাগ্যান্বেষণে পূবদিকের বাস উঠিয়ে এখানে কাজকর্ম খুঁজতে এসেছেন, সঙ্গে যুবক পুত্র পঞ্চানন আর ভাই শুকদেব। ব্রাহ্মণ বলে সুতানুটি-গোবিন্দপুরের মানুষজন তাদের খাতিরযত্ন করে নিয়ে গেছে তাদের গ্রামে, সেখানেই একটা চালা উঠিয়ে বাস শুরু করেছেন তাঁরা। গঙ্গার ধারে বিদেশী জাহাজের আনাগোনা লেগেই থাকে। জাহাজে মালপত্তর ওঠানো-নামানোর তদারকি করে দু’পয়সা আয় হয়। লেখাপড়া জানা ব্রাহ্মণ, তাঁরা বিদেশীদের সঙ্গেও কথাবার্তা বলতে পারেন দেখে গ্রামের মানুষ বেশ সম্ভ্রম করে তাঁদের। যাক, এতদিনে তাদের পুরুতঠাকুর পাওয়া গেছে। পুজোর আচার আচরণ বা মন্ত্র-তন্ত্র তাঁদের যে মুখস্থ ছিলো তা নয়, তবে অশিক্ষিত এদের কাছে নাই মামার চেয়ে কানা মামা তো ভালো। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জাহাজে মাল সরবরাহের তদারকি থেকে পাওয়া টাকা আর গ্রামের মানুষের বদান্যতায় গোবিন্দপুরে গঙ্গার ধারে জমি কিনে তাঁদের পাকা বাড়ি উঠে গেলো, প্রতিষ্ঠা হলো পারিবারিক শালগ্রাম শিলারও। সুতোর কারবার ভালো হলে গ্রামবাসীরা কলাটা মুলোটা এনে দিয়ে যায় তাদের পুরোহিত পঞ্চানন ঠাকুরকে।

জব চার্ণক দেখলেন, এই গ্রামগুলোর পশ্চিমে গঙ্গা আর পূব-দক্ষিণে দুর্গম জলাভূমি। কেবলমাত্র উত্তর-পূর্ব অংশে প্রহরার দরকার। জায়গাটা বেশ সুরক্ষিত। তিন গ্রাম মিলিয়ে জনপদ তেমন বেশি না। ব্যবসার জন্যে কুঠি বানাতে হলে এ বেশ ভালো জায়গা। কিন্তু উপায় কী! পিছনে পড়ে গেছে এখানকার সুবেদার শায়েস্তা খাঁ, হুমকি দিচ্ছে তাদের হটিয়ে দেবে।

শুধু হুমকিই নয়, এর সঙ্গে শায়েস্তা খাঁ ঐ আবেদন করার জন্যে চার্ণকের কাছ থেকে এক মোটা অঙ্কের জরিমানা দাবি করে বসলেন। অন্য সময় হলে চার্ণকের রক্ত গরম হয়ে যেতো, অবিলম্বে গোলাগুলি চালিয়ে বসতেন হয়তো, কিন্তু এখন সময় খারাপ, শায়েস্তা খাঁর সেনার সঙ্গে লড়াই করার মত পর্যাপ্ত ক্ষমতা নেই, তিনি ঢাকায় দূত পাঠালেন সুতানুটিতে কুঠি বানানোর অনুরোধের ব্যাপারটা পুনর্বিবেচনা করে দেখার জন্যে। তিনি সেখানে একটা দুর্গ বানাতে চান, কেবলমাত্র নিজেদের ব্যবসা সুরক্ষিত রাখতে। 

ওদিকে চট্টগ্রাম লুঠতে পাঠানো নিকলসনের ভরাডুবির খবর ইংল্যান্ডে পৌঁছাতে ইংরেজরা বুঝে গেলো গঙ্গার ধারে একটা শক্তপোক্ত দুর্গ না বানাতে পারলে বাংলায় ব্যবসা বাণিজ্যে যে কোনো সময় গণেশ উলটানো থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। সবসময় বাংলার সুবেদারদের মুখ চেয়ে থাকতে হবে, তাদের যা মর্জি হবে, সেটাই তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। এইভাবে কি ব্যবসা চলে? ক্যাপ্টেন হীথ বলে একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হলো, তিনি যেন হয় সুবেদারকে যুদ্ধে পরাস্ত করে ব্যবসা প্রশস্ত করেন, অথবা তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঘরের যাবতীয় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাংলা মুলুক ছেড়ে মাদ্রাজে ফিরে যান। এই দুরূহ কাজের জন্যে তাঁকে দেওয়া হলো একশো ষাট জন সৈন্য।

হীথ বাংলায় এলেন ১৬৮৮-র অক্টোবরে। সেখান থেকে যাবতীয় ইংরেজ মানুষ জাহাজে বোঝাই করে চললেন উড়িষ্যার বালেশ্বরে। ৮ই নভেম্বর সেখানে পৌঁছে আচমকা তুমুল গোলাবর্ষণ করে শহর ছারখার করে দিলেন। নিজেদের ফ্যাক্টরিও গেলো তছনছ হয়ে। উড়িষ্যার সুবেদারের জেলে যেসব ইংরেজ সেনা ছিলো, তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে বালেশ্বর থেকে সব্বাইকে নিয়ে ১৩ই ডিসেম্বর রওনা দিলেন চট্টগ্রামের দিকে। ১৭ই ডিসেম্বর পৌঁছালেন সেখানে, কিন্ত যা দেখলেন, তাতে তাঁর প্ল্যান চৌপাট হয়ে গেলো। দেখলেন, সেখানকার মোগল ঘাঁটি ভয়ানক সুরক্ষিত, তাতে দাঁত ফোটানোর ক্ষমতা মুষ্টিমেয় ক’জন ইংরেজ সেনার নেই। সুবেদারকে চিঠি পাঠালেন গঙ্গার ধারে দুর্গ বানানোর অনুমতি চেয়ে, কিন্তু সেখান থেকে জবাব আসার আগেই আবার দলবল নিয়ে যাত্রা করলেন আরাকানের পথে। উদ্দেশ্য, আরাকানের রাজার সঙ্গে হাত মিলিয়ে লড়াই করবেন মোগলদের বিরুদ্ধে। আরাকান রাজা মোগলদের শত্রু, তাই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। 

পরের বছর, মানে ১৬৮৯ সালের ৩১শে জানুয়ারি ক্যাপ্টেন হীথ পৌঁছালেন আরাকানরাজ্যে। রাজার কাছে সন্ধিপত্র পাঠালেন ঢাকায় একত্রে মোগলবিনাশের বার্তাসহ। এক পক্ষকাল কেটে যেতেও আরাকানের রাজার কোনো উত্তর না পেয়ে বিরক্ত হীথ ৪ঠা মার্চ তল্পিতল্পা গুটিয়ে মাদ্রাজে ফিরে চলে গেলেন। বাংলা জয়ের স্বপ্ন তাঁর অধরাই থেকে গেলো। 

শুধু তাই নয়, আওরঙ্গজেব যেই দেখলেন ইংরেজ মাদ্রাজে ঘাঁটি শক্ত করছে, আশেপাশে তাদের প্রতিপত্তি বাড়াচ্ছে, তাঁর শত্রু শিবাজীর বড়ছেলে সম্ভাজীরাওয়ের সঙ্গে আঁতাত করছে, মোগলদের জাহাজ আক্রমণ করছে, তিনি নির্দেশ দিলেন ব্যাটাদের ভারত থেকে সমূলে উৎখাত করার। যেখানেই ইংরেজদের সম্পত্তি দেখা যেতে লাগলো, সব মোগল সেনাদের হাতে চুরমার হতে লাগলো। বিশাখাপত্তনমে তাদের ফ্যাক্টরি চুরমার হয়ে গেলো। ইংরেজ সেনা ধরা পড়লেই মৃত্যুদণ্ড। শায়েস্তা খাঁ ঢাকাতে যে কজন ইংরেজ সেনা ছিলো, তাদের তাড়া করে ধরে জেলে পুরে দিলেন। 

সেই বছরই শায়েস্তা খাঁ বাংলার সুবেদার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর জায়গায় আওরঙ্গজেব বাংলায় পাঠালেন দ্বিতীয় ইব্রাহিম খাঁকে। আওরঙ্গজেব তখন বিজাপুরে। সেখান থেকে তিনি খবর পাচ্ছেন আরব সাগরে ইংরেজরা মক্কাগামী জাহাজে লুটপাট চালাচ্ছে। ওদিকে সারা দেশ থেকে ইংরেজদের ভাগিয়ে দেওয়ার ফলে তাদের কাছ থেকে রাজস্ব বাবদ যা টাকাপয়সা পাওয়া যাচ্ছিলো, তাও আসছে না। তিনি ভাবলেন, কাজটা ঠিক হলো না, এদের সঙ্গে মানিয়ে চলাই ভালো, ফোকটে কিছু রোজগার তো হয়। ইংরেজরাও তো চায় ব্যবসা বাড়াতে। সেই জন চাইল্ড এলেন দিল্লীতে। সম্রাটের সঙ্গে কথাবার্তা হলো। ইব্রাহিম খানের কাছে নির্দেশ গেলো বাংলায় ইংরেজদের ব্যবসার অনুমতি দেওয়ার। তিনি জব চার্ণককে ডেকে পাঠালেন। 

ধুরন্ধর চার্ণক মোগলদের ব্যাপারটা আঁচ করেছিলেন ভালোই। তিনি এত সহজে আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি হলেন না। বললেন, আগে সম্রাটের ফরমান নিয়ে এসো, তাতে যেন সমস্ত শর্তাবলি লিপিবদ্ধ করা থাকে। ফরমান ছাড়া ব্যবসা শুরু করলেই সুবেদারের লোকজন পেছনে পড়ে যায় ফেউ-এর মতন, অশান্তির একশেষ, তা তিনি চান না। ইব্রাহিম খাঁ বললেন, ঠিক আছে, তাই হবে, সম্রাটের স্পেশ্যাল ফরমান আনিয়ে নেওয়া যাবে, তবে তাতে দু-তিন মাস সময় তো লাগবে। তুমি বাপু চলে এসো বাংলায়, আগের মতই বিজনেস শুরু করে দাও। বুঝতে পারছি শায়েস্তা খাঁ তোমাদের শায়েস্তা করার জন্যে সব ভাংচুর করে দিয়েছে। আমি তার জন্যে আশি হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছি। 

এ তো গাছে না উঠতেই এক কাঁদি! জব চার্ণক যেন হাতে চাঁদ পেলেন। মাত্র তিরিশজন সৈন্য নিয়ে জলা ডিঙিয়ে ফিরে এলেন তাঁর এককালীন অজ্ঞাতবাসের ক্ষেত্র সেই সুতানুটি গ্রামে। ২৪শে অগাস্ট ১৬৯০ সালে সুতানুটির হুগলীর তীরে ইংরেজদের পতাকা উত্তোলন করা হলো। বছর ঘোরার আগেই সম্রাটের ফরমান এসে গেলো হাতে। বাংলায় কোনোরকম শর্ত ব্যতিরেকেই তাঁদের ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে তাতে, আর এর জন্যে বার্ষিক তিন হাজার টাকার বেশি এক পয়সাও কর দিতে হবে না। ইংরেজদের পুরো পোয়াবারো।

বড় করিৎকর্মা লোক এই চার্ণক। নোঙর ফেলার চারদিন পরেই শুরু হলো কাউন্সিল মিটিং। দেখা গেলো, আগে যখন তাঁদের এখানে বসতি ছিলো, তার সবই প্রায় গেছে। আবার বাড়ি তৈরী করতে হবে। ভাঁড়ে মা ভবানী, সুতরাং সস্তা বাড়ি বানাতে হবে, মাটির দেওয়াল, খড়ের চালওলা। ফ্যাক্টরির জন্যে জমি চাই, যতদিন তা না পাওয়া যায়, ততদিন কোনোরকম করে চালাতে হবে।

সেই খড়ের চালের বাড়িও আগুন লেগে পুড়ে গেলো একদিন। তার জায়গায় লোকের কাছে টাকা ধার করে তোলা হলো পাকা বাড়ি, সেটাও বেশিদিন ধরে রাখা যায়নি টাকা শোধ দিতে না পারায়। নিলামে সে বাড়ি বিক্রি হয়ে গেলো ৫৭৫ টাকায়। চার্ণক বাস করতে লাগলেন নৌকায় দলবল এবং কন্যাদের নিয়ে। কাউন্সিলের মিটিং, আড্ডা আর ব্যবসাপাতি সব হতো এক প্রাচীন বটগাছতলায়। 

খুব বেশিদিন অবশ্য চলেনি এসব। সুতানুটিতে ফিরে আসার দেড় বছর পরে ১৬৯২ সালের ১০ই জানুয়ারি জব চার্ণকের মৃত্যু হয়। তার আগে পর্যন্ত যতবার ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধির কথা তুলে বাংলায় তাঁদের কুঠিকে দুর্গ বানাতে চেয়েছেন, ততবার বাধা পেয়েছেন ইব্রাহিম খানের কাছ থেকে। কিন্তু চার্ণকের মৃত্যুর বছর তিনেক পরে হঠাৎ শোভা সিং আর রহিম খাঁ নামে দুজন স্থানীয় বিদ্রোহী হুগলী শহর দখল করে নেয়। ইংরেজরা তখন তাদের সুতানুটির ঘাঁটি সুরক্ষিত করতে নিজস্ব সৈন্য মোতায়নের দাবি তোলে আবার। ইব্রাহিম খাঁ ঘাঁটি সুরক্ষার প্রস্তাব মেনে নেন, কিন্তু তার জন্যে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েনের ব্যাপারে সায় দেননি। ইংরেজরা অবশ্য সুরক্ষার প্রস্তাবে সায় দেওয়াকেই তাদের সপক্ষে যুক্তি ধরে নিয়ে রাতারাতি দুর্গ বানানো শুরু করে দেয়। মাদ্রাজ থেকে জাহাজে নিয়ে আসা হয় দুর্গ বানানোর জন্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলে এই কাজ, তৎকালীন ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়মের নামে এই দুর্গের নাম রাখা হয় ফোর্ট উইলিয়াম। 

সেই যে রাজা আদিশূর, যিনি যজ্ঞ করতে গিয়ে দেখলেন বাংলায় বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ নেই, তাই কনৌজ থেকে আনিয়েছিলেন পাঁচজন ব্রাহ্মণ, যাঁরা বাংলাতেই থেকে গেলেন আর তাঁদের থেকেই শুরু হলো বাংলায় যাবতীয় বামুনকুল, তাঁদের একজনের নাম ছিলো বেদগর্ব, তিনি সাবর্ণগোত্রীয়। তাঁর এক উত্তরসূরী পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায় যুদ্ধে বীরত্ব দেখিয়ে মোগল সম্রাট হুমায়ূনের কাছ থেকে খান উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁর নাম হয়ে যায় পাঁচু শক্তি খান। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি তিনি এক বিশাল প্রাসাদ বানান গঙ্গার ধারে, সে জায়গার নাম রাখেন হাভেলি শহর। লোকমুখে এর নাম হয়ে যায় হালিশহর, সেখান থেকে গঙ্গোপাধ্যায় পরিবার ছড়িয়ে পড়ে উত্তরপাড়া, বিরাটি, বড়িশা প্রভৃতি অঞ্চলে। সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ায় রাজা মানসিংহের আমলে এই পরিবারের লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় এক বিশাল ভূসম্পত্তির জায়গীর বা জমিদারি পান, তার সঙ্গে পান রায়চৌধুরী খেতাব। হালিশহর থেকে বড়িশা রাস্তা বানিয়ে দেন তিনি আর স্থাপন করেন প্রচুর মন্দির। লক্ষ্মীনারায়ণের পরে তাঁর বংশের সবাই রায়চৌধুরীকেই পারিবারিক পদবি বানিয়ে নেয়, তাদের বলা হয় সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার। এই পরিবারের অধীনে ছিলো চার্ণকের পছন্দের সুতানুটি, তার দক্ষিণে ডিহি কলকাতা আর তার দক্ষিণে গোবিন্দপুর গ্রামের জমিদারিও। 

জব চার্ণক মারা যাওয়ার ছ’বছর পরে তাঁর বড়মেয়ে মারির বর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী চার্লস আয়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কাছ থেকে এই তিন গ্রামের জমিদারির স্বত্ব কিনে নেন কোম্পানীর তরফে। ইংরেজ প্রথামাফিক মুঘল রাজদরবারে প্রভূত ঘুষ দিয়ে ও বার্ষিক তেরোশো টাকা রাজস্বের বিনিময়ে এই তিন গ্রামের স্বত্ত্ব ইংরেজদের দিয়ে দেওয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ফার্সিভাষায়। ইংরেজদের উচ্চারণে কলকাতা হয়ে যায় ক্যালকাটা। একদা এক দুর্গম, জলা, প্রায়-পরিত্যক্ত তিন অজগাঁ একত্র করে পত্তন হয় ভারতের নিকট-ভবিষ্যতের রাজধানী ক্যালকাটা প্রেসিডেন্সির। (ক্রমশ)

1 comments:

15

ধারাবাহিক - স্বপন দেব

Posted in


ধারাবাহিক


আমার বারুদ-বেলা—১৩
স্বপন দেব


দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই সি পি আই এম সহ অন্যান্য বামপন্থী নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু যেহেতু তখন সি পি এম-নকশাল বিরোধ তুঙ্গে তাই তাদের আলাদা জেলে বা আলাদা ওয়ার্ডে রাখা হত। মার্চ মাসে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের পতন ঘটল, আর রাষ্ট্রপতি শাসন চলা কালেই তেসরা জুন, ১৯৭০ অমিতাভ সিনহা রয় নামে স্পেশ্যাল ব্র্যাঞ্চের এক নিষ্ঠুর এবং অত্যাচারী ইন্সপেক্টরকে অখিল মিস্ত্রি লেনে শহুরে গেরিলারা খতম করে দিল। এটাই শহর কলকাতায়প্রথম বড় ধরণের ব্যক্তিহত্যা বা খতম। প্রশাসন স্বাভাবিক ভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়ল নকশালদের ওপর। ১১ই জুন, ১৯৭০ নিশীথ ভট্টাচার্যকে তাঁর গোপন আস্তানা বুদ্ধু ওস্তাগর লেন থেকে গ্রেফতার করা হয়, এবং চোদ্দ দিনের পুলিশী নৃশংসতার শিকার হয়ে শেষে তাঁকে বিচারাধীন বন্দী হিসেবে সাতখাতায় পাঠানো হয়। অধ্যাপক নিশীথ ভট্টাচার্য আসার পরে আমাদের জেল সংগঠন আরো মজবুত হয়। অধ্যাপক নিশীথ ভট্টাচার্যের কাছ থেকে জানা গেল যে, বাংলা-বিহার-ওড়িশার আঞ্চলিক কমিটি (B.B.O.B.R.C.) তৈরি হয়েছে ৬৯ সালের শেষেই এবং B.B.O.B.R.C. এর সদস্যরা ছিলেন –অসীম চ্যাটার্জি, ভবদেব মণ্ডল, সন্তোষ রানা, লেবাচাঁদ টুডু, প্রমুখেরা। এদের নেতৃত্বে তখন বাংলা-বিহার উড়িষ্যায় রীতিমতো অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে! সন্তোষ রানার কথায় সেই সময়ে গ্রামে নকশাল আন্দোলনের একটি পরিস্কার ছবি পাওয়া যায়। সন্তোষ রানার কথায় “B.B.O.B.R.C-র প্রথম সাকসেসফুল অ্যাকশন হয় সেপ্টেম্বর মাসের ২৭ তারিখে গোপীবল্লভপুর অঞ্চলে। এই লোকটি ছিল একজন জোতদার, মহাজনও বটে। এই লোকটির ঘরে সন্ধ্যের মুখে আমরা প্রায় তিরিশ-চল্লিশ জনের একটা স্কোয়াড গিয়ে তাকে খতম করে তার বন্দুক দখল করি। তার ঘর থেকে যে বন্ধকী জিনিসপত্র বেরোয় সেগুলি রাতের মধ্যেই আশেপাশের গ্রামে যাদের জিনিস তাদের বিলি করে দেওয়া হয়। এই ঘটনার পর ২৮ তারিখেবহড়াগুড়াতে অ্যাকশন হল। এই অ্যাকশনে অসীম চ্যাটার্জিরা নেতৃত্বে ছিল। জোতদার ভয়ে পালিয়ে যায় কিন্তু তার বন্দুক দখল করা হয়। এরপরেই মালগ্রাম অ্যাকশন। পরপর দুটো অ্যাকশন দুদিনে পাশাপাশি এলাকায় হওয়ায় গোটা এলাকায় জোতদারদের মধে এক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ২৭শে সেপ্টেম্বর হল নগেন সেনাপতি অ্যাকশন। এই অ্যাকশন টার পর থেকে সাঁওতালরা বড়ো আকারে আমাদের দলেযোগ দিতে লাগল। নভেম্বর মাসের সেকেন্ড উইকের মধ্যেই প্রায় ৫০ টি গ্রাম সংগঠিত হয়ে যায়। এই সময়ে সমস্ত জোতদারদের ধান আমরা কেটে নিলাম। সেটা একেবারে একটা অভ্যুত্থানের রূপ নিল। এতটা আমাদের হিসেবের মধ্যেও ছিলনা। যখন দেখছি যে লোকের উদ্যোগ বেড়ে যাচ্ছে, তখনই আমরা ডিসাইড করি, তাহলে বন্দুক ছাড়বো কেন? সেই সময় থেকেই বন্দুক সিজ করা শুরু হল। ‘এই তোমার ঘরে মুড়ি খাবো, মুড়ি দাও’। ‘এই তোমার বন্দুকটা আমাদের কাজে লাগবে, ওটা দাও’—জোতদাররা ভয়ে ঠকঠক করতে করতে দিয়ে দিত বন্দুক। কেউ বাধা দেয়নি। দুদিনেই নিয়ে এলাম এগারো খানা বন্দুক।”

এদিকে ১৯৭০ সাল থেকেই সি পি আই (এম এল) এর নেতা ও কর্মিদের প্রতি প্রচণ্ড দমন-পীড়ন নেমে আসে। সাধারণ ভাবে মিসা, ডি আই আর, পিডি অ্যাক্ট উপদ্রুত এলাকা ঘোষণা, ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা ছাড়াও মিথ্যা সংঘর্ষের নামে হত্যা, গণহত্যা, জেলহত্যা, গুম, খুন ইত্যাদি চলতে থাকল। ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাজ্যসভায় ঘোষণা করলেন---নকশালপন্থীদের শারীরিক ভাবে শেষ না করা পর্যন্ত লড়াই চলবে। ভাবুন একবার! একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে একটি রাজনৈতিক ভাবে স্বীকৃত পার্টির সদস্যদের খুনের হুমকি দিচ্ছেন! প্রায় এক ই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি প্রধান উপদেষ্টা বি বি ঘোষ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতর কে নকশাল দমনের জন্যে প্রচলিত আইনের বাইরেও অধিক ক্ষমতার জন্যে আবেদন করলেন। ১৯৭০ এর ৯ ই অক্টোবর ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ একটি দীর্ঘ প্রতিবেদনেজানাচ্ছে--- কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ, ‘র’( R.A.W.), ও প্রাদেশিক পুলিস কর্তাদের পরামর্শ মত নকশালপন্থীদের হত্যার জন্যে কতকগুলি খুনি স্কোয়াড গড়া হয়েছে এবং তাদের কিছু সাংকেতিক নাম দেওয়া হয়েছে। যেমন, ‘Ton TonMacaute’, ‘PapaDoc’ প্রভৃতি। পশ্চিমবঙ্গে তদানীন্তন পুলিসপ্রধান রঞ্জিত গুপ্ত, গোয়েন্দাপ্রধান দেবী রায়, অফিসার রুণু গুহনিয়োগী, তারাপদ বসু প্রমুখরনেতৃত্বে এই অভিযান চলতে থাকল। ১৯-০৮-৭০ এ সংঘটিত হল বারাসাত গণহত্যা। হাত বাঁধা ও অত্যাচারিত অবস্থায় বারাসাতের বড়ো রাস্তার ওপর পাওয়া গেল ৮ জন যুবকের মৃতদেহ। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার আড়িয়াদহের বাসিন্দা। জানা যায়—কানাই ভট্টাচার্য, যতীন দাস, সমীর মিত্র, গণেশঘটক, শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, তরুণ দাস, সমরেন্দ্র দত্ত ও স্বপন পাল কে খুন করে বেলগাছিয়া দুগ্ধ প্রকল্প বা হরিণঘাটার ভ্যানে চাপিয়ে বারাসাতের রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ২০-০৮-৭০ এর বেলেঘাটায় সি আই টি কোয়ার্টার ও আশেপাশের এলাকা থেকে নকশালপন্থী যুবকদের ধরে এনে খালপাড়ে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে মারা হয়। ১৯শে নভেম্বর ১৯৭০ সালের গভীর রাতে ওই এলাকায় ঘটেছিল একটি মর্মন্তুদ ঘটনা। ওইদিন রাতে পুলিশ ও সি আর পি এর প্রায় ১৫০০ জনের একটি দল ৪০টি পুলিশ ভ্যানে করে বেলেঘাটা অঞ্চলে চিরুণি তল্লাসী বা কুম্বিং অপারেশনে যোগ দেয়। ডি সি ডি ডি দেবী রায়ের নেতৃত্বে এই পুলিশ দলটি ৫৫৬ টি ফ্ল্যাটে হামলা চালিয়ে ৫০ জন যুবক কে গ্রেফতার করে তাদের পুলিশ ভ্যানে তুলে ‘বালুচর’ নামে এক নির্জন জায়গায় নিয়ে যায়। দেবী রায় তাদের মধ্যে অশোক, সাবু ও হাত বাঁধা তিন যুবকসহ কয়েকজনকে হত্যা করে। ভি কৃষ্ণ মেনন, বদরুদ্দোজা, বকর আলি মির্জা, হীরেনমুখার্জি, অরুণ প্রকাশ চ্যাটার্জি, সুহৃদ মল্লিক চৌধুরী, সলিল গাঙ্গুলি, শিবচন্দ্র ঝা ও জ্যোতির্ময় বসুকে নিয়ে যে সংসদীয় তদন্তকমিটি তৈরী হয়েছিল---উপরের রিপোর্টটি হচ্ছে তাঁদের দেওয়া রিপোর্ট। ২৬-০১-৭১ এ ঘটল ২৪ পরগনায় ডায়মণ্ডহারবারের গণহত্যা। ০১-০৬-৭১ এ হুগলীর কোন্নগরের কাছে কানাইপুর গ্রামে পাওয়া গেল ৯ জন যুবকের বিকৃত মৃতদেহ। মজে যাওয়া সরস্বতী নদীর পাড়ের কাছাকাছি একটা গণ কবর খুঁড়ে পুলিশ এখান থেকে উদ্ধার করে—হাওড়ার সীতারাম বসু লেন এর বাসিন্দা বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়, পঞ্চানন তলার মৃণাল ঘোষ ও পঙ্কজ শীল, গোলাবাড়ির বিশু মুখোপাধ্যায়, হাওড়ার ব্যানার্জি বাগান লেনের সুকুমার রায়, উত্তর ব্যাঁটরার বিমান বড়াল, হাওড়ার প্রদীপ নিয়োগী, লেকটাউনের তরুণ বসু এবং শালকিয়ার অসিতকুমার দাস-----এদের মাথা কাটা লাশ। পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী ---৩০শে মে, ১৯৭১ এই ৯ জন যুবক কোন্নগরে তাদের এক বন্ধুর বাড়িতে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিল। নকশালপন্থী সন্দেহে, সি পি এম এর কর্মিরা এদের হত্যা ও মুণ্ডচ্ছেদ করে প্রতিটি লাশের ওপর অ্যাসিড ও চুন ছড়িয়ে দিয়েছিল, যাতে এই লাশ গুলোকে শনাক্ত করা না যায়। এরপর পুলিশ ও মস্তানদের যৌথ পরিচালনায় ঘটল নারকীয় বরানগর-কাশীপুর গণহত্যা। ১৯৭১ এর আগস্টের ১২, ১৩, ১৪ তারিখ জুড়ে সমগ্র এলাকায় চলল হত্যালীলা। পুলিশ প্রশাসন, কংগ্রেস মস্তান ও সি পি এম যে পরস্পর এই হত্যাকাণ্ডে সহযোগী ছিল তা পুলিশ অফিসার রুণু গুহ নিয়োগীর স্বীকারোক্তি( সাদা আমি কালো আমি) থেকে স্পষ্ট। যদিও নকশালপন্থী সংগঠন গুলি ঠিক এই বক্ত্যব্যইদীর্ঘদিন ধরে বলে এসেছে। ‘নয়া ইস্তাহার’ ও তাদের সহযোগী সংস্থার যৌথঅনুসন্ধানে এইরকম ২৬ জনের নাম পাওয়া গেছে, যারা ছিলেন এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার। ১৯৭১ সালের আগষ্ট মাসের ৫ তারিখের মাঝরাতে পুলিশ দক্ষিণ কোলকাতার ৯বি, রাজা বসন্ত রায় রোডের বাসিন্দা অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে সি পি আই (এম এল) এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাসক ও পার্টি মুখপত্র ‘দেশব্রতী’র মুখ্য সংগঠক, সাংবাদিক ও কবি সরোজ দত্তকে গ্রেফতার করে। সেই দিন ই ভোর রাতে তাঁকে হত্যা করে মুণ্ডহীন অবস্থায় ময়দানে ফেলে আসে। মানবাধিকার সংগঠন Amnesty International এর হিসাব অনুযায়ী একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই ১৫০০০ থেকে ২০০০০ হাজার মানুষকে জেলে বন্দি করা হয়েছিল। তাছাড়া ৩০০০০ থেকে ৪০০০০ হাজার জনের মতো ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রুজু করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভায় রাজ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বিবৃতি থেকে জানা যায় তখন পর্যন্ত ১৭ হাজার সাত শো সাতাশি জন নকশালপন্থীকে জেলে আটক রাখা হয়েছে ( আনন্দবাজার, ১৭মার্চ, ১৯৭৩)। এছাড়া D.I.R. ও MISA তে ২০০০ জনকে আটক রাখা হয়েছে আর ১৭,৮০০ জনকে বিচারাধীন বন্দি হিসেবে আটকে রাখা হয়েছে ( The Statesman 1st January, 1973)। বাইরে যখন এইসব অত্যাচার আর তা রোখার পালা চলছে, তখন আমরা বরং আরেকবার জেলের ভেতরটা দেখেনি। তবে সেটা পরের কিস্তিতে (চলবে )।


15 comments:

0

ধারাবাহিক - বিশ্বনাথ রায়

Posted in


ধারাবাহিক


‘যাবনী-মিশাল ভাষা’র সন্ধানে - ৩
বিশ্বনাথ রায়



বাংলার সঙ্গে সংস্কৃত, হিন্দি, ব্রজবুলি, ফারসি প্রভৃতি ভাষার মিশ্রণ ঘটিয়ে কবিতা লেখার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন ভারতচন্দ্র। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনকান্ত দাস সম্পাদিত ‘ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলী’র শেষ দিকে যে-সব বিবিধ প্রকীর্ণ কবিতা আছে, তার মধবে সে প্রমাণ মিলবে। এরকম দু্’টি কাব্যাংশ উদ্ধার করলে বোঝা যাবে বিষয়টি:



ক.     যদি কিঞ্চিৎ ত্বং বদসি       দূর্ জানে মন্ আয়ৎ খোসি
        আমার হৃদয়ে বসি          প্রেম কর খোস্ হোয়কে।
          ভূয়ো ভূয়ো রোরুদসি          ইয়াদৎ নমুদা যাঁ কোসি
             আজ্ঞা কর মিলে বসি           ভারত ফকিরি খোয়কে।।

                                                                (মিশ্রকবিতা / চৌপদীচ্ছন্দঃ)


‘চণ্ডীনাটক’-এ চরিত্র অনুযায়ী ভাষা ব্যবহার করেছেন ভারতচন্দ্র। সূত্রধার সংস্কৃতে, নটী ও ভগবতী ব্রজবুলিতে আর মহিষাসুর হিন্দিতে সংলাপ বলেছে। যেমন – মহিষাসুরের বাক্যে ভগবতীর ক্রোধ:

ত্রিভুবন ঘুঁটত। রবিরথ টুটত। ঘনঘন ছুটত
          যেঁও পরলয়রে।                                 (চণ্ডীনাটক)


‘হাওয়া বর্ণন’-এর একটি স্তবক এবং ‘হিন্দি ভাষার কবিতা’ও ভারতীয় প্রাদেশিক ভাষা নিয়ে তাঁর কাব্যচর্চা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল। এ হেন বহু ভাষাবিদ্ ভারতচন্দ্র অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নবাবি আমলে (১৭৫২) যখন তিন খণ্ডের সুবৃহৎ অন্নদামঙ্গল কাব্য লিখছেন, তখন বঙ্গদেশে য়ুরোপের বণিকরা বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করলেও পলাশীর যুদ্ধ হয়নি। পাশ্চাত্ত শিক্ষালাভ তাঁর সময়ে সম্ভব ছিল না। তবু ফরাসি ও ওলন্দাজ উপনিবেশে কিছুকাল অতিবাহিত করার ফলেতাঁর আয়ত্তাধীন হয়েছিল কিছু পশ্চিমী শব্দ। অন্নদামঙ্গল কাব্যে তার চমৎকার ব্যবহার সচেতন পাঠকের নজরে পড়বেই –

ইংরেজ ওলন্দাজ ফিরিঙ্গি ফরাস।।
দিনমার এলেমন করে গোলন্দাজী।
                                        (অন্নদামঙ্গল, দ্বিতীয় খণ্ড, গড়বর্ণন অধ্যায়)

নিজের কাব্যকে ‘নৌতনমঙ্গল’ বলে ঘোষণা করা ভারতচন্দ্রের কাছে শুধু কথার কথা ছিল না। মঙ্গলকাব্যের প্রথা ভেঙে কাব্য বিষয়ের মধ্যে যেমন তিনি নতুনত্ব এনেছেন, তেমনি নিগড়বদ্ধ ‘বাংলা ভাষাকে শাপমুক্ত করেছেন’। শেষোক্ত কথাটা পরমথ চৌধুরীর। কারণ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ‘অন্নদামঙ্গল’ই একমাত্র কাব্য, যেখানে বাংলা, সংস্কৃত, ফারসি, হিন্দুস্থানি ভাষা সাবলীলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। বহুভাষাবিদ ভারতচন্দ্রের মূল লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিদীপ্ত কাব্যরস সৃষ্টি – কাব্যভাষা নিয়ে কোনও শুচিবায়ুগ্রস্ততাকে প্রশ্রয় না দেওয়া। কাব্য-বিষয় ও ঘটনা-পরিবেশ অনুযায়ী ভাষা বদল করে নিতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ‘বিরসকথা’কে ‘সরস’ করে বলতে ভারতচন্দ্রের জুড়ি মেলা ভার। তাই কাব্যোধৃত আখ্যানের ঘটনাস্থল যখন বঙ্গদেশ থেকে দিল্লির মুঘল দরবারে স্থানান্তরিত হল, তখন তার ভাষাও গেল বদলে। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সুবেদার মানসিংহ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারকে নিয়ে ‘পাতশা’ ‘জাহাঁগীর’-এর দরবারে হাজির হওয়ার পর থেকেই মধ্যযুগে প্রচলিত শিষ্ট বাংলার পরিবর্তে কব্যের অনেকটা অংশ লিখিত হল বাংলার সঙ্গে আরবি-ফারসি-হিন্দুস্থানি মিশ্রিত ভাষায়। ‘মানসিংহের দিল্লিতে উপস্থিতি’ অধ্যায় থেকে শুরু করে ‘পাতশার [বাদশার] নিকট বাঙ্গালার বৃত্তান্ত কথন’, ‘পাতশাহের দেবতা নিন্দা’, ‘দিল্লীতে উৎপাত’, ‘পাতশার নিকট উজিরের নিবেদন’, ভবানন্দে পাতশার বিনয় প্রভৃতি অধ্যায়ে ভাষাবিদ্ ভারতচন্দ্র কেন কাব্যভাষা পরিবর্তন করলেন, তার কৈফিয়ৎ দিয়েছেন প্রথমেই:

মজুন্দারে লয়ে গেলা পাতশার পাশে।
ইনাম কি চাহ বলি পাতশা জিজ্ঞাসে।।
মানসিংহ পাতশায় হৈল যে বাণী।
উচিত যে আরবী পারসী হিন্দুস্থানী।।
কিন্তু সে সকল লোকে বুঝিবারে ভারি।।

                                           (– মানসিংহের দিল্লীতে উপস্থিতি)

অর্থাৎ দিল্লীর দরবারে মানসিংহ ও বাদশার মধ্যে যে ‘আরবী পারসী হিন্দুস্থানী’ ভাষায় কথাবার্তা হয়, সেই সব ভাষায় অভিজ্ঞ ভারতচন্দ্র গোটা বিষয়টি ওই ভাষাতেই ‘বর্ণিবারে’ পারতেন। কিন্তু বাঙালি পাঠকের (‘লোকে’র) পক্ষে তা হত ‘বুঝিবারে ভারি’, অর্থাৎ দুর্বোধ্য। বুদ্ধিমান কবি পাঠলব্ধ ভাষাজ্ঞান উগরে না দিয়ে ‘দুর্দান্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত’কে বর্জন করেছেন। সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রে সুপণ্ডিত কবি খুব ভালো করেই জানতেন কাব্যরসের আধার হল ‘সহৃদয় পাঠক’। ‘লোক বুঝাইতে’ মালাধর-কৃত্তিবাস যেমন কাব্য লিখেছিলেন, সেই লোকসাধারণের জন্যই ভারতচন্দ্র ‘রসকথা’ ‘সরস ভাষে’ বলতে চেয়েছেন। ‘তিনি যেই মতো পড়েছিলেন সেই মতো লেখেননি কেন’, এই কথাটা যদি আমরা ঠিকঠাক বুঝতে পারি, তা হলে কাব্যভাষা সম্পর্কে তাঁর দূরদর্শিতাকে যুগান্তকারী বলতেই হবে।

দ্বিতীয়ত, ‘প্রসাদগুণ হচ্ছে ভাষার একটি বিশিষ্ট রূপ’। ভারতচন্দ্র নিজের কাব্যকে প্রসাদগুণ সম্পন্ন ও রসাল করার আন্তরিক তাগিদে ভাষার বাছ-বিচার মানেননি। কেবল পাঠকদের সমস্যা হবে, এটাই একমাত্র কারণ নয়, ‘আরবী পারসী হিন্দুস্থানী’তে লিখলে –

না রবে প্রসাদগুণ না হবে রসাল।
অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল।।

সুতরাং প্রাচীন সংস্কৃত কবিদের পথ অনুসরণ করে ও রসশাস্ত্রকারদের সমর্থন নিয়ে উচ্চকন্ঠে তাঁর ঘোষণা –

প্রাচীন পণ্ডিতগণ গিয়েছেন কয়ে।
যে হৌক সে হৌক ভাষা কাব্যরস লয়ে।।
রায়গুণাকর কহে শুন সভাজন।
মানসিংহ পাতশায় কথোপকথন।।

সুকবির কাছে কাব্যরসই মূল লক্ষ্য, কাব্যভাষা নিয়ে শুচিবায়ুগ্রস্ত হওয়া তাঁর সাজে না।

প্রমথ চৌধুরী ‘ভারতচন্দ্র’ শিরোনমে লিখেছিলেন কেবলমাত্র তাঁর কবিত্বশক্তির মূল্যায়ন ও অশ্লীল কবির অপবাদ দূরীকরণের জন্য নয়, তাঁর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণের কালে ভারতচন্দ্রকে যুগান্তকারী ভাষাশিল্পীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। ‘বাংলা ভাষাকে শাপমুক্ত করে’ ‘প্রাণবন্ত সর্বাঙ্গসুন্দর’ রূপ দেওয়া তাঁর অন্যতম কীর্তি। ভারতচন্দ্রকে কৃষ্ণনাগরিকতায় ঋদ্ধ ‘জাতকবি’র অভিধায় ভূষিত করে তিনি লিখেছেন, ‘‘অমন সরল ও তরল ভাষাতাঁর পূর্বে আর কেউ লিখেছেন বলে আমি জানিনে।’’

ভাষার ক্ষেত্রে ভারতচন্দ্রের এই নাগরিক মনস্কতা ভুরশুট-মান্দারন থেকেই লব্ধ, পরে তার পরিণত রূপের প্রকাশ ঘটেছে কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায়। সুতরাং ‘গুণাকর কবির’ ভাষায় গুণপনায় সমৃদ্ধ কাব্যটির ‘কারুকার্য’ ও ‘উজ্জ্বলতা’ রবীন্দ্রনাথেরও দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না।

সুপ্রসন্ন ভাষাই হচ্ছে প্রসাদগুণ সম্পন্ন ভাষা। ‘যাবনী মিশাল’ গুণাকরী বাংলায় সেই রসাল প্রসাদগুণের অভাব নেই অন্নদামঙ্গলের তৃতীয় খণ্ডের দিল্লি আখ্যান থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিলেই তা বোধগম্য হবে:

ক. পাতশা কহেন শুন মানসিংহ রায়।
গজব করিলা তুমি আজব কথায়।।

* * * * *

সয়তানে বাজী দিল না পেয়ে কোরাণ।
ঝুটমুট পড়ি মরে আগম পুরাণ।।

* * * * *

ভাতের কি কব পান পানীর আয়েব
কাজী নাহি মানে পেগম্বরের নায়েব।।
আর দেখ নারীর খসম মরি যায়।
নিকা নাহি দিয়া রাঁঢ় করি রাখে তায়।। 

                               (– পাতশাহের দেবতা নিন্দা)


খ.      অরে রে নিন্দুক পুত                       দেখলাও কঁহা ভূত
                 নাহি তুঝে করুঙ্গা দোটুক।
নাহোয় সুন্নত দেকে            কলমা পড়াঁও লেকে
                        জাতি লেঁউ খেলায়কে থুক।। 
                                                            (– দাসুবাবুর খেদ)



গ.     বিবীরে পাইল ভূতে প্রলয় পড়িল।
             পেশবাজ ইজার ধমকে ছিঁড়া দিল।।
             চিতপাত হয়ে বিবী হাত পা আছাড়ে।
              কত দোয়া দবা দিনু তবু নহি ছাড়ে।।
              শুনি মিয়া তসবী কোরাণ ফেলাইয়া।
            দড় বড় রড় দিল ওঝারে লইয়া।।
            ভূত ছাড়াইতে ওঝা মন্ত্র পড়ে যত।
                বিবী লয়ে ভূতের আনন্দ বাড়ে তত।।
               অরে রে খবিস তোরে ডাকে ব্রহ্মদূত।
                 ও তোর মাতারি তুই উহারি সে পুত।।
            কুপী ভরি গিলাইব হারামের হাড়।
                                  ফতমা বিবীর আজ্ঞা ছাড় ছাড় ছাড়।। 

                                                                   (– দিল্লীতে উৎপাত)


‘অন্নদামঙ্গল’-এর এই সব কাব্যাংশে ভারতচন্দ্র-কথিত ‘যাবনী মিশাল’ ভাষাই ‘ইসলামী বাংলা’ বা ‘মুসলমানী বাংলা’ বলে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে কলকাতা ও তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চলে শ্রমজীবী মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। আবার দক্ষিণ-রাঢ়ের ভুরশুট-মান্দারনকে কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী বালিয়া, মণ্ডলঘাট প্রভৃতি পরগনাতেও এই ভাষাকে অবলম্বন করে একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল উচ্চবর্গের মুসলমান সমাজে। ‘আরবী-ফারসী-হিন্দুস্থানী’ মিশ্রিত এই ‘যাবনী মিশাল’ কথ্য বাংলা চমৎকার কাব্য-ভাষা হয়ে উঠতে পারে এবং তাতে বিন্দুমাত্র কব্যরসের বিঘ্ন ঘটে না; প্রথমোক্ত অঞ্চলে কবি কৃষ্ণরাম এবং তারপরে শেষোক্ত অঞ্চলের ‘বাকপতি’ কবি ভারতচন্দ্রের হাতে তা প্রমাণিত হওয়ায় এই ভাষাকে অবলম্বন করে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়া্র্ধ থেকে খুলে যায় নতুন একটি সাহিত্যধারার অভিমুখ। পরবর্তীকালের গবেষকরা এই ভাষাকে বিচিত্র নামে অভইহিত করলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতেই এই ভাষার চরিত্র-বৈশিষ্ট্য বিচার করে যথার্থ নামকরণটি করেছেন ভাষাবিদ্ ভারতচন্দ্র – ‘অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল’। ‘যাবনী মিশাল’ ভাষাও আসলে ‘হিন্দুস্থানী’ ‘উর্দু’র মতোই বিশেষ একটি কালপর্বে বাংলা ভাষায় প্রচলিত ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ (Lingua Franca)।



0 comments: