ধারাবাহিক
সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে
অমিতাভ প্রামাণিক
দুই
দর্শন, মূল্যবোধ, বিচারব্যবস্থা – এসবের সাথে লবঙ্গ-দারুচিনি-গোলমরিচের কোনও সম্বন্ধ আছে?
না থাকলে আর প্রশ্নটা খামোকা করা কেন? আর শুধু দর্শন ইত্যাদিই নয়, সমগ্র পৃথিবীর আজ যে রূপ, তার প্রায় সব কিছুর পিছনেই আপাত-নিরীহ ঐ মশলাপাতির তীব্র ভূমিকা। অবাক লাগছে?
যে কোনও জায়গায় কয়েক দানা চিনি ফেলে রাখলে যেমন অনিবার্যভাবে সারি দিয়ে পিঁপড়ের দল এসে হাজির হয় অচিনপুর থেকে, নেমন্তন্ন করে ডেকে আনতে হয় না, ঠিক তেমনি কেমন করে বিদেশীরা জেনে গেছিলো আমাদের এই ভারতবর্ষ মহার্ঘ মশলার আধার। যীশু জন্মানোর হাজারেরও বেশি বছর আগের কথা এসব। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি হতে শুরু হলো ব্যবসাবাণিজ্যে। আরবেরা সমুদ্রপথে এসে মশলা নিয়ে গিয়ে বেচতো ইওরোপে, চড়া মুনাফায়। ইওরোপীয়ানরা চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? গন্ধে গন্ধে তারাও বেরিয়ে পড়লো ইন্ডিয়ার সন্ধানে। কলম্বাস পথ ভুলে চলে গেলো আমেরিকায়, ভাবলো সেটাই ইন্ডিয়া। সে ভুল ভেঙে গেলে অন্যান্যরাও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সমুদ্রে পাড়ি জমাতে লাগলো। ভাস্কো-ডা-গামা রুট বের করে ফেলতেই দলে দলে হাজির হতে লাগলো পর্তুগীজ, ইংরেজ, ফরাসী, ওলন্দাজ, দিনেমাররাও।
যে সময়ের কথা বলছি, তখন দেশে মোগল আমল চলছে। সপ্তদশ শতাব্দী। তাজমহল বানানো চলছে আগ্রায়, তার জন্যে এক হাজার হাতির পিঠে ধবধবে সাদা মার্বেল আসছে রাজস্থানের মাকরানা থেকে। দেওয়ালে কারুকার্যের জন্য আঠাশ রকমের মণিমুক্তোর কিছু আসছে পশ্চিমে পঞ্জাব বা সুদূর আফগানিস্তান থেকে, কিছু আসছে উত্তরে তিব্বত-চীন থেকে, কিছু বা দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা থেকে। উস্তাদ আব্দুল আহমদ লাহোরির তত্ত্বাবধানে উদয়াস্ত কাজ করছে বিশ হাজার শিল্পী। এর মধ্যে একে একে দিল্লীর মসনদে বসেছেন আগে জাহাঙ্গীর, এখন তাঁর ছেলে শাহজাহান, তৈরী হচ্ছেন তাঁর ছেলে আওরঙ্গজেব। দাপটের সঙ্গে দেশ চালান এঁরা। দেশের প্রজারা সম্রাটকে ভয় করে, মান্য করে। তবে তারা তো আর সম্রাটের দর্শন পায় না, এলাকার জমিদারদেরই ভাবে তাদের ভাগ্যনিয়ন্তা।
জমিদার মানে কিন্তু জমির মালিক না। দিল্লীর বাদশা হচ্ছেন জমির মালিক। বাদশার কাছ থেকে চাষী বা রায়তরা জমির সাময়িক মালিকানা বা জমাবন্দি নিয়ে চাষবাস করে। এতগুলো প্রজা বা রায়তদের কাছ থেকে জমির খাজনা আলাদা আলাদা করে আদায় করা তো সহজ কাজ না, এর জন্য মিড্ল্ম্যান হিসাবে নিয়োজিত হতো যারা, তারাই জমিদার। জমিদারের কাজ ছিলো স্রেফ রায়তদের কাছ থেকে সরকারি খাজনা আদায় করে সরকারের রাজস্বের ভাণ্ডারে মজুত করা। এ কাজ ভালোমতো করতে পারলে বাদশার তরফ থেকে খিলাত বা উপাধি জুটতো। এই খিলাত দিয়ে খুদে জমিদারি থেকে বড় জমিদারি পেতে সুবিধা হতো। সরকার নির্দিষ্ট করে দিতো, কত তার কর চাই, জমিদার প্রজাদের কাছ থেকে সেই কর তুলে জমা দিতো সরকারি কোষাগারে। ধার্যের অতিরিক্ত যা থাকতো তা যেতো তার পকেটে, সহজ সরল হিসেব। কীভাবে সেই খাজনা আদায় হবে, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কী দরকার দিল্লীর বাদশার?
খাজনা মোট তিন ধরণের। আবাদি অনাবাদি সমস্ত জমি যেখানে গাছপালা, বনজঙ্গল, জলাভূমি বা পুকুর আছে, তা থেকে যে খাজনা আদায় করা হতো, তার নাম মাল। তা থেকেই মালকড়ি কথাটার শুরু। নদীপথে যেসব নৌকা-বজরা চলাচল করতো আর গ্রামে গঞ্জে যেসব হাট-বাজার বসতো তা থেকে সেইর নামে আর এক ধরণের খাজনা আদায় করা হতো। যারা বিভিন্ন ধরণের কাজকারবার করতো সেইসব পেশাজীবী বা কর্মজীবীদের কাছ থেকে আদায় করা হতো ইনকাম ট্যাক্সের মত বেশ মোটা অঙ্কের খাজনা, তার নামও ছিলো সেইর। এছাড়া অকাজ-কুকাজের জরিমানা, প্রতারণা, এমনকি বিয়ে-শাদি থেকেও বাজে জমা খাজনা আদায় করা হতো। মাল খাজনা আদায়ের জন্য জমি-জিরেত মাপামাপির হাঙ্গামা ছিলো না, জরিপ করবে কে? আন্দাজে একটা মোটামুটি হিসাব করে খাজনা ধার্য করা হতো। কাজের সুবিধের জন্যে মোট ধার্য খাজনার টাকা ভাগ ভাগ করে জমিদাররা প্রজাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতো। মোগল আমলে জমিদাররা প্রজাদের বেশি শোষণ করতে পারতো না, বেশী ঝামেলা সৃষ্টি হলে দরবারে খবর চলে যেতো, বাদশা জমিদার পাল্টে দিতেন। জমিদারি বাঁচিয়ে রাখার তাগিদেই প্রজাদের তাই হাতে রাখতে হতো। তাদের খুশি রাখতে কিছু দাবিদাওয়াও মানতে হতো।
আভ্যন্তরীণ শান্তি বজায় রাখতে জমিদারদের পুলিশ রাখতে হতো। পাশের রাজ্যের হামলা রুখতে সৈন্যসামন্ত সাপ্লাইয়ের দায়িত্বও তাদের। খাজনা আদায়ের জন্য পাইক বরকন্দাজ থাকতো। তারাই স্থানীয় চুরি-ডাকাতি, দস্যুদের উৎপাত থামানোর কাজ করতো। বড় জমিদারদের আওতায় পুলিশ মোতায়েন করা থানা থাকতো, তার অধীনে একাধিক চৌকি, যার কর্মীদের বলা হতো চৌকিদার। থানার প্রধান ছিলো ফৌজদার। ফৌজদাররা আদতে বাদশার লোক, তবে তারা জমিদারদের অধীনেই কাজ করতো। সবই ছিলো খাজনা আদায়ের নানা বাহিনী।
এসব অঞ্চলে মোগলদের যুদ্ধবিগ্রহের সেনাবাহিনীও ছিলো না। যুদ্ধের বা বিদ্রোহ দমনের জন্যে বা পাশের রাজ্য দখলের কাজে বাদশাহীতে সৈন্য-সামন্ত, হাতি-ঘোড়া যা দরকার হতো, তার যোগান দিতে হতো জমিদারদের। এজন্যেও প্রজাদের ঘাড়ে কিছু অতিরিক্ত খাজনা চাপিয়ে দেওয়া হতো। জমিদাররা নিজেরাই ছোটোখাটো বিচার-টিচার করতেন জমিদারি আদালতে। যেসব বিচার সম্ভব হতো না সেখানে, তা পাঠিয়ে দেওয়া হতো থানাদার বা কাজির কাছে। প্রজাদের সপক্ষে রায় যাওয়ার আশা ছিলো বাতুলতা। বাদশার আর জমিদারের স্বার্থরক্ষা করে যেটুকু করা সম্ভব, তার নামই ছিলো বিচার।
প্রজারঞ্জক বলে খ্যাত সম্রাট আকবরের সেনাপতি তোডরমল বাংলা সুবাহ্য় এই জমিদারি ব্যবস্থা চালু করেন। ভারত বিশাল দেশ, তাকে ভাগ করা হয়েছে অনেকগুলো অঞ্চল বা সুবাহ্য়, এক একটার প্রশাসনের দায়িত্বে এক একজন সুবাহ্দার বা সুবেদার। বাংলা সে রকম একটা সুবাহ্, তার খাজনা আদায় হতো চৌঁত্রিশটা জমিদারি সরকার দিয়ে। অনেক পরে, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে মুর্শিদকুলি খাঁ যখন বাংলার সুবেদার, চালু হলো মালজমিনি ব্যবস্থা। সরকারি কোষাগারে যাতে নিয়মিত বেশি বেশি রাজস্ব আদায় হয়, তা নিশ্চিত করতে মুর্শিদকুলি বাংলাকে তেরোটা প্রশাসনিক বিভাগ বা চাকলায় ভাগ করলেন। বড় বড় জমিদারদেরই মনোনীত করা হলো এই চাকলাগুলোর চাকলাদার হিসেবে, তাদের কাজ হলো দক্ষতার সঙ্গে রাজস্ব আদায় করা। তবে এরা যত বেশি খালসা বা বাদশার কোষাগারের পুঁজির জোগান দিতে লাগলো, তত এদের ক্ষমতা আর মর্যাদা বাড়তে লাগলো। প্রতিভাবান জমিদারদের বিভিন্ন সরকারি পদে নিয়োগের প্রস্তাব এলে তাদের প্রেস্টিজ আরো বেড়ে গেলো। সেইসঙ্গে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির পথও প্রশস্ত হলো। মূলতঃ রাজস্ব আদায়কারীর ভূমিকা থেকে ক্রমশ জমির মালিকে রূপান্তরিত হতে লাগলো তারা।
মুর্শিদকুলি খাঁ নিয়ম করে দিয়েছিলেন চাষের জমির রাজস্বের জন্যে বাদশার পাওনা কী। এক এক শস্যের জন্যে এক এক রকম কর, যেমন গমের চাষ করলে বিঘা পিছু চার মণ গম হবে বাদশার প্রাপ্য। সে রকম যবের চাষ করলে চার মণ যব, সর্ষের বেলায় আড়াই মণ সর্ষে। অথবা সাড়ে তিন মণ ছোলা বা মটর অথবা ছ’ মণ কলাই। কিন্তু জমিতে যদি রাঙা আলু, শাঁকালু, পেঁয়াজ, লেবু, তেঁতুল, লাউ, কুমড়ো, শাকসবজি ফলে, অথবা চাষ হয় নীল বা পানের, তাহলে সেসব তো আর বাদশার নিত্য কাজে লাগবে না, তার খাজনা দিতে হবে নগদ তংখায়। এসব হিসেব করে রাজস্ব ধার্য করার জন্য গ্রামে গ্রামে যেতো কানুনগোরা। খাজনা দিতে হতো গরু মোষ পালতে, ফলের চাষ করতেও। আর এত রকম খাজনার পাশাপাশি ছিলো গাঁজা, কম্বল, তেল, কাঁচা চামড়ার উপরেও আলাদা ট্যাক্স।
তবে মুর্শিদকুলি তো অনেক পরের ব্যাপার। তার একশো বছর আগেই ইংরেজরা এসে গেছে ভারতে, ঐ লবঙ্গ-দারুচিনি-গোলমরিচের মত মশলাপাতির সন্ধানে, জাহাজ নিয়ে বাণিজ্য করতে।
বিদেশে এসে হুট করে জাহাজে মাল তুলে নেওয়া তো চাড্ডিখানি কথা না, ওভাবে কি বিজনেস হয়? বিজনেস করতে গেলে অফিস কাছারি খুলতে হয়, থিতু হয়ে বসতে হয় সেখানে। ইংরেজের ফড়েরা ওদের রিপোর্ট দিলো– কাছারি খুলতে হলে খোলো বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায়। ব্যবসা ওখানেই জমবে ভালো। সেটা ইংরাজী ১৬১৭ সাল। দিল্লীর গদিতে বাদশাহ জাহাঙ্গীর, আর বাংলার সুবেদার ইব্রাহিম খাঁ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তৈরী হয়েছে মূলত ভারতের সঙ্গে ব্যবসার জন্যেই, মাত্র ষোল বছর আগে, শতাব্দীর গোড়ায়। ইংরেজদের অনুরোধে জাহাঙ্গীর বছর তিনেক পরে তাদের সুরাটে একটা কুঠি নির্মাণ মঞ্জুর করলেন। কুঠি মানে আধুনিক ডিপো বা ওয়্যারহাউস, কাছেপিঠের অঞ্চল থেকে জিনিসপত্র যোগাড়যন্ত্র করে যেখানে মজুত রাখা যাবে কিছুদিন, আর খাতাপত্তর সমেত অফিস। ওরা অবশ্য সেটাকেই বলত ফ্যাক্টরি।
সুরাটের পর আগ্রায় আর মাদ্রাজের দক্ষিণে মছলিপত্তনমে ফ্যাক্টরি বানালো ইংরেজরা। কিন্তু চোখ তো বাংলার দিকে, বাদশার কাছে চলতে লাগলো নিরন্তর আবেদন। আরো চোদ্দ বছর পরে জাহাঙ্গীরের ছেলে শাহজাহান এক ফরমান জারি করলেন যে এরা বাংলায় কুঠি বানাতে পারবে, তবে ওদের থাকার জায়গা হবে উড়িষ্যার পিপলিতে। কুঠি এক জায়গায়, থাকার জায়গা অন্যত্র, এ ঠিক পছন্দ হলো না কোম্পানীর। তারা বলল, তাহলে পিপলিতেই কুঠি বানাই? বাদশা বললেন, না।
বাদশার আদেশ নড়চড় করা মুশকিল। নতুন ফরমান চাই। কিন্তু চাইলেই কি আর পাওয়া যায়?
কপালে থাকলে সবই সম্ভব। বছর দুই পরে শাহজাহানের এক কন্যা হঠাৎ আগুনে ভয়ঙ্করভাবে পুড়ে গেলো। দিল্লীর তাবড় ডাক্তার-বদ্যি-হাকিম তাকে চিকিৎসা করে বাঁচাতে পারে না প্রায়। সারা গায়ে ঘা, দিন দিন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। সে খবর গেলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কানেও। সুরাট থেকে ইংরেজ ডাক্তার বাউটন এলেন তার চিকিৎসা করতে। কন্যা সুস্থ হয়ে গেলো। বাদশা তো মহাখুশি। লিখে দিলেন, যাও পিপলিতে কুঠি বানাও গে। সেটা ১৬৩৩ সাল।
ইংরেজ বাণিজ্যতরী সেই প্রথম নোঙর ফেলল ভারতের পূর্ব উপকূলে।
১৬৩৮ সালে শাহজাহান তাঁর মেজ ছেলে শাহ সুজাকে পাঠালেন বাংলার সুবেদার করে। তাঁর গৃহেও এক মহিলার অসুখ কিছুতে সারে না। আবার ডাক পড়ল সেই বাউটনের, তিনি হাজির হলেন সুজার রাজধানী রাজমহলে। এবারও অসুখ সারিয়ে দিলেন ডাক্তার বাউটন। ফলে পিপলির সঙ্গে বুড়িগঙ্গার তীরে বালেশ্বর আর কয়েক বছর পরে ১৬৫১ সালে গঙ্গাতীরে হুগলিতেও কুঠি খোলার অনুমতি পেয়ে গেলো কোম্পানী। এরপরে কাশিমবাজারে, তারপরে পাটনায়, সিঙ্গিরায় আর ১৬৬৮ সালে ঢাকায় ইংরেজরা একে একে কুঠি বানিয়ে ফেললো।
এর মধ্যে ১৬৬৪ সালে দিল্লীর মসনদে শাহজাহানের পুত্র আওরঙ্গজেব বাংলার সুবেদার করে পাঠালেন মামা শায়েস্তা খাঁকে। শায়েস্তা খাঁ অতিশয় তালেবর শাসক, কিন্তু হঠাৎ গজিয়ে ওঠা মারাঠা দস্যু শিবাজীকে দমন করতে গিয়ে নাকানিচুবানি খেয়ে গেছেন। তিনি বাংলা শাসন করতে লাগলেন ঢাকা থেকে। ইংরেজরা শায়েস্তা খাঁকে ধরে পড়লো– বাংলায় তারা যেন আজীবন ব্যবসা করতে পারে দিল্লী থেকে এই মর্মে যদি এক ফরমান জারী করিয়ে নেওয়া যায়। বছর বছর রিনিউয়াল এক বিরাট ঝক্কি, বিশেষ করে গদি পাল্টে গেলে নতুন সম্রাটের কী মর্জি হয়, কে জানে! তার চেয়ে পাকাপাকি একটা বন্দোবস্ত হয়ে থাকলে বেশ হয়। ইংরেজদের এতাবৎকালের কার্যকলাপ লক্ষ করে বাদশা তা মঞ্জুর করলেন।
হুগলির কুঠিতে তিনশো তোপধ্বনির মাধ্যমে সেই আদেশের আনন্দ উদ্যাপিত হলো।
রাতারাতি বাংলায় বাণিজ্য বেড়ে গেলো। এর আগে মাদ্রাজে ঘাঁটি গেড়ে নিয়েছিলো ইংরেজরা, পূব ভারতের সব কুঠিগুলো ছিলো তাদেরই অধীন। নতুন ফরমান পেয়ে বাংলাকে মাদ্রাজের থেকে আলাদা করে দেওয়া হলো, মিস্টার হেজেস এলেন বাংলায় বাণিজ্যের অধিকর্তা হিসাবে। হুগলিতে নির্মাণ করা হলো হেজেসের জন্যে এক প্রাসাদ। মাদ্রাজ থেকে সৈন্য এনে মোতায়েন করা হলো তার দেউড়িতে। সেই প্রথম কোনও ইংরেজ সেনা পা রাখলো বাংলার মাটিতে। বাংলা বিহার উড়িষ্যার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রমরমা ব্যবসা চালু হলো ইংরেজদের।
এই যে ফরমান জারি হয়েছিলো দিল্লী থেকে, তার অনেক ব্যাপারই ছিলো গোলমেলে। মাঝেমাঝেই এ নিয়ে ইংরেজ আর সুবেদারের বিবাদ বাধতে লাগলো। সেই সময় বিহারে এক ছোটখাট ঝামেলায় বিহারের এক জমিদার সেখানকার সুবেদারকে আক্রমণ করায় পাটনা কুঠির অধ্যক্ষ মিস্টার পীকককে জেলে ভরে দেওয়া হলো এই অভিযোগে যে, সেও এর পেছনে কলকাঠি নেড়েছে। কামানের গোলায় ব্যবহার হয় সল্টপিটার বলে এক রাসায়নিক বস্তু, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার একচেটিয়া বাণিজ্য করে। ব্যবসার রমরমা দেখে আর এক বিদেশী কোম্পানীও ঐ বস্তুটি বিক্রী শুরু করলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর এই ব্যবসা পড়তে থাকে। সেই সময় অন্য ঝুটঝামেলা বাংলায় না হয়, তা নিশ্চিত করতে এরা হুগলী নদীর মুখে এক দুর্গ বানানোর অনুমতি চাইলো। শায়েস্তা খাঁ এসব বেয়াদপি বরদাস্ত করবেন কেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেই অনুরোধ নাকচ তো করলেনই, উপরন্তু এই বেয়াড়া অনুরোধের জবাব হিসাবে বাংলায় ব্যবসা করার জন্য বার্ষিক প্রদেয় যে তিন হাজার টাকা কর, তার ওপর আরো শতকরা সাড়ে তিন টাকা সারচার্জ হেঁকে বসলেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাংলার ব্যবসা দেখার দায়িত্বে তখন জব চার্ণক নামে এক ইংরেজ। তাঁর জন্ম ১৬৩০ সাল নাগাদ ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ার অঞ্চলে। ছাব্বিশ বছর বয়সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজ নিয়ে ভারতে আসার বছর দেড়েক পরে তিনি এই কাশিমবাজার কুঠিতে বার্ষিক কুড়ি পাউন্ড বেতনে সাধারণ কর্মী হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। কাশিমবাজার থেকে পদোন্নতি হয়ে তিনি গেলেন পাটনায়। এখানে তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হলো। পাটনার গঙ্গাতীর ধরে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরছিলেন চার্ণক তাঁর সঙ্গী জো-এর সঙ্গে। হঠাৎ এক শোরগোল শুনে তাঁর দৃষ্টি গেলো দূরের এক প্রান্তে, সেখানে গঙ্গাতীরে চিতা জ্বলছে, তাতে শায়িত এক বৃদ্ধের মরদেহ। জনতা শোক করছে না, তারা ঐ একই চিতায় তুলে দিতে চায় আরও দুজন মহিলাকে, তার মধ্যে একজন তো নেহাৎই বালিকা। মুহূর্তের মধ্যে চার্ণক বুঝে গেলেন কী হচ্ছে। তিনি শুনেছেন এদেশের এই প্রথার কথা। জনতার মধ্যে তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘স্ক্যাটার দ্য ফ্যাকটর্স। দ্য পেল্ উইডো ইজ মাইন। জো, দ্য লিটল ব্রাউন গার্ল ইজ ফর ইউ।’’
নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া সেই পেল্ উইডো – বামুনের ঘরের মেয়ে আর সদ্য স্বামীহারা বৌ – চার্ণকের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে গেলো, চার্ণক তার নাম দিলেন মারিয়া।
পনেরো বছর চাকরি করে চার্ণকের মাইনে শুরুর সময়ের দ্বিগুণ হয়ে বছরে হলো চল্লিশ পাউন্ড, আর তার চার বছর পরে আরো কুড়ি পাউন্ড গ্রাচুইটি দিয়ে বছরে ষাট পাউন্ড। আরো চার বছর পরে, ১৬৮০ সালে ফের তাঁর প্রত্যাবর্তন কাশিমবাজারে কুঠির প্রধান হয়ে, তখন তিনি এই অঞ্চলের সেকেন্ড অফিসার। প্রায় তিন দশক কাজ করে নিজের প্রতিভাবলে চাকরিতে উন্নতি করে করে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাংলার এজেন্ট হলেন, হুগলিতে হলো তাঁর অফিস। ততদিনে একের পর এক চারখানা কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়ে কুড়ি বছর সংগ্রামী সংসার করে মারা গেছে মারিয়া। কলকাতার নরম জলা জায়গার প্রাচীনতম ইঁটের বাড়ি সেন্ট জন চার্চ প্রাঙ্গনে তাকে কবরস্থ করা হয়েছে। প্রতি বছরে স্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকীতে চার্ণক সেখানে গিয়ে একটা করে মুরগি জবাই করেন পঞ্চপীরের ভক্ত স্ত্রীর বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধায়।
এদিককার কাউন্সিলের চার্ণকই তখন প্রধান, রিপোর্ট করেন মাদ্রাজের ওপরওলাদের কাছে সরাসরি, তারা জানে জব চার্ণক হচ্ছে এক উদ্ধত গোঁয়ার, সে নিয়ে তাদের মধ্যে হাসাহাসিও কম নয়। শায়েস্তা খাঁ বাংলায় অতিরিক্ত কর বসাতে চার্ণক রেগে গিয়ে মোগলদের এক আড়তে গোলাগুলি চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেন। সেই প্রথম মোগলদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের যুদ্ধ। শায়েস্তা খাঁ ভীষণ চটে গিয়ে হুগলীর মোহনা থেকে ইংরেজদের জাহাজ ফিরিয়ে দিলেন মালপত্র ওঠানামা না করতে দিয়েই। সেটা ১৬৮৫ সাল। মোগলদের ভয়ে জব চার্ণক বাধ্য হয়ে কুঠি ছেড়ে পালালেন, প্রথমে চট্টগ্রামে, পরে সেখান থেকে মাদ্রাজে নিজেদের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ কুঠিতে।
ক্রুদ্ধ ইংরেজ কোম্পানী তাদের রাজা দ্বিতীয় জেমসকে অনুরোধ করলো তাদের যেন সেনা নিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়, তারা প্রয়োজনে যুদ্ধ করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখবে। মোগলদের শত্রু আরাকানের রাজার সঙ্গে তলে তলে আঁতাত করে ঠিক হলো নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল নিকলসন রণতরী নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর আক্রমণ করে দখল করে নেবেন, সেখানে হবে ইংরেজ ঘাঁটি। তারা সেখানে টাঁকশাল প্রতিষ্ঠা করবে, রাজস্ব আদায় করবে। তারপর সেখান থেকে তারা এগিয়ে আসবে ঢাকায় আর সেটাও দখল করে নেবে। ইংরেজরা ধরেই নিলো এর ফলে বাংলার সুবেদার বাধ্য হবেন ঢাকা চট্টগ্রাম ছেড়ে পালাতে, আর সন্ধিপ্রস্তাব নিয়ে তাদের বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অনুমতি দেবেন। জব চার্ণক তখন মাদ্রাজে। তাঁকে বলা হলো ৪০০ সৈন্য নিয়ে নিকলসনের সঙ্গে চট্টগ্রামে যোগ দিতে।
কাজের সময় ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ অন্যরকম হলো। বঙ্গোপসাগরে এক ভয়ঙ্কর নিম্নচাপে উঠলো তীব্র ঝড়, উল্টোপাল্টা হাওয়ায় নৌবহর দিক ঠিক রাখতে পারলো না। চট্টগ্রামের বদলে পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে দু পক্ষই হাজির হলো হুগলির মোহানায়। তাতে অবশ্য তাদের খারাপ কিছু হলো না, বাংলা উপকূলে এতগুলো বিদেশী যুদ্ধজাহাজ দেখে শায়েস্তা খাঁ একটু ভড়কে গেলেন। তিনি ইংরেজদের কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠালেন।
শান্তি অবশ্য বেশিদিন বজায় রইলো না। কিছু ইংরেজ সেনা শায়েস্তা খাঁর সেনাদের সঙ্গে অভব্যতা করায় বেধড়ক পিটুনি খেলো। বদলা নিতে অ্যাডমিরাল নিকলসন গোলাবর্ষণ করে জ্বালিয়ে দিলেন পাঁচশোর বেশি ঘরবাড়ি, তিরিশ লক্ষ টাকার ওপর ক্ষয়ক্ষতি হলো সেই গোলাগুলিতে। শায়েস্তা খাঁ প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ইংরেজদের সোজা বলে দিলেন বাংলা থেকে পাততাড়ি গোটাতে। আদেশ দিলেন সমস্ত কুঠি ভেঙে দিতে, সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে। সেনা পাঠালেন হুগলি ছেড়ে ইংরেজদের ভাগিয়ে দিতে।
চার্ণক প্রমাদ গণলেন। হুগলীতে থাকা বিপদ, শায়েস্তা খাঁর সেনাবাহিনীর সাথে তাঁদের পেরে ওঠার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ১৬৮৬ সালের শেষদিক সেটা। সপরিবার চার্ণক হুগলী ছেড়ে নেমে এলেন দক্ষিণে এক গ্রামে। এই গ্রামের তিনদিক ঘেরা জলাভূমিতে, পশ্চিমে বইছে গঙ্গা। তাঁর সৈন্যদের জ্বর, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া জাহাজগুলোর ভালোরকম মেরামত দরকার। এই সময় কোনোভাবেই যুদ্ধ-টুদ্ধ করার উপায় নেই। চট্টগ্রাম আক্রমণের প্ল্যান বাতিল, এই গ্রামেই যে করে হোক কিছুদিন কাটাতে হবে। দিল্লীর সম্রাটের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে চিঠি লিখলেন তিনি, অনুরোধ করলেন আগের ফরমান যেন পুনর্বহাল করা হয়। সম্রাটের আদেশে শায়েস্তা খাঁ এদের সাথে শান্তির চুক্তি করে নিলেন।
তবে শায়েস্তা খাঁ ব্রিটিশদের একদম পছন্দ করতেন না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ব্যাটাদের মতিগতি ভালো না। তাই পরের বছর ফেব্রুয়ারীতে আবার বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে হুগলী এলেন ইংরেজদের উৎখাত করে দিতে। চার্ণক দেখলেন এই গ্রামেও থাকা যাবে না, পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন হিজলি দ্বীপে। হিজলি বঙ্গোপসাগরে এক নগণ্য দ্বীপ, মূলতঃ জলাভূমি। মশার চাষ হয় সেখানে, সাপ আর বাঘের উপদ্রবও কম না। বসবাসের উপযোগী নয় মোটেই। শায়েস্তা খাঁর সৈন্য অতদূরে তাদের খেদাতে এলো না বটে, কিন্তু তিন মাস সেখানে থেকে জব চার্ণকের অর্ধেক সৈন্য কেউ অসুখে ভুগে, কেউ সাপে কেটে, কেউ বাঘের পেটে চলে গেলো। যারা বাকি রইলো, তাদের অবস্থাও কহতব্য নয়।
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। শায়েস্তা খাঁর কাছে ভিক্ষা চাওয়া ছাড়া আর গতি নেই। হঠাৎ ভাগ্যের চাকা কিছুটা ঘুরে গেলো চার্ণকের। রাজা দ্বিতীয় জেমস যখন নিকলসনকে চট্টগ্রামে পাঠিয়েছিলেন, একই সময়ে জন চাইল্ড নামে একজনের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয় বোম্বেতে কোম্পানীর যা সম্পত্তি ছিলো তা গুটিয়ে নিয়ে পশ্চিম উপকূলে মোগলদের সঙ্গে সমুদ্রে লড়াই করার। বোম্বেতে ইংরেজদের অনেক আগে এসেছিলো পর্তুগীজরা, ঘাঁটি ছিলো তাদেরই। ১৬৬১ সালে তাদের রাজকন্যা ক্যাথেরিন অফ ব্র্যাগাঞ্জার বিয়ে হয় ইংল্যান্ডের রাজপুত্রের সাথে, বিয়েতে যৌতুক হিসাবে তারা বোম্বে দিয়ে দেয় ইংরেজ রাজাকে। রাজা আর বোম্বে নিয়ে কী করবে, তার স্বত্ব পেয়ে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী, ব্যবসার কারণে। এদিকে পশ্চিম উপকূল থেকে মুসলমান রাজত্বে প্রতি বছর হজ করতে পুণ্যার্থীদের মক্কা পাঠানো হতো সমুদ্রপথে। জন চাইল্ড তাদের ওপর অতর্কিত হামলা শুরু করতেই দিল্লীশ্বর আওরঙ্গজেব প্রমাদ গুণলেন। তিনি চান না পুণ্যকামী মুসলমানেরা ইংরেজদের হাতে আরব সাগরে বিপদে পড়ুক। শায়েস্তা খাঁকে ডেকে বললেন ইংরেজদের সঙ্গে সমঝোতা করে নিতে। ফলে ১৬৮৭ সালের মাঝামাঝি শায়েস্তা খাঁ জব চার্ণককে ডেকে সন্ধির প্রস্তাব দিলেন। চার্ণকের কাছে এ তো মেঘ না চাইতেই জল!
শায়েস্তা খাঁ অবশ্য ইংরেজদের বাড়াবাড়ি করতে দিতে রাজি নন, তিনি এদের চরিত্র ভালোই জানেন। পরিষ্কার বলে দিলেন, দ্যাখো বাপু, বাংলায় বিজনেস করতে চাও, করো, কিন্তু থাকতে হবে উলুবেড়িয়ায়, তার উত্তরে কোনো স্থাবর সম্পত্তি বানানোর চেষ্টা করোনা। করলেই আমি ভেঙে দেবো। এর আগে চার্ণক যে গ্রামে আশ্রয় গেড়েছিলেন কিছুদিন, উলুবেড়িয়া তারও দক্ষিণে, নদীর পাড়ে ছোট্ট গ্রাম। সেখানে ইংরেজরা ঘাঁটি গাড়তে পারে, তবে তাদের রণতরী যেন হুগলী নদীতে বিলকুল না ঢোকে, শায়েস্তা খাঁ পইপই করে বলে দিলেন তাদের। চার্ণক এসে হাজির হলেন উলুবেড়িয়ায়, সেখানে একটা জাহাজঘাটা বানানোর কাজ শুরু করলেন। কিন্তু জায়গাটা তাঁর মনঃপূত হলো না একেবারেই। এর চেয়ে সেই গ্রামটা অনেক ভালো। মনে মনে চার্ণক তাকে পছন্দ করে ফেলেছেন। সেখানে ফেরার আবেদন জানাতেই শায়েস্তা খানের হুমকি ভেসে এলো – খবরদার! ওখানে ঘাঁটি হারগিজ বানাবে না।
এই যে গ্রামটা চার্ণকের এত পছন্দ হয়ে গেছিলো, তার কারণ আর কিছুই না, এর তিনদিক ঘেরা জলাভূমি। অনেককাল আগে এখনকার ব্যান্ডেল আর ত্রিবেণীর মাঝামাঝি হুগলি নদীর পশ্চিমতীরে সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁ ছিলো এক বিরাট বন্দর। নদীর ভাটিতে একই পাড়ে ছিলো বেতড় নামে এক গ্রাম – এখন যাকে ব্যাঁটরা বলা হয় - সে ছিলো এক উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যকেন্দ্র। এখানে পথিকেরা কেনাকাটা করতো, মা চন্ডীর পূজা দিতো। ১৫৩০ সাল নাগাদ বাংলায় পর্তুগীজদের যাতায়াত শুরু হয়, তখন মোগল আমল সবে শুরু হয়েছে, দিল্লীর গদিতে বাবর। বাংলা প্রদেশে তখন দুটো প্রধান বাণিজ্যিক বন্দর – চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রাম। পর্তুগীজরা চট্টগ্রামকে বলত Porto Grande বা Great Haven আর সপ্তগ্রামকে বলত Porto Piqueno বা Little Haven। টালির নালা বা আদিগঙ্গা ছিলো সমুদ্রে যাতায়াতের পথ। সমুদ্রগামী বড়োবড়ো জাহাজগুলো এখনকার গার্ডেনরীচ অঞ্চলে নোঙর ফেলতো। কেবলমাত্র দেশি ছোটো নৌকাগুলোই হুগলি নদীর আরো উজানের দিকে চলাচল করতে পারতো।
১৫৮০ সালে, মানে চার্ণকের এই সময়ের একশো বছর আগে, চুঁচুড়াতে পর্তুগীজরা একটা নতুন বন্দর স্থাপন করে। তার কিছু সময় পরে সাতগাঁয়ের দেশী বণিকরা নতুন আর একটা বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপনের দরকার মনে করলেন। তাঁদের অধিকাংশই হুগলিতে বসবাস শুরু করলেন, কিন্তু চারটে বসাক পরিবার আর একটা শেঠ পরিবার বেতড়ের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে নদীর পূবদিকে এক গ্রামের পত্তন করেন, সেখানে অধিবাসীরা বৈষ্ণবমতে গোবিন্দের পুজো শুরু করলো ঘরে ঘরে। সে গ্রামের নাম হয়ে গেলো গোবিন্দপুর। তার ঠিক উত্তরের গ্রামে চলে শক্তির উপাসনা। এখানে এক বহুকালের পুরনো কালীমন্দির আছে। তার জন্যেই হয়ত এর নাম কালীক্ষেত্র। লোকমুখে বদলাতে বদলাতে সে তখন হয়ে গেছে ডিহি কলকাতা। এই গ্রাম একেবারে গণ্ডগ্রাম নয় ঠিক, দুশো বছর আগে স্থানীয় কবি বিপ্রদাস পিপলাই মনসামঙ্গল নামে কাব্য লিখেছেন, সেখানে এই গ্রামের উল্লেখ আছে। তাতে লেখা ছিলো, চাঁদ সদাগর সপ্তগ্রাম বন্দরে যাওয়ার পথে সেখানকার কালীঘাটের মন্দিরে গিয়ে মা কালীর পুজো দিয়েছিলেন। গঙ্গার ধারে ডিহি কলকাতার উত্তরেই চার্ণকের পছন্দের গ্রাম। সেখানকার মানুষজন অধিকাংশই তাঁতী, তাঁতে সুতো কেটে কাপড়চোপড় বানায় তারা, গ্রামের নাম সুতানুটি। তাদের সুতোর হাট বসে কাছেই এক বাজারে, এরা তাকে বলে বড়োবাজার। তাঁতী ছাড়াও বেশ কয়েক ঘর জেলে, মালো, কৈবর্ত জাতির লোক আছে এখানে আর ব্যবসায়ী কিছু নিচু জাতের বণিক। তারা স্বর্ণবণিক বা গন্ধবণিক নয়, তাদের পদবী পোদ।
এক জায়গায় এতগুলো ঘর, কিন্তু তাদের পুজো আচ্চার জন্যে ব্রাহ্মণ পেতে যেতে হতো সেই ডিহি কলকাতার কালীমন্দিরে। কয়েক মাস আগে মহেশ্বর কুশারী নামে এক প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ ভাগ্যান্বেষণে পূবদিকের বাস উঠিয়ে এখানে কাজকর্ম খুঁজতে এসেছেন, সঙ্গে যুবক পুত্র পঞ্চানন আর ভাই শুকদেব। ব্রাহ্মণ বলে সুতানুটি-গোবিন্দপুরের মানুষজন তাদের খাতিরযত্ন করে নিয়ে গেছে তাদের গ্রামে, সেখানেই একটা চালা উঠিয়ে বাস শুরু করেছেন তাঁরা। গঙ্গার ধারে বিদেশী জাহাজের আনাগোনা লেগেই থাকে। জাহাজে মালপত্তর ওঠানো-নামানোর তদারকি করে দু’পয়সা আয় হয়। লেখাপড়া জানা ব্রাহ্মণ, তাঁরা বিদেশীদের সঙ্গেও কথাবার্তা বলতে পারেন দেখে গ্রামের মানুষ বেশ সম্ভ্রম করে তাঁদের। যাক, এতদিনে তাদের পুরুতঠাকুর পাওয়া গেছে। পুজোর আচার আচরণ বা মন্ত্র-তন্ত্র তাঁদের যে মুখস্থ ছিলো তা নয়, তবে অশিক্ষিত এদের কাছে নাই মামার চেয়ে কানা মামা তো ভালো। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জাহাজে মাল সরবরাহের তদারকি থেকে পাওয়া টাকা আর গ্রামের মানুষের বদান্যতায় গোবিন্দপুরে গঙ্গার ধারে জমি কিনে তাঁদের পাকা বাড়ি উঠে গেলো, প্রতিষ্ঠা হলো পারিবারিক শালগ্রাম শিলারও। সুতোর কারবার ভালো হলে গ্রামবাসীরা কলাটা মুলোটা এনে দিয়ে যায় তাদের পুরোহিত পঞ্চানন ঠাকুরকে।
জব চার্ণক দেখলেন, এই গ্রামগুলোর পশ্চিমে গঙ্গা আর পূব-দক্ষিণে দুর্গম জলাভূমি। কেবলমাত্র উত্তর-পূর্ব অংশে প্রহরার দরকার। জায়গাটা বেশ সুরক্ষিত। তিন গ্রাম মিলিয়ে জনপদ তেমন বেশি না। ব্যবসার জন্যে কুঠি বানাতে হলে এ বেশ ভালো জায়গা। কিন্তু উপায় কী! পিছনে পড়ে গেছে এখানকার সুবেদার শায়েস্তা খাঁ, হুমকি দিচ্ছে তাদের হটিয়ে দেবে।
শুধু হুমকিই নয়, এর সঙ্গে শায়েস্তা খাঁ ঐ আবেদন করার জন্যে চার্ণকের কাছ থেকে এক মোটা অঙ্কের জরিমানা দাবি করে বসলেন। অন্য সময় হলে চার্ণকের রক্ত গরম হয়ে যেতো, অবিলম্বে গোলাগুলি চালিয়ে বসতেন হয়তো, কিন্তু এখন সময় খারাপ, শায়েস্তা খাঁর সেনার সঙ্গে লড়াই করার মত পর্যাপ্ত ক্ষমতা নেই, তিনি ঢাকায় দূত পাঠালেন সুতানুটিতে কুঠি বানানোর অনুরোধের ব্যাপারটা পুনর্বিবেচনা করে দেখার জন্যে। তিনি সেখানে একটা দুর্গ বানাতে চান, কেবলমাত্র নিজেদের ব্যবসা সুরক্ষিত রাখতে।
ওদিকে চট্টগ্রাম লুঠতে পাঠানো নিকলসনের ভরাডুবির খবর ইংল্যান্ডে পৌঁছাতে ইংরেজরা বুঝে গেলো গঙ্গার ধারে একটা শক্তপোক্ত দুর্গ না বানাতে পারলে বাংলায় ব্যবসা বাণিজ্যে যে কোনো সময় গণেশ উলটানো থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। সবসময় বাংলার সুবেদারদের মুখ চেয়ে থাকতে হবে, তাদের যা মর্জি হবে, সেটাই তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে। এইভাবে কি ব্যবসা চলে? ক্যাপ্টেন হীথ বলে একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হলো, তিনি যেন হয় সুবেদারকে যুদ্ধে পরাস্ত করে ব্যবসা প্রশস্ত করেন, অথবা তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঘরের যাবতীয় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাংলা মুলুক ছেড়ে মাদ্রাজে ফিরে যান। এই দুরূহ কাজের জন্যে তাঁকে দেওয়া হলো একশো ষাট জন সৈন্য।
হীথ বাংলায় এলেন ১৬৮৮-র অক্টোবরে। সেখান থেকে যাবতীয় ইংরেজ মানুষ জাহাজে বোঝাই করে চললেন উড়িষ্যার বালেশ্বরে। ৮ই নভেম্বর সেখানে পৌঁছে আচমকা তুমুল গোলাবর্ষণ করে শহর ছারখার করে দিলেন। নিজেদের ফ্যাক্টরিও গেলো তছনছ হয়ে। উড়িষ্যার সুবেদারের জেলে যেসব ইংরেজ সেনা ছিলো, তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে বালেশ্বর থেকে সব্বাইকে নিয়ে ১৩ই ডিসেম্বর রওনা দিলেন চট্টগ্রামের দিকে। ১৭ই ডিসেম্বর পৌঁছালেন সেখানে, কিন্ত যা দেখলেন, তাতে তাঁর প্ল্যান চৌপাট হয়ে গেলো। দেখলেন, সেখানকার মোগল ঘাঁটি ভয়ানক সুরক্ষিত, তাতে দাঁত ফোটানোর ক্ষমতা মুষ্টিমেয় ক’জন ইংরেজ সেনার নেই। সুবেদারকে চিঠি পাঠালেন গঙ্গার ধারে দুর্গ বানানোর অনুমতি চেয়ে, কিন্তু সেখান থেকে জবাব আসার আগেই আবার দলবল নিয়ে যাত্রা করলেন আরাকানের পথে। উদ্দেশ্য, আরাকানের রাজার সঙ্গে হাত মিলিয়ে লড়াই করবেন মোগলদের বিরুদ্ধে। আরাকান রাজা মোগলদের শত্রু, তাই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
পরের বছর, মানে ১৬৮৯ সালের ৩১শে জানুয়ারি ক্যাপ্টেন হীথ পৌঁছালেন আরাকানরাজ্যে। রাজার কাছে সন্ধিপত্র পাঠালেন ঢাকায় একত্রে মোগলবিনাশের বার্তাসহ। এক পক্ষকাল কেটে যেতেও আরাকানের রাজার কোনো উত্তর না পেয়ে বিরক্ত হীথ ৪ঠা মার্চ তল্পিতল্পা গুটিয়ে মাদ্রাজে ফিরে চলে গেলেন। বাংলা জয়ের স্বপ্ন তাঁর অধরাই থেকে গেলো।
শুধু তাই নয়, আওরঙ্গজেব যেই দেখলেন ইংরেজ মাদ্রাজে ঘাঁটি শক্ত করছে, আশেপাশে তাদের প্রতিপত্তি বাড়াচ্ছে, তাঁর শত্রু শিবাজীর বড়ছেলে সম্ভাজীরাওয়ের সঙ্গে আঁতাত করছে, মোগলদের জাহাজ আক্রমণ করছে, তিনি নির্দেশ দিলেন ব্যাটাদের ভারত থেকে সমূলে উৎখাত করার। যেখানেই ইংরেজদের সম্পত্তি দেখা যেতে লাগলো, সব মোগল সেনাদের হাতে চুরমার হতে লাগলো। বিশাখাপত্তনমে তাদের ফ্যাক্টরি চুরমার হয়ে গেলো। ইংরেজ সেনা ধরা পড়লেই মৃত্যুদণ্ড। শায়েস্তা খাঁ ঢাকাতে যে কজন ইংরেজ সেনা ছিলো, তাদের তাড়া করে ধরে জেলে পুরে দিলেন।
সেই বছরই শায়েস্তা খাঁ বাংলার সুবেদার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর জায়গায় আওরঙ্গজেব বাংলায় পাঠালেন দ্বিতীয় ইব্রাহিম খাঁকে। আওরঙ্গজেব তখন বিজাপুরে। সেখান থেকে তিনি খবর পাচ্ছেন আরব সাগরে ইংরেজরা মক্কাগামী জাহাজে লুটপাট চালাচ্ছে। ওদিকে সারা দেশ থেকে ইংরেজদের ভাগিয়ে দেওয়ার ফলে তাদের কাছ থেকে রাজস্ব বাবদ যা টাকাপয়সা পাওয়া যাচ্ছিলো, তাও আসছে না। তিনি ভাবলেন, কাজটা ঠিক হলো না, এদের সঙ্গে মানিয়ে চলাই ভালো, ফোকটে কিছু রোজগার তো হয়। ইংরেজরাও তো চায় ব্যবসা বাড়াতে। সেই জন চাইল্ড এলেন দিল্লীতে। সম্রাটের সঙ্গে কথাবার্তা হলো। ইব্রাহিম খানের কাছে নির্দেশ গেলো বাংলায় ইংরেজদের ব্যবসার অনুমতি দেওয়ার। তিনি জব চার্ণককে ডেকে পাঠালেন।
ধুরন্ধর চার্ণক মোগলদের ব্যাপারটা আঁচ করেছিলেন ভালোই। তিনি এত সহজে আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি হলেন না। বললেন, আগে সম্রাটের ফরমান নিয়ে এসো, তাতে যেন সমস্ত শর্তাবলি লিপিবদ্ধ করা থাকে। ফরমান ছাড়া ব্যবসা শুরু করলেই সুবেদারের লোকজন পেছনে পড়ে যায় ফেউ-এর মতন, অশান্তির একশেষ, তা তিনি চান না। ইব্রাহিম খাঁ বললেন, ঠিক আছে, তাই হবে, সম্রাটের স্পেশ্যাল ফরমান আনিয়ে নেওয়া যাবে, তবে তাতে দু-তিন মাস সময় তো লাগবে। তুমি বাপু চলে এসো বাংলায়, আগের মতই বিজনেস শুরু করে দাও। বুঝতে পারছি শায়েস্তা খাঁ তোমাদের শায়েস্তা করার জন্যে সব ভাংচুর করে দিয়েছে। আমি তার জন্যে আশি হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছি।
এ তো গাছে না উঠতেই এক কাঁদি! জব চার্ণক যেন হাতে চাঁদ পেলেন। মাত্র তিরিশজন সৈন্য নিয়ে জলা ডিঙিয়ে ফিরে এলেন তাঁর এককালীন অজ্ঞাতবাসের ক্ষেত্র সেই সুতানুটি গ্রামে। ২৪শে অগাস্ট ১৬৯০ সালে সুতানুটির হুগলীর তীরে ইংরেজদের পতাকা উত্তোলন করা হলো। বছর ঘোরার আগেই সম্রাটের ফরমান এসে গেলো হাতে। বাংলায় কোনোরকম শর্ত ব্যতিরেকেই তাঁদের ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে তাতে, আর এর জন্যে বার্ষিক তিন হাজার টাকার বেশি এক পয়সাও কর দিতে হবে না। ইংরেজদের পুরো পোয়াবারো।
বড় করিৎকর্মা লোক এই চার্ণক। নোঙর ফেলার চারদিন পরেই শুরু হলো কাউন্সিল মিটিং। দেখা গেলো, আগে যখন তাঁদের এখানে বসতি ছিলো, তার সবই প্রায় গেছে। আবার বাড়ি তৈরী করতে হবে। ভাঁড়ে মা ভবানী, সুতরাং সস্তা বাড়ি বানাতে হবে, মাটির দেওয়াল, খড়ের চালওলা। ফ্যাক্টরির জন্যে জমি চাই, যতদিন তা না পাওয়া যায়, ততদিন কোনোরকম করে চালাতে হবে।
সেই খড়ের চালের বাড়িও আগুন লেগে পুড়ে গেলো একদিন। তার জায়গায় লোকের কাছে টাকা ধার করে তোলা হলো পাকা বাড়ি, সেটাও বেশিদিন ধরে রাখা যায়নি টাকা শোধ দিতে না পারায়। নিলামে সে বাড়ি বিক্রি হয়ে গেলো ৫৭৫ টাকায়। চার্ণক বাস করতে লাগলেন নৌকায় দলবল এবং কন্যাদের নিয়ে। কাউন্সিলের মিটিং, আড্ডা আর ব্যবসাপাতি সব হতো এক প্রাচীন বটগাছতলায়।
খুব বেশিদিন অবশ্য চলেনি এসব। সুতানুটিতে ফিরে আসার দেড় বছর পরে ১৬৯২ সালের ১০ই জানুয়ারি জব চার্ণকের মৃত্যু হয়। তার আগে পর্যন্ত যতবার ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধির কথা তুলে বাংলায় তাঁদের কুঠিকে দুর্গ বানাতে চেয়েছেন, ততবার বাধা পেয়েছেন ইব্রাহিম খানের কাছ থেকে। কিন্তু চার্ণকের মৃত্যুর বছর তিনেক পরে হঠাৎ শোভা সিং আর রহিম খাঁ নামে দুজন স্থানীয় বিদ্রোহী হুগলী শহর দখল করে নেয়। ইংরেজরা তখন তাদের সুতানুটির ঘাঁটি সুরক্ষিত করতে নিজস্ব সৈন্য মোতায়নের দাবি তোলে আবার। ইব্রাহিম খাঁ ঘাঁটি সুরক্ষার প্রস্তাব মেনে নেন, কিন্তু তার জন্যে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েনের ব্যাপারে সায় দেননি। ইংরেজরা অবশ্য সুরক্ষার প্রস্তাবে সায় দেওয়াকেই তাদের সপক্ষে যুক্তি ধরে নিয়ে রাতারাতি দুর্গ বানানো শুরু করে দেয়। মাদ্রাজ থেকে জাহাজে নিয়ে আসা হয় দুর্গ বানানোর জন্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলে এই কাজ, তৎকালীন ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়মের নামে এই দুর্গের নাম রাখা হয় ফোর্ট উইলিয়াম।
সেই যে রাজা আদিশূর, যিনি যজ্ঞ করতে গিয়ে দেখলেন বাংলায় বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ নেই, তাই কনৌজ থেকে আনিয়েছিলেন পাঁচজন ব্রাহ্মণ, যাঁরা বাংলাতেই থেকে গেলেন আর তাঁদের থেকেই শুরু হলো বাংলায় যাবতীয় বামুনকুল, তাঁদের একজনের নাম ছিলো বেদগর্ব, তিনি সাবর্ণগোত্রীয়। তাঁর এক উত্তরসূরী পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায় যুদ্ধে বীরত্ব দেখিয়ে মোগল সম্রাট হুমায়ূনের কাছ থেকে খান উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁর নাম হয়ে যায় পাঁচু শক্তি খান। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি তিনি এক বিশাল প্রাসাদ বানান গঙ্গার ধারে, সে জায়গার নাম রাখেন হাভেলি শহর। লোকমুখে এর নাম হয়ে যায় হালিশহর, সেখান থেকে গঙ্গোপাধ্যায় পরিবার ছড়িয়ে পড়ে উত্তরপাড়া, বিরাটি, বড়িশা প্রভৃতি অঞ্চলে। সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ায় রাজা মানসিংহের আমলে এই পরিবারের লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় এক বিশাল ভূসম্পত্তির জায়গীর বা জমিদারি পান, তার সঙ্গে পান রায়চৌধুরী খেতাব। হালিশহর থেকে বড়িশা রাস্তা বানিয়ে দেন তিনি আর স্থাপন করেন প্রচুর মন্দির। লক্ষ্মীনারায়ণের পরে তাঁর বংশের সবাই রায়চৌধুরীকেই পারিবারিক পদবি বানিয়ে নেয়, তাদের বলা হয় সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার। এই পরিবারের অধীনে ছিলো চার্ণকের পছন্দের সুতানুটি, তার দক্ষিণে ডিহি কলকাতা আর তার দক্ষিণে গোবিন্দপুর গ্রামের জমিদারিও।
জব চার্ণক মারা যাওয়ার ছ’বছর পরে তাঁর বড়মেয়ে মারির বর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী চার্লস আয়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কাছ থেকে এই তিন গ্রামের জমিদারির স্বত্ব কিনে নেন কোম্পানীর তরফে। ইংরেজ প্রথামাফিক মুঘল রাজদরবারে প্রভূত ঘুষ দিয়ে ও বার্ষিক তেরোশো টাকা রাজস্বের বিনিময়ে এই তিন গ্রামের স্বত্ত্ব ইংরেজদের দিয়ে দেওয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ফার্সিভাষায়। ইংরেজদের উচ্চারণে কলকাতা হয়ে যায় ক্যালকাটা। একদা এক দুর্গম, জলা, প্রায়-পরিত্যক্ত তিন অজগাঁ একত্র করে পত্তন হয় ভারতের নিকট-ভবিষ্যতের রাজধানী ক্যালকাটা প্রেসিডেন্সির। (ক্রমশ)
0 comments: