Next
Previous
Showing posts with label মুক্তগদ্য. Show all posts
0

মুক্তগদ্য - অপরাহ্ণ সুসমিতো

Posted in


মুক্তগদ্য


পরাজয় বন্দনা
অপরাহ্ণ সুসমিতো



মেয়েটার কি কেউ নেই? মেয়েটি কোন দেশে থাকে বা কোন নগরে? ওর চেনা কে কে আছে? জল তো পড়ে, পাতা নড়ে, বাতাস অবিরাম দোল খায়। কী সুন্দর অন্ধ সে কিছুই দেখে না।

না কেউ নেই কোথাও!

সেনাবাহিনী মার্চপাস্ট করছে না, কুচকাওয়াজের শব্দ শোনে না, যেমন শুনছে না সুর সুর গান। ভয় ভয় লাগে। একা হলেই তার ভয় লাগে। আজকাল ঘরে ফিরতে মন চায় না। গভীর রাতের অন্ধকারকে জানান দিয়ে সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করে তার। আকাশকে বলে: আকাশ বৃষ্টি দাও তো। জলে ভেজাও সারা ঢাকা। আকাশ তোমার জল উজাড় করে দাও। ঢাকা থেকে অসুন্দর নিপাত যাক। তোমার জল থেকে আমি কিছুই বাঁচাব না শুধু বইয়ের পাতা ছাড়া। অপলক ভিজে ভিজে আমি প্রার্থনা করব:

রোদ্দুর সরাও তোমার করাল ছায়া 
দাও বৃষ্টি দাও তোমার অমল মায়া

সে স্বপ্ন দেখে (আদৌ কি মানুষ স্বপ্ন দেখে?)। স্বপ্নময় মানুষ নিশিপদ্ম হাতে নিয়ে বসে থাকে চৌপর। ঢাকা শহরে এত মানুষ কি চায়? এতো ভিড় কেন? ঘুমন্ত মানুষ কি জেগে উঠবে না ভিড়ের পদধ্বনি শুনে?

মনে হচ্ছে পরাজিত হচ্ছে কুসুম ও কলি। ঘুম পরাজিত হচ্ছে মধ্যরাতের খুরধ্বনি শব্দে। শব্দগুলো কী বিভীষিকাময়! শব্দগুলো কি কিশোরীবেলা ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে?

হু হু কেঁদে উঠছে গাছ, সরণী, সরু পথ, নগর, অসভ্য ফুটপাত। কখন রাত্রি শেষ হবে? কখন ফুটবে ভোরের চিবুক সুন্দর আলো? হাসপাতালে জেগে আছে অসুখী কিশোর, স্বরাষ্ট্র বিভাগ। ঐ কিশোরের চিবুকে কি প্রথম প্রেমের ছায়া?

মেয়েটির তো বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। হাঁটে। তৃষিত জলৌকা হয়ে অবিরাম অগণন হাঁটে। ও আচানক ঝরঝর কেঁদে ফেলে: ও হানাহানি তুমি মরো।

মধ্যরাতে জন্ডিসের আলোতে আর নিজের ছায়া দেখে না। পাগলের মতো সে নিজের ছায়া খুঁজতে থাকে। না, নেই। দিঘির কাছে যেতে চায় সে। কোথায় দিঘি? দিঘি কি তবে মা?

এত হলুদ হয়ে আছে পরনের স্যান্ডেল, কানের দুল, গলার কাছে চুমু খাওয়া তিল। মনে হচ্ছে অন্তর্বাসগুলোও হলুদ হয়ে আছে। কী অসহ্য আয়নাবিহীন রাত!

স্তব্ধতা নামছে ধীরে ধীরে। আদালত থেকে মামলা লোপাট হচ্ছে। মানুষ মিশে যাচ্ছে জলে। স্বৈরাচারী ফুল ফুটছে অকাতরে। ভিন গোলার্ধে বাস করছে সুষমা। অভিধান ভরে যাচ্ছে পরাজয়ের সমার্থক শব্দে।

মোম ঘর বাঁধে অন্ধকারে।

একদিন কনে দেখা আলোর কাছে নুয়ে থাকবে সে। আকাশ ছোঁয়া বাড়ি থেকে সখি পতাকার মতো হাত নেড়ে বলবে: ও ব্যর্থতার যুগ্মসচিব, বাড়ি ফিরে যাও। বাড়ি ফেরো। বাবুই পাখির মতো স্বদেশ বাঁধো। বাঁধো...





0

মুক্তগদ্য : শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়

Posted in


মুক্তগদ্য


মাকড়সা
শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়

গতকাল আমাদের মধ্যের দূরত্বে চিহ্ন রেখে গেছে ইকড়িমিকড়ি কিছু মাকড়সা-পংক্তি। কথা ছিল ব্যক্তিগত পরিসর কিন্তু কালো ওই মাকড়সার নিভাঁজ দুলকি রীতিমতো শোর মাচানো! ফলে অসংকলিত হল যুগ্ম ছবি আর রঙগুলো লাফিয়ে এল ইনডিভিজ্যুয়াল জড়িয়ে মড়িয়ে প্যালেটের মেশালীতে নতুন ক্রিয়েটিভ নেমন্তন্নয়। সকালেরকাগজবাইলেকট্রিকবিলজমাদেওয়া- এইসব রুটিন অবশ্যম্ভাবীগুলো বাদে দিনের বাকি পৃষ্ঠায় পড়েরইল চন্দ্র অভিযান বা পরস্পরকে আবিষ্কারের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস ঘাঁটা। অথবা ‘অপেক্ষা’ নামক ঘরোয়া টোটকা সহায় কারণ মাকড়সার ব্যবহৃত শব্দরাশি (যেমন মেরি স্টোপস) দেখিয়েছিল কতটা প্রাগৈতিহাসিক এই প্যারালালিজম। পদবীযুগলের থার্ড ব্র্যাকেটের আভাসেও তো আসন্ন পাখির ওড়াউড়ির মতো একাকী যাপন।

নাকি

মাকড়সার রক্তবীজ সম্পৃক্ত সুতোর রিফু সেলাইয়ে সম্ভাবনাময় আমাদের দ্বৈত নির্লিপ্তির প্যাশনেট ক্র্যাশল্যান্ডিং...
0

মুক্তগদ্যঃ পল্লববরন পাল

Posted in


মুক্তগদ্য



নিজস্ব কুরুক্ষেত্রে
পল্লববরন পাল



এক


উঠোন সেজে উঠেছে আবর্জনা-আগাছা-জঞ্জালে – যেন বসন্তের সাজ – শীতের বাদামি ঝরাপাতা আর বৃক্ষের কঙ্কালে – সকলের চোখের সামনেই একটু একটু করে নির্মাণ –অথচ সময়ের কোতোয়ালি দৃষ্টিকে নিপুণ অভিমানের আড়ালে রেখেই।

সদর দরজা থেকে আকাশ-ছাদউঠোন পেরিয়ে দালানে ওঠার সিঁড়ি। পঞ্চাশোর্ধ প্রাচীন বাড়ির পলেস্তারা খসাইঁটের ভাঁজে ভাঁজে বনস্পতির উলঙ্গ শেকড়বাকড় – যেন দাঁতালো বিদ্রুপ হাসি ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিবেশী রোদ্দুরে। ধুসর প্রৌঢ় চুনকামি দেয়ালে দেয়ালে, কড়িকাঠের সেগুনের অসংখ্য উইশিরার বক্ররেখায় আর কব্জা ভাঙা জানলার খড়খড়ি পাল্লার ধুলোয় আটকে আছে পঞ্চাশ বছর আগের হৈহৈ অধ্যায়–আবছা ক্লান্ত মাকড়শার জালে ঝুলে থাকা টুকিটাকি স্বপ্ন – যেন দূর সম্পর্কের কোনো রঙ চটা শিলালিপির দীর্ঘশ্বাস।

একএকটা ঘরের মধ্যে এক একটা মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস – আবাল্য স্মৃতির হলুদউপন্যাস। কেউ লেখেনি, কেউ পড়েনি, তবু কী সদর্প সাড়ম্বর অক্ষর ধুলোয় নিপুন প্যাপিরাস চাষ!

রোজের যাওয়া আসার এতোদিনের অভ্যস্ত পথে বাড়িফেরার বিষণ্ণ গোধুলি অকস্মাৎ হাহাকার করে উঠলো। 

কাল রবিবার। এই মলিনআবর্জনা-ধুলোর বিরুদ্ধে ঘর্মাক্ত আস্ত একটা দিনের হার-না-মানা লড়াই...

ও শৈশব, 

সন্ধ্যেবেলা তাড়াতাড়ি এসো – উষ্ণ ধোঁয়ার আলপনা আঁকা পেয়ালায় জীবনমুখি চায়ের সবান্ধব নিমন্ত্রণ রইলো।

-------------------------------------------



দুই


একটা দরজা। তার দু’দিকে দু’টো জানলা। নীল। মাথার ওপর সিঁদুরে লাল ত্রিভূজ ছাদ। দরজার নিচে তিনটি সিঁড়ির ধাপ। সেই ধাপের প্রান্ত থেকে একটা খয়েরি রঙের রাস্তা এঁকেবেঁকে নাচতে নাচতে গেছে পুকুর পাড়ে – যে পুকুরে ভেসে যাচ্ছে সাদা হাঁস, তার গোলাপি ঠোঁট। পুকুরপাড় ছাড়িয়ে রাস্তা গেছে মাঠের দিকে। সবুজ মেঘের মতো গাছ। টঙে বসে আছে পাখি। বাড়ির পিছনে ঘন জঙ্গল। তারও পিছনে ধূসর পাহাড় চূড়োর মাঝখানের উপত্যকায় উঁকি দিচ্ছে আগুন সূর্য।

শৈশব।

আমাদের প্রত্যেকের। এই অবধি হুবহু একই রকম।

আমরা সবাই সেই নীল দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিলাম খয়েরি রাস্তায়।

কেউ কেউ দৌড়ে গেছি মাঠে। গাছের ছায়ায় কেউ বসেছি বাঁশি হাতে। হাওয়ায় হাওয়ায় ঘাসের ছন্দে সুর তুলতে। তরতর করে কেউ উঠে গেছি মগডালে – পাখির কাছে গিয়ে বলেছি – তুমি কি ব্যাঙ্গমা? তবে মেঘের দেশের রূপকথার কাহিনী শোনাও। এ ডাল থেকে কেউ ও ডালে লাফ দিয়ে দোল দোল দুলুনি। ডালের গোড়ায় বসে কেউ একমনে একের পর এক ফল খাচ্ছি। কেউ কাঁচা ডাল ভেঙে মড়াৎ।

কেউ কেউ ঝাঁপ পুকুরের জলে। কেউ ডুব সাঁতারে মাছের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। কেউ হাঁসের কাছে পাঠ নিচ্ছি ভেসে থাকার। কেউবা স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে উঠে এলাম।

আমাদের কারুর কারুর জঙ্গলের রোমাঞ্চে নেশা। কেউ আবার জঙ্গল পেরিয়ে পাহাড়ের দুর্গম পাথরের খাঁজে খাঁজে ভর করে চলেছি শিখর জয়ের লক্ষ্যে। কেউ আরো দূরে পাহাড় পেরিয়ে চলেছি সূর্যসন্ধানে।

দিনের শেষে ফের সবাই যে যার মতো ফিরে আসি ঐ সেই খয়েরি রাস্তা ধরে।

শৈশবে। নীল দরজায়।

--------------------------------------------------------------------



তিন


কৃষ্ণ বলিলেন - 

মোবাইল টেপো। ছবি তোলো। বেচে দাও। ব্যাস।

কলকাতা ডায়মণ্ডহারবার রাণাঘাট তিব্বত। সিধেরাস্তা। সোয়া ঘন্টার পথ।

যুদ্ধের দুটিমাত্র পিঠ। মুদ্রার মতোন। হার আর জিত। হেড আর টেল। ত্রিসিংহ স্তম্ভ পিঠ, যাকে তুমি জয় বলে জানো – ভুল। স্তম্ভ তো স্থবিরতা, ইতিহাস, সমাপ্তি চিহ্নমাত্র, মৃত। অন্য পিঠে দ্যাখো – সংখ্যা – গণিত – মুদ্রামান, তোমার অর্জন – জয়। সমগ্র আকাশ।

মাটি আর আকাশ – মাঝখানে অনর্থক কুয়াশার দিকশূন্য স্তর – সম্পর্ক স্মৃতি ইতিহাস - মায়া। শুধু মুধু বাড়িয়ে কী লাভ? ধুয়ে জল খাবে? মায়ার চেয়ে মুদ্রার দাম বেশি। সম্মানও।

মায়া নয়, মুদ্রায় এসো।

যে অধ্যায় সমাপ্ত – তাকে বেচে দাও। যে সময় ডিঙিয়ে এসেছো – বেচে দাও। যে বইয়ের পৃষ্ঠা হলুদ – বেচে দাও।

বেচে দাও। বেঁচে ওঠো।

একটি মাত্র চন্দ্রবিন্দুর ব্যবধান। হলুদ চুম্বনের দাগ – তোমার কপালের।

পাহাড় জঙ্গল মাঠ পুকুর। হাঁস মাছ পাখি ফল ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী রূপকথা সব। দাও বেচে। নইলে প্রোমোটরকে দাও। ভেঙে গুঁড়িয়ে সমতল করে বানাবে স্বর্গরাজ্য। বিলাস আমোদ। অনেক মুদ্রা পাবে বিনিময়ে। লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি।

হে সারথি মধুসূদন, 

কিছু যে বাদ পড়ে গেলো তালিকায়।

কী ভাবে বেচবো সূর্য? জন্মসূত্র?

নীল দরজা? মাতৃ যোনি? 


আমরা তো সকলেই যে যার মতোন করে সূর্য সন্ধানী। শৈশবে ফিরতে হবে সন্ধ্যেবেলা। নিমন্ত্রণ আছে।
0

মুক্তগদ্যঃ অপরাহ্ণ সুসমিতো

Posted in


মুক্তগদ্য


কাল সন্ধ্যায় আমি মারা গেছি
অপরাহ্ণ সুসমিতো



কাল সন্ধ্যা সাতটা তেত্রিশ মিনিটে আমি মারা গেছি

আমার মারা যাবার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদযন্ত্রের সমস্যা কোনওটাই ছিল না।

ঝুঁকিমুক্ত থাকার জন্য জীবনবীমা করেছি, গোলাপ বাগান করেছি, কখনও রেইন ফরেস্টে ঘন্টার পর ঘন্টা পাখপাখালিদের ঘর সংসার দেখেছি। মরবার কোনো বিলাসী সাধও আমার কখনও ছিল না।

নরম আর্তনাদ খান খান করে জেগে ওঠে যখন মধ্য দুপুরে আসন্ন আষাঢ়ের আসন্ন প্রথম পূর্ণিমায় আমার লাশ পড়ে থাকে এই আশ্চর্য বালুচর সংসারে।

মাছের চোখের মতো তাকাতে তাকাতে আমাকে মৃত ঘোষণা করেছো তুমি আমার শবদেহের সামনে শোকবাণী উচ্চারণ করছো খবরের কাগজে শিরোনাম হয়েছে বিষণ্ণ হরপ্পা হরফে।

নিপুণ সভ্যতায় তোমার চোখে শোকার্ত কালো চশমা তোমার দ্রাবিড় শরীরে অতীতের কোমল বাকুম তিল তিল সংসার তাকাও,দেখো আমার লাশ শুয়ে আছে তোমার কুসুমিত মেঝেতে।

চারপাশের পিপাসার দুপুর...আমি দেখতে পাচ্ছিনা তুমি কাঁদছো কি না !

পৃথিবী চলছে নবীন মেঘে কবিতার খোকন, গোলাপি খুকি ও পাড়ার বকুল
মোটাসোটা নায়িকা, সর্দি লেগে থাকা সাংসদ,চশমা চোখে নীলুফার ফরমালিন বিক্রেতা, গোয়ালন্দের সর্দারনী,রাম শাম যদু মধু রহিম... সবাই চলছে।

সবাই হুমহুম করে হেঁটে যাচ্ছে। কোথাও কেউ থেমে নেই 

মৃত মানুষের আটচালা নেই, কোনও সহায় নেই জেনো 

শোনো, তোমার সামনে লাশ হয়ে আছি...

কোথায় রাখবে বলো এ শব ? 

শুইয়ে দাও না আমাকে

0

মুক্তগদ্যঃ দীপঙ্কর বেরা

Posted in


মুক্তগদ্য



ভাব অভাব 
দীপঙ্কর বেরা


অভাবকে কিছুতেই সঞ্চয় করে রাখব না। যদিও তাকে যত সরাতে চাই সে আমাদের এই ন্যালা ফেলা জীবনে বার বার ফিরে আসে। কত কষ্ট করে ভাবকে জমিয়ে রাখি। সুযোগ বুঝে ঝাঁপি থেকে খুলব আর অনেকটাই এগিয়ে যাব জীবন পথে।

কিন্তু ভাবের ঘরে হয়ে যায় চুরি আর আমি দিশেহারা। আর অভাব লেগেই থাকে। তাকে যতই খরচের খাতায় লিখে রাখি সে ঠিক উঠে চলে আসে জমার ঘরে। যে করেই হোক দিনের শেষে শূন্যমেলাতে হবে। তাই অভাবকে বাদ দিয়ে অঙ্ক হয় না।

আর তখনই বুঝলাম, ওরে বাস! এ যে সেই সমীকরণ। অভাব আছে বলেই আমি এত ভাব খুঁজে পাই। যতই চুরি হোক, এই অভাব আমাকে অন্য, আরও অন্য এক ভাবের ঘরে পৌঁছে দেয় রোজ। আমি এক আকাশ থেকে অন্য আকাশে দৌড়ে যাকে তাকে ধরে ফেলতে পারি। কেননা আমার অভাব আমার সঙ্গে আছে। সে জাগিয়ে রাখে তাই সমীকরণেও এসে যায় সরলতা। ভাবের পর ভাব। আর আমার জীবনী স্বভাব।

তবে হ্যাঁ, এক অভাব ডিঙিয়ে অন্য অভাবে অবাধ বিচরণ করি তাই সঞ্চয় করি না। কিন্তু ভাব সঞ্চয় করি। জমিয়ে রাখি। অভাবকে তাড়াতে মাঝে মাঝে ভাবকে নাড়াচাড়া করার অনন্য ঔষধের জুড়ি মেলা ভার।

তাতে কি হয়... এই খুব কষ্ট আর এই খুব আরাম। যেন এই মেঘ তো এই রোদ্দুর। আর পরক্ষণে বৃষ্টি।তাই আমি তো মাঝে মাঝে অভাবকে আহ্বান করি। পাশ দিয়ে চলে গেলে হবে না। আমার বাড়ি আসতেই হবে। তাই করলাম কি, পেছনে লেগে গেলাম। দিলাম খুনসুটির সঙ্গে একটু ঝালের আরক। বেশ লেগে গেল। পাল্টে গেল মুহূর্ত। শুধু খেয়াল রাখি সীমা যেন না ছাড়িয়ে যায়। মানবতা লঙ্ঘন করে তা যেন কোন সংশয়ের মধ্যে আমাকে না ডুবিয়ে দেয়। কিছুতেই জীবনকেও হাত দিতে দিই না।

আর আমার টেনশন! পালিয়ে গেল আহ্লাদ। জুটবে কি না জানি না। অভব্যের মত তার অন্য আনাগোনা। আর আমার ভাব সঞ্চয়।

কুড়িয়ে বাড়িয়ে তাকে কিছুতেই হাত ছাড়া করি না। দাঁড়াতেই হয় ফুটপাতে। মোড়ে। লোকালয়ে। ঝুপড়িতে। এমন কি ইমারতেও মাঝে মাঝে ঢুঁ মারি। পেয়ে যাই তাদের। সহজেই পেয়ে যাই। আর তারা এত সুন্দর করে আমার ভাবের আগমন ঘটিয়ে দেয় যে আমি একেবারে বিমোহিত হয়ে যাই।

শত অভাবের মধ্যে আমি তাই আজও ভাব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
0

মুক্তগদ্যঃ রিয়া চক্রবর্তী

Posted in


মুক্তগদ্য


স্বপ্ন পরিযায়ী স্বপ্ন
রিয়া চক্রবর্তী


সময়ে অসময়ে মনের মধ্যে বাসা বাঁধে সমুদ্রের উচ্ছ্বাস। দলছুট কোনও ঢেউ তীরে এসে সুর তোলে ছলাৎ ছলাৎ। নীল জলে স্বপ্নভ্রূণ উল্লাস, অন্ধিতে, সন্ধিতে খোঁচা দেয় শীতের আগমনের। পর্বতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে উড়ে যায় এক ঝাঁক পরিযায়ী পাখি। সর্বস্ব পিছনে ফেলে নতুন ভূগোলে এসে সংসার পাতে তারা। যার সাক্ষী ইতিহাস যুগ যুগ ধরে।

বুক তোলপাড় করে চলে ইচ্ছেদের সাথে স্বপ্নের কথোপকথন। আকাশের সন্ধ্যে পাড়ায় তারাদের চঞ্চল আগমন। এই তারারাও কিন্তু পরিযায়ী। আজ একজায়গায় তো কাল অন্য জায়গায়। স্বপ্নরাও পরিযায়ী। ডেইলি প্যাসেঞ্জারের মতো একই কাপড় পরে চলে যায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। শুনেছি স্বপ্নেরা সুন্দর হয়,জন্ম হয় শুভ্র অথবা শীতল মনের আঁতুড় ঘরে।আবার যখন ছেড়ে চলে যায়,চোখ চঞ্চল হয় একফোঁটা অথবা দুফোঁটা জলকণায়। 

পরিযায়ী শব্দটি সম্ভ্রমে মাথা নীচু করে একমাত্র মেয়েদের কাছে। সে ঘুরে বেড়ায় বাবার ঘর থেকে বৃদ্ধাশ্রম পর্যন্ত। একজন মেয়ে বউ হয়, মা হয়। নতুন ভূগোলে এসে সে ভুলেই যায় সে অতীতে কি পড়তো, কি ভাবতো বা কি খেতো। কবে সে কোন বিকেলে বন্ধুদের সাথে খেলনা বাটি খেলেছে।আড্ডায় কি রঙের জামা পরে ভেসেছে, হেসেছে, কেঁদেছে!যখন তার মন কষ্টে নীল হয়, একটাও কোল সে পায়না, যেখানে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে পারবে। নীরব নিষ্প্রাণ বালিশগুলো তার নোনা জলের সাক্ষী। 

যখন ঋতু বদল হয়, সাথে সাথে কতবার তার মুড’ও বদলেছে ঐ ঋতুর সাথে পাল্লা দিয়ে, পরিযায়ী তাই তার খেয়াল রাখেনা কেউ। মেয়েটি একদিন সত্যিই বদলে যায় যখন এক নতুন অতিথি আসে তার কোল জুড়ে। ইতিহাস সাক্ষী এই বদলের যুগ যুগ ধরে।


0

মুক্তগদ্যঃ শিবলী শাহেদ

Posted in



মুক্তগদ্য


যে শহরের নাম প্রান্তমুখী
শিবলী শাহেদ


বারান্দায় দাঁড়ালেই মনে হয়— বাড়ির সামনে যে রাস্তাটি সটান শুয়ে পড়েছে— তারও আছে কোনো ব্যতিক্রমী পরিচয়। ফলে রাস্তায় নামি। দেখি দুপাশ দিয়ে উঠে গেছে কত সুসভ্য দালান। হেলানো, স্থির চক্ষু। এরকম এক মাঝারি উচ্চতার দালানের সাথে দু'দণ্ড চোখাচোখিও হয়ে গেল। আর তক্ষুণি পাগলটা হাত তুলে ডাক দিল। কী হে, খবর ভালো? আমি মাথা নাড়াই। স্রোতের মতো রিকশা আসে, যায়। রিকশার ঘণ্টাধ্বনিতে হৈ হৈ ক'রে জেগে ওঠে প্রান্তমুখী শহর।

নতুন ক'রে রাস্তার সাথে পরিচয়ের মূল পর্বটুকু পেরুতে না পেরুতেই আরেক রাস্তার সূচনাবিন্দুতে এসে স্থির হলাম। এখানেই আমার শৈশবের ইশকুল। প্রান্তমুখী উচ্চবিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের মাঠে গিয়ে দাঁড়াই। টের পাই, কথারা হারায়নি। যে জায়গায় যে কথাগুলো বলা হয়েছিল সেখানেই সেগুলো রয়ে গেছে, ঘুরছে। ছদ্মবেশী ছায়ায় যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে স্মৃতিজাগানিয়া সমস্ত হাওয়া-সংলাপ!

আজ ক্লাস করব না...
ছুটি, ছুটি...
ক্যান্টিনে যাই...
স্যার আজ আসেন নাই...
বিদায় বন্ধু সৌরভ...
এসেম্বলি হবে এক্ষুণি...
দোস্ত, আসি...
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি...

আমার পৃথিবীটা দুলে ওঠে। আমি শৈশব হারিয়েছি, আমার তো আর কিছু হারাবার নাই। ফলে ঘাসের বুকে আমি নতজানু হয়ে ঈশ্বরের কাছে শৈশবকেই ফিরে চাই। অদূরেই শ্রেণিকক্ষ। শিক্ষক রোল কল করছেন। আমি করিডর ধরে হাঁটতে থাকি। শিক্ষক কোথায়, এ তো সেই পাগলটা। আমাকে দেখেই হাত নাড়লো। কী হে, খবর ভালো? আমি ধন্দে প'ড়ে যাই। কম্পিত পায়ে ফের এগুতে থাকি। আরেকটা কক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। যে শিক্ষক পড়াচ্ছেন তিনি অবিকল আমার মতো দেখতে, ছাত্রদের মুখগুলোও সব আমারই মুখ। নিঃশব্দে নিজের ভীড়ের ভিতর গিয়ে বসে পড়ি। আর অপলকে দেখি— এই শহরের সবচেয়ে প্রাচীন বিদ্যালয়ে দাঁড়িয়ে আমি আমাকেই শিখিয়ে চলেছি বৃত্তাভিমুখী জীবনের আরো কোনও দুর্বোধ্য সমীকরণ...



1

মুক্তগদ্যঃ পল্লববরন পাল

Posted in


মুক্তগদ্য


নেঃ খাঃ
পল্লববরন পাল




কেনরে তোরা সবাই এখনও বর্ষাকাল? কেনরে তোরা সবাই এখনও ভাঙা পাঁচিল? মুখ তোল। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দ্যাখ – শারদ রোদ্দুরে ভেসে যাচ্ছে সেই এবড়ো খেবড়ো রাস্তা, পুকুর পাড়, তালসারি মাঠে কাশফুলের বাৎসরিক সমুদ্রোৎসব – চিনু কাকার ঝালমুড়ির দোকানে ঝাড়পোঁছ হবে বলে কাঁচের বয়ামগুলো তাক থেকে মাটিতে নেমেছে, গন্ধেশ্বরী স্টোর্সের কাঠের শাটার প্রতি বছরের মতন পুজোর ঠিক আগে আগেই তো রঙ বদলায় – এবার কি আকাশনীল না ঘাসসবুজ? বুল্টিদার বইয়ের দোকানে শারদীয়া পত্রিকা এসেছে?

রাজমিস্ত্রির জীবনে আবার কিসের মহালয়া, কিসের পুজো? – তাই তার পরিবারেও ওসব উৎসব টুৎসব নেই কোনও দিন। কত দূরে দূরে বাবা কাজে যেতো – পাঁচ-ছ’মাস পরপর এক-দুদিনের জন্য যখন বাড়ি আসতো – সেদিনটাই ছিলো আমাদের উৎসব। আমাকে আর ভাইকে বুকে জড়িয়ে বাবা বলতো – তোরাই তো আমার উৎসব। ঐএক-দুদিন মায়ের চোখের দৃষ্টিতে ছড়িয়ে যেতো উৎসবের আলো। হ্যারিকেন দাওয়ায় চারটে থালায় গরম ভাতের গন্ধে ম’ম করতো আমাদের উৎসব।

শুনেছি সেকালে রাজা মহারাজেরা উৎসবে ঢাক ঢোল-খোল-করতাল বাজিয়ে মোষ বলি দিতেন – কেউ কেউ নরবলিও। সতীদাহও তো উৎসব ছিলো একসময়ে। ৭ই জুন, ২০১৩ – ইতিহাস পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে আমিও যে সেরকমই এক অন্য উৎসবের বলি হয়ে ইতিহাস হয়ে যাবো – কে জানতো?

ভাঙা পাঁচিলের গায়ে এখনও লেগে আছে সে উৎসব উল্লাসের দাগ।
কেন রে তোরা সবাই এখনো ৭ই জুন? 
কেন রে তোরা সবাই এখনো বর্ষাকাল? 
কেন রে তোরা সবাই এখনো ভাঙা পাঁচিল? 

মুখ তোল। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দ্যাখ – ভাঙা পথের রাঙা ধুলোয় লেগেছে শারদ রোদ্দুরের ওম – তালসারি মাঠে গরম ভাতের মতন কাশফুলের উৎসব –

দশ হাতে নেচে ওঠ্‌ টুম্পা –
মাতৃশক্তি সংহত করে জেগে ওঠ্‌ মৌসুমী - 

এ অসুর নিধন ওই সব সরীসৃপ দেব দেবীদের কম্মো নয় – তাঁরা কেউ ব্যস্ত নিরন্তর নিজেদের পকেট গণিতের হিসেব নিয়ে, কেউ প্রাণ ভয়ে ফাইলের আড়ালে গুটিশুটি। মিডিয়াও বাকি বুদ্ধিমানদের রুটিন মাফিক মোমবাতি আহা উহুর আয়ু তো ওই প্রথম দু’মাস।

এ আসুরিক শিরশ্ছেদ উৎসবের বীরেন্দ্রকৃষ্ণ মন্ত্রে গা ঝেড়ে উঠুক সারা বাঙলার কামদুনিরা।

কামদুনি মেয়েটিও দশভূজা আশির্বাদ চেয়েছিলো কলেজ ফেরত
তুমি শুধু বাৎসরিক নির্বাচনী অশ্বডিম্ব প্রসব ও বিতরণ করো
অসুরেরা সাড়ম্বরে উৎসবে বিনিয়োগকারী – প্রমাণিত তুমি অভিভূত
অন্ধকার শিল্প বাড়ে – জ্যামিতিক অনুপাতে কামদুনি বাড়ে সংখ্যায়
দু’মুঠো অন্ধকার নিয়ে আমাদের সম্মিলিত অভিমান এবং আক্রোশ
অন্ধকারতর এই গুগুলিয় মানচিত্রে ঝাড়বাতি জ্বেলে দিতে পারে
যার প্রতিবিম্ব পরিধিতে
ছোটো ছোটো অন্ধকারেরা
আলো খিদে ভিক্ষুকের আচমন সেরে
যে যার সাধ্য মতো
ছায়াবৃত্ত সীমান্তের কাঁটাতার জীবনেও সানন্দ প্রস্তুত

ওরা থাক উৎসবে।
বাকি অন্ধকারটুকু
প্রদীপ শিখার মতো আগলে নিয়ে আমরা হেঁটে যাবো
শহরের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত অসুরের কাছে
মুখের সামনে ছুঁড়ে বলবো –
নেঃ
খাঃ

সমস্ত রাত ধরে তারপর
কামদুনি পাঁচিলের ভাঙা কোণে বসে
উল্লিখিত বহুমূল্য বিসর্গ সমেত
নাগরিক অন্ধকার উইকিপিডিয়া
দশহাত পঞ্চাশ নখে খুঁটেখুঁটে
ভিখিরিটা বাতাসার মতো
চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে – খেতে বাধ্য হবে
যতক্ষণ না কোটি কাক ডাকে ঘুম ভাঙে ঝাড়বাতি রোদ্দুরের
ততদিন এইসব উৎসব টুৎসব ভণ্ডামিতে নেই




0

মুক্তগদ্যঃ তাহমিনা শাম্মী

Posted in


মুক্তগদ্য


বিরহীপাখি
তাহমিনা শাম্মী


মধুপুর বনে বাস করে এক বিরহ বিলাসী পাখি। কারণে অকারণে সে বিরহের সাথে নিত্য মিলন ঘটায়। বিরহের সাথে বিলাস করাতেই যেন তার সুখ। একাএকা কথা বলে, চোখের জল ফেলে সে প্রকৃতির সাথে নিজের দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়। তবে তার মনে যে সত্যি কোনও কষ্ট ছিলো না তা নয়। তার মনের মধ্যেও এক বড় ব্যাথার ঘা ছিলো, প্রিয় হারানোর ব্যাথা ছিলো। সে বনের কারো সাথে খুব একটা মিশতো না, এমনকি কথাও বলতো না। তাই বনের সবাই তাকে বিরহী পাখী বলে ডাকতো। 

একদিন এক শিল্পী পাখি উড়ে এসে বসলো বিরহী পাখির ছোট্ট বাসার সামনে, সেখানে বসে বিরহী পাখির জন্য সে গাইলো মন ভালো করা মন ভোলানো গান। গান শুনে সত্যিই বিরহী পাখীর মন ভালো হয়ে গেলো। বিরহী পাখি তার একাকীত্বের সময়ে একজন সঙ্গীকে দেখতে পেয়ে ভীষণ খুশি হলো। সে তার সব দুঃখ ভুলে গিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো। বললো,

‘‘তোমার গান আমার মন কেড়েছে। তোমার সুর আমার হৃদয় ছুঁয়েছে। তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। এসো, আমরা প্রাণ খুলে গল্প করি। কতদিন কারো সাথে কথা বলিনি!’’

শিল্পী পাখি বলল, ‘‘না, এখন না। এখন আমি শুধু তোমাকে দেখতে আর তোমার মন ভালো করে দিতে এসেছি। 
তুমি আজ রাতে জেগে থেকো, আমি তখন আসবো। 
আজ সারারাত তোমার সাথে আড্ডা দেবো।
গান শোনাবো জোনাকি ওড়াবো
রূপকথার গল্প বানাবো
আজ সারারাত জোৎস্না বানাবো
সেই জোৎস্নায় তোমাকে ভেজাবো।’’

একথা শুনে বিরহী পাখি খুব খুশি হলো। বললো, ‘‘তুমি সত্যি আসবে? তবে জোনাকির প্রদীপ দিয়ে দিয়ে সাজাবো আমার ছোট্ট ঘর। পারিজাতের মালা বানাবো তোমার জন্যে। ফুলের মধু দিয়ে বানাবো অমৃত।
তোমার গানে মাতাল হবো, দোলনায় দুলবো।
তোমার গল্পে হারাবো রূপকথার দেশে।
তোমার বানানো জোৎস্নায় ভিজবো, তোমাকেও ভেজাবো।’’

‘তুমি আকাশের সাথে বাতাসের সাথে সময় করো পার,
আমি ফিরবো তোমার জন্য নিয়ে সুখের প্রহর।’ 

- এই বলে শিল্পী পাখি চলে উড়ে চলে গেলো। বিরহী পাখি তার উড়ে যাওয়া পথে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলো। সে তার সব বিরহ ভুলে গুণগুনিয়ে গান ধরলো। সূর্যকে তাড়াতাড়ি বিদায় হতে বলে চাঁদকে আমন্ত্রণ জানাতে লাগলো। সন্ধ্যায় চৈতালি হাওয়াকে শীতল হতে বললো। শিল্পী পাখির জন্য তুলে আনা বন্য ফুল দিয়ে বানালো প্রকাণ্ড এক সিংহাসন। ফুলের দোলনায় বসে সে অপেক্ষা করতে লাগলো।

সূর্য পাটে গেলো। রাত্রি এলো, শুরু হল অপেক্ষা... 

জোনাকিরা জ্বেলে দিলো আলো, যৌবনা চাঁদ উঠে এলো মাথার উপর। দক্ষিণের হাওয়া শীতল হলো। অপেক্ষা... একপ্রহর...দুইপ্রহর...তিনপ্রহর...



0

মুক্তগদ্যঃ সকাল রয়

Posted in


মুক্তগদ্য




মুক্তপত্র- নন্দিতা 
সকাল রয়



নন্দিতা, 

ভালো খারাপ একটা কিছু আছো নিশ্চই? অনেকদিন পর কলম তুললাম, তোমাকে অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে হলেও উপায় নেই ভেবেই লেখা হয়না কোন চিঠি। তাই অসম্পাদিত একটা চিঠির মতো করে কিছু লিখলাম। দেখো আমাকে নিয়ে আবার বিশেষনে জড়িয়ো না তাহলে আবার চক্ষুশূল হয়ে যেতে পারি। নন্দিতা, বর্তমান যুগটা এমন হয়েছে যে, সেখানে কারো ভুল ধরতে নেই, তাহলে প্রতিহিংসার শিকারে পড়তে হয়, দৃষ্টিভঙ্গির কথা চলে আসে। কারো দোষকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিতে নেই তাহলে নিন্দুক হবার সুযোগ থাকে। কেউ হাসলে আমরা যেমন অনেক সময়ই বারণ করতে পারিনা তেমনি কেউ কাঁদলে তাতে বাঁধা দিতে নেই, যে যায় সে তার নিজের ইচ্ছেতে যায়; তাকে ফেরাবার চেষ্টা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। কারো জন্য ভাবনার উঠোন দীর্ঘ করতে নেই তাতে জলোচ্ছাসের ভয় থাকে, কাউকে পাটিসাপটার মতো জড়াতে মুক্ত হতে গেলে তাখন কাটার আঁচড় খেতে হয়। আমার কথাগুলোকে পাগলের প্রলাপ ভাবছো হয়তো! আমি কিন্তু সেটা নিয়ে কিছু মনে করতে পারছি না, কারন তোমার চিন্তা শক্তিতে আমার কষ্টপাওয়া নিছক বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়। তুমি তো জানো যারা গাইছে আনন্দের গান তাদের দেয়ালে কানপেতে শুনে যেতে হয়। যারা কষ্ট নিয়ে হাটছে তাদের পাশে সঙ্গি হতে হয় কিন্তু আগ বাড়িয়ে কারো গলা জড়িয়ে ধরতে নেই, তাতে গলগ্রহ হবার ভয় থাকে। এখন সময়টা নিজেকে জানার। কাজের শেষে চোখ বন্ধ করে শুধু ভাববার আয়োজন করো। তাতে নিজের দোষ, গুন নিজের আয়নাতেই ভেসে উঠবে। জগৎ ভালোই, নিজে ভালো হতে পারাটাই কঠিন!

তুমি হয়তো এখনি বলবে; কেউ ইচ্ছে করে আঘাত দিয়েছে, এড়িয়ে গেছে, মিথ্যে বলেছে, প্রতারণা করেছে। করুক সে, এতটুকু শান্তি সে পাক; যতটুকু সে চায় কিংবা চাইছে। কারো পথে বাধা হতে নেই, কারো ইচ্ছেয় বাধা দিতে নেই তাতে নিজেরই প্রতারক হবার ভয় থাকে। তুমি ঠিক এভাবে ভাবতে পারতে আগে এখনো কি পারো কিনা তা বলতে পারিনে। “এক জীবনে নিজেকে চিনতে না পাড়াই সবচে বড় ব্যর্থতা। কেউ আমায় উপহাস করুক আমার দুর্বলতা নিয়ে, কিন্তু আমি যেন প্রতিহিংসা পরায়ন না হই তার কাছে। কেউ আমায় অহংকারী ভাবুক তার পথে আমায় না পেয়ে তাতে সে হয়তো সাময়িক কষ্ট পাবে কিন্তু তার পথের সাথী হতে গিয়ে আমার জন্যই যদি তার জীবনটা বিষময় হয়ে উঠে তারচে’ সেই ভালো চুপ করে থাকা”। আমি জানি আমার এ কথাটাই তোমাকে কষ্ট দিয়েছে সাময়িক মিথ্যে বলে আনন্দ পাবার চেয়ে সত্যি বলে দীর্ঘস্থায়ী কষ্ট পাওয়া ভালো। নিজেকে ধ্বংস করার আগে নিজেকে শুধরে নেয়াটা জরুরী। তাইতো নিজেকে শুধরে নিচ্ছি। নন্দিতা, প্রতিদিন অন্তত একবার করে পৃথিবীর মতো করে হেসো তাতে জমে থাকা কষ্টগুলো হালকা হবে। জানোতো ভাবলেই কষ্ট না ভাবলে কিছুই না। মন থাকলেই মন খারাপ হয়। 

তীরে এসে তরী ডুবলে ভাগ্যের দোষ দেই আমরা কিন্তু ভাগ্যটাকে বদল করতেই যতো আপত্তি! আমি হয়তো ভাগ্যটাকে একটু বদল করতে পারতাম কিন্তু তাতে জীবন ততটা আনন্দের হতো না যতটা তুমি চেয়েছিলে। 

নন্দিতা, রাত সাড়ে ১০টা বাজতে চললো। ষ্টুডিও ছেড়ে বাড়ি যেতে হবে। আজ এটুকুই আবার আর একদিন লিখবো। ভালো থেকো অন্তত অভিনয় করে হলেও। 

শেষান্তে 
রয়
4

মুক্তগদ্যঃ দময়ন্তী দাশগুপ্ত

Posted in


মুক্তগদ্য





গোলাপসুন্দরী
দময়ন্তী দাশগুপ্ত



তাহার কক্ষে গোলাপসুন্দরীর প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। অথচ গোলাপ জানিত কক্ষখানি একান্ত তাহারি। গোলাপকে দেখিলেই সে মুখখানি ফিরাইয়া লয়, দ্বার বন্ধ করিয়া দেয়। গোলাপসুন্দরী দ্বারে করাঘাত করিয়া প্রতিদিন বলিয়া যায়, ‘তুই মর।’ দ্বার খুলে না। কেবলমাত্র অন্যপার্শ্বে সে ডাকিতে থাকে, ‘গোলাপ, গোলাপ’। গোলাপ শুনিতে পায়, গোলাপ সাড়া দিয়া বলিয়া উঠে, ‘যাইই...।’ দ্বার খুলে না। দ্বার শুধু ডাকিতে থাকে, ‘গোলাপ, গোলাপ’। 

মধ্যে মধ্যে তাহার বড় শ্রান্ত লাগিতে থাকে। এই জীবন, এই বাঁচিয়া থাকা – আপনার মনে অস্ফুটে ডাকিতে থাকে সে – ‘গোলাপ, গোলাপ’। চক্ষে জল আসিয়া পড়ে। গোলাপ কি ঘুমাইয়া পড়িয়াছে? সাড়া দেয় না কেন? – ‘গোলাপ, গোলাপ...’।

কলম দিয়া কি চক্ষের জল পড়ে? তাহা না হইলে অক্ষরময় পৃষ্ঠাগুলি আবছায়া হইয়া যায় কেন? নিদ্রা আসিতেছে, ‘ও গোলাপ, মস্তকে হস্ত বুলাইয়া দিবি না? ওষ্ঠে অঙ্গুলি বু্লাইবিনা তোর? ও গোলাপ, স্বপনে আসিবি তো ঠিক?’

গোলাপ প্রাতঃকালে স্নান করিয়া পাটভাঙা শাড়িখানি পরিয়া আসিয়া দ্বারে করাঘাত করিতে থাকে, ডাকিয়া কহে, ‘ওঠ মরণ, উঠিয়া পড়, প্রাতঃকাল যে কখন হইল।’ দ্বার কেহ খুলিয়া দেয় না। স্বপনের ঘোরে শুনিতে পাওয়া যায় অস্পষ্ট কন্ঠস্বর, ‘গোলাপ, গোলাপ’।

দিন কাটিয়া যায়, নিঃশব্দতায়। কেবলমাত্র গোলাপের কঙ্কনগুলি রিনিঠিনি বাজিয়া কহে, ‘মরণ, মরণ’। সূর্য উঠিবার সময় ডাক দিয়া যায়, ‘ও গোলাপ, গোলাপ’। নামিবার সময় ফিসফিস করিয়া বলিতে থাকে, ‘গোলাপ, গোলাপ’। গোলাপ খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠে, ঠোঁট চাপিয়া ভ্রুভঙ্গী করিয়া কহে, ‘মরণ’। নিদ্রা যাইবার পূর্বে স্নান সারিয়া আসিয়া পুনরায় দ্বারে করাঘাত করিয়া যায়, হাসিতে হাসিতে বলিয়া উঠে, ‘খুলিয়া দে, একমুষ্টি হলাহল দিয়া যাই, মক্ষিকাসুধা তো মুখে রুচিবে না’। দীর্ঘশ্বাস শুনিতে পাওয়া যায় দ্বারের অন্যপার্শ্ব হইতে।

একেকটিদিন বড় বেদনা হইতে থাকে তাহার। স্থির থাকিতে পারেনা। পালঙ্কে এপাশ-ওপাশ করিতে থাকে সে। সেইসব রাত্রে গোলাপসুন্দরী বৃক্ষ হইয়া যায়। বৃক্ষ হইয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরে, ডালপালায়, শিকড়ে। তাহার শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসে। গোলাপকে সে দুই হস্তে ঠেলিয়া দেয়। গোলাপ তাহাকে পুনরায় জড়াইয়া ধরিয়া কহে, ‘মরিতে চাহিয়াছিলি অদ্যপি ভীত হইলে চলিবে কেন?’ সে মরিতে থাকে অতঃপর। কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ করিয়া বৃক্ষদেহে মিশিয়া যাইতে যাইতে মরিতে থাকে। তাহার ইহকাল পরকাল, অতীত বর্তমান সব হারাইয়া যায়। একটি ক্রমশঃ গভীর মরণে সে শ্বাস বন্ধ করিয়া ডুবিয়া যায়। গোলাপ তো ঠিকই কহিয়াছে, সেতো মরিতেই চাহিয়াছে আজীবন।

পরদিন প্রাতঃকালে পালঙ্কে শুষ্কপত্র পড়িয়া থাকে।

কোনো কোনোদিন গোলাপসুন্দরীর দেহে নদী বহে। নদী হইতে লবণাক্ত সমুদ্রের লাবণ্যে ঢেউ উঠিতে থাকে। লবণাক্ত বাতাসের স্পর্শে ঘুম ভাঙিয়া যায় তাহার। জলে ডুবিতে ডুবিতে খড়কুটো খুঁজিতে থাকে – অথচ সর্বত্র ঢেউ বহে - ওষ্ঠে, স্তনে, নাভিতে, জঙ্ঘায়। গোলাপ দন্ত দিয়া ওষ্ঠ চাপিয়া ফিসফিস করিয়া বলিয়া ওঠে, ‘আ, মরণ, কেবলমাত্র দুষ্টামি’।

প্রাতঃকালে সিক্ত শয্যাবস্ত্রটি পড়িয়া থাকে পালঙ্কে।

একেকটিদিন গভীর রাত্রিতে তৃষ্ণায় তাহার ছাতি ফাটিয়া যায়। অন্ধকারে হাতরাইয়া হাতরাইয়া ডাকে, ‘গোলাপ, গোলাপ’। গোলাপ জল রাখিয়া যায় নাই কেন? গোলাপ জল হইয়া আসে নাই কেন? ‘গোলাপ, খানিক বৃষ্টি দিয়া যা গোলাপ’। গোলাপসুন্দরী তাহার কক্ষে নিদ্রা যাইতে যাইতে মৃদুস্বরে বলিয়া উঠে, ‘মরণ’।

প্রাতঃকালে শয্যায় লাগিয়া থাকে অশ্রু এবং স্বেদ।

কোনো রাত্রিতে গোলাপ আসিয়া তাহার দ্বারে আছড়াইয়া পড়িয়া বলিয়া উঠে, ‘উঠ, উঠ, অগ্নি লাগিয়াছে’। সে আসিয়া গোলাপকে তুলিয়া কহে, ‘কোথা?’ গোলাপ বলিয়া উঠে, ‘চক্ষুর মাথা খাইয়াছিস নাকি, দেখিতে পাইতেছিস না?’ অতঃপর অগ্নি জ্বলিতে থাকে। তাহার শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিতে চাহে - উত্তাপে, ধূম্রে। সে পুড়িতে থাকে। সে মরিতে থাকে।

প্রাতঃকালে শয্যায় কিয়ৎখানিক ভস্ম পড়িয়া থাকে।

এই কাহিনিটি আমি শুনিয়াছি তাহার কাছেই। চিত্র অঙ্কন করিত সে। গোলাপসুন্দরীর চিত্র দেখাইয়াছিল আমায়। গোলাপ - নদী, বৃক্ষ, আগুন। প্রাতের আলোক আর সন্ধ্যাকালের স্নিগ্ধতা। বলিয়াছিল, হয়তো গোলাপসুন্দরী বলিয়া কেহ ছিল না। অথবা গোলাপসুন্দরীরা হয়তো হারাইয়াই যায় চিরকাল। বলিয়াছিল, হয়তো সকল পুরুষের কল্পনাতেই গোলাপসুন্দরীরা বাঁচিয়া থাকে, বাঁচিয়া থাকিতে চাহে। 

শুনিতে শুনিতে অকস্মাৎ মনে হইল, নূপুর নিক্কনশব্দে হাসিয়া কে যেন কহিয়া উঠিল, ‘মরণ’।
2

মুক্তগদ্যঃ পল্লববরন পাল

Posted in


মুক্তগদ্য




তিন গুনগুন
পল্লববরন পাল





একা নই বধ্যভূমিতে 


একাকিত্বে ছমছম কালো বেড়ালের মতো সবুজ চোখের ভয় – ঠান্ডা শিরদাঁড়া থেকে শব্দহীন পাহাড়সানুতে আতঙ্কিত জলফোঁটা টুপ টুপ ছড়ায় সন্ত্রাস – গুগাবাবা সিনেমায় বাঘার এন্ট্রি মনে আছে? এ বাদাড়-তল্লাট আশৈশব তালু-পরিচিত – গলিপথ চিরকাল কালো বেড়ালের গা, ঘুটঘুটে এবং একাকী, বিদ্যুৎ মোমবাতি নেই, সবুজ শ্বাপদ দৃষ্টি ইতস্তত শুধু থাকে রাত্রি পাহারায় – বুকের ভেতর থেকে এইসব ত্যারাব্যাঁকা গলিঘুঁজি মাথা থেকে পায়ুদ্বার শাসন করছে ক্রমাগত

কী বলি তোমাকে আজ? ভালো কথা শোনানোর সাহস কিনতে গেছি ভুলে – স্বেচ্ছায় – মধ্যমাসে মানিব্যাগ টম্বুর রেস্টুরেন্ট-বিলে – সাহস কি ভাঁজ করে রাখা যায় মুদ্রা-কোলাহলে? কথা তো মশার মতো - শ্রেষ্ঠগতি বংশবিস্তারে – ভালো কথা আকাশকুসুম - ভালো মশা, মানুষের মতো 

সকাল সকাল এক মুশকো-কালো বেড়ালের পাঁচিল-শৃঙ্গ জয় নিয়ে হইচই – কামদুনি থেকে কায়রোয় – রাষ্ট্রসঙ্ঘ ক্লাবঘরে টিভি ও ক্যারাম – কালো-সাদা-লাল ঘুঁটি থিকথিকে মাছিভিড় – কেউ কিন্তু একা নেই পৃথিবীর কোনও দেশে – নারী ও পুরুষ – শিশু ও শুয়োর - হরিদ্রাভ চোখওলা কালো বেড়ালের মতো ইথিওপিয়ার সেই কঙ্কালসার বালকেরও গায়ে গায়ে লেগে আছে বিশ্বব্যাপি ক্ষুধা – বিশ্বাসী নাছোড় সঙ্গী ধর্মকুকুর 

আমিও তো একা নই আর – আয়না থেকে ডেকে নিই তাকে - সাষ্টাঙ্গে চুমু খাই – হাত ধরে হেঁটে যাই বধ্যভূমি বিছানার দিকে

-------------------------------------------- 





থার্ড থিয়েটার?


নাটক মানেই নয় উঁচু স্টেজ অডিটোরিয়াম। আলো সেটসেটিঙের হ্যাপা নয়। কুড়ি-বিশ যুগে আর তিন চার মাসব্যাপি রিহার্সাল-টিহার্সাল নয়। ব্রেশ্ট-স্তানিস্লাভস্কি বা শম্ভু-উত্‍পলময় প্রয়োগকৌশল নয়। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নয়। শুকনো কাশি মুঠিফোন সাইলেন্সে রাখবার অনুরোধ চিত্‍কার নয়। টিকিট বিক্রি নয়। দর্শকসংখ্যা নিয়ে আর্থ-গাণিতিক কোনো লাভ-লোকসান নয়। দর্শক হলো কি হলোনা – প্রযোজক গৌরী সেন - না হলে বরং বেশি ভালো।

প্রথাগত স্ক্রিপ্ট নেই। ডায়লগ অন্-স্পট উচ্চারণ অনভিধানিক - মুখস্থের হাঙ্গামাও নেই। ভরপুর অ্যাকশন। স্বতঃষ্ফুর্ত কিছু শীৎকার-আবহের ব্যবহার আছে। আদ্যোপান্ত জীবনমুখিন। 

পাঁচ কিম্বা ছ’টি চরিত্র – সন্ধান করেনা কোনো নাট্যকারের, প্রয়োজনও নেই – তত্‍সহ একটিমাত্র নারী। 

মেট্রোস্টেশনে পথে ভীড়বাসে পাঁচিলের ভাঙাকোণে অভিনয়। কখন কোথায় কবে – আগেভাগে বিজ্ঞাপন নেই। চলতি মানুষজন দাঁড়াবে সহসা। নির্বাক। অথবা উর্দ্ধশ্বাস। এ নাটকে হাততালি নেই, ফিরপথে কখনোসখনো অযাচিত মোমবাতি জ্বালানো নিয়ম। সন্ধ্যেবেলা টিভির চ্যানেলে ওঠেনামে টিআরপি-র শেয়ারবাজার। খুশিহাসি গৌরী সেন মোমবাতিব্যবসায়ীর চওড়া চোয়ালে। 

দৈনিক নির্ভয়ার আত্মাদের সংখ্যা বাড়ে উর্দ্ধলোকে ঘেরাও মিছিলে - মধ্যমণি মাথা নিচু, চোখ বন্ধ - বাদল সরকার।

----------------------------------------------- 





নিরুদ্দিষ্ট একমাত্রা 


কাব্যালাপে সহসা সন্ত্রাস - পঞ্চম পংক্তি থেকে একমাত্রা হঠাৎ উধাও – সমস্ত সীমান্তে খিল তুলে সারি বেঁধে তন্নতন্ন – শব্দ বর্ণ কমা রেফ র-য়ের ফুটকি সেমিকোলন – ব্রা থেকে অণ্ডকোষ গোয়েন্দা তল্লাশ – না:, এদিকওদিক ঝোপঝাড় – না:, এক থেকে চতুর্থ লাইন – না:, ইতিউতি শব্দলাশ – না:, সমার্থক বহুতল, কাটাকুটি, খানাখন্দ – না: না না – অগত্যা –

হঠাৎ হোঁচটে হাওয়া কলমের খেই – অট্টভেংচি মুদ্রালাপে হাই তুললো মধ্যরাত – জানলার কালো কাঁচে শহুরে উড়াল বিন্দুরা সারি সারি গুণচিহ্ন – অগত্যা –

বালিশে মাথা রাখতেই বাঁপাশের চিৎদেহ সমকোণ ঘুরে অক্টোপাস হাত-পায়ে সাপটে ধরলো আমাকে – পঁচিশ বছর চেনা রমণীয় প্রিয় ঘ্রাণে ধীরে ধীরে শিথিল স্নায়ুও – ঘুমের চৌকাঠে পা, মুহূর্তে নজরে আসে নিরুদ্দিষ্ট সেই একমাত্রা নরম নারীপাহাড় উপত্যকায় পোষা বেড়ালের মতো গুটিসুটি – বামাল গ্রেপ্তার করে ফিরতে যাবো পঞ্চম লাইনে – হাত-পা সরাতে গেলে হুড়মুড় নিদ্রাপ্রাসাদ, ক্রোধানলে পুড়ে যাবে সভ্যতা ও প্যাপিরাস খাতা - নিরুদ্দিষ্ট একমাত্রা অগত্যা আমার সতর্ক পাশবালিশ – আমি ঘুম

শেষরাতে নারী ডেকে নিয়ে যায় মোহনার স্নানাগারে – চোখের ওপর দিয়ে একমাত্রা ভেসে যায় বেনাগাল বন্দর ছাড়িয়ে

প্রতিবন্ধী চার পংক্তির কঙ্কালহাড় নিয়ে নোংরা ন্যাংটো ছেলে শিকনি-নাকে ডাংগুলি খেলে – ইতস্তত অক্ষরেরা নাগরিক অন্ধকারে সোনাগাছি কালীঘাটে শরীরশিল্পী হয়ে বেঁচেবর্তে থাকে 

ইতিমধ্যে আমার শহর মাত্রাছাড়া শিশু-যিশু-হিসুর ত্রিফলা আলোর উত্‍সবে পঞ্চদশ পংক্তিভোজনে একনিষ্ঠ পোষা চতুষ্পদী
1

মুক্তগদ্যঃ রিয়া চক্রবর্তী

Posted in


মুক্তগদ্য 




আমি ও আমার পৃথিবী
রিয়া চক্রবর্তী 



আমার পৃথিবীর সাথে আমার পথ চলে যে কবে, কিভাবে মনে পড়ে না। হয়তো বাড়ীর অন্য সবার সঙ্গে শুরু হয়েছিল পথ চেনা বা হাঁটা। সে পথ চলতে চলতে সমান্তরাল আর একটা রেখা টেনে আরেকটা পৃথিবী গড়ে নিয়েছিলাম আমি সেই সময় টাও আজ মনে নেই। 

এ যেন অন্য এক পৃথিবী, লাল-নীল-সবুজ-হলুদ নানান রঙের সমারোহ। যেখানে আমি নিশ্চিন্তে আমার কল্পনাগুলোকে আমার তুলির ছোঁয়ায় আমার পৃথিবীতে নিয়ে আসতাম। আমার আরেকটা পৃথিবী, যার রং- এর ছোঁয়ায় মুহূর্তে গড়ে ওঠে নতুন বিশ্ব, বরফের গন্ধ মাখা দুধ সাদা সে বিশ্ব জুড়ে শুধু আমি শান্তির ঘুম খুঁজি। খাদ্যের প্রয়োজন এ স্বপ্নের বিশ্বের নেই। রামধনুর রঙে সাজানো আমার পৃথিবীতে হেরে যাওয়া জীবনেরা নির্দ্বিধায় চলে আসে আমার কাছে। এমনকি পলেস্তারা খসে পড়া ছাত, ঘুন ধরা আসবাব, নোনা ধরা ইঁট, হারানো গুপ্তধন, হেরে যাওয়া রাজা, নোনা জলে ভরা রাজ্য, প্রদীপের আলোয় জাগা ঘুম ঘুম চোখের রূপকথা, মেঠোপথ, মুছে যাওয়া জঙ্গল, ধুয়ে যাওয়া ইতিহাস, রাখালের বাঁশী সুর, হেরে যাওয়া ধুলো হয়ে ভুলে যাওয়া সক্কলের অনায়াস আবাস আমার সে পৃথিবীতে। গরাদের আড়ালের বনের রাজা পায় অনন্ত মুক্তির আস্বাদ। 

পৃথিবী শব্দটা তাই বড় বেশি জটিল আমার কাছে। আজ এই এখন, বড় বেশি ক্লান্ত আমি এ নীল সবুজ গ্রহতে। আর কথা বলাও কমাতে কমাতে তলানিতে এসেছি। আজকের পৃথিবী একদম অচেনা। এ অচেনা ছবি আমাকে, নাহ, অবাক করে না আর, আজ আমি শুধুই বেঁচে আছি, এ মুখের দেহে প্রাণ নেই, যন্ত্র চলে, যন্ত্র বলে, মন ভোলে, স্বাধীনতা কাড়ে, খুন করে জীবন, ছাই করে স্বপ্ন। 

আমি তাই নিজেকে আলাদা করে সরিয়ে নিচ্ছি একটু একটু করে আমার পৃথিবীতে। যে পৃথিবী সাজানো রামধনু রঙে, শরতের শিউলি, বুকে নীল সুমুদ্রের ডাক আর হাতে সোনালি ঈগলের স্বপ্ন। আমার পৃথিবীতে তাই নতুন জঙ্গল গড়ে তুলি, এক নৌকো হারানো জীবন নিয়ে। হারানো সে গ্রাম গড়ি, খড়ের চাল দিয়ে, মাটির নাটমন্দির ঘিরে, বটের ঝুড়ি বুনে, লাল ডুরে শাড়ি-নাকে টালুক টুলুক নোলক পরা এক রত্তি মেয়ের সাথে শ্যাওলা ধরা পুকুরে পায়ের পাতা ডুবিয়ে, শীতল পাটি বিছিয়ে নিয়ে জোনাক জ্বলা সন্ধ্যে হয়ে শাঁখের ডাক শুনি। 

এই কল্প বিশ্বের স্বচ্ছ আকাশ জুড়ে প্রতি পদের একা চাঁদ স্বাক্ষী হয় এক পক্ষকাল ধরে। এ তবু অনেক সুন্দর, নির্বিরোধী নির্বিকার নিরুত্তাপ, তাতে না আছে কোন অহংকার, না আছে কোন আস্ফালন, না আছে কোন আকাঙ্খা, না আছে কারো পদানত হয়ে থাকা, অদ্ভুত এক চিরশান্তি ধু ধু করে তুষার শীতল হাওয়াতে। জানি আজও সেই কল্পনার রামধনু রঙে রাঙ্গানো পৃথিবী আমার গড়ে তোলা হয়নি, আমার পৃথিবীতে কোন সীমানা নেই, তাই ঘর গড়ি না। কল্প বিশ্ব জুড়ে অনন্ত আকাশ। তাই এ পরিব্রাজকের গ্রহ থেকে পৃথিবী হয়ে বিশ্ব জুড়ে অবাধ অনায়াস যাতায়াত। সেই বিশ্ব আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বুকের পাঁজরের আনাচ কানাচ ধরে ফুসফুসের হাওয়া কুঠুরিতে; নির্ভেজাল অক্সিজেন। 

যে আকাশে আলো জ্বলে প্রতি কৃষ্ণপক্ষে সেই খানে লুকিয়ে রেখেছি আমি আমার স্বপ্নকে- আর রাখা আছে আমার পৃথিবীকে; " আমার আমিকে "।



0

মুক্তগদ্যঃ ইন্দ্রাণী ঘোষ

Posted in


মুক্তগদ্য



সামার অফ ফিফটিন
ইন্দ্রাণী ঘোষ 



জ্বলছে শহর। আগুন বড় একটা রেয়াত কাউকে করছে না। বৃষ্টি লুকিয়েছে কোথায় কেউ জানে না। মাঝে মাঝে দু এক ঝলক ফিচেল হেসে সেই যে পালিয়েছে আর পাত্তা নেই। তাও সে প্রায় হপ্তা দুএক আগে। মেঘ কিন্তু খুব রাগ “এ কি দায়িত্বজ্ঞ্যানহীন কাজকর্ম বৃষ্টির ?” রাগে মাঝেমাঝেই তড়পাচ্ছে আর দাত কিড়মিড় করছে। মাঝে মাঝে আকাশের বুক চিরে হলুদ আলো ঝলকাচ্ছে। মেঘের কথা শুনছে বৃষ্টি ,মজা পাচ্ছে। আরও মেঘের বুকের গভীরে জাঁকিয়ে বসছে। ভোর থেকে মেঘ রোজ শাসন চালাচ্ছে, তা ওই মেয়ে শুনলে তো। একেবারে গুটিসুটি মেরে মেঘের বুকের ভিতর ঢুকে পড়েছে। শেষে মেঘ ঠিক করলে একটু নরম হয়েই বোঝাবে। সে বললে, “দুষ্টুমি করে না সোনা, এবার যাও, তুমি না গেলে পৃথিবীর তূলিতে রঙ লাগবে কি করে?” বৃষ্টি নাছোড় সে যাবেই না। মেঘ তখন এক গল্প ফাঁদলে, সে বললে---

‘আমার ছিল একটা একতারা, জানিস বৃষ্টি, পাঁচ টাকায় কিনেছিলাম মেলা থেকে। বাজাতে বাজাতে আঙুল কেটে রক্ত ঝরত, আর ছিল বন্ধু হাওয়া, আর এক স্তিমিত তারা। হাওয়া গেল ঝিলের পারে গল্প বলতে আর সেই তারাও খসে পড়ল। আমি জানতাম আমাদের ‘একতারার জলসা’র মেয়াদ ফুরবে, বেশি পথ হাঁটব না আমরা। তবু চলেছিলাম জানিস। আজও ফিরে দেখি, সেই একতারার জলসার রাতগুলো খুঁজি আলোর সমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে। পাই না খুঁজে। আমি একটা গোটা জীবন ওই একতারার সূরের নেশায় বুঁদ হয়ে কাটিয়ে দিতে পারি । ওই জলসার দিনগুলো আমার লুকনো ঝাঁপির মণিমুক্ত। গল্প বলতে বলতে মেঘের চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তারপর সে হঠাৎ দেখলে তার চোখের জল, বুকের বৃষ্টির সাথে মিলে কখন পৃথিবীতে গড়িয়ে পড়েছে, মেঘ নিজে বুঝতেই পারে নি। বৃষ্টির খবর মেঘকে দিলে এক দীঘি, দীঘির বুকে বৃষ্টি তখন আছারি বিছাড়ি কান্না জুড়েছে। 










0

মুক্তগদ্যঃ প্রান্ত পলাশ

Posted in

মুক্তগদ্য


বন্ধু, বিদায় অথবা ববি
প্রান্ত পলাশ



বন্ধু, বিদায়। সংক্ষেপে ববি। যতবার ‘বন্ধু, বিদায়’ বলতে চেয়েছি, ততবার সংক্ষেপরূপ ‘ববি’ শব্দটি বুকের ভেতর মৃদু কাঁপন ধরিয়ে বুকের ভেতরই ঘাপটি মেরে বসেছে। পরক্ষণেই হয়তো কর্পূরের মতো হালকা গন্ধ ছড়িয়ে উবে গেছে, জড়িয়েছে নতুন সান্নিধ্যে। আর আমিও তো জড়িয়েছি কত শব্দে, নির্বিচারে নিরর্থকতায়। কিন্তু ‘বন্ধু, বিদায়’ বলতে পারিনি। আবার নতুন করে পুরনো ‘ববি’, একটি নারীনাম কাঁপন ধরিয়েছে। আমি চিৎকার করে ‘বন্ধু, বিদায়’ না ‘ববি’ বলে বায়ুস্তর ফুটো করে দেব?

তখন বয়স দশ। বাবার শিফট ডিউটি, কেরুতে। আমাদের দুটো পেয়ারা গাছ। কোয়ার্টারের সামনে পড়ে থাকা ছোট ছোট মাঠে আমার বয়সীরা গোল্লাছুট, সাতচাড়া, সন্ধ্যার অন্ধকারে এ-কোনা ও-কোনায় লুকিয়ে উঁকি উঁকি খেলত। আমার খেলা হতো না। মা সারাদিন ‘বই পড় বই পড়’ করত। দিনে পেয়ারা গাছে উঠে হেলান দিয়ে দেখতাম সবাই খেলছে। আর আমি বই হাতে। সে-সময় ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরি থেকে ধারে আনা রবীন্দ্রনাথ, সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, বুদ্ধদেব গুহ, বিমল মিত্র, নিমাই ভট্টাচার্য... পড়তাম, না বুঝেই। বড় বোনের বান্ধবীরা বাসায় এলে ‘বাপ রে!’ বলে হেসে উঠত। তারপর একসময় কীভাবে জানি ফাঁকিবাজি শিখলাম। বই হাতে রাখলেও পড়তাম না। স্কুলে ফার্স্ট-সেকেন্ড হলেই মা তো খুশি! একরাতে বাবা আমাকে বলল, ‘কী রে, তুই না কি সুযোগ পেলেই পেয়ারা গাছে উঠে বসে থাকিস? কী করিস ওখানে?’ আমি বলি, ‘পেয়ারা খাই, বই পড়ি’। বাবা হেসে বলল, ‘কবিতা-টবিতা লিখিস না কি? তোর চোখ-মুখ তো কেমন লাগে!’ ‘আরে না’ বলতেই বাবা বলল, ‘লিখবি না কি?’ আমি না বুঝেই হ্যাঁ বলি, বলি, ‘তুমি শিখাবা?’ বাবা খাতা আনতে বলে। আমি শেষ পৃষ্ঠা খুলি। ‘সুকান্তের আশা/ আশায় বাঁধিয়া ঘর, বসিয়াছে বৃক্ষতল/ আঁখিভরা জল সদা ছলছল/ কবে হইবে তার বৃক্ষের মতো শতদল’––এইটুকু বলে বাবা বলে, ‘পরের লাইনগুলো তুই লিখিস’। আমি স্কুল শেষ করেই পেয়ারা গাছে উঠি। হাতে খাতা। মাথায় ওই চার লাইন। কী লিখি কী লিখি...

বাবা দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ। আজও পরের লাইনগুলো লিখে উঠতে পারিনি। মা এখনও বলে, ‘তুই তো ভাল ছাত্র ছিলি, রেজাল্টও ভাল, কিন্তু কিছুই করতে পারলি না!’ মায়ের আক্ষেপ বুঝি। বুঝি বাবার আক্ষেপও। যে-বার আমার প্রথম বই ‘সাধুখালির রাত’ বেরুলো, বাবাকে কুরিয়ারে পাঠিয়েছিলাম। এক অসুস্থ সন্ধ্যায় বাবা বুকের ওপর আমার বইটি রেখে মা-কে বলেছিল, ‘ছেলেকে বেশি বকাবকি করো না, ও তো ভাল লেখে!’ মা-ই জানিয়েছিল এ-কথা। বাবা ভুলে গেছে কি না জানি না, কিন্তু আমি এখনও ওই চারের পরের লাইনগুলো খুঁজি, লেখার চেষ্টা করি, পারি না। বাবার হাতের লেখাও খুব সুন্দর ছিল। একটা বড় কাগজে বড় হস্তাক্ষরে বাবার লেখা ছিল, ‘মাতা-পিতা হারা সন্তান/ এই পৃথিবীতে মৃতের সমান’। পেয়েছিলাম টিনের ট্রাংকে। বাবা একটু বেশি অসুস্থ হলেই এই লাইন দুটো মনে পড়ে। চোখে জল আসে। হায়, ওই লাইনগুলো না দেখেই... না, আমি ‘মৃতের সমান’ হতে চাই না কখনও!

বিদায় ব্যাপারটিই আমার ভাল্লাগে না। খুব ছোট থেকেই দেখেছি কোয়ার্টার ছেড়ে যাওয়া। কত জেলা থেকে মানুষ চাকরির জন্য আসে। রিটায়ার্ড হলে চলে যায়। অন্যরা ঢোকে, যায়। ছোটবেলায় শিউলিরা যখন কোয়ার্টার ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও, আমি ওকে বিদায় বলিনি। আমি পেয়ারাতলায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ট্রাকে ভর্তি হচ্ছে আসবাব। ভাবছিলাম, আর বোধহয় পাঁচকড়ি খেলা হবে না, কাঁঠাল গাছের নিচে মিথ্যামিথ্যি চড়ুইভাতি হবে না। ওরা গাড়িতে ওঠার আগে শিউলি এক দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কাছে এসেছিল। বলেছিল, আর দেখা হবে না। আমি ভাবতেই পারিনি, কেন দেখা হবে না। বকেছিলাম ওকে, ‘ধুৎ, আরেকবার বললে এক চটকনা দেব!’ ‘আইচ্ছা হবে’ বলে শিউলি গাড়িতে উঠে যায়। আমাদের আর দেখা হয়নি। শুধু একবার ওর বিবাহবিচ্ছেদের খবর পেয়েছিলাম।

আমি কাউকে বিদায় বলিনি। কাউকে বিদায় বলতে হবে কি না জানি না। আমাকেই ছেড়ে গেছে সব। আমি কিছুই ছাড়িনি। শৈশবের সেই পেয়ারা গাছ দুটো আমাকে ছেড়েছে। দু’বছর আগে সেখানে গিয়ে দেখি, সেই কোয়ার্টার নেই, সেই পেয়ারা গাছও নেই, নেই কাঁঠাল গাছটাও। সেখানে হলুদখেত। আমার চোখের সামনে ছায়াছবির মতো ভেসে উঠছিল বইহাতে একটি ছোট্ট ছেলের তরতর করে পেয়ারা গাছে ওঠার দৃশ্য!

যাওয়ার মাসখানেক আগে কাকলি বলেছিল, ‘বাবা রংপুর সুগার মিলে ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছে’। তখন কিশোর আমি। মেয়েরা যেমন হয়, কাকলিকে বড়ই দেখাত। ওর বাবা ছিল বড় কর্মকর্তা, থাকত বাংলোপাড়ায়। কাকলি প্রায় বিকেলে ওদের মালিকে পাঠাত আমাকে নিয়ে যেতে। যেতে ইচ্ছে করত না। বড় গেইট, দারোয়ান, মালি ঠেলে ওদের বাংলোয় যাওয়ার কথা ভাবলেই বুকটা কেমন করত। হয়তো হীনমন্যতা ছিল। আমি কানাপুকুরের পাড়ে ফেলে রাখা অসংখ্য গাছের গুঁড়ির একটিতে বসতাম, আর ভাবতাম ওই তো ওখানে কাকলিরা থাকে। ওদের মালি এসে দীর্ঘক্ষণ আমার পাশে বসে থাকত, বলত, ‘দিদি বলেছে আজ আপনাকে নিতে না পারলে খবর আছে!’ আমি যেতাম না। একদিন কানাপুকুরে কাকলি হাজির। আমার দিকে না তাকিয়ে মালিকে বলল, ‘তাকে জিজ্ঞেস করেন, আর কয়দিন ডাকলে বাসায় যাবে। বাসায় আসলে কী হয়’। কাকলি হনহন চলে যায়। আমি বড় মসজিদের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি। একদিন ওর বাসায় না গিয়ে উপায় থাকে না। রাতে নিমন্ত্রণ, আমাদের পুরো পরিবার। ওর ছোট বোন ডলি ‘দাবু’ বলে দুষ্টুমি করে। আমিও হাসি, আমার বড় বোনও হাসে। সেদিন রাতে কাকলি একটি গল্প বলতে চেয়েছিল। কিন্তু এক ঘটনায় তা আর বলা হয়ে ওঠেনি। তবে শুরু করেছিল। ‘একটি বক মহাসমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঢেউয়ে ভেসে আসছে অমৃতফল। বকটা হা’... বলতেই হা হা করে কাকলি হাসছিল। সাথে আর সবাই। আবার সেই দু’লাইন, বকটা হা বলতেই হাসি। ‘আশ্চর্য, বললে বলো, নাইলে উঠে যাচ্ছি’ বলতেই কাকলি বাম হাতে চোখ ঢেকে ডান হাতে ইশারা দিল। দেখলাম প্যান্টের চেইন খোলা। আমার মুখ লাল হয়ে উঠল, আর কথা বেরোয়নি। পরের কথাগুলো থাক। যাওয়ার আগে কাকলি চিঠি দিতে বলেছিল। ওর মা বলেছিল, ‘বাবা, আমাদের সাথে যোগাযোগ রেখো। কাকলি তোমাকে খুব পছন্দ করে।’ আমার আর চিঠি দেওয়া হয়নি। মুঠোফোনযুগে প্রবেশের পর আমার বাবা কাকলির বাবার নাম্বার যোগাড় করে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘মুকুলবাবুর সাথে কথা বলে দেখ’। আমার আর ফোন করা হয়নি। ও এখন কোথায়, কার ঘরে, কয় সন্তানের জননী––আমার কিছুই জানা নেই। কাকলির সেই ছোট্ট মুখটা খুব মনে পড়ে। স্পষ্ট চোখে ভাসে। চোখে ভাসে ওদের আসবাবপত্র ঘরশূন্য হওয়ার দৃশ্য।

‘বন্ধু, বিদায়’ আমি কখনওই বলিনি। বিছানায় এলেই যে একে একে সব মুখ আছড়ে পড়ে, তাদেরকে কীভাবে বিদায় বলি। জানি ‘বন্ধু, বিদায়’ নেই, ‘ববি’ আছে? শুধু মনে মনে ‘ববি, ববি’ বলে চিৎকার করতে পারি। একমাত্র আমিই জানি ‘ববি’ শব্দে কোন ধ্বনি দীর্ঘ হয়ে আমাকে আমূল নাড়িয়ে দেয়, আরেক মুহূর্ত বেঁচে থাকতে বলে...