Next
Previous
Showing posts with label মুক্তগদ্য. Show all posts
1

মুক্তগদ্য - পল্লববরন পাল

Posted in

মুক্তগদ্য


কীভাবে বেচবো সূর্য? 
পল্লববরন পাল 



এক 


বেচারা 
কীভাবে বেচবো সূর্য আর জন্মসূত্র? নীল দরজা আর মাতৃযোনি? 

কৃষ্ণ বলিলেন – মোবাইলে ছবি তোলো আর ওয়েলেক্স – ব্যাস – কলকাতা ডায়মণ্ডহারবার রানাঘাট তিব্বত – সিধে রাস্তা, সোয়া ঘন্টা – মনে রাখবে, আমার ভাগবৎ অনুপ্রেরণাই ট্রেডমার্ক। 


স্যরি মধুবাবু, 
আমি শৈশবে ফিরতে চাই। বিনাশর্তে। গীতাটিতা ছাড়াই। 



দুই 

ওং শান্তি 
তুমি ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙবে নাকি হাই তুলবে – সেটা ঠিক করার তুমি কে? আগে দাঁতমাজা নাকি পটি – ব্রেকফাস্টে টোস্ট নাকি ওমলেট – অফিস যাবার পথে দেখা হলে জীবনদাকে হাই নাকি ভালো আছেন তো – আদৌ মুখ তুলে হাসি বিনিময় করবে কিনা – ফেরার পথে কোন দোকান থেকে বাজার করবে – কোন ব্র্যাণ্ডের বিস্কুট – ডিনারে কাতলা না মাগুর – বউ আদরের সাপ্তাহিক ডেট ও স্টাইলের রুটিন 

- এ সবের কোনও কিছুই ঠিক করার এক্তিয়ার তোমার নেই – তুমি শুধু একটি শান্তিপ্রিয় ভোটার কার্ড, ডেমোক্র্যাসির ডেমো 

ক্র্যাস করবো 

আমি 

আর আমার সিণ্ডিকেট 


তিন 

নীল বিদ্রোহ 
কতবার তোকে বলেছি আকাশ – নীল চোখ দেখাস না – সহ্য করতে পারিনা – স্বপ্ন দেখে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নিজেকে সত্যিই সুনীলের মতো গাণ্ডুগাণ্ডু লাগে – এমনিতেই দেশে এখন কেউ আর ওসব দেখেটেখে না – দিনরাত ড্যাঙডেঙিয়ে নীলউৎসব অনেক মানুষকে একসাথে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিলো যারা, ঠাণ্ডাঘরের এসিহাওয়ায় ঠেস দিয়ে ঘুমোচ্ছে –মানুষ আর স্বপ্ন দেখে না, ঢপের চপ খায় – হজমও করে নিমেষে – আবার খায় - চপ এখন নীল, ঢপ এখন শিল্প – 

এখন নীল আর স্বপ্নের রঙ নয় – শহর সাজছে বিষনীলে – সেতু থেকে আবাসন, সংস্কৃতি থেকে রাজনীতি জুড়ে সাড়ম্বর নীলচাষ – নারীও ঊরুসন্ধির দরজায় লাগিয়েছে নীল রঙ – স্বপ্ন না বিষ? 

আয় আকাশ, আমার পুরুষদণ্ডের ওপর প্রজাপতি হয়ে এসে বোস – আর একবার দরজা ভেঙে শুরু করি নীলবিদ্রোহ 



চার 

এসো আকাশ আঁকি ফের 
এক নক্ষত্রনির্দেশ এলো – ধর্ষণ উপভোগ করো, নয়তো চিৎকার করো। অন্য এক নক্ষত্রের নির্দেশ – ঘরে ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে ‘রেপ্‌’। চাঁদ বললেন – শরীর থাকলে জ্বর হয়, ধর্ষণও। ভারতবর্ষের আকাশের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র মদাড়ম্বরে রাজস্থানের জঙ্গলে কৃষ্ণসার আর মুম্বাইয়ের ফুটপাথে কঙ্কালসার শিকার করলেন। হাততালি দিয়ে উঠলেন সপ্তর্ষির এক ঋষিগায়ক – ফুটপাথে রাত্রিবাস করে একমাত্র চতুষ্পদী সারমেয়, মানুষ নৈব নৈব 

আমরা চুপ। নাঢেউ পুকুর। 

অথচ আকাশটা আঁকার সময়ে আমরাই গোল চাঁদ আর তারার ফুটকি দিয়ে সাজিয়েছিলাম। 

এখন এইসব অসভ্য চাঁদ তারাদের ছিঁড়ে কুটিকুটি করে নতুন আকাশ আঁকতে ক’মিনিট সময় লাগবে আমাদের? 


পাঁচ 

বি ফর্‌ বিজিনেস 
ইদানিং মোমবাতি আর গামছা শিল্পের রমরমা – যে কোনও রহস্যমৃত্যুতে অবশ্য নয় – এঙ্কাউন্টারে আভিজাত্যের নীলরক্তের গন্ধ না থাকলে যে পাব্লিক খায়না – টিআরপিও না – সম্ভ্রান্ত আততায়ীদের সঙ্গে থাকে অস্ত্র ও গামছা – মিডিয়ার সামনে গামছামুখে বুকের ছাতি রেডরোড – গামছা থাকে থানার লকারেও – কখনো এলিতেলি মুখ ঢেকে ভিআইপি গ্রেপ্তার দেখালে পদোন্নতির টুপাইস বদলির চান্স – 

মোমবাতি আবার ওসব চুনোপুটি রিটেইলে বিশ্বাসী নয় - হোলসেল – তেমন তেমন মৃত্যু হলে ঝটকায় হাজার হাজার 

ঘরে ঘরে ক্ষুদ্রশিল্প – সরকারী উৎসাহ ও সহজ কিস্তিতে ব্যাঙ্কঋণ – স্যটাস্যট আগামী পাঁচ বছরে বাঙলা থেকে বেকারি হাওয়া – হুঁ হুঁ বাওয়া, আমার সিণ্ডিকেট ব্রেন নিয়ে আর কোনো কথা হবে না 


ছয় 

কামদুনি উৎসব 
কেন রে তোরা সবাই এখনও বর্ষাকাল? কেন রে তোরা সবাই এখনও ভাঙা পাঁচিল? মুখ তুলে দ্যাখ – শারদ রোদ্দুরে ভেসে যাচ্ছে সেই এবড়ো খেবড়ো রাস্তা, পুকুরপাড়, তালসারি মাঠে কাশফুলের বাৎসরিক সমুদ্রোৎসব – চিনুকাকার দোকানে কাচের বয়ামগুলো ঝাড়পোঁছ হবে বলে তাক থেকে মাটিতে, গন্ধেশ্বরী স্টোর্সের কাঠের শাটার বছর বছর পুজোর মুখেই তো রঙ বদলায় – এবার কি আকাশনীল না ঘাসসবুজ? বুল্টিদার দোকানে শারদীয়া পত্রিকা কী কী এলো রে? 

মিস্ত্রি পরিবারে আবার কিসের মহালয়া, কিসের পুজো? কত দূরে দূরে বাবা কাজে যেতো, তিনচার মাস পরপর দুদিনের জন্য যেদিন বাড়ি আসতো – সেদিনটাই আমাদের মহালয়া। হ্যারিকেন দাওয়ায় গরমভাতের থালায় ম ম করতো আমাদের উৎসব 

শুনেছি সেকালে রাজা মহারাজাদের উৎসবে ঢাক-ঢোল-খোল-কর্তাল-কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে মোষ বলি – কেউ কেউ নাকি নরবলিও – সতীদাহও তো উৎসবই ছিলো এককালে 

৭ই জুন ২০১৩ – ইতিহাস পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে আমিও যে সেরকমই এক উৎসবের বলি হয়ে ইতিহাস হয়ে যাবো – কে জানতো? 

ভাঙা পাঁচিলের গায়ে এখনও লেগে আছে সে উৎসব উল্লাসের চাপ চাপ দাগ 

কেন রে তোরা সবাই এখনও ৭ই জুন? 

কেন রে তোরা সবাই এখনও বর্ষাকাল? 

কেন রে তোরা সবাই এখনও ভাঙা পাঁচিল? 

মুখ তুলে দ্যাখ, ভাঙা পথের রাঙা ধুলোয় শারদরোদ্দুরের ওম – তালসারি মাঠে কাশউৎসবে গরমভাতের রঙ – 

দশ হাতে নেচে ওঠ্‌ রে টুম্পা 

শক্তিরূপে সংস্থিতা হ মৌসূমী 

অসুরনিধন ওইসব সরীসৃপ দেবদেবীদের কম্মো নয় – তাঁরা কেউ ব্যস্ত পকেট গণিতের হিসেব নিয়ে, কেউ প্রাণভয়ে ফাইলের আড়ালে গুটিশুটি – মিডিয়া ও বুদ্ধিমানদের রুটিন মোমবাতির আহাউহু ওই খবর গরম থাকা অবধিই 

এ আসুরিক শিরশ্ছেদ উৎসবের বীরেন্দ্রকৃষ্ণ মন্ত্রে গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়াক গোটা বাঙলার কামদুনিরা 


সাত 

মুদ্রামায়া 
যুদ্ধের দুটিমাত্র পিঠ – ধাতু মুদ্রা – মাথা-লেজ, হার আর জিত – রক্তপান আর চুম্বনশৃংগার – একে ফর্টিসেভেন আর রবীন্দ্রসঙ্গীত - ত্রিসিংহমুখিস্তম্ভ চক্র – যাকে তুমি জয় বলে জানো – নিতান্তই ভুল। 

স্তম্ভ মানে স্থবিরতা, ইতিহাস - সমাপ্তি, মৃত্যু, দাড়ি। অন্যপিঠে দেখো – সংখ্যা – গণিত – মুদ্রামান – তোমার অর্জন – জয়। 

জয় তো উড়ানমুক্তি – মুঠোবন্দী মস্ত আকাশ – 

মাটি আর আকাশ – মাঝখানে অনর্থক দিকশূন্য কুয়াশার স্তর – সম্পর্কের ধুলোমেঘ মায়া – শুদুমুদু বাড়িয়ে কী লাভ? ধুয়ে জল খাবে? 

মায়া নয়, মুদ্রায় এসো। 

যুদ্ধে এসো 
0

মুক্তগদ্য - অভিষেক ঘোষ

Posted in


মুক্তগদ্য


কুয়াশার দানা 
অভিষেক ঘোষ 

১ 

ঝুলন্ত পুকুরটার নীচ দিয়ে আমরা রাস্তা করেছিলাম। সে রাস্তা থেবড়ে দিয়ে একপাল গরুর পায়ে বর্ষা দাগ এগিয়ে যেতেই আমি বুঝলাম এসব বলার কথা নয়। নিঝুম মাঝে মাঝেই আমার পাশে এসে বসত।তার নাম জানতে চাইলে কিছুই বলত না,ঠিকানা পদবি সব আমিই ওকে দিলাম। আলোর চত্তরগুলো কেটে কেটে একটা লম্বা ইটভাঁটা হয়েছে এখানে। সেখান থেকে প্রতি রাতেই বরফের হাওয়া পাই গায়ে। জিভে ঠক ঠক শব্দ তুলে ঘোড়ার দল এগিয়ে যায়। রাজা রাজ্য শাসন সব কিছুই আমার হাতে তৈরি করি, আবার ভেঙে দিয়ে ঠাণ্ডা ছাদের কার্নিশে শ্যওলা পড়তে পড়তে যতগুলো দেয়ালে কবিতার পতাকা লাগিয়েছিলাম সব কটা নয় দেখি কিছু কিছু পতাকার গায়ে সমুদ্র পিক ফেলে ফেলে তাকে নোনতা করতে চাইছে। নিঝুম স্কুলে চলে গেলে আমি আরও কিছুটা বড় হয়ে উঠি, সিলিং ফ্যান মুছি, দড়ি ধুই, সাবান খেতে ইচ্ছে করে না খরগোশগুলোর তাই কেটে কেটে এক দুটো টমেটো খাওয়াই, খবরের কাগজে প্রজাপতি দেখলেই, চোখের সামনে বিয়ের কার্ড দেখলেই হলুদ আর সেন্টের গন্ধটা রুমালে ঘসে ঘসে টানিয়ে রাখি বারান্দায়। 

দুপুর হলে এদিকটায় একজন শিল কাটাও বলে চিৎকার করে। তার মুখটা দেখতে পাইনি কোনওদিন, শুধু গলার স্বরে বুঝেছি সে এসেছে। আমি দেয়ালে একটা গর্ত করি। হাতুড়ি মারতে মারতে একটা মার ভুল পড়ে যেতেই হাত দিয়ে রংমশালের আগুন বেরয়।আঙুলগুলির দিকে চাইলে দেখি সব বুড়িয়ে আসছে, ঝড়ের আগে পাখি গুলো বাসা বদল করতে পারছে না বলে একটা একটা করে ডিম মাটিতে ফেলে দিচ্ছে। সেই ডিম ফাটছে না। নিঝুম স্কুল থেকে ফিরে আসে, ওগুলোকে নিয়ে ফুটবল খেলতে খেলতে। আমি বারণ করেছি ওকে বহুবার। নিঝুম বলে—দাদা আমি হ্যান্ডরাইটিং এ দশে আট পেয়েছি, আর কল্পনা, স্মৃতি শক্তির খেলায় দশে দুই। 

২ 

মিক্সির আওয়াজে নিঝুম ভয় পেত ছোটবেলা। দেয়ালে দুটো সাঁওতাল দম্পতির মুখোশ দেখে ও খুব ভয় পেত। আমি ভয় পেতাম রামধনু কাঁদলে। জানলায় আগুনপাখির ডানা থেকে জল বেরত।তার ঠোঁটে হাত দিতে ভয় পেতাম না তেমন, ছাদ ছোট হয়ে আসত, ফুটো ফুটো ফ্রিজ থেকে সবজির খোসা মুখে করে টিকটিকি ঘড়ির পিছনে চলে যেত। আমাদের বালতি থেকে মরা কেরসিনের গন্ধে বর্ষার ঘরটা দমকা ফ্ল্যাড লাইটের আলোর থেকে নিংড়ে নিত ঘাসের ফুলকি। শিশিরের আগেও এখানে শীতকালে কেউ কেউ আসত। 

ভিজে চাদর থেকে ছেঁচরে টেনে নিয়ে যাওয়া রক্তের দাগে পিঁপড়ে এসে বসলে, মাছিরা এদিক ওদিক খুঁজে জানলার বাইরে যেতে চাইত। ফ্লাস্কে কফি ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল অনেকক্ষণ আগেই। ছাই দানির ভিতর ছোটবেলার সবচেয়ে প্রিয় খ্যলনা গাড়ির ব্যটারিটা পড়ে ছিল। দু চার টে ছেঁড়া তারে মাথা গুঁজে শুয়ে ছিল চীন দেশ,তার গোলাপ কক্ষ থেকে ফিনাইলের গন্ধ আসতেই আমরা ছুটে গিয়েছিলাম দরজায় দরজায়... কিন্তু না্‌, সেদিন কেউ দরজা খোলেনি। 


৩ 

একটানা চোদ্দশো বার ফোন করার পর ফোনটা ছুড়ে ফেলে দি।রাত সারে তিনটে বাজলেও নিঝুম আগে আসত।এখন দু চার মাস আসছে না। চিঠি লিখেছিলাম ওকে একটা, ঠিকানাটা বদলেছে কিনা তাও জানি না। রাত দেড়টা দুটো বাজলে ছাদে চেয়ার নিয়ে আসে ভ্রান্ত। উপরে ওঠার সময় আমায় একবার টোকা দিলেই আমি ওর সাথে গিয়ে ছাদে বসি। এখন আকাশের রংটা রাতে তেমন পালটায় না।তারাদের গাড়ি চলে সেখানে।হাট বসে। পরীরা বাজারের থলি হাতে নিলেও, ডানার আলোয় আমাদের চোখ আরাম পায়। মাছের দেহ নিয়ে ব্যবসা হয় না সেখানে। সমুদ্রের মাঝখানে একটা মাছঘর বানিয়ে সেখানেই পরীরা স্নান করে। পিঠের দিকটা শুধু দেখতে পাই। সাদা গোলাপি কালো লাল নীল হলুদ কত রঙের পিঠ। ভ্রান্ত আমায় ফিস খেলতে বলে। আমি ফিস ফিসিয়ে ওকে বলি-- দেখছ না? ও বলে ওসব পুরনো ব্যপার। আসলে কিছুই নেই।আমি বলি আছে আছে যা আছে তাতেই আছে। মোষের খুব বড় বড় মাছ হয় সেখানে, ডলফিনের বাচ্চা পাউরুটি খেয়ে লাফাতে শেখে,ফটাস জলের ফস ফস আওয়াজে আমরা দুজন লেজ নাড়ি,কোকিলের বাসায় হীরের ডাল রান্না করছে কাক।বাচ্চাদের এড়িয়ে যাচ্ছে রোডম্যপ।সব ফ্যকাশে চোখের মধ্যে গরম সুচ ঢুকিয়ে কেউ দুল পড়িয়ে দিচ্ছে আর আমরা ধিরে ধিরে নগ্ন থেকে নগ্নতর নদীর চরা দিয়ে হেঁটে আসছি যদি সামনে কোন চায়ের দোকান খোলে তবে দুটো বিস্কুট কিনে পকেটে রেখে দেব আরও কিছু দিন।যেদিন খিদের চেয়েও বেশি খিদে পাবে গলায় এক কামড় দিয়ে আবারও রেখে দেব পকেটে...আর ভ্রান্ত বার বার বলবে ওই জামা আমার ঘরে রাখবে না...পিঁপড়ে হলে বিছানায় আমার ঘুম হবে না... আমি বলি তুমি ঘুমাও কোথায়?আমরা তো রোজ রাতেই ছাদে বসে থাকি.... 

৪ 

ময়ূরের পালক কেটে কেটে শান্তা তখন কোলাজ বানাচ্ছিল।উপরে সারাসারি পাল্কী করে ব্যট ম্যান সুপার ম্যান আর জাম্বু ম্যান একসাথে এগিয়ে যাচ্ছে মরুভূমির দিকে।উটের চিৎকার শুনতে পেয়ে মাহুতরা হাতির গায়ে জল দিয়ে ভাল করে সাবান মাখিয়ে দিচ্ছে।এখনও লম্বা একটা পথে তাদের যাত্রা।তাবু নেই,কিন্তু কাপড় আছে,আগুন আছে,দড়ি আছে,খুঁজলে বাঁশ জোগাড় হয়ে যাবে।রাতে তাবু খাটানো যাবে অনায়াসেই।যদি বেশি ঠাণ্ডা লাগে তার জন্য দুটো গরম জামা নেওয়া আছে।গানের দুটো কলি থেকে কবিতার বুলি হবে না জেনে মাটি খোঁড়া আছে,ক্যকটাসের গায়ে দুটো ধুপকাঠি দিয়ে আরও দু পা এগিয়ে যাওয়া আছে যদি না কাঁচ এসে কেটে দেয় বালি। 

কাঁকড়ার গলায় একটা দামি লকেট দেখে শান্তা বলে, আমার ওটা চাই।আমি ছুটতে ছুটতে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে তার পিছু নিতে নিতে শেষ মেশ মন্দারমনির হোগলা বনে গিয়ে তাকে ধড়তে পাই।আমি বলি ওই লকেট টা দু দিনের জন্য দেওয়া যাবে?কাঁকড়া তেড়ে এসে আমার পায়ে কামড় দিয়ে আমায় বালির নীচে নিয়ে চলে যায়...আমি লাথি মারি,ঘুষি মারি,চিৎকার করি সে ছাড়ে না,অবশেষে একজন গেরুয়া বসন পরা মানুষ এসে তার পকেট থেকে চাকু বার করে কাঁকড়া টিকে মেরে দেয়।কাঁকড়া কে মারতে গিয়ে আমারও বুড়ো আঙুলটা কিছু টা কেটে যায়... আমি খুড়িয়ে খুড়িয়ে বাড়ি ফিরে আসি।পকেটে হাত দিয়ে লকেট দিতে গিয়ে শান্তার সামনে বেজায় বোকা হয়ে যাই... শান্তা বলে— 

পেলে? 

আমি মনে মনে বলি, পেয়েছিলাম, কিন্তু আসার পথে ওই গেরুয়া বসন আমার সাথে এসেছিল কিছুটা পথ...তার পরে আর পকেটে হাত দি নি... তাই মনে পরছে না... 

দাঁড়াও... না হয় আরো একবার যাচ্ছি... 


৫ 

টর্চের আলোটা চোখে এসে ধাক্কা মারতেই চোখের মণিটা স্থির করলাম।তারপর এ বি সি ডি র রেললাইন ধরে ছোট ছোট হিল জুতো,গাম্বুট এগিয়ে এগিয়ে এক জায়গায় স্তুপ হয়ে পরে থাকল।ঝরা পাতা আর ঝরা মানুষের স্তুপে পেট্রল দিয়ে দেশলাই টা যেমনই ছুড়তে যাচ্ছিল নন্দ বাজ পরল আকাশে।বাড়িতে বাড়িতে টি ভি গুলো কাঁপতে কাঁপতে বন্ধ হয়ে গেল।টেলিফোনের ওদিকের আওয়াজ এদিকের আওয়াজ শুনতে পেল না... সকলেই হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে... সেখান থেকে এমন এক সুর তৈরি হল যে জানলার পাশে গীটার নিয়ে বসা ছেলেটা গীতা খুলে বসল।ঠাকুমা দিদিমার পানের ডিবেতে ফাগুন লাগা সুপারির দানা থেকে হাত পা বেড়িয়ে এসে একে একে তারা সুপারি গাছে গিয়ে উঠল।চাঁদের ছবি তুলতে এসে একজনের হাত থেকে ফোন পড়ে গেল খাদের নীচে।বেঞ্চিতে কুয়াশার দানা দানা জল মুছে দুজন অতি বৃদ্ধ দম্পতি কোটের পিছন থেকে একটা পায়রা উড়িয়ে দিল।সেই পায়রা উড়তে উড়তে কোথায় হারিয়ে গেল আমি দেখতে পেলাম না...আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম—কোথা থেকে পেলেন এই সময়ে পায়রা?তারা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে হেঁসে বলল—এ আমার পিতৃ দেবের আমলের জিনিস।আমিও নিয়ে ছিলাম তাকে, এই প্রায় আশি বছর..... আজ উড়িয়ে দিলাম... হঠাৎ আচমকা টর্চের আলোয় কে এসে পিছন থেকে বলল--- ওঠ ওঠ...তারা উঠে চলে গেল। 

জাহাজের আগে একটা নৌকা ছিল এই পথে বাঁধা।আমরা ছোটবেলা থেকে সেই নৌকায় এসে বসতাম।নীচে কোন জল ছিল না...কংক্রিটের রাস্তাকে জল ভেবে গাছ থেকে একটা ডাল ভেঙে আমরা নৌকা পারি দিতাম...সে দূর দূর দেশ... কত কুয়াশা সেখানে,কত পাহাড়,কত পাখি,কত সূর্য।সেখানে স্কুলের ঘণ্টা বাজলে আমরা দৌড়ে গিয়ে জানলার পাশে এসে বসতাম না...পাছে জানলার বাইরে চোখ পরে যায়?তাহলেই তো মুশকিল... তাহলেই তো পুকুর,তাহলেই তো রাজার মুকুটে জং দেখতে পাবো...তাহলে তো হাত মুঠো, সপাং সপাং স্কেলের বারি খেতে খেতে ফিরে আসব আবার নৌকায়।চোখে কোন জল নেই,মনে কোন বল নেই,কাউরর উপর এতটুকু কোন ক্ষোভ নেই, 

আছে যা তা আরও আরও বেশি ভাল ওরা বলতে পারবে...আমার বলার ছিল যেটুকু সেটুকু বলার আগেই চোখে টর্চের আলো পরেছিল,দরজার বাইরে আজ ভ্রান্ত নেই, শান্তা নেই, নিঝুম তো কত দিন হল নেই...ডাক্তারের মুখ থেকে হাল্কা ব্লু লেবেলের গন্ধ নাকে এল...চোখটা বুজে হাতের কাছে একটা পেপার ওয়েট পেলাম,ভাবলাম ছুঁড়ে মারি আয়নার দিকে,যদি চুরমার হলে আবারও ওরা ফিরে আসে, তবে গিয়ে বলব ওদের এতদিন ধরে যা শেষ করতে পারছিলাম না আজ তা করেই ছাড়ব। ভ্রান্ত এসব শুনে বলবে, ছাদে চলো...শান্তা এসব শুনে বলবে ঘুরে এসো,নিঝুম এসব শুনে বলবে, দাদা এবার আমার বাড়িতে এসে থেকে যাও কিছুদিন,আর আমি এসব শুনে কি বলব সেটাই ভাবছিলাম, কিন্তু দেখলাম—এসব ভাবার বিষয় নয়।
0

মুক্তগদ্য - নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

Posted in


মুক্তগদ্য


সিলি সিলি সিলসিলা 
নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় 



অনেক চেষ্টা করেছিলুম; ব্যাঁকা-সোজা-উত্তর-দক্ষিণ-পাহাড়-সমুদ্র-ডায়াক্রনি-সিনক্রনি... 

১. 
ইস্টগেট থেকে ধুনোমাখা পথ, নোনাদেওয়ালে মোহিত-শিল্পা তির-হৃৎপিণ্ড, আগুন রঙা ফুটপাথের তীরে তীরে টাঙ্গাওলার খেউড়ক্ষেত্র, পথচিহ্নে ছাগলের নাদি, গাজরের হালুয়া, ইঁটের অন্তস্থলে রেচনভূমি পেরিয়ে কেল্লা। কেল্লার ফটকের ফুট বেয়ে হাঁটতে থাকলে ডানদিকে পড়ে রামলীলা ময়দান। গোলাপী, হলুদ, আকাশী, মাংসল, রুগ্ন হরেক বাস ময়দান জুড়ে ভিড় জমিয়ে থাকে। তারই পাশে চুমকিবসানো সাড়ির জমায়েতে চোখা বিতরণ। এরা কেল্লা হয়ে একইদিনে অন্য কোথাও যাবে। আগুনে ফুটের কিনারার দিকে যত যাওয়া যায়, রঙ তত গাঢ়। দু'একজন মানুষ, পঞ্চাশোর্ধ, রোগা মোটা, তেলতেলে কপালের নীচে সমকোণে গর্ত করা চেরাচোখ; সাদাকালোকমলা খোঁচাচুল মাথার পেছনে একটা ঘূর্ণি তৈরি করেছে; ভুঁড়ির অর্ধাংশ সোয়েটারে উন্মুক্ত; টেরিকটে অবহেলিত প্রস্রাবচিহ্ন; ডাক দিচ্ছে "আঁটো লে লিজিয়ে, সিধে ভগওয়ান টাঁকিজ"। অটো যায় গলিপথ ধরে। ন্যাড়া দেওয়ালে ডক্টর শাস্ত্রী, টোঁপি পেহেন লে, মজা লেলে, শুয়োরের চারণভূমি মহিষের জাবনা পেরিয়ে গলি ঢোকে নিবান্দা টাউনশিপে। টাউনশিপ চিরে কিছু বিক্ষিপ্ত পশ বাড়ি চেয়ে রয়েছে। এরপরেই কোনও একখানে ভগবান টকিজ। মাথার ওপর চারমুখো ফ্লাইওভারে নদীর এপার ওপার থেকে গাড়ি, ট্রাক, অটোর সমাগম। লোহা, লক্কড়, সিমেন্ট, বিচুলি, মার্বেলস্ল্যাব, রেপ্লিকা এবং সর্বোপরি মানুষ বোঝাই অটো ছাড়ছে বাসস্ট্যান্ডগামী। হাইওয়ের বাঁপাশে জংলাজমি, পাতাপোড়া গন্ধ, ডানপাশে রাজপুত ছজ্জায় সমাধি ঢাকা পড়েছে। জংলাজমি পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে সরকারি বাস টার্মিনাস। যে বাস কেল্লা থেকে ছাড়েনা, সে বাস এখানে এসে ধরতে হয়। বাস তার নাম্বারপ্লেট ধরে রাখতেই অক্ষম, আর মানুষ। আকাশী সিটে আগের ট্রিপের শিশুর গুয়ের ছোপ, খাটো পাদানিতে পা রাখলে মাছিরা বমি ছেড়ে ভনভনিয়ে পালায়। পেছনে, সামনে, শালমুড়ি, জ্যাকেটচাপা তেলামাথা যুবা, প্রৌঢ়, প্রবীণ। এই বাস সোজা যাবে। টুওয়ার্ডস সভ্যতা। 

২. 
আকাশে পাহাড় গেঁথেছে। বিভাজিকায় অস্পষ্ট ভিজিএ-প্রায় চীরগাছ বা কিছু। যে কাঁচ দিয়ে বাঙলা সিনেমা নর্থবেঙ্গল দেখে, সে কাঁচ পরশু দুপুরে নদীর জলে ধোয়া হয়েছে। তারই মধ্যে কিছু নাছোড় জলকণা সারাগায়ে ধুলোভরে উল্কি হয়ে রয়েছে, কোনোক্রমে টিঁকে যাওয়ার ছুতোয়। বাঙালি বরফ ফ্রিজে দেখতেই অভ্যস্থ। খয়েরি পাথরের ওপরে সোলার চাঙড়ের মতন প্রৌঢ় বরফ, গতসপ্তাতেও একযৌবন জুতো বয়েছে। এখন তার ওই ছাপসর্বস্ব জৌলুস, আকাশী ফিল্টার দিলেও বয়েস লুকোবার জো নেই। হোটেলের পাশে গাঢ় নীল নদী। এ অঞ্চলে রাত কীর’ম দেখতে হয় জানা নেই। দেখা যায়না। হোটেলের আলো জানলার কাঁচ ঠেলে খুব বেশি হলে তুষারপাত-অবধি পৌঁছতে পারে, গ্রামের ওপরের ঢাল অবধি যেতে আলোরও শীত করে। মেরুন সাদা হলদে উলে বোনা কচিহাত বেয়ে ঝাপসা আলোয় খোবানিকাঠ চলে নদীর ধার দিয়ে দিয়ে। পাথরের খোঁদলে পা ফেলে বাড়ির বারান্দা উঁকি মারে। বরফেপোড়া ছিটেধরা মুখ তাহান দেখেনি, ফেসবুকও দেখেনি, ট্যুরিস্ট দেখেছে। দেখেছে কালো-চৌখুপ্পি-অগ্রচর্ম-লেদারজ্যাকেট, কাল সকালে থুকপা খাবে। ইস্কুল অনতিদূরে, চিবুকে তার ক্ষেতজমি। ক্ষেতজমির ওপর পুরু বরফ। পুরু বরফের ওপর জুতোর ছাপ। 

৩. 
চৌকো টাইলের আকাশী বাসস্টপ; লোহার বেঞ্চির ওপর আগের মানুষটার গন্ধ উষ্ণতা ইত্যাদি। বেঞ্চির পেছনের ওই ঘিঞ্জি জায়গাটুকুতেই মাথা গুঁজে শুয়ে থাকে কেউ। বাঁহাত দুপায়ের ফাঁকে জড়ো করে আনা, ডানহাত বেয়ে মুখফিরতি গ্যাঁজলা। সোজা চলার পথে খৈনির দোকানের মুখে উপুড় হয়ে বমি করতে থাকা ট্যাক্সিড্রাইভার, বমি শেষে টাল খেতে থাকে, থমকে যায়, আবার টাল খেতে থাকে। একটু এগোলে বাঁহাতে হলদে রঙের একটা শাটার ফেলা ঘর, শাটার খোলা থাকলে মিন্সড পর্ক ও তার সামনে খানচারেক কুকুর। আরো খানিক এগোলে লুঙ্গির ওপরে স্যান্ডো গেঞ্জি পেট থেকে বুকে তুলে পায়ের ছাল খুঁটছে কেউ, সামনের হুকে ছাড়ানো পাঁঠা। বাঁপাশে মন্দির, ট্রাপিজিয়ম ফুটপাথের খোপে দুধ জমেছে। রোজ ধোয়, রোজ জমে। লোহালক্কড়ের, রাবার শিটের ওপর লজেন্স, বিড়ি, দেশলাই সাজানো, ডাঙা থেকে নেমে পড়লে আনাজবাজারের ভিড়টুকু এড়ানো যায়। পাতালপথ ধরার মুখে কাদা জমে। তার সামনে ঠেলাগাড়ি। চালকের গায়ে মেরুন গেঞ্জি, রাস্তা থেকে কোল-ভরে আনারসের ছিবড়ে, সবুজকাচের বোতল, ছালে জড়ানো মাছের কাঁটা, তুলে তার গাড়িতে জমায়। সে চলে আগে আগে। আড়াই মিনিটের বাস-স্ট্যান্ড, সরে দাঁড়ান পেরিয়ে বাদামভাজা, চিঁড়ে, মুড়ির কোণে হেদিয়ে যাওয়া এটিয়েম; ভেতরে কালচে বালতি, এসির জল জমে শ্যাওলা ধরেছে। উলটো ফুটে আধাপরিত্যক্ত বায়োস্কোপের আড়ালে মিটমিটে কেবিন, পাশে থানরঙা দেয়ালে ডিম-আলো ধরা ওষুধঘর। ঠেলাগাড়ি এদ্দূর এসে মোচড় নেয়, ক্যাসেটের দোকান ধুনোয় ঝাপসা। ভেড়ার চামড়া, বাঁধাকপির খোসা, ম্যানিকুইনের আত্মা ঠাসা হয় ঠেলাগাড়িতে। তারই মধ্যে ছেতরে বসে মাথা গুঁজে দিয়েছে এক ন্যাড়ামাথা কিশোর। গোড়ালিতে ব্যান্ডেড। একটা পা বাইরের দিকে ঠিকরে। মুখটুকু ডিমের খোলায় ঢুকে এসেছে। বুকের কাছের জামাটুকু অর্ধচন্দ্রাকারে ভেজা। নাকের কোণায় গ্যাঁজলা। 

৪. 
কালচে কাচের ওপর লেপে দেওয়া নোনা রোদ, অনুবাতে অন্ধকার। রাস্তার আধা-আঁধারি এপ্রিলমাস মুড়ুক্কুর দোকানে ছাউনি টেনেছে। এমাসে অস্বস্তিসূচক অনাচ্ছন্নাবস্থায় মাঝারি থেকে কমের দিকে। কাঁচা সবুজ, ছাইছাই, মেরুন রঙের শার্টের উড়ুক্কু অপাবৃত হাতা, চুড়িদারের ওড়নাবাওয়া কিছু অনভ্যস্থ চোখ, ইতি-উতি বেরিয়েছে পথে, সন্তর্পণে পা ফেলছে সিগ্ন্যাল মেপে, অপরিচিত। সোজা গেলে অটোপথ শিরিষফুলে বিছানা পেতেছে। হাত-ছয়েক বাঁদিকে আয়তাকার কাচের দোকান, হিম দিয়ে চুষে নিচ্ছে কপালে জমা নোনা বালি, চুলে জমা তাপ। মোড়েরমাথায় চশমা চকচক করে। এপ্রান্তে প্রতি বর্গকিলোমিটার অন্তর সে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে খসড়া হাতে, বুলি-বোবা-সাহিত্য-চীৎকার ব্যাতিরেকে; মৃত স্পোক্সপার্সনকে অটোকারেক্টে ইতিহাস বলে। মিশকালো যৌবনঘেঁষেচলা মোপেডচালক। তার এক মাথা দুপুরে জবজবে চানের জল, কানের লতিতে নারকোল তেল। চড়াই, উতরাই গড়িয়ে অটো এনে নামায় একটা প্রকাণ্ড গ্রন্থির মুখে। নাকের সামনে লাল টিউনিকবাঁধা খুকি, মস্ত গোরিলা আর আরো প্রকাণ্ড একটা কিছু; বিনোদন। দুদিক থেকে দুটো পিষেফেলা বিপরীতমুখী রাস্তা, মাঝদুপুরের ঝাঁঝে সুবিপুল, বা নয়, মধ্যিখানে যা আসছে আছড়ে তুবড়ে থেঁতলে ফেলছে। গাঢ় আসমানি আকাশের তলায় এলোপাথাড়ি হাওয়া। আলজিভ ছুঁয়ে সিলিকন, কাঁকড়া, ইউরিনাল, মুমফলি, মাখিয়ে, বুকের ওপর অবধি জ্বালা ধরিয়ে হাওয়া আরও পশ্চিমে সরে যায়। সমুদ্রবায়ু। 

৫. 
ধাতুর আঁশে গতিদীর্ণ সময়। কাদাগোলা জলে গামছা চুবিয়ে মুছে নেওয়া দুটো কাচ; তারই আধ ইঞ্চি ব্যবধানে জমা হয়েছে মরা উচ্ছিষ্ট, কখনও সোনালী, কখনও ছায়া রঙের। অভিমুখন এমন একটা ব্যাপার, যার ভেতর বাহির আবছা; স্থানানুক্রমিক। ভেদ নেই এমন নয়, তবে একটা অন্যটার প্রতিস্থাপকের মতন, অফুট। জানলা পেছনে ফেলে যায় অভিমুখ, চ্যুইংগামে আটকে পড়া, হাওয়ায় ফুলে ওঠা কালো প্লাস্টিক, মাঝরাস্তায়। শহরের পরিসীমায় প্লাস্টিকের সুবিপুল ইমারতগুলো। সেখানে কেউ থাকেনা। কেবল সেগুলিই থাকে। চিকন ঘাসের ওপর লোহার, আরো বিচিত্র শংকরের আলপনায় অতিপৃক্ত সভ্যতা। ইতস্তত ওঠানামায় বাসস্ট্যান্ড ছোটবড়ো। ঢলা সূর্যের বিপরীতে অন্ধকার মুখ বাস পাচ্ছেনা। বাগান, ঝিল, সব নকল? এই মাস্তুল থেকে ডলফিন, ডলফিন থেকে ফুটবল, ফুটবল থেকে পেট্রোল পাম্প, এর মধ্যেগুলো? এর অভিমুখ কোথায়? জানলার ভাঁজ থেকে তুলে নেওয়া হাতে বাসা নেওয়া ছাপ, তার অভিমুখ কোথায়? এই যে কিছু হবেনা, এই যে পেটের ডান পাশ থেকে ঘূর্ণির মতন নেমে আসা কুঁকড়ে দেওয়া যন্ত্রণা, এই যে কানের মধ্যে ঠেলতে থাকা ইয়ারফোন, শুনতে পাচ্ছিনা, এই যে প্রচণ্ড পাঘামানো দুশ্চিন্তা, এর অভিমুখ কোথায়? এই যে কাচের মধ্যে থেকে ঠিকরে থাকা অর্ধেক চোখের কানা প্রতি সিগ্ন্যালে পরাবাস্তব ফ্রেম তৈরি করার চেষ্টা করে যায়; এই যে পরের মুহূর্তেই তা টুকরো হয়ে যায়, এসবের অভিমুখন বাধ্যতামূলক? আনত সোয়েটারের হাতায় ব্যাগ গলিয়ে সময় নেমে যায়; অভিমুখ অভিমুখের মতন।
0

মুক্তগদ্য - কৃপা বসু

Posted in


মুক্তগদ্য


সত্তা
কৃপা বসু 




ঈশ্বরী ধর্ম ও যৌনতা

প্রব্রজ্যা ভেঙে স্নেহরঙের জলপট্টি মাথায় রাখে ও। উলের মতো পাক খেতে খেতে আমার মুখে নুয়ে পড়ে ওর নীরস আধফোটা বুক। বীজভাঙা সরল হাতে চুলে বিলি কেটে দেয়, ওর গা থেকে ঝিমধরানো কচি চাপাতার গন্ধ পাই আমি।

পাংশু পাঁজর ছুঁয়ে নির্মেদ ঝর্ণার মতো মোমদান হাতে সে যতবার এগিয়ে আসে, আমি পর্দা টেনে দিই ঘরের। আশরীর রসায়ন ভুলে আমি ওকে আমার মেয়ের মতোই ভালোবাসি তখন। 

যতবার দেখি ওর বয়স তেইশেই আটকে থাকে যেন, ওকে আমি সরসিবালা বলি। খরস্রোতা নদীর মতোই সহজ ওর মোলায়েম চুলের গিঁঠ। শিশিরস্নাত, শয্যাসংসক্ত এক রহস্যময়ী নারী,যার অক্ষতযোনি বেয়ে চুঁইয়ে পড়া রজঃস্রাবের লাল ছিটকে লাগে আমার শ্যাওলা পিঠে।

ওর তুলতুলে স্তনদ্বয়ের দিকে তাক করে লাল নীল হলুদ ফুল ছুঁড়ে দেয় শ্বাপদের দল। জপতে থাকা পবিত্র তসবি ছিঁড়ে ফেলি। মহাশূন্যের অলৌকিক নিয়মে ওর কাছে যাওয়া বারণ মোসলমান বলে। নাছোড়বান্দা আমিও দূর থেকে চেটে খাই ওর অশক্য পুষ্পনাভিমূল। জুতোর ফিতে ঘেমে ওঠে, ঘাতক বটের পাতা পায়ের কাছে ঝরতে থাকে ক্রমশ।

জিভের লকলকে তরোয়ালে কেটে ফেলি কমলালেবুর শরীর। বিসর্পিত অন্ধকার চিরে কান ঘেঁষে ঘ্যানর ঘ্যানর বাজে ''জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচোযুগোশোভিত মুক্তাহারে''। এক খাবলা নুন মুখে পুরে সুরভিত মদের নেশায় মেতে উঠি গয়বি-খেলায়। 

সে একাধারে আমার মেয়ে, স্ত্রী, মা, আমার প্রেমিকাও বটে, ও আমার সরসিবালা। বল্কল ত্যাগ করে কিরাতের মতো ফিরে আসি ময়লা কুঠিরে...


সত্তা

স্নেহ
বাউলানী থালায় ধোঁয়া ওঠা ডাল ভাতের গন্ধে মা রঙা আঁচল উড়তে দেখি...

আশ্রয়
বিচ্ছেদের নামতা গুনে ফেরা শঙ্খচিলের ডানায় হেমন্তের ঘ্রাণ মাখানো সেপিয়া বিকেল এঁকে রাখা।

অভিমান
বোবা টেলিফোন, একঝাঁক কথারা যার ভেতর কাঁটাতার হয়ে ঘিরে থাকে জামরুল বন।

ভয়
নীল স্কার্ট পরা মেয়েটির কনুই বেয়ে নেমে আসা কাঠি আইসক্রিমের তরল যে ছেলেটি তার সবুজ রুমালে আলতো করে শুষে ফেলে, তার ঘোলাটে চোখে মাঝেমধ্যে বারুদ-গন্ধী আগুন জ্বলে...

অনুযোগ
কানের পালকে পোঁতা একগাছা ধারালো সেফটিপিন। গুগল সার্চ করে একদিন ঠিক ব্লেড হয়ে ফিরবে তোমার ঠিকানায়।

বিচ্ছেদ
বিকেল পাঁচটায় ফ্ল্যাটের নীচে যে পুরুষ রজনীগন্ধা হাতে দাঁড়ায় রোজ তার ঠোঁটের কপাটে হার্ট সার্জারির রঙিন বিজ্ঞাপন ঝুলতে থাকে...

কান্না
চেরাই করা কাঠের পাঁজরে লেগে থাকে কুঠারের স্নেহওম। দিন গড়ালে আসবাবপত্রে পরিণত হয় ।

প্রশ্ন
আচ্ছা ডুবন্ত টাইটানিকের মতো তিরতির করে কেঁপে ওঠা সংসার নামের যাবতীয় অসুখ মুছে ফেলার ডিলিট বটন হয়না কেন?


জেহাদী অস্তিত্ব 

১.
জল আর পানিতে ঘেঁটে ফেলি জেহাদের নুন।
সাম্যবাদ আসলে সবুজ রঙের আলো,
নিভে গেলে অবোধ শিশু মুখস্থ করে সন্ধ্যার শাঁখ ও ভোরের আজান।

নগ্ন প্রেমিক প্রেমিকার নাভি ছুঁয়ে যায় ধর্মীয় চুম্বন।
দূরে কোথাও ছোট্ট কুয়োর জলে মধুক্ষরা চাঁদ শুয়ে পড়ে চুপচাপ।
নিমবৃক্ষে টাঙানো বৈরাগ্য শোক।

পান্তা ভাতের সাথে মেখে এভাবেই খেয়ে ফেলি নিজেরাই নিজেদের নিরীহ ভারত।

২.
সরসীকোল থেকে ঝরে যায় বাদামী রোদ।
আঙুলের চামড়ায় ঝোলে সময়ের ক্ষয়।
মেয়েলী গন্ধে ধুলো জমে ঈশ্বরের ক্ষমাহীন চোখে।

গায়ে যৌবন রঙ মেখে মেয়েটি তুলে নেয়
দায়িত্ব ভরা মোহর কলসী কাঁখে।
অনেকখানি নিঃস্ব হলে শেষ ট্রেনে ফেরে
ক্ষীণ হয়ে আসা বিহানআলোর কাছে।

৩.
পাখির ডানায় লেগে থাকা ভ্রমর-বিকেল
ব্রাশ দিয়ে সাফ করে কেউ রোজ।
ময়লা টিকিট শুষে নেয় ধুঁকতে থাকা শহরের এঁটো ঘাম।

খুরিতে লেপটে থাকা শেষ চায়ের মতো বিক্ষিপ্ত উষ্ণতা ভাগ করে নেয় সন্দিগ্ধ শিকড়।
গলার শিকলে টান পড়ে, দরজার বাইরে সফেদ
চাদর গায়ে হাঁটু মুড়ে বসে ক্ষয়াটে বসন্ত।

অদূরে জমির বুক থেকে ছিঁড়ে যায় ধানের পোশাক।
0

মুক্তগদ্য - পরমা মিত্র

Posted in


মুক্তগদ্য


রোদ্দুর
পরমা মিত্র



শিউলিগাছের পাতা থেকে নামতে নামতে রোজ ধরা পড়ে যায় মায়ের আঁচলে।বমুঠি করে ধরে নেয় মায়ের ওম, নেমে আসে বাগান পেরিয়ে উঠোনে। বারান্দায় বড় হতে থাকে চিকচিকে পাতাবাহার। রোদ্দুর এগিয়ে যায় আরেকটু। তুই বুঝিসনি আজকেও, তোর পাশে ও বসেছিল খানিক, জানলার ধার ঘেঁষে, আমার সে ছোট্ট রোদ্দুর। 

হঠাৎ ডাক পাঠালো আমগাছের চিরচিরে মুকুলেরা, ছুটছুট ছুট, তোর গাল ছুঁয়ে এক ছুট্টে পেরিয়ে যায় ঘর, সরে যায় পর্দারা। ব্যস্ত হয়ে পড়ে উনুনের আঁচ, ফুটতে থাকে রোজনামচা। পাঁচিলের ওপাশ থেকে উঁকি মেরে টুকি দেয়, ঘুলঘুলি নকশা সেজে ঢুকে পড়ে একদম মায়ের পুজোর ঘরে। গুটিসুটি বসে থাকে লক্ষ্মীর ঘট ধরে, কত বলি সর, সর, সর। একদম কথা শোনেনা, আমার সে একরত্তি রোদ্দুর। 

এঘর, ওঘর, সেঘর, বারেবারে এসে দাঁড়ায় পাশটিতে। এক্কা দোকা খেলে চলে দেওয়াল ঘড়ি। বাবার টেবিল থেকে তুলে নেয় আজকের কাগজ। খবরের পাতা টাতা সরিয়ে দুলে দুলে পড়ে চলে "মিতুলসাহা। বয়স ১৭। পরনে ছিলো চেক চেক জামা। যেখানেই থাকো ফিরে এসো, মা অসুস্থ"। স্নান বাকি, অগোছালো কাজ বাকি, সবখানে ফাঁকি হয়ে ধরা পড়ে এমনি বেভুল। বকা দিলে সাত সমুন্দর চোখে তুলে তাকাবেই, আমার সে অভিমানী রোদ্দুর। 

রাগ করে গাল ফুলি হয়ে লুকিয়ে পড়ে আলমারির পেছনটিতে, ছায়াদের একদম কোল ঘেঁষে। মাকড়সারা বুনতে থাকে জাল। এদিকে তুই হয়ত সবে স্নান সেরে পরিপাটি হবি, তাকিয়ে দেখবি একরাশ আলো আয়নায় মায়ের টিপের পাশে আটকে গেছে কি করে। ধরে পড়ে চিকমিক করে ওঠা জলছবি রঙ হয় আমার সে টুকি দেওয়া রোদ্দুর। 

এদিকে ততক্ষণে কুলুঙ্গিতে নেমে এসেছে সুজ্জি, পশ্চিমের জানলায় হেলান দেয় ক্লান্তি। ঘুঘুর ডাক ফিরে গেছে ফেরিওয়ালার সাথে। দেওয়াল জুড়ে বারোমাসের গদ্য। ইশকুলের ঘণ্টিও খেলতে যাবে, রেডি। আকাশ জুড়ে বাড়ি ফেরার তাড়া। আরও একবার গুছিয়ে নিলো সব, তুই তবুও শুনলিনা সে, "আসি"। শহর জুড়ে সাঁঝের শামিয়ানায় ডানা মেলে উড়ান দেয় আমার সে আদরের একমাত্র রোদ্দুর। 
0

মুক্তগদ্য - সুমনা পাল ভট্টাচার্য

Posted in


মুক্তগদ্য


না পাঠানো চিঠি
সুমনা পাল ভট্টাচার্য


তোমায় কখনও বলা হয়নি ,
তুমি যখন আমায় আদরের পেয়ালায় চুবিয়ে আমার 
মচমচে মেরুদণ্ডটাকে ভিজিয়ে ন্যাত্যা করে দিতে,
আমার একান্ত কোষগুলোতে তখন সালোকসংশ্লেষ 
হতো না আর,
পরমাণুগুলো এক্কেবারে ভেঙেচুরে কেমন তোমার রসায়ন পাত্রের নিখুঁত আণবিক গঠন নিয়ে নিতো, জানো..

নরম , তরল, বড় সহজ, জলের মতোই।

তোমার ঠোঁটের সন্ন্যাসকালে যেদিন গেরুয়া হলো সিঁথি, আমার শরীরও সেদিন হলো জমাট বরফ,
আমার মেরুদণ্ড ততদিনে আর নিজের জোর ফিরে পায় না, পঙ্গুতার ছাপ তার গাঁটে গাঁটে...

জলের স্রোতে যে ঘর ভিজেছিল, সে ঘরে বরফ আঁটতো কি করে বলো !
তাই আছাড় মেরে ঘরের এক কোণে ছুঁড়ে দিতেই 
নারকেলের পাঁজর ফাটা বিষাদজল বয়ে চলল নিরন্তর...
বুঝলাম, রাতের চোখে নদী হবার নিভন্ত আগুনটুকু রয়েই গেছিল শেষাবধি
:
আজকাল হইলচেয়ারের চাকার আওয়াজ নিয়ে আসে প্রতিটা সকাল।
0

মুক্তগদ্য - শালিনী ঘোষ

Posted in

মুক্তগদ্য


পুরুলিয়া
শীত'২০১৭
শালিনী ঘোষ


এখন গাঢ় চন্দ্রালোকে গা গুলিয়ে আসে। ধুলোওঠা রাস্তা আর মাইলের পর মাইল বিছিয়ে থাকা গাছহীন জমিতে বাহুল্য মনে হয়। বিলাসিতা। বেলা বাড়লে খাবার জলটুকু উঠে আনাও বড় শ্রম। অথচ ঘরে মানুষজন নেই। লোহার গেটের ওধারে যারা মাঝেমধ্যে হানা দিয়ে যায়- ছোটো মাপের বাচ্চা, ইতিউতি গাড়ি, একেকদিন মনে হয় তাদের কাছে গিয়ে দুদণ্ড বসি, জিরোই, বাতচিত এগোক খানিক হাওয়ায় হাওয়ায়। হয়ে ওঠেনা।

পূর্ণিমার অপচয় আর তেষ্টার জল আর আলাপীর অভাব ক্রমশ বয়ে যায় আরো আরো উত্তরের দিকে।




যেমন আজ মনখারাপ। সকাল থেকে অদ্ভুত স্তব্ধতা জমাট বেঁধে আছে চারদিকে। এতটাই শুনশান, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে কবি ডুবে গেলে একলা স্টেশন দিয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে, পুকুরপাড়ের আড্ডা হয় কোমলে মাপা। বালিশে প্রাণপণ মাথা চেপে ধরে পাতাদের মৃত্যু টের পাওয়া অভ্যেস করতে চাইছি। অথচ বারবার ফিরে আসে যা, আমারই সর্দি বসা বিক্ষিপ্ত শ্বাস। ছড়িয়েছিটিয়ে কাচ বাষ্পে ভরে তোলে। যত অনায়াস শরীর ইত্যাদি, নাম-মুখ কুয়াশার ভিড়ে চোখে পড়েনা। নিরাসক্তি আঁকড়ে শীতঘুমে যাওয়া প্রিয়, মৃত্যুর মতো প্রিয় মনে হয়।




অনেকক্ষণ শান্ত চোখ মেলে রাখা। ভিড় হয়ে যেতে মন করে। আলপথ বেয়ে অবিরাম চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে শেষতম বাঁকে মিলিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা। ওই জোটে হারিয়ে যাওয়ার দায় যতখানি, ততটুকু মাপেই স্থবিরতার বিপরীত মেরু টান। ঘূর্ণিতে আবর্তিত হয় আমারই যৌবন, আবেশ, কলমের ডগায় ঝরে না পড়া অলৌকিক শব্দগুচ্ছ। অনন্ত জুড়ে থাকে ধুধু প্রান্তর। আমের পল্লবে পুরু হয়ে বাস করে অস্থিপোড়া বেনামি ছাই।
0

মুক্তগদ্য - ঈশানী বসাক

Posted in


মুক্তগদ্য


পরিণত বৃক্ষ
ঈশানী বসাক 

বহুবছর পূর্বে এক রোগীর ব্রেন ডেথ হলে তার পরিবারের অনুমতি নিয়ে তার হৃদয় অন্য এক প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করে। দেখা যায় সেই মানুষটি নতুন হৃদয় নিয়ে সুখী নয়। বেঁচে থাকা আর অসুখ নিয়ে বাঁচার মধ্যে একটা নিজস্ব লড়াই চলে আর সেই মানুষটি প্রতিদিন এই দোটানার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যায়। একদিন সে সেই মৃতমানুষটির কবরের পাশে বসে। মাথা রাখে তার শীতল খালি বুকে। হৃদয়হীন সেই বুকের একটা নিরুত্তাপ মায়া অনুভব করতে করতে বলে আমার হৃদয় দেওয়ার ক্ষমতা নেই কারণ সে হৃদয় আপনার। এমন ভাবে আমাকে বন্দী করবেন না। আমার বাতিল হৃদয় আমাকে ভালবাসার অধিকার দিতো। কিন্তু এই হৃদযন্র শুধু কৃতজ্ঞ হতে চায়। বিশ্বাস করুন আমি আপনার মতোই হৃদয়হীন। আমাকে আপনার সম্পত্তি ফেরত নিয়ে বিদায়ের অনুমতি দিন। অন্তত কৃতজ্ঞতাময় মৃত্যু চাই না।

কবিতার ফর্ম বা কনটেন্ট নিয়ে কথা বলার ধৃষ্টতা নেই একেবারেই। তবে একটা কথা মনে পড়ে গেল । একটা ফর্ম শরীরের মতো। তার মধ্যে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ স্থাপন না করলে শুধু শরীর নিয়ে কি বা লাভ? একটি সম্পূর্ণ মনহীন শারীরিক সম্পর্ক যা ক্রয় বিক্রয় বোঝে সেখানেও একটা মানসিক কয়েক মুহূর্তের যোগসূত্র থাকে। তবে খালি খোলস নিয়ে লাভ? একটা সংযোগ, একটা বিষয়, একটা যাপন না থাকলে কি একটা শরীর গড়ে নেওয়া যায়? তাই কনটেন্ট প্রয়োজন। তবে খালি কনটেন্ট দিয়ে কি হবে? শরীরটাও যে চাই। তার ছাঁচ রূপ সব যেন ভিন্নতা পায়। তোমাকে সবার মতো দেখতে হলে হবে? ভাল লাগবে কী? নাহ। তাই শরীর হবে সবার থেকে আলাদা। তাই অন্যের হৃদয় বসিয়ে প্রভাব আসতে পারে, কৃতজ্ঞতা আসতে পারে, রক্তক্ষরণ আসে কী? ভালবাসা আসে কি? ফর্ম আর কনটেন্টকে লড়াইতে না নামিয়ে তাদের অপরিহার্য বন্ধু বলা যায়, বৈবাহিক সিদ্ধান্ত বলা যায়। তবেই যাপন বসেন কলমে।

একটা শহর বহুদিন পোস্টঅফিসহীন। সংযোগহীন পড়ে থাকে সে। একটা দিনকে পর্দা দিয়ে অসময়ে ঢেকে দাও। পাখিরা ঘুমিয়ে পড়বে। এক সম্পর্কহীন বয়স নিয়ে চলতে চলতে দেখবে আমাদের ছাদ এক। দশক থেকে বেরিয়ে এসে জানি কবি যখন লেখেন তখন তার কোনো সময় নেই, সংযোগ নেই। যত বিচ্ছিন্ন থাকেন ততই তার আনন্দ ঝরে। চক্ষুদান করেন একটা শরীরকে। তখন ছাই মনে থাকে নাকি তাকে পোস্টঅফিসহীন দুনিয়া থেকে নিয়ে যেতে হবে শহরে। যেখানে সময়, যুগ মাপা হয়। পড়াতে হবে দশক মেপে। দশক তো চিহ্নিত করার কাজ। ও তো গবেষণা স্বার্থে। আমরা তো পড়তে চাই। যা পাবো তার সবটুকু রস নিংড়ে নেব। যেমন যতক্ষণ দিন থাকে পাখি দুচোখ ভরে পৃথিবী দেখে। পুরনো নতুন সব।
0

মুক্তগদ্য - অনিমেষ ভট্টাচার্য্য

Posted in


মুক্তগদ্য


ইচ্ছে
অনিমেষ ভট্টাচার্য্য



আমার সঙ্গে সুরভীর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। গদ্যপ্রদেশের সুরভী। রাজধানী যানজটনগরে ওদের তুলির ভাস্কর্য আছে। একটা বিরাট সারস হাঁ করে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। চারপাশে খাবলে খাওয়া হাড়! পাহাড়। না, ওটা মহেঞ্জোদাড়ো না। ওখানে কেউ চান করে না।

ওদের বাড়িতে সবাই আলাদা। সুরভীর বাবা গতিশীল। মা চাতক পাখি। সুরভী সেক্ষেত্রে একটা নৌকা, যার দিগন্ত হওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু, বাতাস এখানে খুব অলস।

বিয়েটা ছিল সংক্রান্তির দিন। সকাল থেকে সুরভীর ধুম জ্বর। নিরাময় খুঁজতে চলে গেছে তার বাবা। মাথায় জলপট্টি দিয়ে অপেক্ষায় বসে আছে মা। ক্রমে ক্রমে ভিড় বাড়ছে। প্রথম প্রথম সবাই খবর নিচ্ছিল। আস্তে আস্তে খুব ভিড় হয়ে গেল। বিয়ের জন্য নয়। দেরি হচ্ছিল বলে।

দেরি হলে ভিড় হয়। ভিড় হলে দেরি।

যানজটনগরের আকাশে পলাতকা মেঘ। বিকেল ফুরিয়ে আসছিল বলে আমি সারস'টার নাম দিলাম, অভিমান। সে মৃদু চাহনিতে ডাকল। আমি পাহাড় সরিয়ে এগোতে গেলাম। আর সেগুলো দুমড়ে ভেঙে যেতে লাগল। কারওর সাড়া না পাওয়া দমচাপা বাতাস ছিটকে এল মুখে। আমি তখন দুন্দুভি হতে পারতাম, কিংবা ক্লান্ত। কিন্তু, আমি উজান হলাম।

অভিমান ঠিক বুঝেছিল, সন্ধ্যাস্নান আসন্ন।

তারপর থেকে তো সবটাই লৌকিক। যেমন গদ্য, যেমন জীবন, যেমন নদী...

আমি আর সুরভী আজও ভেসে চলেছি। সুরভী দিগন্ত হতে চায়, আর আমি শান্ত...শান্ত...।
0

মুক্তগদ্য - পৃথা রায় চৌধুরী

Posted in


মুক্তগদ্য


ফাইনাল ভার্ডিক্ট... জন্মান্তর 
পৃথা রায় চৌধুরী 



অল ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার

আঘাটায় বসে তুমি কুক্কুরীর বহুগামীতা দেখছো। তাদের আদিম আওয়াজে প্রার্থনা করছো, অভিশাপে অক্ষম তোমার পুরুষাঙ্গ আবার জেগে উঠুক পৃথিবীর নারীভাগে প্রলয় ডেকে আনতে।

হায়, শত্রুজিৎ! তুমি বসে আছো সে কোন গঙ্গার তীরে। সেখান থেকে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি মেলে ধরেছো হোটেল ওরিয়েন্টের এক বিকিকিনির কামরায়। সেই যে শাল্মলী পরিবহনের বিপরীতে ওরিয়েন্ট! সীমিতা দেহপসারিণীর বিকৃতি তুমি ধারণ করছো নিজের শ্রবণেন্দ্রিয়ে। তবু, হায় বেনুবল্লভ, ফিরে এলো না তোমার বিনষ্ট পৌরুষ। বড়ো আক্ষেপে বলেছো, সময়ে কেন নেত্রাকে নিক্ষেপ করোনি এমনই কোনো বিকিকিনির বাজারে! সে তুমি পারতে না শত্রুজিৎ, আমার কোমরের খাঁজে যেখানে বাড়তি মেদ, ঠিক সেখানেই তুমি নেশাবন্দী ছিলে। তখন আমায় নিক্ষেপ করলে বুঝি সেও আসতো না, যাকে অক্লান্ত চেষ্টা করছো আমার থেকে কেড়ে নেবার। তুমি চেষ্টা চালিয়ে যাও। একে একে তোমার সব ঘৃণ্য গৌরব কেড়েছি, কেড়েছি তোমার যুগল ঘেয়ো কুত্তার বীরত্ব। অহল্যা এবার নষ্টার নষ্টামির দিকে এগিয়ে দিয়েছে তার বিচারদণ্ড। দক্ষিণ তিলে আগুন লেগেছে অহল্যার কপালে।

অচেনা অদেখা সেই আগন্তুকের সুলুক পেয়েছো? এ সেই তোমার চিরশত্রু প্রসন্নজিৎ। তবে তোমার বুদ্ধির তারিফ কিভাবে করি বলো দেখি? নিজের শতসহস্র মৃত্যুবাণ তুমি স্বহস্তে তুলে দিয়েছো তার হাতে। তার বর্ম আর মুখ ঢাকা শিরস্ত্রাণের আড়ালে প্রথমে ভেবেছিলে, কোনো স্থূলবুদ্ধি, এরপর ভাবলে দাঁড়িয়ে আছে ত্রিনেত্রা অথবা তার গর্ভাশীর্বাদ! আর কতোবার, তোমার দুঃখে হায় বলে বিলাপ করি? আসল চেহারা বুঝতে বড়ো দেরি হয়ে গেল...

ক্রমাগত ডেকে চলেছো সেই সন্তানকে, যার মাতৃগর্ভের পরিচয় জেনে ভেবে নিয়েছো, এ তোমার জন্মজন্মান্তরের ঔরস। দুটি বটফল হাতে চেনার চেষ্টা করো, সে কোন জন! তোমার পচে যাওয়া বাম বৃক্কের দোহাই পেড়ে আমারই সন্তানকে বলছো, তার ভ্রষ্টা মাকে পদাঘাত করে তোমার কাছে চলে যেতে। তোমার শরীর থেকে নিত্য নিঃসরণ হয় যে বদরক্তের, তার দোহাই পাড়ছো। কি করে ভেবে নিলে, পাপাত্মার ডাকে মা'র কোল ছেড়ে যাবে সে? কি মনে করেছো, সন্তান দ্বারা অহল্যার পুণ্য তোমাকে মৃত্যুগহ্বর থেকে টেনে আনবে, তুমি জয়োল্লাসে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেবে অন্ধকারের পরাগ? হায়, বেনু... হায়!

একমাত্র মা জানে সন্তানের পিতৃপরিচয়। তুমি তবে জেনে রাখো, পিতা হয়েছো কেবল বীর্যে। সন্তানদ্বয় ফিরে ফিরে আসে সেই ওমের আদরে, যাকে তারা বলে পিতা। সেই পিতৃস্নেহ, পিতৃদায় নিজেদের অস্তিত্বের অংশ করে পৃথিবীর বুকে ফিরে ফিরে আসে তারা। সন্তানসুখ কেবল আমার, কেড়ে নিয়েছি তোমার সে অধিকার পুরাকালের কোন বিস্মৃত লগ্নে।

রাজপথ, পাখালি ভোর, বটের ফল
বাছতে বসো, খুঁজতে বসো, গড়ালো জল।



ইট'স অল ইন দ্য গেম

প্রথম কিস্তিতে, বন্ধ হোক আগুন কলম আশায় আশায় ছিঁড়ে আসা মুখোশেরা শরণাপন্ন শেষ আশ্রয়ের। সামাল সামাল, মুখোশ বুঝি ওই দামাল দাবানলে খাক হয়ে যায়। বেরিয়ে পড়ে বুঝি বসনহীন বিক্রম অভেদ শত্রুজিতের দল। শেষ আশ্রয় হোক নেত্রার আদরের সেই ডাক, "দাদা", যে বোঝে না, ছলনায় তাকে মুখোমুখি করেছে দুরাত্মারা, প্রিয় সহোদরার। সরল দাদা, জটিল বোন... Mission aborted, beep beep beep!

দ্বিতীয় কিস্তিতে, দালাল তুমি দালাল নও? পরিমার্জিত শ্রুতিমধুর করে, এজেন্ট? দালাল বললে ফোঁস করো সীমিতা-সুচন্দন সুবাসের ওপর? You are a bloody pimp, বেনুবল্লভ!

তৃতীয় কিস্তিতে, আমার সন্তানকে দেখাবে আমার ব্যাভিচারের দাগ? সন্তান কোলে অহল্যা তোমাকে বেঁধেছে তার নশ্বর ঝাঁঝালো মাদক দেহের বাঁকে, তোমার ঘৃণ্য পাপী কবল থেকে সন্তানকেই বাঁচাতে। আঁচলচাপা ক্রোড়স্থ সন্তানসাক্ষী। পুত্রকন্যা মাতৃদেহের কালশিটেফুলে বুলিয়েছে অমৃতপরশ, অহর্নিশ।

চতুর্থ কিস্তিতে, তুমি নিজের ফাঁপানো পৌরুষের যে ডঙ্কা বাজাতে, আসলে অহল্যা ভালোবেসে কখনো তোমার দুর্বল পৌরুষের ব্যঙ্গ করেনি! চিরকাল অহল্যার পৌরুষে ডুবে মিছেই ভেবেছো অসম ভাবে তুমি ভোগ করেছো। আত্মঘাতী হবে, যদি বলি ভোগ হয়েছো ভোগী, তোমার অপ্রেমে?

নেত্রা তোমাকে জানায়নি, পবিত্র গর্ভদান করেছিলো পবিত্র বীর্যবান। খেলতে খেলতে নিজের বুদ্ধির ওপর চরম আস্থায় ভুলে গেছিলে, অহল্যা ছিল পাশায় দক্ষ... নেত্রা তোমাকে মনে মনে বলেছিলো, তুমি কোনাকুনি এসো, আড়াই ঘরের চাল দেবো।

সাদায় কালোয় জিতের হার, বোড়ের চলন এই
বিনি সুতোর বাঁধন যার, মুছতে পারে সেই।



দ্য পাওয়ার বিহাইন্ড

ছেলেটার পিতৃপরিচয় নিয়ে খিল্লি করছো, করো। নিজের পিতৃপরিচয় কি, তা জানাতে পারবে তো, পৃথিবীকে? বলতে পারবে তো, তুমি তোমার মা'র স্বেচ্ছা অজাচারের ফসল? সেই অজাচারের দুই ভাগিদারের একজন, তোমার গর্ভধারিণী, আরেকজন তোমার মাতামহ। সামাজিক পিতার বীর্যে অন্ধকারের বীজমন্ত্র তুমি, কখনোই দেখতে না ইহলোক। এসো বেনুবল্লভ, একে একে সকল সংহার শেষে এখন তোমার মুখোমুখি অহল্যাপ্রভা। দশভূজার থেকে জাত গণপতিকে প্রশ্ন করো, তার পিতা কে? তুমি যাকে উচ্চস্বরে নিজের হেরে যাওয়া চাপা দিতে, "খানকির ছেলে" বলছো, তাকে জন্ম দিয়েছে ত্রিনেত্রা নিজের কষ্টকে তিলতিল আদর দিয়ে। প্রয়োজন হয়নি তার কোনো বীর্যবানের। অশালীন ভাষা বড়ো, আমি বলেছি বলে? তুমি এই ভাষায় চেঁচিয়ে উঠলে পৌরুষ!

তোমার শাস্তিকালে আমাকে শুষে জীবনধারণ করতে বলেছে যে নষ্টা, তাকে জানিও, অজ্ঞাতে নয়, জ্ঞাতে সয়েছি সব... যদি অন্তত এবার তোমায় বিনাশে হাত থেকে... পারিনি। তুমি, আর আমার আগুন। ব্যাস, এই ভবিতব্য। তোমার অজ্ঞাতে বরং যতোবার রক্তপায়ীকে আক্রমণ করতে বলেছো আমার পুত্রকন্যাদের, ততোবার আমার গরল পাঠিয়েছি তার সাথে। নিষ্ঠুর খেলা খেলেছি, বড়ো দুঃখে।

তুমি যা ভাবছো, আমিও ঠিক তাই ভাবছি, জানো? তুমি আমার কষ্টজাতককে বোঝাতে চাও, প্রয়োজনে আমি তাকে মেরে ফেলতে পারি। পারিই তো। ছলনায় যে পিশাচবিন্দু তুমি তার ভেতরে দিয়েছো, তাকে তিলতিল করে মেরে ফেলে সংহার করবো সেই পিশাচের। উল্লাস! তাকে তিলতিল করে মেরে ফেলবো যখন জানিয়েছি এক সমুদ্র কান্নায়, সে জড়িয়ে বলেছে, তোর ত্রিনয়নের মণি মরতেও রাজী। এবার, শত্রুজিৎ?

তবে চলো, আমার স্তনের অমৃতকলস আর তরবারির একত্র চলন দেখো। দেখো, a filicide stands before you now... তার আগে আরো একবার তারকেশ্বরের পথে পুণ্যার্থী হবে নাকি? আবার এসে পৌঁছবে না তোমার নরমাংসের কারবারির দল। এতো খেউড় করতে নেই জিৎ, কাকেই বা করছো? অহল্যাকে? তার জন্মদাতা বা জন্মদাত্রীকে?

দুধপুকুর কাঁধের বাঁক উপচে পড়ে জয়োল্লাস
দূরের পথে আটকে থাকে পচতে থাকা ঘৃণ্য লাশ!



মাদার ইজ অল আই নো

অহল্যাপ্রভার ছেলে বলছি। জিতমন্যু। আমি মা'র কষ্ট সন্তান। তোমাদের বোধের শেষ যেখানে, সেখানে আমার জন্ম। আমাকে মা'র থেকে কেড়ে নিতে পিশাচেরা ব্যবহার করেছিলো মার পবিত্র শরীর। মা'র তেজে তারা আজ মৃত। মা'র সতীত্ব নষ্ট করতে না পেরে, পিশাচ তার সর্বশেষ ছোবল দিলো। ছোবলের নাম পৃথ্বীরাজ। গ্রাস করলো সে, ত্রিনেত্রাপুত্রকে। নরপিশাচেরা পাপের ভারে ভরিয়ে দেয় তাকে আর জয়োল্লাস করে। মা'র যে তৃতীয় নয়ন, তার থেকে বেরিয়ে আসে প্রলয়ের রশ্মি।

এমন গ্রাস, পৃথ্বিরাজের মৃত্যু হলে, জিতমন্যুর জীবনসংশয়! তাহলে? তাহলেও চলুক মা'র বিনাশানলের তাণ্ডব। তোমরা দেখো, ওই আমার ক্রোধান্ধ মমতাময়ী মা। ওই দেখো, সাথে আমার সহোদরা, বিদ্যা। আগুনের ওপর নিক্ষিপ্ত আমি পুড়ছি, ছুটে বেরিয়ে আসছি ওদেরই টানে। আমি মৃতপ্রায় দেখছে ওরা। রুক্ষস্বরে মা'র আদেশ, পৃথ্বিরাজকে ত্যাগ না করলে, আমাকেই পুড়িয়ে দেবে আগুন। পরজীবি পিশাচনন্দন আমার সঙ্গে পুড়তে পারেনি, পালিয়ে গেছে চিরতরে। মার আগুনে আমি জখম, পিশাচবীজ বন্দী অতলে। মৃতবৎসার কান্না শোনো, সে তার পাপফসল। সম্পূর্ণ নষ্টপৌরুষ তার পাপাত্মা পিতার হাহাকার শোনো, হেরে গেছে আমার মা'র কাছে।

গন্ধরাজ গাছ ঝেঁপে ফুল ফুটেছে, মার আঁচলে গন্ধরাজ ফুল হয়ে আমি আর বোন। মার আঁচলের শক্ত গিঁট। মা হাসছে। আঁচলের শক্ত গিঁটে মার হাসি। তোমরা আমার মার বুক দেখেছো, সত্যি সুন্দর... তোমাদের লালসার স্থানে মা ধরে রেখেছে পুত্রকন্যার সঞ্জীবনী।

ময়লা শরীর পোড়ার দাগে মায়ার পরশ অহর্নিশ
জ্বলছে ধিকি রাজার টীকা, পাপের মরণ পুণ্যবিষ।



দ্য আনহোলি পায়ার

কাঠকুটো সুখা পাতার ওপর শায়িত তোমার জাত অজাত পুত্রের শব, কাঁদছো চরম হাহাকারে। শব নয়, সে শবের প্রতিকৃতি মাত্র। তোমার স্বহস্ত নির্মিত। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বিকারগ্রস্তা তোমার কলুষসঙ্গিনীরা,শোকাকুলা। হুতাশে অগ্নিসংযোগ করেছো চিতায়, আর ধিক্কারে খুনি নামে ভূষিত করেছো ত্রিনেত্রাকে। শতেক কুশব্দ বলে চলেছো চাঁড়ালরূপী অহল্যাপ্রভাকে, তুমি আর তোমরা।

দেহে বন্দী করেছি সন্তানদ্বয়, সন্তানদ্বয়ের মাঝে গেঁথেছি নিজেকে। সাদা থান পরিহিত পরাজিত বেনুবল্লভ উঠে এসো গঙ্গাবক্ষ থেকে, পুত্রহারা পিতা! শ্রাদ্ধাদি সুসম্পন্ন করো আগামীতে। তবু, মুক্তিহীন হবে তোমাদের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ। ফিরে ফিরে আসি, শুধু তোমার সংহারে, নষ্ট পুরুষ।

কে বলে আমায় খুনি? যে কালো মৃত, তার আঠালো রক্তে আসলে মাখামাখি তোমরা। সাদার মাঝে অন্ধকারের শুধু মরণ ভবিতব্য, অজ্ঞাত ছিলো কি? প্রতিহিংসায় মৃত্যু দিতে চাও আমায়, আগে বার করো গেঁথে থাকা ত্রিনেত্রাকে তার সন্তানের ভেতর থেকে। সন্তানকে ছুঁতে গেলে তোমাকে পেরিয়ে যেতে হবে নেত্রাকেই। তোমার বোধী কি বলে, শত্রুজিৎ? It's a deadlock!

ছিনিয়ে নিয়েছি তিলতিল হাসি, তোমার থেকে ধর্ষকামী,
আঁচলচাপা গন্ধরাজের বর্মে মোড়া আমার আমি।


দ্য সেন্ট্রিফিউজ

বিষাদ ছড়িয়ে পড়ছে না কিছুতেই, চাইছি একটু বিষণ্ণতা। আমি এখন দুসরা চেহারা কুড়োতে ব্যস্ত। পৃথিবীময় রূপটান। একেক সময় অহল্যাপ্রভার অস্তিত্বরক্ষার যুদ্ধ ভাবি, ভাবি বেনুবল্লভের পৌনঃপুনিক বিনাশ;মনে করি কেন যেন দাবানলেও চুপ গাছেরা তাকিয়ে থাকে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর দিকে। তবু বিষণ্ণতা অমিল!

গুনে গুনে ঠিক বত্রিশের আড়াল থেকে শব্দরা ছিটকে বেরিয়ে কখনো আশীর্বাদ বা শাপ; সমস্ত সত্যির পথে বেপথু চলন। তবু কেন উল্লাস? তোমার উদ্যত মিথ্যার জালে ত্রিনেত্রা বিপর্যস্ত, এগিয়ে আসে প্রচুর নখদাঁত... ছিঁড়ে ফেলে ষড়কারী জাল। তুমি পালিয়ে যাচ্ছো; যাচ্ছে তোমার সাথে তোমার রাক্ষুসে পেইন্টব্রাশ। গান গাইতে পারি, পারি কিছু অক্ষর সাজাতে। তবু তুমি হেরে গেলে চিত্রকর! ছবি আঁকা এতো সহজ,আগে বোঝেনি ত্রিনেত্রা। উল্লাস আর ক্রোধের রঙে মাখিয়ে নেয় আনন্দাশ্রু, সে এক অপার্থিব ফল। তুমি সত্রাসে চেয়ে দেখো, পুড়ে যাচ্ছে বাড়বানলে পৃথিবীর আদি অন্ত।

চারের ফের, মনে করিয়ে দিই এসো। বাইশতম প্রবঞ্চনার মাসে তুমি বুঝে নাও, সাদা আঁকড়ে থেকে কোনোদিন অন্ধকারের বশবর্তী থাকিনি। প্রেম বড়ো সরল, বড়ো স্পর্শকাতর। সপ্রেমে হত্যা করেছি অপ্রেমের নগর। যাদের যাদের সাথে সওদা করেছো আমার ব্যাভিচারী শীৎকারের, my foot rests on their Adam's apple!

কিনারা খোঁজো, পিতাপুত্রহীন অমেরুদণ্ডী। সহায় করো আরো আরো বুক ঘষটে চলা প্রাণীকে। প্রত্যেকের জন্য তৈরি রেখেছি অমৃতবাণ, মৃত্যু আসন্ন। বিষণ্ণতা ঠেলে ঠেলে এগিয়ে আসে সক্রোধ উল্লাস।


দ্য বুচার অ্যান্ড দ্য হোলি ট্রি

তুমি বরং একটু ঘুমিয়ে নাও, ততক্ষণ এদিকের শোরগোল শুনে নিই। ডালপালা শেকড় থেকে আলাদা হয়ে মাটিতে নেমে আসার কাহনে হইহই রবে ছুটে এসেছে কিছু না-মানুষ। আপ্রাণ ক্ষতসম্বল আমার প্রশাখা দেখাই তাদের। তারা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, রক্তঝোরায় কি ছিলো... কিছু স্বস্তিক অথবা চাঁদতারা? উত্তর দিতে পারিনি অ্যাল্পাইন ফরেস্ট, উত্তর দিতে পারিনি প্রাচীন সিবিলা। এসব ভাবতে ভাবতে দেখি রাস্তা জুড়ে মরুভূমি।

রোমান মিথক হতে রাজী আছি। আমায় প্রশ্ন কোরো না, কার উপাসক আমি। আমার স্বার্থে ঘা লেগেছে বলেই ছুটে আশ্রয় নিই মাজারমধ্যের গন্ধরাজে, আর ওরা সযত্নে আমায় নাম দেয় সাদা পরী। তখন আমি কি ইসলাম? আবার শুক্রবারের চাঁদ পেয়ে উঠে শনিমঙ্গলের কোলে মন্দিরের চাতালে মাথা কুটে বলি, হে দেবী, আমায় কোলেই রেখো। অপর হাতে উদ্যত খড়্গ নিয়ে সংহারে নামো দুরাত্মার... সে কাফের, অথচ সেজে আছে স্বজাতি; কার জুরিসডিকশনে পড়বে বেনুবল্লভের কুকর্ম? তোমার, না আল্লাহর?

সেই যে ক্রসের ছায়ায় দাঁড়িয়ে শিখেছিলাম, সর্বশ্রেষ্ঠ যিশু, তাকে নস্যাৎ করেছিলাম। শাদাব বানোর সাথে, নিলোফারের সাথে একাত্ম ত্রিনেত্রাকে এখনো দলবদ্ধ রক্ষার দায় নেয় মন্দির মসজিদ গির্জা। সমাজচ্যুত করবে তাকে? তার আগে বলো তো, আমার সবুজ লাল আঁচল পীরের সমাধিতে, আমার হলুদ লাল আঁচল কামাক্ষ্যায়, ঠিক কোনটা অপবিত্র নামধারী?

হাইওয়ে জুড়ে দুদল মানুষ, একদল জড়িয়ে রেখেছে গাছেদের... "যেতে নাহি দিব"; আরেকদল ধেয়ে যায় পরস্পরের প্রতি বীভৎসতায়, হাতে খাপ খোলা অস্ত্র। হাতে মারণাস্ত্র, শত্রুজিতের সংহার শেষে চারাসন্তানদ্বয় কোলে, গাছ জড়াতে যাবো... মেলে দেবো ধর্মহীন ছায়া। The shadow that pronounces your death.

আখের খোঁজো হলফনামায় খোদাই করা লুঠতরাজ
নীলের পানি গঙ্গাজলে বেহাল তোমার কলুষতাজ! 



মি, দ্য রিপার

অদ্ভুত ভাবে তুমি মিল খুঁজতে থাকো বারো আর একুশের মাঝে, ভাবতে থাকো এ শুধুই এক আর দুইয়ের খেলা? ওদিকে বদলে যায় বিচারকের আসন, এদিকে তুমি আলোচনায় বসো, তোমার তস্করবৃত্তি কোন কোন স্থান থেকে বিতাড়িত করেছে তোমায়।

জানালার কপাটে মুখ রাখি, গরাদে বেঁধে দিই দৃষ্টি। দৃষ্টিতে মেঘ এলেই তুমি সজোরে বন্ধ করতে থাকো প্রতিটা জানালা, পাছে তুঁতবর্ণ হয়ে যায় সব! সেদিন সারা রাত ধরে নিজেদের প্রতিটা স্নানপাত্র লুকিয়ে ফেললে; লুকোতে লুকোতে নিজেকেও লুকোলে ঘুমের তলায়, সমানে বলে চললে, "আমার রক্তে স্নান না করে এ থামবে না, লুকিয়ে পড়ি।" তাহলে চিনেছো আমায় শতকরা একশো ভাগ...

তুমি একপা বেরোও আমার আলপনা অহল্যাগণ্ডীর বাইরে, তাড়া করে আসে মারমুখী যানচালকের দল। তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শক্তির কাছে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার চাইবে না? চাও, প্রাণ ভরে চাও। এই তো সেদিন, লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে আবার আলটপকা উথলে উঠেছিলো হাজার চল্লিশ। ভাগ্যলক্ষ্মী, তুমি কার? তার, যে বুকে আগলায়, তার।

আমার বিশালাক্ষীর ভারে চাকা ঘুরিয়ে দিই। তুমি খোঁজো তাকে, যে আমার প্রতি ফোঁটা চোখের হিসেব রাখে। তোমার প্রতি পদক্ষেপে লাঙ্গলের ফলা ধরেছি। পৃথিবী আসছে আগ্রাসী।



ল্যান্ডমাইন ইন দ্য গ্রীন

রাতব্যাপী যজ্ঞ হোমাগ্নি সব দেখেছি, দেখেছি তোমাদের কি আকুল প্রচেষ্টা আমাকে তুষ্ট করার। চাও আমার তুষ্টির হাসি মেখে আমার সন্তান তোমাদের উদ্ধারে যাক। এখন হাসি না, বারুদ কাঁদি অবিশ্রান্ত।

ত্রিনেত্রাকে সস্তা গুঁড়োর দোহাই দাও, অহল্যাপ্রভার পুত্রকে নিজের পুত্র বলো... কোন সাহসে? আমার কষ্টবীজ কোলে রুখেছি তোমাদের শস্ত্র। বারবধূ আখ্যা দিয়েছো, বারবার ফিরে এসো মাটিভিক্ষায়, আমারই উঠোনে।

পলাশসারি ধরে হাঁটতে হাঁটতে বিষবৃক্ষের জ্বালা ধরেছি বছর চার। তুমি ভরে দিয়েছো গরল। এবার নিলিয়ে দিই, এসো বেনুবল্লভ। শুধু তুমি নয়, গোগ্রাসে গিলবো সব। বড়ো তেষ্টা পায় আজকাল, মেয়েমানুষের তেষ্টা পেতেও বারণ? Fresh black blood is my fav now, you know!

চোখ বাঁধা, চীৎকার করছে ছেলের পেইন্টিংটা সদ্য ভেঙ্গেছি... বলেছি, মৃত্যু দিলাম, সাথে মুক্তি না হবার শাপ। তবে আমি ভিখিরিকে খালি হাতে ফেরাই না। কষ্টবীজ পাঠিয়েছি... হাসি নয়, বারুদ মাখিয়ে।



পেন উইথ দ্য ব্রোকেন নিব

আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছি মোহনা, অসীম আমার বুকেও ফসফরাস থাকে জ্বলে ওঠার। জেলেডিঙি নিয়ে যারা যায়, সাবধানে তাদের ঝড় নিজে নিয়ে বসি। অনুমতি না নিয়েই বলে দিলে, তোমার বীজমন্ত্রের আয়ুবৃদ্ধি আমার দায়। বাধ্যতামূলক যেকোনো কিছু আমার নাপসন্দ, জন্মান্তরেও তা একই।

প্রতি শ্বাসে, ঠিক দুটি মোমের শিখার তালে নিজেকে জীবন দিচ্ছি। তোমার পিশাচ ঔরসের থালা ছিটকে গেছে... I laugh wildly at your heinous intentions, O Satan! 
পরাজিত করো আমায়।

সকালের রোদে যে ছেলেটার হাতে প্রসাদী ফল তুলে দিলো পুজারী, তার কপালের টীকায় মিশিয়ে দিয়েছি আমার তৃতীয় চোখ। খুঁজে বেড়ালে তাকে আপ্রাণ, যে তোমার ছায়ায় লেপটে... তার মাতৃঋণ শোধে।

বিচারপতি চুপ করে আছেন, তুমি দুশ্চিন্তায় ছটফট। ছুটে যাও দিশাহীন স্বপক্ষের রায়ের আশে। এসো অ-নাথ, সপ্রেমে স্বহস্তে তোমার গলায় দিই বিনাশমাল্য। সামান্য হাতে ধরেছি বিচারকলম।
0

মুক্তগদ্য - রেনেস

Posted in


মুক্তগদ্য


পালকবেলা
রেনেস



একটা পুচপুচ ঘেমো বেলা পেলুম। মলয় পবন সমীরণ ইত্যাদি ঝুড়িচাপা ছিল বটে, তবু তেমন জুৎ করে উঠতে পাল্লুম না। মাথার ওপর স্বার্থপর ফ্যান ফ্যাট ফ্যাট করে কয়েক পাক হাঁপিয়ে ছুটি নিলো। অতঃকিম? জানালাটা ডাক দিলো, "এসো বৎসে।" কি কাণ্ড, তুমি এক খান পালক লাগিয়ে পগার পার! জানলা কাঁচুমাচু মুখে পিঠ ফেরালো। অগত্যা টেকো বুড়োর ফেলে যাওয়া দূরবীনখানা বাগিয়ে বারান্দাগামী লোকাল হলুম। ওমা, চৌমাথার সিগন্যালে একি দেখি! চুনীমার্কা সিগন্যালে দাঁড়িয়ে হলুদপানা ট্যাক্সির ছাদে পরোটা মুখে কে ওটা! বলি, বোধ বুদ্ধিটা জন্মাবে কবে আর! এমন ঘেমো বেলায় বাতায়নে পালক লাগিয়ে ভেগে যাবার মতন বুদ্ধি যে কেবল তোমারই আছে, তা কী ভাবে আমি ভুলে গেলুম! কেলেমুখো, শিগগির চলে এসো। নয়তো কাঠবেড়ালির বিয়েতে কচিপেঁপেরঙা শাড়িটা দিয়েই দেবো। ওই দ্যাখো, সিগন্যালে পান্না জ্বলছে। এবার তো উড়ে যাও, প্লিজ।
0

মুক্তগদ্য - শালিনী ঘোষ

Posted in


মুক্তগদ্য


দেয়া আর ঈশ্বরের গল্প

শালিনী ঘোষ



(পর্ব ১)

- শেষ মাথার ভিটে
লাল মেঝে বারান্দা
সদর পেরুলে জুলুসের ঠাকুরদালান
বাতাস জুড়ে কেবল ঝিমধরা গন্ধ
সোহাগে সাজানো থাকে পালঙ
মেহগনি আসবাব
ফুলতোলা রেকাবিতে নিয়ম মেনে 
রোজের মিষ্টি 
গলিতে শাঁখারির হল্লা বাড়ে
শোওয়ার জো থাকেনা
কাজের মধ্যে
পানের ডিবেয় লক্ষ্মী বাঁধুন দেওয়া
আর
সময়ের বড়ি, আচার সাজিয়ে
হুসহাস কাক তাড়ানো

ঘর সাজিয়ে হাপিত্যেশে জন্ম ঘুরল যে!
পায়ে পড়ি, এসো...


- পায়ে হেঁটে শহর ঘুরেছ দেয়া? একের পর এক জীবন টপকে যাওয়ায় বড় নেশা। প্রত্যেক পথের মোড়ে আলাদা ঘ্রাণ। একেক দিন শুধু জিভ মেলে রাখি। দরজায় দরজায় আলাদা স্বাদ ঘোরে। চার পা অন্তর কোথাও লোনাভাব, কোথাও আশ্চর্য কর্পূরের আবেশ। এদিককার রঙও কেমন নতুন লাগে। সকালে ঘাটের দিকে পালোয়ানদের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। ধাপি জুড়ে পরপর বেছানো থাকে শাড়ি। দ্রৌপদীর কথা ভারী মনে পড়ে সেসময়। কোথাও না কোথাও চিতা জ্বলেই যায় নাগাড়ে। ক্রমশ রোদ বাড়লে অভ্যস্ত হয়ে যাই। অত কটু তখন আর লাগেনা। চলে যাওয়ার এ এক আজব মজা, নিয়মমেনে তোমার পঞ্চব্যঞ্জনে সাড়া দেওয়ার তাড়া থাকে না। পুরি তরকারি চলতে থাকে আর দেদার চা। সন্ধে নামলে আরতির ধূম ওঠে। আমি সরে সরে থাকি। ভাবি, চিৎকার করে সব ভণ্ডামি গুঁড়িয়ে দিই; ভাবি, এমন বিশ্বাসের জোর যদি আমার থাকত... ছোট্ট ছোট্ট টুপড়ি সাজিয়ে কিছু ফুল, প্রদীপ ভাসিয়ে দেয় অনেকে। অনেকদূর অবধি যায়। তারপর ডুব। হিসেব কষি মনেমনে কোনটা কদ্দুর। সে বেজায় মজার খেলা, শিখিয়ে দেবোখন। সময় মেপে শুয়ে পড়ি আজকাল। আড়াইটে নাগাদ একটা গাড়ি থামে কাছাকাছি কোথাও। কদিন লক্ষ্য করে দেখেছি। চাপা শব্দ ওঠে। কিন্তু ঘোর পেরিয়ে কোনোদিনই মালকিনকে দেখা হয়ে ওঠেনা। এসময় তুমি আরো বুকের কাছে ঘন হয়ে আসতে। ঘুমোলে খানিক দাঁত দেখা যায় তোমার। আসছে মাসে কী এক পরব আছে, বিশাল মেলা বসে। যদিও সে এখান থেকে দিব্য দূর।

সাবধানে থেকো দেয়া। ঠোঁটে টান ধরছে। এখন আচমকা ঠাণ্ডা লেগে যায়।



(পর্ব ২)

- আর কোনো ঘাটে শরীর বাঁধতে পারিনা সাঁই। মন ডোবে না। চারপাশ দিয়ে জীবনের জোয়ার বয়ে চলে। অথচ আমিও বহু চেষ্টা করে দেখেছি, বিশ্বাস করো। কত তাপের দুপুরে, অসহ্য রাতে আর আর সব বুকে মাথা গুঁজে দিতে, এক চুমুকে শুষে নিতে নোনা ঠোঁট। আর সব চুমু কেমন কান্না হয়ে যায়। দীর্ঘ সঙ্গমের মাঝেও তোমার চোখ জেগে ওঠে। অকারণ উছলে যায় শরীরী তরল আর শ্বাসের ওঠাপড়ায় তোমার হাসি। আমার আর পাপবোধ জাগেনা সাঁই। আমার সন্ন্যাসের তুমি এক পৃথিবী পুরুষ হয়ে আমার সর্বস্ব লুঠপাট...


তুমি জানো, তোমার দেয়ার পরজন্মে বড় লোভ। ফিরেফিরে আসব সাঁই, বারবার। তুমি আমায় সব রমণ পেরিয়ে মিলনের বীজ দেবে বলো...

- দেশ বলতে তুমি কী বোঝো দেয়া? মানুষ? রাস্তা? বাড়ি? চারপাশের গাছ, তোমার শহর কোলকাতা, ম্যানহোল, কাশী মিত্তির ঘাট? সন্ধ্যে নেমে এল প্রায়। যেদিকে তাকাই বালি আর বালি। কী এক পোকা, তাতে হেঁটে যায়। ফিরতি পথ আলপনা আঁকা থাকে। আমার কিচ্ছু কাজ থাকেনা এসব সময়। আঙুলে আনমনা দাগ কাটি। নকশায় তোমার মুখ ফুটে ওঠে। বিনবিনে দেশোয়ালি সুর ভেসে আসে। দূরে গোটা চার পাঁচেক বাড়ির ছায়া। সেই নিয়েই গ্রাম। পায়ে পায়ে উঠে যাই। নিকোনো দেওয়াল। তাতে খড়িমাটি দিয়ে কত সুর বোনা। কত ফিকে হয়ে আসা উৎসবের মাঙ্গলিক চিহ্ন। মাঝেমাঝে খাটিয়া থাকে। আমি খানিক শুই, খানিক হাওয়া গুনি। হাওয়াদের ভাষা থাকে দেয়া। ঝড়েদের আসা টের পাওয়া যায়। এই আমার দেশ দেয়া। এই জলের খোঁজ, এই শীর্ণ শরীরে ঝলমল পাগড়ি, এই উটের সারি, ধুলো পথ আর নিয়মিত নেমে আসা অন্ধকার আমার দেশ, দেয়া। আমাদের। দেয়া, জীবন!


(পর্ব ৩)

- কাল রাতে সে এক ভারি মজার স্বপ্ন দেখলুম, জানো। দুপুরবেলা। চান সেরে বেরিয়েছি। আর ঠিক তক্ষুনি দরজায় আওয়াজ। আমি বলি, এই অসময়ে আবার কে! দরজা খুলে দেখি, তুমি। তুমি! এলে, সটান এসে বসলে। আমিও জল নিয়ে তড়িঘড়ি। আহা! তেতেপুড়ে এসেছে মানুষটা! সব কেমন সহজ গো। যেন এই, "ওগো, একটু মোড়ের মাথা দিয়ে ঘুরে আসি" বলে খানিক আগেই জুতোজোড়া গলিয়ে হাঁটা দিয়েছিলে। আমিও এমনি বেয়াকুব, এই যে তোমার জন্য এত্ত এত্ত হুড়ুমদুড়ুম কান্নাকাটি ভুলেই সারা। যেন লক্ষ্মীপ্রতিমাটি। যেন এইমাত্তর সিঁথিতে সিঁদুর, মাথায় নোয়া ছুঁইয়ে, "ঠাকুর, মানুষটাকে দেখো গো, ভালো রেখো, যেন অসুখ বিসুখ না বাঁধায়, তুমি ওকে সব রাস্তা সাবধানে পার করিয়ে দিও" র মতোই স্বাভাবিক তুমি এসেছ। হ্যাঁ গো, এমন কেন হয়? তুমি এলে আর চাদ্দিক আলো আলো। জ্যোতি বেরুলো। আমিও শান্ত।স্থির। যেন কুঁজোর জলে আটকানো তিরতিরে নদী। 

তুমি বুঝি জীবনের চেয়েও বড়?

- অস্থির লাগছিল দেয়া। এতোলবেতোল রাস্তা দিয়ে হাঁটলাম অনেকক্ষণ। রাত বাড়ছে। ঝোড়ো হাওয়া। জেলেবস্তির দিকটায় একটা নৌকো পড়েছিল। আঁশটে গন্ধ। তাতেই চেপে বসলাম। বেলা পড়ে এলেই এসব দিক শুনশান হয়ে যায়। জলের দিকে তাকিয়ে থাকলে দু'একটা ট্রলারের আলো বিন্দু হয়ে চোখে ধরা পড়ে। আবার হুউউশ করে মিলিয়ে যায়। আসার পথে একটা বড় কাছিম মরে থাকতে দেখেছি। দমকা হাওয়ায় তার বাস ঝাপট দিচ্ছে। জলের রঙ ঘোর কালো। মাঝেমাঝে সামনে একটা ধূধূ মাঠ বলে ভ্রম হয়। চাঁদের আলো ঢেউয়ের মাথায় ঠিকরে পড়লে ফেনাগুলো চকচক করে ওঠে। ঢেউ গুনছি দেয়া। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ জড়িয়ে আসে। মনে হয়, এই সমুদ্রের সামনে, এই বিশালতার সামনে আমি কেউ না, কিচ্ছু না। জলের সাথে আরেকটা বিন্দুমাত্র হয়ে মিশে যাচ্ছি আমি। প্রত্যেকটা গর্জনে, আছড়ে পড়ায় আসলে আমি। আমি, আমার ধর্ম, আমার জ্ঞান, আমার নীতি, আদর্শ, বোধ - সব সব সব আসলে চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে। জীবনে প্রথমবার এই আমার গা ছমছম করে উঠছে, দেয়া। দেয়া, আমার নিজেকে বড় সামান্য, এক্কেবারে নগ্ন লাগছে।