0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in







অধ্যায় ১২

এই গাঁয়ে গয়াদীন বলে এক ভদ্রজনের নিবাস। ও যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগের হিসেবে ভারি দক্ষ, কারণ ওর পেশা হোল সুদখোরি।ওর একটা দোকান আছে, তাতে কাপড় কেনাবেচা হয় , আবার টাকাপয়সার লেনদেনের কারোবারও খুব চলে। ঘরে আছে যুবতী মেয়ে, ওর নাম বেলা। আর আছে এক বিধবা বোন। এক বৌ ছিল, যে মরে হেজে গেছে। বেলা মেয়েটি, দেখতে সুন্দর, স্বাস্থ্য ভাল, রামায়ণ আর মায়া-মনোহর কহানিয়া(নবকল্লোল ধরণের পত্রিকা)জাতীয় ম্যাগাজিন পড়ার মত লেখাপড়া জানে। ওর জন্যে এক সুন্দর সুযোগ্য পাত্র খোঁজা চলছে। বেলা দেহ-মন দুদিক দিয়েই প্রেম পড়ার যোগ্য।প্রতিবেশি পরিবারের রূপ্পনবাবু ওর প্রেমে পড়েছেন কিন্তু সেটা বেলার অজানা।

রূপ্পনবাবু রোজ রাত্তিরে ঘুমনোর আগে ওর দেহের ধ্যান করে থাকেন। আর ধ্যানটি শুদ্ধ রাখার জন্যে শুধু শরীর দেখেন, তাতে বস্ত্র দেখেন না। বেলার বিধবা পিসি গয়াদীনের ঘর-গেরস্থালি সামলায় আর বেলাকে চোখে চোখে রাখে; ঘরের বাইরে এক’পা নয়। বেলা বড়দের কথা শুনত, চৌকাঠ ডিঙোত না। যদি বাইরে যেতে ইচ্ছে করত, ও ছাদে উঠে পড়শিদের গায়ে গায়ে লাগা ছাদ টপকে যেকোন বাড়ির ভেতরে চলে যেত। রূপ্পনবাবু বেলার প্রেমে মুহ্যমান হয়ে প্রত্যেক সপ্তাহে তিন চারটে প্রেমপত্র লিখে ফেলতেন। তারপর সেগুলোকে ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেলে দিতেন।

এসব এখন কোন কাজের কথা নয়। আসল কথা হল গয়াদীন সুদে টাকা খাটায় এবং কাপড়ের দোকান চালায়। কো-অপারেটিভ ইউনিয়নও সুদে টাকা ধাড়িদেয় এবং কাপড়ের দোকান চালায়।দু’পক্ষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চলে আসছে।

বৈদ্যজীর সঙ্গে গয়াদীনের বেশ ভাল সম্পর্ক, উনি বৈদ্যজীর কলেজের ম্যানেজিং কমিটির উপ-সভাপতি।ওঁর পয়সা আছে, সমাজে মান-ইজ্জত আছে, আর এছাড়া ওঁর ওপরে বৈদ্যজী, পুলিস, রূপ্পন, স্থানীয় এম এল এ, জেলাবোর্ডের ট্যাক্স কলেক্টর—সবার বরদহস্ত রয়েছে।

এতসব থাকতেও উনি ঘোর নিরাশাবাদী।মেপে মেপে পা’ ফেলেন।নিজের শরীর ও স্বাস্থ্য নিয়ে বড্ড খুঁতখুঁতে। এমনকি কলাইয়ের ডাল থেকেও দূরে থাকেন। গয়াদীন একবার শহরে এক কুটুমবাড়ি গেছলেন। সেখানে খাবারে কলাইয়ের ডাল দেখে থালা ঠেলে দিয়ে খালি আচমন করে উঠে পড়লেন। সন্ধ্যে বেলা কুটূমমশায় অনেক চাপাচাপি করলেন—কলাইয়ের ডাল খেলে কী হয় বলতে হবে। তখন উনি খানিকক্ষণ এদিক ওদিক দেখে নিচু গলায় বললেন- কলাইয়ের ডাল খেলে ওনার পেটে বায়ু জমে এবং খুব রাগ হয়। কুটুম অবাক। রাগ হলে ত এত ভয় পাবার কী হয়েছে? রাগ কী কোন বাঘ ভালুক নাকি?

কুটুমমশায় একটা সরকারি অফিসে কাজ করতেন। তাঁকে গয়াদীন বললেন,’আপনি ঠিকই বলেছেন। তবেঁ রাগটাগ সবাইকে মানায় না, শুধু হাকিমদের মানায়। আজকের হুকুম কাল পালটে গেলেও হাকিম তো হাকিমই থাকবেন! কিন্তু আমরা হলাম ব্যবসায়ী মানুষ, আমাদের এত রাগ থাকলে কাল থেকে দোকানে খদ্দের আসা বন্ধ হয়ে যাবে।ফের কবে কি ঝঞ্ঝাট বেধে যায় কে বলতে পারে?

গয়াদীনের ঘরে চুরি হয়ে গেল আর চোর শুধু কিছু গয়ানাগাটি ও কাপড় হাতিয়ে কেটে পড়ল, ফলে পুলিশের সহজ সিদ্ধান্ত –সেদিন যারা রাত্তিরে চোর চোর করে দৌড়ুচ্ছিল তাদের মধ্যেই কেউ হাত সাফ করেছে। চোর যখন ছাদ থেকে লাফিয়ে আঙিনায় পড়ল তখন তার বোন অথবা মেয়ে কেউ টের পায়নি। টের পেলে তো চোরের মুখই দেখতে পেত।কিন্তু চোর যখন একটা লাঠির সাহায্যে পাঁচিলে চড়ে ছাদে উঠে গেল তখন ওরা ওকে দেখতে পেল, কিন্তু শুধু পেছন থেকে। এতে পুলিশের বড্ড রাগ। ওরা তিনদিন ধরে একগাদা দাগি চোরকে দাঁড় করিয়ে সামনে-পেছনে দুদিক থেকেই গয়াদীনের বোন ও মেয়ের সামনে পেশ করল। কিন্তু বেলা বা তার পিসি এমন কাউকে পেলনা যে গলায় বা পিঠের দিক থেকে ব্যাটাকে বরমালা পরিয়ে বলে উঠবে- ‘দারোগাজী, এই হোল আমাদের সে’রাতের চোরচুড়ামণি’।এতে পুলিশের রাগ বেড়ে গেল এবং দারোগা গুজুর গুজুর করতে লাগল যে গয়াদীনের বোন এবং মেয়ে ইচ্ছে করে চোরকে চিনিয়ে দিচ্ছে না! কে জানে কী ব্যাপারঅ

কিন্তু গাঁয়ে এতগুলো ঘর থাকতে চোরের নজর কেবল গয়াদীনের বাড়িতে? এতে ওনার নিরাশা আরও বেড়ে গেল। আর দারোগাজী সবাইকে দেঁতো হেসে বলছেন-চোরের নিচে নামার সময় গয়াদীনের বোন ও মেয়ে ওর মুখ চাইলেই দেখতে পেত, কিন্তু ওদের নজর শুধু পিঠের দিকে?

এসব চিমটিকাটা কথা বলতে দারোগা গয়াদীনের পরিবার ছাড়া আর কাউকে পেলনা?

গাঁয়ে কিছু মাস্টার থাকে, ওদের মধ্যে এক হোল খান্না মাস্টার-হদ্দ বোকা। আরেকজন হোল মালবীয়-সে ও বোকা। এদের ছাড়া বাকি তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, বষষ্ঠ ও সপ্তম মাস্টারের নাম গয়াদীনের জানা নেই, তব নিঃসন্দেহে ওরাও বোকার হদ্দ। এখন গয়াদীনের নিরাশা আরও বেড়ে যাচ্ছে কারণ সাতজন মাস্টার দলবেঁধে এদিকেই আসছে, মানে ওনার বাড়ির দিকে। এরা নির্ঘাৎ চুরির ঘটনা নিয়ে আহাহ-উহু করে তারপর কলেজের ব্যাপারে কোন ক্যাবলামার্কা কথা আরম্ভ করবে।

ঠিক তাই হোল। মাস্টারের দল আধা ঘন্টা ধরে গয়াদীনকে বোঝাতে চাইল যে ও হোল কলেজের ম্যানেজিং কমিটির উপাধ্যক্ষ। অধ্যক্ষ গত কয়েকবছর ধরে বোম্বাইবাসী হয়েছেন এবং তাঁর গাঁয়ে ফেরার সম্ভাবনা নেই বললেই হয়।তাই কলেজের ম্যানেজার ও প্রিন্সিপালের খামখেয়ালিপনা এবং অনাচার আটকানোর জন্যে উপাধ্যক্ষের কিছু করা উচিত।

গয়াদীন ওদের খুব ঠান্ডা মেজাজে সর্বোদয়ী সভ্যতার ঢঙে পালটা বোঝাতে থাকল যে উপাধ্যক্ষ পদ হোল কথার কথা, বাস্তবে এর কোন গুরুত্ব নেই, কোন ক্ষমতা নেই। আর মাস্টার মশাইরা! এই খেলা তোমরাই খেল, আমাকে এর মধ্যে টেনো না।

এবার সিভিক্সের মাস্টার ওনাকে বোঝাতে লাগলেন কি উপাধ্যক্ষের কত ক্ষমতা। ভেবেছিলেন গয়াদীন এসব কিছু জানেনা, তাই ভারতের সংবিধানে উপ বা উপাধ্যক্ষের অধিকার বোঝাতে শুরু করল। কিন্তু গয়াদীন জুতোর ডগা দিয়ে ধূলোয় একটি বৃত্ত আঁকতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এর মানে এ’নয় যে গয়াদীন ইদানীং জ্যামিতি পড়ছে, বরং বোঝাই যাচ্ছে যে ও নতুন কোন ফাঁদ পাতার কথা ভাবছে।

হঠাৎ ও মাস্টারকে থামিয়ে দিয়ে বলল,’বেশ, তাহলে মাস্টার সাহেব বল দিকি ভারতের উপাধ্যক্ষ এখন কে’?

এমন প্রশ্নের সামনে মাস্টারের দল যেন পালাতে পারলে বাঁচে। কেউ এদিকে তাকায় তো কেউ ওদিকে, কিন্তু ভারতের উপাধ্যক্ষের নাম আকাশের কোন কোণে দেখা গেল না। শেষে সিভিক্সের মাস্টার বলল,’প্রথমবার তো রাধাকৃষ্ণন ছিলেন, এখন কে মনে পড়ছে না।

গয়াদীন নিচু গলায় বলল, ‘মাস্টারমশায়েরা! উপাধ্যক্ষের কতটুকু পাওয়ার এবার বুঝলেন তো’?!’

কিন্তু মাস্টারেরা এত সহজে হার মানবে না। একজন জিদ করতে লাগল যে গয়াদীন অন্ততঃ একবার কলেজের ম্যানেজিং কমিটির মিটিং ডাকুন। গয়াদীন গাঁয়ের মহাজন বটে, কিন্তু সে’মহাজন ন’ন, যে উনি যেদিকে যাবেন সবাই ‘গতঃ সঃ পন্থা’ বলে পেছন পেছন চলতে শুরু করবে। উনি সেই জাতের মহাজন যারা অজানা পথে চলার সময় আগে ভাড়া করা লোক পাঠিয়ে অপেক্ষা করে যতক্ষণ না তার পায়ে পায়ে পাকদন্ডী তৈরি হয়, শক্তপোক্ত হয়, ভরসা হয় ধ্বসে যাবে না। তারপর মহাজন ছড়ি হাতে নিয়ে খোঁচা মেরে মেরে সাবধানে টুক টুক করে এগোতে থাকে।তাই মাস্টারদের জিদে কোন কাজ হলনা। উনি ধীরে ধীরে বললেন,’মীটিং ডাকার জন্যে রামাধীনকে লাগিয়ে দাও মাস্টার সাহেব। এসব কাজের জন্যে ওই ঠিক লোক’।

--‘ওকেই তো লাগিয়েছি’।

--‘ব্যস্‌ তাহলে আর চিন্তা কিসের! ওর পেছনে লেগে থাক, পিছলে যেতে দিওনা’, এসব বলে গয়াদীন আসাপাশে যারা বসে অপেক্ষা করছিল তাদের দিকে ফিরলেন। এরা সব কাছাকাছি গাঁ থেকে আসা পুরনো খাতক। এদের কেউ কেউ এসেছে টাকা ধারের ব্যাপারে নতুন হ্যান্ডনোট লেখাতে, কেউ পুরনো হ্যান্ডনোটের তারিখ বাড়িয়ে নিতে, আবার কেউ কেউ এসেছে যেন তেন প্রকারে হোক, হ্যান্ডনোটের মায়াজাল কেটে যাতে না বেরোতে হয় তার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু খান্না মাস্টার আজ ভেবেই এসেছে যে ওই ইস্যুতে গয়াদীনের সঙ্গে কথাটা পুরো করে তবে যাবে। তাই ও আবার বোঝাতে লাগল। বলল,’ মালবীয়জী, আপনিই গয়াদীনজীকে বোঝান। এই প্রিন্সিপাল তো আমাদের পিষে ফেলছে’।গয়াদীন লম্বা শ্বাস টানলেন। বুঝে গেছেন এই অকম্মার ঢেঁকি মাস্টারগুলো সহজে নড়বে না।আজ কপালে এই লেখা আছে। এবার আগের জায়গা থেকে নড়ে খাটিয়ায় একটু গা ছেড়ে দিয়ে আরাম করে বসলেন। এতক্ষণ অপেক্ষায় থাকা খাতকদের বললেন- যাও ভাই, তোমরা আজ যাও। কাল সকালে একটু তাড়াতাড়ি এসো’খন।

গয়াদীন এবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খান্না মাস্টারের দিকে ফিরলেন। খান্না মাস্টার বলল,’ আপনার অনুমতি পেলে গোড়া থেকে বলি’?

“নতুন কি আর শোনাবে মাস্টার সায়েব’, গয়াদীন এবার ক্লান্ত,’প্রাইবেট স্কুলে মাস্টারি করতে এয়েচ, -এখানে পিষে যাওয়াই নিয়তি। পালিয়ে যাবেটা কোথায়’?

খান্না উবাচ- ’সমস্যা হোল এই স্কুলের গভর্নিং বডির মিটিং গত পাঁচ বছরে একবারও হয়নি, তাই বৈদ্যজী ম্যানেজার হয়ে গেঁড়ে বসেছেন।নতুন করে সাধারণ সভার বৈঠক ও নির্বাচন হয়নি, যা প্রতিবছর হওয়ার কথা’।

উনি এবার রামলীলার রাম-লক্ষণ চরিত্রের মত ভাবলেশহীন চেহারা বানিয়ে চুপ করে বসে রইলেন।তারপর বললেন,’আপনারা তো লেখাপড়াজানা লোক।আমি আর কি বলব?কিন্তু গুচ্ছের সংস্থা চলছে যাদের বার্ষিক বৈঠক বছরের পর বছর হয়না।এখানকার জেলা বোর্ডকেই দেখুন! সেই কবে একবার হয়েছিল, তারপর বিনা নির্বাচন কত বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছে’। এবার উনি গাল ফুলিয়ে ধরা গলায় বললেন,’গোটা দেশেরও এই হাল’। ওঁর গলা ধরে গেছল দেশপ্রেমের আবেগে নয়, কফ জমে গিয়ে।

মালবীয় মুখ খুললেন,’ প্রিন্সিপাল হাজার হাজার টাকা ইচ্ছেমত খরচ করছে। প্রত্যেকবার অডিট আপত্তি করে, কিন্তু প্রত্যেক বছর এই চলতে থাকে’।

গয়াদীন নিরীহ মুখ করে বললেন,’আপনি কি অডিটের ইনচার্জ’?

মালবীয় আওয়াজ চড়িয়ে বলল,’জী না; কিন্তু সেটা কথা না।কথা হোল এভাবে চোখের সামনে জনগণের পয়সা নয়ছয় হবে এটা দেখে—‘।

গয়াদীন ওকে মাঝখানে থামিয়ে আগের মতই শান্ত ভাবে বললেন,’ তাহলে আপনি জনগণের পয়সা কীভাবে নয়ছ্য় হতে দেখতে চান? বড় বড় বিল্ডিং বানিয়ে? একের পর এক মিটিং ডেকে? পার্টি দিয়ে’? এই পরমজ্ঞানের সামনে মালবীয়জী হার মানলেন। গয়াদীন উদারছন্দে বোঝাতে লাগলেন,’মাস্টারসাহেব, আমি বেশি লেখাপড়া শিখিনি। কিন্তু সুদিনে কোলকাতা বোম্বাই খুব দেখেছি।তাই একটু আধটু আমিও বুঝি।জনগণের পয়সা নিয়ে এত সহানুভূতি ভালো কথা নয়। ও তো নয়ছয় হবেই’। খানিকক্ষণ সবাই চুপ। তারপর উনি খান্না মাস্টারকে কাছে ডেকে প্রশ্রয়ের সুরে বললেন- না হে মাস্টারমশাই!জনগণের পয়সা নিয়ে এত ভাবনাচিন্তা করে শরীর খারাপ কর’ না। নইলে কষ্টের সীমা থাকবে না’।

মালবীয়জীর মনে হোল গয়াদীনের চিন্তাধারার স্রোত অনেক গভীর অর্থবাহী। সত্যিই অনেক গহন। ওরা তো তীরে বসে বালুকাকণা গুণছে।বলল,’গয়াদীনজী, মানছি, এসবে আমাদের মাস্টারদের কোন সম্পক্কো নেই। বৈদ্যজী চাইলে কলেজ বন্ধ করে গমপেষাই কল লাগিয়ে নিন, অথবা প্রিন্সিপাল মেয়ের বিয়ে দিন, কিন্তু শেষ বিচারে এই সংস্থা তো আপনাদেরই!এ’নিয়ে এত ফালতু কথা! নৈতিকতার কোন নাম-গন্ধ নেই’।

এতক্ষণে প্রথমবার গয়াদীনকে একটু বিচলিত মনে হল।কিন্তু যখন মুখ খুললেন তখন গলার আওয়াজ ফের আগের মত ধরা ধরা। “নৈতিকতার নাম নাই নিলে মাস্টার! কেউ শুনতে পেলে থানায় কেস খাইয়ে দেব”।

ফের সবাই চুপ। হঠাৎ গয়াদীন নড়ে চড়ে বসলেন। ওঁর দৃষ্টি ঘরের কোণায় একটা ভাঙাচোরা চৌকির দিকে। ওটার দিকে আঙুল তুলে বললেন,’ধরে নাও নৈতিকতা ঠিক ওই চৌকিটার মতন। সভাসমিতির সময় ওর উপরে একটা চাদর বিছিয়ে দিলে সব ঢাকা পড়ে যায়।ওটার উপরে চড়ে বড়বড় লেকচার চেঁচামিচি সব হয়। ওটা আছেই ওইসব কাজের জন্যে’।

এমন লাগসই উদাহরণের পর মাস্টারের দল একেবারে চুপ।তখন গয়াদীনই ওদের উৎসাহ দিয়ে বললেন,” এবার বল মাস্টার সাহেব, তোমার কিসের কষ্ট?এতক্ষণ তো খালি জনতার কষ্টের কথা শুনলাম’।

খান্না মাস্টার উত্তেজিত। ‘আপনাকে দুঃখকষ্টের কথা শোনানোর কোন মানেই হয়না। আপনি তো কোন অসুবিধেকেই আমল দিতে চান না’।

‘কেন আমল দেবনা?গয়াদীন ফের ওকে উৎসাহ দিলেন, ‘নিশ্চয় দেব। তুমি বলেই দেখ’।

মালবীয়জী,’ প্রিন্সিপাল আমাদের হাত থেকে সব দায়িত্ব কেড়ে নিয়েছে। খান্নাকে হোস্টেল ইনচার্জ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। আমার থেকে গেমস এর চার্জ নিয়ে নিয়েছে।রায়সাহেব বহুদিন ধরে পরীক্ষার সুপারিন্টেন্ডেন্ট, ওকেও সরিয়ে দিয়েছে। সব কাজ খালি নিজের লোক দিয়ে করাতে চায়’।

গয়াদীন কি একটু দ্বিধায়? তারপর বললেন,’আমি যদি কিছু বলি তো আপনারা খুশি হবেন না। দেখুন, প্রিন্সিপালের নিজের পছন্দ মত ইনচার্জ বেছে নেওয়ার অধিকার যখন রয়েছে তখন এতে রাগ করার কী হয়েছে’?

মাস্টাররা চিড়বিড়িয়ে উঠছেন দেখে আরও জুড়ে দিলেন,’দুনিয়ায় সব কিছু তোমার বুদ্ধিতে চলে নাকি মাস্টার? গতবছরের কথা মনে কর। ওই বেজেগাঁওয়ের লালসাহেবকে লাটসাহেব ভাইস চ্যান্সেলর বানিয়ে দিলেন কি দেননি? লোকজন এত লাফালাফি করল, কিন্তু হলটা কী? যথারীতি কদিন পরে চুপ মেরে গেল। তুমিও চুপ মেরে যাও মাস্টার। চেঁচিয়ে কোন লাভ নেই, লোক তোমাকেই লোচ্চা বলবে’। পেছন থেকে একজন মাস্টার এগিয়ে এল।‘কিন্তু এটার কী করবেন? প্রিন্সিপাল ছাত্রদের আমাদের বিরুদ্ধে ভড়কাতে থাকে। আমাদের মা-বোন তুলে গাল দেয়। আমাদের নামে ফলস কমপ্লেইন করায়।আমরা কিছু লিখে দিলে সেই কাগজটা গায়েব করে দেয়।তারপর জবাবতলব করতে থাকে’।

গয়াদীন নড়ে বসলেন। খাটিয়া চরমরিয়ে উঠল। উনি একটু গুটিয়ে গেলেন। তারপর একটু ভেবে বললেন,’এসব তো তুমি আমাকে অফিসের কায়দাকানুন শেখাচ্ছ। কোন নতুন কথা নয়। দফতরে তো এরকমই হয়’।

মাস্টার গরম হয়ে বলল,’ পাঁচ-দশটা লাশ পড়ে গেলে মানবেন কি নতুন কিছু হোল’?

গয়াদীন ওর ক্রোধের প্রকাশকে করুণার দৃষ্টিতে দেখছিলেন; বুঝে গেলেন যে আজ মাস্টার কলাইয়ে ডাল খেয়ে এসেছে।তারপর আগের মত শান্তভাবে বললেন, ’এটাই বা কোন নতুন কথা?চারদিকে ধড়াধড় লাশ তো পড়ছেই’।

খান্না মাস্টার তাড়াতাড়ি সামাল দেবার চেষ্টা করলেন।“ওর মেজাজ দেখে রাগ করবেন না যেন। আমরা সত্যি বড় কষ্টে আছি।বড্ড ঝামেলা।দেখুন না, এই জুলাই মাসে নিজের তিন আত্মীয়কে মাস্টার করে ঢুকিয়েছে।ওদেরই আমাদের সবার সিনিয়র বানিয়ে কাজ আদায় করছে। বলুন, আমাদের খারাপ লাগে না”?

“খারাপ লাগার কী হল ভাই”? গয়াদীন কোঁৎ পেড়ে বলতে শুরু করলেন,’ তুমিই তো একটু আগে বলছিলে—আজকাল সবাই নিজের লোক ঢোকাচ্ছে। হয়ত বৈদ্যজীর আত্মীয় পায়নি, তাই বেচারা নিজের লোক এনে ঢুকিয়েছে”!

দু-একজন মাস্টার মশাই হাসতে শুরু করায় গয়াদীন বললেন,’ হাসির কথা নয়। এটাই আজ যুগধর্ম। যা সবাই করে, প্রিন্সিপালও তাই করছে। বেচারার এত আত্মীয়স্বজন, তাদের একটা হিল্লে করতে হবে না”?

তারপর উনি সোজা খান্না মাস্টারকে বললেন,”তুমি তো ইতিহাস পড়াও। বলতো, সিংহগড় জয় কেমন করে হয়েছিল’?

খান্না মাস্টার উত্তর খুঁজছিলেন। গয়াদীন বললেন,”আমি বলছি।তানাজী কী নিয়ে গেছল? একটা গোধিকা বা গোসাপ। ওটাকে দড়িতে বেঁধে পাঁচিল টপকে ভেতরে ফেলে দিল। আর গোসাপ যা করে, একজায়গায় গেঁড়ে বসে। বাকি সৈন্যরা সেই দড়ি ধরে পাঁচিল বেয়ে সোজা ছাদে পৌঁছে গেল”।

এত লম্বা কথা বলে উনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। ভাবলেন, মাস্টাররা বোধহয় কথাটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু ওদের চেহারায় নির্বিকার ভাব দেখে ফের বোঝাতে লাগলেন,’ আমাদের দেশেরও একই হাল, মাস্টারসায়েব।যে যেখানে ঠাঁই পেয়েছে একেবারে গোসাপের মত গেঁড়ে বসেছে।একেবারে নট নড়ন চড়ন, নট কিস্যু! ওকে যত ইচ্ছে খোঁচাও, যত চাও দুর দুর কর, ও নিজের জায়গা আঁকড়ে বসে থাকবে আর যত আত্মীয় কুটুম রয়েছে সব ওর লেজ ধরে সড়সড়িয়ে উপরে পৌঁছে যাবে। কলেজের খামোকা কুচ্ছো গাইছ, সব জায়গায় ওই একই হাল”।

ফের এক লম্বা শ্বাস টেনে বললেন,’ আচ্ছা, বল দেখি মাস্টারসায়েব, এই অবস্থা কোথায় নেই’?

মাস্টারের দল চামারটোলার পাশ দিয়ে ফিরছিল।সবার মুখচোখ এমন লটকে রয়েছে যেন টপ করে পায়ের কাছে খসে পড়বে।

চামারটোলা গাঁয়ের একটা মহল্লার নাম যেখানে চামারেরা থাকে।চামার একটি জাতি যাকে অচ্ছুত ধরা হয়। অচ্ছুত এক দু’পেয়ে জীবের নাম যাদের মানুষ সংবিধান তৈরির আগে ছুঁতে চাইত না।সংবিধান হোল একটি কবিতা যার অনুচ্ছেদ ১৭তে ছোঁয়াছুঁয়ি খতম করে দেয়া হয়েছে। যেহেতু দেশের লোক কবিতার সাহায্যে বাঁচে না, বরং ধর্মকে আঁকড়ে বাঁচে এবং যেহেতু ছোঁয়াছুঁয়ি এ’দেশের একটি ধর্ম, তাই শিবপালগঞ্জেও অন্যসব গাঁয়ের মত অচ্ছুতদের থাকার জন্যে আলাদা আলাদা মহল্লা রয়েছে এবং ওদের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা মহল্লা হল চামারটোলা। চামারদের জন্যে আলাদা মহল্লা গড়ে তুলতে একসময় জমিদারেরা খুব উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। এর কারণ আদৌ গ্রামীণ এলাকায় চর্মশিল্পের উন্নতি করা নয়, আসল ব্যাপার হল ওই আশ্রয়ের খোঁজে আসা চামারের দল লাঠি চালাতে ওস্তাদ।

ভারতের সংবিধান শুরু হবার পর চামারটোলা আর শিবপালগঞ্জের মাঝে একটা ভাল কাজ হোল, অর্থাৎ ওখানে একটা চবুতরা বা জনগণের বসে গুলতানি করার জায়গা পাকা করে বাঁধিয়ে দেয়া হোল। লোকমুখে এর নাম পড়ে গেল ‘গান্ধী-চবুতরা’। আপনাদের কারও কারও মনে পড়বে যে গান্ধী নামক ভদ্রলোকটি এইদেশেই জন্মেছিলেন এবং মৃত্যুর পর তাঁর অস্থিকলস এলাহাবাদের কাছে প্রয়াগে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তার সঙ্গে ভাসিয়ে দেয়া হয় তাঁর নীতি ও সিদ্ধান্তের বোঝা। এরপর ঠিক হয়যে এখন থেকে ওঁর স্মৃতিতে শুধু বড় করে গান্ধীভবন বানানো হবে, ব্যস্‌। আর ওই প্রোজেক্টে শিবপালগঞ্জের কপালে জোটে শান-বাঁধানো গান্ধী-চবুতরা। এই জায়গাটা শীতের দিনে রোদ পোহানোর জন্যে চমৎকার। বেশির ভাগ সময় এখানে কুকুরের দল রোদ পোহায়। আর যেহেতু ওদের জন্য কেউ সরকারি প্রস্রাবাগার বানিয়ে দেয়নি তাই এরা দরকার পড়লে থামে গায়ে সু-সু করে দেয়। দেখাদেখি কিছু লোকও চবুতরার আড়ালে গিয়ে ওই কম্মটি সারে।

মাস্টারের দল দেখতে পেল যে আজ চবুতরাতে লঙ্গড় আগুন জ্বালিয়ে বসে কিছু একটা সেঁকছে। কাছে গেলে বোঝা গেল যে সেঁকা হচ্ছে কিছু গোল গোল রুটিজাতীয় জিনিস— নিশ্চয়ই চারপাশে ঘুরে বেড়ানো কুকুরগুলোকে খাওয়ানোর জন্যে নয়। লঙ্গড় কে দেখেই মাস্টারদের বুকের ভার হালকা হয়ে গেল। ওরা দু’মিনিট ওর সঙ্গে কথাবলে জেনে নিল -এতদিন তহসীল অফিসে যে দস্তাবেজের নকল পাওয়ার জন্যে লঙ্গড় চেষ্টা করেছে সেটা এবার ও এক পয়সা ঘুস না দিয়ে , নিয়মমাফিক, পেয়ে যাচ্ছে।

মাস্টারদের বিশ্বাস হলনা।

লঙ্গড়ের কথাবার্তায় আজ কোন নিরাশাবাদ+ নিয়তিবাদ= পরাজয়বাদ/হীনমন্যতাবাদ বা এসবের ছায়া নেই। ও বোঝাতে থাকে—‘মেনে নাও বাপু। আজকে আমি সব ঠিক করিয়ে এসেছি। আমার দরখাস্তে ফের দুটো ভুল বেরিয়েছিল, শুধরে দিয়ে এসেছি’।

একজন মাস্টার বলে উঠল-এর আগেও তো তোমার দরখাস্তে ভুল বেরিয়েছে। ব্যাটা নকলনবীস প্রত্যেকবার নতুন নতুন ভুল বের করছে কেন? চোট্টা কোথাকার!’

“ গালি দিচ্ছ কেন, বাপু?” লঙ্গড় বলে ওঠে,’ দেখ, এসব হোল ধর্মযুদ্ধ, এখানে গালি-গালাজ চলবে না। বেচারা নকলনবীস! কলমবাজদের জাতটাই যে এমনই’।

“তাহলে ওই নকল কবে নাগাদ হাতে পাচ্ছ?’

“ ধরে নাও পেয়েই গেছি, আর দশ-পনেরো দিন, ব্যস্‌। মূল কাগজ জেলা সদরে গেছে, এখন আমার দরখাস্তও সদরে যাবে। ওখানে নকল তৈরি হবে। ফের এখানে ফেরত আসবে, ফের রেজিস্টারে চড়বে, ফের---‘।

লঙ্গড় নকল পাওয়ার যোজনা শোনাতে শোনাতে খেয়াল করেনি যে মাস্টারের দল ওর বেত্তান্ত এবং গান্ধী-চবুতরার চারপাশে ব্যাপ্ত দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে কখন এখান থেকে এগিয়ে গেছে। ও কথা শেষ করে মুখ তুলে তাকাল, দেখতে পেল ওর চারপাশে শুধু চির-পরিচিত কুকুরের দল, শুয়োরের পাল আর ছড়িয়ে থাকা নোংরা, যাদের সাহচর্যে ও সরকারি অফিসের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে।

গোধূলি লগন। একটা বাছুর শিঙ উঁচিয়ে চারটে কচি পায়ে এলোমেলো লাফালাফি করতে করতে চবুতরার পাশ দিয়ে ছূটে বেরিয়ে গেল। কিছুদূর দৌড়ে সবুজ গমের ক্ষেতের পাশে পৌঁছে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেল।লঙ্গড় হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলল,” ধন্য হো, দারোগাজী”!

0 comments: