0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















৪০

ফাইনহালস নিজের মনে হাসতে শুরু করল। সে ফ্রয়লাইন মের্ৎজবাখকে খুব ভালো করেই চেনে। মেয়েটা তার থেকেও বেশ কয়েক বছরের ছোট। সে যখন বাড়ি ছেড়েছিল, তখন মেয়েটা চোদ্দ বছরের রোগাটে গড়নের এক ছটফটে কিশোরী ছিল, যে অনেকক্ষণ ধরে খুব অপটু হাতে পিয়ানো বাজাতো। তার মনে আছে গ্রীষ্মে রবিবারের বিকেলগুলো; তাদের পাশের বাড়িতে ফ্যাক্টরির মালিকের একতলার বৈঠকখানায় বসে মেয়েটা পিয়ানো বাজাত। সে নিজেদের বাড়ির বাগানে বসে পড়াশুনা করত। মেয়েটার রোগাটে, পাংশু মুখটা মনে আছে তার। বাজানোর ফাঁকে ফাঁকে বিষণ্ণ চেহারায় এসে জানালায় দাঁড়িয়ে বাগানের দিকে চেয়ে থাকত। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে আবার ফিরে যেত পিয়ানো বাজানোর রেওয়াজ করতে। সেই মেয়ে নিশ্চয়ই এখন সাতাশ বছরের তরুণী। ফ্রয়লাইন মের্ৎজবাখের একজন প্রেমিক আছে জেনে ফাইনহালসের বেশ ভালো লাগল।

সে ভাবতে লাগল যে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বাড়িতে পৌঁছে যাবে। দুপুরের খাওয়ার সময় একতলা থেকে সে আগামীকাল দেখতে পাবে পাশের বাড়িতে ফ্রয়লাইন মের্ৎজবাখের আমেরিকান প্রেমিককে। যদি সম্ভব হয় একবার কথা বলে নেবে তার সঙ্গে; তার কাগজপত্র একটু দেখিয়ে নেবে মানুষটিকে। ফ্রয়লাইন মের্ৎজবাখের প্রেমিক নিশ্চয়ই কোনো সাধারণ সৈনিক নয়, অতি অবশ্যই মানুষটি একজন অফিসার হবেন তিনি।

শহরের ছোট এপার্টমেন্টটার কথাও মনে পড়ল ফাইনহালসের। তবে সে জানে যে ওই বাড়িটা এখন আর নেই। শহরের বন্ধুরা তাকে লিখেছিল যে ওই বাড়িটা বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। যদিও সে নিজের চোখেই বহু বাড়ি ধ্বংস হয়ে যেতে দেখেছে, কিন্তু ওই বাড়িটা, যেখানে সে থাকত, সেটা ধ্বংস হয়ে যাবার কথা সে ভাবতেও পারেনা। মাঝে ছুটি পেলেও সে আর ওই দিকে যায়নি। কারণ সে সহ্য করতে পারবে না, যদি সে সেখানে গিয়ে দেখে যে কিচ্ছু নেই। শেষ বার যখন সে ওই পাড়ায় গিয়েছিল ১৯৪৩ সালে, বাড়িটা তখনও দাঁড়িয়েছিল। ভাঙা জানালা কার্ডবোর্ড দিয়ে ঢাকা, সেই দৃশ্য সে দেখেছিল। দু তিনটে বাড়ি পরে একটা নাইটক্লাবে গিয়ে প্রায় ঘণ্টা তিনেক বসেছিল সে। ওয়েটারের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেছিল সে। ওয়েটার অল্পবয়েসি ছেলেটাও ভারি সপ্রতিভ, ব্যবহার ভারি ভালো ছিল। চল্লিশ ফেনিসে সিগারেট আর পঁয়ষট্টি মার্কে ফরাসি কনিয়াক পেয়েছিল সে সেখানে। খুব সস্তা অন্যান্য জায়গার তুলনায়। ওয়েটার ছেলেটি নিজের নাম বলেছিল, যদিও নামটা এখন আর ফাইনহালসের মনে নেই। ওয়েটার ছেলেটি এক মহিলার কথা বলেছিল তাকে। যথার্থ জার্মান আদবকায়দাসম্পন্ন এবং সমীহ জাগানো সেই মহিলার নাম ছিল গ্রেটে। সবাই ওই মহিলাকে ‘মুত্তার’ (মা) বলে ডাকছিল। ওয়েটার বলেছিল যে কনিয়াক খেতে খেতে ওই মহিলার সঙ্গে আলাপ করতে ভালো লাগবে তার। ফাইনহালস তিন ঘণ্টা ধরে গ্রেটের সঙ্গে আলাপ করেছিল। গ্রেটেকে তার খুব সোজাসাপটা, খোলা মনের মানুষ বলে মনে হয়েছিল। ফাইনহালসকে তিনি তার বাবা মায়ের বাড়ি যেখানে, সেই শ্লেসভিগ-হোলস্‌টাইনের গল্প বলছিলেন। যুদ্ধের ব্যাপারে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তাকে। সত্যিই সেই নাইটক্লাবে গিয়ে তার খুব ভালো লেগেছিল। যদিও রাতের দিকে মাতাল সৈনিক এবং অফিসারেরা হঠাৎ কুচকাওয়াজ অভ্যাস করবার চেষ্টা করছিল সেখানে।


ফাইনহালসের এটা ভেবেই খুব ভালো লাগছিল যে সে বাড়ি ফিরছে। এখন দীর্ঘদিন সে বাড়িতে থাকতে পারবে। বাড়িতে ফিরে কি কাজ করবে সে? নাহ, কোনো কাজ করবে না। আগে চারপাশের পরিস্থিতি ভালো করে বুঝে নেবে। যুদ্ধের পরে কাজ পাওয়া যাবে না, এমন নয়। অনেক কাজ পাওয়া যাবে। কিন্তু এখনই কোন কাজ করবার পরিকল্পনা নেই তার। ইচ্ছেও নেই। এখন সে কিচ্ছুটি করতে চায় না। অবশ্য হ্যাঁ, চাষবাসের কাজে একটু আধটু হাত লাগাতে পারে সে। ছুটিতে দেশগাঁয়ে বেড়াতে আসা অতিথির মত মাঝে মধ্যে বেলচাকাঁটা হাতে নিতে রাজি আছে সে; তাই বলে রোজ রোজ গা ঘামাতে পারবে না।

পরে হয়তো সে ধীরে সুস্থে কাজকর্ম শুরু করবে। আশেপাশের এলাকাতেই অর্ডার পেলে ভালো। নতুন বিল্ডিং বানাবে সে। তাড়াতাড়ি একঝলক জরিপ করে নেয় সে হাইডেসহাইমের পরিস্থিতি। অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে যুদ্ধে। স্টেশন বরাবর বিল্ডিঙের সারিটা উধাও। স্টেশনটাই এখন নেই। একটা ভাঙাচোরা মালগাড়ি পড়ে আছে স্টেশনের কাছাকাছি জায়গার লাইনে। গাড়িটাতে বোমা পড়েছিল; একটা কামরা থেকে কাঠ নামানো হচ্ছিল পাশে আরেকটা আমেরিকান ট্রাকে। কাঠগুলো চকচক করছে। কফিনের দোকানের বাগানে যে ছুতোর বসে কাজ করছিল, সেই বাগানের ছুতোরের কাঠের মতই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এই মালগাড়ি থেকে নামিয়ে রাখা কাঠগুলো। কাঠগুলো বসন্তের গাছে গাছে ফুটে থাকা ফুলের থেকেও বেশি চকচক করছে, উজ্জ্বল সোনালি আভা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

ফাইনহালস চিন্তা করতে শুরু করে যে কোন পথে গেলে ভালো হয়। ফিঙ্ক তাকে ভালো ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে রেললাইনের কাছের পথে আমেরিকান প্রহরীরা মোতায়েন আছে। যারা মাঠেঘাটে কাজ করছে, চাষাভুষো মানুষ… তাদের প্রহরীরা কিছু বলে না। কিন্তু একা পেয়ে তাকে যদি ধরে? সবচেয়ে ভালো হয় যদি নদীর বাদাবনের পাশের রাস্তাটা দিয়ে যাওয়া যায়। কিছুটা হামাগুড়ি দিয়ে, কিছুটা কাদাজল ঘেঁটে যেতে হবে। একটু ঘুরে নদীর মুখে কের্পেলের উঁচু ঘাসবনের মধ্য দিয়ে গেলেই লাগোয়া ভাইডেসহাইমের বাগান। বাগানে একবার ঢুকে গেলে আর সমস্যা নেই। প্রতিটি পদক্ষেপ তার চেনা পথ।

হাতে একটা কাস্তে কিম্বা কাঁধে একটা বেলচা থাকলে কি সুবিধে হত? বুড়ো ফিঙ্ক তো বলছিল যে ভাইডেসহাইম থেকে প্রচুর লোকজন কাজ করতে আসে। আঙুরের ক্ষেতে কিম্বা ফলের বাগানে কাজ করতে আসে চাষাভুষো মানুষেরা।

ঘরে ফিরে সে শুধু শান্তি চায়। বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করতে চায় সে দীর্ঘক্ষণ ধরে। কেউ তাকে বিরক্ত করবে না। সে শুয়ে শুয়ে ইলোনার ধ্যান করবে, তার কথা ভাববে। হয়তো ইলোনা স্বপ্নে আসতে পারে এবার। শান্তিতে বিশ্রাম করবে সে ঘরে শুয়ে বসে।



(চলবে)

0 comments: