undefined
undefined
undefined
গল্প - নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী
Posted in গল্প
গল্প
ওপেন ব্যাপার
নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী
(এক)
বছরের শেষ দিনটায় গোপেনবাবু ব্রেকফাস্ট খেতে বসে প্লেটের দিকে দেখলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ডাইনিং টেবিলে তাঁর পাশেই বসে তার ছেলে মেয়ে প্রাতরাশ করছে। তাদের প্লেটে লুচি আলুভাজা। নিজের প্লেটেরদিকে আঙুল দেখিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন - এটা আমায় কী দেওয়া হয়েছে?
কথাটা বলা হলো তাঁর স্ত্রীকে। বলার সময়ে তিনি চেষ্টা করলেন গলায় যেন বেশ অ্যাংরি ইয়ংম্যান ভাব থাকে। কিন্তু অ্যাংরি ইয়ংম্যান নিজেই এখন সাদা ফেঞ্চকাট রেখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গোপেনগিন্নির উপর সেই ভয়েসের কোনও প্রভাব পড়ল না। তিনিও গম্ভীর গলায় বললেন - যা দিয়েছি তাই খাও।
- সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি। এটা দিয়েছটা কী?
- শসা, দই আর একটা টোস্ট ব্রেড।
- ব্রেডে কী লাগানো আছে?
- মার্জারিন।
- মার্জারিন কেন? বলেছি না, আমায় পুরু করে মাখন দেবে টোস্টে? এই ভ্যাতকা মার্জারিন আমার ভালো লাগে না। একটা মাত্র টোস্ট। তাতে একটু মাখন লাগাতে কী হয়?
গোপেনগিন্নি তাঁকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললেন - যা দিয়েছি তাই চুপচাপ খাও। বাড়িতেই তো এইসব দেওয়া হয়। বাইরে বেরোলে তো যা ইচ্ছে তাই চলে। আমি কী সেসব বুঝিনা?
- এই ব্রেকফাস্ট আমি মরে গেলেও খাব না।
- খেয়ো না। বিনা চিনির চা দিচ্ছি। থিন বিস্কুট দিয়ে খেয়ে নাও।
গোপেনবাবু হতভম্ব গলায় বললেন - তোমরা আমার সামনে বসে লুচি তরকারি খাবে আর আমি চা বিস্কুট দিয়ে ব্রেকফাস্ট করব?
তাঁর ইচ্ছে হলো সমস্ত টেবিলের খাবার টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দেন। প্লেট টেট ভেঙে ফেলেন। বেশ সিনেমায় নায়করা রেগে গেলে যেমন করে, সেরকমই একটা কিছু করেন। কিচ্ছু করা হলো না। তাঁর স্ত্রী নিজের কাটলারির ব্যাপারে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তাছাড়া কলেজে পড়া ছেলে মেয়ে রয়েছে। তারাও তাদের মায়ের দলে। একা একা তিনি তিন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এঁটে উঠতে পারবেন না। তিনি প্লেটটা জোরে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ধাক্কাটা এমনভাবে দিলেন, যাতে তার প্লেটটা ছেলের লুচি ভর্তি প্লেটে গিয়ে লাগে আর টং করে একটা আওয়াজ হয়। এসব ধাক্কা অনেক হিসেব করে দিতে হয়। ছেলে তাঁর দিকে বেজার মুখে তাকাল। গোপেনবাবু খুব খুশি হলেন। ব্যাটা একনম্বরের মায়ের ন্যাওটা। মাঝে মাঝে তাঁর সন্দেহ হয়, প্রেয়সী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে গিয়ে তাঁর লুকিয়ে চুরিয়ে মিষ্টি, চপ, সিঙাড়া খাবার খবরটা এই ছেলেই তার মায়ের কানে তুলেছে।
গোপেনগিন্নি খুব নির্বিকার মুখে জিজ্ঞেস করলেন - ব্রেকফাস্ট খাবে না?
গোপেনবাবু বললেন - এই গু-গোবর আমি খাই না।
কথাটা ছেলেমেয়ের সামনে একটু অভব্য হয়ে গেল। কিন্তু পুরুষমানুষ রেগে গেলে এত হিসেব করা উচিৎ না বলেই মনে হলো গোপেনবাবুর।
তাঁর গিন্নি খুব স্বাভাবিকভাবে এক থালা লুচি আর আলুভাজা নিয়ে বসে গেলেন। যেন কিছুই হয়নি। গোপেনবাবু রাগে মনে মনে কিড়মিড় করে উঠলেন। পরিবারের যে মানুষটা রোজগার করে আনছে, সে বলেছে সকালের জলখাবার খাবে না, তাকে একটা অনুরোধ, উপরোধ করার নিয়ম আছে। তাঁর স্ত্রী কি বলতে পারতেন না, আচ্ছা বাবা রাগ করে না। দিচ্ছি না হয় একটু বেশি করে মাখন। তাঁর ছেলে না হয় কিছু নাই বা বলল, ব্যাটা মায়েরগুপ্তচর।মেয়েটাও কী সাধতে পারল না। হা সংসার, এই তো জীবন গোলাম হোসেন, ইত্যাদি ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে গোপেনবাবু জুতো পরতে লাগলেন।
অথচ কদিন আগেও তাঁর জীবনটা অন্যরকম ছিল। অফিস থেকে ফেরার পথে তিনি পাড়ার প্রেয়সী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার নামে মিষ্টির দোকানটায় ঢুকে পড়তেন। বেশ সুন্দর আলোয় ভরা একটা জায়গা। এক মধুমেহের রুগির পক্ষে এর চাইতে মারাত্মক, এর চেয়ে অ্যাডভেঞ্চারাস, এরকম আনন্দদায়ক, এর থেকে প্রিয় ব্যাপার আর কি আছে? জীবনে যে জিনিস বারণ করা হয়, তার প্রতিই মানুষের টান বেড়ে যায়।
রোজ গোপেনবাবু সেখানে ভাল করে চপ, কচুরী, রাজবল্লভী, মিষ্টিমাষ্টা এইসব সাঁটিয়ে বাড়িতে ঢুকতেন। হঠাৎ কি করে সেটা যেন খবর হয়ে গেল! আজকাল এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে একবার কোনও ব্যাপার খবর হয়ে গেলে সামলানো মুশকিল। গোপেনবাবুও সামলাতে পারলেন না। দুনিয়ার লোকে যেন তাঁরই পিছনে পড়ল। তাঁর এই কীর্তিকলাপের খবর ফোন হোয়্যাটস্যাপ মারফৎ পৌঁছল তাঁর গিন্নি এবং ছেলে মেয়ের কাছে। বাড়িতে তাঁর সুখের দিন শেষ হলো। সুগারের রুগি হলেও, পাঁউরুটিতে একটু আধটু মাখন, লুচির সাথে সামান্য আলুভাজা, মাঝে সাঝে দু একটা মিষ্টির যে ছাড় তিনি বাড়িতে পেতেন, তা একেবারে বন্ধ হল।
প্রচণ্ড রাগে গিরগির করতে করতে গোপেনবাবু অফিস চললেন।
বেরনোর সময় গিন্নি জিজ্ঞেস করলেন - রাতে কখন ফিরছ?
- তাতে তোমাদের কী?
- কথাবার্তার কী ছিরি হচ্ছে দেখ। ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে, তার কোন খেয়ালই নেই।
- কেন? তোমরা কোন হরিদাস পাল?
- ভদ্রভাবে কথা বল।
- চুপ কর। একটাও ফালতু কথা বলবে না। বলেই দড়াম করে দরজা টেনে দিয়ে তিনি বার হয়ে গেলেন।
সারাদিন অফিসে যা পারলেন খেলেন দেলেন। এখন প্রতি সপ্তাহে তাঁর সুগার চেক করার ব্যবস্থা হয়েছে। সামান্য বেপট খেলেই ধরা পড়ে যান। আর ধরা পড়লেই বাড়িতে চিত্তির। ডায়েট আরও শক্ত করে দেওয়া হচ্ছে।ঘটনা যেভাবে এগোচ্ছে, মনে হয় এবার তাঁকে না খেয়ে থাকতে হবে।
স্কুটি নিয়ে স্টেশনের দিকে যেতে যেতে তাঁর মনে হল, আজ আর অফিস থেকে বাড়ি ফিরবেন না। এধরনের ইচ্ছা তাঁর প্রায়ই হয়। তিনি অফিস থেকে না ফেরার ইচ্ছে নিয়ে অফিস যান। সারাদিন পরে সবকিছু ভুলে আবারবাড়ির দিকে রওনা হন।
(দুই)
রাতের বেলা যে ট্রেনটায় ফেরেন, বছর শেষের ছুটির বাজারে তা আজকাল বেশ ফাঁকা ফাঁকা থাকে। গ্যালপিং গাড়ি। আগে কলকাতা ছেড়ে বেরনোর পাঁচ ছটা স্টেশন পরে জায়গা পেতেন। আজকাল দু’চারটে স্টেশন পরেই পেয়ে যান। আজ একেবারে উঠেই বসার জায়গা পেলেন।
বসেই তিনি মোবাইলের সেই প্রাগৈতিহাসিক সাপটাকে কিছুক্ষণ খেলালেন। এই সাপ খেলিয়ে খেলিয়ে তাঁর বুড়ো আঙুলে ক্রনিক ব্যথা হয়ে গিয়েছে। একটু পরে সাপলুডো ধরলেন। সবার হয়ে চাল দিতে দিতে একটু বোর হয়ে গেলেন। মোবাইলও আজ ব্যাটারি শেষ করে জবাব দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
তাঁরও একটু ঘুম ঘুম পেতে থাকল। রোজকার ‘এই যে গোপেনদা’ বলা ডেলি প্যাসেঞ্জার লোকজনও কম। পরিচিতরা প্রায় নেই বললেই চলে। সব শীতের ছুটি কাটাচ্ছে। খদ্দের নেই বলে রোজকার ঘটিগরম আর ঝালমুড়ি ওয়ালারাও নেই। ঘুমের সাথে খিদে খিদেও পেতে থাকল।
বাইরে বেশ রাত হয়ে এসেছে। আজ বাদে কাল দু হাজার উনিশ চলে আসবে। বছরের শেষ দিনে রাজ্যসুদ্ধ মানুষের ছুটি থাকে, তাঁর অফিস খোলা থাকে। ভাল করে জানলা টানলা বন্ধ করে সিটের উপর টানটান হয়ে শুয়ে ফাঁকা কামরায় গোপেনবাবু তাঁর দুঃখের কথা ভাবতে লাগলেন।
সারাদিন ভাল খাওয়া দাওয়া হয়নি। পেট চুঁইচুঁই করছে। অদ্ভুত ব্যাপার, এতক্ষণ তাঁর সেরকম খিদে পায়নি। শীতটা একটু কম লাগতেই, তাঁর আসুরিক ধরনের খিদে পেয়ে গেল। ধর, এইসময় বাড়ি গিয়ে যদি গরম গরমভাত, তার সাথে একবাটি ঘি, আর ধর গিয়ে বেশ তেলতেলে গোটা দুয়েক মাছের পেটি পাওয়া যেত...
তারপর আসত সোনামুগের ডাল, দু তিনরকম ভাজা, বকফুলের বড়া, আহাহা। দু বারের জায়গায় চারবার ভাত নিতেন তিনি। এক দেড় থালা ভাত তো শুধু ডাল আর ভাজাভুজি দিয়েই শেষ করে ফেলতেন। কিন্তু হা হতোস্মি!তাঁর কি আর সে কপাল আছে। বাড়ি ফিরে হয়তো দেখবেন দু খানা শুকনো রুটি আর পটলের ছেঁচকি করে রাখা আছে। তিনি সুগারের পেশেন্ট। রাতের বেলা ভাত খাওয়া বন্ধ। এমনকি দুটোর জায়গায় তিনটে রুটি চাইলেওসময়ের হিসেব, হজমের হিসেব এইসব লাখো ফিরিস্তি শুনতে হবে।
শুয়ে শুয়ে তাঁর মাথায় নানা উদ্ভট কথা আসছিল। মনে হল, দুটো স্টেশন আগে যদি একটা ছোট বাড়ি ভাড়া নেন, তবে কেমন হয়? ধরা যাক সেখানে একটা কুক রাখলেন। সপ্তাহে তিনদিন গোপনে সেখানে যাবেন, আর ভরপেট খাবেন। বেশ ডিমের ডেভিল, মাংসের কোর্মা, পোলাও বিরিয়ানি, হাঁসের ডিমের ডালনা, সাথে লাচ্চা পরোটা এসব রান্না করানো হবে।
ঘরের তৈরি জিনিস নিশ্চয়ই শরীরের তেমন ক্ষতি করবে না। তবে মাত্র তিনদিন। শুধু তিনদিন। সেই তিনদিন খ্যাঁটন দিয়ে এসে বাড়িতে তিনি প্রায় কিছুই খাবেন না। দুটোর জায়গায় তিনটে রুটি সাধলে না করে দেবেন। বাড়ির লোক অবাক দৃষ্টিতে তাকাবে। বাকি তিনদিন চলবে কৃচ্ছ্রসাধন। কঠোর সংযম, তাহলেই আর সপ্তাহশেষের টেস্টে সুগারের বাড়া কমা ধরা পড়বে না। এইসব আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে গোপেন বাবু ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়লেন।
(তিন)
ঘুম ভেঙে মুখের লালা টালা মুছে উঠে দেখলেন কামরা ফাঁকা। অন্যদিকে একটা লোক বসে আছে। অদ্ভূত ধরনের পোষাক পরা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ঘড়ি বন্ধ হওয়ার কথানয়। কিন্তু তিনি ট্রেনে উঠেছেন সাড়ে আটটায়। সিটে লম্বা হয়েছেন নটার দিকে । আর এখন ঘড়িতে বাজে নটা পনেরো। কাঁটা বন্ধ।
গোপেনবাবু সোজা হয়ে বসতেই কামরার একমাত্র লোকটি তাঁর দিকে তাকাল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে গোপেনবাবু একটু ধাক্কামতো খেলেন। যার মুখের দিকে তিনি তাকিয়ে আছেন, সে ভূত নাও হতে পারে। যদিও ভূত হওয়ার সম্ভাবনাই তার বেশি। লোকটির পায়ে বুটজুতো আছে, হাতে ছাতার মতো একটা জিনিস। মাথায় বেশ একটা টুপির মতো জিনিসও দেখছেন। শুধু ঘটনা হল, লোকটি এই ঘন রাত্রিবেলা সানগ্লাস পরে আছে। সেই সানগ্লাসের রঙ কুচকুচে কালো। আর সবচেয়ে কিম্ভূত ব্যাপার হল, লোকটির মুখ তাঁর চেনা। গত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে এই মুখ তিনি দেখে আসছেন আয়নায়। লোকটিকে অবিকল তাঁর মতো দেখতে।শুধু একটাই পার্থক্য, লোকটি গোপেনবাবুর চেয়েও অনেক লম্বা।
গোপেনবাবু বিড়বিড় করে বললেন - আমি ঘুমোচ্ছি। আমি ঘুমোচ্ছি।
তাঁর ধারণা হয়ে গেল তিনি ট্রেনে শুয়ে এখন ঘুমোচ্ছেন। এই পুরো ব্যাপারটাই তাঁর স্বপ্নে ঘটছে। যদিও তাঁর মনে পড়ল না এত স্পষ্ট স্বপ্ন তিনি এর আগে কবে দেখেছেন।
বিড়বিড় করতে করতেই গোপেনবাবু লোকটির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন। ব্যাপারটা আর কিছুই না। তিনি দেখছেন, লোকটা কালো চশমাটা খুলল, তার চোখদুটি এত উজ্জ্বল যেন মনে হচ্ছে সেখান থেকে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে।
তাঁর মনে হল, এক্ষুনি মস্তবড় লোকটি বলে বসবে, সে মানুষ না। অন্যরকম কিছু একটা। তাঁর মনে হল, ভূতের পায়ে জুতো থাকতেই পারে, ভূতে টুপি আর ছাতাও রাখতে পারে। সানগ্লাসও পরতে পারে। তিনি নিজেই কত বইতে সাহেবভূতের গল্প পড়েছেন। তারা এই ধরনের বেশভূষা পরতেই পারে।
- গোপেনবাবু, ভয় পাবেন না। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
ভূতের কাছ থেকে এরকম কথা শুনে যে কোনও মানুষের চমকে ওঠার কথা। চমকে মরেও গেলেও আপত্তি ছিল না। অথচ গোপেনবাবু চমকালেন না। খানিকটা আশ্চর্য হয়ে বললেন - আজ্ঞে না, ভয় পাব না।
বলেই ওঁর মনে হল ভূতটির সাথে মিষ্টি করে কথা বললে তাঁর কোন ক্ষতি না হতেও পারে। কী বলা যায়, কী বলা যায় ভেবে, তিনি জিভটিভ চেটে আর কিছু ভেবে না পেয়ে বললেন - থ্যা _ থ্যা_ থ্যা – ন - কু।
ভূত একটু হেসে বলল - আপনি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছেন। দাঁড়ান, আপনাকে একটু এনার্জি দিই।
লোকটা অথবা ভূতটা এগিয়ে এসে তার পাশে বসে তাকে হাত দিয়ে একটু স্পর্শ করল। তিনি শুনেছিলেন ভূতের হাত বরফের মতো ঠান্ডা হয়। এর হাত বেশ গরম। তিনি শরীরে হালকা একটা চিনচিনে ভাব টের পেলেন। তারপরে বোধ করলেন তাঁর বেশ ভাল লাগছে। তাঁর হাত চিনচিন, পা ঠ্যারঠ্যার, শুকনো গলা, ফ্যাঁসফ্যাঁসে স্বর অনেকটা ঠিক হয়ে গিয়েছে।
তিনি ভূতের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা আরম্ভ করলেন - আপনি আমায় কী দিলেন?
- একটু আমার প্রাণশক্তি দিলাম।
- প্রাণ! মানে আপনি ভূত নন।
- আজ্ঞে না।
- তবে আপনি কে? ভগবান?
লোকটি হেসে বলল - না, আমি একজন মানুষ। আপনার মতোই মানুষ। আমি ভবিষ্যত থেকে এসেছি।
গোপেনবাবু যন্ত্রের মতো কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন - ওহ আচ্ছা, বুঝলাম।
- আপনি আমাকে এখন আর ভয় পাচ্ছেন না তো!
- নাঃ।
- অথচ আপনি এখনও মনে মনে রাম রাম বলে যাচ্ছেন। এই রাম কে?
- রাম একজন মানুষ। তিনি অতীতের মানুষ। আপনি যেমন ভবিষ্যতের, তিনি অতীতের। বলা হয়, তাঁর নাম করলে ভূত, প্রেত, পিশাচ কাছে আসে না। মানুষ সেইজন্যে তাঁকে ভগবানের দর্জা দিয়েছে।
- আপনি কী এখনও আমাকে ভয় পাচ্ছেন?
- একটু পাচ্ছি।
- কেন?
- আপনারও মুখ নড়ছে না, আমারও ঠোঁট খুলছে না, অথচ আমরা দুজনে কথা একে অপরের সাথে কথা বলছি। মানে, এ ধরনের ব্যাপার তো সচরাচর ঘটে না। তাই একটু...
- শব্দ করে সব প্রাণী ভাবের আদানপ্রদান করে, তাই তো?
- হ্যাঁ।
- সেই আদানপ্রদানটা আমরা করছি আমাদের মগজ দিয়ে। সোজাসুজি। আপনারা হয়তো এই ব্যাপারটাকে মন বা চিন্তা বলেন।
গোপেনবাবু ভাবলেন, ভয়টা কাটাবেন। কিন্তু কাটছে না। এই ভবিষ্যতের মানুষ তাঁকে নিয়ে কী করবে তা বোঝা যাচ্ছে না।
- আপনার কোন চিন্তা নেই। আপনাকে শুধু কয়েকটা প্রশ্ন করেই আমি চলে যাব।
এ লোক বা ভূত তাঁর চিন্তা বুঝতে পারছে।
- হ্যাঁ, আমি আপনার কিছু কিছু চিন্তা বুঝতে পারছি। আমি আর আপনি পাশাপাশি থাকলেও আমাদের মধ্যে একটা বিরাট বড় টাইম ল্যাগ চলছে। তাতে আপনার অনেক চিন্তা হারিয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে সব কিছু সঠিকভাবে এসে পৌঁছচ্ছে না।
- ও আচ্ছা। বলুন আপনার কী প্রশ্ন?
- আজ কত তারিখ?
- আজ্ঞে?
- আজকের তারিখ কত?
- আজ ডিসেম্বরের একত্রিশ তারিখ। কাল নতুন বছর।
- সাল?
- দু হাজার আঠার। কাল থেকে উনিশ হবে।
- আমি আসছি ৪০০৫ সাল থেকে।
- ওয়েলকাম। ওয়েলকাম... একটু স্বাভাবিক হচ্ছেন এখন গোপেনবাবু।
- আপনি সমানে তিনজন মানুষের কথা ভেবে যাচ্ছেন। একজন পুরুষ আর দুজন মহিলা। এরা কারা?
- এরা আমার পরিবার। পুরুষটি হলআমার ছেলে, মেয়েদের মধ্যে একজন আমার স্ত্রী, আর একজন আমার কন্যা।
- এক্সেলেন্ট, ভেরি গুড।
এর মধ্যে এত গুডের কী আছে তিনি ভেবে পেলেন না। এ পৃথিবীতে বহু মানুষেরই পরিবার আছে। বরং যাদের পরিবার নেই সেটাই তাদের দুঃখের কারণ।
- আপনি কী আপনার পরিবারের উপর কোনও কারণে বিরক্ত?
- হ্যাঁ।
- কেন বিরক্ত একটু বলা যাবে? অবশ্য আপনার যদি আপত্তি না থাকে।
- না না আপত্তি কিসের। আপনি যদি এ যুগের মানুষ হতেন, তবে আপত্তি হতো। এ যুগের মানুষের স্বভাব চরিত্র খুব খারাপ। কিছু পেলেই সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে দেয়। আসলে আমার ডায়াবিটিসের কারণে আমার পরিবার ভাল কিছু খেতে টেতে দেয় না। বলুন, সুগারের পেশেন্ট বলে আমার জিভে কি টেস্ট বলে কিছু নেই? আপনি আমার সমস্যাটা কী ধরতে পারছেন?
- হুঁ কিছুটা পাচ্ছি। আচ্ছা, কালও আপনি আমার পরিবারের উপর বিরক্ত হয়েছিলেন? কেন?
- কাল? আর বলবেন না! রাতে খেতে গিয়ে দেখি চিকেনের ঝোলে একফোঁটা মশলা নেই। শুধু স্টু। আচ্ছা, আপনিই বলুন, মশলা ছাড়া চিকেন আর তেঁতুল জল ছাড়া ফুচকা, এই সব জিনিসের কোনও মানে আছে? চিকেন গরম মশলা ফশলা দিয়ে একটা রগরগে ব্যাপার না হলে...
- আচ্ছা, আপনার পরিবারের সঙ্গে কি সবসময় আপনার খাওয়া দাওয়া নিয়েই ঝামেলা বাঁধে?
- ইয়ে... না ভাই, ঠিক তা না। আমার বাড়ির লোক সবসময় আমার পিছনে লেগে আছে। আমি যদি বলি সকালে আনন্দবাজার পড়ব, তবে তারা বলবে বর্তমান, আমি যদি ছুটির দিন চিড়িয়াখানা যাব বলি, তবে তারা অবশ্যই বলবে বোটানিক্যাল গার্ডেন যাবে। আমি যদি সকালে লুচি বেগুন ভাজা খেতে চাই, তাহলে বাড়িতে ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানানো হবে, ওহ স্যরি আবার খাবার দাবারের প্রসঙ্গ এসে গেল। মোটমাট আমি যদি পূবে থাকি ওরা পশ্চিমে, আমি সমুদ্র বললে ওরা পাহাড়। মা, মেয়ে, ছেলে সবাই মিলে একদলে হয়ে, আমায় প্রায় একঘরে করে রেখেছে রে ভাই!
গোপেনবাবু বাড়ির কথা বলতে বলতে সেন্টিমেন্টাল হয়ে প্রায় পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডার মুডে চলে এসেছেন। একটু আগের ভয়ডর আর তাঁর মনে পড়ছে না। তাঁর ভাবগতিক দেখে বলাই যায় এই গল্পগুজব তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা চালাতে পারেন।
- মানে আপনার পরিবার পুরোপুরি আপনার বিরুদ্ধে।
- বিরুদ্ধে বলে বিরুদ্ধে। আমি যদি কংগ্রেস হই, তবে ওরা পুরোপুরি সিপিএম। আমি যদি রোনাল্ড রেগন হই তবে ওরা গর্বাচেভ। আমি যদি আমেরিকা হই, ওরা তবে সোভিয়েত রাশিয়া।
- আপনি কী বলছেন ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে আপনার পরিবারের সাথে আপনার সম্পর্ক একেবারেই ভাল না।
- অবশ্যই ভাল না। একশভাগ ভাল না। জানেন স্যার, আপনি আসার আগেই আমি ভাবছিলাম অন্য জায়গায় একটা ছোট ঘর ভাড়া নেব। সেখানে রান্নাবান্নার কুক রাখব। ভাবতে পারছেন আপনি আমার অবস্থাটা?
- আচ্ছা, আপনার পরিবারের সদস্যরা ভালো সময় কাটান না? ধরুন কোনও উৎসবের সময় গিফট দেওয়া নেওয়া, একসাথে ঘুরতে যাওয়া... এইসব?
- গিফট দিই, অবশ্যই দিই। এই যে, পুজোর সময়...
- পুজো কী?
- সে একটা ফেস্টিভ্যাল। একজন গড্ডেসকে আমরা ফুল, ধুপ, ধুনো এইসব দিয়ে আরাধনা-টনা করি। যা বলছিলাম, এই পুজোতে বাড়ির প্রত্যেককে দু তিন জোড়া জামাকাপড় দিই। তাছাড়া এমনি বিভিন্ন অকেশন তো লেগেই আছে। গতবার কী হল বুঝলেন, যদিও… আপনি ভাই এটা ভাববেন না যে আমি বউয়ের নামে বদনাম করার জন্যে এটা করছি।
- আপনি নিশ্চিন্তে বলে যান গোপেনবাবু।
- গতবারের পুজোতে, একটা সুন্দর দেখে শাড়ি কিনে আলমারিতে লুকিয়ে রেখেছি। ঠিক পুজোর সময় সারপ্রাইজ দেব বলে। ও হরি, উনি সেটা দেখে ফেললেন আমায় না জানিয়ে। কাণ্ডটা ভাবুন। উনি ভেবে নিলেন, সেটা আমি অন্য কারোর জন্যে কিনেছি। আমার কোনও গার্লফ্রেন্ড, ইয়ে মানে বান্ধবী টান্ধবী, মানে বুঝতে পারছেন তো..?
- বুঝতে পারছি।
- মানে উনি ভেবে ফেললেন ওই শাড়ি আমি আমার কোনও এক্সট্রা ম্যারিট্যাল ইয়ের জন্যে কিনেছি। ভাবতে পারেন, স্যার? তারপর উনি কী মারাত্মক কাজ করলেন আপনি তা ভাবতেও পারবেন না। আমাকে না জানিয়ে গিন্নি জিম-টিম করে রোগা হওয়ার চেষ্টায় ওজন ফজন কমিয়ে শরীর-টরীর খারাপ করে একাকার ব্যাপার। কী না, ওনার ধারণা হল আমি নাকি ওনাকে আর আগের মতো সুন্দরী ভাবিনা।
- এই ব্যাপারটা দিয়ে কী প্রমাণিত হল?
- কী বলছেন দাদা! স্বামী ইস্তিরির একটা ইয়ে থাকবে না? একটা ওই কী যেন বলে, কনফিডেন্স। আমার গিন্নি বুঝলেন, সবসময় আমাকে হ্যাটান্যাটা করে। একবার কী হল জানেন, রোজ বাজার করে আসি, ওনার সেই এক কথা, বলে আমি নাকি ঠিক করে দরদাম করতে পারি না। শুধু নাকি ঠকে আসি। সারা বাজারের লোকজন নাকি বসে আছে আমাকে কানা বেগুন, পাকা ঢেঁড়স আর নরম পেটির মাছ গছাবার জন্যে। মাছের পিস নাকি আমি কোনওদিনই ঠিকঠাক করাতে পারি না।
- তারপর?
- আমিও তক্কে তক্কে ছিলাম। একদিন ওনার সাথে একটা শাড়ির দোকানে গেলাম। বল্লে পেত্যয় যাবেন না, ঝাড়া দু ঘন্টা লাগাল একটা শাড়ি কিনতে। সবার শেষে গিয়ে একদম প্রথমে যে শাড়িটা দেখেছিল, ঘুরে ফিরে সেটাই কিনল ওই একই দাম দিয়ে। অথচ ভাবখানা এমন রাখলো যেন, বিশাল একটা দাঁও মেরেছে। বলল, দেখলে এরম করে দরদাম করতে হয়, তবেই ভাল জিনিস সস্তায় পাওয়া যায়।
- ও, তা আপনি কী করলেন?
- আমি? আমিও পরদিন আমিও মাছের বাজারে গিয়ে পাক্কা তিনঘন্টা ধরে মাছ কিনলাম। ওনার শেখানো, দরদামের স্টাইলে, যে মাছ প্রথমে দেখেছিলুম, দেড়ঘন্টা পরে সারা বাজার ঘুরে সেই মাছই কিনলুম। তারপর আস্তে আস্তে আরও দেড়ঘন্টা ধরে এক একটা পিস দেখে দেখে কাটালুম। বাজার সেরে যখব ফিরলাম তখন বেলা দুপুর। তাতেও আবার ওনার মুখ ভার। আমি নাকি ওনার সাথে ফাজলামি করছি। বলুন, আপনিই বলুন, এমন মানুষের সাথে কোথাও ঘুরতে বেড়াতে যাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবা যেতে পারে?
- তার মানেটা কী দাঁড়াল? আমি তাহলে আপনার স্ত্রীকে ভালবাসেন? না বাসেন না?
- অবশ্যই বাসি না। স্ত্রী কেন, ছেলে, মেয়ে কাউকেই ভালবাসিনা। বাসলে বছরের শেষদিনটাতে এত রাত করে বাড়ি ফিরি আর আপনার চক্করে পড়ি...ইয়ে শেষ কথাটা বাদ দিন। এবং কথা হল তারাও আমাকে ভালবাসে না।
লোকটা বলল - ধন্যবাদ। আপনি দেরি করে বাড়ি ফেরায় আমার খুব লাভ হয়েছে।
- আপনার কী রকম লাভ?
- আপনি হয়তো দেখছেন যে ট্রেনটা চলছে তো চলছেই, কিন্তুকোনও স্টেশন আসছে না। সময়টা একই জায়গায় আটকে আছে।
- হ্যাঁ। মানে, তা তো হচ্ছেই।
- না হচ্ছে না। আমরা আপনার টাইমটাকে একটা লুপে ফেলেছি। যদি এই সময়টাকে একইভাবে চলতে দিই তবে আপনার জীবনটা এইভাবেই চলতে থাকবে। আপনি একটা সময়ের পরে রোজ বছর শেষে ট্রেনে উঠবেন আর সেখানে আপনার সাথে আমার দেখা হবে। এমনই চলতে থাকবে অনন্তকাল।
- কি সব্বোনাশ। কেন? আমরা মানে? আপনারা আর কে কে আছেন?
- আমরা মানে ভবিষ্যতের মানুষেরা। আমরা আমাদের সমাজের নিয়ম মাফিক একটা ছোট্ট রুটিন রিসার্চ করছিলাম।
গোপেনবাবু হাঁ করে শুনছিলেন।
- আমরা আপনাকে একটা র্যান্ডম স্যাম্পলিং-এর মাধ্যমে সিলেক্ট করেছি। আমরা যখন এ যুগের সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্যান করছিলাম, একটা পোস্ট বারবার ঘুরে ফিরে আসছিল। তাতে আপনার নাম ছিল।
গোপেনবাবু এবার বুঝলেন তাঁর এই হয়রানির কারণ! একবার যদি জানতে পারতেন কোন অলপ্পেয়ে ড্যাকরা হনুমান লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁর প্রেয়সী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে যাওয়ার কথাটা ভাইরাল করেছে!
লোকটি বলে চলেছে, - এবার আমরা একটা খুব ভাল খবর আপনাকে দিতে চলেছি। আমাদের টেস্টে স্যাম্পল হওয়ার পর এই অধিকার আপনি অর্জন করেছেন।। যাদের সাথেই আমরা এই টেস্ট করি, শেষে তাদের একটা দারুণ খবর শোনাই আমরা। এ পর্যন্ত আমাদের ডেটা বলছে, ফিডব্যাক নেওয়ার পর তার রেজাল্ট শোনালে তাঁরা অত্যন্ত আনন্দ পান।
গোপেনবাবু উদ্গ্রীব হলেন। সারাদিন পরে একটা অন্তত কোনও ভাল খবর তিনি শুনবেন। হয়তো এটাই এ বছরের জন্যে তাঁর জীবনের সেরা খবর, একটা ভাল ব্যাপার তাঁর জীবনে ঘটবে।
লোকটি বলল- আপনার জেনে ভাল লাগবে, ভবিষ্যতের পৃথিবীতে কারোরই পরিবার বলে কোন ব্যাপার নেই।
গোপেনবাবু বিষম খেলেন। পরিবার নেই মানে, সবাই অনাথ। আহারে!
লোকটা বলল -আমরা ভবিষ্যতের মানুষরা, অনেক রিসার্চ করে দেখেছি, পৃথিবীতে সব ঝামেলার মূলে আছে পরিবার। ইতিহাসে এমন ঘটনাও আছে, তাতে এক পারিবারিক যুদ্ধে একটা দেশের প্রায় সব মানুষ মরে যায়। আছে না?
গোপেনবাবু অবাক হলেন। সত্যিই তো, রামায়ণ আর মহাভারত, ইলিয়াড ওডিসি ট্রয় ফয়ের যুদ্ধগুলো তো আসলে পারিবারিক ঝামেলা, সত্যি মিথ্যে ধর্ম ন্যায় অন্যায় এইসবের নাম দিয়ে সবাইকে তার মধ্যে টেনে নেওয়া হয়েছিল।
- আমাদের কাছে যা তথ্য আছে, তাতে দেখা গিয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধী সংগঠনগুলো একসময় পরিবারেরাই চালাতো। যা বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল সবই পরিবার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
গোপেনবাবু ভেবে দেখলেন, কথা সত্যি, সেই আগেকার সিনেমার গডফাদার থেকে হাল আমলের ডি কোম্পানি, সবাই-ই তো পরিবার দিয়েই ধান্দা চালায়। বড় ব্যবসায়ী বলতেই টাটা বিড়লা রিলায়েন্স। সবই পরিবার।
আমরা অনেক গবেষণা করে দেখেছি, পরিবার থেকেই মানুষ স্বার্থপর হতে শেখে, অনর্থক অর্থ জমিয়ে রাখতে শেখে। বাবা মায়েরা সবসময় তাদের সন্তানদের জন্যে যার যেমন ক্ষমতা নিজের নিজের সাধ্যানুসারে সম্পদ জমিয়ে রেখে যেতে চাইত। সেই উদ্বৃত্ত ধন থেকেই ধনী দরিদ্রের ভেদাভেদ তৈরি হতো। পৃথিবীর বেশিরভাগ যুদ্ধ, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার এই সব কিছুর পিছনে ছিল পরিবারতন্ত্র।
কথা ঠিক। ভেবে দেখলেন গোপেনবাবু। ভবিষ্যতের মানুষটার কথায় অকাট্য যুক্তি আছে।
- তাই আমাদের কোন পরিবার বলে ব্যাপার নেই। আমরা জানি না, আমাদের মা কে, বাবা কে, কাকা বা জ্যাঠা কিংবা মাসি বা পিসি কে। আমরা জানতে চাই না, আমাদের ভাই বোন ছেলে মেয়ে কাউকেই। সকলেরই পরিচয় একজন ব্যক্তি হিসাবে। আমাদের সমাজ খুব সুন্দরভাবে চলছে। মাঝে মাঝে আমাদের এই সিদ্ধান্ত যে কতটা সঠিক, তা দেখার জন্যে আমরা সার্ভে করি। সেই সার্ভে থেকে আমরা সবসময় বিভিন্ন টাইমজোনে পরিবারের উপর বীতশ্রদ্ধ লোকজন পাই। যারা একই পরিবারে থেকে সারাজীবন ধরেও কেউ কাউকে ভালোবাসে না। অনেকে মুখে ভালবাসা দেখায়, অথচ পিছনে ঘৃণা, ঈর্ষা আর হিংসা থাকে। সেটা আরও খারাপ। মানুষকে সারাজীবন মিথ্যে বলতে শেখায়।
গোপেনবাবু খুব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন - সকলের পরিবারে সব মানুষই কী খারাপ?
- না। মানুষ জন্মগতভাবে খারাপ হয় না। শুধু পরিবারের সাথে থাকলেই তাদের মধ্যে তাদের পরিবারের সদস্যরা জেনে বা অজান্তে সব খারাপ লক্ষ্মণ ঢুকিয়ে দেয়-ট্রেন থেমে গেল। লোকটি দরজার দিকে এগিয়ে গেল। মুচকি হেসে, উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে বলল - স্টেশন এসে গিয়েছে, চলি।
গোপেনবাবু গভীর বিস্ময়ে অনড় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর হঠাৎমনে হল তিনি লোকটির নাম জিজ্ঞেস করেননি। তিনি তাড়াতাড়ি বললেন -আপনার নামটা কী ভাই? কথায় কথায় আসল কথাটাই জানা হয়নি -
চলে যেতে যেতে হাতের ছাতা মতো জিনিসটা মেলে ধরতে ধরতে লোকটি বলল - আমার নাম ওপেন। আমার দুনিয়ায় সবাই বলে সান ওপেন। যাকে বাংলায় বলা যেতে পার ওপেন বাবু। আমি সবার মনের কথা ওপেন করে বেড়াই।
গোপেনবাবু দরজার দিকে তাড়াতাড়ি এগোতে এগোতে বলল – আপনাকে দেখতে কিন্তু একেবারে আমার মতো।
ছাতাটা মেলা হয়ে গিয়েছে, নেমে যেতে যেতে ওপেনবাবুর গলার স্বর শোনা গেল - স্যাম্পলরা সবসময় আমাকে তাদের নিজেদের মতো দেখে। তাতে তারা একান্ত মনের কথা বলে ফেলে। এটাই আমার স্পেশাল স্কিল।
(চার)
ওপেনবাবু চলে যাবার পরেও গোপেনবাবু অনেকক্ষণ স্টেশনে রইলেন। দু বার এদিক থেকে ওদিক চক্কর দিলেন। ওপেনবাবুকে কোত্থাও দেখতে পেলেন না। গোপেনবাবু যেখানটা থাকেন, সে জায়গাটা আধামফঃস্বল। তিন চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ি যেমন আছে, তেমনই একটু এগোলেই ধানক্ষেতও পাওয়া যায়। জায়গাটা এখনও শহর হয়নি, তবে চেষ্টায় আছে। বছর দশেকের মধ্যেই হয়তো হয়ে যাবে।
স্টেশনে যেমন অটো, টোটো আছে, তেমনই ভ্যানরিক্সাওয়ালারাও আছে। ছোট স্টেশন, ছোট প্ল্যাটফর্ম। সামনে একটা চায়ের দোকান। সবসময় লোকজন থাকে। আজ ভিড় কম। চায়ের দোকানের পাশেইসাইকেল স্ট্যান্ড। গোপেনবাবু সাইকেল স্ট্যান্ড থেকে নিজের স্কুটি নিয়ে বাড়ির দিকে এগোলেন। চারিদিকে অল্প অল্প অন্ধকার। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। একটু দূরেই তাঁর বাড়ি। ঠাণ্ডায় তাঁর হাত পা জমে যেতে থাকল। ওই তো, মোড়ের মাথায় প্রেয়সী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের নিয়ন সাইন বোর্ডের আলোর আভাস দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
স্কুটিতে আসতে আসতে তিনি মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে, তিনি ট্রেনে শুয়ে গভীর ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আর তাতেই আসতে আসতে চমৎকারএকটাস্বপ্নদেখলেন।ঘুমচোখেইউঠেট্রেনথেকেনেমেছেন।তিনিজানেন,স্বপ্নেএসবছোটখাটব্যাপারস্যাপারহয়েইথাকে।এরআগেওএকবারঘুমথেকেউঠতেদেরিকরছিলেনবলে, তাঁর বৌ গরম চায়ের কাপে তার আঙুল ছুঁইয়ে দিয়েছিল, তাঁর মনে হয়েছিল তিনি আগ্নেয়গিরিতে পড়ে যাচ্ছেন। ছোটবেলায় একবার ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়লে তাঁর মুখে জল ছেটানো হয়েছিল, তাঁর মনে হচ্ছিল তিনি নদীতে সাঁতার কাটছেন। ভবিষ্যতের মানুষ! ফুঃ, ভবিষ্যতের মানুষের সাথে দেখা হওয়া এতই আসান নাকি!
তবু শরীরটা বেশ এনার্জেটিক লাগছে। অনেকটা তরতাজা ভাব। সাধারণত অফিস থেকে এসে তিনি হেদিয়ে পড়েন। এই ঝরঝরে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ট্রেনের ঘুমের ফল। তিনি ঠিক করলেন, আজ বাড়িতে বেশ টেম্পার নিয়ে ঢুকবেন। আর এই টেম্পার নিতে গিয়ে সবার আগে যে কাজটা করতে হবে তা হল খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া। হয়তো রাতভোর একটু কষ্ট হবে, সেটা জল ফল খেয়ে ম্যানেজ দিতে হবে। খাবার খেয়ে ফেললেই টেম্পার হ্যাম্পার হয়ে যাবে।
গোপেনবাবু বেল টিপতেই দরজা খুলে গেল। ঘরের সবাই বসে টিভি দেখছে। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের জগঝম্প হচ্ছে সেখানে। বাড়ির লোকজন হাঁ করে তাই গিলছে।
হুঁঃ, এই তো ফ্যামিলি। বাড়ির কর্তা না খেয়ে অফিসে গিয়েছে আর কারোর কোনও বিকার নেই, এদের জন্যই তো সারাদিন খেটে…নিজের মনে গজগজ করতে করতে বাথরুমে ঢুকলেন তিনি। হাতমুখ ধুয়ে আসতেই একটা গরম গরম সুগন্ধী কেক তাঁর সামনে আনা হলো। তার সাথেই এলো চিকেন হাক্কা চাউমিন আর চিলি চিকেন।
তিনি বসতেই তাঁর মেয়ে বলল - জানো বাবা, তুমি না খেয়ে বেরনোয় মাও সারাদিন কিছু খায়নি। সকালের ব্রেকফাস্ট ফ্রিজে তুলে রাখা হয়েছে।
গোপেনবাবু গিন্নির মুখের দিকে একটু তাকাতেই দেখলেন তাঁর স্ত্রীর চোখ লাল আর ফোলা। তার মনে কান্নাকাটিও হয়েছে। তিনি গিন্নির দিকে একটু কেক তুলে বললেন - নাও খাও।
গিন্নি বললেন - তুমি প্লিজ ন্যাকামিটা বন্ধ কর, সেই বিয়ের পর থেকে আজ বুড়ো বয়েস অবধি তোমার হাড়জ্বালানি ন্যাকামি দেখতে দেখতে আমার জীবন শেষ হয়ে গেল। তোমার ছেলে মেয়ে সবকিছু যোগাড়যন্ত্র করে না দিলে, আমি আজ আর রান্নাও করতাম না।
তাঁর মেয়ে হি হি করে হাসতে লাগল। ছেলেও মুচকি মুচকি হাসছে।
গিন্নি খেলেন না দেখে মিটি মিটি হেসে তিনি কেকের টুকরোটা নিজেই মুখে পুরে দিলেন। আহ অমৃত!
তাঁর স্ত্রীর যখন মনমেজাজ খুব ভাল হয় তখন তিনি এইভাবে কথা বলেন। ঠাণ্ডা, স্বাভাবিক গলায় কথা মানেই মুড গরম। তিনি জানেন। তাঁর স্ত্রীর হাতের রান্না অতি চমৎকার।বাইরে কোথাও খেয়ে তাঁর কখনও মন ভরেনা। তিনি এই কথাটা একদিন গিন্নিকে বলতে চান। কোনদিনও গুছিয়ে বলতে পারেন না।সবসময় কোনও না কোন একটা গুবলেট করে বসেন।
তাকিয়ে দেখলেন সবাই প্লেট সামনে নিয়ে তাঁর খাওয়া শুরু করার অপেক্ষায় বসে আছে।
তাঁর মনে হল, ভবিষ্যতে যদি মানুষের পরিবার বলে কিছু না থাকে তবে তাদের তা বড়ই দুর্ভাগ্য। মানুষের কাছে তার পরিবার একটা অসাধারণ ব্যাপার। আর তিনি খুব ভাগ্যবান যে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পরিবারটি তাঁর সঙ্গে আছে।
তিনি সবার দিকে তাকিয়ে বললেন - বহুদিন একসাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না, চলো না কাল সবাই মিলে কাছাকাছি কোথাও পিকনিকে যাই।
বেশ।
ReplyDelete