প্রচ্ছদ নিবন্ধ
সিনোসিলিকাফোবিয়া
চন্দ্রভানু
সম্পাদীকামহোদয়া যবে থেকে আমার মেসেঞ্জারে ক্রুজ মিসাইল হয়ে ঢুঁ মেরেছেন, সেদিন থেকে জাইথোলজি (zythology) নিয়ে খেলতে হচ্ছে। ছোটোবেলায় যেমন খলতে খেলতে জ্বরজারি বাঁধিয়ে বসতাম তেমনি জাইথোলজি নিয়ে খেলতে গিয়ে সিনোসিলিকাফোবিয়ায় (cenosillicaphobia) ভুগে ভুগে এক মহা জ্বালা উপস্থিত হয়েছে। মানে, এই ধরুন গেলাসে ঠাণ্ডা বিয়ার ঢেলেছি, কিন্তু পাছে গেলাস খালি হয়ে যায় সেই ভয়ে চুমুক দিতে ভয় পাচ্ছি। পাগলের প্রলাপ বলে মনে হচ্ছে তো? আমারও তাই মনে হচ্ছিল, পরে দিব্যজ্ঞানের গুঁতোয় জানা গেল গ্রিক শব্দ zythos হলো বিয়ার (আরও সঠিকভাবে বললে গেঁজানো) আর logos মানে যে জ্ঞান, সেই জ্ঞান তো সকলেরই আছে। অর্থাৎ কিনা বিয়ার সংক্রান্ত জ্ঞানই হলো জাইথোলজি, মতান্তরে গ্যাঁজানোর জ্ঞান, আর সিনোসিলিকাফোবিয়ার আক্ষরিক অর্থ শূন্য গেলাসজনিত ভয়। অগত্যা এই ভয় কাটাতে সিরিস এবং তাঁর জননী নিনকাসির শরণাপন্ন হই। সিরিসের সঙ্গে কিন্তু শিরীষকাগজের কোনও সম্পর্ক নেই এবং যদ্দুর জানি অন্যজন শিব্রামের কল্কেকাশির কোনও আত্মীয়া নন। বেশী পাঁয়তারা না করে খুলেই বলি তাহলে, সিরিস হলেন সুপ্রাচীন মেসোপটেমিয়ান সভ্যতায় বিয়ারের দেবী এবং তাঁর মাতৃদেবী নিনকাসি সুমেরিয় সভ্যতায় ঐ একই পদে পূজিতা হতেন। পৌরাণিক গল্পকথা ছেড়ে পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণে নজর দিলে দেখতে পাওয়া যায় পৃথিবীর সব থেকে পুরোনো অ্যালকোহলিক পানীয় এই বিয়ারের প্রথম লিখিত ইতিহাস উদ্ধার হয় অধুনা ইরান থেকে, যা কিনা খ্রিস্টের জন্মের চার হাজার বছরেরও বেশী পুরোনো। অথচ বিবর্তনের অঙ্গুলি নির্দেশে সেই ইরানেই এখন অ্যালকোহলিক বিয়ারের কেনাবেচা আইনত নিষিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ববিদ ম্যাকগোভার্নের (Patrick McGovern) গবেষণা অনুযায়ী প্রাচীন মিশরের গিজা শহরের বিখ্যাত পিরামিড তৈরীর সময় শ্রমিকদের প্রতিদিন মাথাপিছু নাকি চার লিটার করে বিয়ার বরাদ্দ ছিল। আবার ব্যাবিলনের সম্রাট হামুরাবির আমলে কিউনিফর্ম হরফে লেখা শিলালিপি থেকে জানা যাচ্ছে, বিয়ারে জল মেশালে উনি বিন্দাস কোতল করার ফরমান জারি করেছেন।
শুধু ইতিহাস কেন, নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহরে রাস্তার ঝাড়ুদারদের দৈনিক ভাতায় এখনও পাঁচ ক্যান বিয়ার বরাদ্দ, দেবী সিরিসের আশীর্বাদধন্য হতে গেলে এই পাঁচ ক্যানের কথাটা যথাসম্ভব পাঁচ কান করুন। ঝাড়ুদারদের কথা যখন এল, তখন পেশাগত সাম্য বজায় রাখতে বৈজ্ঞানিকের কথাও বলতে হয়। ১৯২২ খৃষ্টাব্দে ডেনমার্কের পদার্থবিজ্ঞানী নিলস বোর (Niels Bohr) নোবেল পুরস্কার পান আর সেই সম্মানে গর্বিত হয়ে সে দেশের বিয়ার কোম্পানি কার্লসবার্গ তাঁকে একটি বাড়ি উপহার দিয়ে বসে। কার্লসবার্গ বিয়ার ফ্যাক্টরির পাশে অবস্থিত বাড়িটির বৈশিষ্ট্য ছিল রান্নাঘরের কলে, কল খুললেই বিয়ারের আনন্দধারা চব্বিশ ঘন্টা।
খামির বা ঈস্ট (yeast) ব্যবহার করে বিভিন্ন খাদ্যশস্য অথবা ফলমূল গেঁজিয়ে (ferment) বা চোলাই করে তা থেকে তৈরী হয় ধরাধামের তামাম সুরাসার পানীয়। এ লেখা যেহেতু বিয়ার পান করে, থুড়ি, বিয়ার পান করা নিয়ে, তাই চট করে সংক্ষেপে জেনে নিই বিশ্ব-জনপ্রিয়তায় (জল এবং চায়ের পরে) তৃতীয় স্থানাধিকারী এই পানীয় তৈরীর ছলাকলা। বিয়ার তৈরীতে ব্যবহার হয় মূলতঃ যব বা বার্লি (barley), তবে যবের সঙ্গে কখনও সখনও ব্যবহার হয় চাল, গম, ভুট্টা মায় কাসাভা (cassava) অবধি। এখেনে ছোট্ট করে জানিয়ে রাখি, এই কাসাভা (এক প্রজাতির মূল) থেকেই আবার তৈরী হয় আমাদের অতিপরিচিত সাবুদানা বা সাগুদানা (tapioca)। বিয়ার তৈরীর পদ্ধতির সবিস্তার বর্ণনা করে পাঠককূলের মস্তিষ্ক ঘেঁটে দেবার কোনও সুপ্ত বাসনা আমার মধ্যে নেই, তবে কিছুটা উল্লেখ না করলে আবার অসম্পূর্ণতার দায়ে পড়তে হয়। বিয়ার তৈরীর যাত্রা শুরু হয় অঙ্কুরিত যব থেকে, অঙ্কুরোদ্গমের ফলে শস্যদানার ভেতরে তৈরী হয় বিভিন্ন ধরণের উৎসেচক (enzyme) আর এই অঙ্কুরিত যবদানা গরম হাওয়ায় শুকিয়ে নিলে তাকে বলে মল্টেড বার্লি (malted barley)। অতীতে বার্লি মল্ট করার জন্য ব্যবহার হতো কাঠের আগুনের চুল্লি। কিন্তু চুল্লির ভেতর সর্বত্র তাপমাত্রা সমান রাখতে পারত না এই কাঠের আগুন, যার ফলে বার্লিদানার মল্টিংও হতো অসমানভাবে, আর এর প্রভাব পড়ত বিয়ারের স্বাদের তারতম্যে। ইংল্যান্ডে শুরু হওয়া শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাপ উৎপাদনের জন্য ব্যাপকহারে কয়লার ব্যবহার শুরু হয় এবং মল্টিং-এর জন্যও অবশেষে কাঠের আগুনের জায়গা নেয় কয়লার আগুন। কয়লার আগুনের ব্যবহার শুরু হতে মল্টিং প্রসেসও সম্পন্ন হতে থাকে সর্বত্র সমানহারে আর বিভিন্ন ব্যাচে তৈরী বিয়ারের স্বাদের মধ্যেও তারতম্য কমে যায়। সময়ের সঙ্গে বিয়ার তৈরীর প্রত্যেকটি ধাপের পরিবর্তনে লক্ষ্য করা যায় বিজ্ঞানের উন্নতির পদক্ষেপ।
মল্টেড বার্লিকে গুঁড়ো করে নিয়ে গরম জলের সঙ্গে মণ্ড বানালে যবদানার মধ্যে থাকা শ্বেতসার (carbohydrate) উৎসেচকের প্রভাবে পরিণত হয় বিভিন্ন ধরনের শর্করায়। এই শর্করা কিন্তু আমাদের চিরপরিচিত চিনির থেকে রাসায়নিকভাবে আলাদা, যদিও স্বাদে চিনির মতোই মিষ্টি। শর্করার এই জলীয় দ্রবণে (wort) মেশানো হয় বিভিন্ন গাছের পাতা ও ফুল, শুধুমাত্র সংরক্ষক (preservative) হিসেবেই নয়, বিয়ারের তিতকুটে স্বাদ এবং তার চারিত্রিক সুবাস (flavour) আনার জন্যও বটে, এই পদ্ধতির বিলাতি নাম হপ (hop)। ঐ হপ মিশ্রিত শর্করা দ্রবণ ছেঁকে নিয়ে তাতে মেশানো হয় ঈস্ট, যা কিনা এককোষী ছত্রাক। এই ঈস্টের কাছেই থাকে বিয়ার তৈরীর আসল চাবিকাঠি। শর্করা দ্রবণে ঈস্ট মহানন্দে নিজের বংশবিস্তার করে এবং তার সঙ্গে তৈরী করে বিভিন্ন উৎসেচক, উৎসেচকের প্রভাবে বার্লির শর্করা গেঁজে উঠে তৈরী হয় অ্যালকোহল আর কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস। বিয়ারের গেলাসে যে ফেনা দেখা যায় তা এই কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের বুদবুদমাত্র। প্রায় দেড় হাজারেরও বেশী প্রজাতির ঈস্টের সন্ধান পাওয়া গেছে, যার মধ্যে অনেকগুলি আবার মনুষ্যসৃষ্ট, তবে সব রকমের ঈস্ট কিন্তু বিয়ার তৈরীতে কাজে লাগে না। হাজার হাজার বছর ধরে সভ্যতার বিবর্তনের ছোঁয়া পড়েছে বিয়ার তৈরীর পদ্ধতিতে, তবে সম্ভবত সবথেকে বেশী প্রভাব পড়েছে এই ঈস্ট নির্বাচনে, তাই ঈস্টকে বিয়ার তৈরীর ইষ্টদেবতা বললেও অত্যুক্তি হয়না। যাঁরা বিয়ারের নাম শুনলে নাক সিঁটকে বলেন, স্কচ-হুইস্কির কাছে বিয়ার কিস্যু নয়, তাঁদেরকে বলি, বিয়ার হচ্ছে গিয়ে স্কচের জনক। আজ্ঞে হ্যাঁ, হপ করার পরিবর্তে বিয়ারকে যদি সোজা পাতন (distillation) করা হয়, সোজা বাংলায়, উনুনে বিয়ার ফুটিয়ে তার বাষ্প সংগ্রহ করলে সেই থেকে জন্ম নেয় অ্যালকোহলসমৃদ্ধ স্কচ-হুইস্কি। সাধে কি মহাজনেরা বলেছেন, beauty is in the eye of beer holder. এই দ্যাহো, হপ লিখে লিখে হাঁপিয়ে গেলাম, অথচ এটা বলতে ভুলে গেছি যে, হপ আদতে একটি গুল্মজাতীয় ফুলগাছের চলতি নাম, দাঁতভাঙা ল্যাটিনে একে ডাকা হয় হিউমুলাস লুপুলাস (Humulus lupulus) নামে। হপ নামটি যদিও বিলিতি এনার একটি সুন্দর পোষাকি বাংলা নাম আছে, আজিঘ। এখেনে এটা জানিয়ে রাখা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, আজিঘ আবার উচ্চবংশীয় কুলীন শ্রীল শ্রীযুক্ত শ্রীমান গঞ্জিকা গাছের নিকটাত্মীয়! আজকাল অবিশ্যি বিয়ার তৈরীতে হপ ছাড়াও অন্যান্য গাছেরও ফুল পাতা ব্যবহার হয়ে থাকে, তবে প্রক্রিয়াটির নাম সেই হপই রয়ে গেছে।
গেঁজানোর গাজন শুনে এখনও অবধি যাঁদের গলা শুকিয়ে যায়নি বা প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়নি, তাঁদের আরেকটু তথ্য দিলে ক্ষতিবৃদ্ধির বিশেষ সম্ভাবনা দেখছিনে। আপনি বিয়ার রসিক হোন বা না হোন বিয়ারের প্রকারভেদ জানাটা কিন্তু অত্যন্ত জরুরী, নিদেন বন্ধুদের জ্ঞানসুধাধারা বিতরণে কাজে লাগতে পারে। ফার্মেন্টেশনের সময় কিছু ঈস্ট শর্করা দ্রবণের উপরিভাগে ভেসে থেকে বংশবৃদ্ধি করে, কিছু ঈস্ট আবার ডুবে ডুবে জল খাওয়ার মতো দ্রবণের তলানিতে থেকে বংশবৃদ্ধি করতে পছন্দ করে (যদিও ফার্মেন্টেশনের শেষে সমস্ত ঈস্ট নীচেই থিতিয়ে পড়ে)। প্রথম প্রকারের ঈস্টসৃষ্ট বিয়ারকে বলে এল্ (ale) আর অন্যটির পরিচিতি ল্যাগার (lager) নামে, মোটামুটিভাবে সমগ্র বিয়ার প্রজাতিকে এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এই দুজাতের ঈষ্টের কাজের পরিবেশও আবার ভিন্ন; এল্ তৈরি করার ঈষ্ট, যার পোষাকি ল্যাটিন নাম Sacchromyces cervisiae, কাজ করে মোটামুটি ১৬ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে এবং প্রাথমিকভাবে ফার্মেন্ট করতে প্রায় দিন সাতেক সময় নেয়। Sacchromyces patorianus ল্যাগার তৈরীতে সময় নেয় প্রায় দেড় থেকে দুমাস এবং এর পছন্দের তাপমাত্রা দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও নীচে। আধুনিক গবেষণায় জানা গেছে এল্ তৈরীর ঈস্ট পেডিগ্রিওয়ালা বিশুদ্ধ প্রজাতির, কিন্তু ল্যাগারের ঈস্ট আদতে বর্ণসঙ্কর, তাই খৃস্টিয় পনেরোশ বছরের আগে ল্যাগার বিয়ারের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। তবে কয়লার আগুনের ব্যবহারকে যদি বিয়ার তৈরীর একটা মাইলস্টোন ধরা যায়, তাহলে ল্যাগার বিয়ার তৈরীর ক্ষেত্রে রেফ্রিজারেশনের আবিষ্কার ছিল অন্যতম যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বিয়ার রসিকেরা বিয়ারের স্বাদ এবং সে স্বাদের রেশ (after taste) এই দুইয়ের ওপর ভিত্তি করে এল্ আর ল্যাগারের পার্থক্য অনায়াসে বলে দিতে পারেন। প্রকৃতির খেয়ালে এল্ তৈরীর ঈস্ট অনেক বেশী অ্যালকোহল সহ্য করতে সক্ষম, তাই এল্-এ অ্যালকোহলের ভাগ অনেকক্ষেত্রেই ল্যাগারের থেকে বেশী হয়। হয়ত সেজন্যই সেই কোনওকালে সেক্সপিয়র সাহেব বলে গেছেন "for a quart of ale is a dish for a king", দুপাত্তর এল্ আর রাজভোগে কোনও পার্থক্য নেই। রঙের বিচারে ল্যাগার সাধারণত হালকা সোনালী থেকে গাঢ় হলদেটে রঙের হয়, সেখানে এল্-এর রঙ আরও গাঢ় হয়ে কালচে লাল, যাকে বলে অ্যাম্বার এল্ (amber ale), এমনকি আরও কৃষ্ণবর্ণের হতে পারে। ভারতীয় উপমহাদেশে বেশীরভাগ বিয়ার প্রস্তুতকারক সংস্থা ল্যাগার বিয়ার তৈরী করে থাকে, বস্তুত সারা বিশ্বে ল্যাগারের চাহিদাই বেশী। তবে মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতার কারণে এবং কেরামতিতে আজকাল শুধুমাত্র রঙ বা অ্যালকোহলের পরিমাণ দেখে এল্ আর ল্যাগারের পার্থক্য করা ক্রমেই শক্ত হয়ে পড়ছে।
অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে বিয়ারের আগমন ঘটে ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের হাত ধরে এবং আরও পাকাপাকিভাবে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জয়লাভের পরে। এই কালা নেটিভদের দ্যাশে সাহেবরা যখন গরমে হেঁদিয়ে যেতেন, তখন দু-এক গেলাস ঠাণ্ডা বিয়ার বোধকরি তেনাদের শরীরে নতুন জোশের জোয়ার নিয়ে আসত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই উপমহাদেশে বিয়ার ছিল দুর্মূল্য, কারণ ইংল্যান্ড থেকে প্রায় ছয়মাস যাবৎ জাহাজ যাত্রা শেষে যখন বিয়ার এসে পৌঁছতো ততদিনে বহু বিয়ারের পিপে জাহাজ যাত্রার ধকলে ঠোকাঠুকি লেগে ভেঙে নষ্ট হয়েছে; আবার, ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে বিয়ার খারাপ হওয়ার ফলেও অনেক বিয়ার নষ্ট হতো। ফলতঃ বেঁচেকুচে থাকা বিয়ারের দাম অগ্নিমূল্যে না বেচলে পড়তায় পোষাত না। অবশেষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উৎসাহে লন্ডনের জর্জ হজসন (George Hodgson) ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে তৈরী করেন পেইল এল্ (Pale ale); যা পরবর্তীতে পরিচিতি পায় ইন্ডিয়ান পেইল এল্ (Indian pale ale বা সংক্ষেপে IPA) নামে। জর্জ সাহেবের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল এমন এক বিয়ার বানানোর, যা ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসার ছয়মাস জাহাজ যাত্রার পরেও ব্যাকটিরিয়ার আক্রমণে নষ্ট হবে না। জর্জসাহেব সেইসময়ে লন্ডনে প্রচলিত অক্টোবর এল্ (October ale) নামে একটি জনপ্রিয় এলের স্বাদে অনুপ্রেরিত হয়ে বেশী অ্যালকোহল এবং অতিরিক্ত হপ যুক্ত এই ইন্ডিয়ান পেইল এল্ তৈরী করেন, pale শব্দ যোগ করা হয় এই এল্-এর হালকা রঙের জন্য। জানা যায়, ভারতে বসবাসকারী ধনী ইংরেজদের কাছে এই এল্ ছিল যথেষ্ট জনপ্রিয়। তবে IPA তৈরী করার কয়েক বছরের মধ্যেই হজসনের দুই ছেলে বুড়ো বাপের থেকে ব্যবসা ছিনিয়ে নেয় এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে বিভিন্ন বৃটিশ উপনিবেশে হজসন বিয়ার শুরু করে একচেটিয়া ব্যবসা। সম্ভবতঃ বিশ্বের প্রথম গ্লোবাল বিয়ার ব্র্যান্ড এই হজসন, যাদের লোগো ছিল একটি লাল রঙের ত্রিভুজ। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হজসন কোম্পানি অবশেষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তোয়াক্কা না করে নিজেই সরাসরি বিভিন্ন বৃটিশ উপনিবেশে ব্যবসা শুরু করে। এর ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লভ্যাংশ কমতে থাকে এবং কোম্পানির কর্তারা বিকল্প অনুসন্ধানে মনোযোগী হন। ১৮২১ খৃস্টাব্দের শেষাশেষি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্তাব্যক্তি Campbell Marjoribanks ইংল্যান্ডের বার্টন-অন-ট্রেন্ট শহরের একটি বিয়ার কোম্পানির মালিক স্যামুয়েল অ্যালসপকে (Samuel Allsop) চ্যালেঞ্জ দেন হজসন বিয়ারের থেকেও ভালো স্বাদের বিয়ার বানানোর। কয়েকমাসের মধ্যেই অ্যালসপ তৈরি করেন আরও ভালো স্বাদের IPA, ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জানুয়ারি তৎকালীন খবরের কাগজ ক্যালকাটা গেজেটেও এই IPAর গুণগান করে খবর ছাপা হয়। অনুমান করা যায়, স্বাদে হিট দামে ফিট এই IPA ওয়াজ সেলিং লাইক হট কচুরিস। অ্যালসপের প্রায় রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বার্টন শহরের আরও অনেক বিয়ার তৈরীর কোম্পানি এই অলিখিত প্রতিযোগিতায় যোগ দেয় এবং এর ফলে অবশেষে হজসনের একচেটিয়া ব্যবসার অবসান হয়।
ফুল্লরার বারোমাস্যা বলুন বা ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত পাদ্রি সাহেব উইলিয়াম ওয়ার্ডের লেখা (A view of the history, literature and religion of the Hindoos) বলুন, তৎকালীন ছাপোষা বাঙালীদের খাদ্যাভাসে পানীয় বলতে কিন্তু জল, ডাবের জল, ঘোল বা দুধ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। অথচ বঙ্কিমচন্দ্রের 'বাবু' বা ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নব বাবু বিলাস' পড়লে দেখা যায় যে, উচ্চবিত্ত বাঙালিবাবুরা সবিশেষ পানপটু ছিলেন। তবে অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষাভাষী রাজ্যের আদিবাসীদের মতো বাংলার আদিবাসী সমাজেও বোধকরি তালের রস এবং মহুয়া থেকে বানানো অ্যালকোহলিক পানীয় চালু ছিল। তার মানে বর্তমান সামাজিক অবস্থার মতোই তখনকার মধ্যবিত্ত বাঙালিও এ রসে বঞ্চিত ছিল। বাঙালির বিয়ার পানের সপক্ষে প্রথম লিখিত ঐতিহাসিক রেফারেন্স পাওয়া যায় ১৮৪৩ খৃস্টাব্দে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ওরিয়েন্টাল ম্যাগাজিনের পাতায়। ডিরোজিওর নেতৃত্বে ইয়ংবেঙ্গল মুভমেন্টের যে সূত্রপাত তার পরিপ্রেক্ষিতে ঐ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল "... (young Bengalis) cutting their way through ham and beef, and wading to liberalism through tumblers of beer". অর্থাৎ, পশ্য পশ্য, তরুণ বাঙালিরা নির্দ্বিধায় গরু-শুয়োর হজম করিয়া বিয়ারের গেলাস হস্তে উদারনৈতিক পথে অগ্রসর হইতেছে। অতএব, দেখা যাচ্ছে শাক্ত বাঙালি যতই পঞ্চ ম-কারে পটু হোক না কেন, বিয়ারের নোলাটি কিন্তু তাঁদের বৃটিশদের থেকেই পাওয়া।
বিয়ারপ্রেমীদের কাছে দুঃখের কথা এই যে, ইংরেজদের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতেও IPA বা ইন্ডিয়ান পেইল এলের বিলুপ্তি ঘটে, যদিও ইংল্যান্ড-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এখনও এর কদর বেড়েছে বই কমেনি। অথচ ওদিকে আবার সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক শহরের Sixpoint brewery নামে একটি সংস্থা Bengali নামে একটি IPA ব্র্যান্ড বাজারে ছেড়েছে। ইদানীং শোনা যাচ্ছে ছোটো ছোটো কিছু ভারতীয় কোম্পানিও IPA বানানো শুরু করেছে, যদিও ভারতীয় উপমহাদেশের ল্যাগারখোর সমাজ একে মেনে নেবে কিনা জানা নেই। প্রায় স্বচ্ছ হালকা সোনালি বর্ণের এল্ যদি পেইল এল্ হয়, তবে তার অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটি স্টাউট (stout) নামে পরিচিত। কাঁচের গেলাসে স্টাউট ঢাললে দেখা যাবে তা প্রায় অস্বচ্ছ, ঘোর বাদামি থেকে প্রায় কৃষ্ণবর্ণের, অ্যালকোহলের পরিমাণও এতে কিঞ্চিৎ বেশী থাকে। সাধারণত আয়তন হিসেবে বিয়ারে অ্যালকোহলের পরিমাণ ৯% এর নীচেই থাকে, তবে এ নিয়মের ব্যতিক্রমী এমন অনেক ইউরোপিয়ান বিয়ার আছে যাতে ১৩% অবধি অ্যালকোহল পাওয়া যায়। বিয়ারে অ্যালকোহলের পরিমাণ নিয়েই যদি কথা ওঠে, তবে সেখানে জ্বলজ্বল করছে আইরিশ কোম্পানি Brewmeister-এর তৈরী Snake venom বিয়ার, শুধু নামে নয় কার্যতই এ যেন সর্পবিষ, এতে অ্যালকোহলের পরিমাণ ৬৭.৫%! যেখানে হুইস্কি, ভডকা জাতীয় কড়া পানীয়তে অ্যালকোহলের পরিমাণ থাকে ৪২.৫%।
এল্ নিয়ে এত কিছু বলার পর ল্যাগার নিয়ে কিছু না বললে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হতে হয়। ল্যাগার শব্দটি কিন্তু আদতে জার্মান শব্দ lagern থেকে এসেছে, যার অর্থ জমিয়ে রাখা (to store)। ভাঁটিতে ল্যাগার তৈরী হবার পর বেশ কয়েকমাস যাবৎ একে শীতঘুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, অর্থাৎ খুব কম তাপমাত্রায় একে স্টোর করে রাখা হয়। এভাবে কয়েক হপ্তা রাখার ফলে এতে অত্যন্ত ধীর গতিতে অতিরিক্ত ফার্মেন্টেশন (secondary fermentation) ঘটে। ল্যাগার স্টোর করতে যদি কাঠের পিপে ব্যবহৃত হয় তাহলে কাঠের ট্যানিন বা ভ্যালিনিনের সঙ্গে বিয়ারের জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিয়ারে বিভিন্ন নতুন ফ্লেভার তৈরী হয়, একে বলে এজিং (aging)। তাই ঐতিহ্যগতভাবে এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কাঠের পিপেতে এজিং করা বাঞ্ছনীয়। বহুজাতিক সংস্থাগুলি অবশ্য ল্যাগার তৈরীর ক্ষেত্রে কাচের বোতলেই বিনা এজিং-এ শুধুমাত্র সেকেন্ডারি ফার্মেন্টেশন করে সেই কাজ সারছে। এখানে একটা কাজের ইনফরমেশন দিয়ে রাখা ভালো, অনেক রেঁস্তোরা বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে "এখানে ড্রট (draught) বিয়ার পাওয়া যায়" এই বলে, কাচের বোতল বা অ্যালুমিনিয়ামের ছোট ক্যানের বদলে কাঠের পিপে থেকে গেলাসে ঢেলে যে বিয়ার পরিবেশন করা হয় সেটাই ড্রট (ভিন্ন উচ্চারনে ড্রাফ্ট) বিয়ার। তবে এখন কাঠের পিপের বদলে স্টেইনলেস স্টিলের পিপে ব্যবহার হয়, যার মধ্যে বিয়ারের সঙ্গে থাকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা নাইট্রোজেন গ্যাসের উচ্চচাপ। সাধারণত কোনও রেস্তোরাঁর আশেপাশে বিয়ার তৈরীর ভাঁটি থাকলে সেখানে সদ্যোজাত ড্রাফ্ট বিয়ার পাবার সম্ভাবনা বেশী। সুতরাং, হে সরলমতি পাঠকপাঠিকাগণ, কদাপি বিজ্ঞাপনের চটকে ঠকিবেন না, ড্রট বা ড্রাফ্ট কোনও বিশেষ প্রকারের বিয়ার নয় বরং পরিবেশনের প্রকারভেদে (সাধারণতঃ সদ্যোজাত) বিয়ারের নামান্তর মাত্র। বলা বাহুল্য যে, এই ড্রাফ্ট বিয়ার কিন্তু এল্ বা ল্যাগার দুটোই হতে পারে।
এ জগতে বিয়ার পান করার লোকের যেমন অভাব নেই, তেমনি বিয়ার ত্যাগ করেছেন এমন লোকও বিরল নয়। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ল, গপ্পোটা বলি শুনুন। বেলজিয়ামের কোন এক বিয়ার বারে এক ব্যক্তি গিয়ে তিন গেলাস বিয়ার চাইলেন, বিয়ার এল। উনি তরিবৎ করে প্রত্যেকটি গেলাস থেকে একচুমুক একচুমুক করে শেষে তিনটে গেলাসই খালি করে ফেললেন। পরের দিন ঐ একই সময়ে একই ব্যক্তি অকুস্থলে হাজির, সেই তিন গেলাস বিয়ার, ম্যায়খানার নতুন সাকি এবার একটু অবাক। তৃতীয় দিন ঐ একই ঘটনা ঘটতে আমাদের নয়া বারটেন্ডার আর নিজেকে সামলাতে না পেরে বলে ফেলে, দাদা, বলছি কি আপনি একসঙ্গে তিন গেলাস বিয়ার না নিয়ে একটা শেষ হলে পর একটা নিন না, সবাই তো ঠাণ্ডা বিয়ারই পছন্দ করেন। লোকটি তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করে, জানো ভায়া, আমরা তিন ভাই। কিন্তু তিন ভাই তিনটে আলাদা দেশে থাকি, তাই আমরা ঠিক করেছিলাম আমরা আলাদা থাকলেও যখনই আমাদের মধ্যে কোনও একজন বিয়ার পান করবে, তখন সে একইসঙ্গে অন্য দুই ভাইদের জন্যও স্বাস্থ্যপান করবে। এই তিনটে গেলাসের একটা আমার আর বাকি দুটো আমার দুভাইয়ের জন্য, তাই আমাকে একসঙ্গে তিনটে গেলাস নিতে হয়। এমন অসাধারণ ভাতৃপ্রীতি দেখে আমাদের সাকি ভায়া খুবই মুগ্ধ, যাকে বলে এক্কেরে অভিভূত। এরপর থেকে ঐ ভদ্রলোক এলেই খাতিরটা একটু বেশী হতে লাগল। এভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর একদিন ঐ ভদ্রলোক এসে ছলছল চক্ষে দু গ্লাস বিয়ারের অর্ডার দিলেন। আমাদের সাকি ভায়া দরদী মানুষ, ওনার গেলাসের বিয়ার শেষ হলে পর সহানুভূতি জানাতে কাছে গেলেন, দাদা আপনার দুঃখ আমি বুঝতে পারছি, কেউ তো আর চিরকাল থাকে না, জন্মিলে মরিতে হবে, বাসাংসি জীর্ণানি ইত্যাদি ইত্যাদি, এবং অবশেষে জিজ্ঞেস করেই ফেল্লে, তা আপনার কোন ভাই মারা গেলেন? ভদ্রলোক একটু বিমর্ষ হয়ে বললেন, না হে, ভাইয়েরা সবাই ঠিকই আছে, আমিই বিয়ার ছেড়ে দিয়েছি।
সেই বেলজিয়ামের কাহিনী যখন শুনলেন তখন এটাও শুনে রাখুন, ইউরোপ মহাদেশে বেলজিয়াম এমন একটি দেশ যেখানে প্রায় একহাজার ছ'শ বিভিন্ন জাতের বিয়ার পাওয়া যায়। হতে পারে বেলজিয়ামে বিশ্বের সর্বাধিক বিভিন্ন প্রকারের বিয়ার পাওয়া যায়, কিন্তু কখনও কখনও মায়ের কাছেও মাসির গল্প করতে হয়। কেন জানেন? কারণ, প্রতি বছর মাথা পিছু বিয়ার পানের কম্পিটিশনে বেলজিয়ামকে বাইশ নম্বরে ফেলে প্রথম স্থান অধিকার করে বসে আছে বেলজিয়ামের পড়শির পড়শি দেশ চেক রিপাবলিক (পূর্বতন চেকোস্লোভাকিয়ার অংশ)। চেক করে দেখে নিতে পারেন চেক রিপাবলিকের একজন মানুষ বছরে গড়পড়তা প্রায় ১৪২ লিটার বিয়ার পান করে থাকেন। এহেন তথ্য বোধকরি গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে ছাপার যোগ্য। ও হ্যাঁ, গিনেস বলতে আবার মনে পড়ল, এ হলো বিখ্যাত আইরিশ কোম্পানি Guiness Brewery এবং এদের তৈরী স্টাউট বিয়ার বিশ্বপ্রসিদ্ধ। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই কোম্পানির বিয়ার সর্বাধিক বিক্রি হয় নাইজেরিয়ায়, নিজের দেশ আয়ারল্যান্ডে নয়। সেইজন্য বোধহয় বাংলায় প্রবাদ আছে, কোথাকার বিয়ার, থুড়ি, জল কোথায় গড়ায়।
এই গিনেস কোম্পানির বিয়ার এতই খানদানি যে একে নিয়ে একটি মজার গল্প বাজারে চালু আছে। কোনও একসময় সমস্ত নামকরা বিয়ার কোম্পানির কর্ণধারেরা নাকি ব্যবসা সংক্রান্ত একটি আলোচনাসভায় মিলিত হন। মিটিংয়ের শেষে খানাপিনার সময় প্রত্যেকে বিয়ার অর্ডার দিলেন, স্বাভাবিকভাবেই সবাই নিজের নিজের কোম্পানির তৈরী বিয়ারের অর্ডার করলেন। যেমন বাডওয়াইজারের বড়কর্তা বাডওয়াইজার অর্ডার দিলেন, টুবর্গের ম্যানেজার টুবর্গ চাইলেন ইত্যাদি। কিন্তু গিনেসের মালিক চাইলেন কোকাকোলা, উপস্থিত সকলেই অবাক, ব্যাপারটা কি? সবাই চেপে ধরলেন ওনাকে, কি ব্যাপার মশাই? আপনি গিনেস নিলেন না যে বড়ো? যেন একপ্রকার অপ্রস্তুত হয়েই উনি উত্তর দিলেন, দেখলাম আপনারা কেউ বিয়ার নিচ্ছেন না, আমি আর কোন মুখে গিনেসের কথা বলি।
তা গিনেসের বিয়ার না পেলেও ক্ষতি নেই, অন্য যেকোনও বিয়ারে গলা ভেজাতে পারেন। কারণ, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় জানা গিয়েছে বিয়ার আদতে স্বাস্থ্যকর পানীয়, ওয়াইনের চাইতেও বেশী প্রোটিন আর ভিটামিন বি এতে আছে। সাদা বা হলদে রঙের উদ্ভিজ্জ দ্রব্যে যে সকল রঞ্জকপদার্থ পাওয়া যায় তাদেরকে একত্রে বলে ফ্ল্যাভোনয়েড (flavonoid), আর বিয়ারে এই ফ্ল্যাভোনয়েড রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে যা আসে হপ থেকে। এসমস্ত ফ্ল্যাভোনয়েড মানুষের শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, ঠিক যেমন ভিটামিন সি এবং ভিটামিন ই করে থাকে। গবেষকরা বলছেন নিয়মিত স্বল্প পরিমাণে বিয়ার পান করলে প্রস্টেট ক্যানসার থেকে শুরু করে ডায়াবেটিস, রক্তাল্পতা, কিডনির পাথর মায় হার্ট অ্যাটাক অবধি বিবিধ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়, উপরন্তু শরীরের হাড়গোড় হয় মজবুত। তবে কিনা শাস্ত্রে বলেছে সর্বমত্যন্ত গর্হিতম, অর্থাৎ কিনা কোনওকিছুর বাড়াবাড়ি ভালো নয়। তাই কবি (কোন কবি জিজ্ঞেস করে অধমকে লজ্জা দিবেন না) লিখেছেন -
অতএব হে সুধীজন,
আপ্তবাক্য রাখিয়া স্মরণে
বিয়ার সেবন কর
নিয়মিত স্বল্প পরিমাণে।
তবে শুধু স্বাস্থ্য কেন, সৌন্দর্যায়নেও বিয়ারের উপস্থিতি সর্বঘটে কাঁঠালি কলার মতো, অনেক বিউটি টিপস্-এ স্নানের সময় বিয়ার দিয়ে চুল ধোয়ার কথা বলা হয়, বিশেষতঃ যাঁদের চুলে জট পড়ার প্রবণতা বেশী রয়েছে। ফার্মেন্টেশনের পরেও বিয়ারের মধ্যে থেকে যায় স্বল্প পরিমাণে স্টার্চ বা শ্বেতসার বেঁচে থাকে এবং বিয়ার দিয়ে চুল ভিজিয়ে ধুয়ে নিলে প্রত্যেকটি চুলের ওপর এই স্টার্চের একটা সূক্ষ্ম আস্তরণ পড়ে যায়, যা চুলকে জটমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। বিয়ারের চুলচেরা বিচার ছেড়ে বরং বিয়ার উৎসবের দিকে নজর দেওয়া যাক। বিয়ার পান করা যে শুধুমাত্র নেশা করার জন্য নয় বরং তার থেকেও আরও বেশী আনন্দ উদ্রেককারী অনুভূতির জনক, বোধকরি সেইটে বোঝার জন্য সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিয়ার উৎসবের দিকে তাকানো উচিত। জার্মানি, ইংল্যান্ড-সহ বহু ইউরোপিয়ান দেশে, ওদিকে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিল, চিলি, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর বা কলম্বিয়াতে বছরেরবিভিন্ন সময় বিভিন্ন শহরে বিয়ার উৎসবে শয়ে শয়ে মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন। আপনার কাছে যদি একসেকেন্ডে বিশ্বভ্রমণের কোনও উপায় থাকত, তাহলে দেখতে পেতেন যেকোনও মুহূর্তে প্রায় পাঁচ কোটি লোক এই আনন্দধারায় মেতেছে ভুবনে। আজ্ঞে হ্যাঁ, পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে জানা গেছে প্রতি সেকেন্ডে বিশ্বের সমগ্র জনসংখ্যার প্রতি হাজার জনে সাতজন লোককে মাতাল অবস্থায় পাওয়া যায়।
জানি জানি, আপনারা এই বিয়ারের গেঁজানো গজল্লা পড়ে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছেন। তবে কেটে পড়ার আগে, খাস কোলকাত্তাইয়া কাহানি না শুনলে এই বিয়ারের পাঁচালি পড়ার পুণ্যটাই নষ্ট। কোলকাতায় কালীপুজোর সময় নতুন নতুন কলেজে ঢোকা ছেলে-ছোকরারা বিয়ার সেবনের কলজে পায়। সেরকমই কোনও এক কালীপুজোর রাতে দুই কলেজ পড়ুয়া বন্ধু আকন্ঠ বিয়ার-বিহার সেরে রাস্তা দিয়ে টলতে টলতে যাচ্ছে। এমন সময় সামনে পড়েছে কালীপুজোর এক প্যান্ডেল, মণ্ডপে বিরাজমানা মাকালীর বিগ্রহ দেখে এক বন্ধুর হঠাৎ ভক্তিযোগ জেগে ওঠে, সে দাঁড়িয়ে পড়ে উদ্বাহু হয়ে করজোড়ে বলে, মা, মাগো, আমাদের একটু দেখো মা। অন্য বন্ধুটির কানে মা শব্দটি পৌঁছতে সেও তখন জড়িত কন্ঠে বলে ওঠে, আমাকেও একটু দেখবেন কাকিমা।
1. Ancient Wine: The Search for the Origins of Viniculture, Patrick McGovern,Princeton University Press, 2003
2. https://www.factslides.com/s-Beer
3. A view of the history, literature, and mythology of the Hindoo, William Ward, Serampore Mission Press, 1818
5. Studies in Bengalee Literature I, S. Mukerjee, Hindustan Review, May 1907, p 480
0 comments: