The art of the actor is made up of speech and bodily movement... as in music, the correct, precise, and pure striking of each single tone is the foundation of all further artistic execution, so in the art of the actor the clean and perfect pronunciation of each word is the basis of all higher recitation and declamation... By recitation is understood a delivery which... lies midway between cold, quiet speech and highly excited speech. The auditor must feel that.... the speech is objective. (The Purpose of Playing: Modern Acting Theories in Perspective By Robert Gordon)
গর্ডনের গ্রন্থে উদ্ধৃত গয়টের বিখ্যাত মন্তব্য দিয়ে শুরু করতে চাইছি রচনা, তার অন্যতম কারণ হল, আবৃত্তি সংগীত আর অভিনয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে এটি একটি দিকনির্দেশক বাণী বলে আমার মনে হয়। যাঁরা আবৃত্তি শিল্পের সঙ্গে মনে প্রাণে জড়িয়ে আছেন তাঁরা কতটা মানবেন আমি জানি না, আমার মনে হয় আবৃত্তি বেচারি শিল্প হিসেবে নিতান্তই দুর্ভাগা। নিশ্চয় এমন বেশ কিছু মানুষ আছেন যাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে এর চর্চা করে থাকেন, কিন্তু তার বাইরে একটি বড় অংশের ধারনা, আবৃত্তি করতে গেলে শেখবার তেমন কোনও দরকার হয় না, কবিতা (বা গদ্য) মোটামুটি উচ্চারণে মানে বুঝে পড়ে গেলেই চলে। আমি কোন কোন অনুষ্ঠানে মন্ত্রী সান্ত্রিদের কবিতা পাঠ করতেও দেখেছি, অভিনয় বা গানে তাঁরা এতটাই সাহসী হবেন বলে মনে হয় না। বলে রাখা দরকার, একটা অনুষ্ঠানে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য আবৃত্তি করে বেশ চমকে দিয়েছিলেন, আবার বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর আবৃত্তি একেবারেই দাঁড়ায়নি। তার বাইরেও, এই শিল্পের প্রথম ধাপ যাঁরা তৈরি করেন, সেই কবিরা সাধারণত একে একেবারেই পছন্দ করেন না। তাঁদের মতে, আমি লিখেছি লিখেছি, অন্য একজন আবার সেটা ইনিয়ে বিনিয়ে পড়বে, আর সেটা আমায় সহ্য করে যেতে হবে – এ মেনে নেওয়া যায় না। এটা আপাতদৃষ্টিতে একটু অদ্ভুত বলে মনে হয়। যাদের বলতে পারি পরনির্ভর শিল্প, অর্থাৎ অন্য কোন শিল্পের ওপর ভর করে যারা দাঁড়িয়ে থাকে, যেমন ধরা যাক বাক্য নির্ভর গান বা নাটক – সেখানে মূল শিল্পটি যিনি তৈরি করেছেন, অর্থাৎ সাহিত্যিক, তিনি যে সব সময় তার সংগীতরূপ বা নাটকরূপ পছন্দ করছেন এমনটা নয়, কিন্তু প্রায় কখনই তিনি এমন অভিমান নিয়ে বসে থাকছেন না যে ওই শিল্পের নাক গলানো আমার দরকার নেই, আমি যা লিখেছি ছাপা রূপে তা যে ভাবে আছে তাই আমার কাছে যথেষ্ট। নাটকের চূড়ান্ত মোক্ষ হল অভিনয়ের মঞ্চ, গানের চূড়ান্ত লক্ষ্য সুর সহযোগে তার উপস্থাপনায় – এ কথাকে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয়, কিন্তু কবিতা তার পূর্ণতা পায় আবৃত্তির মধ্যে, এমন মত চালু আছে বলে শুনিনি কখনো।
কবিরা মনে রাখেন কিনা জানি না, সাহিত্যের ইতিহাসের অনেকখানি অংশ কিন্তু উপস্থাপনার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সেলিম আল দীন যেমন বলেছিলেন, ছাপাখানা আবিষ্কৃত হবার আগে পর্যন্ত যে কোন সাহিত্যই ছিল নাটক, উপস্থাপনার মধ্যে দিয়েই তারা উপভোক্তার সঙ্গে সংযোগ তৈরি করত। যদি বাংলা সাহিত্যের কথা ভাবি, সেই প্রাচীন থেকে প্রাক আধুনিক যুগে অবশ্য নাট্য, গান আর আবৃত্তির মধ্যে ফারাক খুব স্পষ্ট ছিল না। পাঁচালী যে ভাবে পড়া হয়, তাকে গান বলব না আবৃত্তি বলব? যদি আবৃত্তি হিসেবে ধরি, তাহলে তো বলা যায়, চর্যাপদ থেকে ভারতচন্দ্র সকলের লেখা মূলত আবৃত্তিই করা হত, পুথি নামক লিখিত আকার থাকত আর কটি? সাহিত্য বলুন সাহিত্য, কাব্য বলুন কাব্য – এদের ধরনের একটা বদল এল ছাপাখানা আসার পরে। কবি যা লিখেছেন, ছাপার হরফে হুবহু তা চলে যাচ্ছে পাঠকের কাছে, মধ্যবর্তী কারুর দরকার হচ্ছে না সেখানে। সেই সূত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। উপস্থাপনানির্ভর শিল্পে যা হয়ে থাকে, উপস্থাপকের স্মৃতিভ্রংশতার কারণেই হোক, আর তাঁর সচেতন বিবেচনার জন্যেই হোক, মূল রচনাটা খানিক খানিক বদলে যেতে পারে, যায়ও, ছাপার হরফ তাকে একটা স্থায়িত্ব দিল। যে সাহিত্য বা কাব্য যত জনপ্রিয় তার বিকৃতি তত বেশি হয়েছে। যেমন ধরুন, কৃত্তিবাসী রামায়ণের ভাষা আদিতে কী ছিল তা জানবার কোনও উপায় আজ আর নেই, কথকদের মুখে মুখে এতটাই বদলে গেছে সে। সবচেয়ে বড় কথা, যা ছিল এতকাল শ্রোতার উপভোগের জন্যে, বাচিক শিল্পীর মারফৎ যা পৌঁছোত সেই শ্রোতার কাছে, বাচিক শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গি, লেখাটি বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা রূপ পেত উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে, তা অদৃশ্য হয়ে রচনাটি এখন পাঠকের উপভোগের বিষয় হয়ে দাঁড়াল।
কবিতা সেই শর্তে পাল্টে ফেলল নিজেকে। নানা সামাজিক রাষ্ট্রীক এবং অবশ্যই মানসিক কারণে অনেক মানুষের সামূহিক উপভোগের শিল্প থেকে সে হয়ে উঠতে চাইল একক মানুষের নিভৃত পাঠের সামগ্রী, তার মধ্যেও চলে এল গভীর নির্জনতা, ভীড়ে যার সংবেদন নষ্ট হয়। এই পর্বান্তরের দীর্ঘ ইতিহাস আছে, আবার হা আমলের কবিতাও সব সময়েই সেই গভীর নির্জনতাকে নিয়ে চলেছে এ কথা বললে ভুল হবে, কিন্তু বাংলা কবিতার অন্যতম জোরালো বৈশিষ্ট্য হয়ে এলো এই ধরন, বর্ণনার থেকে যে নিজেকে সরিয়ে আনতে চায় প্রতিক্রিয়ার দিকে, যার সঙ্গে আলোছায়ার মত মিশে আসে নানা ধরনের বিমূর্ততা। কবি মানুষেরা এ ব্যাপারে একটু অভিমানীও হয়ে পড়লেন, বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া যে কোনো নাটককার যেমন নাটক লেখার সময় থেকেই অপেক্ষা করে থাকেন সে নাটকের মঞ্চায়নের জন্যে, কবিরা অনেকেই তেমন করে উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে তাঁর লেখাটি পৌঁছাক তা চাইলেন না। আর এই থেকেই জন্ম নিল কবিদের সঙ্গে আবৃত্তিকারদের বিরোধ।
এই সূত্রে আরও দু একটা কথা মনে রাখা চাই। রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা কবিতা যখন তার নতুন পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, সেই সময় আবৃত্তির জগতে খ্যাতিমানদের মধ্যে আছেন শম্ভু মিত্র বা কাজী সব্যসাচীর মত মানুষেরা, যাঁরা খানিকটা নাটকীয় করে কবিতা বলে থাকেন। শম্ভু মিত্রের কথা বলার ধরনে যে অতিরেক, শব্দকে তার ব্যঞ্জনায় বাজিয়ে তোলার যে সচেতন প্রয়াস, তা হয়তো মধুবংশীর গলির বেলাই যতখানি অমোঘ, জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তির বেলায় ততখানি নয় – এমনটা ভেবেছেন অনেকে, সে ভাবনাকে এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া উচিত হবে বলে মনে হয় না। সব্যসাচীর বেলাও সমস্যাটা অনেকটাই তাই। কবিতা পাঠের বা আবৃত্তির সময় শুধু তার শব্দগুলোকে বলে যাওয়া হোক, আর কোন কিছুর দরকার নেই – শ্রোতা তার ভেতর থেকে নিজের মত পাঠ তৈরি করে নেবেন, এমনটাই মনে হচ্ছিল কবিদের অনেকের। তাঁদের সামনে তখন এসে গেছে বিদেশী কবিদের কন্ঠে তাঁদের লেখা কবিতা পাঠের রেকর্ড, সভায় সঙ্গতে আমাদের কবিরাও তাঁদের লেখা পড়ছেন, নাটকীয়তাহীন সেই সব উচ্চারণ পছন্দ করছেন বেশ কিছু মগ্ন মানুষ। অরিণ মিত্রের কবিতা পড়া নিয়ে সিমনের সেই গান তো অনেকেরই স্মৃতিধার্য হয়ে আছে নিশ্চয় - ‘নতুন একটি কবিতা পড়তে উঠে দাঁড়ালেন অরুণ মিত্র।’ মনে পড়ে, সম্ভবত সন্তোষকুমার ঘোষের আয়োজনে রবীন্দ্র সদনে একবার আবৃত্তি বিষয়ে একটি আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়, তাতে উপস্থিত ছিলেন শম্ভু মিত্র তাঁর কন্যা শাঁওলীকে নিয়ে, অন্যদিকে ছিলেন কবি অরুণ মিত্র। স্বীকার করা ভাল, এই সন্ধ্যায় শম্ভু মিত্রের অসহিষ্ণুতা অনেককেই পীড়া দিয়েছিল।
নাটক গান এবং কবিতার মধ্যে আর একটি তফাতের জায়গা আছে, যা আদৌ উপেক্ষার যোগ্য নয়। হাল আমলের তথাকথিত কোম্পানি থিয়েটারের কথা জানি না, কিন্তু চল্লিশ পরবর্তী বাংলা নাটকের প্রধান ধারার সঙ্গে অনেক দিন পর্যন্ত আদর্শের অনুষঙ্গ লেগে ছিল, নাটক লিখে সম্মানজনক অর্থ পাবেন, এমনটা নাটককারেরাও ভাবতেন না, দলগুলিও দেবার কোন দায় বোধ করত না। সে ধারা এখনও আছে। বহু দল ছাপা নাটক নির্বিচারে অভিনয় করেন, ছাপা নাটকের জন্যে নাকি টাকা দেবার দরকার নেই, এমনটাই তাঁদের বেশিরভাগের বিশ্বাস। এমনকি, লেখককে একবার জানানোর সৌজন্যটুকু পর্যন্ত মনে থাকে না তাঁদের। ফলে, নাটক লিখে অর্থাগমের কল্পনা অধিকাংশ নাটককারের মনেই থাকে না। নাটককারেরাও নিজেদের থিয়েটারের মানুষ বলে মনে করেন, খানিকটা বন্ধু, অনুজ বা অভিভাবকসুলভ ঔদার্যে এসব মেনে নেন বা নিতে বাধ্য হন। গানের বেলা কিন্তু বিষয়টা এমন নয়, সেখানে একটা পেশাদার মনোভাব কাজ করে থাকে। রেকর্ড করার সময় কোম্পানির সঙ্গে রীতিমত আর্থিক চুক্তি হয়, সেই চুক্তি অনুযায়ী টাকা দেওয়া হয় গীতিকারকে। এ কথাও তো আমরা জানি, যে আধুনিক গান রেকর্ড করা হয় নি, তেমন গান আসরে গাইবার রীতি অন্তত পেশাদার গায়কদের মধ্যে প্রায় নেই। এ দুয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আবৃত্তি। তার রেকর্ড খুব কম, রেকর্ডের বাইরে থাকা কবিতাও আবৃত্তিকার আসরে পরিবেশন করে থাকেন, তার বদলে কবিকে কোনও দক্ষিণা দেবার প্রথা প্রচলিত নেই। কবিরা তো আর নাটককারদের মতো নিজেদের আবৃত্তির লোক বলে মনে করেন না, তাই এই বঞ্চনা তাঁদের ভেতরের ভেতরে রাগ তৈরি করে।
এতক্ষণের আলোচনায় যদি আমি এখটু কবিদের দিকে ঝুঁকে পড়ে থাকি, সেখান থেকে ফিরে আসতে চাই এবার। এ কথা কবিদের মেনে নিতেই হবে, তাঁদের জনপ্রিয়তা, বা কবিতার প্রসারে আবৃত্তিকারদের বড় ভূমিকা আছে। কোন অচেনা কবির ভাল কবিতা আসরে পড়া বা আবৃত্তি করা হলে সংবেদনশীল শ্রোতা তার কবি সম্পর্কে আগ্রহভরে খোঁজ খবর নিচ্ছেন, এমনটা একাধিকবার নিজের চোখে দেখেছি। আর্থিক লেনদেনের একটা সম্পর্ক নিশ্চয় আবৃত্তিকারদের সঙ্গে কবিদের হওয়া উচিত, বিশেষ করে আজকাল আবৃত্তিশিল্পীরা কেউ কেউ যখন অনুষ্ঠানের জন্য ভদ্র সম্মান দক্ষিণা পেয়ে থাকেন।
আমার মনে হয় কবি আর আবৃত্তিকারদের মধ্যে সম্পর্কের প্রধান আততি তৈরি হয় কবিতাটির শিল্পরূপ নিয়ে। কবির ভালবাসাবার শব্দগুলি নিয়ে আবৃত্তিকার যথেচ্ছাচার করছেন, মূল রচনাকারের যদি এমনটা মনে হয় তাহলে তো তিনি রাগ করবেনই। আবৃত্তি শিল্পীরা কি অন্তত জীবিত কবিদের সঙ্গে কবিতা নিয়ে একটু আলোচনা করে নিতে পারেন? তার মানে কিন্তু এমন নয় যে আবৃত্তির ব্যাপারে কবি যা বলবেন তাকেই অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে। মা যেমন তাঁর সন্তানকে বোঝেন না, কবিও তেমনি সব সময় তাঁর নিজের কবিতা ভাল বুঝতে পারেন না, অনেক সময়েই নিজের লেখার ভুল, একপেশএ, এমন কি অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যাও করতে দেখা যায় তাঁদের। তাছাড়া, যে কোন শিল্পের প্রধান রহস্য হল, সে এক একজনের কাছে এক এক মানে নিয়ে ধরা দেয়, সেক্ষেত্রে কবির মানে আর আবৃত্তিকারের মানেতে খানিকটা প্রভেদ ঘটে যেতেই পারে – কবি কি তা মেনে নিতে পারবেন না? আমি জানি মেনে নেওয়া ব্যাপারটা আপেক্ষিক। আবৃত্তিকারদের অনেকের মধ্যে ফাঁকিবাজি আছে, অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রস্তুতির ধার না ধেরে কোন একটা কবিতায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে সেটি পড়ে দিলেন, এমনটা তো হয়েই থাকে। কবি কেন তাঁর নিজের লেখা নিয়ে এই ব্যভিচার সহ্য করবেন? যে ধ্যান দিয়ে তিনি কবিতাটি রচনা করেছেন, আবৃত্তিকার যদি তা না দেন, কবির অধিকার আছে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করার। তবে এর উল্টো যুক্তি হিসেবে বলা যায়, যাঁরা এমনটা করেন, তাঁরা কি সত্যিই আবৃত্তিশিল্পী? তাঁদের দোষে যাবতীয় আবৃত্তিকার সম্পর্কে বিরূপ ধারনা পোষণ করা কী কবিদেরই উচিত কাজ হচ্ছে?
আশা করা যায় এ লেখা কিছু আবৃত্তিকারের চোখে পড়বে, দু একজন কবির নজরে আসাও অস্বাভাবিক নয়। তাঁদের কাছে আমার একটা প্রস্তাব আছে। যে সব বাচিক শিল্পীদের যে সব সংগঠন আছে, তাঁদের উদ্যোগে কয়েকজন কবির সঙ্গে আবৃত্তিকারেরা একটু বসলে কী হয়? কবিরা তাঁদের কথা বলবেন, আবৃত্তিকারেরা তাঁদের কথা। দু পক্ষের কাছ থেকে দু পক্ষের বেশ কিছু কথা শোনার, জানার এবং শেখার আছে, এ কথা কি কেউ অস্বীকার করতে পারেন?
0 comments: