0
undefined undefined undefined

সম্পাদকীয়

Posted in




সম্পাদকীয়


"যে অক্ষর পুরুষকে আশ্রয় করিয়া

অহোরাত্রাণ্যর্ধমাসা মাসা ঋতবঃ সম্বৎসরা ইতি বিধৃতাস্তিষ্ঠন্তি,

দিন এবং রাত্রি, পক্ষ এবং মাস, ঋতু এবং সম্বৎসর বিধৃত হইয়া অবস্থিতি করিতেছে, তিনি অদ্য নববর্ষের প্রথম প্রাতঃসূর্যকিরণে আমাদিগকে স্পর্শ করিলেন। এই স্পর্শের দ্বারা তিনি তাঁহার জ্যোতির্লোকে তাঁহার আনন্দলোকে আমাদিগকে নববর্ষের আহ্বান প্রেরণ করিলেন। তিনি এখনই কহিলেন, পুত্র, আমার এই নীলাম্বরবেষ্টিত তৃণধান্যশ্যামল ধরণীতলে তোমাকে জীবন ধারণ করিতে বর দিলাম—তুমি আনন্দিত হও, তুমি বরলাভ করো।"

১৪২৪ বঙ্গাব্দকে স্বাগত জানিয়ে প্রকাশিত হলো ঋতবাক তৃতীয় বর্ষ, নবম সংখ্যা। মানব সভ্যতার সকল সংকটের মহা অবসান সেই মানুষটিকে আশ্রয় করেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 

"জীবনস্মৃতি অনেক কাল পূর্বের লেখা। তার পরে বয়সও এগিয়ে চলেছে, অভিজ্ঞতাও। বৃহৎ জগতের চিন্তাধারা ও কর্মচক্র যেখানে চলছে, সেখানকার পরিচয়ও প্রশস্ততর হয়েছে। দেখেছি চিত্ত যেখানে প্রাণবান্‌ সেখানে সে জ্ঞানলোকে ভাবলোকে ও কর্মলোকে নিত্যনূতন প্রবর্তনার ভিতর দিয়ে প্রমাণ করছে যে, মানুষ সৃষ্টিকর্তা, কীটপতঙ্গের মতো একই শিল্পপ্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি করছে না।
"মত বদলিয়েছি। কতবার বদলিয়েছি তার ঠিক নেই। ...শেষ দিন পর্যন্ত যদি আমার মত বদলাবার শক্তি অকুণ্ঠিত থাকে তা হলে বুঝব এখনো বাঁচবার আশা আছে। নইলে গঙ্গাযাত্রার আয়োজন কর্তব্য।"

সব সাধনার একতম শেষ পরিণাম... শিক্ষা আর অভিজ্ঞতার প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন বদলে যাওয়া, প্রতিদিন নতুন মানুষ, নতুন ভাবনা, নতুন 'শিল্পপ্যাটার্নের' প্রবর্তনা... এইভাবেই প্রতিদিন নতুন নতুন সত্যকে উপলব্ধি করা... এটাই জীবন, এটাই এগিয়ে চলা। খুব সঙ্গত কারণেই একটা কথা স্বীকার করা ছাড়া আজ আর উপায় নেই যে, মানুষই সৃষ্টিকর্তা। তাই আজ নিজেকেই ঠিক করে নিতে হবে, ভালো থাকবো, না খারাপ! স্বভাবতই ঋতবাক ভালো থাকাতেই বিশ্বাস করে। ঋতবাকের সঙ্গে সহযাত্রায় আপনারাও ভালো থাকুন, নববর্ষে এই শুভেচ্ছাই জানাই। 

সম্প্রতি এক অনন্য সাধারণ প্রাপ্তিতে ঋদ্ধ হলো ঋতবাক। একান্ত আলাপচারিতায় মুখোমুখি হওয়া গেল সজনীকান্ত সেনের দৌহিত্র, সঙ্গীতসাধক দিলীপ রায়ের(১৯১৭- )। অভিমানী শিল্পীর সঙ্গে কাটানো সেই কয়েক ঘন্টার অভিজ্ঞতার কথা লিখছেন ভগিনীপ্রতিম কস্তুরী সেন, এই সংখ্যাতেই। ঘটনাচক্রে আগামী ২৯শে এপ্রিল কিংবদন্তী এই শিল্পীর শততম জন্মতিথি। শতায়ু প্রতিভাকে ঋতবাকের শুভেচ্ছা ও প্রণাম। 

নিরন্তর সহযোগিতা ও দীর্ঘ সহযাত্রার কামনায় সম্পৃক্ত হয়ে, ঋতবাকের যাত্রাপথ উত্তরোত্তর মসৃণ হোক, এই প্রত্যাশাই রাখি। 

শুভেচ্ছা নিরন্তর 

সুস্মিতা বসু সিং












0 comments:

8
undefined undefined undefined

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - কস্তুরী সেন

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


সে গান কবে গভীর রবে..... 
কস্তুরী সেন


১ 

শুরুটা সঙ্গীতমেলা চত্বর। শুরুটা ডিসেম্বরের গোড়ার নন্দন ক্যান্টিন। বাংলা গান বাংলা গান। ‘না, সামান্য আছে', ‘না, পুরোই গেছে' এ জাতীয় যা হয় ধোঁয়া ওঠা তর্ক। তর্কের মুখে ‘কাকে তোরা বাংলা গান বলিস!’ জাতীয় কাষ্ঠহাসি প্রশ্ন থেকে শুরু করে ‘কেন, কী জন্য হতে পারে না বিশ্বভারতীর বাইরে রবীন্দ্রসঙ্গীত?’ জাতীয় হাত মুঠো জিজ্ঞাসা অবধি সমস্তটা যখন প্রায় কভার করা সমাপ্ত, এবং বাংলা গানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতে আর মিনিট পাঁচ মাত্র বাকি, সে সময় পত্রিকার কর্ত্রী গোছের মানুষজন সঙ্গে থাকলে যা হয়; কান্তগীতি, অতুলপ্রসাদী বা দ্বিজেন্দ্রগীতি বিষয়ে, বাঁশবন ভেবে আমার খানিক ওজস্বিনী মত প্রকাশের সুবাদে চশমার ফাঁক থেকে একটি হাড়হিম দৃষ্টি ও অবধারিত প্রশ্ন ভেসে এল- “এ গানগুলো শুনিস নিয়মিত?খোঁজ খবর আদৌ কিছু রাখিস?”.....সমস্যা, এই কর্ত্রীটি শুধু পত্রিকা চালান না, ক্লাসিকাল মিউজিকে রীতিমত তালিমপ্রাপ্ত এবং গানের বিষয়টা বোঝেন অধিকাংশের চেয়ে ভাল। ফলে অম্লানবদনে ‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই' বললে গভীর পাকে পতনের সম্ভাবনা, এবং ‘না মানে ওই' বললেও এতক্ষণের বক্তৃতা মাঠে মারা যায়। তবে যেহেতু কর্ত্রী কারোরই ত্রিশঙ্কু দশা নিয়ে অধিক সময় ব্যয় করার লোক নন, ফলে পরের দশ মিনিটে প্রশ্নের উদ্দেশ্য বিশদ হলো এই অর্থে যে ঋতবাক চায় আগামী বেশ কিছু সংখ্যায় সংস্কৃতির জগতে আলোচিত, অথবা তত আলোচিত নন, এমন মানুষজনকে নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার ভিত্তিক লেখাপত্রের বিভাগ চালু করতে। গানের প্রসঙ্গ উঠেছে যখন, তখন এই যে ধারাটি, অর্থাৎ অতুলপ্রসাদ, রজনী সেন, দ্বিজেন্দ্রলালের ‘এ পৃথিবী একবারই পায় তারে পায় না ক' আর’ জাতীয় অবিস্মরণীয় সৃষ্টিগুলি নিয়ে এ শহরে আজও যাঁরা চর্চা করছেন, দক্ষিণী সুর অনুসারী সিনেমা সঙ্গীত অথবা নতুন বিমিশ্র বাংলা গানের দিগন্তব্যাপী বিস্তারের মধ্যে আজও একেকটি নিভৃতের হর্ষবিষাদ, দু একটি রেডিও/টেলিভিশন প্রোগ্রাম, সীমিত কিছু শহুরে গানের অনুষ্ঠান বা দলছুট খানিক ইউটিউব সার্চে যে অমৃত বয়ে যাচ্ছে, পাক খাচ্ছে, মথিত হচ্ছে বাঙালির শ্রুতি থেকে হৃদয়ে এই ২০১৭ সালেও, সে বৃত্তের কাউকে চাইছে ঋতবাক। ফেলে আসা বাংলা গানের দিনগুলিকে, আকাশবাণীর দুপুর বিকেলগুলিকে, গ্রামাফোন রেকর্ডের সন্ধেবেলাগুলিকে খুঁজছে এ প্রজন্ম। প্রশ্ন এল, কে আছেন, বসা যায় গিয়ে যাঁর মুখোমুখি? 


২ 

সমাপতন এই যে, ডিসেম্বরেরই ২৯ তারিখে, ডোভার টেরাসের আশ্চর্য ছায়া ছায়া এবং আশ্চর্য আলো আলো বাড়িটির একতলার ঘরে গিয়ে যখন বসা গেল, এবং যখন তিনি, যাঁর সঙ্গে দেখা করতে আমরা কজন, যাঁকে খুঁজে পেতে তারও আগে আমমরি গো পিয়াসে/তবু যাহা চাই সকলই পেয়েছি/তুমি তো কিছুই পাওনি”.....প্রণামে কখনও বড় বিলম্ব হয়, সর্বার্থেই 


৩ 

--‘রজনীকান্ত সেনের প্রভাব? তিনি মারা গিয়েছেন ১৯১০ সালে, আমার জন্ম তার ৬/৭ বছর পর, ওই দাদামশাই, এটুকু, প্রভাব টভাব তেমন কিছু ছিল তো না, পাঁচ ভাইতে মিলে খেলাধুলো করে বড় হয়েছি....হ্যাঁ, মনে আছে মা যেতেন বাপের বাড়ি রাজশাহী, সেখানে ফজল আলি বলে এক মুসলমান ভদ্রলোক ছিলেন, তাঁর কাছে প্রথম গান শেখা....ঐ ১৯২৩/২৪ সাল”---গমগমে কণ্ঠটি এতই অমলিন যে সে অভিঘাত কাটানোও সময়সাপেক্ষ বিষয়। তবু যদি বা ‘কী গান' ‘কী গান’ করে ঝুঁকে পড়া গেল, বিস্মিত উত্তর এল ‘রবীন্দ্রনাথ, আবার কী? ...কখন যে বসন্ত গেল, এবার হলো না গান' ডায়রি, পেন, ফোন রেকর্ডার সমেত গুছিয়ে বসা, প্রায় দু পাতা জোড়া প্রশ্নের খসড়া তৈরি করে নিয়ে যাওয়া, মোটামুটি সার হলো পরবর্তী দীর্ঘক্ষণের জন্য, যখন তাঁর গানের তালিমের সূত্রে, কর্মজীবনের সূত্রে, যে সময়টাকে খোঁজার, খোঁড়ার, স্পর্শ করার জন্য যাওয়া, সে সময়ের অজস্র স্মৃতি, বহুবর্ণ ছবির মতো উঠে এল পরপর, বিনা সূত্রে ও প্ররোচনাতেই। ‘প্রথাগত তালিম তো নিইনি কখনও, ঐ ছোটবেলার মেঠো গান শেখা বাদ দিলে, পরে, কলকাতায় এসে যখন এণ্টালিতে থাকি, তখন ধর্মতলার এক হার্ডওয়্যারের দোকানে গিয়ে রেডিও শুনে শুনে গান শিখেছিলাম অনেক'—বেশ, শেখাতেন কে?পঙ্কজ মল্লিক। সেসময় প্রতি রবিবার রেডিওতে গান শেখানীর একটি অনুষ্ঠাণ হতো তাঁর। সেন্ট জেভিয়ার্সে যখন পড়েন, তখন প্রত্যেক শনিবার আধঘণ্টার একটি অনুষ্ঠান করতেন সেখানকার ছাত্ররা। রীতিমত অডিশন দিয়ে সুযোগ পেতে হতো সেখানে গাইবার। থার্ড ইয়ারে পড়াকালীন দিলীপবাবু গেলেন অডিশন দিতে।রজনী সেনের উত্তরাধিকার তখন জানেন না একটিও তাল ঠাট রাগের নাম। সহাস্যে জানান সে অডিশনে সকলেই পাশ করেছিল।বাদে তিনি। প্রথম রেডিওতে গাওয়া ১৯৩৭/৩৮ সালে। সুযোগ খানিকটা বাড়ি বয়েই এসে উপস্থিত। মামা সুকৃতি সেন তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওর কর্তাব্যক্তি একজন, ভাগ্নে দিলীপকে নিজে চাইলেন তালিম দিতে, সুযোগও, গাইবার। রেডিওতে গাইতে গিয়ে প্রথম শুনলেন একেকটি তালের নাম, পরিচিত হলেন তেওড়া, কাহারবা, দাদরার সঙ্গে। সেসব তালের প্রয়োগও বুঝিয়ে দিলেন রেকর্ডিং এর সহশিল্পীরা। সেসময় মিহি সুরে গান গাইবার চল –-‘আমার তখন রোল মডেল হচ্ছেন সন্তোষ সেনগুপ্ত। প্রথম রেকর্ড হয়েছিল ১৯৩৭ সালেই, সুকৃতি সেনের লেখা গান ‘ওপারে প্রভাত হল'। সে রেকর্ড বেরোয়নি অবশ্য। বেরোল পরেরটি, ১৯৩৮সালে পুজোর সময়, বীরেন ভট্টাচার্যের সুরে অজয় ভট্টাচার্যের লেখা গান। সেই প্রথম রেকর্ড। 


৪ 

প্রশ্ন স্বতঃসিদ্ধই ছিল অপরজনকে, দ্বিজেন্দ্রলালের উত্তরসূরী কিংবদন্তি শিল্পী দিলীপকুমার রায়কে নিয়ে। কেমন ছিল সম্পর্ক এই মণ্টিবাবুর সঙ্গে সেই মণ্টুবাবুর? আদানপ্রদানের জায়গা তৈরি হয়েছিল কোনও? মুহূর্তে উজ্জ্বল শতায়ু যুবকের মুখ, ‘মণ্টুবাবুর সঙ্গে অত্যন্ত হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল আমার। শুধু তাই নয়, তাঁর এক ছাত্রী, ইন্দিরা দেবী, আমার দাদামশাইয়ের অনেকগুলি গান ইংতেজিতে অনুবাদ করেন'। নিজে মণ্টিবাবুকে ডেকে ছাত্রীর অনূদিত সেই গানগুলি শোনাবার ব্যবস্থা করেছিলেন মণ্টুবাবু, প্রবাদপ্রতিম দিলীপকুমার রায়। পরবর্তীতে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিম অগ্রজ শিল্পী সমরেশ চৌধুরীর সাহচর্যে। সেনোরা কোম্পানির দৌলতে কাজী নজরুল ইসলাম, হিমাংশু দত্ত থেকে শুরু করে অনুপম ঘটক, গান শিখবার সুযোগ এরপর এসেছিল অনেকের কাছেই। মজার হেসে এইখানে অব্যর্থ যোগ করেন আকাশবাণীর প্রবাদপুরুষ ‘মিছে কথা কইছি না কিন্তু, এত বড় বড় নাম শুনে ভাবিসনা বানানো'। চাকরিসূত্রে এসময় চলে যেতে হলো চাইবাসা অঞ্চলে,জায়গার নাম বড়জামদা। কেমিস্টের পদ। সঙ্গী বলতে ৫ টাকা দামে কেনা সম্ভবত ডুয়ার্কিনের একটি হারমোনিয়াম, আর কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপির বই। নির্জনবাসে নিজেই প্র‍্যাকটিস করে তুলে ফেললেন ১৫/২০ টি গান। একাকিত্বের কারণে এরপর ছেড়েও দেন সে চাকরি। কলকাতায় ফেরার পর দেখলেন রেডিও থেকে ডাক এসেছে অনুষ্ঠানের। অনুষ্ঠানের সময়সীমা?সাকুল্যে ৫ মিনিট। দক্ষিণা শূন্য। ইতস্তত করে গিয়ে ধরলেন রেডিওস্টেশনের তৎকালীন বড়কর্তা নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ মজুমদারকে, তাঁর আনুকূল্যে সময়সীমা বেড়ে হল দশ মিনিট, দক্ষিণা দাঁড়াল ৫ টাকা। 


৫ 

--‘হিমাংশু দত্তের মতো সুরকার আমি আর পাইনি। আত্মশ্লাঘা হবে, তাও বলি, তিনি আমায় বলেছিলেন, এমন গান আপনাকে দেব যা বাঙালি চিরকাল মনে রাখবে। অজয় ভট্টাচার্যের মতো গীতিকার!পাইনি আর'......দিলীপবাবুর উচ্চারণের সামনে আপনা থেকেই এসময় শ্লথ হয়ে আসে খসখস টুকে নিতে থাকা কলম, ২০১৭ সালের বাঙালি আমাদের কজনের ইতস্তত করে ওঠা স্বাভাবিক এই গান মনে রাখার বিষয়টি সামনে এলে। অজয় ভট্টাচার্য বিস্মৃতপ্রায় নাম, হিমাংশু দত্তের গানও যথাযথ মনে রেখেছি, এ দাবি করা বস্তুত অসম্ভব প্রাচীন মানুষটির সামনে। -- ‘ব্রাহ্মসমাজে প্রতিবছর অতুলপ্রসাদকে নিয়ে অনুষ্ঠান হতো সেইসময়। এইখানে গান শুনেছিলাম রেণুকা দাশগুপ্তের। অতুলপ্রসাদের কাছে যাঁরা সরাসরি শিখেছেন, রবীন্দ্রমোহন বসু যেমন, হরিপদ রায়, তাঁরাও গান শেখাতেন এইখানে'। রজনীকান্ত এবং অতুলপ্রসাদের গান প্রথম রেডিওতে গাইছেন দিলীপ রায়ই এসময়। গাইছেন রবীন্দ্রসংগীত দ্বিজেন্দ্রগীতি আধুনিক গান। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়টায় অতুলপ্রসাদ রজনীকান্ত দ্বিজেন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে হিমাংশু দত্তের সুরের ইন্দ্রজালে যখন ভ'রে উঠছে বাঙালির বৈঠকখানা, সেসময়েই মনোমালিন্য শুরু হলো অল ইন্ডিয়া রেডিওর সঙ্গে।কর্তৃপক্ষ বললেন রজনীকান্তের গান ছাড়া আর যে কোনও গানই গাইতে গেলে অডিশন দিতে হবে দিলীপবাবুকে।‘আমি বলেছিলাম দ্বিজুবাবুর, অতুলপ্রসাদের গান রেডিওতে ইন্ট্রোডিউসই করেছি আমি, অডিশন দেব কার কাছে? পারলে ধরে আনুন শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে, নয়ত সম্ভব নয়'—এবং ছাড়লেনও আকাশবাণী। এইচ এম ভি থেকে ফোন এল এরপর। গ্রামাফোন কম্পানির কর্তা পি কে সেনের আগ্রহে তখনকার বিখ্যাত গায়িকা গায়ত্রী বসুকে তালিম দিতে শুরু করলেন অতুলপ্রসাদের গানে। উভয়ের রেকর্ডও বেরোয় এসময় কিছু।


৬ 

‘হেমন্ত was brilliant!’—আবারও উজ্জ্বল মুখ একদা সতীর্থের স্মৃতিচারণায়।‘সে আমার সামনে রজনীকান্তের গান গাইতে চাইত না বন্ধুবিচ্ছেদের ভয়ে' হাসেন দিলীপবাবু। ‘আরেকজন ছিল brilliant, মানবেন্দ্র মুখার্জি, ঐ গলা, তান, লয়কারি আর দ্বিতীয় দেখিনি।‘—উঠে আসে পরপর সুবিনয় রায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়দের নাম স্মৃতিচারণার সূত্রে। গ্রামাফোন কম্পানি থেকেই এরপর অনুরোধ এল গান লেখার। বাসে যেতে যেতে ভাবতেন গানের কলি। দিলীপ রায়ের লেখা প্রায় ৫/৬ টি গান এসময় গেয়েছিলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। ‘আমার লেখা একটি গান, মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানিনে মা, তো খুব জনপ্রিয়ও হয়েছিল ওর গলায়।পান্নালালের সঙ্গেও অত্যন্ত বন্ধুত্ব হয়েছিল আমার’। বেশ, আধুনিক গান? আধুনিক বাংলা গান? নিজে গেয়েছেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে গাইতে শুনেছেন, এসময়ের আধুনিক গান সম্পর্কে মত কী? সেই অব্যর্থ হাসিটি হেসে গলা নামান দিলীপ রায়, ‘ইংরেজিতে একটা কথা আছে জানিস? The less said, the better!’—হাসি তো বটেই, প্রবলই হাসি, তবু খড়কুটো হাতড়ানোর মতো জিজ্ঞেস করতেও ছাড়িনা- তবু, তবু, একটাও এখনকার গান কি শোনেন না? ভাল লাগেনি কিছুই? অর্চনাদি ধরিয়ে দেন পাশ থেকে –‘ প্রায়ই বলেন যে,সেই ব্যান্ডের গানখানা?’—ব্যান্ড? দিলীপ রায়? বলুন, বলুন! পারলে প্রায় চেয়ারসমেত হুমড়ি খাই আমরা প্রত্যেকেই, এবং আমাদের হতভম্বতর করে দিলীপবাবু নিজেই দু কলি গুনগুন করেন সামান্য – ‘হ্যাঁ ওই যে, বারান্দায় রোদ্দুর... তোমার দেখা নাই রে?...ঐ গানটি ভাল লেগেছে। ভাল গানের এলিমেন্ট রয়েছে ওর মধ্যে, কথা সুন্দর'....মুহূর্তে সম্পাদিকা সব ফেলে ঠিক করতে বসেন ‘ভূমি' পর্যন্ত এ খবর পৌঁছে দিয়ে তাদের থেকে ঋতবাক এর আগামী কোন সংখ্যার জন্য কী আদায় করা যেতে পারে। ছবি টবি ইত্যাদির পর্ব মিটিয়ে ঝোলাঝুলি তুলে বেরিয়ে আসছি যখন, তখন বারোটা পেরিয়ে অনেকদূর এগিয়েছে ঘড়ির কাঁটা। অর্চনাদি বলেছিলেন ‘১০/১৫ মিনিট কেমন? এত কথা বলেন তো না, অসুস্থ বেশ অনেকটাই উনি'—আড়াই ঘণ্টা পার করেছে সেই দশ মিনিটের বরাদ্দটুকু বহুক্ষণ। কথা বলেন না এমন তো নয়!কে স্থির করে দিল কথা বলে না বিগত শতক আমাদের সঙ্গে! কে স্থির করল বিশুদ্ধ বাংলা গান, কাল ও প্রজন্মের সীমা পেরিয়ে তেমন করে ভেসে আসতে চায়না পূর্বসূরীদের প্রান্ত থেকে আমাদের আজকের এ প্রান্তে, কে সিদ্ধান্তে এল আসতে পারেন না দ্বিজু রায়, রজনী সেন, দিলীপকুমার, হিমাংশু দত্তরা! দিলীপবাবু তাঁর শতক প্রাচীন অননুকরণীয় কণ্ঠটিতে, বেরিয়ে আসার আগে আমাদের অনুরোধে গেয়েছিলেন দু কলি। তাঁর স্বর ভেঙে যাচ্ছিল, সামান্য হাঁফ ধরছিল স্বভাবতই। তবু গেয়েছিলেন--'আমার শুধু দিবস সাঁঝে/মিশিয়ে দেওয়া আপনাকে যে/সেই আনন্দস্রোতে/তোমার বাঁশির সুরে নিত্য যা বয়----'....আনন্দস্রোতটি প্রসারিত রেখেছে করতল, দুপুর রোদে ফিরে আসতে আসতে সেদিন মুহূর্তমাত্র টের পেয়েছিলাম, প্রসারণটি অপেক্ষার। এপ্রান্ত সেই অপেক্ষার হাতখানি ধরলে, বিশুদ্ধ সঙ্গীতের মোহনায়, মিলন হতে তিলপরিমাণ বাধা থাকেনা দুই প্রজন্মের। 









8 comments:

14
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - সোমেন দে

Posted in


প্রবন্ধ


বাঙালি পদবীর সৃষ্টিমূল সন্ধান 
সোমেন দে 



জনৈক সত্যভুষণ সেন একসময় রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠি দিয়ে বিয়ের পরে বাঙালি মেয়েদের পদবী পরিবর্তন সম্মন্ধে তাঁর মত জানতে চেয়েছিলেন। 

এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ একটি প্রবন্ধে বাঙালিদের নামের সঙ্গে পদবী ব্যবহার করার যৌক্তিকতা সম্মন্ধেই কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁর মতে বাঙালির কাছে সামাজিক ভাবে তার জাতের পরিচয় একসময় খুব গুরুত্বপুর্ণ ছিল। মানুষের পরিচয় তার জাতের মধ্যে দিয়ে পাওয়া ব্যাপারটা সমাজে প্রচলিত ছিল। তাই মানুষের পদবীর একটা গুরুত্ব ছিল। কিন্তু ক্রমশ যখন বৈঠক মজলিশে, সভা-সমিতিতে, ইস্কুলে কলেজে, অপিসে আদালতে আগেকার মতো পংক্তি বিভাগের দাগটি লুপ্ত হয়ে গেছে তখন পদবী ব্যাপারটাও এখন বাহুল্য হয়ে গেছে। তাঁর মতে ভারতবর্ষে বাংলাদেশ ছাড়া প্রায় সকল প্রদেশেই পদবীহীন নাম বিনা উপদ্রবেই চলে আসছে। তাই –

‘আমার প্রস্তাব হচ্ছে, ব্যক্তিগত নামটাকে বজায় রেখে আর-সমস্ত বাদ দেওয়া’ - 
- ‘ব্যাঙাচি পরিণত বয়সে যেমন ল্যাজ খসিয়ে দেয় বাঙালির নামও যদি তেমনি পদবী বর্জন করে আমার মতে তাতে নামের গাম্ভীর্য বাড়ে বৈ কমে না।’
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

তিনি প্রস্তাব রেখেছিলেন বটে তবে এ ব্যাপারে তেমন কোনও উদ্যোগ তিনি নেননি। তাঁর নামের সঙ্গে যে পদবীটি বাঙালির তথা বিশ্বের কাছে পরিচিত সেই পদবীটিও তাঁর পূর্ব পুরুষ নীলমণি কুশারিকে দিয়েছিলেন কলকাতা বন্দরের শ্রমিকরা। তিনি যখন ব্যবসার প্রয়োজনে কলকাতা বন্দরে যাতায়াত করতেন তখন সেখানকার শ্রমিকরা, যারা প্রধাণত অন্তজ শ্রেণীর মানুষ ছিলেন, তাঁরা ব্রাহ্মণ নীলমণি কুশারীকে ‘ঠাকুর’ বলেই ডাকতেন। সাহেবরা ঠাকুরকে তাদের সুবিধে মতো টেগোর করে নেয়। তবু এই পদবী বহন করতে তিনি বিশেষ আপত্তি করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। 

এক সময় শনিবারের চিঠির সম্পাদকমশাই পদবী বর্জনের পক্ষে মতামত গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। সে চেষ্টায় বিশেষ কেউ সাড়া দেননি। তাই বাঙালি নামের সঙ্গে পদবী আপাতত লেজুড় হয়েই থাকবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। 

বরং বুঝে নেওয়া যাক কি ভাবে আমাদের পদবিগুলি জুড়ে গেল আমাদের নামের সঙ্গে। 

হিন্দু বাঙালিদের ঠিক কত রকমের পদবী আছে সেটার সঠিক পরিসংখ্যান করা খুব কঠিন কাজ। সে বড় বিচিত্র এক জগৎ। 

ঠিক কবে থেকে বাঙালিরা প্রত্যেক ব্যাক্তির নামের সঙ্গে নিয়ম করে একটা করে পদবী জুড়ে দেওয়া শুরু করেছিল তার সঠিক কোনও ইতিহাস লিপিবদ্ধ নেই। তবে এটা ঠিক একদা বাঙালির নামের সঙ্গে কোনও পদবীর ব্যাবহার ছিল না। অনেকটা জাত পাত নির্ভর বিভাজনেরই আর একটা নতুন উপায় হিসেবেই সম্ভবত পদবীর উদ্ভাবন হয়েছিল। 

পদবীর উৎস খুঁজতে গিয়ে যদি আমরা চলে যাই বেদ পুরাণ, জাতক, কথাসরিৎ এর সময়ে চলে যাই তাহলে দেখব, সে সময় পদবী বলে কিছু ছিল না। সেখানে নামের মধ্যেই কখনও পিতার কখনও মাতার পরিচয় আছে। যেমন পিতা অরুণের পুত্রের নাম আরুণী আবার মাতা জাবালার পুত্রের নাম সত্যকাম জবলী। মহাভারতের যুধিষ্টির, অর্জুন, দুর্যোধন, দুঃশাসন এদের পদবী ছিল না। মহাভারতের একই দ্রৌপদীর ‘দ্রৌপদী’ নামটি পিতার নাম থেকে এসেছে, পাঞ্চালী এসেছে জন্মস্থানের নামের ইঙ্গিত বহন করে, আবার জন্ম ইতিহাসের পরিচয়ে হয়েছিল যাজ্ঞসেনী। কিন্তু বিয়ের পর তাঁর নাম পরিবারের পদবী বহন করে দ্রৌপদী পাণ্ডব হয়নি। 

পরবর্তী কালে আমরা যে সব নাম পাই তার মধ্যে বিষ্ণুশর্মা, কৃষ্ণস্বামী, চন্দ্রবর্মা এই জাতীয় নাম ছিল। এর মধ্যে থেকে নামের শেষ ভাগ, মানে শর্মা, স্বামী বা বর্মা হয়ত এক সময়ে পদবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এতে যদি আমরা মনে করি আমাদের মিত্র পদবী বিশ্বামিত্র ঋষির নামের থেকে এসেছে, তাহলে এটাও মেনে নিতে হয় টড সাহেবের বইতে গুহায় বাস করা এক শ্রেণীর মানুষদের গোহো বলে ডাকা হতো, আমাদের গুহ পদবীও সেখান থেকে এসেছে। আসলে আমাদের পদবীর ইতিহাস মোটেই ততটা প্রাচীন নয়। সেটা খুব বেশি হলে দুশো আড়াইশো বছর হতে পারে। এবং তার উৎপত্তির মধ্যে জাতপাত, জীবিকা এবং সমাজপতিদের দাদাগিরির অনেকটা ভূমিকা আছে। 

প্রথমে জাতপাতের ব্যপারটায় যাওয়া যাক। আমরা যতই ইংরেজদের দায়ী করি এদেশে Divide and rule কায়দায় শাসন ব্যবস্থা চালু করার জন্যে আসলে আমাদের দেশে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী মানব জাতির আদি পুরুষের নাম মনু। এ রকম একটি বিশ্বাস চালু আছে তিনি ব্রহ্মার শরীর থেকে উদ্ভূত হয়ে ছিলেন। তিনিই মনুসংহিতা রচনা করেন। কিন্তু মনু আসলে একজন নয়। আমাদের বেদ গীতা মহাভারতের মতোই মনুসংহিতা রচিত হয়েছে একটা বিশাল সময় জুড়ে অনেকের যোগদানে। শেষ মনু সম্ভবত তৃতীয় শতাব্দীতে। এই মনুসংহিতাই মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে বর্ণাশ্রমের প্রচলন করার পথটি প্রথম দেখান। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে ঈশ্বরের বিধান অনুযায়ী মানুষের চারটি বর্ণ। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয়, বৈশ্য, শুদ্র। ব্রাহ্মণ অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যাগ, যজ্ঞ ইত্যাদি কর্মে নিযুক্ত থাকবে। ক্ষত্রিয়রা প্রজাদের রক্ষা করবে। বৈশ্যরা পশুপালন, কৃষিকাজ এবং ব্যবসা বাণিজ্য করবে। আর শুদ্রদের কাজ হলো আগের তিন শ্রেণির মানুষদের সেবা করা। 

এই ব্যাবস্থাকে আমরা যদি Division of labour এর পটভুমিতে দেখি তাহলে, শাসন ব্যাবস্থা পরিচালনার স্বার্থে খানিকটা যুক্তি খুঁজে পাই। কিন্তু গণ্ডগোলটা হলো এর মধ্যে ঈশ্বরের বিধানকে নিয়ে আসা। যার ফলে এই ব্যবস্থায় শুদ্ররা কোনওদিন অধ্যাপনার সুযোগ পাবেনা, কারণ তাতে ঈশ্বরের সমর্থন নেই।।

মেগাস্থিনিসের লেখায় যে মৌর্য সাম্রাজ্যের বিবরণ পাওয়া যায় সেখানে বলা আছে চতুবর্ণের পরিবর্তে বৃত্তি অনুযায়ী সমাজে মানুষের শ্রেণী বিভাগ হতো। তখন সাতটি শ্রেণী ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শিক্ষক, কৃষক, পশুপালক, কারুশিল্পী, বণিক, সৈনিক, রাজকর্মচারী। 

কালের অগ্রগতির সঙ্গে এই বিভাজন দূর হওয়া তো দূরের কথা চার বর্ণ থেকে এটা বেড়ে দাঁড়ালো তিন হাজারের কাছাকাছি। এর মধ্যে শুধু ব্রাহ্মণদের শ্রেণীই তিনশোর বেশি। 

আমাদের পদবীগুলির কোনও নির্দিষ্ট উৎস নেই বা তা সবসময় কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেও সৃষ্টি হয়নি। কখনও তা গাঞী, মানে গ্রাম থেকে বা অঞ্চল থেকে এসেছে, কখনও এসেছে রাজপুরুষের দেওয়া উপাধি থেকে, কখনও বৃত্তির ধরন থেকে, কখনও ব্যাবসার বিশেষ সামগ্রী থেকে, কখনও শিক্ষার মাপকাঠি থেকে, আবার কখনও কোনও ঘটনার সূত্র থেকে। 

রমেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয়ের একটি গ্রন্থে লিখেছেন ‘আমাদের কুলজী গ্রন্থে আছে যে মহারাজ আদিশূরই প্রথম বাংলাদেশে কয়জন ব্রাহ্মণ এবং কায়স্থদের নিয়ে আসেন তাঁদের বংশধরেরাই পরে কুলিন ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের মর্যাদা পান। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অক্ষয় কুমার মৈত্র এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেননি। 

কিন্তু যত দিন গেছে এই বর্ণ বিভাজন ক্রমশ আরও বেড়ে গেছে। নানা রকমের উপবর্ণ সৃষ্টি হয়েছে। চোদ্দ শতকে স্মৃতি শাস্ত্রকার উদ্যোগে যে সব কুলজী গ্রন্থ রচিত হয় তাতে তৎকালীন কৌলিন্য প্রথা এবং জাতপাতের বিভাজনের কিছু ধারণা পাওয়া। তবে এই সব কুলজী রচনার মধ্যেই অনেকটাই জনশ্রুতি, কল্পনা, অর্ধ এবং আংশিক সত্যের উপর নির্ভর করে রচিত হয়েছিল। কারণ মুসলমান-পূর্ব যুগের বাংলার সামাজিক কাঠামো এবং বাংলার ইতিহাস সম্বন্ধে খুব স্পষ্ট কোনও প্রামাণ্য গ্রন্থ ছিলনা। তাই কুলজী গ্রন্থের রচয়িতাদের মধ্যে অনেক অস্পষ্ট ধারণা ছিল যা তাদের প্রভাবিত করেছিল। এর ফলে বর্ণহিন্দু মানে ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থদের মধ্যে কৌলীন্য প্রথার নাম করে ছোটো ছোটো গোষ্ঠী এবং বড় জাত ছোটো জাতের ধারণা তৈরি হতে শুরু হলো। 

তবে বাংলায় ক্ষত্রীয় বা বৈশ্য বর্ণের প্রভাব তেমন ভাবে পড়েনি। এখানে বিভাজন ছিল মূলত ব্রাহ্মণ, শুদ্র এবং অন্তজদের মধ্যে। 

ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত না হলেও প্রচলিত ধারণা এই যে বাংলার কৌলীন্য প্রথার সঙ্গে সেনরাজারা এবং রাড়ীয় ব্রাহ্মণদের কুলজীর সঙ্গে আদিসূর যুক্ত ছিলেন।

আসলে একসময় বাংলায় দুই বর্ণের বিবাহ প্রচলিত ছিল। একাদশ দ্বাদশ শতকে এই বাংলায় পাল বংশের শাসনকে অপসারণ করে কর্নাটকের সেনরা এবং চন্দ্র বংশের শাসন সরিয়ে কলিঙ্গের বর্মনরা শাসন ভার নেন। এর ফলে বাংলার সামাজিক এবং ধর্মীয় সংস্কৃতিতে বিরাট পরিবর্তন হয়ে যায়। পাল এবং চন্দ্ররা বৌদ্ধঘেঁষা ছিলেন বলে তাঁরা হিন্দু ধর্মীয় আচার আচরণের ব্যাপারে অনেকটা উদার ছিলেন। তাঁদের আমলে শাক্ত এবং শৈব্য তন্ত্রের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের বজ্রযান, মন্ত্রযান, সহজযান মিলে মিশে এক উদার ছন্দের সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল। কিন্ত সেন এবং বর্মণ রাজারা ছিলেন উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদী। তাঁরা এসে শুরু করলেন যাগ যজ্ঞ পূজাপাঠের অনুশাসন। বর্ণাশ্রম প্রথা কঠোর ভাবে পালন করা হতে থাকল। 

বল্লাল সেন সম্মন্ধে একটি গল্প প্রচলিত আছে। তিনি এক স্ত্রী বর্তমান থাকা সত্বেও তিনি বেশি বয়সে এক সুন্দরী ডোম রমনীকে বিয়ে করেন। তাঁর প্রজারা এই বিয়ে সহজে মেনে নেয়নি। বল্লাল সেন প্রজাদের অসন্তুষ্টিকে ঠাণ্ডা করার জন্যে এক বিশাল ভোজের আয়োজন করে সব সম্প্রদায়ের প্রজাদের নিমন্ত্রণ করেন। নমঃশুদ্র এবং আরও কিছু সম্প্রদায় এই ভোজ বয়কট করলেও অনেক সম্প্রদায় ভোজে যোগদান করে রাজার সুনজরে থাকার চেষ্টা করে।যারা ভোজসভায় এসেছিল রাজা সেই সব সম্প্রদায়কে ইচ্ছে মতো কৌলীন্য এবং পদবী দান করেন। সম্ভবত এই সময়ে ছত্রিশটি জাতি বা উপজাতির সৃষ্টি হয়। অনেক ঐতিহাসিক অবশ্য এই গল্পকে স্বীকৃতি দেন না। 

স্বয়ং নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন – ‘অথচ এই রাজার (বল্লাল সেন) আমলে যে সব স্মৃতি ও ব্যবহারগ্রন্থ রচিত হইয়াছিল, ইহাদের নিজেদের যে সব লিপি আছে তাহার একটিতেও এই প্রথা সম্বন্ধে একটি ইঙ্গিত মাত্র নাই, উল্লেখ তো দূরের কথা। বল্লাল ও লক্ষ্ণণের নাম কৌলীন্য প্রথা উদ্ভাবনের সঙ্গে জড়িত থাকিলেও তাঁহারা নিজেরা কেহ উল্লেখ করিলেন না ইহা খুবই আশ্চর্য বলিতে হইবে। ’ 

ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে শক হুণ মোগল পাঠান দ্রাবিড়, নেপালি, দক্ষিণ ভারতীয়, উত্তর ভারতীয় সব রকম রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছে বাঙালির রক্তের সঙ্গে। ঠিক কখন কি ভাবে এই রক্তের সংমিশ্রণ হয়ে কোনও জাতি বা উপজাতির সৃষ্টি হয়ে তা আজ আর নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। আর এই রক্তের সংমিশ্রণের সঙ্গে নানা ভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের পদবির ইতিহাস। 

বাঙালি ব্রাহ্মণদের মধ্যে প্রচুর শাখা উপশাখা আছে। পদবীও আছে প্রচুর। কনৌজী ব্রাহ্মণদের পদবী পাঁড়ে, দুবে, তেওয়ারী, চৌবে, সুকুল, দীক্ষিত, পাঠক, ওঝা, বাজপেয়ী ইত্যাদি। এর মধ্যে কিছু পদবী বাঙালিদের মধ্যেও দেখা যায়।

গৌড়ীয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে আছে সপ্তশতা, বারেন্দ্র, রাড়ী, বৈদিক, মধ্যশ্রেণী, শাকদ্বীপী ইত্যাদি। 

ব্রাহ্মণদের আদি পদবিগুলি সম্ভবত আসে তাদের বাসস্থান, অঞ্চল বা গ্রাম থেকে। এগুলিকে গাঞী পদবি বলা হয়ে থাকে। যেমন বন্দো, ভট্ট, চট্ট ইত্যাদি। 

জানা যায় গাঞী নামের বাইশটি এসেছে বর্ধমান জেলা থেকে, চারটি বাঁকুড়া থেকে, বীরভুম থেকে নটি, মুর্শিদাবাদ থেকে নটি, মানভুম থেকে একটি, হুগলি থেকে পাঁচটি এবং সাতটির উৎস জানা যায় না। 
দেখা যাচ্ছে ব্রাহ্মণদের সবচেয়ে বেশি গাঞী পদবী এসেছে বর্ধমান জেলা থেকে। তাই মনে করা যেতে পারে রাড়ী ব্রাহ্মণরা বর্ধমান জেলা থেকে অন্য জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। 

অনেকে মনে করেন গোত্রের সঙ্গে পদবীর সম্পর্ক আছে। কিন্তু কিছু পণ্ডিতরা মনে করেন গোত্র শব্দটি এসেছে গোষ্ঠ বা গো সম্পদের সাথে যুক্ত। আর্যরা যেহেতু প্রাথমিকভাবে পশু পালক ছিল এবং তাদের সম্পদ বলতে ছিল গো সম্পদ তাই তাদের গো সম্পদকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করার জন্যে গরুর গায়ে গরম কিছু দিয়ে তাদের গোষ্ঠির নাম দেগে দেওয়া হতো। সেখান থেকেই গোত্র ব্যাপারটি উৎপত্তি হয়। তাই পদবীর সঙ্গে গোত্রের কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। 

বৃত্তি থেকে পদবী গৃহীত হওয়ার অনেক উদাহরণ আছে। রাজশেখর বসুর মতে চৌধুরী পদবী চতুর্ধুরিণ শব্দের অপভ্রংশ। যার মানে চতুঃসীমানার অন্তরগত শাসক। সে কারণেই সম্ভবত বেশিরভাগ জমিদারদের পদবী হত চৌধুরী। আবার অন্য মতে চৌধুরী এসেছে চৈথহারী শন্দ থেকে এসেছে যার মানে যারা চৌথ (কর) আদায় করে। হাজারী পদবী মোগল আমলে প্রচলিত হয়। মনসবদারী থেকে অপভ্রংশ হয়ে হাজারি পদবী এসেছে। বিশ হাজারি, দশ হাজারি মনসবদার থেকে হাজারিটুকু রয়ে গেছে। তেমনি চাকরী সূত্রে মজুমদার, তালুকদার, চাকলাদার তরফদার, খাসনবীস, মহলানবীশ, পত্রনবীশ, বক্সি, মুস্তাফী, মুন্সী ইত্যাদি। 

মজুমদার হয়েছে যারা মজমা বা মৌজার হিসেব রাখত, তালুকদার তালুক-এর অধীকর্তা, সোহনবীশ দৈনিক হিসেব রাখত, শিকদার ছিল শান্তিরক্ষক। ফৌজের কাজে যারা হিসেব রাখত ফার্সীতে তাদের বলা হত বখসী। সেখান থেকেই হয়েছে বক্সী।

এরকম ভাবে, হাড়ি, ঢেঁকি, ঢাকি, ঢুলি, কড়াই, ঘড়া, খাঁড়া, হাতা, উকিল, গায়েন, তন্তুবায়, কর্মকার, মোদক, যোগী, স্বর্ণকার, মালাকার, ঘটক, পাঠক, জ্যোতিষী, কবিরাজ, ঘরামি, বৈদ্য, বণিক ইত্যাদি পদবীগুলি পেশাভিত্তিক বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। 

হাবিলদারের কাজ যাঁরা করতেন, তাঁদের বলা হতো ‘লস্কর’। দশজন সেনার উপরে যিনি থাকতেন, তাঁকে বলা হত ‘পদিক’। অপভ্রংশে যা হয়ে দাঁড়ায় ‘শতিক’। দশ শতিকের উপরে যিনি থাকতেন, তাঁকে বলা হত ‘সেনাপতি’। দশ সেনাপতির উপরে যিনি থাকতেন, তাঁকে বলা হত ‘নায়ক’। ‘দলুই’ পদবী এসেছে সম্ভবত দলপতি থেকে। অনুরূপ “চাকলাদার”, চাকলা মানে কতকগুলি পরগনার সমষ্টি। এই পরগনা সমষ্টির রক্ষাকর্তা চাকলাদার। 

কিছু পদবী আবার অন্তনাম থেকে উঠে এসেছে। নীহাররঞ্জন রায়ের মতে অন্তনাম থেকে উঠে আসা পদবী হলো দত্ত, পাল, নন্দী, বর্মন, দাস, ভদ্র, সেন, দেব, ঘোষ, কুন্ডু, পালিত, নাগ, চন্দ্র, দাম, ভুতি, বিষ্ণু, যশ, শিব, রুদ্র।

এগুলি সবই কায়স্থ বা বর্ণহিন্দুদের পদবি। ব্রাহ্মণদের পদবী নয়। 

আবার ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর ‘চিন্ময় বঙ্গ’ বইতে লিখেছেন যে বসু, মিত্র, দত্ত, দেব, চন্দ্র, সেন, নন্দী, ধর, ভদ্র, শূর এই সব পদবিতে জৈন সংস্রবের পরিচয় পাওয়া যায়। 

ব্রাহ্মণদের যেমন তিনশোর বেশি শ্রেণী আছে কায়স্থদের মধ্যেও বহু শ্রেণী ভাগ আছে। দক্ষিণ রাড়ী, উত্তর রাড়ী, বঙ্গজ ও বারেন্দ্র কায়স্থ ছাড়াও করণত-কায়স্থ, বাহাত্তর ঘর, রাজু-কায়স্থ প্রভৃতি অনেক শ্রেণীর কায়স্থ আছে।

তূলনামূলকভাবে বৈদ্যদের শ্রেণী ভাগ কম। বৈদ্যদের চারটি মতান্তরে পাঁচটি শ্রেণী আছে। 

বৈদ্যদের মধ্যে যুগ্ম পদবী ঠিক কি ভাবে এসেছে তা নিয়ে মতভেদ আছে। ষষ্ঠ শতকে রচিত দামোদর লিপিতে মহাসেনগুপ্ত নামটি পাওয়া যায়। তবে এখানে সেনগুপ্ত মোটেই পদবী নয়। তেমনি আর একটি ঐতিহাসিক নাম আদিত্য সেনগুপ্ত। এই নামের আদিত্য, সেন এবং গুপ্ত তিনিটি অংশই বাঙালির পদবী হয়েছে। এই ধরণের আরও কিছু নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়, যেমন দেবরায়, নাগসেন, চন্দ্রগুপ্ত, রুদ্রসেন, যশবর্মন ইত্যাদি। 

কিছু পদবী ইংরেজ শাসনকালে সৃষ্টি হয়েছে অথবা সাহেবদের উচ্চারণের সুবিধের জন্যে পরিবর্তিত রূপ নিয়েছে। পাল থেকে Paul, দাঁ থেকে Dawn, বোস থেকে Basu, মিত্র থেকে মিটার, চন্দ্র থেকে চন্দর, সিংহ থেকে সিনহা, রায় থেকে রয় অথবা রে ইত্যাদি। 

নানারকমের বিচিত্র পদবী আছে বাঙালিদের সেগুলি কোথা থেকে এসেছে তা অনুমান করা যেতে পারে, কিন্তু সিদ্ধান্তে আসা যায় না। 

সাহা পদবী এসে থাকতে পারে সিন্ধু প্রদেশের পদবী সাহানি থেকে।পটল এসেছে সম্ভবত গুজরাটের প্যাটেল থেকে। আটা পদবী এসে থাকতে পারে আট থেকে। হয়ত অষ্টপ্রহর কীর্তন গাইয়ে থেকে। ভঞ্জ পদবী এসে থাকতে পারে ভঞ্জদেব থেকে। ওয়াদ্দেদর পদবী এসে থাকতে পারে ওয়াদাদার থেকে। ওয়াদাদার একটি পদ, মানে যিনি আদালতে শপথ গ্রহণ করাতেন। কেরানি থেকে মুনশী, মহাজনী কারবার করা ব্যাক্তি হয়েছেন পোদ্দার, দলপতি থেকে দলুই। কুশো গ্রাম থেকে কুশারি, বোড়ো গ্রাম থেকে বড়াল, গড়গড়ে গ্রাম থেকে গড়গড়ি, পোষলা থেকে পুষালি, ঘোড়ুই এসেছে ঘড়াই বা ঘরামী থেকে, বসাক এসেছে বস্ত্র সম্বন্ধীয় থেকে, ইত্যাদি।

অতয়েব দেখা যাচ্ছে আমাদের বেশির ভাগ পদবীর উৎপত্তি পুরোপুরি ভাবে কোনও নির্ধারিত পদ্ধতি, নিয়ম, ঐতিহ্য, পরম্পরা, বংশানুক্রম ইত্যাদি মেনে সৃষ্টি হয়নি। বাসস্থান থেকে, বৃত্তি থেকে, বিদ্যা থেকে, শাসকের দেওয়া পুরস্কার থেকে বা শাস্তি থেকে, শব্দের অপভ্রংশ থেকে, অথবা অনেক সময় হয়েছে নেহাতই সমাজপতিদের খেয়ালখুশি মতো। 

তাই যারা এই সময়ে দাঁড়িয়েও কোনও ব্যাক্তির পদবীর মধ্যে দিয়ে তার জাত খুঁজবার চেষ্টা করে থাকেন তিনি একেবারেই ভুল রাস্তায় হাঁটেন। কারণ একই পদবী কত ব্যাপকভাবে বিভিন্ন জাতের মধ্যে দেখা যায় তার কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো। 

যেমন বিশ্বাস পদবী আছে কায়স্থ, মাহিষ্য, নমঃশুদ্র এবং আরও তিরিশ রকম জাতের মধ্যে। সেন পদবী আছে কায়স্থ, বৈদ্য ছাড়াও প্রায় ২৪ রকম জাতের মধ্যে। গোস্বামী পদবি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য, বৈষ্ণব, মাহিষ্য, সদগোপ, মালি, নমঃশুদ্র, এবং আরও কয়েকটি জাতের মধ্যে। অধিকারী পদবী আছে ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব মাহিষ্য, সদগোপ, কর্মকার, মালাকার, নমঃশুদ্র ইত্যাদি জাতের মধ্যে। 

জাতপাতের ধন্দে না গিয়ে আমরা যদি একটু পিছিয়ে গিয়ে বাঙালি জাতের উৎপত্তি নিয়ে একটু মাথা ঘামাই, তাহলে দেখব অতি প্রাচীন কালে যাদের আদি-অস্ট্রেলীয় বলা হতো তাদের নাম এ দেশে পরে হয়ে যায় ‘ভেড্ডিড’। কেউ কেউ যাদের দ্রাবিড়, আর্য এই ভাবে নরগোষ্ঠীগুলিকে ভাগ করবার চেষ্টা করেন, নীহার রঞ্জন রায় মশাই তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন এইগুলি আসলে ভাষাগোষ্ঠীর নাম। একই নরগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন ভাষা গোষ্ঠীর অবস্থান থাকতে পারে অঞ্চল হিসেবে। তাই এগুলি নরগোষ্ঠি নয়। 

গবেষকরা বাঙ্গালির জনপ্রকৃতির মধ্যে এ পর্যন্ত যে সব উপাদান পেয়েছেন তা থেকে বলা যায় ভেড্ডিড উপাদানই বাঙলার জনগঠনের প্রধান উপাদান। পরে কম বেশি ইন্দো-আর্য , মঙ্গোলীয়, শক ইত্যাদি উপাদান এসে মিশেছে। পাঁচমেশালী জাত হয়েও কালক্রমে বাঙালির একটা নিজস্ব গড়ন দাঁড়িয়ে গেছে। মিশ্রিত বলেই বাঙালির শরীরের গঠন সবই মাঝামাঝি। শরীরের উচ্চতা, মাথার গড়ন, নাকের উচ্চতা, গায়ের রঙ এ সবই মাঝারি। আদি কাল থেকে নৃতাত্বিক ভাবে বাঙালিরা এই সব নানা রকমের মিশ্রিত উপাদান গ্রহণ করে এবং এই বাংলাদেশের নদীজপমালাধৃতপ্রান্তরে বাস করতে করতে এক ধরণের টিপিক্যাল বাঙালি চেহারা অর্জন করেছে। যা দেখে সাধারণত কোনও বাঙালিকে বাঙালি বলে আমরা চিনতে পারি। তাই সহস্র বছরের প্রবহমান জীবনধারা বাঙালির শরীর ও মস্তিস্কে যে সব উপাদান নিহিত করেছে তার মধ্যে পদবীর ভুমিকা নেহাতই অর্বাচীন। পদবীর মধ্যে বাঙালির সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের প্রভাব খুব সামান্য। 

তাই রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশা মতো বাঙালি পরিণত হবার প্রমাণ হিসেবে কোনওদিন যদি ব্যাঙ্গাচির অস্থায়ী ল্যাজটির মতো আমাদের নামের পিছনে লেগে থাকা পদবীটি বর্জন করে দিতে পারে তাহলে সেটা হয়ত জাত হিসেবে আমাদের গৌরব বৃদ্ধিই করবে।

14 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - সুমন মাইতি

Posted in


প্রবন্ধ


সেন্ট ফ্রান্সিসের মেষপালক

এবং ইওরোপীয় নবজাগরণ


সুমন মাইতি





মধ্যযুগে ফ্রান্সিস্কান সন্ন্যাসীরা জুতো পরতেন না, কর্দমাক্ত পুতিগন্ধময় রাস্তা দিয়ে এই সন্ন্যাসীরা যখন হেঁটে কারুর বাড়ী যেতেন দূর থেকেই তাঁদের আসার “গন্ধ” পেত লোকে। দারিদ্র্যের অনুশাসন অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্যই এ বন্দোবস্ত। প্রতিষ্ঠাতা সেন্ট ফ্রান্সিস অফ অ্যাসিসি জীবনব্যাপী কৃচ্ছসাধন, কৌমার্যপালন আর জনসেবার ব্রত মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কালক্রমে জনসেবা করাটাই ফ্রান্সিস্কানদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এর কারণও ছিল। ত্রয়োদশ শতকে চার্চের আভ্যন্তরীণ রেষারেষি চরমে পোঁছয়। স্প্যানিশ রাজপুরুষ ডোমিনিক দে গুজমান স্থাপিত কট্টরপন্থী ডোমিনিকানদের সঙ্গে ভক্তিবাদী ফ্রান্সিস্কানদের মতাদর্শগত সংঘর্ষ একরকম অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে যার ফলে চার্চের আভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বড়সড় প্রশ্নের মুখে পড়ে। “ঈশ্বরের সারমেয়” (Domini Canes) বলে খ্যাত ডোমিনিকানদের হেরেটিক হান্টার বলা যায়। আচার ব্যবহারে নিজেদের এলিটিস্ট ভাবমূর্তি বজায় রাখতে পছন্দ করতেন তাঁরা। তাঁদের সাথে পাল্লা দিতে জনবান্ধব ভাবমূর্তিকেই প্রধান অবলম্বন করেন ফ্রান্সিস্কানরা। বৃহত্তর ক্ষেত্রে সাধারণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে যে আখেরে চার্চেরই প্রাসঙ্গিকতা গৌণ হয়ে পড়বে এটা বুঝতে ভুল করেননি ফ্রান্সিসকানরা ফলত ডোমিনিকানদের তুলনায় নিজেদের ব্যতিক্রমী হিসেবে তুলে ধরতে বিশষভাবে সচেষ্ট ছিলেন ফ্রান্সিস্কান সন্ন্যাসীরা। ৪০০ খ্রিষ্টাব্দের প্রখ্যাত দার্শনিক অগাস্টিন অফ হিপোর ধ্রুপদী গ্রীক আর জুডেইজমের মিশেলে গড়ে তোলা খৃষ্টীয়ধর্মের মূল কাঠামোয় চিড় ধরতে শুরু করে ত্রয়োদশ শতকে। গ্রেনাডার মুর শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় হেলেনিস্টিক দর্শনের পুনর্ন্মেষ হওয়ায় তৎকালীন চার্চের নেতৃত্ব প্রমাদ গোণেন। ডোমিনিকান দার্শনিক টমাস অফ অ্যাকুইনাস নিজের লেখায় অ্যারিস্টটলীয় দর্শন আর চার্চের ঘোষিত অবস্থানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার একটা চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি - টমাসের মৃত্যুর মাত্র তিন বছরের মধ্যে ১২৭৭ সালে অ্যারিস্টটলীয় দর্শনকে হেরেটিকাল ঘোষণা করেন বিশপ এতিয়েন তঁপিয়ে। কিন্তু এই নির্বিকল্প কট্টরবাদ যে মানুষকে চার্চের প্রতি আরো বিরূপ করে তুলবে সেটা বুঝতে পারছিলেন অনেকেই। সেজন্য দরকার হলো নতুন জন সংযোগনীতির। “le jongleur de Dieu” বা “God’s Tumbler” নামে খ্যাত ফ্রান্সিস মনে করতেন ধর্ম এবং ধর্মীয় আচার মানুষকে কাছে টানার মাধ্যম। জনসমর্থনের সাথেই জড়িয়ে আছে রাজনৈতিক চেতনা, ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের অবাধ অধিকার। ফ্রান্সিসকে পপুলিস্ট অভিধা দিলে অতিশোয়ক্তি হবে না। এই রাজনীতি একুশ শতকেও প্রাসঙ্গিক যেখানে উগো চ্যাভেজ গসপেলের সাথে সাম্যবাদের সমন্বয় ঘটিয়ে সমাজপরিবর্তনের স্বপ্ন ফিরি করেন! কাজেই জনসমর্থন উদ্ধারে ফ্রান্সসিকানদের মতামতটাই প্রাধান্য পেল তৎকালীন চার্চে। উচ্চশিক্ষিত দার্শনিক টমাসকে সরিয়ে “অতি সাধারণ” ফ্রান্সিসই চার্চের যোগ্যতম মুখপাত্র হয়ে উঠলেন যিনি বাস্তবের আঙ্গিনায় হাতের নাগালে নামিয়ে আনলেন ধর্মকে। মৃত্যুর তিন বছর আগে ১২2৩ খ্রিষ্টাব্দে গ্রেইচ্চো (Greccio) শহরে ক্রিসমাসের প্রাক্কালে নেটিভিটি উদযাপনের সময় চার্চে হাজির করলেন দৈনন্দিনতার অতিপরিচিত মনুষ্যেতর প্রাণী- গাধা, ষাঁড় যাতে বেথলেহেমের আস্তাবলের “বাস্তবসম্মত” রূপ দেওয়া যায় – রূপক নয় ঘটমান বাস্তব সৃষ্টি করলেন দর্শকের জন্য। “I wish to make a memorial of that child who was born in Bethlehem and as far as is possible behold with bodily eyes the hardship of his infant state, lying on hay in a manger with ox and the ass standing by.” পূর্ববর্তী বাইজান্টাইন শিল্পীরা ঈশ্বরকে বেঁধে রাখতে চেয়েছেন দূরতর মাত্রায় - রাজন্যপৃষ্ঠপোষকতায় বিস্তার লাভ করা ধর্মে সময়ের সাথে এই দূরত্ব তৈরি করে নেওয়াটা হয়ত প্রয়োজন ছিল কিন্তু ত্রয়োদশ শতকের গিল্ডনির্ভর উচ্চাশী বণিককূল সেই কাঠামোয়টায় যে ধাক্কাটা দিচ্ছিল সেটাকে সামলে উঠতে না পারলে মূল কাঠামোটাই ভেঙে পড়তে পারত। ফ্রান্সিস সেই প্রতিঘাত সামলে ওঠার রাস্তাটা দেখিয়ে দিলেন - রহস্যের দোরগোড়া থেকে বোধগম্যতার সন্ধিক্ষণে উপস্থিত করলেন দর্শককে - জন্ম হলো রিয়ালিজমের। গত শতকের স্টুডিওর সেট থেকে বেরিয়ে ৩৫ মিমি লেন্সে ঘটমান বাস্তবতা ধরতে চাওয়া রোজেলিনি, ভিত্তোরিও ডি সিকা নিওরিয়েলিজমের যে ধারা তৈরি করেন তার সূচনা হয়ত গ্রেইচ্চোতেই হয়েছিল। ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর মঠে যোগ দেন রজার বেকন -আধুনিক বিজ্ঞানের আদিগুরু। যদিও বেকন বিশুদ্ধতাবাদী ফ্রান্সিস্কান মতবাদে আজীবন বিশ্বাসী ছিলেন কিন্ত স্বভাব দার্শনিক বেকনের কাছে অন্তহীন নিয়মানুবর্তিতা আর বৌদ্ধিক স্বাধীনতার মধ্যে দ্বিতীয়টিকে প্রেয়তর মনে হয়েছিল। তাঁর মতে পরিদৃশ্যমান এই জগতের একটি হচ্ছে আমাদের জগত, সদা উদ্ভ্রান্ত, আবেগনিত্য বাসনাভূমি; অন্যদিকে রয়েছে বিশুদ্ধ, শাশ্বত, ধ্রুবক সত্য। এই জগতের অপ্সৃয়মান ছায়ায় নিত্যতার অন্বেষণের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে রহস্য। ফ্রান্সিসের মতোই বেকন মনোনিবেশ করলেন সেই রহস্যের উন্মোচনে - অন্ধকার থেকে আলোর আধোদীপ্ত উত্তরণের এপথ ধরেই ভাববাদী দর্শন থেকে বস্তুবাদী জিজ্ঞাসার উন্মেষ, জন্ম আধুনিক বিজ্ঞানের। বেকনের রাস্তাটা সহজ ছিলনা যদিও – ফ্রান্সিস্কান মাস্টার বনাভঁশ্যিওর চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেননি যাতে বেকনের বই প্রকাশ হয়। তৎকালীন চার্চের মূলভাষ্য;- ঈশ্বর নির্দিস্ট জগতে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই – অজ্ঞেয়বাদী প্রশ্ন করলেই সে হেরেটিক, ইনক্যুজিশানের উপযুক্ত। উপরন্ত একজন ফ্রান্সিস্কান ফ্রায়ারের পক্ষে প্রশ্ন তোলা ব্ল্যসেমীর সমতুল – এই বই প্রকাশিত হলে চিরপ্রতিদ্বন্দী ডোমিনিকানদের হাতে সেটি যে রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠবে না সে নিশ্চয়তাই বা কে দেবে! কাজেই বনাভঁশ্যিওর আপত্তির কারণ বুঝতে অসুবেধে হয় না। কিন্তু বেকন চার্চ নেতৃত্বকে বোঝাতে সক্ষম হন এই উত্তরের অন্বেষণই ঈশ্বরসৃষ্ট এ জগতের প্রতি মানুষকে আরো মনোযোগী করে তুলবে, তাতে স্রষ্টাই মহিমান্বিত হবেন, জনমানসে আরও গভীর হবে বিশ্বাস। শেষপর্যন্ত পোপের সম্মতি মিলল। বেকনের লেখা ওপাস মায়ুস প্রকাশিত হয় ১২৬৭ সালে। বিশ্বাসের জগত ছেড়ে যুক্তিবাদের পথে একধাপ এগোল ইতিহাস। এই বই প্রকাশের কয়েকদশক পর আরেকটি বিপ্লব ঘটাবেন অন্য এক ফ্রান্সিসকান। 

ফ্লোরেন্স থেকে ছোট্ট শহর ভেস্পিন্যিন্যানো যাচ্ছিলেন প্রখ্যাত
ইতালীয় ভাস্কর সিমাব্যুয়ে - পথিমধ্যে চোখে পড়ল একটি ছেলে আত্মমগ্ন হয়ে পাথরের ওপর ছবি আঁকছে, সামনের মাঠে চরতে আসা ভেড়ার পাল অবয়ব পাচ্ছে নির্মোহ মর্মরে। বছর দশেকের ছেলেটিকে মনে ধরল সিমাব্যুর – শিক্ষানবীশ হিসেবে নিজের কাছে নিয়ে এলেন। সময়টা সম্ভবত ১২৭০-৭৫। কয়েক বছরের মধ্যেই আপন স্বাতন্ত্র্যে নিজের জাত চেনালো ছেলেটি। গুরুর ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজস্ব ঘরানার জন্ম দিল। ছেলেটির নাম জিয়েত্তো ডি বনদুন। ইতালির বাণিজ্য নির্ভর নগররাষ্ট্রগুলিতে ততদিনে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মুক্ত অর্থনীতির সুফল মিলতে শুরু করেছে। অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে ব্যবসায়িক মেলবন্ধনে লাভবান হচ্ছে ফ্লোরেন্স, জেনোয়া, পাদুয়া। শিল্প-স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন ইতালীয় বণিকশ্রেণী।
এই প্রাক-রেনেসাঁ যুগে জন্ম জিয়েত্তোর। নিজের ক্ষর্বাকৃতি নিয়ে স্বভাব সচেতন শিল্পী অনুপম দক্ষতায় ভাস্কর্যে ফুটিয়ে তুলতেন সাধারণ মানুষের রূপ। শুধুই হেলেনিস্টিক যৌনতার বাহ্যিক উপাচার বা বাইজেন্টাইন অনমনীয় কঠোরতা নয় (ষষ্ঠ শতকের সেন্ট অ্যাপোলিনারে ন্যুয়েভো ব্যাসিলিকায় আঁকা ভার্জিন অ্যান্ড চাইল্ড দ্রষ্টব্য)- জিয়েত্তো শিল্পসত্তায় আনবেন মানবীয় নির্ভাষ, চরিত্রের দোলাচল, ঋজুরেখ নয় কোমল বাস্তবতায় মূর্ত হয়ে উঠবে সে সৃষ্টি। উত্তরকালে এর ছায়া পড়বে সাহিত্যে, কবিতায়, নাটকে, ছবিতে - মানবীয় হয়ে উঠবে শিল্প। 

স্ক্রোভেন্নি চ্যাপেলের দেওয়ালে আঁকা জিয়েত্তোর কিস অফ জুডাস গ্রোটেক্সের শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশে অনন্য। গার্ডেন অফ গ্যেথসেমনিতে দাঁড়িয়ে জিসাস – চারিদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ইয়াওয়ের পবিত্রতা রক্ষায় উন্মক্ত একদল ধর্মান্ধ মানুষ, কেইনের মতোই তাদের হাতে ঘাতক অস্ত্র, মশালের আলোয় জ্বলছে চোখগুলো, অবদমিত হিংস্রতা সে চোখে – “কে এই প্রতারক যে নিজেকে ঈশ্বরপুত্র বলার দুঃসাহস দেখায়!” মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিসাস আর জুডাস, একটু আগেই জুডাস এগিয়ে এসে চুমু এঁকে দিয়েছেন র‍্যাবাইয়ের গালে। জিয়েত্তো এখানে নিজেকেও ছাপিয়ে যাছেন –– জিসাসের বিপ্রতীপে উদগ্র জিঘাংসায় অসূয়ার অপাংক্তেয়তায় পরাভূত ক্যুব্জ জুডাস, যে নিজেও জানে অপরিমেয় এই ধ্বংসের খেলার অন্তে তার পরিণতি কিন্তু এক অমোঘ আগ্রাসনে নিয়তির কাছেই আত্মসমর্পণ করেছে সে। জুডাসের মুখমণ্ডল জুড়ে রিক্ত সর্বগ্রাসী ঘৃণা, রক্তের ভেতরে চারিয়ে যাওয়া অস্ত্বিত্ব বিনাশক কদর্যতা ফুটিয়ে তুলছেন জিয়েত্তো। ছবিতে কদর্যতা এবং আত্মিক সংকট যেন সমার্থক হয়ে ওঠে। নিরন্তর আত্মরতির সাধনায় মগ্ন আমরা নিজেরাই কোন না কোন সময় জুডাস হয়ে উঠি – জিয়েত্তো আর্শি তুলে ধরেন, আত্মপ্রত্যয়ের এই অন্তহীন স্খলনে, নিজেরাই সচকিত হয়ে তাকাই, অস্ত্বিত্বের দোহাই দিয়েও সেখান থেকে মুক্তি মেলে না।

জিয়েত্তো ফ্রান্সিকান অর্ডারের সদস্য ছিলেন। গুরুতর্পণে অকৃপণ। সেন্ট ফ্রান্সিসসের নামে উৎসর্গীকৃত ব্যাসিলিকায় করা তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফ্রেস্কোগুলিতে ফ্রান্সিসের অনুষঙ্গ এসেছে বারেবারে। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকা সন্তকে দেখতে এসেছেন ক্লে’য়ার (Saint Francis Mourned by Saint Clare)– ফ্রান্সিসের সাথে তাঁর বিশেষ বন্ধুত্ব, সাধন পথের সহযাত্রী - একাধিক জায়গায় ফ্রান্সিস নিজেই বলেছেন সেকথা। জিয়েত্তো সন্ত নয়, মানবী ক্লে’য়ার ছবি আঁকছেন – অনেকটা পথ উজাড় করে বন্ধুকে শেষবারের মতো দেখতে এসেছেন
তিনি - অপরিসীম মমতায় ধরে আছেন ফ্রান্সিসের হাতখানি –নিষ্প্রাণ সে দেহ তবু এত সহজে কি যেতে দেওয়া যায় তাকে? ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন ক্লে’য়ার। অস্তিত্বের সমস্ত গ্লানি আর গৌরব মিশে আছে এই নশ্বর দেহে – ফ্রেস্কোর আঁচড়ে অমূল্য সেই অসহায়তা ফুটিয়ে তুলছেন জিয়েত্তো। বহুদিন আগের গ্যালিলিতে হেঁটে ছিলেন যে ঈশ্বরপুত্র, ভাগ করে নিয়েছিলেন মানুষের কান্না, হাসি, যন্ত্রণা, শিল্পের মধ্যে ধরা দিচ্ছে সেই দ্যোতনা। জিয়েত্তোর দেখানো পথ ধরেই একে একে আসবেন ঘিবার্তি, দোনাতেল্লো, মন্তেগন্না, কারাভাজ্জো - নীরব নতমস্তক হবেন রেনেসাঁ যুগের তিন মহারথী মিকেলাঞ্জেলো, রাফ্যেল এবং ভিঞ্চি; এঁদের প্রত্যেকের সৃষ্টিতে জিয়েত্তোর শিল্পঘরানার প্রভাব সুস্পষ্ট।


শিল্পী জিয়েত্তো একে একে সামাজিক প্রথাগুলো ভাঙছেন – চিত্রে ইঙ্গিতময়তার (অনু)প্রবেশ ঘটছে। এরকম আরেকটি সৃষ্টি Renunciation of Worldly Goods। ব্যপ্টিজমের পর সেন্ট ফ্রান্সিস এসেছেন পিয়েজ্জায় – উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আপন পিতা, সম্ভ্রান্ত বস্ত্র ব্যবসায়ী; একমাত্র পুত্রের সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি তিনি, উন্মক্ত ক্রোধে আরক্ত পিতা পুত্রকে আঘাত করতে উদ্যত।
ছবিতে পিতাপুত্রের মাঝে নিঃসীম তমিস্রা, ঘন নিশ্চিত, শীতল অব্যর্থ এই বিভাজন – পার্থিবের সাথে অপার্থিবের। পিতার উদ্যত হাত নিবৃত্ত করছেন আরেক বৃত্তিজীবি– সন্তান মাত্রেই পিতার ইচ্ছে-অনিচ্ছের দাস নয়, নিজের পছন্দ অপছন্দ বেঁচে নেবার অধিকার রয়েছে তারও। ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিসর তৈরি করছেন জিয়েত্তো। এই সন্ত সুদূর আধ্যাত্বিক জগতের বাসিন্দা নন – আমাদের খুব কাছাকাছি একদম পাশের বাড়ীর ছেলেটির মতোই সে। রাজার প্রাসাদে নয়, নির্লিপ্ত নিরালার উপান্তে কোন উপাসনালয় নয়, তিনি নেমে আসছেন গণিকা, ভবঘুরে, বাউণ্ডূলে অধ্যুষিত হাটে-বাজারে; সম্ভ্রান্ত, পবিত্রতার মোড়ক খুলে আধ্যাত্বিকতার আগমন ঘটছে ধুলিধুসরিত মানব জমিনে। 

সচেতনভাবেই হেলেনিস্টটিক প্রেক্ষিতকে প্রকট করে তোলেননি জিয়েত্তো বরং অবাঙমানসগোচর পেরিয়ে দারিদ্র্যে ভরা ভুবনে নামিয়ে এনেছেন আপন চরিত্রদের – স্রষ্টা হিসেবে এটা তাঁর অর্জন। যদিও আজীবন নিষ্ঠাবান ক্যাথলিকের মতোই নিজের কৃতিত্বের পুরোটাই ঈশ্বরের দান বলেছেন কিন্তু তাঁর বাস্তবতা কেবল সন্ত নিরূপিত চার্চের একরৈখিক ভাষ্য নয় – সেখানে জিয়েত্তোর চরিত্রদের নিজস্ব হতাশা, দ্বেষ, অসহয়তা, আশা, অপত্যভাব, দূরত্বের বিস্তার এই সামগ্রিকতার ছাপ পড়েছে তাঁর ছবিতে।
জিয়েত্তোর সৃষ্ট ওনিস্যান্তি ম্যাডোনা আর নেটেভিটি অফ জিসাস ফ্রেস্কোদুটিতে এর প্রকাশ খুব স্পষ্ট। ম্যাডোনার চেহারায় ইতালীয় প্রভাব স্পষ্ট, নশ্বর মানবী। সদ্যজাতের মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ যেন মা জানেন ভবিষ্যতের গর্ভে তাঁর সন্তানের জন্য কি পরিণতি অপেক্ষায়। স্বর্গীয় আভার সাথে জীবনের অনিশ্চয়তায় বিম্বিত হয় সে ম্যাডোনা। নেটিভিটি অফ জিসাস ফ্রেস্কোটিতে মেরি এবং ম্যাজাইয়ের মাঝখানের স্পেসটিতে আপেক্ষিক ত্রিমাত্রিকতায় বিন্যস্ত জোসেফ গর্দভ অজ, মেষ, আর গোশাবক – বলতে চাইছেন এই সৃষ্টি কেবল মানুষের নয়, মনুষ্যেতর প্রাণীরাও এই সমগ্রতার অংশ। নশ্বর জগতের সঙ্গে অবিনশ্বরের মেলবন্ধন ঘটাচ্ছেন তিনি, শিশু নোয়েল সেই মধ্যবর্তিকার সেতুবন্ধন। ইউক্রাইস্টের ভিত্তিভূমি। 

একনিষ্ঠ আনুগত্যের পরিবর্তে মনের গহীনের এই আলোছায়ার পরিস্ফুরণ ঘটিয়েছেন জিয়েত্তো। রেনেসাঁর আদিপর্বের বেকনের রহস্যবাদীতার পুনর্জন্ম ঘটাচ্ছেন শিল্পে। ইউক্রাইস্টের সিম্বলিজমের সাথে সম্পৃক্ত ভৌম বস্তুজগত আর আধ্যাত্বিক চেতনার মধ্যবর্তী অদৃশ্য সোপানসারি দর্শকের সামনে তুলে ধরছেন –প্রশ্ন তৈরি করছেন – যে রহস্যের মোড়কে একটুকরো রুটি ঈশ্বরের অংশ হয়ে ওঠে, আপাত জড় পদার্থে প্রাণ সঞ্চার হয় তার স্বরূপ কি? কেনই বা তার ভিন্ন প্রকাশভঙ্গি? এই রূপান্তর কি সার্বজনীন নাকি ক্ষেত্রভাবউদ্ভূত? প্রশ্নগুলো চার্চের নীরব পালপিটে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত তুলছে বিশ্বাসীর মনে, স্থাপিত হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর – এই পরিপ্রশ্নেন সংস্থিতা দার্শনিক চিন্তার ছাপ পড়বে ভাস্কর্যে, চিত্রকলায়, বিজ্ঞানে – চার্চের অজান্তেই ধীরে ধীরে নবজাগরণের দরজাটা উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন জিয়েত্তো। 

ক্ষর্বকায়, শালপ্রাংশু, উচ্ছল, বিনয়ী এভাবেই জিয়েত্তোর বর্ণনা দিয়েছেন গুণমুগ্ধ কথাকার ফ্লোরেস ডি আর্কেইস যদিও সমসাময়িক স্বভাব রসিক জিওভান্নি বোকাচ্চিও তাঁর দৈহিক রূপকে শ্লেষে বিদ্ধ করতে ছাড়েননি “...amazing genius is often found to have been placed in the ugliest of men...” - বোকাচ্চিওর বর্ণণায় জিয়েত্তো এক কুদর্শন, খর্বকায়, গাঁট্টাগোঁট্টা মেষপালক। মধ্যযুগের আভিজাত্যের শ্রেষ্ঠত্বের অভিমান আর ফিউডাল ফিয়েফডমের পূর্বনির্দিষ্ট নিয়তিরবাদের কোনটাই তিনি বংশগরিমায় অর্জন করেননি – ভাগ্যিস করেননি। ছাত্রদের মুখে মায়েস্ত্রো সম্ভাষণ শুনলে বিরক্ত হতেন, সচেতনভাবেই এড়িয়ে যেতেন উপাধি বা পদবীর গরিমা – এটা তাঁর নীরব প্রতিবাদ। সামান্য এক মেষপালকের কাছে চিত্রশিল্প শিখতে আসছে রাজপুরুষরা এটাই তো এক বিস্ময়! স্ক্রোভেন্নি চ্যাপেলেই রয়েছে আরেকটি ফ্রেস্কো – লাস্ট জাজমেন্ট। বহুজনের ভীড়ে দাঁড়িয়ে জিয়েত্তো, পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে তাঁর মুখ – আপন হাতের জাদুতে যিনি ভেঙে দিয়েছেন শতাব্দীলালিত ধারণগুলো, যাঁর প্রদর্শিত পথে আসবে রিয়ালিজম, স্যুরিয়ালিজম, ম্যাজিক হার্মোনিকায় সুর তুলবেন পিটার গ্যাব্রিয়েলের স্যলসবুরী হিল - জীবনের ম্যাগনাম ওপাসে সেই ভাস্কর শিল্পী বড়ই বিনম্র, স্থিতধী, আনতচোখে যেন প্রভুর অপক্ষায়। তাঁর কাজ শেষ। প্রাকরেনেসাঁ এই ভগীরথের হাত ধরেই চার্চের বস্তসর্বস্ব উপাচারের ভেতর থেকে মাথা তুলে দাঁড়াবে হিউম্যানিজম – মাধ্যম, রূপক, ক্ষেত্র প্রস্তুত করে ফেলেছেন জিয়েত্তো;- মিক হ্যাজ ইন্ডিড ইনহেরিটেড দ্য আর্থ। 






তথ্যপঞ্জীঃ

St. Francis of Assisi by G.K. Chesterton
Giotto: The Complete Works by Luciano Bellosi 
Giotto by Francesca Flores d’Arcais 

0 comments:

0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - সুবোল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবোল দত্ত


॥১০॥


বিপন্ন ধাতুর পাতে ভেষজের আত্মসমর্পণ 


পেরো

হুঁশে ফিরে আসতে যে নিজেরই শরীরের সাথে এমন লড়াই লড়তে হয়, এটা পেরো কখনোই জানতো না। ওকে নিয়ে কেউ যেন শূন্যে লোফালুফি খেলছে। পুরো শরীরটা যেন বরফের গোলা। তবে পরিস্থিতি যেমনই হোক নিজেকে নিজের মধ্যে ফিরে পাওয়ার মানসিক লড়াই পেরোর নতুন নয়। কিন্তু তবু টেনে হিঁচড়ে চেতনায় আসতেই শুরু হলো পেটে ও তলপেটে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। যেন নাড়ীভুঁড়ি অবাধ্য সাপের মতো ফণা তুলে চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। অনেক চেষ্টা করেও সে এখানে কি করে এল আর কিইবা হয়েছিল কিছুতেই মনে করতে পারছে না সে।

শেষমেষ চোখের পাতা একটু খুলতে পারলো। খুলেই দেখলো উজ্জ্বল সিঁদুর রঙের বাঁশের বেতে ছাওয়া একটা চালার নিচে শুয়ে। সিঁদুর রঙএর বাঁশ! পেরোর কেমন অদ্ভুত লাগলো।দৃষ্টি আরএকটু ফর্সা হতে পেরো দেখল ঠিক বাঁশ নয় তবে বাঁশের মতোই অদ্ভুত ধরনের লাল কাঠ, গাঁঠগুলো চওড়া মসৃণ আর হরেকরকম সুন্দর কারুকাজ করা। সেগুলোর উপরে বড়বড় তালপাতার মতো সিঁদুর রঙএর শুকনো পাতা দিয়ে ছাওয়া ঘরের ভিতরে সে শুয়ে আছে। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই সে মনে করতে পারছিল না সে কে আর কেনই বা তার এই দশা। ধীরেধীরে শরীরের সাড় ফিরে আসতে পেরোর মনে হলো সে যেন একটা সর্ষে আর হাওয়া ভরা খুব নরম ঠাণ্ডা একটা গদির ভিতরে ডুবে আছে। একটু মাথা তুলে ভালো করে দেখেই পেরো হয়রান হয়ে গেল। বিছানাটা কোনও তোষক নয়। মস্ত বড়বড় পদ্মপাতায় হালকা করে তার পুরো শরীরটাই মোড়া। আর পুরো শরীরটাই ঘৃতকুমারীর রসের মতো হলুদ পিছল রসে মাখামাখি। এতো ঠাণ্ডা আর গুড়ের মতো এমন গাঢ় চ্যাটচ্যাটে রস যে আঙুল পর্যন্ত নড়াতে পারছে না পেরো। একটু নড়াচড়ার অসফল চেষ্টার পর পেরো চুপচাপ পড়ে রইল। হাতপা এর সাড় নেই। পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। পেরো অন্য যেকোনও মানুষ থেকে একটু আলাদা এ কথাটা সাবজী বারবার বলেন। যন্ত্রণা সইবার অসম্ভব ক্ষমতা পেরোর। মুখ দিয়ে একটুও আওয়াজ বেরোয় না। ওইভাবে যন্ত্রণা সহ্য করে কিছুক্ষণ পড়ে থাকতে থাকতেই একটা আরো তীক্ষ্ণ ব্যাথা তার সারা দেহ কাঁপিয়ে মুখ দিয়ে বার হলো। মুখ দিয়ে শুধু চিত্কার বেরলো না, একটা কালো পিচের মতো তরল ঝলকে ঝলকে বার হতে লাগলো। চোখের সামনে লাল বাঁশের চালা বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে লাগলো। ঠিক তখনই একটা মেয়েলি রিনরিন কণ্ঠ শুনে তার সব কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু আবার অজ্ঞান হয়ে গেল।

দুর্গম পাহাড়ী জঙ্গলে পেরোর অনায়াস বিচরণ এবং সে এত সতর্ক থাকে যে ছোটো চোরা গর্তও তার নজর এড়ায়না। কিন্তু পেরোর মাথায় কি দুর্বুদ্ধি এসেছিল, দৌড়ে গিয়ে ওই লুকনো গভীর ফাটলের হাঁ মুখে পড়েছিল। আসলে ওই গর্তটা হলুদ স্বর্ণলতার ঘন জাল ও বনখেজুরের ঝোপে ঢাকা ছিল। পেরো ভেবেছিল একটা লম্বা লাফ দিয়ে পার হয়ে যাবে। কিন্তু সেই ফাটলের হাঁ মুখ দিয়ে সরাসরি গলে গিয়ে একটা প্রায় তিনশ মিটার ন্যাড়া দেওয়ালের মতো খাড়া পাহাড়ের নিচে খাদে পড়ে গিয়েছিল। সেই অতল খাদ আসলে একটা পাঁকে ভর্তি জলাভূমি।পাহাড় বেয়ে পড়তে পড়তে দু চারবার পাথুরে দেওয়ালে পেরোর শরীর ধাক্কা খায়। একটা বাবলা গাছের লম্বা লম্বা কাঁটার ঘায়ে তার পেট ও হাত পা কোমর চিরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। তারপর তার শরীরের প্রায় অর্ধেকটাই পাঁকে ডুবে যায়। পেরো এমন খাড়া ভাবে পড়েছিল যে তার বুক অব্দি জল ও কাদাতে ডুবে ছিল। ওই অবস্থাতে পেরো প্রায় দু তিন ঘণ্টা অজ্ঞান হয়ে রয়েছিল। ওই অবস্থাতেই যখন জ্ঞান ফিরলো তখন পেরো দেখল তার চারপাশে উজ্জ্বল নীল আর হলুদ রঙের বড়ো বড়ো পদ্মফুল। আর মোটা মোটা ডাঁটার উপরে মস্ত বড় বড় পদ্মপাতা উঁচু ছাতার মতো তাকে অদল করে আছে। প্রচুর ছোটো ছোটো মাছির মতো কিছু তার মাথার চারপাশ ঘিরে উড়ছে। একটু মাথা ঘুরিয়ে দেখল তার খুব কাছে একটা বড় পদ্মপাতার নিচে একটা ছোটো মৌচাক থেকে বেরিয়ে ওগুলো উড়ছে। তার মানে ওগুলো মৌমাছি! ওই মৌচাকে পদ্মমধু আছে! মৌমাছিগুলো ওর গায়ে মুখে বসছেনা। সেও কিন্তু কোনওমতেই নড়তেচড়তে পারছিল না। তবে তার চেতনা ফিরে আসাটা ছিল ক্ষণিক। শরীরের নিচের ভাগ আছে কি না বা আদৌ কি ছিল সেটা মনে করতে করতেই আবার জ্ঞান হারিয়েছিল। আবার দীর্ঘসময় পর যখন তার জ্ঞান ফিরলো দেখল চারপাশে আর সেই পদ্মফুলের বন নেই। মাথার উপরে পরিষ্কার নীলাকাশ। সে মস্তবড় নরম সবুজ পদ্মপাতায় শুয়ে। হাত দুটো কোনও খুঁটিতে বাঁধা। খুব কাছে এক নারী তাকে ছুঁয়ে আছে। আর দুজন খালি গায়ে বয়স্ক মানুষ তার শরীর কাটা ছেঁড়ায় ব্যস্ত। শরীরে কোনও সাড় নেই আর ওরা কেন আর কি জন্যে এইসব করছে আর এরজন্যে তাকে কি করতে হবে সে কোনওমতেই বুঝতে পারছিল না। একবার শরীর মোচড় দিয়ে হাতের বাঁধন খুলতে চাইল কিন্তু ওই মেয়েটি তার মুখে বুকে হাত বুলিয়ে দিতে সে স্থির হয়ে অবোধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার জ্ঞান হারালো।

আবার যখন জ্ঞান ফিরলো পেরো শুনল তার খুব পরিচিত মাতৃভাষা। সেই মেয়েটি আর তার পাশে সেই দুটো লোক। ওরা তারই খেড়িয়া শবর ভাষায় কথা বলছে। কিন্তু ওদের গায়ের রঙ এত স্নিগ্ধ আকাশী নীল আর গোলাপী রঙের! পেরো দেখল মেয়েটি তার খুব কাছে ঘেঁষে রয়েছে। উঁচু সামনের দিকে ঠেলে বেরিয়ে আসা কপাল। থ্যাবড়ানো নাক। পুরু ঠোঁট। চেহারার গঠনে ও খেড়িয়া শবর কিন্তু গায়ের রঙ নীলচে গোলাপী। আর স্বাস্থ্য! এইরকম সুঠাম নীরোগ শরীর পেরো আগে কখনও দেখেছে বলে মনে পড়ে না। কথা বলছে যেন মধু ঝরে পড়ছে। এমন সুন্দর ঝকঝকে সাদা দাঁত পেরো আগে কখনও দেখেনি। এতো মনোরম স্বর্গীয়! তবে কি স্বর্গে এসে গেছি আমি? পেরো দেখল তার গা থেকে পদ্মপাতার মোড়ক খোলা হচ্ছে। মেয়েটি তার খুব কাছে বসে একটা নারকেলের খোলে রাখা মধুর মতো কিছু তার ঠোঁটের কাছে আনলো। একহাত দিয়ে পেরোর ঠোঁট খুলে হাঁ মুখে সেই তরল ঢালতে লাগলো। দুই বয়স্ক মানুষ তখন তার শরীরের ক্ষতের উপচারে ব্যস্ত। তিনজনেই নীচুস্বরে কথা বলে চলেছে।

ওদের কথাবার্তা শুনে পেরো বুঝল ওকে জড়িবুটির ওষুধ পদ্মমধুর সাথে খাওয়ানো হচ্ছে। পেরোর পেটের অনেকটা জুড়ে সেলাই করা হয়েছে। সেটা করা হয়েছে বিশেষ ধরনের মিহি রেশম সুতো দিয়ে। বমির সাথে পেটের ভিতর থেকে কালো কালো তরল বেরিয়ে আসাই নাকি পেটের ভিতরের মারাত্মক ক্ষতে জমে থাকা বদরক্ত। তবে এখন অনেকটাই আরোগ্যের মুখে। এছাড়াও শরীরের অনেক জায়গায় গভীর ক্ষত। সেগুলোতেও ছোটোখাটো সেলাই করা হয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা শুনল পেরো। ওর এখানে থাকা আজ তিনদিন হলো। মেয়েটি ওকে ওষুধ খাওয়ানোর পর পেরোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। শরীরে ব্যাথা থেকে থেকে ফুঁসে উঠছে। কিন্তু পেরোর ভীষণ ভালো লাগছে। এই অসাধারণ ভালো লাগা জীবনে কোনওদিন আসেনি। এই অসম্ভব ভালোলাগার আমেজে পেরো মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

0 comments:

0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


জলরেখা 
নন্দিনী সেনগুপ্ত


১৮ 

ওরা আয়নায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দেখে নিজেদের। ভারি সুন্দর মানিয়েছে দুজনকে। নিরূপের মাথায় পাগড়ি, গায়ে রেশমের আংরাখা, কোমরবন্ধনীতে কৃপাণ... নিখুঁত সাজ। নিরূপ প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা এই কৃপাণ থাকে কেন? মানে এই যোদ্ধার সাজসজ্জা, কাকে রক্ষা করার জন্য?’ আইয়ম বলে, ‘হ্যাঁ, রক্ষা করার জন্য। বলো তো কাকে?’ আইয়ম মুখোমুখি দাঁড়ায় নিরূপের। নিরূপ লক্ষ্য করে আইয়ম আয়ত চোখে তাকিয়ে আছে ওর চোখের দিকে সোজাসুজি। নিরূপের একটা অস্বস্তি হতে থাকে। আইয়ম কেটে কেটে বলে, ‘হ্যাঁ, রক্ষা করার জন্য। বলতে পারছ না উত্তরটা? জানো না তুমি?’ নিরূপ লক্ষ্য করে ওর চোখের দৃষ্টি কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। ওর চোয়ালে একটা কাঠিন্য। ওর চোখের প্রেমময় দৃষ্টি বদলে যাচ্ছে; ঝরে পড়ছে ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ। আইয়ম হঠাৎ নিরূপের কোমরবন্ধনীর খাপ থেকে চকিতে মুক্ত করে নেয় কৃপাণ। নিরূপ দেখে ওর সামনে ধাতব ফলক। ও কিছু বুঝতে পারেনা। ও পিছিয়ে যেতে থাকে। একসময় দেখে ওর পিছনে শক্ত দেওয়াল। ওর আর কোথাও যাবার নেই। ও সর্বশক্তি দিয়ে চীৎকার করে উঠতে চায়, বলতে চায়, ‘জানি না-আ-আ-আ! জানি না আমি এসব কিচ্ছু।’ কিন্তু বলতে পারেনা। ওর গলা শুকিয়ে গিয়েছে আইয়মের এই অদ্ভুত রণচণ্ডী মূর্তি দেখে। নিরূপ ওকে কিছু বলবার ব্যর্থ চেষ্টা করে মরীয়া হয়ে হাত তুলে ওর হাত থেকে কৃপাণ কেড়ে নেবার চেষ্টা করে। পারেনা। ওর শরীর যেন পাথরের মতো ভারি হয়ে গেছে। ও যেন জড়পদার্থে পরিণত হয়েছে। আইয়ম এক হাত দিয়ে কৃপাণ ধরে থেকে আরেকটা হাত দিয়ে ওকে ঝাঁকায়। নিরূপের মনে হয় তার সময় ফুরিয়ে আসছে। সমানে ঝাঁকাচ্ছে ওকে, ওর শরীরে প্রচণ্ড শক্তি, ভূমিকম্পের মতো ঝাঁকুনি হচ্ছে, সে যেন কোনও মানবী নয়, ভীষণদর্শনা এক ক্রুদ্ধ দেবীমূর্তি। 

ঝাঁকুনি খেতে খেতেই নিরূপের ঘুম ভাঙ্গে, কে ডাকছে ওকে? ‘গাগা, গাগা’... ‘কি হয়েছে? গোঙাচ্ছিলে কেন? শরীর খারাপ?’ আরে, এ তো নয়নের কণ্ঠস্বর! নিরূপ এতক্ষণে বুঝতে পারে যে ও স্বপ্ন দেখছিল। ও তো কাল সন্ধেবেলা কলকাতায় এসেছে। রাতে তো সে নয়নের ঘরে নয়নের সাথে একই বিছানায় ঘুমিয়েছিল। তার মানে এতক্ষণ যা দেখছে, পুরোটাই স্বপ্ন! নিরূপ নিশ্চিন্তে নিঃশ্বাস ছাড়ে। ওর শরীর প্রচণ্ড ঘামছে। নয়ন আবার বলে, ‘গাগা, জল খাবে?’ নিরূপ মাথা নাড়ে। নয়ন উঠে আলো জ্বালে। জলের জাগ থেকে গ্লাসে জল ঢেলে এগিয়ে দেয়। নিরূপ উঠে বসে। ধীরে ধীরে এক ঢোঁক এক ঢোঁক করে জল খায়। সে কিছু চিন্তা করতে পারছেনা। আপাতত দুঃস্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে, এই ভাবনাটা তাকে স্বস্তি দিচ্ছে। কিন্তু এটা পুরোটা তো দুঃস্বপ্ন ছিল না। কিছুটা তো সত্যিই। হুবহু এরকম না হলেও, সত্যিই তো তাদের বিয়ে হয়েছিল। তারা তো ঘরসংসার করছিল। সাঙ্ঘাতিক ভুলবোঝাবুঝি কিছু তো কখনও তার আর আইয়মের মধ্যে হয়নি। তাহলে কেন? কেন নিরূপ পালিয়ে এলে তুমি? নিরূপ নিজেকে এই প্রশ্নটা করে। নয়ন জিজ্ঞাসা করে, ‘কিছু বলছ গাগা?’ নিরূপ উত্তর দেয়, ‘না রে, কিছু না। ঘুমিয়ে পড়। ঘুমিয়ে পড়!’ দ্বিতীয়বারের ঘুমিয়ে পড়ার উপদেশ সে অস্ফুটে বলে। হয়তো বা নিজেকেই বলে। কারণ এখন আবার নয়ন ঘুমিয়ে পড়বে আলো নিভিয়ে, কিন্তু সে কি পারবে আবার ঘুমিয়ে পড়তে? নয়ন আলো নিভিয়ে সত্যিই মুহূর্তের মধ্যে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। 

নিরূপ জেগে থাকে। বসেই থাকে। এইসময় হয়ত বা একটা সিগারেট খেলে সে এই অদ্ভুত একটা সময়ের ঘেরাটোপ যা স্বপ্নের মধ্য দিয়ে তাকে গিলে নিচ্ছিল, সেটার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারতো। কিন্তু সে ছেড়ে দিয়েছে সিগারেট বেশ অনেকদিন হলো। যখন ছাড়তে পেরেছে, আর নতুন করে ধরবে না। জীবনে সে অনেককিছুই ছেড়ে এসেছে, হয়ত তার মধ্যে অনেককিছুই ছিল, যা খুব ভালো। সেগুলো তো আর চেষ্টা করেও সে ফেরত পাবেনা কোনওদিন। তাহলে কেন হঠাৎ এই সিগারেটের নেশার কথা এই মধ্যরাতে তার মাথায় উদয় হলো? ভাবতে ভাবতে নিরূপ নিজের মনেই একবার ফিক করে হেসে ফেলে। হেসে সব উড়িয়ে দিতে চায়। যেভাবে এদ্দিন দিয়েছে। আসলে হয়ত কিছু একটা করলে যে অশান্তিটা স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে মনের মধ্যে ডালপালা মেলে রেখেছে সেটা কমতো। 

নিরূপ কিছু একটা করতে চাইছিল, তখনই। উঠে একবার টয়লেটে যায়। ফিরে এসে বিছানায় বসে ভাবে আগামীকাল দুপুরে ল্যাবে যেতে হবে স্যাম্পলগুলি নিয়ে। সেগুলো আলাদা ব্যাগেই আছে, তবুও একবার লিস্ট মিলিয়ে গুছিয়ে নিলে হতো। কিন্তু এখন মাঝরাতে আলো জ্বালিয়ে ঘরের মধ্যে খুটখাট করলে নয়নের ঘুম ভেঙ্গে যাবে। বই পড়তে গেলেও আলো জ্বালতে হবে, কাজেই সেটাও সম্ভব নয়। নিরূপ কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ- ওপাশ করে তারপর উঠেই পড়ল। 

ঘর থেকে বেরিয়ে ঘরের দরজা ভেজিয়ে যতটা নিঃশব্দে পারা যায় সেভাবে যাওয়ার চেষ্টা করছিল বাবা- মায়ের ঘরের লাগোয়া একফালি ছাদে। ওই ছাদটা তার খুব পছন্দের জায়গা ছোটবেলা থেকেই। শিশুবেলায় ছোটকার সঙ্গে সে আর অরূপ ওই ছাদে গমের দানা ছড়িয়ে দিত, অনেক পায়রা আসত। খুঁটে খুঁটে খেয়ে যেত সব গম। এমনকি একটা পায়রা সোজাসুজি তার হাত থেকেই গম খেয়ে নিত। অরূপ তার নাম দিয়েছিল ‘বংশীলাল’। নিরূপ বলত, ‘চিনতে পারিস? আমার তো সব্বাইকে একরকম লাগে!’ অরূপ খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘাড় নেড়ে বলত ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, চেনা যায়।‘ ছোটকাও সমর্থন করত অরূপকে। তারপর বিশ্বকর্মা পূজার দিনে ঘুড়ি ওড়ানো, সেও তো ওই ছাদ থেকেই। অনেক স্মৃতি ভিড় করে আসে তার মনে। বাবা মায়ের ঘর তো বন্ধই পড়ে আছে; কিন্তু মাঝখানের প্যাসেজ দিয়েও ছাদে যাওয়া সম্ভব। নিরূপ পা টিপে টিপে চোরের মতো হাঁটে, যাতে আওয়াজে কারও ঘুম ভেঙ্গে না যায়। আলো জ্বালে না সে। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে তার। ছাদে ঢুকতে গিয়ে সে লক্ষ্য করে ছাদে যাবার জন্য যে প্যাসেজের দরজা, সেটা আটকানো নয়। ভেজানো। নিরূপের অস্বস্তি হয়। তাহলে কি ছাদে কেউ আছে? এই মাঝরাতে কে থাকতে পারে ছাদে? নাকি চোর এল বাড়িতে? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নিরূপ দরজা ঠেলে ছাদে পা রাখে। চারপাশ তাকিয়ে প্রথমে কাউকে দেখতে পায় না। পায়ে পায়ে ছাদের রেলিং এর কাছে যায়। হঠাৎ চোখে পড়ে ছাদে তুলসীগাছের ওপাশে আবছা একটা নারীমূর্তি। নিরূপের বুকটা ছাঁৎ করে ওঠে। স্বপ্নের ঝলক ফিরে আসে এবং একই সঙ্গে মনে পড়ে যায় যে অরূপ বলত সে নাকি তাদের পরলোকগতা ঠাকুমাকে অনেকবার ছাদে দেখেছে। নিরূপ নিজে কোনওদিন এমন কাউকে দেখেনি বলে সে বিশ্বাস করত না। নিজের অজান্তেই সে স্থির হয়ে যায় এবং দেখে সেই নারীমূর্তি তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সে বুঝতে পারছে এটা স্বপ্ন নয়। এটা বাস্তব। ছাদের রেলিং এর ধারে দাঁড়িয়ে নিরূপ নিজেকে বলে, ‘এবার কোথায় যাবে?’

0 comments:

6
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


এক কিশোরীর রোজনামচা - ১৫

সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়




Diary Entry - 13
14th. August, 1942, FRIDAY


প্রিয় কিটী, 

গত একমাস তোমায় কোনও চিঠিই লিখিনি। সম্ভবত আমার লেখা বা লেখার ইচ্ছা, সব কিছু মরুভূমিতে হারিয়ে গিয়েছিল, বা এখনও যাচ্ছে। কোন ঘটনাই ত’ ঘটছে না, কি লিখব? সত্যিই ভাবলে আবাক হবে, গত একমাসে এত কম ঘটনা ঘটেছে, যে তোমায় কিছু লিখে জানাব, তার মতো কোনও বিষয়বস্তুই খুঁজে পাইনি। আমাদের জীবনটাই নিস্তরঙ্গ প্রবাহের মতো হয়ে গেছে। সকাল বেলায় ওঠা থেকে, রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমাদের কাজ কেবল নিজেদের লুকিয়ে রাখা, আর লুকিয়ে রেখে বাঁচার চেষ্টা করা। এর মধ্যে আমি খুঁজেই পাইনি, আমার লেখার বিষয়বস্তু, অথবা তোমায় কি লিখব, বা কি লিখে জানাব! এর মধ্যে যে ঘটনাটা ঘটেছে, তা’হল, গত ১৩ই জুলাই ভ্যান ড্যান সপরিবারে আমাদের অ্যানেক্সে বা উপগৃহে এসে উঠেছেন। অর্থাৎ আমাদের জায়গা আরও সংকুচিত হয়ে গেছে। অবশ্য এ’সব ভাবনা বর্তমান পরিস্থিতিতে সঠিক নয়। কেমন যেন অসূয়া গ্রস্থের ভাবনার মতো। কারণ আমরা ইহুদিরা শুধু ভীত নই, জীবনের ভয়ে বিব্রত, বিভ্রান্ত। ভ্যান ড্যানের সপরিবারে আসার কথা ছিল, ১৪ই জুলাই। কিন্তু তারা একদিন আগেই পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। ওদের কাছে শুনলাম, নাৎসি বাহিনীর গেস্টাপো ইউনিট, গত ১৩ থেকে, ১৬ই জুলাই-এর মধ্যে, সকল ইহুদিকে প্রায় ছাকনি দিয়ে ছেঁকে ক্যাম্পে ডেকে হাজির করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে, আর ১৩ তারিখ থেকে সেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। স্বাভাবিক করণেই চারিদিক হঠাৎ করে অশান্ত ও চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ইহুদিরা প্রায় পাগলের মতো, পালিয়ে যাওয়ার বা লুকানোর জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে। ভ্যান ড্যান পরিবারও তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে, নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে, নির্ধারিত দিনের একদিন আগেই এখানে পালিয়ে এসেছে। ওদের কাছে, একদিন অপেক্ষা করার চেয়ে, একদিন আগে চলে আসাটাই একমাত্র বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয়েছে। হয়ত সম্ভব হলে আরও আগেই তারা চলে আসত। 

তখন সকাল ন’টা বা সাড়ে ন’টা হবে। আমরা সবাই মিলে জলখাবার খেতে শুরু করেছি। এমন সময়, ভ্যান ড্যানের ছেলে পিটার ভ্যান ড্যান এসে হাজির। 

পিটার ভ্যান পেলস, অ্যানি এ’কে তার ডাইরিতে পিটার ভ্যান ড্যান নামে উল্লেখ করেছে। (২)

পিটার ভ্যান ড্যান, ভ্যান ড্যানের একমাত্র ছেলে। পিটারের বয়স তখন ষোলোরও কম (মানে মারগটের চেয়ে ছোট। কিন্তু অ্যানির চেয়ে প্রায় বছর তিনেকের বড়)। স্বভাবে নরম ও শান্ত প্রকৃতির। লাজুক টাইপের ছেলে, কেমন যেন জবুথবু গোছের। ওর সাথে গল্প করলে তোমার ভাল লাগবে না। এমনকি ওর সঙ্গে মিশতেও তোমার খুব একটা ভাল লাগবে বলে মনে হয় না। আসার সময় বাড়ির বিড়ালটাকেও (মৌসচি- Mouschi) নিয়ে এসেছে। এসে বলল, তার বাবা মা দুজনেই আসছে। পিটার আসার আধ ঘণ্টা পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যে পিটারের বাবা ও মা এসে পৌঁছালেন। প্রথমে দেখেই আমরা আনন্দে খাবার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠলাম। আমাদের একাকীত্বের জীবনে আরও কিছু মানুষ এসেছেন যারা আমাদের একান্ত পরিচিত ও প্রিয়। কিন্তু তারপরই আমাদের সবার অবাক হওয়ার পালা। বিশেষ করে শ্রীমতী ভ্যান ড্যানকে দেখে। শুনলে অবাক হবে, না হতবম্ব হয়ে যাবে জানি না, শ্রীমতী ভ্যান ড্যান তাঁর সঙ্গে করে একটা বড় ব্যাগ নিয়ে এসেছেন, আর তার মধ্যে করে নিয়ে এসেছেন, বড় একটা “পটি বক্স”। এর আগে আমি অন্তত কাউকে কোথাও যাওয়ার সময় “পটি বক্স” নিয়ে যেতে দেখিনি। জানি না তুমি দেখেছকি’না!! ওটার দিকে সবাই অবাক চোখে তাকাতেই, উনি একমুখ হেসে বললেন, “আসলে এইটা ছাড়া আমি কোথাও নিশ্চিন্ত হতে পারি না। অতএব ওনাকে নিশ্চিন্ত করার জন্য, অন্য কিছু কোথায় রাখা হবে, সে বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করার আগে, ওই বড় “পটি বক্স”টাকে কোনও একটা জায়গায় যুতসই করে রাখতে হবে। কারণ ওটা ছাড়া শ্রীমতী ভ্যান ড্যানের একটা দিনও ভালভাবে কাটবে না। অতএব, প্রথমেই ওই “পটি বক্স”টাকে পরম যত্নে গুছিয়ে খাটের তলায় রাখা হলো। মিঃ ভ্যান ড্যান অবশ্য তাঁর স্ত্রী-র মতো প্রাতঃকৃত্যের জন্যে “পটি বক্স” নিয়ে আসেননি। তবে তিনিও কিছু কম নন। তিনি তাঁর বগলদাবায় করে “পটি বক্স”এর বদলে একটা ফোল্ডিং চায়ের টেবিল বয়ে নিয়ে এসেছেন। যাক, এ’তে অন্তত সবাই মিলে বসে চা’ খাওয়া যাবে। 

ওঁরা এখানে আসার পর থেকেই ক্রমে ক্রমে আমাদের খাওয়া শোওয়া থাকা সব কিছুর মধ্যে এক বিপুল পরিবর্তন এল। ভ্যান ড্যান পরিবার যেদিন থেকে আত্মগোপন করতে এখনে এল, মোটামুটি সেদিন থেকেই আমাদের খাওয়া- দাওয়া ইত্যাদি সব কিছু দৈনিক কাজ একসাথে করতে আরম্ভ করা হলো। আমরা একক পরিবার হয়ে এখানে ছিলাম, হঠাৎ আমরা একটি যৌথ পরিবারে পরিণত হয়ে গেলাম। আমরা এখানে আসার প্রায় সপ্তাহ খানেক বা দু-সপ্তাহের কাছাকাছি সময় ভ্যান ড্যান পরিবার বাইরের জগতে ছিল। তারা আমাদের চেয়ে বেশী বাইরের জগতটাকে দেখেছে। বাইরের জল- হাওয়াকে আমাদের চেয়ে বেশী দিন উপভোগ করেছে। এটা আমাদের কাছে একটা বিরাট বিষয়। ওরা আসার পর, আমরা সবাই একসাথে বসে, তাদের কাছে ওই সব বাড়তি থাকার দিনগুলোর কথা, বাইরের বিভিন্ন গল্প গ্রোগ্রাসে শুনতাম। বেশী করে শুনতে চাইতাম, আমাদের বাড়িটার কথা। যে বাড়িটাতে আমরা থাকতাম, (এখানে আসার আগে) তার এখন কি অবস্থা, কেউ সেটা দখল করে নিয়েছে কি’না, মিঃ গোল্ডস্মিথ, যিনি আমাদের সাথে থাকতেন, তাঁর খবর – এসবই ছিল আমাদের অগ্রহের বিষয়। আসলে কেউ দখল করে নিলে আমরা কোথায় গিয়ে থাকব, এটাই ছিল আমার মূল চিন্তা। কথায় কথায়, মিঃ ভ্যান ড্যান আমাদের বললেন, 

“সোমবার (হিসাব মতো, সম্ভবত ১০ জুলাই—অনুবাদক।) ঠিক সকাল ন’টার সময় মিঃ গোল্ডস্মিথ আমায় একটা ফোন করেন। এবং ফোনে ব্যস্তসমস্ত গলায় বলেন, আমি তক্ষুনি ওনার কাছে যেতে পারব কি’না? ভীষণ দরকার। আমিও ফোন পাওয়ার সাথে সাথেই প্রায় দৌড়ে গিয়ে মিঃ গোল্ডস্মিথের সাথে দেখা করি। ওখানে পৌঁছে দেখি, সেখানে “শ্রী জী” দাঁড়িয়ে আছেন। শুধু দাঁড়িয়েই আছেন না, গিয়ে বুঝলাম, আমার জন্যেই বেশ উত্তেজিত ভাবে অপেক্ষা করছেন। আমি পৌঁছানো মাত্র, ‘মিঃ জী’ আমায় একটা চিঠি পড়তে দিলেন। তাঁর কাছে শুনলাম, ফ্রাঙ্ক না’কি তাঁকে চিঠিটা দিয়ে গেছেন। চিঠিতে শুধু লেখা ছিল, ‘সে তার বিড়ালটাকে তার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে নিয়ে যেতে চায়।‘ চিঠিটা পড়ে বেশ মজা পেলাম। বুঝতে পারলাম না এর আবার কি’ গূঢ রহস্য আছে! তবে ওর সামনে আমি গম্ভীর হয়েই থাকলাম। ‘মিঃ জী’ এরপর আমায় বললেন, দু’এক দিনের মধ্যেই এই বাড়ি আর ঘরগুলো খানাতল্লাশী হতে পারে এবার আমি মনে মনে কিছুটা হলেও ভয় পেয়ে গেলাম। ওকে আর বিশেষ কিছু না বলে, আমি তড়িঘড়ি সব ঘরগুলোকে আবার একবার ঘুরে দেখতে লাগলাম। দেখার সময় যেখানে যা’ কিছু ছিল, সেই সবকিছুকে এক জায়গায় জড় করে ভাল করে বেঁধে ফেললাম। জলখাবারের জায়গাটায় যেসব টুকরোটাকরা জিনিষ পত্র ছিল, সেগুলোকে ভাল করে পরিষ্কার করে ফেললাম। এইসব করতে গিয়ে হঠাৎ নজরে এল, শ্রীমতী ফ্রঙ্কের লেখার টেবিলের দিকে। সেখানে দেখি একটা খোলা চিঠি লেখার প্যাড পড়ে আছে। আর তাতে খোলা পাতাটায় ম্যাসট্রিচট (Maastricht) (১) এর একটা জায়গার ঠিকানা লেখা আছে। আমি ঔই লেখাটা দেখেই তৎক্ষণাৎ অনুমান করে নিই, যে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়েই ঔই জায়গার নামটা লেখা হয়েছে, আর তা’ কোনমতেই এখানে প্রকাশ করা যাবে না। বিশেষ করে ‘মিঃ জে’-র সামনে কিছুই প্রকাশ করা বা তাঁকে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না। তাই ‘মি জে’-র সামনে আমি অবাক হওয়ার ভান করি। এমন ভান করি, যেন ‘মি জে’ মনে করেন, যে বিষয়টা যে গুরুত্বপূর্ণ সেটাই আমি মনে করি না। বরং আমি ওটাকে একটা বাজে কাগজ ছাড়া আর কিছুই ভাবছি না। তাই আমি তৎক্ষণাৎ ‘মি জে’-কে ওই কাগজটা ছিঁড়ে ফেলতে অনুরোধ করি। ‘মিঃ জে’-ও বিশেষ কিছু না ভেবে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলেন। 

“তারপরও আমার মনে হয়, ‘মিঃ জে’ মনে মনে কিছু একটা ভাবছেন। ওই দেখে, আমি ওনার সমনে ভান করি, যে, তোমরা কোথায় গেছ, কেন গেছ, এ’সব আমি কিছুই জানি না। আর তোমরাও কোনদিনই এ’ব্যাপারে আমার সঙ্গে কোন কথাই বলনি। কিন্তু ‘মিঃ জে’ বা মিঃ গোল্ডস্মিথের মনের সন্দেহটা তখনো ঘোরাফেরা করছে দেখে, আমিও প্রথমে ভাবতে শুরু করি ওই লেখাটার মাধ্যমে, কি বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে! মনে মনে ভাবি, বিষয়টা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। কিন্তু ওপরে বা মুখের ভাবে, সেটা ওদের কাছে লুকিয়ে রাখি। পরিবর্তে, মিঃ গোল্ডস্মিথকে গদগদ ভাবে বললাম, দেখুন এই কাগজটা দেখে, প্রথমেই আমার মনে হয়েছিল, ঠিকানাটা ঠিক কি বোঝাচ্ছে! কিন্তু একটু চিন্তা করতেই আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল। মাস ছয়েক আগে একজন অফিসার গোছের লোক আমাদের অফিসে এসেছিলেন। সম্ভবত কিছুর একটা সরবরাহকারী ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে ওটো ফ্রাঙ্কের সঙ্গে ভদ্রলোকের বেশ সুন্দর ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ভদ্রলোকটিও বেশ ভাল ছিলেন। সেই সময় আমি শুনেছিলাম, তিনি ফ্রাঙ্ককে বলছেন যে, তার কোন রকম অসুবিধা হলে তিনি আন্তরিক ভাবে ফ্রাঙ্ককে যে কোন রকম সাহায্য করতে প্রস্তুত। ফ্রাঙ্ক অবশ্য প্রত্যুত্তরে কোনও কথাই বলেননি। সেই ভদ্রলোক কথায় কথায় বলেছিলেন, যে তিনি ম্যাস্ট্রিচটে থাকেন। তিনি তখন তাঁর ঠিকানাও লিখে দিয়েছিলেন। আমার এখন মনে হচ্ছে, ঐ অফিসার তাঁর কথার দাম রেখেছেন। মনে হয়, তিনি ওটো ফ্রাঙ্ক ও তার পরিবারকে প্রথমে বেলজিয়ামে যেতে পরে সেখান থেকে সুইজারল্যান্ডে পৌঁছতে সাহায্য করেছেন। যাওয়ার আগে আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমি কি তাঁর এই যাওয়ার কথা, গোপন করে রাখব? না’কি আমাদের কোনও বিশেষ বন্ধু যদি তোমাদের কথা জিজ্ঞাসা করে, তবে কি তাকে বলব তোমাদের এই যাওয়ার কথা? আমার কথার উত্তরে, ওটো ফ্রাঙ্ক স্পষ্টভাবে আমায় বলেছিলেন, আমি যেন কোনভাবেই তাঁদের কথা কাউকে না বলি।  

এরপর আমি ঐ অফিস থেকে বেরিয়ে যাই। তবে ওখানে যতক্ষণ ছিলাম, ততক্ষণে আমি বুঝতে পারি, তোমার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই জানে, তোমার সাথে ঐ ভদ্রলোকের আলাপ বা কথাবার্তার খবর। কারণ আমি ওখানে অনেকের কাছেই ম্যাস্ট্রিচটের নাম শুনেছি। এবং জায়গাটা কোথায়, সে বিষয়েই অনেকে অনেক কিছু জানে। 

আমরা উপগৃহের আলো আধারে বসে এতক্ষণ ধরে বেশ মন দিয়ে এবং কৌতূহল নিয়ে ভ্যান ড্যানের পুরো গল্পটা শুনছিলাম। ভ্যান ড্যানও বেশ মজা করেই গল্পটা বলছিলেন। ওঁর গল্প শেষ হওয়া মাত্র, আমরা সবাই হো হো হেসে উঠলাম। হাসিটা অবশ্যই বেশ নিশ্চিন্তের হাসি। এখনও বাইরের লোকে আমাদের কথা ভাবে, আমাদের গতিবিধি সম্পর্কে অনুমান করার, বা, কল্পনা করার চেষ্টা করে। আমরা কোথায় আত্মগোপন করে আছি, বা আদৌ আত্মগোপন করে আছি না দেশ ছেড়ে চলেই গেছি, সে ব্যাপারে আলোচনা করে, কল্পনা করে, আর কিছু জানতে না পেরে, আমাদের অনুপস্থিতিকে জানান দিতে, বিভিন্ন গুজব ছড়ায়। যেমন, ভ্যান ড্যানের কাছেই শুনলাম, আমাদের বাড়ির কাছে থাকেন এক ভদ্রমহিলা না’কি পাড়ায় বলেছেন, যে তিনি আমাদের ভোর বেলায় রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে যেতে দেখেছেন। সেই শুনে আরেকজন না’কি বলেছেন, যে তিনি নিজের চোখে স্পষ্ট দেখেছেন, মাঝ রাত্রিরে নাৎসি বাহিনীর সৈন্য আমাদের একটা সামরিক বাহিনীর গাড়ীতে, জোর করে টেনে হিঁচড়ে গায়ের জোরে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সব কিছু শুনে আমার মনে হয়, শুধু আমরাই জানি না, আমরা কিভাবে এসেছি, কোথায় আছি !! 



ইতি,
তোমার অ্যানি। 



অনুবাদকের সংযোজন - 

(১) ম্যাসট্রিচট বা Maastricht হল দক্ষিণ নেদারল্যান্ডের বা হল্যান্ডের এক পুরানো শহর। প্রাচীন ইউরোপের এক প্রাচীন নগরী। ইউরোপের রেনেশাঁ পূর্ব প্রাচীন নির্মাণ শিল্পের বহু নিদর্শন এই স্থানে দেখা যায়। এক অর্থে ম্যাসট্রিচট ইউরোপের প্রাচীন নগরী গুলির এক অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য হিসাবে আকর্ষণীয় ছিল। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে, জার্মানির নাৎসি বাহিনী এই শহরটি আক্রমণ করে। এবং এর সুপ্রাচীন ঐতিহ্যপুর্ন নির্মাণ শিল্পের চিহ্ন সমূহকে ধ্বংস করে। ১৯৪৪ সালে মিত্র শক্তি ম্যাসট্রিচট শহরটিকে নাৎসি বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত করলেও, এর পুরানো চিহ্ন সমূহকে পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। তাছাড়াও ম্যাসট্রিচট শহরকে মিত্র শক্তি নাৎসি কবল থেকে মুক্ত করলেও, নাৎসি বাহিনী তার অবস্থানকালের মধ্যেই ম্যাসট্রিচট শহরে বসবাসকারী অধিকাংশ ইহুদিকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ( Concentration Camp ) ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। 

(২) বর্তমান প্রসঙ্গে পিটার ভ্যান ড্যান ( যে ভাবে অ্যানি ফ্রাঙ্ক তার ডাইরিতে উল্লেখ করেছে) বা পিটার ভ্যান পেলস সম্পর্কে দু-এক কথা বলা প্রয়োজন। বিশেষ করে পাঠকবর্গের সঠিক অনুধাবনের জন্যে। পিটার একদিকে যেমন বেশ নিরীহ গোছের ছেলে ছিল, তেমনি তার মধ্যে এক বিশেষ ধরণের সন্মোহোক ক্ষমতা ছিল। তাকে দেখে সাধারণভাবে মেয়েরা আকৃষ্ট হতো। কিন্তু অ্যানির স্বভাব বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট একটু অন্যরকম ছিল। অ্যানি বেশ বুদ্ধিমতী, ও কৌতুকপ্রিয় মেয়ে ছিল। অ্যানি তার ডাইরির প্রথমেই পিটারকে অলস, জবুথুবু মার্কা ছেলে হিসাবে চিহ্নিত করে। বিশেষ করে পিটার এতটাই লাজুক প্রকৃতির ছেলে ছিল, যে অ্যানির নেকনজরে আসা হঠাৎ করে তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। তাই প্রথমদিকে অ্যানি তাকে বিশেষ পাত্তাই দিত না। বরং কথায় কথায় অগ্রাহ্য করত। তারপর ওখানে থাকতে থাকতে, অ্যানির মধ্যে পিটার সম্পর্কে ক্রমে ক্রমে দুর্বলতা সৃষ্টি হয়। অ্যানি পিটারের চাউনির মধ্যেও এক অন্য রকমের বিহ্বলতা দেখতে পায়। অ্যানি দ্রুত পিটারের প্রতি দুর্বল হয়ে ওঠে, পিটারকে তার সুন্দর, মিষ্টি ও আকর্ষক ছেলে বলে মনে হতে থাকে। 

বছর দুয়েক তারা ওই উপগৃহে একসাথে অন্তরালবর্তী হয়ে ছিল। এই দীর্ঘ সময়, তাদের দুজনের মানসিক পরিবর্তনের পক্ষে যথেষ্ট সময়। অ্যানিরও এই দুবছরের মধ্যে পিটারের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হয়, অ্যানি তার ডাইরিতেই স্বীকার করেছে, এক জায়গায় থাকতে থাকতে পিটারের প্রতি তার দুর্বলতা বা ভালবাসার অনুভূতি অল্প অল্প করে বৃদ্ধি পায়। অবশ্য এর মূল কারণ ছিল দীর্ঘ সময় লোকচক্ষুর বাইরে গোপন স্থানে পরিবার দুটির গোপন অবস্থান। তাই এ’মত অবস্থায় পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার বিকল্প কিছুই তাদের কাছে ছিল না। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৪ সালের মার্চ মাসের ডাইরির পাতায় আমরা দেখব, অ্যানি লিখেছে, আমি জানি না, এখানথেকে বেরিয়ে আমি পিটারকে আর পছন্দ করব কি’না। তার সাথে স্থায়ী সম্পর্কে আবদ্ধ হতে চাইব কি’না!! আমার মনে হয় পিটারও এ’কথাটা জানে না। আসলে অ্যানেক্সের অভ্যন্তরে তাদের যে একাকীত্ব আর নির্জনতা তাদের মধ্যে প্রেম ও ভালবাসা জন্ম দিয়েছিল, বাইরের পৃথিবীতে বেরিয়ে সেটা একইরকম থাকবে কি’না, এ’ ব্যাপারে অ্যানি তার ডাইরির বিভিন্ন অংশে সন্দেহ প্রকাশ করেছে।

নাৎসি বাহিনীর হাতে ধরা পাড়ার শেষ মুহূর্তের আগেও অ্যানির আশা ছিল সে আবার স্বাধীন হবে, বাইরের পৃথিবীতে বেরিয়ে আবার আকাশভরা আলো দেখবে। তাই সে ভাবত তার আর পিটারের সম্পর্কটা স্থায়ী হবে কি’না, তা’ এখান থেকে বেরোনোর পর যখন তারা সমাজের আর পৃথিবীর বিশাল ক্যানভাসের সামনে দাঁড়াবে, তখনি তা’ চূড়ান্তভাবে পরীক্ষিত হবে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের এই ভালোলাগা বা ভালবাসাকে লাগাম ছাড়া করার চেষ্টা করলে, তা’ হবে সামাজিকভাবে নীতিবিরুদ্ধ এবং ব্যক্তিগতভাবে অসংযমের পরিচায়ক। 

উপগৃহের মধ্যে পিটার অ্যানির কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যে, সে কোনদিন অ্যানির সাথে ঝগড়া করবে না। অবশ্য অ্যানি মনে করত পিটারের এই প্রতিজ্ঞার কারণ এই নয়, যে পিটার খুব শান্তি প্রিয় ছেলে, আসলে অ্যানির মতে পিটার ছিল এক কৌতূহলহীন উদাস অলস ছেলে। 

পিটারের মৃত্যু হয়েছিল ম্যুথাউসেন (Mauthausen) বন্দী শিবিরে। প্রথম অবস্থায় পিটার অটো ফ্রঙ্কের সঙ্গে আউশউইতজ (Auschwitz) বন্দী শিবিরেই ছিল। অটো ফ্রাঙ্ক তাকে বারংবার একসাথে থাকার জন্যে জোর করেছিলেন এবং বন্দীদের কুচকাওয়াজে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু পিটার ভেবেছিল বন্দীদের কুচকাওয়াজে গেলে সে আউশউইতজ শিবিরের কষ্টকর জীবন থেকে মুক্তি পাবে এবং ম্যুথাউসেন শিবিরে যাওয়ার সুযোগ পাবে। শেষ পর্যন্ত পিটারকে ম্যুথাউসেন বন্দী শিবিরে ১৯৪৫ সালের ২৫শে জানুয়ারী নিয়ে যাওয়া হয়। পৌঁছানোর চার দিনের মাথায় তাকে শিবিরের বাইরে প্রচণ্ড রোদে কাজ করতে পাঠানো হয়। সেখানে কাজ করতে গিয়ে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ১৯৪৫ সালের ১১ই এপ্রিল পিটারকে অসুস্থদের ব্যারাকে পাঠানো হয়। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর দিন ও সময় কিছুই জানা যায়নি। রেডক্রস তার নথীতে পিটারের মৃত্যু দিন হিসাবে ৫ই মে ১৯৪৫ সালের দিনটিকে চিহ্নিত করেছে।

6 comments: