0

সম্পাদকীয়

Posted in




সম্পাদকীয়


যুবাং চিদ্ হি ষ্ম অশ্বিনৌ অনু দ্যূন্
বিরুদ্রস্য প্রস্রবণস্য সাতৌ।
অগস্ত্যো নরাং নৃষু প্রশস্তঃ
কারাধুনীব চিতয়ত্ সহস্রৈঃ। (ঋক্ বেদ)

রুদ্রনিনাদে ঝরঝর ঝরে বিপুল প্রস্রবণ
তাকে জিনে নিতে, ওগো অশ্বীরা, অনুদিন, অনুখণ
জাগিয়ে তুলতে তোমাদের ডাক দিয়েছে শঙ্খস্বনে
লোকবিশ্রুত এই অগস্ত্য শতসহস্র গানে। (অনুঃ গৌরী ধর্মপাল) 

বেদ যাকে প্রস্রবণ বলছে তা হ'ল কথার নির্ঝর। গানের ঝরণা। কথাসাহিত্যের উৎসমুখ এই সুরলোকে পৌঁছতে হয় সুরেরই পথ ধরে, গানের সরণী বেয়ে। বেদ সে পথকে বলে গাতু। গীতিপথ। ঋষি অগস্ত্য তাঁর বোধনসঙ্গীতে জাগিয়ে তুলতে চান রচয়িতার অন্তঃস্থিত ঋতবানের যুগল মূর্তিকে। তাঁরা জাগ্রত হ'লে সৃজনবাহনে সওয়ার হয়ে স্রষ্টা এসে পৌঁছবেন কথাপারাবারের তীরে। সেই অনাদ্যন্ত বারিধিতে ডুব দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে তিনি মিশিয়ে দেবেন চিরনবীকৃত সৃজনী প্রক্রিয়ার সঙ্গে। প্রাতিস্বিকতাকে ছাড়িয়ে এক সর্বত্রব্যাপী সৃষ্টিসুখের আনন্দধারার অংশ হয়ে তাঁর গান হয়ে উঠবে অপৌরুষেয়। 

ঋতবাকও সেই চিরন্তন সৃজনলোকের সন্ধানী। সে জানে আগামীতে যখন ব্যক্তি স্রষ্টার স্মৃতিও বিলুপ্ত হবে তখনও তিনি রয়ে যাবেন ঋতবাকের সঙ্গে অদ্বয় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে। তাঁর ঋত বাক্ হবে অপৌরুষেয়। 

উদাহরণ স্বরূপ বলা চলে যে তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে সমর সেনকে কথাশরীরি অস্তিত্ব দান প্রকল্পে যোগদান করেছে ঋতবাকও। সমর সেন এখন আর কোনও ব্যক্তির নাম নয়। তিনি এখন শব্দসৃজিত বিশ্বের অংশীভূত। তাই তাঁর উচ্চারণ অপৌরুষেয়। 

সকলে ভালো থাকুন। সৃজনে থাকুন।।

0 comments:

2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - চয়ন

Posted in











প্রচ্ছদ নিবন্ধ


সমরবাবুর বৃত্তান্ত
চয়ন



"ঘুণধরা আমাদের হাড়,
শ্রেণী ত্যাগে তবু কিছু 
আশা আছে বাঁচবার" --

কবি সমর সেন বারবার চেয়েছিলেন সাধারণ মধ্যবিত্ত চেতনাকে অতিক্রম করতে। তাঁর একান্ত কামনা ছিল,

"তিলকে তাল করার ভ্রান্তি পার হয়ে
আত্মকরুণার ক্লান্তি পার হয়ে 
সহজ জীবনে সহজ বিশ্বাসে ফেরা।"

কিন্তু গত শতকের সত্তরের দশকে নিজের জীবনের দিকে চেয়ে তাঁর মনে হয় : "জনগণের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ছিল না, পরিধি ও পরিবেশ ছিল মধ্যবিত্ত। আমার ছাত্রাবস্থায় বাবা বলতেন আমার বন্ধু বান্ধব সবাই স্বচ্ছল। কথাটা ঠিক।" (বাবু বৃত্তান্ত)।

বিংশশতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশক। ইওরোপীয় আধুনিকতার ঢেউ এসে পৌঁছেছে বাংলায়। খণ্ডিত মহাবিশ্বে টুকরো হওয়া 'আমি'কে নিয়ে বিভ্রান্ত কবি সাহিত্যিকরা। ব্যক্তিপরিচয় ও শ্রেণী পরিচয়ের দ্বন্দ্ব একই সত্তার মধ্যে। মার্কস, ফ্রয়েড, ইয়ুঙের প্রভাবে নিজেকে খুঁড়ে, বা সামূহিক অবচেতনার অংশ হিসেবে ধরে অথবা বৃহত্তর এক সামাজিক প্রেক্ষায় ক্ষুদ্র 'আমি'কে স্থাপন ক'রে এক আত্মন নির্মাণ প্রয়াস দেখা যাচ্ছে বাংলা সাহিত্যের শাখা, উপশাখায়। এই 'আত্মন' ও 'নির্মাণ' শব্দদুটি খুব জরুরী। এদের কাছে আমরা পরে ফিরব। এই মুহূর্তে আমরা ভাবছি ব্যক্তিসত্তার ভেতরে চলা দ্বন্দ্ব নিয়ে যে দ্বন্দ্ব জন্ম দেয় এক সংশয়ী আত্মসচেতনতার। এই সংশয়ই তার কন্ঠস্বর খুঁজে পায় সমর সেনের আত্মচরিত 'বাবু বৃত্তান্ত'তে। ছত্রে ছত্রে তার শ্লেষ ; আত্মকথনের নামে আত্মরতিপরায়ণতাকে ব্যাঙ্গ; নিজের শ্রেণীচরিত্র নিয়ে কুন্ঠা এবং তার ফলে এক সদাজাগ্রত আত্মসমালোচনা। অন্যভাবে বলতে গেলে, ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত এই বইটিতে অস্থির, উত্তাল ত্রিশ, চল্লিশের দশকের স্মৃতিচারণার সময় যাতে কিছুতেই তাঁকে 'বাবু' বলে মনে না হয় তার জন্য লেখক আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেন।

এখান থেকেই আমাদের ভাবতে শুরু করতে হবে। বুঝে নিতে হবে 'বাবু' শব্দের অর্থ। প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে বঙ্কিমচন্দ্রের সুপরিচিত সংজ্ঞাটির বিস্তৃত আলোচনা আমরা করছি না কারণ আপনাদের প্রত্যেকের তা মনে আছে। কিন্তু, এর ব্যবহার আমাদের করতে হবে। যাই হোক, আরম্ভে আমরা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শব্দকোষটা একবার দেখে নিই। এই অভিধান বলছে যে 'বাবু' শব্দের উৎস মুণ্ডারি এবং এর মানে গ্রামাধ্যক্ষের ছোটভাই। তাহলে, উৎপত্তিস্তর থেকেই শব্দটির গায়ে একটা ক্ষমতার গন্ধ মাখানো আছে। এ কথাটিও আমাদের যথাকালে মনে করতে হবে। এবার একবার বঙ্কিমের 'বাবু' কে মনে করুন। ইংরেজের কাছে বাবু মানে কেরাণী, গরীবের কাছে এর মানে বড়লোক, ভৃত্যের কাছে এর মানে প্রভু। কিন্তু, বঙ্কিমচন্দ্র এদের কাউকেই আক্রমণের লক্ষ্য করেননি। তাঁর কাছে বাবু মানে অনাচারী, অপদার্থ কুলকজ্জ্বলের দল। ১৮৭২ থেকে '৭৩ এর মধ্যে এই রচনা বঙ্গদর্শনে প্রকাশ পায় এবং 'কৌতুক ও রহস্য' গ্রন্থভুক্ত হয় ১৮৭৪ সালে। ঐ বছরেরই জুলাই মাসে তাঁর 'গ্রামবার্তা প্রবেশিকা'য় কাঙাল হরিনাথ 'বাবু' নামে এক প্রতিবেদন লেখেন। সেখানে তিনি বলেন যে তাঁর মতে এই শব্দ যাবনিক এবং এর কোনও প্রকৃত অর্থ আছে বলেও তাঁর মনে হয় না। তিনি আরও বলেন যে এটিকে তিনি একটি সম্ভ্রমসূচক শব্দ বলে মনে করেন। এরপর তিনি 'বাবু'দের চারভাগে ভাগ করেন। প্রথম পর্যায়ে আছেন ইংরেজের নকল নবিশি করা নব্যধনী সম্প্রদায়, দ্বিতীয়টিতে রয়েছেন ইংরিজিনবিশ রাজকর্মচারীরা, তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত ইংরেজের কাছে পাত্তা না পাওয়া কিন্তু ভীষণভাবে তাদের নজরে পড়তে চাওয়ার দল, আর সবশেষে আসেন শহরবাসী, অপব্যয়ী উমেদারগোষ্ঠী। এরপরই হরিনাথ এক আশ্চর্যকথা লেখেন। এই উমেদাররা চাকরির উমেদার নয়। খাওয়া পরা জোটাতে সে উমেদারি তো করতেই হবে। তাই, "আমরা সাধারণতঃ উমেদারদিগকে উল্লেখ করিতেছি না। যাঁহারা ভদ্রলোক এবং যাঁহাদিগের পারিবারিক চিন্তা আছে, যাঁহাদের অপমমানের ভয় আছে, যাঁহাদিগের মনুষ্যত্ববোধ আছে, তাঁহাদিগকে আমরা কিছু বলিতেছি না, তাঁহারা আমাদিগকে ক্ষমা করিবেন।" কাদের বলছেন তবে? যাদের ব্যবহার ভদ্র নয়, যারা গালাগালি শুনে বা দিয়ে লজ্জা পায় না, মদ খেয়ে রাস্তায় গড়ায় এবং বেশ্যাবাড়ি যায়। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে এই চতুর্থশ্রেণীর বাবুরা কতগুলো বিশেষ 'শীল' আয়ত্ত করতে পারলেই 'ভদ্রলোক' হয়ে যান। নীহাররঞ্জন রায় বলেন,"প্রত্যেক মানুষ বা মানবগোষ্ঠীই বাস করে কোনও দেশে বা কালে, এবং প্রত্যেক কালেরই কিছু কিছু নূতন প্রশ্ন থাকে, সমস্যা থাকে, দায়দায়িত্ব থাকে যা সেইকালেরই...সমসাময়িক কালের মানুষকে তার...সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয় এবং সেই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে প্রশ্ন ও সমস্যার উত্তর খুঁজতে হয়, পেতে হয়, দায়দায়িত্বের উদ্ধার করতে হয়।" এই সংগ্রাম, সন্ধান, এই সচেতন গুণগত পরিবর্তন(Qualitative Change) প্রয়াস ---এরই নাম শীলাচরণ যা ব্যক্তির অর্ধেক পরিচয়। বাকী অর্ধেক রয়েছে তার পারিবারিক ও সামাজিক আবহের মধ্যে বা কুলে। কুলশীল মিলে ভদ্রলোক। এখন প্রশ্ন হ'ল ভদ্রলোক বাবু কিনা? আমরা একবার হরিনাথের রচনার আরম্ভটা দেখে নিই :"আজকাল বাবুর অভাব নাই,রাজা হইতে কুলিমজুর পর্যন্ত সবাই বাবু।" আর একটু এগোলে দেখছি: "যদি ইংরাজদিগকের মধ্যে করোনার সাহেব(Esquire) হইতে পারিলেন; আমাদের মধ্যে রামা বাগদি যে বাবু হইবে, ইহাতে আশ্চর্য কি?" অতএব? সদকুলজাত, সচেষ্টায় শীলিত ভদ্রলোক মধ্যবিত্তের দল যদি কুলিমজুর, রামা বাগদি অথবা ভৃত্যস্থানীয়দের কাছে 'বাবু' হয়ে ওঠেন তবে বঙ্কিম বা হরিনাথের আপত্তি নেই তত। কারণ, সেক্ষেত্রে এটি একটি সম্ভ্রমজনক অভিধা যাকে এই শ্রেণীর মানুষজন নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতার সময়ও ব্যবহার করে থাকেন। 'বাবু' বলতে যে ঘৃণিত সম্প্রদায়কে তাঁরা বোঝেন এই চাকরবাকরের বাবুরা সেই দলে পড়েন না। না পড়ুন কিন্তু নতুন অর্থে প্রয়োগ হলেও 'বাবু' শব্দের গায়ে ক্ষমতার গন্ধটা লেগেই থাকে। 

বঙ্কিমের বা হরিনাথের রচনার আঁতমহলে একটা টানাটানি খুব স্পষ্ট। আর এই দ্বান্দ্বিকতাই ঊনবিংশ শতকের 'মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক' সম্প্রদায়ের অন্যতম শ্রেণী চরিত্র। ইংরেজ প্রভুদের কাছে তাঁরা বাবু আবার তাঁদের ভৃত্যদের তাঁরা বাবু। তাঁদের ঘেন্নার পাত্র আবার আরেকদল বাবু। ইংরেজের বাবু ডাকের মধ্যে যে অসীম তাচ্ছিল্য তা যে তাঁরা বোঝেন না এমন নয়। কিন্তু, " For the middle class Bengali Babu of late nineteenth century Calcutta, the figures of the White Boss in a mercantile office or jute mill, the magistrate in court, the officer in the district, the police sergant or uniformed soldiers roaming the streets of Calcutta (invariably, it seems,in a state of drunkenness) were not objects of respect and emulation: they were objects of fear"(Partha Chatterjee)। 

'সেই সময়' উপন্যাসের চন্দ্রনাথ ওঝাকে মনে পড়ে? সে যেসব অসুখের চিকিৎসা করত তার মধ্যে একটা হ'ল সাহেবের ভয়। কী ছিল চন্দ্রনাথের চিকিৎসা পদ্ধতি? তার সহকারী সুলতান রোগীকে সাহেব সেজে ভয় দেখাত আরও বেশী করে। চোখ লাল ক'রে বলত, "ড্যাম পামকিন, ড্যাম কিউকাম্বার, ড্যাম, ড্যাম, ড্যাম..."। ভয়ের শেষ সীমায় পৌঁছে রোগী যখন টেবিলে রাখা মুগুর হাতে ঘুরে দাঁড়াত তখনই রোগ সারত তার। সুলতান হেসে বলত : " মুই ছুলতান সাহেব।" চন্দ্রনাথ এগিয়ে এসে মনে করিয়ে দিত যেমন কুকুর তেমনি মুগুর। আপনারা নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভয় আর প্রতিরোধ দুটিকেই ভাষাস্তরে স্থাপন করেছেন? মনে আসছে নিশ্চয়ই চন্দ্রনাথের ইংরিজি ভাষার ওপর দখল? ঠিক এই উপায়েই প্রতিরোধ গড়েছিলেন কেশববাবু(সেন), বঙ্কিমবাবু(চট্টোপাধ্যায়)রা। ক্ষমতার ভাষা ইংরিজিকে আত্মস্থ ক'রে তাঁরা ইংরিজি কাগজ বার করছিলেন; ইংরিজিতে উপন্যাস লিখে হাত মকশো ক'রে বাংলা নভেল লিখছিলেন, জাতির ইতিহাস খুঁজছিলেন। একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক সমাজের বাসিন্দারা এক আত্মন (Self) নির্মাণও করে চলছিলেন। তারই দেখা পাওয়া যায় সেই সময়ে রচিত আত্মজীবনীগুলির মধ্যে। "Historians of Bengali Literature conventionally agree that the modern forms of the biography and the autobiography made their appearance in Bengal sometime in the middle of the nineteetnth century because of the emergence of the new concept of the 'individual' amnog the English educated elite।" কিন্তু, এই আত্মজীবনীগুলিও আত্মসচেতন। বস্তুতঃ রচয়িতারা জানতেন যে তাঁরা এলিট। এদিকে তাঁরা ইংরেজনির্মিত নেইশনহুডের ধারণা নিজের দেশে প্রয়োগ করতে চান। আর সেই দেশে রামা বাগদিদের সংখ্যাই বেশী। তাই সমাজ সংস্কারক রামতনুবাবুর (লাহিড়ী) জীবনীর আকারে লেখা হয় উনিশ শতকের বাংলার প্রথম সামাজিক ইতিহাস 'রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ'; সুরেনবাবু (সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়) ইংরিজিতে তাঁর আত্মজীবনী লেখেন বটে কিন্তু "the foremost political leader of Bengal at the turn of the century entitled his autobiography 'A Nation in Making'. The 'new individual', it would seem, could represent the history of his life only by inscribing it in the narrative of the nation।" এলিট বাবুদের আত্মজীবনী লিখতে ব'সে সংশয় তাহলে অনেক পুরনো এক সমস্যা। 

শ্রেণীচরিত্র নিয়ে সমর সেনের কুন্ঠার কারণ এবার আমরা বুঝতে আরম্ভ করেছি। একে তো তাঁর সাম্যবাদী মনোভাব তাঁর নিজের মধ্যবিত্ত অবস্থানকে বুর্জোয়া ব'লে চিনতে শিখিয়েছে। উপরন্তু ইংরিজি ভাষার ওপর তাঁর অধিকার প্রবাদপ্রতিম। Power Language এর ক্ষমতাবৃত্তের মধ্যেই যে তাঁর অবস্থান তা তিনি বিলক্ষণ জানতেন। এবং তাঁর পূর্বসূরিদের মতোই এই কারণে তাঁর অস্বস্তি ছিল। আর সেই কারণেই তাঁদেরই মতো এক বৃহত্তর ন্যারেটিভের মধ্যে তাঁর জীবনকাহিনীকে প্রতিস্থাপন করেছিলেন তিনি। নিজেকে বিশ্লিষ্ট ক'রে তিনি যেন দেখতে আর দেখাতে চাইছিলেন বাঙালী, মধ্যবিত্ত, ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের সীমাবদ্ধতা এবং তাদের যুক্তিহীন ব্যক্তিপূজার প্রবণতাকে। তাই তাঁর আত্মসমালোচনা: "আমাকে কেউ বিপ্লবী বললে মনে হতো -- এবং এখনও হয় -- যে বিপ্লবকে হেয় করা হচ্ছে। চিন্তায় ও কর্মে সমন্বয় আনতে না পারলে বড় জোর 'বিপ্লবী' সাপ্তাহিক চালানো যায় কিন্তু বিপ্লবী হওয়া যায় না।" 

এই কারণেই বাঙালী আইকনদের সচেতনভাবে আঘাত করা : "নাট্যমঞ্চে তখনো সম্রাট শিশিরবাবু তবে তাঁর অভিনয় নির্ভর করত মাদক মাত্রার ওপর। সীতা নাটক, প্রথম দৃশ্যে রামের অঙ্কশায়িনী সীতা (শ্রীমতী প্রভা), সিন উঠলো, রাম (শিশিরবাবু) জড়িত কন্ঠে বললেন, 'সীতা তুমি যদি রাম হতে আর আমি সীতা, তাহলে একটু জিরোনো যেত।' পট নেমে আসত।" এই উদ্দেশ্যেই রবীন্দ্রনাথকে রবিবাবু ব'লে সম্বোধন এবং সেই অমর উক্তি, "শান্তিনিকেতনে পরচর্চার আবহাওয়া দেখে বলতাম ব্রাহ্ম পল্লীসমাজ (বুদ্ধদেববাবুর 'সব পেয়েছির দেশ' অন্য সুরে লেখা)।"

কিন্তু, এসব সত্ত্বেও সত্যের খাতিরে তাঁকে আরও কিছু লিখতে হয়েছে যা তাঁর কুল-শীলের পরিচয় দেয়। যেমন: 

"ঠাকুরদা [রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেন] ঘোড়ার গাড়িতে বেহালা থেকে যেতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে"; "দিলীপ রায় পণ্ডিচেরী থেকে কলকাতায় এসে বিদগ্ধ ও সম্ভ্রান্ত সমাজে গানের আসর বসাতেন...তাঁর সূত্রে ঘরোয়া আসরে গান শুনেছি কেশরবাঈ ও হীরাবাঈ বরোদেকরের"; "একবার বিষ্ণুবাবু...আমাদের বৈঠকখানায় যামিনী রায়ের একটি ছবি টাঙিয়ে দিয়ে যান"; 
"যামিনীদা'কে ছোটবেলা থেকে চিনতাম"; "আমার বেশি অনুরাগ ছিল এলিয়টের প্রতি। 'Poetry is not a turning loose of emotion' কথাটি এখনও মনে পড়ে বাংলা কবিতা পড়লে"। 

রাধারমণবাবু (মিত্র) ও বঙ্কিমবাবু(মুখোপাধ্যায়)কে মননঋদ্ধ কিন্তু 'সহজ জীবনের, সহজ বিশ্বাসের' দিশারি হিসেবে মেনে নেওয়া; ক্রিস্টোফার কডওয়েলের উল্লেখ; সেকাল - একালের ছাত্র চরিত্র নিয়ে হঠাৎ তুলনায় যে সমর সেনের দেখা আমরা পাই তাঁকে সসম্ভ্রমে সমরবাবু ছাড়া অন্য কোনও অন্তরঙ্গ প্রিয় সম্বোদ্ধনের কথা ভাবাই যায় না। তাঁর এই আভিজাত্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলেই রচনা থেকে গড়ে ওঠা মেধাবলে ক্ষমতাশীল এক শ্রেণীর প্রতিভূস্বরূপ লেখকের ব্যক্তিত্ব ও তাঁর উদ্দেশ্যের মধ্যে এক দ্বান্দ্বিক টানাপড়েন 'বাবুবৃত্তান্তের' কথাশরীর জুড়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়।

'বাবুবৃত্তান্তের' আরেকটি বৈশিষ্ট্য হ'ল তার নাগরিকতা বা কলকাতা কেন্দ্রিকতা। তাঁর এক স্মৃতি চারণায় অশোক মিত্র বলেন: "In the Babu's Tale one can savour his passionate attachment to North Calcutta and the Sagar Manna Road in the neighbourhood of Behala।" রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন যে, বাঙালীর উনিশশতক চর্চার প্রায় সবটাই কলকাতা কেন্দ্রিক। ১৮২৩ সালে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'কলিকাতা কমলালয়' প্রকাশিত হওয়ার সময় থেকেই তার বিশেষত্ব ও মহিমার কারণে কলকাতাকে কৃষ্ণনগর, ঢাকা, মুর্শিদাবাদের মতো আরও পুরনো সব জনপদের ওপরে রাখাটা রেওয়াজ হয়ে ওঠে। "কলকাতা বনাম বাকি বাংলা -- এমন একটা খাড়াখাড়ি ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছিল" উনিশ শতকে; গড়ে উঠেছিল বিখ্যাত ক্ষমতাকেন্দ্র 'কলকাতা কালচার' যার প্রবক্তা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক বাবুর দল। 'বাবুবৃত্তান্তের' প্রতিটি শব্দ এই সাংস্কৃতিক নির্ধারক প্রসূত। 

এবার সাহস ক'রে বলার সময় হ'ল যে 'ভদ্রলোক বাবু' শব্দজোড়টি একটি 'নির্মাণ' বা 'Construct' হিসেবে এক 'সাংস্কৃতিক বয়ান' বা 'Cultural discourse' এর অংশ। ঊনবিংশ শতক থেকেই ভদ্রলোকদের আত্মজীবনীর 'আত্মন নির্মাণ' বা 'Construction of the Self' কে এই বয়ান নিয়ন্ত্রণ করে। ১৯৭৯ সালে আত্মজীবনী সম্পর্কে 'Autobiography as De facement' নামে এক বৈপ্লবিক প্রবন্ধ লেখেন Paul de Man। তাঁর মতে আত্মজীবনীতে প্রকাশ পায় যে, "all knowledge including self knowledge, depends on figurative language or tropes. Autobiographies thus produce fiction or figures in place of self knowledge they seek. What the author of an autobiography does is to endow his inscription within the text with all the attributes of a face in order to mask or conceal his fictionalization or displacement by writing" (Linda Anderson)। লিখন মানেই কথাবিশ্ব রচনা। ভাষা দিয়ে গড়া আত্মজীবনীর 'আত্নন'ও ভাষাসৃজিত। লেখক আত্ম - কথাকে নিজের মুখ ধার দিলেও কথাশরীরে সে মুখ শব্দে আঁকা ছবি হয়ে ওঠে। শব্দের নানান কোণ আর খাঁজ থেকে বিচ্ছুরিত হয় অর্থ ও বোধের বিভিন্ন মাত্রা। শোনা যায় বহুল স্বর: ঐতিহ্যের, ইতিহাসের, নির্ধারকের। তাই তাঁর জীবনকাহিনী লিখতে গিয়ে বহুস্তরী কাহিনীই রচনা করতে হয় সমর সেনকে। বয়ান ও লিখনের শক্তি তাঁর ব্যক্তিত্বকে করে তোলে এক প্রবাহিত বৃত্তান্তের অংশ। বাবু বৃত্তান্ত।।



ঋণস্বীকার : 
১) উনিশ শতকের সামাজিক আন্দোলন, কাঙাল হরিনাথ ও গ্রামবার্তা প্রবেশিকা -- ডঃ অশোক চট্টোপাধ্যায়।
২) The Nation and its Fragments -- Partha Chatterjee। 
৩) ভারতেতিহাস জিজ্ঞাসা --- নীহাররঞ্জন রায়।
৪) A Way of Putting It --- Asok Mitra। 
৫) পরশুরামের নাগরিকতা --- রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য।
৬) Autobiography --- Linda Anderson। Samsung tablet.


2 comments:

6

প্রবন্ধ - দীপারুণ ভট্টাচার্য্য

Posted in


প্রবন্ধ


চা-পান উদর
দীপারুণ ভট্টাচার্য্য


অনেকদিন আগের কথা। একজন দেওয়ালে লিখেছিলেন, "বাঙালী জাগুন" পরদিন দেখা গেলো কেউ লিখেছেন তার পাশে, "জেগেছি, চা দিন" আমাদের দিন শুরু হয় চা দিয়ে। কবীর সুমন তাঁর গানে তুলেছিলেন সেই অমোঘ প্রশ্নটি, "একটু ভালো চা পাওয়া যায় কোন দোকানে?" আহা সত্যিই তো, চা ছাড়া কি বাঙালীদের চলে? বিশেষ করে, আড্ডাবাজ বাঙালীদের জন্য চা এক উৎসাহবর্ধক টনিক বটে। তবে ঐ একটু ভালোর কিন্তু কোনও মাপকাঠি নেই। চায়ের গুণমান ও গুণাগুণ নিয়ে বহু চাচা চাচিকেই চোখ রাঙিয়ে গলা ফাটাতে দেখেছি। চা নিয়ে চাপান উতোর আজকের নয়। বাংলা সাহিত্যর বহু রথী-মহারথীও এই রসের রসিক। রবি বাবু শান্তিনিকেতনে চা চক্র বা চায়ের আড্ডার নাম দিয়েছিলেন "চাক্র"। এবাদে নজরুল, ডি এল রায় থেকে পরশুরাম এমনকি স্বামী বিবেকানন্দও এই একই পথের পথিক।

চা প্রথম চাষ হয় চীনে। ১৭৭৪ এ ইংরেজরা চীন থেকে বীজ এনে ভুটানে চা চাষের চেষ্টা করেন। ১৭৮৮ সনে কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনেও চাষের চেষ্টা হয়। ১৮২৩ সালে মেজর চার্লস রবার্ট ব্রুস আসামে প্রথম ভারতীয় প্রজাতির চা গাছ আবিষ্কার করেন। উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ সালে গঠন করেন চা সমিতি। দুই বাঙালী রাধাকান্ত দেব ও রামকমল সেন ছিলেন এই সমিতির অন্যতম সদস্য। ১৮৩৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি আসামে চা চাষের মধ্যে দিয়ে ভারতে চা শিল্পের গোড়াপত্তন করে। ১৮৪০ নাগাদ আবার চীনের বীজ এনে চা চাষের চেষ্টা হয় বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের পাহাড়ী অঞ্চলগুলিতে। ১৮৪৭ সালে দার্জিলিং অঞ্চলে চা চাষ শুরু হয়।

এখন ভারতে মূলত দার্জিলিং-সহ উত্তরবঙ্গ, আসাম ও উত্তর পূর্বের কিছু রাজ্য, যেমন, ত্রিপুরা এবং দক্ষিণের কেরালায় চা চাষ হয়। সম্প্রতি ঘুরতে গিয়ে দেখেছি উত্তরাখণ্ডের কৌশানীতেও আছে চায়ের বাগান। চায়ের বিজ্ঞান সম্মত নাম ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস (Camellia Sinensis)। আর দার্জিলিং ও আসামের চা গাছের নাম যথাক্রমে ক্যামেলিয়া চায়নিকা ও ক্যামেলিয়া আসামিকা।

CTC শব্দটি চায়ের বাজারে পরিচিত। এর অর্থ Cut, Tear, Curl. এই পদ্ধিতিতে তৈরি হয় আসামের চা। তাই তা দেখতে ছোট ছোট বলের মতো। আসাম চায়ে মেশাতে হয় দুধ ও চিনি। সারা ভারতে এর ব্যবহারই সব চাইতে বেশি। যদিও "একটু ভালো চা" বলতে আমার কিন্তু দার্জিলিং চায়ের কথাই মনে হয়। তাই সেই চা পান করিয়েই সকলের উদর ভরাতে চাই।

কলকাতার লাল বাজার এলাকায় আছে পর পর চায়ের দোকান। মনে হয় এত চায়ের দোকান সারা ভারতে এক সঙ্গে আর কোথাও নেই। এর মধ্যে একটি দোকান ধ্রুবদার দোকান বলে পরিচিত। বিভিন্ন দামের চা পাওয়া যায় সেখানে। অনেককে দেখেছি কেনার আগে শুকনো চা শুকে দেখেন। অনেকটা সুকুমার রায়ের গন্ধ বিচারের ভঙ্গিতে। ভারতে যে চা পাওয়া যায় তাকে উৎস, গন্ধ, স্বাদ ও বর্ণ অনুসারে ভাগ করলে প্রায় ত্রিশ লক্ষ রকমের হবে। মূলত চা তিন রকম, কালো চা বা ব্ল্যাক টি, সবুজ চা বা গ্রীন টি এবং সাদা চা বা হোয়াইট টি।

আগে আমার ধারণা ছিলো ব্ল্যাক টি আর গ্রীন টি বুঝি আলাদা আলাদা গাছ থেকে হয়। এই ধারণা সঠিক নয়। একই গাছ ও পাতা থেকে বিভিন্ন ধরনের চা আমরা পাই। পার্থক্য শুধু কারখানার পদ্ধতিতে। এ বিষয়ে আলোচনা হবে, তার আগে প্রশ্ন হলো, চা পাতা কখন তোলা হয়? আগে ধারণা ছিলো, মহিলা শ্রমিকেরা বুঝি সারা বছর পাতা তোলেন। এ ধারণাও সঠিক নয়। পাতা মূলত চারটি সময়ে তোলা হয়। শীতকাল মানে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পাতা তোলা হয়না। কেননা এই সময় সেভাবে পাতা জন্মায়না। মনে রাখার জন্য বলি দুর্গা পুজো ও কালী পুজোর পর পর পাতা তোলা বন্ধ হয়ে যায় আর সরস্বতী পুজোর আগে পিছে আবার পাতা তোলা শুরু হয়। যদিও সব বাগানে শীত এক সময় আসেনা। যে সব বাগান পাহাড়ের উপরে সেখানে শীত আসে আগে। শীতের সময় বাগানের মহিলা শ্রমিকেরা খুব সাজগোজ করেন। কেননা অন্য সময় তারা নেলপলিশ বা সুগন্ধী ব্যবহার করতে পারেন না। এতে চায়ের গন্ধ নষ্ট হয়ে যায়।

প্রায় তিন চার মাস পর ফেব্রুয়ারীতে আবার পাতা তোলা শুরু হয়। এত দিন পর তোলা হয় বলে এই পাতা স্বাদে গন্ধে ভরপুর হয়। তাই এই চায়ের দামও হয় সব থেকে বেশি। এই চায়ের পোশাকি নাম First Flush. কেজি প্রতি আট-দশ হাজার টাকার নীচে বিশুদ্ধ First Flush পাওয়া যায়না। স্বাদ গন্ধ থাকলেও এই চা লিকার ততটা দিতে পারেনা। কেননা শীত কালের রোদের অভাব। মার্চের শেষের থেকে বাড়তে থাকে রোদ্দুর। তখন যে পাতা তোলা হয় তাকে বলে Second Flush. এই চায়ের গন্ধ একটু কম তবে লিকার বেশ ভালো। ভালো বাগানের Second Flush চার-পাঁচ হাজার টাকা কেজি দরে পাওয়া যায়। দার্জিলিংয়ের সব বাগানের গাছ কিন্তু একই, তবে চা বাগান কতটা উপরে, পাহাড়ের কোন দিকে মানে কেমন রোদ্দুর পায়, কারখানা বাগানের কাছাকাছি কিনা, ইত্যাদি অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে কোন বাগানের চা কত দামি হবে। তবে মার্কেটিং ও একটা বড় ব্যাপার। ভারতের প্রধানমন্ত্রী গেলেন রানী ভিক্টোরিয়ার সাথে দেখা করতে। উপহার দিলেন 'মকাইবাড়ির চা'। এই খবর বাজারে আসতেই মকাইবাড়ির চায়ের দাম বাড়তে বাধ্য।

জুন জুলাই পাহাড়ে বৃষ্টির সময়। এই সময় গাছ পাতা দেয় সব থেকে বেশি। তবে সে পাতায় তেমন সুগন্ধ বা লিকার থাকেনা। কাজেই 3rd Flush এর চা আপনি বাজারে পাবেন না। এই চা মূলত অন্য সুগন্ধির সাথে ব্লেন্ডিং করে বিক্রি হয়। যেমন, তুলসী, জুঁই, গোলাপ, এলাচ, লবঙ্গ, ইত্যাদি। এর পর আসে শরৎ কাল সেপ্টেম্বর অক্টোবর। এই 4th Flush-এর চা তুলনায় প্রায় 2nd Flush-এর কাছাকাছি।

দার্জিলিং ব্ল্যাক বা কালো চায়ের জন্য পরিচিত। ছোট বেলা থেকে শুনেছি 'হ্যাপি ভ্যলি' বাগানের চা নাকি জগৎ বিখ্যাত। তবে একই চা পাতা কি ভাবে কালো, সবুজ ও সাদা চায়েতে পরিণত হয় এটা একটা প্রশ্ন বটে। প্রথমে বলি কালো চা কিভাবে তৈরি হয়। চায়ের পাতায় কিছু এনজাইম থাকে যেগুলো বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে সৃষ্টি করে গন্ধ ও বর্ণ। এক জন মহিলা শ্রমিক প্রতিদিন গড়ে আট থেকে দশ কেজি পাতা তোলেন। আমাদের ধারণা আছে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির। আসল সত্য হলো সব কচি পাতাই তোলা হয়। সাথে থাকা কচি ডালের অংশও। চায়ের পাত্রে মাঝে মধ্যে এমন দু’একটা ডালপালা পাওয়া যায়।

চীনের সনাতন পদ্ধতি ছিলো চা পাতা তুলে তাকে খানিকটা রোদে শুকানো। তার পর দু’হাতের তালুর মধ্যে ঘষা, যেভাবে সলতে পাকানো হয়। এখনও দার্জিলিংয়ে এই সনাতন বা অর্থোডক্স পদ্ধতিতেই চা তৈরি হয়। শুধু সময় বাঁচাতে এসেছে মেশিন। সারাদিনের তোলা পাতা একটা তার জালের উপর বিছিয়ে রাখা হয়। নিচে থেকে দেওয়া হয় ঠাণ্ডা ও গরম হাওয়া। ঠাণ্ডা মানে প্রাকৃতিক আর গরম মানে ৩০℃. ১২-১৮ ঘন্টা চলার পর পাতা হারায় ৬০% জল। সেই নরম পাতাকে তখন মেশিনে দিয়ে আলতো ভাবে ঘষা হয় যাতে এনজাইমগুলো বেরিয়ে আসতে পারে। তার পর ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে জানালা খুলে দেওয়া হয়। এতে অক্সিজেন পাতার এনজাইমের সাথে বিক্রিয়া করে তৈরি করে বর্ণ ও গন্ধ। অক্সিডেশন যত বেশি হবে তত বর্ণ বাড়বে আর গন্ধ কমবে। কারখানার ম্যানেজার অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজন অনুসারে সময় নির্ধারণ করেন। মোটামুটি ৩-৬ ঘন্টা সময় লাগে এখানে।

গ্রীন-টিকে অক্সিডেশনে দেওয়া হয়না তাই সেটা কালো হতে পারেনা। হোয়াইট-টিকে আগের পদ্ধতি মানে ঘষাও হয়না। তাই এটি বর্ণ বা গন্ধ তেমন দিতে পারেনা। এটিতে থাকে অনেক এন্টিঅক্সিডেন্ট। যদি কোনও চা কারখানা বাগান সংলগ্ন না হয়ে শহরের মাঝে হয়, তবে সব কিছু ভালো হাওয়া সত্ত্বেও চায়ের মান খারাপ হয়। এটা শহরের দূষণের মাত্রা ও অক্সিজেনের জন্য। অক্সিডেশনের পর একটি মেশিন তাপ প্রয়োগ করে পাতা থেকে শুষে নেয় ৯৮% জল। ২% জল তবু থেকে যায়। তাই চায়ের পাত্র বার বার খুললে অক্সিডেশনের জন্য চা স্বাদ ও গন্ধ হারায়।

এরপর থাকে চা ভাগ করার পালা। কেননা বিভিন্ন স্তরে কিছু কিছু পাতা ভেঙ্গে যায়। একটি যন্ত্রের সাহায্যে আকার অনুসারে চার ভাগে চা ভাগ হয়। হোল লিফ বা গোটা পাতা, ব্রোকেন বা ভাঙা, ফিনিক্স বা খুব ছোট ছোট পাতা আর টি ডাস্ট বা চায়ের গুঁড়ো। অনেকে চা বানানোর কষ্ট এড়াতে "টি ব্যাগ" ব্যাবহার করেন। সাধারণত বাজারে যত রকম "টি ব্যাগ" পাওয়া যায় সবই তৈরি হয় এই চায়ের গুঁড়ো দিয়ে। সম্প্রতি বড় পাতার "টি ব্যাগ" বাজারে এসেছে। এগুলো দেখতে তিন কোনা, ত্রিভুজের মতো। এই ব্যাগ গরম জলে পড়লে পাতা খুলে যাওয়ার সুযোগ পায়।

গাছ থেকে তোলা একশো কেজি পাতা থেকে মাত্র ১৮-২০ কেজি চা তৈরি হয়। চায়ের অধিক দামের জন্য এটাও একটা কারণ। তবে এই শিল্পে প্রায় কিছুই নষ্ট হয়না। যাই হোক আলাদা আলাদা হবার পর প্রায় সব চা আসে কলকাতাতে। এখন দার্জিলিং অঞ্চলে প্রায় ৭৮টি উল্লেখযোগ্য চা বাগান রয়েছে। সবার অফিস আছে কলকাতাতে। বড় বাগানের আছে নিজস্ব টি টেস্টার। যারা বিভিন্ন ধরনের চা মিলিয়ে মিশিয়ে তার বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ ও মূল্যকে করে তোলেন আমাদের মনের মতন।

ইতিহাস খুঁজলে পাওয়া যায় দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিলো "The Bengal Tea Association" ১৮৩৯ সালে। ১৯০০ সালে প্রথম বাংলা ভাষার চা পুস্তক প্রকাশ পায়। লেখক গিরিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আর বইটির নাম "চা প্রস্তুত প্রণালী শিক্ষা"। এরপর বিগত ১১৫ বছরে চা নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে। নিশ্চয়ই আগামী দিনেও হবে। এই লেখার সাথে রইলো চা বাগানের ছবি, চা ফুলের ছবি ও একটু ভালো চায়ের ছবি। এই লেখা পড়তে পড়তে দার্জিলিং চায়ে চুমুক দিয়ে যদি নিজের অজান্তে কন্ঠ বলে ওঠে, "আঃ" তবেই এ লেখা সার্থক। কেননা মদ খেয়ে মাতাল হওয়া যতটা সোজা, চা খেয়ে চাতাল হওয়া ততটা সহজ নয়।







6 comments:

1

প্রবন্ধ - উত্তম বিশ্বাস

Posted in

প্রবন্ধ


কুয়োতলার কাব্য 
উত্তম বিশ্বাস 



‘ময়লা কাপড় রুক্ষ মাথা / দুঃখ বলে থাকি কোথা! 
কোঁকের কাঁটা ক্যাতার (কাঁথা) সুঁই / কেঁচোর নাড়ি শীতের পুঁই!’ 

বুড়ি আয়ি! বাঁ হাতের তালুতে একঝাকা এঁটো বাসন নিয়ে জলের ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কত কাব্যই না করে যায়! বুদবুদের মতো ফেনিয়ে ওঠে কথা। কোনটা ভেসে ওঠে কোনটা হেসে ওঠে; আবার কেউ কেউ ঝিমকেটে বীজ বোনে ঘোলাটে জলের দেশে! কে শোনে কারও কথা! তরিবালা আসে, পেছনে ঘ্যাচড় দিতে দিতে আসে মাজাভাঙ্গা আধমরা ধাই! ক্ষ্যামার মা আসে, পানপাতার মতো থুতনি নাচাতে নাচাতে আসে খয়েরি হরিমতি--- এরা সকলেই কবি! একেবারে সহজাত কবি! যদিও এদের জন্যে সময় অসময়ের একমাত্র সম্মানজনক সাহিত্যের ঠেক হলো কেশেমোড়লের কুয়োতলা! না গো! এরা কস্মিনকালেও কফিহাউসের নাম শোনেনি! বুড়ো বটতলা অথবা ভীষ্মমোড়লের আটচালা মাটির বারান্দাই ছিল এদের যৌবন বার্ধক্যের চুনকামহীন আলোমাটির নন্দন! এত যে উদয় অস্ত কলকল খলখল ছলছল ঝনঝন শনশন কাব্যের লহরি ওঠে তার যোগ্য সমাজ স্বীকৃতি কি ওরা কেউই পেয়েছে! না, পায়নি! রেশমের উত্তরীয় তো দূর অস্ত; মনের সুখে ঠ্যাং ছড়িয়ে মনসার ভাসান শুনতে গিয়েও একমুঠো পলবিচুলির জন্যে ওদের কত না কাড়াকাড়ি হুড়োহুড়ি! অথচ দ্যাখ, বছর বিয়োনে গাভীর মতো কত কবিতার জন্ম দিয়ে গেল ওরা! কেউ আঁতুড়েই এক খামচা নুন পেয়ে চুপ থাকল, কেউ এঁটো বাসনের সাথে কপাল ঠুকে ঠুকে মলো, আবার কেউবা কাস্তের আগায় লাঙলের ফলায় কামারের হাঁপরে জান কয়লা করে দিতে দিতে অলক্ষ্যেই মিলিয়ে গেল মহাকালের অতল তলে! তখন তো শ্বাশুড়ি ভাজের কুরুক্ষেত্র আর কাঁখে একটা কোঁকে একটা, মেঝেয় চারটে গড়াগড়ির যুগ! তার পরেও কোন এনার্জিতে কবিতায় প্রেগন্যান্ট হতো কি জানি বাপু! তবে রহস্য একটা রয়েই যায়; এরাই কি কবিতার আদি জননী, নাকি ধাই---সঠিক বলতে পারেনা কেউ! শুনেছি ইঁদুরের গর্তেই নাকি আদি ফসলের গন্ধ পাওয়া যায়; ঠিক তেমনি ওদের হৃদের ক্ষত থেকে যে ব্যথা, যে উত্তাপ বেরিয়ে আসত তা অন্য কোনও হেঁয়ালি বা খনার বচনে সেই উষ্ণতা পাওয়া যায় না! পুত্রকন্যা পরিবেষ্টিত একান্নবর্তী সংসার; হয়তো ধনেজনে সম্পদশালীও--- তবু তার মাঝেও সূক্ষ্ম ফাটল ধরা পড়ে শাশ্বত সত্যরূপে--- 

‘কাচের গেলাস চিনের বাটি 
এতে শুধু পয়সা মাটি!’ 

প্রাপ্তি আর প্রত্যাশার সঙ্গে বরাবরই ব্যাস্তানুপাতিক সম্পর্ক, এটা আবহমানকাল ধরে বয়ে চলা নিয়ম। কিন্তু অদৃষ্টের এই নিষ্ঠুর গাণিতিক উদাসীনতাকে মানতে চায় না জীবন! তাই তো গরম হাপরের মতো ফুসফুস ঠেলে বেরিয়ে আসে বীতরাগ হাওয়া--- 

‘পুড়া কপালে ভিটের দোষে 
মুততি বসলি হাগা আসে!’ 

ভাবুন একবার! শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ার সাথে নিয়তি নির্দেশকে একাসনে বসাতে হলে কতখানি উঁচুদরের কবিত্বশক্তির প্রয়োজন হয়! 

আত্মার আলপনায় অন্তরের আঙিনা রঙিন হয়ে ওঠে! উঠোন উঠে আসে অন্দরে; অন্দর আহ্বান করে নিখিলের নিবিড় সখ্যতা! কিন্তু সেখানেও ঝনঝনিয়ে খসে পড়ে মেকি সত্যাসত্যের শার্শি! স্বার্থ আর পরার্থপরতার পরশপাথরের ঘষাঘষিতে উঠে আসে আসল সোনা ---

‘জল আওলাও জল আওলাও 
জল কখনও ঘুলা না। 
হিদের মাছ (মাঝ) কেটে দেখ 
পর কখনও আপন না!’ 

মাঝ’খানটিকে যদি ‘মাছ’ ধরেও পড়া হয়, সেখানেও কী বিচিত্র রঙিন পাখনা নেড়ে যায় জীবন-সমুদ্রের আশাচারলোভী মীনেরা! 

কাঠঘুটের আখা। যেখানে আগুনের চেয়ে ধোঁয়ার হল্লাই বেশি, সেখানে অকারণ সোহাগ সাঁতারে ভাসতে দেখলে হাঁড়ি মাজা কেলে আইবুড়ি দাসীরও অঙ্গে ঝামা ক্ষরিয়ে ওঠে--- 

‘মাগীদের ঠ্যাকার বুঝবে কার বাপে 
কেস্তের ঠোকা মেরে বলে কেমড়েছে আমার সাপে!’ 

কিম্বা--- 

‘ঠ্যাকার ঠ্যাকার করে গা 
আখার মদ্দি দিয়ে পা! 
ঝ্যেকন আসব্যান বাড়ি তুলবান পা 
না ঝদি আসে পুড়ে যাক গা!’ 

ষোলকলার নারী মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ন করতে আমাদের মা ঠাকুরমারা আয়িরা তো সেদিন ব্যাতসায়ন কিম্বা ফ্রয়েড অধ্যায়ন করেনি! নিদেন পক্ষে তাদের মধ্যে কেউ কেউ একটা দাশুর পাঁচালিও পড়তে জানত না; তবে কোথায় পেল তারা এই অপূর্ব বিদ্যা! 

তুর্কি তাতার থেকে শুরু করে যুগযুগ ধরে কত দল উপদলের হাতে উঠে এসেছে বাংলার শাসনভার। একদিকে প্রজাপালনে অপদার্থতা, অপরদিকে লাগামহীন স্বৈরাচার! পীড়িত প্রজার তিতিক্ষা যেন গোষ্ঠহীন গাভীর মতো ঝড়বাদলে অবনত মস্তকে ভেজা আর রৌদ্রোজ্জ্বল সকালের জন্য প্রতীক্ষা করা ছাড়া কিছুই থাকে না--- 

‘অভদ্রা বর্ষা কাল 
হরিণ চাটে বাঘের গাল! 
শোনরে হরিণ তোরে কই 
কালগুণে সবই সয়!’ 

এই অমোঘ কথাগুলো সত্যিই কি শুধুমাত্র সাবেক কালের গণ্ডিতে ফেলে রাখা যায়! বর্তমানে রাজনৈতিক কদাচার অশিক্ষিতের হাতে শিক্ষা সংস্কৃতি রুচি আদর্শের আদ্যশ্রাদ্ধ দেখলে আমাদের অন্তরাত্মাও কি আরও একটিবার সম্ভাব্য সুদিনের জন্যে এইভাবে প্রতীক্ষা করে না ? 

‘থাক রে পরাণ সয়ে 
ভাদ্দরমাসে ভাত দেব তোর / ঝিঙের ঝোল দিয়ে!’ 

অপরদিকে আটপৌরে মানুষের জীবনদর্শনও রচনা করে গেছে তারা আটকুঠির নোনালাগা দাওয়ায়... 

‘ভাগের ভুঁই ভাগে দিয়ে / যাওয়া আসা সার!’ 

কিম্বা,

‘ভোগের মা শালিমাগী / আমাকে দেখে গোসা করিল!’ 

ভোগসুখ বঞ্চিতা নিরক্ষরা জগতসংসার এছাড়া আর কিভাবেই বা তার ব্যথার ব্যঞ্জনা রেখে যেতে পারে! 

সাতপাঁচে মুখরিত পাড়া। পাঁচকানে পঞ্চমুখ দেশিয়ালি নেটওয়ার্ক! ওদের মধ্য কেউই হয়তো পড়েনি মন্থরা, জানেনা বড়ায়ি; তবু পাড়াতুত কৌটিল্য আয়িকে চিনতে ভুল করে না কেউ--- 

‘কাক কক্ক কক্কধাড়ি 
কক্ক বেড়ায় বাড়ি বাড়ি। 
হ্যাদে কক্ক শুনে যা 
চাচির ফাড়া গুণে যা! 
চাচি লো চাচি 
এগিয়ে এসে শোন, 
যবন ঘরে বিশ্বাস নেই 
মামাতুত বোন!’ 

অথবা, 

‘মুখ দালালী কাঁঠাল কুশি 
আমার বাড়ি যেও। 
হাঁড়িতে ভাত নেই 
লেবু দিয়ে খেও!’ 

নারীর আত্মমুকুরে চিরবসন্তের তৃষ্ণা লেগে থাকে! বার্ধক্যকে জরাকে সে কখনই স্বীকার করে না! আজকের অরিষ অ্যারমা্থেরাপির জাদু তাদের কতখানি প্রোটেকশান দিতে পেরেছে জানিনা। তবে চিলেকোঠায়, খোলা ছাদে উঠোনের শুকনো পাতায় আজও মর্মরিত হয় হারানো লাবণ্যের দীর্ঘশ্বাস--- 

‘আম শুকোলি আমসি 
আর যৈবন গেলি কানতি বসি!’ 

অথবা,

‘আয় রে যৈবন ফিরে আয় 
বুড়ির দোর দে’ কড়ি যায়!’ 

এই যে প্রচেষ্টা আর ব্যর্থতার বেদনার ইতিহাস নিতান্ত সাদাকালিতে ব্যাখ্যা করা যাবে না বোধহয়! তবে একালের কবিতার ভাষায় এভাবেও হয়তো খানিকটা ধরা যায়--- 

‘কাজল মাখিতে মাখিতে / আয়নার কুচি 
চোখের কোটরে নখ / খুঁটে মরে মিছিমিছি! 
পলক ঝরিয়া যায় / বয়সের তাড়া; 
লাথিঝাঁটা খেয়ে মরে / আয়নার পারা!’ 

সমাজ আর সংস্কার নিয়েই যেসব মানুষের বাঁচতে হয়; তারাও কখনও কখনও সমাজের চোখে ধুলো দিয়ে আপন অস্তিত্ব রক্ষার কৌশল অবলম্বন করে বাঁচে! কিন্তু সেখানেও জহুরি চোখ আতস কাচ হাতে নিয়ে হাজির হয়,

ধান নেই পান নেই / গোলাভরা ইঁদুর; 
ভাতার নেই পুত নেই / সিঁথি ভরা সিঁদুর!’ 

কিম্বা,-- 

‘কোনদিন দ্যাখলাম না কাত হয়ে শুতি 
নিত্য দেখি মাদুর ক্যাতা (কাঁথা) ধুতি!’ 

একদিকে পরকীয়া, অপর দিকে সমাজের রক্তচক্ষুর শাসানি; উভয়ের যাঁতাকলে পিষ্ট হয় জীবন... 

‘ধরিছি স্বপন পাখি / সব ছেড়ে দে’ একটা রাখি!’ 

অপর পক্ষের আন্তরিক অথচ নিষ্ঠুর সতর্কতা---

‘নাঙ মলে কেঁদো না / চুরা ধন চেও না!’ 

আসক্তি বাসি হতে হতেও একসময় বাসনা শুকিয়ে আসে; ঘরদোর গ্রাস করে বৈরাগ্যের ব্যথা, 

‘গোঁসাই তুমি ব্যালক হও / আমি আপ্ত(আত্ম ?) রেখে আছি!’ 

অথবা, 

‘আশা করে বাঁধলাম বাসা / না রাখিলাম দোর! 
অগ্নিতে পুড়ে মরলাম / জলের ভেতর!’ 

বুড়ি আয়ি তরিবালা হরিমতি খ্যামার মা, আজ আর কেউই নেই মহাকালের নিয়মকে মাথাপেতে নিয়ে ওরাও বিদায় নিয়েছে কুয়োতলা থেকে! ছ্যাতলা পড়া ঘাটে, এঁটো বাসনের কানায় ঘাসপাতার নুড়োতে রেখে গেছে যে বিপুল কাব্য সম্ভার তার কি মৃত্যু আছে; মৃত্যু নেই! ঘোলা ঘাটের ছলাতছল ঢেউ বলে আদি নিয়মের কথা--- 

‘হউত মউত বিয়ে 
তিন দেবতা নিয়ে। 
হউত লেখে গায় 
মউত লেখে পায়; 
যার যেখানে মরণ 
পায়ে হেঁটে যায়!’ 

সবশেষে বলি, আমাদের আয়ি, মা খুড়িরা প্রথাগত অর্থে আদৌ কেউ কবি নন! কবিতার আদি আঁতুড়ঘর ছিলেন মাত্র! আজকে আমরা যারা বাংরেজি বাগদত্তার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ শিরোমণি চূড়োমণি বাক্যবাগিশ যে যা’ই হই না কেন; তাদের সঞ্চিত সঞ্চয় আজ আমরা রক্ষা করতে পারি আর না পারি; শ্রদ্ধার সদিচ্ছা থাক আর না থাক--- ফ্যাশান আর মোশানের ঠাটে এটুকু স্বীকার করতে আমরা যেন কেউই এতটুকু কুণ্ঠিত না হই!


1 comments:

5

প্রবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


বাংলার গান - বাঙালির গান – ২
সোনার গান : শোনার গান
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

আগের সংখ্যায় বাংলার গান – ‘বাঙালির গান’ নিবন্ধে মধ্যযুগ থেকে প্রাক-আধুনিক যুগ পর্যন্ত বাংলা গানের পথচলাটি বুঝতে চেয়েছিলাম। কীর্তন, ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ হয়ে বাংলা গান পৌঁছেছিল রামনিধি গুপ্তর টপ্পা ও দাশরথী রায়ের পাঁচালী গানে। তারপর বাঙ্গালির গান পেল আধুনিকতার স্পর্শ, পেল আধুনিক কাব্যের লাবণ্য রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়ায়। সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে পড়তে যান। সেখানে তাঁর পাশ্চাত্য সংগীত সম্পর্কে ধারণা হয়। সেখান থেকে কয়েকটি আইরিশ লোক সংগীতের সুর সংগ্রহ করেন। বিলেত থেকে ফিরে তিনি গীতিনাট্য ‘বাল্মীকি প্রতীভা’ ও ‘কালমৃগয়া’ রচনা করেন। জীবন স্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন “এই দেশী ও বিলিতি সুরের চর্চার মধ্যে বাল্মীকি প্রতীভার জন্ম হইল”। সুতরাং বলা যায় বিলাত থেকে প্রত্যাগমনের পরই রবীন্দ্রনাথের সংগীত রচনার ইতিহাসের সূত্রপাত। বাংলা গানের এতাবৎ কালের পথচলায় নিশ্চিতভাবেই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ রবীন্দ্রনাথের স্পর্শ। সে প্রসঙ্গে আসবো। তার আগে আর একটি পর্যায় আছে তা হলো থিয়েটারের গান।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা গান বলতে কবিগান, আখড়াই তরজা, পাঁচালী গান আর বিত্তশালী বাবুদের বাগানবাড়ি, রক্ষিতা গৃহে চটুল আদিরসাত্মক গান। গান তখনও সাধারণ মানুষের বিনোদন সামগ্রী হয়ে ওঠেনি। থিয়েটারও ছিল জমিদার বাবুদের গৃহপ্রাঙ্গণে বন্দী। সাধারণ মানুষ বিনোদনের ভাগ পেতো বিত্তশালীদের আয়োজিত পূজা, উৎসবের ঝুমুর, কবিগান, তরজা, পাঁচালীর আসর থেকে।

১৮৭২এ জমিদার বাবুদের প্রাঙ্গণ থেকে বাংলা থিয়েটার চলে এল সাধারণ মানুষের নাগালে ন্যাশানাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। থিয়েটার হয়ে গেল বাঙালির বিনোদনের সেরা মাধ্যম। এবং থিয়েটারের গান। এখন বাংলা থিয়েটার থেকে গান প্রায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেও সেকালে গানই ছিল থিয়েটারের প্রাণ, সে যুগের নাটকের সেরা উপাদান। নাট্যকাহিনীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হোক বা না হোক নাটকে একাধিক গান রাখতে হতো, না হলে সে নাটক দর্শক আনুকুল্য পেত না। গিরিশচন্দ্র ঘোষ তাঁর নাটকের জন্য অসংখ্য গান লিখেছিলেন। গান ছাড়া নাটক লেখার কথা সে যগের নাট্যকাররা ভাবতেই পারতেন না। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের প্রবাদপ্রতীম নাটক ‘আলিবাবা’য় ছিল ৩৬টি গান। এমন নয় যে থিয়েটারের গানগুলির লোকপ্রিয়তা শুধু সে যুগেই সীমাবদ্ধ ছিল, সেদিনের থিয়েটারের অজস্র গান শতাধিক বছর পরে আজও কথা ও সুরের মায়ায় আমাদের আন্দোলিত করে। এযুগের শিল্পীরা সেইসব গানের রিমেক করছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের ‘চন্দ্রগুপ্ত’নাটকের গান ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে কি সংগীত ভেসে আসে’ গানটি প্রবাদের মতো হয়ে আছে। আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগে ‘নর্তকী’ নাটকে অতুলপ্রসাদ সেনের ‘আমার জীবন নদীর ওপারে, এসে দাঁড়ায়ও দাঁড়ায়ও বধু হে’ গানটি গেয়েছিলেন আঙ্গুর বালা আজও সেই গানটি পূণর্নির্মাণ করেন একালের শিল্পী। সে গান শুনে আমাদের মুগ্ধতা যায় না। ১৯০৫এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উত্তাল সময়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের দেশাত্মবোধক থিয়েটারের গানগুলি ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’, সাজাহান নাটকের ‘ধন্যধান্য পুষ্প ভরা’ স্বদেশী আন্দলনের চারণমন্ত্র হয়ে উঠেছিল, তবে ধ্বনি মুদ্রণ বা গ্রামফোন রেকর্ড এসেছিল অনেক পরে, তাছাড়া নাট্যমঞ্চ থেকে সরাসরি রেকর্ডিং ব্যবস্থা তখন কল্পনাতেও ছিল না। ফলে থিয়েটারে গানের বিপুল ঐশ্বর্যের সামান্যই সংরক্ষিত আছে। পরবর্তী কালে নজরুল ইসলামই সর্বাধিক থিয়েটারের গান রচনা করেছিলেন ও সুর দিয়েছিলেন। ১৯২৯এ শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ‘রক্তকমল’ নাটকে সঙ্গীত রচনার মধ্য দিয়ে থিয়েটারের গানে প্রবেশ করেছিলেন, তারপর দেড় শতাধিক গান লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন। এছাড়া বহু খ্যাতকীর্তি সাহিত্যিক – জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমেন্দ্রকুমার রায়, সজনীকান্ত দাশ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ থিয়েটারে গান লিখেছেন ।

কীর্তন, লোকগান, রামপ্রসাদী, কবিগান, পাঁচালী গান থেকে থিয়েটারের গান - – বিভিন্ন ধারার বাংলা গান বাঙালির একান্ত প্রাণের জিনিস হয়ে উঠেছিল। গানের এমন বৈচিত্রপূর্ণ সমাবেশ অন্য কোনও ভাষাভাষীদের মধ্যে ছিল না, আজও নেই। সুতরাং বাংলা গানের বিপননযোগ্য পণ্যমূল্য তৈরি হল আর তা বুঝতে ইংরাজ বনিকদের দেরি হল না। ইতিমধ্যে টমাস আলভা এডিসন ১৮৭৭ খৃষ্টাব্দে আবিস্কার করলেন অত্যাশ্চর্য ‘ফোনোগ্রাফ’ যন্ত্র, যা পরিচিতি পেল গ্রামফোন বা বাঙালির দম দেওয়া ‘কলের গান’ নামে। উনিশ শতক শেষ হবার আগেই কলকাতায় এসে গেল ‘কলের গান’। ১৯০২তে এমারেল্ড থিয়েটারের দুই নাচ-বালিকা শশীমুখী ও ফণীবালার কন্ঠে দুটি গান রেকর্ড হলো, সেটিই এদেশের প্রথম বাংলা গানের ধ্বনিমুদ্রিকা বা গ্রামফোন রেকর্ড। কালো গালার চাকতিতে ধ্বনিমুদ্রিত বাংলা গান গ্রামফোন যন্ত্রবাহিত হয়ে পৌঁছে গেল মধ্যবিত্ত বাঙালির অন্দরমহলে। বিশ শতকের সেই প্রথম দশকেও, বাংলার সমাজ অনেক শিক্ষিত, জাতীয়তাবাদ তীব্র হয়েছে তখনও গান গাওয়াকে বৃত্তি হিসাবে গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে ওঠেনি। গান গাওয়াকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করাকে হীন বৃত্তি রূপেই মনে করা হতো আর মেয়েদের গান করা তো ছিল তখনকার সমাজের চোখে পাপ কাজ। অভিজাত পরিবারের সন্তান হিসাবে প্রথম গ্রমফোন রেকর্ডে গান করেন লালচাঁদ বড়াল, যার পুত্র রাইচাদ বড়াল আধুনিক বাংলা গান ও সিনেমার গানের সুর রচনার ক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃতের মান্যতা পেয়েছেন। রেকর্ডিং চালু হবার পর ২৫/৩০ বছর নীচের মহল থেকে উঠে আসা মেয়েরাই বাংলার সঙ্গীত জগতকে আলোকিত করেছিলেন। শিল্পীর মর্যাদায় এরা সঙ্গীত জগতে লিজেন্ড হয়ে আছেন। গহরজান, কৃষ্ণভামিনী, হরিমতি, কমলা ঝরিয়া, আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা থেকে কানন দেবীরা বাংলা গানের ভুবনকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে গেছেন। শিল্পীর মর্যাদায় এরা সঙ্গীত জগতে লিজেন্ড হয়ে আছেন। সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী ইন্দুবালা খ্যাতির শিখরে উঠেছিলেন, গ্রামোফোন কম্পানীর ‘গোল্ডেন ডিস্ক’, ‘সঙ্গীত নাটক আকাডেমি সম্মাননা পেয়েছেন। কলকাতার রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর পদপ্রান্তে দাঁড়িয়ে উদ্বোধনী সঙ্গীত গেয়েছিলেন ইন্দুবালা। দেশজোড়া খ্যাতি সত্ত্বেও তিনি রামবাগানের নিষিদ্ধপল্লী ছেড়ে অন্যত্র চলে যাননি। বলতেন ‘আমি রামবাগানের মেয়ে... রামবাগানই তো আমায় সব কিছু দিয়েছে। অর্থ, সম্মান ভালোবাসা সব...’। একদিকে দেশজোড়া খ্যাতির আলো আর অন্যদিকে রামবাগানের নিষিদ্ধ পল্লীর অন্ধকার। এই দুইয়ের মাঝেই সুরের আকাশে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন ইন্দুবালা।

গ্রামফোন রেকর্ড সম্পর্কে দু'একটি তথ্য জানিয়ে রাখি। একদম প্রথমে এদেশে ধ্বনি মুদ্রনের প্রযুক্তি ছিল না। রেকর্ড প্রিন্ট হয়ে আসতো জার্মানী, অন্ডন, ফ্রান্স থেকে সেগুলি হতো একটু বড় মাপের এবং একদিকে একটি মাত্র গান থাকতো। অবশ্য পরবর্তী সময়ে আমাদের পরচিত রেকর্ডের মত ৭৮ পাকই ঘুরতো একটি গানের জন্য। ১৯৬২ নাগাদ এই ৭৮ ঘুরণের রেকর্ডের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, আসে ৪৫ ঘুরণের বর্ধিত বাদন বা এক্সটেন্ডেড প্লে যাতে দু'পিঠে চারটি গান থাকতো, এবং ৩৩ ঘুরণের দীর্ঘবাদন বা লং প্লে রেকর্ড যাতে দু'পিঠে ৮টি গান থাকতো। আশির দশকের শুরুতে সেগুলির উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যায়, চলে আসে ক্যাসেট। বছর দশেকের মধ্যে ক্যাসেট লুপ্ত হয়ে চলে আসে কমপ্যাক্ট ডিস্ক বা সিডি। অর্থাৎ তিনরকম প্রযুক্তিতে বিপননযোগ্য বাংলা গানের বয়স একশো বছরেরও কম।

১৯০২এ বাংলা রেকর্ডের গানের প্রচলন হলেও পরিশীলিত গায়নশৈলী, গানের কথায় আধুনিক কাব্যের ছোঁয়া লাগতে এবং আমাদের গায়নরুচি তৈরি হতে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও ২৫/৩০ বছর। তখনকার বিনোদনের গানগুলি ছিল কীর্তনাঙ্গ, দেহতত্ব, প্রেম ও ছলনামূলক চটুল গান অথবা মোটা দাগের হাসির গান। ইতিমধ্যে অবশ্য শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকরা রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেছেন। তখন বলা হতওঁ ‘রবিবাবুর গান’। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং নিজ কন্ঠে গান রেকর্ড করেছিলেন ১৯০৮এ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কালে পৌছে বাংলা গানের কথা, সুর ও গায়নশৈলীতে লক্ষ্যনীয় পরিবর্তন এলো। ইতিমধ্যে বাংলার সামাজিক প্রেক্ষাপট প্রস্তুত হয়েছিল আগেই। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে স্বদেশী ভাবনার গান বাংলাকে উত্তাল করেছিল, এসেছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ, রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক গানের প্রবল জোয়ার। রবীন্দ্রনাথ পথে নেমেছেন, মঞ্চনাটকে গান গাইছেন, ক্ষুদিরাম শহিদ হয়েছেন, বুড়িলামের যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন বিপ্লবী বাঘা যতীন, স্বদেশী ভাবনায় উত্তাল পল্লীবাংলার পথে পথে অনামি চারণ গান গেয়ে চলেছে ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’। বাঙালি মননের ঊর্বর ভূমি অতয়েব প্রস্তুত। বাংলা গান প্রকৃত অর্থে আধুনিক হওয়ার প্রস্তুতি শুরু যেন শুরু হয়েছিল। 

গত শতকের তিরিশের দশকে পৌঁছে বাংলা গানের আধুনিক হয়ে ওঠা বা বাংলা গানের স্বর্ণযুগের সূচনা হওয়ার অনুঘটক হিসাবে তিনটি ঐতিহাসিক ঘটনা কাজ করেছিল, সেগুলি হলো (১) ১৯২৭এ রেডিও বা বেতার ব্যবস্থার সূচনা (২) ১৯৩২এ বাংলা চলচ্চিত্রের সবাক হওয়া আর (৩) চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রগানের সফল প্রয়োগ শুরু হওয়া, আর (৪) বাংলা গানের জগতে নজরুল ইসলামের আবির্ভাব।

গান বাঙালির প্রাণের জিনিস হয়ে ওঠায় বাংলা গানের চাহিদা বাড়লো, ১৯২৪এর ২৬শে অগস্ট বেসরকারী উদ্যোগে পত্তন হলো কলকাতা বেতার কেন্দ্রের। ১৯২০র দশকেই উঠে এলেন অনেক শিল্পী – কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, শচিন দেববর্মন, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সন্তান শচিন দেববর্মন রেডিওতে প্রথম গান গাইলেন ১৯২৫এ, পঙ্কজ কুমার মল্লিক ১০২৭এ। 

পঙ্কজকুমার মল্লিকের কন্ঠে ছিল গান, কিন্তু পিতার নির্দেশে পাটের দালালির ব্যবসায়ে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯২৭এর এক বর্ষামুখর সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এক ডাক্তারবাবুর ডিসপেন্সারির রোয়াকে। সেখান দাঁড়িয়েই রবীন্দ্রনাথের গানের দুটো কলি গুনগুন করে গাইছিলেন – ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়...’। ভেতর থেকে দক্ষিণ ভারতীয় ডাক্তারবাবু ডেকে নিলেন তাঁকে, বললেন ভেতরে এসে গানটা একটু শোনান তো, ভারি সুন্দর গাইছিলেন। সেই দক্ষিণ ভারতীয় ডাক্তারবাবুর নাম ডাঃ রামস্বামী আয়েঙ্গার। গান শোনার পর ডাঃ আয়েঙ্গার বাইশ বছরের সেই যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি রেডিওতে গান করতে চাও? ওখানে আমার জানাশোনা আছে। পঙ্কজকুমার হাতে চাঁদ পেলেন, সম্মতি জানালেন। তখন সবেমাত্র বেসরকারী ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন গঠিত হয়ে বেতার প্রচার শুরু করেছে। ১৯২৭এর ২৬শে সেপ্টেম্বর বাইশ বছরের সেই যুবক রেডিওতে গাইলেন রবীন্দ্রনাথের দুটি গান ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ ও ‘একদা তুমি প্রিয়ে’। তারপর সময়ের স্রোতে সেদিনের পাটের দালালি আর গানের টিউশানি করা সেই যুবক আপন সাধনা ও নিষ্ঠায় হয়ে গেলেন ভারতীয় সঙ্গীত জগতের লিজেন্ড পঙ্কজকুমার মল্লিক। ত্রিপুরার রাজপরিবারের সন্তান শচিনদেব গানকে ভালোবেসে রাজপরিবারের বিলাস ত্যাগ করে গানকেই বেছে নিলেন তাঁর পথচলার ছন্দ হিসাবে। আধুনিক বাংলা গানের গায়কীর অনেকটাই যেন ঠিক করে দিলেন শচিনদেব। বাংলা গানের জগতে শচিনদেবের গৌরবময় প্রতিষ্ঠা এবং আধুনিক বাংলা গানের মোড় ঘুরিয়ে দেবার ঘটনায় আরও দু'জন মানুষের কথা একই সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে আছে – তাঁরা হলেন শচিনদেবের কুমিল্লার সাথী সুরসাগর হিমাংশু দত্ত ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য। 

১৯৩০ থেকে ৪০এর মধ্যে বাংলা গানের জগতে উঠে এলেন অনেক কালজয়ী কন্ঠশিল্পী, সুরকার ও গীতিকার। কুন্দনলাল সায়গল, কানন দেবী, কাশেম মল্লিক। আব্বাসউদ্দীন আহমেদ, যুথিকা রায়। জগন্ময় মিত্র, গৌরিকেদার ভট্টাচার্য, সত্য চৌধুরী, সুধীরলাল চক্রবর্তী, বেচু দত্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, জ্ঞাণেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী, মৃণালকান্তি ঘোষ, অপরেশ লাহিড়ী, সুপ্রীতি ঘোষ, সুপ্রভা সরকার, দিপালী নাগ, তারাপদ চক্রবর্তী, কমল দাশগুপ্ত, সলিল চৌধুরী, প্রমুখ। বাংলা গানের জগৎ যেন চাঁদের হাট। ১৯৪০এর পর তিনটি দশক তো বাংলা গানের সোনার দিন, গান শোনার দিনও।

বাংলা গানের সোনার দিন রচনায় বানিজ্যিক স্বার্থে গ্রামফোন কম্পানির পৃষ্ঠপোষকতা যেমন ছিল তেমনই ছিল বাংলা ছায়াছবির অবদান। ১৯৩২এ বাংলা চলচ্চিত্র কথা বলতে শুরু করলো; চলচ্চিত্র সবাক হওয়ার ফলে বাংলা গানের অন্য এক দিগন্তের উন্মোচন হলো। বাংলা গানের চাহিদা বেড়ে গেল, উঠে এলেন অনেক নতুন কন্ঠশিল্পী, সুরকার ও গীতিকার। গান বাঙালির প্রাণের জিনিস বলেই পুরনো দিনের থিয়েটারের মতো ছায়াছবিতেও একাধিক গান রাখতে হতো। অনেক দুর্বল কাহিনী ও অভিনয় সম্বলিত সিনেমাও শুধুমাত্র ভালো গানের জন্যই দর্শক আনুকুল্য পেত, প্রযোজক টাকা ফেরৎ পেতেন। গানের জন্যই সঙ্গীতপ্রধান সিনেমা নির্মাণেরও প্রবণতা এসেছিল। জয়দেব, বিদ্যাপতি, যদুভট্ট, ঢুলি, কবি, বসন্তবাহার, শাপমোচন – এইসব সিনেমার কথা কার না মনে আছে! তখনও টেপ রেকর্ডার বা ক্যাসেটের উৎপাত শুরু হয়নি, গ্রামফোনই বা কত মানুষের ঘরে থাকতো! গান শোনা মানে সপ্তাহে একদিন দুপুরে বেতারে অনুরোধের আসর আর পাড়ার জলসায় নামি শিল্পীদের স্বকন্ঠের গান। সুতরাং সাড়ে পাঁচ আনার টিকিট কেটে প্রাক্ষাগৃহে বসে গান শোনা মন্দ কি! বস্তুত বাংলা গানের স্বর্ণসময় রচনায় বোধকরি সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছিল সিনেমার গান।

উল্লেখ করেছি যে গত শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকটা ছিল বাংলা গানের স্বর্ণসময়ের প্রস্তুতি পর্ব। নানান ধারার বাংলা গানের বৈচিত্রপূর্ণ সমাবেশ এই সময়কালে। সুতরাং বাংলা গানের এক অলিখিত শ্রেণীবিভাগ বা বর্গীকরণ চালু হয়ে গেল। ‘বাউল’, ‘কীর্তন’, বিভিন্ন লোক আঙ্গিকের গান কিংবা ‘শামা সঙ্গীত’ বা ‘ভক্তিগীতি’ না হয় পৃথকভাবে চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু ‘আধুনিক বাংলা গান’ ও ‘রাগপ্রধান’ বড়ই বোকা বোকা বিভাজন যা অনেক প্রশ্ন রাখে। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের গানে (শেষের গানগুলি ছিল তোমারই লাগি’, ‘ফুলের দিন হলো অবসান’, ইত্যাদি) আধুনিক কাব্যের লাবণ্য পাই, তাহলে তাঁর গান আধুনিক নয় কেন ? ত্রমনই শচিনদেবের ‘আমি ছিনু একা বাসর জাগায়ে’ রাগপ্রধান নয় কেন? ‘বেগম আখতারের জ্যোছনা করেছে আড়ি’ রাগপ্রধান হলে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর ‘ঝনন ঝনন বাজে’ রাগপ্রধান না হয়ে আধুনিক কেন? জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী গীত ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা’ কোন শ্রেণীতে রাখবো – শ্যামা সঙ্গীত, রাগপ্রধান না নজরুল গীতি? এমনই হাজারো প্রশ্নের জন্ম দেয় এই অর্বাচীন বিভাজন। এই বিভাজনে রবীন্দ্রনাথ, অতুল প্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্তর গানও আধুনিক বাংলা গানের তকমা পায়নি। অথচ রবীন্দ্রনাথই বাংলা গানের মুক্তিদাতা, বাংলা গান আধুনিক হলো তাঁরই ছোঁয়ায়। ১৯৩০এ বেতার ব্যবস্থার শৈশবে ‘আধুনিক বাংলা গান’ কথাটা চালু করে ঢাকা বেতার কেন্দ্র। তার পর থেকে কলকাতা বেতারেও এই শ্রেণিভাগ চলে আসছে। ১৯৫০/৫২ নাগাদ আধুনিক গানের আর একটা শ্রেণি বিভাগ করে। তাদের নিজস্ব প্রযুক্তি ও স্টুডিওতে বেশ কিছু বাংলা গান রেকর্ড করেন যেগুলিকে বলতো ‘রম্যগীতি’ এবং সম্প্রসারিত হতো কলকাতা বেতারে ‘রম্যগীতির আসর’ নামে দুপুর ৩টা নাগাদ। স্মৃতি যতদূর যায়, মনে হয় বেতারে এই রম্যগীতির আসরটি সঞ্চালনা করতেন দীপালী নাগ।

কাব্যের লাবণ্যই বাংলা গানের আশ্রয়। অজয় ভট্টাচার্য, কমল দাশপ্ত, সলিল চৌধুরী, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আধুনিক কাব্য-মাধুর্যমাখা গান তো আছেই, তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান বাঙালির সঙ্গীত ভাণ্ডারের চিরকালীন গর্বের উপাদান হয়ে আছে। এবং নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথের পরে যার কাছে বাংলা গানের ঋণ সবচেয়ে বেশি। রবীন্দ্রগানের ঐশ্বর্যে বাঙালি মজেছিল তাঁর মৃত্যুর অনেক পর থেকে। তাঁর গানে মজে যেতে বাঙ্গালির এত দেরি হলো কেন, তা এক চিরকালীন ধন্দ। বাঙালি যখন থেকে রবীন্দ্রগানে মজে যেতে শুরু করলো তার অনেক আগেই নজরুলের কলম ও কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেছে। ১৯২৮ বাংলা গানের তখনও অপরিণত ভুবন, নজরুল পাকাপাকিভাবে এলেন গানের জগতে। অর্থের প্রয়োজনে গ্রামফোন কম্পানির মাসমাইনের চাকুরি নিতে হয়েছিল। ১৯৩৩এ প্রকাশিত ‘রুবাইত-ই-উমর খৈয়াম গ্রন্থের ভূমিকায় নজরুল লিখলেন “কাব্যলোকের গুলিস্তান থেকে সঙ্গীতলোকের রাগিনী দ্বীপে আমার দ্বীপান্তর হয়ে গেছে”। বাংলা গানে নজরুলের অবদান বিস্ময়কর। তাঁর গীত রচনার সংখ্যা প্রায় চার হাজার, তার মধ্যে রেকর্ড হয়েছে ১৭০০ গান। গানের সবক’টি শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল, গীত রচনা, সুর সংযোজন, গায়ন ও গায়নশৈলী নির্মাণ, ইসলামি গান, গজল (বাংলায় গজল গানের তিনিই প্রবর্তক) হাসির গান, শ্যামা সঙ্গীত, থিয়েটার ও সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনা, (এমনকি একটি চলচ্চিত্রে অভিনয়) সব। অথচ নজরুলের সক্রিয় সাঙ্গীতিক জীবন মাত্র ১৪ বছরের। 

শৈশবে পিতৃ-মাতৃহীন নজরুলের সঙ্গীত শিক্ষার সূত্রগুলি, তাঁর সাঙ্গীতিক জীবন গড়ে ওঠার কিছুই জানা যায় না। সঙ্গীতের প্রথাগত শিক্ষা অর্জন করার কোনও সুযোগ নজরুল পাননি। লেটোর দলে ঘুরে বেড়ানো এবং শৈশব-কৈশোরের বাউন্ডুলে জীবনে বাংলার লোক আঙ্গিকের বিভিন্ন ধারার গান বাউল, ঝুমুর, পাঁচালী গান, টপ্পা ইত্যাদির সুর আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন, তার সব কিছুই বাংলা গানের ভুবনে উজাড় করে দিয়েছিলেন নিজেকে নিংড়ে দিয়ে।

নজরুলের গানের ভুবন ছিল স্বতস্ফূর্ততায় ভরপুর। পেটের দায়ে কাব্যলোক থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে গ্রামফোন কম্পানির দাসত্ব নেওয়ার জন্য তাঁর নিজের যন্ত্রণা বড় কম ছিল না। কবি বন্ধুদের অনেকেই তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন। এই সময় রবীন্দ্রনাথকে এক পত্রে নজরুল লিখেছিলেন “গুরুদেব, বহুদিন আপনার শ্রীচরণ দর্শন করিনি। আমার ওপর থেকে হয়তো প্রসন্ন কাব্যলক্ষ্মী হিজ মাষ্টার্স ভয়েসের কুকুরের ভয়ে আমায় ত্যাগ করেছেন। সুতরাং সাহিত্যের আসর থেকে আমি প্রায় স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিয়েছি। ... আমার এক নির্ভিক বন্ধু আমাকে উল্লেখ করে একদিন বলেছিল ‘যাকে বিলিতি কুকুর কামড়েছে তাকে আমাদের মাঝে নিতে ভয় হয়। সত্যি, ভয় হবারই কথা। তবু কুকুরে কামড়ালে লোকে নাকি ক্ষিপ্ত হয়ে অন্যকে কামড়াবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আমার কিন্তু সে শক্তি নেই, আমি হয়ে গেছি বীষ জর্জরিত নির্জিব”। সূত্র – অরুণ কুমার বসু / ‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’, পুরশ্রী পত্রিকা, জুলাই ১৯৯৯)। তবু নজরুল তাঁর ভেতরের বিষ জর্জরতার কোনও প্রভাব তার সঙ্গীত সৃজনে পড়তে দেননি। কন্ঠ স্তব্ধ হবার আগে, শেষের দিকে অর্থকষ্ট, পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্ত্রীর চিকিৎসার অর্থ জোগাড় করতে না পারার গ্লানি তাঁর অনাবিল ঝর্ণা ধারার মতো সঙ্গীত সৃজনে পড়তে দেননি বিন্দুমাত্র। ভিতরে ক্ষয় ধরলেও বাইরে তা প্রকাশ করেননি। বাংলা সঙ্গীত সৃজনের নিজস্বতায় রবীন্দ্রনাথের অবদান যতটা, ততটাই কাজী নজরুলেরও।

সঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রে ও সৃজন বৈচিত্রে রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি না থাকলেও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন ও রজনীকান্ত সেনের গানও বাংলা কাব্যসঙ্গীতের ভাণ্ডারের অক্ষয় সম্পদ হয়ে আছে। পরিতাপের কথা, এঁদের সুর রচনার সংরক্ষণে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ছিল না। আমাদের দুর্ভাগ্য দ্বিজেন্দ্রলাল ও রজনীকান্তর ৭৫ ভাগ গানেরই কোনও স্বরলিপি সংরক্ষিত হয়নি। তুলনায় অতুলপ্রসাদের গান অনেক বেশি গীত হয়েছে মূলত ব্রাহ্মসমাজের পৃষ্ঠপোষকতায়। দ্বিজেন্দ্রলালে গানের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক, যার অধিকাংশের সুরই সংরক্ষিত হয়নি, গায়কীও জানা যায় না। পত্নীর অকাল-প্রয়াণ, জীবিকার সঙ্গে তাঁর শিল্পসাধনার বিরোধ এবং সর্বোপরি পুত্র দিলীপকুমার যৌবনেই সাংসারিক জীবনের অন্তরালে চলে যাওয়া, বাংলা সঙ্গীতের ভাণ্ডারে তাঁর অসাধারণ সঙ্গীত সৃজনের সিংহ ভাগই সঞ্চিত হতে দেয়নি। রজনীকান্ত শুধু সঙ্গীত রচনাই করেননি, তিনি নিজে ছিলেন সুকন্ঠ গায়ক। তাঁর সঙ্গীতিক প্রতিভার সামান্যই সঞ্চিত আছে বাংলার সঙ্গীতভাণ্ডারে, রজনীকান্ত উকিল ছিলেন কিন্তু সফল ছিলেন না। আর্থিক অসাচ্ছল্য ছিল তার নিত্য সঙ্গী। তার ওপর দুরারোগ্য কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন মাত্র ৪৫ বছরের জীবনের শেষ একটা বছর, কথাও বলতে পারতেন না। বাংলায় ঠুংরি আঙ্গিকের সঙ্গীত রচনার প্রবর্তক অতুলপ্রসাদ সেনের দাম্পত্যজীবন সুখের ছিল না, যা তাঁর সঙ্গীত রচনায় প্রভাব ফেলেছিল। আজও, সেই সব সঙ্গীত রচনার শতাধিক বর্ষ পরেও যদি কারও কন্ঠে বা কোনও গৃহ থেকে ভেসে আসে ‘তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে (রজনীকান্ত), কে তুমি বসি নদীকূলে একেলা’ (অতুলপ্রসাদ) কিংবা বঙ্গ আমার জননী আমার’ গানগুলি ভেসে আসে তখন আমাদের থমকে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। 

গত শতকের চল্লিশের দশকে গণনাট্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আর একটি সঙ্গীত-ধারা সমৃদ্ধ করেছিল বাংলা কাব্যসঙ্গীতের স্বর্ণ সময়ে, তার পোষাকি নাম ‘গণসঙ্গীত’। কোন গান গণসঙ্গীত, কোনটা নয় -এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। প্রয়াত সলিল চৌধুরীর কথায় “শ্রমজীবি মানুষের আশা-আকাঙ্খ্যার ইতিহাস হলো গণসঙ্গীত”। হেমাঙ্গ বিশ্বাস স্পষ্ট করেছিলেন এভাবে –“স্বাদেশিকতার ধারা সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার সাগরে গিয়ে মিশেছে সেই মোহনায় গণসংগীতের জন্ম”। আবার কেউ বলেন ‘গণসঙ্গীত শুধুমাত্র সংগীতের একটি প্রবল ধারা নয়, গণসংগীত ধরে রাখে ইতিহাসের এক বিশেষ প্রতিবাদী পর্যায়’। গত শতকের চল্লিশ থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত সময়কালের বাংলা গানে অবশ্যই একটা নতুনতর মাত্রা যোগ করেছিল এই ধারার গান। সেই সময়কালে গুরুদাস পাল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নিবারণ পণ্ডিত, সলিল চৌধুরী, রমেশ শীল, দিলীপ সেনগুপ্ত প্রমুখ বাংলা গানের ভাণ্ডারে অনেক মণিমুক্ত রেখে গেছেন। সহজবোধ্য কারণেই গ্রামফোন কম্পানী এই ধারার গানকে বিপননযোগ্য মনে করেনি। স্মরণে আছে, ১৯৪৮ সালে গণনাট্য সঙ্ঘের সমবেত সঙ্ঘসঙ্গীত ‘এসো মুক্ত করো’ কলম্বিয়া লেবেলে রেকর্ড করেছিল। শুরুর পর্বে দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, প্রমুখ যশস্বী শিল্পীরা গণনাট্য সঙ্ঘের মঞ্চে সামিল হয়েছিলেন। চল্লিশের দশকটা ছিল এক উত্তাল সময়কাল, মানবতাধ্বংসি ফ্যাসিবাদের উত্থান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মন্বন্তরে নিরন্ন মানুষের হাহাকার, সেই সময়টা সাহিত্যে – কবিতা গান নাটকেরও মহাজাগরণকাল। ১০৪৬র ডাক ও তার ধর্মঘটের প্রেক্ষিতে সলিল চৌধুরীর অসামান্য সঙ্গীত সৃজন ‘রাণার’, যেটি পরে গ্রামফোন রেকর্ডে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন। এই গানটি শোনেননি এমন বাঙালি সম্ভবত এমন কেউ এই প্রজন্মেও নেই। ১৯৪৮ সলিল চৌধুরীর কালজয়ী সঙ্গীতসৃজন ‘কোন এক গাঁয়ের বধু’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর কবিতার সঙ্গীতায়ন ‘পালকীর গান’, তারপর একেরপর এক সলিল - হেমন্তর যুগলবন্দী ‘ধান কাটার গান’, ‘নৌকা বাওয়ার গান’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘ঠিকানা’, হেমন্ত-লতার দ্বৈত কন্ঠে ‘দে দোল দোল’, বাদল কালো ঘিরলো গো’, সুবীর সেনের ‘ঐ উজ্জ্বল দিন’ এই সব গান গণসঙ্গীতের তকমা না নিয়েও লোকের মুখে মুখে ফিরেছে। বাংলায় গণসংগীত পুষ্ট হয়েছে সমাজ বদল ভাবনার ঐতিহাসিক প্রয়োজনে। গণসংগীত তার নিজস্ব শক্তিতে এখনও মানুষকে আন্দোলিত করে, পীড়িত মানুষের বেদনার কেন্দ্রে হাত রাখে, যুথবদ্ধ মানুষের আপন গান হয়ে ওঠে। গুরুদাস পাল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, ভুপেন হাজারিকা থেকে রুমা গুহ ঠাকুরতা, সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কয়ার গান কিংবা একালের কল্যাণ সেন বরাটের বৃন্দগান, কিংবা প্রয়াত নরেন মুখোপাধ্যায়, শুভেন্দু মাইতি, কঙ্কণ ভট্টাচার্য, প্রমুখের গান গণসঙ্গীত ধারাকেই পরিপুষ্ট করেছে। এইসব গানকে গণসঙ্গীত বলি আর না বলি, মানুষ যে গানে তার প্রাণের ভাষা আর সুর খুঁজে পায়, যে গান তার সংগ্রামী চেতনাকে স্পর্শ করে তাইই গণসঙ্গীত। 

আমি সঙ্গীত-বেত্তা নই, গায়কও নই। শুধু দুটি কানের ভরসায় বিগত সত্তর বছরের গান শোনা আর গানকে ভালোবাসার সূত্রে গত শতকের চল্লিশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত বাংল গানের নানান পর্যায় নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণটিই প্রস্তুত করলাম, তার বেশি কিছু নয়। মোটামুটি মধ্য আশি পর্যন্ত চল্লিশটা বছর বাংলা গানের এই চালচিত্রটিই বজায় ছিল। এর পরের কথা বারান্তরে গানের একাল – গানের আকাল’।


5 comments:

4

বইঘর - কস্তুরী সেন

Posted in


বইঘর


জয় গোস্বামী : নিজস্ব পাঠ
কস্তুরী সেন



--গদ্য? অসম্ভব!
--কারণ? জানা যায়?
--কারণ আমি কবিতার। কারণ আমি আদতে ধৈর্যহীন। কারণ গদ্যরচনায় মনঃসংযোগের একটা বড় ভূমিকা থাকে।
--মন ও সংযোগ, বেশ,(সামান্য বিশদ হন প্রতিপক্ষ এইবার)...এ দুটোকে যদি মেলানো যায়?
--অর্থাৎ?
--অর্থাৎ জয় গোস্বামী। ব্যক্তিগত জয়?

কাট টু উনিশশো সাতানব্বই, বা আটানব্বই। অর্থাৎ ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্য। নবম নয়, তবে অষ্টম শ্রেণি, কিংবা সপ্তম, এবং একটি পাড়ার পুজোর নাটকের রিহার্সাল রুম, ভিতরে কেউ জোরে জোরে পড়ে যাচ্ছে কবিতা। সামান্য কটি লাইন।

'পাগলী, তোমার সঙ্গে বই দেখব প্যারামাউন্ট হলে
মাঝে মাঝে মুখ বদলে য়্যাকাডেমি, রবীন্দ্রসদন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নাইট্যশালা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে কলাকেন্দ্র কাটাব জীবন!'

অর্থাৎ? নাইট্যশালা জীবন? কীভাবে? কীভাবে! এবং সেই অষ্টম শ্রেণি মন্ত্রমুগ্ধের মতো পা মুড়ে বসে পড়ছে ঘরে ঢুকে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে পড়ছে লাইনগুলির সামনে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো, নতজানু, বলা চলে এইবার তার পাঠকজন্মের নিয়ন্তার মুখোমুখি হচ্ছে সে, আগামীর সমস্ত দিনগুলি, প্রায় তার অদ্যাবধি জীবন, সে উৎসর্গ করছে, প্রায় বলিপ্রদত্ত হতেই, এক কবির হাতে। জয় গোস্বামীর হাতে।

জয় গোস্বামীর সঙ্গে, সেই আমার প্রথম সাক্ষাৎ। এবং সেই সময়ে, তার পূর্ববর্তী, পরবর্তী বহু মানুষের মতোই, আমরা অনেকেই, সাক্ষাৎমাত্রেই জয়কে চিনতে পেরেছিলাম। আমাদের সৌভাগ্য। জয়, অন্তত তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মৃদুতার সঙ্গে হলেও, আলাপ, জোড়, ঝালা, সবটা সমেত তাঁর নিজস্ব পাঠকবৃত্তের সামনে, মুহূর্তেই উদ্ভাসিত হন। বিষয়টা অনেকটা এই যে, জয়ের সঙ্গে প্রতিটি প্রেমই, পাঠকের, ঘটে প্রথম সাক্ষাৎমাত্র। জয় গোস্বামী, যদি সত্যিই তাঁকে আমার ব্যক্তি অভিজ্ঞতায় ধরি, তবে তিনি সময় দেওয়ার লোক নন। তাঁর চর্চা সম্ভব না। তাঁর চর্বিতচর্বণ সম্ভব না, তাঁর কবিতাগুলির সমালোচনা প'ড়ে, তাঁকে দিনানুদৈনিক অভ্যাস করে, ধীরে ধীরে, ধীরে ধীরে তাঁর প্রতি আগ্রহ জন্মে ওঠার মতো কবি তিনি নন। না জয় সঞ্জয় ভট্টাচার্য নন, জয় বিনয় মজুমদার নন, বিষ্ণু দে? প্রশ্নই নেই, সমর সেন, সুধীন্দ্রনাথ, এই অংশটাতেই তাঁকে ধরা সম্ভব না। সম্ভব না প্রতিভা বা ক্ষমতার অর্থে আদৌ নয়, তুলনা সম্ভব নয় তার আদত কারণ ওই একই, জয় সময় দেন না। জয়ের কবিতার মধ্যে একটা সর্বগ্রাসী বিষয় থাকে, থেকেছে বরাবর, পাঠক মুহূর্তমাত্রে সর্বস্ব সমর্পণ করেন, এবং যাঁর হলো না তাঁর হলো না, জয় গোস্বামী সে পাঠকের নন।

তবে জয় কোন্ পাঠকের? বেশ, এটা ভালো প্রশ্ন। জয় গোস্বামী লিখছেন সত্তরের দশক থেকে। প্রথম কবিতার বই, 'ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ'-র প্রকাশকাল ১৯৭৬। কবিতাসংখ্যা আট। দ্বিতীয় 'প্রত্নজীব'(১৯৭৮), তৃতীয় 'আলেয়া হ্রদ'(১৯৮১) পার হয়ে 'উন্মাদের পাঠক্রম'-এ(১৯৮৬) এসে আস্তে আস্তে জয় যখন নিজের 'ফোর্টে' তৈরি করছেন, তখন, সেই আটের দশক, নয়ের দশক জুড়ে আমরা জানিই, সত্তরের উত্তাল রাজনীতির পর, খানিক মোক্ষণের সময় এসেছে। খানিক স্থিরতা, খানিক নিস্তরঙ্গতা, সামান্য দম নেবার সময়, একে অন্যের মুখের দিকে তাকানোরও কি নয়? কাছাকাছি সময়ে, এতদিনকার জমে থাকা গুমোট মুহূর্তে তছনছ করে দিতে, প্রায় বলতে গেলে হাত ধরে বাংলা সংস্কৃতিকে একটা অন্য পর্বের মুখোমুখি করে দিতে, তীরের বেগে দিগন্তের দখল নিচ্ছেন গিটার কাঁধে অপর একজন, কলকাতা কাঁপছে, জেলা-মফস্বল কাঁপছে তাঁর 'তোমাকে চাই'-এর, 'প্রিয়তমা, তোমাকে অভিবাদন'-এর অভিঘাতে। বাংলা কবিতা, বাংলা গান তার দিক বদলাচ্ছে। জয় এই দিক বদলেরই কবি। জয়, তাঁর রানাঘাটবাসের প্রেক্ষাপট সমেত, তাঁর সামান্য অগেরস্ত, সুরপাগল 'মধুবাবু' পিতার প্রভাবে (যাঁকে আমরা পরবর্তীতে অজস্রবার পড়ব, কবির স্কুলশিক্ষয়িত্রী মা'কে ও, রানাঘাট লোকাল কি গোঁসাইবাগানে) নিজস্ব একটি গানের, গান শোনার প্রেক্ষাপট সমেত, একটি আক্ষরিক অর্থে সমকালীন মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের প্রেক্ষাপট সমেত, তাঁর সমস্ত অসাধারণ সাধারণত্ব সমেত এসে দাঁড়াচ্ছেন এই সময়টি সামনে, বলছেন--

'তোমাকে নিশ্চয়ই আমি পুত্ররূপে চাইতাম ঠাকুর,
কিন্তু তুমি এই জন্মে কোথাকার কোন এক মেয়ে হয়ে এসে
যেভাবে আমার মন কেড়েছো, তুলনা হয় না তার।
আজ পুনঃ পুনঃ মরি ওই হাতে, পরিচর্যা করো মৃত্যুখানি....' (মহৎ)

পাঠকের কাছে বিকল্প কী? চন্দ্রাহত হওয়া ছাড়া? জয় এই চন্দ্রাহত পাঠকের কবি। যাঁরা জয় গোস্বামীকে আদ্যন্ত রোমান্স ছাড়া আর কোনওকিছু বলে মানতে চাইবেন না, যাঁরা তাঁকে, সমসময় থেকে বিযুক্ত বলে অভিযুক্ত করবেন প্রায়শই, না 'শাসকের প্রতি', 'নন্দর মা', 'সোজা কথা' তাঁদের উত্তর নয়। বরং যদি শিরোনামে ফিরে গিয়ে ব্যক্তি অভিজ্ঞতাই বলতে হয় আবারও, আমি বহুদূর একমত হব এই দ্বিতীয় অংশের পাঠকের সঙ্গেই, যাঁরা রোমান্স বলছেন। জয় রোমান্সধর্মিতার প্রধান শর্ত, অর্থাৎ মর্মবিদারণ, মর্মে মর্মে মেনে চলেছেন তাঁর প্রতিটি আঙ্গিকের, প্রতিটি বিষয়ের কবিতায়। এসব পঙক্তিই দেখা যাচ্ছে তার সার্থক উদাহরণ--

'খানিকটা নাম বেড়ায় আটকে গেল
খানিকটা গোঁজা রইল খড়ের বাতায়
খানিকটা নাম কাঁটাতারে তারে বেঁধা,
খানিকটা যায় ইমিগ্রেশন খাতায়।
একটা বয়েস সে দেশে ছেড়ে এলাম,
একটা বয়েস নিয়ে ছেড়ে দিল স্বামী
একটা বয়েস ছেলে বড় করে শেষ
ছেলের নামেই আজ চেনা দি এই আমি-
......................................................
ছেলেকে ভাবিনা,
ভাবিনা স্বামীর-ও নাম
শুধু মনে পড়ে আমরা যাচ্ছিলাম 
সেই কোন দেশে পালিয়ে যাচ্ছিলাম!'
                                                    (নন্দর মা)

বিনাশর্তে। বিনাপ্রশ্নে। মর্মবিদারণ। নয় কেন রোমান্স। এবং কি সার্থক রোমান্স।

ব্যক্তিগত জয় গোস্বামী নতজানু করবেনই। এক্ষেত্রে বলা সামান্য ভুল হলো 'ব্যক্তিগত' শব্দটি। জয় আসলে একটা সময়কে নতজানু করেছেন, মোহিত করেছেন, অস্ত্রত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন তাঁর কবিতাগুলির সামনে। বিশেষ শ্রেণি, মনন ও মেধার যে অনুশীলিত গণ্ডি, তা থেকে মুক্ত করে, সেভাবে দেখতে গেলে জয়ই প্রথম বাংলা আধুনিক কবিতাকে এনে দাঁড় করিয়েছেন সাধারণ মানুষের চৌহদ্দিতে। যে সাধারণ মানুষ ছেলে পড়ায়, নিজের না মেটা সাধের ভার তর্কাতীতভাবে চাপিয়ে দেয় সন্তানের মাথায়--

'তোমাকে পেতেই হবে শতকরা অন্তত নব্বই(বা নব্বইয়ের বেশি)
তোমাকে হতেই হবে একদম প্রথম,
তার বদলে মাত্র পঁচাশি!
পাঁচটা নম্বর কম কেন? কেন কম?
এইজন্য আমি রোজ মুখে রক্ত তুলে খেটে আসি?'
                                                                (টিউটোরিয়াল)

ঘরে ঘরে যে সাধারণ মেয়েটি ভুলতে পারে না নিজের বাধ্য হয়ে ছেড়ে আসা সংসার, বাধ্য হয়ে ছেড়ে আসা মানুষ--

'কে তাহলে ভাত বেড়ে দেয়?
কে ডেকে দেয় সকাল সকাল?
রাত্তিরে কে দরজা খোলে?
ঝক্কি পোহায় হাজাররকম?
কার বিছানায় ঘুমোয় তবে?
কার গায়ে হাত তোলে এখন
কার গায়ে হাত তোলে এখন?'
                                        (প্রাক্তন)

অথবা সত্যিই জনস্রোত স্তব্ধ করে দেওয়া তাঁর অবিনশ্বর, প্রেমের পঙক্তিগুলি--

'মা আমার এক দীঘি জল
সারা গ্রাম করে ছলোচ্ছল....
   "পোড়ামুখী, দু চক্ষের বিষ
    ফের তুই প্রেমে পড়েছিস"?'
                                 (মা আর মেয়েটি)

'ফার্স্ট পার্সন'-এ ঋতুপর্ণ লিখেছিলেন--'এ-ও জানিনা, আজ থেকে অনেক বছর পর, 'স্ত্রী'র পত্র'র মাখন বড়াল লেনের মতো, মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়ও বাংলা সাহিত্যে উইমেন স্টাডিজের একটি নতুন উৎসমুখ হয়ে উঠবে কি না!'---আমরা কি সামান্য বেশি জোর দিয়ে বলব, বিশেষ কোনও কবিতা নয়, 'বেণীমাধব বেণীমাধব'-এর কবি স্বয়ংই বাংলা কবিতার একটি নতুন স্রোতপথের উদ্ভাবকের আসনটি অধিকার করে নেবেন উত্তরযুগের কাছ থেকে?... উত্তর, জানেন প্রায় সকলেই। সর্বাধিক জানে, জয় গোস্বামীরই কবিতা---

'অনেক পরিবারের মধ্যে মিলিয়ে গেছে আমার পরিবার
পাঠক, আমি তোমার পায়ের কাছে বসে পড়লাম।
আমার কিছু বলবার নেই আর.....'
                  (অনেক : আমরা সেই চারজন)
                   দেশ পত্রিকা, নভেম্বর,২০১৬।

4 comments:

2

প্রাচীন কথা - সুষমা ব্যানার্জী

Posted in


প্রাচীন কথা


লক্ষ্মণ-চরিত
সুষমা ব্যানার্জী


একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস লক্ষ্মণের বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া নির্গত হইল। সরযূতীরে সূর্য অস্ত যাইতেছে। গোধুলিবেলায় পক্ষীকুল আপন নীড়ে ফিরিতে অকারণ কলকাকলি করিতেছে। চারিপাশে জনমানবের চিহ্নমাত্র নাই। দু’একটি গোবৎস মাতার সন্ধানে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল, মাতার আহবান পাইবামাত্র ছুটিয়া আলয়ে ফিরিল। লক্ষ্মণের অশ্রু বাঁধ মানিল না। আজ তাঁহার ফিরিবার স্থান নাই। তাঁহার একমাত্র আশ্রয় আজ তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়াছেন। তাঁহার বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নাই অগ্রজের প্রতি। ধর্মপ্রাণ শ্রীরামচন্দ্রের প্রতি রাগ বা অভিমান তাঁহার স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু অপরিসীম যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হইতেছে তাঁহার হৃদয়। এ কেমন ধর্ম যাহা কায়া হইতে ছায়া পৃথক করিয়া দেয়? এ সংশয় মনে উঠিবামাত্র নিজের মনকে ধিক্কৃত করিলেন লক্ষ্মণ। দেবতার প্রতি সংশয়! ইহা অপেক্ষা মৃত্যুও বুঝি কাম্য। আর বিলম্বে কাজ নাই। আচমন করিয়া সরযূ তীরে যোগমগ্ন হইলেন তিনি। 

"সৌমিত্রি, তোমাকে বিসর্জন দিলাম।"
কে বলিল একথা? আপন কর্ণকে অবিশ্বাস করিতে চাহিলেন তিনি। রামের পক্ষে লক্ষ্মণ বর্জন? ইহা যে অতি অসম্ভব ঘটনা। অতঃপর যাহা শুনিলেন তাহা কি সত্যই রামচন্দ্রের মুখনিঃসৃত বাণী? 

"প্রিয়জন কর্তৃক ত্যাগ বা মৃত্যু, সাধুদের পক্ষে দুই সমান" -কেন বারংবার কথাগুলি কানে বাজিতেছে? কেন মনঃসংযোগ করিতে পারিতেছেন না? অগ্রজ কি পরোক্ষে মৃত্যুকে বরণ করিতে বলিলেন? এমন মৃত্যুই কি কাম্য ছিল? সারা জীবন রামচন্দ্রের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়াছেন, মৃতুও কি তাঁহারই ইচ্ছাধীন? 

আবার সংশয়! কেন বারংবার মন বিরোধিতা করিতেছে? তবে কি রামচন্দ্রকে সম্পূর্ণরূপে দেহে মনে সমর্পণ করেন নাই তিনি? পুনরায় আচমন করিয়া ধ্যানমগ্ন হইলেন। 

কিন্তু দেবদর্শনের পরিবর্তে কী দেখিতেছেন রামানুজ? চোখের সামনে দৃশ্যগুলি ভাসিয়া যাইতেছে যেন.... 

মহর্ষি বিশ্বামিত্র রাজদর্শনে আসিয়াছেন। দুই কামরূপী শক্তিশালী রাক্ষস মারীচ এবং সুবাহু নানাবিধ বিঘ্ন সৃষ্টি করিয়া যজ্ঞ বিনষ্ট করিতেছে বারংবার। মহামুনি বিশ্বামিত্র তাই রামচন্দ্রকে লইয়া যাইবেন রাক্ষসদের বিনাশ করিবার নিমিত্ত। কিন্তু, লক্ষ্মণ কেমন করিয়া রামচন্দ্রকে একাকী ছাড়িয়া দিতে পারেন? সঙ্গী হইলেন অগ্রজের। দুষ্টচারিণী তাড়কাকে বধ করিবার পর মুনিশ্রেষ্ঠ বিশ্বামিত্র পরিতুষ্ট হইয়া রামচন্দ্রকে যখন অদ্ভুত শক্তিশালী দিব্যাস্ত্রসমূহ দান করিলেন, সেই সময় অগ্রজের প্রাপ্তিকে আপন প্রাপ্তি বলিয়া মানিয়াই অনাবিল আনন্দিত হইয়াছিলেন। আজ, এত বছর অতিক্রান্ত হইবার পর কেবলি নিজেকে বঞ্চিত মনে হইতেছে কেন? কেন মনে হইতেছে তাঁহারও কিছু প্রাপ্য ছিল ঋষি বিশ্বামিত্রের পক্ষ হইতে? শিশুকাল হইতে যে অগ্রজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলিয়াই আপনাকে ভাবিয়াছেন, আজ তবে কেন পৃথক সত্তা মাথা তুলিতে চায়? 

অস্থির, চঞ্চল লক্ষ্মণ ধ্যানভঙ্গ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। রামচন্দ্রের সহিত বিচ্ছেদের আঘাত সহ্যাতীত হইয়াছিল বলিয়া তৎক্ষণাৎ অযোধ্যা ত্যাগ করিয়াছিলেন। সহধর্মিণী ঊর্মিলার সহিত সাক্ষাতের কথা মনে করিবার অবকাশ ছিলনা তাঁহার। চিরটাকাল তাহাকে বঞ্চিত করিয়াই কাটাইয়া দিলেন। আজ যে মুহূর্ত হইতে নিজেকে বঞ্চিত মনে হইতেছে, সে হতভাগিনীকে বড় বেশী মনে পড়িতেছে। জীবনে প্রথমবার স্ত্রী ও পুত্রদ্বয়ের জন্য অশ্রুবিসর্জন করিলেন লক্ষ্মণ। 

ক্রমাগত অগ্রজের কথাই স্মরণ হইতেছে কেন? পিতৃসত্য পালনার্থে রামচন্দ্রের বনবাসে কে ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন সর্বাধিক? এমনকি পিতাকে কামুক বুদ্ধিভ্রষ্ট বলিয়া সমগ্র অযোধ্যা নির্মনুষ্য করিবার সংকল্প কাহার ছিল? অরণ্যযাত্রার প্রভূত কষ্ট এবং শ্রম মাথায় পাতিয়া লইয়াছিলেন কে? দিবসরজনী অতন্দ্রভাবে রাম-সীতাকে রক্ষা করিবার ভার কে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করিয়াছিলেন? স্ত্রীর সজলনেত্র, মাতার বক্ষবিদারী ক্রন্দন উপেক্ষা করিয়া দিনের পর দিন অরণ্যমধ্যে গৃহনির্মাণ করিয়া শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যকে বাসযোগ্য করিয়া তুলিবার মধ্যে কাহার স্বার্থ নিহিত ছিল? তাঁহার তো পিতৃবাক্য পালনের বাধ্যবাধকতা ছিল না! শুধু ছিল রামচন্দ্রের প্রতি প্রগাঢ় প্রীতি। অগ্রজের সঙ্গে তাঁহার বন্ধন অচ্ছেদ্য বলিয়াই জানিতেন তিনি। ইহা কি তাঁহার অপরাধ? 

লক্ষ্মণ পুনঃপুনঃ ব্যর্থ হইয়া ধ্যানের প্রচেষ্টা ত্যাগ করিলেন। একটি বৃক্ষতলে বসিয়া পূর্বকথা স্মরণ করিতে লাগিলেন তিনি। দীর্ঘসময় অশ্রু বিসর্জনের পরে তাঁহার মনের ভার কিছুটা লাঘব হইল। অতীতকথা যেন গতজনমের কথা বলিয়া ভ্রম হয়। 

অপরাধ? …কিছু ছিল নিশ্চয়ই। দণ্ডকারণ্যে অবস্থানকালে শূর্পণখার সহিত তাঁহাদের আচরণ সমীচীন ছিল কি? পরিহাসের ছলে তাহাকে অপমানিত করা হইয়াছিল বলিয়াই আজ বিবেচনা হয়। স্বেচ্ছায় ভর্তাগ্রহণ অনার্যজাতির পক্ষে স্বাভাবিক; বিশেষত সে যখন হতভর্তা। তাই বোধকরি সে প্রথমে শ্রী রামচন্দ্র এবং পরে তাঁহাকে বিবাহপ্রস্তাব দিয়াছিল। সেদিক হইতে তাহার আচরণ বিসদৃশ কিছুই নয়, কিন্তু তাঁহারা স্ত্রীজাতির প্রতি যে কোমলতা দেখানো যাইত, তাহা না করিয়া বিদ্রূপ করিয়াছিলেন তাহাকে। তাই বোধকরি ঈর্ষান্বিত হইয়া সে দেবী সীতাকে আক্রমণ করিয়াছিল। প্রবৃত্তিদমন তাহাদের স্বভাববিরূদ্ধ। শূর্পনখার নাসাকর্ণ ছেদনের অপরাধবোধ আজও লক্ষ্মণকে সংকুচিত করিয়া দেয়। যক্ষিণী তাড়কাকে হত্যা করিবার মধ্যে ঋষিসমাজকে সুরক্ষিত করিবার ভাবনা ছিল, মহামুনি বিশ্বামিত্রের আদেশ ছিল, তদুপরি প্রাণ বাঁচাইবার তাগিদ ছিল। শূর্পনখার ক্ষেত্রে এসকল কিছুই ছিল না। আরও কিছুটা সংবেদনশীল হইলে বোধকরি সীতাহরণের ঘটনাটি এড়ানো যাইত। 

সত্যই যাইত কি? সোনার হরিণের পিছনে রামচন্দ্রকে ছুটিতে বাধ্য করিয়াছিলেন দেবী সীতা। লক্ষ্মণের বহু নিষেধ অমান্য করিয়া। দৈত্যদানব পরিবেষ্টিত অরণ্যে এজাতীয় চিত্তচাঞ্চল্য কাম্য নয়। হয়ত বিপদ অন্য প্রান্ত হইতে আসিত। আর দেবী সীতা কর্তৃক কি চরম অপমান! লক্ষ্মণ দেবীকে একা রাখিয়া যাইতে অস্বীকৃত হইলে দেবী তাঁহাকে আপনার প্রণয়প্রার্থী সন্দেহ করিয়াছেন। সারাজীবন দেবীজ্ঞানে সেবা করার কি চরম প্রাপ্তি! 

আজ কেবল অপমান আর অপ্রাপ্তির কথাই স্মরণে আসিতেছে কেন? তবে কী লক্ষ্মণের সত্যই লোভ হইয়াছিল? লোভ হইয়াছিল খ্যাতির প্রতি? রামচন্দ্রের সুকীর্তির কিছু খণ্ডাংশ পাইবার আশা কি তাঁহারও ছিল? তাই কি রামচন্দ্র কর্তৃক পরিত্যাজ্য হইয়া খ্যাতিহীন হইবার আশংকা হৃদয়ের গোপনে রক্ষিত আবেগগুলি নিংড়াইয়া বাহির করিতেছে? 

ধিক্‌ কষ্ট! এসকল কেমন কথা চিত্তদাহ ঘটাইতেছে? দুঃখের অনলে পুড়িয়া শুদ্ধ না হইয়া এসকল মনের ক্লেদ কোথা হইতে নির্গত হইতেছে? কিন্তু, না, আজ হৃদয় সংবরণ করিবেন না তিনি। হৃদগতি যেইদিকে ইচ্ছা যাউক! 

সীতা অন্বেষণে রামচন্দ্র বানর জাতির সহায়তা লইলেন। কিন্তু কিরূপে? বালীকে অন্যায্যভাবে হত্যা করিয়া। অবশ্য, বানররাজ্যে গিয়া বানররাজ বালীকে সম্মুখসমরে আহ্বান করা আর আত্মহত্যা সমান। তবুও আড়ালে দাঁড়াইয়া শত্রুহত্যা করা ছাড়া বিকল্প কি কিছু ছিল না? 

সব চিন্তাভাবনা একসূত্রে গ্রথিত করিতে পারিতেছেন না লক্ষ্মণ। কেবলই এলোমেলো হইয়া যাইতেছে। আজ কেন প্রভু রামের ত্রুটিগুলিই দৃষ্টিগোচর হইতেছে? ভালো কি লক্ষ্মণকে বাসেন নাই তিনি? সারাজীবন পার্শ্বে থাকিয়া সুখদুঃখের ভাগীদার হন নাই? লক্ষ্মণের দুই পুত্র অঙ্গদ এবং চন্দ্রকেতুকে প্রতিষ্ঠিত করেন নাই কারুদেশ এবং চন্দ্রকান্ত দেশে? রাবণ নিক্ষিপ্ত অষ্টঘন্টাযুক্ত শক্তি যখন লক্ষ্মণের হৃদয়ে প্রবিষ্ট হইল, রামচন্দ্রের সে আকুল ক্রন্দন, তাঁহাকে জীবনদানের ব্যাকুল প্রয়াস, এসকল তো অসত্য নয়! 

ক্রোধসংবরণ লক্ষ্মণের প্রকৃতিবিরুদ্ধ। রামচন্দ্রের বনবাসের কথা শুনিয়া ভরতের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা, তদুপরি পিতা দশরথকে হত্যা করিবার যে ঘৃণ্য চিন্তা তাঁহার মস্তিষ্কে আসিয়াছিল, সেসকল দোষ নিজগুণে ক্ষমা করেন নাই রামচন্দ্র? 

তবু কেন সংশয় জাগে সকল অপ্রিয় কাজগুলি তাঁহারই স্কন্ধে ন্যস্ত করিয়াছিলেন রাঘব? বালী হত্যার পর কিষ্কিন্ধাপতি হইয়া সুগ্রীব যখন সীতা অন্বেষণ ভুলিয়া বিলাসে ডুবিয়া ছিলেন, লক্ষ্মণকে দূত করিয়া রাজসভায় প্রেরণ করিয়াছিলেন তিনি। একাকী লক্ষ্মণ ক্রোধোন্মত্ত হইয়া বহু কুকথা বলিয়াছিলেন সুগ্রীবকে। বানরসৈন্য তাঁহাকে হত্যা করিলেও কি কিছু করিবার ছিল তাঁহার? নাকি অপরিসীম আস্থা ছিল লক্ষ্মণের শক্তি এবং বিচারবুদ্ধির উপর? তাই বোধকরি রাবণপুত্র মহাশক্তিধর অতিকায় এবং মায়াবী ইন্দ্রজিতের হত্যার ভার তাঁহার উপরেই ন্যস্ত করিয়াছিলেন শ্রীরাম! 

কিন্তু একি কেবলই আস্থা? রামচন্দ্র কি পারিতেন না এই সকল রাক্ষসকে হত্যা করিতে? বিশেষত মহাবীর হনুমান, মহাশক্তিধর সুগ্রীব যখন তাঁহার সহায় ছিল? আবার, একথাও কি সত্য নয় যে মহান বীর ইন্দ্রজিত বধের ভার লক্ষ্মণকে দিয়া পক্ষান্তরে তাঁহার বীরত্বকে সম্মান জানাইয়াছিলেন শ্রীরামচন্দ্র? লঙ্কাবিজয়ের কাহিনীতে লক্ষ্মণের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখার জন্যই এই কর্তব্য তাঁহাকে দেওয়া হইয়াছিল? 

এপথের ভাবনাটিই সঠিক। এতক্ষণে লক্ষ্মণ আশ্বস্ত হইলেন। দেবতা রামের প্রতি সন্দেহের অগ্নি যা তাঁহাকে অদ্যবধি দগ্ধ করিতেছিল, তাহা শীতল বারিধারা লাভ করিল যেন। 

কিছু প্রশ্ন তবু স্ফুলিঙ্গের ন্যায় মনে উড়িতেছে। সীতামাতার প্রতি রামচন্দ্রের আচরণ। ধর্মপালনের পথ কি কঠোর! স্বর্ণলঙ্কা বিজয় সম্পূর্ণ হইয়াছে। বিভীষণকে লঙ্কাধিপতি ঘোষণা করিলেন শ্রীরামচন্দ্র। সীতাদেবী স্বয়ং ভর্তাকে দেখিতে তাঁহার ইচ্ছা ব্যক্ত করিয়াছেন মহাবীর হনুমানের নিকট। রামচন্দ্রের আদেশে অশোকবন হইতে আনীতা হইলেন জানকী। শিবিকা হইতে অবতরণ করিয়া রাজনন্দিনীকে পদব্রজে আসিবার নির্দেশ দিলেন কৌশল্যানন্দন। এ কেমন আদেশ? দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর নির্জনে আলাপই কি বাঞ্ছনীয় নয়? রামচন্দ্রের আদেশে সীতামাতা সমস্ত বনবাসী, বানরভল্লুকাদির সমীপে রাজদর্শনে আসিলেন। লজ্জায় নিজের দেহেই লীন হইয়া যাইতেছিলেন বৈদেহী। এখানেই অন্ত হয় নাই। নিষ্পাপ সীতামাতার চরিত্রের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করিয়া তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়াছেন রঘুকুলপতি। সীতা উদ্ধারের মাধ্যমে তিনি রাজধর্ম পালন করিয়াছিলেন মাত্র। রাবণের হস্তে সীতার নিপীড়ন রামচন্দ্রের বংশগৌরব ক্ষুণ্ণ করিয়াছে। তাই সীতাকে মুক্ত করিয়া লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সুগ্রীব অথবা রাক্ষস বিভীষণ যাহাকে ইচ্ছা তাহাকে গ্রহণের আজ্ঞা দিয়াছেন। কিন্তু মাতাসীতা অভিমানবশতঃ সত্যই বিভীষণের অঙ্কশায়িনী হইলে বংশগৌরব বৃদ্ধি পাইত কি? ইহা যেন পতিধর্ম পদদলিত করিয়া রাজধর্ম পালন! সীতাদেবী কিন্তু বংশের মর্যাদা এবং পত্নীর স্বাভিমান উভয়ই নিরঙ্কুশ রাখিতে অগ্নিতে প্রবেশ করাই স্থির করিলেন। সেই অগ্নি প্রজ্জ্বলনের ভার পড়িল লক্ষ্মণের উপর। কেহ রামচন্দ্রকে অনুনয় করিতে সাহস করিলেন না। দেবগণ আসিয়া সীতা উদ্ধার না করিলে লঙ্কায় সীতা বিসর্জন করিয়াই আসিতে হইত। 

কিন্তু সম্পূর্ণ ভাবে গ্রহণ করিয়াছিলেন কি তিনি বৈদেহীকে? নতুবা পুনরায় রাজধর্ম পালনার্থে সন্তানসম্ভবা জানকীকে পরিত্যাগ করিলেন কেন? সীতাকে নির্বাসনের ভার পড়িল পুনরায় সৌমিত্রির উপর। কি নিদারুণ কঠিন দায়িত্ব! সহায় সম্বলহীনা একাকী সন্তানসম্ভবা নারীকে অরণ্যে নির্বাসন। কী আকুলভাবে কাঁদিতেছিলেন বৈদেহী! তখনই কি স্থির হইয়া যায় নাই সৌমিত্রির ভাগ্য? প্রাণপ্রিয়া সীতাদেবীকে হেলায় পরিত্যাগ করিতে পারিলে তাঁহাকেও জীর্ণ বস্ত্রের ন্যায় পরিত্যাগ করিতে পারেন ধর্মাত্মা রামচন্দ্র! 

এসব কী ভাবিতেছেন লক্ষ্মণ? তাঁহার চিন্তাশক্তি লোপ পাইতেছে কি? ধর্মের নিমিত্ত সকল কিছু পরিত্যাগ করিতে পারা যায়, কিন্তু কোনও মূল্যেই ধর্মকে পরিত্যাগ করা যায়না- এই শিক্ষাই তো পাইয়াছেন চিরকাল। তবে কেন সংশয়? ব্রহ্মার দূতের সহিত গোপনে পরামর্শ করিতেছিলেন রামচন্দ্র। প্রতিহারীকে সরাইয়া লক্ষ্মণকে দ্বাররক্ষার ভার দিয়াছিলেন। দুর্বাসা মুনি আসিয়া সেই গোপনীয়তা ভঙ্গ করিয়া দেন। দ্বাররক্ষক লক্ষ্মণ গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিজ্ঞাপালনে ব্যর্থ হইয়াছিলেন। তাইতো এই দণ্ড। রাজাজ্ঞা পালনের ব্যর্থতার দায় তো লক্ষ্মণ স্বীকার করিয়াছেন। তবে কেন দুর্বলতা মনকে অধিকার করিতেছে? দেবতাকে সন্দেহ করিবার মতো ঘৃণ্য কাজ করিয়াছেন লক্ষ্মণ। রামচন্দ্র আপন ধর্মপালন করিয়াছেন, এক্ষণে তাঁহার পালা। 

মনস্থির করিয়া আচমন করিলেন লক্ষ্মণ। রামচন্দ্রের ধ্যান করিলেন। সমস্ত ইন্দ্রিয়দমন দমন করিয়া শ্বাসরুদ্ধ করিলেন। লক্ষ্মণের সংজ্ঞাহীন দেহ যখন খরস্রোতা সরযূ নদীতে বহিয়া গেল, কেহ তাহার সাক্ষী রহিল না।




2 comments: