2
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - তুষার সরদার

Posted in


প্রবন্ধ


সত্যমিথ্যার আলোছায়া
তুষার সরদার


মানুষের জীবনে খুব সাধারণ অথচ অপরিহার্য দুটি বিষয় হচ্ছে সত্য ও মিথ্যা। জীবনে এই দুটি বিষয়েরই প্রয়োজন আছে। ক্ষেত্র এবং সময় বিশেষে দুটি বিষয়েরই সংজ্ঞা এবং তাৎপর্য পরিবর্তিত হয়। পরিস্থিতিভেদে মিথ্যা সর্বদাই কুটিল ও হানিকারক হয় না অথবা সত্য সর্বদাই হিতকারক ও সরল হয় না। সত্য ও মিথ্যার এই বিচিত্র গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করতে গিয়ে আঙ্গিক হিসাবে মহাভারতে উল্লেখিত কয়েকটি প্রসঙ্গ অবলম্বন করা হয়েছে। এখানে যেসব প্রসঙ্গের বা ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে সেগুলি জনপ্রিয় এবং প্রায় সকলেরই মোটামুটি জানা আছে। সেজন্য ওই ঘটনাগুলির খুঁটিনাটি বা বিস্তৃত বিবরণ অপ্রয়োজনীয় বোধে দেওয়া হল না।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দ্রোণপর্ব। কৌরবপক্ষের সেনাপতি আচার্য দ্রোণের প্রবল বিক্রমে পাণ্ডবপক্ষ তখন গভীর বিপন্নতায় নিমজ্জিত। পাণ্ডবপক্ষীয় কোন বীরই রণাঙ্গনে আচার্যের ধ্বংসলীলা কিছুতেই রোধ করতে পারছেন না। এদিকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সর্বশ্রেষ্ট ধনুর্ধর অর্জুন তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় অস্ত্রগুরুর বিরুদ্ধে কোন মারাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আন্তরিকভাবে অনিচ্ছুক। অন্য কোন উপায় না থাকায় মহাভারতের প্রবলতম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুনকে না জানিয়েই দ্রোণবধের গোপন এক পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সেই পরিকল্পনাটি করা হয়েছিল দ্রোণাচার্যেরই একটি বিশেষ কথার উপর ভিত্তি করে। তিনি কথাপ্রসঙ্গে পাণ্ডবদের একসময় বলেছিলেন তাঁর হাতে যতক্ষণ অস্ত্র থাকবে ততক্ষণ তাকে যুদ্ধে পরাজিত বা নিহত করা অসম্ভব। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সম্মুখ-সমরে অস্ত্রের আঘাতে মহাবীর দ্রোণাচার্যকে অস্ত্রহীন করে ফেলা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। অতএব অন্যতর অমোঘ এক আঘাতের কথা ভাবা হয়েছিল। অতর্কিত সেই আঘাতে যেকোন মহাবীরের বিকলন সম্ভব।

শ্রীকৃষ্ণের পরিকল্পনা অনুযায়ী পরদিন রণক্ষেত্রে ‘অশ্বথামা’ নামের একটি রণহস্তীকে নিহত করে মধ্যমপাণ্ডব ভীম ‘অশ্বথামা হত’ হয়েছে বলে চিৎকার শুরু করলেন এবং পান্ডবপক্ষীয়রা সৈন্যরা সেই দাবিতে প্রবল ভাবে গর্জন করতে লাগলেন। সেসব কথা শুনে তাঁর পুত্র অশ্বথামা নিহত হয়েছে ভেবে দ্রোণাচার্য আশঙ্কায় নিতান্ত ব্যাকুল হয়ে নিগূঢ় বিশ্বাসে পরম সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের কাছেই সেই ভয়াবহ সংবাদ সত্য কিনা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। 

সবাই জানেন যে সে প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির কী বলেছিলেন এবং তা বলার পর কী কী ঘটেছিল। যুধিষ্ঠির তখন যে উত্তরটি দিয়েছিলেন সেটি ঠিক সত্য বা মিথ্যা ছিল না। বলা যায় সেটি অর্ধসত্য বা অর্ধমিথ্যা ছিল। এই অর্ধসত্য বা অর্ধমিথ্যাটি বলার জন্য শাস্তিস্বরূপ পরমধার্মিক মহাসত্যবাদী যুধিষ্ঠিরকে একবার নরক-দর্শনের কষ্ট নিতে হয়েছিল। 

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী যুধিষ্ঠির জীবনে এই একবারই তিনি মিথ্যা বলেছিলেন এবং সেটি আবার অর্ধমিথ্যা ছিল মাত্র। কিন্তু মহাভারত রচয়িতার বর্ণনা অনুসারে যুধিষ্ঠির আরও অন্তঃত তিন তিনবার মিথ্যাভাষণ এবং মিথ্যাপোষণ করেছিলেন। সেগুলির প্রত্যেকটিই সম্পূর্ণ এবং প্রত্যক্ষ মিথ্যাকথন ছিল। এগুলির কথা বিবেচনা করলে যুধিষ্ঠিরকে একজন যথেষ্ট পোক্ত মিথ্যাবাদী বলে নিঃসন্দেহে ভেবে নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে তো মিথ্যাকথনের অপরাধের জন্য নরক-দর্শনের পরিবর্তে নরকবাসই যুধিষ্ঠিরের যথাযথ শাস্তি ছিল।

প্রথমতঃ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মিথ্যাচারণ হোল অজ্ঞাতবাসকালে মৎসরাজ বিরাটের কাছে আদ্যন্ত মিথ্যাকথন। দ্রৌপদীসহ ভাইদের সঙ্গে নিয়ে যুধিষ্ঠির সেখানে সম্পূর্ণ মিথ্যা নাম বলেছিলেন ও মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় দীর্ঘ এক বছর ধরে সে মিথ্যাকে তিনি সযত্নে লালন করে গেছেন।

দ্বিতীয়তঃ একচক্রা নগরীতে চারভাই এবং মা কুন্তী সমেত নিজেদের ব্রাহ্মণ হিসাবে পরিচয় দিয়ে এক ব্রাহ্মণের গৃহে আশ্রয় নিয়ে দীর্ঘদিন বাস করেছিলেন। সে যুগে ভিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে দরিদ্র ব্রাহ্মণদের জীবিকার্জন প্রচলিত ছিল বলে যুধিষ্ঠিরাও তাই করতেন, যাতে অন্যের কাছে তাঁদের মিথ্যা পরিচয় নিটোল সত্য বলে চালানো যায়।

তৃতীয়তঃ দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় গিয়ে ক্ষত্রিয় হয়েও সেখানে নিজেদের ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দিয়েছিলেন এবং ব্রাহ্মণদের জন্য নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করেছিলেন।। ক্ষত্রিয় রাজারা লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হলে ধৃষ্টদ্যুম্ন যখন অন্য সম্প্রদায়কে লক্ষ্যভেদে আহবান জানালেন, ‘ব্রাহ্মণ’ যুধিষ্ঠিরের অনুমতিক্রমেই অর্জুন ব্রাহ্মণ হিসাবে লক্ষ্যভেদে অগ্রসর হয়েছিলেন। এগুলি প্রত্যক্ষভাবে অন্যের পক্ষে হানিকারক না হলেও স্পষ্টতঃই সম্পূর্ণ মিথ্যাচারণ। 

এই তিন তিনটি মিথ্যাচারের জন্য পরবর্তী কালে যুধিষ্টিরের কোনরকম শাস্তিবিধানের কোন উল্লেখ না থাকলেও শুধু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কথিত সেই অর্ধমিথ্যাটির জন্য শাস্তিবিধানের উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ একাধিকবার পূর্ণমিথ্যা কথনেও কোন অপন্যায় ঘটে নি, কিন্তু মাত্র একবার অর্ধমিথ্যা কথনেই শস্তিযোগ্য অপন্যায় ঘটে গেছে। তবে কী মহাভারত রচয়িতা তাঁর মহাগ্রন্থে স্ববিরোধী বক্তব্য প্রকাশ করেছেন?

দৈবী মহিমাকীর্তন, মানুষিক মহত্বের দেবত্বে উত্তরণের বিবরণ, অসাধারণ চরিত্রচিত্রণ, মহাকাব্যিক জটিলতা এবং সর্বোপরি কালজয়ী সাহিত্যগুণ, সবদিক দিয়েই মহাভারত শ্রেষ্ট মহাকাব্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর সেই কালোত্তীর্ণ মহাকাব্যে স্ববিরোধিতার মত অতি নিম্নমানের অসঙ্গতি বর্তমান থেকে গেল? ঘটনাগুলির গভীরতা যথাযথ ভাবে অনুধাবন করতে পারলে এই তথাকথিত ‘অসঙ্গতি’ কে এক তাৎপর্যপূর্ণ সুসঙ্গতি বলে প্রতিভাত হবে।

একটু তলিয়ে চিন্তা করলে বোঝা যাবে ওই অর্ধমিথ্যাটির সঙ্গে অন্য তিনটি পূর্ণমিথ্যার একটি মূলগত পার্থক্য আছে। পূর্ণমিথ্যাগুলি কথিত হয়েছিল পাণ্ডবদের আত্মপরিচয় গোপন করার জন্য। অর্ধমিথ্যাটি কথিত হয়েছিল তীব্র সংকটে পড়ে – যুদ্ধক্ষেত্রে সম্ভাব্য পরাজয়ের মুখে পড়ে। আর শুধু এজন্যই যুধিষ্ঠিকে শাস্তি পেতে হয়েছিল – করতে হয়েছিল নরক দর্শন! অথচ এমন ধারণাই সাধারণ্যে বহুল প্রচলিত রয়েছে যে আত্মরক্ষার্থে মিথ্যাকথন গুরুতর অপরাধ নয়।

এই আপাত-স্ববিরোধিতার আড়ালে এক গভীর মহান জীবনাদর্শের বাণী নিহিত আছে। যখন শুধুমাত্র আত্মপরিচয় গোপন করতে গিয়ে যখন মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হল সেক্ষেত্রে সত্য-বিচ্যুতি যতটা গভীর, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পরাজয় এড়ানোর তাগিদে মিথ্যা ভাষণের ক্ষেত্রটিতে সে বিচ্যুতি অনেক বেশি গভীর – তাই শাস্তিযোগ্য। সত্যনিষ্ঠ বলে প্রতিষ্ঠিত কারো পক্ষে সত্যের সহজ পরীক্ষায় ব্যর্থ হবার অপরাধের তুলনায় সত্যের কঠিন পরীক্ষায় ব্যর্থ হবার অপরাধ অনেক বেশী। যুধিষ্ঠিরের মত একজন সত্যনিষ্ঠ বলে খ্যাত ব্যক্তির যুদ্ধে পরাজয়ের ভয়ে সত্য-বিচ্যুতির অপরাধ মহাভারতকার কিছুতেই ক্ষমা করতে পারেননি। 

অন্য এক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েও এই মহৎ তত্ত্বটিকে প্রতিষ্ঠা করা যায়। পূর্ণ মিথ্যাভাষণগুলি আত্মগোপনের জন্য কথিত হয়েছিল, কিন্তু তা কারো কোন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্য কথিত হয়নি। সেজন্য সেগুলিকে পাপ বলে গণ্য করা হয়নি। কিন্তু কুরুক্ষেত্রের রণভূমিতে যুধিষ্ঠিরের এই অর্ধমিথ্যা ভাষণটি প্রত্যক্ষভাবে কৌরব সেনাপতি মহারথী দ্রোণাচার্যের নিশ্চিত বিনাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছিল – তাই তা পাপ বলে গণ্য হয়েছিল। ‘ধর্মরাজ’ অভিধার খোলসটির আড়ালে যুধিষ্ঠির অধার্মিকতার অনেক কাজই করেছিলেন। কিন্তু সেসব অন্য কাহিনী।





2 comments:

  1. খুব ভালো লাগলো লেখাটি। । অসাধারণ ব্যাখ্যা।

    ReplyDelete