প্রবন্ধ
বাংলার গান - বাঙালির গান – ২
সোনার গান : শোনার গান
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
আগের সংখ্যায় বাংলার গান – ‘বাঙালির গান’ নিবন্ধে মধ্যযুগ থেকে প্রাক-আধুনিক যুগ পর্যন্ত বাংলা গানের পথচলাটি বুঝতে চেয়েছিলাম। কীর্তন, ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ হয়ে বাংলা গান পৌঁছেছিল রামনিধি গুপ্তর টপ্পা ও দাশরথী রায়ের পাঁচালী গানে। তারপর বাঙ্গালির গান পেল আধুনিকতার স্পর্শ, পেল আধুনিক কাব্যের লাবণ্য রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়ায়। সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে পড়তে যান। সেখানে তাঁর পাশ্চাত্য সংগীত সম্পর্কে ধারণা হয়। সেখান থেকে কয়েকটি আইরিশ লোক সংগীতের সুর সংগ্রহ করেন। বিলেত থেকে ফিরে তিনি গীতিনাট্য ‘বাল্মীকি প্রতীভা’ ও ‘কালমৃগয়া’ রচনা করেন। জীবন স্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন “এই দেশী ও বিলিতি সুরের চর্চার মধ্যে বাল্মীকি প্রতীভার জন্ম হইল”। সুতরাং বলা যায় বিলাত থেকে প্রত্যাগমনের পরই রবীন্দ্রনাথের সংগীত রচনার ইতিহাসের সূত্রপাত। বাংলা গানের এতাবৎ কালের পথচলায় নিশ্চিতভাবেই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ রবীন্দ্রনাথের স্পর্শ। সে প্রসঙ্গে আসবো। তার আগে আর একটি পর্যায় আছে তা হলো থিয়েটারের গান।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা গান বলতে কবিগান, আখড়াই তরজা, পাঁচালী গান আর বিত্তশালী বাবুদের বাগানবাড়ি, রক্ষিতা গৃহে চটুল আদিরসাত্মক গান। গান তখনও সাধারণ মানুষের বিনোদন সামগ্রী হয়ে ওঠেনি। থিয়েটারও ছিল জমিদার বাবুদের গৃহপ্রাঙ্গণে বন্দী। সাধারণ মানুষ বিনোদনের ভাগ পেতো বিত্তশালীদের আয়োজিত পূজা, উৎসবের ঝুমুর, কবিগান, তরজা, পাঁচালীর আসর থেকে।
১৮৭২এ জমিদার বাবুদের প্রাঙ্গণ থেকে বাংলা থিয়েটার চলে এল সাধারণ মানুষের নাগালে ন্যাশানাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। থিয়েটার হয়ে গেল বাঙালির বিনোদনের সেরা মাধ্যম। এবং থিয়েটারের গান। এখন বাংলা থিয়েটার থেকে গান প্রায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেও সেকালে গানই ছিল থিয়েটারের প্রাণ, সে যুগের নাটকের সেরা উপাদান। নাট্যকাহিনীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হোক বা না হোক নাটকে একাধিক গান রাখতে হতো, না হলে সে নাটক দর্শক আনুকুল্য পেত না। গিরিশচন্দ্র ঘোষ তাঁর নাটকের জন্য অসংখ্য গান লিখেছিলেন। গান ছাড়া নাটক লেখার কথা সে যগের নাট্যকাররা ভাবতেই পারতেন না। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের প্রবাদপ্রতীম নাটক ‘আলিবাবা’য় ছিল ৩৬টি গান। এমন নয় যে থিয়েটারের গানগুলির লোকপ্রিয়তা শুধু সে যুগেই সীমাবদ্ধ ছিল, সেদিনের থিয়েটারের অজস্র গান শতাধিক বছর পরে আজও কথা ও সুরের মায়ায় আমাদের আন্দোলিত করে। এযুগের শিল্পীরা সেইসব গানের রিমেক করছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের ‘চন্দ্রগুপ্ত’নাটকের গান ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে কি সংগীত ভেসে আসে’ গানটি প্রবাদের মতো হয়ে আছে। আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগে ‘নর্তকী’ নাটকে অতুলপ্রসাদ সেনের ‘আমার জীবন নদীর ওপারে, এসে দাঁড়ায়ও দাঁড়ায়ও বধু হে’ গানটি গেয়েছিলেন আঙ্গুর বালা আজও সেই গানটি পূণর্নির্মাণ করেন একালের শিল্পী। সে গান শুনে আমাদের মুগ্ধতা যায় না। ১৯০৫এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উত্তাল সময়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের দেশাত্মবোধক থিয়েটারের গানগুলি ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’, সাজাহান নাটকের ‘ধন্যধান্য পুষ্প ভরা’ স্বদেশী আন্দলনের চারণমন্ত্র হয়ে উঠেছিল, তবে ধ্বনি মুদ্রণ বা গ্রামফোন রেকর্ড এসেছিল অনেক পরে, তাছাড়া নাট্যমঞ্চ থেকে সরাসরি রেকর্ডিং ব্যবস্থা তখন কল্পনাতেও ছিল না। ফলে থিয়েটারে গানের বিপুল ঐশ্বর্যের সামান্যই সংরক্ষিত আছে। পরবর্তী কালে নজরুল ইসলামই সর্বাধিক থিয়েটারের গান রচনা করেছিলেন ও সুর দিয়েছিলেন। ১৯২৯এ শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ‘রক্তকমল’ নাটকে সঙ্গীত রচনার মধ্য দিয়ে থিয়েটারের গানে প্রবেশ করেছিলেন, তারপর দেড় শতাধিক গান লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন। এছাড়া বহু খ্যাতকীর্তি সাহিত্যিক – জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমেন্দ্রকুমার রায়, সজনীকান্ত দাশ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ থিয়েটারে গান লিখেছেন ।
কীর্তন, লোকগান, রামপ্রসাদী, কবিগান, পাঁচালী গান থেকে থিয়েটারের গান - – বিভিন্ন ধারার বাংলা গান বাঙালির একান্ত প্রাণের জিনিস হয়ে উঠেছিল। গানের এমন বৈচিত্রপূর্ণ সমাবেশ অন্য কোনও ভাষাভাষীদের মধ্যে ছিল না, আজও নেই। সুতরাং বাংলা গানের বিপননযোগ্য পণ্যমূল্য তৈরি হল আর তা বুঝতে ইংরাজ বনিকদের দেরি হল না। ইতিমধ্যে টমাস আলভা এডিসন ১৮৭৭ খৃষ্টাব্দে আবিস্কার করলেন অত্যাশ্চর্য ‘ফোনোগ্রাফ’ যন্ত্র, যা পরিচিতি পেল গ্রামফোন বা বাঙালির দম দেওয়া ‘কলের গান’ নামে। উনিশ শতক শেষ হবার আগেই কলকাতায় এসে গেল ‘কলের গান’। ১৯০২তে এমারেল্ড থিয়েটারের দুই নাচ-বালিকা শশীমুখী ও ফণীবালার কন্ঠে দুটি গান রেকর্ড হলো, সেটিই এদেশের প্রথম বাংলা গানের ধ্বনিমুদ্রিকা বা গ্রামফোন রেকর্ড। কালো গালার চাকতিতে ধ্বনিমুদ্রিত বাংলা গান গ্রামফোন যন্ত্রবাহিত হয়ে পৌঁছে গেল মধ্যবিত্ত বাঙালির অন্দরমহলে। বিশ শতকের সেই প্রথম দশকেও, বাংলার সমাজ অনেক শিক্ষিত, জাতীয়তাবাদ তীব্র হয়েছে তখনও গান গাওয়াকে বৃত্তি হিসাবে গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে ওঠেনি। গান গাওয়াকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করাকে হীন বৃত্তি রূপেই মনে করা হতো আর মেয়েদের গান করা তো ছিল তখনকার সমাজের চোখে পাপ কাজ। অভিজাত পরিবারের সন্তান হিসাবে প্রথম গ্রমফোন রেকর্ডে গান করেন লালচাঁদ বড়াল, যার পুত্র রাইচাদ বড়াল আধুনিক বাংলা গান ও সিনেমার গানের সুর রচনার ক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃতের মান্যতা পেয়েছেন। রেকর্ডিং চালু হবার পর ২৫/৩০ বছর নীচের মহল থেকে উঠে আসা মেয়েরাই বাংলার সঙ্গীত জগতকে আলোকিত করেছিলেন। শিল্পীর মর্যাদায় এরা সঙ্গীত জগতে লিজেন্ড হয়ে আছেন। গহরজান, কৃষ্ণভামিনী, হরিমতি, কমলা ঝরিয়া, আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা থেকে কানন দেবীরা বাংলা গানের ভুবনকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে গেছেন। শিল্পীর মর্যাদায় এরা সঙ্গীত জগতে লিজেন্ড হয়ে আছেন। সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী ইন্দুবালা খ্যাতির শিখরে উঠেছিলেন, গ্রামোফোন কম্পানীর ‘গোল্ডেন ডিস্ক’, ‘সঙ্গীত নাটক আকাডেমি’ সম্মাননা পেয়েছেন। কলকাতার রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর পদপ্রান্তে দাঁড়িয়ে উদ্বোধনী সঙ্গীত গেয়েছিলেন ইন্দুবালা। দেশজোড়া খ্যাতি সত্ত্বেও তিনি রামবাগানের নিষিদ্ধপল্লী ছেড়ে অন্যত্র চলে যাননি। বলতেন ‘আমি রামবাগানের মেয়ে... রামবাগানই তো আমায় সব কিছু দিয়েছে। অর্থ, সম্মান ভালোবাসা সব...’। একদিকে দেশজোড়া খ্যাতির আলো আর অন্যদিকে রামবাগানের নিষিদ্ধ পল্লীর অন্ধকার। এই দুইয়ের মাঝেই সুরের আকাশে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন ইন্দুবালা।
গ্রামফোন রেকর্ড সম্পর্কে দু'একটি তথ্য জানিয়ে রাখি। একদম প্রথমে এদেশে ধ্বনি মুদ্রনের প্রযুক্তি ছিল না। রেকর্ড প্রিন্ট হয়ে আসতো জার্মানী, অন্ডন, ফ্রান্স থেকে সেগুলি হতো একটু বড় মাপের এবং একদিকে একটি মাত্র গান থাকতো। অবশ্য পরবর্তী সময়ে আমাদের পরচিত রেকর্ডের মত ৭৮ পাকই ঘুরতো একটি গানের জন্য। ১৯৬২ নাগাদ এই ৭৮ ঘুরণের রেকর্ডের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, আসে ৪৫ ঘুরণের বর্ধিত বাদন বা এক্সটেন্ডেড প্লে যাতে দু'পিঠে চারটি গান থাকতো, এবং ৩৩ ঘুরণের দীর্ঘবাদন বা লং প্লে রেকর্ড যাতে দু'পিঠে ৮টি গান থাকতো। আশির দশকের শুরুতে সেগুলির উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যায়, চলে আসে ক্যাসেট। বছর দশেকের মধ্যে ক্যাসেট লুপ্ত হয়ে চলে আসে কমপ্যাক্ট ডিস্ক বা সিডি। অর্থাৎ তিনরকম প্রযুক্তিতে বিপননযোগ্য বাংলা গানের বয়স একশো বছরেরও কম।
১৯০২এ বাংলা রেকর্ডের গানের প্রচলন হলেও পরিশীলিত গায়নশৈলী, গানের কথায় আধুনিক কাব্যের ছোঁয়া লাগতে এবং আমাদের গায়নরুচি তৈরি হতে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও ২৫/৩০ বছর। তখনকার বিনোদনের গানগুলি ছিল কীর্তনাঙ্গ, দেহতত্ব, প্রেম ও ছলনামূলক চটুল গান অথবা মোটা দাগের হাসির গান। ইতিমধ্যে অবশ্য শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকরা রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেছেন। তখন বলা হতওঁ ‘রবিবাবুর গান’। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং নিজ কন্ঠে গান রেকর্ড করেছিলেন ১৯০৮এ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কালে পৌছে বাংলা গানের কথা, সুর ও গায়নশৈলীতে লক্ষ্যনীয় পরিবর্তন এলো। ইতিমধ্যে বাংলার সামাজিক প্রেক্ষাপট প্রস্তুত হয়েছিল আগেই। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে স্বদেশী ভাবনার গান বাংলাকে উত্তাল করেছিল, এসেছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ, রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক গানের প্রবল জোয়ার। রবীন্দ্রনাথ পথে নেমেছেন, মঞ্চনাটকে গান গাইছেন, ক্ষুদিরাম শহিদ হয়েছেন, বুড়িলামের যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন বিপ্লবী বাঘা যতীন, স্বদেশী ভাবনায় উত্তাল পল্লীবাংলার পথে পথে অনামি চারণ গান গেয়ে চলেছে ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’। বাঙালি মননের ঊর্বর ভূমি অতয়েব প্রস্তুত। বাংলা গান প্রকৃত অর্থে আধুনিক হওয়ার প্রস্তুতি শুরু যেন শুরু হয়েছিল।
গত শতকের তিরিশের দশকে পৌঁছে বাংলা গানের আধুনিক হয়ে ওঠা বা বাংলা গানের স্বর্ণযুগের সূচনা হওয়ার অনুঘটক হিসাবে তিনটি ঐতিহাসিক ঘটনা কাজ করেছিল, সেগুলি হলো (১) ১৯২৭এ রেডিও বা বেতার ব্যবস্থার সূচনা (২) ১৯৩২এ বাংলা চলচ্চিত্রের সবাক হওয়া আর (৩) চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রগানের সফল প্রয়োগ শুরু হওয়া, আর (৪) বাংলা গানের জগতে নজরুল ইসলামের আবির্ভাব।
গান বাঙালির প্রাণের জিনিস হয়ে ওঠায় বাংলা গানের চাহিদা বাড়লো, ১৯২৪এর ২৬শে অগস্ট বেসরকারী উদ্যোগে পত্তন হলো কলকাতা বেতার কেন্দ্রের। ১৯২০র দশকেই উঠে এলেন অনেক শিল্পী – কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, শচিন দেববর্মন, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সন্তান শচিন দেববর্মন রেডিওতে প্রথম গান গাইলেন ১৯২৫এ, পঙ্কজ কুমার মল্লিক ১০২৭এ।
পঙ্কজকুমার মল্লিকের কন্ঠে ছিল গান, কিন্তু পিতার নির্দেশে পাটের দালালির ব্যবসায়ে যোগ দিতে হয়েছিল। ১৯২৭এর এক বর্ষামুখর সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এক ডাক্তারবাবুর ডিসপেন্সারির রোয়াকে। সেখান দাঁড়িয়েই রবীন্দ্রনাথের গানের দুটো কলি গুনগুন করে গাইছিলেন – ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়...’। ভেতর থেকে দক্ষিণ ভারতীয় ডাক্তারবাবু ডেকে নিলেন তাঁকে, বললেন ভেতরে এসে গানটা একটু শোনান তো, ভারি সুন্দর গাইছিলেন। সেই দক্ষিণ ভারতীয় ডাক্তারবাবুর নাম ডাঃ রামস্বামী আয়েঙ্গার। গান শোনার পর ডাঃ আয়েঙ্গার বাইশ বছরের সেই যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি রেডিওতে গান করতে চাও? ওখানে আমার জানাশোনা আছে। পঙ্কজকুমার হাতে চাঁদ পেলেন, সম্মতি জানালেন। তখন সবেমাত্র বেসরকারী ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন গঠিত হয়ে বেতার প্রচার শুরু করেছে। ১৯২৭এর ২৬শে সেপ্টেম্বর বাইশ বছরের সেই যুবক রেডিওতে গাইলেন রবীন্দ্রনাথের দুটি গান ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ ও ‘একদা তুমি প্রিয়ে’। তারপর সময়ের স্রোতে সেদিনের পাটের দালালি আর গানের টিউশানি করা সেই যুবক আপন সাধনা ও নিষ্ঠায় হয়ে গেলেন ভারতীয় সঙ্গীত জগতের লিজেন্ড পঙ্কজকুমার মল্লিক। ত্রিপুরার রাজপরিবারের সন্তান শচিনদেব গানকে ভালোবেসে রাজপরিবারের বিলাস ত্যাগ করে গানকেই বেছে নিলেন তাঁর পথচলার ছন্দ হিসাবে। আধুনিক বাংলা গানের গায়কীর অনেকটাই যেন ঠিক করে দিলেন শচিনদেব। বাংলা গানের জগতে শচিনদেবের গৌরবময় প্রতিষ্ঠা এবং আধুনিক বাংলা গানের মোড় ঘুরিয়ে দেবার ঘটনায় আরও দু'জন মানুষের কথা একই সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে আছে – তাঁরা হলেন শচিনদেবের কুমিল্লার সাথী সুরসাগর হিমাংশু দত্ত ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য।
১৯৩০ থেকে ৪০এর মধ্যে বাংলা গানের জগতে উঠে এলেন অনেক কালজয়ী কন্ঠশিল্পী, সুরকার ও গীতিকার। কুন্দনলাল সায়গল, কানন দেবী, কাশেম মল্লিক। আব্বাসউদ্দীন আহমেদ, যুথিকা রায়। জগন্ময় মিত্র, গৌরিকেদার ভট্টাচার্য, সত্য চৌধুরী, সুধীরলাল চক্রবর্তী, বেচু দত্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, জ্ঞাণেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী, মৃণালকান্তি ঘোষ, অপরেশ লাহিড়ী, সুপ্রীতি ঘোষ, সুপ্রভা সরকার, দিপালী নাগ, তারাপদ চক্রবর্তী, কমল দাশগুপ্ত, সলিল চৌধুরী, প্রমুখ। বাংলা গানের জগৎ যেন চাঁদের হাট। ১৯৪০এর পর তিনটি দশক তো বাংলা গানের সোনার দিন, গান শোনার দিনও।
বাংলা গানের সোনার দিন রচনায় বানিজ্যিক স্বার্থে গ্রামফোন কম্পানির পৃষ্ঠপোষকতা যেমন ছিল তেমনই ছিল বাংলা ছায়াছবির অবদান। ১৯৩২এ বাংলা চলচ্চিত্র কথা বলতে শুরু করলো; চলচ্চিত্র সবাক হওয়ার ফলে বাংলা গানের অন্য এক দিগন্তের উন্মোচন হলো। বাংলা গানের চাহিদা বেড়ে গেল, উঠে এলেন অনেক নতুন কন্ঠশিল্পী, সুরকার ও গীতিকার। গান বাঙালির প্রাণের জিনিস বলেই পুরনো দিনের থিয়েটারের মতো ছায়াছবিতেও একাধিক গান রাখতে হতো। অনেক দুর্বল কাহিনী ও অভিনয় সম্বলিত সিনেমাও শুধুমাত্র ভালো গানের জন্যই দর্শক আনুকুল্য পেত, প্রযোজক টাকা ফেরৎ পেতেন। গানের জন্যই সঙ্গীতপ্রধান সিনেমা নির্মাণেরও প্রবণতা এসেছিল। জয়দেব, বিদ্যাপতি, যদুভট্ট, ঢুলি, কবি, বসন্তবাহার, শাপমোচন – এইসব সিনেমার কথা কার না মনে আছে! তখনও টেপ রেকর্ডার বা ক্যাসেটের উৎপাত শুরু হয়নি, গ্রামফোনই বা কত মানুষের ঘরে থাকতো! গান শোনা মানে সপ্তাহে একদিন দুপুরে বেতারে অনুরোধের আসর আর পাড়ার জলসায় নামি শিল্পীদের স্বকন্ঠের গান। সুতরাং সাড়ে পাঁচ আনার টিকিট কেটে প্রাক্ষাগৃহে বসে গান শোনা মন্দ কি! বস্তুত বাংলা গানের স্বর্ণসময় রচনায় বোধকরি সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছিল সিনেমার গান।
উল্লেখ করেছি যে গত শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকটা ছিল বাংলা গানের স্বর্ণসময়ের প্রস্তুতি পর্ব। নানান ধারার বাংলা গানের বৈচিত্রপূর্ণ সমাবেশ এই সময়কালে। সুতরাং বাংলা গানের এক অলিখিত শ্রেণীবিভাগ বা বর্গীকরণ চালু হয়ে গেল। ‘বাউল’, ‘কীর্তন’, বিভিন্ন লোক আঙ্গিকের গান কিংবা ‘শামা সঙ্গীত’ বা ‘ভক্তিগীতি’ না হয় পৃথকভাবে চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু ‘আধুনিক বাংলা গান’ ও ‘রাগপ্রধান’ বড়ই বোকা বোকা বিভাজন যা অনেক প্রশ্ন রাখে। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের গানে (শেষের গানগুলি ছিল ‘তোমারই লাগি’, ‘ফুলের দিন হলো অবসান’, ইত্যাদি) আধুনিক কাব্যের লাবণ্য পাই, তাহলে তাঁর গান আধুনিক নয় কেন ? ত্রমনই শচিনদেবের ‘আমি ছিনু একা বাসর জাগায়ে’ রাগপ্রধান নয় কেন? ‘বেগম আখতারের জ্যোছনা করেছে আড়ি’ রাগপ্রধান হলে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর ‘ঝনন ঝনন বাজে’ রাগপ্রধান না হয়ে আধুনিক কেন? জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী গীত ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা’ কোন শ্রেণীতে রাখবো – শ্যামা সঙ্গীত, রাগপ্রধান না নজরুল গীতি? এমনই হাজারো প্রশ্নের জন্ম দেয় এই অর্বাচীন বিভাজন। এই বিভাজনে রবীন্দ্রনাথ, অতুল প্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্তর গানও আধুনিক বাংলা গানের তকমা পায়নি। অথচ রবীন্দ্রনাথই বাংলা গানের মুক্তিদাতা, বাংলা গান আধুনিক হলো তাঁরই ছোঁয়ায়। ১৯৩০এ বেতার ব্যবস্থার শৈশবে ‘আধুনিক বাংলা গান’ কথাটা চালু করে ঢাকা বেতার কেন্দ্র। তার পর থেকে কলকাতা বেতারেও এই শ্রেণিভাগ চলে আসছে। ১৯৫০/৫২ নাগাদ আধুনিক গানের আর একটা শ্রেণি বিভাগ করে। তাদের নিজস্ব প্রযুক্তি ও স্টুডিওতে বেশ কিছু বাংলা গান রেকর্ড করেন যেগুলিকে বলতো ‘রম্যগীতি’ এবং সম্প্রসারিত হতো কলকাতা বেতারে ‘রম্যগীতির আসর’ নামে দুপুর ৩টা নাগাদ। স্মৃতি যতদূর যায়, মনে হয় বেতারে এই রম্যগীতির আসরটি সঞ্চালনা করতেন দীপালী নাগ।
কাব্যের লাবণ্যই বাংলা গানের আশ্রয়। অজয় ভট্টাচার্য, কমল দাশপ্ত, সলিল চৌধুরী, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আধুনিক কাব্য-মাধুর্যমাখা গান তো আছেই, তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান বাঙালির সঙ্গীত ভাণ্ডারের চিরকালীন গর্বের উপাদান হয়ে আছে। এবং নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথের পরে যার কাছে বাংলা গানের ঋণ সবচেয়ে বেশি। রবীন্দ্রগানের ঐশ্বর্যে বাঙালি মজেছিল তাঁর মৃত্যুর অনেক পর থেকে। তাঁর গানে মজে যেতে বাঙ্গালির এত দেরি হলো কেন, তা এক চিরকালীন ধন্দ। বাঙালি যখন থেকে রবীন্দ্রগানে মজে যেতে শুরু করলো তার অনেক আগেই নজরুলের কলম ও কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেছে। ১৯২৮ বাংলা গানের তখনও অপরিণত ভুবন, নজরুল পাকাপাকিভাবে এলেন গানের জগতে। অর্থের প্রয়োজনে গ্রামফোন কম্পানির মাসমাইনের চাকুরি নিতে হয়েছিল। ১৯৩৩এ প্রকাশিত ‘রুবাইত-ই-উমর খৈয়াম’ গ্রন্থের ভূমিকায় নজরুল লিখলেন “কাব্যলোকের গুলিস্তান থেকে সঙ্গীতলোকের রাগিনী দ্বীপে আমার দ্বীপান্তর হয়ে গেছে”। বাংলা গানে নজরুলের অবদান বিস্ময়কর। তাঁর গীত রচনার সংখ্যা প্রায় চার হাজার, তার মধ্যে রেকর্ড হয়েছে ১৭০০ গান। গানের সবক’টি শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল, গীত রচনা, সুর সংযোজন, গায়ন ও গায়নশৈলী নির্মাণ, ইসলামি গান, গজল (বাংলায় গজল গানের তিনিই প্রবর্তক) হাসির গান, শ্যামা সঙ্গীত, থিয়েটার ও সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনা, (এমনকি একটি চলচ্চিত্রে অভিনয়) সব। অথচ নজরুলের সক্রিয় সাঙ্গীতিক জীবন মাত্র ১৪ বছরের।
শৈশবে পিতৃ-মাতৃহীন নজরুলের সঙ্গীত শিক্ষার সূত্রগুলি, তাঁর সাঙ্গীতিক জীবন গড়ে ওঠার কিছুই জানা যায় না। সঙ্গীতের প্রথাগত শিক্ষা অর্জন করার কোনও সুযোগ নজরুল পাননি। লেটোর দলে ঘুরে বেড়ানো এবং শৈশব-কৈশোরের বাউন্ডুলে জীবনে বাংলার লোক আঙ্গিকের বিভিন্ন ধারার গান বাউল, ঝুমুর, পাঁচালী গান, টপ্পা ইত্যাদির সুর আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন, তার সব কিছুই বাংলা গানের ভুবনে উজাড় করে দিয়েছিলেন নিজেকে নিংড়ে দিয়ে।
নজরুলের গানের ভুবন ছিল স্বতস্ফূর্ততায় ভরপুর। পেটের দায়ে কাব্যলোক থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে গ্রামফোন কম্পানির দাসত্ব নেওয়ার জন্য তাঁর নিজের যন্ত্রণা বড় কম ছিল না। কবি বন্ধুদের অনেকেই তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন। এই সময় রবীন্দ্রনাথকে এক পত্রে নজরুল লিখেছিলেন “গুরুদেব, বহুদিন আপনার শ্রীচরণ দর্শন করিনি। আমার ওপর থেকে হয়তো প্রসন্ন কাব্যলক্ষ্মী হিজ মাষ্টার্স ভয়েসের কুকুরের ভয়ে আমায় ত্যাগ করেছেন। সুতরাং সাহিত্যের আসর থেকে আমি প্রায় স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিয়েছি। ... আমার এক নির্ভিক বন্ধু আমাকে উল্লেখ করে একদিন বলেছিল ‘যাকে বিলিতি কুকুর কামড়েছে তাকে আমাদের মাঝে নিতে ভয় হয়। সত্যি, ভয় হবারই কথা। তবু কুকুরে কামড়ালে লোকে নাকি ক্ষিপ্ত হয়ে অন্যকে কামড়াবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আমার কিন্তু সে শক্তি নেই, আমি হয়ে গেছি বীষ জর্জরিত নির্জিব”। সূত্র – অরুণ কুমার বসু / ‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’, পুরশ্রী পত্রিকা, জুলাই ১৯৯৯)। তবু নজরুল তাঁর ভেতরের বিষ জর্জরতার কোনও প্রভাব তার সঙ্গীত সৃজনে পড়তে দেননি। কন্ঠ স্তব্ধ হবার আগে, শেষের দিকে অর্থকষ্ট, পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্ত্রীর চিকিৎসার অর্থ জোগাড় করতে না পারার গ্লানি তাঁর অনাবিল ঝর্ণা ধারার মতো সঙ্গীত সৃজনে পড়তে দেননি বিন্দুমাত্র। ভিতরে ক্ষয় ধরলেও বাইরে তা প্রকাশ করেননি। বাংলা সঙ্গীত সৃজনের নিজস্বতায় রবীন্দ্রনাথের অবদান যতটা, ততটাই কাজী নজরুলেরও।
সঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রে ও সৃজন বৈচিত্রে রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি না থাকলেও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন ও রজনীকান্ত সেনের গানও বাংলা কাব্যসঙ্গীতের ভাণ্ডারের অক্ষয় সম্পদ হয়ে আছে। পরিতাপের কথা, এঁদের সুর রচনার সংরক্ষণে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ছিল না। আমাদের দুর্ভাগ্য দ্বিজেন্দ্রলাল ও রজনীকান্তর ৭৫ ভাগ গানেরই কোনও স্বরলিপি সংরক্ষিত হয়নি। তুলনায় অতুলপ্রসাদের গান অনেক বেশি গীত হয়েছে মূলত ব্রাহ্মসমাজের পৃষ্ঠপোষকতায়। দ্বিজেন্দ্রলালে গানের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক, যার অধিকাংশের সুরই সংরক্ষিত হয়নি, গায়কীও জানা যায় না। পত্নীর অকাল-প্রয়াণ, জীবিকার সঙ্গে তাঁর শিল্পসাধনার বিরোধ এবং সর্বোপরি পুত্র দিলীপকুমার যৌবনেই সাংসারিক জীবনের অন্তরালে চলে যাওয়া, বাংলা সঙ্গীতের ভাণ্ডারে তাঁর অসাধারণ সঙ্গীত সৃজনের সিংহ ভাগই সঞ্চিত হতে দেয়নি। রজনীকান্ত শুধু সঙ্গীত রচনাই করেননি, তিনি নিজে ছিলেন সুকন্ঠ গায়ক। তাঁর সঙ্গীতিক প্রতিভার সামান্যই সঞ্চিত আছে বাংলার সঙ্গীতভাণ্ডারে, রজনীকান্ত উকিল ছিলেন কিন্তু সফল ছিলেন না। আর্থিক অসাচ্ছল্য ছিল তার নিত্য সঙ্গী। তার ওপর দুরারোগ্য কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন মাত্র ৪৫ বছরের জীবনের শেষ একটা বছর, কথাও বলতে পারতেন না। বাংলায় ঠুংরি আঙ্গিকের সঙ্গীত রচনার প্রবর্তক অতুলপ্রসাদ সেনের দাম্পত্যজীবন সুখের ছিল না, যা তাঁর সঙ্গীত রচনায় প্রভাব ফেলেছিল। আজও, সেই সব সঙ্গীত রচনার শতাধিক বর্ষ পরেও যদি কারও কন্ঠে বা কোনও গৃহ থেকে ভেসে আসে ‘তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে’ (রজনীকান্ত), ‘কে তুমি বসি নদীকূলে একেলা’ (অতুলপ্রসাদ) কিংবা ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ গানগুলি ভেসে আসে তখন আমাদের থমকে দাঁড়িয়ে যেতে হয়।
গত শতকের চল্লিশের দশকে গণনাট্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আর একটি সঙ্গীত-ধারা সমৃদ্ধ করেছিল বাংলা কাব্যসঙ্গীতের স্বর্ণ সময়ে, তার পোষাকি নাম ‘গণসঙ্গীত’। কোন গান গণসঙ্গীত, কোনটা নয় -এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। প্রয়াত সলিল চৌধুরীর কথায় “শ্রমজীবি মানুষের আশা-আকাঙ্খ্যার ইতিহাস হলো গণসঙ্গীত”। হেমাঙ্গ বিশ্বাস স্পষ্ট করেছিলেন এভাবে –“স্বাদেশিকতার ধারা সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার সাগরে গিয়ে মিশেছে সেই মোহনায় গণসংগীতের জন্ম”। আবার কেউ বলেন ‘গণসঙ্গীত শুধুমাত্র সংগীতের একটি প্রবল ধারা নয়, গণসংগীত ধরে রাখে ইতিহাসের এক বিশেষ প্রতিবাদী পর্যায়’। গত শতকের চল্লিশ থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত সময়কালের বাংলা গানে অবশ্যই একটা নতুনতর মাত্রা যোগ করেছিল এই ধারার গান। সেই সময়কালে গুরুদাস পাল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নিবারণ পণ্ডিত, সলিল চৌধুরী, রমেশ শীল, দিলীপ সেনগুপ্ত প্রমুখ বাংলা গানের ভাণ্ডারে অনেক মণিমুক্ত রেখে গেছেন। সহজবোধ্য কারণেই গ্রামফোন কম্পানী এই ধারার গানকে বিপননযোগ্য মনে করেনি। স্মরণে আছে, ১৯৪৮ সালে গণনাট্য সঙ্ঘের সমবেত সঙ্ঘসঙ্গীত ‘এসো মুক্ত করো’ কলম্বিয়া লেবেলে রেকর্ড করেছিল। শুরুর পর্বে দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, প্রমুখ যশস্বী শিল্পীরা গণনাট্য সঙ্ঘের মঞ্চে সামিল হয়েছিলেন। চল্লিশের দশকটা ছিল এক উত্তাল সময়কাল, মানবতাধ্বংসি ফ্যাসিবাদের উত্থান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মন্বন্তরে নিরন্ন মানুষের হাহাকার, সেই সময়টা সাহিত্যে – কবিতা গান নাটকেরও মহাজাগরণকাল। ১০৪৬র ডাক ও তার ধর্মঘটের প্রেক্ষিতে সলিল চৌধুরীর অসামান্য সঙ্গীত সৃজন ‘রাণার’, যেটি পরে গ্রামফোন রেকর্ডে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন। এই গানটি শোনেননি এমন বাঙালি সম্ভবত এমন কেউ এই প্রজন্মেও নেই। ১৯৪৮ সলিল চৌধুরীর কালজয়ী সঙ্গীতসৃজন ‘কোন এক গাঁয়ের বধু’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর কবিতার সঙ্গীতায়ন ‘পালকীর গান’, তারপর একেরপর এক সলিল - হেমন্তর যুগলবন্দী ‘ধান কাটার গান’, ‘নৌকা বাওয়ার গান’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘ঠিকানা’, হেমন্ত-লতার দ্বৈত কন্ঠে ‘দে দোল দোল’, ‘বাদল কালো ঘিরলো গো’, সুবীর সেনের ‘ঐ উজ্জ্বল দিন’ এই সব গান গণসঙ্গীতের তকমা না নিয়েও লোকের মুখে মুখে ফিরেছে। বাংলায় গণসংগীত পুষ্ট হয়েছে সমাজ বদল ভাবনার ঐতিহাসিক প্রয়োজনে। গণসংগীত তার নিজস্ব শক্তিতে এখনও মানুষকে আন্দোলিত করে, পীড়িত মানুষের বেদনার কেন্দ্রে হাত রাখে, যুথবদ্ধ মানুষের আপন গান হয়ে ওঠে। গুরুদাস পাল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, ভুপেন হাজারিকা থেকে রুমা গুহ ঠাকুরতা, সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কয়ার গান কিংবা একালের কল্যাণ সেন বরাটের বৃন্দগান, কিংবা প্রয়াত নরেন মুখোপাধ্যায়, শুভেন্দু মাইতি, কঙ্কণ ভট্টাচার্য, প্রমুখের গান গণসঙ্গীত ধারাকেই পরিপুষ্ট করেছে। এইসব গানকে গণসঙ্গীত বলি আর না বলি, মানুষ যে গানে তার প্রাণের ভাষা আর সুর খুঁজে পায়, যে গান তার সংগ্রামী চেতনাকে স্পর্শ করে তাইই গণসঙ্গীত।
আমি সঙ্গীত-বেত্তা নই, গায়কও নই। শুধু দুটি কানের ভরসায় বিগত সত্তর বছরের গান শোনা আর গানকে ভালোবাসার সূত্রে গত শতকের চল্লিশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত বাংল গানের নানান পর্যায় নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণটিই প্রস্তুত করলাম, তার বেশি কিছু নয়। মোটামুটি মধ্য আশি পর্যন্ত চল্লিশটা বছর বাংলা গানের এই চালচিত্রটিই বজায় ছিল। এর পরের কথা বারান্তরে ‘গানের একাল – গানের আকাল’।
0 comments: