প্রবন্ধ
ভারতের দিদিভাই
সীমা ব্যানার্জী-রায়
“আগুনের রং লাল কেন-বাবা?”
বাবা স্যামুয়েল রিচমন্ড নোবল খুঁজে পেলেন না মেয়ের প্রশ্নের সঠিক উত্তর। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেনঃ “তুমি যখন আমার মতন হবে, তখন তুমি নিজেই পেয়ে যাবে তোমার প্রশ্নের উত্তর।”
উত্তর আইয়ারল্যান্ড থেকে বেশ কিছু দূরে একজন পুরোহিতের অনুগত ভক্তিমতী স্ত্রী খুব ভীত হয়ে পড়লেন তাঁদের প্রথম সন্তানের জন্মের সময় - এক আকস্মিক ভাবনা পেয়ে বসল তাঁকে---এই সন্তান বাঁচবে তো? তিনি মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করলেন সেই প্রথম সন্তান যেন সুস্থভাবে জন্ম গ্রহণ করে। তিনি সেই প্রথম সন্তানকে ঠাকুরেরই চরণে নিবেদন করবেন। সেই সন্তান নিবেদিত হয়েছিল মায়ের গর্ভে থাকাকালিনই। সেই মেয়েই পরবর্তী জীবনে ভগিনী নিবেদিতা নামে ভারতের পুণ্য মাটিতে নতুনভাবে জন্ম নিলেন।। আধ্যাত্মিক নারী সিস্টার নিবেদিতা পরিচিতা হলেন সন্ন্যাসী রাজা স্বামী বিবেকানন্দের পুণ্য সংস্পর্শে। আর ভারতের মাটিতে জন্ম হল সবার দিদিভাই-এর।
উত্তর আয়ারল্যান্ডের এক ছোট্ট শহর ডানগ্যানন(Dungannon) জন্মালেন এক অসাধারণ বিদুষী নারী। নাম মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল, ১৮৬৭ সালের ২৮শে অক্টোবর। বাবা স্যামুয়েল রিচমন্ড নোবল ছিলেন একজন ধার্মিক পুরোহিত আর মা ছিলেন মেরি ইসাবেল নোবল। ছোট্ট মেয়ে বাবাকে হারালেন মাত্র দশ বছর বয়সে। কাঁধের ওপর এসে পড়ল অনেক দায়-দায়িত্ব সেই অল্প বয়সেই। ছোট বেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত সাহসী আর আত্মপ্রত্যয়ী।
একটা ঘটনা তাঁর চরিত্রের এই দিকটা স্পষ্ট করে দেয় আমাদের কাছে...
অক্স্মাৎ পিতৃবিয়োগের পর ১৩ বছরের ফুটফুটে মার্গারেট মা, বোন আর ভাই-এর সাথে বাস করতেন। পারিবারিক স্বাচ্ছ্বলতা রাখার জন্য স্থির করা হল ৩ বছরের ভাই আয়ারল্যান্ডে দাদুর কাছে থাকবে। কিন্তু ভাইকে সেখানে কে পৌঁছে দেবে? পারিবারিক দায়-দায়িত্ব বজায় রাখার জন্য মা-র পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব ছিল না। অবশেষে এই গুরুদায়িত্বের অধিকারিণী হলেন মিস মার্গারেট।
জল, স্থল, অতিক্রম করে একটা ছোট্ট শিশুকে নিয়ে যাওয়া তখনকার দিনে কোন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পক্ষেও মোটেই সুখপ্রদ ছিল না। কিন্তু একটা স্কুল-পড়ুয়া মেয়ে সব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে ছোট শিশুভাইকে নির্বিঘ্নে আয়াল্যান্ডে দাদুর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই ঠাকুর হয়ত তাঁকে নির্বাচন করে রেখেছিলেন আর সব মহান মনিষীদের মধ্যে। যাঁরা অল্প সময়ের মধ্যে কোন মহান কাজের নিদর্শন রেখে ছিলেন বা রাখতেন। চরম পরীক্ষার মাধ্যমে ঠাকুর তাঁদের মানসিক শক্তির প্রেরণা জোগান ।
পড়াশুনা ভালভাবে করার জন্য চলে গেলেন হ্যামিল্টনে মামার বাড়িতে । হ্যামিল্টন তখন ফ্রীডম মুভমেন্টের এক নম্বর জায়গা ছিল।
পূর্বপুরুষ, বাবার অণুপ্রেরণা তার সাথে দাদুর শিক্ষায় তাঁর চরিত্র গঠিত হচ্ছিল সত্য, আধ্ম্যাতিক প্রেরণা, দেশপ্রেম। আর তার সাথে যুক্ত হয়েছিল রাজনীতির প্রভাব।
তিনি প্রথম স্কুলজীবন কাটান লন্ডনের বিখ্যাত ডিসিপ্লিনড চার্চ বোর্ডিং স্কুলে। অসাধারণ বুদ্ধিমতী মেয়ে ছিলেন । তিনি শুধু পড়ার বইয়ে ডুবে থাকতেন না, তার সাথে সাথে সমান ভাবে পরিচিত হচ্ছিলেন সাহিত্য, সঙ্গীত, আর্টস, ফিজিক্স এবং বটানি।
প্রাথমিক পড়াশুনা শেষ করেই মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি স্কুলশিক্ষিকা হয়েছিলেন অত্যন্ত মেধাবী হওয়ার জন্য। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজের স্কুল প্রতিষ্ঠা করে ছাত্রীদের নিজের আদর্শে গড়ে তুলতে লাগলেন। এই সময়-ই তিনি বিভিন্ন বিষয়ে লেখালিখি করে লন্ডনে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন। আধ্যাত্মিক জগতের প্রভাব এর বিশ্লেষণ করবার জন্য তিনি প্রচুর পড়াশুনা করলেন কিন্তু তাঁর আত্মাকে কিছুতেই তৃপ্ত করতে পারছিলেন না।
১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে, লন্ডনের এক শীতপ্রবণ সন্ধ্যায় স্বামী বিবেকানন্দ একজন বনেদি বাড়ির লেডি ইসাবেলের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলেন। স্বামীজি বৈঠকখানায় বেদান্ত ফিলোজফি বোঝাচ্ছিলেন। এখানেই মার্গারেট স্বামীজিকে প্রথম দর্শন করেন। নিমন্ত্রিতরা সাকুল্যে ১৫ জন ছিলেন। স্বামীজির সামনে সবাই অর্ধাকৃ্তি ভাবে বসেছিলেন। তিনি অভিভূত হয়ে গেলেন স্বামীজির বেদান্ত ফিলজফি শুনে। মোহিত হলেন দর্শন করে একজন সুদর্শন এবং শিশু-সুলভ সরলতাভরা উজ্জ্বল ভারতীয় সন্ন্যাসীর প্রতি। তারপর থেকেই তিনি স্বামীজির লন্ডনে থাকাকালিন সমস্ত ভাষণ আর প্রশ্ন-উত্তরের ক্লাসে যোগ দিতে শুরু করেন। প্রত্যেকটি ক্লাসের বিষয় খুব মনোযোগ সহকারে শুনতেন আর তার সাথে তিনিও নিজের আকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন রাখতেন। সেই সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে তিনি গভীরভবে চিন্তা করতেন। অবশেষে তিনি বুঝতে পারলেন এই ভারতীয় যুব সন্ন্যাসীই তাঁকে সঠিক পথে চালনা করতে পারবেন। তিনি তাঁকে গুরু মেনে নিলেন। স্বামীজিও তাঁর সততা, দৃঢ়চেতা, আর সবার চেয়ে বেশি আকৃষ্ট হলেন তাঁর দয়ালু মনের প্রতি।
স্বামীজি খুঁজছিলেন এইরকম একজন মহিলা যে তাঁর দেশের মেয়েদের উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে তাঁদের আত্মচেতনা আর যাতে তারা নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে সক্ষম হয়।
তিনি মার্গারেটকে তাঁর দেশে গিয়ে মেয়েদের শিক্ষা দানের জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। স্বামীজি লিখলেন তাঁকেঃ “আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, ভারতে তোমার ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। একজন মহিলার দরকার ভারতে-কোন পুরুষ নয়-একজন সত্যিকারের বাঘিনীর প্রয়োজন ভারতের কাজের জন্য। তোমার শিক্ষা, আন্তরিকতা, বিশুদ্ধতা, অসীম ভালবাসা, সংকল্প, সর্বশ্রেষ্ঠ তোমার মতন কেল্ট জাতির রক্তের অধিকারী নারীর প্রয়োজন আমাদের দেশের নারীদের।”
ভারতীয় ধর্মকে আপনার ধর্ম বলে আলিঙ্গন করলেন। ভারতবর্ষের কথা উঠলেই তিনি ভাবে বিভোর হয়ে উঠতেন। ভারতবর্ষ তাঁর ধ্যান ও তপস্যা ছিল। মেয়েদের বলতেন, 'তোমরা সকলে জপ কর, ভারতবর্ষ'! ভারতবর্ষ'! ভারতবর্ষ'!
সত্যসত্যি দিদিভাই ভারতকে হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করতেন। ভারতের সনাতন ধর্ম তাঁকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল।
তবে থেকে তিনি কখনও বলতেন না যে, “ভারতের প্রয়োজন, ভারতের মহিলা” উপরন্তু বলতেন “ আমাদের প্রয়োজন, আমাদের মহিলা”।
আমাদের লজ্জা তাঁকে আমরা এখনও “ বিদেশিনী” ভাবতে দ্বিধা বোধ করি না। এক গোছা গোলাপ ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে তিনি বলতেনঃ 'ভারতবর্ষ', 'ভারতবর্ষ', 'মা', 'মা'।
আমাদের পবিত্র সারদা মাঠাকুরাণি প্রায়ই বলতেন, “ খুকি এই দেশেরই মেয়ে। শুধু (ঠাকুরের) কথা প্রচারের জন্য সেইদেশে জন্মেছে।”
তার নারী চেতনা থেকে একটা উদাহরণ পাওয়া যায়ঃ
১৯০৬ খৃষ্টাব্দে তিনি অণুপ্রাণিত হন একজন নামকরা তামিল কবির( ভারতী সুব্রামানিয়া) জীবনী পড়ে।
দুজনের দেখা হয় শুধুমাত্র একবার একটা ছোট্ট সভায়। এই প্রথম কলকাতা কংগ্রেস সভায় -ই কবি ভারতী বুঝতে পারেন নিবেদিতা একজন মহান শক্তির অধিকারিণী। আলোচনা প্রসংগে জানতে পারেন আমাদের দিদিভাই যে, কবি ভারতী একজন বিবাহিত। দিদিভাই প্রশ্ন রাখলেন, “ আপনি কেন আপনার স্ত্রী-কে নিয়ে আসেন নি এই সভায়?”
-“ আমাদের সমাজে বিবাহিতা স্ত্রী-কে নিয়ে কোন জনসভায় যাওয়া যুক্তিযুক্ত নয়।”
দিদিভাই রাগে ফেটে পড়লেন। বললেনঃ “ আমার শুনে খুব খারাপ লাগছে যে, ভারতীয় পুরুষেরা মেয়েদের ঝি ছাড়া আর কিছু ভাবতে জানে না। আপনার শিক্ষার কি মূল্য আছে যেখানে আপনি আপনার স্ত্রীর মর্যাদা আপনার কাছে রাখেন না? কি হবে দেশমাতার স্বাধীনতার জন্য লড়ে যেখানে এই দেশেরই অন্যদিকের মা-এরা অন্ধকারে থাকে? আজ থেকে আপনি স্ত্রীকে আপনার চেয়ে আলাদা ভাববেন না। তাঁকে ভালবাসা দিয়ে আপনার পায়ে পা মিলিয়ে চলতে দেবেন।
কবি ভারতী শুনে অভিভূত হয়ে গেলেন। তিনি ক্ষমা চাইলেন দিদিভাই-এর কাছে আর প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি দিদিভাই-এর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন। তিনি দিদিভাইকে 'গুরুমা' করে নিলেন। সেইদিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত সবার কথ অগ্রাহ্য করে স্ত্রীকে সব রকম কাজে নিযুক্ত করেছিলেন এবং রাস্তায় স্ত্রীর হাত ধরে পায়ে পা মিলিয়েছেন। তাঁর মন থেকে জাতি, ধর্ম, ধর্মমত দূর হয়ে গেছিল। তিনি একজন নামকরা কবি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি দুখানা কবিতা দিদিভাই-কে উৎসর্গ করেছিলেন।
একটা বই-এর ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেনঃ “ I offer this little book at the feet of my Provider of learning who, by unfolding the spiritual vision of Mother India, infused in me the love for the Motherland, just as Sri Krishna by showing his Cosmic form to Arjuna conferred on him true self-knowledge.”
“নিবেদিতা সম্পর্কে একটা গুরুত্বপূর্ণ বাক্য লিখে গিয়েছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। লিখেছিলেন, নিবেদিতা ছিলেন বিবেকানন্দের উপসংহার। কিন্তু উপসংহার বলিয়া তিনি ঠিক বিবেকানন্দের প্রতিরূপ ছিলেন না।”
এত অল্প কথায় নিবেদিতাকে আর কেউ বোধকরি ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। এক অর্থে নিবেদিতার ভিতর তাঁর গুরু বিবেকানন্দের তার্কিক মননের অনেকটাই ছায়া পাওয়া যায়।
আমার মনে হয় আমাদের দিদিভাই ছিলেন ভারতের এক আদর্শ নেত্রী, ছিলেন সত্যিকারের যোদ্ধা। তাঁর রাগ ছিল জলের মত তার কোন রং-গন্ধ ছিল না। একবার অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক শ্রী মতিলাল ঘোষের সাথে কোন ব্যাপারে রাগারাগি হয় –তিনি অফিস ছেড়ে চলে যান। পরের দিন আবার ফিরে এসে শিশুদের মত হাসিতে ফেটে পড়েন । ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বলেনঃ “মতিবাবু, ইয়েস্টার্ডে আই ওয়াজ ভেরি দুষ্টু (naughty)।” এই রকম সরলতা মাখানো কথা শুনে মতিবাবুর দুচোখ জলে ভরে যায়।
তিনি ভারতের নারী-কল্যাণ, বিজ্ঞান, রাজনীতি, সাহিত্য, ভ্রমণ, ব্যায়াম, বাংলা ভাষা, শিল্প এই সমস্ত ব্যাপারে গুরুতররূপে নিজেকে উতসর্গ করেছিলেন। তিনি শুধু বেলুড়মঠের কাজেই নিজেকে ব্যপৃ্ত রাখেন নি।
১৭ই মার্চ , ১৮৯৮ তাঁর নিজের ডায়েরী“A day of days” -এ লেখেন এইদিন প্রথম তিনি শ্রী মা সারদা দেবিকে দর্শন করেন। স্বামীজির আরো দুজন ইউরোপীয়ান শিষ্যাদের সাথে তিনি মা-এর কাছে গিয়েছিলেন। মা তাঁকে সেইদিনি “আমার মেয়ে খুকী” বলে সম্বোধন করেছিলেন। মা নিবেদিতাকে নিজের হাতে তৈ্রী করে একখানা উলের পাখা দিয়েছিলেন। সেই পাখা পেয়ে তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান। একবার সেই পাখা মাথায় রাখেন তো একবার নিজের বুকে রাখেন। সেখানে উপস্থিত সবাইকে দেখাতে শুরু করেন “ কি সুন্দর, কি অদ্ভুত আমাদের মায়ের হাতের কাজ।
মা এইসব দেখে বলে উঠলেন, “কী অসাধারণ ভক্তি এই মেয়ের। এ তো দেবীর প্রতিমূর্তি। নরেনের প্রতি কি অসামান্য ভক্তি। কারণ নরেন জন্মেছে এই দেশে, তাই সে নিজেকেও সমর্পণ করেছে। গুরুর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা। এবং কত ভা্লবাসে এই দেশকে।”
আমরা মায়ের যে ছবিতে এখন পূজা করি সেই ছবি কিন্তু নিবেদিতা এবং অলি বুলের সাহায্যেই তোলা হয়েছিল। নিবেদিতা নিজে মাকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। মা খুব লজ্জা পাচ্ছিলেন। তাই প্রথম ছবিটায় মায়ের মুখ নীচু ছিল। মা ভেবেছিলেন ছবি তোলা হয়ে গেছে তাই যেই তিনি মুখ উঠিয়েছেন আর তাঁর ছবি তোলা হয় দ্বিতীয়বার। মা স্নেহের চোখে তাকিয়ে আছেন তাঁর খুকির দিকে... সেটা তোলা হয় মায়ের ৩য় ছবি হিসেবে। দিদিভাই-এর নির্দেশেই তোলা হয়েছিল প্রথম ছবি মা-এর। মার বয়স তখন ৪৫ বছর। সেই ছবি আজ ঘরে ঘরে পূজিত হয়।
২৫ নভেম্বর ১৮৯৮ স্বামীজির কাছে ব্রহ্মচর্য্যগ্রহণ করেন তিনি, আর তাঁর নাম হয় নিবেদিতা।
তিনি সন্ন্যাস কেন নেন নি? কারণ, তিনি স্বামীজির কাছে প্রশ্ন তুললে, স্বামীজি বলেছিলেন, “তুমি যেমন আছো তেমনি থাকো।” তাই সারাজীবন তিনি ব্রহ্মচারিণী হিসেবেই ছিলেন।
কি অসাধারণ গুরু ভক্তি। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে মনে হয়, গুরু তাঁকে পুরো ভারতমাতার জন্যই নিবেদন করেছিলেন।
তারপর থেকেই তিনি দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে প্রায়ই যেতেন। যখনই যেতেন, দীন-হীনভাবে প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। যদিও দেবীদর্শন করবার অধিকারে তিনি বঞ্চিতা ছিলেন।
তবুও তিনি রামকৃষ্ণ ঠাকুর, মা, এবং স্বামীজি্র একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। নিজের নাম স্বাক্ষর করবার সময় লিখতেন, 'Nivedita of Ramkrishna-Vivekananda.' দিদিভাই ইংরাজীতে ধর্ম ও শিক্ষাবিষয়ক বহু গ্রন্হ রচনা করেছেন। তন্মধ্যে-'The Master as I saw Him', 'Hints on Education', 'Kali the Mother', 'The Cradle Tales of Hinduism', 'An Indian Study of Love and Death', প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ধর্মের জন্য তিনি আজীবন তপস্যা করেছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই জীবনব্যাপী তপস্যাকে সতীর তপস্যার সাথে তুলনা করেছেন।
প্রথম ভারতে পৌঁছুবার অল্পদিন পরেই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর ছোট মেয়েকে ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য।
কিন্তু দিদিভাই স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, “ বিদেশী ভাষাশিক্ষা্র কী প্রয়োজন? নিজের দেশের প্রভাব, আচার আচরণ তো সবথেকে বড় বিদেশী শিক্ষার থেকে। আমি এ দেশে মেয়েদের ইংরাজি ভাষা বা আচার ব্যবহার শিক্ষা দিতে আসি নি। আমি অপারগ।”
পরেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে পুরাতন ভারতীয় ভাবনা ধারায় আশ্রম স্থাপন করেছিলেন।
কলিকাতার বোসপাড়ার একটা বাড়িতে তিনি বাস করতেন। সেই বাড়িতেই একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভারতের নারীদের সর্ববিধ শিক্ষাবিধান তাঁর জীবনের সংকল্প ছিল। এই সংকল্প অনুসারেই উক্ত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর মতে ত্যাগ ও প্রেমই ভারতবর্ষের শিক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ ফল।
প্লেগের সময় নিজের জীবন তুচ্ছ করে প্লেগ রুগীদের সেবা করেছিলেন। এবং অন্যান্যদের উৎসাহিত করেছিলেন। “ক্লাসিক থিয়েটার”-এর অডিটোরিয়ামে তিনি গুরু স্বামীজির সাথে একত্রে “প্লেগ এবং স্টুডেন্টদের কার্যপ্রণালী” বিষয়ে বক্তৃতা দেন। সেই বক্তৃতা শোনার পর সমস্ত স্টুডেন্টরা একজোট হয়ে সেবা কাজে নাম লিখিয়েছিল।
এই সমস্ত অসামান্য ঘটনাবলীর খবরাখবর গিয়ে পৌঁছায় তখনকার দিনের বিখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ আর জি কর -কাছে। ওনার কথায়ঃ
-একদিন চৈত্রের দুপুরে রুগী দেখে যখন বাড়ি ফিরছিলাম, দেখি একজন ইউরোপীয়ান ভদ্রমহিলা দরজার কাছে বসে আছেন। আমি কারণ জিজ্ঞাসা করতে জানালেন যে, সকালে আমি যে শিশুটিকে দেখে এসেছিলাম তার সুস্থতার জন্য কী কী দরকার। আমি বললাম, তার অবস্থা ভাল নয়। আর তিনি যেন নিজেকে সাবধানে রাখেন এই ছোঁয়াচে অসুখ থেকে। পরের দিন ছেলেটিকে দেখতে অবাক হয়ে গিয়েছিলামঃ গিয়ে দেখি সেই ছেলেটিকে কোলে নিয়ে বসে আছেন সেই মহিলা। তার মা আগেই মারা গেছেন। সেই স্যাঁতসেতে ঘর তিনি রং করেছেন নিজের হাতে। সেই ছেলেটি তাঁর কোলেই মারা যায়—তিনবার 'মা মা মা' ডেকে।
কোন রকম বিচার বিবেচনার ধার ধারেন নি তিনি।
স্বামী সারদানন্দের চিঠিতে জানতে পারেন স্বামীজির মহাপ্রয়ানের কথা। সেই রাতেই তৎক্ষণাৎ মঠে উপস্থিত হন। ভোর পর্যন্ত স্বামীজির মাথার কাছে বসে খুব আস্তে পাখা করেন।
তাঁর খুব ইচ্ছে হয় স্বামীজির গেরুয়া কাপড় থেকে এক টুকরো কাপড় নেবার জন্য। কিন্তু নিজের মনের কাছেই উত্তর রাখলেন, সেই কাপড় নিজের কাছে রাখা হয়ত ঠিক হবে না । আশ্চর্য্য তিনি যখন চিতার সামনে বসে ছিলেন দেখলেন শেষ চিতা নেবার আগে কোথা থেকে এক টুকরো কাপড় তাঁর হাতের কাছে এসে স্পর্শ করে । তিনি পরম শ্রদ্ধায় সেই কাপড়ের টুকরো নিজের কাছে রাখেন।
একদিন স্বামী সারদানন্দ এক গল্পের ছলে বলেন যে, “ ভারতীয় নারীরা অশিক্ষিতা ...নিবেদিতা তাঁকে পুরো বলতে না দিয়ে বলে উঠলেনঃ “ ভারতীয় নারীরা মোটেই অজ্ঞ নয়। পশ্চিম দেশে কি কেউ শুনেছে সারদা মা-র মতন নারীর কথা? না, নারীদের পূজা করা হয় পশ্চিমে?”
১৯০২ সালে পশ্চিম থেকে ফিরে এসে মাদ্রাসে তিনি এক বক্তৃতায় বলেছিলেনঃ “যারা ভাবেন যে, ভারতীয় নারীরা পাশবিক অচ্যাচারের শিকার। তা কিন্তু সত্য নয়। অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতীয় নারীদের উপর পাশবিক অত্যাচার অনেক কম। সুখ, সামাজিক প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে আমি বলতে পারি মহৎ চরিত্রের ভারতীয় মহিলারা জাতীয় জীবনের বৃহদাকার অধিকারের অংশীদার। যখন আমাদের এই সিদ্ধান্তে আনা হয় যে, ভারতীয় নারীরা অবহেলিতা, আমরা পৌঁছাই এমন এক দিগন্ত বিস্তৃত মিথ্যে যুক্তির সিদ্ধান্তে। তারা হয়ত বাহ্যা্নুষ্ঠানের অন্তর্ভূক্ত হতে পারেন নি। সেটা হয়ত বলা যায়, কেউ কেউ লিখতে পারেন, কিন্তু পড়তে পারেন মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন। মহাভারত, রামায়ন এবং পুরাণ-এর গল্প যে মা, দিদিমা, ঠাকুমারা শিশুদের শোনান এই বইগুলি কি সাহিত্য নয়? ইউরোপীয়ান উপন্যাস বা ম্যাগাজিন না পড়তে পারলেই কি ভারতীয় নারীরা অশীক্ষিতা? এই কথাগুলো আপাতবিরোধী সত্য তাই না?
আমার মতেঃ লেখাকে কালচার হিসেবে ধরা যায় না। যদিও এটা একটা কালচারের সাময়িক প্রভাব … যাঁরা ভারতীয় সমাজ জীবন সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল তাঁরা জানেন যে ভারতীয় মহিলারা শিক্ষা অর্জন করেন নিজেদের গৃহে- মর্যাদা, কোমলতা, পবিত্রতা, মিতব্যয়িতা, ধর্ম শিক্ষা, উত্তরাধিকারীদিগের কাছ থেকে মন এবং হৃদয় গঠন-যদিও তিনি নিজের নাম সাইন করতে পারেন না। আমার মনে হয় পিচ্ছিল সমালোচনার থেকে তাঁরা অনন্ত শিক্ষা এবং সাহিত্যে পারদর্শী।”
আমাদের দিদিভাই-এর উপরোক্ত কথাগুলি যে কতখানি সত্য তার প্রমাণের সাক্ষী আমি । আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছরের ঘটনাকে এখনও পশ্চিমের মানুষেরা ধ্রব সত্য হিসেবে মনে করে।
একটা ঘটনা থেকে আমি জানাই আজঃ
২০০২ সালে লুইজিনায় চাকরির সূত্রে এই ঘটনার সম্মুখীন হই। একই অফিসে কাজ করতাম দাদা, আমি আর আমার বড়ো ভাইঝি। একদিন আমরা তিনজনে অফিসে ঢোকার মুখে হঠাৎ শুনি আমাদের এ্যডমিনিস্টারের মুখে যে, দাদা কেন পিছনে? তিনি পড়েছেন বা জেনেছেন যে, ভারতে মেয়েরা সব সময় পেছনে থাকে। আমার ভাইঝি জবাবে বলে দিয়েছিল যে, “ আপনি যা জানেন -সেটা মোটেই সত্য নয়।” আর কিছু বলেন নি তিনি।
আরেকটা ঘটনায় জানা যায় তাঁর দয়ালু প্রাণে প্রাণীরাও স্থান পেয়েছিল। কারণ তিনি ঘোড়ার গাড়িতে চড়তেন না, ঘোড়াদের কষ্ট হবে ভেবে। গোলাপ মা একবার ওনার সামনেই একটা বেড়ালকে ঘাড় ধরে বাইরে ছুঁড়ে ফেলেন। তিনি তাই দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন। সীমিত বাংলা ভাষায় গোলাপ- মা কে বলেন “গোলাপ মা, মৃত্যু(death) মৃত্যু(death).”
ভারতের ভাস্কর্য, চিত্রকলা প্রভৃতি শিল্পের উপর দিদিভাই-এর সবিশেষ অনুরাগ ছিল। ভারতশিল্পের প্রাণ যে আধ্যাত্মিকতা তা তিনি বিশ্বাস ও অনুভব করতেন। কথিত আছে, বৈ্দেশিক চিত্রকরের অনুকরণে অঙ্কিত ছবি অপেক্ষা মেয়েদের হাতের অঙ্কিত আলপনা তাঁর বেশি আদরের সামগ্রী ছিল। একটি বালিকার অঙ্কিত শতদল পদ্মের ছবি তিনি নিজের ঘরে টাঙ্গিয়ে রেখেছিলেন। বিখ্যাত শিল্প সমালোচক ডাক্তার কুমারস্বামী একদিন তা দেখে খুব প্রশংসা করেছিলেন। বিদ্যালয়ে ইতিহাসের পাঠ দেবার সময় তিনি তন্ময় হয়ে যেতেন; রাতপুতরমণী পদ্মিনীর উপাখ্যান বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠতেন।
দিদিভাই ভারতের প্রায় সকল তীর্থেই ভ্রমণ করেছিলেন। এমনকি সুদূর বদরিকাশ্রম পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
১৯০১ সালে রয়াল সোসাইটি অফ লন্ডন স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর সমস্ত সায়েন্টিফিক রিসার্চ পেপার অগ্রাহ্য করে। কারণ তিনি পরাধীন দেশের নাগরীক। পরে আমাদের দিদিভাই-এর পরামর্শে এবং তাঁর পরিচালনায় স্যার বসুর তিনখানা পুস্তক প্রকাশিত হয়। দিদিভাই -এর চেয়ে দশ বছরের বড় হলেও তিনি স্যারকে “খোকা ' বলে ডাকতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্যারকে বলেছিলেনঃ “সিস্টার নিবেদিতার সাহায্য ছাড়া তিনি বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত হতেন না সারা বিশ্বে। স্যারের সব কাজে যেন দিদিভাই-এর নাম লেখা থাকে।” “বসু বিজ্ঞান মন্দিরে” দিদিভাই-এর ফলক আছে এবং দিদিভাই-এর অস্থির টুকরো উ্পরেই “বসু বিজ্ঞান” মন্দির স্থাপিত হয়।
দার্জিলিং-এ, ১৯১১ সালে ১৩ই অক্টোবর আমাদের দিদিভাই মহাপ্রস্থানে যাত্রা করেন । শেষ সময়ে তাঁর কাছে ছিলেন স্যার বসু এবং লেডি অবলা বসু।
“এমন দিদিভাই আর কজন আছেন?
তোমার মতন দিদিভাই...
কখনও বা জননী, কখনও শিক্ষিকা,
কখনও বা স্নেহময়ী দিদিভাই...”
আমার অনেকদিনের ইচ্ছে আজ কতখানি সম্পূর্ণ করতে পারলাম, আমার জানা নেই। স্কুলজীবনে একবার ভারতের শ্রেষ্ঠ এক নারীর সম্বন্ধে রচনা লেখার সময় প্রথমেই আমাদের সবার 'দিদিভাই'-এর নামটা আগে আমার মনে এসেছিল। কিন্তু তখন ছোট থাকার জন্য আর ওঁনার সম্বন্ধে কিঞ্চিত জ্ঞান থাকার দরুণ লিখতে পারি নি। ২০১২ সালে ডালাস দুর্গোৎসব পূজামন্ডপে স্বামী প্রভানন্দ মহারাজের লেখা বই “Nivedita of India” দেখেই কিনে ফেলি। আজ আমি আমার সামান্য জ্ঞান থেকে “ প্রিয় দিদিভাই” -কে নিয়ে লিখতে পেরে নিজেকে খুব কৃতার্থ মনে করছি। এই লেখায় যদি কিছু ভুলত্রুটি হয়ে থাকে, তাই সবার কাছে অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী। আর এই লেখা যদি পাঠক-পাঠিকার মনে কিঞ্চিত রেখাপাত করে, তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করব।
2 comments: