2

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয় 



শহরে শীত পড়বো পড়বো করেও কেমন যেন পড়ছেই না, কুয়াসাচ্ছন্ন শিশির ভেজা ভোর, বেলা বাড়তেই ত্বিষাম্পতির কঠোর শাসনে তড়িঘড়ি বেমালুম অন্তরীণ। একে কি আর শীত কাল বলে? আমি জানি, সুপর্ণা জানে শীতকাল কবে আসবে(-ভাস্কর চক্রবর্তী)... শিশিরেরা রাতভোর খেলা করে গাছের পাতায়, ঘাসের আগায়। পেলব পাপড়ির মখমল শরীরে শীতল বিন্দু শিহরণ জাগায়... তবুও অতিথি শীত আসে কই !!

এদিকে অতিথি অভ্যর্থনার সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ করে পায়ে পায়ে ঋতবাক পৌঁছল সংখ্যা পাঁচে। দেখতে দেখতে পাঁচ মাস... কতটা সাবালক হল, বিচার্য একমাত্র আপনাদেরই। 

ঋতবাক –এর পঞ্চম সংখ্যায় পড়ুন বেশ কিছু নতুন আঙ্গীকের লেখা। কেমন লাগলো, অবশ্যই জানাবেন। এই সংখ্যায় থাকছে প্রচ্ছদ নিবন্ধ, তিনটি প্রবন্ধ, একটি সরস নিবন্ধ, বিশেষ রচনা, সাতটি ছোটগল্প, দুইটি মুক্তগদ্য, বারোটি কবিতা, একটি অনুবাদ কবিতা আর বিশেষ আকর্ষণ দুইটি ভিন্ন স্বাদের ধারাবাহিক।

আশা করি, ভালো লাগবে। আপনাদের নিরন্তর শুভকামনা একমাত্র পাথেয়। সঙ্গে থাকবেন, ভালো থাকবেন, শুভেচ্ছা জানবেন।

নমস্কারান্তে

সুস্মিতা বসু সিং

2 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ : শ্রীশুভ্র

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ

বহুগামিতা ও পুরুষতন্ত্র!
শ্রীশুভ্র

আমাদের ধনতান্ত্রিক ভোগবাদী দুনিয়ার প্রেক্ষিতে আমরা ক্রমেই পেতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি! তাই প্রাপ্তির কোটা পুরোপুরি পুরণ না হলেই মনের মধ্যে জমে ওঠা ক্ষোভের বিক্ষুব্ধ বাষ্প, অসহিষ্ণু করে তোলে আমাদের! সেই অসহিষ্ণুতার অস্থিরতায় খেয়ালই থাকে না যে, আমার দেওয়ার কোটায় আর একজনের অপ্রাপ্তির ব্যাথা বেদনা রয়ে গেল কিনা! ফলে পারস্পরিক এই অসহিষ্ণুতার মল্লযুদ্ধে দাম্পত্যের ফাটল ক্রমেই প্রশস্ত হতে থাকে! তবু সমাজ সংসারের ঘেরাটোপে ভাঙ্গা সম্পর্ক নিয়েই নরনারী তাদের জীবন ধারণ করে চলে! মনের গহন গভীর অন্তরে তবু রয়ে যায় প্রেম! তবু এক হৃদয়ের প্রীতির আকাঙ্খা চেতন অবচেতনের দ্বন্দ্ববিধুর সংবর্তে স্বপ্ন বোনে মনের অজান্তে! 

আর সেই দমবন্ধ পরিবেশে হঠাৎ যদি খোলা হাওয়ার টাটকা ছোঁয়া নিয়ে এসে উপস্থিত হয় কোনো নতুন সম্পর্কের হাতছানি, মন হয়তো প্রথমেই পা বাড়ায় না, শরীর হয়তো বিবেক বুদ্ধির নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে পারে না নিজেকে; তবু কিছু ভালোলাগার টুকরো টুকরো ক্ষণিক মুহূর্ত্ত শরীর মনের অন্ধগলিতে বিদ্যুৎচমকের মতো শিহরণ তুলে যায়! শিহরিত সেই সব মুহূর্ত্তের ভালোলাগাগুলো বুনে বুনে গড়ে উঠতে পারে ভালোবাসার নতুন একটি সাঁকো! হয়তো তা মজবুত নয়, হয়তো অজানা আশঙ্কা, বিবেকবোধের পিছুটান, নতুন মানুষটি সম্বন্ধে আশা নিরাশার দ্বন্দ্বদোদুল দোলাচল, অনেকটাই নড়বড়ে করে রাখে ভালোবাসার সেই সাঁকোর ভিত্তি- তবু দাম্পত্যের ফাটলের ফাঁকে ঝুলতে থাকে সেই সাঁকো! 

একটু গভীর ভাবে তলিয়ে দেখলে দেখা যায়, সবকিছু বাদ দিলেও দিনের শেষে আমরা একটু আদরের প্রত্যাশী! আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো এই আদরটিই যেন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যায়! দাম্পত্যের অভ্যাসে সেই আদরের ঐশ্বর্য্যটুকুই যেন একটু একটু করে ক্ষয় হতে থাকে! প্রথমে কেউই টের পাই না! কিন্তু যখন টের পাই, অধিকাংশ সময়েই দেখা যায়, আদরের অনেকটা ঐশ্বর্য্যই ক্ষয় হয়ে গিয়েছে কখন! খেয়াল হয়নি আমাদের! খেয়াল হয়, যখন দুজনের মধ্যে কোনো একজনের জীবনে আদরের নতুন ঐশ্বর্য্য নতুন ছবি আঁকতে থাকে সম্পর্কের নতুন বিন্যাসে! সমাজ সংসার যে বিন্যাসকে নাক কুঁচকে বলবে বহুগামিতা! বহুগামিতার প্রধান স্তম্ভই কিন্তু আদরের ঐ উষ্ণতা!

বহুগামিতা মানুষেরই সহজাত প্রবৃত্তি, নাকি তাবৎ জীবকুলেরই সহজাত প্রবৃত্তি; সেটা অবশ্য বলতে পারবেন জীব বিজ্ঞানীরাই। আমরা যারা সাধারণ দিন আনি দিন খাই গোছের মানুষ, কিংবা মাসিক কারবারি, তারা অবশ্য বহুগামিতাকে সমাজ সংসার আইন আদালত চক্ষুলজ্জার দায়ে এড়িয়ে চলতেই অভ্যস্ত! সেটা যতটা না নীতিগত আদর্শের কারণে, তার থেকেও বেশি উপায়হীনতার কারণেই। কিন্তু যাদের উপায় অনন্ত! সমাজের তথাকথিত অভিজাত শ্রেণীর জীবকুল! সিনেমার হিরো হিরোইন সুপারস্টার মার্কা আইকনিক ফিগার? তাদের লাইফস্টাইলে একটু আধটু বহুগামিতার টাচ না থাকলে লাইমলাইটে থাকার সামান্য অসুবিধেই বুঝি ঘটে! বহুগামিতার গুজব- যে সুপারস্টারকে ঘিরে যত বেশি, তার জনপ্রিয়তার টি আর পি যেন ততই উর্দ্ধগতির হয়! অর্থাৎ সাধারণ জনগণের অবদমিত আকাঙ্খা প্রিয় স্টারদের ঘিরে কিছুটা তৃপ্ত হয়! বস্তুত আমাদের অধিকাংশ সাধারণ মানুষের মধ্যেই বহুগামিতার প্রতি একটি চোরা আবেগ সামাজিক সুবোধ পরিচয়ের আড়ালে সুপ্ত থেকেই যায়!

এই যে সামাজিক সুবোধ পরিচয়, আমরা অধিকাংশ মানুষই এইটির অধীনে নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে ভালোবাসি। তাই আমরা সাধু! কিন্তু সামাজিক সাংসারিক বেড়াজালের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে একটু আধটু সাহসী, কিছুটা শরমহীন হতে পারলেই আমাদের অবদমিত আবেগের যে বহিঃপ্রকাশ ঘটে না তা নয়। তবে সবটাই পর্দার আড়ালে, লুকোচুরির সেন্টের মৌতাতে! কিন্তু কেন এই লুকোচুরি? সামাজিক বিধিনিষেধের ঘেরাটপের জন্যেই তো? তা বিধিনিষেধ থাকলেই লুকোচুরিরই বা কি দরকার? বিধিনিষেধের লৌহকপাট ভেঙ্গে ফেলে লোপাট করলেই তো হয়! না! তা যে হয় না সেটা আমরা সবাই মানি। ঐ বিধিনিষেধটুকু না থাকলে আমাদের নিজেদেরই বিপদ! বিপদ কারণ, আমার প্রিয় মানুষটিও তো তখন সেই সুযোগটি নিতে দ্বিধা নাও করতে পারেন। অর্থাৎ নিজের জন্যে বহুগামিতার মৌতাতটুকু আমাদের অধিকাংশেরই আকাঙ্খার চোঁয়া ঢেকুড়ে জায়মান থাকলেও সেইটি আমাদের প্রিয়জনেদের ক্ষেত্রেও থাকবে- এইটি আমরা ভাবতেও পারি না! এ যেন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা! 

তাই আমাদের সমাজ সংসারে বহুগামিতাকে আমরা অনৈতিকতার তকমায় মুড়ে রেখে নিশ্চিন্তে নিদ্রা দিতে পছন্দ করি! আর মনের সঙ্গোপনে স্বপ্নের আলোছায়ায় তাকে লালন করি! এই যে দ্বিচারিতা এইটিই আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট! বিশেষতঃ বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর। বস্তুত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা আগারও খেতে যেমন ভালোবাসি, তেমনই গোড়ারও কুড়োতে ভালোবাসি, তবে লোকচোক্ষুর অন্তরালেই! সেটাই আমাদের স্বভাব ধর্ম। কিন্তু এইখানেই আরও একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় আমাদের, একটু যদি বিষয়ের গভীরে যেতে চাই। বহুগামিতার প্রতি এই যে সহজাত আকর্ষণ, এইটি কি নারী পুরুষ নির্বিশেষেই? আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সংসারে সামাজিক ভাবে নারী পুরুষের অবস্থানগত ফারাকটা কি আকাশ পাতাল নয়? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় আবিশ্ব সকল দেশেই পতিতালয়গুলি কি এই বহুগামীতারই চর্চাকেন্দ্র নয়? কিন্তু এইগুলিতে কাদের ভীড়, সে কথা আমরা সবাই জানি। তবে তো একথাই বলা যায়, বহুগামিতা মানুষের নয়, শুধুমাত্র এবং শুধুই পুরুষেরই সহজাত প্রবৃত্তি! নারীর বহুগামিতাকে প্রশ্রয় দেবার জন্যে তো আর পতিতালয় নয়! যদিও বিতর্কের নেশায় কেউ কেউ এই বলে কূটতর্ক জুড়ে দিতে পারেন যে, পতিতালয়ের যৌনকর্মীরা কি বহুগামী নয়? তারা কি প্রতিদিন একটিই খদ্দেরের সাথে ব্যাবসা করে চলে? তা তো নয়? তাহলে! তাহলেই তো কথাটা উঠছে, পতিতালয়গুলি যাদের দাক্ষিণ্যে রমরমিয়ে চলে, সেই পুরুষসম্প্রদায়ের অধিকাংশেরই ঘরসংসারে দাম্পত্য ভালোবাসার সুখী গৃহকোণ থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রবৃত্তির অভিমুখ পতিতালয়মুখী হলেও, অধিকাংশ যৌনকর্মীরই কোনো সুখী দাম্পত্য গৃহকোণ থাকে না। থাকলে পতিতালয়গুলি ফাঁকা পড়ে থাকতো! তাই আমাদের সমাজ সংসারে বহুগামিতা পুরুষেরই একটি রোগ! যাকে আমরা প্রবৃত্তি বলে দোষারোপের পরিসরটিকে কিছুটা হালকা করতে চাইছি! আবার অনেকে একথাও বলবেন, সভ্যতার ঊষালগ্নে সমাজ তো বহুগামিই ছিল! ছিল, কিন্তু সেটা কি কোনো সমাজ ব্যবস্থা ছিল আদৌ? না কি সমাজ সংসার গড়ে উঠেছিল বহুগামিতাকে পরিহার করার হাত ধরেই!

আর এইখানেই ইতিহাস আমাদেরকে আরও একটি ভয়াবহ সত্যের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়! বহুগামিতাকে পরিহার করার জন্যেই কি সমাজ সংসার গড়ে উঠেছিল? নাকি নারীকে পুরুষের অধীনে তার নিয়ন্ত্রণে বেঁধে ফেলার জন্যেই এবং সম্পত্তির ভোগসত্ত্ব পুরুষের এক্তিয়ারে ধরে রাখার জন্যেই সমাজ সংসার গড়ে উঠেছিল! অর্থাৎ বাহুবলে বলীয়ান পুরুষ তার সম্পত্তি ভোগবাদের ধারণায় নারীকেও একই সূত্রে বেঁধে ফেলার লক্ষ্যেই কি বহুগামিতার বিরুদ্ধে সমাজ সংসার গড়ে তোলেনি? তবে তো প্রশ্ন উঠতেই পারে, নারীকে বহুগামিতা থেকে আটকাতেই অন্যান্য সম্পত্তির মতোই তাকে নিজের এক্তিয়ারে বেঁধে ফেলার জন্যেই পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ সংসারের উৎপত্তি! আর তাই বহুগামিতার বিরুদ্ধে এত বিধিনিষেধের কড়াকড়ি।

সবটাই নারীকে নিজের অধীনে বেঁধে রাখার জন্যই। তাই বহুবিবাহ পুরুষের ক্ষেত্রে আজও কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায়ে প্রচলিত থাকলেও নারীর ক্ষেত্রে কোনো কালেই তা স্বীকৃত ছিল না! যারা এই প্রসঙ্গে দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চাইবেন, তাদের সবিনয়ে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে, সেই ঘটনা দ্রৌপদীর ইচ্ছাধীনে ঘটেনি! অর্থাৎ আমরা পুরুষরা বহু মহিলাতে আসক্ত হলেও সেটা চলে যায়, কিন্তু আমার গৃহলক্ষ্মী যেন দ্বিতীয় কোনো পুরুষের স্বপ্নও না দেখেন! দেখলেই পাপ! এই যে পাপ পূণ্যের ধারণা সেটাও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীকে অবদমিত রাখার কৌশল মাত্র! কিন্তু নারী! নারী কি পুরুষের মতোই বহুগামী? প্রকৃতি নারীকে যেমন দুহাত ভরে উজাড় করে সাজিয়ে দিয়েছে, ঠিক তেমনই নারীকে মতৃত্বের লক্ষণ রেখায় আবদ্ধ করে রেখেছে স্নেহ মায়া মমতার সৌকর্যে। পুরুষের গর্ভধারণ করতে হয় না বলেই তার পক্ষে বহুগামিতা যতটা রমণীয়, নারীর পক্ষে ততটাই অসুবিধেজনক। নারী তাই সহজাত ভাবেই একটি সুখী গৃহকোণের স্বপ্নেই বিভোর থাকতে ভালোবাসে আজীবন, সেখানেই তার নিশ্চিন্তি! এই নিশ্চয়তা, বিশেষতঃ আমাদের মতো অনুন্নত দেশে, যেখানে নারীকে স্বামীর খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্যে নির্ভর করতে হয়, নারী জীবনের প্রধানতম বিষয়! নারী তাই আত্মরক্ষার তাগিদেই বহুগামী হয়ে উঠতে পারে না সহজাত ভাবেই। আবার সেই আত্মরক্ষার তাগিদেই অবস্থাবৈগুণ্যে তাকে বাসা বাঁধতে হয় পতিতালয়েও! 

অর্থাৎ এইখানে অর্থনৈতিক স্বঅভিভাবকত্বের বিষয়টিই নারীর জীবনে প্রধানতম বিচার্য বিষয়! তাই সবাই অপর্ণা সেন বা তসলিমা নাসরীন হয়ে উঠতে পারেন না! আর তখনই বিতর্কবাদীরা নড়েচড়ে বসবেন! তবে তো এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজেই নারীরও বহুগামী হয়ে উঠতে বাধা নেই! আলোচনার শুরুতেই সেকথার উত্তর দেওয়া আছে! সমাজের অভিজাত শ্রেণীর পক্ষে যা সহজ শোভনীয়, সাধারণ জনজীবনে, সেইটিই চূড়ান্ত কঠিন ও সামাজিক লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় না কি? তাই বাস্তবতার ছবিটা স্পষ্ট দেখতে পেলে আমরা অনুধাবন করতে পারি আমাদের সমাজ সংসারে নারী পুরুষের অবস্থানগত বৈষম্য কতটা গভীর! এবং সেই বৈষম্যের হাত ধরেই নারী পুরুষের মানসিকতার পরিসরেও আকাশ পাতাল তফাৎ! তফাৎ তাদের সহজাত প্রবৃত্তিতেও! তাই বহুগামীতা পুরুষেরই সহজাত প্রবৃত্তি, নারীর নয়। অন্তত পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ ব্যবস্থার প্রতিদিনের বাস্তবতার পরিসরে!

কিন্তু বহুগামিতা কি শুধুই ঐ আদরের উষ্ণতা যেকথা দিয়ে শুরু করে ছিলাম আমরা! এবং যে আদরের কথা উঠছে, সে কতটা শারীরীক আর কতটাই বা মানসিক! সেই আদরের প্রয়োজন কি পুরুষের জীবনেই বেশিমাত্রায় প্রয়োজন নারীর তুলনায়? প্রশ্নগুলি আমাদের সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষিতে বেশ জটিল বলেই মনে হয়! প্রসঙ্গত প্রেম ভালোবাসা আদর, যৌনতৃপ্তি নারী পুরুষ সকলেরই জন্য সমান প্রয়োজন! লিঙ্গভেদে তার যে কোনো তারতম্য হয় না, সে কথা যেন আমরা কেউই অস্বীকার না করি! কিন্তু পুরুষতন্ত্র তার সংকীর্ণ স্বার্থজালে নারী ও পুরুষের জন্যে সামাজিক রীতি নীতির পার্থক্যের সুস্পষ্ট বিভাজন তৈরী করে রেখেছে! তার রূপরেখা দেশ কাল সমাজ ধর্মের প্রেক্ষিতে যতই ভিন্ন হোক না কেন! আর সেই বিভাজনের হাত ধরেই, আজও যৌনকর্মী বলতে সাধারণ ভাবেই নারীকেই বোঝায়! পৃথিবীর সকল দেশেই বেশ্যালয় থাকলেও, কোনো দেশেই পুরুষ যৌনকর্মীদের বেশ্যালয় গড়ে ওঠেনি! যদিও সাম্প্রতিক কালে পুরুষ যৌনকর্মীর সংখ্যাও ধীর গতিতে হলেও ক্রমবর্ধমান! এই চিত্রটি অন্তত কি উন্নত, কি অনুন্নত সকল দেশেই কম বেশি সমধর্মী। অর্থাৎ সেই সত্যই ঘুরে ফিরে আবারও ফিরে আসে, বহুগামিতার ক্ষেত্রটি পুরুষের জন্যে যতটা উন্মুক্ত, নারীর জন্যে তার সিকি ভাগও নয়! কিন্তু বহুগামিতা যদি আদরের উষ্ণতারই অন্যতম বহিঃপ্রকাশ হয় তাহলে তো তা নারীর জন্যেও সমান ভাবেই প্রযোজ্য! এমনকি তা যদি যৌনতৃপ্তির রাজপথও হয় তবুও তা নারী পুরুষ উভয়েরই জন্য সমান সত্য হওয়ারই তো কথা! কিন্তু সমাজবাস্তবতার চিত্র তো ভিন্ন কথাই বলে! আর বলে যে, সেকথা আমরা পূর্বেই আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি! আর এইখানেই শারীরীক কারণেই নারী পুরুষের থেকে অধিক রক্ষণশীল! যৌনতৃপ্তির একদিকে যেমন শরীর মনের উল্লাস থাকে, নারীর পক্ষে অপরদিকে ঠিক তেমনই রয়ে যায় অনাকাঙ্খিত মাতৃত্বের ঝুঁকি! যদিও বিজ্ঞানের হাত ধরে আজ সেই অসুবিধে অনেকটাই অপসৃত! কিন্তু কোনোকালেই পুরুষের পক্ষে এই ঝুঁকিটা না থাকার কারণেই বহগামিতা তার কাছে সহজাত একটি প্রবৃত্তি, যে কথা আমারা পূর্বেই উল্লেখ করেছি! দুঃখের বিষয় ঠিক এই কারণেই; পুরুষের এই বহুগামিতা প্রবৃত্তির প্রয়োজন মেটাতেই পৃথিবীর আদি ব্যাবসা বলতে নারীর দেহব্যাবসাকেই বোঝায়! এমনকি অনেকেই মনে করেন, এই ব্যাবসাটি আজও টিকে আছে বলেই; ঘরে ঘরে নারীরা তুলনামূলক ভাবে অধিকতর সুরক্ষিত! অর্থাৎ দুর্দমনীয় পৌরুষের এই বহুগামিতা আদতেই সমাজস্বীকৃত প্রথমাবধি! আর তখনই এই কথাও যেন সত্য হয়ে ওঠে যে বহুগামিতা মূলতই যৌনতৃপ্তি জাত একটি শারীরীক প্রক্রিয়া মাত্র! যে তৃপ্তির অধিকার সামাজিক ভাবেই পুরুষতন্ত্রে পুরুষের জন্যেই স্বীকৃত! কোনো নারী যদি সেই অধিকারের বলয়ে পা রাখতে প্রয়াসী হয়, তখনই সমাজে গেল গেল রব ওঠে! তখনই আমরা বহুগামিতার বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠি! এইভাবেই পুরুষতন্ত্র নারীর মাতৃত্বের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে বহুগামিতাকে পুরুষের জন্যেই সুরক্ষিত রেখেছে আবহমান কালব্যাপি।

1 comments:

0

সরস নিবন্ধ : স্বপন দেব

Posted in


সরস নিবন্ধ 

“সখী, ভালোবাসা কারে কয় !”
স্বপন দেব




আমার বউ কে নিয়ে আমার নিত্য ঝামেলা !! ১/২ বছর পর পর ই ওনার নতুন নেশা চাপে। উনি যখন নেশাগ্রস্তা থাকেন, তখন আমিও পরম শান্তিতে থাকি ! তবে বিপদ হচ্ছে ঐ নেশার ঘোরটি কেটে গেলেই ! তখন থেকে আবার নতুন কোন নেশার খপ্পরে পড়ার আগে অবধি আমার জীবন অতিষ্ঠ করে ছাড়েন ! 

ব্যাপারটা খুলেই বলি। মানে, এবারের ব্যাপার টা। ইউ এস এ থাকাকালীন উনার নেশা চাপে ডারউইন এবং বিবর্তনী মনোবিজ্ঞান আর বিবর্তনী জীব বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার ! সে যাই হোক, কেউ পড়াশোনা করতে চাইলে তো বলার কিছু নেই ! কিন্তু মুস্কিল হোল, আমার ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট করে উনি প্রতি সপ্তাহেই আজ ডেভিড বুস (David Buss) তো কাল হেলেন ফিশার (Helen Fisher), পরশু জেফ্রী মিলার (Geoffrey Miller),পরের সপ্তাহেই আবার রবিন বেকার (Robin Baker) এবং আরো প্রায় গোটা পাঁচেক বই আমার হাজার পনেরো টাকা খরচা করিয়ে সকালে, দিনে, বিকেলে, রাতে এবং গভীর রাতেও সেগুলি ঘাঁটাঘাঁটি করতেন। তবে পড়তেন কিনা আমি জানিনা ! আসার সময়েও দেখেছিলাম ফ্লাইটে উনি গভীর মনোযোগ দিয়ে লীডা কসমীডস (Leda Cosmides) এর একটি বইএর পাতা ওল্টাচ্ছেন ! 

সে যাই হোক, দেশে ফিরে হপ্তা খানেক সুখেই ছিলাম। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে নতুন উৎপাত ! দিন পনেরো আগে, সকালে উঠে অ্যামেরিকান স্টাইলে চীজ স্যান্ডউইচ এ একটা কামড় দিয়ে এফ এম টা খুলে “সখী, ভালোবাসা কারে কয় ?” গানটা শুনতে শুনতে কফির কাপে আলতো চুমুক দিয়েছি মাত্র, বউ এসে ঘচাং করে রেডিও টা বন্ধ করে দিল ! কি হোল আবার ? ওই বস্তাপচা নেকু নেকু গান শুনতে এখনো ভালো লাগে তোমার ? মেজাজ টা ধাঁ করে চড়ে গেল ! জলদ-গম্ভীর স্বরে বললাম, ওটা রবি ঠাকুরের গান। জানো ? জানবো না কেন ? আর শুধু তোমার রবি ঠাকুর নয়, প্রায় এক ই সময়ে মার্কিন গীতিকার কোল পোর্টার ও এক গানে জিগ্যেস করেছিলেন, প্রেম জিনিষ টি কি ? “What is this thing called love?”। তাহলে ? সবাই তো জানতেই চায়, প্রেম কি? সবাই নয়, তোমার মত কিছু মুখ্যু যারা এখনো সেই উনবিংশ শতাব্দীতে পড়ে আছে, তারাই এখনো প্রেম কি ? ভালোবাসা কারে কয় ? প্রশ্ন করে যাচ্ছে ! তোমার লজ্জা করেনা ? ঝগড়া করার মুডটা ফুটন্ত জলে ফেলা তিন মিনিটের ম্যাগি নুডুলের মত কিলবিল করে উঠলো ! কেনো ? 

একবিংশ শতাব্দীর মানুষ কি জেনে গেছে ভালো বাসা কারে কয় ? বেশ ঝগড়াটে মুখে চোখ বড় বড় করে জিগ্যেস করলাম ! একবিংশ নয়, বিংশ শতকের শেষ দুই দশকেই সমাজজীববিজ্ঞানীরা আর বৈবর্তনিক মনোবিজ্ঞানীরা এর রহস্য সমাধান করে ফেলেছেন ! বউ এর পালটা জবাব। ও তাই? বেশ ! বেশ ! এবার তাহলে দয়া করে তুমি ই বলে দাও প্রেমের সংজ্ঞা কি ? প্রেম একটা অনুভূতি। অনুভূতির সংজ্ঞা হয়না। তুমি কি বলতে পারবে সবুজ রঙের সংজ্ঞা কি ? তবে ডারুইনের “প্রজাতির উৎস (Origin of Species)” আর “মানুষের উৎপত্তি (The Descent of man)” বই দুটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আজ অবধি ডারুইনের সেই মূল তত্ত্ব কে সাক্ষ্য-প্রমাণ আর পর্যবেক্ষণ লব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে পরিশীলিত ও সংশোধিত করে মানব প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টায় জীব্বিজ্ঞানীরা অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। প্রেম কি ? মানব নৈতিকতার উৎস কি, বহুগামীতার কারণ কি ? ইত্যাদি সনাতন প্রশ্নের উত্তর এখন অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে এসেছে সমাজজীববিজ্ঞানী আর বিবর্তনী মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণার দৌলতে। এ সবের কোন খবর ই তো তুমি রাখোনা ! চব্বিশ ঘণ্টা খালি ফেসবুক আর গ্রুপ-মিট নিয়েই পড়ে আছো ! হুম, এবার বুঝলাম ! আর বুঝে ভয়ে কাঁটা হয়ে রইলাম! কারণ, বিগত পাঁচ মাসে ঐ বইগুলো থেকে তিনি যা গিলেছেন সেগুলি এখন আমার গায়ে উগড়োবেন ! মিনমিন করে বললাম, অনেক তো হোল, এবার একটু কফি ব্রেক হলে হয় না ? 

সাময়িক বিরতি। আমি প্রভাতী কাগজের পাতায় সবে মনোনিবেশ করেছি, ঠক করে এক পেয়ালা কফি আমার সামনে বসিয়ে দিয়ে তিনি আবার শুরু করলেন ! তুমি কি জানো, তাঁদের গবেষণা মানব অনুভূতির সকল দিকেরই কারণ হিসেবে আমাদের বৈবর্তনিক ইতিহাসের দিকেই আঙ্গুল দেখায় ? অন্য সব অনুভূতির মত প্রেমানুভূতি বা বহুগামীতার মূল ও কিন্তু এই বিবর্তনে নিহিত। তাহলে তো ল্যাটা চুকেই গেলো ! তোমার এই বকবকানিও কি বিবর্তনে নিহিত ? থলি টা দাও বাজারে যাই। থাক ! আর বাজারের দোহাই দিতে হবেনা ! বাজারে গিয়ে তো আনবে কিছু চুনো মাছ, কাঁচালঙ্কা আর ধনে পাতা ! একদিন আলুসেদ্ধ ভাত খেলে তুমি মরে যাবেনা ! কিন্তু এগুলো না জানলে তোমায় নিয়ে আমি শিক্ষিত সমাজে যাবো কি করে ? শুরু হোল আবার আমাকে শিক্ষিত করার পালা ! 

এতোক্ষণ ডিফেন্সিভ খেলছিলাম। ভাবলাম এবার একটু অফেন্সিভ খেলে দেখলে কি হয় ? তাই জিগ্যেস করলাম, বিবর্তন তো বুঝলাম। কিন্তু,সখী, ভালো বাসা কারে কয় এর উত্তর তো পেলাম না এখনো ! প্রেমানুভূতি বা বহুগামীতার মূল উৎস বা কারণ কি ? আমি কিন্তু আর বিবর্তনের ব্যাখ্যা শুনতে রাজী নই ! বউ এবার একটু দুষ্টু মিষ্টি হেঁসে বলল, উত্তর টি কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সরল। বংশানু উদ্বর্তনের( Survival of the Genes ) তাগিদ ই প্রেম ও বহুগামীতার আদি কারণ। বৃহত্তর চিত্রে এই বংশানু উদ্বর্তনের তাগিদ প্রাকৃতিক নির্বাচন ( Natural Selection ) ও পরিব্যক্তি ( Mutation )র সমণ্বয়ে বিবর্তনের প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে যা শুধু প্রেমুনুভূতি ই নয় মানুষের সব অনুভূতি ও আচরণের জন্ম দেয়। আরে বিবর্তন বিবর্তন করে তো তুমি সকাল থেকে আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছো ! কে বলেছে তোমায় এইসব ফালতু কথা ? কে বলেছে ? দাঁড়াও ! এরপরে উঠে ঘরে যাওয়া, ত্রস্ত পায়ে ফিরে আসা একটি মোটা বই নিয়ে। বইএর মলাট দেখে বুঝলাম এটা জীববিজ্ঞানী লীন মার্গুলিসের লেখা “ Mystery Dance: On the Evolution of Human Sexuality” বউ এটার ৪৬ পৃষ্ঠা খুলে একটা জায়গা দেখিয়ে বলল পড়ো ! “ All our desires, passions etc, reflect inanimate tendencies already implicit before life in the second law of Thermodynamics”। অর্থাৎ,আমাদের সকল কামনা বাসনা আবেগ ইত্যাদি এক অজৈবিক প্রবণতার প্রতিনিধিত্ব করে যা প্রাণ সৃষ্টির পূর্বেই তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রে প্রচ্ছন্ন আছে। তাহলে, প্রেম বা বহুগামীতা কি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি না নিছক ই মানব-সংস্কৃতি বা সভ্যতা প্রসূত একটা ধারণা মাত্র ? বিবর্তনের হাত থেকে বাঁচতে আমি আবার মৌলিক প্রশ্নে ফিরে গেলাম। বলছি। তার আগে ভাত টা চাপিয়ে দিয়ে আসি দাঁড়াও। 

যাক, কিছুক্ষণের জন্যে রেহাই পাওয়া গেল। তবে সেটা মাত্র ঘণ্টা খানেকের। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে গৃহিণীর পুনরাগমন ! না, শুধু বিবর্তন ই নয়। গবেষণায় দেখা গেছে –বিবর্তন,জীববিজ্ঞান ও রসায়ন বিদ্যা এই তিনটে শক্ত ভিতের উপরেই প্রেম বা বহুগামীতা নামক তাঁবুটির বাস। সেরেছে ! 

এতক্ষণ বিবর্তন আর জীববিজ্ঞান ছিল। এখন আবার তার সঙ্গে রসায়ন যোগ করলে ? হ্যাঁ, আফ্রিকান সমভূমিতে আজ থেকে প্রায় চল্লিশ লাখ বছর আগে প্রথম মস্তিষ্ক থেকে এক বিশেষ ধরনের নিউরো-কেমিক্যাল ক্ষরণ হয়।নারী ও পুরুষ এরই প্রভাবে একে অন্যের দিকে তাকায়। ঘামতে থাকে হাতের তালু, আঙ্গুল, ত্বকে রক্তিম আভা, দ্রুত নিশ্বাস প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয়। জন্ম হয় এক নতুন অনুভূতির। যার নাম প্রেম। বুঝলে কিছু ? বউএর জিজ্ঞাসু প্রশ্নের উত্তরে বললাম,হ্যাঁ বুঝলাম ! আচ্ছা দেখতো আমার মুখ টা কি লাল হয়ে গেছে ? আমার হাতের তালু আর আঙ্গুল কিন্তু ঘামছে ! নিঃশ্বাস ও খুব দ্রুত পড়ছে ! তাহলে কি আমি আবার নতুন করে তোমার প্রেমে পড়লাম ? না। আসলে আমি আর কতক্ষণ তোমায় জ্বালাবো এটা ভেবেই তোমার উৎকন্ঠা বাড়ছে ! 

আসলে প্রেম আর উৎকণ্ঠার বাহ্যিক প্রকাশ মোটামুটি এক ই রকম। এর জন্যে দায়ী এম্ফেটামাইনের সমগোত্রীয় কিছু রাসায়নিক। যার মধ্যে নাম করা যায় – জেপ্যামিন, নরএপিনেফ্রিন আর বিশেষ করে ফিনাইল ইথাইল এমিন( PEA) ইত্যাদির। যাক, তুমি যখন বুঝেছো যে আমার উৎকণ্ঠা বাড়ছে, সেই সঙ্গে রক্ত-চাপ ও তখন একটু রেহাই দাও লক্ষ্মী-সোনা ! স্নান খাওয়া করে আবার তোমার গল্প শুনব ! বউ এবার সদয় হোল ! সত্যি গো, তোমার মত মুখ্যু কে এত কথা একসঙ্গে বললে তোমার কিছুই মনে থাকবেনা ! তুমি বরং স্নান খাওয়া করে একটু ঘুমিয়ে নাও। আমি সন্ধ্যায় আবার তোমার ক্লাস নেব ! বলির পাঁঠাকে যেমন স্নান করিয়ে ঘাস খাইয়ে তারপর ঘচাং করে কাটে, আমিও তেমন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ই স্নান খাওয়া সেরে মটকা মেরে বিছানায় শুয়ে রইলাম। 

বিকেলে আমি রোজ ই বাড়ীর চারপাশে একটা চক্কর মারি। আজ গিয়ে চুপ করে একটা পার্কে বসে সময় কাটালাম। তারপরেই এল সেই ভয়ঙ্কর সন্ধ্যা !! আমার ক্লাস শুরু !! তোমার মনে আছে, আমার প্রেমে তুমি যখন হাবুডুবু খাচ্ছিলে তখন একদিন আমায় জড়িয়ে ধরে গেয়েছিলে, “আমার ও পরাণ যাহা চায় ?” গেয়েছিলাম বুঝি ? সে কত যুগ আগের কথা। সব কি মনে আছে ? আসলে সেটা ছিল তোমার ফিনাইল ইথাইল এমিন ( PEA )এর নেশা ! তবে এই PEA নেশা অনন্তকাল থাকেনা। যে কোন এমফেটামিনস এর মতই এই কেমিক্যাল ও শরীরের সঙ্গে টলারেন্স-ডিপেন্ডেন্স এর খেলা খেলে। ক্রমশ শরীরে এই PEA টলারেনস তৈরি হয়। তিন চার বছরের মধ্যে শরীরে PEA টলারেন্স এতোটাই বেড়ে যায় যে, রোমান্টিক প্রেম জাগাতে যতটা পরিমাণ PEA দরকার শরীর আর তা তৈরি করতে পারেনা। ফলে প্রেমের অনুভূতি আর আগের মত তীক্ষ্ণ থাকেনা। ফলে নতুন প্রেমের স্বাদ পেতে অনেকেই ছুটে বেড়ান নির্দিষ্টতার সম্পর্ক থেকে আর এক সম্পর্কে, স্থান থেকে স্থানান্তরে। এর ই নাম বহুগামীতা। 

মানে ? তুমি কি আমায় এবার বহুগামী অপবাদ দেবে ? আমি দিচ্ছিনা, এঁরা দিচ্ছেন ! এঁরা কারা ? এইযে জীববিজ্ঞানী মেরেডিথ স্মল তাঁর Whats love got to do with it ? বইএর ১৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “ এটা প্রতীয়মান যে নারী এবং পুরুষ কেউই জীবতাত্বিক ভাবে একগামিতার জন্য তৈরী নয়”। প্রাইমেটবর্গের ( যার মধ্যে মানুষ ও অন্তর্ভুক্ত ) ২০০ টি প্রজাতির মধ্যে মাত্র ১৪ শতাংশ একগামী। ও ! একা মেরেডিথ কি বলেছেন সেটাই মেনে নিতে হবে বিনা বাক্যব্যয়ে ? জবাবে বউ যে বিশাল বইটা নিয়ে এলেন,হার্ডকভারে বাঁধানো বই টা আমার মাথায় ছুঁড়ে মারলে ফেটে চৌচির হয়ে যাবে !এলিসন রজার্স এর বিশাল গবেষণা গ্রন্থ “ Sex: A Natural History” এর ৩৩৮ পাতায় লিখেছেন, মানুষ অন্তত ১০০% একগামিতা বা ১০০% হারেম প্রথা, কোনটার জন্যেই পরিকল্পিত হয়নি। শোন, তোমার ঐ PEA এর গল্প যদি সত্যি হয় তাহলে তুমি আর আমি একসঙ্গে ৪১ টা বছর কাটালাম কি করে ? আমি এবার ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলাম ! 

বলছি। তার আগে তোমার জন্যে কটা লুচি আর আলুছেঁচকি বানিয়ে আনি !বউ এবার সদয় হয়ে রান্নাঘরে ঢুকল আর আমি ঢুকলাম ফেসবুকে ! ডিনার টেবিলে ডাক পরলো ঘণ্টা খানেক পরে। ফুলকো লুচি আর আলুছেঁচকির সদ্ব্যবহার করে আমি বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। আধঘণ্টা পরে বউ এসে পাশে শুয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে বলল, ঐ PEA পর্বটা শেষ হওয়ার আগেই আমরা বিয়ে করে নিয়েছিলাম যে ! পাকাপাকি ভাবে একজনের সাথে বাস করলে সেই সঙ্গী বা সঙ্গিনীর ক্রমাগত উপস্থিতি মস্তিষ্কে এনডরফিন জাতীয় এক রাসায়নিকের ক্ষরণ নিশ্চিত করে। এই জাতীয় রাসায়নিক আনন্দের তুবড়ি না ফোটালেও এক শান্ত, সমাহিত, নিশ্চিন্ত, নিরাপদ ভাব সৃষ্টি করে। বলা যায়, এগুলি প্রাকৃতিজ যন্ত্রণা নিবারক। দম্পতিদের মধ্যে একে অপরকে ছেড়ে গেলে বা একজন মারা গেলে এই এনডরফিনের ক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দূর্বিষহ হয়ে ওঠে জীবন। 

আচ্ছা, তুমি যে এত পড়াশুনো করলে তা বলতো এই মুহুর্তে মানুষ বহুগামী না একগামী ? আমার মতে, মানুষ এখন মূলত একগামী, তবে গোপন ব্যভিচার সহ !

0 comments:

1

প্রবন্ধ : অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

Posted in


প্রবন্ধ 


আইনের সিঁদুরবিন্দু 
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী 



ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা নং ৪৯৭। পৃথিবীর আর কোন দেশের দণ্ডবিধিতে এই একবিংশ শতাব্দে এমন চিত্তাকর্ষক দ্বিতীয় কোন ধারা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কেন চিত্তাকর্ষক সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বরং যে অপরাধের শাস্তির জন্যে এই ধারাটি বরাদ্দ সেই অপরাধটি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। 

ইংরাজিতে অপরাধটিকে বলে adultery। ল্যাটিন adulterium থেকে আগত এই ইংরাজি শব্দটির অর্থ হল, কোন বিবাহিত ব্যক্তির নিজ স্বামী বা স্ত্রী ব্যতীত অন্য ব্যক্তির সঙ্গে স্বেচ্ছাকৃত যৌনসংগম। বিবাহিত ব্যক্তিটি পুরুষ হলে তিনি adulterer, মহিলা হলে তিনি adulteress। নিজের এই অনুবাদটির ওপর ভরসা না করে আমি অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ, দুটি অভিধান থেকেই adultery শব্দটির অর্থ তুলে দিচ্ছি: 

1. Voluntary sexual intercourse of married person other than with spouse [Oxford]. 

2. Sex between a married man or woman and someone who is not their wife or husband [Cambridge]. 

ভারতবর্ষ বাদে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের আইনি পরিভাষা(law lexicon)-য় এই শব্দটি উল্লিখিত অর্থে গৃহীত হয়েছে। বাংলা ভাষায় এই শব্দটির যথার্থ প্রতিশব্দ নেই। ‘ব্যভিচার’ শব্দটি এই অর্থে আমরা ব্যবহার করে থাকি ঠিকই, কিন্তু ‘ব্যভিচার’ শব্দের আভিধানিক অর্থ অনেক বিস্তৃত। সেখানে যে কোন ধরনের অনাচারকেই ব্যভিচার বলা হয়; যৌন অনাচারের ক্ষেত্রে ‘বিবাহিত/বিবাহিতা’ ও ‘অবিবাহিত/ অবিবাহিতা’র কোন ভেদ এই অর্থের মধ্যে অনুপস্থিত। ‘পরকীয় গমন’(‘পরকীয়’ উভয় লিঙ্গার্থে ধরে) বললে বরং adultery শব্দের সঠিক অর্থটি পাওয়া যায়। 

বিভিন্ন দেশের দণ্ডবিধির প্রসঙ্গে আসার আগে আমি law lexicon -এ গৃহীত adultery -র সংজ্ঞাটি উল্লেখ করছিঃ 

Adultery is voluntary sexual intercourse between a married person and someone other than the lawful spouse. 

অর্থাৎ, আভিধানিক ও আইনি – দুটি অর্থেই পরকীয়গামী (adulterer) তিনিই যিনি বিবাহিত হয়েও নিজের স্ত্রী ব্যতীত অন্য মহিলার সঙ্গে যৌনসংগম করেছেন বা যিনি অন্যের স্ত্রী-তে উপগত হয়েছেন। আবার, পরকীয়গামিনী (adulteress) তিনিই যিনি বিবাহিতা হয়েও নিজের স্বামী ব্যতীত অন্য পুরুষের সঙ্গে যৌনাচার করেছেন বা যিনি অন্যের স্বামীর সঙ্গে যৌনসংগম করেছেন। 

শব্দার্থ বা বাক্যার্থ নিয়ে এতখানি পরিসর খরচ করার উদ্দেশ্য একটাই – দণ্ডবিধিতে এই কার্যটিকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসাবে গণ্য করার অন্তর্নিহিত মূল নীতিটি খুঁজে বের করা। আশা করি এতক্ষণে বোঝা গেছে যে অপরাধটি মূলত বিশ্বাসভঙ্গের। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘বিবাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানটির পবিত্রতা রক্ষা করা। একদিকে ধর্মীয় ও নৈতিক বিচার, বংশধারা ও উত্তরাধিকারের বিশুদ্ধতা, অন্যদিকে মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ও ব্যক্তি স্বাধীনতা – এই দুই টানাপড়েনে বিষয়টি জটিল ও তর্কসাপেক্ষ। এ নিয়ে বিশদ আলোচনা এই নিবন্ধে অপ্রাসঙ্গিক। তবুও এটি উল্লেখ করার হেতু এই যে, এই বিতর্কের কারণেই যুক্তরাজ্য সমেত ইউরোপের সব দেশগুলিই গত শতাব্দের মাঝামাঝি থেকে তাদের দণ্ডবিধি থেকে ‘পরকীয়গমন’-কে রেহাই দিয়েছে। ওই দেশগুলিতে তা এখন ব্যক্তিক অপরাধ (personal offence) মাত্র। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আজও এই বিতর্কের মীমাংসা হয়নি। ফলে সে দেশের ২৩টি রাজ্যে এখনও ‘পরকীয়গমন’ আইনত দণ্ডার্হ অপরাধ। তবে সেই সব রাজ্যের দণ্ডবিধিতে এটি বিবাহের অনেকগুলি চুক্তির মধ্যে যে চুক্তিটি ভঙ্গের অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয় তা হল দম্পতির পরস্পরের প্রতি একনিষ্ঠ যৌনতায় আবদ্ধ থাকার চুক্তি। তৃতীয় কোন ব্যক্তি যদি বিবাহিত দম্পতির এই একনিষ্ঠতা ভঙ্গের কারণ হন, তিনিও একই অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবেন। অপরাধী প্রমাণিত হলে এই কর্মে লিপ্ত দুই ব্যক্তির শাস্তি সমমাত্রিক, নারী-পুরুষের ভেদরেখা এই সব রাজ্যের দণ্ডবিধিতে অনুপস্থিত। 

এবার ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারাটি মূল ভাষায় একবার পড়ে নেওয়া যাকঃ 

Indian Penal Code 

Section 497: Adultery 

Whoever has sexual intercourse with a person who is and whom he knows or has reason to believe to be the wife of another man, without the consent or connivance of that man, such sexual intercourse not amounting to the offence of rape, is guilty of the offence of adultery, and shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to five years, or with fine, or with both. In such case the wife shall not be punishable as an abettor. 

দেখুন দেখি, এই না হলে আইন! একেবারে সোজা-সাপটা, জলবত্তরলম্‌; এদিক-ওদিক কিচ্ছু নেই, এর একটাই দিক। অন্য দেশের আইনটি বুঝতে এবং বোঝাতে গিয়ে এতক্ষণ আমার মাথাটি বন্‌বন্‌ করে ঘুরছিল। adultery, adulteror, adulteress, বিবাহিত, বিবাহিতা, কে কার স্বামী বা স্ত্রী, কে কার বিশ্বাসভঙ্গ, অধিকার-লঙ্ঘন ইত্যাদি করল – সেসব ভাবতে গিয়ে এমনই খেই হারিয়ে ফেলছিলাম যে আমাকে ওই ইংরাজি শব্দগুলির বিশ্রী কতগুলি বাংলা প্রতিশব্দ পর্যন্ত তৈরি করতে হল। 

এখানে আর সেসব ঝামেলা নেই। আমরা এখন অন্য দেশে, অন্য যুগে চলে এসেছি। আপনি যদি পর-এর অনুমতি বা প্রশ্রয় বিনা জেনেবুঝে পরদার গমন করেন, এবং আপনার এই কম্মটি ধর্ষণ বলে পরিগণিত না হয়, তাহলে আপনি adultery বা আমার বদজবানিতে, পরকীয়াগমন অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবেন, এবং আপনার পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাবাস, বা জরিমানা, বা দুটোই হতে পারে। আপনার দুষ্কর্মে সহযোগী হিসাবে পরদারটি কিন্তু শাস্তিযোগ্য হবেন না। 

শেষ লাইনটি পড়ে যদি আপনার আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়, তাহলে ধরে নিতে বাধ্য হব এই দেশে আপনি ভুল করে একশ বছর আগে নিয়ে ফেলেছেন! এ দেশের বিয়েতে চুক্তি বা বিশ্বাসের কোন প্রশ্ন নেই; কেননা, ওসব দুটি সচেতন মানুষের মধ্যে হয়। নারী তো অচেতন পদার্থ মাত্র। সুতরাং এখানে চুক্তি বা বিশ্বাসভঙ্গ অবান্তর কথা। তবে পরকীয়াগামী পুরুষটি অবশ্যই শাস্তিযোগ্য, যেহেতু সে বিনা অনুমতিতে অপরের সম্পত্তিতে প্রবেশ করেছে (মাতৃবৎ পরদারেসু পরদ্রব্যেসু লৌস্ট্রবৎ - এই ঋষিবাক্যটি সাফ্‌ল করে পরদারেসু লৌস্ট্রবৎ গণ্য যদি না করতে পারেন তো কারাবাস অর্জনই আপনার নিয়তি)। কিন্তু নারীটি তার স্বামী এবং প্রভুর সম্পত্তিমাত্র, তার শাস্তির প্রশ্ন অবান্তর! আবার, স্বামী চাইলে তাঁর সম্পত্তিটি অন্য কাউকে ব্যবহার করতেও দিতে পারেন; তাতে কোন অপরাধ সংঘটিত হবে না, বরং মহাভারত শুদ্ধ হবে – ক্ষেত্রজ সন্তানের কথা পাঠকেরা অবশ্যই অবগত আছেন। 

ভাবলে সত্যই অবাক হয়ে যেতে হয় ভারতীয় দণ্ডবিধিতে এমনই একটি ধারা আজও সগৌরবে বিদ্যমান! ইংরেজদের তৈরি করা এই ধারাটি তারা নিজেদের দেশে কবেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে আর আমরা সেটিকে এখনও দিব্যি বয়ে নিয়ে চলেছি! জাতীয় মহিলা কমিশন ধারাটির সমালোচনা করে এটিকে বাতিল অথবা দেওয়ানি অপরাধের সামিল করার দাবি অবশ্যই জানিয়েছেন, কিন্তু বিস্তর যে সব নারীবাদী সংগঠন আছেন, যাঁরা বিভিন্ন অকিঞ্চিৎকর ব্যাপারে প্রায়ই প্রবল শোরগোল তোলেন, তাঁরা নারীর পক্ষে তীব্র অবমাননাকর এই ধারাটির প্রতি এতটা সহিষ্ণু কেন সেটা তাঁরাই জানেন! 

তথ্যসুত্রঃ 1. Indian Penal Code 

2. Adultery: A Comparison of Military Law and State Law and the Controversy by Melissa Ash Haggard 

3. Laws on Infidelity and Adultery(website: www.epis.us

1 comments:

2

প্রবন্ধ : সীমা ব্যানার্জী-রায়

Posted in


প্রবন্ধ

ভারতের দিদিভাই
সীমা ব্যানার্জী-রায়



“আগুনের রং লাল কেন-বাবা?” 

বাবা স্যামুয়েল রিচমন্ড নোবল খুঁজে পেলেন না মেয়ের প্রশ্নের সঠিক উত্তর। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেনঃ “তুমি যখন আমার মতন হবে, তখন তুমি নিজেই পেয়ে যাবে তোমার প্রশ্নের উত্তর।”

উত্তর আইয়ারল্যান্ড থেকে বেশ কিছু দূরে একজন পুরোহিতের অনুগত ভক্তিমতী স্ত্রী খুব ভীত হয়ে পড়লেন তাঁদের প্রথম সন্তানের জন্মের সময় - এক আকস্মিক ভাবনা পেয়ে বসল তাঁকে---এই সন্তান বাঁচবে তো? তিনি মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করলেন সেই প্রথম সন্তান যেন সুস্থভাবে জন্ম গ্রহণ করে। তিনি সেই প্রথম সন্তানকে ঠাকুরেরই চরণে নিবেদন করবেন। সেই সন্তান নিবেদিত হয়েছিল মায়ের গর্ভে থাকাকালিনই। সেই মেয়েই পরবর্তী জীবনে ভগিনী নিবেদিতা নামে ভারতের পুণ্য মাটিতে নতুনভাবে জন্ম নিলেন।। আধ্যাত্মিক নারী সিস্টার নিবেদিতা পরিচিতা হলেন সন্ন্যাসী রাজা স্বামী বিবেকানন্দের পুণ্য সংস্পর্শে। আর ভারতের মাটিতে জন্ম হল সবার দিদিভাই-এর।

উত্তর আয়ারল্যান্ডের এক ছোট্ট শহর ডানগ্যানন(Dungannon) জন্মালেন এক অসাধারণ বিদুষী নারী। নাম মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল, ১৮৬৭ সালের ২৮শে অক্টোবর। বাবা স্যামুয়েল রিচমন্ড নোবল ছিলেন একজন ধার্মিক পুরোহিত আর মা ছিলেন মেরি ইসাবেল নোবল। ছোট্ট মেয়ে বাবাকে হারালেন মাত্র দশ বছর বয়সে। কাঁধের ওপর এসে পড়ল অনেক দায়-দায়িত্ব সেই অল্প বয়সেই। ছোট বেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত সাহসী আর আত্মপ্রত্যয়ী। 

একটা ঘটনা তাঁর চরিত্রের এই দিকটা স্পষ্ট করে দেয় আমাদের কাছে...

অক্স্মাৎ পিতৃবিয়োগের পর ১৩ বছরের ফুটফুটে মার্গারেট মা, বোন আর ভাই-এর সাথে বাস করতেন। পারিবারিক স্বাচ্ছ্বলতা রাখার জন্য স্থির করা হল ৩ বছরের ভাই আয়ারল্যান্ডে দাদুর কাছে থাকবে। কিন্তু ভাইকে সেখানে কে পৌঁছে দেবে? পারিবারিক দায়-দায়িত্ব বজায় রাখার জন্য মা-র পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব ছিল না। অবশেষে এই গুরুদায়িত্বের অধিকারিণী হলেন মিস মার্গারেট।

জল, স্থল, অতিক্রম করে একটা ছোট্ট শিশুকে নিয়ে যাওয়া তখনকার দিনে কোন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পক্ষেও মোটেই সুখপ্রদ ছিল না। কিন্তু একটা স্কুল-পড়ুয়া মেয়ে সব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে ছোট শিশুভাইকে নির্বিঘ্নে আয়াল্যান্ডে দাদুর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই ঠাকুর হয়ত তাঁকে নির্বাচন করে রেখেছিলেন আর সব মহান মনিষীদের মধ্যে। যাঁরা অল্প সময়ের মধ্যে কোন মহান কাজের নিদর্শন রেখে  ছিলেন বা রাখতেন। চরম পরীক্ষার মাধ্যমে ঠাকুর তাঁদের মানসিক শক্তির প্রেরণা জোগান ।

পড়াশুনা ভালভাবে করার জন্য চলে গেলেন হ্যামিল্টনে মামার বাড়িতে । হ্যামিল্টন তখন ফ্রীডম মুভমেন্টের এক নম্বর জায়গা ছিল। 

পূর্বপুরুষ, বাবার অণুপ্রেরণা তার সাথে দাদুর শিক্ষায় তাঁর চরিত্র গঠিত হচ্ছিল সত্য, আধ্ম্যাতিক প্রেরণা, দেশপ্রেম। আর তার সাথে যুক্ত হয়েছিল রাজনীতির প্রভাব।

তিনি প্রথম স্কুলজীবন কাটান লন্ডনের বিখ্যাত ডিসিপ্লিনড চার্চ বোর্ডিং স্কুলে। অসাধারণ বুদ্ধিমতী মেয়ে ছিলেন । তিনি শুধু পড়ার বইয়ে ডুবে থাকতেন না, তার সাথে সাথে সমান ভাবে পরিচিত হচ্ছিলেন সাহিত্য, সঙ্গীত, আর্টস, ফিজিক্স এবং বটানি।

প্রাথমিক পড়াশুনা শেষ করেই মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি স্কুলশিক্ষিকা হয়েছিলেন অত্যন্ত মেধাবী হওয়ার জন্য। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজের স্কুল প্রতিষ্ঠা করে ছাত্রীদের নিজের আদর্শে গড়ে তুলতে লাগলেন। এই সময়-ই তিনি বিভিন্ন বিষয়ে লেখালিখি করে লন্ডনে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন। আধ্যাত্মিক জগতের প্রভাব এর বিশ্লেষণ করবার জন্য তিনি প্রচুর পড়াশুনা করলেন কিন্তু তাঁর আত্মাকে কিছুতেই তৃপ্ত করতে পারছিলেন না। 

১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে, লন্ডনের এক শীতপ্রবণ সন্ধ্যায় স্বামী বিবেকানন্দ একজন বনেদি বাড়ির লেডি ইসাবেলের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলেন। স্বামীজি বৈঠকখানায় বেদান্ত ফিলোজফি বোঝাচ্ছিলেন। এখানেই মার্গারেট স্বামীজিকে প্রথম দর্শন করেন। নিমন্ত্রিতরা সাকুল্যে ১৫ জন ছিলেন। স্বামীজির সামনে সবাই অর্ধাকৃ্তি ভাবে বসেছিলেন। তিনি অভিভূত হয়ে গেলেন স্বামীজির বেদান্ত ফিলজফি শুনে। মোহিত হলেন দর্শন করে একজন সুদর্শন এবং শিশু-সুলভ সরলতাভরা উজ্জ্বল ভারতীয় সন্ন্যাসীর প্রতি। তারপর থেকেই তিনি স্বামীজির লন্ডনে থাকাকালিন সমস্ত ভাষণ আর প্রশ্ন-উত্তরের ক্লাসে যোগ দিতে শুরু করেন। প্রত্যেকটি ক্লাসের বিষয় খুব মনোযোগ সহকারে শুনতেন আর তার সাথে তিনিও নিজের আকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন রাখতেন। সেই সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে তিনি গভীরভবে চিন্তা করতেন। অবশেষে তিনি বুঝতে পারলেন এই ভারতীয় যুব সন্ন্যাসীই তাঁকে সঠিক পথে চালনা করতে পারবেন। তিনি তাঁকে গুরু মেনে নিলেন। স্বামীজিও তাঁর সততা, দৃঢ়চেতা, আর সবার চেয়ে বেশি আকৃষ্ট হলেন তাঁর দয়ালু মনের প্রতি। 

স্বামীজি খুঁজছিলেন এইরকম একজন মহিলা যে তাঁর দেশের মেয়েদের উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে তাঁদের আত্মচেতনা আর যাতে তারা নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে সক্ষম হয়।

তিনি মার্গারেটকে তাঁর দেশে গিয়ে মেয়েদের শিক্ষা দানের জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। স্বামীজি লিখলেন তাঁকেঃ “আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, ভারতে তোমার ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। একজন মহিলার দরকার ভারতে-কোন পুরুষ নয়-একজন সত্যিকারের বাঘিনীর প্রয়োজন ভারতের কাজের জন্য। তোমার শিক্ষা, আন্তরিকতা, বিশুদ্ধতা, অসীম ভালবাসা, সংকল্প, সর্বশ্রেষ্ঠ তোমার মতন কেল্ট জাতির রক্তের অধিকারী নারীর প্রয়োজন আমাদের দেশের নারীদের।” 

ভারতীয় ধর্মকে আপনার ধর্ম বলে আলিঙ্গন করলেন। ভারতবর্ষের কথা উঠলেই তিনি ভাবে বিভোর হয়ে উঠতেন। ভারতবর্ষ তাঁর ধ্যান ও তপস্যা ছিল। মেয়েদের বলতেন, 'তোমরা সকলে জপ কর, ভারতবর্ষ'! ভারতবর্ষ'! ভারতবর্ষ'!

সত্যসত্যি দিদিভাই ভারতকে হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করতেন। ভারতের সনাতন ধর্ম তাঁকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল।

তবে থেকে তিনি কখনও বলতেন না যে, “ভারতের প্রয়োজন, ভারতের মহিলা” উপরন্তু বলতেন “ আমাদের প্রয়োজন, আমাদের মহিলা”। 

আমাদের লজ্জা তাঁকে আমরা এখনও “ বিদেশিনী” ভাবতে দ্বিধা বোধ করি না। এক গোছা গোলাপ ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে তিনি বলতেনঃ 'ভারতবর্ষ', 'ভারতবর্ষ', 'মা', 'মা'। 

আমাদের পবিত্র সারদা মাঠাকুরাণি প্রায়ই বলতেন, “ খুকি এই দেশেরই মেয়ে। শুধু (ঠাকুরের) কথা প্রচারের জন্য সেইদেশে জন্মেছে।”


তার নারী চেতনা থেকে একটা উদাহরণ পাওয়া যায়ঃ

১৯০৬ খৃষ্টাব্দে তিনি অণুপ্রাণিত হন একজন নামকরা তামিল কবির( ভারতী সুব্রামানিয়া) জীবনী পড়ে। 

দুজনের দেখা হয় শুধুমাত্র একবার একটা ছোট্ট সভায়। এই প্রথম কলকাতা কংগ্রেস সভায় -ই কবি ভারতী বুঝতে পারেন নিবেদিতা একজন মহান শক্তির অধিকারিণী। আলোচনা প্রসংগে জানতে পারেন আমাদের দিদিভাই যে, কবি ভারতী একজন বিবাহিত। দিদিভাই প্রশ্ন রাখলেন, “ আপনি কেন আপনার স্ত্রী-কে নিয়ে আসেন নি এই সভায়?” 

-“ আমাদের সমাজে বিবাহিতা স্ত্রী-কে নিয়ে কোন জনসভায় যাওয়া যুক্তিযুক্ত নয়।” 

দিদিভাই রাগে ফেটে পড়লেন। বললেনঃ “ আমার শুনে খুব খারাপ লাগছে যে, ভারতীয় পুরুষেরা মেয়েদের ঝি ছাড়া আর কিছু ভাবতে জানে না। আপনার শিক্ষার কি মূল্য আছে যেখানে আপনি আপনার স্ত্রীর মর্যাদা আপনার কাছে রাখেন না? কি হবে দেশমাতার স্বাধীনতার জন্য লড়ে যেখানে এই দেশেরই অন্যদিকের মা-এরা অন্ধকারে থাকে? আজ থেকে আপনি স্ত্রীকে আপনার চেয়ে আলাদা ভাববেন না। তাঁকে ভালবাসা দিয়ে আপনার পায়ে পা মিলিয়ে চলতে দেবেন।

কবি ভারতী শুনে অভিভূত হয়ে গেলেন। তিনি ক্ষমা চাইলেন দিদিভাই-এর কাছে আর প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি দিদিভাই-এর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন। তিনি দিদিভাইকে 'গুরুমা' করে নিলেন। সেইদিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত সবার কথ অগ্রাহ্য করে স্ত্রীকে সব রকম কাজে নিযুক্ত করেছিলেন এবং রাস্তায় স্ত্রীর হাত ধরে পায়ে পা মিলিয়েছেন। তাঁর মন থেকে জাতি, ধর্ম, ধর্মমত দূর হয়ে গেছিল। তিনি একজন নামকরা কবি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি দুখানা কবিতা দিদিভাই-কে উৎসর্গ করেছিলেন। 

একটা বই-এর ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেনঃ “ I offer this little book at the feet of my Provider of learning who, by unfolding the spiritual vision of Mother India, infused in me the love for the Motherland, just as Sri Krishna by showing his Cosmic form to Arjuna conferred on him true self-knowledge.” 

“নিবেদিতা সম্পর্কে একটা গুরুত্বপূর্ণ বাক্য লিখে গিয়েছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। লিখেছিলেন, নিবেদিতা ছিলেন বিবেকানন্দের উপসংহার। কিন্তু উপসংহার বলিয়া তিনি ঠিক বিবেকানন্দের প্রতিরূপ ছিলেন না।” 

এত অল্প কথায় নিবেদিতাকে আর কেউ বোধকরি ব্যাখ্যা করতে পারেন নি। এক অর্থে নিবেদিতার ভিতর তাঁর গুরু বিবেকানন্দের তার্কিক মননের অনেকটাই ছায়া পাওয়া যায়।

আমার মনে হয় আমাদের দিদিভাই ছিলেন ভারতের এক আদর্শ নেত্রী, ছিলেন সত্যিকারের যোদ্ধা। তাঁর রাগ ছিল জলের মত তার কোন রং-গন্ধ ছিল না। একবার অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক শ্রী মতিলাল ঘোষের সাথে কোন ব্যাপারে রাগারাগি হয় –তিনি অফিস ছেড়ে চলে যান। পরের দিন আবার ফিরে এসে শিশুদের মত হাসিতে ফেটে পড়েন । ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বলেনঃ “মতিবাবু, ইয়েস্টার্ডে আই ওয়াজ ভেরি দুষ্টু (naughty)।” এই রকম সরলতা মাখানো কথা শুনে মতিবাবুর দুচোখ জলে ভরে যায়।

তিনি ভারতের নারী-কল্যাণ, বিজ্ঞান, রাজনীতি, সাহিত্য, ভ্রমণ, ব্যায়াম, বাংলা ভাষা, শিল্প এই সমস্ত ব্যাপারে গুরুতররূপে নিজেকে উতসর্গ করেছিলেন। তিনি শুধু বেলুড়মঠের কাজেই নিজেকে ব্যপৃ্ত রাখেন নি। 

১৭ই মার্চ , ১৮৯৮ তাঁর নিজের ডায়েরী“A day of days” -এ লেখেন এইদিন প্রথম তিনি শ্রী মা সারদা দেবিকে দর্শন করেন। স্বামীজির আরো দুজন ইউরোপীয়ান শিষ্যাদের সাথে তিনি মা-এর কাছে গিয়েছিলেন। মা তাঁকে সেইদিনি “আমার মেয়ে খুকী” বলে সম্বোধন করেছিলেন। মা নিবেদিতাকে নিজের হাতে তৈ্রী করে একখানা উলের পাখা দিয়েছিলেন। সেই পাখা পেয়ে তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান। একবার সেই পাখা মাথায় রাখেন তো একবার নিজের বুকে রাখেন। সেখানে উপস্থিত সবাইকে দেখাতে শুরু করেন “ কি সুন্দর, কি অদ্ভুত আমাদের মায়ের হাতের কাজ। 

মা এইসব দেখে বলে উঠলেন, “কী অসাধারণ ভক্তি এই মেয়ের। এ তো দেবীর প্রতিমূর্তি। নরেনের প্রতি কি অসামান্য ভক্তি। কারণ নরেন জন্মেছে এই দেশে, তাই সে নিজেকেও সমর্পণ করেছে। গুরুর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা। এবং কত ভা্লবাসে এই দেশকে।”

আমরা মায়ের যে ছবিতে এখন পূজা করি সেই ছবি কিন্তু নিবেদিতা এবং অলি বুলের সাহায্যেই তোলা হয়েছিল। নিবেদিতা নিজে মাকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। মা খুব লজ্জা পাচ্ছিলেন। তাই প্রথম ছবিটায় মায়ের মুখ নীচু ছিল। মা ভেবেছিলেন ছবি তোলা হয়ে গেছে তাই যেই তিনি মুখ উঠিয়েছেন আর তাঁর ছবি তোলা হয় দ্বিতীয়বার। মা স্নেহের চোখে তাকিয়ে আছেন তাঁর খুকির দিকে... সেটা তোলা হয় মায়ের ৩য় ছবি হিসেবে। দিদিভাই-এর নির্দেশেই তোলা হয়েছিল প্রথম ছবি মা-এর। মার বয়স তখন ৪৫ বছর। সেই ছবি আজ ঘরে ঘরে পূজিত হয়।


২৫ নভেম্বর ১৮৯৮ স্বামীজির কাছে ব্রহ্মচর্য্যগ্রহণ করেন তিনি, আর তাঁর নাম হয় নিবেদিতা। 

তিনি সন্ন্যাস কেন নেন নি? কারণ, তিনি স্বামীজির কাছে প্রশ্ন তুললে, স্বামীজি বলেছিলেন, “তুমি যেমন আছো তেমনি থাকো।” তাই সারাজীবন তিনি ব্রহ্মচারিণী হিসেবেই ছিলেন।

কি অসাধারণ গুরু ভক্তি। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে মনে হয়, গুরু তাঁকে পুরো ভারতমাতার জন্যই নিবেদন করেছিলেন। 

তারপর থেকেই তিনি দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে প্রায়ই যেতেন। যখনই যেতেন, দীন-হীনভাবে প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। যদিও দেবীদর্শন করবার অধিকারে তিনি বঞ্চিতা ছিলেন।

তবুও তিনি রামকৃষ্ণ ঠাকুর, মা, এবং স্বামীজি্র একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। নিজের নাম স্বাক্ষর করবার সময় লিখতেন, 'Nivedita of Ramkrishna-Vivekananda.' দিদিভাই ইংরাজীতে ধর্ম ও শিক্ষাবিষয়ক বহু গ্রন্হ রচনা করেছেন। তন্মধ্যে-'The Master as I saw Him', 'Hints on Education', 'Kali the Mother', 'The Cradle Tales of Hinduism', 'An Indian Study of Love and Death', প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ধর্মের জন্য তিনি আজীবন তপস্যা করেছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই জীবনব্যাপী তপস্যাকে সতীর তপস্যার  সাথে তুলনা করেছেন।

প্রথম ভারতে পৌঁছুবার অল্পদিন পরেই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর ছোট মেয়েকে ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য।

কিন্তু দিদিভাই স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, “ বিদেশী ভাষাশিক্ষা্র কী প্রয়োজন? নিজের দেশের প্রভাব, আচার আচরণ তো সবথেকে বড় বিদেশী শিক্ষার থেকে। আমি এ দেশে মেয়েদের ইংরাজি ভাষা বা আচার ব্যবহার শিক্ষা দিতে আসি নি। আমি অপারগ।” 

পরেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে পুরাতন ভারতীয় ভাবনা ধারায় আশ্রম স্থাপন করেছিলেন। 

কলিকাতার বোসপাড়ার একটা বাড়িতে তিনি বাস করতেন। সেই বাড়িতেই একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভারতের নারীদের সর্ববিধ শিক্ষাবিধান তাঁর জীবনের সংকল্প ছিল। এই সংকল্প অনুসারেই উক্ত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর মতে ত্যাগ ও প্রেমই ভারতবর্ষের শিক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ ফল।

প্লেগের সময় নিজের জীবন তুচ্ছ করে প্লেগ রুগীদের সেবা করেছিলেন। এবং অন্যান্যদের উৎসাহিত করেছিলেন। “ক্লাসিক থিয়েটার”-এর অডিটোরিয়ামে তিনি গুরু স্বামীজির সাথে একত্রে “প্লেগ এবং স্টুডেন্টদের কার্যপ্রণালী” বিষয়ে বক্তৃতা দেন। সেই বক্তৃতা শোনার পর সমস্ত স্টুডেন্টরা একজোট হয়ে সেবা কাজে নাম লিখিয়েছিল। 

এই সমস্ত অসামান্য ঘটনাবলীর খবরাখবর গিয়ে পৌঁছায় তখনকার দিনের বিখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ আর জি কর -কাছে। ওনার কথায়ঃ

-একদিন চৈত্রের দুপুরে রুগী দেখে যখন বাড়ি ফিরছিলাম, দেখি একজন ইউরোপীয়ান ভদ্রমহিলা দরজার কাছে বসে আছেন। আমি কারণ জিজ্ঞাসা করতে জানালেন যে, সকালে আমি যে শিশুটিকে দেখে এসেছিলাম তার সুস্থতার জন্য কী কী দরকার। আমি বললাম, তার অবস্থা ভাল নয়। আর তিনি যেন নিজেকে সাবধানে রাখেন এই ছোঁয়াচে অসুখ থেকে। পরের দিন ছেলেটিকে দেখতে অবাক হয়ে গিয়েছিলামঃ গিয়ে দেখি সেই ছেলেটিকে কোলে নিয়ে বসে আছেন সেই মহিলা। তার মা আগেই মারা গেছেন। সেই স্যাঁতসেতে ঘর তিনি রং করেছেন নিজের হাতে। সেই ছেলেটি তাঁর কোলেই মারা যায়—তিনবার 'মা মা মা' ডেকে।

কোন রকম বিচার বিবেচনার ধার ধারেন নি তিনি। 

স্বামী সারদানন্দের চিঠিতে জানতে পারেন স্বামীজির মহাপ্রয়ানের কথা। সেই রাতেই তৎক্ষণাৎ মঠে উপস্থিত হন। ভোর পর্যন্ত স্বামীজির মাথার কাছে বসে খুব আস্তে পাখা করেন। 

তাঁর খুব ইচ্ছে হয় স্বামীজির গেরুয়া কাপড় থেকে এক টুকরো কাপড় নেবার জন্য। কিন্তু নিজের মনের কাছেই উত্তর রাখলেন, সেই কাপড় নিজের কাছে রাখা হয়ত ঠিক হবে না । আশ্চর্য্য তিনি যখন চিতার সামনে বসে ছিলেন দেখলেন শেষ চিতা নেবার আগে কোথা থেকে এক টুকরো কাপড় তাঁর হাতের কাছে এসে স্পর্শ করে । তিনি পরম শ্রদ্ধায় সেই কাপড়ের টুকরো  নিজের কাছে রাখেন।

একদিন স্বামী সারদানন্দ এক গল্পের ছলে বলেন যে, “ ভারতীয় নারীরা অশিক্ষিতা ...নিবেদিতা তাঁকে পুরো বলতে না দিয়ে বলে উঠলেনঃ “ ভারতীয় নারীরা মোটেই অজ্ঞ নয়। পশ্চিম দেশে কি কেউ শুনেছে সারদা মা-র মতন নারীর কথা? না, নারীদের পূজা করা হয় পশ্চিমে?” 

১৯০২ সালে পশ্চিম থেকে ফিরে এসে মাদ্রাসে তিনি এক বক্তৃতায় বলেছিলেনঃ “যারা ভাবেন যে, ভারতীয় নারীরা পাশবিক অচ্যাচারের শিকার। তা কিন্তু সত্য নয়। অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতীয় নারীদের উপর পাশবিক অত্যাচার অনেক কম। সুখ, সামাজিক প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে আমি বলতে পারি মহৎ চরিত্রের ভারতীয় মহিলারা জাতীয় জীবনের বৃহদাকার অধিকারের অংশীদার। যখন আমাদের এই সিদ্ধান্তে আনা হয় যে, ভারতীয় নারীরা অবহেলিতা, আমরা পৌঁছাই এমন এক দিগন্ত বিস্তৃত মিথ্যে যুক্তির সিদ্ধান্তে। তারা হয়ত বাহ্যা্নুষ্ঠানের অন্তর্ভূক্ত হতে পারেন নি। সেটা হয়ত বলা যায়, কেউ কেউ লিখতে পারেন, কিন্তু পড়তে পারেন মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন। মহাভারত, রামায়ন এবং পুরাণ-এর গল্প যে মা, দিদিমা, ঠাকুমারা শিশুদের শোনান এই বইগুলি কি সাহিত্য নয়? ইউরোপীয়ান উপন্যাস বা ম্যাগাজিন না পড়তে পারলেই কি ভারতীয় নারীরা অশীক্ষিতা? এই কথাগুলো আপাতবিরোধী সত্য তাই না? 

আমার মতেঃ লেখাকে কালচার হিসেবে ধরা যায় না। যদিও এটা একটা কালচারের সাময়িক প্রভাব … যাঁরা ভারতীয় সমাজ জীবন সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল তাঁরা জানেন যে ভারতীয় মহিলারা শিক্ষা অর্জন করেন নিজেদের গৃহে- মর্যাদা, কোমলতা, পবিত্রতা, মিতব্যয়িতা, ধর্ম শিক্ষা, উত্তরাধিকারীদিগের কাছ থেকে মন এবং হৃদয় গঠন-যদিও তিনি নিজের নাম সাইন করতে পারেন না। আমার মনে হয় পিচ্ছিল সমালোচনার থেকে তাঁরা অনন্ত শিক্ষা এবং সাহিত্যে পারদর্শী।” 

আমাদের দিদিভাই-এর উপরোক্ত কথাগুলি যে কতখানি সত্য তার প্রমাণের সাক্ষী আমি । আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছরের ঘটনাকে এখনও পশ্চিমের মানুষেরা ধ্রব সত্য হিসেবে মনে করে। 

একটা ঘটনা থেকে আমি জানাই আজঃ 

২০০২ সালে লুইজিনায় চাকরির সূত্রে এই ঘটনার সম্মুখীন হই। একই অফিসে কাজ করতাম দাদা, আমি আর আমার বড়ো ভাইঝি। একদিন আমরা তিনজনে অফিসে ঢোকার মুখে হঠাৎ শুনি আমাদের এ্যডমিনিস্টারের মুখে যে, দাদা কেন পিছনে? তিনি পড়েছেন বা জেনেছেন যে, ভারতে মেয়েরা সব সময় পেছনে থাকে। আমার ভাইঝি জবাবে বলে দিয়েছিল যে, “ আপনি যা জানেন -সেটা মোটেই সত্য নয়।” আর কিছু বলেন নি তিনি।

আরেকটা ঘটনায় জানা যায় তাঁর দয়ালু প্রাণে প্রাণীরাও স্থান পেয়েছিল। কারণ তিনি ঘোড়ার গাড়িতে চড়তেন না, ঘোড়াদের কষ্ট হবে ভেবে। গোলাপ মা একবার ওনার সামনেই একটা বেড়ালকে ঘাড় ধরে বাইরে ছুঁড়ে ফেলেন। তিনি তাই দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন। সীমিত বাংলা ভাষায় গোলাপ- মা কে বলেন “গোলাপ মা, মৃত্যু(death) মৃত্যু(death).” 

ভারতের ভাস্কর্য, চিত্রকলা প্রভৃতি শিল্পের উপর দিদিভাই-এর সবিশেষ অনুরাগ ছিল। ভারতশিল্পের প্রাণ  যে আধ্যাত্মিকতা তা তিনি বিশ্বাস ও অনুভব করতেন। কথিত আছে, বৈ্দেশিক চিত্রকরের অনুকরণে অঙ্কিত ছবি অপেক্ষা মেয়েদের হাতের অঙ্কিত আলপনা তাঁর বেশি আদরের সামগ্রী ছিল। একটি বালিকার অঙ্কিত শতদল পদ্মের ছবি তিনি নিজের ঘরে টাঙ্গিয়ে রেখেছিলেন। বিখ্যাত শিল্প সমালোচক ডাক্তার কুমারস্বামী একদিন তা দেখে খুব প্রশংসা করেছিলেন। বিদ্যালয়ে ইতিহাসের পাঠ দেবার সময় তিনি তন্ময় হয়ে যেতেন; রাতপুতরমণী পদ্মিনীর উপাখ্যান বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। 

দিদিভাই ভারতের প্রায় সকল তীর্থেই ভ্রমণ করেছিলেন। এমনকি সুদূর বদরিকাশ্রম পর্যন্ত গিয়েছিলেন।

১৯০১ সালে রয়াল সোসাইটি অফ লন্ডন স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর সমস্ত সায়েন্টিফিক রিসার্চ পেপার অগ্রাহ্য করে। কারণ তিনি পরাধীন দেশের নাগরীক। পরে আমাদের দিদিভাই-এর পরামর্শে এবং তাঁর পরিচালনায় স্যার বসুর তিনখানা পুস্তক প্রকাশিত হয়। দিদিভাই -এর চেয়ে দশ বছরের বড় হলেও তিনি স্যারকে “খোকা ' বলে ডাকতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্যারকে বলেছিলেনঃ “সিস্টার নিবেদিতার সাহায্য ছাড়া তিনি বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত হতেন না সারা বিশ্বে। স্যারের সব কাজে যেন দিদিভাই-এর নাম লেখা থাকে।” “বসু বিজ্ঞান মন্দিরে” দিদিভাই-এর ফলক আছে এবং দিদিভাই-এর অস্থির টুকরো উ্পরেই “বসু বিজ্ঞান” মন্দির স্থাপিত হয়। 

দার্জিলিং-এ, ১৯১১ সালে ১৩ই অক্টোবর আমাদের দিদিভাই মহাপ্রস্থানে যাত্রা করেন । শেষ সময়ে তাঁর কাছে ছিলেন স্যার বসু এবং লেডি অবলা বসু।

“এমন দিদিভাই আর কজন আছেন?
তোমার মতন দিদিভাই...
কখনও বা জননী, কখনও শিক্ষিকা,
কখনও বা স্নেহময়ী দিদিভাই...” 

আমার অনেকদিনের ইচ্ছে আজ কতখানি সম্পূর্ণ করতে পারলাম, আমার জানা নেই। স্কুলজীবনে একবার ভারতের শ্রেষ্ঠ এক নারীর সম্বন্ধে রচনা লেখার সময় প্রথমেই আমাদের সবার 'দিদিভাই'-এর নামটা আগে আমার মনে এসেছিল। কিন্তু তখন ছোট থাকার জন্য আর ওঁনার সম্বন্ধে কিঞ্চিত জ্ঞান থাকার দরুণ  লিখতে পারি নি। ২০১২ সালে ডালাস দুর্গোৎসব পূজামন্ডপে স্বামী প্রভানন্দ মহারাজের লেখা বই “Nivedita of India” দেখেই কিনে ফেলি। আজ আমি আমার সামান্য জ্ঞান থেকে “ প্রিয় দিদিভাই” -কে নিয়ে লিখতে পেরে নিজেকে খুব কৃতার্থ মনে করছি। এই লেখায় যদি কিছু ভুলত্রুটি হয়ে থাকে, তাই সবার কাছে অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী। আর এই লেখা যদি পাঠক-পাঠিকার মনে কিঞ্চিত রেখাপাত করে, তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করব।

2 comments:

2

প্রবন্ধ : পিয়ালী বসু

Posted in




প্রবন্ধ


বিবাহের উৎস সন্ধানে 
পিয়ালী বসু 


বিবাহ শব্দটাই একটা বিতর্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে, পাড়ার চায়ের দোকানে, কলেজ ক্যান্টিনে, কফি হাউসে, এমনকি নিভৃতে প্রেম করতে করতেও এই বিষয়টি নিয়ে অনায়াসেই বেশ বিতর্ক তৈরি হয়ে পড়ে। 

বহুল চর্চিত এই বিষয়টির উৎস সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই ইতিহাসের প্রসঙ্গ এসে পড়ে, বলা যেতে পারে অ্যাংলো স্যাক্সন জনগোষ্ঠীই প্রথম এই বিষয়ের অবতারণা করে, তাও আবার ৪,৩৫০ বছর আগে ।

Stephanie Coontz এর (Marriage: A History বইটির লেখিকা ) উক্তি অনুযায়ী জানা যায় মূলত ব্যাবসার উদ্দেশ্যেই অ্যাংলো স্যাক্সন জনগোষ্ঠী এই বিবাহের প্রথম ব্যাবহার শুরু করে । তারপরে অবশ্য অবধারিত ভাবে এসে পড়ে নারীকে একান্তই নিজের সম্পদ ভাবার সেই একচেটিয়া পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, অর্থাৎ ৩০ জনের জন্য একজন নারী নয়, একজনের জন্যই একজন নারী ! তাই বিবাহ ! তাই একসাথে সারাজীবন পাশে থাকার অঙ্গীকার ! 

একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিবাহ ব্যাপারটায় প্রধান দুই অংশ গ্রহণকারী / কারিণী দের প্রায় কোন মতামতই ছিল না, প্রেম এর অস্তিত্ব ছিলই না সেই বিয়েতে, ছিল রাজনৈতিক এবং বৈষয়িক চিন্তা ! Decretum Gratiani বইটি আমাদের এও জানায় যে, বিবাহে সেসময়ে পাত্রীর প্রায় কোন প্রত্যক্ষ ভূমিকাই ছিলোনা, সমস্ত রকমের মতামত নিতেন পরিবারের অন্যান্য বয়জ্যেষ্ঠরা সদস্যরা, বিশেষত পাত্রীর বাবা। 

আমরা যে সময়ের কথা আলোচনা করছি সেসময়ে রোম্যান ক্যাথলিক চার্চের হাতেই ছিল সর্বাধিক ক্ষমতা , তারাই প্রথম স্থির করে পুরোহিত স্থানীয় কারোর মন্ত্র পাঠের মাধ্যমেই বিবাহ তার আইনি মর্যাদা পাবে (বিবাহ রেজিস্ট্রি ভুক্ত করার প্রচলন আরও অনেক পরে কার্যকরী হয়), ১৫৬৩ সালে ট্রেন্ট কাউন্সিলে ইশ্বর কে সাক্ষী রেখে যে বিবাহ সম্পন্ন হয়, তা পরবর্তী কালে ক্যানন আইনেও নথিভুক্ত হয় ।

আস্তে আস্তে বিবাহ পদ্ধতিটির মধ্যে সুক্ষ ভাবে জায়গা করে নেয় ধর্ম । ক্যাথলিক চার্চ শেখায় কি ভাবে নারীর সম্মান রক্ষা করতে হয়, শেখায় ডিভোর্স পাপ !

হিন্দু বিবাহ 

"যদিদং হৃদয়ং তব তদিদং হৃদয়ং মম" 

ধর্ম, অর্থ, কাম, ও মোক্ষ , এই চারটি কর্তব্য পালনের উদ্দেশ্যেই হিন্দু বিবাহের প্রচলন হয় বলে জানা যায়। ইতিহাস আমাদের জানায় হিন্দু বিবাহ প্রধানত অষ্ট প্রকার, অর্থাৎ আট রকমের বিবাহের বিবরণ পাওয়া যায় । 

ব্রাহ্ম বিবাহ 
দৈব বিবাহ
প্রজাপত্য বিবাহ
গান্ধর্ব বিবাহ
অসুর বিবাহ
আরশো বিবাহ
রাক্ষস বিবাহ
পৈশাচ বিবাহ

রীতিমত জন্ম কুণ্ডলী মিলিয়ে বিবাহ হত হিন্দুদের (এখনও হয় তবে সংখ্যাটা অনেকটাই কম )। পাঁজি দেখে শুভ দিন নির্ধারণ করতেন পরিবারের বয়জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা, এবং সেই বিয়েতে পাত্রী বা পাত্রের ভুমিকা ছিল বেশ নগন্যই । 

লাল রঙ হিন্দুদের কাছে শুভত্বের প্রতীক, তাই বিবাহে পাত্রীর পরনে থাকতো লাল শাড়ি (প্রথম দিকে তাঁত এর শাড়ি , পরবর্তী কালে বেনারসি , বালুচরি , কাঞ্জিভরম আরও কত কি ), ব্রাহ্মণ পুরহিতের মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে সম্পন্ন হত বিবাহ, পাত্রী তথা স্ত্রী র সিঁথিতে সিঁদুর দানের মাধ্যমেই বিবাহ তার মর্যাদা রক্ষা করতো । 


খ্রিস্টান বিবাহ 

খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়, Protestant ও catholic, খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী বিবাহ বিষয়ে রোমানদের পথ অনুসরণ করে , তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয় চার্চে ফাদার বা পাদ্রী কে সামনে রেখে বাইবেলের মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে । খ্রিস্টান দের কাছে সাদা রঙ পবিত্র তার প্রতীক, তাই সাদা রঙের গাউনে পাত্রী কে ও সাদা সুট এ পাত্র কে সজ্জিত করা হয় ।

আসলে বিবাহ ব্যাপারটা হল একসাথে সারাজীবন থাকার আইনি অঙ্গীকার ।


ইসলামীয় বিবাহ 

মুসলমান বা ইসলামীয় গোষ্ঠীর কাছে নিকাহ সবচেয়ে পবিত্র ঘটনা, তাদের চোখে বিবাহ একটা legal contract যেখানে পাত্রী তার নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করে তার জীবন সঙ্গী নির্বাচিত করেন, অর্থাৎ এক্ষেত্রে নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় । 

বিবাহ অর্থে সারাজীবনের নর্ম সহচরী বা কর্ম সহচর ! ইসলামীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ডিভোর্স খুব জনপ্রিয় না হলেও অচল নয় , Nikāḥ al-Mutʿah নামক temporary বিবাহের কথাও জানা যায়, যা মূলত শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহ অবশ্যই জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, কিন্তু তা কখনোই বাধ্যতামুলক নয়, পুরুষ এবং নারী উভয়েরই একা জীবন কাটানর স্বাধীনতা আছে । বিবাহে পাত্রীর “কবুল হায়” এই উক্তির প্রাধান্য সর্বাধিক ! তার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে নিকাহ সম্ভব নয় । মৌলবি কে সাক্ষী রেখে তাঁর মন্ত্রে মাধ্যমেই সম্পন্ন হয় নিকাহ। 

It's never being to old to hold hands, 

একা আসা একাই যাওয়া, তবুও মাঝের সময়টা কাটানোর জন্য সঙ্গী বা সঙ্গিনী খোঁজা ! সামাজিক আমরা একা থাকতে বড়ই ভয় পাই, তাইতো বিবাহ, তাইতো মাঝের সাঁকোটা একসাথে পার হওয়ার জন্য একসাথে থাকার অঙ্গীকার !

2 comments:

1

বিশেষ রচনা : শৌনক দত্ত

Posted in




বিশেষ রচনা


নিঃসঙ্গ সৃষ্টিতে...
শৌনক দত্ত

সুস্মিতার সাথে অভিমানের পর্ব যখন চরম, বাসু তখন ছাদে। পঞ্চমীর চাঁদ তখন আধখাওয়া রুটির মত একা। বাসু তখন কবিতা বলতে থাকে নিঃসঙ্গ আকাশের দিকে চেয়ে। বাসু জানে সুস্মিতা এখনই জীবনানন্দ শুনে উঠে আসবে অভিমান ভেঙ্গে পড়বে জীবনানন্দীয় বোধে আর নিঃসঙ্গতায়। সুস্মিতাও নিজের পছন্দের কবিতা জুড়ে দেবে।

বেশ কিছু কবিতা আওড়ানোর পর ও যখন সুস্মিতা এলো না, বাসু অবাকই হলো। অনিচ্ছায় নেমে এলো। ঘরের কোথাও সুস্মিতা নেই, বিছানায় পড়ে আছে কমলকুমার মজুমদার আর জীবনানন্দ দাশের পাশে নির্জনতা। বাসু এ ঘর সে ঘর দেখে আর অবাক হয় সুস্মিতা কোত্থাও নেই। গন্ধ খোঁজে বাসু।জীবাননন্দের বইটি তুলে নিতেই তার মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের অন্তত বারো কিংবা চৌদ্দোটি উপন্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। সম্ভবত আরো চারটি লুক্কায়িত আছে তার পান্ডুলিপির জীর্ণ স্তুপে। ছোটগল্প প্রায় একশ কুড়িটি।রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের সংখ্যা বারটি এবং ছোটগল্প একশোর কমই হবে।রবীন্দ্রনাথ সবই দেখে গেছেন মুদ্রিত অবস্থায়। জীবনানন্দের মত একজন আপাদমস্তক কবি কোন রকম পাঠক প্রত্যাশা না করেও কেন একটিও গদ্য কাহিনী প্রকাশ করতে চাননি, সে রহস্য আর বোধহয় উদঘাটিত হবার নয়।বাসু সুস্মিতা কে ডাকতে থাকে..

সুস্মিতার মত হাস্যোজ্জ্বল একটি ব্যক্তিত্ব মনের কোথাও কোনো গহীনে কি একা ছিলো? আজ এ প্রশ্ন জেগে ওঠে কমলকুমার মজুমদারের বইটি তুলে নিতেই। সুস্মিতার খুব প্রিয় দুটি বই বড় পছন্দের দুজন স্রষ্টা, অথচ দুজনেই বড় বিচিত্র। কমলকুমার মজুমদার উপন্যাস লিখেছেন আটটি এবং কিছু গল্প। উপন্যাসগুলি এবং প্রায় সব গল্পই প্রকাশিত হয়েছে এক্ষণ, কৃত্তিবাসের মতন পত্রিকায়। কমলকুমার জীবনানন্দের মতন নিঃসঙ্গতা বিলাসী ছিলেন না। সুস্মিতা কমলকুমার মজুমদার নিয়ে কিসব যেন লিখেছিলো। বাসু সুস্মিতার ডাইরী হাতড়ে বেড়ায় সেলফে, টেবিলে, ড্রয়ারে কোথাও নেই তখনই চোখে পড়ে ডাইরীটা পড়ে আছে বাসী দৈনিক পত্রিকার পাশে ধুলোময়। সযত্নে বাসু ডাইরীটা বুকে চেপে ধরে রাখে অনেকক্ষণ তারপর পাতা উল্টেপাল্টে পড়তে থাকে সুস্মিতার লেখা-

কমলকুমার মজুমদার[১৯১৪-১৯৭৯]বাংলা সাহিত্যে বিতর্কে কন্টকাকীর্ণ, নির্মাণে নিঃসঙ্গ এক নাম। স্বতন্ত্র শিল্পরীতি আর বর্ণাঢ্য যাপিতজীবন মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবার চেয়ে আলাদা, মহামহিম। জীবদ্দশায়ই হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি পুরুষ। আড্ডায়, পান্ডিত্যে, রসিকতায়, পরনিন্দা, পরচর্চায় ও নতুন নতুন কাহিনী সৃষ্টিতে তিনি নিজেই কাহিনী পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন।

লেখাটা পড়তে পড়তেই বাসু উঠে দাঁড়ায় রান্না ঘরে উঁকি দেয়। সুস্মিতা নেই।দুই মগ ব্ল্যাক কফি বানিয়ে ফিরে আসে। কফির গন্ধ ছাপিয়ে সুস্মিতার গন্ধ নাকে লাগে বাসু তার লেখা সুস্মিতার খুব প্রিয় দুটি লাইন আনমনেই বলে ওঠে 'তোমাকে খোঁজার বেদনায় দেখো ফুটে আছে বয়স, আমার খুব গভীর মৌন রাতে তোমায় মনে পড়ে, সব মনে পড়ে তোমার রোদগন্ধ নাকে এসে লাগে!' একটা দীর্ঘশ্বাস কফি মগে রেখে অন্য একটি মগে ঠোঁট রাখে বাসু আর চোখে ভেসে উঠে সুস্মিতার ছায়া অক্ষর।

কমলকুমার অল্প সংখ্যক পাঠক পেয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন, পরনিন্দা, পরচর্চা ও অপরের চরিত্রহরণকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন শৈল্পিকতায় আর সাহিত্যকে নিয়ে গিয়েছিলেন এমন এক পর্যায়ে যা আমাদের বোধ, অনুভূতি ও পরিপার্শ্বের সব রঙ, রেখা ও উচ্চতাকে ধারণ করে হয়ে উঠেছে এক ভিন্ন উচ্চতর সৃষ্টি।হয়তো তিনি সচেতন ছিলেন, তার রচনারীতি বৃহত্তর পাঠক সমাজের জন্য নয়। সেই জন্যই হয়ত তিনি একটার পর একটা উপন্যাস ছোট পত্রিকায় লিখে গেলেও রচনাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল না, যতদূর জানা যায় তার একটি মাত্র উপন্যাস 'অন্তর্জলী যাত্রা' এবং একটি গল্প সংকলন 'নিম অন্নপূর্ণা' প্রকাশিত হয়েছিল তার জীবিতকালে।

খ্যাতির আকাঙ্ক্ষায় লেখেননি কমলকুমার, অর্থের জন্য তো নয়ই। যতদূর জানা যায় এক্ষণ পত্রিকায় সন্মানী দেবার রেওয়াজ ছিল না, কমলকুমার কিছু পেয়েছিলেন কিনা জানা যায়নি, তবে কৃত্তিবাস থেকে তিনি যে একটিবার চেয়ে তিরিশ টাকার নিয়েছিলেন, তা জানা যায়, আর জানা যায় যে গুটিকয়েক বিদ্যার্থী কে তিনি ফরাসী ভাষা শিক্ষা দিতেন, তাদের কাছ থেকে গুরুদক্ষিণা নিতেন মাসিক একটি টাকা। কফি শেষ হয়। দীর্ঘশ্বাস মাখা মগের কফি তখনো ঝিমুচ্ছে। সুস্মিতা আসেনি। বাসু নিজের সাথে কমলকুমার কিংবা জীবনানন্দ কে মেলাতে মনের শ্লেটে অংক কষে তার ও তো কোন খ্যাতি নেই। অর্থের জন্য সেও তো লেখেনা। তবে সে কে জীবনানন্দ নাকি কমলকুমার? সুস্মিতাই বা কে লাবণ্য নাকি দয়াময়ী? দ্বান্দিকতার বুদবুদ বাড়তে থাকে সুস্মিতাকে তার দয়াময়ী মনে হয়। কমলকুমারের স্ত্রী দয়াময়ী মজুমদার স্বয়ং বিদুষী এবং সুলেখিকা। কিন্তু কোনো বিচিত্র কারণে সধবা অবস্থায় তার এইসব পরিচয় কিছুই জানা যায়নি, তিনি ছিলেন অন্তরালবর্তিনী। এমনকী কমলকুমার তার প্রথম উপন্যাস গ্রন্থটি পত্নীকে উত্‍সর্গ করলেও সেখানে সহধর্মিনীর নাম উল্লেখ করেননি, শুধু লিখেছিলেন 'স্ত্রী কে', সেই দয়াময়ীই কমলকুমারের অকালমৃত্যুর পর উপন্যাসগুলি পত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধার করেন।

বাসু ছাদে উঠে আসে হাতে সুস্মিতার ডাইরী। বারকতক ডাকে, সুস্মি, এই সুস্মি, তুমি কোথায় সামনে এসো। কান ধরছি এবার ক্ষমা করে দাও প্লীজ। সুস্মিতার প্রিয় হাসনাহেনা গাছে ফুল ফুটেছে দেখেই সে দৌড়ে নীচে নেমে আসে বলতে গিয়েও আবেগটা খানিক লাগাম টেনে বলে, তোমার লাগানো হাসনাহেনায় আজ প্রথম ফুল এসেছে দেখবে এসো। উত্তর আসেনা একরাশ নির্জনতার হাওয়া ফিসফিস বয়ে যায়। ডাইরীটা বুকে চেপে বসে পড়ে বাসু। সুস্মিতার লেখা এর আগে তার এত মন দিয়ে পড়া হয়নি আজ ভীষন কষ্ট হচ্ছে। এত ভাল লেখা এর আগে কেন পড়েনি এই আক্ষেপ বোধ তাকে ঘুনপোকার মত কুড়ে কুড়ে খায়।ডাইরীর পাতা উল্টে আবার সুস্মিতাকে ছুঁয়ে দেয় বাসু। কমলকুমারের সাহিত্য রচনার প্রেরণা খুঁজে গেলে প্রথমেই চোখে পড়বে তিনি ছিলেন উত্তম পড়ুয়া, তাঁর সময়ে, একশো বছরের বাংলা গদ্য সাহিত্য ছিলো তার নখের ডগায়, বিশেষ অনুরাগী ছিলেন বঙ্কিম এবং রাজশেখর বসুর, এই ভাষার ঐশ্বর্য নিয়ে তার গর্ব ছিল, তবু কিছু একটা অভাববোধ ও ছিল। অদ্ভুত, সব কিছুকে আপাতভাবে ব্যাখ্যার মধ্যে নেওয়া যায় এমন এক জীবন যাপন করেছেন তিনি।

কমলকুমার শুধু সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হননি, তিনি নতুন ধারার প্রবর্তনে উদ্যত হয়েছিলেন, তার প্রথম উপন্যাস অন্তর্জলী যাত্রা বাংলা সাহিত্যে এসে পড়েছে কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া সহসা, এই গদ্যরীতি ও কাহিনী বিন্যাস একদম নতুন। এমন রচনার মাঝে ডুবে যাবার জন্য বাংলার পাঠকরা ডুবসাঁতারে পারঙ্গম নয়। তার ভাষা শুধু সাধু বাংলা নয়, বাক্য বিন্যাস ও ছিলো একেবারে স্বতন্ত্র। কমলকুমারের সমস্ত রচনার উপাদান দেশজ এবং মূলত গ্রাম ভিত্তিক।আমাদের সাহিত্যে গ্রাম বাস্তবতা বড় বেশি গ্রাম্য এবং আঞ্চলিক শব্দে কন্টকিত। কমলকুমার গ্রামের মানুষদের তুলে দিয়েছেন উচ্চ পর্যায়ে, তারা হয়ে গেছে চিরকালীন মানুষ। খেলার প্রতিভা উপন্যাসে একটি মৃত ভিখিরির লাঠিটা নিতেও যাদের বিবেক দ্বন্দ হয়, তারা অনায়াসেই মহাভারতীয় চরিত্র হয়ে ওঠে।সত্যজিত্‍ রায় বলেছেন 'আপাতবিরোধী এতগুলো দিক তার মধ্যে ছিল যেমন আর কোনো মানুষের মধ্যে দেখিনি'। রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ছিলেন বলে তিনি রবীন্দ্রনাথ কে 'বেম্মো' বলে অবজ্ঞা করতেন, অথচ শানু লাহিড়ী লিখছেন, দাদা প্রায় সময় হেলেদুলে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন। রবীন্দ্র উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র করার কথা ভেবেছিলেন। রবীবাবুর নাটক অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে মঞ্চায়ন করেছেন।

কমলকুমার বাক্য বিন্যাসে স্বতন্ত্র। তিনি যে সাবলীল, ঝকঝকে চলিত ভাষাও লিখতে পারতেন, তার অনেক নিদর্শন আছে। বড় পত্র পত্রিকায় শিল্প সমালোচনা এবং নানা বিষয়ে নিবন্ধ লিখতেন চলিত ভাষায়। উপন্যাস গল্পের ভাষা সম্পর্কে তার বিশেষ চিন্তা ছিল, এ ভাষায় দায় নেই সহজ বোধ্যতার, এ শিল্প নির্মাণের ভাষা, যে কোনো উচ্চাঙ্গ শিল্পের মতনই এর রস গ্রহণ করার জন্য পাঠকদের দীক্ষিত হতে হবে। যেহেতু কমলকুমারের ভাষার কোনো পূর্ব নজির নেই, অন্য কোন লেখকের সাথে তার তাই ভাষার তুলনা চলেনা। তাই তাকে বারবার পড়েই লেখার মর্ম উদ্ধার করতে হবে। আর তাই কমলকুমারকে বারবার পড়তে হয়। তিনি নিজে অনেকসময় বলতেন, বাংলা গদ্যের সিনট্যাক্স হুবহু ইংরেজি গদ্যের অনুকরণে, তিনি সেই প্রথা ভেঙে ফেলে ফরাসি গদ্যের প্রকরণ আনতে চান। তার এই উক্তি আক্ষরিক অর্থে গ্রহন না করেও বলা যায় কমলকুমার এক আশ্চর্য মিনার যা বাংলা সাহিত্যে চিরকাল স্বতন্ত্র হয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে। জীবনানন্দ দাশ আর কমলকুমার মজুমদারের তুলনা এ কারণেই আমায় ভাবায়। গদ্য নয়, দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ থেকে জীবনানন্দ যে কাব্যভাষা গ্রহণ করেছিলেন তা অননুসরণীয় এবং বাংলা কবিতায় তা পূর্বাপর রহিত। জীবনানন্দীয় গোত্রের দ্বিতীয় কোনো কবিকে খোঁজা যেমন নিরর্থক তেমনি একটি ছোট অথচ মনোযোগী পাঠকগোষ্ঠী তৈরী করবেন বলেই যেন কমলকুমার কাহিনীগুলিতে ভাষার বর্ম দিন দিন আরো সুদৃঢ় করেছেন। তিনি সব পাঠককে সহজে তার লিখনবিশ্বে ঢুকতে দিতে চান না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উপমা দিয়ে বলেছিলেন, ফুলবাগানের চারপাশে যেন কাঁটার বেড়া দিয়ে রেখেছিলেন। যাতে অনাকাঙ্খিতরা প্রবেশ করতে না পারে। কমলকুমার কে একবার এত কঠিন করে কেন লিখেন জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন 'বলা কঠিন'। তারপর একটু থেমে বলেছিলেন, 'আমার যে খুব সহজ, তরতরে লেখা পড়তেও কষ্ট হয়, হোঁচট খাই।' কিন্তু আমার বারবার মনে হয় যারা কাব্যপাঠে অভ্যস্ত, তারাই পাঠক হবার জন্য এগিয়ে যেতে পারে। এ ঠিক গদ্য নয়, কাব্যের সৌরভ সর্বত্র অথচ চকিতে এক একটি দেশজ শব্দ এসে ঘোর ভেঙে দেয়। এক কথায় বললে শব্দের বাচকতা, এটা কমলকুমারের সঠিক পরিচয় আর তার লেখা উপন্যাসগুলো আসলে আধুনিক চম্পু। রাত কেটে সূর্যের প্রথম কিরণ পর্দার ফাঁক গলে দেয়ালে টাঙ্গানো ছবিতে বিচ্ছুরিত হচ্ছে বাসুর ঘোর কেটে যায় টেবিলের খালি মগটির পাশে শীতল ব্ল্যাক কফির মগটি দীর্ঘশ্বাস মুছে ফেলে উঠে দাঁড়ায়। বাসুর চোখের তারায় তখন সুস্মিতা, গত পরশুই সুস্মিতা ছবি হয়ে গেছে। ছবিতে এখনো আধ শুকনো ফুলের মালা। বাসুর চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। সে কি অশ্রু নাকি বিচ্ছেদ শিশির..?

1 comments:

2

ধারাবাহিক : নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


ছুটি কথা ৪
নন্দিনী সেনগুপ্ত


আমি যেমন মামাবাড়ি যেতে ভীষণ ভালবাসতাম, তেমনি আমার মাসতুতো ভাই বুবাইও খুব ভালবাসত মামাবাড়ি যেতে। বুবাই সেজমাসির ছেলে, আমার থেকে বছরদুয়েকের বড়। মা আমাকে অনেকবার বুঝিয়ে বাগে আনবার চেষ্টা করেছে বুবাইকে ‘বুবাইদাদা’ বলে সম্বোধন করার জন্য । ফুঃ, দু বছরের বড় আবার বড় নাকি? আমার বয়ে গেছে বুবাইদাদা বলতে। সোজাসুজি বুবাই। ওরা চুঁচুড়ায় থাকে। আমরা যখন দুজনেই আরও ছোট ছিলাম, এতটাই ছোট যে কিছু কিছু কথা আবছা আবছা মনে থাকে এরকম, তখন বুবাইরা কুমারডুবিতে (ধানবাদের কাছে অবস্থিত শহর, বর্তমানে ঝাড়খণ্ড প্রদেশে) থাকত। সেখানে আমি গিয়েছিলাম একবার। ওদের কুমারডুবির বাড়ির সামনে একটা ফুলের বাগান ছিল, সেখানে প্রজাপতি উড়ছিল, আমার এইটুকুই মনে আছে। যাকগে, যা বলছিলাম বুবাইও খুব ভালবাসত মামাবাড়ি যেতে। অনেকসময় এরকম হত যে আমি আর বুবাই দুজনেই একই সময়ে মামাবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি ইস্কুলের ছুটি পড়বার পর। আমরা দুজনেই আলাদা-আলাদা ভাবে শান্ত বাচ্চার প্রকারভেদের মধ্যে পড়তাম, কিন্তু দুজন একত্র হলে কিরকম যেন চঞ্চলতার আবহ তৈরি হত, সে এক ভারি অদ্ভুত ব্যাপার। আমার ধারণা প্রথম শুরুটা বুবাই করত, এটা আমার ধারণা! অন্যরকম কিছু ঘটে থাকলে বুবাইকেও ছুটিকথা লেখা শুরু করতে হবে। বুবাই এখন নামীদামী কোম্পানির বিরাট উচ্চপদে কাজ করে, গাড়ি এবং ভুঁড়ি হাঁকিয়ে অফিস যায়। এখনও ফোনে কথা শুরু করলে বা কখনও দেখা হলে শুরুটা বুবাইই করে। শুরু, অর্থাৎ বদমায়েশির শুরু করে আমার ছোটবেলার গপ্পো বলে। ও শুরু করে, সেই ছোটবেলা থেকেই এমনটি করত, ‘আরেএএএ,--এ তো আমাদের রঞ্জনা! (আমার মামাবাড়ির দেওয়া নাম রঞ্জনা) সেই যে মনে আছে? সেই যে তুই কুমারডুবিতে গিয়েছিলি, তারপর ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে পাঁউরুটি খাচ্ছিলি!’ আমি একটু একটু রাগতে থাকি। যারা পাঠক-পাঠিকা, তারা ভাবতেই পারেন যে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে পাঁউরুটি খাবার কথায় রেগে যাওয়ার কি হল? তাহলে শুনুন, তার পরের বাক্যটা বুবাই বলে ওঠে, ‘খাচ্ছিলি—কিংবা খাচ্ছিলি না’। স্বাভাবিকভাবেই আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন প্রশ্ন করতাম, ‘মানে? খাওয়া এবং না খাওয়া—দুটো একসঙ্গে কিভাবে হতে পারে?’ বুবাই উত্তর দেয়, ‘হতেই পারে, আমরা ভাবছিলাম তুই খাচ্ছিস, আসলে-- তুই প্রথমে আঙুল দিয়ে পাঁউরুটির স্লাইসের ঠিক মাঝখানে একটা ফুটো করতিস’। আমি রেগে গিয়ে বলতাম, ‘তারপর?’ বুবাই তখন উত্তর দিত, ‘না মানে- আমি তো শ্রীকৃষ্ণকে কখনও দেখিনি! শ্রীকৃষ্ণ বোধহয় সুদর্শনচক্র ঐভাবেই চালাতো! তুই ঐ পাঁউরুটির স্লাইসের ফুটোর মধ্যে তর্জনী ঢুকিয়ে বাঁইবাঁই করে ঘুরাতে থাকতিস, তারপর ঐ পাঁউরুটির মধ্যিখানে একটা বড় ফুটো হয়ে যেত, শুধু ধারের চৌকোণা অংশটা পড়ে থাকতো! মাসিমণি ভাবতো তুই ধারের অংশটা বাদ দিয়ে খেয়েছিস, কিন্তু আসল গল্পটা আমি জানি এবং তারপর তুই ধারের চৌকোণা অংশটার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বালার মত করে পরে বসে থাকতিস! বাহবা, এখনও ওইরকম গয়না পরিস তুই?’ 

এইপর্যন্ত পড়ে এইবার বলুন তো পাঠক-পাঠিকারা, যে- রেগে গিয়ে মানুষ মানুষকে কামড়ে দিতে পারে কিনা এইরকম ইয়ার্কিতে! ঠিক ধরেছেন, আমি সত্যি সত্যি বুবাইকে ছোটবেলায় একবার কামড়ে দিয়েছিলাম। তবে ইয়ার্কিতে ক্ষেপে গিয়ে নয়, ভয়ানক মারামারি করে। আমরা শান্ত বাচ্চা হলেও অদ্ভুতভাবে নিজেদের মধ্যে ভীষণ মারামারিতে জড়িয়ে পড়তাম। সেটা শুরু হত ন’মামার নবজাতক পুত্র শুভর বিছানা থেকে দুখানা ছোট ছোট পাশবালিশ তুলে নিয়ে গদাযুদ্ধ করবার সাথে সাথে। এরকম হয়েছিল যে আমরা দুজনে গদাযুদ্ধ করে শুভর পাশবালিশ ফাটিয়ে দিয়েছিলাম এবং পরে দিদা সেই কোলবালিশ আবার ঠিকঠাক সেলাই করে দিয়েছিলেন। কি হাসিমুখে দিদা সামলাতেন নাতিনাতনিদের দৌরাত্ম্য সে এক দেখবার জিনিস! দিদা আমাদের বদমায়েশিতে বিপর্যস্ত হয়ে বাঙাল ভাষা ভুলে গিয়ে কলকাত্তাই টানে বলতেন, ‘ও সোনামণিরা, তোমরা কেন দুষ্টুমি করছো? তোমরা একটু শান্ত হয়ে বস না’। এই অবধি বলে দিদা অনেকসময় আমাদের দুজনের হাতে কাগজ আর পেন্সিল ধরিয়ে দিয়ে বলতেন ‘ছবি আঁকো, সোনামণিরা!’ হ্যাঁ, এই কায়দাটায় বেশ কাজ হত, কারণ আমার মনে আছে, আমরা দুজনেই ছোটবেলায় ছবি আঁকতে খুব পছন্দ করতাম। আমি আঁকতাম রাজা-রানি অথবা গ্রামের ছবি যেখানে নারকেলগাছ থাকবেই থাকবে। বুবাই আঁকতো কার্টুনের চরিত্রগুলো। খুব ছোট বয়সেই বুবাই খুব সুন্দর আঁকতে পারতো হুবহু একরকম বাঁটুল দি গ্রেট, হাঁদা, ভোঁদা, টিনটিন বা ক্যাপ্টেন হ্যাডকের চেহারা। শুধু অরণ্যদেবটা ঠিকঠাক পারতো না। জিজ্ঞাসা করলে বলতো, ‘ধুস, কিরকম গুলি গুলি মাসল্ দ্যাখ! কিরকম বিচ্ছিরি, ভাল্লাগেনা, তার চেয়ে বরং দ্যাখ আমার বাবার ছবি আঁকি’। একথা বলেই সঙ্গে সঙ্গে এক টানে বুবাই ইয়া মোটা গোঁফওয়ালা, মাথায় পাগড়ি, হাতে বন্দুক, গলায় টোটার মালা, এইরকম একটা লোকের ছবি এঁকে ফেলত। আমি দেখে খুব ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, ‘এবাবা, এটা সেজমেসো কোথায়? এটা তো তুই একটা চম্বলের ডাকু মানসিং আঁকলি!’ এবার বুবাই কিরকম দুঃখদুঃখ মুখ করে বলতো, ‘ডাকুই তো! তুই জানিস না, বাবা আসলে ডাকু মানসিং। একটু লক্ষ কর, বাবার গোঁফটা কিন্তু এইরকমই কতকটা, আর মাথার টাকটা যদি তুই পাগড়ি দিয়ে ঢেকে দিস, এইরকমই কিন্তু দেখাবে’। আমি পুরোপুরি ফেলে দিতে পারি না ওর কথাটা। কিন্তু সেজমেসোর মত পরিশীলিত, মৃদুভাষী মানুষ কি করে ডাকু মানসিং হবেন, সেইটাও আমি ঠিক ভেবে পাইনা। বরঞ্চ আমার বাবা একবার ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় ‘দস্যু রত্নাকর’ সেজেছিল, হু-হু-হু-হা-হা-হা-হা-হা-হা করে ডাকাতদের মতো অট্টহাসিও হাসতে পারে। সেজমেসো অত জোরে হাসি তো দূরের কথা, বাক্যালাপও করেন অত্যন্ত ধীরে এবং নীচুগ্রামে। কিন্তু বুবাই বলেই চলে, ‘শুধু চেহারা? নামেরও মিল আছে। ভাব একবার, বাবার ভাল নাম কি? না-মানবেন্দ্র। মানবেন্দ্রই মানসিং। এইটাই আসল কথা, বুঝলি? আর আস্তে কথা বলা? জানবি যারা ডাকাত, তারা ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করে দেয়। আমার বাবা আস্তে আস্তে কথা বলে যখন শাসন করে, তখন মনে হয় এর থেকে মায়ের হাতের পাখার ডাঁটের পাঁচটা ঘা অনেক ভালো’। এতদূর বলে বুবাই উদাস ভঙ্গীতে পুকুরের জলের দিকে চেয়ে থাকে। আমি খুব ধন্দে পড়ে যাই, ভাবতে থাকি এ কি করে সম্ভব? চম্বলের ডাকু মানসিং? দুত্তোর, আর কাউকে জিজ্ঞাসাও করতে পারিনা, বুবাই যে আমায় দিব্যি দিয়েছে, কাউকে না বলতে এই কথা। বাব্বা, এই এদ্দিন পরে, এত বচ্ছর পরে, দিব্যির দোষগুণ সব কেটে গিয়েছে ধরে নিয়ে এই ছুটিকথায় এসব গোপন কথা বিবৃত করলাম।

-চলবে 

2 comments: