Next
Previous
Showing posts with label মুক্তগদ্য. Show all posts
0

মুক্তগদ্য - স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার

Posted in



মুক্তগদ্য


ঠামাইয়ের ঝাঁপি
স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার


করমচা রাঙা সুজ্জি পুবের দরজা খুলে বাইরে এসেছে কি আসেনি অমনই গলায় কুঁচরঙা চুণীর মালা পরে, সারা গায়ে কচিধানের বরণ নিয়ে এক ঝাঁক টিয়ে রামধনু আকাশে ডানা মেলে দিল। তাদের পাখায় প্রবালদ্বীপের সুবাস মাখা, চোখে নিঝুমপুরের অলৌকিক আলো। আকাশপানে তাকিয়েই চাঁদের বুড়ি এক টুকরি তুলোয় মোড়া মনছবি যেই না ছড়িয়ে দিল অমনই দিনের বুকে লুকিয়ে থাকা তারারা, চোখপাতা পড়ল কি পড়ল না, বুনে ফেলল সবুজ আঁচল এক মেঘডুম্বুর শাড়ি। 

টিয়ের ঝাঁক ঝপাং ঝপাৎ করে সেই শাড়ি জড়িয়ে নিল তাদের পাখায় - 

চল্ চল্ কল্ কল্ 
কোনখানে
চাঁদ বরণী কন্যে কাঁদে
যেইখানে...

রকম সকম দেখে কলমীলতার ওড়না গায়ে ভোঁদড় ঠাকুরানী ডুব দেয় পান্নাপুকুরের জলে আর ওঠে। 
বোয়ালমারী রাজা দিকশূণ্যপুরের নদীর পানে মনপবন নাও ভাসিয়ে দেয়, ততক্ষণে ঘাটের পৈঠাতে তাথৈ নাচন নেচেই সারা খোকন বাবু... 

সর্ সর্ ধর্ ধর্
কদম তলায় কে
আমরা সরাল সাজবে
খোকন তার যে হবে বে'...

লাল টুকটুকে কিংখাবের ধুতি - সোনারবরণ মেরজাই নিয়ে হই হই করে সবাই নেমে পড়ল ঘাটে। 

ঝমাঝম ঝমাঝম 

বনগাঁবাসি মাসি পিসি মল বাজিয়ে লক্ষ্মীপেঁচার পিঠে চড়ে খই মোয়া নিয়ে ঘাটে এসে নামে... তক্ষুনি খোকাকে বর সাজিয়ে মাসিপিসির কোলে ফেলে দেয় সরালের দল... 

একগালে চুমু খায় মাসি
আরগালে চুমু খায় পিসি

সোনার আটন সোনার বাটন কে বকেছে বল?

কেউ বকেনি কেউ বকেনি কন্যের পানে চাই... এই কথা! হাস হাস ফিসফাস বাঁশবন নড়ে, চোখে চশমা এঁটে ভুঁড়োশিয়ালী হাতের পাঁজি পড়ে...

'আজ সুজ্জি যখন চাঁদের হাতে ঘর দুয়ারের দেবে চাবি, তখন পাবি'। 
কি পাব কি পাব - কুব কুব করে কুবো ...

দিকশূণ্যপুরের ঘাটে নাও তৈরি, সাঁজসুজ্জির সিঁদুরমেঘ নিয়ে ভুতুম বসে হালে - আকাশ থেকে ঝাঁক টিয়া ফেলে টুপ নায়ে পড়ে পদ্মমালা মাসি বলে ষাট। সরাল ফেলে টাপ নায়ে পড়ে সাঁজ শিউলি মালা পিসি বলে ষাট। 

দুজনকে নিয়ে সবুজ গাঁ পেরিয়ে তিনপল্লীর মাঠ পেরিয়ে সবাই এসে নামে দুখসায়রের তীরে দুয়োরাণীর কুটীরের দোরে - ঢোল ডগরে ঘা দিয়ে শঙ্খচিল উড়ে যায় আকাশপট পার হয়ে অন্য খোকন অন্য কন্যের মিল পাতাবার দেশে... 

দূরে আরও দূরদেশে... দূরে দূরে - 

দুয়োরানি কোলে পেল খোকা পেল কন্যে
কথা ফুরালো নটে মুড়ানোর সুরে সুরে...
0

মুক্তগদ্য - দীপাঞ্জনা মণ্ডল

Posted in


মুক্তগদ্য


প্রতিসরণ
দীপাঞ্জনা মণ্ডল


ইস্কুলের নাম যার নরনারায়ণসেবা, তার বাড়ির নাম কাঙালিভোজন। নামের সঙ্গে ঈশ্বরের কোনও এক সমর্থ নাম জুড়ে দিয়ে খুব সম্মান হয়, ইহা লোকবিশ্বাস (হরিজন)। ঐ একটু মোলায়েম করে বলা আর কি! ধরো, বলির আগে ছাগশিশুর ঘাড়ে-গর্দানে গাওয়া ঘি ডলার মতো অনেকটা। না না, এতে করে এক কোপে ধারালো খাঁড়া নামিয়ে ফেলতে পেরে যে বলি দিচ্ছে তার সুবিধে হয়, এটা একপেশে ভাবনা। একবারে গলা নেমে গেলে তো বলিপ্রদত্তেরও সম্ভাব্য সর্বাধিক সুবিধা। বলি যাকে হতে হবেই, তার ক্ষেত্রে শেষ ইচ্ছে মানে তুলনামূলক কম কষ্টের মৃত্যু। ছাগুলে বুদ্ধি ঘি-এর গন্ধে সুতরাং মানতের সঙ্গত করে। সোজা আঙুলে না উঠলেও ঘি কিছু আঙুল বাঁকিয়ে স্বল্পসঞ্চয় প্রকল্পে রাখা আবশ্যক। ছাগল আঁতেল হলে কি প্যাঁচে খেলত, সেসব অশৈলী কথা না ভাবাই ভাল। অতএব মোলায়েমের মর্ম আছে। অর্থ যা-ই হোক, শেষত অনর্থ ঠেকাতে তুমি কীভাবে বললে সেটা গুরুত্বের। তা দিয়ে তোমার ভবিষ্যৎ কিছু বিনির্মিত হবার সম্ভাব্য সম্ভাবনা নির্মাণ করা যায়।
 
উদ্দেশ্যপ্রবণ বুদ্ধিমত্তা এরকম নামকরণে দড়। কোনও শিশু ভয়ে বা ব্যথায় কাঁদলে এরা বলে, ‘তুমি না সাহসী! তুমি কাঁদছ!!!’ কি গেরো ভাই! ওই বাচ্চাকে পর্যন্ত তার সামনে উপস্থাপিত এক ইতিবাচক বিশেষণের টোপ দেখিয়ে কান্না গিলে ফেলার বীরত্বে বন্দী করে ফেলা হয়। এবার সারাজীবনের জন্য কিছু বার খাওয়ানো পিঠ চাপড়ানির প্রত্যাশায় সে সাহসী হবে নিজের ক্ষমতা মতো। গুণ্ডা হতে পারে, গুণ্ডা ঠেঙাতে গিয়ে শহিদ হতে পারে, মুখের ওপর নিজের বুদ্ধির মাপে বোঝা সত্যি ট্যাঁকটেঁকিয়ে শোনাতে পারে, সরকারি সম্পত্তি অনবরত নষ্ট করতে পারে, ঘুষ নিতে পারে, টেবিলের তলায় মোক্ষম সময়ে ঘুষ এগিয়ে দিতে পারে, প্রেম–প্রস্তাব অনুশীলনসাধ্য প্রকরণে পেশ করতে পারে, শৈল্পিক সুষমামণ্ডিত সত্যির আড়ালে চটচটে দুর্গন্ধের মিথ্যে লুকিয়ে তার মতে বৃহত্তর স্বার্থসিদ্ধি করতে পারে – এসব সে তার জীবনদর্শন অনুযায়ী সাহসিকতা হিসেবেই চিনেছে, জেনেছে, বুঝেছে। সুতরাং সারাজীবন সে হিসেবমতো বাহবা-র দাবিদার। 

এতদ্বারা বোঝা গেল, নামে অনেক কিছু আসে যায়- এই রবিবাণীটি শেক্সপিয়ারবিরুদ্ধ হলেও এ লেখায় তারই সমর্থনে প্রচার। নাম আসলে একটি পরিচয়, সমষ্টি থেকে ব্যক্তিকে আলাদা করবার অবলম্বন। চেনাশোনা এমন অনেক আন্তরিকতা উদযাপনকারী আমাদের আশেপাশে থেকেই থাকেন যাঁরা শৈল্পিক অভ্যাস দক্ষতায় নামকরণ করেন। রাজলক্ষ্মী এদের মুখে রাজু, অনন্যা- অনু ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। পুংবাচক-গুলির বিশেষ বিশেষ উদাহরণ মনে ভেসে উঠলে যে যার মতো মুচকি হাসুন অথবা এক্ষুনি পুরনো কোনও এরকম অভিধাঅর্জনকারীকে ফোন করে ফেলুন। কিন্তু ওই ব্রেক নিয়ে এখানেই ফিরে আসুন। এই নামকরণগুলি অনেক সময়ই চরিত্রবৈশিষ্ট্যের অনুগামী হয়। ধরুন যার বংশগত পাইলস আছে তার বন্ধুমহলে নাম ‘কষ্ট’, তার আর কেষ্ট হওয়া হলো না(অন্তত হবার সম্ভাবনা কমল)। এরকম নাম ভেঙে নাম, ব্যাঞ্জনাময় নাম এসব তেমন একটা প্রভাব রেখে যায় না শেষত। তার কারণ খুব খাজা বা আত্মসম্মান বিধ্বংসী নাম-ও এসব ক্ষেত্রে বহুব্যবহারে খরতা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু ওই যে ‘তুমি তো ছেলে, তোমার চোখে জল কেন’ এ আরোপ জীবনান্তের আগে নিশ্চিহ্ন হতে না দিতে চেয়ে জীবনপণ করে ফেলা যায়; যেমন যায় ‘আ হা, কি ভাল মানুষ তুমি’ অথবা ‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করি’ অথবা ‘আমি জানি তুমি আমার কোনও ক্ষতি হতে দেবে না’ ইত্যকার পরিচয়ের রক্ষাকল্পে। এঁরা মারাত্মক সব গণ্ডি হয়ে উঠবার ক্ষমতা রাখেন। যে নিরীহ মানুষটি সকালে টয়লেটের বন্ধ দরজার আড়ালেই একমাত্র তার ক্ষতি ও ক্ষতের প্রতিশোধ অনুমানের চেষ্টায় একটা ধারালো ছুরি ধারণ করতে চেয়েও ঝরঝরিয়ে কেঁদে পরের অধ্যায়ে যায়, তাকেও ‘তুমি তো প্রয়োজনে তীব্র প্রতিশোধ সক্ষম’ দেগে দিলে তার জ্বালা ফুস হয়ে যেতে সময় নেয় না। সে জানত সে পারে না, সে জানল সে পারতেই পারে। অতএব পেরে ওঠবার দরকার নেই তারপরে। ঘেঁটে ঘ। কিসস্যু বোঝা গেল না। হুম্‌ম। চোরাবালির মধ্যে যে ঘুম নেমে আসে তার থেকে জেগে উঠবার উপায় জানো? 

যথেষ্ট ক্লান্ত হবার পক্ষেও বড় বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়লে দু-হাত পা দিয়ে জড়িয়ে ধরা যায় ঝুরঝুরে বালিদের। যারা নিচে নামে আর নেমে নেমে যায়। আমরা আরও নিচে নিচে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে চেনা না গেলে মুখের ওপর একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলি, সময়। তারপরে ঘুমের সময়টুকু নোনা জল ফুটিয়ে কেটে গেলে পুরনো শ্যাওলাধরা ইঁট বেরিয়ে আসা নিঝঝুম বাড়িগুলোর দরজা নাড়ি। সাড়া পাই, অথবা পাই না। কিচ্ছুতে যায় আসে না কিছু। সাড়া পেলে ভাল, তাকে বলি - আমায় সেই যে ডেকেছিলে গ্লুকোমা বলে, আর একবার ডাকো। ডাক জন্মায়, অচেনা সুরে। শীত করে, জ্বর আসেনা, আমি পায়ে পায়ে ফিরে আসি আতঙ্কে। সাড়া না পেলে দরজার ওপরে কিল, চড়, ঘুষি, মাথা খোঁড়া। তারপরে নখের আঁচরে স্বাক্ষর- এসেছিলাম, সোনার তরী। সেই জ্বরবিহীন শীত মেখে পশ্চাদপসরণ। এরকম বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে সব রাস্তা আর দরজা আর জানলা আর বারান্দা আর ঘরের আভাস এর ওর তার ঘাড়ে পিঠে চেপে পড়ে। এক্কেবারে হারিয়ে যাবার আগের মুহূর্তে সামনের বাড়িকেই নিজের মনে করে আমি ঠিকানা মুখস্থ করতে শুরু করি। কেউ নাম দিয়েছিল ‘আঁকড়ে ধরা’। মনে হয় ঠিক এরকমই হবার ছিল। আমি ঠিকানাটা, বাড়িটা, রাস্তাটা, জানলা, জানলার বাইরের আকাশ, ছাতের ঢাল সঅঅঅব আঁকড়ে ধরে ফেলি। আবার সব গলে যায় আঙুলের ফাঁক দিয়ে। 

অথচ দেখা যায় বাহ্যত, আমার বা আমাদের মাথার ওপরে ছাত, পায়ের নিচে মার্বেল, চোখে ছায়া, মুখে আলো, হাতে কাঁটা-চামচ। অতএব দুঃখ আমাদের বিলাস ব্যক্তিগত। মাঠে মাঠে একা মুখ কালো করে পাখি তাড়ায় যে কাকতাড়ুয়াগুলো, তাদের কালো মুখে অনাবিল হাসি স্পষ্ট প্রতীয়মান, দাঁতের সজ্জা যদিও বিসদৃশ, তবু হাসি নির্বিষ। এত স্পষ্ট যে ওদের কালো মুখ পাদপ্রদীপের আলো পায় না। অন্যদিকে, সকালে জানা গেছিল আশ্চর্য পরিণত চোখ, নাক, কান, মুখ আর ত্বকের বিষয়ে। বেলা গড়াতে জানা গেল চক্ষুদান-ও হয়নি। ধীরে ধীরে পশ্চিমের জানলা গলে পড়তে শুরু করলে ঘরের মেঝেয় বোঝা গেল চাকচিক্য সাময়িক। গোধূলির ক্লান্তি দেখাল মাটি তাল তাল, তারও অন্ধকার গর্ভে কিছু শুকনো খড় গৃহপালিতের বরাদ্দ। আর শক্ত মেরুদণ্ডটি চিহ্নিত হলো ক্ষণিক জ্বালানি হবার যোগ্য কঞ্চি হিসেবে। এই এই এই শুধু। অস্ত্র, শাড়ি, গয়না, অঙ্গরাগ, গঙ্গামৃত্তিকা, খড়, বাঁশ, এমনকি বেশ্যাবাড়ির মাটিটুকুও দেবীত্ব চায় কিনা তিথিনক্ষত্র নিয়ন্ত্রিত, কেউ কখনও জিজ্ঞাসু হয়নি সে বিষয়ে। অতএব বিসর্জনে ‘আসছে বছর আবার হবে’-তেই ঘামতেল সার্থকতা। কাকতাড়ুয়াগুলো একই মেরুদণ্ড নিয়ে সোওওওজা দাঁড়িয়ে থাকে রোদ-জলে। ছেঁড়া জামা রুগ্ন কাঁধ বেয়ে ভারসাম্যে দোলে। একা একটা গোটা মাঠের দায়িত্বে কাকতাড়ুয়া ভয় পায়। পা একটামাত্র বলে ছুটে পালাতে পারে না। অনৈসর্গিক হেসে যায়। ওর দায়িত্বের সীমানা বরাবর সর্পিল বিচ্ছিন্নতা অবিচ্ছিন্ন অন্তর্জালের মতো ছিটিয়ে থাকে। ফলত পাশের কাকতাড়ুয়ার কাঁধে হাত রেখে দুজনেই দুটো করে পা পাবে এমনটা সম্ভাব্যতা পায়না। চাঁদোয়াবিহীন কাকতাড়ুয়া আর থিমওয়ালা মণ্ডপের কেন্দ্রে স্থাপিত প্রতিমার মেরুদণ্ড এক। একজন পার্থিব ফসলের রক্ষক, অন্যে অপার্থিবের। শস্য যারা কেটে নিয়ে যায় গুচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে দুধেল রাতে নদীর নিচে শুয়ে থাকা চোখে অথবা মাঠে একা কাকতাড়ুয়াদের ছরকুটে দাঁতে জিঘাংসা জমে। চাঁদের আলো ওদের শয়তানের শক্তি দেয়। জলের ভেতরে চার অথবা তার থেকে বেশি বাহুতে সাঁতার দিয়ে আর বাতাসে আলগা জামার ডানা মেলে ওরা দুঃস্বপ্ন তৈরি করে।

প্রতিমা আর কাকতাড়ুয়ার পাহারায় থাকা সমস্ত ফসলে অমৃত মেশায় প্রহরীরা। বংশানুক্রমের জীবনে ওমনি মৃত্যুর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়ে যায়। ফসলের গোলা বাঁধবার আকাঙ্খায় ওরা শস্যের গুচ্ছের বদলে কাস্তে চালায় প্রতিবেশীকে লক্ষ্য করে। রক্ত ঝরে আর রক্তবীজ বেড়ে ওঠে। ওরা ছিন্নমস্তা খোঁজে। আর ভুলে যায়, যাকে ওরা ছিন্নমস্তা সাজিয়েছিল তারও ওই কঞ্চির মেরুদণ্ড একটা ছিল। ও মেরুদণ্ড ভাঙে তবু মচকায় না। অবাধ্য মেরুদণ্ডগুলো আর কোনও নামের ভেতরে বন্দনার গণ্ডিতে অথবা সংজ্ঞার বাঁধনে থাকবে না। দেবত্বে বা ক্লাউন হয়ে নয়, প্রান্তিক বা হরিজন হয়ে নয়, ওই কাঙাল বা নরনারায়ণ হয়েও নয়- ওরা ওদের মতো থেকে যেতে পেরে বেঁচে থাকবে। একটা সোজা মেরুদণ্ড আছে তো, আর কিছু উপচারের ভিক্ষে দেবার স্পর্ধা সহ্য করবার দরকার কি!
1

মুক্তগদ্য - স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার

Posted in


মুক্তগদ্য


যে_ফুল_ঝরে_সেই_তো_ঝরে
স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার



দক্ষিণের বারান্দায় বসে মন অনেকক্ষণ ধরে উলুক ঝুলুক শালুক ফুল হয়ে ইতিউতি চাইছিল... হঠাৎ দেখি দুটো মৌমাছি, একটা ভোমর আর এক হরিণ টিপ প্রজাপতি কেউ বসছে জুঁইএর বুকে, কেউ মল্লিকায় আর কেউ চাঁপাফুলে। মধুকরই একমাত্র সঞ্চয়ী, মধুটুকুও নেয় আবার পরাগে পা রাঙায়... মন বলে- দেখো, চোখপাতা খুলে দেখ, কেউ কিন্তু ফুলবুক নিয়ে বিবাদ করছে না--- ভাবি তাই তো! 'গুন গুন গুঞ্জন ছন্দে মধুকর ঘিরি ঘিরি বন্দে'... আহা! পাখনা দুটো মেলে দিয়ে তিরতিরিয়ে ফুলের বুকের কাঁপন নিয়ে কেমন সোহাগে মেতেছে প্রজাপতি। ভোমরাটা একটু দস্যু প্রকৃতির, বোঁ করে বসেই শুষে নিল চাঁপার অধর মধু। টুক্ টুক্ টুক্ -মন বলে, আবার কি ভাবনা ধরলে গো?

বলি, এই যে মধু আর পরাগ মিলেজুলে চলে যায় অন্য ফুলবুকে অমনি দেখো পাপড়ি ঝরা শুরু, এক দুই করে সব ঝরে যায়... তাই বলে কি শেষ থাকে না? থাকে গো, ছোট্ট যৌবন মুকুল ফল। সে পুষ্ট হয়, সরস হয় তারপর এক সময় তার শিমূলফাটা বুক ছড়িয়ে পড়ে মাটির বুকে, আশ্রয় নেয় পাখপাখালির গর্ভে। আবার জন্ম, আবার অঙ্কু্‌র, আবার গাছ, আবার ফুল- 
"যে ফুল ঝরে সেই তো ঝরে 
ফুল তো থাকে ফুটিতে
বাতাস তারে উড়িয়ে নে যায়
মাটি মেশায় মাটিতে"
...আমি শ্বেতপদ্মের বুকে এক স্বর্ণচাঁপাকে শুইয়ে পদ্মপাতায় ভাসিয়ে দিলাম দীঘির জলে। ছলাৎছলাৎ "ঢেউ দিয়েছে আমার মর্মতলে" ফুল ফুটিলে কি সুখ? শ্যামল লাবণ্য ছেনে যৌবন উঁকি দেয় রাই মনে। বলে "আমি এলেম তারি দ্বারে" ...ঘাই মেরে মন বলে ফুল কি শুধু রাইয়ের? ঠিক তো কানু দেহেও যৌবন ফুল আসে, চমক লাগে তার দেহে। কিসের পরশন আশে সেও দিক ভুল করে "তার পরাণে কোন পরশমণির খেলা" ...শুধু যাতনা একটাই। ফুলেদের সমাজ আছে, যৌবনমধু আছে, মধুকর আছে তবে সব কেমন রুনুরুনু রুনুঝুনু ধ্বনির মতো। আর এই যে আমার মানুষ মনের সমাজ এখানে কেবল বেনিয়ম। যৌবনমদ মত্ত পুরুষদণ্ড খুঁজে নেয় শিশুদ্বার। ছিন্ন হয় জরায়ুফুল। ধ্বস্তবিধ্বস্ত হয় বেহুলা নূপুর। উলুক ঝুলুক শালুক মন ভেবে মরে, তবু কেন চলে রোজ ফুলবুক ছিন্ন ফুলদোল!? 

চারিদিকে শব পরিবাহী
ঢাকা দণ্ড চক্র ঘুরে মর
ফুলেরা অকালে ঝরে যায়
সূর্য বড়ো পরিতাপে কাঁদে।
দাহ জ্বলে ওঠে বড়ো খেদে
বিষানে ধ্বনিত হয় সুর
প্রেম গেছে মরে...
তারপর পড়ে থাকে ছাইউড়ি
খেলা ফুল পোড়া আবিরে 
রাঙানো। আমার শালুকমন
ফুলভাসা চিতাকাঠ ছুঁয়ে
মন্ত্র পড়ে তর্পণের তিলাঞ্জলি নিয়ে...
3

মুক্তগদ্য - পল্লববরন পাল

Posted in


মুক্তগদ্য


অ-এ অজগর, স-এ সিল্প
পল্লববরন পাল


শহর জুড়ে মধ্যরাতের দাপাদাপি। দূষণে ডুবে গেছে সূর্যোদয়। সকালটকাল কী জিনিস – খায় না মাথায় দেয় – অজগর শব্দে ব-এ শূন্য নাকি ড-এ শূন্য - এ প্রজন্মের গুগুলিত মস্তিষ্কে আপডেট চাইলে স্ক্রিন জুড়ে ইয়াব্বড়ো জিজ্ঞাসাচিহ্নের খিলখিল হাসি। বাঁশের বাঁশরি বা রণতূর্যটুর্য নয়, হাতে হাতে এখন মোবাইল আর একে সাতচল্লিশ। 

সহরে সহরে সুধু স্যামবাজারের সসীবাবুদের – না না, তালু বা মূর্ধা নয়, শুধু কুমড়োদাঁতের সিণ্ডিকেটসিল্পের রমরমা – মানুস সুখে আর সান্তিতে কচকচিয়ে ওয়াইফাই ঘাস খাচ্চে। সুখসান্তিরও সিণ্ডিকেট আচে – পয়সা ফেলো সুখ গেলো ঢকঢকিয়ে আর সান্তিতে সয্যারতি করো, ব্যাস

রোজকার এই যে অসংখ্য সদন্ত হসন্ত-হোঁচট, সেই হসন্তকে যাপনপংক্তিতে একটা গোটা মাত্রা দেওয়াটা ঠিক হবে কিনা – এ প্রশ্নের উত্তরের আশায় গিয়েছিলাম কফিহাউসে 

সেখানে সুসীল সিণ্ডিকেট সালিসী ডেকে নিদান সুনিয়ে দিলো – সিস্ন কুচুৎ। 

-----------------------------------------

ওং শান্তি

তুমি ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙবে নাকি হাই তুলবে – সেটা ঠিক করার তুমি কে? আগে দাঁতমাজা নাকি পটি – ব্রেকফাস্টে টোস্ট নাকি ওমলেট – অফিস যাবার পথে দেখা হলে জীবনদাকে হাই নাকি ভালো আছেন তো – আদৌ মুখ তুলে হাসি বিনিময় করবে কিনা – ফেরার পথে কোন দোকান থেকে বাজার করবে – কোন ব্র্যাণ্ডের বিস্কুট – ডিনারে কাতলা না মাগুর – বউ আদরের সাপ্তাহিক ডেট ও স্টাইলের রুটিন 

এ সবের কোনো কিছুই ঠিক করার এক্তিয়ার তোমার নেই – তুমি শুধু একটি শান্তিপ্রিয় ভোটার কার্ড, ডেমোক্র্যাসির ডেমো 

ক্র্যাস করবো 

আমি 

আর আমার সিণ্ডিকেট 

----------------------------------------------- 

সম্বদ্ধোনা

বুদবার আউড্ডোর মঞ্চে - সাম্বাদিক পেস-ফেস ক্যামেরা আলো হৈচৈ – পোচুর মানুস মানে পাব্লিকের সামনে আম্মা আপনাকে সম্বদ্ধোনা দেবেন – নেবেন না মানে? আপনার আস্পদ্দা তো কম নয়? আপনি এতো বড়ো একজন ইয়ে, সারা দেস্‌ আপনাকে চেনে, সম্মান করে – আর আপনি আম্মাকে অসম্মান করচেন? সুনুন দাদা, ঠিক আড়াইটেয় গাড়ি পাটিয়ে দেবো – মাঞ্জাটাঞ্জা দিয়ে রেডি থাকবেন, ব্যাস্‌

গাড়ি যদি খালি ফেরে - মনে রাকবেন – বৌদি কিন্তু মেয়েচেলে –আমাদের কাচে পাঁচ থেকে পঁচাসি সব এক রে্ট - রাস্তাঘাটে কোতায় ককোন কী হয়ে যাবে - বাঁচাতে পারবেন তো? আপনার নামে আলিপুরদুয়ার বা সুন্দরবনে রেপকেস – ভিক্টিম রেডি আচে স্টকে – কোর্টে আপনাকে সনাক্ত করবে - ভাল্লাগবে? 

আপনি বুদ্দিমান লোক – বুদ্দিজিবি – আম্মা আপনাকে সম্মান দিচ্চেন, আর আপনি আম্মাকে রিটান্‌ দেবেন না – কোন কোম্পানির মাল আপনি? 

----------------------------------------------- 

ঢ্যা র‍্যা র‍্যা র‍্যা

অহঙ্কার নাকি স্পর্ধা –গর্ব নাকি গরিমা - ঠিক কোন শব্দটা মানানসই হবে – টালবাহানা করতে করতে কলেজস্ট্রীট কফিহাউস থেকে শিবপুর বি ই কলেজ – সিধে রাস্তা সোয়া ঘন্টার পথ – দরজা খুলতেই জি বাংলা সারেগামাপাধানি – দত্তদা আর বৌদি এতোক্ষণ তোমার জন্য বসে বসে – এখন আর চা দিলামনা, হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসো‍ - জানো আজ নিউজে বললো – সিডনি না কোথায় রেস্টুরেন্টে ঢুকে ঢ্যার‍্যার‍্যার‍্যা – কাশ্মীরসীমান্তে ঢ্যার‍্যার‍্যার‍্যা – সারদা নারদা বরোদা ঢ্যার‍্যার‍্যার‍্যা 

খাবার টেবিলে রুটির সঙ্গে ঢ্যার‍্যার‍্যার‍্যা – রাতবিছানায় রুটিন-রতির ঢ্যার‍্যার‍্যার‍্যা পেরিয়ে –

কই রে? কী যেন শব্দগুলো? 

অহঙ্কার না গর্ব? নাকি স্পর্ধা? 

কোথায় গেলি? 

ঢ্যা র‍্যা র‍্যা র‍্যা

ঢ্যা র‍্যা র‍্যা র‍্যা 
0

মুক্তগদ্য - দীপাঞ্জনা মণ্ডল

Posted in


মুক্তগদ্য


হয়ে ওঠার অন্ধকার ও ফিনিক্সের আগুনযাপন
দীপাঞ্জনা মণ্ডল


অপর্যাপ্ত আলোর জন্য দুজনে দুজনের মুখ দেখছিল অপলক, দৃষ্টিটা জন্মাচ্ছিল গলার অথবা আঙুলের ডগার সীমাবদ্ধতা থেকে। বলায় বা ছোঁয়ায় যা আঁকা যায় না - চাঁদের আলোর প্রতিফলন, পর্দার ছেনালি আর অনিয়মিত শ্বাস সেই সব গুনগুন করে চলছিল। চোখ দীর্ঘ পরিশ্রমে ঘেমে উঠছিল, আর সেই চকচকে ঘেমে ওঠা আলোর ক্রমাগত স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে লুকোচুরি খেলছিল ধরা না পড়ে অথচ আছেই এমন প্রামাণ্য অনিশ্চয়তায়।

ঘুম দরকার ছিল পরের দিনের পশরা সাজানোর বাধ্যবাধকতায়। এদিকে চোখ উপচানো বর্জ্যের জন্য চাদর, বালিশ, তোশক তো কোন ছাড়, ছড়ানো ছিটনো গুটিসুটি পোশাক, আধভেজা গামছারা, এমনকি ছপছপে বাথরুমটা, কেউ চওড়া কাঁধ অথবা শান্ত বুক এগিয়ে দেয়নি। এখন ওই বাড়তি উপজাতটির ভদ্রস্থ গতি না করা অব্দি ঘুম কেমন পাতলা হয়ে থাকছিল। জলে দ্রবীভূত হয়ে ঘুম ভেসে যাচ্ছিল ধুলো সরিয়ে। জলপথের ঢাল স্পষ্ট হচ্ছিল। চোখের কোলে আর কানের মাথা ছুঁয়ে চুলের গহিনে বহুস্রোতা গঙ্গা ঐরাবতের প্রার্থনা জানাচ্ছিল। জল বারবার ধুলো সরিয়ে দেয় সমস্ত অর্জিত স্মৃতি আর তার ব্যক্তিক উপলব্ধির পরতের উপর থেকে। এবং সমস্ত বন্ধ বইয়ের ভাঁজ তখনও পাললিক শিলার মতো জীবাশ্মদের অবয়ব প্রদর্শন করে।

প্রার্থনার বিভঙ্গেই একজোড়া চোখ মাথা নুইয়েছিল, আর যে কোনও মাথা নুয়ে পড়লেই যে অনেক সব দুর্ঘটনা ঘটে, তার অন্যতম ঘুমে জেগে থাকা। অন্যজোড়া ছটফট করে ডানা ঝাপটাচ্ছিল তখনও, আর ঘাম। ভোর আসছিল। একটা বেজি প্রাতর্ভ্রমণ সারতে সারতে ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছে নিত্যনৈমিত্তিক মদনমোহন তর্কালঙ্কার আচরণ করে নিচ্ছিল। ঘুমন্ত আনত প্রার্থনা বিড়বিড় করছিল অদীক্ষিত মরা মন্ত্র দেবভাষায়। জ্যান্ত একবগ্‌গাটি তখনও তার উপাচার নিয়ে সন্ত্রস্ত, সব অসংস্কৃত প্রাকৃত হয়ে ওঠাদের কৌমার্য নিয়ে। আশপাশের সমস্ত প্রত্যাখ্যান অঞ্জলির আদরে মাখিয়ে সে কাগজের নৌকা ভাসাচ্ছিল ঘেমে ওঠা চোখের মুষলধারার নিচেই। টলমল দু-এক কলি সাধবার আগেই সে সব খড়কুটো ঘূর্ণিতে ঘুলিয়ে যাচ্ছিল।

ঘেমে ঘেমে সমস্ত শারীরিক স্বচ্ছলতা হারিয়ে তাকিয়ে থাকা আর কিছুই দেখছিল না। কোনও পরিবর্তন আলোর অথবা রূপান্তরিত আন্তরিকতার। বর্জ্যরা মাছিদের সঙ্গে কিছু সম্পর্কে বাধ্য হচ্ছিল। মাছের কাঁটা অথবা মাংসের নলি, যা কিনা জিভ-দাঁত-আঙুলের প্ররোচনায় শহিদ হওয়াকে সার্থকতা বিশ্বাস করেছিল রাতের ভোজসভার মধ্যমণিত্বে, আলোর সামনে থতমত নিজেদের কঙ্কাল আবিষ্কার করছিল আর নিজস্বতার নেই হয়ে যাওয়া নিয়ে মণ্ড পাকিয়েও একলা নিঃস্ব শূন্য অপেক্ষা করাকে দুঃসময় বলে মানিয়ে নিচ্ছিল। সুদৃশ্য ডাস্টবিনে ওদের আশ্রয়ের প্রদর্শন, এমনকি ওদেরও আত্মঘাতী আঘাত করবার বিষয়ে মূল্যবোধ ছড়াচ্ছিল। সেই সব ঝকঝকে বহুজাতিক দর্শন ব্লটিঙে শুষে যাচ্ছিল জল, আর বারুদ যে ওরা নয় তা রাত্রিকালীন ভোজের পরে সুনিশ্চিত হওয়া গেছিল সকালের প্রাতঃকৃত্যের নিঃশব্দ হালকা হওয়ায়।

সারাদিনের জন্য প্রস্তুত বেজির তৎপরতায় সমস্ত শয়তান, আদিম পাপ অথবা সমকালীন খিদের অধিকারের ইস্তেহার নিয়ে ইঁদুরের গর্তে লুকোয়, সপ্তাহান্তে একটা স্বজনবান্ধবের একত্রিত হবার উছলা খুঁজে পেতে রাখে, অথবা মাসান্তে অফবীট টুরিস্ট স্পটের স্পন্সর বাগানোর ফাঁদ পাতে।

দোতলার ব্যালকনি থেকে টিপ করবার জন্য হাতে কিছু সময় দুলতে পাচ্ছিল সমস্ত দলাপাকানো অনুভূতি আর আহ্লাদে গদগদ ভাবছিল‘আপন হাতের দোলে দোলাও’, ঠিক তক্ষুনি সাক্ষ্যপ্রমাণাদি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট অভ্যস্ত সতর্কতার সঙ্গে চোখের উপজাত, মাছ ও মাংসের কঙ্কাল, ডাঁটার ছিবড়ে উদ্বৃত্তের আছাড় খেল নির্ভুল লক্ষ্যে রাস্তার ভ্যাটে। সমস্ত শারীরিক ও মানসিক যত্ন পাতে সাজিয়ে দেবার আগে পর্যন্ত যা কিছু প্রাপ্য বুঝে নেবার শেষতম সুযোগ। অথবা ডাস্টবিনে যাওয়া সরকারি বাহনে সওয়ারি হতে। গোটানো চাদর টানটান,কোঁচকানো পোশাক, অন্তর্বাস, কানের দুল অথবা লাইটার অন্তর্হিত হয় সামাজিক বাধ্যতায়। হঠাৎ খাবার অদৃশ্য হতে মনমরা মাছি সকালের রংচটা খানকির মতো ময়লাটে পর্দাটার সঙ্গে দুটো-চারটে খেজুরে আলাপ সেরে রাখে। মৌখিক সদালাপটুকু রেখে গেলে পরে কখনও কোনও কাজ সহজে হবার সম্ভাবনা। পর্দাও শেষ সকালের রোদে স্যাঁতস্যাঁতে গা এলিয়ে দিতে দিতে মাছিকে ঠোনা মেরে বলে, ফেসবুকের প্রো পিকটা ঝিঙ্কু হয়েছে। মাছি জানলার বাইরে যায়,পর্দা আড়মোড়া ভাঙে।

ঘর এইমত অভ্যাগতবিমুক্ত হলে সভাকবি নান্দনিক ঠাটবাটে বিষয়কর্মে নিযুক্ত হন। তাঁর এবারের প্রার্থনায় সজাগ মস্তিস্ক বড় প্রয়োজন, অবশ্যই নত দৃষ্টির অভ্যাস তাঁর সহজাত। উদাসীন সভাকবি কুটিল শহুরে বাস্তবতার মৃত্যুফাঁদ এড়িয়ে গা বাঁচিয়ে কোনও অলৌকিক সমাপতনে দরবারে হাজিরা দেন। তাঁর প্রার্থনার চোখ তখন ভিক্ষান্নের সন্ধানে শ্যেনদৃষ্টি। মহারাজা সেলাম পেয়ে কিছু দ্রব হলে হঠাৎ সভাকবির ঝোলা থেকে একতাড়া নোনতা জল বেরিয়ে আসে। মহারাজা নুনের সততা চেখে ভগ্নাংশের হিসেবে কিছু চিত্তবিনোদন বাহাল করেন। সভাকবি অসন্তুষ্ট মনে প্রথমে কবিতায় পদমর্যাদাবশত গুঁজতে পারবেন না এমন কিছু উপাধিতে রাজাকে ভূষিত করে তারপরে এই যথোপযুক্ত পরিমাণ না পাওয়া মেনে নেওয়া জনিত মহত্ত্বে নিজেকে স্বভাবকবি নির্দিষ্ট করেন। এবং এই স্বীকৃতি আর যাতে কেউ না পায় তাই বাকি সমস্ত বঞ্চিতকেই প্রচণ্ড প্রতিবাদের প্ররোচনা দিতে থাকেন।

এইসব ঘটনার সময়ে সেই রাতজাগা ঘেমো চোখ দুটো একরাশ কালি মেখে একা একা পিচ ভাঙছিল। একটা গন্ধ ছাড়া আর কেউ ছিল না তার পাশে। পর্দা, মাছি, বাথরুম, গামছা অথবা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার সময় দরজার বন্ধ হবার তাড়াহুড়ো, কেউ না, কিচ্ছু না। অথচ গন্ধটা ওকে মেখে নিচ্ছিল। একটা মদির গন্ধ, ঘুমের গন্ধ,ঘামের না কি! একটা বলয়ের মতো সামনের চর্বিখোঁজা হাত বা পাশের বইমুখোর থেকে ওকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। ও অন্য একটা ঘরে পৌঁছে অনেকের ব্যবহার করা বাথরুমে স্নান সেরে নেবার পরেও গন্ধটা ওকে শুঁকে যেতে থাকে। দিনে দিনে এমন হয় সমস্ত পৃথিবীটা ওর কাছে গন্ধহীন অথবা এক অনুপ্রবেশকারী অবৈধ গন্ধের আকর হয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই, আপনারা জানেন, গন্ধের না থাকায় খাবারেরা ওর কাছে পঙ্গু, গন্ধটা ওকে গিলে ফেলে বলে, ওর গলা দিয়ে খাবার নামতে চায় না। পেটে খিদে হানটান করে, আর মুখ সমস্ত খাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

ছ'মাস ন'মাস কেটে যায়। গন্ধশূন্য। কেউ ওর রান্না চেখে চোখ মুখ নাচিয়ে তুললে ওর তাকে মারতে ইচ্ছে করে। চোখ বুজে খেলে ও চা অথবা কফিও আলাদা করতে পারে না। ঠিক এই সময়েই একদিন ও মুখ থুবড়ে পড়ে একটা কাঁচা নর্দমার উপরে। কালো জলের ভিতর থেকে কিছু লার্ভা ওকে কৌতূহলী পর্যবেক্ষণে রাখে। গন্ধ না পাওয়াতে ওর গা গুলোয় না। লার্ভারা ব্যাপারটা সহজে নিতে পারে না। যতযতবার ও পয়োঃপ্রণালীপথে কিছু বয়ে যাওয়া কল্পনা করে কুলকুচি অথবা স্নানের জল বয়ে যেতে দেখে অথবা আর যা যা সম্ভাবনা এ জাতীয় আপনাদের দৈনন্দিনের বন্ধ স্নানঘরের ওপারের, কোনও এক কালিন্দী মোহ হয়ে আসে ওর পাশে। এমনকি লার্ভারাও এ অসুখ বহন করেনি, শুধু কিছু তোতাকাহিনী। জন্ম হোক যথা তথা, তবু উত্তরাধিকারে পাওয়া নর্দমার প্রতি তার পৃষ্ঠপোষকদের উন্নাসিকতায় লার্ভাদের দেশঘরের নিশ্চয়তা, সহানুভূতি আদায়ের নিশ্চিত উপায়। ওর চোখে সেই ঘৃণার অনুপস্থিতি না সমস্ত লার্ভার জন্মানো ডানাগুলোকে অনিশ্চয়তা দেয়। গন্ধের ঘেন্না চলে যায় তবু।

একা একা জেগে থাকা, চেয়ে থাকা, ঘেমে নেয়ে ওঠা চোখে আর ত্বকে, খিদে আর তেষ্টা সব নিয়ে নিমীলিত প্রার্থনার সামনে দাঁড়ানোর পরে দেখা যায় সমস্ত রাজকীয় অভিজ্ঞান রাঘববোয়ালের ভল্টে সুরক্ষিত। অভিজ্ঞান পেয়ে পরে রাজাকেও সরানো হয়েছে। আর সব তো খিদের সমবণ্টনের দাবিতে। সুতরাং বিপ্লব প্রমাণিত। অথচ মাছি ছাড়া আর সবাই খিদেতে হন্যে। সভাকবির স্বভাব সম্পর্কে সন্দেহের আগে তিনি প্রার্থনায় বসলেন ক্ষমার। নিজের জন্য ক্ষমার যুক্তি জমিয়ে কিছু পরে চোখ খুলে বললেন, ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ –এই সত্য। অতএব সমস্ত প্রার্থনা আদতে ভণ্ডামি।

সেইসব জেগে থাকার রাতগুলো মুহূর্তে নেই হয়ে যায়। যেহেতু কোনও প্রার্থনা ছিল না, তাই কোনও নতচোখ ছিল না, তাই সেই নতির দর্শক আসলে থাকতেই পারেনা। পর্দা আর মাছি ও বাথরুমের মেঝে খলখল হেসে ওঠে। অপলক চোখের অন্ধত্ব, একপেশে গন্ধের বিভ্রান্তি, খিদের উস্কানি, সব তালগোল পাকিয়ে যায়। সভাকবি একটা স্বাধীন ও পক্ষপাতহীন সংঘ গড়ে তোলবার প্রস্তাব দেন, মাছির আলপনা ও পর্দার সরগম সেখানে কবিতার পাশাপাশি দেওয়াল সাজায়।

বইয়ের গন্ধ, ইউক্যালিপটাস, সাঁতলানো মুসুরির ডাল কাউকে খুঁজে না পেতে পেতে হারিয়ে যেতে থাকে রোজ। চোখ একরকমের ইস্তফা দেয় কাজে। ক্রমাগত ঘাম ঝরিয়ে নিঃস্ব তারা। সন্ধ্যের অন্ধকার গঙ্গার পাড়ে ওর পাশে বসে। একটু একটু করে গল্পে ফিরে আসবার জন্য কাছি বাঁধা নৌকাটা ওর পিঠ চাপড়াতে থাকে। কান্নার সেই চোখদুটোর অশ্রুগ্রন্থি শুকিয়ে যায়, আর ওর এতোলবেতোল দেখা-চাখার মধ্যে চোখ প্রাণপণে শেষ জলের রেশটুকু ধরে রাখে পাতার কানায়। এতকাল ঝরে পড়া জলেরা ওর কান্নার নাম পায়নি, অথচ এই শিকড়হীন শুকিয়ে ওঠা ডেড সি দিব্য গণ্ডাকয় ‘যো হুজুর’-এর নিঃশর্ত মালিকানা পায়। সুতরাং ওই এক কুমিরছানা দেখিয়ে জীবিকার্জনের পথ মসৃণ করে নেয় ও। এমনকি এই ভেজা ভেজা দীর্ঘ আঁখিপল্লব নিয়ে ও গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্রের জন্য দরপত্র জমা দেয়। বন্ধ খামের ভেতরে চালান করে দিতে থাকে ওর গন্ধ, স্পর্শ,ঘাম, শব্দ আর কিছু ফাঁপানো নিজেকে।

সভাকবি কি একটা টের পেয়ে স্নানের জলে ক’ফোঁটা বাড়তি ওডিকোলন মেশান। জেগে থাকা চোখের মণি সচল হয়, কি যেন দেখতে পায় আবছায়া। গন্ধের খোলসটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়। পৃথিবীর খিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠা যায়। ডাস্টবিনে পরিত্যক্ত হাড় আর কাঁটা ছাড়া কোথাও কিছু নেই তখন। যাদের আঙুলে আগলে জিভ ছুঁইয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল অতীতে। অতীতের থেকে তবু কোনও এক সঞ্জীবনী উৎসে তাদের পূর্ণযৌবনের গন্ধ অবিকল খিদে বাড়িয়ে দিয়ে যায়। ডাস্টবিনে ভয় বেবাক কাটে তাদের উৎসের অনুসন্ধানে।

মাছিদের পোয়াবারো। খিদের দাবি ক্রমশ স্বীকৃতি পায় বলে শয়তান মাঠে নামে। খিদেকে লেলিয়ে দিয়ে সামনের পথে নিজে খিড়কি খোলে। ওগরানো বিষ দিয়ে ঘুমের ওষুধ। খিদেকে চাগিয়ে দেয় ঘুমের ওষুধের বাজারটা জমিয়ে তুলতে। চাঁদের আলোর মায়ায়, অন্ধকারের ছায়ায় ছায়ায় যে ঘুম পর্দায় দোল খেয়ে ঝুপঝাপ নামে, তা নীলচে আঠালো। খিদেরা ঘুমিয়ে পড়লে তিতকুটে গলা নিয়ে বাথরুমে ওক তোলা শুরু হয়। আঙুল পৌঁছয় গলায়। তেতো স্বাদ স্থানপরিবর্তন করে না। চোখ কিছু নোনা জল ওগরায়। বিষ ধুয়ে যায়, ঘুম। গঙ্গার জলে সূর্য স্নান সেরে ওঠে। বেজির গন্ধ পেয়ে শয়তান হামা টানে জোর।

সভাকবি ফ্যাশন ম্যাগাজিনের পাতা থেকে ক্বচিতে ত্বরিতে বস্তিবাসীদের গরম কাপড় বিলোতে নামেন। অন্যসময়ে শব্দে ‘শব দে’ধ্বনি তুলে ভরে পাওয়া প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কেশরাশি ঝাঁকান। অন্যথায় খুলির ভিতর তাঁদের কোনও দ্বন্দ্ব নেই। বশীকরণের জন্য আনা একটা মাছের কাঁটা আঙুলে বিঁধে কবি তাড়িত হলে সমস্ত ডাস্টবিন আর নর্দমা গা ঝাড়া দেয়। ডাস্টবিনের ভয় অথবা নর্দমার ঘেন্না নেই হয়ে যেতে অশ্রুহীনতার লজ্জা চলে যায় সেই ঘেমেনেয়ে একলা হয়ে থাকা চোখদুটোর। খোলা চোখদুটো জেগে থাকার ক্লান্তিতে, জীবনধারণের নুনটুকু খুইয়ে এক আদর, অভিমান, খুনসুটি একাধিক চ্যাট-এ বইয়ে দিতে দিতে দক্ষ জীবন হয়ে ওঠে।

কিছু কুকুর আর বেড়াল আর ক্ষুধার্ত নিয়ে একত্রে ওরা সমস্ত মাছ-মাংসের স্বত্ব নিয়ে নেয়। ডাস্টবিনে নয়, কাঁটা ও হাড় সসম্মানে গৃহীত হয় বিড়াল-কুকুরে। সমস্ত শুঁয়োপোকা প্রজাপতি হতে দেখে লার্ভারা অন্যান্য ডানা পাতে রোদে। রোঁদে বেরোয় বেজি। সাপ গর্তে খোলস খুলে ফেলে। মাছি কানা হয়, অতএব লক্ষ্যভেদ হয়না স্বভাবে কবির।

একটা শীতের রাত ঠাণ্ডা মেঝেতে পা ছুঁইয়েই তড়বড়ে চড়ে দাঁড়াবার একজোড়া অপেক্ষমান পা খুঁজে পায়। টুপটাপ শিশির জমাতে থাকে ভোর। হিরের কুচোগুলোর ওপর দিয়ে হেঁটে যায় রামধনুর পেলব গন্ধ।
1

মুক্তগদ্য - শালিনী ঘোষ

Posted in


মুক্তগদ্য


চক্রব্যূহ
শালিনী ঘোষ


পৃথিবীর সব পথ প্রবলভাবে ঘরের দিকে টানতে থাকে। নিয়নের সেপিয়া গলি, ঘষটানো পিচ, খোয়া ওঠা ধুলো ধুলো - সবার গন্তব্য সেই এক। ঘর বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক পালঙ্ক মাত্র। মিশকালো পালিশ। আর পায়ের গোড়া বেয়ে নেমে গেছে চৌকি। পালঙ্কের তলার অন্ধকার খোঁদল জুড়ে অনায়াস পরিপাটি আরও একটা সংসার হওয়ায় বাধা নেই কোনও। ভীড়ের মধ্যে অসহায় একা নিস্তরঙ্গ মানুষকে প্রতিটা পরিচিত ঘর থেকে ওই পালঙ্ক হাতছানি দেয়। মাথার পাশে বড় কাঁসার গ্লাসটা জল ভরাই থেকে যায় অনন্ত। যেন সীমাহীন উৎসমুখ। অমনই খানিক মলিন ঘিয়েটে চাদর আর চূড়ো করা মশারির তাল আর শ্বাস টের পাওয়ার সতর্কতায় ঘুণপোকার কিট কিট হঠকারি হতে দেয়না। শিকড়ে ঘরের টান বুনে দেয় আজীবন।

প্রতিটা ঘরের নিজস্ব গন্ধ থাকে কিছু, মানুষের চুলের মতন, যোনিঘ্রাণের মতোই আলাদা করা যায় সহজে; আলমারির পিছনে কোণাঘুঁপচিতে জমতে থাকা ঝুলেরা, মেঝের কোনায় কোনায়- ঠিক যেখানে ভেজা ছোঁয়া পড়েনি, পড়েনা বহুকাল এসবের টান তীব্র, বড় তীব্র মনে হয় কখনও। চান করতে গিয়ে পা হড়কে যাওয়ার প্রিয় গোলাপি পাথর, ভোররাতে কাঁচের ফাঁকটুকু দিয়ে টুপটাপ বেয়ে আসা হিম আর স্বপ্ন থেকে উঠে আসা আজান -সব স্মৃতি গায়ে মেখে চায়ের দোকানে প্রথম আগুনের আঁচ আসে, প্রথম ট্রেন শহর ছোঁয়ার ব্যস্ততায় ঈষৎ নড়েচড়ে বসা হয় খানিক। এসব দিনে, এসব অন্য মানুষের অন্য জীবনে ঘোর লাগে নেশার পরত বেয়ে বেয়ে। 

মহাশূন্যের মাঝে পৃথিবী নামের যে গ্রহে প্রাণগুলো নড়েচড়ে জীবনকে সাড়া দেয়, কখনও নিযুত আলোকবর্ষ পেরিয়ে তাতে পা রাখে ভিনগ্রহী। যে অসীম বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ড তারও গভীরে বৃত্তের প্রসারে ক্রমাগত সংকোচন ঘটাতে থাকলে বিন্দু স্থির হয় এই নগরীতে। চৌপেয়ে প্রাণী যাবতীয় কবিতার খাতা গিলে ফেলে প্রতি গ্রাসে। গায়ে মেখে নেয় সৃষ্টিকালীন সুর- যা কিছু গান হতে পারত, রমণেচ্ছু আর্তি হতে পারত, হতে পারত প্রাণের প্রবল ঘোষণা, মৃত্যুর তীক্ষ্ণ হাহাকার।

প্রতিটা মৃত্যু এসব সময়ে বড় প্রিয় হয়ে ওঠে। সৃষ্টির তাগিদ ফুরোলে, রাগমোচন হলে, এমন কী সংশয়ী মানুষ যখন আচমকা জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পায়, আজীবনের দ্বন্দ্ব যখন ফুরিয়ে যায় - শ্রান্তি নামে। সর্বগ্রাসী অপূর্ণতা, যন্ত্রণা যখন তাড়নাকে ছাপিয়ে নির্লিপ্তি এনে দেয়, সে মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকে অন্তহীন শূন্যতা। সে মাটির রস নিতে অক্ষম গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিধনের অপেক্ষায়।

এইসব গল্পে পালঙ্কের কারুকাজের সায় থাকেনা কোনওদিন, তার সূক্ষ্মতার পাঁজর চিরে অনাগ্রহের রঙচটা ছাপ ধরে ধীরে। প্রতিটা ঘরের পিছুটান বড় আনুষ্ঠানিক এমন বন্ধ্যা দিনে। মিশকালো পালঙ্ক আর চৌকির সিঁড়ি আর ভরা গ্লাস আর নীচের অন্ধকার আর তুলে রাখা মশারির চূড়ো আর ঘিয়েটে মলিন ভাঁজ পড়া চাদর বহুভাগ হয়ে ভাঙতে থাকে নিয়নের গলি আর ঘষটানো পিচ,খোয়া ধুলো ফেলে আরও। নতুন বৃত্তের দিকে।


0

মুক্তগদ্য - স্মৃতি

Posted in


মুক্তগদ্য


জায়-মান

স্মৃতি




যাপনের কি রঙ থাকে 'সোনালী, রূপালী, সবুজ অথবা সুনীল'!!
একমুঠি শালুক লতা নিজের গলায় - মাথায় জড়িয়ে
নদী ভাসানিয়া সুরটি আকাশে ছড়িয়ে দিয়ে সুরবতী
নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে থাকে বাড়ির পথ ধরা সূর্যের
দিকে। কি এক ক্ষরিত হরমোন তাকে একবার ধোপার
পাটে আছাড় মারে আবার অন্য আছাড়ে শুকিয়ে ঝকঝক তকতক করে নদীর বুকে ভাসিয়ে রাখে।
প্রতিদিন সুরবতী ভাবে - প্রতিদিন সে কত ভাবে ভাঙে নিজেকে, নিজের মেয়েবেলার অস্তিত্ব,
বৌবেলার বিছানার অস্তিত্ব - যার সত্যিই কোনও অর্থ নেই। অনেকগুলো সরল রেখা যেন পর পর কেউ
সাজিয়ে দিয়ে বলছে রিপুর তুফানে পাল তুলে দিয়ে
ভেসে চলতে। ক্রমশ ভাসার শেষে সুরবতী মিশে যাবে
ভিড়ের মাঝে - এই শালুক গোছা যাবে হারিয়ে..
ছয় ঋতুর পালা বদলের এক বিরাট ইতিহাসের ইতিবৃত্ত
সে বুকের রক্ত কুটীরে লুকিয়ে রাখবে।
রাত ঘুমানো ফুল জাগা কিছু স্মৃতি বন জ্যোৎস্নার
মায়াবী আলোয় ইতিউতি ঘুরে মরে পৌঁছে যায় নিজের
গন্তব্যে।
মৃত্যুর কি কোনও রূপ আছে? আছে কোনও বিন্দেদূতী? আচ্ছা সুরবতীর এত ভাবনা কেন? খুব কি তাড়া আছে
কোথাও যাবার অথবা নির্ধারিত কোনও সুরে পঞ্চম লাগানোর প্রাণান্তকর অঙ্গীকার?!
সে কি জানতে চায় কার কোলে তার বাখারি ছোঁয়া নাড়ী কে কেটেছিল তার পরিচয়? এই এক শব্দভেদী শব্দ - পরিচয়। তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় - অনেক অনেক
আগের মৃত্যুজন্মে যে পরিচয় ছিল বা আদৌ ছিল কি!
সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে রমণ মানে ছিল জীবন্ত
সংঘাত। তার কি বদল ঘটল নি:শব্দে?
না – না... ঘটেছে। গান-ছবি, ছবি-গান সব কেমন মিশে
গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক নতুন অন্ধকারের। সেখানেই
রভসে - রমণে জন্ম নেয় ছন্দ - জন্ম নেয় কবিতা -
অন্তে যে বলে ওঠে 'ভয় পেয়ো না সুরবতী -
এই আমি তোমার কোলে আসনটি পাতলাম। পাঁচ আঙুলে আমায় ছুঁয়ে দেখো, সব কটি আঙুল এক
এক ভিন্নতর বোধির কবিতা। প্রেমের, প্রেমিকের, প্রোষিতভর্তৃকার, বিধবা বিকেলের চোখের চকচকে
কনীনিকা।'
ধীরে - অতি ধীরে একটা করে শালুক ফুল লতা থেকে ছিন্ন করে সুরবতী। এইবার ডুব জল - খুব জল...

'নদী গো আমি তোমারই অংশ - নদী, জল, কবিতা
কি করে স্বতন্ত্র হবে গো!'
ডুব দেয় সুরবতী। মাথার উপর ছড়িয়ে থাকে
কবিতা শালুক লতা।... এ জীবন থেকে পরজন্মে -
অথবা আরও অনেক জন্মে যখন পৃথিবীতে আঁকড়ে
থাকা মৃতদেহের সংস্কার নিয়ে সে জন্ম নেবে...
অনন্ত আগামী অসত্যে বা শাশ্বতিক কবিতায়, নতুবা অকবিতায়..
তখনি বেজে উঠবে তিনবার শঙ্খ - ধ্বনি কারণ জন্মান্তর ঘটলেও কবিতা অমৃতময়। নিত্যকাল প্রতিপল
অনুপল তার জন্ম মুহূর্ত...


0

মুক্তগদ্য - স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার

Posted in


মুক্তগদ্য


আর রেখো না আঁধারে আমায় 
স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার


কৃষ্ণা একাদশীর তমসাময়ী রাত... সারা আকাশপথ জুড়ে একটাই সুরের কাঁপন... নক্ষত্রলোককে দিল ছুঁয়ে। দু একটা নক্ষত্র সেই কাঁপন বুকে নিতে না পেরে ঝরে পড়ল...। সৃষ্টি হলো অতল গহন গহ্বর... মৃত্তিকা বড়ো সহননশীল... তাই ভেতর বুকে নিয়ে নিল জ্বলন্ত ঊল্কাকে--- "অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ হবে"... ঝুম ঝুম ঝিম ঝিম... গুন্ঠনে ঢাকা ও কে? 

অকস্মাৎ আদ্রা অথবা মৃগশিরা...কারও দেহ থেকে... তির্যক আলোক রেখা ঘিরে ফেলে অবগুণ্ঠনবতীকে...। ক্ষুধিত শার্দুল তাড়িত হরিণীর মত ক্ষিপ্র পদে এগিয়ে চলে সে অতল গহবরের দিকে... চারপাশ জুড়ে হিমায়িত নৈঃশব্দ--- "অবনী বাড়ি আছ..." কালো গহ্বরের দ্বারে দাঁড়িয়ে আজানুচুম্বিত কেশ ছড়িয়ে এই আহ্বান সে ছুঁড়ে দেয় অশনির মতন... ঊর্দ্ধবাহু হয়ে..." অন্ধকারে বেজে ওঠে যেই, চেয়ে দেখি কেহ কোথা নাই..."। ও!!

"অনন্ত কূয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে" গুণ্ঠনহীনা বাড়িয়ে দেয় হাত... সুরের কম্পন যায় দ্রুত থেকে খাদে... ধৈবতে... পঞ্চমে---" উজ্জ্বল বিধবা ঝোলে একটানা দীর্ঘ জামগাছে" এসো... ধরো... অন্ধকারের বন্ধন ভয় আমারও আছে..." আলোক চাইতে তোমার কাছে যেতেই হবে বিড়ম্বনা হয়তো তখন রইবে হাতে আলোক মাত্র একটি কণা" ...রাত্রির চেতনে লাগে আঘাত... কার হাত! 

ভালবাসা বাড়িয়েছিল হাত... হায়..."ভালবাসা তার কাছ ক্রমাগত ভীষণ অসুখ" ...আকাশপথ জুড়ে সুরের সে কাঁপন এবার দুই কুটুরীর ফাঁকে... ক্রমাগতভাবে পরিবর্তন করে স্থান...। ফাঁকটুকু হলো রুদ্ধ... তীব্র পঞ্চম এবার... কম্পন... শুধুই কম্পন...। ভাল থাক হৃদয় আমার--- যোজন দূরত্ব থেকে আলোক তরঙ্গ এবার ভেঙ্গে পড়ে... ভেঙ্গে পড়ে--- অতল গহবর থেকে ভেসে আসে ভৈরব স্বর..."ভালো রাখার কে সে? জীবন মরণ সবটুকু যায় নদীর জলে ভেসে দুঃখ ও সুখ দুজনে যায় বাণের জলে ভেসে ভালোরাখার কে সে? তখন ভালোরাখার কে সে?" 

বাড়ান হাত ধরে অতল - নিতল থেকে উঠে আসে কবি... শঙ্খ বাজে... লাজ বর্ষিত হয়--- ক্ষিপ্রপদে পিছু হাঁটে গুণ্ঠন হীনা...। আকাশ গঙ্গা সুধা ধারায় ভরিয়ে দেয় আকাশপথকে..." এই তো তোমার প্রেম ওগো হৃদয় হরণ এই যে পাতায় আলো নাচে সোনার বরণ... সোনার বরণ...বরণ..।। 

কৃতজ্ঞচিত্ত :- শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুধীন দত্ত


0

মুক্তগদ্য - সায়ন্ন্যা

Posted in


মুক্তগদ্য


যাতায়াত 
সায়ন্ন্যা



বহুদিন হলো এবাড়ির দরজা খোলেনা কেউ। এক আধবার ঝড় উঠলে দু একটা পাতাপত্র ধুলোবালি পাক খেয়ে যায় সকাল বিকেল। দেওয়াল পেরিয়ে যেটুকু যা রোদ্দুরের গন্ধ ছুঁয়ে যায় সেসব এখন বাহুল্য। এইসব ঘাসজমি… ফুলফল… ইকিরমিকির… নোনা চিংড়ির খোলস বাসর আর কয়েকটা চরিত্র স্নেহরং জলফরিঙের ডানায় ভাসে ইচ্ছেমতন। কেউ কখনও বলেনা, "এসেছো? থাকবে? খুব কষ্ট পেয়েছি, জানো?" 

এযাবৎ যেটুকু যা ঘুম, ইত্যাদির সুযোগ এসেছে সেসব ছুঁড়ে ফেলেছি তুমি ফিরবে বলে একদিন। গতমাসে বড্ড বৃষ্টি হলো। পথঘাট... পীরের থান... আমতলার কল... সব ভাসছে। চাদ্দিকে শুধু জল আর জল। আমি দেখছি বাদলা পোকা পাক খাচ্ছে খুব। মানে, আরও হবে। এইবার বৃষ্টি নামলে ভাসিয়ে দেবো খাতাপত্তর। একজোড়া নৌকো নামাবো কাদাজলে। টাল খেয়ে এগিয়ে যাবে একটা ভালবাসা রং উপচে পড়া নালায়। এই যে এতগুলো দিন পেরিয়ে যাচ্ছে। এই যে একবারও আটকে রাখছিনা। তুমি... তোমার শব্দ... তোমার আলুথালু জামাকাপড়... দু তিনটে পুরনো কলম... আমাদের সব অংক, ভূগোল, ব্যাকরণ... রুনিদের কালো কুকুর... তোমাদের ছাদের শিবমন্দির... এত্তসব ফেলে রেখে কেমন করে ভালো আছো গো? রাতের পর রাত এবাড়িতে কেবল একটা চাঁদ জেগে থাকে একলা। কালো আকাশটা বুকের মধ্যে জমিয়ে রেখে একটা চাঁদ শুধু অতীতজ্বরে বাঁচে। তোমাদের পশ্চিম বারান্দায় ঊষর কিছু ভাঙ্গাচোরা টব আজও দিন গুনছে ফুল ফুটবে বলে। এই যে এতসবের পরেও একজন চলে গেছে; ফিরবেনা কোনওদিন... এই যে এতকিছু ভেবে দিন থেকে রাত আর রাত থেকে দিন গড়িয়ে যাচ্ছে... আর ঠিক কতটা না পেরে উঠলে চাঁদ একদিন কেঁদে উঠতে পারবে... অবসরে বলে যেও কখনও।


0

মুক্তগদ্য - পল্লববরন পাল

Posted in


মুক্তগদ্য


বেড়ালের দন্ত্য-স 
পল্লববরন পাল 



এক


অ-এ অজগর, স-এ সিল্প 

শহর জুড়ে মধ্যরাতের দাপাদাপি। দূষণে ডুবে গেছে সূর্যোদয়। সকালটকাল কী জিনিস – খায় না মাথায় দেয় – এ প্রজন্মের গুগুলিত মস্তিষ্কে কোনো আপডেট চাইলে ইয়াব্বড়ো জিজ্ঞাসাচিহ্ন স্ক্রিন জুড়ে খিলখিল হাসে। বাঁশের বাঁশরি বা রণতূর্যটুর্য নয়, হাতে এখন মোবাইল আর একে সাতচল্লিশ। 

হরে হরে সুধু স্যামবাজারের সসীবাবুদের – না না, তালু বা মূর্ধা নয়, শুধু কুমড়োদাঁতের সিণ্ডিকেট সিল্পের রমরমা – মানুস সুখে আর সান্তিতে কচকচিয়ে ওয়াইফাই ঘা খাচ্চে। সুসান্তিরও সিণ্ডিকেট আচে – পয়সা ফেলো সুখ গেলো ঢকঢকিয়ে আর সান্তিতেয্যারতি করো, ব্যা

রোজকার এই যে অসংখ্য হসন্ত-হোঁচট, সেই হসন্তকে যাপনপংক্তিতে একটা গোটা মাত্রা দেওয়া হবে কিনা – এ প্রশ্নের উত্তরের আশায় গিয়েছিলাম কফিহাউসে 

সেখানে সুসীসিণ্ডিকেট সালিসী ডেকে নিদান সুনিয়ে দিলো –সিস্ন কুচুৎ। 



দুই 


ওং শান্তি 


তুমি ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙবে নাকি হাই তুলবে – সেটা ঠিক করার তুমি কে? আগে দাঁতমাজা নাকি পটি – ব্রেকফাস্টে টোস্ট নাকি ওমলেট – অফিস যাবার পথে দেখা হলে জীবনদাকে হাই নাকি ভালো আছেন তো – আদৌ মুখ তুলে হাসি বিনিময় করবে কিনা – ফেরার পথে কোন দোকান থেকে বাজার করবে – কোন ব্র্যাণ্ডের বিস্কুট – ডিনারে কাতলা না মাগুর – বউ আদরের সাপ্তাহিক ডেট ও স্টাইলের রুটিন 

এ সবের কোনো কিছুই ঠিক করার এক্তিয়ার তোমার নেই – তুমি শুধু একটি শান্তিপ্রিয় ভোটার কার্ড, ডেমোক্র্যাসির ডেমো

ক্র্যাস করবো আমি আর আমার সিণ্ডিকেট



0

মুক্তগদ্য - স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার

Posted in


মুক্তগদ্য


আমার একলা শাওন 
স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার



মন তুই যাস কোথা রে। 'রিমঝিম ঘন ঘন রে'

.... ঝপাৎ ঝপ। ঝপাৎ ঝপ। ইচ্ছে সুখে বৃষ্টি ভেজা।.. জন্মক্ষণে বিধাতা দিয়েছিলেন এক কোলকাতা বৃষ্টি।... তা এহেন বাদুলে কি
"শাওন গগনে ঘোর ঘন ঘটায়" এক জায়গায় দাঁড়ায়..... দে দৌড়... দে দৌড়। এক্কেবারে কৃষ্ণপদাবলীর দেশে ---। দরজাটা তো খোলাই আছে... দেউড়িতেও কেউ নেই... ঢুকেই পড়ি...

আহা! একি বাদল গো? ... অনেক মেঘ, অনেক গর্জন... অনেক বিদ্যুৎ -- অশনিপাত আর গহন ঘন আঁধার -- কাজল পরে আরো কৃষ্ণ - কাজল হয়েছে গো...। কৃষ্ণ নিজের কুঞ্জবাটিতে কেমন বসে আছে!! রাধাভিসার কত্ত কষ্টের ভেবে কপালে তিন রেখা টেনে দিলে.... আকাশের এ কোটি ও কোটি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন জলদ দল এসেছে গাঢ় হয়ে।

বর্ষণ করে চলেছে জলভার। কি করে কাঙ্ক্ষিত স্থানে আসবে শ্রীমতী!

"কাজরে সাজিল রাতি
ঘন ভএ বরিস এ জলধর পাতি।।
বরিস পয়োধর ভার
দূরপথ গমন কঠিন অভিসার।।" 

হা রে বিদ্যাপতি!!...
মানস গঙ্গার পারে বর্ষা কি যে ভাবতে বসেছে... এত ভাবন কেন গো? ঊর্ধ্বলোক চারিণী -- ধূলিলীনা রাই কিশোরী কি ভাবছে --- এই রিমঝিম ধারা বুকে তুলে দিল মিলন বাসনা।.... যাও শ্রীমতী.... "যাইব কেমনে"..

"মন্দির বাহির কঠিন কপাট
চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।।
তাঁই অতি দূরতর বাদর দোল
বারি কি বারই নীল নিচোল"।।

তা 'গোবিন্দ দাস' এ কি আঁকলেন বর্ষার মোহন চিত্র।..... তা কি করা যাবে... মরি মরি!
ঘন মেঘপুঞ্জিত - বিদ্যুদবিলসিত --অশনি শব্দিত পবন আন্দোলিত... আর কি বাধ মানে?... 'রায় শেখর' মহাশয় লিখেই ফেললেন----

"গগন অবঘন মেহ দারুণ
সঘনে দামিনী চমকই।
কুলিশ পাতন শব্দ ঘন ঘন
পাবন খরতর বলগই।।"

বাব্বা! কি কঠিন কঠিন কথা!....
বাদুলে মেয়ে মন পালা --- পালা --। পা সরে না। বিভাষিত আনন্দে দ্বৈত ভূমিকা অভিনেত্রী বর্ষাসুন্দরী চণ্ডীদাসের রাধা হয়ে ছুঁয়ে দিল আমায়...

"এ ঘোর রজনী মেঘেরঘটা 
কেমনে আইব বাটে।
আঙ্গিনার কোণে বঁধুয়া তিতিছে
দেখিয়া পরাণ ফাটে।।''....

কি সুন্দর তুমি চণ্ডীদাস!... রাধার আর্তি সত্য -- প্রিয় মিলনের আর্তি সত্য -- কিন্তু কি করুণ মেঘাড়ম্বরময়ী বর্ষা শর্বরী! বর্ষা আমার কি রহস্যময়ী তুমি --- অভিসারকে ত্বরান্বিত করতে, বিরহ বেদন জাগ্রত করতে তোমার জুড়ি নেই -- প্রিয় কন্ঠ আলিঙ্গনে সুখী প্রিয়া আর যারা দূরবর্তী নক্ষত্রলোকে আছে ---

"মেঘালোকে ভবতি সুখিনোহপ্যন্যথা:বৃত্তিচেত:!
ও বাদুলে মন যাস কোথা --- 
"শাঙন গগনে ঘোর ঘন ঘটা
নিশীথ যামিনী রে..."

এই তো আমার ঠাকুরের দেউড়ি গো ---- স্বপ্নমিলন-- শ্রাবণ যামিনী -- যুগপৎ কুহু- কেকার মুখরতা -- দাদুরী - ডাহুকীর, ঝিল্লীর মত্ত রব...
আ! কি শান্তি!... 

"সঘন গহন রাত্রি 
ঝরিছে শ্রাবণ ধারা..
অন্ধ বিভাবরী সঙ্গ পরশ হারা"....

ও কিশোর তুমি কি কিছু বলবে ----
'ভানুসিংহ' তুমি বলো বলো ----

" বাদর বরখন, নীরদ গরজন
বিজুলী চমকে ঘন ঘোর,
উপেখই কৈছে আওতো কুঞ্জে
নিতি নিতি মাধব মোর।।"

আমার যে বুক ভরা শাওন --- কবি "আঁধারে একেলা ঘরে"... 

'শ্রাবণ বরিষণ পার হয়ে
কি বাণী, আসে ওই রয়ে রয়ে'

....আর জ্বালাতন করিস নে বাদল মন -- ফিরে তো আসলি তিনভুবনের পারের 'ঠাকুরকে' প্রাণে নিয়ে.... বড়ো ব্যথা যে এই শ্রাবণে... 

"সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণ ধারা
অন্ধ বিভাবরী সঙ্গ পরশ হারা".....

বাদুলে চোখতারা ঝাপসা -- মেঘভাঙা বৃষ্টি ধারা....

"ঝরছে রয়ে রয়ে ----'.....
অশ্রুভরা বেদনা দিকে দিকে জাগে
আজি শ্যামল মেঘের মাঝে
বাজে কার কামনা"

......আমার গো আমার। এই বাদুলে মনের --- ফের রে এবার ঘরে ফের ---

"ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর"....

বৈষ্ণবপদাবলীর বর্ষার রসামৃত পান করতে বৈষ্ণব হবার দরকার নেই গো পুরবাসী.... কৃষ্ণকে অবতার মানা ---- না গো তারও প্রয়োজন নেই। শুধু এক বুক বৃষ্টিতে দেহাবরণ বাইরে এনে ভিজতে পারলেই --- পরম পাওয়া.....

"মনে পড়ে বরিষার বৃন্দাবন অভিসার
একাকিনী রাধিকার চকিত চরণ।
শ্যামল তমাল তল, নীল যমুনার জল
আর দুটি ছলছল নলীন নয়ন।
এ ভরা বাদর দিনে কে বাঁচিবে শ্যাম বিনে
কাননের পথ চিনে মন যেতে চায়।
বিজন যমুনা কূলে বিকশিত নীপমূলে
কাঁদিয়া পরান বলে বিরহ ব্যথায় -----"

আমার সব হারাবার শাওন
আমার জীবন ধারণ শাওন
আমার বুকের মধ্যে শাওন......


0

মুক্তগদ্য - সায়ন্ন্যা

Posted in


মুক্তগদ্য


এইসব দুপুর বিকেল 
সায়ন্ন্যা 





ঠিক ঠিকানা পেছনে ছড়িয়ে রেখে হেঁটে এসেছি অনেকটা। যেখানে এসেছি; পেছন ফিরলে আর চোখে আসেনা বসতজমি। এইখানে একটা টেরাবেঁকা মাচা লকলকে লাউডগা পিঠে মস্ত বড় ফসল নিয়ে শুয়ে রয়েছে। রোদ্দুরটা পিছলে গিয়ে পঞ্চাননের চাতালে ইকিরমিকির খেলছে। কয়েকটা পাতিহাঁস পুকুরে ভেসে আছে একমনে। জলের রং সবুজ; কালচে সবুজ। বেশকিছু কচুরিপানার মাথায় বেগুনী ফুলের মুকুট। আমি ওদের ডিঙিয়ে জল দেখছি। মাথাভর্তি রোদ্দুর রং।

- এই এখানে ভেবে নাও হারিয়ে গেলাম। 

- ভেবে নিলাম।

- এসো একবার নেড়েচেড়ে দেখি শুকনো পাতার বুকে রাখা বিচ্ছেদ। 

- এখন মুঠোয় আঙ্গুল; তবে বিচ্ছেদ কেন আসবে? আসলে মহুয়ার জ্বর আসুক। রাখালের গামছার সুখ, ঘাসফড়িং মন, ভো কাট্টা পথঘাট অথবা নিদেন একটা প্রেমের স্বপ্ন আসুক! 

- প্রেমের স্বপ্ন এল, তারপরে? 

- তারপরেও হেঁটে যাচ্ছি। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যে আসবে। রাস্তার পাশে বুনোঝোঁপ। একটা কালাচ হিসহিসিয়ে পা ছুঁয়ে ঢুকে যাচ্ছে গর্তে। আমরা হাঁটছি। পেরিয়ে যাচ্ছি কথাবার্তা। ফিরে আসাও পেরিয়ে গেলাম। আকাশে অল্প একটু চাঁদ। আমি তারা চিনিনা তখনও। তুমি দেখালে শুকতারা। সে একাই জ্বলছে। ভালবাসলে নাকি একাই জ্বলতে হয়? 

- তবে? শেষমেষ সেই একলা হলে? দুজনে বহুদূর গেলাম; তবুও ফেরাটুকু থেকেই যায়।

এরপরে সন্ধ্যে গাঢ় হলো। আমরা ছবি তুলছি। নদী, পুকুর, সমুদ্র . . . মাঠ, জঙ্গল, ধুলোবালি সব জমিয়ে রাখছি। মাথার পেছনে ক্ষয়াটে চাঁদ। একে একে খসে যাচ্ছে নাম, ঠিকানা, গোত্র। আমরা খুলে যাচ্ছি। পরতে পরতে জ্যোৎস্না। পরতে পরতে সুগন্ধ। তখনও ভেতরে মায়াবী নীলচে আগুন। নিষিদ্ধ বলে যাকিছু বারণ করো সেসব পুড়িয়ে বেড়িয়ে আসছে হৃদয়। আমরা কেউ নাl আমাদের কোন ভবিষ্যৎ নেই। আমাদের অতীত ছিলনা। আমাদের পরিচয় নেই। আমরা শুধু মিশে যাচ্ছি। আমরা শুধু পুড়ে যাচ্ছি; ভালবেসেছি তাই।










3

মুক্তগদ্য - শর্মিষ্ঠা ঘোষ

Posted in


মুক্তগদ্য


ঠাকুর 
শর্মিষ্ঠা ঘোষ



রবিঠাকুরের আপন দেশে কবির গুমোর সর্বনেশে। কবির মেঘ করলে প্রতিটি শস্যকণার মুখে ছায়া পড়ে। অন্নদাতা জলচিত্র চালচলন বদলে ফেলে দ্বীপান্তরী হয়। কবি রোদ্দুর বললে দেশোয়ালি ঘরকন্নায় চুলা জ্বলে। নিকোনো দাওয়ায় এসে বসে বাউলের উদাত্ত টান। জেগে ওঠে কুলুঙ্গিতে ঠাকুর বানিয়ে রাখা কবির মাটির বিশ্বাস। টাইট জিন্সের ছেলেটি টুইট করে খুশিয়ালি। প্রবাসী মেয়েটির গিটারে টুংটাং চাঁদের পাহাড়ের দূর। আগুন আর জল করমর্দন করে। বিয়োগান্ত দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ব্রহ্মসঙ্গীতের শান্তি। চলুন, এবার কবির অন্তরমহলে তাকাই। উনকোটি চৌষট্টি লক্ষ অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে জেরবার কবি শ্যাম রাখতে রাখতে কুল হারাতে হারাতে ন্যানো সুযোগের ছলাৎছলেই ভেসে যাচ্ছেন কয়েক নটিক্যাল। গোবেচারা অনুরাগী ফ্যালফেলিয়ে দিক্‌ভ্রান্ত হচ্ছে। ‘তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলে আর মেলে না’। উদয়াস্ত টান টান স্নায়ু যাপনের মিঠেকড়া পাকে চুবিয়ে রেকাবিতে থরে থরে সাজানো যেন রথের মেলায় ভাজা জিলিপি পাঁপড়। রথের রশি টানতে টানতে কবির কপালে বিন্দু বিন্দু পরিশ্রম। রথে অধিষ্ঠিত দেবতারা আলাদা করে কবিকে বর দেবেন না। সমষ্টির ওপর শান্তিজল ছেটালে কবির জোব্বায় এসে লাগবে ছিটেফোঁটা। হারানোর হাহাকার কবিকে বলতে নেই। কবির কেবল সান্ত্বনা হতে হয়। কবির কেবল ঠাকুর হতে হয় বেঁটে মানুষদের চোখে।


0

মুক্তগদ্য - সায়ন্ন্যা দাশদত্ত

Posted in


মুক্তগদ্য


পরিণতি 
সায়ন্ন্যা দাশদত্ত 



যেকোন গল্পের পরিণতি এলে, মনেমনে আমি ঈশ্বর হয়ে উঠিl দীর্ঘসময় সাদাটে পাতার পাশে বসে ভাবতে থাকি- মেলাবো? নাকি বিচ্ছেদ? সমস্ত চরিত্র উদ্বেল হয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেl কখনও দেখি চোখের পাশে জলl মনের পাশে দুঃখl অনেকে ফিরতেই চায়নাl নিজেকে নিপুণভাবে গুটিয়ে নেওয়ার পরে একটুআধটু প্রেম অপ্রেমে ঝড় বাদলা হয়নাl এক একবার হাত ধরে দাঁড়াইl খাদের পাশে অন্ধকারের বুকে মুখ রেখে বলি ফিরে চলোl মিলিয়ে দিই এবারl বিরহ, অভিমান সবই তো ঘন গাঢ় কিছু একটা গড়িয়ে পড়া কষ্টl কি লাভ? কি পেলে একলা হয়ে? যদি তোমায় রেখেও দিই অকৃত্রিম... কে বুঝবে? জানলার ওপারে ভীষণ মেঘের দুপুরে কে আসবে নৌকো হয়ে? ওরা মানতে চায়নাl কেউকেউ যদিও ফিরে আসে... আয়না রাখেনা সাথেl নিজেকে কিছু একটা জড়িয়ে বুড়িয়ে নিয়ে; কি যেন একটা তালগোল হয়ে বাঁচেl আমিতো লেখক; পরিণতি অমোঘl মিলিয়ে আমায় দিতেই হবেl নতুবা দিতে হবে বিচ্ছেদl আমি ঘন্টার পর ঘন্টা দর্শকের কথা ভাবিl ভাবি যারা দেখছে... যারা পড়বে তাদের কোনটি প্রয়োজন? তারপর একটা সময় আসে... বুঝতে পারি... সমস্ত গাঢ়, গভীর অসুখ সবদিন আলমারির কোন একটা গোপন প্রকোষ্ঠে তোলা হয়ে থাকেl যে তাকে রোদ ঢোকেনাl হাওয়া খেলেনাl শ্বাসপ্রশ্বাস কিছুই চলেনাl একটা জড়বৎ অনুভূতি হয়ে রয়ে যায় সেসব গল্পl আমি তখন ঈশ্বরl নশ্বর আলো, হাসি, কান্না পার করে আমি গভীরে প্রবেশ করিl যতসমস্ত ছেঁড়াখোড়া শব্দের সুতো ধরে আমি বিরহ বুনতে থাকিl গল্প ফুরোয় নাl



1

মুক্তগদ্য - শর্মিষ্ঠা ঘোষ

Posted in


মুক্তগদ্য



ছাড়ছি না 
শর্মিষ্ঠা ঘোষ


এত স্মরণ থাকে মানুষের! মাইল মাইল পেছাতে পেছাতে মাপছি কি মারাত্মক এগিয়ে গেছি আমরা। আগে পিছে উপর নীচে ছাড়াতে ছাড়াতে ছড়াতে ছড়াতে হাতে তাও লেগে থাকছে চেনা চেনা গন্ধ, সে আমি রেগে গেলে কস্তুরি না বলে কাচড়াও বলতে পারি, কিন্তু সারসংক্ষেপ তো এটাই যে আমি ব্যর্থ প্রতিপন্ন হচ্ছি সানন্দে কলার তুলে। উরুম দুরুম বাকবিতণ্ডার পর ঘরটা থম মেরে গেলে সিগারেটের ধোঁয়া পায়ে পড়তে বাকি রাখে ‘আমায় নাও’ বলতে গিয়ে।

কে কি ভাবে দেখবে কোনও ঘটনা বা প্রতিক্রিয়া দেখাবে কোনও অভিঘাতে, নাকি আদৌ কিছু দেখবে না, শুনবে না, তা একান্তই তার ব্যক্তিস্বাধীনতা। কেউ যেমন এটা আশা করতে পারে না সব মানুষই একই রকমভাবে ‘উফ্’ বলবে চিমটি কাটলে, তেমনি এটাও নিশ্চয় করে বলা যায় না চিমটি খেয়ে সে মনে মনেই গজরাবে শুধু না উলটে আরেকটা চিমটি কাটার সাহস রাখবে। এটার কারণ একটা যদি হয় মানুষটির মানসিক গঠন, তবে আরেকটা কারণ অবশ্যই তার নিজস্ব লাভ লোকসানের হিসেব, আত্মমর্যাদা বোধের তীব্রতার তারতম্য এবং আত্মবিশ্বাস। ছোট ভাইবোন চিমটি কাটলে দাদা দিদি উলটে চিমটি না কাটলেও শাসন করে, শেখায় ছোটজনকে যে অকারণে কাউকে উত্যক্ত করতে নেই। এতে তার ভাই বোনের প্রতি ভালোবাসায় ঘাটতি পড়ে না। আমাদের তো রক্তসম্বন্ধ নয় যে, সব স্নেহ ক্ষমা বাৎসল্য দিয়ে নাড়ি টেনে রাখবে, মুক্ত হবার আনন্দে বগল বাজাতে গিয়ে কাঠি পড়ছে নিজের ভুয়োদর্শনের অহম সর্বস্ব ঢাকে, তার ঢ্যাম কুড়াকুড়ে লাজুকটি সেজে স্বীকার যাচ্ছি, ঝগড়া করার মানুষটিও কত দরকারী, এবেলা ওবেলা দেয়াল দরজা গাছ ফুল সক্কলে সম্মিলিত মনে করিয়ে দিচ্ছে, আমি কতটা আহাম্মক, বিবাদ বাদ দিতে গিয়ে বেঁচে থাকা বয়কট করতে বসেছি।

ভুল করে কিছু ফেলে যাচ্ছ কি? নাকি এ আবার ফিরে আসবার অছিলা? খুব যন্ত্রণামুখর কাটাকুটিতে তুমি বলে কেউ নেই। প্রতিটা খুন বা খুনের মত কিছু আমাকে একলা পেয়ে দাঁত বের করে হাসছে। তুমি এমনকি সেই অট্টহাস্যও শুনতে পাচ্ছনা। আমাকে বোঝাতে চাইছ আমার স্বভাবদোষে হ্যালুসিনেশান দেখছি। আসলে কোথাও কিস্যু ঘটছে না। কতকিছু নিষিদ্ধ চুপিসাড়ে করে ফেলি কেউ দেখছে না ভেবে। কত টুপি সুন্দর পরিয়ে দি নিজেরই হেরে যাওয়া মাথায়। তুমিও দিব্যি বিশ্বাস করে ফেল আমি সব সত্যি বলছি। আমি নই, ওরাই দূর্বৃত্ত। আমি হরিনাম ভজছিলাম যখন ওদের অনভ্যস্ত কান সেগুলোকে গালাগাল ভেবে চপার তুলে তেড়ে এসেছিল। তুমি শান্তিজল ছেটাচ্ছিলে যখন আমি ঝটিতি মাথা সরিয়ে নিয়েছিলাম। এই আগুন নিভাবো না, সন্তানের চিতার থেকে তুলে আনা অঙ্গার আঁচলে গিঁট দিয়ে রাখছি। তুমি ভেবেছ হরিলুটের বাতাসা? তা ভালোই, যে যেমন দেখতে চায়। হরি, হরি। আমাকে ক্রোধ দাও, বল দাও, শিড়দাঁড়া দাও, কথা দাও, চিৎকার দাও। এই আমি তোমার বরাভয়ের হাতখানা পাকড়াও করলাম, একটি অবিশ্বাস্য চড় মেরে আমাকে না কাঁদালে আরতো ছাড়ছি না। 





0

মুক্তগদ্য - হিমাদ্রি মুখোপাধ্যায়

Posted in


মুক্তগদ্য



অসমাপ্ত 
হিমাদ্রি মুখোপাধ্যায় 


এসেছিলে আচম্বিতে। চলেও গেলে নিঃশব্দে; স্তব্ধ আকাশে রঙের বর্ণমালা ছড়িয়ে সূর্য যেমন অস্তদিগন্তে মিলিয়ে যায়। 

তখনও সন্ধ্যা নামে নি। আমার বিবর্ণ বীণায় বেজে উঠেছিলো পূরবী-আলাপ। ঝড়ের মতন তুমি এসেছিলে। কেড়ে নিলে বীণা। বললে-"আমি বাজাবো এবার --বিভাস।" অবাক হয়ে বললুম-- "সে কী!সন্ধ্যায় কী বিভাস বাজে কখনও!" 

"বাজে না বুঝি!" খিলখিল হেসে তুমি বলেছিলে--"শোনো তবে।" 

ঝংকার দিয়ে উঠলো তোমার বীণা। বিভাস তো নয়! দরবারী কানাড়ায় রক্তস্রোত কখন যে উচ্ছলিত হলো তোমার মুখে! অতর্কিতে বীণা সরিয়ে দিলে তুমি। তোমার আরক্ত চুম্বন উদ্ভাসিত পদ্মের মতন নেমে এলো আমার নীরক্ত ওষ্ঠপ্রান্তে। 

মুহূর্তে নক্ষত্রপুঞ্জ জ্বলে উঠলো আকাশে। তর্জনীসংকেত করে তুমি বললে- "ওই দেখো আমাকে---আমি ধ্রুবতারা"। প্রতিচুম্বনে প্রত্যুত্তর আর রচনা করা হলো না। 

শ্রাবণরজনী ঘন হয়ে আসে আজও। ঝিল্লীঝংকারে প্রতিদিন আমি শুনি--বুঝি এলো, বুঝি এলো... 

মালবিকা, একবার, শুধু একবার এসো তুমি, ভাটির পথ বেয়ে অন্তহীন কালস্রোতে। পূর্ণ কর, চরিতার্থ কর একবার অসমাপ্ত চুম্বন তোমার॥