1
undefined undefined undefined

গল্প - বিবি বসু

Posted in

গল্প


অনসূয়া
বিবি বসু


ঝুপ করে সন্ধ্যে নামলো। ঝকমকে উপনগরী। প্রাচীন পাড়ায় সন্ধ্যে নামতো শাঁখের আওয়াজে। এখানে আকাশের আলো এক ফুঁয়ে নিভলে নামে সন্ধ্যে।

সত্যি তো কতক্ষণ কেটে গেছে ছাদে। ডুবে ছিল অনসূয়া নিজ গহনে। বিকেলের ট্রেন কখন যে ঝুপসি আঁধার সন্ধ্যা-স্টেশনে এসে শ্বাস ফেলেছে, খেয়াল করেনি অনসূয়া।

অদ্ভুত এক দোলাচল। অরিত্রর সাথে আলাপ সেই কলেজবেলায়। সখ্য গভীর হয়েছিলো অচিরেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে অরিত্র গেল পৈতৃক ব্যবসায় আর অনসূয়া গবেষণায়। শেষমেশ লাল, নীল-সাদা, গেরুয়া রঙের লোকজনের চাকরি হলে, একদম রংহীন অনসূয়ার একটি চাকরিও জুটলো দূরান্তের মহাবিদ্যালয়ে। তাও গেস্ট লেকচারার।

তারপর অরিত্রর সাথে সাতপাক। অরিত্র ততোদিনে ব্যবসা প্রায় তিনগুণ বাড়িয়ে ফেলেছে। অনসূয়ার মা মৃদু আপত্তি তুলেছিলেন--- অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যে একেবারেই মেলে না।

বাবা যখন গত হন, তখন অনসূয়ার বয়স সাত আর ছোটবোন প্রিয়ংবদার বয়স তিন। তার মনে আছে, তারা তিনজন মামার বাড়িতে থাকতে গিয়েছিলো বাবার মৃত্যুর পর। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই কোন এক অজানা কারণে মা ভাড়াবাড়ি খুঁজতে থাকেন। মুখে জানান--- তাঁর প্রাইমারি স্কুলটা তাদের মামারবাড়ি থেকে অনেকটা দূর, তাই ওঁর স্কুলের কাছাকাছি বাড়ি নিতে হবে।

মায়ের ইস্কুলেরই সঞ্চিতা মাসির বাড়ির দোতলায় থাকার ব্যবস্থা হ'ল তিনজনের। দেড়খানা ঘর আর একটুকু ঘেরা জায়গায় রান্নাবান্না। মামাতো বোনের বিয়ের আগে, দীর্ঘ কুড়ি বছর আর মামা-মামীদের সাথে দেখা হয়নি অনসূয়াদের।

এমনভাবেই দিন গড়ালো বছরে, বছর দশকে। ঈশ্বরের আশীর্বাদে অনু আর প্রিয়া দুজনেই সুশিক্ষিতা। বিপর্যয়গুলো পেরিয়ে এসেছে ধাপে ধাপে।

কিন্তু একি বিষম বিপর্যয় এল জীবনে তার! যা এতদিন অরিত্রর ভদ্রতা ভেবে অত্যন্ত শ্লাঘা অনুভব করেছে অনু, তা পুরোটাই মেকী! সবটাই ভান! প্রেম পর্যায়ের এতগুলো বছরে অরিত্র তাকে কোনওদিনও জানায়নি এই কথা!

প্রেম পর্যায়ে অরিত্রর শরীর-উদাসীনতা তাকে এক অদ্ভুত অহংকারে ভরিয়ে রাখতো। অরিত্র আলাদা--- অন্য বন্ধুদের বয়ফ্রেন্ডদের মতন আলো-আঁধারির সুযোগ নিয়ে শরীর ছোঁয়া ধরণের নয়। নিখাদ বন্ধুত্বের অর্থ জানে অরিত্র--- এইসব ভেবে এক চাপা অহং অনুভব করেছে অনসূয়া। কিন্তু ওই নিখাদের খাদটুকু স্বপ্নেও ভাবেনি।

বিয়ের বয়স দুসপ্তাহ। কাঙ্খিত কোন মুহূর্তই আসেনি আজ অবধি। বিয়ের পর অরিত্র জানিয়েছে তার ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন orchidectomy হবার কথা। স্তব্ধবাক অনসূয়া শুধু অরিত্রর চোখে রেখেছিল তার চোখ। ভাষা ফোটেনি।

ধীরে ধীরে আকাশে অবয়ব নিল সেই যোদ্ধাপুরুষ। তার পায়ের কাছে লুব্ধককে খুঁজতে গিয়ে কি চোখে কুটো পড়লো তার! বুক ভেসে যাচ্ছে যে। চলে যাবে সেই ছোট্ট ভাড়াবাড়িটায়? রিটায়ার্ড মায়ের পাশে পাশে থাকবে। দিনরাত অমন টিউশন করবে?

চোখের সামনে ভেসে এলো বহুযুগ আগের এক ছবি। ছোটবোন প্রিয়া ছলছল চোখে ফাঁকা বাটি নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে। পানিফলওয়ালা পানিফল দেয়নি--- মা দুটো টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। ফলওয়ালা চার টাকা চেয়েছিলো।

সংযমের অভ্যেস সেই ছোটবেলা থেকে করে নিয়েছে অনসূয়া।

আজ জীবনের এক সন্ধিক্ষণ। সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আদালতের দ্বারস্থ হবে, না মেনে নেবে মিসেস অরিত্র রায়ের জীবন!

না, ঠিক করতে পারছেনা সে। প্রায় রাত হয়ে আসছে। রাত নটায় অরিত্র ফিরবে। বাঁ হাতের ভারি কঙ্কন আর সোনা বাঁধানো লোহায় ঠোকাঠুকি হয়। শব্দে সম্বিত ফেরে। প্রাচুর্যের কাঙাল নয় সে। কিন্তু আজীবন বড় কঠিন সংযমের মধ্যে কেটেছে। কতদিন ভালো শাড়ি দেখেও, বুকে পাথর চাপা দিয়ে বলতে হয়েছে, 'আমার সহজে জিনিস পছন্দ হয়না। আমি খুব খুঁতখুঁতে। শাড়িটার রঙ আর ডিজাইনে কেমন যেন অমিল।'

নিরাপত্তা---হ্যাঁ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বড় দায়। যারা জন্ম থেকে সেই নিরাপত্তা বলয়ে বড় হয়েছে, তারা বুঝবে না। উঠে মখমলি চটিতে পা গলায় অনসূয়া। রান্নাঘরে যাবে একবার। নিজের ঘরদোর, সংসার নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। শুধু কাজের লোকের ওপর কি ভরসা করা যায়!

1 comment: