প্রবন্ধ
সত্য, সুন্দর এবং বিজ্ঞান
সিদ্ধার্থ মজুমদার
সুন্দর বা সৌন্দর্য বহু আলোচিত বিষয় এবং প্রাচীনকাল থেকেই এ নিয়ে চর্চা হয়ে আসছে। দার্শনিক ও চিন্তাবিদরা এ নিয়ে আলোচনাও করেছেন অনেক। আছে নানান ব্যাখ্যা আর বিশ্লেষণ। তবুও সৌন্দর্য নিয়ে এখনও অজস্র প্রশ্নের উত্তর অজানা থেকে গেছে। এর একটা বড় কারণ, সৌন্দর্য বিদ্যার সঙ্গে একাধিক জটিল বিষয়ের সম্পর্ক।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে সৌন্দর্য বিদ্যারও অনেক নতুন দিক খুলে গেছে আজ। যার ফলে বিস্তৃত হয়েছে সৌন্দর্যের ধারণা ও প্রচলিত সৌন্দর্য অভিজ্ঞতার পরিধি। বহুকাল আগে থেকেই সৌন্দর্যবিদ্যাকে যেমন দর্শন ও শিল্পকলার শাখা হিসেবে মনে করা হত, এখন তা বিজ্ঞানের বৃত্তেও জায়গা করে নিয়েছে। বিশেষত ‘স্নায়ুবিজ্ঞান’ আজ সৌন্দর্য ভাবনার নানান অজানা ক্ষেত্র উন্মোচিত করেছে এবং স্নায়ু বিজ্ঞানীদের এবিষয়ের বিভিন্ন আলোকপাত সৌন্দর্যের জ্ঞানকে বিস্তৃত করেছে।
‘অ্যাসথেটিকস’ (aesthetics) শব্দটির অর্থ হল ‘নন্দনসংক্রান্ত’, যা গ্রীক aisthetikosথেকে এসেছে। ইংরেজিতে যার মানে sensory perception। বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধ করা’।‘অ্যাসথেটিকস’ বিদ্যার মধ্যে পড়ে সৌন্দর্য-উপভোগ্যতা, শিল্পকলা, সৌন্দর্য, স্বাদ, সৃষ্টি, এই সমস্ত বিষয়গুলি।
স্বর্ণে রত্নে শোভন লোভন জানি, বর্ণে বর্ণে রচিত ...
সৌন্দর্য নিয়ে কিছু ভাবতে গেলে প্রথমেই প্রকৃতির কথা আসবে। প্রকৃতির সৌন্দর্য নিয়ে শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গখ যথার্থই বলেছেনঃ “যদি তুমি সত্যি প্রকৃতিকে ভালবাসতে পার, তাহলে তুমি সবখানে, সব কিছুর মধ্যে খুঁজে পাবে সুন্দর-কে।” আসলে প্রকৃতির সব কিছুর মধ্যেই তো জড়িয়ে আছে অনিন্দ্য সুন্দর রূপের বৈভব। প্রকৃতির রূপ, রং আর রসের অফুরন্ত সৌন্দর্য অভিজ্ঞতা মানব মনের মণিকোঠায় সদাই বিরাজমান।
প্রকৃতির মধ্যে এই সৌন্দর্য ছাড়াও আরও এক ধরনের সৌন্দর্য ভাবনার মধ্যে এসে যায়, যা সৃজনশীল মানুষের সৃষ্টি করা চিত্র,শিল্পকলা, ভাস্কর্য, আলোকচিত্র, কবিতা, সংগীত, নাটক, নৃত্যকলা ইত্যাদির শৈল্পিক সৌন্দর্য!
‘সুন্দর কী?’ বা ‘একটি জিনিসকে কেন সুন্দর বলে মনে হয়?’ সুন্দর-এর কথা প্রসঙ্গে এই প্রশ্নই প্রথমে মনে আসে। এই সব প্রশ্নের স্পষ্ট কোনো উত্তর হয় না। প্রশ্ন দুটির উত্তর পেতে গেলে জানতে হবে ‘সৌন্দর্য চেতনার উৎস’ সম্বন্ধে! বলাবাহুল্য, এবিষয়ে এখনও অনেক প্রশ্নেরই উত্তর অজানা।
পাশাপাশি আরও কয়েকটি প্রশ্ন জাগে। যেমন, ‘মানুষ কীভাবে বিচার করে, কোনটি বেশি আর কোনটি কম সুন্দর? এবং সেই বিচার প্রক্রিয়াই বা ঠিক কেমন?’ কিংবা, ‘কোনো কিছু জিনিস আমাদের কাছে কেন সুন্দর বলে মনে হয়?’ আর যাকে সুন্দর বলে আমরা মান্যতা দিলাম, তা কি সেই জিনিসটির মধ্যে থাকা সৌন্দর্য? নাকি দ্রষ্টার কাছে তা সুন্দর হিসেবে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে বলেইতা সুন্দর মনে হয়?
এমন নয় যে এই প্রশ্নগুলি নতুন। বহু কাল আগে থেকেই এমন প্রশ্নের উত্তর মানুষ খুঁজে আসছে।সৌন্দর্য ভাবনার এইসব চিরাচরিত প্রশ্নগুলিকে সঙ্গে নিয়ে সুন্দরতার সুলুক সন্ধান এর পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করা হয়েছে এই লেখায়।
বিভিন্ন সময়ে একাধিক চিন্তাবিদ সৌন্দর্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যদিও সুন্দরকে সংজ্ঞায়িত করা যে কঠিন কাজ, সে কথা তাঁরা বলেছেন। মূলত দুটি দিক থেকে সুন্দরকে বুঝতে চেয়েছেন তাঁরা।প্রথমটি হল -- গঠন,ফর্ম বা অর্ডার সম্পর্কিত। সৌন্দর্য উপাদানের পরিমাপ, অনুপাত, রঙ বা টেক্সচার ইত্যাদি গুণাগুণগুলি এর সঙ্গে জড়িত। দ্বিতীয়টি হল, সৌন্দর্য উপভোগ করার পরে দ্রষ্টার যে অনুভূতি, সুখ, আবেগ বা ভালোলাগার অভিজ্ঞতা হয়, সে সংক্রান্ত। এটা ঠিক যে, সৌন্দর্যের উপভোগ্যতা বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি পণ্ডিতরা।
সৌন্দর্যের ব্যাখ্যায় গ্রীক দার্শনিক ও স্বনামধন্য গণিতবিদ পিথাগোরাসের (৫৭০ বিসিই - ৪৯৫ বিসিই) ব্যাখ্যা অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি বিশ্বাস করতেন, যা কিছু সুন্দর, তার সঙ্গে নিশ্চিতভাবে সিমেট্রি এবং গাণিতিক কোনো সম্পর্ক থাকবে। প্রাচীন ইজিপ্টের মানুষই প্রথম, যারা এই গাণিতিক অনুপাত, নিয়মানুগতা বা ‘গোল্ডেন সেকশেন’-এর কথা ভেবেছিলেন। পিরামিডের ডিজাইনের মধ্যে যে জ্যামিতিক নিয়মানুগতা দেখা যায়, তা যে পিথাগোরাসের ভাবনার প্রতিফলন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিশ্ব-নাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে ...
শিল্পকলাতে গণিতের যে প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়, সম্ভবত তা শুরু হয় বিশ্বপ্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতাকে প্রত্যক্ষ করে। প্রকৃতির সবকিছুর মধ্যে একধরনের গাণিতিক নিয়ম রয়েছে, প্রাচীন চিন্তাবিদরা অনেকেই এমন কথা বুঝেছিলেন। পিথাগোরাস বিশ্বাস করতেন, ‘মিউজিক্যাল হারমনির সঙ্গে যেভাবে গণিত জড়িয়ে থাকে, সেভাবেই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অন্তর্নিহিত সুরমূর্ছনার প্রকাশের সঙ্গেওমিশে থাকে গণিত।’ পিথাগোরাসের মতন প্লেটো-ও বিশ্বাস করতেন, ফিজিক্যাল-ওয়ার্ল্ডের যে সৌন্দর্য, তার মূলে রয়েছে গাণিতিক সৌন্দর্য।
বলতে হয় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির (১৪৫২-১৫১৯) কথাও। তাঁর জগদ্বিখ্যাত চিত্রশিল্পগুলিতে তিনি বিভিন্ন গাণিতিক সূত্র, রঙ আর জ্যামিতিক প্যাটার্নের ব্যবহার করেছেন। বস্তুত তিনিই প্রথম গাণিতিক ভাষার নিপুণ প্রয়োগ করে তাঁর সৃষ্টি করা চিত্রশিল্পগুলিকে এক মহত্তম সৌন্দর্যে উত্তীর্ণ করে তোলেন।
সে সময়ের চিন্তাবিদদের মতন বর্তমান সময়ের অনেক দিকপাল পদার্থবিদ, রসায়নবিদ এবং গণিতজ্ঞরাও বিশ্বাস করেন, প্রকৃতির মধ্যে থাকা যে শৈল্পিক স্টাইল, তার হলমার্ক হল ‘সিমেট্রি’।বিশ্বপ্রকৃতির সব কিছুর মধ্যে রয়েছে গাণিতিক প্যাটার্ন! প্রকৃতির মধ্যে থাকা এই যে নিখুঁত নিয়ম-শৃঙ্খলা, ছন্দ, তাল, সামঞ্জস্য আর সময় জ্ঞান —তাতো আসলে সৌন্দর্যেরই প্রকাশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভাবনায় গণিতের ভূমিকা থাকার কথা নোবেলজয়ী পদার্থবিদ্ রিচার্ড ফেইনম্যানের (১৯১৮-১৯৮৮) কথাতেও স্পষ্ট। তিনি বলেছেন -- “সৌন্দর্যকে প্রকৃতও নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করতে হলে কিংবা প্রকৃতির অন্তর্নিহিত যে গভীরতম সৌন্দর্য বিদ্যমান, তা জানার জন্য গণিতের প্রয়োজন। গণিতের ভাষা জানা না থাকলে সেই অপরূপ সুন্দরতাকে সম্যক বোঝা সম্ভব নয়।যদি তুমি প্রকৃতিকে জানতে চাও, বুঝতে চাও,পড়তে চাও, উপলব্ধি করতে চাও, তাহলে প্রকৃতি যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষাটি জানা একান্ত প্রয়োজন।”
তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম ...
সৌন্দর্য অনুভবের জন্য মনের একটা বিশাল ভূমিকা থাকে, তা আলাদা করে না বললেও বোঝা যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও সেই কথা বলেছেন --“শুধু চোখের দৃষ্টি নহে, তাহার পিছনে মনের দৃষ্টি যোগ না-দিলে সৌন্দর্যকে বড়ো করিয়া দেখা যায় না। এ মনের দৃষ্টি লাভ করা বিশেষ শিক্ষার কর্ম।” রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘মনেরদৃষ্টি’ বলেছেন, বস্তুত সেই দর্শন অনুভূতির কেন্দ্রস্থলটি আসলে ‘মগজ’। সৌন্দর্য অনুভবের সঙ্গে মগজের সম্পর্ক নিবিড়ভাবে জড়িত। মগজের কথায় আমরা পরে আসব। তার আগে, সৌন্দর্যের রসাস্বাদন সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা কী ভাবেন, তা জানার চেষ্টা করব।
কীর্তিমান বিজ্ঞানীরা যে বিজ্ঞানের কাজে সৌন্দর্যের রসাস্বাদন করেন, বিজ্ঞান কম-জানা মানুষের পক্ষে এমন কথা বোঝা কষ্টকরই বটে। বস্তুত, কেবল কবি-শিল্পী বা শিল্পরসিকরাই যে সৌন্দর্যের রসাস্বাদন করতে পারেন, বিজ্ঞানীরা নয়, এ কথা ঠিক নয়। বিজ্ঞানীরাও এক অর্থে সৌন্দর্যেরই উপাসক। আসলে, বিজ্ঞানের কাজের ধরনের সঙ্গে যেহেতু বিজ্ঞানের বাইরের জগতের মানুষ ততটা পরিচিত নন, তাই তাঁদের পক্ষে সুন্দর আর বিজ্ঞানের এই যোগসূত্র বুঝে ওঠা কিছুটা কঠিনই বটে।
স্বনামধন্য বিজ্ঞান গবেষকরা সৌন্দর্য বলতে ঠিক কী বোঝেন? তাঁদের কাছে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কি প্রচলিত ধ্যানধারণার থেকে আলাদা কিছু ? এবার সেই কথা বুঝতে চেষ্টা করব।
প্রথমে যাঁর কথা বলতে হয়, তিনি সুব্রম্যণিয়ম চন্দ্রশেখর (১৯১০-১৯৯৫)। ভারতে জন্ম আমেরিকান অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট। ১৯৮৩ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। ‘সৌন্দর্যকী?’ - তা নিয়ে বলা তাঁর একটি কথা পড়ি, - “যে আহ্বানে মানুষের মন সবচেয়ে গভীরভাবে সাড়া দেয়, তাই হল সৌন্দর্য”। বিশ্ববন্দিত এই বিজ্ঞানীর লেখা একটি অসামান্য বই রয়েছে, নাম--Truth and Beauty, Aesthetics and Motivation in Science। চন্দ্রশেখরের সাতটি বক্তৃতার সংকলন নিয়ে এই বই। বিজ্ঞানের মহতী সত্য আবিষ্কার আসলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনির্বচনীয় সৌন্দর্য ও রূপের অনুসন্ধান। এই বইয়ে রয়েছে সে কথারই প্রতিধ্বনি।
আলোকে মোর চক্ষুদুটি মুগ্ধ হয়ে উঠল ফুটি ...
সৌন্দর্য-অভিজ্ঞতা বোধ বা অনুভবের বিষয় হলেও এর শুরুটা হয় ‘দেখা’ থেকে। তবে এই ‘দেখা’-র সঙ্গে শুধু যে চোখের সম্পর্ক রয়েছে, তা নয়। চোখের মাধ্যমে আমরা দেখি ঠিকই, কিন্তু দেখার ব্যাপারে মগজ বা ব্রেন নামের আমাদের মহার্ঘ অঙ্গটির বিশাল ভূমিকা রয়েছে। তা সে বইয়ের পাতার লেখা হোক বা সুন্দর দৃশ্য, সুন্দর মুখ কিংবা কোনো শিল্প সৌকর্য। যে-কোনো দেখা-ই মগজ নির্ভর। সেরকমই, সৌন্দর্য চেনার ক্ষেত্রেও রয়েছে মগজের প্রত্যক্ষ ভূমিকা।
দেখার সঙ্গে মগজের সম্পর্ক বুঝতে গেলে, মগজ-এর অসীম ক্ষমতার সঙ্গে একটু পরিচিত হওয়া দরকার। বোধ, মনন,অনুভূতি, চিন্তাশক্তি, মেধা, বুদ্ধি-বিবেচনা, স্মৃতি কিংবা বিশ্লেষণী ক্ষমতা –এইসব ক্রিয়াকলাপের অন্যতম নায়ক হল ব্রেন। মগজের মধ্যে থাকে স্নায়বিক কোষের বিপুল এক নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা। মগজের মধ্যে যে বিপুল সব কর্মকাণ্ড ঘটে, সেই কাজগুলি করে এই বিশেষ স্নায়ুকোষগুলি। শুধু দেখা-র কাজ-ই নয়। অজস্র জটিল কাণ্ডকারখানার সঙ্গে জড়িত ব্রেন। বিস্ময় কিংবা নান্দনিক বোধ বা থ্রি-ডাইমেনশনাল অনুভূতি বা কল্পনাপ্রবণতা -- এসবও নিয়ন্ত্রিত হয় ব্রেনের মাধ্যমে।
বিপুল তরঙ্গ রে ...
ব্রেনের যাবতীয় কার্যকলাপ চলে নার্ভকোষের মাধ্যমে। প্রায় এক কোটি নার্ভকোষের জাল বিছিয়ে রাখা আছে আমাদের যাবতীয় মগজিয় কাজের জন্য। এক একটি নার্ভকোষের মধ্যে রয়েছে আবার প্রায় এক হাজার থেকে এক লক্ষ সংযোগ সূত্র। এই সংযোগ সূত্রগুলির মধ্যে দিয়ে তড়িৎ সংবাহন প্রবাহ আদান প্রদান হয় নার্ভকোষের মধ্যে। সে এক দারুণ জটিল সংযোগ ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে প্রত্যেকের মগজ সিস্টেম কাজ করে। এই সব নানান মগজিয় ক্রিয়াকলাপের জন্যেই আমরা দেখতে সমর্থ হই এবং উপভোগ করতে পারি সৌন্দর্য। সৌন্দর্যের সঙ্গে মগজের বিভিন্ন অংশ কিংবা নানান প্রাণরাসায়নিক পদার্থ কীভাবে জড়িত, তা নিয়ে গবেষণা করছেন স্নায়ুবিজ্ঞানীরা। কীভাবে এই জটিল এবং সুসংহত কাজগুলি ঘটে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা যেটুকু জেনেছেন, সেখানে একটু প্রবেশ করার চেষ্টা করি।
আমাদের ব্রেনের পেছনের দিকে রয়েছে ‘অক্সিপিট্যাললোব’। চোখ দিয়ে দেখার পর সেখানেই সিগন্যাল যায়, তারপর সেই প্রাথমিক তথ্যগুলি বিশ্লেষণের পরে তা চলে যায় ব্রেনের অন্য অংশে, যেখানে তা আরও উচ্চতর মাত্রায় বিশ্লেষিত হয়। নার্ভ কোষগুলির নিজেদের মধ্যে সংকেত আদান প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ নিউরো-ট্রান্সমিটার কাজ করে, যেগুলি নার্ভ কোষ থেকে নিঃসৃত হওয়া একধরনের প্রাণরাসায়নিক অণু। সেই রকমই একটি গুরুত্বপূর্ণ নার্ভ-কোষ নিঃসৃত অণু হল ‘ডোপামিন’।গবেষণা থেকে জানা গেছে যে আকর্ষণীয় কোনো কিছু উপভোগ করলে ব্রেনের মধ্যেকার ‘ডোপামিন’ চালিত ‘রিওয়ার্ড-নেটওয়ার্ক’ অংশটি উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। সাধারণভাবে এই ‘রিওয়ার্ড-নেটওয়ার্ক’ অংশটি আমাদের সুখ, আনন্দ আর ভালোলাগা বোধের উৎপত্তি স্থল।
‘অ্যামিগ্ডলা’ নামের একটি অংশকেও চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা, যেখানে সুন্দর কোনো কিছু দেখে অথবা কোনো ভালোলাগা বোধ হলে, কিংবা ভয়ের কিছু দেখে আতঙ্কিত হলে, ব্রেনের এই অংশটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। মগজের নির্দিষ্ট ঠিক কোন জায়গায় সৌন্দর্য বিচার প্রক্রিয়াগুলি হয়, তা নিয়ে সাম্প্রতিককালে একাধিক স্নায়ুবিজ্ঞানী গবেষণা চালাচ্ছেন। বছর পনেরো-ষোলো আগে ‘নিউরোঅ্যাসথেটিকস’ নামে একটি বিশেষ শাখাও গড়ে উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে সব চেয়ে আগে যাঁর নাম বলতে হয়, তিনি হলেন খ্যাতনামা নিউরো-বায়োলজিস্ট সেমির জেকি। ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনে ‘ভিজ্যুয়াল-অ্যাসথেটিকস-এরও পর গবেষণা করেন তিনি। ‘আর্টিস্টিক ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড দা ব্রেন’ শীর্ষক সেমিরের একটি রচনা, যা বিজ্ঞানের নামজাদা পত্রিকা ‘সায়েন্স’ (২০০১)-এর একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে তিনি বলেছেন “অ্যাসথেটিকসের কোনো ব্যাখ্যাই সম্পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তা স্নায়বিক দিক থেকে ব্যাখ্যা করা হয়।”
সুন্দর হে সুন্দর ...
স্নায়ুবিজ্ঞানীরা কীভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করে মগজের অন্দরমহলের হালহকিকতের খোঁজ পান,সেই সব কথা সহজভাবে একটু বোঝার চেষ্টা করব। ‘নিউরোইমেজিং’ নামের একটি খুব কার্যকরী পরীক্ষার কথা বলি প্রথমে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে ব্রেনের ঠিক কোন জায়গা সজাগ ও ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে, তা বুঝতে পারা যায়। বর্তমানে অতি সংবেদী ব্রেন-ইমেজিং টেকনিক, যেমন ‘TMS’এবং ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (fMRI) ব্যবহার করে আরও ভালোভাবে এই বিষয়গুলি বোঝা সম্ভব। এই সব পরীক্ষার সাহায্যে ব্রেনের রক্ত সঞ্চালন এবং অক্সিজেনেশেনের ছবি পাওয়া যায়। যা থেকে ব্রেনের সংশ্লিষ্ট ক্রিয়াশীল অংশগুলি সম্পর্কে বোঝা যায়। সেই সঙ্গে শিল্পসৌন্দর্যের প্রতিক্রিয়ায় ব্রেনের উদ্দীপিত অংশগুলির মাত্রা নির্ণয় করা যায়।
পরীক্ষা করে ব্রেনের চারটি অংশকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন স্নায়ুবিজ্ঞানীরা, যে অংশগুলি সৌন্দর্য অনুভবের ফলে অনেক বেশি উদ্দীপিত এবং ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে ‘অরবাইটো-ফ্রন্টালকর্টেক্স’ নামের একটি অংশ সৌন্দর্য দেখার ক্ষেত্রে এবং ‘মোটরকর্টেক্স’ অংশ কুৎসিত কোনো কিছু দেখার ক্ষেত্রে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
তবে ‘নিউরো-অ্যাসথেটিকস’ থেকে শিল্প সৌন্দর্য অনুভব সম্পর্কে আমরা সত্যিই কত খানি জানতে পেরেছি? এর উত্তর আমরা পেয়ে যাই ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য স্নায়ুবিজ্ঞানী ভিলায়ান্যুর সুব্রম্যণিয়ম রামচন্দ্রনের কাছে। ভিলায়ান্যুর দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন—‘নিউরো- অ্যাসথেটিকস যে মানুষের সৌন্দর্য অভিজ্ঞতা বোঝার ক্ষেত্রটি সমৃদ্ধ করে তুলতে সক্ষম, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’ তিনি আরও বলেন– ‘তবে আমরা এ বিষয়ে কেবলমাত্র উপরতলেই আঁচড় কাটতে সক্ষম হয়েছি।শৈল্পিক সৌন্দর্যের যে কেন্দ্রীভূত বিশুদ্ধ অংশ আর সংশ্লিষ্ট সৃজন প্রতিভার যেসব বিষয়, তার কিঞ্চিৎও ছুঁতে পারিনি আমরা।’
বিশ্বতনুতে অণুতে অণুতে কাঁপে নৃত্যের ছায়া ...
বিশ্বপ্রকৃতির দৃশ্যমান জগতের মতনই রয়েছে আরও একটি জগৎ, তা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অদৃশ্য এক জগৎ। প্রকৃতির একদিকে রয়েছে বৃহৎ আর অতি বৃহৎ এর জগৎ (ম্যাক্রো ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ড), অন্য দিকে অণু পরমাণু কণাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অদৃশ্য এক অন্যতর জগৎ (মাইক্রো ফিজিক্যাল অয়ার্ল্ড)। সমস্ত কিছুই যে অতীব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণাদিয়ে তৈরি হয়েছে, তা আমরা জানি। বিজ্ঞানীরা আজ জেনেছেন সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতের মধ্যেও রয়েছে অভাবনীয় রকমের নিয়ম-নীতি পরিমাপ আর সিমেট্রি! আর এই সব কণাগুলির যে কার্যাবলী, সেগুলিও নিয়ন্ত্রিত হয় গাণিতিক নিয়ম নীতি অনুযায়ী, যাকে আমরা বলে থাকি ‘ল’ জঅফনেচার’। এই যে অণুপরমাণু কণাদের অদৃশ্য এবং সূক্ষ্মতম জগৎ সেই সাম্রাজ্যের মধ্যেও কি সৌন্দর্যের প্রকাশ বিদ্যমান? যদি সৌন্দর্য থেকে থাকে, তবে কী ভাবেই বা তার সন্ধান পাওয়া যায়?
বস্তুত, এই অদৃশ্য জগতের সৌন্দর্য সন্ধানের ক্ষেত্রে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশাল এক ভূমিকা রয়েছে। সেই অভিনব সৌন্দর্য উন্মোচনের কথা না জানলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে সৌন্দর্য নিয়ে আমাদের এই আলোচনা। তাই এখন সেই ধরা ছোঁয়ার বাইরের জগৎ সম্পর্কে বুঝতে চেষ্টা করব।
বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এবং প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি হওয়ায় মানুষের পক্ষে প্রকৃতির অদৃশ্য জগতের জিনিস আজ দেখা সম্ভব হয়েছে। তবে প্রকৃতির মধ্যেকার অদৃশ্য সৌন্দর্য উন্মোচনের ক্ষেত্রে বিশেষ করে মাইক্রোস্কোপিক টেকনিকের ভূমিকার কথা বলতেই হয়।
যা ছিল অজানা আর অদেখা, সেই অদৃশ্য জগতের রহস্যময় বৈভব মানুষের কাছে ধরা দিল মাইক্রোস্কোপ বা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু, যা খালি চোখে কখনোই দেখা সম্ভব ছিল না, তা আজ দেখতে সক্ষম হয়েছে মানুষ। বিভিন্ন প্রাণ-অণুর কার্যকলাপ সম্বন্ধেও অনেক কিছুই আজ জানা সম্ভব হয়েছে হাই-রেজোলিউশেন মাইক্রোস্কোপি এবং নানান অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে। মাইক্রোস্কোপি টেকনোলজির ইমেজ ক্যাপচার করার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে আণবিক সিস্টেমের ধারণা পরিষ্কার হয়েছে আজ। চোখের আলোয় যা দেখা সম্ভব ছিল না, সেই অধরা মাধুরীর অতিপ্রাকৃতিক এক অকল্পনীয় সৌন্দর্য জগৎ আজ প্রতীয়মান হয়েছে।
মানুষের বুদ্ধিমত্তা, উদ্ভাবনীশক্তি, সৃজনশীলতা আর অতি-সংবেদী যান্ত্রিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের ব্যবহারের ফলেই সম্ভব হয়েছে এই সন্ধান। অত্যাধুনিক ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপির ব্যবহারে আজ অণু, এমনকি পরমাণুর ছবির আন্দাজ পর্যন্ত পাওয়া সম্ভব হয়েছে। এসেছে নবতম অ্যাটমিকফোর্স মাইক্রোস্কোপ, ট্রান্সমিশন মাইক্রোস্কোপ বা স্ক্যানিং ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ। এইভাবেই এক নতুন দিগন্ত খুলে গেছে আজ। অণু, পরমাণু, কোষ, ইত্যাদির গঠন বিন্যাস ছাড়াও, তাদের সমন্বয়,সংযোগ, সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ আর সূক্ষ্ম রাসায়নিক যে রকমফের, এমন নানান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আজ বুঝতে পারা সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন অণুর অত্যাশ্চর্য যেসব ক্রিয়াকুশলতা আর মুনশিয়ানা আছে, সেসবের অনেক কিছুই আজ জানা সম্ভব হয়েছে। আণবিক নির্মাণ, অণুদের পারস্পরিক সংযোগ, নির্দেশ ব্যবস্থা কিংবা সমন্বয়ের নিখুঁত নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ার কথা জেনে মানুষ বিস্মিত হয়েছে বারে বারে। এই পথ ধরেই ছোটোর মধ্যে বিপুল এক সাম্রাজ্যের জ্ঞান অর্জনে সমর্থ হয়েছে মানুষ।
নৃত্যের বশে সুন্দর হল বিদ্রোহী পরমাণু ...
এই অভিজ্ঞান অর্জন থেকে মানুষ একদিকে যেমন জীবন ও প্রকৃতির নানান দুর্জ্ঞেয় রহস্যের উত্তর জানতে পেরেছে, তেমনই অন্যতর এক সৌন্দর্য অভিজ্ঞতার সাক্ষী হওয়ায় সক্ষম হয়েছে। এইভাবে সৌসাম্য, সুস্থিতি, শৃঙ্খলা ও দারুণ জটিল নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার মাইক্রো-ইমেজের বিপুল জগতজন্ম দিয়েছে নতুনতর এক সৌন্দর্য মাত্রার। সূচিত হয়েছে সৌন্দর্যের সর্বাধুনিক সংজ্ঞা। খুলে গেছে সৌন্দর্যের নতুন এক বিদ্যাচর্চা, যা Molecular Aesthetics বা আণবিক সৌন্দর্য নামে পরিচিত। এ এক নতুন প্যারাডাইম।
গাছ, প্রাণী কিংবা মানুষের মতন একটি অণুও যে এই বিশ্ব প্রকৃতির অংশ, তা এখন আমরা বুঝেছি। আর অণুর অন্দরমহলের মধ্যে থাকা যে পরম সৌন্দর্য, তারই অনুসন্ধান করে চলেছেন একাধিক খ্যাতনামা বিজ্ঞানী। তাঁদেরই একজন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের নোবেলজয়ী রোয়াল্ড হফম্যান। রসায়নশাস্ত্রে তাঁর মৌলিক গবেষণার জন্য তাঁর নাম বিশ্ববন্দিত। কবি, নাট্যকার এবং প্রাবন্ধিক হিসেবেও সমাদৃত এই বিজ্ঞানী। রসায়নশাস্ত্রের মধ্যে ‘সৌন্দর্য’ খুঁজে পানহফম্যান। তিনি বিশ্বাস করেন, সৌন্দর্য ধরা দেয় আসলে জটিল অণুর অন্তর্নিহিত ইলেকট্রন অরবাইটেলদের সিমেট্রি ও অ্যাসিমেট্রির জন্যে। দ্রষ্টাসাপেক্ষ সৌন্দর্যের কথা বিশ্বাস করেন তা বোঝা যায় যখন তিনি বলেন --“সরলতা কিংবা জটিলতা, এসবের মধ্যে সৌন্দর্যের অবস্থান নয়। সৌন্দর্যকে প্রস্ফুটিত করা হয়ে থাকে। হতে পারে তা কোনও অণু কিংবা কোনও সংগীত, হতে পারে কোনও সেরামিকের ফুলদানী –যার মধ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে সৌন্দর্য।এইসব সৃষ্টির পেছনে থাকে চিন্তা আর মনন। সৌন্দর্যের সন্ধান সেখানেই মেলে, যেখানে রয়েছে অসমঞ্জস সরলতা, জটিলতা, স্থিরতা বা অস্থিরতার প্রসারিত কিনারা।”
প্রতিটি অণুরই রয়েছে নিজস্ব গঠন এবং তারা কেউ স্থির নয়, সব সময়ই আন্দোলিত হয়ে চলেছে। তাই বলতে হয় , যে-কোনো অণুর গঠন আসলে সেই অণুর অন্তর্গত পরমাণুগুলির গড় অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। অণুগুলির জ্যামিতিক সজ্জা কখনও খুব সরল, কখনোবা সেই বিন্যাস অসম্ভব রকমের জটিলতায় ভরা। আণবিক সৌন্দর্য নিয়ে অসাধারণ কয়েটি রচনা আছে রোয়াল্ড হফম্যানের। একজন রসায়নবিদ হিসেবে বিশেষ বিশেষ কিছু অণু তাঁর চোখে কেন সুন্দর হয়ে ওঠে তা নিয়ে হফম্যান লিখেছেন। তিনি বলেন - “অণুগুলিকীকরেএতোঅপরূপসুন্দরহয়েওঠে? হয়তো তার পেছনে রয়েছে তাদের সহজ সরল গঠনের সমমিতি। অথবা এর পেছনে রয়েছে তাদের জটিলতা এবং গঠনের মধ্যেকার বিপুল সম্পদ বৈভব! যে সম্পদের গুণে অসাধারণ কার্যকরী হয়ে ওঠে অণুগুলি। একটি অণুর মধ্যেকার যে সৌন্দর্য, তা কখনও কখনও তার ভাঁজে ভাঁজে লুকনো অবস্থায় থাকতে পারে, যা প্রকাশিত হয়ে ওঠে সঠিক সময়ে আর সঠিক অবস্থানে পৌঁছে। সব মিলিয়ে তাদের নভেলিটি আর আশ্চর্যময় ক্ষমতা, নিপুণ কার্যকারিতা আর প্রয়োজনীয়তার যে ভূমিকা --তার জন্যেই নান্দনিক হয়ে ওঠে অণুগুলি।”
সেই রকমই, ডিএনএ অণুর ডাবল-হেলিক্স গঠনের মধ্যেকার দারুণ সরল আর এলিগেন্ট রূপ যখন আবিষ্কারকের কাছে ধরা দিল, সেই মুহূর্তের সেই মুগ্ধতা অর্জন ব্যাখ্যা করা হয়তো কঠিন। তবু ডিএনএ অণুর গঠনের রূপ এবং একই সঙ্গে ডিএনএ অণুর প্রতিলিপি তৈরি করতে পারার অভাবনীয় কর্মকুশলতার কথা আন্দাজ করে এর অন্যতম আবিষ্কর্তা ফ্রান্সিস ক্রিক আনন্দে অভিভূত হয়ে বলে উঠেছিলেন ‘দা মলিক্যুল হুইচ হ্যাজ স্টাইল’। এই যে তিনি অণুর স্টাইলের কথা বললেন, তা তো আসলে সৌন্দর্যেরই এক ব্যাখ্যা!
মধুর তোমার শেষ যে না পাই ...
তবে একজন রসায়ন বিজ্ঞানীর অনুভবে অণু পরমাণুর যে সৌন্দর্য অথবা একজন সেল-বায়োলজিস্টের কাছে কোষের অন্দরমহলের যে সৌন্দর্য, সাধারণ মানুষ হিসেবে তা যে আমাদের কখনোই মুগ্ধ করতে পারবে না, তা বলা বাহুল্য। আবার এটাও সত্যি যে, সবার কাছে সব কিছু একই রকম উপভোগ্য হয়ে উঠবে এমনটাও সব সময় ভেবে নেওয়া যায় না। যেরকম, অনেক ক্ষেত্রে, কোনো সৌন্দর্য যা আমাদের আকৃষ্ট করে, অথচ আমাদের চারপাশে এমন মানুষ আছেন যাঁদের কাছে তা কোনো আবেদন-ই ফেলতে পারে না। সবার ক্ষেত্রে সৌন্দর্যের আবেদন কেন একই হয় না, মগজ বিজ্ঞানীরা হয়তো এর উত্তর দিতে পারবেন।
বহু মানুষ যে সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয় অথচ যে কোনো কারণেই হোক, যারা সেইসব সৌন্দর্য বোধে আকৃষ্ট হতে পারে না, সেইসব দুর্ভাগাদের অনুভব শক্তি বাড়ানোর কোনও পথ সম্ভবত আর খোলা থাকে না। স্বনামধন্য শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাতে সেই কথারই প্রতিফলন শুনতে পাই “যার চোখ সুন্দরকে দেখতে পেলে না আজন্ম তাঁর চোখে জ্ঞানাঞ্জন শলাকা ঘষে ক্ষইয়ে ফেললেও ফল পাওয়া যায় না, আবার সুন্দরকে দেখতে পেলে সে অতি সহজেই দেখে নিতে পারলে সুন্দরকে, কোনও গুরুর উপদেশ পরামর্শ এবং ডাক্তারি দরকার হল না তাঁর, বিনা অঞ্জনেই সে নয়নরঞ্জনকে চিনে গেলো।”
দ্রষ্টা তাঁর মনের মাধুরী মিশিয়ে ‘সুন্দর’কেসুন্দরকরেতোলেন, নাকিযা সুন্দর তা সত্য এবং চিরকালীন, দ্রষ্টার উপর তা নির্ভরশীল নয়? সৌন্দর্য নিয়ে অনেক উত্তরহীন প্রশ্নের মতন এইসব পুরনো বিতর্ক জারি থাকবে,যতদিন পর্যন্ত না দার্শনিক ও মগজ-বিজ্ঞানীরা সৌন্দর্য আসলে ঠিক কী, তার নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন।তাঁদের সেই সৌন্দর্য সন্ধানের যাত্রাপথের দিকে মানুষ তাকিয়ে থাকবে।
তথ্যসূত্র
S.Zeki, Artistic Creativity and the Brain, Science 6 July 2001:Vol. 293 no. 5527 pp. 51-52
S. Zeki, Inner Vision: An Exploration of Art and the Brain (Oxford Univ. Press, Oxford, 1999).
Chelsea Wald, Neuroscience: The aesthetic brain, Nature, Vol. 526, 8 October 2015, 82-83
Michelle Francl, Zen and the art of molecules, Nature Chemistry, Vol. 4, March 2012, 142-144
LelioOrci& Michael S.Pepper,Nature Reviews Molecular Cell Biology 3, 133-137 (February 2002)
Roald Hoffmann, Molecular Beauty , American Scientist, Vol.76, July-August 1988, 389-391
Hoffmann,R.,J.Aesthet.Art Critic.48,191-204 (1990)
Steven Brown and Xiaoging Gao,The Neuroscience of Beauty:How does the brain appreciate art? , September 27 (2011), Scientific American, [ http://www.scientificamerican.com/article/the-neuroscience-of-beauty/]
Gideon Engler, British Journal of Aesthetics, Vol. 30, No 1, January 1990, AESTHETICS in Science and in Art
Robert Root-Bernstein, Sensual Chemistry: Aesthetics as a Motivation for Research, International Journal for Philosophy of Chemistry
0 comments: