1

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়



সময় স্থির নয়। ঘটনা পরম্পরাও অ্যাবসার্ড নাটককে মনে পড়াচ্ছে বার বার। যেমন, এই মুহূর্তের ডেঙ্গির ডঙ্কা। সেদিন সুমনদা’র প্রেসে বসে আছি। একটা মশা এক ভদ্রলোকের গায়ে এসে বসল।

- ডেঙ্গির মশা! সুমনদার দৃঢ় ঘোষণা।

- কী করে বুঝলে? আমাদের প্রশ্ন।

- মশাটা ওকে আই কার্ড দেখিয়েছিল। গম্ভীর মুখে বললেন মশকবাহক।

এই একটা বিষয় লক্ষ্য করে অবাক না হয়ে পারিনা। চূড়ান্ত অসুবিধের মধ্যে পড়েও মানুষ দিব্যি ঠাট্টা, তামাসা করে তা নিয়ে। এই মুহূর্তে মহামারীর সামনে দাঁড়িয়ে সে চুটকি লিখছে, কার্টুন আঁকছে, প্যারডি গাইছে। এককথায় বিপণ্ণতা হয়ে উঠছে শিল্প মাধ্যম। আসলে, কৌতুক সুখের আতিশয্য থেকে আসে না। হঠাৎ অসঙ্গতি, বিড়ম্বনা বা লজ্জার পীড়া থেকেই উঠে আসে। হাসির আড়ালে একরকম নিয়মভাঙার আমোদ থাকে। লুকোনো থাকে নিয়মতান্ত্রিকতাকে পরিহাস। হাসি প্রতিবাদের আরএক নাম। দেখুন না, এই পুজোতেই তো অসুররূপে মণ্ডপে হাজির হলেন ডাক্তারবাবুরা। তাই নিয়েও কত কৌতুক করলেন তাঁরা নিজেরাই। নিজেকে নিয়ে হাসা বড় হিম্মতের ব্যাপার। আর, যাঁরা যমের সঙ্গে রোজ পাঞ্জা লড়েন তাঁদের তো সে হিম্মত থাকবেই। তবে, সমস্যা হয়, যদি সহনশীলতার অভাব ঘটে, তখন। গণতান্ত্রিক পরিসরে নিজের মত প্রকাশ করতে গেলে যদি ক্ষমতা গলা টিপে ধরে। প্রতিবাদের জন্য হাঁটলে অরওয়েলের পৃথিবীর বড়দা’ এসে অতি মিহিন স্বরে প্রশ্ন করেন – গতকাল কোথায় ছিলেন? তখন গলাটা কেমন শুকিয়ে আসে। হাসি নয়, গলা চিরে বেরোতে চায় চিৎকার। তখন, সেই চিৎকারকেই অবলম্বন করে গাইতে হয়, আঁকতে হয়, লিখতে হয়। যদি সেটাও না পারি, তবে, ক্ষমতার আস্ফালনের মধ্যেই মাথা উঁচু রাখার চেষ্টাটা চালিয়ে যেতেই হয়। সেটাই করে চলেছি। সঙ্গে আপনারা আছেন। 

সকলে সজাগ থাকুন, সুস্থ থাকুন।

শুভ কামনা নিরন্তর।

1 comments:

9

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - স্বপন দেব

Posted in

প্রচ্ছদ নিবন্ধ


বাংলা নবজাগরণের এক অনালোচিত ইতিহাস 
স্বপন দেব 



বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে, বিশেষ করে উনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে, এক স্মরণীয় ও গৌরবোজ্বল অধ্যায় হলো আমাদের নবজাগরণ বারেনেঁসা। এই সময় থেকেই আমাদের জাতীয়তা বোধের উন্মেষ শুরু হয় ও বিদেশি শাসকের থেকে স্বাধীনতা লাভের স্পৃহা জেগে ওঠে। ফলত, ভারতীয় উপমহাদেশে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কম্পানি এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসনের অবসানের জন্য ভারতবাসীর জাতীয় আন্দোলন এবং স্বাধীনতা লাভের লড়াই শুরু হয়। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা অহিংস আন্দোলন ও প্রতিবাদ দিয়ে শুরু হলেও পরে হিংসাত্মক লড়াই শুরু হয়। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কম্পানীর বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালের মীরাটের সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত নব্বই বছরের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে সব থেকে সংগঠিত ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল বাঙালিদের এবং বাংলায়। কারণ নবজাগরণ বা রেনেসাঁর সুত্রপাতও ঘটেছিল এই বাংলায়। একটা কথা গোড়াতেই পরিষ্কার হয়ে যাওয়া ভালো। একটি দেশ বা জাতির প্রকৃত জাগরণ কখনওই সম্ভব নয় যদি তা সর্বমুখী না হয়। সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা সর্বস্তরে যদি এই জাগরণ না ঘটে, সে জাতির প্রকৃত সর্বাঙ্গীন জাগরণ ও সম্ভব নয় কিছুতেই। আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, ইংরেজ তথা শ্বেতাঙ্গদের দম্ভ ও ঔদ্ধত্য, বর্ণবিদ্বেষ, তাদের অমানবিক শোষণের বিরুদ্ধে। কিন্তু তাই বলে আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা, যে এই ইংরেজদের মধ্যে, শেতাঙ্গদের মধ্যে, এমন গুটিকয় মানুষ ছিলেন, যাঁদের বিশেষ অবদান ছিল, যাঁরা সবকিছুর উর্দ্ধে উঠে ভারতবর্ষ, ভারতবর্ষের মানুষ, বিশেষ করে বাংলার মানুষের সুখে দুঃখে বেদনায় আনন্দে সমভাগীদার হয়েছিলেন। যে সর্বাঙ্গীন বা ব্যাপক জাগরণের কথা আমি আগেই বলেছি, সেই জাতীয় জাগরণে এঁদের অসামান্য অবদানের কথা আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। পৃথিবীর যে কোনও দেশে, আমাদের দেশে তো বটেই, ছোটো মনের ছোটো মাপের লোকের সংখ্যা বেশি, বড়ো মনের, বড়ো মাপের মানুষের সংখ্যা কম। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ছোটো ইংরেজ, বড়ো ইংরেজের কথা। আজ আমি এমন একজনের কথা শোনাতে যাচ্ছি, যিনি ছিলেন শুধু বড়ো মনের নয়, বিরাট মাপের এক ইংরেজ, যিনি জাতিতে বিদেশি হলেও, গায়ের রঙ সাদা হলেও, অন্য সবদিক দিয়ে ভারতবর্ষ, ভারতবর্ষের মানুষ, বিশেষ করে বাংলার মানুষের অন্তরঙ্গ বন্ধু ও শুভার্থী। 

সেই মানুষটি হলেন রেভারেন্ড জেমস লঙ। ওঁর সাথে সাথেই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি উইলিয়াম কেরি, উইলিয়াম অ্যাডামস-এর কথাও। শেষোক্ত ব্যক্তিটির নামই হয়তো শোনেননি অনেকেই। জেমস লঙ-এর মতো এমন বিশাল মনের ইংরেজ, অন্তত সেই যুগে আর কেউ এসেছিলেন বলে আমার জানা নেই। বাংলার সমাজ কল্যাণ, বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি, সর্বক্ষেত্রেই এই মানুষটি সোৎসাহে এগিয়ে এসেছেন সক্রিয় ভাবে। সমাজ সংস্কারে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। প্যারিচাঁদ মিত্রের “আলালের ঘরের দুলাল” ও তাঁর সমাজসংস্কারমূলক সচেতন লেখা পড়ে, তাঁকে আখ্যা দিয়েছেন, “ডিকেন্স অফ বেঙ্গল”, বাংলার চার্লস ডিকেন্স। ১৮৫১ সালে ‘বেথুন সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠার কাজে, এই মানুষটিই হাত মিলিয়েছেন, দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাম গোপাল ঘোষ, প্যারিচাঁদ মিত্র, দক্ষিণারঞ্জন মজুমদার, রাধানাথ শিকদারের সঙ্গে। বাংলার নবজাগরণের ক্ষেত্রে এই বেথুন সোসাইটির অবদান, সর্বজনস্বীকৃত। এই একই বছরে, বাংলা তথা মাতৃভাষার বিকাশ তথা সাহিত্য চর্চার জন্য ‘ভার্নাকুলার লিটারেচার সোসাইটি’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলার জন্য আবার এগিয়ে এসেছেন, জেমস লঙ। বিদ্যাসাগর ও রাধাকান্ত দেব এর মতো দুই বিপরীত চরিত্রের মানুষকে নিয়ে এসেছেন, একই ছাতার তলায়। এই ভার্নাকুলার লিটারেচার সোসাইটির মুখপত্র হিসেবে, বিলিতি পেনি ম্যাগাজিনের অনুকরণে প্রকাশ করেছেন বাংলা ভাষায় প্রথম সচিত্র বাংলা মাসিক পত্রিকা, ‘সচিত্র বিবিধার্থ সংগ্রহ মাসিক পত্রিকা’। এই পত্রিকাটির অবদান বাংলার মনিষীদের প্রভাবিত করেছে, এমন কি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এটি পড়ে প্রভবিত হয়েছেন। এই পত্রিকাটির রচনার মান যাতে উন্নত হয়, বিভিন্ন বিষয়ে যাতে লেখা প্রকাশিত হয়, তার উদ্যোগ নিতে এগিয়ে আসতে দেখি, সেই জেমস লঙ সাহেবকে। ১৮৫৭সালে জানুয়ারি মাসে তখনকার আইন সচিব বার্ণস পীকক একটি প্রস্তাব পেশ করে জানালেন যে, এদেশের যাঁরা শ্বেতাঙ্গ অধিবাসী আছেন, তাঁরা এদেশের আইন, এদেশের আদালতের অধীনে না থাকার ফলে, আইন শৃঙ্খলা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে, আইনের দৃষ্টিতে সমতা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেনা। তিনি আরও জানালেন যে, ভারতীয়রা, বিশেষত শিক্ষিত, রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ভারতীয়রা তাঁকে সমর্থন জানাচ্ছেন। তাই তিনি একটি বিল এনে, শ্বেতাঙ্গ অশ্বেতাঙ্গ, এদেশের সমস্ত অধিবাসীদের, একই আইন ও একই আদালতের অধীনে আনতে চান। কিন্তু, উনবিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকেই এদেশে আসা এবং থেকে যাওয়া উদ্ধত বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গরা কোনও রকমেই আইনের সমতা চায়না কালা আদমিদের সঙ্গে। তাঁরা বিরাট প্রতিবাদ জানালো প্রস্তাবিত এই বিলএর বিরুদ্ধে। বিক্ষোভ জানাতে শুরু করলো এই বলে যে, এতে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে, এটা আমরা কিছুতেই বরদাস্ত করবোনা। তাদের বাধা বুলি ছিলো, এটা কালা কানুন, এই Black Act চালু করা যাবেনা। 

বাংলার নবজাগরণের যুগে, আজ আমরা যাঁদের মনিষী বলে জানি, তাঁদের অনেকেই ছিলেন তখনকার ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। সেই সময়কার রাজনৈতিক সংস্থা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব। এই ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে এক সভা ডাকা হয়, শোভাবাজার রাজবাড়ির নাটমন্দিরে। অসুস্থতার জন্য রাজা রাধাকান্ত দেব সভায় আসতে পারলেন না, সভাপতিত্ব করলেন রাজা কালীকৃষ্ণ দেব। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, এই বিল খুবই যুক্তিযুক্ত এবং ন্যায়সঙ্গত। কেন শ্বেতাঙ্গরা সমস্ত আইনের উর্ধে থাকবে? মনে রাখতে হবে যে, ১৮৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে, সভা ডেকে, ভারতীয় এবং শ্বেতাঙ্গদের একই আইনের অন্তর্ভুক্ত করে সমান অধিকার দাবী করা, আইনের চোখে ভারতীয় ও শ্বেতাঙ্গদের সমদৃষ্টিতে দেখার দাবী করার সাহস খুব কম ভারতীয় এবং বাঙালিদের ছিল। যাঁরা রাধাকান্ত দেবকে এক রক্ষণশীল, সতীদাহ প্রথা রদের বিরোধী মানুষ বলে জানেন, তাঁদের কেন এই সত্যটি জানতে দেওয়া হয়না যে, অসুস্থতার কারণে (তখন রাধাকান্ত দেবের বয়েস ৭৩ বছর) রাধাকান্ত দেব এই সভায় উপস্থিত থাকতে না পারলেও, তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়ে ছিলেন, রাজকৃষ্ণের পুত্র কালীকৃষ্ণ দেবকে এবং শোভাবাজার রাজবাড়ির নাটমন্দিরে অনুষ্ঠিত হওয়া এই সভার সিদ্ধান্তকে সর্বান্তকরণে পুর্নসম্মতি জানিয়েছিলেন? এই ব্যাপারে, রাজা রাধাকান্ত দেবের কথা পরে আবার বলতে হবে, কিন্তু, যে মুষ্টিমেয় শ্বেতাঙ্গ বা ইংরেজ সেদিন এই আইনটি সমর্থন করে ভারতীয়দের সঙ্গে সোচ্চারে গলা মিলিয়ে ছিলেন, তাঁদের মুখপাত্র ছিলেন, জেমস লঙ। শোভাবাজার রাজবাড়িতে ডাকা এই সভায় উপস্থিত ছিলেন জেমস লঙ আর জর্জ টমসন নামে মাত্র দু’জন শ্বেতাঙ্গ। দেশের মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, মানবিকতা আর মানবাধিকারের প্রশ্নে ভারতীয়দের হয়ে এবং ঐ বিলের স্বপক্ষে বলার সাহস দেখিয়েছিলেন তিনি। লঙ বলেছিলেন, কালাকানুন, Black Act! কে বলল ও কালাকানুন? কে বললে Black Act? নাম যদি দিতেই হয়, তবে এর নাম দেওয়া উচিত, সাদা কানুন, White Act! 

১৮৫৯ সাল। তখন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলাদেশে, মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষায় প্রচুর সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। আমাদের একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলো সেই সময়কার নাম করা ইংরেজি খবরের কাগজগুলো। এটি মোটেও ঠিক নয়। ইংরেজি কাগজের থেকে অনেক অনেক বেশি বড়ো এবং মুখ্য ভূমিকা নিয়ে ছিলো মাতৃভাষায় প্রকাশিত সেই সময়ের ছোটো ছোটো পত্র-পত্রিকাগুলো। 

তখন ঠিক হলো, যে সমস্ত মাতৃভাষায় প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা আছে, তার একটা তালিকা বানানো দরকার। কে তার সম্পাদক, কি ধরণের কাগজ, কত দিন প্রকাশিত হচ্ছে, কত জন পড়ে, কি তার প্রভাব? কিন্তু, কাকে এই দায়িত্বভার দেওয়া যায়? ইংরেজদের মধ্যে কে বাংলা পত্রিকা পড়তে পারে? কে এত পরিশ্রম করবে? এসব করার জন্য তো তখন একজন, কেবলমাত্র একজনই ইংরেজ ছিলেন, রেভারেন্ড জেমস লঙ! তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হলো, বাংলা ভাষায় প্রকাশিত যে সব ছোটো খাটো পত্র-পত্রিকা সারা বাংলা জুড়ে রোজ বেরোচ্ছে, তার একটি তালিকা তৈরি করে রিপোর্ট দিতে। মাত্র দু’মাস সময় নিয়ে ছিলেন লঙসাহেব এই রিপোর্টটি পেশ করতে এবং আজ পর্যন্ত, যাঁরা জনমানসে সংবাদপত্রের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন বা করবেন, তাঁদের এই জেমস লঙএর রিপোর্ট পড়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। জেমস লঙ সাহেব, তাঁর রিপোর্টে সাহস করে কি লিখেছিলেন, জানেন? রিপোর্টে তিনি লিখেছিলেন, “এই দেশের বেশিরভাগ ইংরাজি ভাষায় প্রকাশিত কাগজগুলি জাতি বিদ্বেষে ভোগে আর ভারতীয়দের যথেচ্ছ ভাষায় গালিগালাজ করে। আর সেই কারণেই বেশিরভাগ বাঙালি এখন বাংলা কাগজ পড়ে”। এই রিপোর্ট পড়ে, তখনকার দিনের হোমরাচোমরা সাহেব আমলারা, আর নীলকরেরা হাড়ে হাড়ে চটে গেলেন লঙ সাহেবের ওপর এবং কিভাবে এঁকে শায়েস্তা করা যায়, তার ফন্দি-ফিকির আঁটতে লাগলেন। 

পরের বছর, জুন মাস, ১৮৬০ সাল। সিপাহী বিদ্রোহ ঘটে গেছে। তখনকার দিনের শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায় আর নীলকরেরা যথেচ্ছভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারতো। এর জন্য কোনও লাইসেন্স বা অনুমতির দরকার হতো না। এবং এই আগ্নেয়াস্ত্র তারা এবং নীলকরেরা ব্যবহার করতো নিজেদের খেয়াল খুশি মর্জি মাফিক কালোদের বিরুদ্ধে। সিপাহি বিদ্রোহের পর একটা কথা উঠেছিল, যে আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে গেলে সকলেরই একটা লাইসেন্স থাকা প্রয়োজন। শুরু হয়ে গেল শ্বেতাঙ্গ আর নীলকরদের আপত্তি আর আন্দোলন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তখন এই আইন পাশ করা যায়নি, কারণ সুপ্রিম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি মর্ডান্ট ওয়েলস এই আইন বাতিল করে দেওয়ার রায় দেন। কিন্তু, জেমস লঙ এর মতো মানুষের পূর্ণ সমর্থন ছিল শ্বেতাঙ্গ ও নীলকরদের এই আইনের আওতায় আনার। 

ইতিমধ্যেই আমি ১৩০০টি শব্দ খরচ করে বসে আছি জেমস লঙ এর কার্যকলাপ নিয়ে, কেন জানেন? কারণ আমাদের প্রজন্ম, আমাদের পরের প্রজন্মও জেমস লঙ বলতে জানি এবং বুঝি, নীলদর্পন অনুবাদ করা এবং ১৮৬১ সালে এই অপরাধে তাঁকে আদালতে দোষী সাব্যস্ত করে শুধু জরিমানা নয়, জেলেও পাঠানো হয়। নীলদর্পনের অনুবাদ ও তার জন্য সাজা পাওয়াটাকে যদি আমরা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখি, তাহলে বোঝাই যাবেনা যে, কি এমন একটা ব্যাপার ঘটলো, যে নীল দর্পন অনুবাদ করার জন্য তখনকার একজন পাদ্রী রেভারেন্ড উইলিয়াম জেমস লঙ—যাঁর বিশাল প্রতিপত্তি খ্রিস্টান মিশনারি মহলে, হাজার হাজার মানুষ যাঁকে শ্রদ্ধা করে, বাংলার ছোটোলাট লেফট্যেনান্ট গভর্নর যাঁকে বিশ্বাস ও সন্মান করেন, ভারতসচিব এর সংগে যাঁর বেশ দহরম মহরম, এমন কি, আজকের দিনেও এইরকম একটি মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করে তাঁকে আদালতে দোষী প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। তাহলে? কি করে আজ থেকে ১৫৭ বছর আগে, এই রকম একজন মানুষের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে শুধু জরিমানাই নয়, কারাগারে পাঠানো হলো? লঙএর ১৮৫১ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত কার্যকলাপ, বাংলার নবজাগরণের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকাটি জানা না থাকলে এবং তাঁর প্রতি শ্বেতাঙ্গ সাহেবদের ভয় ও ঘৃণার কারণগুলো জানা না থাকলে জেমস লঙের নীল দর্পন অনুবাদের শাস্তি হিসেবে জেল ও জরিমানার শাস্তিটা বুঝতে আমাদের অসুবিধে হবে। আসলে, লঙ সাহেবকে যেনতেনপ্রকারেণ একটা মোক্ষম শিক্ষা দেওয়ার জন্য সুবিধেভোগী দলে ভারি শ্বেতাঙ্গরা তখন বদ্ধপরিকর। রাগটা কিন্তু শুধুমাত্র নীলদর্পন অনবাদের জন্য নয়। ঐতিহাসিক নীল বিদ্রোহের অবসান হচ্ছে। ইন্ডিগো কমিশন, নীল কমিশন বসছে। কমিশনের রিপোর্ট কার্যকরি করা হবে বলে সরকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, আর এই কমিশনেও লঙ সাহেবের বেশ বড়সড় ভূমিকা রয়েছে। শ্বেতাঙ্গরা তো ক্ষুদ্ধ ছিলোই, তার সঙ্গে যোগ দিল নীলকরেরা। তাই, নীলদর্পন অনুবাদের জন্য যেই মামলা শুরু হলো, ওঁরা ভেবে নিলেন, এইবারে ব্যাটাকে বাগে পাওয়া গেছে! এই লোকটা এতদিন আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে, এইবারে একটা উচিত শিক্ষা দিতে হবে এই সাদা চামড়ার ভারতীয়টাকে! 

যদি কেউ ভেবে থাকেন, এর পরের ঘটনাবলী তো আমাদের জানা, তিনি ভুল ভেবেছেন। পরবর্তী ঘটনা, মানে এই নীল দর্পন অনুবাদ সম্পর্কিত মামলা এবং সেটি চলাকালীন লঙ সাহেবের ভূমিকাটি সঠিক জানা না থাকলে, এই মহান লোকটির সম্পর্কে ধারণা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আর তারপরেও জানতে হবে, লঙ সাহেবের সাজা ঘোষণার পরে জনমানসের প্রতিক্রিয়া। লেখাটি একটু দীর্ঘ হলেও, আগ্রহীরা পড়বেন বলে আশা রাখি। 

নীল দর্পনের লেখক, দীনবন্ধু মিত্র একজন সরকারি চাকুরীজীবী। নীল দর্পনের কাহিনী আপনাদের জানা। তিনি দু’টি কাল্পনিক চরিত্র এঁকেছিলেন। নীলকর উড আর নীলকর রোগ সাহেব। যত রকমের অপকর্ম, কুকর্ম হতে পারে, সবকিছু নির্দ্বিধায় করতে পারেন এরা। কোন বাধা, সঙ্কোচ, লজ্জা ভয়, বিবেকের পরোয়া করতেন না এরা। এই বীভৎস চরিত্র দুটি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন দীনবন্ধু। লেখক চান, সরকার এবং ইংরেজদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তাঁর বইটির প্রতি। দীনবন্ধুর প্রথমেই মনে হলো লঙ সাহেবের কথা। পাঠিয়ে দিলেন। লঙ বেশ ভালো বাংলা জানতেন, পড়ে দেখলেন অদ্ভুত বাস্তবের ছবি তুলে ধরা হয়েছে, এত জীবন্ত, সত্যের এত সুন্দর প্রকাশ সচরাচর দেখা যায়না। সরকারের এটা জানা উচিত, ভেবে লঙ সাহেব চিফ সেক্রেটারি অফ বেঙ্গল এবং ইন্ডিগো কমিশনের চেয়ারম্যান, সেটান কার’কে বললেন, একটা অসাধারণ নাটক লিখেছেন এক ভদ্রলোক। সেটান কার লঙ সাহেবের কথায়, জানতে চাইলেন মূল বিষয়ের কথা এবং আকৃষ্ট হলেন। সেটান কার লঙ এর মতো অতটা না হলেও, ভারতীয়দের প্রতি সহানুভূতি ছিল। সেটান এবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন বাংলার ছোটোলাট গ্রান্ট সাহেবের। গ্রান্ট সাহেবের মধ্যেও একটা উষ্ণ দিক ছিল। তিনি বললেন, এটা আমি পড়তে চাই, ইংরাজি অনুবাদ করাতে হবে এবং অনুবাদের পরে কতকগুলো কপি ছাপা হোক...এগুলো আমাদের সরকারি মহলের জানা দরকার, পড়া দরকার। গ্রান্ট সাহেব, ছাপানোর কথা বললেও, কত কপি ছাপা হবে, সে নির্দেশ দেননি। সম্ভবত প্রথমে বঙ্কিমচন্দ্র অনুবাদের কাজ শুরু করেন (আমি নিশ্চিত নই), পরে মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরো বইটি অনুবাদ করে তুলে দিলেন লঙ সাহেবের হাতে। লঙ অনুবাদটির লাইনের পর লাইন পড়েছিলেন, কিছু কিছু জায়গায় সামান্য সংশোধন ও পরিমার্জন করলেও, প্রকৃত অনুবাদক ছিলেন, মধুসূদন দত্ত, লঙ নন। যেমন আমার এই লেখাটি মনোনীত হলে ব্লগের জন্য, নিশ্চিত ভাবেই এর কিছু পরিমার্জন এবং সংশোধন করবেন, সম্পাদিকা। কিন্তু, লঙ এই বই এ একটি ছোট্টো ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন, ছোট্টো একটি মন্তব্য, যার জন্যই লঙ সাহেব বিপদে পড়ে গেলেন। কথাটি ছিল, “Pointed out in language plain but true”। সহজ ভাষায় সত্যি বলা হয়েছে এই নাটকে। আদালতে মামলা চলাকালীন লঙের বিরুদ্ধে সব চেয়ে বড়ো অভিযোগ ছিল এটাই যে, তিনি ভূমিকায় লিখেছিলেন...যা কিছু বলা হয়েছে, তা সত্যি। গ্রান্টসাহেব কত কপি ছাপা হবে, না বললেও, সেটান কার কিন্তু বইটির একেবারে পাঁচশো কপি ছাপার সরকারি আদেশ দিয়েদিলেন (এ পর্যন্ত পড়েই, ঋতবাক প্রকাশনার কর্ণধার ভাবছেন, তখনকার দিনে ৫০০? তাহলে তো এখন অন্তত ৫লাখ কপি ছাপার সরকারি আদেশ হতো! আহা!, স্বপনদা যদি এইরকম একটা বই লেখে, আর আমি সরকারি আদেশে ছাপার বরাতটা পাই!)! সরকারি বই, সরকারি শীলমোহর দেওয়া। ছেপে বেরোতে না বেরোতেই হৈচৈ পড়ে গেলো। ওদিকে মৌচাকে ঢিল, নীলকর সাহেবরা, অন্যান্য ইংরেজরা ক্ষেপে লাল। কী কাণ্ড! এই লেখা সরকার ছেপেছে, লঙ সাহেব অনুবাদ করেছেন, আবার ভূমিকায় বলছেন, যা লেখা হয়েছে, তা নির্ভেজাল সত্যি! কিছুতেই বরদাস্ত করা যায় না এসব। এ ব্যাটাকে শায়েস্তা করতেই হবে। তারা দিলো একটা মামলা ঠুকে আদালতে। আদালতে মামলা হলে, সরকার ইচ্ছে করলেও তাকে ঠেকাতে পারেনা। শুরু হলো নীলদর্পন অনুবাদের মামলা। এই সব ক্ষেত্রে মামলা হলে, প্রথম অভিযুক্ত হন, যিনি প্রকাশক বা যিনি বইটি ছেপেছেন তিনি। ছেপেছেন, মিঃ এইচ ম্যানুয়েল। তিনি বললেন, হ্যাঁ আমি ছেপেছি। তাহলে অনুবাদ কে করেছেন? নাম দেওয়া আছে লঙ সাহেবের। নীলকর সাহেবদের লক্ষ্য কিন্তু ম্যানুয়েল সাহেব নন, তাই তাঁর অল্পস্বল্প জরিমানা হোল। এবার সমস্ত রাগটা গিয়ে পড়লো লঙের বিরুদ্ধে। মানহানির মামলার অভিযোগ, নীলকর সাহেব এবং সামগ্রিকভাবে সব ইংরেজদের মানহানি হয়েছে এই বইটির অনুবাদ করে। মানহানির মামলা চলাকালীন, লঙ একটা স্টেটমেন্ট দিয়েছিলেন আদালতে। “It is folly to shut our eyes to the warning the native state may give”–লঙ আরো বলেছিলেন, এই অনুবাদ আমি করেছি অন্য কোনও কারণে নয়, কারও মানহানি করার উদ্দেশ্যে নয়, সরকারের যাতে চোখে পড়ে, এই বইয়ে যা বর্ণনা করা হয়েছে, সেই অভিযোগের যাতে প্রতিকার হয়, সেইজন্য। 

লঙের বাঁচবার কিন্তু খুব একটা সহজ উপায় ছিল। লঙ সাহেব যদি আদালতে দাঁড়িয়ে বলতেন, এটা আমাকে অনুবাদ করার আদেশ দিয়েছেন সেক্রেটারি জেন্যারেল সেটান কার, ছাপার কথা বলেছেন গ্র্যান্ট সাহেব নিজে… তাহলে কিন্তু মামলা টিঁকতো না, সমস্ত দায়িত্ব গিয়ে পড়তো সেটান কার আর গ্র্যান্টের ওপর আর বেকসুর খালাস পেতেন লঙ সাহেব! কিন্তু, একটি বারের জন্যও সেটানের নাম করেননি, গ্র্যান্টের নাম করেননি, মাইকেলের নাম করেননি। দুর্জয় সাহসে বলেছেন, যা করার আমিই করেছি, সব দায় আমার। উনবিংশ শতাব্দীর প্রজন্ম তোমার মূল্যবোধকে প্রণাম জানাচ্ছে লঙ সাহেব!! 

বিচারের রায় দানের দিন, ১৯শে জুলাই, ১৮৬১। শত শত লোক আদালতে গেছেন লঙের বিচারের রায় শুনতে। বিচার করছেন, সব শ্বেতাঙ্গ জুরী এবং বিচারক মর্ডান্ট ওয়ালেস শুধু এক বর্ণবিদ্বেষী সাহেবই নন, এদেশের মানুষের প্রতি তার তীব্র ঘৃণা। ফলে যা হওয়ার, তাই হলো। বিচারক ওয়ালেস লঙকে শুধু শাস্তির আদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, জঘন্য ভাষায় ভারতীয়দের চরিত্র নিয়েও মন্তব্য করলেন। ওয়ালেসের এই রায় ও মন্তব্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন ভারতীয়রা। কলকাতায়, তৎকালীন সুতানুটিতে শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব ও কালীকৃষ্ণ দেবের নেতৃত্বে সভা সমিতি করে এর প্রতিবাদ ও আদালতে আপিল করে এই রায় কার্যকরী করা বন্ধ রেখে সুপ্রিম কোর্টে পাঠানোর আদেশ চাওয়া হলো। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন, স্যার বার্ণস পীকক। পীকক স্টে অর্ডার দিতে রাজি হলেন না। চারদিনের মধ্যেই মামলা আবার ফিরে এলো মর্ডান্ট ওয়ালেসের কাছে। তিনি রায়দানে লঙের ১০০০ টাকা জরিমানা ও এক মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দিলেন। পরবর্তীকালে আমরা সবাই জানি যে এটা প্রহসন হয়েছিল। সেটান কার পরে স্বীকার করেছিলেন, নীল দর্পনের অনুবাদ ছাপানোর আদেশ তিনিই দিয়েছিলেন, গ্র্যান্টও স্বীকার করেছিলেন। ইংল্যান্ডের কাগজে পর্যন্ত ছাপা হয়েছিলো এটা, “Miscarriage of Justice” হয়েছে। কিন্তু, লঙের এই আত্মত্যাগের একটা সুফলও হয়েছিলো আর সম্ভবত লঙ সাহেব এটাই চেয়েছিলেন। নীলকর সাহেবদের যে অন্যায়, যে লোভ, যে বাড়াবাড়ি, যে জুলুম সেটা এই নীলদর্পন মামলার ফলে খোদ ইংল্যান্ডের সরকারের কাছেও পৌঁছে গিয়েছিল। এই বিচারের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিবাদ এসেছিলো। কলকাতায়, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা লঙকে চিঠি লিখে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল। সন্মান জানিয়েছিল প্রেসিডেন্সির ছাত্ররাও। ভারতবর্ষের বিভিন্নপত্র-পত্রিকা সোমপ্রকাশ ইত্যাদি কাগজে লেখা হয়েছিল, আর ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, হুগলী, এলাহাবাদ, মাদ্রাজ, বোম্বের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ সভা হয়েছে, আলোড়ন তৈরি হয়েছিলো। 

তবে, ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থার এই বৈষম্যমূলক অন্যায়ের প্রতিবাদে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে ছিলো, রাজা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে তদানীন্ত নসুতানুটির মানুষ। ১৮৬১ এর ২৬ শে আগষ্ট, শোভাবাজার রাজবাড়ীতে, আমার পূর্বপুরুষরা মিলিত হয়েছিলেন। তীব্র ভাষায় গর্জে উঠেছিলেন, মর্ডান্ট ওয়ালেসের অবিচার আর বর্ণবিদ্বেষের প্রতিবাদে। সভাপতিত্ব করেছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব। বক্তৃতা করেছিলেন, রাজা কালীকৃষ্ণ দেব, প্রতাপচন্দ্র সিংহ, রামনাথ ঠাকুর, সত্যানন্দ ঘোষাল, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, রামগোপাল ঘোষ, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সেতাব সিং। নবাব আসগর আলি খান এবং আরও অনেকে। হিন্দু, ব্রাহ্ম, খ্রীষ্টান, মুসলমান সবাই মিলে সই করে প্রতিবাদপত্র পাঠিয়ে ছিলেন তদানীন্তন ভারত সচীব চার্লস উডের কাছে। কতজন লোক এই প্রতিবাদ পত্রে সই করেছিলেন, কল্পনা করতে পারেন? ২০ হাজার মানুষ! ১৮৬১ সালের ৩১ শে আগষ্ট এই শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকে রাজা রাধাকান্ত দেব পাঠিয়েছিলেন এই প্রতিবাদ পত্র চার্লস উডের কাছে। এই শোভাবাজার রাজবাড়ী থেকেই যে ঢেউ উঠেছিলো, সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে ইংল্যান্ডের বুকে ভারত সচিবের কাছে এমন ভাবে আছড়ে পড়ে ছিলো যে, চার্লস উডকে শেষ পর্যন্ত ভৎর্সনা করতে হয়েছিলো, মর্ডান্ট ওয়েলসকে, তুমি যা করেছো, অন্যায় করেছো। 

তবু কিছু আফশোষ থেকে যায়, ইতিহাস কেন শুধু কিছু মানুষের অন্ধকার দিকগুলোতেই আলোকপাত করে? কেন কিছু ঐতিহাসিক, স্রেফ প্রকাশকের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য আর নিজের য়্যালিটি পাওয়ার জন্য প্রচলিত মিথগুলিকেই সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করেন? রাধাকান্ত দেবের সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার বিরোধীতার কথা এঁদের কল্যাণে আমরা সবাই জেনেছি। সীমাবদ্ধতা আর দ্বিচারিতা, নবজাগরণের যুগে কোন মনিষীর ছিলোনা বলতে পারেন? কিন্তু, এই রাধাকান্ত দেবই সেই যুগে, সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন করেছিলেন, মরণোত্তর দেহদানের কথা, ডক্তারি পড়ুয়াদের কাজে লাগবে বলে। তার উল্লেখ পাইনা কেন এই শখের ঐতিহাসিকদের লেখায়? এই যে, একটা Public cause, common cause এ ইংরেজদের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিয়ে গর্জে উঠেছিলেন, সেকথা এর আগে জানা ছিলো ক’জনে? 

এবার আসি, লঙ সাহেবের কথায়। র থেকে র, অর্থাৎ রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ…এটাই নাকি নবজাগরণের কালসীমা। যেকোন প্রৌঢ়, যুবক, বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করুন, নবজাগরণের মনিষীদের নাম…, শুনবেন, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বংকিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, কেশবচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এঁদের মধ্যে কেন ঠাঁই পেলেননা নবজাগরণের এই উপেক্ষিত নায়ক, জেমস লঙ? 

লঙ জেল খেটেছিলেন একমাস। কিন্তু আমাদের যে জাতীয় আন্দোলন, রাজনৈতিক চেতনা, প্রতিবাদ আন্দোলন তাকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন রেভারেন্ড জেমসলঙ। তখনো কিন্তু ভারতীয়দের মধ্যে বিভেদ ছিল, ছিল হিন্দু, ব্রাহ্ম, ছিল খ্রীষ্টান, ছিল মুসলমান, ছিল প্রগতিশীল, ছিল রক্ষণশীল, ছিল চরমপন্থী, ছিল নরমপন্থী। কিন্তু, তা সত্ত্বেও তাঁরা সবাই এসেছিলেন শোভাবাজার রাজবাড়িতে লঙের প্রতি অবিচারের প্রতিবাদ জানাতে। অবিচার, অন্যায়, বৈষম্যমূলক আচরণ কি বন্ধ হয়ে গেছে, আমাদের সমাজে এখন? তাহলে কেন বহু...বহুদিন দেখিনা, ধর্ম, জাতপাত, রাজনৈতিক মতবাদকে ভুলে গিয়ে সবাই এক সংগে, ভারতবাসী হিসেবে কোন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, গর্জে উঠতে? 

9 comments:

9

প্রবন্ধ - উদয়াদিত্য সোম

Posted in


প্রবন্ধ


এলি-কাহন 
উদয়াদিত্য সোম


পাহাড়-জঙ্গলকে সাক্ষী রেখে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির এক কন্যার সাথে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হচ্ছি সমস্ত মধ্যবিত্ত সংস্কার আর নৈতিকতার আগলকে জলাঞ্জলি দিয়ে - অতি বড়ো সুখস্বপ্নেও ভাবিনি এমনটা।

প্রাথমিক কুণ্ঠাবোধ যে খানিকটা ছিলো না, তা নয়। একে তো বিজাতীয়া বান্ধবী, ভাষা বোঝার সম্ভাবনা নেই, তাতে তারও মধ্যবয়স পেরিয়েছে, সব মিলিয়ে অন্ততঃ হাত-পা ভাঙার, বা কোমরে হ্যাঁচকা লাগার ভয় যে ছিলো না এমন কথা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারিনা। আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরে সাহস যোগালেন সঙ্গের ভদ্রলোক। পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বললেন, থাই ভাষায় ভদ্রমহিলার নাম ফেউং ওআন। নামের আক্ষরিক অর্থ - মৌচাকের মতো মিষ্টি!

নামের মধ্যেই মধুচক্র! হে ঈশ্বর - এ আমি কোথায় এসে পড়লাম? 

মনস্তত্ত্বের পণ্ডিতরা বলেন, হৃদয় যেখানে কথা বলে, মুখের ভাষার ব্যবধান সেখানে কোনো দূরত্বই আনতে পারে না। কথাটা প্রমাণ করে দিলেন মধুচক্রিকা - এক্কেবারে হাতেনাতে।

শুঁড়েনাতেও বলা যায়। আমার সমস্ত দ্বিধা, সঙ্কোচ, ভয় এবং আরও যা যা শহুরে মাঝবয়সী জড়তা আমাদের মধ্যে আগল তুলে দাঁড়িয়ে ছিলো এতক্ষণ - শুঁড়ের একটা গভীর দীর্ঘশ্বাসে তাদের উড়িয়ে দিলেন তিনি।তারপর সেই শুঁড়েরই আলিঙ্গনে আমায় জাপটে ধরে টেনে নিলেন নিজের আরও কাছে। আর আমিও স্থান-কাল-পাত্র বিস্মৃত হয়ে চকাস করে একটা চুমু খেয়ে ফেললাম তেনার শুঁড়ে। বুড়ো বয়সের ভীমরতি যেমন হয় আর কি।

******

ব্যাংকক থেকে একশো কিলোমিটার দক্ষিণে একটি হাতিদের হাসপাতালে এসেছি এক দিনের জন্যে, ভলান্টিয়ার হয়ে। নামেই হাসপাতাল, আসলে বৃদ্ধাশ্রম। পঞ্চাশ থেকে নব্বই, বিভিন্ন বয়সের অসুস্থ, আহত বা পঙ্গু একটি হস্তীযুথ, যাদের প্রায় গোটা জীবনটাই কেটেছে দাসত্বের বেড়ি পায়ে, তাদের শেষ জীবনে দু-দণ্ড জিরিয়ে, কায়িক শ্রমের হাত থেকে মুক্ত হয়ে, সময়ে খাবার আর ওষুধ পেয়ে, শান্তিতে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করার শেষ জংশন স্টেশন।

এই মুহূর্তে এশিয়ায় ষোলো হাজারের ওপর হাতি বন্দী জীবন যাপন করছে। বন্দী, অর্থাৎ তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের বাইরে, তাদের 'মানুষ প্রভু'-দের আজ্ঞাবহ দাস হয়ে - তা সে মহীশূরের রাজপ্রাসাদ হোক, বা আমেরের দুর্গ, জলদাপাড়ার অভয়ারণ্য হোক বা থাইল্যান্ডের কাঠ-চেরাই কল, কিংবা ভিয়েতনামের পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র। দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো স্থলচর প্রাণীটির পায়ে, সবচেয়ে ধূর্ত প্রাণীটির শিকল পরানোর প্রায় চার হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্যের নিশান। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের 'পোষ মানানো'-র ধরণটা কমবেশি একরকম - সোজা কথায় জোর খাটিয়ে, অকথ্য অত্যাচার করে - শারীরিক ও মানসিক দুই-ই।

এই মানসিক অত্যাচারের পরিপ্রেক্ষিত'টা আরেকটু পরিষ্কার করে বলার প্রয়োজন আছে।

হাতি'র মতো পরিবারবদ্ধ প্রাণী জীবজগতে খুব বেশি নেই। এবং শুধু পরিবারবদ্ধই নয়, মাতৃতান্ত্রিক-ও। হাতি'র যুথ পরিচালিত হয় হাতি-দিদিমা’র ইচ্ছেতে। তার পরে মা-মাসী-ইত্যাদিদের জোর। দাদু-ঠাকুর্দারা তো গুনতিতেই আসেন না, এমন কি বাবা-কাকাদেরও বয়ঃপ্রাপ্তির পরে বুঝিয়ে দেওয়া হয় নিজেদের রাস্তা দেখে নিতে। প্রবীণা দিদিমার সঙ্গে, মা-মাসীদের স্নেহের ছায়ায় বেড়ে ওঠে কচিকাঁচারা।

এই যে ষোলো হাজার বন্দী হাতির কথা বলছি, এদের প্রায় সকলকেই কম-বেশি তিন থেকে ছ'বছর বয়সের মধ্যে চুরি করে - বা অনেক ক্ষেত্রে তাদের চোখের সামনেই তাদের পরিজনকে হত্যা করে - ছিনিয়ে আনা হয় এদের প্রাকৃতিক পারিপার্শ্বিক থেকে। তার পরে চলে তাদের 'crushing the spirit' - দেশীয় ভাষায় 'ফাজান' (Phaazan), অর্থাৎ, তাদের মাথার ওপর থেকে যে দিদিমা-মা-মাসীদের স্নেহ বা ভরসার ছায়া সরে গেছে সারা জীবনের মতো, এর পরের জীবনটা যে তাদের অতিবাহিত করতে হবে শুধুই তাদের দু-পেয়ে মনিবদের আজ্ঞাবহ দাস হয়ে - এই কথাগুলো তাদের ছোট্ট অপরিণত মাথায় আক্ষরিক অর্থেই গজাল মেরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়; এমনভাবে, যাতে অবচেতন মনেও তাদের মধ্যে কখনো স্বাধীনতার স্বপ্ন শিকড় না গাড়তে পারে। শুওরের খোঁয়াড়ের মতো ছোট্ট আস্তানায় রাখা হয় এই চুরি-করে আনা দুধের ছানাগুলোকে – পাঁচ-ছ বছর অবধি যারা নির্ভর করে থাকে মায়ের দুধের ওপর, তাদের আধপেটা খাইয়ে, কখনো বা দীর্ঘ অনাহারে রেখে, শিকলে বেঁধে, অঙ্কুশের বাড়িতে রক্তাক্ত করে তাদের মনের মধ্যে পাকাপাকিভাবে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়; বেঁচে থাকার জন্যও তাদের নির্ভরশীল করে তোলা হয় তাদের দু-পেয়ে মালিকদের দয়ার ওপরে - ঠিক তেমন করে, যেমন করে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে আনা শিশুটিকে বিকলাঙ্গ করে বসিয়ে দেওয়া হয় রাস্তার মোড়ে ভিক্ষে করতে, বা শেখানো হয় ভীড় বাসে পকেট তাক করে ক্ষুর চালাতে, বা নীলামে চড়ানো হয় তার কৌমার্য। 

আর তাদের ছোট্ট মাথায়, ছোট্ট বুকে সেই ভয় আর ধুকপুকুনি নিয়ে তারা বেড়ে ওঠে, বড়ো হয়, বুড়ো হয়। কেউ কেউ মারাও যায় অল্প বয়সে। প্রতিটি হাতি, যাদের দেখেন পিঠে ট্যুরিস্টদের নিয়ে দুলকি চালে হেঁটে চলেছে পাহাড়ী রাস্তায় বা জঙ্গলে - জানবেন, তাদের প্রত্যেকের বন্দীজীবনের দাম, গড়পড়তা আরো চার থেকে পাঁচটি হাতির প্রাণ।

ইন্টারনেট ঘাঁটলে এ বিষয়ে অনেক প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যাবে - তেমনই এক তথ্যসূত্র থেকে তুলে দিচ্ছি এই 'ফাজান' প্রক্রিয়ার রূপটি।

“Repeatedly beaten with sharp metal and other tools, the helpless baby elephants will be constantly yelled and screamed at. They are stabbed, burned and beaten, as well as starved of food and deprived of water. Bull hooks (a tool used in most forms of elephant control) will be used to stab the animal's head, slash the skin and tug the ears. Asian elephants used in trekking (elephant rides), circuses or any other form of entertainment, often have shredded or torn ears from their tissue being ripped and pulled away during the training process.

They also often have scars on their foreheads from deep lacerations caused by beatings. The Phajaan may last from several days to weeks, most elephants go through it when they are 3-6 years, but they can be younger depending on the age at which they were taken from their mothers. They have no rest from physical torture and mental domination. Gradually, their spirits are broken, as their handlers achieve control.

In the final stage of the Phajaan, the elephant’s mahout will bring the animal its first meal with water, and will be the one to ''release'' the elephant and lead it away from the crate. After weeks of torture, mental and emotional abuse, loneliness, confusion and separation, the elephant sees this human figure as its saviour – the one it trusts. This is just another stage of mental and emotional manipulation, of course, but it is how a particular mahout gains such immense control over its animal.”

স্টকহোম সিন্ড্রোমের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে কি, পাঠক?

এরপর যখন হাতিটি তার মাহুতের পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করে নেয়, তখন শুরু হয় তার ট্রেনিং। তবে তার সঙ্গে মাঝে মাঝেই চলতে থাকে 'ফাজান'-এর পুনরাবৃত্তি - নিয়মিতভাবে তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় তার নিজের জায়গা। তখন থেকে শুরু করে, যতদিন অবধি সে পুরোপুরি অথর্ব না হয়ে পড়ছে ততদিন অবধি সে বেঁচে থাকে কেবল একটা ভারবহনের যন্ত্র হয়ে, তা সে কাঠের গুঁড়ি বা পাথরের ভারই হোক, বা মানুষের। তার কোনো অধিকার থাকে না, তার কোনো ইচ্ছে-অনিচ্ছে থাকে না, কোনো ইউনিয়ন লড়াই করে না তার হয়ে, এমন কি এশিয়ার বহু দেশের বন্যপ্রাণী-সংরক্ষণ আইনের আওতাতেও আসে না সে। অর্থাৎ, জঙ্গলে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানো হাতির দলটি সংরক্ষণের হকদার, কিন্তু সেই দল থেকে যে মুহুর্তে একটি বাচ্চাকে চুরি করে ছিনিয়ে এনে তাকে বশ্যতা স্বীকার করিয়ে ফেলা হয়, কাগজপত্র জাল করে তাকে গৃহপালিতের তকমা দিয়ে দেওয়া হয়, তখনই সে হারিয়ে ফেলে তার সংরক্ষণের সমস্ত অধিকার।

আর এই আমরাই বুক ঠুকে বলি - এই দুনিয়া থেকে দাসপ্রথা নির্মূল হয়ে গেছে! হায় রে ভণ্ডের পৃথিবী!

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ভারবহনের কাজটা একটা হাতির কাছে আর এমন কি? কথায় বলে, হাতির মতো জোর! কটা মানুষকে পিঠে নিয়ে হেঁটে যাওয়া, বা কিছু মোট বয়ে দেওয়া - একটা হাতির কাছে এটা কি আর এমন কাজ? তার বদলে তো তাকে দেওয়াও হচ্ছে হাতির খোরাক - ঠিক কি না?

ভূল - সর্বৈব ভূল।

হাতির শরীরের গঠন, বিশেষ করে তার পিঠের গঠন, ভারবহনের জন্য তৈরি নয় মোটেও।

হাতির মেরুদণ্ডের কশেরুকার গঠন অনেকটা খাঁজ-কাটা, এবং পর পর দুটি কশেরুকার মধ্যে থাকে বেশ খানিকটা ফাঁক। পিঠের ওপর হাওদা, বা এমনকি কোনো সওয়ারী বওয়ার জন্যও একেবারেই উপযোগী নয় তার শারীরবৃত্তীয় গড়ন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই কাজটিই তাকে করে যেতে হয় নিয়ত, কারণ তাতেই তার প্রভুদের লাভ। দিনের পর দিন এই কাজ করতে করতে পাকাপাকি স্পাইনাল ইঞ্জুরির শিকার হয় অনেক হাতি।

আর হাতির খোরাক?

একটি পূর্ণবয়স্ক হাতির খাদ্যের পরিমাণ দিনে দেড়শো থেকে আড়াইশো কিলোগ্রাম। ভাগ্যবান/ ভাগ্যবতী বন্দী যারা, তারা হয়তো এর অর্ধেক পায় বড়ো জোর। আমার কথা নয় - এশিয়ার এগারোটি দেশের গৃহপালিত (?) বন্দী হাতিদের নিয়ে বেশ কিছু প্রামাণ্য কাজ হয়েছে। এই পরিসংখ্যান সেখান থেকেই নেওয়া।

এর পর, যখন এদের আর ক্ষমতা থাকে না শক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে মানুষ-প্রভুদের কাজে আসার, তখন তাদের কখনো খেদিয়ে দেওয়া হয় জঙ্গলে। কেউ কেউ মারা যায় অসময়ে। কখনো বা কসাইয়ের ছুরি কিছু দরিদ্রের থালায় অসময়ে পড়ে-পাওয়া মাংসের জোগান দেয়।

আবার স্বপ্নের মতো অন্যরকম কিছুও ঘটে কখনো কখনো। কিছু মানুষ হয়তো উদ্যোগী হয়ে ওঠেন এদের শেষ জীবনটায় একটু আরামের, একটু বিশ্রামের ছোঁয়া দিতে। তখন আবার এদের প্রভুদের হয় পোয়াবারো। 'মরা হাতি লাখ টাকা' এই আপ্তবাক্যটিকে সত্যি প্রমাণ করতে তখন এইসব মরতে-বসা প্রাণগুলো আবারও হাতবদল হয় কিছু টাকার বিনিময়ে। জায়গা পায় এলিফ্যান্ট স্যাংচুয়ারিতে।

থাইল্যান্ড-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে, মানুষের করুণা ভাঙিয়ে, এমনকি এই এলিফ্যান্ট স্যাংচুয়ারির নামেও বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে একাধিক জায়গায়। 

******

এটা যে সেরকম কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়, এবং এদের রোজগারের পুরোটাই যে খরচা হয় এদের আশ্রিত হাতিদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য, নিজেকে সে ব্যাপারে খানিকটা নিশ্চিত করে, এক শনিবারের সকালেএসে হাজির হলাম এদের ফাউন্ডেশনের দরজায়। উদ্দেশ্য, শ্রমদান। একটি হাতির সঙ্গে খানিকটা সময় কাটানো। ওদের বিষয়ে কিছু জানা। এবং হয়তো কিছু ভূল ধারণা ভাঙা।

ব্রায়ান নামের যে ভদ্রলোক আমার সঙ্গে ছিলেন আমার গাইড হয়ে, তিনি চাকরিজীবনে ছিলেন ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি'র কম্যান্ডো। কাজের সূত্রে হয়তো প্রাণ নিয়েছেন অবলীলায়। কিন্তু এখন নিবেদিতপ্রাণ, এই বৃদ্ধআহত প্রাণীদের রক্ষণাবেক্ষণে। এরা প্রত্যেকেই ভারবাহীর কাজ করে এসেছে সারা জীবন - স্পাইনাল ইঞ্জুরির শিকার এরা সকলেই। তার ওপর কারোর একটা চোখে জ্যোতি নেই, কেউ একটা পা'য়ে পুরোপুরি পঙ্গু, কারোর নানাবিধ অন্য সমস্যা - আমার মধুচক্রিকা যেমন ফোকলা। আমার মনে পড়ে যাচ্ছিলো আমার দিদা'র কথা - শেষ বয়সে সব কটি দাঁত খুইয়ে আরো খোলতাই হয়েছিল ভদ্রমহিলার রূপ!

সারাটা দিন কাটলো বুড়ির পরিচর্যা করে। তাকে জঙ্গলে ঘোরাতে নিয়ে যাওয়া, তার খাবার তৈরি করা, পাহাড়-প্রমাণ ফল কাটা, তাকে ঘড়ি ধরে খাবার এবং ওষুধ খাওয়ানো - এবং সর্বোপরি তাকে স্নান করানো।মনে হলো, আমার সঙ্গ ভালোই লাগলো ভদ্রমহিলার। কিংবা কি জানি, এও হয়তো স্টকহোম সিন্ড্রোম!

স্নান-খাওয়ার পরে তাকে ছেড়ে আসা হলো ফাউন্ডেশনের লাগোয়া জঙ্গলে। ব্রায়ান বেশ লম্বা একটা দড়ির একটা মাথায় ফাঁস লাগিয়ে বেঁধে দিলেন মধুচক্রিকার পায়ে। অন্য মাথাটি বাঁধলেন মোটা একটা আমগাছেরগুঁড়িতে। আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে বললেন,

- Someone of her age and disability, and a broken spirit cannot handle full freedom. If left untied, she might break another of her limbs, or get injured by another elephant. She must live within a limited freedom, so that she can live the last few days of her life at peace. 

ফিরে আসার আগে আরেকবার দেখা করতে গেলাম মধুচক্রিকার সাথে । শুনেছি হাতির ঘ্রাণশক্তি অসম্ভব প্রখর। জানিনা আমার গন্ধে আমাকে চিনতে পারলো কি না। কিন্তু আমি গিয়ে দাঁড়াতেই শুঁড় বাড়িয়ে দিলো, ছোঁয়ালো আমার গায়ে, মাথায়, মুখে।

ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে, ওর খরখরে শুঁড়ের স্পর্শ পেতে পেতে মনে হলো, আমার শরীর থেকে একটা একটা করে খসে যাচ্ছে আমার জন্ম, আমার শিক্ষা, আমার পেশা, আমার সমৃদ্ধির আবরণ। খোলা আকাশের নীচে মুখোমুখি শুধু দুটি প্রাণী। একজন আশিটি বসন্ত পার করে দিয়েছে এই পৃথিবীতে। আরেকজন দাঁড়িয়ে পঞ্চাশের উপকণ্ঠে। একজন প্রতিভূ পৃথিবীর যাবতীয় সারল্যমাখা শক্তির - আরেকজন পৃথিবীরসব শঠতা, নীচতা আর কুটিলতার প্রতীক। দুজনেই নির্বাক - কিন্তু মনে হলো আমার গায়ে মাথায় ওর স্পর্শ বুলিয়ে দিতে দিতে মধুচক্রিকা আমাকে নিরুচ্চারে প্রশ্ন করছে, 

- কেন? 

বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলাম না ওর সামনে।

এই প্রশ্নের উত্তর তো আমাদের সভ্যতার সিলেবাসে নেই।

9 comments:

2

প্রবন্ধ - সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


রক্ত ও রক্তদান- কিছু সাধারণ কথা
সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়



১৬১৬ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম হার্ভে বুঝিয়েছিলেন মানবদেহে রক্ত সঞ্চালনের ক্রিয়াপদ্ধতি। তারপর কেটে গিয়েছে তিন শতাব্দী। লোকে যুদ্ধ দেখেছে, হানাহানি দেখেছে, দেখেছে রক্তক্ষয়। বুঝেছে রক্তের উপর মানুষের নির্ভরতা। চেষ্টা চলেছে কুকুর, ভেড়া এমনকি মানুষের শরীর থেকেও রক্ত নিষ্কাশন করে অন্য মানুষকে দেওয়ার। বলাই বাহুল্য, এগুলো অত্যন্ত crude method বলেই বিবেচিত হয়েছিল, সেকালেও--- এর মধ্যে ১৮১৮ সালে ডাক্তার জেমস ব্লান্ডেলের সরাসরি মানুষের শরীর থেকে রক্ত নিয়ে এক রক্তশূন্য প্রসূতিকে বাঁচানোর ঘটনাটি প্রণিধানযোগ্য।

অবশেষে, বিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায়, ১৯০১ সালে অস্ট্রিয়ান প্যাথোলজিস্ট ডাক্তার কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার আবিষ্কার করলেন ব্লাড গ্রুপ--- যাকে আমরা ABO system বলে অভিহিত করি। যদিও নেগেটিভ না পজিটিভ গ্রুপ, তা জানতে কেটে গেল আরো উনচল্লিশটা বছর। ১৯৪০ সালে ল্যান্ডস্টাইনার, ডাক্তার আলেকজান্ডার ওয়াইনারের সঙ্গে যৌথভাবে আবিষ্কার করলেন Rh factor, অর্থাৎ রক্তের গ্রুপ পজিটিভ না নেগেটিভ, তার নির্ণয় করা সম্ভব হলো। Blood transfusion এর ক্ষেত্রে ঘটে গেল নিঃশব্দ বিপ্লব!

এর পরেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ সালে কলকাতায় চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউএর অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথে, ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস সোসাইটির দ্বারা পরিচালিত ভারতবর্ষের প্রথম ব্লাডব্যাঙ্ক স্থাপিত হলো।

রক্ত মূলত দুই কারণে প্রয়োজন হয়। প্রথমত, আপৎকালীন বা ইমার্জেন্সি অবস্থায়, যেমন প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ, অপারেশন টেবিলে অথবা অপারেশনের অব্যবহিত পরেই কোনো শিরা বা ধমনী থেকে রক্তক্ষরণ(ম্যাসিভ হেমারেজ), পথ দুর্ঘটনা, অস্ত্রক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ(স্ট্যাব ইনজুরি বা বুলেট ইনজুরি), শরীরের কুড়ি শতাংশ বা তার বেশি পুড়ে যাওয়া, অকস্মাৎ রক্তবমি বা রক্ত পায়খানা, ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়ার মতো কিছু সংক্রমণ ইত্যাদি।

আর, দ্বিতীয়ত, রক্ত লাগে কিছু নন ইমার্জেন্সি অবস্থায়, যেমন কোনো পরিকল্পিত অপারেশন--- হার্টের বাইপাস অপারেশন, থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের অপারেশন, জরায়ু বাদ দেওয়ার অপারেশন, ভাঙা হাড় জোড়া দেওয়ার অপারেশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে--- এবং বিভিন্ন রক্তঘটিত রোগের ক্ষেত্রে, যেমন, থ্যালাসেমিয়া, লিউকেমিয়া, অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া, হিমোফিলিয়া ইত্যাদি রোগের সঙ্গে যুদ্ধে।
প্রতিটি রোগীর আত্মীয়ের কাছেই তার রোগীর অবস্থা সবচেয়ে জরুরী বা ইমার্জেন্সি--- আমি শুধু চিকিৎসকের দৃষ্টিতে আপৎকালীন এবং আপৎকালীন নয়, এমনভাবে ভাগ করে দিলাম। যদিও অবস্থাগতিকে তারতম্য থাকবেই, ব্যতিক্রমও থাকবে, কিন্তু সেটা অন্য কোনো বিস্তারিত আলোচনার জন্য তোলা থাক।

এবার আসা যাক রক্তদানের কথায়। 
কারা রক্তদান করতে পারেন? ১৮ বছর বয়সের উপরে এবং ৬৫ বছর বয়সের নীচে যে কোনো ব্যক্তি--- পুরুষ, মহিলা নির্বিশেষে, রক্তদান করতে পারেন।
রক্তদান করতে গেলে শরীরের ওজন কমপক্ষে ৪৫ কেজি হতে হবে। একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষের শরীর থেকে কেজি প্রতি আট মিলিলিটার পর্যন্ত রক্ত সংগ্রহ করলে তাঁর কোনোপ্রকার ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না।
একবার রক্তদান করলে তিনমাস পর্যন্ত আর রক্ত দেওয়া যায় না। তারপর আবার দেওয়া যায়। একজন সুস্থ মানুষ বছরে চারবার রক্ত দিতে পারেন।
বিগত একবছরের মধ্যে জন্ডিস বা টাইফয়েড আর ছয়মাসের মধ্যে ম্যালেরিয়া হয়ে থাকলে রক্ত দেওয়া যাবে না।
জলাতঙ্ক বা হেপাটাইটিস বি টিকা নেওয়ার একবছরের মধ্যে রক্ত দেওয়া যাবে না।
কোনো বড় অপারেশনের একবছরের মধ্যে এবং ছোটখাটো সার্জারি, যেমন দাঁত তোলা, ফোড়া কাটা ইত্যাদির ছয়মাসের মধ্যে রক্ত দেওয়া যাবে না।
ব্লাডসুগারের রোগী যদি ইনসুলিন নেন, রক্ত দেবেন না। যদি খাওয়ার ওষুধ খান, আর ব্লাডসুগার নিয়ন্ত্রিত থাকে(অবশ্যই সাম্প্রতিক রিপোর্ট সঙ্গে রাখবেন), রক্ত দিতে বাধা নেই।
ব্লাডপ্রেশার নিয়ন্ত্রিত থাকলে রক্ত দেওয়া যায়, তবে ১৪০/৯০ এর ঊর্দ্ধে থাকলে রক্তদান করা অনুচিত।
কিছু কিছু রোগ থাকলে কখনোই রক্তদান করা উচিৎ নয়, যেমন হাঁপানি, মৃগী, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, হার্টের অসুখ, কিডনি বা থাইরয়েডের অসুখ, সিজোফ্রেনিয়া, ক্যানসার ইত্যাদি থাকলে রক্তদান করবেন না।
মহিলারা ঋতুচক্র চলাকালীন রক্ত দিতেই পারেন, যদি হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ঠিক থাকে।
গর্ভপাতের ছয়মাসের মধ্যে, আর প্রসবের একবছরের মধ্যে রক্ত দেওয়া যায় না। সন্তানকে স্তন্যপান যতদিন করানো হয়, ততদিন রক্ত দেওয়া যায় না।

অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে খেতে রক্ত দেওয়া যাবে না। ওষুধ বন্ধ হওয়ার ৭২ঘন্টা পরে দাতা রক্ত দিতে পারেন। সম্ভাব্য দাতা সবসময়ই ওষুধের প্রেসক্রিপশন সঙ্গে রাখবেন।
রক্ত দেওয়ার আগে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। ১২ থেকে ১২.৫ গ্রাম/ডেসিলিটার থাকলে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিক বলে ধরা হয় আর রক্তদাতা নির্বিঘ্নে রক্ত দিতে পারেন।

এবার প্রশ্ন হচ্ছে, রক্তদান কত রকমের হতে পারে? 
পাড়ায় পাড়ায়--''স্বেচ্ছা রক্তদান শিবির''--এর ফেস্টুন বা ব্যানার দেখেননি এমন মানুষ বিরল।
প্রখ্যাত রসসাহিত্যিক তারাপদ রায়, তাঁর রম্যবচনার সংকলন 'কান্ডজ্ঞানে' লিখেছিলেন, রক্তদান কি করে স্বেচ্ছায় ব্যতীত অন্যভাবে হতে পারে? দান, বিশেষত তা যদি রক্ত হয়, সেটা 'স্বেচ্ছা'য় না হয়ে অনিচ্ছায় হলে তো ভয়ানক ব্যাপার! 
একটু বিশদে বলি। 
Donation কথাটার বাংলা হলো দান। তাই, মানুষের শরীর থেকে,তার অনুমতি নিয়ে রক্ত নিষ্কাশন করা হলেই সেটা 'দান'। এবার, যদি কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই, এই দান করতে কেউ রাজি থাকেন, তাহলে তাঁকে voluntary donor বা স্বেচ্ছা রক্তদাতা বলে অভিহিত করা হয়। 
আর যদি কোনো ব্যক্তি তাঁর কোনো আত্মীয় বা স্বজনবন্ধুর জন্য ব্লাডব্যাঙ্ক থেকে রক্ত নিতে এসে, এক ইউনিট রক্ত বা রক্তের কোনো উপাদানের বিনিময়ে রক্তদান করেন, তাঁকে বলা হয় replacement donor বা বিনিময়কারী রক্তদাতা। ব্লাডব্যাঙ্কের বাইরে আয়োজিত বিভিন্ন শিবিরে, কোনো বিনিময় ছাড়াই যাঁরা অচেনা অজানা মানুষের উপকারে লাগবে বলে মনের তাগিদে রক্তদান করেন, সেই স্বেচ্ছা রক্তদাতারাই যে কোনো ব্লাডব্যাঙ্কের মেরুদণ্ড।
এখানে একটা কথা বলা হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না, যে ভারতবর্ষে professional blood donation বা পেশাদার রক্তবিক্রয় কিন্তু ১৯৯৮ সালের ১লা জানুয়ারি থেকেই মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আদেশে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে।

আজকাল শিবিরগুলোয় রক্তদাতাদের আকর্ষণীয় উপহারসামগ্রী দেবার চল হয়েছে। কিন্তু নিয়মমাফিক, একটি ছোট টিফিনের প্যাকেট, সুদৃশ্য ব্যাজ এবং রক্তদানের সার্টিফিকেট ছাড়া, রক্তদাতাদের আর কিছু দেওয়া নীতিবিরুদ্ধ।

পশ্চিমবঙ্গে রক্তদান আন্দোলনের গোড়ার থেকে এই মহীরূহে যাঁরা অক্লান্তভাবে জলসেচন করে আসছেন, সেই অসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি, West Bengal Voluntary Blood donor's forum বা Association of Voluntary Blood donors কিন্তু কোনো উপঢৌকন বা উপহারের বিনিময়ে রক্তদানের তীব্র বিরোধিতা করে থাকেন। 
আবার, এটাও লক্ষ্যণীয় যে, বিনা incentiveএ অধিকাংশ শিবিরেই দাতা দুর্লভ হয়ে ওঠেন। এ-ও দেখেছি, পাশাপাশি পাড়ায় দু'টি রক্তদান শিবির অনুষ্ঠিত হলে, যে উদ্যোক্তারা বেশি দামী উপহার দিচ্ছে, তাদের ক্যাম্পেই ভিড় বেশী হয়ে থাকে।
'দিবে আর নিবে' মন্ত্রজপা বর্তমান স্বার্থপর সমাজে, প্রকৃত স্বেচ্ছা রক্তদানের সামাজিক সচেতনতাটুকু এখনো সেভাবে গড়ে তুলতে পারেননি গণআন্দোলনের কর্মীরা--- এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়।

আরো একটা বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে চাই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা রক্তদান আন্দোলনকে ইদানীং রক্তদান উৎসব বলে উল্লেখ করছেন, খুবই ভাল কথা। কিন্তু উৎসব যদি কেবলমাত্র ডিসেম্বর-জানুয়ারী এবং জুলাই আগস্ট মাসেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে না উৎসব, না বিপ্লব--- কোনোটাতেই সেই কর্মকান্ড উত্তীর্ণ হতে পারেনা। এই রক্তদাতারাই যদি অল্প সময়ে বিরাট পরিমাণে রক্ত না দিয়ে, unused blood wastage এর পরিমাণ কমিয়ে, সারা বছর ধরে ছোট ছোট শিবিরে বিভক্ত হয়ে রক্তদান করেন, গ্রীষ্মকালীন এবং শারদোৎসবকালীন রক্তের হাহাকারটা একটু কমে। এখানেই donor motivation factorটা ভীষণ জরুরী কথা হয়ে দাঁড়ায়।

যে কোনো রক্তদান শিবির থেকে রক্ত সংগ্রহের পরে, তা পাঁচ থেকে ছ'ঘন্টার মধ্যে ব্লাডব্যাঙ্কে এনে পৃথকীকরণের কাজ শুরু করে দেওয়া উচিৎ। 
পৃথকীকরণ মানে? যখন রক্ত সংগৃহীত হয়, তা সবসময়ই হোল ব্লাড হিসেবে সংগৃহীত হয়। ব্লাডব্যাঙ্কে এনে নানা যন্ত্রের মাধ্যমে সেই হোল ব্লাড থেকে প্যাকড রেড ব্লাড সেল, প্লাজমা এবং প্লেটলেট তৈরি করার পদ্ধতিকেই বলে পৃথকীকরণ।
তাছাড়া, সংগৃহীত রক্তে বিভিন্ন জীবাণুর উপস্থিতিও পরীক্ষা করে দেখা হয়---যেমন, এইচ আই ভি, হেপাটাইটিস বি এবং সি, ম্যালেরিয়া আর ভিডিআরএল( সিফিলিস জাতীয় যৌনরোগ)--- যে জীবাণুগুলি রক্তের মাধ্যমে রোগীর দেহে সংক্রমণ ছড়াতে পারে, সেই জীবাণুকে চিহ্নিতকরণের কাজ হয়। যদি সংগৃহীত রক্তে এ ধরনের কোনো জীবাণুর উপস্থিতির প্রমাণ মেলে, তা সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট করে ফেলা হয়-- কোনো রোগীকে দেওয়া যায় না। সেই রক্তদাতা, যাঁর রক্তে জীবাণু মিলেছে, তাঁকে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে( যে হাসপাতালের সঙ্গে ব্লাডব্যাঙ্কটি যুক্ত), সেখানে ডেকে এনে উপযুক্ত চিকিৎসা এবং কাউন্সেলিং করা হয়। 
এই কারণে, প্রতিটি রক্তদান শিবিরে, রক্তদাতার ঠিকানা এবং মোবাইল নম্বর নথিভুক্ত করা আবশ্যক।

দেখা যাক মূলত কি কি রোগ দূষিত রক্তের মাধ্যমে ছড়ায়। ভাইরাল রোগের মধ্যে রয়েছে এইচ আই ভি, হেপাটাইটিস বি এবং সি, হিউম্যান টি লিম্ফোট্রফিক ভাইরাস(সংক্ষেপে এইচটিএলভি), সাইটোমেগ্যালোভাইরাস বা সিএমভি, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস ইত্যাদি। ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমণের মধ্যে রয়েছে সিফিলিস। আর প্যারাসাইটিক সংক্রমণের মধ্যে রয়েছে ম্যালেরিয়া এবং শাগাজ ডিজিজ(Chagas disease).
আমাদের দেশে, রক্তসংগ্রহের পরে এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি ও সি, সিফিলিস এবং ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা করা হয়।

যখনি কোনো জীবাণু মানবদেহে ঢোকে, শরীরের ইমিউন সিস্টেম তাকে প্রতিহত করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এই antibody testই হলো immunoassay বা ELISA, যা এইচআইভি 1ও 2, হেপাটাইটিস বি এবং সি-র জীবাণুর উপস্থিতি প্রায় নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করে।

রোগজীবাণুর শরীরে প্রবেশ এবং তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কালই হলো window period. এইসময়ের মধ্যে যদি কোনো রক্তদাতার রক্ত ELISA test এ পরীক্ষা করা হয়, জীবাণুর উপস্থিতির প্রমাণ না-ও পাওয়া যেতে পারে। ঠিক এই কারণেই, রক্তদাতাদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি, যাকে বলা হয় pre donation history taking. অনেকসময় খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমেই এমন অনেক তথ্য উঠে আসে, অভিজ্ঞ চিকিৎসক বা ব্লাডব্যাঙ্কের কর্মী বুঝতে পারেন, যে রক্তে জীবাণু থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। 
আর সম্ভাব্য রক্তদাতারও কোনো তথ্য গোপন করা অনুচিত। শুধু বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থে নয়, তার নিজের সুরক্ষার জন্যও।

ব্লাডব্যাঙ্কের সেরোলজি ল্যাবে সম্পন্ন হওয়া এই পরীক্ষা কিন্তু কখনোই confirmatory test নয়। এই ELISA test result positive হলে সেই রক্তের ব্যাগটি সঙ্গে সঙ্গেই autoclave পদ্ধতিতে নষ্ট করে ফেলা হয়। কিন্তু সেই ব্যক্তিটির আরো কতকগুলি পরীক্ষা নিরীক্ষা(অবশ্যই ব্লাডব্যাঙ্কের ল্যাবরেটরিতে নয়) করাবার পরে তবেই নিশ্চিত রূপে বলা যায়, যে উল্লিখিত রক্তদাতা সেই রোগে আক্রান্ত। এই কারণেই প্রত্যেক রক্তদাতার মোবাইল নম্বর এবং যোগাযোগের ঠিকানা রক্ত সংগ্রহকারী ব্লাডব্যাঙ্কের কাছে নথিভুক্ত করে রাখা প্রয়োজন, যাতে screening test positive এলেই পরবর্তী পরীক্ষার জন্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।

ELISA test যেমন ইমিউন সিস্টেমের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় তৈরি হওয়া antibodyর উপস্থিতি দেখে result দেয়, তেমনই কিছু পরীক্ষা আছে, যেগুলি ভাইরাসের জিনগত উপকরণ খুঁজে বার করতে সাহায্য করে। এই পরীক্ষাকে বলে Nucleic acid test, সংক্ষেপে NAT. NAT যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ হওয়ায় সরকারী ব্লাডব্যাঙ্কে এর ব্যবহার সীমিত।

উপরোক্ত পরীক্ষাগুলি ছাড়াও সিফিলিসের জন্য rapid plasma reagin, সংক্ষেপে RPR এবং ম্যালেরিয়ার antibody test ও হয়।

সকলের মনেই এই প্রশ্ন থাকতে পারে, যে রক্ত দেওয়ার আগেই এই পরীক্ষাগুলি কেন করানো হয় না? তাহলে তো কোনোভাবেই রক্তসুরক্ষার সঙ্গে কোনো আপস হয় না। না, সেটা সম্ভব নয়। কারণ, এই serological test অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আর খামোখা একজন সম্ভাব্য রক্তদাতাকে দু'বার সূচ ফোটানোর কষ্ট পেতেই বা হবে কেন?

Pre donation donor screening এবং history takingএর গুরুত্ব কিন্তু অপরিসীম। আর এই ব্যাপারে রক্তদান শিবিরের উদ্যোক্তা ক্লাবগুলিরও কিন্তু যথেষ্ট ভূমিকা আছে। 
অধিকাংশ রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেন পাড়ার ক্লাব, স্থানীয় রাজনৈতিক দাদা দিদিরা। বহিরাগত ব্লাডব্যাঙ্ক কর্মীদের চেয়ে স্থানীয় রক্তদাতা মানুষজনকে ক্লাবের ছেলেরা অনেক বেশি চিনবেন। কার তিনমাস আগে জন্ডিস বা ম্যালেরিয়া হয়েছিল, কে মুম্বইতে সোনার কাজ করতে গিয়েছিল একা, কার মাদক নেওয়ার অভ্যাস ছিল, অথবা, কে উপঢৌকনের লোভে একমাস আগে পাশের পাড়ায় রক্তদান করার কথা বেমালুম গোপন করছে, এ কথা ক্লাবের ছেলেরা জানবেই।
তাদের সহযোগিতায় এই donor screening আরো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে, রক্তসুরক্ষার বলয় আরো অটুট হবে, এটা নিশ্চিত বলা যায়।

আরো একটা কথা, রক্তদান শিবির উদ্যোক্তাদের একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, যে blood safety নিশ্ছিদ্র করতে, NACO অর্থাৎ National Aids Control Organisation এর guideline অনুযায়ী কোনো যৌনপল্লীর 2 কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কোনো রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা যায় না।

একটাই কথা বলার--- যে transfusion transmitted infection এর screening test গুলোর কথা লিখলাম, সেগুলি খুবই স্পর্শকাতর এবং উপযোগী হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু 100% fullproof নয়। তাই মুষ্টিমেয় কিছু ক্ষেত্রে হলেও দুর্ভাগ্যজনক ভাবে থ্যালাসেমিয়া বা হিমোফিলিয়া আক্রান্ত রুগ্ন মানুষ শুধু unsafe transfusion এর কারণে HIV বা HEPATITIS B/C আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে-- শুধু এদেশে নয়, বিদেশেও।

রক্তসুরক্ষা নিয়ে অক্লান্ত কর্মকাণ্ড আজও চলছে। ভারতবর্ষের মতো জনবিস্ফোরণে ভারাক্রান্ত দেশে, যেখানে public health awarenessই সর্বত্র সেভাবে গড়ে ওঠেনি, যেখানে সিংহভাগ রক্তের চাহিদার জন্য মাঠেঘাটে স্বেচ্ছারক্তদান শিবিরগুলির উপর ভরসা করতে হয়, সেখানে নিখুঁত রক্তসুরক্ষার জন্য আমাদের অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।

অযথা আলোচনা দীর্ঘায়িত করব না--- বড় ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে। রক্তদান এক বিশাল বিষয়। এই ছোট্ট পরিসরে তাকে ধরা মুশকিল। অনেক প্রশ্ন হয়ত অমীমাংসিত থেকে গেল--- বহু প্রশ্ন উথ্থাপনই করা হলো না। তবু আলতো করে ছোঁয়া হলো হয়ত অচেনা জগৎটাকে। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা কিছু ভ্রান্ত ধারণাকেও ভাঙার চেষ্টা করা গেল একটুখানি।

সাধারণ মানুষের সচেতন সহযোগিতা ব্যতীত আমাদের দেশে রক্তদান এবং রক্তসুরক্ষা নিয়ে বেশিদূর এগোনো যাবে না-- সকলকে এই কথা মনে করিয়ে দেওয়াই এই লেখার উদ্দেশ্য।

2 comments:

3

বইঘর - চয়ন

Posted in


বইঘর


সূর্যনগরীর কান্না
চয়ন



‘দুর্গম গহন অরণ্য, তার মধ্যে আছে হিংস্র জন্তু, নির্জন মরুর চেয়েও শুষ্ক বিশাল পর্বত-রাজ্য- তারই আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকবে লাল-মানুষের সতর্ক চক্ষু। সে সব নিষ্ঠুর চোখ যখনই আমাদের আবিষ্কার করবে তখনই ছুটে আসবে উত্তপ্ত বুলেটের ঝটিকা।’ (সূর্যনগরীর গুপ্তধন : হেমেন্দ্রকুমার রায়;১৯৪৪)

‘বন্দর-নগর টম্‌বেজ যে অত্যন্ত উন্নত ও সমৃদ্ধ এক অজানা রাজ্যের একটি সীমান্ত ঘাঁটি মাত্র তা বুঝতে তাঁর দেরী হয়নি। সর্বত্র রাস্তায় ঘাটে দেবস্থানে সোনা-রুপোর ছড়াছড়ি দেখেছেন,দেখেছেন সেই আশ্চর্য প্রাণী যার কোমল মসৃন লোম ইউরোপের শ্রেষ্ঠ পশমকেও হার মানায়- অজানা সভ্যতায় ব্যবহৃত নতুন কয়েকটি শব্দ শিখেছেন যেমন কুরাকা, যেমন মিনি মারেস্‌, যেমন ইঙ্কা।’ (সূর্য কাঁদলে সোনা :প্রেমেন্দ্র মিত্র, ১৯৬৯)

দুই কিশোরপাঠ্য অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস। এক পটভূমি – পেরু। দু’জন লেখক। জগৎ চিন্তার দুটি মেরু। সূর্যনগরীর গুপ্তধন এবং সূর্য কাঁদলে সোনা। হেমেন্দ্রকুমার রায় আর প্রেমেন্দ্র মিত্র। ১৫৩২ সালে স্পেনের ফ্রান্‌সিস্‌কো পিজারো, চরম নীচতা আর বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়ে পেরুর সম্রাট ইংকা নরেশ আতাহুয়াল্পাকে হারিয়ে পেরু জিতে নেন। পেরুবাসীর ওপর চলে অকথ্য অত্যাচার। শেষে সম্রাটকে খুনও করেন পিজারো। সম্রাটের মুক্তিপণ হিসেবে রাশি রাশি সোনা নিয়ে আসছিল প্রজারা। রাজহত্যার খবর পেয়ে সেই সোনা তারা কোনও গোপন স্থানে লুকিয়ে ফেলে। সূর্যনগরীর গুপ্তধন বিংশ শতকে এই লুকোন সম্পদ দেখতে যাওয়ার কাহিনী বলে। সূর্য কাঁদলে সোনা বলে পিজারোর পেরু বিজয়ের গল্প। 

প্রথমটির নায়ক বিমল-কুমার। বা আরও স্পষ্ট করে বললে বিমল। ছ’ফুটের ওপর লম্বা, অসীম দৈহিক বল, রাইফেলে ক্র্যাক্‌শট, বাঙালির ঘরকুনো বদনাম ঘোচাতে মরিয়া। তার ঘোষণা- ‘ঘরকুনো বাঙালির ঘরে জন্মেও আমরা হতে চাই বিশ্বমানবের আত্মীয়, আমরা ধন-মান-খ্যাতি কিছু প্রার্থনা করি না, আমরা চাই শুধু ঘটনার আবর্তে ঝাঁপ দিতে, উত্তেজনার পর উত্তেজনা ভোগ করতে, নব নব দৃশ্য আর সৌন্দর্যের মধ্যে তলিয়ে যেতে’ (সোনার পাহাড়ের যাত্রী, নজরটান আমার)। দ্বিতীয়টির নায়ক ঘনরাম দাস। ১৫০৩ সালে ভারতের ‘পশ্চিম উপকূলের সমুদ্রে পর্তুগীজ বোম্বেটেদের লুট- করা, জ্বালিয়ে- দেওয়া তাম্রলিপ্তির সদাগরী জাহাজ থেকে রক্ষা পেয়েও ধরা পড়ে প্রায় অর্ধেক যৌবন পর্যন্ত পোর্টুগ্যাল, স্পেনে এবং এখন যাকে আমরা কিউবা আর মেক্সিকো বলে জানি, সেই দুই দেশে ক্রীতদাস হয়ে কাটিয়ে... [পরে] দাসত্ব থেকে মুক্তি পেলেও নিজের বংশের ধারার ওই চরম গ্লানি ও পরম গৌরবের অধ্যায় চিরস্মরণীয় করে রাখবার জন্য দাস পদবীই গ্রহণ করেছিলেন’ (সূর্য কাঁদলে সোনা)। শ্যামলকান্তি, সুপুরুষ ঘনরাম তলোয়ার চালান কিংবদন্তীর এল্‌ সিড্‌ কম্পিয়াডরের মতো; ফার্নানদেজ দে ওভিয়েদো ঈ ভালদেজের মতো পণ্ডিত তাঁর শিক্ষাগুরু। তাঁর আত্মঘোষণা, ‘স্পেনের শত্রু আমি নই, অবিচার অন্যায় নীচতা দম্ভ পাশবিকতা লোভ পৃথিবীর সব সাধারণ মানুষের মতো আমি শত্রু এই সব কিছুর।’ এই স্বর আমরা আবার শুনি তাঁর অধঃস্তন দ্বাবিংশতিতম উওরপুরুষ একমেবাদ্বিতীয়ম্‌ ঘনশ্যাম দাসের গলায়। অমানুষ ধলা-আদমি ফিংককে তিনি বলেন, ‘আমার দেশের নাম মানুষের দুনিয়া। আপনার দক্ষিণ আফ্রিকা তার মধ্যে নেই’ (‘জল’:প্রেমেন্দ্র মিত্র, ১৯৬৪। নজরটান আমার)।

আপনি জানতে চাইছেন, এই নজরটান গুলো ঊদ্ধৃতির মধ্যে আমি দিচ্ছি কেন? আসলে, একই পটভূমিতে লেখা দু’টো কিশোরপাঠ্য অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসকে সামনে রেখে বইঘর বুঝে নিতে চাইছে বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের এক বিশেষ ধরণকে। একটু পিছিয়ে যাই। উনিশ শতক, ঔপনিবেশিক শিক্ষার দৌলতে গড়ে উঠল এক নতুন শ্রেণী। বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক সম্প্রদায়। ইংরিজি সে শিখল বটে, কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই বোঝা গেল যে সে এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রোডাক্ট, যার উদ্দেশ্য হলো সুশীল, রাজভক্ত প্রজা বানানো। এই শ্রেণীর একটা বিশেষত্ব ছিল। একদিকে, এরা বৃটিশরাজকে ভয়,ভক্তি করতো, আর একটা প্রবল হীনমন্যতায় ভুগত ইংরেজের ক্ষমতার আস্ফালনের সামনে। মনে মনে চাইত প্রভুর সমান হতে। অন্যদিকে, ‘ছোটলোক’ সম্প্রদায়কে ঘেন্নার ব্যাপারে এরা ছিল একেবারে এককাট্টা। ঔপনিবেশিক শিক্ষার সবচেয়ে খারাপ দিক ছিল নিরন্ন, অপুষ্ট, অশিক্ষিত প্রকৃত ভারতথেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। এই দু’রকম দিকেরই প্রতিফলন ঘটে বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে। আমরা তার একটা দিককে দেখতে চাইছি। বিশের শতকের দ্বিতীয়ভাগ থেকেই বাংলা ছোটদের লেখায় এক ধরণের চরিত্রের দেখা পাওয়া যেতে থাকে। এরা গতে বাঁধা জীবন নিয়ে প্রচণ্ড অসন্তুষ্ট; অজানার আহ্বানে চঞ্চল পাখা মেলতে তাদের মন-বলাকা হামেশা তৈয়ার। তারা জগৎ দেখতে চায়, অ্যাডভেঞ্চার চায়,সাহেব প্রভুদের মতো শক্ত সমর্থ হতে চায়। কিংসটন-ব্যালেন্টাইন-হেন্‌টি-হ্যাগার্ড-কিপলিং-ওয়ালেস পড়া বাঙালি লেখককুল গড়ে তুললেন ইচ্ছেপূরণের দুনিয়া, যেখানে বাঙালির ছেলে বদ্ধঘর ছেড়ে বেরোতে চায়। গোলটাও বাধল ঠিক এখানেই। নিজের অজান্তেই ঔপনিবেশিক বয়ানের ফাঁদে পড়লেন তাঁরা। যেসব সাহেব সুবোর নাম করলাম তাঁদের লেখার উদ্দেশ্যই ছিল সাহেবখোকাদের (খুকুদের নয়) গ্লোরিয়াস এম্পায়ার রক্ষার তালিম দেওয়া। সাদা মানুষের অসভ্য কালা-আদমিদের সভ্য করে তোলার বোঝা বওয়ার মতো মজবুত কাঁধ বানাতে মদত করা। ঠিক এই ছাঁচেই পড়ে গেল ছোটদের জন্য লেখা বাংলা অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসগুলো। সঙ্গে মিশল মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণীচরিত্র। দু’ইয়ে মিলে ফল দাঁড়ালো এই যে, ঘরের বাইরে বেরোতে চেয়েও ঘরেই রয়ে গেল ডানপিটে অভিযানকারীর দল। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কালজয়ী গোপাল রাখাল দ্বন্দ্ব সমাস – উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য বইয়ে লিখেছেন,

উত্তেজনার খোঁজে বেরিয়ে পড়া বাঙালিরা-আফ্রিকা, লাতিন- আমেরিকা, চীন, ব্রহ্মদেশ, ভারত যেখানেই যাক, যত বিচিত্র মানুষের সংস্পর্শে আসুক, যত আলাদা রীতি-নীতি ধ্যানচিন্তার আবহে প্রবেশ করুক, অচেনা ভুবনগুলি তারা নেহাতই স্পর্শকের মতো ছুঁয়ে যায়, অপরিসীম অবজ্ঞা ও নাকউঁচু মনোভাব নিয়ে এড়িয়ে যায়। ফলে তাদের মনে চেনা অচেনার কোনো দ্বন্দ্ব তৈরি হয় না, যে চেনা জগৎ ছেড়ে তারা বেরিয়েছে সেই জগৎটাই ছাপিয়ে উঠে গ্রাস করে নেয় অচেনা জগৎকে। (গোপাল রাখাল দ্বন্দ্ব সমাস – উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য; পৃ:২৮৬)

তাই বিভূতিভূষণের শঙ্কর রোডেশিয়া গেলেও চাঁদের পাহাড় – এর কোথাও সাদাদের অমানবিকতা নিয়ে ঘনশ্যাম দাসের মতো স্পর্ধিত উচ্চারণ নেই। আসলে এক উপনিবেশের প্রজা অন্য উপনিবেশের প্রজার মধ্যে নিজেকে দেখতে চায় না। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘একদিকে যারা সাড়ম্বরে বিজ্ঞাপিত করে তারা স্বভাব বাউণ্ডুলে, সৃষ্টিছাড়া, তারাই আবার নিজেদের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। অন্যের মাপকাঠিতে নিজেকে যাচাই করার দায় থেকে রেহাই পেতে চায় বলেই বিকল্প জীবনযাত্রাকে তারা আমল দেয় না।’(গোপাল রাখাল দ্বন্দ্ব সমাস – উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য; পৃ:২৮৬)

এই কারণেই, বিমলের বিশ্বমানবের আত্মীয় হওয়ার ইচ্ছে আর ঘনরাম- ঘনশ্যামের মানুষের দুনিয়া-র মধ্যে আড়াআড়ি বেধে যায়। সূর্যনগরীর গুপ্তধন যদি ভালো করে পড়েন তবে দেখবেন বইটার মধ্যে রামায়ণের আদল আছে। নিষিদ্ধ সূর্যনগরীতে সবান্ধব বিমল, কুমার আর ফিলিপ সাহেব ঢুকতে পারেন বিভীষণ ইক্‌নিটাইক্‌-এর সাহায্যে। এখানে একটা কথা মনে রাখলে ভালো। ইংকা সাম্রাজ্যের বর্ণনা দেওয়ার সময় ফিলিপ সাহেব পিজারোকে নিষ্ঠুর, বিশ্বাসঘাতক, দস্যু প্রভৃতি বাছা বাছা বিশেষণে বিশেষিত করেন। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় ভিন্ন সভ্যতা সম্বন্ধে তাঁর মনে একটা খোলা ভাব আছে? না। একেবারেই না। গুলি খাওয়া ইক্‌নিটাইক্‌ যখন জল চাইছে তখন,

ফিলিপের ওষ্ঠাধরে ফুটল কঠিন হাসি। তিনি বললেন, “ইক্‌নিটাইক্‌, তুমি যে আমাদের পরম শত্রু, সে কথা আমরা জানি। আমাদেরই অনিষ্ট করবার জন্যে কাল তোমরা এখানে এসেছিলে, তাই ভগবান তোমাকে শাস্তি দিয়েছেন। আমাদের কাছে জল চাইতে তোমার লজ্জা হচ্ছে না?”

একেবারে পেশিবহুল কেরেস্তানি গলার স্বর। তাহলে, এই বই কি পুরোপুরি সাহেব ভজনায় ভর্তি? তাও নয়। আসলে ব্যাপারটা এত সোজা সাপটা হলে কোনও সমস্যাই থাকত না। এই বই পড়লে দেখবেন ন্যারেটিভ স্তরে একটা বিপুল টানাটানি আছে। ইংকা সভ্যাতার উন্নত দিকটা অস্বীকার করা যাচ্ছে না আবার তাদের নিষ্ঠুর প্রথার কথা ভেবে সভ্য ভাবতে বাধছে! ১৯৪৪এ দাঁড়িয়ে স্বাধীনতাকামী বাঙালি লেখক রোমান ক্যাথলিকদের ইন্‌কুইজিশন্‌-কে সমালোচনা করছেন, একইসঙ্গে ইংরেজ জমানায় সিডিশনের দায়েও পড়তে চাইছেন না। তার ওপর আবার,ভিন্নতাকে কদর দেওয়ার প্রশিক্ষণও তাঁর নেই। ফলে বইটা টেনশনে ভরা। এই টেনশনটাই ঔপনিবেশিক কালে আমাদের মধ্যবিত্ত মনের গহীনে চারিয়ে গিয়েছিল। আজও বোধহয় আমরা সেটা কাটিয়ে উঠিনি। কিন্তু, সেটা আলোচনার জায়গা বইঘর নয়। যাই হোক, এই টেনশনের দায়ে এই বই ভুলে যায় যে ইংকা বা ইন্‌কা একটা জাতির নাম! কয়েক পাতা আগে যাদের সভ্যতার কথা বলা হচ্ছিল, শেষের দিকে দেখা যায় সেই ইন্‌কা বলতে রাজা বোঝানো হচ্ছে! রাজা বলব, না ‘অসভ্য জাত’-এর সর্দার বলব? মৃণুর গানের অবজ্ঞার ধরণে তাই মনে হয় যে!


ইন্‌কা যদি করত আমায় ইন্‌কী রে!

চক্ষে তবে জ্বলত আমার

অগ্নিরাগের ফিন্‌কি রে!

এক চড়ে তার ঘুরত মাথা,

কুঁচকে যেত বুকের ছাতা,

ভাবত বোকা- ‘এমনি ভাবেই

কাট্‌বে আমার দিন কি রে,-

এ যে বিষম ইন্‌কী রে!’



শেষ পর্যন্ত অটুটই থাকে ঔপনিবেশিক বয়ান। আর,ঠিক এখানটাতেই সূর্য কাঁদলে সোনা আলাদা হয়ে যায়। পঁচিশ বছরের মধ্যে বদলে গেছে বাঙালি কিশোর সাহিত্যিকের চিন্তাবিশ্ব। হীরোর মডেল একই আছে। শস্ত্র-শাস্ত্র নিপুণ, রূপে-গুণে অদ্বিতীয়। কিন্তু, পালটে গেছে দেখার ধরণ। একটা উদাহরণই যথেষ্ট হবে। যে ইন্‌কা নিয়ে মৃণুর গান, তাঁর সম্ব্বন্ধেই বলছে কথককন্ঠ-

এই নতুন মহাদেশে এ পর্যন্ত এস্‌পানিওলরা অনেক কিছু দেখেছে, বড় ছোট অনেক মানুষের সংশ্রবে এসেছে। তুষার ঢাকা অভ্রভেদী পাহাড়ের বুকে ‘সূর্য কাঁদলে সোনা’র দেশ যত রহস্যময়ই হোক সত্য-মিথ্যা নানা বর্ণনা শুনে তার রাজ্যেশ্বর ইংকা আতাহুয়াল্পা সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা তাই পিজারো আর তাঁর দলবলের মনে গড়ে উঠেছিল।

আতাহুয়াল্পার চাক্ষুষ যে রূপ দেখা গেছে তার সঙ্গে সে ধারণার একেবারে মিল নেই।

আতাহুয়াল্পার মতো এরকম সত্যিকারের সম্রাটোচিত চেহারাই এর আগে এদেশে কোথাও পিজারো বা তার সঙ্গীদের কারুর চোখে পড়ে নি।

দে সাটো আর হার্নাণ্ডো পিজারোর এই ইংকা নরেশের সামনে আপনা থেকেই নিজেদের কেমন ছোট মনে হয়েছে।


দু’টো আলাদা জীবন ধারার সংঘাতের কাহিনী লিখছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর সব শর্ত মেনেই। তাঁর গল্প বরং হেমেন্দ্রকুমারের থেকে বেশ একটু জটিল। মারপ্যাঁচ অনেক বেশি। থ্রিল আছে, সাসপেন্স আছে, নায়ক-নায়িকা আছে, খলনায়ক-খলনায়িকাও আছে। কিন্তু, সব চেয়ে বেশি করে আছে ভিন্ন সংস্কৃতিকে সম্মান দেওয়া। নিরপেক্ষ মূল্যায়নের চেষ্টা। এর জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন লেখক, বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে তা অন্তত আমার চোখে আগে পড়েনি। নায়ক ঘনরাম স্পেন আর পেরু দু’জায়গাতেই বহিরাগত। যতই বিদেশে বড় হোন না কেন, তাঁর মনে পড়ে আছে জন্মভূমিতে। তাই, তাঁর পক্ষেই সম্ভব কোনও পক্ষই না নেওয়া। তিনি কতগুলো আদর্শের পক্ষে। অজানাকে জানা, জ্ঞানের বিস্তার ঘটানো, মানুষে মানুষে মিতালি। মানে, যেটা আগের নায়করা চেষ্টা করেও পারেননি, ঘনরাম অবলীলায় সেটা পেরেছেন। তার ওপর ক্রীতদাসের জীবন কাটানোর ফলে নিপীড়িতের যন্ত্রনা তিনি একেবারে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানেন। তাই তিনি এক সুপার-কমন্‌-ম্যান্‌। তাঁর বাসভূমি সত্যিই মানুষের দুনিয়া । এরকম নায়ক সৃষ্টি দেশ স্বাধীন না হলে হতো কি না, সে তর্কে ঢুকছি না। শুধু ভাবছি, প্রেমেন্দ্রও তো পরাধীন ভারতে জন্মেছিলেন, ঔপনিবেশিক শিক্ষাতেই শিক্ষিত হয়েছিলেন, ভদ্রলোক সম্প্রদায়ভুক্তও ছিলেন, তাহলে এই খোল নলচে বদলানোর কাজটা তিনি করলেন কীভাবে? জবাব বোধহয় আছে। প্রেমেন্দ্রের সামনেও একটা মডেল ছিল। খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ভোম্বল সর্দার । বাংলা ছোটদের লেখার জগতে প্রথম আউটসাইডার। ‘অতিথি’র তারাপদর কথা তুলবেন না। প্রথমত, ওটা ছোটদের কথা ভেবে লেখা নয়; দ্বিতীয়ত, তারাপদ একটা মেটাফর। ভোম্বল তারাপদর মতো মূর্তিমান সারল্য নয়। সে জেদি, গোঁয়ার,অবাধ্য। তার চোখে ধরা পড়ে গ্রামের দারিদ্র্য, পীড়ন, অপুষ্টি। তার চলা আর দেখে চলা প্রসঙ্গে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘ভোম্বলের ওই নিষ্পলক দৃষ্টি যেন বলছে, জন্মলগ্ন থেকে বাঙালি ভদ্রলোক সম্প্রদায় কর্মসূচির যে খসড়া লিখে চলেছে তা এবার আগাপাশতলা পালটানো দরকার’ (গোপাল রাখাল দ্বন্দ্ব সমাস – উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য; পৃ:২৯৬)।

আমি একবারও বলছি না যে প্রেমেন্দ্র খগেন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত। সেটা সম্ভবও নয়। কারণ, ভোম্বল সর্দার –এর প্রথম খণ্ড ১৯৩৬এ বেরোলেও, দ্বিতীয় আর তৃতীয় খণ্ড বেরোয় যথাক্রমে ১৯৫৫ ও ১৯৭৫ এ। সূর্য কাঁদলে সোনা-র প্রথম প্রকাশ ২৫শে বৈশাখ, ১৩৭৬। আমি বলতে চাইছি, চালু বয়ানের প্রতি-বয়ান থাকবেই। একই সামাজিক পরিবেশ থেকে বিরোধী স্বর জন্ম নিতে বাধ্য। তাই, হেমেন্দ্র যে স্বরের প্রতিনিধি তার উলটো স্বরের প্রতিনিধিত্ব করেন খগেন্দ্র-প্রেমেন্দ্র।

সূর্যনগরীর গুপ্তধন আর সূর্য কাঁদলে সোনা বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের দু’টো ভিন্ন ধারার প্রতিভূ। নামেই তার প্রমাণ। হেমেন্দ্র জোর দিয়েছেন অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্যের চিরাচরিত গুপ্তধন মোটিফের ওপর। এর সঙ্গে মিশে থাকে একটা জিতে নেওয়ার গন্ধ। ভিন্ন সংস্কৃতি ইত্যাদি এখানে গৌণ। প্রেমেন্দ্র ভাবছেন পেরুর লোককথা নিয়ে। সোনাকে যে বলে সূর্যের চোখের জল। নামই বলছে ‘অপর’-এর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার কথা। বলছে এস্‌পানিওলদের ইস্পাতের তলোয়ারের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত পেরুবাসীর চোখের জলের প্রতি তাঁর মমত্বের কথা। 

এক পটভূমি। দু’টো বই। বিশ্বপ্রেক্ষার দুই ভিন্ন মেরু।

3 comments:

0

বইঘর - গ্রন্থকীট

Posted in








বইঘর


বইয়ের খবর
গ্রন্থকীট





বইয়ের নাম : ধূসর যাপন
লেখক : সোমঙ্কর লাহিড়ী
প্রকাশক : ঋতবাক
বিনিময় মূল্য : ২০০ টাকা

বুলেটের শিস। রক্তের গন্ধ। বোমার আগুন। খুন। ষড়যন্ত্র। এক ভিন্ন যাপন কথা। এক বাস্তব যা চোখের আড়ালে থাকে। সাদা নয়। কালো নয়। জীবনের রঙই তার রঙ। এ যাপন ধূসর যাপন।

রহস্য-রোমহর্ষ। লোভ। কাম। নানা বাঁক ও মোচড়। রতন-বিল্লা-রাম ঠাকুর-আলিবাবা-জীবন সাহা-চায়না-মায়া। এদের যাপন। ধূসর যাপন। থ্রিলার। হুডানিট নয়। ক্রাইম ডাজ্‌ নট্‌ পে কি না, তা নিয়ে লেখক খুব একটা ভাবিত নন। এ বইয়ের ছত্রে ছত্রে শিহরণ। এককথায় আনপুটডাউনেবল্‌।



বইয়ের নাম : ঠিক বারোটা
লেখক : কর্ণ শীল
প্রকাশক : ঋতবাক
বিনিময় মূল্য : ১৭৫ টাকা

অন্য রাস্তায় যেতে কিসের ভয়?... সাজুর খিদে মেটে কিসে?... মাছ শিকার করতে গিয়ে গা হিম কার?... কার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকে মানুষের রক্ত-মাংস? ...

ঠিক বারোটা-র হাড় হিম করা কথাবিশ্বে উত্তর মিলবে। এক ডজন গল্পের সংকলন এ বই শুধু একটা বই নয়। এ হলো জমাট বাঁধা আতঙ্ক। রাতের বেলা এই বই পড়া মানা।

ভয় বা আতঙ্ক এই দুটো শব্দকেই হরর কথাটা দিয়ে বোঝানো যায়। ল্যটিন horreere থেকেএসেছে এই ইংরিজি শব্দ। এর অর্থ হলো মাথার চুল খাড়া করিয়ে দেওয়া আর কাঁপুনি ধরানো। তার মানে, যে ধরণের গল্প পড়লে ভয়ে কাঁটা হয়ে, আমরা কাঁপতে থাকব, তাই হলো সার্থক ভয়ের গল্প। ঠিক বারোটা সব রকম অর্থে ভয়ের গল্পের সংকলন।






বইয়ের নাম : আম্মা এবং...
লেখক : রাজা ভট্টাচার্য
প্রকাশক : ঋতবাক
বিনিময় মূল্য : ২০০ টাকা

আম্মা এক বাস্তব চরিত্র। আম্মা এক প্রতীক। নিষ্কলুষ শৈশবের প্রতীক। যার চোখে বড়দের জগতের অসঙ্গতিগুলো সব ধরা পড়ে। আম্মা চিরকেলে মা। আম্মা চিরশিশু। বাস্তব জগতের আম্মা বড় হয়ে গেলেও লেখার দুনিয়ায় তার বয়স বাড়ে না। তাই, তার দিব্যদৃষ্টিও অটুট থাকে। আম্মা এবং –এ আম্মা একা নয়। তার বন্ধু বান্ধবরাও হাজির। তারা আমাদের দম চাপা পৃথিবীতে এক ঝলক তাজা বাতাস আনে। এই বই লেখকের কলম শুদ্ধ করার প্রক্রিয়ার নাম। এই বই পড়া মানে গঙ্গা স্নান।





বইয়ের নাম: চিতে ডাকাত ও অন্যান্য
লেখক : সরিৎ চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশক : ঋতবাক 
বিনিময়মূল্য : ২০০ টাকা

দুটো অণু উপন্যাস, চোদ্দটা গল্প আর চোদ্দটা অণুগল্প। নানা রঙ, নানা গন্ধ, নানা স্বাদ। সব মিলে একটা নাম – জ্যান্ত জীবন। বাস্তব যাপন। ভাষার মায়াতুলিতে বাস্তবকে মায়ায় ভরে এই বই। মায়া মানে মমত্ব, মায়া মানে জাদু। বাস্তব উপাদান, লেখকের সমানুভূতি আর ভাষার সুদক্ষ প্রয়োগ – তিনে মিলে চিতে ডাকাত ও অন্যান্য এক সৃষ্টির নাম। মানুষের সম্পর্কের জটিলতা, জীবন-রাজনীতি-ইতিহাসের কথোপকথন আর লেখকের অভিজ্ঞতার প্রসার থেকে উঠে আসা বাস্তববোধ এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে বইটিকে।

0 comments:

0

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


প্রাচীন কথা


রাজ আজ্ঞা
অনিন্দিতা মণ্ডল



বড়ই বিপদে পড়েছেন ক্ষত্তা অধিরথ। এমনতরো বিপদ যে আসতে পারে তা তাঁর স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। বেশ সুখেই জীবন কাটছিল। কিন্তু গত রাতে রাজা জানশ্রুতির এক অদ্ভুত দর্শন হয়েছে। ফলে শয্যাত্যাগের পরপরই এই বিপত্তি। ডেকে পাঠিয়েছেন ক্ষত্তা অধিরথকে।

রাজা জানশ্রুতি পৌত্রায়ন। এমন শ্রদ্ধাশীল, দানশীল নৃপতি ভূভারতে নেই। তাঁর রাজত্বে একটি মানুষও অভুক্ত থাকেনা। রাজপথ জুড়ে পান্থশালা, অন্নসত্র। সেখানে তাঁর নির্দেশে এমনভাবে অন্নপাক হয় যে প্রতিটি মানুষ ক্ষুধার অন্ন পায়, অথচ একটি কণাও অপচয় হয়না। একে প্রজারা দৈবকৃপা বলে। জানশ্রুতির এই মহৎ কাজটির কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি অসাধারণ খ্যাতিমান। সারা দিনমান রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি গমন করেন। নিজে অন্বেষণ করেন কেউ অভুক্ত আছে কিনা। তাঁর এই যাত্রায় সঙ্গী থাকেন ক্ষত্তা অধিরথ। এমন একটি মহান কাজে যুক্ত থাকার ফলে সারথির মনেও অপার শান্তি। সারাদিন রাজার সঙ্গে থাকার পরও রাজ প্রাসাদের একটি নিভৃত কক্ষে তিনি নিশিযাপন করেন। কখন না জানি রাজার সারথির প্রয়োজন পড়ে। বিশেষ কারণে ছাড়া অবশ্য রাজা তাঁকে রাত্রিতে ডেকে তোলেন না। আজ কিন্তু বিশেষ কারণেই রাজা তাঁকে নিশি পোহাতেই ডেকে পাঠিয়েছেন। 

রাজার কাছে গিয়ে অভিবাদন করে দাঁড়ালেন তিনি। জানশ্রুতি একটু যেন বিমর্ষ, চিন্তান্বিত। যে পুণ্যকর্মের বিভায় তাঁর মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে থাকে, তা যেন কিছুটা মলিন। ক্ষত্তা অবাক হলেন। এমন কেন? রাজা জানশ্রুতির ন্যায় এমন শ্রদ্ধাশীল দানী জগতে বিরল। তাঁর অর্জিত পুণ্য অক্ষয়। তবে কেন এই চিন্তাক্লিষ্ট বদন? সাধারণত ক্ষত্তার সঙ্গে রাজা একান্তে অনেকটা সময় অতিবাহিত করেন। ফলে রাজা-ভৃত্য সম্পর্ক ছাপিয়ে একধরণের সখ্য গড়ে উঠেছে দুজনের মধ্যে। তাই রাজা কোনও রাজকর্মচারীর সঙ্গে পরামর্শ না করে ডেকেছেন অধিরথকে। শূদ্রাণী গর্ভজাত এক ক্ষত্রিয়সন্তান অধিরথ। তাঁকে রাজা নিজের ছায়ার মতন বিশ্বাস করেন। অধিরথ জিজ্ঞাসু চোখে চাইলেন রাজার পানে। তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় রাজা যা বলবার নিজেই বলবেন। একটু সময় নিচ্ছেন মাত্র। 

জানশ্রুতি বলতে শুরু করলেন। যদিও কথার মাঝে তাঁর অস্থিরতা ও মানসিক ক্লেশ প্রকাশ পাচ্ছিল। অধিরথ ব্যথিত হচ্ছিলেন। কি সেই কথা? গতকাল সারাদিন প্রখর গ্রীষ্মের দাবদাহ উপেক্ষা করে রাজা তাঁর রাজত্বের প্রত্যন্ত প্রদেশে গমন করেছিলেন। নতুন একটি পান্থশালা নির্মিত হয়েছে। স্বহস্তে অন্নপাক করে সেটির উদ্বোধন করে এসেছেন। এই উত্তাপ, যাত্রার ধকল, ও অন্নপাক তাঁকে ক্লান্ত করেছিল। তাই সন্ধ্যার পর জানশ্রুতি প্রাসাদ সংলগ্ন উদ্যানে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। শীতল হাওয়ায় শরীর জুড়োবে। এই সময় আকাশে দুটি হাঁস উড়ে যাচ্ছিল। জানশ্রুতি বুঝতে পারলেন যে হাঁস দুটি দুই ঋষি। আকাশপথে যাত্রা করছেন। দুজনের মধ্যে যিনি পশ্চাদবর্তী তিনি প্রথমজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন – ওহে সাবধান। তুমি এখন রাজা জানশ্রুতির রাজ্যসীমায় পৌঁছেছ। তাঁর এমন দিব্য তেজ যে চেয়ে দ্যাখো, নিশার আকাশও যেন দিনের মতো উজ্জ্বল। সতর্কতা অবলম্বন না করলে ওই তেজে আমরা জ্বলে যেতে পারি। কিন্তু প্রথমজন এই সাবধান বাণী সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলেন। হেসে বললেন – কি এমন তেজ রাজা জানশ্রুতির? তা কি শকটবাহী রৈক্কের চেয়েও বেশি? দ্বিতীয় জন বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন – রৈক্ক কে? প্রথম ঋষি জানালেন পরিচয়, -রৈক্ক পূণ্যবাণ। তাঁর পূণ্যফলে জগতের সমস্ত ব্যক্তির ব্যক্তিগত পূণ্যার্জন যোগ হয়ে যায়। ঠিক যেমন ‘কৃত’ পাশার খেলা। উক্ত ক্রীড়াটিতে যিনি জয়লাভ করেন তাঁর জিতসংখ্যার সঙ্গে অন্যান্য সকলের দানের সংখ্যা যুক্ত হয়ে যায়। বিজিত ব্যক্তির দেওয়া দানের কোনও মূল্য থাকেনা। রাজা জানশ্রুতি সম্পূর্ণ কথোপকথন শুনলেন। অবিলম্বে তাঁর মানসিক স্থৈর্য অন্তর্হিত হলো। তাহলে এতদিন ধরে তাঁর এত কাজ সব বৃথা? তাঁর অর্জিত কর্মের ফল রৈক্কের কর্মফলে যুক্ত হয়েছে? তাঁর সঞ্চয় শূন্য? জীবন যেন এক লহমায় মুল্যহীন হয়ে গেলো। জীবনের লক্ষ্য তাঁর কাছে স্থির ছিল। সেই একমুখী লক্ষ্যে অবিচল থেকে তিনি পরমার্থ লাভে ব্রতী হয়েছিলেন। কিন্তু আজ যেন সেই স্বর্গ থেকে পতন হলো তাঁর। দিবসের দাবদাহ থেকে নিশীথের শীতলতা বেশি অস্বস্তিকর হয়ে উঠল। সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারলেন না। অবশেষে প্রত্যূষে ডেকে পাঠালেন ক্ষত্তাকে। সন্ধান চাই রৈক্কের। কে এই মহামহিম? এতকাল কেন তাঁকে জানা যায়নি? তাঁর রাজ্যসীমার মধ্যে তিনি বাস করেন অথচ রাজা জানেন না? কিন্তু অনুসন্ধান গোপন রাখতে হবে। 

নগরের প্রতিটি স্থান তন্নতন্ন করে খুঁজেও রৈক্ককে পেলেননা অধিরথ। কে এই মহাপুরুষ? বিফলমনোরথ হয়ে ফিরে গেলেন রাজপুরীতে। নতবদনে জানালেন ব্যর্থ হয়েছে অনুসন্ধান। পাওয়া যায়নি তাঁকে। আর ঠিক তখনই রাজার মনে খেলে গেলো চকিত বিদ্যুতের মতো একটি সূত্র। রৈক্ক ব্রহ্মজ্ঞ! রৈক্ক সর্বজ্ঞ! তাই তাঁর পূণ্যার্জন কোনও সীমিত সংখ্যায় নয়! তিনি অমিত পুণ্যের অধিকারী! অনন্তপুণ্য তিনি! নব উন্মেষে উদ্দেপ্ত রাজা আজ্ঞা দিলেন – ক্ষত্তা, কোনও নগরে তাঁর অনুসন্ধান কোরোনা। জনবিরল যে স্থানে কোনও ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ বাস করেন সেরকম স্থানে খুঁজে এসো। নিশ্চয় পাবে। অধিরথ ক্লান্ত। মনে মনে সব আশা ছেড়েছেন। তবু রাজার আদেশ। সখাও বটে। তাঁকে স্বস্তি দিতে না পারলে তিনি নিজেও স্বস্তি পাননা। আরও একবার সন্ধানে গেলেন তিনি। সোজা রথ ছুটিয়ে দিলেন নগরের সীমানা ছাড়িয়ে। প্রবেশ করলেন অরণ্যে। আর সেখানেই দেখতে পেলেন একটি ক্ষুদ্র শকট। সেই শকটের নীচে বসে আছে এক ব্যক্তি। সর্বাঙ্গে তার খোস। সে মুখভঙ্গি করে পরম আরামে চুলকে চলেছে সেই খোস পাঁচরা। ভীষণ ঘৃণায় মুখ কুঞ্চিত করে অধিরথ চলে যেতে চাইলেন। এ রৈক্ক হতে পারেনা। তবু একবার কর্তব্য স্মরণ করে জিজ্ঞাসা করলেন – আপনিই কি মহামতি রৈক্ক? খোস চুলকোনো অব্যাহত রেখে পুরুষ উত্তর দিলেন – হ্যাঁ আমিই রৈক্ক। কালক্ষেপ না করে অধিরথ ফিরে এলেন রাজার কাছে। জানালেন – অত্যন্ত ঘৃণ্য দৈহিক অবস্থায় একটি ক্ষুদ্র শকটের নীচে বিশ্রামরত এক ব্যক্তিকে দেখেছি। তিনি নিজের গায়ের দুষিত ক্ষত ক্রমাগত নখ দিয়ে চুলকে চলেছেন। এত দুষিত এত পূতিগন্ধময় দেহ, এমন একজনকে মহামতি রৈক্ক ভাবতে আমার প্রবল অনীহা জন্মাচ্ছে রাজন। রাজার মুখ কিন্তু উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চোখের তারায় এক অপার্থিব আলো। ক্ষত্তা বোঝেননি যে মহামতি তাঁর স্বরূপ গোপন করেছেন। যোগ্য পাত্রের কাছেই নিজেকে উন্মোচন করবেন। কিন্তু এখন ক্ষত্তাকে সেকথা বোঝাবার অবকাশ নেই। মুহূর্ত চলে যাবে। মহাকাল জানশ্রুতির জন্য আচার্য চিহ্নিত করে দিয়েছেন। সম্বর্গ বিদ্যার আচার্য। যে বিদ্যা অধীত হলে জানশ্রুতির কর্মের পূণ্যফল আর সীমিত থাকবেনা। কারণ অনন্ত অক্ষয় সেই পূণ্য কোনও কর্মার্জিত হবেনা। হবে এক অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের উন্মেষে। 

তখনই অধিরথের রথ ছুটল অরণ্য অভিমুখে।

0 comments: